2 of 3

১.৭২ যে কথা ফোটে না গানে

যে কথা ফোটে না গানে
বুঝি তাহা সুরে,
যে ছবি ফোটে না রঙে
ফোটে তা রেখায়।

সিঁড়ির ধাপে পা রাখতেই এসরাজের সুর উঠল। বাগেশ্রীর ধরতাই। বড় সুন্দর ধরেছেন, যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে। সুরের টানে শূন্য বাড়ি যেন কেঁদে উঠছে। আরও দু’ধাপ উঠতেই নাকে একটা সুন্দর গন্ধ এসে ঢুকল। এমন একটা কিছু রান্না চেপেছে, যাতে ঘি আছে, গরমমশলা আছে। বুকের কাছে বলাইবাবু খোলে ঢুকে পড়েছে।

সেই হলঘর। একটি মাত্র আলো জ্বলছে। যে-ঘর একসময় গাইয়ে, বাজিয়ে আর শ্রোতায় ভরে থাকত সেই ঘরে একপাশে ছোট্ট একটি জাজিম পেতে পিতৃদেব এসরাজ নিয়ে বসেছেন। দক্ষিণের জানলা দিয়ে বাতাস ঢুকছে। দেয়ালে ক্যালেন্ডারের পাতা উড়ছে। মেঝেতে বলাইবাবুকে রাখতেই গুটিগুটি এগিয়ে চলল পাতা জাজিমের দিকে। বেশ সংগীতরসিক হয়ে উঠেছে।

বাজাতে বাজাতে চোখ খুলে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, সব হল?

বুকটা কেমন যেন হুঁত করে উঠল। সব হল, মানে? যা হল, সে হওয়া তো ওঁর আশঙ্কাকেই। সমর্থন করে। ভেতরে ভেতরে হয়তো এমন শক্তি অর্জন করে বসে আছেন, যাকে বলা চলে থার্ড আই। গাড়ির পেছনের আসনের মাথার ওপর দুটি অদৃশ্য চোখ। ভাবতেই ভেতরটা আবার কেঁপে উঠল।

কাঁপাকাঁপা গলায় বললুম, আজ্ঞে হ্যাঁ।

বেশ।

বেশ, বলে মাথা নাড়লেন। এসরাজ বাজতে লাগল, সব যে হয়ে গেল কালো।

সামনে গিয়ে বসার সাহস হল না। নিজেকে বড় অশুচি মনে হচ্ছে। যেন নিজেকে সৎকার করে শ্মশান থেকে ফিরে এলুম। রান্নাঘরই ভাল। নির্জনে উনুনের ওপর ছোট্ট একটি হাঁড়িতে খিচুড়ি ফুটছে। বড় মধুর সুবাস। বহুদিন পরে পিতৃদেব আবার রন্ধনের হাত খুলেছেন। আহা! মাতামহ নেই। সমঝদার চলে গেছেন। খিচুড়ি বড় প্রিয় বস্তু ছিল। প্রিয় ছিল মোহনভোগ। আর ছিল তেলেভাজা। রান্নাঘরের চারপাশে তাকিয়ে কাকিমার অনুপস্থিতি প্রথম অনুভব করলুম। বিশাল এই জগতে নিঃসঙ্গ এক মহিলা ক্রমশই দূর থেকে দুরে অনিশ্চিত এক পরিবেশের দিকে এগিয়ে চলেছেন। আবার নতুন করে সকলের মন জয় করতে হবে। নিজের সংসার আর পরের সংসারে অনেক তফাত। এই যাওয়ার ব্যাপারে আমার কথা বলা অনুচিত হয়েছে। কেন আমি সব তছনছ করে দিলুম? বলা যায় না, ওই নারীপাগল মামাশ্বশুর হয়তো খুঁজে খুঁজে ওইখানেই গিয়ে হাজির হবেন। পাশে দাঁড়াবার মতো আমাদেরও আর কেউ রইলেন না। মাতামহ তার রাজসিকতা নিয়ে আর এগিয়ে আসবেন না। মাতুল প্রবাসী। প্রতিবেশীরা ঈর্ষাপরায়ণ।

এসরাজ থেমে গেল। পিতা উঠে এলেন।

কী, খুব খিদে পেয়েছে?

আজ্ঞে না।

বিকেলে কিছু খেয়েছিলে?

একেবারে সরাসরি দুম করে মিথ্যেই বললুম, আজ্ঞে না।

তা হলে তো খিদে পাওয়া উচিত। এই তো তোমার খাবার বয়েস। আজ আর বেশি হ্যাঁঙ্গাম করলুম না, বুঝলে? লাগিয়ে দিলুম ডালেচালে। অনেকদিন রাঁধিনি, জানি না কী বস্তু দাঁড়াল!

দারুণ গন্ধ বেরিয়েছে।

গন্ধ কিন্তু ভাল রান্নার পরিচয় নয়। ঘি আর গরমমশলা, অনেকটা কীরকম জানো, ধাপ্পামারা মানুষের মতো। মুখে না দিলে বোঝা যাবে না। টেস্ট অফ দি পুডিং ইজ ইন দি ইটিং।

খিচুড়ির হাঁড়িতে পিতৃদেব হাতা চালাতে লাগলেন। তলা ধরে গেলে সব বরবাদ হয়ে যাবে। দেয়ালে ছায়া নাচছে। হাতাটা হাঁড়ির মুখে শুইয়ে রেখে পিতা বললেন, বাড়ি একেবারে পরিষ্কার, কী বলে?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

কোথা থেকে উড়ো সব ঝামেলা এসে তালগোল পাকিয়ে দিয়ে চলে গেল। একেই বলে গ্রহ। আবার সেই পুনর্মুষিক ভব। পিতা আর পুত্র। তুমি এখন সুখী তো?

সুখী?

প্রশ্নকে প্রশ্ন দিয়ে ঠেকালুম। সুখী কি না, অত সহজে বলা চলে। দুঃখের অভাব যদি সুখ হয়, তা হলে সুখী! এইবার মনে হয় একটি সত্য কথা বলছি, আজ্ঞে সুখী কি না বলতে পারব না।

কেন? অশান্তির কারণ তো সব চলে গেছে। এখন আমরাই তো একচ্ছত্র নৃপতি।

বড় ফাঁকা হয়ে গেল না!

সেইটাই তো আমাদের পরিবেশ!

সইয়ে নিতে কয়েকদিন সময় যাবে।

তা ঠিক! আমরা বড় জড়িয়ে পড়েছিলুম। ধীরে ধীরে নিজেদের হারিয়ে ফেলছিলুম। একেই বলে মন না মতিভ্রম। তুমি ঠিকই বলেছ, সংসার আমাদের ধাতে সইবে না। আমরা বেশ পুরোমাত্রায় একলফেঁড়ে হয়ে উঠেছি। আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর। হয় এইভাবেই আমাদের কাটাতে হবে, না হয় সন্ন্যাসীর ভেক ধরতে হবে।

ভেক বলছেন কেন?

না, রেগে যেয়ো না। তোমার কথা আমি বলিনি। আমি আমার কথা বলছি।

আপনি বিকেলেও আমাকে প্রায় একই কথা বলেছেন। অনেকটা চ্যালেঞ্জের মতো। আমার দ্বারা ভাল কিছুই কি করা সম্ভব নয়।

শোনো শোনো, ভাল কিছু এক জিনিস, আর স্বভাববিরুদ্ধ আর এক জিনিস। তোমাকে আমি যতটা চিনি, তুমি নিজেই হয়তো নিজেকে ততটা চেনো না! ছেলেবেলা থেকে শিবরাত্রির সলতের মতো তোমাকে আগলে আগলে মানুষ করা হয়েছে অনেকটা তুলোয় রাখা আঙুরের মতো করে। প্রকৃতি থেকে তুমি বিচ্ছিন্ন। ঝড় উঠলে ভয় পাও, বিদ্যুৎ চমকালে বালিশে মুখ গোঁজো। সামান্য। আরশোলা দেখলে নৃত্য করো। তুমি কেমন করে সব ছেড়ে সন্ন্যাসী হবে! মহাপুরুষদের জীবনী পড়ে দেখো, তারা কেউ আদুরে ছিলেন না। ওই তো বইয়ের র‍্যাকে গোপীনাথ কবিরাজজির লেখা। বিশুদ্ধানন্দ পরমহংসজির জীবনী রয়েছে, পড়ে দেখো। গেরুয়ায় সন্ন্যাস নেই, সন্ন্যাস আছে মনে।

কে যে কখন কী করে ফেলতে পারে, তা কি আগে থেকে বলা যায়!

পিন্টু, সে হল হঠকারিতা। হঠাৎ খুন করা যায়, আত্মহত্যা করা যায়, হাততালির লোভে ছোটখাটো বীরত্ব দেখানো যায়, নামের লোভে দাতা হওয়া যায়, সন্ন্যাসী হওয়া যায় না। আবার বলি পূর্বজন্মের অসীম সুকৃতি ছাড়া সন্ন্যাসী হওয়া অসম্ভব। তর্ক করে লাভ নেই, তিক্ততা বাড়বে। তৈরি হয়ে নাও, ঠান্ডা হয়ে যাবার আগেই খেতে বসতে হবে।

নীরবে আহারপর্ব শেষ হল। আজ আর পরিবেশনের ঘটা নেই। নানারকম পদ নেই। বেগুনভাজা আর খিচুড়ি। চোখে পড়ছে মাতামহের খড়মজোড়া। একটি জলচৌকির ওপর সযত্নে রক্ষিত। বারান্দার তারে ঝুলছে কাকিমার শাড়ি। সারাবাড়ি স্মৃতিতে স্মৃতিতে ছেয়ে আছে। স্মৃতিই বেদনার উৎস।

রান্না অতি উপাদেয় হয়েছিল। এমন মানুষ যে-কোনও মহিলাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেন। সূক্ষ্ম সেলাই, রিপু, ফ্যান গালা, বাটনা বাটা, কুটনো কোটা, সবই জানেন। এমন জানেন যার কোনও তুলনা হয় না। মাতামহ থাকলে এতক্ষণ প্রশংসায় প্রশংসায় বাড়ি মাত করে দিতেন। সব ফাঁকা। সব ধুস হয়ে গেছে। কয়েকটি ব্যবহৃত জিনিস মাত্র পড়ে আছে। পাটকরা একটি গামছা। কীটদষ্ট একটি বই। সিন্দুকে কী আছে খুলে দেখা হয়নি। আমি নিজে কোনওদিন খুলবও না। খুলতে হলে মাতুলের সামনেই খুলব।

পিতৃদেব বললেন, সারাদিন খুব খাটাখাটুনি করেছ, এইবার শুয়ে পড়ো। আমি আমার পুরনো অভ্যাসটা আবার ফিরিয়ে আনি। একা একা রাত জাগা। কত কী পড়ার রয়েছে! জমে জমে পাহাড় তৈরি হয়েছে।

টেবিলে আলোর সামনে গিয়ে বসলেন। একদিকে থাক থাক বই, আর একদিকে ছোট বড়। নোটখাতা। মাঝে একফালি কাঁচে-ঢাকা জায়গা। আজ আর আমার লেখাপড়ার মেজাজ নেই। শুয়ে শুয়ে চোখের সামনে দেখছি অনন্ত আকাশ। তারার ফুল ছড়িয়ে আছে। সামনে পড়ে আছে জীবনের অনন্ত পথ। কনকের কথা মনে পড়ছে। সে ঠিকই করেছে। আমার দুর্বলতাকে আদৌ পাত্তা দেয়নি। দিলে বিপদেই পড়ত। যে নিজে চলতে পারে না, সে অপরকে চালাবে কী করে! মুকু মনে বড় টোল ধরিয়েছে। কী সব ঘটছে জীবনে? আগামীকাল আমি অফিসফেরতা স্বামী নির্মলানন্দের কাছে যাব। য পলায়তি স জীবতি। আর এখানে নয়। ওই কাকিমা অবশ্যই আবার ফিরে আসবেন। পিতার এই নিঃসঙ্গতা অবশ্যই ঘুচে যাবে। সংসার কারুর জন্য বসে থাকে না। সব যেমন চলার তেমনি চলে। মায়ের অভাবে পিতার জীবন তো কই অচল হয়নি! আমার অভাব, অভাব বলেই মনে হবে না। কর্মী মানুষ, কাজে কাজেই ঠিক চালিয়ে দেবেন। কিন্তু আমি কীভাবে ছেড়ে থাকব! যেখানেই যাই। মন যে আমার কাদবে। মুকুর কথার কোনও মাথামুন্ডু নেই। মুকু আমার মা হবে, সৎ মা! সত্যিই যদি হয়, আমার আর কোনও পিছুটান থাকে না। অপরিসীম ঘৃণায় বৈরাগ্যের পথ পরিষ্কার হয়ে যায়। তা কি আর হবে? ঘটনা আমাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে পথে নামাবে না। আমাকেই নামতে হবে। ধাক্কা মেরে।

চোখ কখন বুজে এসেছিল জানি না। গভীর রাতে এসরাজের সুর শুনেছিলাম মনে হয়। জয়জয়ন্তী বেজেছে কেঁদে কেঁদে। মুখে যা প্রকাশিত হয়নি, হয়েছে সুরে সুরে। ধড়মড় করে বিছানায় যখন উঠে বসলুম, তখন যথেষ্ট বেলা হয়েছে। এভাবে কোনওদিন তো ঘুম ভাঙে না। কে। যেন ঠেলা মেরে উঠিয়ে দিল। অনেকটা হাত ধরে ঠেলে তুলে দেবার মতো করে। আলোয় চোখ ক্রমশ সয়ে এল। বাইরে কাকের কর্কশ চিৎকার। বালিশের পাশে পোস্টকার্ডের মতো ছোট্ট একটা কী পড়ে আছে। প্রথমে ভেবেছিলুম, জানলা দিয়ে আসা রোদের টুকরো। না, তা তো নয়! মুক্তোর মতো কয়েকটি অক্ষর ভাসছে। তুলে চোখের সামনে ধরলুম। সাতসকালে চিঠি ডেলিভারি হল বিছানায় বালিশের পাশে। কে সেই পিয়ন।

একটি মাত্র লাইন, লোহা গরম থাকতে থাকতেই হাতুড়ি মারা উচিত। হরিশঙ্কর।

তার মানে? এ কথার অর্থ কী! কোথায় তিনি? আমার সমস্ত শরীরে ঝাঁকুনি মেরে কে আমায় জাগাল? আমার কোনও আতঙ্ক! মশারি তুলে তাড়াতাড়ি নামতে গিয়ে পা জড়িয়ে টান লেগে একপাশের ফিতে ছিঁড়ে গেল। মুখ থুবড়ে পড়ে যাইনি এই আমার ভাগ্য!

টেবিলের আলো তখনও জ্বলছে। রাত-জাগা পাণ্ডুর রুগির মতো। বইপত্র সামান্য এলোমেলো। আলো না নিবিয়ে টেবিল ছেড়ে উঠে যাবার মানুষ তো তিনি নন। তাঁর জগৎ তো কারণ-জগৎ। কার্য ছাড়া কারণ, কারণ ছাড়া কার্য হয় না। অকারণে আলো জ্বলুক, এ তো তিনি চাইবেন না। বিছানায় শুয়েছিলেন বলে মনে হয় না। চাদর টানটান। মশারি ফেলে চারপাশ গুঁজে রেখেছিলেন, সেইভাবেই গোঁজা রয়েছে, টেনে খোলার চিহ্ন নেই। মাতামহ যে-ঘরে জীবনের শেষ ক’টা দিন কাটিয়ে গেলেন, সে ঘরের দরজা খুললেই, সুন্দর অপার্থিব একটা গন্ধ নাকে এসে লাগে। এ ঘরেও তিনি নেই। বিছানার ওপর একটি ফুল পড়ে আছে। চাঁদরের মাঝখানে। রান্নাঘর শূন্য। বিভিন্ন খাদ্যবস্তুর চাপা গন্ধে গুমোট হয়ে আছে। শুকনো, খসখসে, স্নেহহীন মেঝে। কোনও কোনও জায়গা চাটনি কিংবা টক পড়ে সাদা সাদা হয়ে গেছে। এই ঘরে কনক বেঁধে গেছে, এখন সে কার ঘরনি। কাকিমা তাঁর নতুন গন্তব্যস্থলে এতক্ষণে মনে হয় পৌঁছে গেছেন। বাথরুমের দরজা বন্ধ। দরজা খুলতেই ভস করে একটা বন্দি হাওয়া বেরিয়ে চলে গেল। ঘষা কাঁচ লাগানো পুবের জানলায়। রোদ এসে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে।

দোতলার সব দেখা হয় গেল। কোথাও তিনি নেই। অথচ মনে হচ্ছে আছেন। ধূপের গন্ধের মতো। এইমাত্র জ্বলছিল। জ্বলতে জ্বলতে নিবে গেছে। শেষ ধোঁয়া এখনও যেন বাতাসে সরু সুতোর মতো পাক খাচ্ছে। ছাদের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে উঠতে আর একবার ভাবার চেষ্টা করলুম, কী হতে চলেছে? কী মানে ওই লাইনটির? ইংরেজিরই বাংলা তর্জমা, স্ট্রাইক হোয়াইল দি আয়রন ইজ হট। কোন লোহা? কে লোহা? মশারি তুলে বালিশের পাশে একটি কার্ড ফেলে রেখে তিনি গেলেন। কোথায়! এ আবার কী ধরনের রসিকতা! ভোরবেলা বাজার? জীবনে যাননি। মর্নিং ওয়াক! ওসব শৌখিন ব্যাপারে আদৌ অভ্যস্ত নন।

খোলা ছাদ চারপাশে দৌড়োদৌড়ি করছে। ঝলমলে পৃথিবী সকালের বাতাসে দু’বাহু তুলে যেন নাচছে। আলোয় আলোকিত। সেই পায়রার ঝক উড়ছে পুব আকাশে ঘুরে ঘুরে। একটা-দুটো পাখি খুব নিচু দিয়ে ফুড়ত করে উড়ে গিয়ে এ গাছ থেকে ও গাছে গিয়ে বসছে। দিন এল বলে প্রকৃতিতে যেন শোরগোল পড়ে গেছে। আশা ছিল, হয়তো পিতৃদেবকে দেখব পরিচিত ভঙ্গিতে। সার সার ফুলগাছের টবের সামনে উবু হয়ে বসে আছেন। শীত আসছে। ফুল আসবে। ছাদ ফাঁকা। প্রতিবেশীরা জেগে উঠেছেন। কলরব কানে আসছে। জলের বালতি জোরে বসাবার ধাতব শব্দ। এক মহিলা রোদের আলসেতে হলদে শাড়ি মেলছেন পরিপাটি করে। মাটি খোঁড়ার যন্ত্রটি একপাশে পড়ে আছে। কালো পিঁপড়ের দল ভীষণ ব্যস্ত। মিছিল করে এগিয়ে চলেছে টবের পাশ দিয়ে দিয়ে। গাছের পাতা থেকে কাণ্ড থেকে এক ধরনের তিক্ত গন্ধ বেরোচ্ছে। বড় পরিচিত। গন্ধে যেন কীসের খবর ভাসছে। পুজো প্রায় এসে গেল। শিশিরের কাল আসছে। মাটির গভীরে, কোন অদৃশ্য লোকে কুঁড়ি জাগছে, এইবার তার মুখটি উঁকি দেবে পাতার ফাঁকে। পাশের নিমগাছ থেকে চকচকে দুটি কাঠবেড়ালি নেমে এসেছে। আলসে বেয়ে ন্যাজ তুলে ছুটছে।

শূন্যতার আঘাত এই প্রথম উপলব্ধি করলুম। কিছু না-থাকা যে কত বড় শাস্তি! পাখিদের কি এরকম মনে হয়! আতঙ্ক হয়! ভেতরটা কেমন যেন করে উঠল! মৃত্যু সুস্পষ্ট একটা আঘাত। তবু সহ্য করা যায়। প্রাণ না থাকলেও সামনে একটা দেহ পড়ে থাকে। মৃত্যুর সঙ্গে জীবনের অনেকদিনের বোঝাঁপড়া। মনের একটা প্রস্তুতি আছে। কিন্তু শূন্যতা! রহস্যময় অনুপস্থিতি! বুকটা ধক করে ওঠে। ভীষণ আচমকা একটা আঘাত। সামলাতে কষ্ট হয়।

উদ্বেগ চেপে আবার নীচে নেমে এলুম। অসম্ভব রাগে শরীর জ্বলছে। পৃথিবীটা ক্রমশই যেন নাটুকে হয়ে উঠছে। একজন প্রৌঢ় মানুষ হঠাৎ এমন নাটকীয় হয়ে উঠলেন কেন? পুত্রের সঙ্গে মজা করছেন! অন্ধকার একতলায় চুঁইয়ে চুঁইয়ে দিনের আলো ঢুকেছে। অন্ধকারের স্তরে কোথাও এখনও একটা ঝিঁঝি ডাকছে থেমে থেমে। রাত যে ভোর হল, সে খবর এখনও পায়নি। কাকিমা যে-ঘরে রাঁধতেন, সেই ঘরে খুটুস খাটুস করে এক ধরনের শব্দ হচ্ছে। ইঁদুররা ফিরে এসেছে আবার। ঝিঁঝি থামলেই চারপাশ থেকে অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা ফিরে আসছে। চিড়-খাওয়া সদর দুয়ার বাতাসে কাঁপছে। একপাশে প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে খিল। আর কোনও সন্দেহ নেই। যতই খুঁজি না কেন, এ গৃহে তিনি নেই। দরজার বাইরে রাজপথ। এক বাহু পশ্চিমে চলে গেছে গঙ্গায়, আর এক বাহু পুবে, প্রসারিত অনির্দেশ যাত্রায়। আমি এখন কী করি!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *