2 of 3

১.৬৭ হে অন্তরযামী ত্রাহি

হে অন্তরযামী ত্রাহি!
তুমি বিনা মোর কেহ আর নাহি ॥

আমি সব মেনে নিতে পারি, পারি না কেবল একটা জিনিস, আমার মায়ের ছেড়ে যাওয়া সংসারে। অন্যের কর্তৃত্ব। অন্যের বিশ্বাসে আমি হাত দিতে চাই না; কিন্তু আমার নিজের একটা বিশ্বাস আছে। মানুষের এই আসা আর যাওয়ার পরও, সংগীতের মতো একটা রেশ থেকে যায়। দেহ থেকে মুক্তি পাবার পর আত্মার স্বাধীনতা বেড়ে যায়। যেখানে আছি, সেখানে আছি, যেখানে নেই সেখানেও আছি। বিজ্ঞান ঘোড়ার ডিম কী বলবে! তার পরিধি কতটুকু! দুইয়ের পাশে দুই রেখে গুনবে, এক দুই-তিন-চার। এক যে চার হতে পারে, অনন্ত হতে পারে সেই সত্যটি জানা আছে কেবল সাধকদের। কবিদেরও সে অনুভূতি আছে। তা না হলে এমন লাইন আসে কোথা থেকে?

একি জ্যোতি, একি ব্যোম দীপ্তদীপ-জ্বালা
দিবা আর রজনীর চির নাট্যশালা
একি শ্যাম বসুন্ধরা, সমুদ্রে চঞ্চল
পর্বতে কঠিন, তরু পল্লবে কোমল,
অরণ্যে আঁধার। এ কি বিচিত্র বিশাল
অবিশ্রাম রচিতেছে সৃজনের জাল
আমার ইন্দ্রিয়যন্ত্রে ইন্দ্রজালবৎ।

প্রত্যেক প্রাণীর মাঝে প্রকাণ্ড জগৎ। সাধকের কথা মিথ্যে, আর টেস্টটিউব নাড়া বিজ্ঞানীর কথা সত্য! যাঁরা না চাখলে মিষ্টির মিষ্টতা স্বীকার করেন না, যারা না দেখলে অস্তিকে নাস্তি করে দেন, তাদের কথায় কল চলতে পারে, মানুষ চলতে পারে না। কেউ না জানুক আমি জানি, এ বাড়ির সর্বত্র মায়ের অস্তিত্ব বর্তমান। একটা কাসার বাটি জোর করে মাটিতে কে বসাবার পর পাশ থেকে দেখলে কী দেখা যাবে? বাটিকে ঘিরে আর একটি বাটি কাঁপছে। অস্তিত্বের এই কম্পন মানুষের বেলায় অত সহজে বিলীন হয় না। কত লক্ষ যোনি ঘুরে মানুষের জন্ম! জীবচক্রের শেষ ক্রম। তারপর কী? সৃষ্টি বিজ্ঞানীরা জানেন না। জানেন সাধক। কেউ যদি প্রশ্ন করেন, গান থেমেছে? বলব, হ্যাঁ থেমেছে, কিন্তু সুর ভেসে আছে।

কুলদানন্দ ব্রহ্মচারীজির ডায়েরি আমি লাইন বাই লাইন পড়েছি। ভাগলপুরের কাছে বস্তি বলে একটি অঞ্চলে ব্রহ্মচারীজির দাদা থাকতেন। সেখানে নির্জন একটি ঘরে সেই মহাপুরুষ রাতে যে-খাটে শুতেন, সেই খাটটি রোজ রাতে এসে কেউ প্রচণ্ড ঝাঁকিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে দিয়ে চলে যেত। বন্ধ ঘরে মাঝরাতে এই উৎপাতের কোনও সন্তোষজনক ব্যাখ্যা ছিল না। হাসপাতাল-সংলগ্ন আবাসস্থল। ব্রহ্মচারীজির অগ্রজ বললেন, আশ্চর্য হবার কিছু নেই, হতেই পারে। বহু অবাঞ্ছিত মৃত্যু এখানে প্রতিদিন হচ্ছে, বহু আত্মা ঘুরছে চারপাশে। সংলগ্ন হাসপাতালের একটি ওয়ার্ডে, একটি বেডের কথা তিনি বললেন। সেই শয্যায় যাঁকেই রাখা হত, তিনিই পরের দিন তল্পিতল্পা গুটিয়ে পালাতেন। কারণ অনুসন্ধান করে দেখা গেল, সেই খাটে যে ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছিল, মৃত্যুর পরেও তিনি তার অধিকার ছাড়তে পারেননি। মাঝরাতে এসে আগন্তুকের বুকে চেপে বসে কিল চড় ঘুসি মারতেন। খামচে দিতেন। অবশেষে তুলে ফেলে দিতেন নীচে। কোনও সাধক নিশ্চয়ই ভূতের গল্প বানাবেন না। সাধারণ মানুষের মতো তারা ভূতের ভয়ও পাবেন না। যা সত্য তা সত্য। যার বিশ্বাস আছে তার আছে। প্রেত যদি বায়বীয় একটা ব্যাপারই হবে, তা হলে তার ওজন আসে কোথা থেকে! বুকে চেপে বসলে দম বন্ধ হয়ে আসে কেন? যদি অঙ্গপ্রত্যঙ্গই না থাকবে, তা হলে কিল চড় ঘুসি মারে কী করে! সমস্ত ব্যাপারটার মধ্যেই একটা অজ্ঞাত বিজ্ঞান রয়েছে। পরমহংস বিশুদ্ধানন্দজির কাছে গেলে বুঝিয়ে দিতেন, সূর্যবিজ্ঞানে সবই সম্ভব। সূর্যের রশ্নিজালের মিলনে, গঠনে, অমিলনে, বস্তুজগতের উদ্ভব। সেই মহাত্মা শুধুমাত্র হাতে নাড়াচাড়া করে গাঁদাকে গোলাপ আবার সেই গোলাপকে জবাতে রূপান্তরিত করতে পারতেন সকলের চোখের সামনে অক্লেশে। তিনি বলতেন সূর্যবিজ্ঞানই সৃষ্টিতত্ত্বের মূল রহস্য। সেইজন্যে সূর্যের আর এক নাম সবিতা। এর পাশাপাশি আরও বিজ্ঞান আছে, যেমন চন্দ্রবিজ্ঞান, বায়ুবিজ্ঞান, নক্ষত্রবিজ্ঞান, শব্দবিজ্ঞান, ক্ষণবিজ্ঞান। এসব জ্ঞান তিনি পেয়েছিলেন তিব্বতে থাকার সময়। তিনি প্রয়োজন বোধে তার শরীরের যে-কোনও অঙ্গকে আকারে বিশাল ও বিপুল করে ফেলতে পারতেন। যেমন আদেশ করার সময় তাঁর তর্জনীকে তিনি এমন স্ফীত করতে পারতেন আদিষ্ট বিস্ময়ে হতবাক হতেন। আমাদের চোখের, কানের, মনের অনেক পরিমিতি আছে। আমরা সব শব্দ শুনতে পাই না, সব আলো দেখতে পাই না। আমাদের মগজের তিনের চার অংশ ঘুমিয়ে আছে। তাকে জাগাবার কৌশল সাধারণ মানুষের নেই। একের চারেই এত সব হচ্ছে। সাধকরা বলেন, ধ্যান করো। বিক্ষিপ্ত মনকে অন্তর্মুখী করো। সহস্রদলকে বিকশিত করো। তখন দেখবে, তুমিই বিশ্ব, বিশ্বই তুমি। যেখানে লয় নেই, ক্ষয় নেই, রূপান্তর আছে। সূর্যের সহস্রধারায় বস্তুপুঞ্জ অণুতে পরমাণুতে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন গঠিত পুনর্গঠিত হচ্ছে। একই বহু, বহুই এক। বিশুদ্ধানন্দজি বলছেন, সমস্ত বস্তুর ভেতরেই সমস্ত বস্তু অল্পবিস্তর আছে। পরমাণুর গ্রহণ আর বর্জনই বস্তুর এক এক রূপে আবির্ভাব ও বিলয়। জড় বিজ্ঞানীর কাছে বিজ্ঞানের কী-ই বা শেখার আছে! কিছু দেখা, আর সেই দেখার ওপর ভিত্তি করে কিছু সূত্র নির্মাণ। কিছু শিখতে হলে যেতে হবে যোগীর কাছে, যাঁরা বলছেন: সূর্যই হল সব বিজ্ঞানের মূল স্তম্ভ। সৃষ্টি, স্থিতি, সংহার এককথায় জাগতিক আর ব্যবহারিক সবকিছুই সূর্যাধীন। ইচ্ছাশক্তি, জ্ঞানশক্তি, ক্রিয়াশক্তির উৎস সূর্যমণ্ডল। শুধু তাই নয়, সূর্যের পথ ধরে দেবান সম্ভব। সূর্যই মুক্তির দ্বার। যোগে আর বিজ্ঞানে কোনও তফাত নেই, তফাত শুধু প্রণালীতে। যোগের পথে বিজ্ঞান, বিজ্ঞানের পথে যোগ দুই-ই সম্ভব।

আমার এইসব বিশ্বাসের কথা আমি কাউকে বলতে পারব না, বলতে চাইও না। কে শুনবে। পাগল ভেবে করুণার দৃষ্টিতে তাকাবে। আমি জানি, এ সংসার ছেড়ে মা এখনও যেতে পারেননি। তিনি অন্য তরঙ্গে, আমাদের চোখে ধরা পড়ে না এমন রূপে বর্তমান। মাতামহ তা হলে অমন তুলসী তুলসী করতেন না। তার সেই দৃষ্টি ছিল। তিনি ছিলেন গৃহী তান্ত্রিক। তার অনেক বিভূতি ছিল। অদ্ভুত অদ্ভুত সব দুর্ঘটনা থেকে পিতৃদেব কীভাবে রক্ষা পেয়ে আসছেন? এ পাড়ায় আমাদের শত্রুর তো অভাব নেই। মাঝে মাঝেই মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। কে তাদের দাঁত ভেঙে দেন! গুরুজনের সঙ্গে আমি তর্কে নামতে চাই না, আমি শুধু আমার বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চাই।

এই যে কাকিমা এখন ড্রয়ার খুলে সব কাপড়চোপড় গোছগাছ করতে লেগেছেন, কার হুকুমে! নিজের অধিকারের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। ড্রয়ারের দ্বিতীয় খোপে আমার মায়ের কিছু শাড়ি আর ব্লাউজ আছে, রেশমের মতো নরম এক ধরনের পেটিকোট আছে। কী যেন তার নাম, স্যারাঙ্গ না সারঙ্গ। সব ছেড়ে ওইসব নিয়ে টানাটানি করছেন কেন! জানেন না ওগুলো হল পবিত্র স্মৃতি! আমি ঘরে বসে আছি, একবার আমাকে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন বোধ করলেন না। পিঠের দিকে আঁচলে ঝুলছে চাবির থোলো। আমাদের সংসারের চাবি কবে কীভাবে ওঁর অধিকারে চলে গেল! তাজ্জব ব্যাপার! ভদ্রমহিলা কি আমার মায়ের স্থান অধিকার করতে চাইছেন? চেহারায় বেশ একটা লাবণ্য এসেছে। রং যেন ফেটে পড়ছে। চোখে এক ধরনের জ্যোতি এসেছে। সব ব্যাপারেই বাড়তি উৎসাহ। ধরে আনতে বললে বেঁধে আনেন।

মাঝে মাঝে আমি আড় চোখে তাকিয়ে দেখছি। খুব শুদ্ধ দৃষ্টি নয়। শুদ্ধ হলে শরীরের চিন্তা আসত না। এই মহিলার পাশাপাশি থেকে সাধনভজন অসাধ্য। আচারের ঘরে অম্বলের রুগি বাঁচতে পারে না! তিলে তিলে মৃত্যুই আমার কপালের লিখন।

ভদ্রমহিলা মাঝে মাঝে এটা সেটা প্রশ্ন করছেন, যার উত্তরে আমাদের পারিবারিক ইতিহাস বেরিয়ে আসবে। মায়ের সঙ্গে আমার পিতার সম্পর্ক কেমন ছিল! জানেন আমার কিছুই জানার কথা নয় তবু যতসব মেয়েলি প্রশ্ন। কোনওটারই উত্তর আমি দিচ্ছি না, হুঁ হাঁ করে যাচ্ছি বা চুপ করে থাকছি। এক একটা জিনিস বেরোচ্ছে, প্রশ্নের পর প্রশ্ন আসছে, উত্তর ফিরছে না।

আমি খাটে পাশ ফিরে শুয়ে আছি। পিতৃদেব দ্বিপ্রহরের আহারের পর সামান্য বিশ্রাম নিচ্ছেন। আমার শরীরও ভাল নয়, তা ছাড়া মাতুল আজ সন্ধের ট্রেনে ফিরে চলেছেন। আজ আর আমার অফিসে যাওয়া হল না। দেরাদুনে যাবার সময় এগিয়ে আসছে। আর তানানানা করে বসে থাকার কোনও মানে হয় না। কাকিমা মাতুলের সঙ্গে যেতে রাজি হলেন না। ভদ্রমহিলার প্রখর মানসম্মান বোধ। বললেন, ওখানে গেলে তো আমার মতো থাকতে হবে। এ কথা আর কাউকে অবশ্য বলেননি, বলেছেন আমাকেই, একান্তে। শুনে আমি স্তম্ভিত। সেই মুহূর্তে খুব খারাপ একটা কথা আমার জিভের ডগায় এসেছিল, কোনওরকমে আটকে ফেলেছিলুম, তা না হলে বলেই ফেলতুম, খেতে পেলে শুতে চায়!

হঠাৎ ভালবাসা কেন কুৎসিত ঘৃণার চেহারা নিল! কারণটা কী? স্বামী নির্মলানন্দ বলেছেন, নিজেকে অনুসন্ধান করো। অনুসন্ধানের ফলে যেসব বস্তু বেরিয়ে আসছে, দেখে চমকে উঠছি। কর্পোরেশনের ম্যানহোলে মনে হয় এর চেয়ে কম ময়লা জমে আছে। মনটা একেবারে পচে গেছে। অ্যামপুট না করলে বাঁচার আশা নেই। কুৎসিত এক ধরনের ঈর্ষায় ভেতরটা পুড়ছে। সর্বনাশ! আমার দেবোপম পিতৃদেবকে কি আমি রাইভ্যাল মনে করতে শুরু করেছি! আমার আত্মহত্যা করা উচিত। সাধুসঙ্গে সগ্রন্থপাঠে আমার ঘোড়ার ডিম হবে। আমি একেবারে নষ্ট হয়ে গেছি। ঘরে বসে বসে, কারুর সঙ্গে না মিশেও আমি গোল্লায় চলে গেলুম। ভেকের মতো ভোগী একটা সত্তা ভেতরে বসে কর্কশ ডাক ছাড়ছে।

আমার সমস্ত চিন্তায় ছেদ পড়ে গেল। কাকিমা খুব সুন্দর একটা সিল্কের শাড়ি নিয়ে আমার খাটের পাশে এসে দাঁড়ালেন, “দেখেছ, কী সুন্দর শাড়ি তখন তৈরি হত! একেবারে নরম তুলতুলে। ডিজাইনটা দেখো একবার! কী তখন থেকে শুয়ে শুয়ে উ উ করছ! ওঠো না।

কাকিমা আমার চুলের মুঠি ধরে টেনে ওঠাতে চাইলেন। মেয়েদের এ এক ধরনের দানবীয় সোহাগ। ভালবাসার জোয়ারে হজম করা যায়, ঘৃণায় মনে হয় অসহ্য উৎপাত। চুল ধরে তুলতে গিয়ে হাত ফসকে শাড়িটা পাটে পাটে ভেঙে মেঝেতে ধসে পড়ল। দুটো কান আমার গরম হয়ে উঠল। ধৃষ্টতা সীমাহীন! মৃত মানুষ আর দেবতায় কোনও তফাত আছে! এই শাড়িতে আমার মায়ের স্পর্শ, ঘ্রাণ লেগে আছে। যিশুখ্রিস্টের অঙ্গাচ্ছাদনের মতো এই বস্ত্র পবিত্র, আমার কাছে হোলি বাইবেলের মতো।

উঠে বসে বললুম, এ কী করছেন আপনি? এসবে আপনাকে কে হাত দিতে বলেছে। বাড়াবাড়ির একটা সীমা আছে! এ বাড়ির আপনি কে? হু আর ইউ!

রাগের ঝেকে এক নিশ্বাসে কথাটা বলে ফেললুম। অনেকক্ষণ ধরে একটু একটু করে জমছিল। থাইসিসের রুগির ফুসফুসক্ষরিত রক্তের মতো। অপমানে ভদ্রমহিলার টুকটুকে ফরসা মুখ লাল হয়ে গেল। মেয়েদের কী অদ্ভুত মন! সঙ্গে সঙ্গে চোখের কোলে জল এসে গেল। একটি করুণ ছবি ধীরে ধীরে ভোরের শিশির-ভেজা ফুলের মতো চোখের সামনে ফুটে উঠল। নিচু হয়ে অতি যত্নে শাড়িটি তুলে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আর ঠিক সেই মুহূর্তে একটি সাদা স্ট্যাচুর মতো পিতৃদেব ঘরে এলেন।

আমি বলেছি, পলাশ।

চমকে উঠলুম। আমার পিতা জীবনে এই বোধহয় প্রথম ভাল নাম ধরে সম্বোধন করলেন। মুখের চেহারা শীতল। চোখদুটি ইস্পাতের ফলার মতো তীক্ষ্ণ। আশ্চর্য! পিতা কি এই মহিলাকে আগলাবার জন্যে ছুটে এসেছেন? এটা কি এক ধরনের আশকারা নয়, যার উৎস মানুষের মনের দুর্বলতা? পিতা আরও ঠান্ডা আরও কঠিন গলায় বললেন, আমি বলেছি। তুমি না জেনে এইরকম রূঢ় কথা বলতে পারলে? তোমার স্বভাব দেখছি বেশ পালটেছে! পাখি তুমি, বেশ উড়তে শিখেছ, আর এ বাসার প্রয়োজন কী, তাই না?

মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, আপনিও বেশ পালটেছেন।

ভয়ে চোখ বুজিয়ে ফেললুম, এ আমি কী বলেছি! পিতৃদেব বললেন, আমি? আমি সেই একই আছি, দ্যাট সেম ওল্ড হরিশঙ্কর। তবে হ্যাঁ, একটা ব্যাপারে আমি পালটেছি, কাল আমার যে বয়েস ছিল, আজ তা একদিন বেড়েছে। আগামীকাল বেড়ে যাবে আরও এক দিন। তোমার দেখার ভুল। আমি জানি তোমার কী হয়েছে! তোমার দৃষ্টিবিভ্রম হয়েছে!

আপনি আমার পালটানোর কী দেখলেন?

শুনবে তা হলে?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

প্রথম পরিবর্তন, তোমার মধ্যে সবসময় একটা রাগের খেলা চলেছে। কোনও কথাই আগের মতো আর সহজ সরল করে বলতে পারছ না। ছিলে ফুটন্ত ফুলের মতো, হয়ে গেছ কুঁড়ি। অকারণে, আজকাল তুমি আমাকে এড়িয়ে চলতে চাও।

কারণ আছে।

জানি জানি, কারণ ছাড়া কার্য হয় না।

আপনি কারণটা সঠিক জানেন না।

হতে পারে। অনুমান সবসময় সঠিক পথে চলে না। তবে একটা কথা তোমাকে বলি, স্নেহ আর ভালবাসা দুটো মানুষকে এক সুরে বেঁধে দেয়, একই তরঙ্গে তারা কেঁপে কেঁপে ওঠে। তুমি আমাকে ঘৃণা করো, বলল ঠিক কি না! সত্য বলবে। বি ফ্র্যাঙ্ক।

স্বামী নির্মলানন্দ আমাকে ফ্র্যাঙ্ক হতেই বলেছেন। কিছু চেপে রাখবে না। জলের তোড়ে ঠেলে বের করে দেবে। বললুম, ঠিক ঘৃণা নয়, তবে সমালোচনা করতে ইচ্ছে করে। আপনার সবকিছু আর আগের মতো সমর্থন করতে পারি না, মেনে নিই।

সমালোচনার মতো কিছু দেখলে অবশ্যই সমালোচনা করবে। তুমি যেমন আমার পুত্র তেমনই আমার বন্ধু। বলো তুমি, কোথায় আমি তোমার সমর্থন হারিয়েছি?

যেমন ধরুন, যেসব জিনিস আমার মা ব্যবহার করতেন, সেসব জিনিস আমার কাছে ভীষণ পবিত্র। সে জিনিস আমরা ছাড়া অন্য কেন স্পর্শ করবে?

তোমার মা কি আমার স্ত্রী ছিলেন না?

ছিলেন।

দু’জনেরই সমান অধিকার।

আমার কিছু বেশি, পবিত্রতার দিক থেকে। স্ত্রীর চেয়ে মা অনেক বেশি পবিত্র।

স্ত্রী পবিত্র নয়?

মায়ের সঙ্গে সন্তানের রক্তের সম্পর্ক।

ও, তার মানে তুমি দুটো সম্পর্কে একটা ভেদ টানতে চাইছ? একটা রক্তের, সেই হেতু পবিত্র, আর একটা দেহের, সেই হেতু অপবিত্র। দেহ কখন রক্তে এসে যায় জানো কি? তুমি তো বিজ্ঞানের ছাত্র, ফিউশন কাকে বলে জানো? জানো কি এমন বন্ধন আছে যা অবিচ্ছেদ্য, মৃত্যু ছাড়া যে বন্ধন খোলে না। জানো তুমি?

জীবিত অথবা মৃত স্ত্রীকে মানুষ ফেলে দিতে পারে, অস্বীকার করতে পারে, অবহেলা করতে পারে। মাকে তা করা যায় না, যারা করে তারা পাপী।

তার মানে? তুমি বলতে চাইছ আমি তোমার মাকে জীবিত অবস্থায় অবহেলা করেছি, আর মৃত্যুর পর ভুলে গেছি! হায় রে বিচারক! কী তার প্রমাণ।

যে-জিনিস আপনি আমাকেও স্পর্শ করতে দিতেন না, সেই জিনিস আপনি এই মহিলাকে টেনে টেনে বের করার অনুমতি দিয়েছেন, শুধু তাই নয়, অসন্তোষ প্রকাশ করায় তেড়ে এসেছেন আমাকে। অথচ এই মহিলা একদিন আপনার বিছানায় বসেছিলেন বলে, আপনি আমাকে তিরস্কার করেছিলেন।

বিছানায় বসলে এখনও করব। পুরুষের শয্যা পবিত্রস্থান, সাধনপীঠ।

আর মায়ের স্মৃতি বাজারের প্রদর্শনী! মা আর আপনাতে জীবিত নেই। এবার সত্যই তার মৃত্যু হয়েছে।

তোমার ইঙ্গিত বোঝার মতো বুদ্ধি আমার আছে, পলাশ। তবে একটা কথা, তুমি বড় তাড়াতাড়ি। সিদ্ধান্তে এসে গেছ। মানুষ সম্পর্কে তোমার কোনও ধারণা নেই।

মনে আছে, সেই জবার ব্যাপারে আপনি আমাকে কী বলেছিলেন?

তুমি কি তার রিটার্ন দিতে চাইছ?

আমি কেন, জনসাধারণ কী বলছে খবর রাখেন?

জনসাধারণ? তারা কে? আমি কি একটা পাবলিক ফিগার, যে তাদের ভয় করে চলতে হবে! আমি হরিশঙ্কর, একটা ইনডিভিজুয়্যাল ম্যান, যে শুধু তার বিবেকের নির্দেশে চলে, বিবেকের কাছে সমর্থন খোঁজে। তুমি আমাকে দেখছ না? ও, না, আমারই ভুল। তুমি তো চোখে দেখো না, তুমি দেখো কানে, লাইক স্নেকস।

আপনি সংসারের চাবি এই ভদ্রমহিলার হাতে তুলে দিয়েছেন কেন? জানেন এই চাবি আমার মায়ের আঁচলে বাঁধা থাকত!

এতে তোমার মহাভারত এমন কী অশুদ্ধ হল? তোমার শিক্ষা কি পরকে আপন করতে শেখায়নি? কনফিডেন্স শব্দটা কি তোমার কাছে অপরিচিত! তোমার বউ আসুক এ চাবি তো তারই। এটা তো স্টপ গ্যাপ।

বউ কোনওদিনই আসবে না। আমি বিয়ে করব না।

তুমি আমাকে ছোট করে বিদ্রোহ জানাতে চাও?

আপনি ছোট হবেন না, জেনে রাখুন সেই মেয়েটি চরিত্রহীন।

তার মানে? এও কি তোমার এক নতুন আবিষ্কার?

নিজের চোখে দেখা।

আশ্চর্য! চরিত্রহীনতা চোখে দেখা যায়। সে তো অনুসন্ধানের বস্তু, আবিষ্কার করতে হয়।

সত্যের মতো মানুষ হোঁচট খেয়েও তার ওপর পড়তে পারে। আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। হঠাৎ হুমড়ি খেয়ে আমি সেই সত্যের ওপর পড়ে গেছি। মেয়েটি আমার চেয়েও ভাল একটি ম্যাচ জোগাড় করে ফেলেছে। তার সঙ্গেই সারা কলকাতা চষে বেড়াচ্ছে। তা ছাড়া, সেদিন বাগবাজারের মোড়ে পঙ্কজবাবুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল, তিনি আমাকে এমন একটা কথা বলেছেন, যা শুনলে আপনাদের এতদিনকার বন্ধুত্ব বিচ্ছেদ হয়ে যাবে।

শুনতে পারি?

পারেন। তিনি বললেন, পলাশ, তোমার বাবা এটা কী করলেন, আমার মেয়ে ইললিগ্যাল একজন শাশুড়ি নিয়ে কীভাবে ঘর করবে! আমাদের একটা নিখুঁত বংশের ধারা আছে।

ইজ ইট? এই কথা বলেছে? অল রাইট।

পিতৃদেবের চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে। কিছু কথা থাকে যা শত চেষ্টাতেও চাপা যায় না। ঠেলে বেরিয়ে আসে, একটার পেছনে আর একটা। এই মুহূর্তে নিজেকে আমার পিতার চেয়েও মহান মনে হচ্ছে। আমি ইস্পাত, উনি খাগড়া। আমার ধারে উড়ে গেলেন।

আচ্ছা, পুরো ব্যাপারটা আমি একটু খতিয়ে দেখি। বিবেকের কাছে সারেন্ডার করব, না জনসাধারণের কাছে!

সদর থেকে হাক এল, চিঠি আছে, পার্সেল।

ধীরে ধীরে নীচে নেমে গেলুম। বারান্দায় পিতৃদেব দাঁড়িয়ে আছেন, উদাসমুখে, আকাশের দিকে তাকিয়ে। পাশ থেকে দেখলে মনে হবে খোদাই করা পাথরের মূর্তি। কাকিমা যেন দম দেওয়া পুতুল। শাড়িটা রেখে ড্রয়ার বন্ধ করলেন। ঢিস করে একটা শব্দ হল।

বেশ মোটা একটা প্যাকেট। পিতার নামে এসেছে। রেজিস্টার্ড পার্সেল। ফর দিয়ে সই করে নিলুম। মনে হচ্ছে একটা বই আছে। হঠাৎ বই এল কোথা থেকে?

বইয়ের প্যাকেট হাতে তিনি যে জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলেন সেইখানে গিয়ে বললুম, আপনার নামে একটা বই এসেছে। আকাশের দিক থেকে তার চোখ ফিরল না। এক ঝাঁক পায়রা উড়ছে চিকচিক করে। সুদূর থেকে ভেসে এল তার গলা, খুলে দেখো। বই আবার কে পাঠালে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *