অষ্টম পরিচ্ছেদ
তখন ভোরের আলো সবেমাত্র ফুটে উঠছিল। সারারাত ঘুম হয়নি ফাঁতিনের। শেষরাতের দিকে এক মধুর কল্পনার বশবর্তী হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। এই সুযোগে সিস্টার সিমপ্লিস তার কাছ থেকে ওষুধের শিশি থেকে এক দাগ কুইনাইন আনার জন্য গেল। জানালা দিয়ে আসা ভোরের আলোয় ওষুধের শিশিগুলোকে খুঁটিয়ে দেখছিল সে।
সহসা মুখ ঘুরিয়ে দেখেই বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠল। দেখল মঁসিয়ে ম্যাদলেন নীরবে ঘরে ঢুকছে। সে বলল, মঁসিয়ে লে মেয়র?
ম্যাদলেন নিচু গলায় বলল, সে কেমন আছে?
সিস্টার সিমপ্লিস বলল, এখন কিছুটা ভালো আছে বটে, কিন্তু তার জন্য গতকাল আমরা সব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলাম।
এরপর সে ম্যাদলেনকে বলল, গতকাল ফাঁতিনের অবস্থা খুবই খারাপের দিকে যায়। তার পর সে যখন বিশ্বাস করে আপনি তার মেয়েকে আনার জন্য মঁতফারমেলে গেছেন তখন সে হঠাৎ ভালো হয়ে ওঠে। মেয়র কোথায় গিয়েছিল তা জিজ্ঞাসা করতে সাহস পেল না। কিন্তু সে মেয়রের মুখের হাবভাব দেখে বুঝল মেয়র সেখানে যায়নি।
ম্যাদলেন বলল, আমি খুশি। তোমরা তার ভুল না ভেঙে ঠিকই করেছ।
সিস্টার বলল, তা হয়তো ঠিক। কিন্তু আপনি তার মেয়েকে আনেননি, এখন তাকে কী বলব?
ম্যাদলেন দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগল। তার পর বলল, ঈশ্বর আমাকে পথ বলে দেবেন।
তখন দিনের আলো স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। সে আলোয় তার মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। সে মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠল সিস্টার সিমপ্লিস, হা ভগবান! মঁসিয়ে মেয়র, কী হয়েছে আপনার? আপনার মাথার চুল সব সাদা হয়ে গেছে।
সাদা!
তার কোনও আয়না ছিল না। মৃত রোগীরা শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেছে কি না সে বিষয়ে নিশ্চিত হবার জন্য ডাক্তাররা একরকম ছোট আয়না ব্যবহার করত। সেই আয়নাটা নিয়ে ম্যাদলেন নিজের মাথাটা দেখল। সে অন্য কথা ভাবতে ভাবতে আনমনে বলল, তাই তো।
এক অজানিত আশঙ্কায় হিম হয়ে গেল সিস্টারের অন্তরটা।
ম্যাদলেন বলল, আমি একবার তাকে দেখতে পারি?
সিস্টার ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করল, মঁসিয়ে কি তার মেয়েকে আনতে যাচ্ছেন না?
ম্যাদলেন উত্তর করল, হ্যাঁ যাব। কিন্তু দু-তিন দিন দেরি হবে।
সিস্টার বলল, তার মেয়েকে না আনা পর্যন্ত সে আপনাকে দেখতে না পেলে ভাববে আপনি এখনও ফেরেননি সেখান থেকে। তা হলে আমরা তাকে সহজেই শান্ত করতে পারব। তার পর ওর মেয়ে এসে পড়লে ও ভাববে আপনিই তাকে নিয়ে এসেছেন। তা হলে আর আমাদের মিথ্যা কথা বলতে হবে না।
ম্যাদলেন আবার ভাবতে লাগল। তার পর শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলল, না সিস্টার, এখনি তার সঙ্গে দেখা করতে হবে আমায়। হয়তো আমি খুব কম সময় পাব।
সিস্টার হয়তো কথাটার ওপর গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে লাগল। এ কথাটা যেন সমস্ত ব্যাপারটাকে আরও রহস্যময় করে তুলল। সে মুখ নামিয়ে শ্রদ্ধার সঙ্গে বলল, তা হলে সে এখন ঘুমিয়ে থাকলেও ভেতরে যেতে পারেন।
ফাঁতিনের ঘরের দরজাটা খোলা বা বন্ধ করার সময় জোর শব্দ হয়। ম্যাদলেন ঘরের ভেতর ঢুকে গিয়ে তার বিছানার মশারিটা তুলল। সে তখন ঘুমোচ্ছে। কিন্তু তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। মুমূর্ষ সন্তানকে দেখে মা’র যেমন অন্তরটা বিদীর্ণ হয়ে যায় ম্যালেনেরও তাই হচ্ছিল। ফাঁতিনের মুখ ও গালের ম্লান ফ্যাকাশে ভাবটা এক শান্ত শুভ্রতায় পরিণত হয়ে উঠেছিল। তার নিষ্পাপ যৌবন জীবনের একমাত্র অবশিষ্ট সৌন্দর্য টানা টানা চোখ দুটো মুদিত থাকলেও সে চোখের পাতাগুলো অল্প অল্প কাঁপছিল। অদৃশ্য পাখা মেলে ঊর্ধ্বলোকে উড়ে চলার এক অপ্রাকৃত প্রস্তুতি হিসেবে তার গোটা অচেতন দেহটা যেন অশান্ত হয়ে উঠেছিল। এ অবস্থায় কেউ তাকে দেখে ভাবতে পারবে
এক দুরারোগ্য রোগ তার দেহটাকে ভেতরে ভেতরে জীর্ণ করে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে তাকে। তাকে দেখে শুধু এই কথাই মনে হবে যে সে মরছে না, ঊর্ধ্বে উক্রমণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে তার প্রাণের পাখিটা।
যখন আমরা কোনও ফুল তুলতে যাই তখন সে ফুলের বৃন্তটা কেঁপে ওঠে। দেখে মনে হয় একই সঙ্গে আত্মদানে সংকুচিত এবং আগ্রহান্বিত হচ্ছে সে বৃন্ত। তেমনি মৃত্যুর রহস্যময় হাতটা যখন দেহের বৃন্ত থেকে আত্মাটাকে ছিন্ন করে নিতে আসে তখন আমাদের দেহটা কেঁপে কেঁপে উঠতে থাকে এমনি করে।
ফাঁতিনের বিছানার পাশে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ম্যাদলেন। একবার ফাঁতিনের দিকে আর একবার তার মাথার উপর ক্রশটার দিকে তাকাতে লাগল সে। আজ হতে দু মাস আগে প্রথম যেদিন সে তাকে দেখতে আসে সেদিনও সে এমনি করে ক্ৰশটাকে দেখেছিল। সেদিনও এমনি করে ঘুমিয়েছিল ফাঁতিনে। আজ ফাঁতিনের চুলটা ধূসর আর তার চুলটা সাদা হয়ে গেছে একেবারে।
সিস্টার ম্যালেনের সঙ্গে ঘরে ঢোকেনি। ম্যাদলেন তার ঠোঁটে একটা আঙুল দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ঘরে যেন অন্য কোনও লোক আছে এবং তাকে চুপ করতে বলছে। এমন সময় চোখ খুলল ফাঁতিনে। চোখ মেলে তাকাল সে। সে হাসিমুখে শান্তভাবে বলল, কসেত্তে কোথায়?
.
২
বিস্ময় বা আনন্দের আবেগ ছিল না তার কণ্ঠে। সে কোনও অঙ্গভঙ্গি করল না। সে নিজেই ছিল যেন আনন্দের এক প্রতিমূর্তি। এমন এক নিরুদ্বেগ নিশ্চয়তা আর আশ্বাসের সঙ্গে এই প্রশ্নটা উচ্চারিত হল তার কণ্ঠে যে তা শুনে অবাক হয়ে গেল ম্যাদলেন।
ফাঁতিনে বলতে লাগল, আমি জানতাম আপনি এসে গেছেন। আমি ঘুমের মধ্যেও আপনাকে দেখছিলাম, আমি সারারাত ধরে আপনাকে দেখেছি। মনে হচ্ছিল আপনি যেন এক জ্যোতির মূর্তি এবং কত দেবদূত আপনাকে ঘিরে ছিল।
দেয়ালের উপর ঝোলানো ক্রশটার পানে তাকিয়ে রইল ম্যাদলেন।
ফাঁতিনে বলল, কসেত্তে কোথায়? তাকে কেন আমার বিছানায় বসিয়ে দিলেন না? তা। হলে আমি জেগে উঠেই তাকে দেখতে পেতাম।
ম্যাদলেন অস্পষ্ট স্বরে কী বলল তা সে নিজেই বুঝতে পারল না। এমন সময় ডাক্তার এসে ঘরে ঢুকল। তাকে ডাকা হয়েছিল। ম্যালেনের মনে হল ডাক্তার যেন তাকে উদ্ধার করতে এসেছে।
ডাক্তার বলল, তুমি শান্ত হও বাছা। তোমার মেয়ে এসে গেছে।
ফাঁতিনের চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল এবং সেই উজ্জ্বলতা ক্রমে ছড়িয়ে পড়ল তার সারা মুখখানায়। আবেগের সঙ্গে সে তার দুটো হাত দিয়ে কী একটা জড়িয়ে ধরতে যাচ্ছিল।
সে বলল, কেউ তাকে ঘরে নিয়ে আসবে না?
সে ভাবছিল কসেত্তে যেন তখনও কোলের সেই ছোট্ট শিশুটি আছে।
ডাক্তার বলল, এখন নয়। এখনও তোমার গায়ে জ্বর আছে। কোনও রকম উত্তেজনা ক্ষতিকর হবে তোমার পক্ষে। আগে সেরে ওঠ।
ফাঁতিনে বলল, কিন্তু আমি এখন ভালো হয়ে গেছি। আমি ভালো আছি। আপনি এত বোকা হলেন কী করে? আমি আমার মেয়েকে দেখতে চাই।
ডাক্তার বলল, কত তাড়াতাড়ি তুমি উত্তেজিত হয়ে পড়ছ। এ অবস্থায় তাকে আমি আনতে পারি না। তাকে শুধু দেখলেই হবে না। তার জন্যই তোমাকে বাঁচতে হবে। তুমি একটু শান্ত হলেই তাকে নিয়ে আসব আমি নিজে।
মাথাটা নাড়িয়ে ফাঁতিনে বলল, আমাকে মাপ করবেন মঁসিয়ে ডাক্তার, আমি ভালো থাকলে এত কথা বলতাম না। কিন্তু এখন কী বলছি ভুল হয়ে যাচ্ছে; মনে রাখতে পারছি না। অবশ্য আমি বুঝি আপনারা আমাকে উত্তেজিত হতে দিতে চান না। কিন্তু আমি কথা দিচ্ছি, আমার মেয়েকে দেখে আমি উত্তেজিত হব না। আমি তার সঙ্গে খুব আস্তে কথা বলব। আমি সারারাত ধরে তার হাসি-হাসি উজ্জ্বল মুখখানা দেখেছি। এখন আর আমার কোনও রোগ নেই। ঠিক আছে, আমি চুপ করে শান্ত হয়ে থাকব। তা হলে ওরা আমার মেয়েকে নিয়ে আসবে।
ফাঁতিনের বিছানার পাশেই একটা চেয়ারে বসে ছিল ম্যাদলেন। ফাঁতিনে জোর করে নিজেকে সামলে নিয়ে চুপ করে রইল, যাতে ওরা তার মেয়েকে নিয়ে আসে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজেকে সংযত করতে পারল না। একসঙ্গে পরপর অনেকগুলো প্রশ্ন করে বসল ম্যাদলেনকে।
সে বলল, আপনার অসীম দয়া মঁসিয়ে মেয়র। যেতে কোনও কষ্ট হয়নি তো? আমার মেয়ে কেমন আছে? আসতে তার খুব কষ্ট হয়নি তো? সে হয়তো এখন আমাকে চিনতে পারবে না। এখন হয়তো ভুলে গেছে। কতদিন আগে দেখেছে। শিশুরা পাখির মতো ক্ষীণ স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন। তার পোশাক-আশাক ঠিক ছিল তো? থেনার্দিয়েররা তাকে খেতে দিত? তার যত্ন নিত? আমি যখন কপর্দকহীন অবস্থায় দিন কাটাচ্ছিলাম থেনার্দিয়েররা। আমায় দারুণ পীড়ন করতে থাকে টাকার জন্য। যাক, এখন সব কিছু মিটে গেছে। আমি এখন সুখী। মঁসিয়ে মেয়র, কসেত্তে দেখতে সুন্দরী তো? তাকে আপনি একবার আনতে পারেন না? আমার জন্য এইটুকু অন্তত করুন।
ফাঁতিনের একটি হাত টেনে নিয়ে ম্যাদলেন বলল, কসেত্তে সত্যিই সুন্দরী। সে ভালো আছে। তুমি শীঘ্রই দেখতে পাবে তাকে। তুমি কিন্তু খুব বেশি কথা বলছ। তোমার হাত দুটো চাদরের বাইরে বার করলেই কাশি হচ্ছে।
প্রায়ই কাশিতে তার কথাগুলো বাধা পাচ্ছিল। ফাঁতিনে কোনও প্রতিবাদ করল না। বুঝতে পারল তারই ভুল। বেশি কথা বলে ওদের বিশ্বাস হারাচ্ছে। তবু সে শান্তভাবে আবার বলতে লাগল, মঁতফারমেল জায়গাটা খুব সুন্দর, তাই নয় কি? গ্রীষ্মকালে সেখানে অনেক দর্শক যায়। বেনার্দিয়েররা ভালো আছে? জায়গাটার লোকবসতি ঘন নয়। ওদের হোটেলটা খুবই ছোট।
ম্যাদলেন তার হাতটা ধরে ছিল তখনও। ফাঁতিনের দিকে তাকিয়ে ছিল সে একদৃষ্টিতে। একটা কথা বলার ছিল তাকে। কিন্তু বলতে গিয়েও বলতে পারছিল না। ডাক্তার চলে গেছে, শুধু সিস্টার সিমপ্লিস ঘরে ছিল তখনও।
হঠাৎ নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে চিৎকার করে উঠল ফাঁতিনে, আমি তার কথা শুনতে পাচ্ছি। তার কথা শুনতে পাচ্ছি।
হাসপাতালের উঠোনে একটি বাচ্চা মেয়ে খেলা করছিল। হাসপাতালের কোনও মেয়ে কর্মীর সন্তান। মেয়েটি ছোটাছুটি করছিল। নাটকে কল্পিত দুটি সাজানো দৃশ্যের মতো অনেক সময় বিচ্ছিন্ন ঘটনা পরস্পরের কাছে কেমন অদ্ভুতভাবে মিলে যায়।
ফাঁতিনে বলল, আমি বেশ বুঝতে পারছি, এ কসেক্তের কণ্ঠস্বর।
মেয়েটি ছুটতে ছুটতে সেদিকে একবার এসে আবার চলে গেল। তার কণ্ঠস্বরটা ক্রমে মিলিয়ে গেল দূরে। যতদূর পারল সে কণ্ঠস্বর শুনতে লাগল ফাঁতিনে। কণ্ঠস্বর আর শুনতে না পাওয়ার ফলে তার মুখটা কালো হয়ে উঠল। সে বলল, ডাক্তারটা কী নিষ্ঠুর! একবার মেয়েটাকে দেখতে দিল না আমায়। ওর মুখটা দেখলেই নিষ্ঠুর মনে হয়।
কিন্তু অন্য এক বড় আশায় উদ্দীপিত হয়ে সে বালিশে মাথাটা এলিয়ে দিয়ে নিজের মনে কথা বলে যেতে লাগল। আমরা সত্যিই খুব সুখী হব। আমাদের একটা ছোটখাটো বাগান থাকবে। মঁসিয়ে ম্যাদলেন কথা দিয়েছেন, সেখানে কসেত্তে খেলা করে বেড়াবে। এতদিনে তার হয়তো অক্ষর পরিচয় হয়ে গেছে। আমি তাকে এবার থেকে বানান শেখাব। সে যখন ঘাসের উপর দিয়ে প্রজাপতি ধরে বেড়াবে আমি তখন তার পানে তাকিয়ে থাকব। এখন তার বয়স সাত। বারো বছর বয়সে তার প্রথম কমিউনিয়ন হবে। তার মাথায় থাকবে সাদা ঘোমটা।….ও সিস্টার, আমি কত স্বার্থপর! আমি আমার মেয়ের কমিউনিয়নের কথা ভাবছি।
এই বলে হাসতে লাগল সে।
ম্যাদলেন এবার ফাঁতিনের হাতটা ছেড়ে দিল। অতল চিন্তার গভীরে ডুব দিয়ে ফাঁতিনের কথা শুনতে শুনতে তার মনে হচ্ছিল সে যেন কোনও বৃক্ষশাখায় প্রবাহিত বনমর্মরের ধ্বনি শুনছে।
কিন্তু কথা বলতে বলতে সহসা থেমে গেল ফাঁতিনে। সে থেমে যেতেই তার পানে তাকাল ম্যাদলেন। ফাঁতিনের চোখমুখ কেমন যেন ভয়াবহ হয়ে উঠল। সে কনুই-এর উপর ভর দিয়ে বসে ফ্যাকাশে মুখে ভয়ে চোখদুটো বিস্ফারিত করে ঘরের প্রান্তে তাকিয়ে কী দেখছিল।
ম্যাদলেন ব্যস্ত হয়ে বলে উঠল, কী হল ফাঁতিনে? কী ব্যাপার?
ফাঁতিনে কোনও কথা বলল না। ম্যালেনের হাতটা ধরে দরজার কাছে কী দেখাল।
মুখ ঘুরিয়ে ম্যাদলেন দেখল জেভার্ত দাঁড়িয়ে।
.
৩
সত্যিই তাই।
সেদিন রাতে সাড়ে বারোটা বাজতেই ম্যাদলেন অ্যারাসের কোর্ট ছেড়ে হোটেলে চলে গেল। কারণ মন্ত্রিউলগামী ডাকগাড়িতে একটা সিট সংরক্ষণ করে রেখেছিল। সেই গাড়িতেই সে ফিরে যাবে। মন্ত্রিউল-সুর-মেরে পৌঁছেই সে প্রথমে লাফিত্তেকে লেখা চিঠিটা পাঠিয়ে দেবে। তার পর সে হাসপাতালে ফাঁতিনেকে দেখতে যাবে।
এদিকে ম্যাদলেন কোর্ট-ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে সরকারপক্ষের উকিল উঠে দাঁড়িয়ে মন্ত্রিউল-সুর-মের-এর মেয়রের এই হঠকারিতার সমালোচনা করে বলল, উনি হঠাৎ কী করে ধরে নিলেন শ্যাম্পম্যাথিউ’র জায়গায় উনিই কারাদণ্ড ভোগ করবেন এবং তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। তবে অবশ্য উনিই যে জাঁ ভলজাঁ সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তবে আরও অনেক কিছু প্রমাণ করার আছে।
কিন্তু বিচারপতি ও জুরিরা একমত হতে পারলেন না সরকারপক্ষের উকিলের সঙ্গে।
আসামিপক্ষের উকিল বলল, মঁসিয়ে ম্যাদলেন যে প্রমাণ দিয়ে গেছেন তাতে শ্যাম্পম্যাথিউ-এর বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ খণ্ডিত হয়ে গেছে। সুতরাং তাকে মুক্তি না দেওয়ার কোনও কারণ থাকতে পারে না। বিচারপতি তার কথা সমর্থন করলেন। ফলে কয়েক মিনিটের মধ্যেই মুক্তি পেল শ্যাম্পম্যাথিউ। যদি সে জাঁ ভলজাঁ না হয় তা হলে কে সেই ভলজাঁ? তা হলে ম্যাদলেনই হবে সেই জাঁ ভলজাঁ।
কোর্টের কাজ সেদিনকার মতো বন্ধ করে বিচারপতি তার খাস কামরায় সরকারপক্ষের উকিলকে নিয়ে আলোচনা করতে লাগলেন। মন্ত্রিউলের মেয়রকে। অবিলম্বে গ্রেপ্তার করার ব্যাপারে তারা দু জনেই একমত হলেন। বিচারপতি নিজের হাতে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা লিখলেন। আইন তার নিজের পথে চলবে। বিচারপতি একজন বুদ্ধিমান, যুক্তিপ্রবণ ও সহৃদয় ব্যক্তি হলেও আইন ও ন্যায়বিচারের দিক থেকে তিনি ছিলেন কঠোর প্রকৃতির এবং আপোষহীন রাজতন্ত্রী। মেয়র ম্যাদলেন যখন ম্রাটের চেলস-এ অবতরণের কথা বলার সময় বোনাপার্ট না বলে সম্রাট বলে তখন তিনি তা শুনে ব্যথিত হন।
তিনি সঙ্গে সঙ্গে ম্যাদলেনকে গ্রেপ্তার করার জন্য এক পরোয়ানা লিখে এক বিশেষ। দূতকে সে পরোয়ানা দিয়ে মন্ত্রিউলে পাঠিয়ে দেন, যাতে ইন্সপেক্টর জেতার্ত ম্যাদলেনকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করতে পারে।
জেভার্ত অ্যারাসে সাক্ষ্য দিয়েই মন্ত্রিউলে চলে আসে। সে সকালে ঘুম থেকে উঠেই। পরোয়ানা পায়। দূত ছিল একজন অভিজ্ঞ পুলিশ অফিসার। সে অ্যারাসের কোর্টে যা যা গতকাল সন্ধ্যায় ঘটে তা জেভাৰ্তকে বলে। জেভার্তের প্রতি বিচারপতির নির্দেশ ছিল, মন্ত্রিউলের মেয়র ম্যাদলেনকে জেল-ফেরত কয়েদি জাঁ ভলজাঁ হিসেবে শনাক্ত করা হয়। জেভার্ত যেন তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ হেফাজতে রাখে।
জেতার্তকে যারা ভালো করে চেনে না তারা সে যখন হাসপাতালে ম্যাদলেনের খোঁজে যায় তখন তার মনের মধ্যে কী ধরনের চিন্তা বা অনুভূতির খেলা চলছিল তা ঠিক বুঝতে পারবে না। তার বাইরের ভাবটা ছিল শান্ত ও আত্মস্থ এবং তার ধূসর চুলগুলো ছিল ভালোভাবে আঁচড়ানো। যারা তাকে চিনত তারা তখন তাকে ভালোভাবে খুঁটিয়ে দেখলে আশ্চর্য হয়ে যেত।
জেভার্ত ছিল শৃঙ্খলাপরায়ণ লোক। তার চেহারা ও পোশাক-আশাক সব সময় গুছানো থাকত। তার কোর্টের বোতাম সব সময় দেওয়া থাকত। কখনও যদি তার সরকারি পোশাকের কিছুটা অগোছালো থাকত তা হলে বুঝতে হবে তার মনের ভেতর কোনও কারণে ঝড় বইছে।
জেভার্ত হাসপাতালে ম্যাদলেনকে গ্রেপ্তার করতে যাবার সময় চার-পাঁচজন পুলিশ সঙ্গে নিয়ে যায়। তাদের হাসপাতালের উঠোনে রেখে সে সোজা ফাঁতিনের ঘরে চলে যায়। সে মেয়রের কাছে যেতে চাইলে দারোয়ান তাকে নিয়ে যায় বিনা বাধায়। জেভাৰ্ত ফাঁতিনের ঘরে ঢুকে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে দরজার কাছে।
জেভার্তের টুপিটা তার মাথার উপরেই ছিল। তার বাঁ হাতটা ছিল তার কোটের বোতামের উপর। তার বগলের মধ্যে ছিল ধাতব হাতলওয়ালা ছড়িটা। তাকে প্রথমে কেউ দেখতে পায়নি। তার ওপর প্রথমে ফঁতিনের চোখ পড়তেই সে চিৎকার করে ওঠে ভয়ে।
ম্যাদলেন তার দিকে তাকাতেই জেভার্তের চেহারাটা ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। তার আনন্দের চাপা আবেগটা ভয়ঙ্কর হয়ে ফুটে ওঠে মুখের ওপর। তার মুখটা এমন এক শয়তানের মতো হয়ে ওঠে যেন তার হারানো শিকার খুঁজে পেয়েছে হঠাৎ।
সে যে অবশেষে জাঁ ভলজাঁকে হাতের মুঠোর মধ্যে পেয়ে গেছে এই চিন্তার সুতো ধরে তার আন্দোলিত আত্মাটা গম্ভীর হয়ে চোখ-মুখের উপরে উঠে এল। মাঝখানে সে সন্ধানের সুতোটা হারিয়ে ফেলে শ্যাম্পম্যাথিউ নামে লোকটাকে ভলজাঁ বলে ধরে নেওয়ায় যে অপমানের কবলে পড়েছিল, সে অপমান-জয়ের গর্বে ও আনন্দের আবেগের স্রোতে কোথায় ভেসে গেল। সে বুঝতে পারল তার চোখ কখনও ভুল করে না। এক কুৎসিত জয়ের আত্মম্ভরী আনন্দ আর গভীর পরিতৃপ্তি যেন তার উদ্ধত চেহারাটার ওপর ঢেউ খেলে যাচ্ছিল।
জেতার্ত তখন যেন স্বর্গসুখ অনুভব করছিল তার মনে। সে তার গুরুত্ব খুব বেশি করে অনুভব করছিল। সেই মুহূর্তে তার মনে হচ্ছিল সে যেন ন্যায়বিচার, আলো আর সত্যের মূর্ত ও জীবন্ত প্রতীক হয়ে উঠেছে। সে মূর্তি যত সব অশুভ অন্ধকার শক্তিকে পদদলিত করার মহান কার্যে নিরত। সে যেন বাস্তব জগতে নেই, এক মহাশূন্যে ভাসছে আর তার চারদিকে আইনের অবিসম্বাদিত কর্তৃত্ব, বিচারে অমোঘ রায়, জনগণের ধিক্কার নৈশ আকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্ররাজির মতো কিরণ দিচ্ছে। সে যেন তখন আইন-শৃঙ্খলার অভিভাবক, ন্যায়বিচারের বিদ্যুলোক, সমাজের প্রতিশোধ এবং সার্বভৌম রাষ্ট্রশক্তির প্রতিনিধি রূপে এক অনাস্বাদিতপূর্ব গৌরবের আলোকবন্যায় অভিস্নাত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তার উদ্ধত আত্মম্ভরী চেহারাটা এক অতিপ্রাকৃত শক্তিলীলায় প্রমত্ত ধ্বংসোন্মাদ এক দেবদূতের মতো নীলনির্মল আকাশে বিচরণ করে বেড়াচ্ছিল যেন। তার হাতের বজ্রমুষ্টিটা হয়ে উঠেছিল যেন এক আতপ্ত তরবারি। এক নিবিড়তম তৃপ্তির হাসি হাসতে হাসতে সে যেন সমাজ ও সংসারের যত রকমের পাপ, অপরাধ, বিদ্রোহ ও নরকের উপর ঘৃণা ও দর্পভরে হেঁটে চলেছিল সব কিছু মাড়িয়ে দিয়ে।
তবুও এই উদ্ধত আত্মম্ভরী চেহারাটার মধ্যে কোথায় যেন একটা মহত্ত্ব ছিল। সে ভয়ঙ্কর হলেও তাকে ঘৃণ্য বলা যায় না। দৃঢ়তা, নিষ্ঠা, সততা, আত্মপ্রত্যয়, কর্তব্যবোধ প্রভৃতি গুণগুলো কুপথে চালিত হয়ে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠলেও তাদের মধ্যে কিছুটা মহত্ত্ব অবশিষ্ট থেকে যায়। সেই ভয়াবহতার মাঝেও মানবিক বিবেকরূপী এক মহত্ত্ব থেকে যায় তার মধ্যে। যে কারণ এইসব গুণগুলোকে ভুল পথে চালিত করে ভয়ঙ্কর করে তোলে তা হল এক ভ্রান্ত ধারণা। তাছাড়া আর কোনও কারণ নেই। কোনও অত্যুৎসাহী ব্যক্তি সততার সঙ্গে কোনও নিষ্ঠুর কাজ করে এক নির্মম আনন্দ লাভ করলেও সে আমাদের এক বিষাদগ্রস্ত শ্রদ্ধা আকর্ষণ করে। জেভার্ত না জানলেও তার ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর আনন্দ এক ধরনের অনুকম্পা লাভ করে আমাদের কাছ থেকে। এক নিষ্ঠুর কঠোরতার সঙ্গে সম্পন্ন যে কোনও শুভ কর্ম ও চিন্তার মধ্যে যেসব অশুভ শক্তি লীলাচঞ্চল হয়ে ওঠে, সেইসব অশুভ শক্তিগুলো একযোগে যেন মূর্ত হয়ে উঠেছিল জেভার্তের মুখের ওপর। তার মুখের সে দৃশ্য সত্যিই মর্মবিদারক।
.
৪
যেদিন জেভার্তের হাত থেকে ফাঁতিনেকে উদ্ধার করে ম্যাদলেন সেদিন থেকে জেভার্তের দিকে কখনও চোখ ফেরায়নি ফাঁতিনে। তার রুগণ মন জেভার্তের আসার কারণ কিছু বুঝতে না পারলেও জেভার্ত যে তারই জন্য এই হাসপাতালে এসেছে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ রইল না তার মনে। তাকে চোখে দেখার সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর এক পূর্বাস্বাদ অনুভব করল যেন সে। সে দু হাতে মুখ ঢেকে চিৎকার করে উঠল কাতরভাবে, মঁসিয়ে ম্যাদলেন, আমাকে বাঁচাও।
জাঁ ভলজাঁ (ম্যাদলেনকে এবার থেকে আমরা এই নামেই ডাকব) উঠে দাঁড়িয়ে ব্যস্ত হয়ে বলল, ভয় পেও না, ও তোমার জন্য আসেনি।
এবার জেভাৰ্তের দিকে তাকিয়ে ভলজাঁ বলল, তুমি কী জন্য এখানে এসেছ আমি তা জানি।
জেতার্ত বলল, তা হলে তাড়াতাড়ি কর।
কথাগুলো সে এমন নির্মমভাবে এবং এত তাড়াতাড়ি বলল যে মনে হল যেন কোনও মানুষ কথা বলছে না, একটা পশু গর্জন করছে। প্রথাগত কোনও রীতিনীতি মেনে চলল না সে। সে গ্রেপ্তারের কথাটা সরকারিভাবে ঘোষণা করল না অথবা পরোয়ানাটা দেখাল। তার কাছে জাঁ ভলজাঁ ছিল যেন তার বিরামহীন দুশ্চিন্তার এক রহস্যময় বস্তু, এক ছায়াশ যার সঙ্গে পাঁচ বছর ধরে লড়াই করে এসে আজ তাকে ধরাশায়ী করতে পেরেছে। এই গ্রেপ্তার যেন সেই লড়াইয়ের শেষ পরিণতি, কোনও ঘটনার সূচনা নয়। যে তীক্ষ্ণদৃষ্টির শলাকা দিয়ে আজ হতে দু মাস আগে তিনের দেহটাকে ভেদ করে তার অস্থিমজ্জাকে বিদ্ধ করেছিল, সেই দৃষ্টিশলাকা দিয়ে আজ আবার জাঁ ভলকে বিদ্ধ করল সে। ‘নাও তাড়াতাড়ি কর’ নির্মমভাবে এই কথাগুলো ছুঁড়ে দিল তার দিকে।
জেভার্তের কড়া কথাগুলো ফাঁতিনের কানে যেতেই সে আবার চোখ মেলে তাকাল। কিন্তু মেয়র কাছে থাকায় মনে সাহস পেল সে।
জেভার্ত ঘরের ভেতর কিছুটা এগিয়ে গিয়ে বলল, তা হলে তুমি আসছ?
ফাঁতিনে হতবুদ্ধি হয়ে তার চারদিকে তাকাল। ঘরের মধ্যে তখন সে ছাড়া শুধু ছিল সিস্টার সিমপ্লিস আর মেয়র। তা হলে ফাঁতিনে ছাড়া আর কাকে সে কথা বলবে জেভাৰ্ত? সহসা এমন এক অবিশ্বাস্য ও অবাঞ্ছিত ঘটনা সে নিজের চোখে দেখল যা সে রোগের ঘরেও কল্পনা করতে পারেনি কোনও দিন, যা দেখার সঙ্গে সঙ্গে সারা শরীরে কাঁপন ধরে গেল তার। সে দেখল পুলিশ ইন্সপেক্টার জেভার্ত মেয়র মঁসিয়ে ম্যাদলেনের জামার কলার ধরেছে আর মেয়র তা নতশিরে মেনে নিয়েছে।
ফাঁতিনে বলে উঠল, মঁসিয়ে মেয়র। সব দাঁত বার করে এক কুটিল অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল জেভাৰ্ত। বলল, সে আর মেয়র নেই।
জাঁ ভলজাঁ জেভাতের হাত থেকে তার ঘাড়টা ছাড়াবার কোনও চেষ্টা করল না। সে শুধু মুখে বলল, জেভার্ত–
জেভার্ত বলল, বল ইন্সপেক্টার।
ঠিক আছে ইন্সপেক্টার, আমি গোপনে তোমার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।
জেভার্ত বলল, যা কিছু বলার আছে বলে ফেল। আমার সঙ্গে কেউ চুপি চুপি কথা বলে না।
জাঁ ভলজাঁ চাপা গলায় বলল, আমি একটা বিষয়ে তোমার অনুগ্রহ চাই।
আমি বলছি, বলে ফেল।
কিন্তু সেটা শুধু তোমাকেই একান্তভাবে বলতে চাই।
আমি সে কথা শুনতে চাই না।
জাঁ ভলজাঁ জেভার্তের দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বলল, আমাকে মাত্র তিন দিনের সময় দাও। এই হতভাগিনী মহিলার মেয়েটিকে আনার জন্য তিন দিনের সময় দাও। এর জন্য তোমাকে আমি যে কোনও পরিমাণ টাকা দেব। ইচ্ছা করলে তুমি আমার সঙ্গেও যেতে পার।
জেতার্ত বলল, তুমি কি ঠাট্টা করছ? তুমি কি বোকা! তিন দিন বাইরে থাকবে এই মেয়েটার মেয়েকে আনার জন্য? চমৎকার!
ফাঁতিনে কাঁপতে লাগল। সে কাঁপতে কাঁপতে বলল, আমার মেয়েকে আনতে হবে? সে তা হলে আসেনি? সিস্টার, আমার কথার জবাব দাও, কসেত্তে কোথায়? আমি তাকে দেখতে চাই। মঁসিয়ে ম্যাদলেন—
জেভার্ত মেঝের উপর পা-টা ঠুকল। বলল, চুপ কর ব্যভিচারিণী কোথাকার! এ বেশ রাজত্ব হয়েছে, যেখানে জেলমুক্ত কয়েদিরা ম্যাজিস্ট্রেট হয় আর বারবনিতারা কাউন্টপত্নীদের মতো সেবা-শুশ্রূষা পায়। কিন্তু আমরা এ সবকিছুর অবসান ঘটাতে চলেছি এবং তার সময় এসেছে।
ভলজাঁ’র জামার কলারটা আরও জোরে ধরে জেতার্ত ফাঁতিনেকে লক্ষ্য করে বলতে লাগল, আমি তোমাকে বলে দিচ্ছি। এখানে মঁসিয়ে ম্যাদলেন বা মেয়র বলে কেউ নেই। এখানে আছে শুধু এক দাগি অপরাধী, এক কয়েদি, যার নাম জাঁ ভলজাঁ এবং যাকে আমি ধরে আছি।
ফাঁতিনে তার হাতে ভর দিয়ে বিছানার উপর খাড়া হয়ে বসল। তার দৃষ্টি জেতার্ত থেকে ভলজাঁ, আর ভলজাঁ থেকে সিস্টারের দিকে ঘুরে বেড়াতে লাগল। সে কী বলতে গেল, কিন্তু পারল না, শুধু একটা গোঙানির মতো কাতর শব্দ বেরিয়ে এল তার মুখ থেকে। তার দাঁতগুলো কড়মড় করতে লাগল। জলে ডুবে যাবার সময় কোনও লোক যেমন কিছু একটা ধরার চেষ্টা করে তেমনি করে সে দু হাত বাড়িয়ে কী করতে গেল। তার পর বালিশের উপর ঢলে পড়ল। মাথাটা খুঁজে পড়ল তার। চোখ দুটো বড় বড় করে বন্ধ করল সে আর মুখটা হাঁ করে রইল।
ফাঁতিনের দেহটা নিষ্প্রাণ হয়ে গেল।
ভলজাঁ এবার জোর করে জের্তের হাতটা সরিয়ে দিয়ে অনায়াসে তার ঘাড়টা মুক্ত করল। তার পর জেতার্তকে বলল, তুমি এই মেয়েটিকে হত্যা করেছ।
জেভার্ত প্রচণ্ড রাগের সঙ্গে বলল, ঠিক হয়েছে। আমি এখানে তর্ক করতে আসিনি। অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। নিচে পুলিশ পাহারা আছে। তুমি যাবে, নাকি তোমার হাতে হাতকড়া লাগাব?
ঘরের কোণে অব্যবহৃত একটা লোহার খাট ছিল। ভলজাঁ সেখানে গিয়ে তার থেকে একটা লোহার রড টেনে বার করে সেটা হাতে নিয়ে জেভার্তের সামনে এসে দাঁড়াল। জেভার্ত ভয়ে দরজার কাছে পিছিয়ে গেল।
ভলজাঁ সেই লোহার রডটা হাতে নিয়ে ফাঁতিনের বিছানাটার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে মুখ ঘুরিয়ে জেভার্তকে বলল, এই মুহূর্তে তুমি আমার কাজে হস্তক্ষেপ করবে না।
ভয়ে কাঁপতে লাগল জেভাৰ্ত। সে একবার ভাবল নিচে গিয়ে পুলিশদের ডেকে আনবে। কিন্তু আবার ভাবল, সে বাইরে যেতে গেলে ভলজাঁ দরজায় খিল দিয়ে তাকে আটকে দিতে পারে। তাই সে দরজার কাছে নীরবে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল ভলজাঁ কী করে।
খাটের মাথার উপর লোহার রডে কনুই রেখে হাতের তালুতে মুখ রেখে ফাঁতিনের নিথর নিস্পন্দ দেহটার দিকে তাকিয়ে নীরবে কী ভাবতে লাগল ভলজাঁ। ফাঁতিনের মৃত্যুর কথাটাই তখন তার সমস্ত মন জুড়ে বিরাজ করছিল। এক অনির্বচনীয় করুণা ফুটে উঠেছিল তার মুখের ওপর। কিছুক্ষণ পরে সে ফাঁতিনের মৃতদেহটার উপর ঝুঁকে পড়ে খুব নিচু গলায় কী বলতে লাগল।
সে তাকে কী বলল? একজন মৃত মহিলাকে একজন দণ্ডিত ব্যক্তি কী বলতে পারে? কোনও জীবন্ত মানুষ তার যে কথা শুনতে পেল না, সে কথা কি মৃতজন শুনতে পেল? অনেক সময় এমন সব অপ্রাকৃত অবান্তর ঘটনা ঘটে যা এক মহান বাস্তবতা হিসেবে শ্রদ্ধা পায় মানুষের কাছ থেকে। সিস্টার সিমপ্লিস সেই দৃশ্যের একমাত্র সাক্ষী হয়ে পরে বলেছিল, ভলজাঁ যখন ফাঁতিনের কানে কানে অশ্রুত শব্দে কী সব বলছিল, তখন ফাঁতিনের ফ্যাকাশে সাদা ঠোঁট দুটোয় আর তার শূন্য চোখে এক মৃদু হাসি ফুটে ওঠে। মৃত্যুর মাঝেও তার চোখ দুটো বিস্ফারিত হয়ে ওঠে।
ফঁতিনের মাথাটা দু হাতে ধরে মৃত্যুশোকাহত মাতার মতো পরম যত্নে বালিশের উপর রেখে দিল ভলজাঁ। তার নাইট গাউনের ফিতেটা বেঁধে দিল। তার মাথার চুলগুলো ঠিক করে গুছিয়ে দিয়ে তার উপর টুপিটা লাগিয়ে দিল। শেষে তার চোখের পাতাগুলো বন্ধ করে দিল।
ফাঁতিনের একটা হাত বিছানার পাশে ঝুলছিল। ভলজাঁ সেই হাতটা নিয়ে চুম্বন করল।
এরপর সে জেভার্তের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, এবার কী করতে হবে বল।
.
৫
জাঁ ভলজাঁকে গ্রেপ্তার করে মন্ত্রিউল থানার হাজত-ঘরে বন্ধ করে রাখল জেভাৰ্ত।
মঁসিয়ে ম্যালেনের গ্রেপ্তারের ঘটনা দারুণ আলোড়ন সৃষ্টি করল সারা শহরে। সে একজন ভূতপূর্ব কয়েদি এ কথা শুনে সকলেই ঘৃণায় পরিত্যাগ করল তাকে। সে যেসব ভালো কাজ করেছিল এতদিন ধরে সেসব কাজের কথা ভুলে গেল কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই। অবশ্য অ্যারাসে কী ঘটনা ঘটেছিল তা শহরের কেউ জানত না।
শহরের নানা জায়গায় একদল করে লোক জটলা পাকিয়ে তার কথা বলাবলি করতে লাগল। কেউ বলল, শুনেছ, লোকটা জেলফেরত কয়েদি।
আর একজন বলল, কে? মঁসিয়ে ম্যাদলেন? অসম্ভব!
কিন্তু একথা সত্যি। তার নাম ম্যাদলেন নয়, বর্জা না কি। তাকে গ্রেপ্তার করে শহরে থানায় রাখা হয়েছে। পরে অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া হবে। কয়েক বছর আগের এক ডাকাতির ঘটনার অভিযোগে অ্যারাসের আদালতে তার বিচার হবে।
আর একজন বলল, আমি কিন্তু মোটেই আশ্চর্য হইনি এ ঘটনায়। আমার প্রায়ই মনে হত লোকটা এত ভালো কাজ কেন করছে। আমার মনে সন্দেহ ছিল। সে নিজে কোনও সাজপোশাক করত না। শুধু অকাতরে দান করত। কোনও একটা রহস্য আছে এর মধ্যে–এই কথাই শুধু আমার মনে হত।
শহরের অনেক অভিজাত লোকের বাড়ির বৈঠকখানাতেও তার কথা আলোচিত হল। একদিন এক বৃদ্ধা বলল, ভালোই হল। বোনাপার্টপন্থীদের শিক্ষা হওয়া উচিত।
এইভাবে ম্যালেনের প্রেতাত্মাটা মন্ত্রিউল শহর থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল। কেবল তিন-চারজন লোক বিশ্বস্ত রয়ে গেল তার স্মৃতির প্রতি। তাদের মধ্যে ছিল সেই বুড়ি মেয়েটি যে ম্যালেনের বাড়িতে থেকে তার দেখাশোনা করত।
সেদিন সন্ধ্যায় বুড়িটি দারোয়ানের ঘরের কাছে বসে ভাবতে লাগল। আজ সারাদিন কারখানা বন্ধ ছিল। রাস্তা প্রায় ফাঁকা। হাসপাতালে ফাঁতিনের মৃত্যুশয্যার পাশে শুধু সিস্টার সিমপ্লিস আর সিস্টার পার্পেচুয়া বসে ছিল।
ম্যাদলেন বাড়ি ফিরে আসবে এই আশায় সেদিনও বসে ছিল সে। ম্যাদলেন বাড়ি ফিরলে সে তার ঘর থেকে চাবি বার করে দিত। তার বাতি জ্বেলে দিত। তার পর ম্যাদলেন তার নিজের ঘরে চলে যেত।
এমন সময় তার ছোট জানালাটা খুলে কে একটা হাত ঢুকিয়ে নির্দিষ্ট জায়গা থেকে চাবিটা বার করে নিল।
ভয়ে ও বিস্ময়ে কোনও কথা বলতে পারল না বুড়িটি। তার পর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ঈশ্বর আমায় ক্ষমা করুন মঁসিয়ে মেয়র। আমি ভেবেছিলাম আপনি
ম্যাদলেন বলল, তুমি ভেবেছিলে আমি জেলে গেছি। হ্যাঁ, আমি জেলেই গিয়েছিলাম। হাজতে ছিলাম। জানালার একটা রড ভেঙে আমি এখানে এসেছি। আমি উপরতলায় আমার ঘরে যাচ্ছি। একবার সিস্টার সিমপ্লিসকে ডেকে দেবে? সে বোধ হয় হাসপাতালেই আছে।
বুড়ি মেয়েটা চলে গেল সঙ্গে সঙ্গে। ভলজাঁ জানত সে বড় বিশ্বস্ত এবং সে কখনও বিশ্বাসঘাতকতা করে না।
ভলজাঁ উপরতলায় গিয়ে নিজের ঘরের দরজাটা খুলল। তার পর বাতি জ্বালাল। জানালার সার্সিগুলো বন্ধই রেখে দিল সতর্কতা হিসেবে। কারণ জানালাগুলো বড় রাস্তা থেকে দেখা যায়। আলো দেখলে লোকে সন্দেহ করবে।
এবার ভলজাঁ ঘরের খাট, চেয়ার, আসবাবপত্রগুলো দেখতে লাগল। বিছানাটাতে সে তিন রাত শোয়নি। সেদিন রাতে সে যেসব আসবাবগুলো সরিয়ে ঘরটা ওলটপালট করেছিল, চাকরে আবার সেগুলো সব গুছিয়ে ঠিক করে রেখেছে। ঘরে আর আগুন জ্বালানো হয়নি। আগুনের জায়গাটায় ছাইয়ের গাদায় তার আগের লাঠিটা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। পেতিত গার্ভের মুদ্রাটা আগুনে পুড়ে কালো হয়ে গেছে।
ভলজাঁ একটা কাগজ বার করে তার উপর লিখল, এইখানে আমার আগের পোড়া লাঠিটা আর পেতিত গার্ভের কাছ থেকে চুরি করা মুদ্রাটা রইল। এই মুদ্রার কথাটা আমি আদালতে বলেছিলাম। লেখার পর কাগজটা আর মুদ্রাটা ঘরের এমন এক জায়গায় রাখল যাতে কেউ ঘরে ঢুকলেই সেগুলো তার নজরে পড়ে। এরপর ড্রয়ার থেকে একটা পুরনো শার্ট বার করে সেটা ছিঁড়ে বিশপের দেওয়া রুপোর বাতিদান দুটো জড়িয়ে নিল। জেল থেকে দেওয়া যে কালো রুটিটা এতদিন ধরে সে রেখে দিয়েছিল সেটা সে টুকরো টুকরো করে ফেলল। পরে যখন পুলিশ এসে ঘরটা তছনছ করে তখন সেই টুকরোগুলো পায়।
দরজায় মৃদু একটা করাঘাত হল এবং সিস্টার সিমপ্লিস ঘরে ঢুকল। তার মুখটা ম্লান এবং চোখদুটো লাল হয়ে উঠেছিল। তার হাতে একটা বাতি ছিল এবং হাতটা কাঁপছিল। আমরা যতই আত্মস্থ স্বয়ংসম্পূর্ণ ও শৃঙ্খলাপরায়ণ হই না কেন, দুর্ভাগ্যের নির্মম কশাঘাত এমনি করে আমাদের বিচলিত করে, এমনি আমাদের আসল স্বরূপটা টেনে বার করে বাইরে। সেদিনের ঘটনা যা তার সামনে ঘটে গেছে তাতে সন্ন্যাসিনীর মাঝে সুপ্ত নারীসত্তা আবার জেগে উঠেছে। সে সারাদিন কেঁদেছে। তার সর্বাঙ্গ শিহরিত হয়েছে ক্ষণে ক্ষণে।
ভলজাঁ এর মধ্যে একটা চিঠি লেখে। চিঠিটা সে সিস্টারের হাতে দিয়ে বলল, এটা কুরেকে দেবে সিস্টার। তুমি এটা পড়ে দেখতে পার।
সিস্টার চিঠিটা পড়ল। তাতে লেখা ছিল, মঁসিয়ে লে কুরেকে আমি যে টাকা রেখে যাচ্ছি তার সব ভার নেবার জন্য অনুরোধ করছি। সেই টাকায় তিনি আমার মামলার খরচ চালাবেন এবং যে মেয়েটি হাসপাতালে মারা গেছে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য যা লাগবে তা দিয়ে দেবেন। বাকি যা থাকবে গরিব-দুঃখীদের মধ্যে তা বিলিয়ে দেবেন।
সিস্টার কী বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারল না। শেষে সে জিজ্ঞাসা করল, ভলজাঁ শেষবারের মতো মৃত ফাঁতিনেকে দেখবে কি না।
ভলজাঁ বলল, না, ওরা আমাকে খুঁজছে। মৃত্যুশয্যার পাশে ওরা আমাকে গ্রেপ্তার। করলে তার শান্তি বিঘ্নিত হবে।
তার কথা শেষ হতেই নিচে কাদের পায়ের শব্দ শোনা গেল। সেই সঙ্গে শোনা গেল নিচে সেই বুড়ি মেয়েটি প্রতিবাদের সুরে জোর গলায় কী বলছে। সে বলছে, আমি সারাদিন এখানে বসে আছি। কাউকে বাড়িতে ঢুকতে দেখিনি।
একজন লোক বলল, কিন্তু উপরকার ঘরে আলো জ্বলছে।
ভলজাঁ বুঝতে পারল নিচে জেভাৰ্ত কথা বলছে।
ঘরের মধ্যে একটা জায়গা ছিল যেখানে কেউ থাকলে ঘরে কেউ ঢুকলে তাকে দেখতে পাবে না। জাঁ ভলজাঁ বাতির আলোটা নিবিয়ে দিয়ে সেইখানে লুকিয়ে পড়ল। সিস্টার সিমপ্লিস টেবিলের পাশে নতজানু হয়ে প্রার্থনা করতে লাগল।
এমন সময় দরজা খুলে জেতার্ত ঘরে ঢুকল। বারান্দায় কয়েকজন লোকের গলা শুনতে পাওয়া গেল। বুড়ি তখনও তাদের সঙ্গে বাদ-প্রতিবাদ করছে। ঘরের মধ্যে একটা বাতি মিটমিট করে জ্বলছিল।
সিস্টারকে প্রার্থনা করতে দেখে জেতার্ত লজ্জা পেয়ে গেল।
জেভার্তের প্রকৃতিটা যত কঠোরই হোক না কেন ধর্মের প্রভুত্বের প্রতি তার একটা শ্রদ্ধা ছিল। তার মতে একজন যাজক বা সন্ন্যাসিনী কোনও ভুল করতে পারে না, কোনও পাপকাজ করতে পারে না। ধর্মবিশ্বাসের দিক থেকে সে ছিল একেবারে গোড়া। ধর্মের প্রভুত্ব সম্পর্কে তার মনে কোনও সংশয় বা প্রশ্ন ছিল না। তার মতে যাজক বা সন্ন্যাসিনীদের আত্মা আর বাস্তব জগতের মধ্যে ছিল এমন এক প্রাচীরের ব্যবধান, যার মধ্যে যাতায়াতের কেবল একটা মাত্রই দরজা ছিল। সে জাঁ হল সত্যের দরজা।
সিস্টার সিমপ্লিসকে প্রার্থনা করতে দেখে জেভার্তের চলে যেতে ইচ্ছা হল।
কিন্তু তার একটা কর্তব্য আছে। যে কর্তব্য পালন করার জন্য সে এখানে এসেছে। সে কর্তব্য সে অস্বীকার করতে পারে না।
জেতার্ত জানত সিস্টার সিমপ্লিস জীবনে কখনও মিথ্যা কথা বলেনি। তাই তাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখত।
জেতার্ত এবার সিস্টারকে বলল, সিস্টার, আপনি কি এ ঘরে একা আছেন?
সিস্টার সিমপ্লিস এক কঠিন অবস্থার মধ্যে পড়ল। সে বুড়ি মেয়েটি ভয়ে কাঁপতে লাগল। তার মনে হল সিস্টার মূৰ্ছিত হয়ে পড়বে।
সিস্টার সিমপ্লিস মুখ তুলে জেতার্তকে বলল, হ্যাঁ।
জেভার্ত বলল, মাপ করবেন। আজ সন্ধ্যায় আপনি জাঁ ভলজাঁ নামে একজন লোককে দেখেছেন? আজ সে হাজত থেকে পালিয়ে এসেছে। আমরা তাকে খুঁজছি। আপনি তাকে দেখেছেন?
সিস্টার বলল, না।
দ্বিতীয়বার মিথ্যা কথা বলল সিস্টার সিমপ্লিস। এ মিথ্যা তার আত্মত্যাগেরই সমতুল।
জেভার্ত বলল, আমি ক্ষমা চাইছি।
এই বলে ঘর থেকে চলে গেল সে।
যে সিমপ্লিস সংসার ত্যাগ করে দীর্ঘকাল ধর্মের কাজে যোগদান করেছে তার কথা সত্য বলে ধরে নিল। সে লক্ষ করল না একটা বাতি টেবিলের উপর নেভানো ছিল।
এক ঘণ্টা পরে একটা লোককে কুয়াশার মধ্য দিয়ে প্যারিসের পথে একা দেখা যায়। সে লোক হল জাঁ ভলজাঁ। দু একজন গাড়ির চালক গাড়ি চালিয়ে সে পথে যাবার সময় দেখে একটা লোক আলখাল্লা পরে আর হাতে একটা পুঁটলি নিয়ে প্যারিসের পথে হেঁটে চলেছে। সে আলখাল্লাটা কোথায় পেয়েছে ভলজাঁ তা কেউ জানে না।
যে পৃথিবীর মাটি আমাদের সকলের মাতা, আমাদের শেষ আশ্রয়স্থল সেই পৃথিবীর মাটিতে চিরবিশ্রাম লাভ করে ফাঁতিনে।
জাঁ ভলজাঁ যে টাকা রেখে গিয়েছিল, কুরে সে টাকার বেশিরভাগ গরিব-দুঃখীদের জন্য রেখে দিয়ে তার থেকে খুব অল্প টাকাই ফাঁতিনের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য খরচ করে। কবরখানার এক প্রান্তে দীন-দরিদ্রদের জন্য সংরক্ষিত এক জায়গায় তাকে অতি সাধারণভাবে কবর দেওয়া হয়। তার কবরটাও ছিল তার বিছানার মতোই দীন হীন।