১.৬
বোরহানপুরে স্বাগতম উস্তাদ আহমাদ।
আপনার ডাক পেয়ে আমি সম্মানিত বোধ করছি, জাহাপনা। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ছুটে এসেছি।
শাহজাহান তার সামনে মাথা নত করে রাখা লম্বা কৃশকায় শরীরের মানুষটিকে পর্যবেক্ষণ করে দেখলেন। আশা করলেন যে অবশেষে এমন এক স্থপতিকে পেয়েছেন যে কিনা মমতাজের সমাধি নিয়ে তাঁর চিন্তাকে বাস্তবে মূর্ত করে তুলতে পারবেন। যে সমাধির কল্পনা তিনি মনশ্চক্ষে স্পষ্ট দেখলেও কেন যেন অসম্পূর্ণই থেকে যাচ্ছে। আমার শ্বশুর আসফ খান আমাকে পত্র মারফত জানিয়েছেন যে তুমি শাহ আব্বাসের জন্য অনিন্দ্যসুন্দর দালান নির্মাণ করেছ। যে কাজের ভার আমি দিতে চাই তা কোন পারস্যের শাহ আজ পর্যন্ত করেননি–আমার স্ত্রীর জন্যে এমন একটি সমাধি স্মৃতিসৌধ যেটির অতুলনীয় সৌন্দর্যের জন্য পরবর্তী প্রজন্মও সমানভাবে বন্দনা গাইবে এ যুগের বিস্ময় হিসেবে। এই চিন্তা কি তোমাকে ভগ্নোদ্যম করে দিয়েছে?
না। এই ধরনের একটি চ্যালেঞ্জ কোন সত্যিকার কলাকারই দূরে ঠেলে দিতে পারে না।
পরিষ্কার হয়ে গেল যে উস্তাদ আহমাদ কোন স্র মানুষ নন; কিন্তু এই ভালো, ভাবলেন শাহজাহান। অন্য যাদের সাথেই তিনি কথা বলেছিলেন–যেমন তাঁর প্রধান স্থপতি–সবসময় ব্যস্ত থাকত তিনি যা বলতেন তাতেই প্রশ্বস্তি আর সম্মতি জানাতে, নিজেদের থেকে খুব কম পরিকল্পনার কথাই জানাত তারা। হাত নেড়ে স্থপতিকে লম্বা নিচু টেবিলে বসার ইশারা করলেন সম্রাট। আমার জন্য কী ভাবনা আছে?
আমার মনে হয় পারস্যরা কীভাবে তাদের বাগান নির্মাণ করে, তা জানা আছে আপনার?
আমি চিত্রকলা আর ড্রয়িং দেখেছি। আমি জানি তারা এগুলোকে বলে পারিদায়েজা।
ঠিক তাই জাহাপনা, স্বর্গের উদ্যান। সমান্তভালভাবে দুটি পানির প্রবাহ ছুটে চলে উত্তর থেকে দক্ষিণে এবং পূর্ব থেকে পশ্চিমে, স্বর্গের পবিত্র নদীসমূহের অনুকরণে। পরলোকগত সম্রাজ্ঞীর সমাধিও এভাবেই স্থাপিত হবে।
কিন্তু ইতিমধ্যেই আমি পত্র মারফত জানিয়েছি যে আমি চাই সমাধি নির্মিত হবে বাগানের ঠিক মধ্যিখানে। তোমার কাছে নতুন কোন পরিকল্পনা নেই? নিজের কণ্ঠের বিরক্তি লুকিয়ে রাখতে পারেননি শাহজাহান। কিন্তু উস্তাদ আহমাদ কোন ভ্রূক্ষেপ করল না।
আছে, জাহাপনা। আমি বিশ্বাস করি যে সমাধি বাগানের মধ্যিখানে হবে না–এর পরিবর্তে অর্থাৎ বাগানকে ছাড়িয়েও সমাধি হয়ে উঠবে প্রধান দর্শনীয়। আমার পরিকল্পনুযায়ী যমুনার তীরে আপনি যে জমি ক্রয় করেছেন তা এ কাজের জন্য পুরোপুরি আদর্শ।
উস্তাদ আহমাদের দিকে তাকিয়ে ছবিটা ভাবতে চেষ্টা করলেন শাহজাহান। অশোক সিং পরামর্শ দিয়েছেন তিনি যেন তার পিতা আম্বারের রাজার কাছ থেকে এ জায়গাটা নিয়ে নেন। যমুনা নদীর তীরে ডান হাতি কোন নিয়েছে, আর এ স্থান দুর্গ থেকে একেবারে কাছে খুব বেশি হলে দেড় মাইল দূরত্ব। সমাধি অট্টালিকার প্রাচীর থেকে দেখা যাবে তাই নয় শুধুমাত্র, চাইলে নৌকাযোগেও আসা-যাওয়া করা যাবে। বলে চলল স্থপতি, নদীতীরে নিচে বাগান রেখে একটি মঞ্চে সমাধি নির্মাণের প্রস্তাব করছি আমি।
কিন্তু নদীতীর কি এর ওজন বইতে পারবে? আমার নির্মাতারা বলেছে যে মাটি বালিময় আর হালকা, এছাড়া নদীর গতিপ্রবাহও ভাঙনের কারণ হতে পারে।
এই ক্ষেত্রে যমুনা নদীর বাঁক স্রোতের শক্তি কমিয়ে দেয়। এছাড়া ইমারত সমূহকে ধরে রাখার জন্য তীরে আরো কিছু কাজ করতে হবে।
ইমারত সমূহ? তুমি কি বলতে চাও একের বেশি?
হ্যাঁ। আমাকে দেখাতে দিন জাহাপনা। নিজের বহুল ব্যবহৃত সবুজ চামড়ার থলে থেকে ভাঁজ করা এক বিশাল কাগজ বের করল উস্তাদ আহমাদ। খুলে টেবিলের উপর বিছিয়ে দিল কাগজটি।
আমি সবকিছুই একে এনেছি, যাতে করে আমার প্রস্তাব আপনি পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারেন। সমাধিস্তম্ভটি দুটি মঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে থাকবে–বড়টি থাকবে সমাধির জন্য, এর চারপাশে ছোট আরেকটি ভিত্তিমূল থাকবে।
সমাধির দুই পাশে এই যে কাঠামোগুলোকে চিহ্নিত করেছ এগুলো কিসের?
পশ্চিম দিকে তিন গম্বুজওয়ালা একটি মসজিদ আর পূর্ব দিকে একই ধরনের একটি কাঠামো তীর্থযাত্রীদের বিশ্রামস্থান আর জবাব প্রতিধ্বনি–মসজিদের প্রতিধ্বনি হিসেবে পুরো সমাধিস্থানকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলবে। আমার নকশাতে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর দেখুন জাহাপনা, পুরো আবহকে সম্পূর্ণ করার জন্য দক্ষিণ-উত্তর দিকের প্রবাহের শেষ মাথায়, সমাধির ঠিক বিপরীতে একটি দক্ষিণাংশের ফটক দ্বার নির্মাণের প্রস্তাব করছি আমি। প্রবেশ করার সাথে সাথে দশণার্থীরা সমাধিস্থানকে এমনভাবে দেখতে পাবে যে, অনন্তহীন আকাশের বুকে ভাসছে এটি।
শাহজাহান তাকিয়ে রইলেন উস্তাদ আহমাদের ড্রয়িংয়ের দিকে। মনশ্চক্ষে আদর্শ একটি ভারসাম্যের চিত্র দেখতে পেলেন। এরপরেও সবকিছু নির্ভর করবে সমাধির নকশার উপরে, যেটি শুধুমাত্র একটি চক্র হিসেবে দেখানো হয়েছে। সমাধি স্তম্ভের কী হবে?
নিজের ব্যাগ থেকে সিল্কে মোড়ানো একটি বান্ডেল বের করল স্থপতি। এটি দেখানোর আগে আমার চিন্তাগুলো আপনাকে বলার সুযোগ দিন। কয়েকদিন আগেই দিল্লিতে সম্রাট হুমায়ুনের সমাধি দর্শন করেছি আমি। অবাক হয়ে ভেবেছি কেমন হয় যদি পরলোকগত সম্রাজ্ঞীর স্মৃতিস্তম্ভটিও হুমায়ুনের মত অষ্ট স্তম্ভ পরিকল্পনা মত হয়? কিন্তু থাকবে আলোয় পরিপূর্ণ যেন একজন নারীর স্মৃতির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হয়। জায়গাটা নিয়ে আমি একের পর এক পরীক্ষা করে দেখেছি; শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে ভিত্তি হবে ত্রিকোণাকার আর এর লম্বমান কোণাগুলো অষ্ট স্তম্ভের সৃষ্টি করবে। মধ্যিখানে অবস্থিত একটি অষ্টভুজ, চেম্বারের মাঝে শুয়ে থাকবে শবাধারটি আর চারপাশে আটটি পরস্পর সম্পূর্কযুক্ত চেম্বার থাকবে দুই লেভেলে। বাইরের সম্মুখ ভাগে থাকবে দুই তলা খিলানওয়ালা কুলঙ্গি। কিন্তু যথেষ্ট কথা হয়েছে জাহাপনা, আমাকে এবার দেখাবার অনুমতি দিন।
নিজের ব্যাগ খুলে কয়েকটি কাঠের ব্লক বের করে আনল উস্তাদ আহমাদ। এগুলো দিয়ে সাবধানে তৈরি করল একটি অষ্টভুজ কাঠামো। দেখুন জাহাপনা–চারপাশের প্রতি পাশে থাকবে প্রবেশপথ, যাদের উঁচু মাথা বাকি খোলা জায়গা খুঁড়ে ঊর্ধ্বে উঠে যাবে। মাটি থেকে গম্বুজের মাথার উচ্চতা হবে ২৪০ ফুট।
আর গম্বুজটি?
আমি বলব জোড়া গম্বুজের কথা। আবারো অনুমতি দিন বর্ণনা করার। এবার পকেট থেকে দুই টুকরো পালিশ করা অ্যালবাস্টার বের করল উস্তাদ আহমাদ। সম্রাট হুমায়ুনের সমাধির ভেতর এবং বাইরের গম্বুজ দুটোতে নিচু ড্রাম আছে। এখানকার ক্ষেত্রে আমি প্রস্তাব করছি এমন একটি অভ্যন্তরীণ গম্বুজ উঠে যাবে যেটি মাটি থেকে আশি ফুট উঁচু হবে আর বাইরের গম্বুজের আকৃতি হবে পেয়ারার মত, উপরে থাকবে সোনালি আভা। কথা বলতে বলতে উস্তাদ আহমাদ অভ্যন্তরীণ গম্বুজটিকে মডেলের অষ্টভুজ দেয়ালের মাঝে সাবধানে বসিয়ে চারপাশে বাইরের গম্বুজ বসিয়ে দিল। অবশেষে আমি পরামর্শ দেব চারটি ছবি, উন্মুক্ত মঞ্চ বসাতে, আপনার হিন্দু অনেক প্রতিবেশীর প্রাসাদে ব্যবহার করা হয়েছে, ঠিক যেন আংটির মাঝে প্রধান রত্নটির চারপাশে মুক্তোদানা।
সামনে রাখা মডেলটির দিকে হা করে তাকিয়ে রইলেন শাহজাহান। একেবারে নিখুঁত। এই লোকটা কেমন করে তার চিন্তাগুলোকে এত সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছে যখন কিনা তিনি নিজেও নিজেকে বোঝাতে পারছিলেন না? সন্দেহ নিয়ে তাকিয়ে রইল উস্তাদ আহমাদ, বুঝতে পারছে না সম্রাটের নীরবতার অর্থ কী।
আমি সম্রাজ্ঞীর সমাধি স্মৃতিসৌধ নির্মাণের জন্যে তোমাকে আমার স্থপতি নিয়োগ করলাম। এখনি আগ্রাতে ফিরে যাও। যা দরকার–অর্থ উপকরণ, শ্রমিক সব দেয়া হবে তোমাকে।
জাহাপনা! আমার আরেকটি প্রশ্ন আছে। কোন উপকরণ ব্যবহার করব আমরা? বালিপাথর?
আশেপাশের ইমারতগুলোর জন্য সম্ভবত তাই, কিন্তু সমাধি সৌধের জন্য ব্যবহার করতে হবে বিশুদ্ধ সাদা মার্বেল–আমি ইতিমধ্যে আম্বারের রাজাকে জানিয়েছি যে তার অধীনস্থ মাকরানা খনির সবটুকু ক্রয় করব আমি; এছাড়া তাকে এও জানিয়েছি যেন নিরাপদে মার্বেলগুলো দুইশ মাইল দূরে আগ্রাতে পৌঁছে দেয়া হয়।
প্রথমবারের মত বিস্মিত দেখালো উস্তাদ আহমাদকে। এর আগে কেউই মার্বেল দিয়ে এত বিশাল কিছু নির্মাণ করেনি…ব্যয় তো…
খরচের কথা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। পৃথিবীতে স্বর্গ তৈরি করে দেবার প্রতিজ্ঞা করেছ, এটাই তোমার একমাত্র ভাবনা হবে।
কয়েক মাসের মাঝে এই রাতেই গভীর নিদ্রায় মগ্ন হলেন শাহজাহান। কেমন করে মৃত্যুপথযাত্রী মমতাজের শেষ ইচ্ছে পূরণ করবেন সেই উদ্বেগ দূর করে দিয়েছে উস্তাদ আহমাদের নিপুণ নকশা।
স্বপ্নের মাঝে দেখতে পেলেন তিনি দাঁড়িয়ে আছেন দক্ষিণের বিশাল ফটকদ্বারে, বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছেন উজ্জ্বল সমাধিসৌধের দিকে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার হয়ে গেলেও তিনি যেন নড়াচড়ার শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন, কেবল দেখতে পেলেন প্রভাতের আলোয় গোলাপি আলো ছড়াতে লাগল সাদা মার্বেল, তপ্ত দ্বিপ্রহরের সূর্যের নিচে হীরার মত উজ্জ্বল আর আঁধার ঘনিয়ে আসতেই হয়ে গেল বেগুনির মত মোলায়েম, মুক্তোরমতন গম্বুজের ছায়া চেপে ধরল চারপাশ থেকে। এরপর ভেলভেটের ন্যায় অন্ধকার চিরে লণ্ঠনের আলোয় জ্যোত্সলোকিত ফটকদ্বারে উদয় হল এক নারী। চেহারা না দেখতে পেলেও তিনি জানেন এ নারী মমতাজ….
ধীরে ধীরে বাগানের মাঝে দিয়ে হাঁটতে লাগলেন, নিঃশ্বাসের সাথে পাচ্ছেন চম্পা ফুলের ভারী সুবাস। অনুসরণ করে চললেন সমাধির দিকে প্রবাহিত হওয়া রুপালি জলের ধারার মার্বেল চ্যানেল। যতই তিনি এগোতে লাগলেন, জীবন ফিরে পেল মার্বেলের ঝরনার সারি। বাতাসে ছুঁড়ে দিতে লাগল উজ্জ্বল রত্নের ন্যায় জলবিন্দু। শাহজাহানের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়ে আছে প্রবেশপথে অপেক্ষারত মমতাজের দিকে। মনেপ্রাণে চাইছেন আরো দ্রুত ছুটে যেতে কিন্তু কথা শুনছে না পা জোড়া, এমনকি নিঃশব্দে হাত উঁচিয়ে যখন মমতাজ ডেকে উঠলো তখনো তিনি ছুটতে পারেননি। মমতাজের মুখ এখনো ছায়া ঘেরা কিন্তু গলার চারপাশে থাকা রত্ন ছড়াতে লাগল আলো, কোমর আর কব্জিতেও রত্নের সমাহার। আর কয়েক কদম এগিয়ে গেলেই পত্নীর কাছে পৌঁছে যাবেন তিনি, কিন্তু হঠাৎ করেই কাঁপতে কাঁপতে হারিয়ে গেল নারী শরীরের অবয়ব।
হতাশ হয়ে সিঁড়ি বেয়ে ধূসর সমাধিতে উঠে গেলেন তিনি, স্পর্শ করলেন দুগ্ধ মসৃণ মার্বেল, ভাবলেন শীতলতার ছোঁয়া পাবেন। এর পরিবর্তে স্বচ্ছ পাথর হয়ে গেল সিল্ক আর মানব মাংসের ন্যায় উষ্ণ মমতাজের দেহ। মনে হল বহু বছরের প্রতীক্ষার অবসান হয়েছে, পাথরে চেপে ধরলেন নিজের ঠোঁট। সমাধিসৌধ হয়ে গেল স্বয়ং মমতাজ। চারপাশে শুধু মমতাজের রত্নের সমাহার, যেগুলি তিনি পছন্দ করতেন জীবিত থাকাকালে। এমেরাল্ড, রুবি, অ্যামেথিস্ট, কোরাল ঠিক তেমনিভাবে আলোকিত হয়ে আছে সাদা মার্বেলের উপর ঠিক যেমনি এগুলো উজ্জ্বলতা ছড়াতো তার দেহে। শাহজাহান হাত বাড়িয়ে সমাধি আলিঙ্গন করতে চাইলেন, কিন্তু নিজের শয়নকক্ষের গাঢ় অন্ধকার ছাড়া আর কিছু নেই সেখানে।
উঠে বসে নিজের চারপাশে তাকাতে লাগলেন। হতবিহ্বল হয়ে পড়েছেন। বিছানা থেকে নেমে হেঁটে গেলেন গরাদবিহীন জানালার কাছে, চোখ রাখলেন অন্ধকারে, ঝাপসাভাবে দেখা যাচ্ছে তাপ্তি নদীর বহমান রেখা, মনে পড়ে গেল তিনি আগ্রা আর অস্থায়ী সমাধিতে শুয়ে থাকা মমতাজের কাছ থেকে বহু দূরে। চারপাশ থেকে চেপে ধরা এই বিরান ভূমিতে কেমন অদ্ভুত লাগল নিজেকে। মমতাজের মৃত্যুর আগে একত্রে প্রায়ই তারা গল্প করতেন যে যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে কাশির যাবেন। আর কখনোই যেতে পারবেন না একসাথে সেখানে– কখনোই ঘুরে বেড়ানো হবে না বেগুনি ক্রোকাসের মাঠে অথবা তুষার ছাওয়া পর্বত থেকে আসা হিম বাতাস অনুভব করতে পারবেন না আর না পারবেন পদ্মেভরা হ্রদে নৌবিহারে যেতে। কিন্তু রাতের আধারের দিকে তাকিয়ে মমতাজ আর নিজের কাছে শপথ করলেন; খুব দ্রুত সমাপ্তি টানবেন এই যুদ্ধের আর স্বচক্ষে সমাধি নির্মাণের দেখভালের জন্য আগ্রা ফিরে যাবেন।
*
একটি ছোট্ট পাহাড়ের উপর তৈরি করা রক্তলাল বর্ণের তাঁবুর নিরাপদ শামিয়ানায় নিচে দাঁড়িয়ে চারপাশে নিচু অঞ্চল জরিপ করে দেখলেন শাহজাহান। এই তাঁবুই বর্তমানে তার কমান্ড সেন্টার হিসেবে কাজ করছে। বর্ষার আকাশ থেকে অবিশ্রান্ত ঝরে পড়ছে বৃষ্টিকণা। ভারী বৃষ্টির ফলে এরই মাঝে তাঁবুর চারপাশে কাদা জমে গেছে। তিন সপ্তাহ আগে শেষ হয়েছে খরার কাল। তারপর থেকেই ক্রমাগত বৃষ্টি। সব জায়গাতে মাটি এতটাই শুকিয়ে খটখটে হয়ে গিয়েছিল যে দ্রুত এত পানি শুষে নিতে পারেনি। কয়েক জায়গায় বন্যার তোড়ে ভেসে গেছে মানুষ আর পশু যারা কিনা কিছুদিন আগেই হাহাকার করেছে পানির জন্য। গাছে গাছে আর ঝোঁপঝাড়ে কুড়ি মেলতে শুরু করেছে সবুজ পাতা। ছোট ছোট কমলা গোলাপি রঙের জংলি ফুলও দেখা যাচ্ছে, গান গাইছে হাজারো পাখি। সর্বত্র শুরু হয়ে গেছে প্রাকৃতিক জীবনের জয়গান; এতসব কিছুর মাঝে বিষণ্ণ কেবল মোগল সম্রাট, প্রতিনিয়ত উদ্বেগে ভুগছেন শেষ এই পরাজয়ের আশংকায়।
প্রতিকূল আবহাওয়া সত্ত্বেও বোরহানপুর থেকে দ্রুত প্রস্থানের উদ্দেশ্যে নিচের সেনাবাহিনী নিয়ে এই পানিতে ডোবা মনুষ্যবর্জিত অঞ্চলে এসেছেন। কেননা বিশ্বাসযোগ্য সূত্র থেকে সংবাদ পাওয়া গেছে যে বিজাপুরি সৈন্যদের শেষতম বড়সড় একটি দল মাত্র দুই দিনের দূরত্বে একটি বন্য এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে। এখন বহু চিন্তা-ভাবনার পর মমতাজের মৃত্যুর পর থেকে অসংখ্য নিঘুম রাতের মত আরো একটি রাত পার করে আক্রমণের পরিকল্পনা করেছেন শাহজাহান।
সেনাপতিদেরকে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও। চিৎকার করে পরিচারককে জানালেন। শীঘ্রই সকলে পৌঁছে গেলে পর ভৃত্যদের দেয়া নিচু টুলে বসে পড়ল সবাই শামিয়ানার নিচে। বৃষ্টি সত্ত্বেও অশোক সিং বরাবরের মতই স্বর্ণের কারুকাজওয়ালা মেরুন টিউনিক আর উপরের কোট গায়ে দিয়ে রঙিন আর অভিজাত বেশ নিয়ে হাজির হয়েছে। গাঢ় কৃষ্ণ বর্ণের গোঁফ পরিষ্কারভাবে আঁচড়ানো আর সুগন্ধিও মেখেছে তাতে। কিন্তু অন্য সেনাপতিদের অবস্থা কাদাতে একেবারে নাজেহাল। একপাশে দাঁড়িয়ে আছে আওরঙ্গজেব। পিতার কাছে আর্জি জানিয়ে শাহ সুজার পরিবর্তে এই অভিযানে এসেছে সে। কিন্তু শাহ সুজাকেই নিয়ে আসার ইচ্ছে ছিল শাহজাহানের। যদি না ছেলেটা তার সহিসের নির্দেশে অসমর্থ ঘোটুকী নিয়ে পোলো খেলতে গিয়ে কাঁধের হাড় নাড়িয়ে নিত।
সবাই এসে পৌঁছালে শুরু করলেন শাহজাহান। কিভাবে এ অনুপ্রবেশকারীদের চিরতরে শেষ করে দেয়া যায় সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি। বলপূর্বক শিকারি প্রাণীর মত আমাদের জমিতে উদয় হয়েছে, এখন তাদের মোকাবেলাও একইভাবে করব আমরা। ঠিক যেভাবে আমার পূর্বপুরুষেরা অনুর্বর ভূমিতে শিকার করতেন, আবদ্ধ জায়গায় আটকে ফেলে, তেমনিভাবে আমরাও শত্রুকে চারপাশ থেকে ফাঁদে আটকে ফেলব যেন পালাবার পথ না থাকে। গুপ্তচর মারফত প্রাপ্ত সংবাদে জানা গেছে যে শত্রুরা প্রায় পাঁচ মাইল দূরে দক্ষিণ দিকে ঘন জঙ্গল মত এলাকায় আছে। অশোক সিং, আমি চাই তুমি আমাদের অশ্বারোহীদের মাঝ থেকে শ্রেষ্ঠ পাঁচ হাজার জনকে নির্বাচন করে সবার পেছনে একজন করে বন্দুকবাজকে নেয়ার আদেশ দাও। এরা জঙ্গল ঘিরে ফেলবে–গুপ্তচর খবর দিয়েছে এটি প্রায় ছয় মাইল বিস্তৃত। একে অন্যের মাঝে চার গজ দূরত্ব রেখে অগ্রসর হবে তারা।
আপনি বিজাপুরি সৈন্যদেরকে অতর্কিতে আক্রমণ করতে চান?
প্রথম দিকে হ্যাঁ, তাই, কিন্তু আমাদের ফাঁদ পাতা শক্তিশালী হয়ে গেলে আমি চাই শত্রুরা জানুক যে আমরা আসছি। আমাদের সৈন্যরা গাছপালার ভেতরে প্রবেশ করার পর, যখন চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলব আমরা, আমি ইশারা করলেই চিৎকার চেঁচামেচি এমনকি বাদ্য বাজানো শুরু করবে মোগল সৈন্যরা। চারপাশ থেকে শব্দ পেয়ে শত্রুরা বুঝতে পারবে যে পালানোর পথ নেই, আমরা একসাথে তাড়া করব তাদের ঠিক যেমন শিকারে গিয়ে করে থাকি; এরপর শুরু হবে আক্রমণ। এর মাঝেও যদি কেউ আমাদের ব্যুহ ভেঙে বেরিয়ে যেতে সমর্থ হয় তাহলে জঙ্গলের কিনারে থাকা বন্দুকবাজ সহ অশ্বারোহী তার ভবলীলা সাঙ্গ করবে। পরিষ্কার হয়েছে পুরো ব্যাপারটা?
আমরা কি বন্দি নিব, জাহাপনা? জানতে চাইল অশোক সিং।
না, কোন বন্দি নয়। অশোক সিংকে বিস্মিত হতে দেখে শাহজাহান ব্যাখ্যা করে বললেন, তোমরা রাজপুতেরা যুদ্ধে কোন দয়া চাও না, মৃত্যু পর্যন্ত লড়াই কর। কিন্তু রাজপুতরা সম্মানীয় যোদ্ধা। যদি তারা কখনো আমার মিত্র না হয়ে শত্রু হয়–আশা করি কখনো এমনটা হবে না যে দয়া চাইবে আমি তাকে ছেড়ে দেব। কিন্তু এই বিজাপুরিরা আমার ভূমিতে রক্ত আর বিশৃঙ্খলা ছাড়া আর কিছুই আনেনি, আমার স্ত্রীর জীবনও কেড়ে নিয়েছে। আত্মসমর্পণের প্রতিটি সুযোগ নষ্ট করেছে আর তাই দয়া ভিক্ষা পাবার অধিকারও হারিয়ে ফেলেছে–যদি তারা তা চায়ও।
অশোক সিং কিছুই বলল না, কিন্তু কথা বলে উঠল আওরঙ্গজেব। আব্বা হুজুর, আক্রমণের সময় আমি সঙ্গী হতে পারি?
দ্বিধায় পড়ে গেলেন শাহজাহান। তিনি নিজেও যখন প্রথম যুদ্ধে গিয়েছেন তখন আরো খানিকটা ছোট বয়সী ছিলেন। ঠিক আছে। কিন্তু সত্যিকারের যুদ্ধে অংশ নিতে পারবে না।
আব্বা হুজুর…।
না! আমি আমার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করব না। হয় তুমি নিরাপদ দূরত্বে থাকবে নতুবা আসবেই না সাথে।
এই ব্যাপারে না। আমি আপনাকে জানাতে চেয়েছি যে বিজাপুরিদেরকে ছাড় না দেয়ার আপনার সিদ্ধান্ত পুরোপুরি সঠিক হয়েছে। তারা এর যোগ্য নয়। আর বিশ্বাসঘাতকতার পুরো মূল্য পরিশোধ করতে হবে এখন।
ভালো। মাথা নাড়লেন শাহজাহান। বয়সে তরুণ হওয়া সত্ত্বেও নিজের দৃঢ় মতামত ব্যক্ত করতে কখনো পিছপা হয় না আওরঙ্গজেব। নিজের বিশ্বাসের প্রতি অটুট ভক্তি আছে তার, হোক সেটা ন্যায় অথবা অন্যায়। ভাইদের সাথে তর্কযুদ্ধের সময়ও নিজের সঠিক অবস্থান ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর সে, এক্ষেত্রে যদি প্রয়োজন হয় নিজের মুষ্টিবদ্ধ হাতও ব্যবহার করে।
এক ঘণ্টা পরে, তিন মাইল অতিক্রম করে চলে এসেছে প্রধান সারি। যদি সবকিছু ভালয় ভালয় হয়–চারপাশে অবিশ্রান্ত বৃষ্টি থামারও কোন লক্ষণ নেই–মধ্যাহ্নের মাঝেই ঘন জঙ্গলে পৌঁছে আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে।
কাঁধের উপর দিয়ে পিছন ফিরে তাকালেন সম্রাট, দেখতে পেলেন খুব বেশি দূরে নেই আওরঙ্গজেব। টিউনিক আর রুপালি বুকবর্ম পরিহিত আওরঙ্গজেবের মুখমণ্ডলে গভীর মনোযোগের ছাপ। পিচ্ছিল পথে নিজের ঘোড়া ছোটানোতে মনোযোগ দিলেন শাহজাহান, চারপাশে কাদার ছিটে উঠতে লাগল, স্টিলের তৈরি ঘোড়ার শিরস্ত্রাণের ছিটে লাগল আর রত্নখচিত শিরস্ত্রাণের নিচে ম্রাটের মুখমণ্ডলেও পড়ল ছোট ছোট দাগ।
শীঘ্রই অবশ্য থেমে গেল বৃষ্টি, সামনে দক্ষিণ দিকে ঘন জঙ্গলের দেখা পেলেন শাহজাহান। এক ঘণ্টার চারভাগের এক ভাগ সময়ের মাঝেই রায় সিংয়ের নেতৃত্বে একদল সৈন্যও উদয় হল একই পথে।
সবকিছু ঠিক আছে, জাহাপনা। ভেজা শরীরে লম্বা চুল উড়িয়ে সংবাদ দিল গুপ্তচর। বিজাপুরিরা এখনো জঙ্গলের ভেতরে আর যতদূর আমি বলতে পারি যে আমাদের উপস্থিতি সম্পর্কে কোন ধারণাই নেই তাদের। এখন বৃষ্টি থেমেছে তাই রান্না করার আগুন জ্বেলেছে– দেখুন।
পরিষ্কারভাবে দেখা গেল যে জঙ্গলের মাঝে বেশ কয়েক জায়গা থেকে হালকা ধোয়ার সর্পিল রেখা দেখা যাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে বিজাপুরিরা একটা জায়গায় জড় হয়ে না থেকে পুরো জঙ্গলে ছড়িয়ে আছে। যদি তারা খেতে চায় তাহলে জলদি করাই ভালো–এটাই তাদের শেষ খাওয়া হতে চলেছে। নজর রাখো। সন্দেহজনক কিছু দেখতে পেলেই সাথে সাথে খবর পাঠাবে। নচেৎ ঘিরে ফেলার সাথে সাথেই জঙ্গল ঢুকে পড়ব আমরা।
দ্রুত নিজের সেনাপতিদেরকে সর্বশেষ নির্দেশ জানিয়ে দিলেন শাহজাহান। বনের চারপাশে তোমাদের সৈন্যদের পাঠিয়ে দাও। উত্তরের কিনার থেকে যারা ঢুকবে আমি তাদের সাথে যোগ দেব আর সেখান থেকেই নির্দেশ পাঠাবো। আওরঙ্গজেব, তুমি এখানেই থাকো। বিক্রম দাসপুত্রের নিরাপত্তার রক্ষার দায়িত্ব ভার তোমাকে দিলাম আমি।
মাথা নাড়ল সেনাপতি। নার্ভাস ভঙ্গিতে তাকাল আওরঙ্গজেবের দিকে। যেন তরুণ শাহজাদাকে নিয়ন্ত্রণ করা নিয়ে নিজের ক্ষমতার ব্যাপারে সন্দিহান সে। বুঝতে পারলেন শাহজাহান। আওরঙ্গজেব আমি কি তোমার প্রতিশ্রুতি পেতে পারি যে তুমি এখানেই থাকবে, যুদ্ধে অংশ নেবে না? মুহূর্তখানেক দোলাচলে দুলে উঠে মাথা নাড়ল তাঁর পুত্র।
দেহরক্ষী পরিবেষ্টিত হয়ে ঘোড়া নিয়ে আগে বাড়লেন শাহজাহান, বনের চারপাশে জড় হওয়া অশ্বারোহীদের সাথে যোগ দিলেন। অশ্বারোহী সৈন্যদের পেছনে বসে থাকা বন্দুকবাজদের পিঠে রাখা তাদের লম্বা ব্যারেলঅলা অস্ত্র আর বারুদ ঢুকানোর শিক, কাঁধে ঝুলছে বারুদের ব্যাগ। গাছ থেকে এত বেশি পানি ঝরে পড়ছে যে মনে হচ্ছে এখনো বৃষ্টি হচ্ছে, এর নিচ দিয়ে এগিয়ে গেলেন শাহজাহান ও তাঁর সৈন্যরা। গলা বেয়ে বুকবর্মের নিচে ঢুকে পড়ছে পানির ধারা, জঙ্গলের মাটি ভেজা, পিচ্ছিল। জায়গায় জায়গায় ঘোড়ার পা দেবে যাচ্ছে কাঁদার মাঝে। আরো ঘন হচ্ছে ঝোঁপঝাড়।
গভীর মনোযোগ দিয়ে চারপাশে কান পাতলেন ম্রাট। কিন্তু ঘোড়ার খুরের শব্দ আর মাঝে মাঝে তাদের ডাক ও নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যাচ্ছে না। বিজাপুরিরা এখনো দূরে আছে তাই এগিয়ে আসা আক্রমণকারীদের শব্দ শুনতে পায়নি, কিন্তু খুব বেশি দূরেও নেই।
তলোয়ার উঁচু করে মাথা ঘুরিয়ে রাজাপুতদের উদ্দেশে প্রাচীন রণহুঙ্কার ছাড়ল অশোক সিং, অগ্রসর হও, সূর্য চন্দ্র আর আগুনের সন্তানেরা, সম্মান অথবা মৃত্যু। চারপাশে সৈন্যরা শুরু করে দিল চিৎকার, অস্ত্রের ঝনঝনানি, বাদ্য বাজানো। পুরো জঙ্গলে ছড়িয়ে পড়ল শব্দের মূৰ্ছনা, সাম্বা হরিণ সতর্ক হয়ে চিৎকার শুরু করল, গাছের আশ্রয়ে থেকে আতঙ্কে কিচিরমিচির করে উঠল কবুতব আর ঘুঘুর দল। সময় হয়ে গেছে, বন্দুকবাজরা ঘোড়া থেকে নেমে মাটিতে বসে অস্ত্র প্রস্তুত করে রাখল যেন অশ্বারোহী সৈন্যদের ধাওয়া খেয়ে কোন বিজাপুরি সৈন্য বের হবার চেষ্টা করলেই গুলি করা যায়। উত্তেজিত বক্ষ নিয়ে চারপাশে পড়ে থাকা পাতার দিকে তাকালেন শাহজাহান, ডান হাতের আঙুলগুলো সজোরে চেপে বসল তলোয়ারের বাটের উপর।
মুহূর্তের মাঝে চিৎকারে কান পাতা দায় হয়ে পড়ল। হঠাৎ করেই খানিকটা বাম পাশে নিচু ঝোঁপঝাড় পেরিয়ে পরিষ্কারভাবে দেখতে পেলেন বেশ কয়েকটি তাঁবু আর ঘোড়া। বন্দুকধারীরা, নিচে নেমে যার যার অবস্থানে চলে যাও। সবাইকে জানিয়ে দাও, এ আদেশ। বলে উঠলেন সম্রাট। অশ্বরোহীর দল নির্দিষ্ট সারি বজায় রেখে অগ্রসর হবে কেউ যাতে ঢুকতে না পারে। তার বাম এবং ডান পাশে অশোক সিংয়ের ঘোড়সওয়ারা, হাতে প্রস্তুত বর্শা থকথকে কাদার মাঝে যত দ্রুত সম্ভব ঘোড়া হোটালো সকলে।
খোলা জায়গায় বের হয়ে আসার সাথে সাথে শাহজাহান অনুভব করলেন যে কিছু একটা ছুঁয়ে চলে গেছে তাঁর গাল। কালো রঙের উড়ন্ত তীর এসে পড়েছে তার খুব কাছে কাদার মধ্যে। চারপাশে তাকিয়ে দেখতে পেলেন ধনুধারীকে লম্বা চুলঅলা এক তরুণ–দূরত্ব ত্রিশ মাইল ও হবে না, দাঁড়িয়ে আছে একটা তাঁবুর সামনে আর নার্ভাস ভঙ্গিতে ধনুকে দ্বিতীয় তীর ঠিক করে নিচ্ছে। মাত্র একটা পদক্ষেপে শাহজাহান বের করে আনলেন নিজের জোড়া স্টিলের ফলার ছুরি, বাতাসে ভাসিয়ে দক্ষ হাতে ছুঁড়ে মারলেন। ছুরির মাথা গিয়ে ঢুকে গেল ছেলেটার গলার মাঝে; হাঁটু ভেঙে বসে খামচে ধরে আঙ্গুলের ফাঁক গলে বের হওয়া রক্ত আটকাতে চাইল হতভাগ্য তরুণ।
শাহজাহানের চারপাশে অশ্বারোহীরা চটপট এগিয়ে গেল বিজাপুরিদের দিকে। কিন্তু বড়জোর জনা ত্রিশেক বিজাপুরি সৈন্য দেখা গেল। সম্রাট তাকাতেই দেখতে পেলেন অশোক সিং নিজের ঘোড়ার উপর খানিকটা উপুড় হয়ে আরেকজন ধনুকবিদের মাথা কাঁধ থেকে আলাদা করে ফেলল অস্ত্রের একটা মাত্র কোপ দিয়ে; কাদা মাটিতে মাখামাখি হয়ে গড়াতে গড়াতে কাটা মাথা গিয়ে থামল একটা গাছের শিকড়ের মাঝে। ধড়বিহীন শরীরটা খানিকক্ষণ সোজা হয়ে থেকে আস্তে করে কাত হয়ে পড়ে গেল কাদার মাঝে। অন্য বিজাপুরি সৈন্যরা জঙ্গলের আরো গভীরে পালিয়ে যেতে চেষ্টা শুরু করে দিল। এদিকে আবার বারুদের গন্ধ আর বন্দুকের কড়কড় আওয়াজ শুনে শাহজাহান বুঝতে পারেন যে, নিশ্চয়ই কয়েকজন নির্বোধ বিজাপুরি চেষ্টা করেছিল বন্দুকধারীদের সৃষ্ট দেয়াল ভেঙে পার হতে। ঘোড়াগুলোকে মুক্ত করে তাঁবুগুলোতে আগুন ধরিয়ে দাও। চিৎকার করে উঠলেন তিনি। কিন্তু প্রায় সাথে সাথে শুনতে পেলেন আরেকটা চিৎকার বিজাপুরি সৈন্য এখানে আমার কাছে।
ঘোড়া ঘুরিয়েই পরিষ্কার জায়গার দূরতম কোণে ত্রিশ-চল্লিশ জনের সশস্ত্র অশ্বারোহী দল দেখতে পেলেন শাহজাহান। নেতৃত্ব দিচ্ছে লম্বা এক সৈন্য। আবদ্ধ জায়গায় আটকে পড়া সৈন্যদের চেয়ে তারা নিশ্চয়ই আরো ভালোভাবে প্রস্তুত হবার সময় পেয়েছে, কিন্তু এখানে কাদা মাটিতে মাখামাখি হয়ে আছে রক্ত।
আবারো দলবদ্ধ হও চিৎকার করে নিজের লোকদের আদেশ দিলেন শাহজাহান, সারি ঠিক করে একত্রিত হও। গাছের আড়ালে হয়তো আরো বিজাপুরি সৈন্য লুকিয়ে থাকতে পারে, তিনি চান না তার সৈন্যরা তাড়াহুড়োয় কোন ফাঁদে পা দিক।
ডান এবং বাম পাশ থেকে, দৃষ্টিসীমার বাইরে শুনতে পেলেন মোগল সৈন্যদের সাথে বিজাপুরি সৈন্যদের যুদ্ধের শব্দ। যদিও ঠিকভাবে বলতে পারবেন না যে কীভাবে কী হচ্ছে, কিন্তু বিশ্বাস করেন যে তাঁর সৈন্যরা নিশ্চয়ই তাদের জন্য দেয়া নির্দেশ স্মরণে রেখে নিয়ম বজায় রাখবে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে চারপাশের ন্যূহ ঠিক রেখে সামনে এগিয়ে চলা, শত্রুকে ধাওয়া করে একটা জায়গায় আবদ্ধ করে ফেলা যেখান থেকে তাদেরকে ধ্বংস করা সহজতর হবে।
বিজাপুরি অশ্বারোহীরা বুঝতে পারলো যে তারা সংখ্যায় নগণ্য, তাই খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করাটা উচিত হবে না। তার পরিবর্তে পেছনে ঘটে যাওয়া সংঘর্ষ থেকে বেঁচে যাওয়া দুই/তিনজনকে নিয়ে এরই মাঝে ঘোড়া ঘুরিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে গহীন জঙ্গলে।
তাদের পেছনে নিজের ঘোড়া ছুটিয়ে শাহজাহান উপলব্ধি করলেন যে সামনে তেমন গভীর নয়, গাছের চেয়ে ঝোঁপঝাড় বেশি, মাটিতেও সূর্যের আলো এসে পড়েছে যেখানে সেখানে, তবে মাটি বেশ ভেজা। প্রথম প্রথম বিজাপুরিদের পদচিহ্ন দেখে অনুসরণ করা কঠিন হল না। ভাগ্য সহায় থাকলে এভাবেই তারা মূল শিবিরে পৌঁছে যেতে পারবেন। প্রখর হল সূর্যের আলোর উজ্জ্বলতা, কাদার মাঝে আয়নার মত প্রতিফলিত হচ্ছে, গরম হয়ে উঠেছে বাতাস, শাহজাহানের দুই কাঁধের ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে ঘাম বিন্দু। কানের কাছে পিনপিন করছে মশার দল, চারপাশে তাকালেন সম্রাট, কে জানে কোন ঝোঁপ কিংবা পড়ে থাকা গাছের আড়ালে কোন বিজাপুরি লুকিয়ে আছে কিনা হঠাৎ আক্রমণের উদ্দেশ্যে, দেখা গেল না কাউকে।
হঠাৎ করেই সামনের দিকে ঝুঁকে হুমড়ি খেয়ে পড়ল শাহজাহানের ঘোড়া। আরেকটু হলেই ফেলে দিচ্ছিল তাঁকে। রীতিমত যুদ্ধ করে ঘোড়াকে শান্ত করলেন সম্রাট। কিন্তু আবারো চলার চেষ্টা করতেই টলমল করে উঠল অবোধ প্রাণীটা। হাত তুলে নিজের দুপাশের সৈন্য সারিকে থামার নির্দেশ করে ঘোড়া থেকে নামলেন শাহজাহান। এরপর হাত ঢুকিয়ে দিলেন ঘোড়ার সামনের ক্ষুরের লোমের মাঝে। বাম ক্ষুর স্পর্শ করতেই ব্যথায় ককিয়ে উঠল ঘোড়া। আমার ঘোড়া চলার শক্তি হারিয়েছে। অশোক সিংকে ডেকে বলে উঠলেন ম্রাট। অপেক্ষা করছেন আরেকটা বাড়তি ঘোড়া আসার, এমন সময় পঞ্চাশ গজ দূরে নিচু পাহাড়ের উপর দেখতে পেলেন উদয় হল এক একাকী ঘোড়সওয়ার। সূর্যের আলো পড়ে চকচক করে উঠল শিরস্ত্রাণ। বিজাপুরিদের সাহায্যে এগিয়ে আসা সেই সেনাপতির হাতে উড়ছে সোনালি হলুদ সিল্কের ব্যানার-বিজাপুরের রং নির্ঘাৎ শান্তিচুক্তির পতাকা। ফুসফুসের সমস্ত জোর খাঁটিয়ে চিৎকার করে উঠল সেনাপতি, আমি আমাদের সেনাপ্রধানের কাছ থেকে একটা বার্তা এনেছি। জাহাপনা, আমরা জানি যে আপনার বাহিনী আমাদেরকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেছে। উভয় পক্ষেই আর রক্তপাত না ঘটিয়ে আমরা আত্মসমর্পণ করতে চাই।
তোমার স্মৃতিভ্রম হয়েছে বিজাপুরি। উত্তর দিলেন শাহজাহান। আগে একবার আত্মসমর্পণের প্রস্তাব ভঙ্গ করেছ তোমরা, মৃত্যুবরণ করেছে নিরপরাধ লোক। আজ আর কোন দর কষাকষি হবে না। শান্তিচুক্তি পতাকার নিরাপত্তা পাবার কোন অধিকার নেই বিশ্বাসঘাতকদের, তাই আমি ধরার আগেই চলে যাও। মানুষটা তাড়াতাড়ি ঘোড়া ছুটিয়ে চলে যেতেই আকাশের দিকে তাকালেন শাহজাহান। সূর্যের অবস্থান দেখে বোঝা যাচ্ছে যে এখনো তেমন বিকাল হয়নি। যদি আল্লাহ চান তো সূর্যাস্তের মাঝেই বিজয়ী হবেন তিনি।
চল্লিশ মিনিট পরে শত্রুর বন্দুক থেকে ন্যাকড়া পেঁচানো বল এসে আঘাত করতেই শাহজাহান বুঝতে পারলেন যে শত্রুসৈন্যদের মূল ঘাঁটির অবস্থানের কাছে চলে এসেছেন। তার কাছ থেকে কয়েজ গজ বাম পাশে এক তরুণ রাজপুত্ৰ সৈন্যের উরুতে লাগল প্রথম বল। রক্ত ঝরতে লাগল ক্ষত থেকে। কাত হয়ে ঘোড়া থেকে পড়ে গেল তরুণ। আরেকজন অশ্বারোহী চিৎকার করেই উপুড় হয়ে পড়ে গেল নিজের ঘোড়র উপর, হাত থেকে পড়ে গেল বর্শা। তৃতীয় আঘাত লাগল একটা ঘোড়ার গলাতে, পরপর দুবার ধীরে ধীরে পড়ে গেল ঘোড়াটা, তার আগে সময় দিল নিজের আরোহীকে নিরাপদে লাফ দিয়ে সরে যাবার জন্য। মুহূর্তের জন্য সারা শরীর কেঁপে উঠল অবলা জীবটার, তারপর ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটল কাদা মাটিতে, অবশেষে স্থির হয়ে গেল।
নিচু হয়ে থাকো। গর্জন করে আদেশ দিলেন সম্রাট, আগে বাড়লেন ঘোড়া নিয়ে। খোলা ঝোঁপের মাঝ দিয়ে বড়সড় একটা তাবু দেখতে পেলেন, বুঝতে পারলেন এর পেছনেই আছে বেশির ভাগ বিজাপুরিরা। ব্যারিকেড হিসেবে উল্টো করে ফেলে রেখেছে রসদবাহী গাড়ি। কিন্তু চারপাশ থেকে ঘিরে থাকায় বুঝতে পারছে না এর চেযে অবস্থান ভাল করা যায় কীভাবে অথবা কোথায় আশ্রয় নেয়া যায়। চারপাশ থেকে কেবল শোনা যাচ্ছে এগিয়ে আসা মোগল সৈন্যদের রণহুঙ্কার। প্রতিরক্ষা ব্যুহ এখনো ঠিক আছে আর তিনি যেভাবে পরিকল্পনা করেছেন সেভাবেই চারপাশ থেকে এগোচ্ছে সৈন্যরা একসাথে ভাবতেই অভিযান শেষ করার তাড়নাতে নতুন করে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠলেন শাহজাহান।
ঝটকা মেরে বাম পাশে সরে গিয়ে তাঁবু ঘুরে এগিয়ে গেলেন বন্দুকের গুলি ভরার কাজে ব্যস্ত থাকা বিজাপুরি বন্দুকধারীর দিকে। মানুষটার ডান বাহু ছুঁয়ে ফেলল তার ফলা; ফলে হাত থেকে বন্দুক আর বারুদ ঢোকাবার শিক ফেলে দিয়ে চিৎকার করে দৌড় লাগালো বিজাপুরি। আবারো আঘাত হানলেন শাহজাহান। বন্দুকধারীর পিছন দিক উন্মুক্ত হয়ে দেখা যেতে লাগল হাড়। ঘুরতেই দেখতে পেলেন হলুদ পাগড়ি পরিহিত এক বিশালদেহী লোক ডান হাতে সড়কি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা উল্টো করে রাখা গাড়ির গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে। ঠিক সেই সময়ে পাশ দিয়ে যাচ্ছিল এক মোগল সৈন্য, মানুষটা সর্বশক্তি দিয়ে হাতের সড়কি ঢুকিয়ে দিল ঘোড়ার পাকস্থলিতে। পড়ে গেল ঘোড়া, নিজের উরুর ফাঁকে আটকে ফেলল মোগল সৈন্যকে। নিজেকে বাঁচানোর জন্য চেষ্টা করছে মোগল সৈন্য এমন সময় হলুদ পাগড়ি মাথায় বিজাপুরি সৈন্য লাফ দিয়ে চড়ে বসল তার উপর। দুই হাতে মাথার উপর তুলে ফেলল ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত গড়াতে থাকা সড়কিটাকে। এতটাই মগ্ন নিজের কাজে যে লোকটা শাহজাহানকে দেখতে পেল না এগিয়ে আসতে, যতক্ষণে দেখতে পেল অনেক দেরি হয়ে গেছে ততক্ষণে। নিজের ঘোড়ার পিঠে নিচু হয়ে লোকটার ঘাড়ে তলোয়ার চালালেন সম্রাট, অর্ধেক কাটা মাথা নিয়ে নিজের রক্তের পুকুরেই খপ করে পড়ে গেল বিজাপুরি সৈন্য।
কিন্তু হঠাৎ করেই যেন দুলতে লাগল শাহজাহানের পৃথিবী। নিজেকে অনুভব করলেন যেন শূন্য। ভাসছেন, তারপর ধপ করে পড়ে গেলেন ভেজা মাটিতে। আহত অবস্থায় ঘোড়ার খোঁজে চারপাশে তাকিয়ে দেখতে পেলেন জন্তুটা হাঁটু গেড়ে বসে আছে মাটিতে। উল্টে রাখা গাড়ির সাথে ধাক্কা খেয়েই এ কাণ্ড ঘটেছে নির্ঘাৎ। কয়েক ফুট দূরত্বে পড়ে আছে তাঁর তলোয়ার। হ্যাঁচোড় পাচোড় করে হাঁটুর উপর ভর দিয়ে অস্ত্র পর্যন্ত গেলেন; কিন্তু সেই মুহূর্তের পেছনে হালকা করে ধাক্কা মারল এক জোড়া জুতা সুদ্ধ পা, তাঁকে ফেলে দিল গভীর কাদা মাটিতে। নাক মুখ ভরে গেল কাদা পানিতে। নিঃশ্বাসের জন্য হাঁসফাঁস করতে লাগলেন তিনি। চেষ্টা করলেন উঠে দাঁড়াতে কিন্তু অনুভব করলেন একটা হাত টেনে ধরল শিরস্ত্রাণ, চুলের মুঠি ধরে বাধ্য করল আবারো পানির মাঝে মুখ ডুবিয়ে রাখতে। দমবন্ধ হয়ে প্রায় মারা যাবার জোগাড়, ফুসফুসে মনে হল আগুন ধরে গেছে। নিজের সবটুকু শক্তি দিয়ে চেষ্টা করলেন আক্রমণকারীর হাত ছাড়াতে কিন্তু লোকটা বেশ শক্তিশালী, প্রতিবার নিশ্বাস নেবার চেষ্টাতে বরঞ্চ নাকে মুখে ঢুকতে লাগল আরো বেশি কাদা পানি। মরিয়া হয়ে শেষ চেষ্টা করলেন সম্রাট। কাপড়ের ভেতর হাত ঢুকিয়ে খুঁজতে লাগলেন দ্বিতীয় ছুরি। পেয়ে যাবার পর শক্ত হাতে ধরলেন হাতল। অন্ধের মত চালালেন উপর দিকে শত্রুর উদ্দেশে। শূন্য বাতাস কেটে গেল ছুরির ফলা। কানের পর্দা ফেটে মনে হল রক্ত পড়তে থাকবে আরেকটু পরে, আবার চেষ্টা করলেন তিনি। এবার ফলা গিয়ে বিদ্ধ হল কোন একটা পেশীর মাঝে। বিস্মিত উচ্চস্বরের চিৎকার শোনা গেল, সাথে সাথে চুলের মুঠি ধরে রাখা হাতটাও আলগা হয়ে গেল।
গায়ের উপর থেকে ধাক্কা দিয়ে লোকটাকে ফেলে দিয়ে একপাশে গড়িয়ে গেলেন শাহজাহান। হাঁ করে মুখ খুলে নিঃশ্বাস নিলেন প্রাণ ভরে। শত্রু লম্বা আর ভারী শরীর-মাটিতে গড়াগড়ি খেতে খেতে হাত দিয়ে চেপে ধরেছে বুকের বাম পাশের ক্ষত। আরো কয়েকবার গভীরভাবে নিঃশ্বাস নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন ম্রাট, এগিয়ে গিয়ে ধাক্কা দিলেন। লোকটার পাকস্থলী বরাবর, তারপর জোর করে মাথা চেপে ধরলেন ঠিক সেই কাদা পানির মাঝে যেখানে একটু আগে যুদ্ধ করেছেন তিনি। মানুষটার দুই পায়ের ফাঁকে বসে কাদা মাটির ভেতরে যত শক্ত করে সম্ভব ধরে রাখলেন মাথা। ইচ্ছে মতন হাত-পা ছুঁড়ে নিজেকে বাঁচাতে চাইল বিজাপুরি সৈন্য। কিন্তু ধরে রাখলেন শাহজাহান। কয়েক মুহূর্ত ভয়ংকরভাবে লাথি চালাল মানুষটার পা জোড়া, তারপরই নিস্তেজ হয়ে পড়ল শরীর। উঠে দাঁড়িয়ে তলোয়ার নিলেন সম্রাট। এরপর খানিক দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে গেলেন উল্টে থাকা গাড়ির কাছে। বুঝতে চাইছেন যুদ্ধের কী অবস্থা।
জাহাপনা, আপনি ঠিক আছে তো? যুদ্ধের মাঝে আমি আপনাকে হারিয়ে ফেলেছি। নিজের ঘোড়া থেকে ঝুঁকে এলো অশোক সিং।
আমার নতুন ঘোড়াটাও আহত হয়ে পড়ে গেছে।
আপনার হাত দিন, জাহাপনা, আমার পেছনে উঠে আসুন।
যদিও যুদ্ধ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, তারপরেও মাটিতে থাকার চেয়ে ঘোড়ার পিঠে থাকাটাই নিরাপদ, ঠিকই বলছে অশোক সিং, ভাবলেন শাহজাহান, যদিও চারপাশে ছড়িয়ে থাকা মৃতদেহগুলো বিজাপুরি সৈন্যদের প্রতিরোধ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। দেখতে পেলেন, একটা তাঁবু থেকে বের হয়ে এসেছে চারজন হলুদ পোশাক পরা সৈন্য। হাতের অস্ত্রও ফেলে দিয়েছে। এর একটু দূরেই এক বিজাপুরি সৈন্যকে হত্যা করেছে মোগল অশ্বারোহী, যার তলোয়ার এখনো তার বর্শার মাথার সাথে ঝুলছে রসদবাহী গাড়িতে।
জাহাপনা, বেশ কয়েকজন বন্দি আটক করেছি আমরা। আপনার নির্দেশ কি এখনো পূর্বের মতনই আছে?
হ্যাঁ। হত্যা করো। কিন্তু তাড়াতাড়ি আর নিখুঁতভাবে।
চারপাশের ধ্বংসলীলার দিকে তাকিয়ে ম্রাট ভাবলেন, মমতাজের মৃত্যু আর তাঁর অসম্ভব যাতনার চেয়ে এ সৈন্যদের মৃত্যুযন্ত্রণা তো কিছুই না। শত্রুর মৃত্যুতেও কোন আনন্দ খুঁজে পেলেন না, শুধু এটুকুই স্বস্তি যে যুদ্ধ শেষ হয়েছে, আর তিনি জয়ী হয়েছেন। অবশেষে তিনি এবার আগ্রাতে ফিরে যাবেন ভালোবাসার স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে তোলার জন্য ভালোবাসার নারী মমতাজ।
.
১.৭
নিচু একটা পর্বতের মাথায় পৌঁছেই সৈন্য সারিকে থেমে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন শাহজাহান। চোখের উপর হাত দিয়ে ছায়া তৈরি করে উত্তরে তাকালেন আগ্রার দিকে। মধ্যাহ্নের তাপে দুর্গের পরিচিত বালিপাথরের দেয়াল ঠিকরে বের হচ্ছে লাল আভা। পর্বতের পাদদেশ থেকে শুরু হওয়া সমভূমির মাঝখানে অবস্থিত শহরের বাইরের দিকে দেখা গেল সৈন্যদের বিশাল লম্বা এক সারি–কেউ ঘোড়ার পিঠে, আবার কেউবা হাতির পিঠে এগিয়ে আসছে মোগল সম্রাট ও তার বিজয়ী সেনাবাহিনীকে ঘরের উদ্দেশ শেষ মাইলটুকু সঙ্গ দেবার জন্য।
যথাযোগ্য অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই দুর্গে পুনঃপ্রবেশ করবেন তিনি। ফটকের সামনে বাদ্য বাজানো হবে, দেয়ালে উড়বে সবুজ পতাকা কিন্তু তিনি নির্দেশ দিয়েছেন যে কোন ফুল ছোঁড়া হবে না, কিংবা সোনা রুপা মুদ্রার বৃষ্টি, কোন নর্তকী বা শিল্পীর নাচ গান হবে না, এসব হত যদি মমতাজ এখনো তার পাশে থাকতেন। যখন থেকে দারা আর জাহানারা মমতাজের মৃতদেহ আগ্রা নিয়ে এসেছে, তখন থেকেই তিনি অপেক্ষা করে আছেন এই মুহূর্তটির জন্য। এখন দুঃসহ বেদনাদায়ক মনে হল এই চিন্তা যে রাজকীয় গৃহে ফিরে এসেছেন তিনি, দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে অপেক্ষায় আছেন দুঃখী সম্রাজ্ঞী যিনি কিনা আর কখনো তাদেরকে দেখতেই পারবেন না।
তারপরেও এটি সম্রাটের দায়িত্ব, এটি তাকে করতেই হবে। জ্যোতির্বিদরা জানিয়েছে যে প্রত্যাবর্তনের জন্য আজকের দিনটির মত শুভ দিন আগামী কয়েক সপ্তাহে আর পাওয়া যাবে না। তার কাছে এ ধরনের বিষয়ের কোন গুরুত্ব না থাকলেও জনগণের কাছে আছে। যদিও তিনি ম্রাজ্ঞীকে হারিয়েছেন, এটি আচরণে প্রকাশ করতে হবে যে সৌভাগ্য দেবী এখনো তাঁর এবং রাজবংশের সাথেই আছে। আর এই বার্তা সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার জন্য পুত্রদের সাথে নিয়ে দুর্গের শহরের রাস্তায় হালকা চালে ঘোড়া নিয়ে ঘুরে বেড়াবেন। দারা শুকোহ্ শহর থেকে সৈন্য দলের সাথে এগিয়ে আসছে। অন্যদিকে শাহ সুজা, আওরঙ্গজেব আর মুরাদ পিতার মত শোকের সাদা পোশাক পরিহিত হয়ে সবুজ লাগামঅলা সাদা ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে আছে শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করার জন্য।
অনুষ্ঠানাদি সম্পন্ন হয়ে যাবার সাথে সাথে যমুনা হয়ে মমতাজের সমাধিতে যাবেন তিনি। উস্তাদ আহমাদের পাঠানো সংবাদ ছিল কেমন ভাসা ভাসা টাইপের। চোখ সরু করে দুর্গের পিছনে নদীর বাঁকের দিকে তাকালেন শাহজাহান, চেষ্টা করলেন নির্মাণ স্থানটা দেখতে কিন্তু দিগন্তের কাছে ধূসর ছায়ায় ঢেকে আছে সবকিছু।
আব্বাজান, দেখেন, দারা এসেছে… চিন্তার সূতায় বাধা দিল শাহ সুজা।
পর্বতের নিচে তাকিয়ে দ্রুত ঘোড়া নিয়ে ছুটে আসা দেহ নজরে পড়ল। খুশি হয়ে উঠলেন সম্রাট। আল্লাহ মমতাজকে নিয়ে গেছেন; কিন্তু অনিন্দ্য কান্তি চার পুত্রের মাধ্যমে দীর্ঘজীবী হবে তাঁর রাজবংশ। কৃতজ্ঞ হবার জন্য অনেক কিছুই পেয়েছেন তিনি।
*
পরের দিন সকাল। শাহজাহান তাকিয়ে আছেন ধূসর, প্রায় বর্ণহীন আকাশের দিকে। দরবারে একজন ইতালীয় বণিকের নিয়ে আসা বৈজ্ঞানিক যন্ত্রটি অনুযায়ী আজ হচ্ছে বছরের সবচেয়ে উত্তপ্ত দিন। যন্ত্রটি দেখলে বেশ কৌতূহল জাগে। একটা লম্বা কাঁচের টিউবের সাথে লাগানো আছে পানি ভর্তি কাঁচের বাল্ব। টিউবের উপর বেশ কয়েক সারি লাইন। ইতালিয়ান বণিকের কথানুযায়ী গ্যালিলিও নামেক একজন মানুষ এটি আবিষ্কার করেছেন। ইউরোপে নাকি এটি বেশ প্রচলিত। বণিক আসলান বেগকে দেখিয়ে দিয়েছে যে কীভাবে এটি ব্যবহার করতে হয়। এই জটিল প্রক্রিয়া দেখে মুগ্ধ হয়ে গেছে দারা শুকোহ্, যদিও যন্ত্রটার কার্যকারিতা নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান সম্রাট। হিন্দুস্তানের সমভূমিতে প্রায় প্রতিটি দিনই তো গরম, তাই না?
বালিপাথরের মঞ্চ যেখানে আকৃতি পাচ্ছে সে দিকে চলেছেন শাহজাহান। উস্তাদ আহমাদ অপেক্ষা করছেন। বাতাসে ভেসে থাকা বিশী ধুলা গলার মাঝে যেতেই কাশতে লাগলেন তিনি।
জাহানারা আপনি যদি আমার সাথে ঐ দিকের উঁচু জায়গায় আসেন তাহলে চারপাশের দৃশ্য পরিষ্কারভাবে দেখতে পাবেন আর বাতাসও ভালো থাকবে। বলে উঠল উস্তাদ আহমাদ। উত্তাপে শক্ত হয়ে যাওয়া মাটির উপর দিয়ে উস্তাদ আহমাদের সাথে ছোট পাহাড়টার দিকে চললেন সম্রাট। ঠিক কথাই বলেছে তার স্থপতি–এখানে দৃশ্য ভালোই দেখা যাচ্ছে। বিশাল মঞ্চের চারপাশ পরিষ্কার দেখতে পেলেন তিনি–উস্তাদ আহমাদের হিসাব অনুযায়ী ৯৭০ ফুট লম্বা আর ৩৬৪ ফুট চওড়া এর উপরেই স্থাপিত হবে সমাধিসৌধ।
আমার এখনো ভাবতে অবিশ্বাস্য লাগে যে নদীর এত কাছে ভূমি কীভাবে এত ভার বইবে।
হেসে ফেলল উস্তাদ আহমাদ। জাহাপনা, আমি বারংবার হিসাব কষে দেখেছি। আর তাই পুরোপুরি নিশ্চিত যে আমরা ঠিকঠাকভাবেই নদীর তীর শক্তিশালী করেছি, এতেই কাজ হবে। আমি নদীর তীরের কাছাকাছি খনি খননের নির্দেশ দিয়েছি শ্রমিকদেরকে, ঢালু অনুযায়ী গভীরতা কম বেশি করা হবে। এরপর ইট আর চুনা বালি দিয়ে তৈরি মন্ড দিয়ে বাঁধানো হবে এদের পাড়, ভেতরে ভরে ফেলা হবে আরো মন্ড আর আলগা পাথরের টুকরা দিয়ে। এছাড়াও শ্রমিকদেরকে আরো আদেশ দিয়েছি খনির উপর মঞ্চকে ধরে রাখার জন্য খিলান বসানোর জন্য।
কিন্তু শ্রমিকেরা নদী তীরেও খনন করছে না?
হ্যাঁ জাহাপনা। তারা বিশাল বড় বড় গর্ত খুঁড়ছে। এগুলোর মাঝে চুনা-বালি দিয়ে তৈরি মন্ড ভর্তি আবলুস কাঠের বাক্স ফেলা হবে যেন যমুনা নদীর জোয়ার ভাটার সময়ে কোন সমস্যা না হয়।
মাথা নাড়লেন শাহজাহান। সবকিছুই ভেবে রেখেছে উস্তাদ আহমাদ।
বর্তমানে আমাদের এখানে বিশ হাজার শ্রমিক কাজ করছে। এখানে তাদের থাকার জায়গা। নির্মাণ স্থানের দক্ষিণ দিকে হাত তুলে দেখালো স্থপতি। কুঁড়েঘরের সাথে বণিকদের জন্য চারটি সরাইখানা আছে। প্রতিদিন তাদের উট আর ঘোড়ার গাড়ি এসে পৌঁছায় আর মাঝিরা যমুনা নদীতে বার্জে করে নিয়ে আসে মালপত্র। পরলোকগত সম্রাজ্ঞীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তারা তাদের শহরের নাম রেখেছে মমতাজবাদ। আমি আশা করি এতে আপনার কোন সমস্যা নেই জাহাপনা।
না, ঠিক আছে। কিন্তু আমাকে বলো যে যা দরকার তার সবকিছু আছে এখানে? যথেষ্ট বালিপাথর এসেছে?
হ্যাঁ, এরই মাঝে ভালো একটা মজুদ গড়ে উঠেছে, আপনি তখনো দক্ষিণে ছিলেন; তাই আমি দশ মাইল লম্বা একটি রাস্তা তৈরি করার জন্য শাহজাদা দারার অনুমতি নিয়েছি। যেন স্থানীয় খনি থেকে সঁড়ের দল সহজেই পাথর বোঝাই গাড়ি টেনে আনতে পারে। আপনি কি রাজমিস্ত্রীদের কাজ দেখতে চান, জাহাপনা? এখানে তুলার চাঁদোয়ার নিচে কাজ করছে একটি দল।
সাদা ধুতি পরনে আর কপালে হিন্দুদের লাল তিলক দেয়া একজন মধ্যবয়স্ক লোক ঝুঁকে কাজ করছে বিশাল বড় এক টুকরা চৌকোনা বেলেপাথরের উপর। আর তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে দুটি অল্প বয়স্ক ছেলে, চেহারা দেখে পরিষ্কার বোঝা গেল যে লোকটার ছেলে এরা। শাহজাহান কাছে এগিয়ে যেতেই দেখতে পেলেন যে লোকটা পাথরের টুকরাটার উপর পেরেকের মত কিছু জিনিস এক সারিতে বসিয়ে দিচ্ছে হাতুড়ির বাড়ি মেরে। হঠাৎ করেই সম্রাট আর উস্তাদ আহমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে ঝটকা মেরে সোজা হয়ে গেল।
আমরা বিরক্ত করার জন্য আসি নি। কাজ চালিয়ে যাও। বলে উঠলেন শাহজাহান।
সন্ত্রস্ত ভঙ্গিতে অতিথিদের দিকে তাকিয়ে আবারো কাজ করা শুরু করল লোকটা। পাথরের উপর কাজ করতে করতে ঘাম ঝরছে তার পেশীবহুল হাত বেয়ে। বেশ কয়েক মিনিট পরে এক ছেলের হাতে ধরিয়ে দিল হাতুড়ি, সে-ও একইভাবে ঘা মারতে লাগল তারপর হঠাৎ করেই নিখুঁতভাবে কেটে গেল পাথর। বড় একটা কাঠের টুকরো ব্যবহার করে কনিষ্ঠজন একপাশে নিয়ে গেল একটি টুকরো। সন্তুষ্টির ভঙ্গিতে সদ্যকাটা টুকরাটার উপর আঙুল বুলালো রাজমিস্ত্রী। এরপর ভালো একটা বাটালি তুলে নিয়ে খুব যত্নের সঙ্গে কিনারাগুলো মসৃণ করে তুলতে লাগল।
রাজমিস্ত্রীরা তাদের বাটালি দিয়ে পাথরের উপর কাজ করছে আর একেবারে অ্যালবাস্টারের মত মসৃণ না হওয়া পর্যন্ত পলিশ করছে এর উপরিভাগ।
ব্যাখ্যা করে জানালো উস্তাদ আহমাদ। প্রতিটি ব্লক প্রস্তুত হয়ে গেলে জায়গামত তুলে নিয়ে যাওয়া হবে; এরপর ঠিকভাবে নিরাপদে চুল-বালির লোহার পাত আর বন্ধনী দিয়ে জুড়ে দেয়া হবে। এদের মাঝে একটি ফাটলও খুঁজে পাবেন না আপনি।
কিন্তু মনোযোগ দিয়ে রাজমিস্ত্রীর কাজ দেখছেন শাহজাহান। পাথরের মাঝে ত্রিকোণা করে একটি গর্ত খুড়ছে লোকটা। কী করছো তুমি?
আমার চিহ্ন তৈরি করছি। এটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় কাজ আর আমি চাই কোন একটা চিহ্ন রেখে দিতে যেন বোঝা যায় যে এটা আমার কাজ।
অন্যান্য রাজমিস্ত্রিরাও একই কাজ করছে, জাহাপনা, আমি বাধা দেয়ার কোন কারণ খুঁজে পাইনি।
আর আমিও তা করব না। নিজেদের কাজের প্রতি কারিগরদের এহেন গর্বে আমি খুশি হয়েছি। এটা রাখো। রাজমিস্ত্রীর হাতে কয়েকটা কয়েন তুলে দিলেন শাহজাহান তোমার দক্ষতা আর কাজের প্রতি আগ্রহের জন্য ধন্যবাদ।
এরপর ঘুরে তাকালেন, উস্তাদ আহমাদ, তোমার নকশা অসাধারণ একটা সৃষ্টি হয়েছে। তারপরেও কী যেন নেই?
জাহাপনা? বিরক্ত হবার বদলে বিস্মিত হলেন উস্তাদ আহমাদ।
সমাধির প্রবেশদ্বারে রত্ন পরিহিত মমতাজকে স্বপ্নে দেখার পর থেকে শাহজাহান ভাবছেন যে কেমন করে একে বাস্তবে রূপ দেয়া যায়। আমি সমাধির জন্য আরো গহনা চাই। মার্বেলের মাঝে রত্ন খোদাই করে দেয়া হোক। আমার চেয়ে এ সম্পর্কে ভালো তেমন কেউ জানে না। আমি নিজে শ্রেষ্ঠ রত্ন নির্বাচন করে দেব রাজকোষ থেকে। যদি কোন পাথরের পর্যাপ্ত মজুদ না থাকে সবুজ পান্না, হতে পারে অথবা নীলকান্ত মণি সীমানার বাইরে থেকে আমদানি করব আমি। আর এ কাজ করার সময় আমার কয়েকজন হিন্দু প্রজা আমার সাথে থাকবে, যারা আমি জানি এ কাজ করতে দক্ষ, এই কলাকে তারা বলে পাঞ্চিকূরা-পাথরে খোদাই করা। এছাড়া ইউরোপীয় কারিগরদেরকেও নিয়োগ করতে পারি আমি কৈশোরে পিতার দরবারে আসা দুজন ইতালীয়ের কথা মনে আছে আমার। তারা তাদের জন্মভূমির ছবি নিয়ে এসেছিল–ফ্লোরেন্স এই নামেই ডাকছিল–দেখতে মনে হচ্ছিল ছবি, কিন্তু আসলে অর্ধদামি পাথরের ছোট ছোট টুকরার সমাহার।
মার্বেলের উপর কোন ধরনের আকৃতি আপনি ফুটিয়ে তুলতে চান, জাহাপনা? সম্ভবত জ্যামিতিক নকশা?
না, ফুল, সবুজ পাতা আর লতানো চারা, এতটাই সত্যি হবে যেন মনে হবে যে সমাধির উপরেই জন্মেছে এগুলো, তাহলে আমার পত্নীর সমাধি জীবন্ত হয়ে উঠবে। আমি আরো কিছু কারুকাজ চাই। আমি চাই অন্য কারিগরেরা ঠাণ্ডা মার্বেলের মাঝে জীবনের স্পন্দন নিয়ে আসবে লম্বা আইরিস আর সরু উঁটার টিউলিপ বাতাসে দোল খাচ্ছে এমন দৃশ্য খোদাই করে; ঠিক যেমনটা হয় কাশ্মিরে। আমি জানি যে এটা করা সম্ভব।
*
হে প্রশান্ত আত্মা!
প্রফুল্লচিত্তে স্বীয় প্রভুর দিকে প্রত্যাবর্তন কর,
প্রভু তোমার উপর সন্তুষ্ট এবং তুমিও প্রভুর উপর সন্তুষ্ট থাক।
তুমি আমার বান্দাদের (গোলামদের) সান্নিধ্যে গমন কর।
এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ কর।
ইয়া আইয়্যাতুহান নাফসুল মুতমাইন্নাতুর জিয়ী ইলা রাব্বিকি রাদ্বিয়াতাম মারদ্বিয়াহ্ ফাঁদখুলী ফী ইবাদি ওয়াদ খুলী জান্নাতি। (আল-কোরআন; সুরা : ফজর : আয়াত-৩)
কী মনে হয় আব্বাজান? আমি এবং দারা কোরান থেকে সঠিকটিই নির্বাচন করতে পেরেছি? এটা সহজ কাজ ছিল না। নত স্বরে জানালো জাহানারা।
মাথা নাড়ালেন শাহজাহান। আগ্রাতে ফিরে আসার সাথে সাথেই তিনি তার জ্যৈষ্ঠ সন্তানদের বলেছিলেন শব্দ বাছাই করতে। ফটকের কাঠামোর চারপাশে খোদাই করার জন্য, এ পদ সম্পূর্ণভাবে উত্তম। দর্শনার্থীদেরকে মনে করিয়ে দিবে যে তারা একই সাথে একটি পবিত্র স্থান আর একটি পৃথিবীর স্বর্গে প্রবেশ করছে।
আমি আমানত খানকে নির্দেশ দেব শব্দগুলো খোদাই করে তারপর যেন পাথরকাটা কারীদের কাছে দেয়া হয় মসৃণ করে তোলার জন্য।
তিনি একজন সত্যিকারের কলাকার। তাঁর ক্যালিগ্রাফি বেশ প্রাণবন্ত।
এই কারণেই তাকে সিরাজ থেকে ডেকে পাঠিয়েছে আমি।
শাহজাহান টেবিলের উপর তাকালেন। পুরো ভবনটির কাঠের একটি মডেল রাখা আছে সেখানে। চারটি সাদা মিনার মার্বেল মঞ্চের চারপাশে বেশ উৎসাহব্যঞ্জক। সম্রাটকে বুঝিয়ে বলার সময় উত্তেজিত উস্তাদ আহমাদ এদের নাম রেখেছে স্বর্গের সিঁড়ি, এগুলো নাকি নকশার মাহাত্ম বাড়িয়ে তুলবে। এ মডেলটার দিকে তাকিয়ে থেকেই সন্তুষ্ট হয়ে যান শাহজাহান। কিন্তু এরপরই হাসি মুছে গেল মুখ থেকে।
অনেক বছর লেগে যাবে এ সমাধির প্রস্তুত হতে, তারপরই কেবল মাত্র বরণ করে নেবে তোমার আম্মাজানের শরীর। এর মাঝে কাজের তদারকি আর বিল পরিশোধ করা এটুকুই করতে পারি আমি।
আপনি কি চান আমি বিল দেখাশোনা করি? সাম্রাজ্যের প্রথম শাহজাদি হওয়া সাপেক্ষে আমার কিছু দায়িত্ব আছে।
আমি তোমাকে এ পদবী দিয়েছি কারণ এটি তোমার মায়ের ছিল; তোমার উপর কাজের বোঝা ফেলার জন্য নয়।
আপনি যখন দাক্ষিণাত্যে ছিলেন, তখন আপনার হয়ে যেসব যোগাযোগ আর আবেদন শোনার কাজ করেছি তার চেয়ে তো দুরহ হবে না। এটা আমাকে কিছু করার সুযোগ করে দেবে। দারাকে তো অনেক কাজের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে–আমিও কেন বেশি করতে পারব না?
এটা সত্যি। দারার উপর দায়িত্বের বোঝা বাড়িয়েছেন তিনি, যেমন সেনাবাহিনীর যন্ত্রপাতির পুনর্মূল্যায়ন করা। জাহানারার ভূমিকা হতে হবে আরো সঙ্গত–এমন কাজ যা একজন নারী হারেমে বসে করতে পারে, যেমন মমতাজ করত–কিন্তু এটা বোঝার মত বুদ্ধি তার আছে। ঠিক আছে আমি পারিশ্রমিক তোমার কাছে পাঠিয়ে দেব আর যদি চাও অন্য দায়িত্বও অর্পণ করব। আমি তোমাকে তোমার আম্মাজানের আইভরি সিলও পাঠিয়ে দেব যেন আমার হয়ে রাজকীয় ফরমান জারি করতে পারো।
সম্রাট দেখতে পেলেন খুশি হয়ে উঠেছে জাহানারা। সত্যি কথা বলতে দারার সাহায্যের মত জাহানারার সাহায্য পেলেও খুশি হবেন। তিনি। খোলামেলা ভাব আর সহজাত বুদ্ধির ক্ষেত্রে তারা উভয়েই সমান। এতে অবশ্য বিস্মিত হবারও কিছু নেই। কিন্তু কী হবে তাঁর জ্যৈষ্ঠ্য কন্যার ভবিষ্যত? আকবর নিয়ম করে গেছেন যে সম্রাটের কন্যারা বিবাহ করতে পারবে না। যেন সিংহাসনের দাবি নিয়ে পরিবার সমূহের মাঝে রক্তপাতের সম্ভাবনা কমে যায়। হিন্দুস্তানে মোগলদের প্রথম দিককার ইতিহাস কলুষিত হয়ে আছে এমন সব কাহিনীতে। কিন্তু তারপরেও রাজকীয় কন্যারা কেন তাদের ভাইদের মত একই আনন্দ ভোগ করতে পারবে না?
মমতাজ থাকলে ঠিক বের করে ফেলতেন যে এহেন নিয়মের শুভ দিক কোনটি…কিন্তু হতে পারে এর কোন দিক নেই। রাজবংশের স্থায়িত্বই হচ্ছে প্রধান বিষয়, যেমন আকবর–জ্ঞানী এবং মানবিক ছিলেন তিনি বুঝে গেছেন। মুগ্ধ নয়নে মডেলের দিকে তাকিয়ে থাকা জাহানারাকে দেখলেন শাহজাহান। কন্যাদেরকে খুশি করার জন্য অন্য উপায় বের করবেন তিনি।
জাহানারা, তোমার কথাতে আমার মনে পড়ে গেছে যে তোমার যথেষ্ট বয়স হয়েছে। যদি তুমি স্বাধীন গৃহকন্না চাও তাহলে আমি তোমাকে আলাদা প্রাসাদ দিতে পারি। বেশ সুন্দর একটি আছে–যেটি ব্যবহার করতেন তোমার নানাজানের বাবা গিয়াস বেগ। তুমি রাজি?
এক মুহূর্ত ভাবল জাহানারা। হ্যাঁ ধন্যবাদ কিন্তু আমি ভুলে গিয়েছিলাম… কয়েকটা সংবাদ আছে। সাত্তি আল-নিসা আমাকে জানিয়েছে নিকোলাস ব্যালান্টাইন আগ্রাতে ফিরে এসেছে, বাজারে আছে।
নিকোলাস? সিংহাসনে আসীনের পরপর শেষ এই তরুণ ইংরেজকে দেখেছিলেন শাহজাহান। সে না কোথায় ব্যবসায়িক কাজে গিয়েছিল… কাবুল অথবা সম্ভবত হেরাতে? পরবাসে থাকাকালীন বিপদের দিনগুলোতে তার পারিবারিক বন্ধু হিসেবে বিশ্বস্ততার উদাহরণ ছিল নিকোলাস। এমন কি পিতা জাহাঙ্গীরের দরবারে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে চেষ্টা করেছে শান্তি স্থাপনের জন্য। আমি নিকোলাসের সাথে দেখা করতে চাই। সে আমাদের সে সময়কার বন্ধু যখন আমাদের বন্ধুসংখ্যা ছিল নগণ্য।
পরের দিন নিজের সামনে কুর্নিশরত নিকোলাস ব্যালান্টাইনকে দেখে শাহজাহানের মনে হল যে সে পূর্বের চেয়ে বেশ মোটা চওড়া হয়ে গেছে। আটোমোটো চামড়ার টিউনিক ভেদ করে ফুটে বের হতে চাইছে কাঁধ, আর এই বিদেশীর পরনের বিদেশী প্যান্টালুন ভেদ করে বের হয়ে রয়েছে পায়ের পেশী। কিন্তু মাথা তুলতেই দেখা গেল যে নিকোলাসের চোখ জোড়া ঠিক আগের মতই তীক্ষ্ণ আর নীল। মাখন রঙা এলোমলো চুল, তপ্ত ভারতীয় সূর্যের নিচে প্রায় সাদা হয়ে গেছে পুড়ে।
দরবারে স্বাগতম, আমি শুনেছি তুমি বাজারে উঠেছে। যদি চাও তো আমার কর্মচারীরা দুর্গের মাঝেই তোমার জন্যে থাকার বন্দোবস্ত করে দেবে।
ধন্যবাদ, জাহাপনা।
আগ্রায় কী মনে করে?
সত্যি কথা বলতে আমি আপনার দরবারে চাকরি খুঁজতে এসেছি।
তুমি না ব্যবসায়ী হবে মনস্থির করেছিলে?
হ্যাঁ, কিন্তু সুবিধা করতে পারি নি। আপনার সেবা করে যে অর্থ উপার্জন করেছিলেন তা দিয়ে কাবুলে গিয়ে বড় বাজার থেকে পারস্যের কার্পেট আর চাইনিজ সিল্ক কিনে জাহাজে যাবার পরিকল্পনা করেছিলাম। কিন্তু সন্ধ্যার ঠিক আগমুহূর্তে খুর্দ-কাবুল পাসের সংকীর্ণ রাস্তায় আমাদের ক্যারাভানের উপর আক্রমণ করে খিলজিরা। প্রাথমিক আঘাতেই হত্যা করে বহু বণিককে। আমরা কয়েকজন মাত্র প্রাণে বেঁচে গেছি, তাও হাচোর-পাচোড় করে পাহাড়ের দিকে উঠে গিয়ে অর্ধ আলোয় পাথরের আড়ালে আশ্রয় নিতে পারায়। খিলজিরা আমাদের খচ্চর সহ মলামাল লুট করে ফেলায় আমাদের ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। খানিকটা বেদনাতুর মুখে হাসলো নিকোলাস।
কিন্তু হতাশ হলেন শাহজাহান। নিকোলাসের কথায় স্মরণ হল যে কাবুলে তাঁর সুবেদার ও পাসের কাছাকাছি গোত্র অধিবাসীদের মাঝে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অনতির কথা জানিয়েছে–এদের মাঝে আছে আফ্রিদি, কাফির আর খিলজিরা।
এরপর কী করছো?
এরপর আমি দক্ষিণে কান্দাহার গিয়ে হেলমন্দ নদী পার হয়ে পারস্যে পৌঁছাই। কিছুদিনের জন্য শাহের সেনাবাহিনীতে যোগদান করি।
কখনো তোমার নিজের দেশে ফিরে যাবার কথা মনে হয়নি?
মাথা নাড়ল নিকোলাস। না, আমার জন্য খুব বেশি কিছু নেই সেখানে। পিতা-মাতা মারা গেছে–বাবার সম্পত্তি পেয়েছে বড় ভাই। এছাড়াও…আমি এ দেশকে ভালোবাসি–স্যার টমাসের সাথে যখন থেকে এসেছি, তখন থেকেই আর তাই পারস্য থেকে এখানে ফিরে এসেছি। আমি দেশে যেতে প্রস্তুত নই–অন্তত এখন তো নয়ই।
স্যার থমাস রো…টেকো মাথার ইংরেজ রাষ্ট্রদূতের কথা শাহজাহান প্রায় ভুলেই গেছেন, যার কর্চি ছিল নিকোলাস।
নিকোলাস, তুমি সবসময় আমার প্রতি বিশ্বস্ত ছিলে। তাই আমার কৃতজ্ঞতা স্বরূপ সেনাবাহিনী হেডকোয়ার্টারে দলনেতা হিসেবে নিয়োগ দিলাম তোমাকে। পরিচিত বেশ কিছু চেহারা খুঁজে পাবে সেখানে। শাহের সেনাবাহিনী সম্পর্কে তোমার জ্ঞান বিশেষ করে অস্ত্র সম্পর্কে –কাজে লাগবে। আমার যেটা সন্দেহ যে বস্তুত আমি জানিই আমার সাম্রাজ্যের প্রান্তের ভূমি দখলের উচ্চাকাঙ্খ আছে তাঁর। সেনাবাহিনীর প্রস্তুতি দেখভালের জন্য দায়িত্ব দিয়েছি আমার জ্যেষ্ঠ পুত্রকে। তুমি তাকে সাহায্যে করতে পারবে।
আনন্দের সহিত তা করব আমি জাহাপনা। শাহজাদা দারার কথা বেশ মনে আছে আমার। এরপর খানিকটা দ্বিধাভরে নিকোলাস বলে উঠল, পারস্য থাকাকালীন সম্রাজ্ঞীর মৃত্যুর কথা শুনেছি আমি। সত্যি দুঃখিত।
মাথা নেড়ে আর কিছু বললেন না শাহজাহান। এরপর উঠে দাঁড়িয়ে ইশারা করলেন যে সাক্ষাৎকার শেষ হয়েছে।
চব্বিশ ঘণ্টা পরে মার্বেল হলের চারপাশে নিজের পরিচিত মুখগুলোর দিকে তাকালেন সম্রাট। আগ্রায় ফিরে আসার পর এই প্রথম নিজের পুরো সভাসদদের উপদেষ্টাকে তলব করেছেন। হাত তুলে গুঞ্জন থামিয়ে আলোচনার আশাতে কথা শুরু করলেন শাহজাহান।
উত্তরের গোত্ররা ভাবছে যে তারা এরকম অবিশ্বাস্য আচরণ করে কাবুল আসা যাওয়ার পথে আমাদের বণিকদেরকে লুট করে নিতে থাকবে। তাদের দ্রুত সংগঠিত হওয়া অপরাধ সম্পর্কে শুনেছি আমি। এছাড়া শহরের সুবেদারের পাঠানো প্রতিবেদনও পড়েছি। সম্ভবত এ অপরাধীরা ভেবেছে দাক্ষিণাত্য নিয়ে আমি ব্যস্ত থাকাতে তারা পার পেয়ে যাবে…যদি তাই হয় তাহলে শীঘ্রিই নিজেদের ভুল বুঝতে পারবে তারা। আমি তাদের অভদ্রতা বরদাশত করব না। যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের রাস্তা ঘাট নিরাপদ না হবে, বাণিজ্যের উন্নতিও ঘটবে না।
চারপাশে বিড়বিড় করে নিজেদের সম্মতি জানালো সভাসদবৃন্দ।
অশোক সিং, বলে চললেন শাহজাহান, দাক্ষিণাত্যে নিজের সাহস আর সতোর পরিচয় দিয়েছ তুমি। এই ভয় দূর করার ভারও তোমার উপর অর্পণ করছি আমি। দশ হাজার সৈন্যের সেনাপতি হিসেবে তোমাকে দায়িত্ব দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি–অশ্বরোহী আর বন্দুকধারী। পাসের মধ্য দিয়ে অগ্রসর এই দুবৃত্তদেরকে সমুচিত শাস্তি দেয়ার দায়িত্ব তোমার। প্রধানদেরকে হত্য করে দুর্গ গুঁড়িয়ে দাও, গ্রাম ভেঙে পশুর দল তাড়িয়ে দাও। তাদেরকে বুঝিয়ে দাও মোগল শাসন মেনে না নেবার একমাত্র বিকল্প হল ধ্বংস আর মৃত্যু।
আমার সন্দেহ যে পারস্যের শাহ গোত্র সমূহকে অর্থ দিয়েছে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার জন্যে। শক্তির প্রদর্শন তাঁকে প্ররোচিত করবে দ্বিতীয়বার ভাবতে। আস্তে করে বলে উঠল আসফ খান।
আমি নিশ্চিত যে এটাই সঠিক। মমতাজের পিতা শারীরিকভাবে বৃদ্ধ হতে থাকলেও মস্তিষ্ক পূর্বের মতই তীক্ষ্ণ আর সচল।
আগামী শীতকাল এসে অভিযানের সমাপ্তি ঘটানোর আগেই আমার বাহিনী একত্রিত করে নেব আমি। শুধুমাত্র একটা প্রশ্ন : কামান সাথে নিবো? কামান ছাড়া এগোনোটা দ্রুততর হবে। বলে উঠল অশোক সিং।
তোমার কি মনে হয় কামরান ইকবাল? জানতে চাইলেন শাহজাহান।
আমি এতে একমত। এগুলো শুধু গতি রোধ করবে। যদি কামান প্রয়োজন হয় কাবুলের সুবেদার জোগান দেবে।
এই পরামর্শ ভালোই হয়েছে, যদিও তাঁর পুরাতন সঙ্গীর মুখখানা ব্যথায় জর্জরিত হয়ে আছে। লাহোরে হারানো হাতের ক্ষত কখনোই পুরোপুরি সারবে না।
তাহলে তাই হোক। প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে দেব আমি।
পরবর্তীতে অভিযানের বিশদ আলোচনা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক মতৈক্যের পর উপদেষ্টারা আর সেনাপতিরা চলে গেলে পর খানিকক্ষণ একা বসে রইলেন শাহজাহান। ভাবতে ভালো লাগছে যে নিজের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছেন তিনি। মমতাজের সমাধি নির্মাণের ব্যস্ততা সাম্রাজ্যের নিরাপত্তার ব্যাপারে অবহেলা করতে দেয়নি… তারপরেও সভা চলাকালীন যদিও তিনি সক্রিয় আর কর্মতৎপর ছিলেন তারপরেও কোথায় যেন রেশ ছিল না। মনে পড়ে গেল প্রাচ্য দেশ থেকে একজন ভ্রমণার্থীর কাছে দেখা পুতুল শোর কথা। চামড়ার টুকরা কেটে নারী-পুরুষের অবয়ব দিয়ে কাঠির মাথায় গেঁথে পুতুলগুলোকে লুকিয়ে রাখা হয় সিল্কের পর্দার পিছনে, একসারি তেলের বাতি জ্বালিয়ে দেয়া হয়। অভিনয় চলাকালীন শুধু তাদের ছায়া দেখা যায়। এরকমটাই অনুভব হচ্ছে এখন–তার ছায়া সম্রাট নড়াচড়া করছেন দর্শকের মনোরঞ্জনের জন্য।
এখন থেকে সবসময় কি তাহলে এমনই হবে? নিজের দায়িত্ব সচেষ্টভাবে পালন করতে চাইছেন কিন্তু অভিনয় হয়ে যাচ্ছে? এরকমই মহৎ হবার আকাংখা ছিল একসময়। নিয়ম মেনে চলা আর প্রচেষ্টার মাধ্যমে একে ফিরে আসতে বাধ্য করবেন তিনি।