2 of 3

১.৬২ I shall go to her

I shall go to her, but she shall not return to me

আমি শার্লক হোমস নই, তবু সিঁড়িতে জুতোর চলন দেখে অনুমান করতে পারছি, যিনি উঠে আসছেন তার শরীর হালকা। মেজাজ বেশ খুশিখুশি। বেতালা নন, তাল লয় ছন্দের জ্ঞান আছে। অবশ্যই শৌখিন। কারণ পায়ের জুতো পঞ্চমে বাঁধা তবলার মতো আধধায় বাজছে। কে আসছেন? এমন মানুষ একজনই আছেন, তিনি গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন ভাগ্যান্বেষণে।

দরজার আড়াল থেকে একটি মুখ উঁকি মারল। গোন্ড-ফ্রেমের রিমলেস চশমা। কপালের দু’পাশে চুলের স্তবকের বিদ্রোহ। তসরের পাঞ্জাবি নেমে গেছে হাঁটু ছেড়ে। একটা কোণ, হাতার সামান্য অংশ দৃশ্যমান। ফুলপাড় কোঁচার একটু শাসন-ছাড়া অংশ চৌকাঠ ডিঙিয়ে থমকে গেছে। পাতলা ঠোঁটের ওপর তুলি দিয়ে আঁকা সূক্ষ্ম গোঁফ। টানাটানা দুটো চোখ জ্বলজ্বল করছে। চোখে শিশুর কৌতূহল, প্রচ্ছন্ন দুষ্টুমি খেলা করছে।

আনন্দে প্রায় চিৎকার করে উঠলুম, মামা! মামা এসেছেন।

সঙ্গে সঙ্গে মামা আত্মপ্রকাশ করলেন। দু’হাত বাউলের মতো উর্ধ্বে তুলে গাইতে গাইতে ঘরে ঢুকলেন, আমি পথভোলা এক পথিক এসেছি।

ঘরের বিশ্রী মারমুখী থমথমে আবহাওয়া হঠাৎ তরল হয়ে গেল। কাকিমা আরও সাংঘাতিক কিছু বলার জন্যে হাত তুলেছিলেন, সে হাত বাতাসে স্থির। মাতামহের বুকে লাগোয়া আমার মাথায় তার স্নেহের হাত। পিতা কোমরের পেছন দিকে দু’হাত রেখে পায়চারির ভঙ্গিতে স্থাণু। কাকিমার মামাশ্বশুর দু’হাঁটুতে দু’হাত রেখে গাট হয়ে আছেন। ঠোঁটের পাইপ-লম্বা সিগারেট নিবে গেছে।

দৃশ্য দেখে মাতুলের সংগীত এক লাইনের বেশি এগোল না। তিনি বললেন, কী ব্যাপার, নাটক হচ্ছে নাকি?

পিতা উলটে প্রশ্ন করলেন, কী ব্যাপার জয়, তুমি?

মাতুল উত্তর দেবার আগেই কাকিমা আবার আগের কথার খেই ধরে শাসিয়ে উঠলেন, কী? যাবেন থানায়? যেতে চান? এখুনি চলুন। আজই তা হলে হাতে দড়ি পড়ুক।

মাতুল বললেন, কী ব্যাপার, চুরিটুরি হয়েছে নাকি? আরে এ ভদ্রলোক তো আমার চেনা। সিনেমাপাড়ায় মেয়েছেলে নিয়ে ঘোরাফেরা করেন। ভ্যাম্প গার্ল জুলির সঙ্গে আপনার তো খুব মাখামাখি! আরে মশাই চেষ্টা করলেই কি আর নায়িকা বানানো যায়! দুটি জিনিস চাই, শরীর আর এলেম। পয়সা আছে, ঢেলে যান।

মামাশ্বশুর উঠে দাঁড়ালেন। সামনে কুঁজো হয়ে পড়েছেন। কাকিমার দিকে অদ্ভুত এক দৃষ্টিতে তাকালেন। দু’ঠোঁটের মাঝে সিগারেটের পাইপ। ওপরের ঠোঁটের চাপে নাকের দিকে উঁচিয়ে উঠেছে। চাপা উত্তেজনায় দেহে একটু যেন যুবক-যুবক ভাব এসেছে। ঠোঁট থেকে পাইপ খুলে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, আচ্ছা!

ধীরে ধীরে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। সিঁড়ি বেয়ে জুতোর শব্দ নেমে গেল ধাপে ধাপে নীচে। আশ্চর্য মানুষ! কী যে করতে চান বোঝা শক্ত। অসহায় একজন মহিলার উপকার? এ যেন সম্পত্তি দখলের লড়াই চলেছে। কাকিমা তো চলেই এসেছিলেন। স্বামী বেঁচে থাকলে কী হত? স্বামীর সঙ্গেই জীবন বেঁধে পেছন পেছন ঘুরতে হত। আজ অরক্ষিতা দেখে তেড়ে এসেছেন! ব্যবহারের বস্তু করতে চান। মূর্খ! দেহ তো কিনতেও পাওয়া যায়!

মাতুল বললেন, কী ব্যাপার? বাতাসে বারুদের গন্ধ?

পিতা বললেন, তুমি বোসো। আমার চিঠি পেয়েছ?

মাতুল বসতে বসতে বললেন, কই না, চিঠি তো পাইনি! কাল আমার রেডিয়ো প্রোগ্রাম আছে, তাই আজ চলে এলুম। আপনি কি অসুস্থ! কী একটা হয়েছে। ঠিক ধরতে পারছি না।

পিতা বললেন, একটা নয়, একসঙ্গে অনেক কিছু হয়েছে!

মাতামহ শব্দ করে হাসলেন। যার অর্থ, সাধ করে ধরা দিতে এলে কেন বাপু! বেশ তো ছিলে মনের আনন্দে।

মাতুল বললেন, আপনি চাদর গায়ে দিয়েছেন? চাদর তো আপনাকে কখনও গায়ে দিতে দেখিনি!

কাকিমা এইসব কথার ফাঁকে ভেতরে চলে গেলেন। অনেক কাজ। বাড়িতে অতিথি এসেছেন। যে সে অতিথি নন, ভোজনবিলাসী শিল্পী। মনের মতো রান্না না হলে, পাতে বসে ঠুকরে চলে যাবেন।

পিতৃদেব ঘটনার বিবরণ দিতে শুরু করলেন। মাতামহের অসুস্থতা। প্রফুল্লকাকার মৃত্যু। নিজের দুর্ঘটনা। মামাশ্বশুরের আক্রমণ। শুনতে শুনতে মাতুল কেমন যেন হয়ে যাচ্ছেন। এসেছিলেন লঘু প্রজাপতির মতো। ভেবেছিলেন পুষ্পেদ্যানে এসেছেন, যেমন আসতেন। বসন্ত যে বিদায় নিয়েছে। বৈশাখের জ্বলন্ত আগুনে সব শুকিয়ে গেছে। শীর্ণ শাখায় উত্তপ্ত দীর্ঘশ্বাস। প্রবীণ মানুষ দু’জনের। অদ্ভুত প্রাণশক্তি। যতবার ভেঙেছে ততবার গড়েছেন নতুনভাবে। এখনও সেই একই আশা। আবার। হবে। আবার একদল আসবে শূন্যতা ভরে দিতে! আমার মন বলছে, এই শেষ। এ নাটকের যবনিকা। পতনের সময় আসন্ন।

আমি যা ভাবছি, মাতুলও বোধহয় তাই ভাবছিলেন। সব শুনে উদাস মুখে বললেন, আবার সব ভাঙছে মনে হচ্ছে। ফাটল ধরেছে। বেশ কেমন সব গুছিয়ে উঠছিল!

পিতা বললেন, তুমি দুর্বল মানুষ, তাই তোমার চোখে ফাটল দেখছ, ভাঙন দেখছ। আমার কাছে এসব কিছু নয়। আমি থামতে জানি না, আমি ফিরতে জানি না। সহজে আমার মন ভেঙে পড়ে না। The tree the tempest with a crash of wood/throws down in front of us is not to bar/our passage to our journey’s end for good./But just to ask us who we think we are. Slec ভাঙবে, আবার গড়ব।

মাতামহ বললেন, আমি তোমার দলে। তুমি রাজমিস্ত্রি, আমি তোমার জোগাড়ে। ইট বালি সিমেন্ট এগিয়ে দেব, মশলা মেখে দেব।

মাতুল বললেন, বাবাকে কাল আমি আমার ওখানে নিয়ে যাই। ভাল জল বাতাস, শরীরটা সারবে।

নট এ ব্যাড প্রোপোজাল। এটা তো বেদের টোল। তবু ওখানে একটু যত্নআত্তি পাবেন।

মাতামহ সাধকের মতো আসন করে বসেছিলেন। বুদ্ধদেবের মতো ডান হাতের তালুটি বুকের কাছে ধরে, ডাইনে বামে নাড়াতে নাড়াতে বললেন, আই ওন্ট গো। আই ওন্ট গো। আমার এক পাশে হরি আর শঙ্কর, আর এক পাশে হর হর গঙ্গে, হরিপাদপদ্ম বিহারিণী গঙ্গে, হিমবিধু মুক্তাধবল তরঙ্গে। আই ওন্ট গো। আমার যত্নআত্তির প্রয়োজন নেই। এঘর থেকে বের করে দাও, আমি রকে গিয়ে বসব। রক থেকে নামিয়ে দাও, সামনের রাস্তায় গিয়ে বসে থাকব।

মাতুল মুখ ভার করে বললেন, আমার ওপর আপনি এখনও রেগে আছেন!

ধ্যার বোকা, রাগ হল যৌবনের অলংকার। তিনকাল গিয়ে যার এককালে ঠেকেছে, তার আবার রাগ কী! অভিমান হয়তো ছিল, তাও ভেসে গেছে। এখন আমি উদাসী রাজনারায়ণ।

পিতা বললেন, আমি আপনাকে একদিন বলেছি কারুর মনে দুঃখ দেবেন না। দুঃখ টেনিস বলের মতো বাউন্স করে ফিরে আসে।

তুমি আমার গুরু হরিশঙ্কর। তোমার কথা ভুলতে পারি? আমি দুঃখ দেবার জন্যে বলিনি। ছোট্ট একটা ব্যাপার আছে।

কী ব্যাপার?

সে আমি বলতে পারব না। আমার একটু লজ্জা লজ্জা করছে।

পিতা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, লজ্জা! কীসের লজ্জা!

মাতামহ হঠাৎ হাউহাউ করে কেঁদে ফেললেন। কান্নার প্রথম আবেগ কোনওক্রমে সামলে নিলেন। বুকটা বিশাল হয়ে উঠল। জোরে নিশ্বাস নিয়ে, বাতাস দিয়ে আবেগের উৎসস্থল চেপে ধরলেন। ছোট ছোট বাক্যে বলতে লাগলেন, আমার মেয়ে তুলসী। তোমার স্ত্রী। আমি তাকে বড় অবহেলা করে এসেছি। সে একটা যুগ ছিল, সংসারে মেয়ের চেয়ে ছেলের আদর হত বেশি। মাছের মুড়ো ছেলের পাতে, দুধের সর ছেলের ভাগে, ভাল জুতো, ভাল জামা। মা-মরা মেয়ে, ডুরে শাড়ি পরে ধুলো পায়ে একা একা ঘুরছে। আমি এখনও সে দৃশ্য দেখতে পাই হরিশঙ্কর। কাকিমাদের মুখঝামটা খাচ্ছে থেকে থেকে। আর আমি? আমি এক শয়তান। আমাকে তখন ধর্মে পেয়েছে। ভণ্ডের ধর্ম। ধর্মের নামে মাংস চলছে, মাছ চলছে, অল্পস্বল্প কারণবারি চলছে। ছেলেকে চপচপে গাওয়া ঘিয়ের মোহনভোগ খাইয়ে কাঁধে করে ওস্তাদের কাছে নিয়ে চলেছি ওস্তাদ বানাতে। তুলসী আমার একা। একদিন হঠাৎ বায়না শুরু করলে, কলকাতায় বিলিতি সার্কাস দেখাতে নিয়ে যেতে হবে। কোনওদিন বায়না করে না, সেদিন যে কী হল! মাথায় যেন ভূত চাপল। বুঝলে হরিশঙ্কর, মারলুম ঠেসে এক চড়। ঘুরে পড়ে গেল চৌকাঠের ওপর। সামনের একটা দাঁতের কোণ ভেঙে গেল। ওই যে ছবি দেখছ হরিশঙ্কর, ওই যে দেয়ালে ঝুলছে, ওই ছবির তুলসী যদি এখন ফিক করে হাসে, তুমি দেখতে পাবে, একটা দাঁত একটু কোনা-ভাঙা। এই বুড়ো সে জন্যে দায়ী। যার কোনও বিচার হল না। যার কোনও বিচার হবে না। তোমার ভাষায় যে হল, অলমাইটি ফাদার। তুলসীকে আমি কিছুই দিতে পারিনি হরিশঙ্কর, অবহেলা ছাড়া। যখন ভাবলুম, এবার দিতে হবে, তখন সে চলে গেল অভিমানে, পাছে কিছু নিতে হয় বলে। তুমি জানো বিয়ের পর ওকে আমি একটা সাপ-বালা দিয়েছিলুম। জোড়া সাপ। সাপের চারটে চোখে চারটে লাল রুবি বসানো ছিল। খুব বড় কারিগরের তৈরি।

পিতা বললেন, জানি।

তুমি জানো, একদিন সে ওটা ফেরত দিয়ে এল।

জানি। আমিই বলেছিলুম দিয়ে আসতে।

তুমি? কেন বলেছিলে হরিশঙ্কর?

আপনাকে দুঃখ দেবার জন্যে। আমি তখন খুব নীচ ছিলুম। অহংকারে ফেটে পড়তুম। ক্রুড ছিলুম, ভালগার ছিলুম। আপনাকে বলেইছি, দুঃখ টেনিস বলের মতো। কারুর দিকে ছুঁড়ে দিলেই ফিরে আসে। আমি প্রায়শ্চিত্ত করছি। কোনও মানুষই পারফেক্ট নয়। যত জ্বলবেন যত পুড়বেন তত বিশুদ্ধ হবেন। আমি আপনাকে সান্ত্বনা দিতে চাই না। দুঃখে আপনার ভেতরটা গুমরে গুমরে উঠুক। প্রতি স্পন্দনে একটি করে দেবদূত মুক্তি পাক। মনে পড়ে বায়রন তার কন্যার দুঃখজনক অকাল মৃত্যুতে সমাধি ফলকে কী লিখেছিলেন?

মাতুল বললেন, I shall go to her, but she shall not return to me.

পিতা বললেন, তার মানে, আমি তার কাছে যেতে পারি, সে কিন্তু আমার কাছে আর ফিরে আসবে না।

মাতামহ বললেন, আমি যে তার কাছে যাব বলেই বেরিয়ে এসেছি। আমি তো জানি সে আর আসবে না। যাহা যায় তাহা যায়। আমার যৌবন আর ফিরবে না। কিশোরী তুলসী আর ফিরে আসবে না। পেছন দিক থেকে গলা জড়িয়ে ধরবে না। জীবনে যত ভুল করে এসেছি সেসব আর শোধরানো যাবে না। যা হয়ে গেছে তা হয়ে গেছে।

যাক না। আমার একটা ধারণা আছে শুনবেন। আমাদের প্রত্যেকেরই একটা করে অশরীরী ভৌতিক সত্তা আছে। ছাঁচের মতো। আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। আমার একটা আমি আছে। আপনার একটা আপনি আছেন। কোথাও আছে। কোথায় আছে তা জানি না। প্রতিটি অনুশোচনার তরঙ্গে সেই ছাঁচের হৃদয় পালটাচ্ছে, মন পালটাচ্ছে, আকার আকৃতি পালটাচ্ছে। আবার যখন আমরা ঢালাই হব তখন আমরা আরও সুন্দর হব। নিখুঁত হব। ভয় কী? আপনি প্রাণ খুলে কেঁদে যান। অনুশোচনায় চড়চড় করে পুড়তে থাকুন। আমারও দিন আসছে। সকলেরই দিন আসবে। অতীত হাত ফসকে চলে গেছে যাক। ভবিষ্যৎ তো আছে।

মাতুল বললেন, দিদির তো তেমন দুঃখ করার কথা নয়। আমি তো সবসময় পাশেপাশেই থাকতুম। তারপর বিয়ের পর জামাইবাবু!

পিতা বললেন, জামাইবাবুর কথা আর বোলো না। তখন আমার তিন ভাগ অমানুষ ছিল আর এক ভাগ মানুষ। দোর্দণ্ডপ্রতাপে সংসার করতে গিয়ে ঘাড়মুখ গুঁজড়ে পড়ে গেলুম। তোমার দিদিকে আমি একেবারে চেপে রেখেছিলুম। আমার তখন কী অহংকার! আমি পুরুষ! জুজুর মতো ভয় দেখিয়ে মজা পেতুম। আমার সেই রেপ্লিকা, যেটা কোথাও-না-কোথাও আছে, সেটা দিন দিন আমার সংকীর্ণতায় শুকিয়ে চামচিকির মতো হয়ে গেল। সামলে দেবার মতো কেউ তো ছিল না পাশে। আমাকে ধাক্কা মারার সাহস কারুর ছিল না। ভীরু আর কাপুরুষ নিয়ে সংসার করেছে। অত্যাচারী হরিশঙ্কর। আর তুলসী ছিল ঠিক তুলসীরই মতো। বুক ফাটত, তবু মুখ ফুটত না। রাবিশ। আমি একটা রাবিশ।

মাতামহ বললেন, তুমিও জ্বলছ হরিশঙ্কর?

সর্বক্ষণ আমি জ্বলছি। আই অ্যাম এ বার্নিং মাস! অন্ধকার নক্ষত্রের মতো ধকধক করে জ্বলছি। জীবনের পর জীবন জ্বলতে জ্বলতে একদিন হয়তো পৃথিবীর মতো হরিতাভ একটি গ্রহ হব, তখন সেই মাটিতে জীবন জীবনের মতো খেলবে, প্রেমে ভালবাসায় স্নেহে আনন্দে। নিজেদের চিতা নিজেরাই সাজিয়ে যাই ততদিন। তাই তো আমি প্রফুল্লর স্ত্রীর প্রতি কঠোর হতে পারছি না আর আগের মতো। বলতে পারছি না নিজের পথ নিজে দেখে নাও। সে যে একেবারে অসহায় আশ্রিতা।

মাতুল বললেন, আপনার প্রতিপালনের মতো সংগতি আছে, একটা জীবন যদি আশ্রয় চায় আশ্রয় দেওয়া উচিত।

জয়, মানুষের তুমি কতটুকু জানো? এই সামান্য ব্যাপার কত অসামান্য হয়ে ওঠে একবার দেখো। আমিও প্রস্তুত। এতকাল অকারণে লড়েছি, এইবার একটা কারণে লড়ব। ছোবল খেতে খেতে নীলকণ্ঠ হয়ে যাব।

মাতামহ বললেন, তোমার পাশে আমি না থাকলে তুমি লড়বে কী করে! যত লড়াই তো আমরা দু’জনে করে এসেছি। এই যেমন একটু একপক্কড় হয়ে গেল। ব্যাটাকে আমি মেরেই দিতুম। নেহাত তোমার অবাধ্য হতে পারি না তাই!

মাতুল বললেন, লড়াইয়ের জন্যে সুস্থ শরীর চাই। ওখানে এক নম্বর হাসপাতাল, এক নম্বর ডাক্তার, ভাল জল, ভাল হাওয়া। দিনকয়েক থেকেই চলে আসবেন।

মাতামহ মুখ কাচুমাচু করে বললেন, যদি রাগ না করে একটা কথা বলব?

পিতা বললেন, নিশ্চয় বলবেন।

আমার ভাল লাগে না। ওদের স্বভাবটা একটু ম্লেচ্ছ ধরনের। মুরগি, মুরগির ডিম, পেঁয়াজ, রসুন, এঁটোকাটার বিচার নেই। সন্ধ্যা-আহ্নিক নেই। ধূপধুনো নেই। আমার ভাল লাগে না হরিশঙ্কর। ওস্তাদের বাড়ির হালচাল ওস্তাদের মতো।

মাতুল বললেন, আপনি যেভাবে থাকতে চান, সেইভাবেই থাকার ব্যবস্থা করে দোব। মাছমাংস, ডিম বাড়িতে ঢুকবে না। আলাদা ঠাকুরঘরের ব্যবস্থাও আছে।

কিন্তু! মাতামহ মুখ নিচু করে রইলেন। যখন মুখ তুললেন, চোখদুটো ছলছল করছে। আবেগে। বুক আবার প্রশস্ত হয়েছে। কোনওরকমে সেঁক গিলে বললেন, কিন্তু এখানে যে তুলসী আছে। তোমরা কেউ দেখতে পাও না হরিশঙ্কর, আমি দেখতে পাই, তুলসী এখনও এখানে আছে। আমার নাতিটার মুখের দিকে তাকাও। সেই চোখ, সেই নাক, মুখ, হাসির ধরন, ভাবভঙ্গি, সব তুলসীর মতো। তার আত্মাও এখানে আছে। আমি যখনই আচ্ছন্নের মতো পড়ে থাকি, সে এসে আমার কপালে হাত রেখে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে, বাবা, বড় কষ্ট? এই তো আমি তোমার মাথার কাছে রয়েছি।

মাতুল বললেন, ও আপনার মনের ভুল। দিদির খুব পুণ্য ছিল। দিদি কখনও ভূত হয়ে ঘুরতে পারে না।

পিতা বললেন, জয়, ব্যাপারটা ভূতপ্রেতের ব্যাপার নয়। এসব বোঝার ক্ষমতা তোমার হবে না। এ বুঝতে হলে তোমাকে আর এক প্লেনে চলে যেতে হবে। আমি জানি, উনি যে কথা বলছেন তা সেন্টপারসেন্ট সত্য। এখানে যা শূন্য ওখানে তা পূর্ণ। তোমার চোখে যা নেই, আমার চোখে তা। আছে, তোমার ভাবে নেই আমার ভাবে আছে। তুমি তো শিল্পী! তোমার তো এসব বোঝা উচিত। সুরের পথে তুমি তো বিভিন্ন লোকে চলে যেতে পারো! পারো না?

হ্যাঁ, তা পারি।

পিতা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, জগতে কেউ দেখতে না পায়/লুকানো তাঁর বাতি/আঁচল দিয়ে আড়াল করে জ্বালান সারা রাতি/ঘুমের মধ্যে স্বপন কতই/আনাগোনা করে/অন্ধকারে হাসেন তিনি/আমাদের এই ঘরে।

মাতামহ ছেলেমানুষের মতো বললেন, আমি তোমার সঙ্গে যাব না। যেতেই যদি হয় আমি হরিদ্বারে যাব।

কাকিমা দরজার আড়াল থেকে বললেন, কী, তুমি বাজার করবে না? বেলা যে বেড়ে গেল।

মাতুল বললেন, চল, আমার সঙ্গে গাড়ি আছে, দুজনে একসঙ্গে যাই। চল আজ বড়বাজারে যাই। কতদিন পরে এ বাড়িতে আমি পাত পাড়ব! বেশ গুছিয়ে বাজার করি দুজনে মিলে।

পিতা বললেন, অনেক দেরি হয়ে গেছে, জয়। কখন রান্না হবে?

আপনি সময়ের কথা বলছেন? আপনি না বলেছিলেন, আমি সময়ের দাস নই। সময় আমার দাস। চালাও পানসি বেলঘরিয়া।

কয়েক মাস আগে হলে পিতৃদেব এর উত্তরে কী বলতেন জানা নেই, আজ শুধু মৃদু হাসলেন। এ যেন বোমাবর্ষণের দিনে, নহবতে সানাই বসিয়ে বিবাহের আয়োজন। মাতুল আমার এক এমন চরিত্র যার উৎসাহ দমিয়ে দিতে সকলেরই খারাপ লাগে। প্রজাপতি ফুলের আনন্দে ডানা মেলে উড়বে। সেইটাই স্বাভাবিক। অ্যালবামে পেস্ট করে রাখবেন তারা যারা হৃদয়হীন।

ঝকঝকে নতুন গাড়ি। সামনে লেখা অস্টিন অফ ইংল্যান্ড। উর্দি-পরা ড্রাইভার ফেদার ডাস্টার দিয়ে আদুরে গাড়ির ধুলো ঝাড়ছিলেন। মাতুল বললেন, গাড়িটা কীরকম ম্যানেজ করেছি বল?

কিনলেন?

ধ্যার, আমি তো এখন ফকির। জানিস তো, রাজার উলটো পিঠ ফকির, ফকিরের উলটো পিঠ রাজা। ওখানে আমার খুব খাতির, বুঝলি। একেবারে ডনজুয়ান। চাটুজ্যেমশাইকে যেন বলিসনি! ডন জুয়ান কথাটা তেমন ভাল নয়।

ড্রাইভারকে বললেন, নিউমার্কেটে যাব। কলকাতার কিছু চেনো?

আজ্ঞে হ্যাঁ। আমি তো কলকাতারই ছেলে।

আমাকে বললেন, কতক্ষণ লাগবে বল তো?

আধঘণ্টা।

বুঝলি, বেশ জমে গেছে। কিছু একটা জানলে কিছু-না-কিছু করা যায়, একেবারে বেকার বসে থাকতে হয় না। তোকে আমি কিছুতেই আর্টের লাইনে আনতে পারলুম না। কী যে এক চাকরি ধরেছিস!

আপনাকেও তো শেষপর্যন্ত সেই চাকরিতেই যেতে হল।

এটাকে তুই ঠিক চাকরি বলতে পারিস না। অধ্যাপনা। না, এও চাকরিই রে। হল না, জীবনে যেসব স্বপ্ন ছিল, কিছুই তো বাস্তবে পরিণত করা গেল না। চতুর্দিকে ব্যর্থতা। তোদের বাড়িতেও। তো এলোমেলো হাওয়া হইছে! প্রফুল্লদার স্ত্রীকে নিয়ে ব্যাপারটা বেশ ঘোলাটে হয়েছে!

বেশ ঘোলাটে। চারপাশে যা-তা কথা চালু হয়ে গেছে।

তোরা কিছু বললি না, আমিও সাহস করে তখন জিজ্ঞেস করলুম না। প্রফুল্লদা কি সুইসাইড করেছেন?

আজ্ঞে না! সন্দেহজনক মৃত্যু। ভদ্রলোক খুন হয়েছেন।

বাবা! সেকী রে? ভদ্রলোক খুন হয়?

তাই তো হলেন।

চাটুজ্যেমশাইয়ের সারাটা জীবনে একের পর এক কেবল উটকো ঝামেলা। এক যায় তো আর এক আসে। তুই তখন ছোট, বাড়িতে কাজ করতে এল সুধীর। খুব ভাল, খুব ভাল। সুধীরের প্রশংসায় একেবারে পঞ্চমুখ। হঠাৎ একদিন পুলিশ এসে ধরে নিয়ে গেল। কী ব্যাপার! সুধীর এক ফেরারি ডাকাত। পোঁটলার ভেতর থেকে রিভলভার বেরোল, আরও সব চোরাই মাল। সে এক। হইহই ব্যাপার। কিছুদিন পরে এক বিধবা ভদ্রমহিলা এলেন রাঁধুনি হয়। বছর না ঘুরতেই তিনি। অন্তঃসত্ত্বা হলেন। সে এক কেলেঙ্কারি কাণ্ড। বাবা এসে চেপে ধরলেন। জেরায় জেরায় অপরাধীর সন্ধান বেরোল। ওই তোদের পাড়ার মিষ্টির দোকানের বছর কুড়ি বয়সের এক ছেলে। মার মার কাট কাট ব্যাপার। শেষে দু’জনেই পাড়া-ছাড়া হল। কিছু বলার নেই। সবই হল গ্রহের কারসাজি। দেখ এ যাত্রা আবার কী হয়! আমিও চলে গেলুম বহুদূরে। তুই ওই ভদ্রমহিলাকে বুঝিয়ে বল না, কেন এই সৎ ভালমানুষটিকে বিপদে ফেলছেন? পয়সাঅলা… ও লোকটা কে হয় রে? ওই যে মর্কটমুনি?

মামাশ্বশুর। তার মানে প্রফুল্লদার মামা! তুই বল আপনি ওইখানে গিয়ে সুখে থাকুন। উনি যাবেন না। লোকটা ডিবচ।

সে আমি জানি। খুব ঘোড়েল লোক। তা হলে, আমিই বরং আমার ওখানে নিয়ে যাই। তোর মামির ছেলেপুলে হবে। আর একজন মহিলা থাকলে সুবিধে হবে।

চেষ্টা করে দেখতে পারেন।

তোরা বল, তা না হলে ভদ্রমহিলা অন্যরকম ভাববেন। মানসম্ভ্রমে লাগবে।

দেখি আজ রাতে বাবাকে বলব।

কথায় কথায় গাড়ি নিউমার্কেটে এসে গেল। সায়েবি ব্যাপারস্যাপার। মাতুল আনন্দে ছটফট করছেন। কখনও বলছেন বোনলেস ভেটকি কিনবেন। কখনও বলছেন, ম্যাওয়া কিনবেন। কখনও বলছেন, একঝাক মুনিয়া পাখি কিনবেন। একবার এদিকে ছুটছেন, একবার ওদিকে ছুটছেন। পেছন পেছন গোটা তিনেক মুটে ছুটছে সাহাব সাহাব করে। মাতুলের হাত চেপে ধরে বললুম, আগে ঠিক করুন কী কিনবেন? মনে মনে একটা ফর্দ তৈরি করুন।

তা হলে মাছ দিয়ে শুরু হোক, বোনলেস ভেটকি।

মাছের স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে মাতুল ওজন বললেন। কাটাছেঁড়া চলছে। হঠাৎ আমাকে প্রশ্ন। করলেন, হ্যাঁরে প্রফুল্লদার স্ত্রী, মানে বউদি তো বিধবা হয়েছেন?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

তা হলে মাছ মাংস ডিম তো চলবে না! তা হলে থাক। আমরা খাব আর উনি দেখবেন তা তো হয় না। চল তা হলে ভেজিটেবলের দিকেই যাওয়া যাক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *