দুয়ার খুলে থাকি বসে
আসবে তুমি ফিরে।
প্রদীপটিকে জ্বালিয়ে রাখি
তোমার পথের ধারে ॥
ধীরে, খুব ধীরে, ভয়ে ভয়ে সদর দরজার একটা পাল্লা সামান্য একটু ফাঁক করতেই বাইরের জগৎ যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ল। একঝলক পরিষ্কার বাতাস, শুভ্র রুপোলি আলো, শব্দের গমক ছুটে এল। কিছুই হয়নি যেন! উদাসীন বহির্বিশ্ব যেমন চলছিল ঠিক তেমনি চলছে। সাইকেলের হাতলে পাটপাট কাগজ ভঁই করে খবরের কাগজঅলা ছুটছে পুব থেকে পশ্চিমে। গয়লা চলেছে দুধের বালতি নিয়ে। খড়ের নুটি তালে তালে নাচছে। এপাশ থেকে ওপাশ, যত দূর দৃষ্টি যায় একবার তাকিয়ে দেখলুম। অজগরের মতো পথ চলে গেছে এঁকেবেঁকে। ভেঙে পড়া ঝাড়লণ্ঠনের মতো টুকরো টুকরো মানুষ এলোমেলো ছড়িয়ে আছে। রাতের মুঠো আলগা হয়ে দিনের পৃথিবী খুলে পড়েছে। পাউরুটির সাইকেল ভ্যান বিকট শব্দে চমকাতে চমকাতে চলেছে। হাফপ্যান্ট পরা চালক সিটের ডাইনে বাঁয়ে উঁচু-নিচু হয়ে প্যাডেল ঠেলছে।
দরজা বন্ধ করতেই জগৎ কাটা পড়ে গেল। ঘোলাটে আলো অন্ধকার। সঁতসেঁতে বাতাস। বিষণ্ণ দরজা জানলা। মরচে-ধরা সোজা সোজা গরাদ। ঝিঁঝি এখনও থেমে থেমে তাল ঠুকছে। উত্তরের বাগানে নিমগাছে বসে কাক ডাকছে খা খা করে। দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে আলো-অন্ধকারের দিকে ফিরে তাকালুম। কী ভীষণ শূন্যতা! উধ্বাকাশে প্যারাচুট না খুললে, নিরালম্ব পড়ে যেতে যেতে মনের যেরকম অবস্থা হওয়া উচিত, আমার মনের অবস্থাও ঠিক সেইরকম। পৃথিবীর সঙ্গে নাড়ির যোগ কেটে গেছে। যার পা নেই তার বগল থেকে ক্রাচ কেড়ে নিলে এইরকমই হয়। পাশে দাঁড়াবার মতো কেউ নেই। একেবারে একা। পূর্ণ কুম্ভ থেকে শূন্য কুম্ভ। হঠাৎ মনে হল, সেই অসহায় মহিলাটির হলে কাল কেমন লেগেছিল! কী মন নিয়ে তিনি চলে গেলেন! আমি তো পুরুষ! তাও মনে হচ্ছে মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে।
পিতৃদেব! এ কি লঘু পাপে গুরুদণ্ড হয়ে গেল না! এইভাবে প্রতিশোধ নিলেন? ভয়ে, লজ্জায়, আমি যেন খুনির মতো এই আবছা আলোয়, নোনা বাতাসে সিঁটিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। বিচারক-জগৎ বাইরে বয়ে চলেছে। কোনওক্রমে খবর একবার বাইরে রটে গেলে আমার ফাঁসি হয়ে যাবে। নিরুদ্দেশ সংবাদটিকে গুম করে দিতে হবে। তারপর সারাভারত আমি ছুঁড়ে ফেলব। কিন্তু! ভয়ে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। যদি আত্মহত্যা করে থাকেন! অসম্ভব! তিনি ভীরু ছিলেন না। জীবনের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ার ক্ষমতা রাখেন। এইসময় কেউ যদি আমার পাশে থাকত। এমন কেউ যাকে সব কথা খুলে বলা চলে। যার পরামর্শ নেওয়া চলে। এমনকী মুকুর মতো কেউ থাকলেও এই শূন্যতা সহনীয় হত।
ধীরে ধীরে আবার ওপরে উঠে এলুম। নিজেকে মনে হচ্ছে, ট্রেন দুর্ঘটনার পর, কী বোমা বর্ষণের পর একমাত্র জীবিত মানুষ! প্রতিদিনের অভ্যস্ত জগৎ উলটে পড়ে গেছে। সেই পরিচিত কণ্ঠস্বর নেই, পদশব্দ নেই, উত্তাপ নেই, চাহিদা নেই। অন্যদিন এতক্ষণে চা বসে যেত। বাথরুমে জল পড়ার শব্দ হত। চটি ঘুরে বেড়াত ফটফট করে। বিশ্বাস হচ্ছে না। এ কোনও রসিকতা নয় তো! কিছু তো একটা বলে যাবেন? কী সাংঘাতিক মানুষ! কত বড় একজন অভিনেতা! কাল রাতে এতটুকু বুঝতে দিলেন না। মনে হল পুরনো সেই মানুষটি ধীরে ধীরে ফিরে আসছেন। বজ্রের মতো কঠোর, আবার কুসুমের মতো কোমল। লাস্ট সাপারের অভিনয় করে গেলেন। নিজে বেঁধে শেষ আহার করে গেলেন আমার সঙ্গে। পরিকল্পনাটা কী, একবারও যদি বুঝতে পারতুম! শেষরাতেই যদি চলে গিয়ে থাকেন, কতদূর আর যেতে পেরেছেন? শহর থেকে বেরোবার তো মাত্র দুটি দরজা, হয় শেয়ালদা, হয় হাওড়া। চাকরিতেও কি ইস্তফা দিলেন! আমার তেমন লোকবল থাকলে এক্ষুনি দিকে দিকে সকলকে ছুটিয়ে দিতুম। পালানোর সমস্ত পথ বন্ধ হয়ে যেত! থানায় গেলে কেমন হয়? সে বড় লজ্জার। চারপাশে টিটি পড়ে যাবে। ধূর্ত প্রতিবেশীর দল সান্ত্বনা জানাবার ছলে এসে জল আরও ঘোলা করে দিয়ে যাবে। কী আমি করতে পারি? এই বাড়ি ফেলে কোথায় আমি দৌড়োই? কায়ার। পেছনে ছায়ার মতো! আমার সব পরিকল্পনা এক ধাক্কায় চুরমার হয়ে গেল।
টেবিলের আলোটা নিবিয়ে দিই। এ বাড়িতে আলো আর জ্বলবে না। মাতামহের ভাষায়, সব ধুস হয়ে গেল। পঙ্কজবাবুর কাছে গেলে কেমন হয়? পাকা মাথা থেকে পাকা পরামর্শ বেরোতে পারে। একদিন অকারণে পিতৃনিন্দা করেছেন। না যাওয়াই ভাল। মানুষটির মনে তিন-চার রকমের অহংকার প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে। অর্থের, রূপের, সুন্দরী স্ত্রী কন্যার। স্বপ্নে আছেন, স্বপ্নেই থাকুন। জাগিয়ে লাভ নেই। বরং অক্ষয় কাকাবাবুর কাছে যাওয়া চলে। মাতুলকে খবর দিতে পারা যায়। তবে তিনিও কি কম বিব্রত! বোঝার ওপর শাকের আঁটি চাপিয়ে লাভ কী!
হাতলঅলা মেহগনি কাঠের ভারী চেয়ার টেবিলের দিকে আড় হয়ে আছে। এইমাত্র কেউ যেন ঠেলে উঠে চলে গেছেন। টেবিলঘড়ি প্রবল শব্দে টিকটিক করে চলেছে। উপলখণ্ডের ওপর দিয়ে সময়ের টাটু ঘোড়া যেন দুলকি চালে ছুটছে ভবিতব্যের সওয়ার নিয়ে। যে-চাবি নিয়ে এত লাঠালাঠি সেই চাবির গোছা পড়ে আছে টেবিলে অনাদরে, অবহেলায়। একটি নোটখাতার মাঝামাঝি জায়গায় কলম গোঁজা। কিছু কি লিখছিলেন! পাঁচখণ্ড সদ্গুরু সঙ্গ একপাশে পরপর সাজানো। আর এক পাশে কথামৃত।
খাতাটা খুলতেই চোখে পড়ল কী লিখছিলেন! নিজেকেই লেখা নিজের চিঠি–
হরিশঙ্কর, অনেকদিন হল পৃথিবীতে এসেছ। কেন এসেছ জানো কি? আমার নির্দেশ কি তুমি বোঝো না! সংসার তোমার জন্যে নয়। যতবার তুমি গড়তে চেয়েছ, ততবারই আমি ভেঙে চুরমার করে দিয়েছি। তোমার জীবনে ভোগ নেই, আছে দুর্ভোগ। আর কতকাল ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াবে! তেল পুড়ে আসছে। আলোটা এবার নিজের দিকে তুলে ধরো। অন্ধকারে এসে অন্ধকারে কেন বিদায় নেবে! প্রস্রবণের মুখ চাপা আছে। পুরুষকার দিয়ে সামান্য একটু উসকে দাও। কী সব বাজে অন্তঃসারশূন্য জিনিস নিয়ে মেতে আছ! বিজ্ঞানীর গর্ব তোমার সাজে না। তুমি আইনস্টাইন নও, তুমি রাদারফোর্ড নও। শুল্ক দফতরের সামান্য একজন রাসায়নিক। তোমার পরীক্ষা-নিরীক্ষায় জগৎ একটি কানাকড়িও পাবে না। জীবনসঙ্গিনীকে অনেক আগেই কেড়ে নিয়েছি। যে কর্তব্যের মুখ চেয়ে এতকাল পুতুল খেলছিলে, তোমার সেই উত্তরপুরুষ আজ তৈরি। জীবনের সুপথ, কুপথ, ঘুরপথ সবই চিনতে শিখেছে। স্নেহের শিকল কেটে এবার পাখিটিকে উড়িয়ে দাও। তার স্বাধীন ইচ্ছে তৈরি হয়েছে। আর তাকে প্রদীপের মতো আগলে রেখো না। এবার তাকে সাবালক হতে দাও। হাবুডুবু না খেলে সাঁতার শেখা যায় না। জেনে রাখো এক জঙ্গলে দুটো বাঘ থাকতে পারে না। তুমি তো বৃদ্ধ বাঘ হে! লোলচর্ম, পলিত কেশ। স্বপ্ন ছিল? অনেক স্বপ্ন! কীসের স্বপ্ন হরিশঙ্কর? জীবনটাই তো দীর্ঘ এক স্বপ্ন! স্বপ্নের আবার স্বপ্ন কী? জীবন তো সময়ের বুদবুদ। কেন পড়োনি, ব্রহ্মই বস্তু, আর সমস্ত মায়া, স্বপ্নবৎ অবস্তু? অহংরূপ একটি লাঠি সচ্চিদানন্দ-সাগরের মাঝখানে পড়ে আছে। অহংলাঠিটা তুলে নিলে এক সচ্চিদানন্দ সমুদ্র। অহংলাঠিটি থাকলে দুটো দেখায়, এ একভাগ জল ও একভাগ জল। ব্রহ্মজ্ঞান হলে সমাধিস্থ হয়। তখন এই অহং পুছে যায়। ভেবে দেখো, এই জাগরণ অবস্থাও কিছু নয় হরিশঙ্কর। সেই গল্পটা মনে পড়ে? এক কাঠুরে স্বপ্ন দেখেছিল। একজন হঠাৎ তার ঘুম ভাঙিয়ে দেওয়াতে কাঠুরে রেগে আগুন। তুই কেন আমার ঘুম ভাঙালি? আমি রাজা হয়েছিলাম, সাত ছেলের বাপ হয়েছিলাম। ছেলেরা লেখাপড়া, অস্ত্রবিদ্যা সব শিখছিল। আমি সিংহাসনে বসে রাজত্ব করছিলাম। কেন তুই আমার সুখের সংসার ভেঙে দিলি? যে ঘুম ভাঙিয়েছিল সে বললে, ‘ও তো স্বপ্ন, ওতে আর কী হয়েছে!’ কাঠুরে বলল, ‘দুর! তুই বুঝিস না, আমার কাঠুরে হওয়া যেমন সত্য, স্বপনে রাজা হওয়াও তেমনই সত্য। কাঠুরে হওয়া যদি সত্য হয়, তা হলে স্বপনে রাজা হওয়াও সত্য।’ সবই স্বপ্ন, হরিশঙ্কর! কোনওটা দীর্ঘস্থায়ী, কোনওটা ক্ষণস্থায়ী। শঙ্কর তো পড়েছ? অত বড় অদ্বৈতজ্ঞানী আর কি এসেছিলেন? স্বপ্নে স্বপ্ন সত্য, জাগরণে সব মিথ্যা। তোমার অজ্ঞান জগৎকে সত্য, অবিনশ্বর এইরকম একটা ভ্রম তৈরি করে তুলছে। আসলে তা নয়। সত্যদ্রষ্ট ঋষির বাক্যে বিশ্বাস রেখে এগিয়ে চলো। যখন জেগে আছ তখন স্বপ্ন মিথ্যা, যখন স্বপ্নে আছ তখন জাগরণ বৃথা, যখন তুমি গভীর নিদ্রায় তখন স্বপ্নও নেই, জাগরণও নেই। এইবার স্বপ্ন আর জাগরণকে এক করে ফেলো তখন নিদ্রাটাকেই মিথ্যা বলে মনে হবে। কী সুন্দর কথা! একবার অভ্যাস করে দেখো, পারবে, তুমি পারবে। আমি ধীরে ধীরে তোমার মোহ ছেদন করে দিয়েছি।
যথা মৃদি ঘটো নাম কনকে কুণ্ডলাভিধা।
শুক্তৌ হি রজতখ্যাতিৰ্জীবসংজ্ঞা তথাপরে ॥
মৃত্তিকায় দিলে ঘট নাম, কনকে লাগালে কুণ্ডল নাম, শুক্তিতে নিয়ে এলে রজতের কল্পনা, তেমনি আত্মাকে দিলে জীবনের চেহারা। রঞ্জুতে সর্পভ্রম এনো না। ঘট মৃত্তিকাই, দেহ চিদাত্মময়। তোমার প্রারব্ধ ক্ষয় হয়েছে, এবার আত্মজ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত হও।
আর ঘুমাইও না মন।
মায়াঘোরে কতদিন
রবে অচেতন।
কে তুমি কী হেতু এলে
আপনারে ভুলে গেলে
চাহ রে নয়ন
মেলে
ত্যজ কুস্বপন ॥
সময় ঝুরঝুর করে বালির মতো ঝরে পড়ছে। দেহপিঞ্জর খুলে যাবার সময় আসন্ন। এতকাল স্নেহে অন্ধ হয়ে ছিলে। কর্তব্যের চাকা অবিরত ঘুরিয়েই গেছ, ঘুরিয়েই গেছ। কে তোমার আবেগের মূল্য দেবে! জগৎ বড় স্বার্থপর। কেউ কারুর নয় হরিশঙ্কর! আঁতে ঘা লাগলে সবাই বেঁকে বসবে, এমনকী সন্তানও! সমালোচনা এক জিনিস, সন্দেহ আর এক জিনিস। বার্ধক্যে যখন স্থবির হয়ে যাবে, চোখের দৃষ্টি কমে যাবে, বুদ্ধিভ্রংশ হবে, তখন কি তুমি অপমানের বোঝা নিয়ে পরাজিত সৈনিকের মতো যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করবে! ধিক হরিশঙ্কর, ধিক তোমাকে! সংসার এক ছোবড়া। যতই নিংড়োও এক ফোঁটাও রস বের করতে পারবে না। বৈরাগ্য হিসেব করে আসে না। মুহূর্তে উদয় হয়, মুহূর্তেই মিলিয়ে যায়। যেন ঝড়ের পাখি। বন্ধ জানলার কাছে এসে সরু ঠোঁটের ঘা মারে। খুলে। দাও, খুলে দাও, নয়তো উড়ে চলে যাবে। ঠাকুরের বলা সেই গল্পটি মনে পড়ছে! একজনের পরিবার বললে, ‘অমুক লোকের ভারী বৈরাগ্য হয়েছে, তোমার কিছু হল না। যার বৈরাগ্য হয়েছে, সে লোকটির ষোলোজন স্ত্রী,–এক একজন করে তাদের ত্যাগ করছে।’
সোয়ামি নাইতে যাচ্ছিল, কাঁধে গামছা, বললে, ‘খেপি! সে লোক ত্যাগ করতে পারবে না,– একটু একটু করে কি ত্যাগ হয়? আমি ত্যাগ করতে পারব। এই দেখ,–আমি চললুম!
সে বাড়ির গোছগাছ না করে–সেই অবস্থায়–কাঁধে গামছা–বাড়ি ত্যাগ করে চলে গেল। এরই নাম তীব্র বৈরাগ্য। যে ত্যাগ করবে তার খুব মনের বল চাই। ডাকাত পড়ার ভাব। অ্যায়!!!– ডাকাতি করার আগে যেমন ডাকাতেরা বলে– মারো! লোটো! কাটো!
তুমি তো বারেবারে এই জীবনেই নতুন করে জন্মাতে চেয়েছ। এই কূপ থেকে আর একবার বেরিয়ে পড়ো। স্লেটের লেখার মতো অতীতকে মুছে দিতে না পারলে, বর্তমানকে ফেলে দিতে না পারলে, ভবিষ্যতের মুখোমুখি হওয়া যায় না। কিছুকাল কিছু মানুষের সঙ্গে প্রারব্ধ ক্ষয় করে গেলে, এবার তবে চলো নতুন জন্ম নিতে।
কালির ফোঁটায় লেখা এইখানেই শেষ হয়েছে। এ কবেকার লেখা! কাল রাতের, না তারও আগের? মনে হয় কাল প্রথমরাতে এইসব লিখেছেন। তারপর জীবনের প্রিয় সঙ্গী এসরাজটিকে কাঁধে নিয়ে বসেছেন। শেষ ছড় টেনে জয়জয়ন্তীর করুণ সুরে রাতকে কাঁদিয়েছেন। আমি আধো-তন্দ্রায় সেই সুর শুনেছি।
ছোট্ট আর একটি নোট খাতা মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। সেই বিখ্যাত হিসেবের খাতা। পাতায় পাতায় পরম নিষ্ঠায় পাইপয়সা খরচেরও হিসেব লেখা। শেষ পাতায় নতুন একটি সংযোজন। গহনার তালিকা, বিছাহার, সাতনরি হার, বাজু, মানতাসা, টায়রা, রুলি, চুড়ি, ব্রেসলেট, আংটি। পরপর তালিকা নেমে গেছে নীচের দিকে। চল্লিশ ভরির মতো সোনা। গোটাকতক গিনিও আছে। সোনার রিস্টওয়াচ।
খাতার তলা থেকে ব্যাঙ্কের পাসবই উঁকি মারছে। জয়েন্ট অ্যাকাউন্টে প্রায় সত্তর হাজার টাকা পড়ে আছে। বড় কোম্পানির কিছু শেয়ারও কেনা আছে। বছরে বছরে ডিভিডেন্ড আসতে দেখি। বুকটা হঠাৎ দুধের মতো উথলে উঠল। সব আমার, সব আমার। আমি ধনী, ভিখিরি নই। সব সাজিয়ে রেখে গেছেন আমার জন্যে। আমার সামান্য একটি কথায় একবস্ত্রে গৃহত্যাগ করলেন। কী অসম্ভব মনের তেজ! কী দুর্জয় অভিমান! দিনের পর দিন আমি বসে থাকব এই ভগ্ন অট্টালিকায়। যা দাঁড়িয়ে আছে প্রায় দশ কাঠা জমির ওপর। যক্ষের মতো আগলাব এইসব সোনাদানা। আর সেই মানুষটি পড়ে থাকবেন অজানা অঞ্চলে। কোনও অরণ্যে, কি পর্বতে, কি কোনও আশ্রমে। শীত আসবে, বসন্ত বিদায় নেবে, বর্ষার আকাশ মাথার ওপর গর্জন করবে। এদিকে ছাতে ফুলগাছের টবে। টবে কুঁড়ির মুখ উঁকি দেবে। একটি-দুটি ফুল ফুটবে। আমি শুধু বসে থাকব সুখী যক্ষের মতো, আমার ভোগ নিয়ে, আমার ন্যাজে-খেলানো স্বভাব নিয়ে, আত্মদর্শন-ইচ্ছার মুখোশ পরানো দেহবাসনা নিয়ে। বিষকুম্ভ পয়োমুখং হয়ে বসে থাকব এই স্মৃতির সৌধে। ভাঙছে যখন ভাল করেই ভাঙুক। নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক এই অভিশপ্ত বংশ। যা কিছু আছে সবই দান করে দিই আশ্রমকে। মানুষের চেষ্টায় যা গড়া সম্ভব হল না, গড়ে উঠুক ঈশ্বরের নামে। ওই লেখার পাশে আমিও তো লিখতে পারি, ঠাকুরের কথাতেই লিখতে পারি, বাপ কত বড় বস্তু! বাপ-মাকে ফাঁকি দিয়ে যে ধর্ম করবে তার ছাই হবে! মানুষের অনেকগুলি ঋণ আছে। পিতৃঋণ, দেবঋণ, ঋষিঋণ। এ ছাড়া আবার মাতৃঋণ আছে। সব ঋণ শোধ করে আমি অঋণী হয়ে যেতে চাই।
হরিশঙ্করের পুত্র হরিশঙ্করই হবে। এক প্রান্তে আপনি উঠুন, আর এক প্রান্তে আমি। সময় হলে দেখা হবে দু’জনে, কোনও অরণ্যে, কোনও পর্বতশীর্ষে, কোনও দেবালয়ে। তখন দু’জনেই দুজনকে যাচাই করে নোব। কে কত দুর এগিয়েছে বিচার করবেন সেই তিনি।
কোণের দিকে ঠকাস করে একটা শব্দ হল। বলাইবাবু উলটে গেছে। যাবার আগে বলাইবাবুর একটা ব্যবস্থা করে যেতে হয়। পুকুরে ছাড়লে সর্বগ্রাসী মানুষ খেয়ে শেষ করে দেবে। নদীতে ছাড়লে অনিশ্চয়তায় হারিয়ে যাবে। চলো, তুমি যেখান থেকে এসেছিলে সেইখানেই ফিরে চলো। নাটক শেষ হয়ে গেছে বলাইবাবু। যবনিকা নেমে গেছে। দর্শকের আসন শূন্য। অভিনেতারা সবাই চলে গেছে। শূন্য মঞ্চে শুধু তুমি আর আমি। চলো, আর না। এখানে এবার শুরু হবে নতুন নাটক। সে কাহিনিতে তোমার আর আমার স্থান নেই।
বারান্দার কোণে ঝুড়িতে বলাইবাবুর খাদ্য। শাকপাতা, পাকা কলা। মানুষের হাতে শেষ খাওয়া খেয়ে যাও। বলাইবাবুর বেশ খিদে পেয়েছিল। শরীরের পাশ দিয়ে বিচিত্র মুখটি বের করে শাকের কুচি, কলার টুকরো টেনে নিতে লাগল। অবোধ জীব জানে না, এরপর কী হবে! কে-ই বা জানে! আমি-ই কি জানি, একটু পরে আমার কী হবে! কাল কি জানতুম, আজ আমার কী হবে!
খাওয়া হয়ে গেল? চলো, লক্ষ্মী ছেলে। তুমি ছেলে, না মেয়ে!
বলাইবাবুকে বুকের কাছে ধরে, পেছনের অন্ধকার-অন্ধকার, ভাঙা-ভাঙা-সিঁড়ি বেয়ে নীচে পাতকোতলায় নেমে এলুম। নতুন দিনের আলো লেগেছে গাছের পাতায় পাতায়। বহুকাল পরে বউ কথা কও এসে বসেছে নিমগাছের ঝিরিঝিরি পাতার আড়ালে। বড় অদ্ভুত ডাক। তার হলদে শরীর এক ঝলক নেচে গেল চোখের সামনে ঈশ্বরের খুশির মতো। কুয়োর স্থির জলে নিজের মুখের প্রতিচ্ছবি। বহু দূর থেকে বিষণ্ণ একটি মুখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সত্যিই আমি যেন জলে পড়ে গেছি। মন-কেমন করা একটা শীতলতা ওপর দিকে ঠেলে উঠছে।
বলাইবাবু আজকাল আর খোলের ভেতর মুখ ঢুকিয়ে নেয় না। গলার কাছে তার মুখ খেলছে। ভিজেভিজে স্পর্শ। ভেষজ-ভেষজ গন্ধ। বলাইবাবু, ওই যে তোমার বর্তুলাকার জগৎ। ওইখান থেকেই তুমি এসেছিলে এক বর্ষার দুপুরে। যাও, আবার তুমি তোমার জল-জগতের নিঃসঙ্গ গভীরতায় ফিরে যাও। বড় মনকেমন করছে বলাইবাবু। আর কোনওদিন তোমার সঙ্গে হয়তো দেখা হবে না। না, ওপর থেকে তোমাকে দুম করে ফেলব না। বালতিতে রেখে ধীরে ধীরে নামাব।
বলাইবাবু কিছুক্ষণ ভেসে রইল জলে। কূলকিনারা পাচ্ছে না। মাথাটা বৃত্তাকারে জলে ঘুরে গেল। একবার, তারপর ডিগবাজি খেয়ে বলাইবাবু তলিয়ে গেল জলে। একরাশ বুড়বুড়ি ভেসে উঠল জলের ওপর। পিতৃদেব লিখে গেছেন, আমরা সব সময়ের বুদবুদ।
গোটাকতক কাক ডেকে উঠল খা-খা করে। সমস্ত পৃথিবী যেন শুকিয়ে গেছে। বড় তৃষ্ণার্ত ডাক।
দেখতে দেখতে বেলা বাড়ছে। পিতৃদেব যে-উদ্দেশ্যেই যাত্রা করুন, আমার সঙ্গে ব্যবধান তার ক্রমশই বেড়ে চলেছে। কোথায় যেতে পারেন? হরিদ্বারে? বৃন্দাবনে? বিন্ধ্যাচলে? এই এত বড় একটা দেশ। হারাব মনে করলে অতি সহজেই হারিয়ে যাওয়া যায়।
চৌকির ওপর বসে চারপাশে একবার তাকালুম। কড়িকাঠে চারটে আংটা ঝুলছে। দূর অতীতে ওই আংটা থেকে ঝুলত একটা দোলা। সেই দোলায় শুয়ে শুয়ে হাতপা ছুড়ত একটি অসহায় শিশু। ওই যে ছবি, আমার মা। ডুরে শাড়ি পরে হাঁটু গেড়ে সেই দোলার পাশে বসে ধীরে ধীরে দোলাতেন, হাতের চুড়ি বেজে উঠত জলতরঙ্গের সুরে। ঘুমপাড়ানি গান গাইতেন চিরকালের সুরে, আয় ঘুম, যায় ঘুম, বর্গিপাড়া দিয়ে। তুমি আবার আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দাও মা। অতীতকে অলৌকিক কায়দায় টেনে আনো বর্তমানে। আবার একবার নতুন করে জীবন শুরু করি। যেসব ভুল এবারে করেছি, দ্বিতীয়বার আর তা করব না। না, তা বুঝি আর হয় না! জীবন টুথপেস্টের মতো। যা একবার বেরোয়, যতটুকু বেরোয়, ততটুকুই খরচ করে ফেলতে হয়।
পাশের অন্ধকার ঘর থেকে ঘড়ির চলনে টুপটুপ শব্দ ভেসে আসছে। এ শব্দ তো এতক্ষণ কানে আসেনি। পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে উঁকি মেরে দেখলুম। নীল কাঁচ বসানো জানলা দিয়ে বিষাক্ত আলো এসেছে। দেয়াল-ঘেঁষে সার সার কালির বোতল। একটার মুখে বিশাল এক ফানেল। টুপটুপ করে নীল কালি পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা। হলাহলের মতো। কী আশ্চর্য! যাবার আগে ফিল্টারে কালিও চাপিয়ে গেছেন! এ এখন সারাদিন ধরে পড়বে। বলেছিলেন, যেখান থেকে শুরু হয়েছিল, সেইখানেই আবার তোমাকে ফিরিয়ে দিলুম। তুমি সুখী তো!
রাস্তায় বেরিয়ে সময়টা একবার দেখে রাখলুম। বেলা এগারোটা। সদরের দরজায় সবচেয়ে বড় তালাটা ঝুলিয়েছি। যক্ষপুরীর তালা। শূন্য বাড়িতে কিছু না থাক, সোনা আছে, দানা আছে, আর আছে স্মৃতির স্তূপ। মনের ঝুলিতে ভরে স্মৃতি বহন করা যায়, পার্থিব সম্পদের জন্যে সিন্দুক চাই, তালা চাই।
ক্রমশ ব্যবধান বাড়ছে। মোড়ের মাথায় এসে বাড়িটার দিকে তাকালুম। বিমর্ষ ইটের স্থূপ রোদে পুড়ছে। মাথার ওপর শরতের নীল আকাশ। সাদা ভেলার মতো ভাসছে মেঘখণ্ড। পায়রা উড়ছে চিকচিক করে। আমার বাড়ি। যতই এগোচ্ছি, ততই যেন লোভ বাড়ছে। অসংখ্য অদৃশ্য হাত পেছন থেকে টানছে। দশ কাঠা জমি, বাড়ি, চল্লিশ ভরি সোনা, ষাট-সত্তর হাজার নগদ টাকা, কোম্পানির কাগজ, আমার চাকরি, পদোন্নতি, দেরাদুন। সাবুগাছ লাগানো সেই বাড়িতে একটি মেয়ে। মুকু যার নাম। আজ বললে কালই যে জলে নামতে প্রস্তুত। আবার ওই আংটা থেকে দোলার চেন নেমে আসবে। নির্জন শ্মশানসম বাড়িতে কচি প্রাণের ক্রন্দন শোনা যাবে। চুড়ির জলতরঙ্গ বেজে উঠবে। রং-বেরঙের শাড়ি ঝুলবে। চুলে চিরুনি চালাবার দীর্ঘ শব্দ শোনা যাবে, ঝাউয়ের ডালে নীল সমুদ্রের বাতাসের মতো। আমার তো ভোগই হল না, ত্যাগ হবে কী করে! আমার লোটাকম্বলটি নিয়ে গেলেন যিনি পারেন তিনি। আমি হাঁটছি, হেঁটেই চলেছি, উদ্দেশ্যহীন হাঁটা। মনের প্রান্তরে খুলে গেছে দুটি পথ, ডান দিক গেছে স্বামী নির্মলানন্দের দিকে বৈরাগ্যের পথ, বাঁদিক গেছে সেই সাবুগাছ-ঘেরা মনোহর নিকেতনে। সেখানে আছে জীবনসঙ্গিনী। মন, তুমি বামাচারী হবে! মুকুকে রেখে তুমি তো ভারত ছুঁড়ে পিতৃদেবকে খুঁজে আনতে পারো। দেবসেবা, পিতৃসেবা দু’হাতে চালাতে পারো।
ঠাকুর বলেছেন, না পলাশ! তাকে জেনে– এক হাত ঈশ্বরের পাদপদ্মে রেখে আর এক হাতে সংসারের কার্য করো। যেকালে যুদ্ধ করতেই হবে, কেল্লা থেকেই যুদ্ধ ভাল। তোমরা ত্যাগ কেন করবে? বাড়িতে বরং সুবিধা, আহারের জন্য ভাবতে হবে না। সহবাস স্ব দারার সঙ্গে তাতে দোষ নেই। শরীরের যখন যেটি দরকার কাছেই পাবে। রোগ হলে সেবা করার তোক কাছে পাবে। জনক, ব্যাস, বশিষ্ঠ জ্ঞানলাভ করে সংসারে ছিলেন। এঁরা দু’খানা তরবারি ঘোরাতেন– একখানা জ্ঞানের, একখানা কর্মের।
তা হলে! আমার দশ কাঠা জমি, রাস্তার ধারের বাড়ি, চল্লিশ ভরি সোনা, হার্ড ক্যাশ সত্তর হাজার, কোম্পানির কাগজ! জ্ঞান-সূর্যের উদয়ে, পিতৃদেবের অভিমান-শিশির উবে যাবেই। তিনি জ্ঞানী, হঠকারী নন। ফিরে তিনি আসবেনই, সংসারের টানে। অপেক্ষা করে দেখতে দোষ কী? হঠকারিতার আর এক নাম মূর্খতা।
বেশ, তা হলে তাই হোক। মুকুকে এনে কয়েকদিন পাহারায় রেখে, আমি অনুসন্ধানে বেরোই। চমৎকার সিদ্ধান্ত! মনের কথা শুনতে হয়! মনই তো ঈশ্বর! তা হলে বাঁ দিকেই ঘুরি।