যে রাতে ডাকাতি হলো, তার পরদিন সকালে রেল স্টেশনে স্বাভাবিকের চেয়ে অতিমাত্রায় ভিড় পরিলক্ষিত হলো। দিল্লী থেকে লাহোরগামী সকল সাড়ে দশটার লোকাল ট্রেনটি দেখতে স্টেশনে আসা মানো মাজরাবাসীদের একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। এই ছোট স্টেশনে ঐ ট্রেন থেকে যাত্রীদের ওঠা-নামা, ট্রেনটি দেরী হওয়ার কারণ নিয়ে যাত্রীদের তর্ক-বিতর্ক এবং কবে ঐ ট্রেনটি সময়মতো পৌঁছেছে, তা নিয়ে সরস আলোচনা তারা উপভোগ করত। দেশ বিভাগের পর তাদের একটা বাড়তি আকর্ষণও ছিল। ট্রেনটি এখন প্রায়ই চার/পাঁচ ঘন্টা দেরীতে আসে, অনেক সময় বিশ ঘণ্টা দেরীতে।
ঐ ট্রেনটি যখন পাকিস্তান থেকে আসে তখন ঐ ট্রেনে আসে শিখ ও হিন্দু উদ্বাস্তু। আবার যখন হিন্দুস্থান থেকে আসে তখন আসে মুসলমান উদ্বাস্তু। ট্রেনে এত ভিড় থাকে যে, তাদেরকে ছাদের ওপর বাদুড় ঝোলা অবস্থায় অথবা দুই বণির মাঝে দেখা যায় বিপজ্জনক অবস্থায়।
এদিন সকালে ট্রেনটি ছিল মাত্র এক ঘণ্টা লেট-প্রায় বিভাগ-পূর্ব সময়ের মতো। ট্রেনটি যখন ষ্টেশনে এসে থামল, তখন প্লাটফরমে হকারদের চিৎকার, যাত্রীদের ছোটাছুটি এবং একে অপরকে চিৎকার করে ডাকাডাকিতে মনে হলো যে, স্টেশনে অনেক যাত্রীই অবতরণ করবে। কিন্তু গার্ড যখন ট্রেন চলার হুইসেল দিল তখন দেখা গেল অধিকাংশ যাত্রীই ট্রেনের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। শুধু একটা শিখ কৃষক পরিবারকে দেখা গেল প্লাটফরমে হকারদের মাঝে। লোকটির হাতে একটা বাঁকানো লাঠি, তার স্ত্রী এবং স্ত্রীর কোলে ছোট একটা শিশু। লোকটি তাদের গোলাকার বিছানাপত্র মাথায় নিয়ে এক হাত দিয়ে ধরে রাখল এবং অন্য হাতে নিল মাখনের একটা বড় টিন। লাঠিখানা সে বুলিয়ে নিল তার ঘাড়ে। টিকিট দু’টো সে মুখে করেই নিল। মহিলাটি ক্টেশনের রেলিং-এর বাইরে দাঁড়ানো অসংখ্য লোকের দৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য ঘোমটা দিল। সে তার স্বামীকে অনুসরণ করল। নুড়ি পাথরের ওপর দিয়ে চলার সময় তার স্যান্ডেলের এবং শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে পরিহিত রূপার অলঙ্কারের ঝনঝনানি শব্দ হলো। স্টেশন মাস্টার লোকটির মুখ থেকে টিকিট নিয়ে শিখ দম্পতিকে গেটের বাইরে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। গেটের বাইরে তাদের অনেকে জড়িয়ে ধরল। আনন্দে এবং তার হারিয়ে গেল স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ অভিবাদনের মধ্যে।
গার্ড দ্বিতীয়বার হুইসেল দিলেন এবং সবুজ ফ্লািগ উত্তোলন করলেন। ঠিক সেই সময় ইঞ্জিনের পাশের বগি থেকে কয়েকজন বন্দুক ধারী পুলিশ নামল। তারা সংখ্যায় বারোেজন এবং একজন সাব-ইন্সপেক্টর। তাদের হাতে রাইফেল এবং কোমরের বেল্টে গুলি। দুজনের কাছে হাতকড়া ও শিকল। ট্রেনের শেষ দিকে গার্ডের কামরার কাছের বগি থেকে নেমে এলেন আর একজন লোক। লোকটি যুবক। তাঁর গায়ে লম্বা সাদা সার্ট, বাদামী রংয়ের মোটা সূতোর ওয়েষ্টকোট এবং চিলেঢালা পাজামা। তাঁর কাছে ছিল একটা হোল্কঅল। ট্রেন থেকে তিনি বেশ সাবধানেই নামলেন, মাথার এলোমেলো চুল হাত দিয়ে ঠিক করে নিলেন এবং প্লাটফরমে দাঁড়িয়ে চারদিকে একবার তাকিয়ে দেখলেন। তাঁর দেহের গঠন পাতলা এবং মুখাবয়ব অনেকটা মেয়েলী ধরনের। পুলিশ দেখে তিনি যেন সাহস ফিরে পেলেন। হোন্ডঅলটা বাম ঘাড়ের ওপর রেখে তিনি বেশ খুশি মনেই স্ট্রেশন থেকে বোরোনোর পথ ধরলেন। গ্রামবাসীরা এই যুবক লোকটিকে বেশ ভাল করেই দেখল। পুলিশের দলটি অপর দিক থেকে গেটের দিকে এগিয়ে এল। ষ্টেশন মাষ্টার গেটের কাছেই ছিলেন। তিনি গেটের দরজা খুলে দিলেন পুলিশদের বেরিয়ে যাওয়ার জন্য। সাব-ইন্সপেক্টরকে দেখে তিনি বিনীতভাবে মাথা নোয়ালেন। যুবক ভদ্রলোক গেটের কাছে আগেই পৌঁছেছিলেন। তিনি পড়ে গেলেন পুলিশ ও স্টেশন মাস্টারের মাঝামাঝি স্থানে। স্টেশন মাস্টার তাড়াতাড়ি তাঁর কাছ থেকে টিকিট নিলেন। কিন্তু যুবকটি গেট পার হওয়ার তাড়া দেখালেন না বা সাব-ইন্সপেক্টরের যাওয়ার জন্যও পথ ছেড়ে দিলেন না।
ষ্টেশন মাস্টার সাহেব, এ গ্রামে থাকার মতো কোন জায়গা আছে কিনা বলতে পারেন?
ষ্টেশন মাস্টার কিছুটা বিরক্ত হলেন। কিন্তু লোকটার শুদ্ধ উচ্চারণ, তাঁর চেহারা, পোশাক ও হোন্ডঅল দেখে তিনি রাগ চেপে রাখলেন।
সহাস্য ব্যঙ্গোক্তি করে স্টেশন মাস্টার জবাব দিলান, ‘মানো মাজরায় কোন হোটেল বা সরাইখানা নেই। গ্রামের মধ্যে মাত্র একটা শিখ গুরুদুয়ারা আছে। গ্রামের মাঝখানে ঐ গুরুদুয়ারায় আপনি দেখতে পাবেন হলুদ পতাকা উড়ছে।
ধন্যবাদ।
স্টেশন মাস্টার ও পুলিশ সদস্যরা ঐ যুবককে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখলেন। এই এলাকায় বেশি লোক ধন্যবাদ বলে না। যাঁরা ধন্যবাদ বলেন তাঁদের অধিকাংশই বিদেশে লেখাপড়া করা লোক। ইংল্যান্ডে লেখাপড়া করা অনেক বিত্তবান যুবকের কথা তাঁরা শুনেছেন, যাঁরা কৃষকের পোশাক পরিধান করে গ্রামীণ উন্নয়নমূলক কাজ করেন। তাঁদের অনেকে আবার কমিউনিস্টদের এজেন্ট বলে পরিচিত। তাঁদের অনেকে কোটিপতির ছেলে, অনেক উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তার ছেলে। এদের সবাই গোলমালের তালে থাকে এবং তারা গোলমাল বাধাতেও সক্ষম। এ কারণে সতর্ক থাকাই ভাল।
যুবক লোকটি স্টেশন থেকে বেরিয়ে গ্রামের পথ ধরলেন। যেখানে পুলিশ দাঁড়িয়েছিল তার কয়েক গজ, সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি জেনেশুনে বেশ সোজা হয়েই হাঁটলেন। তিনি যে গুলিশের সতর্ক দৃষ্টিতে এসেছেন। একথা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। তাঁর দিকে তাদের প্রখর দৃষ্টি তাঁকে বুঝিয়ে দিল যে, তারা তাঁকে নিরীক্ষণ করছে এবং তাঁর সম্পর্কে আলোচনা করছে। তিনি তাদের দিকে ফিরে তাকালেন না। একজন সৈনিকের মতোই তিনি তাদের সামনে দিয়ে হেঁটে গেলেন। অদূরেই দেখা গেল একটা সাধারণ কুটির, তার ওপরে হলুদ রংয়ের ত্রিকোণা পতাকা পৎ পৎ করে উড়ছে। পতাকায় ছিল কালো রংয়ে শিখ সম্প্রদায়ের প্রতীক–একটা পোলাকার চক্রের মাঝে ছোরা এবং তার নিচে আড়াআড়িভাবে দু’টো তলোয়ার। তিনি ধূলিময় পথ দিয়ে এগিয়ে চললেন। পথের দুধারে বেড়া দেয়া। এই পথ থেকেই একটা গলি পথ বেরিয়ে গেছে মন্দির, মসজিদ ও মহাজনের বাড়ির কাছে। পিপুল গাছের নিচে-কাঠের বেঞ্চিতে বসে জনা বারো লোক গল্প করছিল। পুলিশ দেখে তারা উঠে দাঁড়াল। তারা দেখল, পুলিশ রামলালের বাড়ির দিকে যাচ্ছে। আগন্তুক লোকটির দিকে তারা খেয়ালই করল না।
মন্দিরের বারান্দার খোলা দরজা দিয়ে তিনি ভিতরে প্রবেশ করলেন। প্রবেশ দ্বারের বিপরীত দিকে একটা বড় রকমের হল ঘর। ঐ ঘরেই আছে রুচিহীন জমকালে সিস্কের কাপড় দিয়ে মোড়ানো ধর্মগ্রন্থ। হলঘরের এক পাশে দু’টো কামরা। দেয়াল ঘেঁষে একটা সিঁড়ি দিয়ে ঐ কামরার ছাদে যাওয়া যায়। মন্দির বারান্দার ধারে একটা পাতকুয়া, চতুর্দিকে বুক সমান উঁচু দেয়াল দেয়া। এই পাতকুয়ার সাথেই আছে চার ফুট উঁচু একটা ইটের স্তম্ভ। হলুদ রংয়ের পতাকা দণ্ডটি এই স্তল্লের সাথেই বাঁধা।
যুবক লোকটি কাউকে দেখতে পেলেন না। তবে তিনি ধারে কাছে কাপড় কাচার শব্দ শুনতে পেলেন। তিনি বেশ ভয়ে ভায়ে কুয়ার অপর পাশে গেলেন। তাঁকে দেখে একজন বৃদ্ধ শিখ উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর লম্বা দাড়ি এবং পরিধেয় সাদা কাপড় থেকে টপ টপ করে পানি ঝরেছিল।
শুভ দিন।
শুভ দিন।
আমি কি এখানে দুতিন দিন থাকতে পারি?
এটা গুরুদুয়ারা-গুরুর ঘর। যে কেউ এখানে থাকতে পারে। কিন্তু আপনাকে মাথার ওপর কাপড় দিতে হবে এবং সাথে তামাক বা সিগারেট আনতে পারবেন না। বা ধূমপান করতে পারবেন না।
আমি ধূমপান করি না, যুবক বললেন। এরপর তিনি তাঁর হোন্ডঅলটি মাটিতে রেখে মাথার ওপর একটা রুমাল ছড়িয়ে দিলেন।
না, বাবু সাহেব, এখন নয়। আপনি যখন ধর্মগ্রন্থের কাছে যাবেন তখনই কেবল জুতো খুলে এবং মাথায় কাপড় দিয়ে যেতে হবে। আপনার জিনিসপত্র ঐ ঘরে রেখে বিশ্ৰাম করুন। আপনার কাছে খাওয়ার কিছু আছে?
ধন্যবাদ। আমার খাবার আমি সাথে করে এনেছি।
বৃদ্ধ লোকটি আগন্তুককে খালি কামরা দেখিয়ে দিয়ে কুয়ার ধারে চলে গেলেন। যুবক লোকটি কামরার মধ্যে গিয়ে দেখলেন, ঘরে আসবাবপত্রের মধ্যে আছে একটি মাত্র খাটিয়া। এক পাশের দেয়ালে টাঙানো আছে একটা বড় রঙিন ক্যালেন্ডার। ঘোড়ার পিঠে বসা লাগাম হাতে গুরুর একটা ছবি আছে। ঐ ক্যালেন্ডারে। ক্যালেন্ডারের আশপাশে দেয়ালে পেরেক পোতা আছে কাপড় ঝোলানোর জন্য।
আগন্তুক তাঁর হোন্ডঅল খালি করলেন। তিনি তাঁর বাতাস দিয়ে ফোলানো গদি বের করে তা ফুলিয়ে চারপাই-এর ওপর বিছিয়ে দিলেন। পাজামা ও সিস্কের গাউন বের করে ঐ গাদির ওপর রাখলেন। সামুদ্রিক মাছের টিন, অস্ট্রেলিয়ান মাখনের টিন এবং এক প্যাকেট শুকনা বিস্কুট তিনি বের করলেন। তিনি তাঁর পানির বোতল নাড়িয়ে দেখলেন। না, বোতলে পানি নেই।
বৃদ্ধ শিখ তাঁর কাছে এলেন। তিনি তাঁর লম্বা দাড়ি হাতের আঙ্গুল দিয়েই আঁচড়াচ্ছিলেন।
আপনার নাম কি? তিনি চৌকাঠের ওপর বসে জিজ্ঞাসা করলেন।
ইকবাল। আপনার নাম কি?
ইকবাল সিং? জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বৃদ্ধ লোকটি উচ্চারণ করলেন নামটি। উত্তরের অপেক্ষা না করে তিনি বলতে শুরু করলেন, আমি এই মন্দিরের ভাই। ভাই মিত সং। ইকবাল সিংজি, মানো মাজরায় আপনার কোন কাজ আছে?
যুবক লোকটি কিছুটা আশ্বস্ত হলেন এই ভেবে যে, বৃদ্ধ লোকটি তাঁর প্রথম প্রশ্ন নিয়ে আর কিছু জিজ্ঞাসা করলেন না। তাকে আর বলতে হলো না যে, তিনি ইকবাল সিং না অন্য কিছু। তিনি মুসলমানও হতে পারেন, যেমন ইকবাল মোহাম্মদ। তিনি হিন্দু হতে পারেন, যেমন ইকবাল চাঁদ অথবা শিখও হতে পারেন যেমন ইকবাল সিং। তিনটে সম্প্রদায়ের কাছে নামটি বেশ পরিচিত। শিখ আধূষিত একটা গ্রামে নিঃসন্দেহে ইকবাল সিং, উত্তম আপ্যায়ন পাবেন ইকবাল চাদ বা ইকবাল মোহাম্মদের চেয়ে, যদিও তীর মাথার চুল ছোট এবং দাড়ি কামানো এবং তাঁর নিজেরও কিছুটা ধৰ্মীয় অনুভূতি ছিল।
আমি একজন সমাজকর্মী, ভাইজি। এখন গ্রামে অনেক কাজ। দেশ বিভাগের ফলে এত রক্ত ঝরিছে যে, তা বন্ধ করতে কাউকে কিছু করতে হবে। উদ্বাস্তু যাতায়াতের জন্য এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ গ্রাম বলে পার্টি আমাকে এখানে পাঠিয়েছে। এখানে কোন অশান্তি দেখা দিলে তা হবে ভয়াবহ।
ভাইজি ইকবালের পেশা সম্পর্কে খুব বেশি উৎসাহী বলে মনে হলো না।
আপনি কোথা থেকে আসছেন, ইকবাল সিংজি?
ইকবাল বুঝলেন, তিনি জানতে চাচ্ছেন তাঁর পূর্বপুরুষের কথা।
আমি ঝিলাম জেলার লোক, এখন ঝিলাম পাকিস্তানে। কিন্তু আমি বহুদিন ধরে ছিলাম বিদেশে। বিদেশে থাকলে বোঝা যায় আমরা কত পিছনে পড়ে আছি। তাই অনেকে দেশের জন্য কিছু করতে চায়। এজন্য আমি সমাজের কাজ করি।
এজন্য তারা আপনাকে কি রকম বেতন দেয়?।
ইকবাল জানতেন এ ধরনের প্রশ্নে বিরক্তি প্রকাশ করা ঠিক নয়।
খুব বেশি কিছু পাইনে। যা পাই তা দিয়ে কোন রকমে আমার খরচ চলে।
তারা কি আপনার স্ত্রী ও সন্তানের খরচও দেয়?
না ভাইজি, আমি বিয়ে করিনি।
আপনার বয়স কত?
সাতাশ বছর। আচ্ছা, এ গ্রামে আর কোন সমাজকর্মী আসেন? মিত সিং-এর প্রশ্ন থামিয়ে দেয়ার জন্য ইকবাল প্রশ্ন করতে শুরু করলেন।
কখনো কখনো আমেরিকান পাদ্রিরা আসে।
তারা যে আপনার গ্রামে খ্ৰীষ্ট ধর্ম প্রচার করে, এটা আপনি পছন্দ করেন?
যে যার নিজের ধর্মকে ভালবাসে। এখানে পাশের ঘরটা মুসলমানদের মসজিদ। আমি যখন গুরুর কাছে প্রার্থনা করি, চাচা ইমাম বখশ তখন আল্লাহকে ডাকেন। বিলেতে কত ধর্ম আছে?
তারা সব খ্ৰীষ্টান, কেউ ক্যাথলিক, কেউ প্রোটেস্টান্ট। তারা আমাদের মতো ধর্ম নিয়ে ঝগড়া করে না। সত্যি কথা বলতে কি, ধর্ম নিয়ে তারা খুব বেশি মাথা ঘামায় না।
এ রকমই আমি শুনেছি, মিত সিং বেশ গভীরভাবেই বললেন, এ কারণেই তাদের নৈতিকতা বলতে কিছু নেই। তারা অন্যের স্ত্রীর সাথে এবং স্ত্রী অন্য সাহেবের সাথে ঘুরে বেড়ায়। এটা ভাল নয়। ঠিক কিনা?
কিন্তু তারা আমাদের মতো মিথ্যা বলে না। আমাদের মধ্যে অনেকে যেমন দুনীতিপরায়ণ ও অসৎ, তারা তেমন নয়, ইকবাল বললেন।
মাছ ভর্তি টিনের মুখ খুলে তিনি বিস্কুটের ওপর মাছ বিছিয়ে দিলেন এবং খেতে খেতেই কথা বলতে শুরু করলেন।
মিত সিংজি, নৈতিকতা হলো এক ধরনের টাকা। গরিব লোকরা নৈতিকতা অর্জন করতে পারে না। এজন্য তাদের আছে ধর্ম। আমাদের প্রথম সমস্যা হলো মানুষকে অধিক খাদ্য, কাপড় ও আরাম প্ৰদান করা। সেটা করা সম্ভব যদি গরিবদের ওপর ধনীদের শোষণ বন্ধ করা যায়। আর জমিদারদের উচ্ছেদ করা যায়। একমাত্র সরকার পরিবর্তনের মাধ্যমেই তা করা সম্ভব।
মিত সিং অত্যন্ত বিরক্তের সাথে যুবক লোকটির খাওয়া দেখছিলেন। লোকটি কিনা অতি নির্বিকারভাবে মাছের মাথা, চোখ ও লেজ খেয়ে যাচ্ছে। গ্রামের লোকদের ঋণগ্রস্ত হওয়া, গড় জাতীয় আয় ও পুঁজিবাদী শোষণ সম্পর্কে লোকটি শুকনো বিস্কুট খেতে খেতে যে সব কথা বলছিলেন, সেদিকে তাঁর বিশেষ মনোযোগ ছিলনা। ইকবালের খাওয়া শেষ হলে মিত সিং তাঁর কলসি থেকে এক মগ পানি এনে দিলেন। ইকবাল তার কথা তখনও শেষ করেন নি। মিত সিং ভাই যখন পানি আনতে বাইরে গেলেন তখন তিনি একটু উচ্চ স্বরেই তাঁর বক্তব্য শুনিয়ে যাচ্ছিলেন।
ইকবাল তার থলে থেকে কাগজে মোড়া একটা ছোট প্যাকেট বের করে তা থেকে সাদা একটা ট্যাবলেট নিয়ে পানির মাগে ছেড়ে দিলেন। মিত সিং-এর হাতের বুড়ো আঙ্গুলের নখের নিচে ময়লা জমে ছিল। ঐ ময়লার আকার দেখতে অনেকটা অর্ধ চন্দ্ৰাকৃতির মতো। পানি আনার সময় মিত সিং ঐ ময়লা হাত পানিতে ডুবিয়েছিলেন, ইকবাল তা দূর থেকেই দেখেছিলেন। ঘটনা যাই হোক, এটা ছিল কুয়ার পানি এবং তা জীবাণুমুক্ত ছিল না।
বৃদ্ধ দেখলেন, ইকবাল পানিতে ট্যাবলেট ছেড়ে দিয়ে তা গুলিয়ে খাওয়ার অপেক্ষায় আছেন। জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কি অসুস্থ?
না, আমার খাবার হজম করতে এটা সাহায্য করে। খাওয়ার পর এ ধরনের জিনিস খেতে আমার মতো শহরবাসীরা অভ্যস্ত।
ইকবাল তাঁর কথা শুরু করলেন। আসল কথা হলো, পুলিশ বাহিনী আছে আমাদের। কিন্তু তারা জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পরিবর্তে তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করে। তারা ঘুষ ও দুনীতির ওপর বেঁচে থাকে। আমি নিশ্চিত যে, আপনি ঐসব কথা জানেন।
বৃদ্ধ মাথা দুলিয়ে তাঁর কথায় সায় দিলেন। কিন্তু কোন মন্তব্য করার আগেই যুবক লোকটি আবার বলতে শুরু করলেন, আমি যে ট্রেনে এলাম ঐ ট্রেনে কয়েকজন পুলিশ ও একজন ইন্সপেক্টর আসে। তারা এ এলাকার সব মুরগি খেয়ে ফেলবে এবং ইন্সপেক্টর ঘুষ হিসাবে কিছু টাকা কামাবে, এতে কোন সন্দেহ নেই। এরপর তারা অন্য গ্রামে চলে যাবে। কেউ হয়ত মনে করতে পারে যে, লোকের কাছ থেকে টাকা কামানো ছাড়া তাদের করার আর কিছুই নেই।
বৃদ্ধ লোকটি ইকবালের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন বলে মনে হওয়ার কোন কারণ ছিল না। কিন্তু পুলিশের কথা শুনে তিনি যেন সম্বিত ফিরে পেলেন। তিনি বললেন, তাহলে পুলিশ এসেছে। তারা কি করছে আমার দেখা দরকার। তারা নিশ্চয়ই মহাজনের বাড়িতে আছে। গত রাতে সে খুন হয়েছে, ঐতো, গুরুদুয়ারার ওপাশে। ডাকাতরা অনেক টাকা নিয়ে গিয়েছে। মহাজনের স্ত্রীর কাছ থেকেও তারা পোচ হাজার টাকার ওপর সোনা-রূপার গয়না নিয়েছে বলে লোকে বলাবলি করছে।
মিত সিং বুঝতে পারলেন যে, তিনি এ বিষয়ে ইকবালের আগ্রহ সৃষ্টি করতে পেরেছেন। আস্তে আস্তে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, আমার সেখানে যাওয়া দরকার। গ্রামের সব লোক সেখানেই জমায়েত হয়েছে। তারা ডাক্তারী পরীক্ষার জন্য মৃতদেহ নিয়ে যাবে। কোন লোক খুন হলে ডাক্তার তাকে ডেথ সার্টিফিকেট না দেয়া পর্যন্ত তার সৎকার করা যাবে না। বৃদ্ধ লোকটির মুখে দেখা গেল বিকৃত হাসি।
হত্যা! কেন? কেন তাকে হত্যা করা হলো? ইকবাল যেন আঁতকে উঠলেন। কিছুটা ভয়ও পেলেন বলে মনে হলো। তিনি আরও অবাক হলেন এই ভেবে যে, নিকট প্রতিবেশীর নিহত হওয়ার ঘটনাটি মিত সিং একবারও তার কাছে উল্লেখ করেন। নি। এটা কি সাম্প্রদায়িক? এ অবস্থায় আমার কি এখানে থাকা উচিত? এই হত্যা নিয়ে গ্রামবাসী যেহেতু উত্তেজিত, সেহেতু আমি কিছু করতে পারব বলে মনে হয় না।
কি হলো বাবু সাহেব! আপনি এসেছেন। হত্যা বন্ধ করতে আর একটা হত্যার খবরে আপনি মুষড়ে পড়লেন? মিত সিং মৃদু হেসে তাঁকে বললেন, আমার ধারণা ছিল আপনি এসব বন্ধ করতেই এসেছেন বাবু সাহেব। তবে মানো মাজরায় আপনি সম্পূর্ণ নিরাপদ। তিনি বললেন, ডাকাতরা এ গ্রামে বছরে একাধিকবার আসে। কয়েকদিন পর পাশের গ্রামেও ডাকাতি হবে এবং তা গ্রামের লোক একদিন ভুলেও যাবে। রাতের প্রার্থনার পর আমরা সব গ্রামবাসী এখানে মিলিত হব। সেই জমায়েতে আপনার কিছু বলার থাকলে বলবেন। আপনি বরং এখন বিশ্রাম নিন। কি হলো তা আমি ফিরে এসে আপনাকে বলব।
বৃদ্ধ লোকটি বারান্দা অতিক্রম করে বেরিয়ে গেলেন। ইকবাল খালি টিন, ছুরি, চামচ, টিনের থালা সব এক সাথে করে কুয়ার ধারে গেলেন ধোয়ার জন্য।