নিত নাহানসে হরি মিলে তো
জলজন্তু হোয়,
ফলমূল খানে সে হরি মিলে তো।
বান্দর বাঁদরি হোয় ॥
আপনি টাকা দেবেন কেন? আমার কাছে আছে।
আজ্ঞে না। তোমার টাকা তোমার কাছেই থাক। এই নাও, স্যালাড নিতে ভুলো না। শুধু ওষুধে কিছু হয় না, সঙ্গে অনুপান চাই।
রাস্তায় নেমে আপন মনে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছি, সবই কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। কত রকমের সাধনমার্গ আছে কে জানে! কোনও মতে, কৌপিন সার। কোনও মতে, সিল্কের গেরুয়া। এই সুন্দর বিকেল, মাতামহের কথা মনে পড়ছে। এমনি বিকেলে আমাদের দুজনের কত জায়গায় যাবার ছিল। কোনওদিন নৌকাবিহার, কোনওদিন সাধুসন্দর্শন। মাঝেমধ্যে উলটোপালটা কথা বলে ফেলতেন আর লেগে যেত লোকের সঙ্গে ধুমধাড়াক্কা। একদিন তো মাঝগঙ্গায় নৌকোর ওপরেই হাতাহাতি বেধে যাবার উপক্রম। একদল হালুইকর এপার থেকে ওপারে যাচ্ছিল। খুব ক্যালোর ব্যাপোর করছে নিজেদের মধ্যে। মাতামহ গলুইয়ের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে কেবল বলছেন, ধ্যার ব্যাটা, ধ্যার ব্যাটা। সেই হল সূত্রপাত। মাতামহ এক স্মৃতি ফেলে রেখে গেছেন, মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে, তিনি কি নদী ছিলেন! জীবনের দু’পাশে অজস্র উপলখণ্ড ছড়িয়ে ছড়িয়ে চলে গেছেন। আজ স্বামীজির কাছে এসে মনটা যেমন হালকা হয়ে গেল, সেইরকম ঘুলিয়েও গেল। মনের তলদেশে অনেক মাটি জমে ছিল। কে জানত! নিজেও জানতুম না। আধ্যাত্মিক মানুষেরা সবই কেমন সহজে টের পেয়ে যান।
বিখ্যাত সেই রেস্তোরাঁয় বিকেলের ভিড় লেগেছে। কাটলেট উড়ছে, ফ্রাই উড়ছে, দোপেঁয়াজা বিজকুড়ি কাটছে ডিমের ফুলকো আবরণের তলায়। ক্যাশবাক্স নিয়ে মালিক যে জায়গায় গাট হয়ে বসে আছেন, সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে ফ্রাইয়ের অর্ডার দিতে গিয়ে চমকে উঠলাম। রাস্তার দিকে পেছন করে এ কে বসে? ঘাড়ের কাছে আলগা খোঁপা দুলছে। নীল ফুলফুল শাড়ি। সরু সরু দুআঙুলে ধরা ঝকঝকে কাটা ঠোঁটের কাছে, কাটলেটের টুকরো নিয়ে কামড়ের অপেক্ষায় হেলছে। দুলছে। দুল ঝিলিক মারছে চাপা আনন্দে। উলটো দিকে যে ছেলেটি বসে আছে, সেই বা কে? বেশ লালটু মার্কা নায়ক নায়ক চেহারা। একে তো কোনওদিন অপর্ণাদের বাড়িতে দেখিনি। ও, কলেজের পর আজকাল এইসব হচ্ছে বুঝি! ভেবেছে কারও চোখে পড়বে না কোনওদিন। পাপ কি চেপে রাখা যায়! বাবা অফিসে, বাড়ি বেশ খানিকটা দূরে। সব শাসনের আড়ালে বসে প্রেম হচ্ছে। পাশের খালি চেয়ারে গিয়ে বসব নাকি! যেন চিনিই না! না, চমকে দেবার মতো সাহস আমার নেই। আমি এত চঞ্চলই বা হচ্ছি কেন? রমণী-মায়ার রমণীয় ঊর্ণনাভ থেকে প্রায় তো বেরিয়ে এসেছি। অ্যাকোয়ারিয়ামের রঙিন মাছের মতো অবস্থা। পায়ুপ্রদেশ থেকে বিষ্ঠার সরু সুতো পুরোটাই বেরিয়ে এসেছে। এখন সাঁতার কাটতে কাটতে একসময় বিমোচিত হয়ে পড়ে যাবে।
খুব ফিসফিস করে মালিককে বললুম, দুটো ফিশফ্রাই, ভাল করে স্যালাড দিয়ে প্যাক করে দিন।
প্রকাশ্য স্থানে বাতাসের স্বরে কথা বললে মানুষ কীরকম অবাক হয়ে যায়, ভাবে লোকটা পাগল। দশ টাকার নোটটা তার চোখের সামনে নাচাতে না থাকলে মালিক হয়তো দূর করে আমাকে তাড়িয়ে দিতেন। ব্যালেন্স ফেরত নিতে নিতে ফিসফিস করেই বললুম, আমি বাইরে দাঁড়াচ্ছি।
ভদ্রলোক বললেন, যে বয়সের যা। বেশি বয়েসে ডিপথিরিয়া বড় সাংঘাতিক জিনিস!
কিছু না বুঝেই বললুম, আজ্ঞে হ্যাঁ।
সাউন্ডবক্স একেবারে নষ্ট করে দেয়। যাক বেঁচে গেছেন, এই ঢের।
আমার সঙ্গে কথা শেষ করেই গলা সপ্তগ্রামে তুলে রেস্তোরাঁর সুরে পাঠশালের সর্দার পোডোর মতো বললেন, দুটো ফিশফ্রাই, স্যালাড, মুড়ে দাও, বাইরে যাবে।
দোকানের বাইরে চাতালের একপাশে চোরের মতো দাঁড়িয়ে আছি। অপরাহ্রে শ্যামবাজার টগবগ করছে। মনে মনে বলছি, হে ঈশ্বর! অপর্ণা যেন আমাকে দেখতে না পায়। ভাবতে চেষ্টা করছি, আমি অপর্ণার পিতা। মেয়েটা সুপাত্রে পড়ুক। মনে মনে সম্পর্ক পালটালে ঈর্ষাটা হয়তো কমে যাবে। যতই বড়াই করি না কেন, নৈবেদ্য ছাগলে খেতে থাকলে পাথরের দেবতাও নড়েচড়ে উঠবেন। আমি তো মানুষ। ভেতরটা খইয়ের মতো চটরপটর ফুটছে। পাশ থেকে অপর্ণাকে দেখছি। গোল হাতের কবজিতে কালো ব্যান্ডে বাঁধা সোনার ঘড়ি। প্রতিটি নখে লাল আপেলের মতো নেলপালিশ। খুশিতে যেন ডগমগ করছে। মাঝে মাঝে হাসছে। মুক্তোর মতো দাঁতের সারি অলংকারের বাক্স থেকে কঙ্কনের মতো স্বপ্রকাশ, অপ্রকাশ হচ্ছে। টেবিলে টেবিলে পিটপিটে কাটলেটের ওপর মরিচগুঁড়ো পড়ছে না তো, পড়ছে আমার মনে। ভেতরে যেন কোস্তাকুস্তি চলেছে। আসক্তি আর নিরাসক্তি মনের মল্লভূমিতে যেন দুই পালোয়ান, পটাপট তাল ঠুকছে। ওদিকে মোগলাই পরোটার মণ্ডে চটাপট চাপড় পড়ছে।
অপর্ণা চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েছে। ছোট্ট হাঁ করে, মুখে মৌরির দানা ছুড়ছে। মেয়েটাকে সত্যিই ভারী সুন্দর দেখতে। ঈশ্বর কি এর চেয়েও সুন্দর! এখুনি দু’জনে বেরিয়ে আসবে। আর একটু আত্মগোপনের প্রয়োজন। দেখে ফেললে ওর লজ্জাটাই আমার লজ্জা হয়ে দাঁড়াবে। চট করে ফুটপাথে নেমে পড়ে ভিড়ে মিশে গেলুম। কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে আবার যখন ফিরে এলুম, দোকান তখন বিপন্মুক্ত।
হাতে গরম প্যাকেট। মৃদু সুবাস নাকে এসে লাগছে। মনে ঘুরছে সেই গানের কলিটি, ঘরে ঘরে আলো/দেখে লাগে ভালো/ মোর হৃদি গেহ/ অন্ধকারে কালো। মাতামহ-শূন্য পৃথিবীর এই পথের পাশে কোথাও যদি পরপারে যাবার একটা সাঁকো থাকত! এখুনি চলে যেতুম। রুপোর গাছে সোনার পাতা, মণিমুক্তোর ফল ধরেছে, চাদির পেখম মেলে ময়ুর নাচছে। তিনি লাল লাল পান্তুয়া খেতে বড় ভালবাসতেন। বড় ভালবাসতেন আমাকে। ভালবাসতেন সাধুসন্তের সঙ্গ। সেখানে গিয়ে যদি দেখি, সকলের সঙ্গে আসর সাজিয়ে কনকও বসে আছে! চাঁদের আলোর রঙের শাড়ি পরে। পাশে হাসিহাসি মুখে বসে আছেন আমার মা। তা কি আর হয়? এ জীবন থেকে যাঁরা হারিয়ে গেলেন, তারা হারিয়েই গেলেন।
কাহার সৃজন এই নগণ্য জীবন?
এ কি শুধু প্রহেলিকা?
ওই আলেয়ার শিখা
জ্বলিতে জ্বলিতে গেল নিবিয়া
যেমন!
বাঁধিতে বাঁধিতে সুর সপ্তস্বরা শত-চুর!
মেলিতে মেলিতে আঁখি মিলাল স্বপন।
আমায় তিনি এই বস্তুটি লুকিয়ে চুরিয়ে আনতে বলেননি, তবু আমি সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময়, উত্তপ্ত বস্তু দুটিকে জামার আড়ালে লুকোবার চেষ্টা করলুম। কী অদ্ভুত আমার সংস্কার! স্বামীজি ছাদে পায়চারি করছিলেন। আঁধার আঁধার আকাশের তলায় গেরুয়ার শোভা কী খুলেছে! সন্ন্যাসীর আশ্রম কত পবিত্র হতে পারে, সংসার যে কত বদ্ধ পঞ্চকুণ্ড এই আমি প্রথম বুঝলুম। অর্থনীতির দাসত্ব নেই, ইন্দ্রিয়ের নিয়ত আবদারে চঞ্চল হতে হয় না, নারীর মুখ দর্শন না করলেও চলে। মনকে শুধু উর্ধ্বে তুলে রাখো। এখানে সদা বসন্ত।
স্বামীজি আমাকে দেখে দু’চরণ গান গেয়ে উঠলেন: তোমার চরণ পেয়ে হরি! আজকে আমি হেসে মরি/কী ছাই নিয়ে ছিলাম আমি, হায় রে কী ধন চাহি নাই।
বড় সুন্দর সাধা গলা। এই গানটি আমার মাতামহ প্রায়ই গাইতেন। গানটি আমার জানা। আমার এই মুহূর্তের আবেগের সঙ্গে ভীষণ খাপ খেয়ে যাচ্ছে। প্রথম চরণটি গাইবার লোভ সামলাতে পারছি না। গেয়েই ফেললুম, আমায় রাখতে যদি আপন ঘরে, বিশ্ব-ঘরে পেতাম না ঠাই/ দু’জন যদি হত আপন, হত না মোর আপন সবাই।
স্বামীজি সোৎসাহে বললেন, এই তো, এই তো, বেরিয়ে এসো। সহজ হও, সুন্দর হও, নির্মল হও। বৈরাগ্য, বৈরাগ্য। নিত্য আমি অনিত্যরে আঁকড়ে ছিলাম রুদ্ধ দ্বারে/ কেড়ে নিলে দয়া করে তাই হে চির! তোমারে চাই।
অনুচ্চ কণ্ঠে, সন্ধ্যার আবেশে, আমাদের দুজনের কণ্ঠ বাতাসে ভেসে ভেসে মহালোকের দিকে পবিত্র পাখির মতো উড়ে গেল। এমন বৈরাগ্যের ভাব আগে কখনও অনুভব করিনি। স্বামীজি আমার পাশে এসে মাথায় হাত রাখলেন। সে স্পর্শের কী অনুভূতি! কোথায় লাগে প্রেয়সীর হাত, পিতার হাত, মাতার হাত। স্নেহ আমরা কাকে বলি! এ স্পর্শে স্নেহের স্নেহ, প্রেমের প্রেম, ভালবাসার ভালবাসা। আবেগে চোখে জল এসে গেল।
স্বামীজি বললেন, কী হবে সংসারে থেকে! এমন একটা মন যখন পেয়েছ, আধারটিকে শুদ্ধ করে আত্মোপলব্ধির দিকে এগিয়ে চলল। তুমি অর্থ দিয়ে অর্থের সঙ্গে লড়তে পারবে না, তুমি ক্ষমতা দিয়ে ক্ষমতার সঙ্গে পারবে না, তুমি হিংসা দিয়ে হিংসার সঙ্গে পেরে উঠবে না। জাগতিক সবকিছুরই বড়র ওপর বড় আছে। প্রভুর ওপর মহাপ্রভু। একমাত্র বৈরাগ্যই অপ্রতিদ্বন্দ্বী। যার ওপরে আর কেউ নেই। বিহায় কামান যঃ সর্বান পুমাংশরতি নিঃস্পৃহঃ/ নির্মমো নিরহঙ্কারঃ স শান্তিমধিগচ্ছতি ॥ বৎস চরৈবেতি, চরৈবেতি।
হে রাজেন্দ্র, তোমা কাছে নত হতে গেলে
যে ঊর্ধ্বে উঠিতে হয়
সেথা বাহু মেলে
লহো ডাকি, সুদুর্গম বন্ধুর
কঠিন
শৈলপথে অগ্রসর করো প্রতিদিন—
চলো, ঘরে চলো, কী এনেছ দেখি! টোম্যাটো সসের বোতলটা নিয়ে এসো।
প্লেটে ফিশফ্রাই, স্যালাড, সস, মনে বৈরাগ্য। আকাশে সন্ধ্যা। নীচে আরতির আয়োজন। সামনে সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী। শুধু সন্ন্যাসী নন, মহা পণ্ডিত। মন, তুমি আর কী চাও!