2 of 3

১.৬৯ সমুখ দিয়ে স্বপনসম

সমুখ দিয়ে স্বপনসম
যেয়ো না মোরে হেলায় ঠেলে

মেসোমশাই!

দরজার সামনে মুকু। স্বপ্ন দেখছি না তো? মুকু হঠাৎ উড়ে এল নাকি?

মেসোমশাই, আমি আবার এসে গেছি।

পিতা চেয়ারে নড়েচড়ে বসে বললেন, এসো এসো। তোমার বাবা?

বাবা আসেননি।

সেকী! তুমি একা একা এতটা পথ চলে এলে?

আমি কত বড় হয়ে গেছি!

তা হয়েছ, তবু মেয়েদের একটু সাবধানে চলাফেরা করাই ভাল।

আমরা এক দল চলে এসেছি হইহই করে।

মুকু কথা বলতে বলতে পিতৃদেবের পায়ের কাছে থেবড়ে বসে পড়ল।

ওকী, তুমি মেঝেতে বসলে কেন?

আপনার পায়ের কাছে বসতে ইচ্ছে করল। আপনি যদি আমার বাবা হতেন, কী ভালই হত!

পাগলি মেয়ে।

পিতার মুখে পাগলি সম্বোধন এই প্রথম শুনলুম। মুকু দু’হাতে পা স্পর্শ করে মাথায় ঠেকাল। পিতা মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন। মুকু কথার ফাঁকে ফাঁকে, বারকয়েক আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসেছে। দুর্দান্ত দেখতে হয়েছে। কচি কলাপাতা রঙের শাড়ি পরেছে। একই রঙের ব্লাউজ। এলো চুলের গোড়ায় একটি ফিতে বেঁধেছে। রেশমের মতো চুলের গুচ্ছ পিঠের কাছে দুলছে। আরও যেন ফরসা হয়েছে। চোখমুখ আরও ধারালো হয়েছে। একবার তাকালে আধ্যাত্মিক শক্তির বলে মনকে ভগবতমুখী করে, কষ্টে চোখ ফেরাতে হয়। ফিরিয়ে নিলেও নিবে-যাওয়া ধূপের ধোঁয়ার মতো অনেকক্ষণ ভাসতে থাকে। বুকে বড় কষ্ট হয়।

হঠাৎ তুমি চলে এলে?

আবার পড়তে এলুম।

তোমার জিনিসপত্তর?

হস্টেলে।

ও তুমি হস্টেলে থাকবে! কেন, এখানে অসুবিধে আছে?

মুকু মাথা ঝাঁকিয়ে বললে, না না, অসুবিধে কীসের! একসঙ্গে কয়েকজন থাকব বলেই হস্টেলে থাকা।

ভালই করেছ। পুরো সময়টাই পড়াশোনায় দিতে পারবে।

কেমন আছেন আপনি? একটু রোগা হয়ে গেছেন।

বেশ বড় রকমের একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল। এক মাস বিছানায় পড়ে ছিলুম।

কী হয়েছিল? অ্যা

সিডে পুড়ে গিয়েছিলুম।

আপনার খুব দুর্ঘটনা হয়, কেন বলুন তো?

প্রারব্ধ ক্ষয় করছি মা।

কাকিমা নেই?

হ্যাঁ আছে, ভেতরে আছে।

মুকু ভেতরে যাবার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ইশারায় আমাকে ডেকে গেল। বেশ সাহস বেড়েছে। সেই চাপা ভাবটা আর নেই। পিতা বললেন, তুমি কিন্তু আর বেশি দেরি কোরো না। জয়কে গিয়ে খবরটা আগে জানিয়ে রাখো।

কাকিমা একটি ছোট পুঁটলি তৈরি করেছেন। দেখে মনে হচ্ছে যাবার জন্যে প্রস্তুত। হাত দুয়েক দূরে মুকু থমকে দাঁড়িয়ে আছে। এখনও মনে হয় ধরতে পারেনি, মহিলার জীবনে কী পরিবর্তন ঘটে গেছে। হয়তো লক্ষই করেনি, শাড়ির জমি কেন সাদা! সিঁথিতে সিঁদুর আছে না মুছে গেছে! আমি আসার আগে মুকু কি কোনও প্রশ্ন করেছিল?

মুকু অবাক হয়ে আমাকে প্রশ্ন করলে, কী হয়েছে?

এক কথায় এ প্রশ্নের জবাব দেওয়া কি সম্ভব! অতীত থেকে ফিরে আসতে হবে বর্তমানে। সে তো অনেক সময়ের ব্যাপার। তা ছাড়া এই মহিলা সম্পর্কে আমার আর কিছু বলার নেই। সমস্ত পরিস্থিতিটাকে ভদ্রমহিলা এমন ঘোলাটে করে তুলেছেন! পুরো পরিবারের মানসম্মান ডুবে যাবে।

বললুম, কাকাবাবু হঠাৎ মারা গেছেন। ইনি আজই চলে যাবেন।

তোমাদের ওপর দিয়ে একটা ঝড় বয়ে গেছে দেখছি।

মুকু এগিয়ে গিয়ে কাকিমার পুঁটলির সামনে উবু হয়ে বসল। কাকিমা কেমন যেন দিশাহারা, অন্যমনস্ক। নৌকোর হাল ভেঙে গেলে তার আর চালচলনের তেমন ঠিক থাকে না। গাছের মতো। শিকড় নাড়ানাড়ি হলে মুষড়ে পড়বেই।

মুকু বললে, আপনি কোথায় যাবেন? বাপের বাড়ি?

কাকিমা নীরব। একবার চোখ তুলে তাকিয়েই চোখ নামালেন। মুকুর প্রশ্নের উত্তর আমাকেই দিতে হল, কাকিমার কেউ কোথাও নেই। উনি আজই আমার মামার সঙ্গে বাইরে চলে যেতে চাইছেন।

কেন? এখানে থাকার কী অসুবিধে ছিল? এমন নির্ঝঞ্ঝাট বাড়ি আর কোথায় পাবেন? আপনি এখানেই থাকুন কাকিমা। মাঝে মাঝে আমি এসে আপনার সঙ্গে গল্প করে যাব। আপনার হাতের রান্না খেয়ে যাব।

দুটো হাত পুঁটলির ওপর রেখে কাকিমা উদাস চোখে মুকুর দিকে তাকালেন। এমন শূন্য দৃষ্টি আগে কখনও দেখিনি। হয়তো কিছু বলার ছিল, ঠোঁটদুটো অল্প কেঁপে উঠল। কিছু বলতে পারলেন না। জলের ধারা নামল দু’চোখে।

মুকুর মুখ দেখে মনে হল, ভীষণ অস্বস্তিতে পড়েছে। জীবন এখনও যার শুরুই হয়নি, সে ভাঙা জীবনের কথা বুঝবে কী করে? মুকু বসে বসেই আর একটু এগিয়ে গিয়ে কাকিমাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বললে, কাঁদছেন কেন? মামাবাবু খুব ভাল মানুষ। মেসোমশাইয়ের মতো গম্ভীর নন। ভীষণ আমুদে। আমরা মাঝে মাঝে আপনাকে দেখতে যাব।

এইসব কথার উত্তরে কাকিমার অনেক কিছু বলার ছিল। আবেগে কণ্ঠরুদ্ধ। সামনের বিমর্ষ পুঁটলিতে জীবনের যৎসামান্য উপকরণ। অনেক কিছুই মনে হয় ফেলে রেখে যেতে হবে। জীবনের প্রয়োজন কত সামান্য।

মুকু, তুমি বোসো, আমি মামার ওখান থেকে চট করে একবার ঘুরে আসি।

আমি যাব তোমার সঙ্গে?

বেশ ভয় পেয়ে গেলুম। মুকু জানে না, আমরা শত্ৰু পরিবৃত হয়ে বসে আছি। প্রায়-সন্ধ্যায় সুন্দরী এক মহিলাকে সাথী করে রাস্তায় বেরোনো, আর নিরস্ত্র সমরাঙ্গনে যাওয়া প্রায় একই ব্যাপার। কায়দা করে বললুম, তুমি এই এলে। কাকিমাও চলে যাবেন। তুমি থাকো, আমি যাব আর আসব।

মুকু চোখের এক ধরনের ভঙ্গি করল, যার অর্থ হতে পারে ভীরু কোথাকার! মুকুর আর আগের সে ভাব নেই। অনেক খোলামেলা, সামান্য চটুলও। স্বাধীনতা পেলে চরিত্রও কেমন পালটে যায়!

রাস্তায় বেরিয়ে মনে হল, সবাই যেন আমার দিকে কোনও একটা প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়ে আছে, কী। গো, বইটা পেয়েছ তো? তোমার পিতা পড়া শুরু করেছেন? জোড়া জোড়া অসংখ্য চোখের সামনে নিজেকে কেমন যেন অসহায় মনে হতে লাগল। পা পথ ভাঙছে দ্রুত গতিতে। বেশ বুঝতে পারছি, এ পল্লিতে আর বসবাস করা যাবে না। পালাতেই হবে।

নারকেল গাছের তলায় মাতামহের ছোট্ট খুপরিতে মাতুল বসে আছেন বিষণ্ণ বদনে। একমাথা রুক্ষ চুল এলোমেলো। জীবনের মতোই বিপর্যস্ত। মুখে সর্বক্ষণের সেই মধুর হাসিটি নেই। পর্বত তার এতকালের আড়ালটি সরিয়ে নিয়েছে।

উদাস গলায় বললেন, আয়, তোর কথাই ভাবছিলুম, এত দেরি করলি?

একটু দেরি হয়ে গেল। বিশ্রী একটা ব্যাপারে আটকে গিয়েছিলুম।

কী আবার হল?

ধীরে ধীরে সব কথাই বললুম, সব শুনে কেমন যেন হয়ে গেলেন। বললেন, ছি ছি, তোদের পাড়াটা কী হয়ে গেল? বইটা চিঠিটা পোড়ালি কেন? পুলিশের হাতে দেওয়া উচিত ছিল। জানিস তো, কান টানলে মাথা আসে। খুব ভুল করেছিস। মাঝে মাঝে মানুষকে উচিত শিক্ষা দিতে হয়, তা না হলে পেয়ে বসে।

বিমর্ষ ঘরে ধীরে ধীরে সাঁঝের আঁধার ঘিরে আসছে। দাদুর তম্বুরাটি ঘরের কোণে এক পায়ে খাড়া দাঁড়িয়ে আছে। তারামায়ের ছবিটি একটু হেলে গেছে, আর সেই রহস্যময় সিন্দুক একপাশে। কতকালের স্মৃতি যে ওর মধ্যে জমা আছে। মায়ের চিঠি আছে, ব্যবহার করা জিনিস আছে, গান লেখা খাতা আছে, তন্ত্রসাধনার নানারকম উপকরণ আছে। সিন্দুকটি ছিল মাতামহের প্রাণ। আগলে আগলে রাখতেন, কাউকে স্পর্শ করতে দিতেন না।

মাতুল চৌকি থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ঠিক আছে, ভদ্রমহিলাকে আমার সঙ্গেই নিয়ে যাচ্ছি। ওখানে সুখেই থাকবেন। একেবারে অনাথ হয়ে গেলুম রে পিন্টু! যতদিন জীবিত ছিলেন বুঝিনি। কত আঘাত দিয়েছি, অশান্তি করেছি, অনাদরও করেছি। কোনও কিছু আর সংশোধনের উপায় নেই। শিল্পীর কখনও বিয়ে করা উচিত নয়। জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল বিবাহ। সংসার অক্টোপাসের মতো সব সাধনাকে জড়িয়ে ধরতে চায়, ভীরু করে দেয়, ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবায়। কিছু কাজ আছে যা একবার করে ফেললে আর নিষ্কৃতি পাবার উপায় থাকে না, কিছু পথ আছে যে-পথে এগোলে আর ফেরার উপায় থাকে না। তুই আমার ভাগনে, দিদি ছিল আমার মায়ের মতো, তোকে আমি কত ভালবাসি তোর ধারণা নেই। একটা কথা বলে যাই, জীবনকে বেশ বুঝেসুঝে খরচ করিস। নিজেকে চেনা বড় কঠিন, সবসময় গুরুজনের পরামর্শে চলিস। নিজেকে এমন কারুর হাতে সমর্পণ করবি যিনি তোর দেহ-মন বুদ্ধি আত্মা সবকিছু ভোলা বইয়ের মতো পড়তে পারেন।

তার মানে গুরু।

পিতার চেয়ে বড় গুরু আর কেউ নেই রে! আমি যে ভুল করেছি, তুই যেন সে ভুল আর করিসনি। জেনে রাখ ভুলও রক্তের প্রবণতা। ভুল মানুষ করে না, ভুলের বীজই মানুষকে ভুল করায়। আমি নিজের দোষে সব ছারখার করে ফেললুম। আজ আমি প্রবাসী। সংসারের ক্রীতদাস। আমার ডানাদুটো কেটে দিয়েছে ভাগ্য। আর আমি উড়তে পারব না। মুক্ত জীব হয়ে গেলুম বদ্ধ জীব।

কথা বলতে বলতে আমরা ঘরের বাইরে নারকেল গাছের তলায় এসে দাঁড়ালুম। সন্ধের বাতাস লেগেছে পাতায় পাতায়। দীর্ঘশ্বাসের মতো শব্দ উঠছে। হঠাৎ যেন চমকে উঠতে হয়। মাতামহ কি এখনও তার প্রিয় জায়গাটিতে বসে আছেন, যেমন বসে থাকতেন গালে হাত দিয়ে। দোতলায় ওঠার নির্জন সিঁড়িটি চোখে পড়ছে। কেউ কোথাও নেই। সরু সরু ঘাসের ডগা উদ্দাম বাতাসে বিরক্ত হচ্ছে। রাতের প্রথম ঝিঁঝিটি যন্ত্রের সুর মেলাচ্ছে।

সন্ধ্যার উদাস আকাশের দিকে তাকিয়ে মাতুল বললেন, সব ছারখার হয়ে গেল। কোথায় গেল আমার সেই স্বপ্নের শৈশব! ওই সিঁড়িটার দিকে তাকালেই আমি দেখতে পাই, বাবা নেমে আসছেন ধীরে ধীরে। যৌবনের সে চেহারা তোরা দেখিসনি। একমাথা চুল ব্যাকব্রাশ করা। বিলিতি পমেড পড়ে চকচক করছে। গায়ে ফিনফিনে পাঞ্জাবি, কোচানো ধুতি। পায়ে গ্রিসিয়ান জুতো। সেই বাবু মানুষ ধীরে ধীরে সব ছাড়তে ছাড়তে, শেষে আমার চক্রান্তে শেষ ক’টা বছর এই ভাঙা ঘরে চাকরের। মতো কাটিয়ে গেলেন। আমি কার কথা শুনব, বউয়ের কথা, না নিজের বিবেকের কথা? ধীরে ধীরে আমার আমি ঘুমিয়েই পড়ল। আর তো ফিরবে না কেউ! যাহা যায়, তাহা যায়।

সিঁড়ি ভেঙে উঠতে উঠতে মাতুল বললেন, ইট, কাঠ, পাথর প্রাণহীন তাই প্রাণের চেয়ে দীর্ঘস্থায়ী! মানুষ চলে যাবার পরেও স্মৃতি বুকে করে এরা পড়ে থাকবে কতকাল। সিঁড়ির ধাপে ধাপে আমার মায়ের পায়ের ছাপ, বাবার পায়ের ছাপ, দিদির পায়ের ছাপ। একদিন আমিও থাকব না, তুই থাকবি। তোর মনে পড়বে, এক সন্ধ্যায় আমরা দুজনে পাশাপাশি কথা বলতে বলতে ওপরে উঠছিলুম, হয়তো এই আমাদের শেষ দিন, হু নোজ, দি ওয়ার্লড মে এন্ড টু-নাইট! কিছুই বলা যায় না, একেবারেই ক্ষণস্থায়ী বন্দোবস্ত। সুইচ-অন, সুইচ-অফ।

রান্নাঘরের সামনে বাহাদুর ভোলা উনুনে কী একটা করছে! তাল-হারা নর্তকের মতো মাতুল এলোমেলো ঘুরতে লাগলেন, ঘর-বারান্দা, বারান্দা-ঘর। কী করবেন, ভেবে পাচ্ছেন না। বারান্দার চেয়ারে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ে বললেন, এ বাড়ি রেখে আর লাভ কী? কে দেখবে? বেচে দেওয়াই ভাল, তুই কী বলিস?

না, এ বাড়ি বেচা চলবে না। আমার মাতামহের স্মৃতি আপনি কার হাতে তুলে দিতে চান?

তুই মাঝে মাঝে এসে দেখবি তো!

আপনার অবর্তমানে এ বাড়িতে এলে আমি কেঁদে ফেলব।

কাঁদবি। কাঁদলে মানুষ পবিত্র হয়। সব অহংকার জল হয়ে ঝরে যায়। তোর কাছে চাবি রইল। আর একটা কাজ সময়মতো করিস, সিন্দুকটা খুলে একবার দেখিস, কী রহস্য আছে।

আপনি পরের বার যখন আসবেন তখন দুজনে একসঙ্গে খুলব। ওর মধ্যে অনেক কিছু আছে। দাদু যেভাবে আগলে আগলে রাখতেন!

আমি আবার কবে আসব তার কি কোনও ঠিক আছে রে?

শ্রাদ্ধশান্তি আপনার কিন্তু এখানেই করা উচিত ছিল।

না রে, আমার মন চাইল না। এখানকার প্রতিবেশীদের আমি সহ্য করতে পারি না, কিছু মনে করিসনি। শ্রাদ্ধ মানেই ভূতভোজন হয়ে যাবে। আমার অন্য প্ল্যান আছে, সাধুসেবা করব। অসাধারণ মৃত্যুর অসাধারণ পারলৌকিক কর্ম। তুই শুনলে আশ্চর্য হবি, তারামায়ের ছবির তলায় দেয়ালে পেনসিল দিয়ে বাবা মৃত্যুর দিন-ক্ষণ-সময় সব লিখে রেখেছিলেন। ঠিক তাই হয়েছে। কী ব্যাপার বল তো? আমার তো সব গুলিয়ে যাচ্ছে রে! সাধনায় মানুষ কী না শক্তি লাভ করে! আমি যদি ওই শক্তির ছিটেফোঁটাও পেতুম! আমি এক কুলাঙ্গার। সংসার, সংসারই আমাকে মেরেছে।

সময় হয়ে আসছে, তাড়াতাড়ি সেরে নিন।

হ্যাঁ, তুই তা হলে এক কাজ করিস, একটা ট্যাক্সি ধরে কাকিমাকে নিয়ে চলে আয়।

বাবার সঙ্গে একবার দেখা করবেন না?

তাও তো বটে! না দেখা করে যাই কী করে? ঠিক আছে তুই যা, আমি আসছি।

মুকু একা চুপ করে বসে আছে। কাকিমা রাস্তার দিকের জানলার একপাশে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছেন। পথ? পথকেই এবার জীবনের সাথী করতে হবে। সেই কথাই হয়তো ভাবছেন।

মুকু, বাবা কোথায়?

হঠাৎ উঠে ছাদে চলে গেলেন। তোমাদের বাড়ির সুর কেটে গেছে।

তা একটু গেছে। তোমাকে সব বললে বুঝতে পারবে। দাদু হঠাৎ চলে গেলেন। এই ঘরেই। সে। দৃশ্য এখনও ভাসছে চোখের সামনে। প্রফুল্লকাকার অস্বাভাবিক মৃত্যু। কাকিমাকে নিয়ে দুরাত্মাদের টানাহ্যাঁচড়া। বাবার অ্যাকসিডেন্ট। সব সুর হঠাৎ বেসুরো। তুমি বোসো, আমি ছাদে ওঁর সঙ্গে একবার দেখা করে আসি।

আকাশে একটা-দুটো তারা চোখ মেলেছে। পিতৃদেব পায়চারি করছেন। আগেকার মতো সদম্ভে নয়। ভোরের বাতাসের মতো মৃদু চরণে।

ছাদে চলে এসেছেন?

আর তো আমার কিছু করার নেই।

মুকু একা বসে আছে!

সে তো তোমার জন্যে বসে আছে। আমাকে তো তার কোনও প্রয়োজন নেই।

কথাটা আচমকা গুলির মতো বুকে এসে বাজল। ইঙ্গিতটা মোটেই ভাল নয়। মুকু কি এমন কিছু বলেছে! অপমানজনক! আর কোনও তিক্ততার মধ্যে যেতে চাই না। প্রসঙ্গ পালটাই, নীচে চলুন। কাকিমা যাবেন, মামা আসছেন। সময় হয়ে এল।

আমি আর কোনও কিছুর সঙ্গে নিজেকে জড়াতে চাই না। যেখানে শুরু করেছিলুম আবার সেখানেই শেষ করে দিলুম। কারুর কোনও অভিযোগ থাকা উচিত নয়। এবার আমরা যে যার পথে। চলব। জীবনের শেষ যাত্রাপথ নিঃসঙ্গ হওয়াই ভাল।

আমার পথ তা হলে আমিই নির্বাচন করতে পারি। সে স্বাধীনতা তা হলে দিলেন?

অবশ্যই।

তা হলে আপনাকে আমি এই সুযোগে জানিয়ে রাখি, আমি সন্ন্যাস নিয়ে আশ্রমে যোগ দিচ্ছি।

পায়চারি করতে করতে ছাদের দূর কোণে চলে গিয়েছিলেন। ফিরে আসতে আসতে থমকে দাঁড়ালেন, সন্ন্যাস?

আজ্ঞে হ্যাঁ। নিজেকে আমি সেইভাবে প্রস্তুত করে ফেলেছি।

সন্ন্যাস তোমার রক্তে নেই। জোর করে বৈরাগ্য হয় না। সন্ন্যাস আর ডাকাতি একই রকম সাহসের কাজ। একটা এ দিক আর একটা ও দিক। তোমার সে সাহস নেই। তোমাকে আমি যতটা জানি, তুমি তার সিকির সিকিও জানো না। ওই ইচ্ছেটাও তোমার এক ধরনের রোমান্টিসিজম। জীবন যাদের খুব মাপা, তারা সন্ন্যাসী হতে পারে না। বলহীনের দ্বারা কিছুই লাভ করা সম্ভব হয় না। ড্রয়িংরুমে বসে ঈশ্বর লাভ করা যায় না।

পায়চারির জন্যে তিনি আবার পেছন ফিরলেন। ধীরে ধীরে দুরে ফুলগাছের টবের দিকে চলেছেন। আমার সমস্ত শ্রদ্ধা কেমন ঘৃণায় পরিণত হচ্ছে। আমার সবকিছু জানেন? আমার মানসিক শক্তি, আমার চিন্তা ভাবনা? সব উনি জেনে বসে আছেন? অসম্ভব!

ঠিক আছে, নীচে না আসেন, না আসবেন। মানুষটি কোনওদিন কারুর কাছে নতি স্বীকার করেননি। এ-ও তো এক ধরনের অহংকার। মুকু বললে, কী হল, তোমাকে বেশ উত্তেজিত মনে হচ্ছে। কথা কাটাকাটি করে এলে?

কী করে বুঝলে?

তোমার মুখ দেখে। তুমি আমার দেওয়া আংটিটা ফেললে কোথায়? আঙুলে নেই তো।

রেখে দিয়েছি।

পরলে না কেন? তোমার সামনে আমার ভীষণ লজ্জা করছে। কেন বলো তো? তুমি আমার আবোলতাবোল পড়ে কী ভাবলে?

আমার সব ভাবনার কথা তোমাকে পরে বলব, মুকু। আজ আমার ভীষণ দুর্দিন। মনে মেঘ করেছে।

কাকিমাকে অমন জোর করে পাঠিয়ে দিচ্ছ কেন?

সে-ও আর এক কাহিনি। এখানে থাকলে বিপদ আছে।

তুমি কি ওঁদের ট্রেনে তুলতে যাবে?

হ্যাঁ।

আমিও তোমার সঙ্গে যাব। অনেক কথা আছে।

চা-টা কিছু খেয়েছ?

সে পরে হবে। তুমি রেডি হয়ে নাও।

বিদায়ের মুহূর্ত ঘনিয়ে এল। মাতুল বাড়ির চাবিটি পিতৃদেবের হাতে তুলে দিতে দিতে বললেন, মাঝেমধ্যে একটু দেখাশোনা করবেন, আবার কবে আসতে পারব জানি না।

পিতা চাবিটি নিতে নিতে বললেন, আমি হয়তো সময় পাব না, তোমার ভাগনেই মাঝে মাঝে যাবে। তবে তুমি চেষ্টা করো যাতে এখানে ফিরে আসতে পারো। জানো তো, কথায় বলে, অপ্রবাসী, অঋণী। ইচ্ছে করলে এখানেও তুমি অনেক কিছু করতে পারো।

কাকিমার বাঁ হাতে পুঁটলি। ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করলেন। পিতা বললেন, ওঠো বউঠান। মন খারাপ কোরো না। মেয়েছেলের জীবন, ঝড়ের এঁটো শালপাতার মতো, যখন যে দিকে উড়িয়ে নিয়ে যায়! সাবধানে থেকো, মানিয়ে থেকো, আনন্দে থেকো।

দাঁতে আঁচল চেপে কাকিমা কান্নার শব্দ করলেন। অনেক চেষ্টায় বললেন, সাবধানে থাকবেন। শরীরের একটু যত্ন নেবেন। হয়তো আরও কিছু বলার ছিল। ভাষা এল না। মাতুলের সুটকেসটি হাতে নিয়ে বাহাদুর অদূরে দাঁড়িয়ে। লাল একটা জামা পরেছে। একমাত্র বাহাদুরের মুখেই হাসি। পাহাড়ের ছেলে পাহাড়ে চলেছে। যে একবার ঘর ছাড়তে পেরেছে, তার আর ভয় কী? বহতা নদী, রমতা সাধু।

পিতা বললেন, আর দেরি কোরো না। মায়ার বাঁধন যত তাড়াতাড়ি খুলে বেরোনো যায়, ততই ভাল। মাতুল চমকে উঠলেন, উদাস সুরে বললেন, আসি তা হলে। মায়ের ছবির দিকে তাকিয়ে বললেন, উঠাও গাঁটরি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *