১.৬ প্রফেসর ডায়োমেডেসের অফিসটা

১.৬

প্রফেসর ডায়োমেডেসের অফিসটা হাসপাতালের সবচেয়ে পুরনো এবং জরাজীর্ণ অংশে অবস্থিত। কোণায় কোণায় ঝুল আর মাকড়সার জাল। করিডোরের দুটো বাতি কোনমতে জ্বলছে কেবল। দরজায় ঠকঠক করার কিছুক্ষণ পর ভেতর থেকে তার কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।

“ভেতরে এসো।”

হাতল ঘোরাতে শব্দ করে খুলে গেল দরজাটা। ধক করে প্রথমেই নাকে এসে লাগলো ভেতরের অদ্ভুত গন্ধ। গোটা হাসপাতালের বাকি অংশের চাইতে একদম ভিন্ন। অ্যান্টিসেপ্টিক বা ব্লিচের ঘ্রাণের কোন বালাই নেই। বরং অর্কেস্ট্রা পিটে নানারকম বাদ্যযন্ত্রের মিশেলে যেরকম গন্ধ হয়, সেরকম। ভেতরের আধো অন্ধকারে চোখ সয়ে আসতে কিছুটা সময় লাগলো। বিশাল পিয়ানোটা দেখে থমকে গেলাম আবারো। আর যা-ই হোক, হাসপাতালে এ রকম কিছু আশা করিনি। বিশটারও বেশি মিউজিক স্ট্যান্ড ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা ঘরটার আনাচে কানাচে। একটা টেবিলে গাদা করে রাখা হয়েছে স্বরলিপির কাগজ, আরেকটু হলেই সিলিং ছোঁবে। অন্য টেবিলটায় শোভা পাচ্ছে ভায়োলিন, ওবো আর একটা বাঁশি। সেগুলোর পাশে কাঠের ফ্রেমের বিশাল হার্পটা আসলেও দর্শনীয়।

মুখ হা করে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ।

হেসে উঠলেন ডায়োমেডেস। “বাদ্যযন্ত্রগুলো দেখে খুব অবাক হয়েছে, না?” ডেস্কের পেছনে বসে আছেন প্রফেসর।

“এগুলো সব আপনার?”

“হ্যাঁ। সঙ্গিত আমার শখ বলতে পারো। নাহ, শখ না, নেশা।” নাটকীয় ভঙ্গিতে একবার বাতাসে হাত নাড়লেন তিনি। এটা যে তার একটা অভ্যাস, তা বুঝে গেছি। অর্কেস্ট্রার পরিচালক যেরকম হাত নাড়ে, ঠিক তেমনি যে কোন কথা সহজভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্যে অঙ্গভঙ্গির সহায়তা নেন ডায়োমেডেস। “একটা শখের সংগীতের দল আছে আমার, যে কেউ যোগ দিতে পারে দলটায়। স্টাফ, রোগি সবার জন্যে দরজা খোলা। সঙ্গিত হচ্ছে চিকিৎসার সবচেয়ে মোক্ষম হাতিয়ার,” এটুকু বলে থামলেন প্রফেসর, পরক্ষণেই গানের সুরে বলেন, “সবচেয়ে হিংস্র প্রাণীটাকেও শান্ত করে তুলতে পারে সঙ্গিত, কি বলো?”

“ঠিক বলেছেন।”

“হুম।” আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন ডায়োমেডেস। “পারো নাকি?”

“কি পারি?”

“কোন কিছু বাজাতে?”

মাথা কঁকালাম। “সঙ্গিত বিষয়ে বিশেষ ‘অজ্ঞ’ আমি। ছোটবেলায় স্কুলে থাকতে কয়েকদিন রেকর্ডার বাজিয়ে দেখেছিলাম, ওটুকুই।”

“তাহলে তো স্বরলিপি পড়তে পারো? সেটাও কম কি। ভালো। যে কোন একটা বাদ্যযন্ত্র বেছে নাও, আমি বাজানো শেখাবো তোমাকে।”

হেসে আবারো মাথা ঝাঁকালাম। “আসলে আমার ধৈৰ্য্য একদমই

“তাই নাকি? সাইকোথেরাপিস্ট হিসেবে ধৈর্য্যের কোন কমতি থাকলে কিন্তু চলবে না। জানো, তরুণ বয়সে আমি অনিশ্চয়তায় ভুগতাম যে পেশা হিসেবে কোনটা বেছে নেবো। সংগীতশিল্পী, ধর্মযাজক নাকি ডাক্তার?” আবারো হাসলেন ডায়োমেডেস। “আর এখন দেখো, একইসাথে তিনটা কাজই করছে।”

“তা বটে।”

“তুমি জানো”–মহুর্তের মধ্যে কথার বিষয়বস্তু পাল্টে ফেললেন তিনি-”ইন্টারভিউয়ের পর গ্রোভে তোমাকে নিয়োগ দেয়ার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটা কিন্তু আমারই ছিল। তোমার পক্ষে বেশ শক্তভাবেই কথা বলেছিলাম। কেন জানো? বলতে সমস্যা নেই-তোমার মধ্যে নিজের ছায়া খুঁজে পেয়েছি আমি, থিও। কে জানে, হয়তো কয়েক বছরের মধ্যে দেখা যাবে গ্রোভ তুমিই পরিচালনা করছে।” একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার বুক চিরে। “যদি ততদিন টেকে আরকি প্রতিষ্ঠানটা।”

“আপনার সন্দেহ আছে সে ব্যাপারে?”

“রোগির সংখ্যা খুব একটা বেশি না। সে তুলনায় স্টাফ প্রচুর। ট্রাস্টের সাথে মিলে আমরা চেষ্টা করছি খরচ যতটা সম্ভব কমিয়ে আনার। বুঝতে পারছো কি বলছি? সার্বক্ষণিক তদারকি করা হয় আমাদের প্রতিটা পদক্ষেপ। এরকম পরিস্থিতিতে কি আর চিকিৎসার কাজ চালিয়ে যাওয়া যায়, বলো? উইনিকট একটা কথা বলেছিল না? যে ভবনের লোকেরা নিজেরাই আগুন নেভাতে ব্যস্ত, তারা কিভাবে অন্যের সাহায্য করবে?” ক্লান্ত ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকালেন ডায়োমেডেস, হঠাৎই যেন বয়স বেড়ে গেছে তার। এরপর কণ্ঠ খাদে নামিয়ে ষড়যন্ত্রীদের মতন ফিসফিসিয়ে বললেন। “আমার ধারণা ইউনিট ম্যানেজার স্টেফানি ক্লার্ক গ্রোভ বন্ধ করে দেয়ার পক্ষে। ট্রাস্ট থেকেই কিন্তু বেতন দেয়া হয় তাকে। খেয়াল করলে তুমি নিজেই ব্যাপারটা বুঝতে পারবে।”

কেন যেন মনে হলো প্রফেসর ডায়োমেডেস একটু বেশিই দুশ্চিন্তা করছেন ব্যাপারটা নিয়ে। কিন্তু তিনি যে অবস্থানে আছেন, এরকমটা হতেই পারে। ইচ্ছে করেই চুপ থাকলাম কিছুক্ষণ, ভুল কিছু বলে তার মেজাজ বিগড়ে দিতে চাচ্ছি না। একটু পর মুখ খুললাম।

“অ্যালিসিয়ার ব্যাপারে কিছু প্রশ্ন ছিল আমার।”

“অ্যালিসিয়া বেরেনসন?” অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন ডায়োমেডেস। “ওর ব্যাপারে কি?”

“তাকে কিরকম থেরাপি দেয়া হচ্ছে সেসম্পর্কে কৌতূহলী আমি। আলাদা করে থেরাপি দেয়া হয় তাকে?”

“না”

“কোন কারণ আছে?”

“সেই চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু সন্তোষজনক ফলাফল না পাওয়ায় বন্ধ করে দেয়া হয়।”

“কেন? কে দেখতো ওকে? ইন্দিরা?”

“না।” মাথা ঝাঁকালেন ডায়োমেডেস। “আমি নিজেই দেখতাম অ্যালিসিয়াকে।”

“ওহ আচ্ছা। কি হয়েছিল?”

উদাসীন ভঙ্গিতে কাধ নাড়লেন প্রফেসর। “আমার অফিসে আসতো না সে, তাই বাধ্য হয়ে আমিই তার রুমে যাই। গোটা সেশনের পুরোটা সময় কিছু না বলে বিছানায় বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। কথা তো বলেইনি, একবারের জন্যে আমার দিকে তাকায়ওনি।” হতাশ ভঙ্গিতে হাত নাড়লেন তিনি। একসময় মনে হয় পুরো ব্যাপারটাই সময় নষ্ট।”

 সায় দেয়ার ভঙ্গিতে মাথা নাড়লাম। “আচ্ছা, এমনটাও তো হতে পারে

 “কি?” কৌতূহলী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন ডায়োমেডেস। “নির্দ্বিধায় বলো।”

“এটাও তো হতে পারে যে অ্যালিসিয়া হয়তো শৈশবের কোন চরিত্রের সাথে আপনার মিল খুঁজে পেয়েছে। এমন কোন চরিত্র যার সামনে মুখ খুলতে ভয় পেতো সে। বাবার সাথে তার সম্পর্ক কেমন ছিল, এটা অবশ্য আমি জানি না। কিন্তু…”

মুখে ছোট একটা হাসি একে আমার কথা শুনছেন ডায়োমেডেস, যেন কৌতুকের মজার অংশটা শোনা অপেক্ষায় আছেন। কিন্তু তোমার মনে হচ্ছে যে তুলনামূলক কম বয়সি কারো সামনে হয়তো মুখ খুলবে সে? যেমন…তুমি? তোমার ধারণা তুমি ওকে সাহায্য করতে পারবে, থিও? ওকে এই দশা থেকে উদ্ধার করতে পারবে? আবারো কথা বলাতে পারবে?”

“উদ্ধার করতে পারবে কি না সেটা ঠিক বলতে পারছি না, কিন্তু তাকে আসলেও সাহায্য করতে চাই আমি। অন্তত সেই চেষ্টাটুকু করার সুযোগ পেলে ভালো হতো।”

 মুখের হাসিটা এখনও অটুট আছে ডায়োমেডেসের। “তুমিই প্রথম ওকে সুস্থ করার স্বপ্ন দেখোনি। আমার বিশ্বাস ছিল, আমি হয়তো পারবো, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। অ্যালিসিয়াকে একটা নির্বাক মৎসকুমারীর সাথে তুলনা করা যায়। তাকে দেখে সব দক্ষ সাইকোথেরাপিস্টরা ছুটে আসবে সাহায্য করার আশায়।” আবারো শব্দ করে হাসলেন প্রফেসর। “ব্যর্থতার বিষয়ে এই বয়সে আমাকে বেশ কঠিন একটা শিক্ষা দিয়েছে ও। তোমারও হয়তো সেই শিক্ষাটা দরকার।”

 দৃষ্টি নামিয়ে নিলাম না ইচ্ছে করেই। “যদি আমি সফল হই, তাহলে কিন্তু শিক্ষাটা পেতে হবে না।”

এবারে হাসিটা মুছে গেল ডায়োমেডেসের মুখ থেকে। এখন তার মনে কি চলছে, সেটা বোঝা মুশকিল। চুপ থাকলেন কিছু সময়, এর মাঝে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন।

“তাহলে দেখা যাক কি হয়, নাকি? আগে অ্যালিসিয়ার সাথে দেখা করো। তার সাথে তো বোধহয় পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়নি তোমাকে?”

“না, এখন অবধি হয়নি।”

“ইউরির সাথে এ ব্যাপারে কথা বলল। আমাকে পরে রিপোর্ট দেবে।”

“ঠিক আছে,” উত্তেজনা চেপে বললাম। “দেব।”

.

১.৭

থেরাপি রুমটা তুলনামূলক ছোট, আয়তাকার। জেলখানার কক্ষের মতনই আসবাবপত্রের বালাই নেই। জানালাটাও বন্ধ, খিল দেয়া। ছোট একটা টেবিলের ওপর গোলাপী রঙের টিস্যবক্স, নিশ্চয়ই ইন্দিরার কাজ। ক্রিস্টিয়ানের মধ্যে ওর রোগিদের টিস্যু দেয়ার সৌজন্যবোধটুকু আছে বলে মনে হয় না।

রুমের প্রাচীন, রঙ উঠে যাওয়া চেয়ার দুটোর একটায় বসে পড়লাম আমি। সময় পার হচ্ছে ধীরে ধীরে, কিন্তু অ্যালিসিয়ার দেখা নেই। বোধহয় আসবে না সে, কে জানে? আমার সাথে দেখা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। মানা করে দেয়ার পূর্ণ অধিকার তার আছে অবশ্য।

 কিছু না করে চুপচাপ বসে থাকতে পারলাম না বেশিক্ষণ। নার্ভাস লাগছে ভেতরে ভেতরে। উঠে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। ধলোমাখা কাঁচ ভেদ করে কোনমতে বাইরের দৃশ্য দেখা যায়।

মূল চত্বরটা আরো তিন তলা নিচে; একটা টেনিস কোর্টের সমান, চারপাশে লাল ইটের দেয়াল। বেশ উঁচু হওয়াতে দেয়াল টপকানো সম্ভব হবে না ভেতরের অধিবাসীদের পক্ষে। তবে কেউ না কেউ তো চেষ্টা করেছিলই নিশ্চয়ই। রোগিদের প্রতিদিন বিকেলে ত্রিশ মিনিট বাইরের খোলা হাওয়ায় সময় কাটানোর সুযোগ দেয়া হয়। ইচ্ছে থাকুক আর না থাকুক, বের হতেই হবে। তবে এই প্রচণ্ড ঠাণ্ডার মধ্যে কেউ যদি বের না হতে চায়, তবে তাকে দোষ দেয়া যাবে না। কেউ একা দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করছে, আবার কেউ অপ্রকৃতিস্থের মতন ইতস্তত পায়চারি করছে চত্বরের এক মাথা থেকে আরেক মাথা অবধি। যাদের অবস্থা তুলনামূলক ভালো, তারা একসাথে জড়ো হয়ে সিগারেট ফুকছে আর আড্ডা দিচ্ছে। তাদের কণ্ঠস্বর আর হাসির শব্দ শুনতে পাচ্ছি।

এবারেও প্রথম দর্শনে অ্যালিসিয়াকে খুঁজে পেলাম না। কিছুক্ষণ খোঁজার পর খেয়াল করলাম চত্বরের একদম কোণার দিকে দেয়াল ঘেঁষে একা দাঁড়িয়ে আছে সে। দেখে মনে হচ্ছে পাথর কুঁদে তৈরি কোন মূর্তি। এসময় ইউরিকে দেখলাম তার দিকে এগিয়ে যেতে। পাশেই দাঁড়ানো নার্সের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলল সে। নার্স অনুমতি দেয়ার ভঙ্গিতে মাথা নাড়লে ধীর পদক্ষেপে অ্যালিসিয়ার দিকে এগিয়ে গেল লাটভিয়ান লোকটা।

আমি ওকে বলে দিয়েছি অ্যালিসিয়াকে খুব বেশি কিছু না বলতে। শুধু এটুকু জানালেই চলবে যে নতুন সাইকোথেরাপিস্ট তার সাথে দেখা করতে চেয়েছে। ইউরিকে বিশেষভাবে বলেছি, কথাটা যেন অনুরোধের সুরে বলে। কোন প্রকার জোর-জবরদস্তির প্রশ্নই আসে না। অ্যালিসিয়াকে দেখে অবশ্য মনে হচ্ছে না যে কেউ ওর সাথে কথা বলছে এটা বুঝতে পারছে। আগের মতনই ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর উল্টোদিকে ঘুরে হাঁটতে শুরু করে ইউরি।

আসবে না তাহলে। ধুর, আগেই ভাবা উচিৎ ছিল ব্যাপারটা। সময় নষ্ট হলো শুধু শুধু।

ঠিক তখনই আমাকে অবাক করে দিয়ে সামনে এগোলো অ্যালিসিয়া। একবার হোঁচট খেয়ে থমকে গেল কিছুক্ষণের জন্যে, তবে হাঁটা থামালো না। একসময় আমার দৃষ্টির আড়াল হয়ে গেল দু’জন।

তাহলে আসছে সে। নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলাম। এই মুহূর্তটার জন্যেই অপেক্ষা করেছি এতদিন। মাথার ভেতরে সেই অশরীরি কণ্ঠস্বরটা শুনতে পাচ্ছি আবারো, পাত্তা দিলাম না।

কয়েক মিনিট পর দরজায় ঠকঠক করলো কেউ।

 “ভেতরে আসুন।”

খুলে গেল দরজাটা। ইউরির সাথে করিডোরে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে অ্যালিসিয়া।

“এসেছে।” উজ্জল হেসে বলল ইউরি।

 “হ্যাঁ, দেখতে পাচ্ছি। হ্যালো, অ্যালিসিয়া।”

কোন জবাব পেলাম না।

“ভেতরে আসবেন না?”

ইউরি তাকে ভেতরে ঢোকার ইশারা করলো, তবে গায়ে হাত দিল না একবারের জন্যেও। বরং ফিসফিসিয়ে বলল, “যাও, ভেতরে গিয়ে বসো।”

দ্বিধায় ভুগছে অ্যালিসিয়া। এবারে মাথা তুলে তাকালো ইউরির দিকে। পরক্ষণেই সিদ্ধান্ত নিয়ে কাঁপা কাঁপা পায়ে প্রবেশ করলো ভেতরে। চুপচাপ খালি চেয়ারটায় এসে বসে পড়লো। যেন ভীতু একটা বিড়ালছানা। কোলের ওপরে রাখা হাতদুটো কাঁপছে।

দরজা বন্ধ করে দিতে উদ্যত হলেও ইউরি চৌকাঠ থেকে সরলো না। “যেতে পারেন এখন, বাকিটুকু আমি সামলাতে পারবো,” নিচু স্বরে বললাম।

ইউরির চেহারায় স্পষ্ট উদ্বিগ্নতা। কারো সাথে একা থাকাটা আসলে নিরাপদ নয় ওর জন্যে। আর প্রফেসর বলে দিয়েছেন যে-”

“সমস্যা নেই, সব দায়ভার আমার।” পকেট থেকে পার্সোনাল অ্যাটাক অ্যালার্মটা বের করে দেখালাম। “এটাও আছে সাথে, তবে লাগবে বলে মনে হয় না।”

 অ্যালিসিয়ার দিকে তাকালাম। দেখে মনে হচ্ছে না যে আমাদের কথা কানে যাচ্ছে তার।

 কাধ ঝাঁকালো ইউরি। খুব একটা খুশি হয়নি বোঝাই যাচ্ছে। “আমি তাহলে বাইরেই দাঁড়িয়ে আছি, যদি হঠাৎ দরকার হয় কোন…”

“সেটার কোন প্রয়োজন দেখছি না, ধন্যবাদ।”

ইউরি চলে গেলে দরজা বন্ধ করে দিলাম। অ্যালার্মটা ডেস্কে রেখে বসে পড়লাম অ্যালিসিয়ার উল্টো দিকের চেয়ারটায়। মাথা তুলল না সে। কয়েক মুহূর্ত একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। বরাবরের মতনই অভিব্যক্তিহীন চেহারা। হতে পারে যে গোটাটাই একটা মুখোশ। সেক্ষেত্রে মুখোশের নিচে কি আছে কে জানে।

“আমি অনেক খুশি হয়েছি, আপনি আমার সাথে দেখা করতে রাজি হয়েছেন।” উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করলাম কিছুক্ষণ, যদিও জানি যে কিছু বলবে না। আমার ব্যাপারে আপনি যতটা না জানেন, তার থেকে আমি আপনার ব্যাপারে অনেক বেশি জানি। এটাই স্বাভাবিক। একজন স্বনামধন্য চিত্রশিল্পীর ব্যাপারে লোকে তো জানবেই। আমি আপনার কাজের ভক্ত।” এবারেও কোন প্রতিক্রিয়া পেলাম না। চেয়ারে নড়েচড়ে বসলাম। “প্রফেসর ডায়োমেডেসকে আপনার সাথে দেখা করার ব্যাপারে বলেছিলাম, তিনিই ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। রাজি হবার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ।”

আশা করেছিলাম হয়তো সামান্য মাথা নাড়বে সে কিংবা চোখ তুলে তাকাবে, কিন্তু সেরকম কিছু হলো না। এবারে কিছুটা দ্বিধা চেপে বসলো আমার চিত্তে। তার মাথায় কি চলছে তা ভাবার চেষ্টা করলাম। হয়তো এত কড়া ঔষধের কারণে ঠিকমতো বুঝতে পারছে না কিছু।

আমার পুরনো থেরাপিস্ট, রুথের কথা মনে হলো এসময়। এরকম পরিস্থিতিতে সে কি করতে? সবসময়ই সে বলে এসেছে যে খারাপ-ভালোর মিশেলেই তৈরি আমরা। সুস্থ একজন মানুষের একইসাথে ভালো এবং খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে সামঞ্জস্য রক্ষা করে চলার ক্ষমতা আছে। কিন্তু যারা মানসিক সমস্যায় ভোগে তারা এই সামঞ্জস্যতাটুকু রক্ষায় অক্ষম। নিজের অপ্রীতিকর দিকগুলোর ব্যাপারে তাদের মস্তিষ্ক কিছু ভাবতে চায় না। এক ধরণের ডিফেন্স মেকানিজম বলা যায় ব্যাপারটা। অ্যালিসিয়াকে যদি আমি সাহায্য করতে চাই, তাহলে সে অবচেতন মনে নিজের কাছ থেকে যে ব্যাপারগুলো লুকোচ্ছে তা খুঁজে বের করতে হবে। একমাত্র তখনই সেই রাতে ঠিক কি ঘটেছিল সেটা জানা যেতে পারে। তবে কাজটা সময়সাপেক্ষ এবং কঠিন।

সাধারণত নতুন কোন রোগির সাথে কাজ করা শুরু করলে আমাদের মধ্যে কোন তাড়াহুড়ো থাকে না। ঠিক কোন উপায়ে চিকিৎসার কাজ করবো, সেসম্পর্কেও আগে থেকে কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে সামনে এগোই না। কারণ হাতে পর্যাপ্ত সময় থাকে। তখন একে অপরের সাথে কথা বলি আমরা। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে অ্যালিসিয়া নিজ থেকেই আমাকে তার ব্যাপারে সবকিছু খুলে বলতো। শৈশব কিরকম কেটেছে, তার বাবা-মা’র ব্যবহার কেমন ছিল-এসব। সব শোনার পর মনে মনে একটা ছবি দাঁড় করাতাম আমি, সমস্যাটা অনুধাবনের চেষ্টা করতাম। কিন্তু এক্ষেত্রে সেটা সম্ভব নয় কিছুতেই। এই মৌনতার মধ্যে থেকেই সব তথ্য যোগাড়ের চেষ্টা করতে হবে আমাকে। সাইকোথেরাপির একটা পদ্ধতি হচ্ছে কাউন্টার ট্রান্সফিয়ারেন্স। এই পদ্ধতিতে বিভিন্ন কথা বা কাজের প্রেক্ষিতে রোগির অনুভূতি বোঝার চেষ্টা করে থেরাপিস্ট। আমাকেও হয়তো সেরকমটা করতে হতে পারে।

মোদ্দা কথা, অ্যালিসিয়াকে আসলে কিভাবে সাহায্য করবো সেটা ঠিক না করেই নৌকায় পা দিয়ে দিয়েছি। এখন যে কোন উপায়ে সফল হতেই হবে আমাকে। শুধু যে ডায়োমেডেসের কাছে নিজেকে প্রমাণ করতে চাইছি, তা নয় কিন্তু একদম মন থেকে অ্যালিসিয়াকে সাহায্য করতে চাই আমি।

উল্টোদিকে ওকে এভাবে ঢুলুঢুলু চোখে, ঔষধের ঘোরে স্থাণুর মত বসে থাকতে দেখে হঠাৎই গভীর বিষণ্ণতায় ছেয়ে উঠলো মন। ওর মত এরকম পরিস্থিতিতে যারা আছে, তাদের সবার জন্যে খারাপ লাগছে ভীষণ। তারাও তো আমাদের মতনই মানুষ।

তবে মনে মনে এসব ভাবলেও মুখে কিছু বললাম না। বরং আমার জায়গায় রুথ থাকলে যে কাজটা করতো, সেটাই করলাম।

চুপচাপ ঘরটায় বসে রইলাম দুজনে।

.

১.৮

ডেস্কের ওপর রাখা অ্যালিসিয়ার ফাইলটা খুললাম। ডায়োমেডেস নিজ থেকেই দিয়েছে এটা। “আমার নোটগুলো অবশ্যই পড়ে নেবে। কাজে আসতে পারে।”

কিন্তু নোটগুলোয় নজর বুলানোর কোন ইচ্ছেই ছিল না আমার; অ্যালিসিয়া সম্পর্কে তার কি ধারণা সেটা জেনে গিয়েছিলাম ততক্ষণে। আমার নিজের কি ধারণা তা জানা দরকার। তবুও ফাইলটা নিয়েছিলাম চুপচাপ।

“ধন্যবাদ। আসলেও কাজে দিবে এগুলো।”

আমার অফিসটা ছোট হলে বেশ গুছোনো। ভবনের শেষ মাথায়, ফায়ার এসকেপের পাশেই। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। একটা ছোট কালো পাখি জমে যাওয়া ঘাসের মধ্যেই ঠোকরা ঠুকরি করছে, তবে কিছু পাবে বলে মনে হয় না।

কেঁপে উঠলো আমার শরীর। ঘরটায় প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। জানালার পাশের রেডিয়েটরটা নষ্ট। ইউরি বলেছে সে একবার চেষ্টা করে দেখবে যে ওটা ঠিক করা যায় কি না, কিন্তু স্টেফানিকে বলাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। তাতেও লাভ না হলে কম্যুনিটি মিটিংয়ে কথাটা পাড়তে হবে। এলিফের প্রতি হঠাই সহমর্মিতা জেগে উঠলো মনে, লাঠিটা ভেঙে যাওয়ায় তারও নিশ্চয়ই আমার মতনই অনুভূতি হয়েছে।

আনমনে অ্যালিসিয়ার ফাইলটা উল্টাচ্ছি, খুব বেশি কিছু পাবো এখান থেকে সেই আশা করছি না। আমার যা তথ্যের দরকার ছিল তার বেশিরভাগই অনলাইন ডাটাবেজ থেকে পেয়ে গেছি ইতোমধ্যে। কিন্তু ডায়োমেডেস এখনও আদ্দিকালের মতন সবকিছু হাতে লিখতে পছন্দ করেন (স্টেফানির আপত্তি সত্ত্বেও)। আর সেজন্যেই এখন এই পেটমোটা ফাইলটা ওল্টাতে হচ্ছে আমাকে।

ডায়োমেডেসের নোটগুলোয় অ্যালিসিয়া সম্পর্কে তার নিজস্ব সেকেলে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ আছে বিস্তর। তবে সেগুলো পাত্তা না দিয়ে আমি নার্সদের লেখা রিপোর্টগুলোয় মনোযোগ দিলাম, এখান থেকে তার দৈনন্দিন জীবনের আচার-ব্যবহার সম্পর্কে বেশ পরিস্কার ধারণা পাওয়া যাবে। তাই এ সংক্রান্ত সবগুলো তথ্য লক্ষ্য করলাম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। যে কাজটা করতে যাচ্ছি, আগে থেকে সে ব্যাপারে বিশদ ধারণা থাকলে কাজে সুবিধা হবে। নতুবা দেখা যাবে হুটহাট নতুন কোন তথ্য সামনে আসাতে চমকে গেছি।

তবে খুব বেশি কিছু জানতে পারলাম না। এখানে ভর্তি হবার পর অ্যালিসিয়া দু’বার কব্জিতে ছুরি চালানোর চেষ্টা করেছে। এছাড়া হাতে কাছে যা পেতো সেটা দিয়েই নিজের শরীরের ওপর অত্যাচার চালানোর চেষ্টা করতো। তাই প্রথম ছয় মাস সার্বক্ষণিক দু’জন নার্স তার দেখাশোনা করে। এক পর্যায়ে গিয়ে দুজনের বদলে একজন নার্স বরাদ্দ করা হয় অ্যালিসিয়ার জন্যে। গ্রোভের অন্য রোগি বা স্টাফদের সাথে কখনো কথা বলেনি সে। দূরে দূরে থাকতো সবসময়। অন্যান্য রোগিরাও তাকে ঘাটায়নি। কেউ যখন কথার জবাবে কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় না বা নিজ থেকে কখনো কোন আলাপ কওে না, তখন তার অস্তিত্ব এক প্রকার ভুলেই যায় লোকে। সেরকমই অ্যালিসিয়ার উপস্থিতিও সবাই উপেক্ষা করতে শিখে যায় কিছুদিনের মধ্যে।

তবে একটা ঘটনা আমার মনোযোগ আকর্ষণ করলো। অ্যালিসিয়া গ্রোভে ভর্তি হবার কয়েক সপ্তাহ পরে ক্যান্টিনে ঘটেছিল ঘটনাটা। এলিফের সিটে বসে পড়েছিল অ্যালিসিয়া, সেটা নিয়েই তাকে দোষারোপ শুরু করে তুর্কী মহিলা। ঠিক কি কারণে বাকবিতণ্ডা শুরু হয়েছিল সে সম্পর্কে অবশ্য বিস্তারিত লেখা নেই, তবে পরিস্থিতি খুব দ্রুত নাগালের বাইরে চলে যায়। ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়ে অ্যালিসিয়া, একটা প্লেট ভেঙে সেটার ধারালো অংশ দিয়ে আক্রমন করে এলিফকে। আরেকটু হলেই গলায় ঢুকিয়ে দিয়েছিল। কোনমতে তাকে আটকে ঘুমের ঔষধ দিয়ে আইসোলেশনে পাঠানো হয়।

ঠিক বলতে পারবো না, ঘটনাটা কেন আগ্রহোদ্দীপক মনে হলো আমার কাছে। শুধু মনে হচ্ছে, কিছু একটা গোলমাল আছে। এলিফকে সেদিনের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করবো বলে সিদ্ধান্ত নিলাম।

 প্যাড থেকে একটা পাতা ছিঁড়ে নিয়ে কলম বের করলাম। এটা আমার বেশ পুরনো অভ্যাস। কাগজে কলমে কিছু না লেখা অবধি শান্তি পাই না। যে কোন ঘটনা সম্পর্কে কাগজে লেখার পরেই পরিস্কারভাবে ভাবতে পারি।

অ্যালিসিয়ার বর্তমান পরিস্থিতি এবং সম্ভাব্য চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে আমার মন্তব্যগুলো টুকে রাখলাম। অ্যালিসিয়াকে সাহায্য করতে চাইলে আমার আগে তাকে বুঝতে হবে। গ্যাব্রিয়েলের সাথে তার সম্পর্কটা কেমন ছিল সেটাও জানা প্রয়োজন। তাকে কি ভালোবাসত ও? নাকি ঘৃণা করতো? খুনের ঘটনাটা নিয়ে কিছু বলছে না কেন? এখন পর্যন্ত একটা প্রশ্নেরও উত্তর মেলেনি।

 একটা শব্দ স্পষ্ট করে লিখে নিচে দাগ দিলাম : অ্যালসেস্টিস।

ছবিটার সাথে গোটা ঘটনার নিগুঢ় সম্পর্ক আছে কোন, সেই সম্পর্কটা জানা গেলেই রহস্য উন্মোচন সহজ হয়ে যাবে। অ্যালিসিয়ার তরফ থেকে কিছু বলার বা ইঙ্গিত দেয়ার একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে পেইন্টিংটা। কিন্তু ইঙ্গিতটা যে কি, সেটা ধরতে হবে আমাকে। লিখে রাখলাম যে আরো একবার গ্যালারিতে যাবো ছবিটা দেখার জন্যে।

আরেকটা শব্দ আলাদা করে লিখলাম একপাশে : শৈশব। গ্যাব্রিয়েল কেন খুন হয়েছে সেটা জানতে হলে শুধু সেই রাতে কি ঘটেছিল তা বের করলেই হবে না, অ্যালিসিয়ার অতীত সম্পর্কেও ঘাটাঘাটি করা প্রয়োজন। ঐ মুহূর্তে কেন স্বামীর ওপর গুলি চালিয়েছিল সে এর মুল প্রোথিত আছে অতীতে। কেন না একজন মানুষ হুট করে খুনে স্বভাবের হয়ে ওঠে না। ধীরে ধীরে তার ভেতরে বাসা বাঁধে ক্ষোভ। খুন সেই ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ। মানুষের শৈশব কেমন কেটেছে তার একটা প্রভাব আছে এর ওপরে।

যদি শৈশবে কেউ অত্যাচার বা অসাদাচরণের শিকার হয় তাহলে তার ভেতরে ধীরে ধীরে দানা বাঁধতে শুরু করে জিঘাংসা। আর একটা পর্যায়ে এই জিঘাংসারই উদগিরণ ঘটে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ক্রোধে অন্ধ হয়ে ভুল মানুষের ক্ষতি করে বসি আমরা। এজন্যেই অ্যালিসিয়ার শৈশব কেমন কেটেছে সেটা জানাটা জরুরি। অ্যালিসিয়া যদি নিজে সেসম্পর্কে কিছু জানাতে না পারে, তাহলে এমন কাউকে খুঁজে বের করতে হবে যে খুনের ঘটনাটা ঘটার অনেক আগে থেকেই ভাল করে চেনে তাকে।

ফাইলে অ্যালিসিয়ার নিকটাত্মীয়ের নাম লেখা লিডিয়া রোজ। সম্পর্কে ওর খালা হন মহিলা। সড়ক দুর্ঘটনায় অ্যালিসিয়ার মা মারা গেলে লিডিয়াই তার দেখাশোনা করা। দুর্ঘটনার সময় গাড়িতে অ্যালিসিয়াও ছিল, তবে বেঁচে যায় সে। সেই বয়সের একটা মেয়ের মানসিকতার ওপর এরকম একটা ঘটনা নিশ্চয়ই মারাত্মক প্রভাব ফেলেছিল। আশা করি লিডিয়া এই ব্যাপারে বিস্তারিত জানাতে পারবেন।

 লিডিয়া বাদে আরেকজন ব্যক্তির নাম পেলাম ফাইলে। ম্যাক্স বেরেনসন, অ্যালিসিয়ার আইনজীবী। ম্যাক্স হচ্ছে গ্যাব্রিয়েল বেরেনসনের বড় ভাই। অ্যালিসিয়া আর গ্যাব্রিয়েলের সম্পর্ক কেমন ছিল এটা নিশ্চয়ই সে বলতে পারবে। তবে আমার সামনে মুখ খুলতে রাজি হবে কি না কে জানে। একজন সাইকোথেরাপিস্ট হয়ে অ্যালিসিয়ার পরিবারের লোকজনের সাথে এভাবে অযাচিত কথা বলতে চাওয়াটা একটু অদ্ভুতই বটে। সচরাচর সাইকোথেরাপিস্টরা এমন কিছু করে না। ডায়োমেডেস অনুমতি দিবেন কি না সে নিয়েও সংশয় আছে। এর চেয়ে বরং তাকে কিছু জিজ্ঞেস না করাই উত্তম।

অ্যালিসিয়ার জন্যে আমি নিয়মের বাইরে গিয়ে যা যা করেছি, তার সূচনা হয়েছিল এই ঘটনাটার মাধ্যমেই। সেখানেই থামা উচিৎ ছিল আমার। কিন্তু ততদিনে দেরি হয়ে যায়। ভাগ্যদেবী ইতোমধ্যে লিখে ফেলেছিলেন যে ভবিষ্যতে আমার জন্যে কি অপেক্ষা করছে, গ্রিক ট্র্যাজেডিগুলোর মতন।

ফোনের দিকে হাত বাড়ালাম। অ্যালিসিয়ার ফাইলে থেকে ম্যাক্সের নম্বরটা আগেই টুকে নিয়েছি। কয়েকবার রিং হবার পর ফোন ধরলো কেউ।

“এলিয়ট, ব্যারো এবং বেরেনসনের অফিস থেকে বলছি।” রিসিপশনিস্টের কণ্ঠস্বর শুনে মনে হচ্ছে ঠাণ্ডা লেগেছে।

“মি, বেরেনসনকে দিন।”

“কার সাথে কথা বলছি সেটা জানতে পারি?”

“আমার নাম থিও ফেবার। গ্রোভের একজন সাইকোথেরাপিস্ট। মি. বেরেনসনের সাথে অ্যালিসিয়ার ব্যাপারে কিছু কথা ছিল।”

জবাব আসতে এবারে কিছুটা সময় লাগলো। “ওহ, আচ্ছা। আসলে মি. বেরেনসন এই সপ্তাহটা আর অফিসে আসবেন না। এডিনবার্গে এক মক্কেলের সাথে দেখা করতে গিয়েছেন। আপনার নম্বরটা জানিয়ে রাখুন, তিনি ফিরলে আমি বলবো যোগাযোগ করতে।”

নম্বর দিয়ে ফোন কেটে দিলাম।

এরপর ফোন দিলাম লিডিয়া রোজের নম্বরে।

 একবার রিং হবার পরেই কণ্ঠস্বর ভেসে এলো ওপাশ থেকে। “হ্যাঁ? কি চাই?”

“মিস রোজ?”

 “কে আপনি?”

“আপনার ভাগ্নি, অ্যালিসিয়া বেরেনসনের ব্যাপারে কথা বলার জন্যে ফোন দিয়েছিলাম। আমি গ্রোভের একজন সাইকোথে

“যত্তসব বালছাল।” কেটে গেল লাইন।

ভ্রু কুঁচকে ফেললাম।

পরিস্থিতি সুবিধের মনে হচ্ছে না।

.

১.৯

সিগারেটের তেষ্টা পেয়েছে ভীষণ। গ্রোভ থেকে বের হবার সময় কোট পকেট হাতড়ে আবিষ্কার করলাম যে প্যাকেটটা নেই।

“কিছু খুঁজছেন নাকি?”

ঘুরে তাকিয়ে দেখি ইউরি আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। তার আসার কোন শব্দই পাইনি, তাই এভাবে কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভড়কে গেলাম।

“নার্স স্টেশনে পেয়েছি।” মুখে দরাজ হাসি ঝুলিয়ে সিগারেটের প্যাকেটটা সামনে বাড়িয়ে দিল সে। “আপনার পকেট থেকে পড়ে গিয়েছিল নিশ্চয়ই।”

“ধন্যবাদ।” একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেললাম দেরি না করে। ইউরিকেও সাধলাম কিন্তু হেসে মানা করে করে দিল। “সিগারেটের নেশা নেই আমার। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে ড্রিঙ্কসের প্রয়োজন। চলুন, বিয়ারের খরচ আমার।”।

ইতস্তত করতে লাগলাম। সহকর্মীদের সাথে যতটা সম্ভব কম মেলামেশা করেই অভ্যস্ত আমি। তাছাড়া ইউরির সাথে আলাপচারিতা চালানোর মত বিষয়ও খুব বেশি নেই। কিন্তু গ্রোভের অন্য যে কারো চাইতে অ্যালিসিয়া সম্পর্কে ইউরিই সবচেয়ে ভালো জানে। তাই তার মন্তব্য আমার কাজে আসতে পারে।

“চলুন তাহলে,” বললাম।

স্টেশনের কাছে অবস্থিত একটা পাবে গেলাম আমরা। পাবের নামটা অদ্ভুত, দ্য টান্ড ল্যাম্ব। ভেতরটা আঁধারে আচ্ছন্ন, বেশ বয়স হয়েছে বোঝাই যাচ্ছে। পাবের অধিকাংশ কাস্টোমারের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। হাতে বিয়ারের গ্লাস নিয়ে সিটে বসে ঢুলছে অনেকে। ইউরি দুই ক্যান বিয়ার নিয়ে এলে পাবের একদম পেছনে গিয়ে বসলাম আমরা।

ক্যানে লম্বা একটা চুমুক দিয়ে মুখ মুছলো ইউরি। “তারপর? অ্যালিসিয়া সম্পর্কে বলুন দেখি।”

“অ্যালিসিয়া?”

“কেমন বুঝলেন ওকে?”

 “আসলে বুঝেছি কি না সে সম্পর্কে নিশ্চিত নই।”

ক্ষণিকের জন্যে বিভ্রান্তি খেলে যায় ইউরির চোখে, পরমুহূর্তেই আবারো হেসে ওঠে। “সে বোধহয় চায় না যে কেউ তাকে বুঝুক, নাকি? ইচ্ছে করেই দেয়াল তুলে রেখেছে চারপাশে।”

“তার বেশ ঘনিষ্ঠ আপনি, বুঝতে পারছি।”

“ওর বিশেষ খেয়াল রাখার চেষ্টা করি। এখানে আমার চেয়ে ভালো করে অ্যালিসিয়াকে কেউ চেনে না, এমনকি প্রফেসর ডায়োমেডেসও না।”

 ইউরির কণ্ঠে প্রচ্ছন্ন গর্ব। কিছুটা বিরক্ত হলাম ব্যাপারটায়। আসলেও ভালো করে চেনে কি না সে ব্যাপারে এখন সন্দেহ হচ্ছে।

“সে যে এখানে আসার পর থেকে কারো সাথে কোন বিষয়ে কথা বলেনি, এ সম্পর্কে আপনার মতামত কি? কেন এই নীরবতা?”

 কাঁধ ঝাঁকালো ইউরি। “এখনও বোধহয় কথা বলতে তৈরি নয় সে। যখন স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে, তখন বলবে।”

“স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে মানে?”

“সত্যটা বলতে কোন সমস্যা থাকবে না যখন, বন্ধু।”

“আর সেই সত্যটা কি?”

একদিকে ঘাড় কাত করলে আমাকে কিছুক্ষণ দেখলো ইউরি। কিছুক্ষণ পর যে প্রশ্নটা করলো তাতে অবাক না হয়ে পারলাম না।

“আপনি কি বিবাহিত, থিও?”

“হ্যাঁ,” মাথা নেড়ে বললাম।

“সেটাই ভেবেছিলাম। আমিও বিবাহিত ছিলাম এক সময়। লাটভিয়া। থেকে স্ত্রীকে সাথে নিয়ে ইংল্যান্ডে এসেছি। কিন্তু এখানে আসার পর আমি যেভাবে খাপ খাইয়ে নিয়েছি, সে পারেনি। চেষ্টাও করেনি আসলে। ইংরেজি শেখার ব্যাপারে কোন আগ্রহ ছিল না। যাইহোক, আমি নিজেও যে খুব খুশি ছিলাম, তা নয়। তবে সেটা কখনো মুখ ফুটে স্বীকার করতাম না। নিজেকে নিজেই ভুলভাল বোঝাতাম…” বাকি বিয়ারটুকু এক চুমুকে খালি করে ফেললো সে। “কিন্তু একসময় সত্যিকারের ভালোবাসার সন্ধান পাই।”

“আর সেটা নিশ্চয়ই অন্য কারো মধ্যে?”

হেসে মাথা নাড়লো ইউরি। “হ্যাঁ, আমাদের প্রতিবেশী এক মহিলা। খুব সুন্দরি। প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ে যাই বলতে পারো,” আমাকে তুমি করে বলা শুরু দিয়েছে সে। বিরক্ত হলেও চেপে গেলাম। একদিন হঠাৎই রাস্তায় দেখি তাকে। এরপর প্রথমবার কথা বলার মত সাহস যোগাতে বেশ সময় লাগে। প্রায়ই অনুসরণ করতাম, দূর থেকে দেখতাম তার অগোচরে। আবার বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতাম, যাতে জানালায় আসলে দেখতে পাই তাকে।” হাসলো ইউরি।

গল্পটা আর ভালো ঠেকছে না এখন। অবশিষ্ট বিয়ারটুকু শেষ করে হাতঘড়ির দিকে তাকালাম। আশা করছিলাম যে ইঙ্গিতটা ধরতে পারবে সে, কিন্তু সেরকম কিছু হলো না।

“একদিন তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করি আমি। কিন্তু আমার প্রতি একদমই আগ্রহী ছিল না সে। এরপরেও আরো কয়েকবার চেষ্টা করি, শেষমেষ আমাকে জানিয়ে দেয় যাতে ওভাবে বিরক্ত না করি।”

মহিলাকে দোষ দেয়া যাবে না, ভাবলাম। আমিও কোন একটা অজুহাত দিয়ে উঠে যাবো শিঘ্রই। ইউরির কথা থামার কোন লক্ষণ নেই।

 “ব্যাপারটা মেনে নিতে বেশ কষ্ট হয়। ধরেই নিয়েছিলাম যে সে আমার একদম আদর্শ জীবনসঙ্গি। হৃদয় ভেঙে খানখান হয়ে যায়। প্রচণ্ড রাগ হয় তার প্রতি। ভয়াবহ রাগ।”

“এরপর?” না জিজ্ঞেস করে পারলাম না।

“কিছুই না।”

 “কিছুই না? তোমার স্ত্রীর সাথেই সংসার করেছে এর পরে?”

মাথা ঝাঁকিয়ে না করে দিল ইউরি। “না। ওর প্রতি টানটুকু তো আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ঐ মহিলার প্রেমে পড়ার আগ অবধি ব্যাপারটা মানতে পারতাম না। মাঝে মাঝে সত্যটাকে স্বীকার করে নিতে অনেক সময়ের প্রয়োজন হয়। সাহসও দরকার।”

“বুঝলাম। তোমার ধারণা অ্যালিসিয়ার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য? সে তার বিয়ের ব্যাপারে সত্যটা স্বীকার করে নিতে তৈরি নয় এখনও? হতেও পারে।”

কাঁধ ঝাঁকালো ইউরি। “এখন হাংগেরির একটা মেয়ের সাথে সম্পর্ক আমার। সবকিছু ঠিক থাকলে সামনে বিয়েও করবো। এক স্পা সেন্টারে চাকরি করে, ভালো ইংরেজি বলে। আমাদের জুটিটা একদম ঠিকঠাক। একসাথে ভালো সময় কাটাই।”

মাথা নেড়ে আবারো ঘড়ির দিকে তাকালাম। এবার আর কোটটা তুলে নিতে দ্বিধা করলাম না। “যেতে হবে এখন। আমার স্ত্রীর সাথে দেখা করতে দেরি হয়ে যাবে নাহলে।”

“ঠিক আছে, সমস্যা নেই। তোমার স্ত্রীর নামটা যেন কি?”

কোন একটা অদ্ভুত কারণে ইউরিকে নামটা বলতে ইচ্ছে করছে না। চাইনা যে ওর ব্যাপারে সে কিছু জানুক। কিন্তু এটা ছেলেমানুষী।

“ক্যাথরিন। ওর নাম ক্যাথরিন। কিন্তু আমি ক্যাথি বলে ডাকি।”

অদ্ভুত একটা হাসি ফোটে ইউরির মুখে। “একটা উপদেশ দেই, কিছু মনে করো না। বাড়িতে তোমার স্ত্রীর কাছে ফিরে যাও। ক্যাথির কাছে, যে ভালোবাসে তোমাকে…আর অ্যালিসিয়াকে নিয়ে মাথা ঘামিও না।”

.

১.১০

সাউথ ব্যাঙ্কের ন্যাশনাল থিয়েটার ক্যাফেতে গেলাম ক্যাথির সাথে দেখা করতে। রিহার্সেলের পর অভিনেতা অভিনেত্রীরা সাধারণত এখানেই সমবেত হয়ে আড্ডা দেয়। ক্যাফের একদম পেছনের দিকে কয়েকজন সহঅভিনেত্রীর সাথে গভীর আলোচনায় মত্ত সে। আমাকে এগোতে দেখে মুখ তুলে তাকালো সবাই।

“কান গরম হয়ে গেছে নাকি, ডার্লিং?” চুমু খেয়ে বলল ক্যাথি।

 “কেন, গরম হবার কথা?”

 “ওদের তোমার ব্যাপারে বলছিলাম।”

“ওহ। আমি আসি তাহলে?”

“বোকার মত কথা বোলো না তো। একদম ঠিক সময়ে এসেছে। আমাদের প্রথম দেখার ঘটনাটা বলা শুরু করেছি কেবলই।”

আমি বসার সাথে সাথে আবার গল্পে ফিরে গেল ক্যাথি। এই গল্পটা সবাইকে খুব আগ্রহ নিয়ে বলে সে। মাঝে মাঝে আমার দিকে তাকিয়ে হাসবে, আমিও যে গল্পটার অংশ সেটা বোঝানোর জন্যেই বোধহয়। তবে সত্যি বলতে গল্পটা আগাগোড়াই ওর, আমার না।

 “একদিন বারে বসে ছিলাম, এসময় জনাবের আগমন ঘটে সেখানে। স্বপ্নের মানুষটাকে খুঁজে পাবার সব আশা ততদিনে ছেড়েই দিয়েছিলাম। কিন্তু ভাগ্যের লিখন, না যায় খণ্ডন। তবে দেরি করে হলেও সন্ধান তো পেয়েছিলাম, এই বা কম কি? বয়স পঁচিশ হবার আগেই বিয়ের শখ ছিল আমার, জানো? ত্রিশ বছরের মধ্যে দু’টা বাচ্চা হয়ে যাবে। এরপর সুখের সংসার। কিন্তু কিসের কি, তেত্রিশে পা দেয়ার পরেও সেই স্বপ্নের টিকিটিরও দেখা মেলেনি।” বলে অন্য সবার উদ্দেশ্যে একবার হাসলো ক্যাথি।

 “যাইহোক, তখন ড্যানিয়েল নামের একটা অস্ট্রেলিয়ান ছেলের সাথে ইটিস পিটিস চলছে আমার। কিন্তু ওর খুব শিগগির বিয়ে বা বাচ্চা নেয়ার কোন ইচ্ছেই ছিল না। সুতরাং আমি এক প্রকার জানতাম যে সময় নষ্ট করছি। ওর সাথেই এক রাতে ঘুরতে বেরিয়েছি এসময় থিও’র দেখা পাই।”এবারে আমার দিকে তাকিয়ে চোখ নাচায় ক্যাথি। “সাথে ওনার গার্লফ্রেন্ডও ছিল কিন্তু।”

 গল্পের এই অংশটুকু বেশ সাবধানে বলতে হয় যাতে শ্রোতাদের কেউ ভুলভাল না বোঝে। হ্যাঁ, ক্যাথির সাথে যখন পরিচয় হয় তখন আমরা দু’জনই আলাদা আলাদা সম্পর্কে ছিলাম। এই তথ্যটা অনেকের জন্যে অস্বস্তিদায়ক। আমার তখনকার গার্লফ্রেন্ড আর ক্যাথির বয়ফ্রেন্ড একে ওপরকে কিভাবে যেন চিনতো, ঠিক মনে নেই। মূলত তারাই আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়। যাইহোক, ক্যাথিকে প্রথমবার দেখেই হৃৎস্পন্দন দ্রুত হয়ে যায় আমার। যেন কেউ হাজার ভোল্টের শক দিয়েছে আমাকে। ওর ঘন কালো চুল, টানা টানা সবুজ চোখ, পাতলা ঠোঁট-মনে হচ্ছিল যেন এক দেবী নেমে এসেছিল মতে।

গল্পের এই পর্যায়ে রুটিন মাফিক একটা বিরতি দিয়ে আমার হাত ধরলো ক্যাথি। “তোমার মনে আছে, থিও? কোন প্রকার জড়তা ছাড়াই আলাপ শুরু করি আমরা। তুমি বলেছিলে যে সাইকোথেরাপিস্ট হবার জন্যে পড়ছে। আর আমি বলি যে আমার মত পাগলের জন্যে এরকম মানুষই দরকার।”

এই কথা শুনে হেসে উঠলো মেয়েরা। ক্যাথিও একবার হেসে আমার চোখের দিকে তাকালো। “একদম প্রথম দেখাতেই প্রেম, তাই না ডার্লিং?”

এবারে আমার পালা। মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে ওর গালে চুমু খেলাম। “হ্যাঁ। একদম সত্যিকারের ভালোবাসা।”

ওর বান্ধবীদের চোখেও সম্মতি দেখতে পেলাম। তবে সত্যি বলতে আমি কিন্তু অভিনয় করছি না, মন থেকেই বলেছি কথাটা। আসলেও প্রথম দেখায় একে অপরের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম আমরা। প্রেম না বলি কামনাও বলা যায় অবশ্য। ক্যাথির দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। দূর থেকে বার বার ওকেই দেখছিলাম। এক পর্যায়ে বুঝতে পারি, ওর বয়ফ্রেন্ডের সাথে ঝগড়া করছে। কিছুক্ষণ পর হনহন করে বার ছেড়ে বেরিয়ে যায় ড্যানিয়েল।

“তোমাকে আজ বড্ড বেশি চুপচাপ লাগছে,” ম্যারিয়ান বলে আমার উদ্দেশ্যে। “কি হয়েছে?”

“কিছু না।”

“চলো বাসায় যাই। আমি ক্লান্ত।”

“আরেকটু থাকি,” ওর কথা আসলে ঠিকমতো কানেও ঢুকছিল না আমার। “আরেক রাউন্ড ড্রিঙ্ক নেই।”

“আমি এখনি বাসায় যাবো।”

 “তাহলে যাও।”

আহত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায় মারিয়ান, কিন্তু কিছু বলে না। একটু পর জ্যাকেট তুলে নিয়ে চলে যায় বার থেকে। জানতাম যে পরদিন এ নিয়ে ঝগড়া হবে আমাদের মাঝে, কিন্তু তাতে আর কিছু যায় আসে না।

বার কাউন্টারে ক্যাথির পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। “ড্যানিয়েল কি ফিরবে?”

“না। ম্যারিয়ান?”

 মাথা ঝাঁকাই আমি। “না। আরেকটা ড্রিঙ্ক নেবে নাকি?”

“হ্যাঁ।”

ড্রিঙ্কসের অর্ডার দিয়ে ওখানে দাঁড়িয়েই গল্প করতে শুরু করি আমরা। আমার সাইকোথেরাপি ট্রেনিং নিয়ে কথা বলি কিছুক্ষণ। ক্যাথির ওর নাট্যকলায় আগ্রহের ব্যাপারে বলে। এই বিষয়ে পড়াশোনাও করছে। প্রথম বর্ষে থাকাকালীন সময় থেকেই এক এজেন্টের সহায়তায় নিয়মিত মঞ্চনাটকে অভিনয় করে। আমার কেন যেন মনে হয়েছিল, সে আসলেও একজন ভালো অভিনেত্রী।

“পড়াশোনা করতে ভালো লাগতো না একদমই,” কথার এক পর্যায়ে বলে ক্যাথি।

“তাহলে কী করতে ভালো লাগতো?”

“জীবনটাকে নিজের মত করে উপভোগ করতে।” ঘাড় কাত করে ক্যাথি। ওর গাঢ় সবুজ চোখজোড়ায় দুষ্টুমি খেলা করছিল। “তো, থিও সাহেব, আপনার এত পড়াশোনার ধৈৰ্য্য এলো কোথা থেকে?”

“হয়তো জীবনটাকে এখনও ‘উপভোগ করার মত সাহস জোগাড় করে উঠতে পারিনি। কাপুরুষ আমি।”

“নাহ, কাপুরুষ হলে তো সুড়সুড় করে গার্লফ্রেন্ডের সাথে বাড়ি চলে যেতে,” এবারে ক্যাথির হাসিতে স্পষ্ট ইঙ্গিত।

ইচ্ছে হচ্ছিলো ওকে শক্ত করে চেপে ধরে চুমু খাই। এর আগে কখনো কারো প্রতি এরকম কামনা অনুভব করিনি। আমার ঠোঁটে ওর ঠোঁটের স্পর্শ অনুভব করতে চাইছিলাম খুব করে।

“সরি,” হঠাৎই বলে ওঠে ক্যাথি। “আমার আসলে কথাটা বলা উচিৎ হয়নি। সবসময় মাথায় যা আসে বলে ফেলি। বলেছিলাম না, আমি আসলেও পাগল।”

ক্যাথির এই অভ্যাসটা এখনও আছে। কথায় কথায় নিজের পাগলামির দোহাই দেয়। ‘আমার মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে’, ‘আস্ত পাগল আমি’। ওর মুখের হাসিটা একদম দিলখোলা। অবসাদ বা বিষণ্ণতায় ভোগা কারো হাসি এরকম হয়না। অন্তত তখন সেটাই মনে হয়েছিল আমার। একটা স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল ওর মধ্যে, হাসিখুশি মানুষের চারপাশে যেরকম একটা আভা থাকে-আশা করি বোঝাতে পারছি কথাটা। জীবনকে পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করার জন্যেই ওর জন্ম। মুখে যা-ই বলুক ওর মতো ভালো মানসিক স্বাস্থ্য খুব কম মানুষেরই আছে। এমনকি ওর আশপাশে থাকলে আমার নিজেকেও স্বাভাবিক মনে হয়।

 ক্যাথি আমেরিকান। বড় হয়েছে ম্যানহাটানের দক্ষিণে। ওর মা ব্রিটিশ হওয়ায় দুই দেশের নাগরিকত্বই পেয়েছিল। তবে সত্যি বলতে ব্রিটিশদের কোন গুণাবলীই ক্যাথির মধ্যে ছিল না। কথাবার্তা, চালচলন, জীবনদর্শন-সব ছিল ব্রিটিশদের বিপরীত। ওর মতন আত্মবিশ্বাসী আর প্রাণোচ্ছল কারো সাথে এর আগে পরিচয় হয়নি আমার।

বার থেকে বেরিয়ে একটা ক্যাব ডেকে সরাসরি আমার ফ্ল্যাটে চলে আসি দু’জনে। আসার পথটুকু কোন কথা হয় না। বাসায় ঢোকার আগে আমার ঠোঁটে চুমু খায় ও। সব বাঁধ ভেঙে যায়, কাছে টেনে নেই ক্যাথিকে। কোন মতে পকেট থেকে চাবি বের করে ফ্ল্যাটে পা দিয়েই দু’জনের ওপর হামলে পড়ি দু’জনে। মেতে উঠি নরনারীর সেই আদিম খেলায়।

ক্যাথির সাথে কাটানো সেই রাতটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে সেরা মুহূর্তগুলোর একটা। ওর শরীরের প্রতিটা বাঁক উপভোগ করেছিলাম। রাত পেরিয়ে যায় কিন্তু আমাদের ভালোবাসা শেষ হয়নি। সবকিছুতেই সাদার আধিক্য ছিল যেন সেদিন। সূর্যের আলো, দেয়াল, বিছানার চাদর, ওর চোখ, দাঁত-সব। কারো ত্বক যে এতটা দীপ্তিময় হতে পারে, এটা আগে জানতাম না। বারবার মনে হচ্ছে যেন কোন গ্রিক দেবীর মূর্তির মধ্যে প্রাণের সঞ্চার হয়েছে আমার হাতে।

একে অপরের বাহুডোরে কতক্ষণ শুয়ে ছিলাম, জানি না। একদম কাছ থেকে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল ক্যাথি। বারবার হারিয়ে যাচ্ছিলাম ওর সবুজ চোখের গভীরে।

“এখন?”

“এখন কি?”

 “ম্যারিয়ানের কি হবে?”

 “ম্যারিয়ান?”

 “তোমার গার্লফ্রেন্ড।” মুখে হাসি ফোটে ক্যাথির।

“ওহ হ্যাঁ।”ইতস্তত করি কিছুক্ষণ। “আসলে জানি না আমি। ড্যানিয়েলের কি হবে?”

চোখ নাচায় ক্যাথি। “ওর কথা ভুলে যাও। আমি আর ওকে নিয়ে কিছু ভাবছি না।”

“আসলেই?”

 জবাবে আমাকে চুমু খায় ক্যাথি।

যাবার আগে গোসল করতে টোকে সে। সেই সুযোগে ম্যারিয়ানকে ফোন দেই আমি। আমি চাচ্ছিলাম দেখা করে কথাটা ওকে বলতে। কিন্তু আগের রাতের ব্যাপারটা নিয়ে খুব বেশি বিরক্ত ছিল সে, তাই যা বলার ফোনেই বলি। ম্যারিয়ান অবশ্য ভাবতে পারেনি যে ব্রেক-আপ করার জন্যে ফোন দিয়েছি আমি। কিন্তু সেটাই করি আমি, যতটা ভদ্রভাবে সম্ভব। এক পর্যায়ে রাগে-দুঃখে কাঁদতে শুরু করে ও, আমি ফোন কেটে দেই। জানি, বড্ড বেশি নিষ্ঠুর শোনাচ্ছে। সেদিনের সেই ফোনকলটা নিয়ে ভাবলে এখনও অস্বস্তিবোধ হয় আমার। কিন্তু এছাড়া আর কী-ই বা করতে পারতাম, বলুন?

***

আমাদের প্রথম আনুষ্ঠানিক ডেটে কিউ গার্ডেনে দেখা করি ক্যাথির সাথে। ওর আইডিয়া ছিল পুরোটাই।

আমি যে ওখানে কখনো যাইনি, এটা শুনে যারপরনাই অবাক হয়েছিল। “এটা কি করে সম্ভব? কখনো গ্রিনহাউজগুলো দেখতে যাওনি? অর্কিড় যেখানে রাখে সেখানটা একদম চুলোর মতন গরম। অভিনয়ের ক্লাস করার সময় শরীর গরমের জন্যে কিউ গার্ডেনে প্রায়ই যেতাম। তোমার কাজ শেষে ওখানে দেখা করলে কেমন হয়?” এরপরই অনিশ্চয়তা ভর করে ওর কণ্ঠে। “নাকি তোমার জন্যে বড় বেশি দুরে হয়ে যাবে?”

“তোমার জন্যে পৃথিবীর শেষ সীমানায় যেতে হলেও যাবো আমি, ক্যাথি।”

“গর্দভ।”ফোনেই একবার চুমু খেয়ে ফোন রেখে দেয় ও।

কিউ গার্ডেনে পৌঁছে দেখি গেটের বাইরে গায়ে বড় একটা কোট জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে ক্যাথি। গলায় স্কার্ফ। আমাকে দেখে বাচ্চাদের মতন হাত নাড়তে শুরু করে। আমার সাথে এসো।”

 ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া শক্ত কাদার ওপর দিয়ে কাঁচের ঘরগুলোর দিকে আমাকে নিয়ে যায় ক্যাথি। নানারকমের গ্রীষ্মমন্ডলীয় গাছ চারদিকে। ভেতরে পা দেয়ার সাথে সাথে টের পাই যে তাপমাত্রা লাফ দিয়ে বেড়ে গেছে অনেকটা। স্কার্ফ আর কোট খুলে ফেলি দ্রুত।

“দেখেছো? বলেছিলাম না গরম লাগবে?” হাসি চওড়া হয় ক্যাথির মুখে।

 হাত ধরাধরি করে গ্রীনহাউজের ভেতরে হাঁটি আমরা। ফুলগুলো আসলেও খুব সুন্দর ছিল।

ওর সাহচর্যে অদ্ভুত এক ধরণের মানসিক প্রশান্তি অনুভব করছিলাম, এরকম অনুভূতির সাথে আগে পরিচয় ছিল না। মনে হয় যেন আমার ভেতরে একটা গোপন দরজা খুলে গেছে। আর সেই দরজা দিয়ে জাদুকরী, উষ্ণ এক জগতে নিয়ে এসেছে ক্যাথি। চারদিকে রঙের স্ফুরণ।

সেই উষ্ণতার প্রভাবে আমার ভেতরে এতদিনের জমে থাকা আবেগের যে প্রস্ফুটন হচ্ছে, তা টের পাচ্ছিলাম। যেন দীর্ঘ শীতন্দ্রিা শেষে সূর্যের আলয় খোল থেকে মুখ বের করছে কোন কচ্ছপ। আমার জীবনটাকে নতুনভাবে সাজানোর পুরো কৃতিত্ব ক্যাথির।

এটাই সত্যিকারের ভালোবাসা, ভেবেছিলাম সেদিন। কোন সন্দেহই ছিল না ব্যাপারটায়। এর আগে কখনো এরকম অনুভূতি হয়নি আমার ভেতরে। ক্যাথির সাথে দেখা হবার আগ অবধি যতগুলো সম্পর্কে জড়িয়েছি, সবগুলোই ছিল সংক্ষিপ্ত। কোন তৃপ্তিও পাইনি সেগুলো থেকে। জীবনে প্রথমবার সেক্স করি কানাডিয়ান মেয়ে মেরেডিথের সাথে; বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়। তবে বিছানায় যাবার আগে নার্ভ শক্ত রাখার জন্যে গলা অবধি মদ গিলেছিলাম। মেরেডিথের দাঁতের ব্রেসের কারণে চুমু খাবার সময় ঠোঁট কেটে গিয়েছিল আমার। এরপর আরো কয়েকজনের সাথে সম্পর্ক হয়, কিন্তু কারো প্রতিই সেরকম টান অনুভব করিনি। ভাবতাম, আমার মত মানুষের পক্ষে সত্যিকারের ভালবাসা খুঁজে পাওয়া বুঝি সম্ভব নয়। কিন্তু এখন প্রতিবার যখন ক্যাথির হাসি শুনি, ভালোলাগায় ছেয়ে ওঠে মন। ওর প্রফুল্লতায় ছুঁয়ে যায় আমাকেও। সেজন্যেই ওর সব আবদারে হ্যাঁ বলেছি সবসময়। নিজেকে নিজেই চিনতে পারতাম না মাঝে মাঝে। নতুন আমাকে নিয়ে অবশ্য কোন আক্ষেপও ছিল না। সুযোগ পেলেই সেক্স করতাম। ওর চারপাশে থাকার প্রতিটা মুহূর্ত কামনায় আচ্ছন্ন। থাকতো আমার শরীর। আর সেই ক্ষুধা মেটানোর একমাত্র উপায় ওর সংস্পর্শ।

সেবছর ডিসেম্বরে আমার এক বেডরুমের ফ্ল্যাটটায় উঠে পড়ে ক্যাথি। নিচতলায় অবস্থিত সে ফ্ল্যাটে জানালা থাকলেও বাইরে দেখার মত কোন দৃশ্য ছিলনা। সিদ্ধান্ত নেই যে আমাদের দুজনের একসাথে কাটানো প্রথম ক্রিসমাসটা ভালো করে উদযাপন করবো। একটা ক্রিসমাস ট্রি কিনে ফেলি মেট্রোরেল স্টেশনের পাশের স্টল থেকে। তারপর দুজন মিলে সাজাই।

সেই গাছটার তাজা সুবাস এখনও মনে আছে আমার। মোমের আলোয় জুলুজুলু চোখে আমার দিকে তাকায় ক্যাথি। সেই দৃষ্টির গভীরে যে কোন সময় হারিয়ে যেতে পারি আমি। “আমাকে বিয়ে করবে?” সাত-পাঁচ না ভেবেই বলে উঠি।

অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায় ক্যাথি। “কি?”

 “আমি তোমাকে ভালোবাসি, ক্যাথি। আমাকে বিয়ে করবে?”

মুখে হাসি ফোটে ক্যাথির। “হ্যাঁ।”এই একটা মাত্র শব্দ আমার ভেতরে যেরকম অনুভূতির সঞ্চার করেছিল, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না।

পরদিন দোকানে গিয়ে ওর জন্যে একটা আঙটি কিনে ফেলি। বাস্তবতাটুকু আরো ভালোভাবে উপলব্ধি করি তখন। ক্যারি আমার বাগদত্তা।

অদ্ভুত হলেও এটা সত্যি, ওর হাতে আঙটি পরানোর পর প্রথমেই মা বাবার কথা মনে হয়েছিল। ক্যাথিকে তাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে চাইছিলাম। চাইছিলাম যে তারা দেখুক আমি কতটা সুখি। অবশেষে অতীতের শেকল ছিঁড়ে সামনে এগোতে সক্ষম হয়েছি। একদম মুক্ত। তাই সারের উদ্দেশ্যে একটা ট্রেনে চেপে বসি আমরা দুজনই। এখন বুঝি যে, গোড়া থেকেই বোকামি ছিল ব্যাপারটা।

বরাবরের মতনই আমাকে দেখে শীতল হয়ে যায় বাবার অভিব্যক্তি। “চেহারার এ কি দশা তোমার, থিও। একদম শুকিয়ে গেছো, চুল এত ছোট কেন? নেশাখোরদের মত লাগছে।”

“ধন্যবাদ বাবা। আশা করি তুমিও ভালো আছো।”

মা’কে গতানুগতিকের তুলনায় সেদিন আরো বিষণ্ণ মনে হচ্ছিল সেদিন। আগের চেয়ে আরো চুপচাপ হয়ে গেছে। বাবার অসহিষ্ণু উপস্থিতি সে তুলনায় অনেক বেশি প্রবল, মনের ওপর চাপ ফেলে। শীতল দৃষ্টিটা একবারের জন্যেও ক্যাথির দিক থেকে সরায়নি সে। বড় বেশি অস্বস্তিকর পরিবেশে দুপুরের খাবার সারি সবাই। ক্যাথিকে পছন্দ হয়নি, ওদের। আমাকে সুখি দেখে তারা যে খুশী হবে, এটা কেনই বা আশা করেছিলাম কে জানে।

খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ হলে বাবা তার স্টাডিরুমে চলে যায়। এরপর আর মুখ দেখায়নি। বিদায় জানানোর সময় আমাকে স্বাভাবিকের তুলনায় একটু বেশিক্ষণ শক্ত করে জাপটে ধরে থাকে মা। ঠিকমতো দাঁড়াতেও পারছিল না সে। পুরনো সেই বিষণ্ণতা আবারো জেঁকে বসে আমার চিত্তে। ক্যাথিকে নিয়ে যখন বেরিয়ে আসি, বঝতে পারি যে আমার ভেতরের সেই সদা ভীত, দুর্বল সক্কাটা এখনও বাড়িটায় বন্দি। চিরকাল বন্দিই থাকবে। আশা হারিয়ে ফেলি, চোখের কোণায় বাঁধ ভাঙার অপেক্ষা করতে থাকে অশ্র। এসময় বরাবরের মতনই আমাকে অবাক করে দেয় ক্যাথি। হাত বাড়িয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। “বুঝতে পারছি,” কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে। “সব বুঝতে পারছি। আগের চেয়ে অনেক বেশি ভালোবাসি তোমাকে এখন।”

 হুট করে সেদিন এই কথাগুলো কেন বলেছিল এটা ব্যাখ্যা করেনি ক্যাথি। ব্যাখ্যার দরকারও ছিল না।

***

এপ্রিলে ইউস্টোন স্কয়ারের একটা রেজিস্ট্রি অফিসে বিয়ে করি আমরা। কারো বাবা মা ই আসেনি অনুষ্ঠানে। ক্যাথির অনুরোধে ধর্মীয় রীতিনীতিরও কোন বালাই ছিল না। তবে মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে ঠিকই কৃতজ্ঞতা জানাই। তার জন্যেই এরকম হঠাৎ করে জীবনে সুখ নামের সোনার হরিণের দেখা পেয়েছি। তার উদ্দেশ্যটা পরিস্কার হয়ে যায় একদম। শৈশবে সেই দুর্বিষহ সময়ে আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেননি তিনি। গোটা সময়টা ক্যাথিকে লুকিয়ে রেখেছিলেন। এখন সময়মতো ঠিকই দূত স্বরূপ ওকে আমার কাছে পাঠিয়েছেন।

 ওর সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্তের জন্যে সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞ আমি। ভাগ্য খুব ভালো বলেই এরকম ভালোবাসার সংস্পর্শ পেয়েছি। পৃথিবীতে এমন অনেকেই আছে যারা আমার মত ভাগ্যবান নয়। আমার বেশিরভাগ রোগিদের কেউ কখনো ভালোবাসেনি। অ্যালিসিয়া বেরেনসনের ভাগ্যেও ভালোবাসা জোটেনি।

 ক্যাথি আর অ্যালিসিয়া একদম আলাদা। ন্যুনতম মিলটুকুও নেই তাদের। ক্যাথিকে দেখলে জীবনের সবচেয়ে সুন্দর দিকগুলোর কথা মনে হয় আমার-উজ্জ্বল হাসি, সম্পর্কের উষ্ণতা। আর অ্যালিসিয়ার কথা ভাবলা চোখের সামনে ফুটে ওঠে অন্ধকার, যেন বিষণ্ণতার প্রতিচ্ছবি সে।

মৌনতার প্রতিমূর্তি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *