I am no prophet
and here is no great matter
I have seen
the moment of my greatness flicker
দুন এক্সপ্রেস স্টেশন ঝাড়পোঁছ করে নিয়ে চলে গেল। দু-একজন পোর্টার আর রেলকর্মী ছাড়া আর কেউ পড়ে রইল না। আমরা দু’জনে পাশাপাশি হেঁটে স্টেশনের বাইরে গিয়ে দাঁড়ালুম। আজ খুব হাওয়া ছেড়েছে। চুল উড়ছে। শাড়ির আঁচল উড়ছে। সুবাস উড়ছে। কোথা থেকে এই ওমর খৈয়ামের রাত এল শহরে!
প্রায়-শূন্য ট্রাম চলেছে এঁকেবেঁকে, ঘণ্টা বাজিয়ে। একটা-দুটো ট্যাক্সি পড়ে আছে শেষ যাত্রীর অপেক্ষায়। পাঞ্জাবি ড্রাইভার বনেটে হেলান দিয়ে সিগারেট টানছে অলসভাবে। কাঠের গোল ড্রামের ওপর নিঃসঙ্গ পুলিশ। শহর এবার শুয়ে পড়বে।
কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে মুকু আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তার অনাবৃত ওপর-বাহু আমার হাত স্পর্শ করছে। পাথরের মতো শীতল। ভেতরে যার আগুন জ্বলছে তার আধার কী করে এমন স্নিগ্ধ হয়! মানব শরীর ঈশ্বরের এক অদ্ভুত সৃষ্টি! একই সঙ্গে গদ্যময়, কাব্যময়। জলে যেন। আগুন জ্বলছে। কেবলই মনে হচ্ছে, এ রাত যেন শেষ না হয়। ভেতরে এক পূর্ণতার ভাব : আসছে। অর্ধাঙ্গ যেন পূর্ণাঙ্গ হয়ে গেছে। মনের সঙ্গে মনের লড়াই চলেছে। আচ্ছা, তন্ত্রে তো প্রকৃতি নিয়ে সাধনার ইঙ্গিত আছে! ইঙ্গিত কেন, নির্দেশ আছে। পঞ্চ মকার ছাড়া তন্ত্রসাধনা হবেই না। তন্ত্রের পথও তো সাধনার পথ, ঈশ্বরলাভের পথ। মুকু তো আমার ভৈরবীও হতে পারে। যার চুল কোঁকড়া, গুরুনিতম্ব, সে তো আদর্শ ভৈরবী। কিন্তু তন্ত্র যে বলছে শ্যামা রমণী না হলে ভৈরবী করা যায় না! ও ওরকম বলে! গাত্রবর্ণে কী এসে যায়! আসল বর্ণ তো মনে! কবি বলেছেন, ওপরে যত কালো আর ধলো, ভেতরে সবার সমান রাঙা। আচ্ছা, আমিই বা এত ঈশ্বর ঈশ্বর করছি কেন? দেরাদুনে একটা প্রোমোশন নিয়ে চলে যাবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। আমাদের লাইনে অভিজ্ঞতা যত বাড়বে, মাইনেও তত বাড়বে। ফ্রি কোয়ার্টার। চিফ হলে গাড়ি। মুকুকে বগলদাবা করে নিয়ে গেলেই তো হয়। ওপাশে হরিদ্বার, এপাশে অরণ্য, মাথার ওপর মুসৌরি।
মুকু হঠাৎ দু’হাতে আমার ডান হাত ধরে ঝুলে পড়ল। মাথাটা আমার ডান কাঁধে। আর একটু হলেই কেতরে পড়ে যেতুম। কোনওক্রমে সামলে নিলুম।
তখন থেকে কী দুষ্টুমি করছ বলল তো!
মুকু হিহি করে হেসে বললে, শীত করছে। কেন বলো তো! জ্বর এল নাকি!
তোমার গা বরফের মতো ঠান্ডা।
শীত কেন করে আমি জানি। স্নায়ুর শিহরনে মনে হয় জ্বর আসছে। আমি যে পুরুষ, এ প্রমাণ পেয়ে বড় ভাল লাগছে। আগুন যদি আগুন লাগাতে না পারে, তা হলে সে তো জোনাকি। আলো
আছে, দাহিকা শক্তি নেই। আমারও একদিন শীতে এইরকম গা কেঁপে উঠেছিল। সে রাতের কথা এখনও ভুলতে পারিনি।
মুকু বললে, অনেক রাত হয়ে গেল। হস্টেলে ঢুকতে দেবে তো!
তোমার হস্টেল তুমিই জানো। না দেয়, আমাদের বাড়িতেই থাকবে।
মেসোমশাই আজ কেমন যেন হয়ে আছেন! প্রথমে বেশ ভালভাবেই কথা বলছিলেন, হঠাৎ কী হল উঠে চলে গেলেন।
মাঝে মাঝে উনি ওরকম হয়ে যান, এতক্ষণে ঠিক হয়ে গেছেন। তুমিই তো একটু আগে কী সব বলছিলে? তুমি গিয়ে সামলাবে।
তোমাকে তো তা হলে আমায় মা বলে ডাকতে হবে। পারবে?
তোমার মাথায় একটা গাঁট্টা মারব।
মুকু হিহি করে হেসে উঠল। পাশ দিয়ে একজন রেলের ভদ্রলোক যাচ্ছিলেন, ঘুরে তাকালেন। নাঃ, মুকুকে আর খোলা জায়গায় বেশিক্ষণ রাখা যায় না, বিপদের সম্ভাবনা আছে। মেয়েদের সাহস মানে দুঃসাহস। জবাকে মনে পড়ছে। স্রেফ একটা সায়া আর ছোট্ট একটা ব্লাউজ পরে পাঁচিল টপকে আমাদের ছাদে পালিয়ে এল। সুখেনের এত টান! এই টানটাকে নিজের মধ্যে এনে যদি ঈশ্বরকে টেনে আনতে পারতুম, তা হলে নিজের সঙ্গে এই দোটানায় পড়তে হত না।
মুকু বললে, আমার আর ট্রামেবাসে চাপতে ইচ্ছে করছে না, একটা ট্যাক্সি করো।
তুমি খুব এক্সপেনসিভ।
জানো আমার কোষ্ঠীতে কী আছে, বড়লোকের বউ হব।
সে যবে হবে তবে হবে। আগে লেখাপড়া শেষ করো। অত বউ হব বউ হব করছ কেন?
নিজেকে তৈরি করছি।
থাক আর তৈরি করতে হবে না। তৈরি হয়েই আছ।
কথাটার মধ্যে অশ্লীল একটা ইঙ্গিত আছে।
শব্দটা তুমিই প্রথম বলেছ।
আমার মানেটা ছিল অন্যরকম, তোমার মানেটা একটু যেন কেমন কেমন!
তোমার আজ কী হয়েছে বলো তো?
ভূতে ধরেছে।
সে ভূত কি আমি?
তুমি ভূত হতে যাবে কেন? তুমি ভগবান।
পাঞ্জাবি ড্রাইভার ট্যাক্সির পেছনের দরজা খুলে দিল। মুকু আগে ঢুকল, পরে আমি। আমার আসনে তার আঁচল বিছিয়ে আছে। কী যে হয়েছে কে জানে! কোনও দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। মেয়েদের ব্যাপার আমি কিছুই বুঝি না। শুনেছি, এই বয়েসটা খুব খারাপ। ফাঁদে পড়ার বয়স, ফঁদে ফেলার বয়েস। জয় গুরু! তুমি আমায় রক্ষা করো। এতকালের শক্ত মন থ্যাসথেসে হয়ে আসছে।
চালক মিটার-ফ্ল্যাগ নামালেন। রিনরিন করে শব্দ হল। আমাদের অন্ধকার কেঁপে উঠল। গাড়ি চলতে শুরু করেছে। হাওড়ার ব্রিজে উঠছে। গঙ্গার বাতাস যেন আরও উতলা। সারি সারি আলোের মালা মাথার ওপর দিয়ে সামনে চলে গেছে। গঙ্গার দু’কূলে আলোর খই ছড়িয়ে আছে।
মুকু ডান দিকে, আমি বাঁ দিকে সম্মানজনক দূরত্বে। মাঝে ফুলের মতো ছড়িয়ে আছে শাড়ির আঁচল। আলোর ঢেউ খেলে যাচ্ছে। সামনে পাথরের মতো মুখ করে গাড়ি চালাচ্ছেন পাঞ্জাবি ভদ্রলোক। গঙ্গাবক্ষে আলোকিত একটি স্টিমার সাগরের দিকে চলেছে।
কঁহা যাইয়েগা জি?
কোথায় যেতে হবে মুকু?
বিবেকানন্দ রোড।
গাড়ির গতি বাড়ছে। সর্দারজি পোল থেকে নেমে ডান দিকে স্ক্র্যান্ড রোড ধরলেন। আমাদের বাঁ পাশে টাঁকশালের বিরাট বাড়ি। মুকু হঠাৎ বাঁ দিকে হেলে আমার কাঁধে মাথা রাখল।
মনে মনে বললুম, ঈশ্বর তুমি দেখো, আমি কিন্তু কিছুই করিনি। জলজ্যান্ত একটি যুবতী মেয়ে আমাকে একা পেয়ে কীভাবে প্রলুব্ধ করছে! আমিও তো মানুষ! দেবতাও নই, বৃদ্ধও নই।
মুকু আমার ডান হাতটা দু’হাতের মুঠোয় নিয়ে বললে, পলাশ, বি সিরিয়াস।
তার মানে?
মুকুর মুখে আলো পড়েছে। উলটো দিক থেকে আসা গাড়ির হেডলাইট। আমাদের চালক রেগে গিয়ে বললেন, আঁরে তেড়দেনি।
কী অর্থ কে জানে! মুকুর মুঠোর জোর বাড়ছে, পলাশ, বি সিরিয়াস। গলাটা ধরাধরা শোনাল। এ আবার কী খেলা রে বাবা! চোখে যেন জল এসেছে! এসবের অর্থ কী?
বি সিরিয়াস বি সিরিয়াস করছ, তার মানেটা কী?
তুমি আমাকে ফেরাতে পারবে না।
তার মানে?
আমি তোমার জন্যেই কলকাতায় পড়তে এসেছি। আমি আর ফিরে যাব না।
কেন মিছে কথা বলছ! তোমার কথা আমি বিশ্বাস করি না।
মুকু আমার শার্টের বুকের কাছটা খামচাতে লাগল, কী করলে বিশ্বাস করবে?
বড় কঠিন প্রশ্ন। সত্যিই তো, কী করলে আমি বিশ্বাস করব!
মুকু বললে, আমি আমার বাবাকে ঘৃণা করি।
কী যা তা বলছ? বাবাকে ঘৃণা করো বলে আমাকে, আমার মতো অপদার্থ একটা ছেলেকে ভালবাসতে হবে?
আমার বাবাকে তুমিও ঘৃণা করো, আর সেইজন্যে তুমি আমাকেও ঘৃণা করো।
আগে করতুম, আজ এই মুহূর্ত থেকে আর করি না।
আমি তোমাকে প্রথম থেকেই ভালবাসি পলাশ। সত্যিই বাসি।
মুকুর গলা ভেঙে এসেছে। ভালবাসা শব্দটা এমনিই এলানো, আরও যেন এলিয়ে গেল ভাঙা গলার গুণে।
কোনওরকমে বললুম, আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ।
তোমার ওই বইয়ের ভাষা ছাড়ো। ওতে মন ভরে না। কাম আউট পলাশ। তুমি বেরিয়ে এসো।
এ কি নাটক হচ্ছে? চলমান মঞ্চে! এমন নাটক করে যদি ভালবাসতে হয়, বেসে কাজ নেই। ঘৃণা অনেক বেশি বাস্তব! আমার জামা খামচে ধরা মুকুর হাত ক্রমশ শিথিল হয়ে এল। শরীরে শরীর এলিয়ে পড়ল। আমার দক্ষিণ অঙ্গ এখন মুকুর দখলে। বেশবাস বিভ্রস্ত। দীর্ঘনিশ্বাস পড়ছে। চুল উড়ে উড়ে এসে চোখেমুখে লাগছে। কী আর করি! তার পিঠের পেছন দিয়ে আমার ডান হাত প্রসারিত করে, ডান হাতের তলা দিয়ে হাত ঘুরিয়ে মুকুর শরীরকে ঘনিষ্ঠ করে নিতে হল। সামান্য শিহরন খেলে গেল মুকুর শরীরে। জানি আমার এ সাহস দুঃসাহসেরই সামিল, কিন্তু উপায় নেই। ডাকে সাড়া না-দেওয়া এক ধরনের উপেক্ষা। মেয়েরা বড় অভিমানী হয়। তা ছাড়া শরীরের যখন যে-অঙ্গ কাজ করে, তখন সেই অঙ্গের আলাদা একটা মগজ তৈরি হয়। মিটারের যেমন সাবমিটার! মেন লাইনের যেমন এক্সটেনশন লাইন। পা যখন লাথি মারে, পায়ের একটা মগজ হয়। হাত যখন কিছু স্পর্শ করে হাতের একটা মগজ হয়।
মানুষের আবেগ বাঁধ বাধা নদীর মতো। জল কেবলই পথ খোঁজে, কোথায় একটা ছিদ্র পাওয়া যায়। ধীরে ধীরে চাপ বেড়ে একসময় বাঁধের দেয়াল চৌচির হয়ে যায়। এতদিন জমে থাকা মুকুর আবেগ বন্যার জলের মতো তেড়ে বেরিয়ে এল। সমস্ত শরীর যেন দুমড়ে মুচড়ে উঠছে। আমি না জেনে বড় স্পর্শকাতর স্থানে হাত দিয়ে ফেলেছি। এ যন্ত্রণা, না সুখ! হাতখানেক ব্যবধানে অপরিচিত একজন মানুষ। পাথরের মতো মুখ করে গাড়ি চালাচ্ছেন। আলোর ঝটকা আসছে, চলে যাচ্ছে। মুকু পা দিয়ে আমার পা খুঁজছে। ভুলে গেছে আমরা বসে আছি ট্যাক্সির পেছনের আসনে।
মুকুর মাথা এখন কাঁধ ছেড়ে আমার বুকে নেমে এসেছে। আমি ভাবতেই পারছি না, রক্তমাংসের এক যুবতী আমার বক্ষলগ্না! যে-ইচ্ছা কল্পনায় উঁকি মেরে যেত, রাতের স্বপ্নে এসে ঘুরপাক খেত, তা এখন বাস্তব। ঈশ্বরলাভ হলে কী হয় আমার জানা নেই। তুলতুলে যুবতীলাভ হলে যা হয়, তা যার হয় সেই জানে। মনে হচ্ছে স্বর্গে ভেসে চলেছি পুষ্পক রথে। বৃষ্টি থেমে যাবার পর গাছের ডালে বসে দোয়েল যেরকম পুচ্ছ তুলে ডাকে আর নাচে, আমার মনও যেন বুকের কাছে সেইভাবে নাচছে। খোঁপা হয়ে ভেঙে পড়ছে। দেহ হয়ে দেহের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। কোথায় আমার তীর্থ বারাণসী! কোথায় আমার পিতৃদেব! কোথায় আমার মৃত মাতামহের জন্যে শোকাকুল মন! সব এই দেহে নিমজ্জিত! চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি পথ ঘুরে যাচ্ছে। হিমালয় সরে যাচ্ছে।
মুকু বললে, আমি আর কিছুতেই বাবার সংসারে ফিরে যাব না পলাশ। তুমি তোমার বাবাকে বলো।
মুকু, তিনি তোমার গুরুজন।
গুরুজন? তুমি জানো, তিনি কী ধরনের নোংরা! তুমি ছেলেমানুষ, সেসব কথা তোমাকে বলা যাবে না। শুধু এইটুকু জেনে রাখো, তিনি আমাকে আর পিতার চোখে দেখেন না।
তুমি যা বলছ, সেকথা আমি কেমন করে বাবাকে বলব! আমারও তো লজ্জাশরম আছে!
তুমি না পারো, আমি বলব। এতে তো অন্যায়ের কিছু নেই! আমরা তো পাপ করতে ছুটছি না! তুমি শুধু অনুমতি দাও।
আজ আর ভাবতে পারছি না, আমাকে দু-একদিন সময় দাও। এত তাড়া কীসের?
তোমাকে আমি চিনি, তোমার সময় বড় দ্রুত চলে। তোমাকে এখুনি ধরতে না পারলে পিছলে যাবে।
আমি একটু ভাবি।
তোমার কি মনে হয় আমি খারাপ মেয়ে, তোমার অযোগ্য?
এ প্রশ্ন তো আমারও হতে পারে?
এর উত্তরে তোমাকে আমি একশোর মধ্যে একশো দিয়ে দিলুম।
লক্ষ্মীটি তুমি এবার সোজা হয়ে বোসো।
মুকু সোজা হয়ে উঠে বসল। খোঁপা ভেঙে পড়েছে। শাড়ির আঁচল অনেক আগেই খসে পড়েছে। নারী আর মৃত্তিকা প্রায় একই জাতের জিনিস। গাড়ি বিবেকানন্দ রোডে প্রবেশ করল। মোড়ের মাথায় একটি অলংকারের দোকান। আধপাল্লা তখনও খোলা। সোনার অলংকার পেছনের আয়না থেকে চোরা চাহনিতে তাকিয়ে আছে।
হস্টেলের প্রবেশ পথের দুপাশে দুটি সাবুগাছ প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে। গভীর বারান্দায় ফানুসের মতো আলো ঝুলছে। বাড়িটির চেহারায় সাবেক কালের গাম্ভীর্য। এক ধরনের বিষণ্ণতা লেগে আছে। গাড়ি ভাড়া বুঝে নিয়ে সোজা চলে গেল। মুকু আমার সামনে নায়িকার মতো দাঁড়িয়ে। তার দিকে তাকিয়ে মন ভবিষ্যতের ছবি আঁকছে। স্ত্রী নয়, তবু মনে হচ্ছে আমার স্ত্রী। সুন্দরী স্ত্রী যে-কোনও মানুষের গর্ব।
ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলুম, ঢুকতে দেবে তো?
হ্যাঁ দেবে।
আমি তা হলে চলি।
রোজ তোমার সঙ্গে দেখা হবে তো?
রোজ কী করে হবে?
তা না হলে আমি মরে যাব।
কীভাবে হবে?
তুমি আসবে। এসে আমার খোঁজ করবে।
দেখি।
কোনও কথাই কি তুমি স্পষ্ট করে বলতে পারো না?
তোমার কাছে আজ যা স্পষ্ট কালই যে অস্পষ্ট হয়ে যাবে না, কে বলতে পারে?
তুমি না পারো, আমি পারি। মেয়েদের কামড় কচ্ছপের কামড়ের মতো।
দুটো সাবু গাছের মাঝখান দিয়ে মুকু ধীরে ধীরে ভেতরে চলে গেল। কোথাও কেউ একজন ভীষণ জোরে জোরে কাশছে। মনে হচ্ছে এখুনি দম আটকে যাবে। সাবু গাছের পাতায় পাতায় রাতের বাতাস শাড়ির আঁচলের মতো খসখস করছে। প্রায়-জনশুন্য পথে দু’কদম হাঁটার পরেই মনে হল, আমি বড় নিঃসঙ্গ। বাড়ি ফিরে যেতেও মন চাইছে না। পিতৃদেবের একটি কথা মনে বড় লেগেছে। মুকু তো তোমার কাছে এসেছে। তার মানে? কাকিমা সম্পর্কে সমালোচনার প্রতিশোধ তিনি কি এইভাবেই নিলেন? অতটা নীচে নেমে আসার মানুষ তো তিনি নন। ওঁর যত তর্জনগর্জন সবই তো ইন্টেলেকচুয়াল লেভেলে। কী জানি? মানুষের দুর্গম অঞ্চলের কোথায় কী যে ঘাপটি মেরে বসে আছে! পৃথিবীতে এমন কোনও লিভিংস্টোন নেই যে আবিষ্কার করেন! তৃপ্তি, অতৃপ্তি, সুখ, দুঃখ, দড়ির মতো পাকে পাকে এমন জড়িয়ে আছে, এককভাবে কোনওটাই পাওয়া সম্ভব নয়। একটু আগে বেশ লাগছিল। মনে হচ্ছিল, আমি একটা মহাদেশ জয় করে ফেলেছি। এখন মনে হচ্ছে নেপোলিয়ানের মতো সেন্ট হেলেনায় চলেছি নির্বাসনে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আমি পুরোপুরি মুকুর ক্লাচে চলে গেছি। মন, সংস্কার সবকিছুই তখন নিস্তেজ হয়ে পড়েছিল। যতটা উচ্চে উঠেছিলুম তার চেয়ে ঢের নীচে নেমে গেছি। আবার আমি পরাজিত। পিতার তিক্ত কথাই সত্য হল। সন্ন্যাস আমার রক্তে নেই, সংস্কারে নেই। একবিন্দু রক্ত অণুবীক্ষণের তলায় ফেললে হয়তো চমকে উঠব। অক্টোপাসের মতো অসংখ্য প্রাণী লোভ লালসার শুড় নেড়ে নেড়ে ভোগের বস্তু খুঁজছে। কোথায় আমার সেই নির্বেদ! আজ যদি আমার কোথাও যাবার জায়গা থাকত! কিংবা, কোথায় চলে যেতে পারতুম চিরকালের জন্যে! এই নির্বান্ধব রাতের পৃথিবীতে সেই গৃহটি ছাড়া আমার আর কোনও আশ্রয় নেই। বেড়ালের মতো ঘুরে ঘুরে সেই একই জায়গায় ফিরে যেতে হবে ন্যাজ তুলে।
হেঁটেই চলেছি, হেঁটেই চলেছি। কোথায় যে যেতে চাই! যে-দিকেই যাই না কেন, বাড়ির দিকেই চলেছি। একেই বলে হোমিং ইনস্টিংক্ট। সানাইয়ের সুর ভেসে আসছে। শরবতের দোকানে রাতের লাইন পড়েছে। বরফের চাংড়ায় থলে জড়িয়ে কাঠের মুগুর পেটাচ্ছে। সুখস্বপ্ন ভেঙে যাবার মতো ঝুরঝুর শব্দ হচ্ছে। পাশ দিয়ে যাবার সময় বরফের বাতাস এসে গায়ে লাগল। ভিজেভিজে কাঠের গুঁড়ি ছড়িয়ে আছে চারপাশে।
সানাইয়ের উৎসস্থলে এসে পড়েছি। বেহাগের সুরে বিয়েবাড়ি জমে উঠেছে। সারাবাড়ির দেয়ালে লাল নীল টুনির মালা ঝুলছে। কাপড়-মোড়া টুঙির মাথায় বসে, মিহি পাঞ্জাবি পরে ওস্তাদজি সুর ছাড়ছেন। চারপাশে আলো আর ফুলের মালার ঘেরাটোপ। ছাদের ওপর বিশাল ম্যারাপ, আলোর চাঁদোয়া তুলেছে। তেরপলে মানুষের ছায়া নাচছে। হইহই উপচে পড়ছে, ফ্রাই, ফ্রাই। সামনের রাস্তাটা ভিজেভিজে। পেন্টকরা মুখ নিয়ে দু-তিনজন যুবক সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে গল্প করছে। সবচেয়ে লম্বা চওড়া স্বাস্থ্যবান যুবকটিই মনে হয় আজকের রাতের নায়ক। সিল্কের পাঞ্জাবি, কোঁচানো ধুতি, পায়ে নিউকাট। তিন-চার রকম গন্ধ, একসঙ্গে মিলেমিশে বিয়েবাড়ির গন্ধ তৈরি করেছে। রজনীগন্ধা, সেন্ট, লুচিভাজা, মাছ, জল, কলাপাতা, সব মিলিয়ে স্বপ্নগন্ধী এক রাত। পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চললুম। ফেলে দেওয়া পাতা আর গেলাসের গাদায় গুন্ডা চেহারার কুকুরের খেয়োখেয়ি লেগেছে। আরও দূরে খাঁটিয়ায় চিতপাত হয়ে পড়ে আছে ভুড়ি-খোলা এক দৈত্য।
বাড়ির সদরে যখন এসে পৌঁছেলুম তখন প্রায় রাত দশটা। সদর হাট খোলা। এমন তো বড় একটা হয় না। পিতৃদেব তো এত উদাসীন নন। কী জানি, কী ব্যাপার! ওপরে একটি মাত্র আলো জ্বলছে। আলোর আভা অসুস্থ বৃদ্ধার মতো ঘষটে ঘষটে সিঁড়ি বেয়ে কিছু দূর নেমে এসে এলিয়ে পড়েছে। সিঁড়ির শেষ ধাপে এটা আবার কী! বলাইবাবু! খোলের বাইরে মুখটি বের করে একপাশে চুপ করে বসে আছে।
বলাইবাবু, তুমি তো কোনওদিন নীচে নামো না, আজ হঠাৎ নেমে এলে?
বলাইবাবুর মুখটি নড়ে উঠল। কচ্ছপও পোষ মানে। পোষ মানে না মানুষ। কাকিমা চলে গেছেন। ছোট্ট এই প্রাণীটি খুঁজতে খুঁজতে টাল খেতে খেতে নীচে নেমে এসেছে। রাস্তার দিকে তাকিয়ে বসে আছে সেই পরিচিত পদশব্দের অপেক্ষায়। কাকিমা বলাইবাবুকে রোজ একবার করে পালিশ করতেন। খোলটি বহু বর্ণে চিত্রিত হয়ে উঠেছে।
চলো, ওপরে চলো। বলাইবাবু, আমরা তো আছি! এক যায়, আর এক থাকে। মানুষের মতো ভুলতে শেখো। এই দেখো, একে একে আমার তো সবাই চলে গেছেন। যান না, আমি ধীরে ধীরে সব ভুলে যাব। একে একে নতুন চরিত্র এসে আমার চারপাশে ঘিরে বসবে। মাইফেল চলবে দিনের পর দিন। তারপর আবার একদিন সব ভোজবাজি! শুন্য কার্পেট, ছেঁড়া ফুলের মালা, ঘুঙুরের দানা, বাতি ম্রিয়মাণ, ভোরের পানসে আলো, ঘুলঘুলিতে তন্দ্রাতুর পায়রার ডানার ঝটপটি, মৃতের নিশ্বাসের মতো ফিকে বাতাস। ছিল সব, নেই কিছু। নদীর এক পাড় ভাঙে, আর এক পাড় গড়ে। চলো। বলাইবাবু, ওপরে চলো। তুমি আমার কোলে উঠে চলো। বর্ষার দুপুরের স্মৃতি। মাতামহ একেই বলতেন– সব ধুস।