বিশাল চারটে ব্যারাক ছাড়াও পাঁচ-ছ’টা বড় কাঠের বাড়িও তোলা হয়েছে। যতদিন না শরণার্থীরা নিজেদের ঘরবাড়ি তৈরি করে নিতে পারছে, ব্যারাকেই তাদের থাকতে হবে। ব্যারাকের ভেতর দেওয়াল তুলে আলাদা আলাদা কুঠুরিতে ভাগ করা হয়নি। টানা পাটাতন পেতে দেওয়া হয়েছে।
দুটো ব্যারাকে থাকবে পুরুষেরা, বাকি দু’টোয় মেয়েমানুষ আর বাচ্চাকাচ্চারা। বাকি যে পাঁচ ছটা ঘর তোলা হয়েছে তার দুটো হল গুদাম, সেখানে সেটলমেন্টের নানা মালপত্র রাখার ব্যবস্থা। দুটো ঘর পুনর্বাসন বিভাগের কর্মীদের জন্য, একটা ঘর কলোনাইজেশন আসিষ্টান্টের, বাকি ঘর দুটোয় পোর্টব্লেয়ার থেকে যে অফিসাররা দু’চার দিনের জন্য সেটলমেন্টের কাজকর্ম দেখতে আসেন তারা থাকেন। বিশেষ করে বিশ্বজিৎ রাহা।
চান করা, কাপড় কাঁচা, বাসন মাজা ইত্যাদির মোটা কাজের জন্য সমুদ্র হাতের কাছেই রয়েছে। কিন্তু নোনা জল তো আর খাওয়া যায় না। সে জন্য কাছাকাছি একটা ঝরনা রয়েছে, অবিরল সেটা জল ঢেলে চলেছে। ঝরনাটা যেখানে, তার পাশের পাহাড়ের মাথায় নৌকোর আকারে মস্ত একটা খোল বা গহুর। সারা বর্ষার জল সেখানে জমে থাকে। দরকারমতো সেখান থেকেও লম্বা লম্বা পাইপ দিয়ে জল আনা যেতে পারে।
.
বিশ্বজিৎ এই সেটলমেন্টে এলে যে ঘরটায় থাকেন বিনয়কে নিয়ে সেখানে চলে এলেন। জিপের ড্রাইভার নাসিম এর মধ্যে। বিনয়ের সুটকেস বিছানা-টিছানা রেখে গেছে।
ঘরটার দুই দেওয়াল ঘেঁষে দু’খানা তক্তপোশ পাতা রয়েছে। আর আছে কাঠের আলমারি। দেওয়ালে টাঙানো আয়না। একটা তাকে সাবান, নারকেল তেলের কৌটো ইত্যাদি টুকিটাকি জিনিস।
বিশ্বজিৎ বললেন, ‘এই ঘরেই আপনি আমার সঙ্গে থাকবেন। পরশু অবশ্য আমি পোর্টব্লেয়ার চলে যাচ্ছি। তারপরও যতদিন ইচ্ছে এখানে থেকে সেটলমেন্টের কাজ দেখবেন। সারাদিন জানি করে জামা-প্যান্টের হাল খারাপ হয়ে গেছে। ঘামে সারা গা চটচট করছে। সুটকেস খুলে তোয়ালে-টোয়ালে বার করে সমুদ্রে গিয়ে চানটা সেরে আসি। পরিতোষরা রিফিউজিদের নিয়ে ব্যস্ত। আজ কিন্তু চানের জন্যে গরম জলের ব্যবস্থা করা যাবে না। কাল থেকে সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’
বিনয় পোর্টব্লেয়ারে বিশ্বজিতের বাংলোয় আপত্তি করেনি। সেখানে অনেক কাজের লোক রয়েছে। কিন্তু এখানে উদ্বাস্তুরাই আসল। তার স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য পুনর্বাসন দপ্তরের কর্মীদের ব্যস্ত করে তোলাটা অস্বস্তিকর। বলল, ‘কী দরকার? সবাই যখন সমুদ্রে গিয়ে চান করবে, আমার জন্যে স্পেশাল অ্যারেঞ্জমেন্টের দরকার নেই। সেটা খারাপ দেখাবে।‘
বিনয় যে বাড়তি কোনও সুবিধা নিতে চায় না সেটা বুঝে আর কিছু বললেন না বিশ্বজিৎ। একটু হেসে আলমারি খুলে ফেললেন। ভেতরে বেশ ক’টা তাকে কয়েক প্রস্থ পোশাক, তোয়ালে রয়েছে।
বিনয়ের মনে পড়ল সকালে তারা যখন পোটচেয়ার থেকে বেরিয়েছিল, সঙ্গে কিছুই নেননি বিশ্বজিৎ। একেবারে খালি হাত-পা। দু’দিন তিনি জঙ্গলে কাটাবেন। পরনের জামা-প্যান্ট তো ঘামে, পথের ধুলোয় নোংরা, চটকানো-মটকানো হয়ে যাবে। সেই পোশাকে কি দুটো দিন কাটানো যায়? উদ্বাস্তুদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে, জঙ্গলের কোন অভ্যন্তরে, সে ব্যাপারে বিনয়ের কৌতূহল তখন এত প্রবল, উত্তেজনা এমন তীব্র যে অন্য কোনও দিকে তার লক্ষ ছিল না। এখন দেখা যাচ্ছে, জঙ্গলে কাটানোর মতো সমস্ত কিছুই এখানে মজুত করে রেখেছেন বিশ্বজিৎ
দু’জনেই ঘরে পরার মতো পাজামা-শার্ট আর পাতলা চটি-টটি বার করে বেরিয়ে পড়ল।
হঠাৎ কিছু খেয়াল হতে বিনয় বলে, ‘একটা কথা খুব জানতে ইচ্ছে করছে।’
চলতে চলতে বিশ্বজিৎ বললেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। বলুন–’
‘আন্দামানে রিফিউজিদের তো আরও সেটলমেন্ট হয়েছে।’
‘হ্যাঁ, তিনটে।’ বিশ্বজিৎ বলতে লাগলেন, আজ যারা এল। তাদের আগে আড়াই হাজারের মতো মানুষ এসেছে। ওদের জমি-টমি দিয়ে বসানো হচ্ছে।’
বিনয় জিগ্যেস করে, ‘সেই সেটলমেন্টগুলো কোথায়?’
উত্তর দিকে আঙুল বাড়িয়ে বিশ্বজিৎ বললেন, ‘ওধারে তিনটে পাহাড় পেরলে পাশাপাশি দুটো সেটলমেন্ট, থার্ডটা আরও দূরে।‘
‘সেইসব জায়গায় তো আপনাকে যেতে হয়—’
‘তা তো হয়ই। এতগুলো মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে আমাদের ভরসায় এত দুরের আইল্যান্ডে এসেছে। তারা কী অবস্থায় রয়েছে, তাদের কোনও অসুবিধা হচ্ছে কি না, কোনও গ্রিভান্স আছে কি না, সেসব দেখতে হবে না?’
বিশ্বজিৎকে যত দেখছে, তার কথা যত গুনছে, ততই শ্রদ্ধা বেড়ে যাচ্ছে। বিনয় জিগ্যেস করল, ‘ওই সেটলমেন্টগুলোতে নিশ্চয়ই এখানকার মতো জামাকাপড় রাখা আছে?’
বিশ্বজিৎ হেসে ফেলেন। ‘–তা তো আছেই।‘
বিভাস আর নিরঞ্জন এর মধ্যে উদ্বাস্তুদের সমুদ্রের দিকে নিয়ে গেছে। ওদর দেখতে পাচ্ছিল বিনয়রা।
পরিতোষ কাছাকাছি কোথাও ছিল। সে দৌড়ে আসে। ব্যগ্রভাবে বলল, ‘স্যার, আপনেরা কষ্ট কইরা সমুদ্রে যাইয়েন না। ঘরে যান। আমি জল পাঠাইয়া দিতে আছি।’
খুব ঠান্ডা গলায় বিশ্বজিৎ বললেন, ‘আমাদের আরামের জন্যে ভাবতে হবে না। এই সেটলমেন্ট যাদের জন্যে তাদের কথা ভাবো।’
ম্লান মুখে দাঁড়িয়ে থাকে পরিতোষ। আর কিছু বলতে সাহস হয় না তার।
বিশ্বজিৎ বিনয়কে নিয়ে এগিয়ে চললেন।
সেটলমেন্টের এদিকটা অন্য তিনদিকের মতো ঘন জঙ্গলে ঢাকা। লম্বালম্বি তার খানিকটা সাফ করে সমুদ্রে যাবার পথ করে নেওয়া হয়েছে। তবে পথের দু’পাশে এখনও চাপ-বাঁধা ঘন ঝোঁপ, নানা ধরনের অজস্র বুনো গাছ এবং জলডেঙ্গুয়া অর্থাৎ বনতুলসীর উদ্দাম ঝাড়।
সমুদ্রের ধারে এসে দেখা গেল দু-আড়াইশো ফিটের মতো চওড়া সোনালি বালির বিচ; ডাইনে এবং বাঁয়ে বহুদূর অবধি শরীর এলিয়ে পড়ে আছে। বেলাভূমির মাথায় মাইলের পর মাইল জুড়ে ঝাড়ালো ম্যানগ্রোভের জটলা। আর কত যে নারকেল গাছ তার লেখাজোখা নেই। আকাশের দিকে মাথা তুলে তারা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আন্দামানের তটরেখা পাহারা দিয়ে চলেছে।
বিচের পর থেকে সমুদ্র। পাড়ের দিকে সিকি মাইল অবধি কাঁচের মতো টলটলে জল। খুব বেশি হলে কোমর সমান। জল এতটাই স্বচ্ছ যে নিচের বালুকণা, পাথর, নুড়ি, নানা রঙের ঝিনুক, সামুদ্রিক শ্যাওলা আর আগাছা স্পষ্ট দেখা যায়।
সিকি মাইল পর থেকে জলের রং ক্রমশ পালটে গেছে। প্রথমে হালকা সবুজ, তারপর গাঢ় সবুজ, নীল এবং আরও দূরে ঘন কালো হয়ে অন্তহীন সমুদ্র দিগন্ত অবধি চলে গেছে।
উদ্বাস্তুরা জলে নেমে পড়েছিল। কলকাতা থেকে আসার সময় চার পাঁচ দিন ‘মহারাজা’ জাহাজে তোলা জলে তারা চান করেছিল। এই প্রথম অফুরান সমুদ্র পেয়েছে। পদ্মা-মেঘনা-কালাবদর ধলেশ্বরীর দেশের মানুষ, এত জল পেয়ে সবাই ডগমগ। বুড়োবুড়ি যুবক যুবতী– কেউ সাঁতরাচ্ছে, কেউ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ডুবের পর ডুব দিয়ে চলেছে। ছোট বাচ্চাগুলো খলবল করে জল ছিটচ্ছে।
সমুদ্র রং বদলে যেখানে সবুজ হতে শুরু করেছে সেদিক থেকে লক্ষ কোটি মাছ ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে আসছে তীরের দিকে। কত রকমের যে মাছ–সুরমাই, লান্স ভেটকি, সার্ডিন, শাকুস, পমফ্রেট ছাড়াও নাম-না-জানা আরও অসংখ্য। এছাড়া উড়ুক্কু মাছেরা তো রয়েছেই। তারা সমুদ্র ফুঁড়ে উঠে আসছে; আধখানা বৃত্তের আকারে শূন্যে চক্কর দিয়ে ফের জলে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এই ওড়াউড়ি চলছে অবিরাম।
জল পেয়ে উদ্বাস্তুরা খুশি তো হয়েছেই। মাছ দেখে একেবারে আত্মহারা। খিদিরপুর ডকে জাহাজে ওঠার সময় তারা ত্রাসে সংশয়ে একেবারে কুঁকড়ে ছিল। এই প্রথম তাদের উচ্ছ্বসিত হতে দেখা গেল। চোখেমুখে তাদের প্রবল উত্তেজনা। নিজেদের মধ্যে ওরা বলাবলি করছিল।
‘বাইসুত রে, সমুন্দুরে কত মাছ দেখছনি? মনে লয় দশহান পদ্ম, দশহান ম্যাঘনা ছেইচা (ছঁচে) ফালাইলেও এত মাছ মিলব না।’
‘সারা জনম খাইয়াও শ্যাষ করন যাইব না।’
‘সারা জনম কী কও, চৈদ্দে পুরুষ খাইলেও ফুরাইব না।’
‘হ, সাচাই কইছ।’
‘কেম্প (ক্যাম্প) থিকা যহন আমাগো খিদিরপুরে লইয়া আইল, ডরে হাত-পাও প্যান্টের ভিতরে হাইন্দা (ঢুকে) গ্যাছিল। অহন মনে লয় (হয়) আন্দায়মানে না খাইয়া মরুম না। আর কিছু না জুটুক, সমুদুরে মাছ তো আছে, হেই খাইয়া বাইচা থাকুম।’
পাড়ে দাঁড়িয়ে বিভাস, নিরঞ্জন আর পুনর্বাসন বিভাগের ক’জন কর্মী উদ্বাস্তুদের ওপর সতর্ক নজর রাখছিল। নিরঞ্জন গলার স্বর উঁচুতে তুলে সমানে বলে যাচ্ছে, ‘কেও বেশিদুর যাইবা না। সমুন্দুরের কিনারে ছান (চান) কর। হাঙ্গরের চোখে পড়লে রক্ষা নাই। সাবধান, সাবধান—’
রাঁচির লোকটিও একটানা চেঁচিয়ে যাচ্ছে, বদমাশ মচ্ছি (হাঙর) হোত খতরনাক। হোশিয়ার—’ তারা অনবরত বলে যাচ্ছে, খানিক দূরে সমুদ্রের জল যেখানে সবুজ হতে শুরু করেছে তার ওধারে হাঙরেরা ঝাঁকে ঝুঁকে ঘুরে বেড়ায়। যে কোনও মুহূর্তে তারা বিদ্যুৎগতিতে পাড়ের দিকে হানা দিতে পারে। সামুদ্রিক এই দানবেরা মানুষ পেলে ধারালো দাঁতে ছিন্নভিন্ন করে ফেলবে।
এত হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও উদ্বাস্তুরা কি সহজে সমুদ্র ছেড়ে উঠতে চায়? দুরে গেল না বটে, কিনারার কাছে জল নিয়ে মাতামাতি করতে লাগল।
শেষ পর্যন্ত ধমকধামক দিয়ে নিরঞ্জনরা তাদের তুলে ফেলল।–’আমাগো কথা কানে তোলো না। হাঙ্গরের প্যাটে কেও গালে তহন দোষ অইব সরকারের। দুনিয়াসুদ্ধা মানুষ জানবো, হাঙ্গর দিয়া খাওয়ানের লেইগা আমরা রিফিউজিগো আন্দামানে লইয়া আইছি।’
উদ্বাস্তুরা সাড়াশব্দ করে না। অপরাধী অপরাধী মুখ করে নিরঞ্জনদের সঙ্গে সেটলমেন্টে ফিরে গেল।
ওরা চলে যাবার পর বিশ্বজিৎ আর বিনয় ভালো করে হাত-পা মুখ ধুয়ে নিল। সারাদিন পাহাড়ি রাস্তায় গাড়িতে এসেছে তারা। ধুলোয় ঘামে জামাকাপড় চটচট করছিল। সেসব বদলে পাজামা-শার্ট পরে নিল।
সেটলমেন্টে ফিরতে ফিরতে হঠাৎ কাজের কথাটা মনে পড়ে গেল বিনয়ের। বলল, ‘আমি তো আপাতত এই জঙ্গলে থেকে যাব। আমাদের কাগজে আন্দামানের রিপোর্ট পাঠাব কী করে?’ এই প্রশ্নটা কি আগেও একবার বিশ্বজিৎকে করেছিল সে? ঠিক মনে পড়ল না।
বিশ্বজিৎ বললেন, ‘আমি তো কালকের দিনটা এখানে আছি। এর মধ্যে দুটো রিপোর্ট লিখে ফেলুন। আমি পরশু পোর্টব্লেয়ার গিয়ে এয়ার মেলে আপনাদের কাগজে পাঠিয়ে দেব।’
‘এবারটা না হয় পাঠানো গেল। তারপর?’
বিশ্বজিৎ জানালেন, পোর্টব্লেয়ার থেকে দু-তিন দিন পর পর। রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্টের গাড়ি নানা জিনিসপত্র নিয়ে এই অঞ্চলের সেটলমেন্টগুলোতে আসে। ড্রাইভারকে তিনি বলে দেবেন বিনয়ের কাছ থেকে লেখা নিয়ে তাঁর কাছে পৌঁছে দিতে। বিশ্বজিৎ রিপোর্টগুলো পাওয়ামাত্র কলকাতায় পাঠিয়ে দেবেন।
রোদের তেজ আর নেই। দিনের শেষ আলোটুকু ফিকে হতে হতে দ্রুত নিভে যাচ্ছে। পাহাড় আর বিশাল বিশাল মহাবৃক্ষের হায়া দীর্ঘ হয়ে চরাচর ঢেকে দিচ্ছে। একটু পরেই বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপে ঝপ করে সন্ধে নেমে যাবে।
সেটলমেন্টে এসে দেখা গেল, এর মধ্যে অগুনতি হ্যাঁজাক আর গ্যাসবাতি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। জ্বলছে বেশ কিছু হ্যারিকেনও। জোরালো আলোয় ভরে গেছে চারিদিক।
লম্বা লম্বা ব্যারাক ধরনের বাড়িগুলোর সামনের দিকের অনেকখানি জায়গায় জঙ্গল তো নির্মূল করা হয়েছিলই, নিচের ঘাস চেঁছে পরিষ্কার করে মাটিও বার করা হয়েছে। সেখানে লম্বা করে দুই সারিতে এমনভাবে চট বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে যাতে পাশাপাশি অনেকে বসতে পারে।
ব্যারাকগুলোর একধারে বিরাট বিরাট টিনের ড্রাম আর উঁই করা অ্যালুমিনিয়ামের থালা আর গেলাস। সেখানে নিরঞ্জন আর বিভাস তো রয়েছেই, তাছাড়া পুনর্বাসন বিভাগের অন্য কর্মীদেরও দেখা যাচ্ছে।
নিরঞ্জনরা দারুণ করিৎকর্মা। সমুদ্র থেকে চান করে আসার পর উদ্বাস্তুদের লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে তারা।
নিরঞ্জনের হাতে লম্বা তালিকা। সেটা দেখে হেঁকে হেঁকে উদ্বাস্তুদের নাম পড়ছিল। –’চন্দ্র সূত্রধর, হরিমতি সূত্রধর–সরকার থিকা আপনেগো হগলেরে থাল গেলাস দেওন হইতে আছে। একে একে লইতে থাকেন–’ নিরঞ্জন কখনও উদ্বাস্তুদের ‘তুমি’ করে বলে, কখনও ‘আপনি’। নিরঞ্জনের পাশেই বিভাস এবং আরও দু’জন কর্মী দাঁড়িয়ে আছে। তারপর টিনের ড্রামগুলোর কাছে আরও কয়েকজন কর্মী। তাদের হাতে মস্ত মস্ত পেতলের হাতা।
বিভাসরা থালা-গেলাস দিয়ে ভ্রামগুলোর দিকে উদ্বাস্তুদের পাঠিয়ে দিচ্ছে। ড্রাম বোঝই রয়েছে খিচুড়ি চালডালের সঙ্গে আলু কুমড়ো পটল এবং অন্যান্য সবজি সেদ্ধ করা হয়েছে। আলাদা করে তরকারি বা ভাজাটাজা করার সময় হয়তো পাওয়া যায়নি।
পুনর্বাসন বিভাগের একজন কর্মী হাতায় করে উদ্বাস্তুদের থালায় খিচুড়ি এবং অন্যজন আর একটা ড্রাম থেকে মগে করে গেলাসে গেলাসে খাওয়ার জল দিচ্ছে।
পরিতোষ একধারে দাঁড়িয়ে তদারক করছিল। সে খানিক দূরে বিছানো চটের আসনের দিকে আঙুল বাড়িয়ে উদ্বাস্তুদের বলছিল, ‘আপনেরা ওইখানে গিয়া বইসা বইসা খান। আইজ খিচোড়ি দেওয়া হইল। কাইল থিকা ভাত মাছ ডাইল দুধ পাইবেন। যান—’
বিনয়কে সঙ্গে করে বিশ্বজিৎ পরিতোষদের কাছে চলে এসেছিলেন। তাদের দিকে নজর পড়তেই ব্যস্ত হয়ে ওঠে পরিতোষ। ক’পা এগিয়ে এসে জিগ্যেস করে, ‘স্যার, আপনেরা কি অখন খাইবেন?’
বিশ্বজিৎ একটু হাসলেন। –‘কখন সেই সকালবেলা ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়েছি। সন্ধে হতে চলল। এর ভেতর পেটে কিছু পড়েনি। পেটে হুতাশন জ্বলছে হে–’
রিফিউজিদের জন্য অ্যালুমিনিয়ামের নতুন নতুন থালা গেলাস ছাড়াও রয়েছে বেশ কিছু শালপাতার থালা আর মাটির গেলাস। পরিতোষ নিজের হাতে শালপাতার থালায় খিচুড়ি নিয়ে এল বিশ্বজিৎদের জন্য। বলল, ‘আপনেরা খাইতে থাকেন স্যার। খাওন হইলে জল নিয়ে আসুম–’
বিশ্বজিৎ আন্দামানে উদ্বাস্তু পুনর্বাসন দপ্তরের প্রায় সর্বেসর্বা; বিপুল ক্ষমতাবান। কিন্তু তার জন্য আলাদা করে পোলাও কালিয়ার ব্যবস্থা করা হয়নি। নিশ্চয়ই আগে থেকে হুকুমনামা জারি করা আছে, যত বড় অফিসারই হোন, রিফিউজি সেটলমেন্টে এলে উদ্বাস্তুরা যা খাবে তাদেরও তা-ই খেতে হবে।
বিশ্বজিৎ বললেন, ‘আমাদের জন্যে উতলা হতে হবে না। খিচুড়ি নিয়ে আসা তোমার উচিত হয়নি। যখন দরকার হবে, আমরাই জল চেয়ে নেব। তুমি ওধারে যাও। দেখ, কার কী লাগবে, পেট ভরে ওরা খাচ্ছে কি না।’
পরিতোষ চলে গেল।
ওধারে খিচুড়ি বিতরণ হয়ে গিয়েছিল। উদ্বাস্তুরা কাতার দিয়ে চটের আসনে বসে খাচ্ছে।
সন্ধে নেমে গেছে। কিছুক্ষণ আগেও যে অন্ধকার ফিকে ফিকে জোলো কালির মতো মনে হচ্ছিল, এখন তা অনেক গাঢ় হয়েছে। দক্ষিণ দিকের সমুদ্র আর দেখা যাচ্ছে না। বাকি তিন পাশের উঁচু উঁচু পাহাড় আর জঙ্গল প্রাগৈতিহাসিক অতিকায় জন্তুর মতো এত পেতে আহে। সেদিকে তাকালে বুকের ভেতর কেমন যেন শিহরন খেলে যায়। বিনয়ের মনে হয় পৃথিবীর বাইরে সৌরলোকের কোনও সৃষ্টিছাড়া গ্রহে এসে পড়েছে।
উদ্বাস্তুরা যেখানে বসে খাচ্ছি সেখান থেকে নিরঞ্জনের গলা ভেসে আসে। কখন যে সে ওদের কাছে চলে গিয়েছিল, টের পাওয়া যায়নি।
নিরঞ্জন গলার স্বর উঁচুতে তুলে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলে যাচ্ছিল, ‘ভাই সগল, পোর্ট ব্লেয়ার থিকা এতখানি পথ আইতে আপনেগো শরীলের উপুর দিয়া অনেকখানি তাফাল গ্যাছে। আইজ তরাতরি খাওনদাওন সাইরা গিয়া শুইয়া পড়েন। কাইল সকাল সকাল উইঠা পড়বেন। কাইল থিকাই আপনেগো জমিন দেওয়া হইব।’
খানিক দূরে দাঁড়িয়ে খিচুড়ি দিয়ে নৈশভোজ সারতে সারতে রীতিমতো অবাকই হয়ে গেল বিনয়। বিশ্বজিতের দিকে ফিরে বলল, ‘এখানে সব দিকেই তো ঘোর জঙ্গল। বড় বড় কটা গাছ কাটা হয়েছে শুধু। এই জঙ্গলে জমি কোথায়? কী করে তা দেওয়া হবে? কে কতটা এলাকা পাচ্ছে তা-ই বা ঠিক হবে কীভাবে?’
বিশ্বজিৎ হাসলেন।–’কালই সব দেখতে পাবেন।’
খাওয়া হয়ে গেলে আঁচিয়ে, জল খেয়ে বিনয়কে নিয়ে বিশ্বজিৎ তাঁর ঘরে চলে গেলেন।
(প্রথম পর্ব সমাপ্ত)