সামনে যখন যাবি ওরে থাক-না পিছন পিছে পড়ে
দেহ যে মন্দির একথা কোনওদিন অনুভব করেছ?
স্বামী নির্মলানন্দ প্রশ্ন করে চেয়ারের পেছনে হাসিহাসি মুখে পিঠ রাখলেন। সামনের টেবিলে ছড়ানো কাগজপত্র। খান তিনেক মোটা মোটা বই। একটি দামি কলম। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে পার্কার। স্বামীজি আজ গেরুয়া টুপি পরেছেন। সাধারণত সন্ন্যাসীরা যে ধরনের টুপি পরেন।
আজ্ঞে হ্যাঁ, কখনও ক্ষণিকের তরে ওইরকম একটা অনুভূতি হয়, তবে বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না।
কেন হয় না?
একগাদা চামচিকি ঢুকে কিচিরমিচির শুরু করে দেয়। সময় সময় দেহ বলে যে একটা বস্তু আছে সেই কথাটাই ভুল হয়ে যায়।
কে ভোলায় কখনও লক্ষ করেছ?
হ্যাঁ, করেছি। যেমন ধরুন কোনও একটা জায়গায় যেতে হবে, তখন দেহ নয়, হাঁটাটাই বড় হয়ে ওঠে। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে, তখন দেহের কথা মনে পড়ে! আক্ষেপ আসে, কেন আমি অফুরন্ত পথ অক্লেশে হেঁটে যাবার শক্তি রাখি না! কেন আমি আরও সক্ষম দেহের অধিকারী হতে পারিনি! সঙ্গে সঙ্গে চিন্তা আসে, কোনও ধনীর পরিবারে জন্মালে আমি ছেলেবেলায় আরও ভালমন্দ খেতে পেতুম! ব্যস দেহ ভুলে গেলুম, চোখের সামনে ভাসতে লাগল প্রাচুর্যের স্বপ্ন। কী করলে ধনী হওয়া যায়! হাঁটছি, হেঁটেই চলেছি, তবে আমি নয়, হাঁটছে ধনীর স্বপ্ন, হাঁটছে। পরিকল্পনা। আই এ এস পরীক্ষাটা দিতে পারলে, ডি এম ডি এম মানে দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। বিরাট একটা জেলার রাজা। ফাঁইল, ডাকবাংলো, গাড়ি, প্রচুর ক্ষমতা। পরমুহূর্তেই আক্ষেপ, কেন আমি সেই ধরনের ভাল ছেলে হতে পারলুম না, যার কাছে যে-কোনও কমপিটিটিভ পরীক্ষা জলভাত। এই করতে করতে পথ ফুরোল। যে কাজে যাঁর সঙ্গে দেখা করতে এলুম, তখন সেই কাজটাই বড় হয়ে উঠল। এইভাবে অষ্টপ্রহর হরিনাম সংকীর্তন চলেছেই চলেছে। কার দেহ, দেহেই বা কে কদাচিৎ মনে পড়ে। কখনও লোভ, কখনও অহংকার, কখনও ক্রোধ, কখনও হিংসা, এক এক ধরনের প্রবৃত্তি এক এক সময় জেগে ওঠে। এ যেন জুড়ি গাড়ি যে চড়ে সেই তখন মালিক। সাঁই সাঁই চাবুক ঘুরছে গাড়ি চলছে কদম কদম।
বাঃ বলেছ ভাল। আচ্ছা, এই মুহূর্তে তোমার কি দেহবোধ হচ্ছে?
আজ্ঞে না, এখন কথার নেশায় আছি। শুরুতে একটু লজ্জা ছিল। লজ্জার ভাব কেটে এল আত্মম্ভরিতা। বেশ কথা দিয়ে কথা গেঁথে গেঁথে এমন কিছু বলতে হবে যাতে আপনার মনে হবে, ছেলেটা খুব ইনটেলেকচুয়াল। মনে হলে কী হবে, আপনি আমার লেখাটা ছাপবেন।
তোমার লেখা তো আমি ছাপবই বলেছি। কিন্তু প্রথম দিনেই যে আমার অহংকার জাগিয়ে দিয়েছেন।
অহংকার কীভাবে জাগালুম?
ওই যে বলেছিলেন, আমি ভেবেছিলুম কোনও রিটায়ার্ড জেন্টলম্যানকে দেখব। আমার অহং যার অর্থ করেছে, আমার বুদ্ধি বয়সের তুলনায় অনেক ম্যাচিয়োর, আমার অনেক বেশি পড়াশোনা। আমি আপনার সমতুল্য কিংবা তার চেয়েও বেশি। আবার এই যে আমি সব বলছি, এর পেছনেও একটা ইচ্ছে ঠ্যালা মারছে, যে আমাকে বলছে, এমন কিছু বলল যা অনেকটা সেলফ-অ্যানালিসিসের মতো হয়। তাতে তোমার এই লাভ হবে, তুমি যাকে বলছ, তিনি তোমাকে সাধারণের চেয়ে অন্য চোখে দেখবেন।
স্বামীজি হাত তুলে আমাকে থামতে বললেন। থামার সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে কেমন যেন বোকাবোকা লাগছে। বাতুল, বাঁচাল। দুটি উজ্জ্বল চোখ নির্নিমেষে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার অন্তঃসত্তা ক্রমশই যেন নগ্ন হয়ে পড়ছে। বেলুন যেভাবে চুপসে যেতে থাকে আমি সেইভাবে চুপসে যেতে লাগলুম। ন্যালব্যালে একটা রবারের ল্যাতকানো আবরণের মতো পড়ে রইলুম মেঝেতে। ছি ছি, এ আমি কী করলুম?
স্বামীজি জিজ্ঞেস করলেন, কী ভাবছ এখন?
ভাবছি, ছি ছি, এ আমি কী করলুম!
এ ‘আমি’টা তোমার কোন ‘আমি’?
আজ্ঞে?
এ ‘আমি’ তোমার কোন ‘আমি’? চোখ বুজিয়ে বসে একটু ভাবো। সার্চ উইদিন। আমাদের ক’টা ‘আমি’?
দুটো।
রাইট, একটা তোমার দেহের সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে, অনেকটা মিউকাস মেমব্রেনের মতো। চুলকুনি কাকে বলে জানো? খোস, পাঁচড়া, দাদ, হাজা?
আজ্ঞে হ্যাঁ, জানি।
থেকে থেকে চুলকে ওঠে। অসংখ্য মাইক্রোসকোপিক জার্মস যেই নড়েচড়ে ওঠে অমনি চুলকোতে ইচ্ছে করে। মলম লাগাতে হয়। লাগাতে লাগাতে একদিন সেরে যায়। দ্রষ্টা ‘আমি’র হাতে এই ‘দেহবদ্ধ আমি’টাকে সমর্পণ করে দাও, কমপ্লিট সারেন্ডার, এলোমেলো বিশৃঙ্খল ‘আমি’র নির্দেশ মানব না। তুমি কে? আমি কি তোমার দাস?
স্বামীজি, এই ‘আমি’টা আবার কে? তৃতীয় কোনও ‘আমি’?
ভাল প্রশ্ন। আচ্ছা, তুমি আগুনের শিখা ভাল করে দেখেছ?
আজ্ঞে হ্যাঁ, রোজই দেখি। লেবরেটরির টেবিলে সারি সারি বুনসেন বার্নার জ্বলে।
তিনটে অংশ দেখতে পাও? একটা নীল অংশ, তাকে ঘিরে লাল একটা অংশ, তার বাইরে সাদাটে একটা অংশ। বাইরের অংশ, যেটাকে বলে পেরিফারি, সেই অংশটি সদা চঞ্চল, বাতাসে হেলছে দুলছে, ফড়ফড় করছে। তারপরের অংশটি স্থির, শিখার সবচেয়ে উত্তপ্ত অংশ, দাহিকা শক্তি সবচেয়ে বেশি। নীল অংশটি শিখার আত্মপুরুষ। স্থির, শীতল। তোমার আঙুল ঢোকালেও পুড়বে না। এই নীল, শীতল অংশটির ওপর দাঁড়িয়ে আছে অগ্নিশিখা। মানুষও তো শিখা। নিথর নিষ্কম্প। নীলাভ আত্মপুরুষ, পরেরটি জ্ঞানপুরুষ যার অহরহ প্রার্থনা, হিরন্ময়েন পাত্রেন সত্যাপি হিতং মুখং, তৎ ত্বং পূষণ অপাৰ্বণু সত্যধর্মায় দৃষ্টয়ে। প্রশ্ন উঠছে সেই জ্ঞানময় কোষ থেকে। সংশয়ী, প্রশ্নকারী। তার ওপর বসে আছে বালকবৎ চঞ্চল প্রাণময় আমি। সে কখনও অভিমানী, কখনও ক্রোধী, লোভী, কখনও উদার, কখনও সহিংস, কখনও অহিংস। কিন্তু তোমার কী হয়েছে। জানো?
আজ্ঞে না।
তোমার শিখাঁটি বড় কেঁপে কেঁপে জ্বলছে। ভেতরটা বড় কুঁকড়ে আছে। জ্ঞানময় আবরণীটি পূর্ণ তেজে বিকশিত হতে পারছে না। প্রশ্ন করো, কেন? লণ্ঠনের কাঁচটিকে ভাল করে পরিষ্কার করো। সাধুর কমণ্ডলুও রোজ মাজতে হয়, তবেই ঝকঝকে থাকে। ভেতরটাকে টেনে বাইরে আনো। ছোট, উদ্যান নয়, চাই তেপান্তরের মাঠ। দিগন্তকে যত পেছোতে পারবে, মন তত ভাল দৌড়োবে। সব জানলা দরজা খুলে দাও, একটু আলো বাতাস আসুক।
কী করে খুলব?
কেটে বেরিয়ে পড়ো। সংসারে তোমার কীসের আকর্ষণ? ভগবান তো পথ পরিষ্কার করেই। রেখেছেন। তোমার সবচেয়ে ভালবাসার মানুষ মাতামহ চলে গেলেন। তোমার পিতা বড় চাকরি। করেন। তিনি অথর্ব নন, যে সেবা করতে হবে। স্বভাবে স্বাবলম্বী। তুমি তার সেবা করো না, তিনিই মা-মরা ছেলেটির সেবা করেন। তুমি কেবল পাকা পাকা কথা বলো আর গুমরে গুমরে মরো। তোমার হল ব্রুডিং নেচার। এইবেলা তোমার হাল না ধরলে, তুমি নিউরোটিক হয়ে যাবে। কিছু। পেতে হলে বলিষ্ঠ হতে হবে। ঠাকুর বলতেন ডঙ্কামারা হৃদয় চাই। ঘায়ের মাছির মতো ভ্যানভ্যানে হলে, সংসার তোমাকে গিলে চেনেবাঁধা ক্রীতদাস করে ফেলে রাখবে। এইসব শোনার পর এখন তোমার কেমন লাগছে?
আজ্ঞে, খুব খারাপ। মনে হচ্ছে পাংচার্ড।
ম্যানেনজাইটিস বলে একটা অসুখ আছে, শুনেছ নিশ্চয়?
হ্যাঁ শুনেছি। রুগি সাধারণত বাঁচে না।
ট্রিটমেন্ট জানো? লাম্বার পাংচার করতে হয়। মেরুদণ্ড থেকে খানিকটা ফ্লুইড বেরিয়ে যায়, রোগী সুস্থ হয়ে ওঠে। তোমার অহং খানিকটা বেরিয়ে গেল। মানুষ বাড়ি রং করে, বছর বছর। জানলায় দরজায় রং চাপায়, নিজের ভেতরেও যে রং ধরাতে হয়, সেই সত্যটিই ভুল হয়ে যায়। পুরনো সংস্কার সব ফেলে দাও, বেদিটি মুছে পরিষ্কার করে আলপনা লাগাও, নীরবে অপেক্ষা। করো, গুহাশায়িত সেই পরমপুরুষ হঠাৎ একদিন আবির্ভূত হবেন, তোমার ক্ষীণ পাণ্ডুর আমি বলিষ্ঠ আমি হয়ে উঠবে। উত্তিষ্ঠত জাগ্রত/ প্রাপ্য বরান্ নিবোধত। ক্ষুরস্য ধারা নিশিতা দুরত্যয়া/ দুর্গং পথস্তৎ কবয়ো বদন্তি। কী মানে? ওঠো, জাগো। শ্রেষ্ঠ আচার্যের কাছে গিয়ে জ্ঞানলাভ করো। জ্ঞানীরা সেই পথকে দুরতিক্ৰমণীয় তীক্ষ্ণ ক্ষুরধারার ন্যায় দুর্গম বলেন। তা হলে, তুমি আগে মেঝে থেকে ওঠো। সেপাইয়ের লাঠির মতো হেলে থেকো না। এই নাও টাকা।
টাকা?
হ্যাঁ, কিনে নিয়ে এসো।
কী কিনে আনব?
একটু আগে আমার এখানে আসার সময়, তোমার যা খেতে ইচ্ছে করছিল।
অবাক হয়ে বললুম, সে তো ফিশফ্রাই! আপনি! আপনি কী করে জানলেন?
পড়ে, তোমাকে পড়ে। ভাবনা ভাষা হয়ে অক্ষরে ধরা থাকে। মাধ্যম, কাগজ, ছাপার কালি। যে ভাবনা ভাষা পায়নি তা লেখা হয় অন্তরে, এক ধরনের ম্যাগনেটিক কোডে। আমি যদি তুমি হই, তুমি যদি আমি হও, মানুষ মানুষের কাছে খোলা বইয়ের মতো। বলল, তোমার ফিশফ্রাই খাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছিল কি না?
আজ্ঞে হ্যাঁ, হয়েছিল। শ্যামবাজারের মোড়ের সেই বিখ্যাত দোকানের সামনে দিয়ে আসার সময় ইচ্ছেটা একবার উঁকি দিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ফ্রাই কি খাওয়া উচিত! ধর্মের পথে…।
ধর্মের সঙ্গে আহারের কোনও সম্পর্ক নেই।
অনেকে বলেন।
ধর্ম কি অতই সহজ পলাশ, যে মাছ ছেড়ে দিলেই ঈশ্বর এসে ধরা দেবেন! ডিম না খেলে তিন দিনে মোক্ষলাভ! তা হলে গোরুকেই তো গুরু বলে ধরতে হয়। সারাজীবন খড় আর ভুষি খেয়ে মাঠেঘাটে হাম্বা হাম্বা করে বেড়ায়।