১.৬১-৬৫ তছি ফিসফিস করে বলল

১.৬১

তছি ফিসফিস করে বলল, তুমি আমার চুলডি কাইট্টা দেও মা।

কথাটা বুঝতে পারল না তছির মা। দুইদিন ধরে খুবই আনমনা সে, খুবই চিন্তিত। প্রথমে তছির মুখে, তারপর আবদুলের মুখে ঘটনা শোনার পর থেকে তছির চিন্তায় না খেতে পারে, না ঘুমাতে পারে। একপাশে বারেক আর একপাশে তছিকে নিয়ে শুয়ে থাকে ঠিকই ঘুম আসে না।

বারেক ছেলেমানুষ, সারাদিন টো টো করে ঘোরে, শোয়ার লগে লগেই ঘুমে কাদা হয়ে যায়। আগে তছিও ছিল বারেকের মতোই। শোয়ার পরই ঘুমিয়ে যেত। যে রাতে মাকে ডেকে তুলে ঘটনাটা বলল সে রাত থেকে ঘুমায় না। মোটা কাঁথায় শরীর ঢেকে এমনভাবে শুয়ে থাকে যেন গভীর ঘুমে ডুবে আছে। দুনিয়াদারির খবর নাই। কানের কাছে টিকারা (গয়না নৌকায় ব্যবহারের ঢোল বিশেষ) বাজালেও যেন এই ঘুম ভাঙবে না।

কিন্তু মা জানে, তছি আসলে ঘুমায় না। তছি আসলে সংসার থেকে, মানুষের কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখছে। একটু শব্দ সে করতে চাইছে না, কোনও ভাবেই জানাতে চাইছে না সে আছে এই সংসারে, সে আছে এই ঘরে! সারাদিন মোটা কাঁথার তলায় নিজেকে আসলে লুকিয়ে রাখছে তছি। যেন কাথা থেকে বের হলেই লোকে জেনে যাবে রিকশাআলা রুস্তমকে খুন করেছে সে। দারোগা পুলিশ এসে ধরবে তাকে, হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাবে। তারপর খুনের দায়ে ফাঁসি হবে তছির।

মাকে ঘটনা বলার পরদিন, সারাদিন কিছু মুখে দেয়নি তছি। আবদুলের কথায় রাতেরবেলা তছির ভাতপানি এনে তার মাথার কাছে রেখেছে মা। রেখে অনেকক্ষণ ডাকাডাকি করেছে মেয়েকে। ওট মা। উইট্টা ভাতপানি খা। কপালে যা আছে তাই অইবো। কপালের লেখন কেঐ খাইতে পারে না। ওট।  

তছি সাড়া দেয়নি, নড়েনি। ভাতপানি ঢেকে শুয়ে পড়েছে মা। কিন্তু ঘুমায়নি। গভীর রাতে শোনে অন্ধকার ঘরে যতটা সম্ভব শব্দ বাঁচিয়ে কাঁথার তলা থেকে বেরুচ্ছে তছি। বেরিয়ে, গিরস্তবাড়ির পালা (পোষা) বিড়ালকে ঠিকঠাক মতো খেতে না দিলে, রাতের অন্ধকারে ক্ষুধার্ত বিড়াল যেমন নিঃশব্দে এসে ঢেকে রান্নাঘরে, যেমন নিঃশব্দে যা পায় তাই খায়, তেমন করে ভাত খাচ্ছে তছি। মাটির বাসনে ভাত সালুন মাখায় এমন সাবধানে, যেন চারির আগা (নখের ডগা) বাসনে লেগে শব্দ না হয়। ভাতের লোকমা মুখে দিয়ে এমন সাবধানে চাবায়, যেন চাবায় না, যেন নিঃশব্দে গিলে ফেলছে ভাত। পানি খাওয়ার সময় গলায় এক ধরনের কোৎ কোৎ শব্দ হয় তছির। সেই শব্দটাও অতি সাবধানে লুকাতে চাইছে সে।

প্রথমে তছিকে মা বলতে চেয়েছে, আন্দারে খাইতে বইলি ক্যা? মাছের কাডাকোড়া গলায় বিনবো! কুপি আঙ্গা।

তারপরই ভেবেছে, বললে ভয় পেয়ে যাবে তছি, দিশাহারা হয়ে যাবে। হয়তো খাওয়া শেষ করবে না, হয়তো পেটের খিদা পেটে নিয়েই, হাত মুখ না ধুয়েই ঢুকে যাবে কাঁথার তলায়। সারারাত কুঁকড়ে থাকবে ক্ষুধার কষ্টে। পাগল মেয়ে কিছুতেই বুঝতে চাইবে না মাকে কোনও ভয় নাই। বুক দিয়ে মা তাকে আগলে রাখবে। আঁচলের তলায় লুকিয়ে আড়াল করবে দুনিয়া থেকে।

 তারপর গভীর কষ্টের এককান্না বুক ঠেলে উঠেছে তছির মায়ের। পাগল মেয়েটাকে নিয়ে এমনিতেই ছিল তার বিরাট দুঃখ। বয়স হয়েছে মেয়ের, এই বয়সী মেয়েদের কত আগেই বিয়াশাদি হয়ে যায়। স্বামী সন্তান নিয়ে সুখ দুঃখের সংসার করে তারা। তছির জীবন কখনও তেমন হবে না। কে বিয়া করবে পাগল মেয়েটিকে! জেনেশুনে কে সংসার করবে এই মেয়ের লগে! তছি পাগল একথা চেপে রেখে চালাকি করে যে তার বিয়া দিবে, দুইদিন পর জামাইবাড়ির লোক যখন বুঝে যাবে বউটা তাদের পাগলনি, আর কিছু না ভেবেই বাপের বাড়িতে ফিরত পাঠাবে মেয়েটাকে। লাভের লাভ কিছুই হবে না, টাকা পয়সা যাবে। জামাইকে ঘড়ি আংটি দিতে হবে, কাপড় চোপড় দিতে হবে। নগদ টাকাও দিতে হতে পারে। মেয়ে ফিরত পাঠাবার সময় ওইসব তো আর ফিরত পাঠাবে না তারা! আর একটা ডরও আছে। ভরন্ত শরীরের যুবতী মেয়ে, দুইদিনের স্বামী সহবাসেই যদি পেট হয় তাহলে হবে আর এক যন্ত্রণা। সারাজীবন বাপছাড়া সন্তানকে টানতে হবে পাগল মেয়েটার। সুতরাং তছির বিয়াশাদির কথা ভাবাই যায় না। জীবন কাটবে তার এইভাবেই। মা যতদিন বেঁচে আছে আগলে রাখবে মেয়েকে। যেমন করে পারে ঘর সংসারের মধ্যে আটকে রাখবে। মা মরবে তো পাখির মতন স্বাধীন হয়ে যাবে তছি। যখন যেদিকে ইচ্ছা উড়াল দিবে। কেউ ফিরেও তাকাবে না তছির দিকে। ভাইরা, ভাইর বউ পোলাপানরা যে থাকবে যাকে নিয়ে। কে তাকাবে তছির দিকে! আর মা না থাকলে তছিও গনায় ধরবে না কাউকে। ইচ্ছা হলে বাড়ি ফিরবে, ইচ্ছা হলে ফিরবে না। দিনে দিনে গ্রামের হাটবাজার রাস্তাঘাটে ঘুরে বেডানো, গাছতলায় বসা থাকা পাগলনি হয়ে যাবে। গায়ে কাপড় থাকবে না। দুষ্ট ছেলেরা চাকা মারবে।

তছির মায়ের এইসব দুঃখ চাপা পড়ে গেছে খুনের ঘটনায়। এখন যেন আর দুঃখ বলে কিছু নাই তার, এখন বুকে সারাক্ষণের এক উদ্বেগ। খালি মনে হয় এই বুঝি দেশ গ্রামের লোকে জেনে গেল, এই বুঝি দারোগা পুলিশে জেনে গেল রুস্তম রিকশাআলাকে খুন করেছে তছি। কেন করেছে সেই কথা কেউ শুনতে চাইবে না, বুঝতে চাইবে না। খুন করেছে জানাজানি হওয়ার পরই ধরবে মেয়েটাকে। ধরা পড়ার পর কিছুদিন জেলে থাকবে মেয়ে। তারপর ফাঁসি হবে। এই যে সারাদিন তছির পিছনে লেগে আছে মা, তছিকে আগলে আগলে রাখছে, তখন আর এইসবের দরকার হবে না। রাতেরবেলা। মায়ের একপাশে তছি, আরেক পাশে বারেক, বারেক ঠিকই থাকবে, তছির পাশটা থাকবে খালি।

কিন্তু মেয়েটা যদি না থাকে তাহলে সারাদিন কার পিছনে লেগে থাকবে মা! কাকে আগলাবে! রাতেরবেলা ঘুম ভেঙে যখন দেখবে তছির পাশটা খালি, বিছানা বালি, অন্ধকার ঘরে সেই শূন্যতা কেমন করে সহ্য করবে সে! বুকটা হু হু করবে না তার!

দুইদিন ধরে এই ভাবনায়, এই উদ্বেগে বেঁচেও যেন মরে আছে তছির মা। কাঁথার তলায় নিঃসাড় হয়ে থাকে তছি আর মা বসে থাকে তার মাথার কাছে। কেউ কোনও কথা বললে সহজে বুঝতে পারে না। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে মানুষটার মুখের দিকে।

তছির মুখের দিকেও তেমন করেই তাকিয়ে ছিল।

তছির হাতে জংধরা পুরানা একখান কেচি (কাটি)। ঘরের মেঝেতে, যেখানে সে বসে আছে তার পাশে চলটা ওঠা, ভাঙাচোরা একখান টিনের বাটি। বাটিতে একটু পানি। বাটির পাশে ছোট্ট এক টুকরা বাংলা সাবান আর কাগজে প্যাচানো একখান ব্লেডের অর্ধেক। জিনিসগুলি দেখেও কেন কিছুই বুঝতে পারল না তছির মা। যেমন তাকিয়ে ছিল তেমন তাকিয়ে রইল মেয়ের দিকে।

মাত্র দুই তিনদিনে মেয়েটা যেন একেবারেই বদলে গেছে, একেবারেই অন্যরকম হয়ে গেছে। চোখ ঢুকেছে গদে (গর্তে)। চোখের কোলে এমন করে কালি পড়েছে, যেন কোনও শিও মায়ের কাজলদানি থেকে চুরি করে কাজল দিতে গিয়ে জায়গা মতো লাগাতে পারেনি কাজল, চোখের সামনে পেটে দিয়েছে। পাগল হলেও অচেনা কেউ তছির মুখ দেখে তাকে পাগল ভাবতে পারবে না। ঢলঢলে, ভরাট সুন্দর মুখ তছির। এই বয়সি গিরস্তঘরের স্বাভাবিক মেয়েদের যেমন হয় তেমন। মাত্র দুইতিন দিনে সেই মুখ ভেঙে গেছে।

পাগলরা পানি ভয় পায়, পানি পছন্দ করে না। তছি করে। শীতকাল নাই খরালিকাল নাই গোসলটা সে নিয়মিত করে। শীতকালে গোসল করে হাত পায়ে না হলেও মুখে এক খাবলা সউষ্যার তেল সে মাখেই। ফলে মুখটা খুব কালচে দেখায়, তবে তেলতেল করে। শুকিয়ে আমসি হয় না মুখ, খড়ি ওঠে না। ঠোঁট দুইখান তাজা থাকে।

সেদিনের পর থেকে গোসল করে না তছি, ঠোঁটে মুখে তেল ছোঁয়ায় না। ফলে মুখখানা খড়িওঠা, সাদাটে ঠোঁট প্রচণ্ড খরায় শুকিয়ে যাওয়া মাঠের মতো। পাকা আমড়ার আঁশের মতো দাগ পড়েছে ঠোঁটে।

তছির মাথার চুল কাউয়া চিলের বাসার মতন। চুল ভর্তি উকুন। দুই চারদিন পর পর উকুনের জ্বালায় পাগল হয়ে তছি নিজেই চপচপ করে তেল দেয় মাথায়। তেল দিয়ে চুল ভিজিয়ে, একপাশে সরু দাঁত অন্যপাশে একটু মোটা এমন একখান কালো বেঁটে কাঁকুই দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে চুল আঁচড়ায়। কাঁকুইয়ের দাঁতে আটকে পড়া উকুন পিছার শলা দিয়ে খুঁচিয়ে বের করে মারে।

সেদিনের পর থেকে কাজটা তছি আর করেনি। সারাক্ষণই শুয়ে আছে বলে চুল হয়েছে কাউয়ার বাসা। এই যে তছি এখন বসে আছে, হঠাৎ করে তার মাথার দিকে তাকালে মনে হয় এটা কোনও যুবতী মেয়ের মাথা না। এ এক গ্রাম্য অনাথ বালিকার মাথা। চুলা জ্বালবার আশায় মাথায় করে শুকনা কচুরির বোঝা বয়ে নিচ্ছে সে। মাথার চারপাশ দিয়ে ঝুলে পড়েছে কচুরির বিষণ্ণ কালো ছোবা।

তছি আবার ফিসফিস করে বলল, কী অইলো! ও মা।

এবার তব্দ (স্তব্ধ) ভাব ভাঙল মায়ের, চোখে পলক পড়ল। একটু নড়ল সে, একটু ব্যস্ত হল। কী কচ?

তছি অস্থির গলায় বলল, কী কইছি হোনো নাই তুমি! আমার চুলডি কাইট্টা দেও। নাইড়া (ন্যাড়া) কইরা দেও আমারে।

একথায় মা একেবারে দিশাহারা হয়ে গেল। হায় হায় কচ কী? নাইড়া অবি ক্যা?

মায়ের গলা একটু চড়ে গিয়েছিল, শুনে ভয় পেল তছি। দুয়ারের দিকে তাকিয়ে হিসহিস করে বলল, আস্তে আস্তে কথা কও। কেঐ হুনবো!

গলা নামাল মা। হুনলে কী অইবো! আমগো বাইত্তে তো অন্যমানুষ নাই!

 না থাউক, আইতে কতুক্ষুণ!

তারপর ভাউয়া (কোলা) ব্যাঙের মতো একখান লাফ দিল তছি, লাফ দিয়ে দুয়ারের সামনে গেল। দ্রুত হাতে ঝাপ লাগাল। তোমারে না কইছি ঘরের ঝাপ সব সমায় লাগায় রাখবা। খোলা রাখছো ক্যা?

আমি ইট্টু বাইরে গেছিলাম।

বাইরে কম কম যাইবা তুমি। হারাদিন এইঘরে বইয়া থাকবা। আমি কেথা মুড়াদা হুইয়া থাকুম তুমি থাকবা আমার শিথানে বইয়া। ঘরের ঝাঁপ বন্দ রাখবা য্যান বাইরে থিকা দেইক্কা কেঐ উদিস না পায় এই ঘরে মানুষ আছে। বাইরে গেলেও ঝাঁপ বন্দ কইরা রাইক্কা যাইবা। বাড়ির বেবাকতেরে কইয়া দিবা দারগা পুলিশে যুদি আমারে বিচড়াইতে আহে কইয়া দিব তছি বাইত্তে নাই। পাগলনি তো, কই জানি গেছে গা! কেরে কিছু কইয়া যায় নাই।

তছির কথা শুনে বুক তোলপাড় করে উঠল মায়ের। পাগল মেয়ে, ঝাঁপ বন্ধ করে কাঁথার তলায় লুকিয়ে থাকলে কী দারোগা পুলিশে তাকে খুঁজে পাবে না! তারা কী এত সোজা জিনিস, বাড়ির মানুষের কাছে শুনবে তছি বাড়িতে নাই আর সেইকথা বিশ্বাস করে ফিরে যাবে! মাথথি মেরে তছির ঘরের ঝাঁপ খুলবে না তারা। কাঁথা তুলে দেখবে না কে শুয়ে আছে।

 একথা তছিকে বলা যাবে না। বললে এতই ভয় পাবে সে, বাড়ি ছেড়ে কোথায় কোথায় চলে যাবে। হয়তো আর কোনওদিন ফিরেই আসবে না। যুবতী মেয়ে কোথায় কার হাতে গিয়ে পড়বে, কে খাবলা (খুবলে) দিয়ে খাবে মেয়েটাকে। এক রুস্তমকে মেরে নিজেকে রক্ষা করেছে সে। দেশে তো রুস্তমের আকাল নাই। কতজনকে মারবে তছি! তারচেয়ে যেভাবে ঘরে লুকিয়ে আছে সেভাবেই থাকুক। আর যাই হোক মায়ের চোখের সামনে তো রইল! দারোগা পুলিশের হাতে ধরা পড়া যদি কপালে থাকে, ধরা সে পড়বেই। ফাঁসি যদি কপালে থাকে, ফাঁসি তার হবেই। কপালের লেখা কে খণ্ডাতে পারে!

আনমনা গলায় মা বলল, দারগা পুলিশের কথা কেঐরে আমি কমু না।

কথাটা যেন বুঝতে পারল না তছি। বলল, ক্যা?

কেঐ তো জানে না বেডারে তুই মাইরা হালাইছস!

তুমি তো জানো! আমি তোমারে বেবাক ঘটনা কইছি না! বড়দাদায়ও তো হুইন্নাইছে!

মা বুঝল এই কথাটা তছি একেবারেই অস্বাভাবিক ভাবে বলছে। কথা বেশিরভাগ সময় সে স্বাভাবিক ভাবেই বলে। স্বাভাবিকভাবে বলতে বলতে নিজের অজান্তেই এক সময় অস্বাভাবিক হয়ে যায়, তছি তা বুঝতে পারে না। ওটাই তার পাগলামি। এখন সেই পাগলামিটা তছি করতে শুরু করেছে। তবে এইসব সময় তছির কথার বিরোধিতা করা মুশকিল। সে যা বলবে তাই মেনে নিতে হবে, সেই মতো কথা বলতে হবে। নয়তো কথার পাগলামি বাদ দিয়ে অন্যরকম পাগলামি শুরু করবে তছি। মা ভাই বুঝবে না, ছেলে বুড়া বুঝবে না, মারামারি লাগিয়ে দেবে।

এখন অবশ্য সেই ভয় নাই। তছি আছে বিরাট ভয়ে। এখন কথার পিঠে বুঝিয়ে কথা বলতে পারলে স্বাভাবিক মানুষের মতন সেই কথার ভালমন্দ বোঝার চেষ্টা করবে।

মা বলল, আবদুল হোনছে খালের মইদ্যে একবেডার লাচ পাওয়া গেছে। বেডারে যে তুই মারছস হেইডা হোনছেনি?

তছি বিজ্ঞের মতো বলল, না, কার কাছে হোনবো! আমি তো বড়দাদারে কই নাই।

কোনওদিন কইচও না। খালি আবদুলরেঐ না, দুইন্নাইর কেঐরেঐ কইচ না। কইলে এককান দুইকান কইরা বেবাকতে জাইন্না যাইবো। পুলিশ দারগায়ও জানবো। জানলে আর রক্ষা নাই।

তছি ভয়ার্ত গলায় বলল, তাইলে আমি যে তোমারে কইয়া হালাইছি।

আমারে কইছস কী অইছে! আমি কী কেঐরে কমুনি?

একহাতে কেচি অন্যহাতে থাবা দিয়ে মায়ের একটা হাত ধরল তছি। কাতর অনুনয়ের গলায় বলল, কইয়ো না মা, কের তুমি কইয়ো না। কইলে কইলাম দারগা পুলিশে আইয়া ধরবো আমারে। জেল অইবো আমার, ফাঁসি অইবো।

তছির কথা শুনে বুকটা হু হু করে উঠল মায়ের। চোখ ছলছল করে উঠল। কথা বলতে পারল না সে। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে চোখের পানি সামলাতে লাগল।

তছি সেসব খেয়াল করল না। বলল, আমিও কেরে আর কোনওদিন কমু না। মইরা গেলেও কম না। কম কেমতে! ঘর থনেঐত্তো বাইর অমু না! কের লগে তো দেহাই অইবো না আমার! কেথা চাড়া দিয়া, ঘরের ঝাঁপ বন্দ কইরা হারাদিন হারারাইত হুইয়া থাকুম। তুমি বইয়া থাকবা আমার শিথানে। দুই একখান কথা কইলে তোমার লগে কমু।

চোখের পানি সামাল দিয়ে মা বলল, হারাদিন কেমতে তর শিথানে বইয়া থাকুম আমি! আমার কাম কাইজ নাই!

থাকলে থাকবো, কাম কাইজ তুমি করতে পারবা না।

তারপর আগের মতন কাতর গলায় বলল, মাগো, তুমি শিথানে বইয়া না থাকলে আমার বহুত ডর করবো। খালি মনে অইবো অহনে পুলিশ দারগায় আইয়া ধইরা লইয়া যাইবা আমারে। অহনে ফাঁসি দিবো। তুমি শিথানে বইয়া থাকলে তারা আমারে ধরতে পারবো না। ফাঁসি দিতে পারবো না।

শুনে আবার চোখ ভরে পানি এল মায়ের।

তছি বলল, দিন দোফরে আর কোনওদিনও ঘর থনে বাইর অমুনা আমি। ঘরের ভিতরে থাকুম, কেথার নিচে থাকুম। খাওন দাওন পেশাব পাইখানা নাওন ধোন বেবাক করুম রাইত্রে, বেবাকতে ঘুমাই যাওনের পর, চুপ্পে চুপ্নে। দিনে দোফরে ঘর থনে বাইর অইলেঐ মাইনষের লগে কথা কইতে ইচ্ছা করবো আমার, বাইত থনে বাইর অইয়া যাইতে ইচ্ছা করবো। কথা কইতে গিয়া করে আমি এই কথা কইয়া হালামু! বাইত থনে বাইর অইয়া গেলে কোনহানে পুলিশে দারগায় আমারে দেইক্কা হালাইবো। এর লেইগাঐ নাইড়া অইয়া যামু। নাইরা অইয়া গেলে ঘরথনে বাইর অইতে শরম করবো আমার। মাইনষের সামনে যাইতে, মাইনষের লগে কথা কইতে শরম করবো। দেও, চুলডি আগে কেচি দিয়া কাইট্টা দেও মা। গোড়া থিকা কাইট্টা, এই যে সাপান (সাবান) পানি আছে, মাথায় সাপান ঘইষ্যা, ফেনা উড়াইয়া এই বেলেড দিয়া ছাইচ্ছা (চেঁছে) দেও।

এবার ব্যাপারটা বুঝল মা, বুঝে হতভম্ব হয়ে গেল। ভয়ে আতংকে ভিতরে ভিতরে পাগলামি বেড়ে গেছে তছির। মাথা নাইড়া করার চিন্তা পাগলামি ছাড়া কিছু না। এই পাগলামি থেকে মেয়েটাকে এখন কেমন করে ফিরাবে সে! এই বয়সী মেয়ে নাইড়া হয়।

তছিকে বুঝ দেওয়ার গলায় মা বলল, ঘর থনে বাইর নাইলে না অইলি, যেমতে যা করতে চাছ কর, নাইড়া অওনের কাম কী! সিয়ানা মাইয়ারা কোনওদিন নাইড়া অয়?

না অয় না। আমি অমু। নাইড়া না অইলে হারাদিন কেথার তলে থাকতে ইচ্ছা করবো না আমার। বাইত থনে বাইর অইয়া যাইতে ইচ্ছা করবো। নেও তাড়াতাড়ি করো।

কেচিটা মায়ের দিকে এগিয়ে দিল তছি।

কিন্তু মা নড়ে না। যেমন বসেছিল, বসে থাকে।

তছি বলল, নাইড়া অওনের আরেকখান দরকারও আছে মা। হেদিনের পর থিকা মাথাডা বহুত গরম অইয়া রইছে। চুলার আগুনে হাড়ির ভাত যেমুন বলকায়, আমার মাথাডা অমুন বলকায়। নাইড়া অইলে বলকানিডা কমবো। উকুনে খাইয়া হালাইলো মাথা, উকুনডিও কমবো। এক কামে ম্যালা কাম অইবো। নেও ধরো কেচিড়া।

কেচি তবু ধরল না মা। আগের মতন বুঝ দেওয়া গলায় বলল, মাথায় তেল দিয়া দেই মা তাইলে মাথার বলকানি কমবো। কাকই দিয়া এচড়াইয়া দিমুনে, উকুন মাইরা দিমুনে। নাইড়া অওনের কাম নাই।

এবার চট করে রেগে গেল তছি। গদে ঢোকা চোখ ধ্বক করে জ্বলে উঠল। দাঁত মুখ খিচে সাপের মতো হিসহিস করে বলল, ঐ মাগি এতো প্যাচাল পারফ ক্যা! নাইড়া করতে কইছি কর, নাইলে তরে আমি নাইড়া কইরা দিমু। নে ধর কেচি।

জোর করে মায়ের হাতে কেচি ধরিয়ে দিল তছি। মাথা এগিয়ে দিল তার দিকে।

তছির এই রাগারাগিতে না, নিজেকে লুকিয়ে রাখবার চেষ্টায়, বাঁচিয়ে রাখবার আশায় পাগল মেয়ের যে অসহায় চেষ্টা সেই কথা ভেবে পানিতে আবার চোখ ভরে গেল তছির মায়ের। চোখের পানিতে ভাসতে ভাসতে তছির চুলে ঘ্যাচ ঘ্যাচ করে কেচি চালাতে লাগল সে।

.

১.৬২

সড়কের মাঝখানে চেয়ার নিয়ে বসেছে আলী আমজাদ। আজ শুক্রবার, মাটিয়ালদের সপ্তাহ দেওয়ার দিন। শেষ বিকালে কাজটা করে সে। যখন দিনের মাটিয়ালদের কাজ শেষ, রাতের মাটিয়ালদের কাজ শুরু।

অন্যান্য দিন বাড়ি যাক না যাক, শুক্রবার দুপুরের দিকে কাজের সাইট ঘুরে, হেকমতের কাছ থেকে মাটিয়ালদের টাকা পয়সার হিসাব বুঝে বাড়িতে চলে যায় আলী আমজাদ। গিয়ে নাওয়া খাওয়া সেরে, হাতে একখান অল্পদামী ব্রিফকেস, বেশ একটা ভাব ধরে বিকালের মুখে ফিরে আসে। খুব বেশি টাকা পয়সা নিজের লগে রাখে না সে। টাকা রাখে বাড়িতে। সপ্তাহে এই একদিন গিয়ে ব্রিফকেস ভরে নিয়ে আসে।

আলী আমজাদের হাতে ব্রিফকেস দেখে খুশিতে ফেটে পড়ে মাটিয়ালরা। তারা জানে ব্রিফকেসে কী! সপ্তাহ পেয়ে কী করবে না করবে, মনে মনে হিসাব করে। ফলে প্রত্যেকেই থাকে কমবেশি আনমনা। এসবের ফাঁকেই, আলী আমজাদ সাইটে আসবার আগেই হেকমতকে বলে আশপাশের বাড়ি থেকে একখান চেয়ার জোগাড় করে রাখে বদর। সাহেব এসে আরাম করে বসবেন চেয়ারে, কোলে ব্রিফকেস নিয়ে টাকা শুনে দেবেন মাটিয়ালদের। সরাসরি নিজ হাতে দিবেন না, পাশে ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে থাকবে হেকমত, মাটিয়ালের মুখ দেখে, তার রোজ মনে করে নিজে একবার শুনে টাকাটা দেবেন হেকমতের হাতে। হেকমত আর একবার শুনে তবে দেবে মাটিয়ালকে। দুইজন মানুষের চোখ হাত ফাঁকি দিয়ে এক টাকা বেশি যাওয়ার পথ নাই কারও হাতে।

সপ্তাহ নেওয়ার সময় গোঁড়া হাতে লাইন ধরে দাঁড়ায় মাটিয়ালরা। বদর তাদের লাইন ঠিক করে দেয়। আগপিছ নিয়ে কেউ কোনও ঝামেলা করলে সেইসব মিটায়। বেশ একখান মাতাব্বরি ভাব থাকে তার। যেন হেকমতের পরই তার জায়গা, সে কোনও সাধারণ মাটিয়াল না। সাহেব তাকে দিয়ে অন্যান্য কাজ করায় বলে সেও যেন। ছোটখাট একজন ম্যানেজার। আর ফুর্তিবাজ মানুষ বদর, শরীরে সারাক্ষণই আমুদে ভাব। ফলে মাটিয়ালরা তাকে পছন্দও করে। সে কোনও ঝামেলা মিটালে, অন্যায় ভাবেও যদি মিটায় কেউ প্রতিবাদ করে না!

সেই বদর কয়েকদিন ধরে একেবারেই অন্যরকম, একেবারেই চুপচাপ। স্বভাব বদলে গেছে তার। দুই তিনদিন ধরে কাজই করে না। কথাও বলে না কারও সঙ্গে। উদাস হয়ে চকে বসে থাকে। সাহেবের জন্য আজ চেয়ার আনতে যায়নি। মাটিয়ালদের লাইন ঠিক রাখার জন্য হামতাম (হম্বিতম্বি) করতাছে না। মরার মতো সবার শেষে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে ছোঁড়া, চোখ আসমানের দিকে। একজন করে টাকা নিয়ে বিদায় হচ্ছে, লাইন আগায়, বদর আগায় না।

এই ব্যাপারটা খেয়াল করল আদিলদ্দি। সে ছিল লাইনের মাঝামাঝি। নিজের সপ্তাহ নিয়ে বের হয়ে যাওয়ার সময় দেখে লাইন অনেকখানি আগিয়েছে তারপর বেশ ফাঁক, ফাঁকের শেষে একা উদাস হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বদর। দেখে যা বোঝার বুঝে গেল সে। নিঃশব্দে এসে দাঁড়াল বদরের পাশে। আস্তে করে ধাক্কা দিল বদরকে। খাড়ই রইলেন ক্যা! যান, আউগগান।

প্রথমে একটু চমকাল বদর, আদিলদ্দির মুখের দিকে তাকাল তারপর পা ফেলল। আদিলদ্দি বুঝে গেল টাকা হাতে না পাওয়া তরি বদরের লগে তার থাকতে হবে। সময় নষ্ট হবে, হোক। চদরি বাড়ির ছাপড়া ঘরে গিয়ে, পুকুরে ডুব দিয়েই রান্না বসাতে বসাতে আজ দেরি হয়ে যাবে, হোক। মনমরা ছেলেটার লগে থাকা দরকার।

আদিলদ্দি রইল।

বদরের লগে আদিলদ্দিকে দেখেই শিয়ালের মতন খ্যাক খ্যাক করে উঠল আলী আমজাদ। ঐ চুতমারানির পো, তুই না টেকা নিলি? আবার লাইনে খাড়াইছস ক্যা?

আদিলন্দি নরম গলায় বলল, আমি লাইনে খাড়ই নাই সাব। বদরের লগে আছি।

ক্যা? বদইরা কি নতুন মাইট্টাল! বোজে না কিছু, না টেকা পয়সা চিনে না? সর তুই। সর এহেন থিকা।

আদিলদ্দি একপাশে সরে দাঁড়াল।

একপলক বদরের দিকে তাকিয়ে হেকমতের দিকে তাকাল আলী আমজাদ। কোলে রাখা প্রায় শেষ হয়ে আসা টাকার ব্রিফকেস বন্ধ করতে করতে বলল, বদইরা তো কয়দিন ধইরা ঠিকঠাক মতন কাম করে না। বইয়া থাকে, আসমানের মিহি চাইয়া থাকে। আমার আহান চক্কু, বেবাক দেখি আমি। দেইক্কাও কিছু কই নাই। কমু ক্যা, কেঐর ইচ্ছা অইলে কাম করবো, ইচ্ছা অইলে করবো না। কামে ফাঁকি দিবো, আমার চকে পড়বো তাও আমি কিছু কমু না। খালি টেকাডা দেওনের সমায় দেইক্কা লমু।

বদরকে না হেকমতকে আলী আমজাদ বলল, হেকমইত্তা, ক কয়দিন ঠিক মতন কাম করতাছে বদইরা আর কয়দিন ফাঁকি দিছে।

হেকমত বলল, এই হপ্তায় ঠিক মতন কাম করতাছে তিনদিন। তারপর থিকা ফাঁকি দিছে। কাম করে তো করে না, গোড়া মাথায় উডায় তো উড়ায় না, বইয়া থাকে। একলা একলা কথা কয়। যারে সামনে পায় তারেই কয়, কন, আমি বলে চোর!

একথা শুনে ভুরু কুঁচকাল আলী আমজাদ। এক পলক বদরের দিকে তাকাল তারপরই স্বাভাবিক হয়ে গেল। যা ইচ্ছা কউক গা। ঐ হগল হুইন্না আমার লাব নাই। আমারে আসল কথা ক, ঠিক মতন কাম করতাছে তিনদিন।

হ।

পয়সা পাইবো তিনদিনের। বাকি চাইর দিনের পয়সা দিমু না।

মনে মনে বদরের রোজ হিসাব করে ব্রিফকেস খুলে টাকা বের করল আলী আমজাদ। হেকমতের হাতে দিল। তারপর ব্রিফকেস বন্ধ করে চেয়ারের ওপর রেখে উঠে দাঁড়াল। কোটের পকেট। বকে প্যাকেট বের করে সিগ্রেট ধরাল। ধরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে টানতে লাগল।

কাতর চোখে বদর তখন তাকিয়ে আছে আলী আমজাদের দিকে। হেকমতের হাতে তার টাকা, সেদিকে খেয়াল নাই। টাকাটা হেকমত তার দিকে বাড়িয়ে দিতেই, টাকা না ধরে, হেকমতের দিকে না তাকিয়ে ভাঙা গলায় আলী আমজাদকে ডাকল। সাহেব।

বদরের দিকে তাকাল না আলী আমজাদ, কথাও বলল না। সিগ্রেটে টান দিয়ে হেকমতকে বলল, কইয়া দে, দাপড়াইয়া মইরা গেলেও আর একটা পয়সা দিমু না আমি।

কথার লগে নাকমুখ দিয়ে ধুমা বের হল। হেকমত সেসব খেয়াল করল না। আলী আমজাদের কথাগুলি বদরকে বলবে, তার আগেই আলী আমজাদকে বদর বলল, আমি সাহেব পয়সা চাই না।

চমকে বদরের মুখের দিকে তাকাল আলী আমজাদ। তয়?

তিনদিনের পয়সা দিছেন হেইডাও আপনে রাইক্কা দেন।

আলী আমজাদ তো হলই, বদরের কথা শুনে হেকমত আর দূরে দাঁড়ান আদিলদ্দিও অবাক হয়ে গেছে। সিগ্রেটে টান দিতে গিয়েছিল আলী আমজাদ, সিগ্রেট ধরা হাত মুখের সামনে উঠে থেমে থাকল, আর হেকমত এবং আদিলদ্দি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল বদরের দিকে।

বদর কারও দিকেই তাকাল না। আগের মতোই ভাঙা গলায় বলল, আমি কোনও পয়সা চাই না সাহেব। আমার কোনও পয়সার লোব নাই। তিনদিন কাম করছি না সাতদিন করছি আমি কোনও ইসাব (হিসাব) করুম না। কয়টেকা পামু না পামু ইসাব করুম না। টেকাডি আপনে রাইক্কা দেন। তাও আপনে কন, আমি চোর না। আমি আপনের পয়সা চুরি করি নাই।

কথা বলতে বলতে ভাঙা গলা জড়িয়ে এল বদরের, চোখ ভরে গেল পানিতে। কারও মুখের দিকে আর তাকাল না সে। একহাতে অসহায় ভঙ্গিতে ধরা মোড়াখান, অন্যহাতে চোখ মুছতে মুছতে পশ্চিম দিককার চকে নেমে গেল। এই চক পাড়ি দিয়ে, ধান আর তিল কাউনের বিল পাড়ি দিয়ে নিজগ্রামে ফিরে যাবে বদর।

তখন শীত বিকালের পদ্মার পানির মতন আলো মুছে দিচ্ছিল দিনশেষের অন্ধকার, কুয়াশা। কুয়াশায় অন্ধকারে আস্তেধীরে মিলিয়ে যাচ্ছিল একজন মানুষ।

.

১.৬৩

রাত দুপুরে মান্নান মাওলানা শোনেন তার গোয়ালঘরে কী রকম একটা নড়াচড়ার শব্দ! গরুগুলো যেন একটু বেশি নড়ছে, লেজ নেড়ে, কান লতর পতর করে একটু বেশি শব্দ করতাছে।

কনকনা শীতের রাতে গরুদের আচরণও হয় মানুষের মতে। নড়াচড়া কম করে তারা, শব্দ কম করে। যেখানে দাঁড়ায় তো দাঁড়িয়ে থাকে, বসে তো বসেই থাকে। জাবর কাটে না। নাদে কম, চনায় কম। শীতের হাত থেকে গরুদের বাচাবার জন্য গোয়াল ঘরে পুরু করে খড়নাড়া বিছিয়ে দেয় গিরস্তরা। শীত কাতরে কোনও কোনও গরুর পিঠে মোটা ছালার চট বেঁধে দেয়। এই বাড়িতে এমন শীত কাতুরে গরু নাই একটাও। পিঠে ছালার চট বাঁধবার দরকার হয়নি কোনও গরুর। তবে গোয়ালঘরে খড়নাড়া বিছানো হয়েছে। দুইতিন দিন আগে কাজটা করেছে নতুন গোমস্তা হাফিজদ্দি। শীত আরও পড়েছে বলে গরুরা খুব কষ্ট পাচ্ছিল।

 এরকম শীতের রাতে গরুরা কেন আজ নড়াচড়া করতাছে! ব্যাপারটা কী! মশায় কামড়াচ্ছে! এই শীতে তো মশা থাকবার কথা না! যা আছে সন্ধ্যাবেলা ধুপ দেওয়ার পর এইমুখি হওয়ার কথা না! মাকুন্দা কাশেমের মতো হাফিজদ্দিও তো ধুপ দেওয়া শুরু করেছে। আজ সন্ধ্যায়ও তো দিল! তাহলে?

লেপের তলা থেকে মাথা বের করলেন মান্নান মাওলানা। জোড় বালিশ শিথান দিয়ে শোয়ার অভ্যাস তার। কাত হয়ে শুয়ে ছিলেন বলে এককান চাপা পড়ে আছে আর এককান খোলা। এককানে শোনা শব্দ ঠিক নাও হতে পারে। বালিশ থেকে মাথা উঁচু করে দুইকান খাড়া করলেন তিনি। হঠাৎ করে ঘুম ভেঙেছে বলে প্রথমে একটু দিশাহারা। ছিলেন। সেইভাব কাটিয়ে পরিষ্কার শুনতে পেলেন গরুদের নড়াচড়ার শব্দ।

না, মশার কামড়ে এমন নড়াচড়ার কথা না গরুদের। শিয়াল ঢোকেনি তো গোয়ালে! নাকি বাঘদাসা ঢুকেছে।

কচি নরম বাছুঁড়ের লোভে কখনও কখনও গিরস্তের গোয়ালে হানা দেয় শিয়াল। একলা না, দল বেঁধে। চতুর জীব তো, দল বেঁধে গোয়ালে ঢুকে তাগড়া জোয়ান গাই গরুগুলিকে ত্যক্ত করতে থাকে কয়েকটাতে। কোনওটায় পা কামড় দিয়ে ধরে কোনও গরুর, কোনওটায় লাফ দিয়ে ওঠে পিঠের দিকে। শিং বাগিয়ে তাদেরকে তাড়া করতে ব্যস্ত হয় গরুগুলি আর সেই ফাঁকে তিনচারটা শিয়ালে মিলে বাছুরটাকে কায়দা করে ফেলে। কেউ কামড় দিয়ে ধরে ঢোর, কেউ এই ঠ্যাং ওই ঠ্যাং। তারপর টেনে নিয়ে যায় চকে।

গোয়ালে শিয়াল ঢুকলে বেশ একটা হুড়াহুড়ির শব্দ হয়! গরুদের নাকমুখ দিয়ে বেরয় রাগ ক্রোধের ভোসভোসানি। এখনকার শব্দটা তেমন না। যদি বাঘদাসাও ঢুকে থাকে, রাগ ক্রোধের শব্দ তো গরুরা করবেই। করতাছে না তো!

বাঘদাসা সাহসী জীব। বাঘের দাস তো, বাঘের মতো না হলেও শিয়ালের মতো, সাহস শিয়ালদের চেয়ে অনেক বেশি। ক্ষুধার জ্বালায় পাগল হয়ে একাই কখনও কখনও হানা দেয় গিরস্তের গোয়ালে। পাঁচ দশটা গরুর সামনেই হয়তো আক্রমণ করে বসে বাছুরকে। খাবলা দিয়ে মাংস তুলে ফেলে।

তেমন হলে তো বাছুড়টার আর্তনাদে লগে লগে জেগে যাবে বাড়ির লোক। কোনও বাছুর তো তেমন আর্তনাদ করতাছে না! তাহলে!

তারপরই মান্নান মাওলানার মাথায় এল অন্য চিন্তা। গরুচোর ঢোকেনি তো তার গোয়ালে! রাত দুপুরে গোয়ালে অচেনা মানুষ দেখে নড়াচড়া করতাছে না তো গরুগুলি!

বিছানায় উঠে বসলেন মান্নান মাওলানা। পাশে শোয়া স্ত্রীকে ধাক্কাতে লাগলেন। তবে শব্দ করে ডাকলেন না তাকে।

দুই তিনবার ধাক্কাতেই সাড়া দিলেন স্ত্রী। কী অইছে! এমুন করেন ক্যা?

স্ত্রীর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে মান্নান মাওলানা বললেন, চুপ। কথা কইয়ো না। চোর আইছে।

চোর আসছে শুনে ভয়ে প্রায় আর্তনাদ করে উঠতে গিয়েছিলেন স্ত্রী, মান্নান মাওলানা তার মুখ চেপে ধরলেন। কইলাম যে চুপ! হোনো, গরুচোর। গোয়াইল ঘরে হানছে। গরু চোররা কইলাম এক দুইজনের বেশি আহে না। ইচ্ছা করলেই ধরন যায়। আমি আইজ ধরুম। ওড়ো তুমি। উইট্টা আমার লগে বাইর অও। আমি একহাতে শরকি লমু। আরেক হাতে টচ (টর্চ) লাইট। তুমি এমুন কইরা দুয়ার খোলবা য্যান আওজ না অয়। আমি তারবাদে, গোয়াইলের সামনে গিয়াঐ, টচ মাইরা শরকি দিয়া একজনরে গাইত্তা (গেঁথে) হালামু। আর তুমি আতাহাররে ডাক দিবা, হাফিজদ্দিরে ডাক দিবা।

বাড়িতে চোর আসার পর, চোর কোনও ঘরে থাকার পরও যে এত ঠাণ্ডা মাথায় চোর ধরার ফন্দি করতে পারে তাঁর স্বামী, এত এত বছর ধরে মানুষটার লগে সংসার করার পরও, মানুষটার হাজার রকমের কায়কারবার দেখবার পরও মান্নান মাওলানার স্ত্রীর তা বিশ্বাস হচ্ছিল না। কী রকম একটা ঘোর লেগে গেল তার। স্বামীর কথা মতন নিঃশব্দে বিছানা থেকে নামল সে।

ততক্ষণে শক্ত করে লুঙ্গি কাছা মেরেছেন মান্নান মাওলানা, বালিশের তলা থেকে পাঁচ ব্যাটারির টর্চ বের করে হাতে নিয়েছেন আর মাথার কাছে, ঢেউটিনের বেডার। এককোণে দাঁড় করিয়ে রাখা শরকি নিয়েছেন। তাঁর কথা মতো সাবধানে দুয়ার খুলেছেন স্ত্রী, মান্নান মাওলানা ঘর থেকে বেরুলেন।

বাইরে আজ প্রচণ্ড শীত, হাড্ডিগুড্ডির (হাড়গোড়ের) ভিতর পর্যন্ত কাঁপন ধরে যায় এমন। মান্নান মাওলানার গায়ে হাফহাতা গেঞ্জি। এমনিতে শীত কাতুরে লোক তবু কিছুমাত্র শীত টের পেলেন না। বরং শরীর তার ফেটে পড়ছিল গরমে। শরকি বাগিয়ে সাবধানী পায়ে গোয়ালঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন। আচমকা টর্চ জ্বেলেই চিৎকার করে উঠলেন, খবরদার! দৌড় দিলেঐ শরকি দিয়া গাইত্তা হালামু।

টর্চের আলোয় গোয়ালঘরের মাঝখানটা আলোকিত হয়েছে। সেই আলোয় দেখা গেল মাকুন্দা কাশেম বসে আছে দুইতিনটা গাই গরুর মাঝখানে। গায়ে নতুন লুঙ্গি পিরন আর তুস রঙের নতুন চাদর। বুকের কাছে দুইহাতে জড়িয়ে রেখেছে গোয়ালের সবচেয়ে ছোট বাছুরটা। টর্চের আলো পড়ায় বাছুরটা আর সে একই রকমের হতবাক চোখে তাকিয়ে আছে মান্নান মাওলানার দিকে।

পরিস্কার দেখেও যেন মাকুন্দা কাশেমকে চিনতে পারলেন না মান্নান মাওলানা। শরকি আগের মতোই বাগিয়ে রেখে বললেন, খবরদার! সাবধান! লড়লেঐ শরকি দিয়া পাড় দিমু।

মান্নান মাওলানার কথা মতন ততক্ষণে তার নিজের কাজ করে ফেলেছেন স্ত্রী। আতাহার ও হাফিজদ্দিকে ডেকে তুলেছেন। বাংলাঘর থেকে কাছা মেরে বেরিয়ে এসেছে তাগড়া জোয়ান আতাহার আর হাফিজদ্দি। আতাহারের হাতে লোহা কাঠের ডাণ্ডা। এই ডাণ্ডা মাথার কাছে নিয়ে শোয় সে। হাফিজদ্দির হাতে ছিল বাঁশের লাঠি। গোয়ালঘরের সামনে এসে বিশাল একখান হাঁক দিল সে। কে কোনহানে আছেন, আউগগান। চোর ধরছি।

হাফিজদ্দির লগে গলা মিলিয়ে চিৎকার দিতে গিয়েছিল আতাহার তার আগেই মান্নান মাওলানা বললেন, আগে ধর তারবাদে চিকুইর দে।

ততক্ষণে মাকুন্দা কশেমকে চিনে ফেলেছে আতাহার। চিনে বেকুব হয়ে গেছে। চোর ধরার উত্তেজনা নাই হয়ে গেছে তার। মান্নান মাওলানার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ও বাবা, কো চোর? এইডা তো মাকুন্দা!

আতাহারের মতো মাকুন্দা কাশেমকে তিনিও চিনছিলেন। তবু ছেলেকে একখান ধমক দিলেন। মাকুন্দা অইছে কী অইছে! ও কি অহন আর আমগো বাড়ির গোমস্তা? ও চোর অইতে পারে না! ও তো আমার গরু চুরি করতেঐ আইছে। দেহচ না বাছুরডারে কেমতে প্যাচাইয়া ধরছে। ধর শুয়োরের পোরে, বান, পিডা।

এবার যেন ব্যাপারটা বুঝতে পারল আতাহার, বুঝে লাফ দিয়ে গোয়ালে ঢুকল। একহাতে খামচে ধরল মাকুন্দা কাশেমের গলার কাছের পিরন চাদর, শূন্যি (শূন্য) করে তাকে নিয়ে এল গোয়ালের বাইরে। আতাহারের আচরণে কাশেমের চেয়েও যেন বেশি ভয় পেল বাছুরটা, ছটফট করে মায়ের পেটের কাছে গিয়ে দাঁড়াল সে। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগল তাদের প্রিয় মানুষটাকে নিয়ে অন্য কয়েকটা মানুষের কায়কারবার।

মান্নান মাওলানা আতাহার আর হাফিজদ্দির চিল্লাচিল্লিতে বাড়ির প্রতিটা ঘরে মানুষ জেগে উঠেছে, জ্বলে উঠেছে কুপিবাতি। দুয়ার জানালা খুলে বাইরে তাকিয়েছে বাড়ির বউঝিরা, পোলাপানরা। শীতে কাঁপতে কাঁপতে কেউ কেউ এসে দাঁড়িয়েছে উঠানে। মান্নান মাওলানা কাউকে খেয়াল করলেন না, কারও দিকে তাকালেন না, আতাহারকে বললেন, বান শুয়োরের পোরে।

গোয়াল ঘরের বাইরের দিককার একটা খুঁটির লগে কাশেমের চাদর দিয়েই কাশেমকে শক্ত করে প্যাচিয়ে বাঁধতে লাগল আতাহার। ততক্ষণে যেন হতবাক ভাব কেটেছে মাকুন্দা কাশেমের। ব্যাপারটা যেন বুঝতে পেরেছে সে। বুঝতে পেরে দিশাহারা গলায় বলল, আমারে বান্দেন ক্যা? আমি তো চোর না! চুরি করতে আহি নাই।

মান্নান মাওলানা এগিয়ে গিয়ে ধাম করে একটা লাথি মারলেন মাকুন্দা কাশেমের পেট বরাবর। চুরি করতে না আইলে রাইত দোফরে আমার বাইত্তে আইছস ক্যা! তুই এই বাড়ির কে? গোয়াইলে আইয়া হানছচ ক্যা? বাছুরডারে এমতে প্যাচাইয়া ধরছিলি ক্যা? বাছুরডারে কুলে লইয়া তো উইট্টা খাড়ইছিলি! শরকি হাতে আমি সামনে আইয়া না খাড়ইলে, টচ না মারলে তো এতুক্ষুণে বাছুরডা লইয়া পলাইতি। শরকি দিয়া পাড় দিমু দেইক্কা লড়তে পারচ নাই। বইয়া পড়ছস।

যে রকম একখান লাথথি খেয়েছে তাতে কেঁদে ফেলবার কথা কাশেমের। কিন্তু অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে, এই অবস্থায় কান্না আসে না মানুষের। এই অবস্থায় অস্থির লাগে, সাঁতার না জানা মানুষের মতন পানিতে ডুবে যাওয়ার সময় যেমন লাগে তেমন লাগে। কাশেমেরও লাগছিল। অসহায় চোখে মান্নান মাওলানার মুখের দিকে তাকাল সে। আতাহার আর আতাহারের মায়ের মুখের দিকে তাকাল। কাতর গলায় বলল, না না। বাছুর কুলে লইয়া খাড়ই নাই আমি। বাছুরডারে বুকে প্যাচাই ধইরা, এই চাইর দিয়া। প্যাচাইয়া বইয়া রইছিলাম। আইজ বহুত শীত পড়ছে। শীতে বহুত কষ্ট পাইতাছিল বাছুর। আমি চোর না। চুরি করতে আহি নাই। গরুডির লেইগা মায়া লাগে দেইক্কা আইছি। দিনে আপনে আইতে দেন না দেইক্কা রাইত্রে আহি। রোজ রাইত্রে আইয়া গরুডির লগে থাকি। আমি চোর অমু ক্যা! আমি তো কনটেকদার সাবের মাইট্টাল অইছি। ভাল টেকা রুজি করি। এই যে দেহেন না নতুন লুঙ্গি পিরন কিনছি, চাইদ্দর কিনছি।

এক ফাঁকে শরকিটা গোয়াল ঘরের একপাশে দাঁড় করিয়েছে মান্নান মাওলানা, হাতের টর্চ দিয়েছেন স্ত্রীর হাতে। দুই হাতই মুক্ত এখন। আর টর্চ এখন জ্বালবারও দরকার নাই। ঘর থেকে আসা কুপিবাতির আলোয় আলোকিত হয়ে গেছে বাড়ি। সেই আলোয় গোয়ালঘরের খুঁটির লগে বাধা মাকুন্দা কাশেমকেও গরুর মতোই অবলা দেখায়। যেন সে কোনও মানুষ না, যেন সেও গরু, গিরস্তের গোয়ালে বাঁধা।

কিন্তু কাশেমের কথা বিন্দুমাত্র পাত্তা দিলেন না মান্নান মাওলানা। ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মতন গো গো করতে লাগলেন। দুইহাঁতে অবিরাম চড়থাবড় কিল ঘুষি মারতে লাগলেন কাশেমকে। লাথথি কন্নি মারতে লাগলেন। চোর না, তুমি চোর না শুয়োরের পো! তুমি সাদু! রাইত দোরে গোয়াইল ঘরে হানছো গৰুডির লেইগা মায়া লাগে দেইক্কা। আমারে ভোদাই (বোকা) পাইছো! যা বুজাইবা তাই বুজুম আমি! আরে চুতমারানির পো, তরে তো আমি চিনি! চুন্নির জানাজায় গেছস দেইক্কা তরে আমি বাইত থিকা খেদাই দিছি। বাইত্তে আর আইতে দেই নাই। তুই আইছস হেই শোদ লইতে। আমার বাছুর চুরি কইরা শোদ লবি তুই। বাছুর হাজার টেকার কম দাম অইবো না। চুরি করতে পারলে বড়লোক অইয়া যাইতি তুই। মাইট্টালগিরি করন লাগতো না। বুজি, বেক বুজি আমি। তয় আমার বাড়ির জিনিস চুরি করন এত সোজা না। দোয়া পইড়া বাড়ি বাইন্দা থুইছি। আমি। চোর আইলে ধরা পড়বোঐ। আল্লার কুদরত। তুইও পড়ছস।

ততক্ষণে কাশেম আর কাশেম নাই, চেহারা বদলে গেছে তার। নাক ফেটে দরদর করে রক্ত পড়ছে, ঠোঁট কেটে ঝুলে পড়েছে। দাঁতের গোড়ায় গোড়ায় রক্ত। বুঝি জিবলাও কেটেছে। মুখের এদিক ওদিক শালুকের মতো ফুলে উঠেছে। কাশেমের মুখ আর মানুষের মুখ মনে হচ্ছে না।

তবু কাঁদল না কাশেম। জড়ানো কাতর গলায়, দুইহাত মোনাজাতের ভঙ্গিতে তুলে মান্নান মাওলানাকে বলল, বিশ্বাস করেন হুজুর, আমারে আপনে বিশ্বাস করেন। আমি মিছাকথা কই নাই। আমি চুরি করতে আহি নাই। গরুডিরে না দেইক্কা থাকতে পারি না, মায়া লাগে দেইক্কা আহি। চুরি করলে তো আগে ঐ করতাম! মায়া না লাগলে এই রকম শীতের রাইত্রে কেঐ আইয়া গোয়াইলে হানদে! আপনের বাইত্তে নাইলে থাকতে না দেন অন্য বাইত্তে তো থাকতে পারতাম!

এবার মান্নান মাওলানা আর কথা বলবার সুযোগ পেলেন না। কথা বলল আতাহার। ভেক ধরছে হালার পো, যা বুজাইবা তাঐ বুজুম আমরা! যত মায়া লাগুক রাইত্রে আইয়া মাইনষে কোনও দিন গরুর লগে থাকে!

মাকুন্দা কাশেম আবার কী বলতে চাইল, তার আগেই আতাহারের দিকে তাকিয়ে মান্নান মাওলানা বললেন, এত প্যাচাইল পারতাছস ক্যা তুই? পিডাচ না ক্যা! গিড়ায় গিড়ায় পিড়া, নল্লি ভাইঙ্গা দে। জিন্দেগীতে যেন উইট্টা খাড়ইতে না পারে। পিডা।

কাশেম এবার মান্নান মাওলানার স্ত্রীর দিকে তাকাল। আম্মা, আম্মা আপনে হুজুররে বুজান। আপনে আতাহার দাদারে বুজান। ছোডকাল থিকা আপনেগো বাইত্তে থাকি। আপনে তো আমারে চিনেন! আপনে তো জানেন আমি চোর না! আমি মিছাকথা কই না। আপনে তাগো বুজান।

কাশেমের কথা শেষ হওয়ার আগেই, স্ত্রীকে কোনও কথার বলবার সুযোগ না দিয়েই আতাহারের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলেন মান্নান মাওলানা। কী কই তরে! পিডাচ না ক্যা! পিডাইয়া লুলা কইরা হালা। বিয়ান অউক, দারগা পুলিশ দিয়া এরাই দিমুনে।

এইবার দুইহাতে লোহা কাঠের ডাণ্ডাটা তুলল আতাহার। কোনওদিকে না তাকিয়ে প্রচণ্ড জোরে কাশেমের ডানহাটু বরাবর একটা বাড়ি দিল। পলকের জন্য আঘাতটা যেন বুঝতে পারল না কাশেম। তারপরই চিকুইর দিয়া উঠল। আল্লারে!

আতাহার তা গ্রাহ্য করল না। আবার বাড়ি মারল। আবার, আবার।

মাকুন্দা কাশেমের বুকফাটা আর্তনাদে তখন স্তব্ধ হয়েছিল জেগে ওঠা মানুষ, ভেঙে খান খান হয়ে যাচ্ছিল শীতরাত্রির নিস্তব্ধতা। মাকুন্দা কাশেমের আর্তনাদে তখন কাঁদতে ভুলে গিয়েছিল আচমকা ঘুমভাঙা শিশু, রুদ্ধ হয়েছিল উত্তরের হাওয়া। মাকুন্দা কাশেমের আর্তনাদে তখন চৌচির হচ্ছিল সাত আসমান, কেঁপে কেঁপে উঠছিল আল্লাহতালার আরশ।

.

১.৬৪

খালি ভার ঘরের ছনছায় নামিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল দবির। অসহায় ভঙ্গিতে পিড়ায় বসে মন খারাপ করা গলায় বলল, একখান খারাপ সমবাত আছে।

উঠানের কোণে জলচৌকিতে বসে রোদ পোহাচ্ছে নূরজাহান। বেলা হয়েছে তবু শীত কমেনি। গায়ে চাদরের মতো জড়িয়ে রেখেছে আকাশি রঙের পাতলা কাঁথা। বাড়ির পুবদিককার নামায় যে কদু উসসির ঝাঁকা সেই ঝাঁকার ঝকমকে রোদে টুকটুক করে লাফাচ্ছে একজোরা ভাত শালিক। আনমনা চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে শালিক দেখছিল নূরজাহান। কথা শুনে দবিরের মুখের দিকে তাকাল। অলস গলায় বলল, কী?

কাইশ্যা ধরা পড়ছে।

কথাটা শুনে চমকাল নূরজাহান। থতমত খেল। অলস আনমনা ভাব কেটে গেল। এই নামের মানুষটাকে জন্মের পর থেকে চিনার পরও যেন এখন আর চিনতে পারল না। বলল, কোন কাইশ্যা?

মাকুন্দা।

এবার যেন চিনল নূরজাহান। আকুল গলায় বলল, কই ধরা পড়ছে?

মাওলানা সাবের বাইত্তে গরু চুরি করতে গেছিলো।

মাজায় লাঠির বাড়ি খেয়ে যেমন করে লাফিয়ে ওঠে নিরীহ আরজিনা ঠিক তেমন করে লাফিয়ে উঠল নূরজাহান। গা থেকে গাছের পাতার মতো খসে পড়ল কথা। নূরজাহান ভ্রুক্ষেপ করল না। চারপাশের ডালিমরাঙা রোদ ম্লান করে তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলল, না না, না। কাশেম কাকায় চুরি করতে যায় নাই। ক্যান গেছে আমি জানি। কাকায় আমারে বেবাক কথা কইছে।

তারপর গরুদের লগে কাশেমের রাতযাপনের ঘটনা অস্থির গলায় দবিরকে বলল নূরজাহান। হামিদা ছিল রান্নাচালায়, কখন এসে দাঁড়িয়েছে নূরজাহান আর দবিরের সামনে ওরা তা খেয়াল করল না।

মেয়ের কথা শুনে দবির তখন বোবা হয়ে গেছে। নূরজাহানের মুখের দিকে খানিক তাকিয়ে থেকে বলল, কচ কী তুই! আ,কচ কী! কাইশ্যা তো তাইলে নির্দোষ! কাইশ্যা তো তাইলে চোর না!

হ, হ। একদোম নির্দোষ। হেয় চোর না। মাওলানা সাবে ইচ্ছা কইরা তারে ধরছে।

দবির করুণ গলায় বলল, খালি ধরলে তো ভাল আছিলো, বাপেপুতে মিল্লা যেই মাইরডা দিছে!

এই হগল মাওলানা সাবের চালাকি। বদমাশি। ছনুফুবুর জানাজা পড়তে আইছিলো দেইক্কা কাশেম কাকার উপরে হেয় চেইত্তা আছিলো। বহুত রাগ অইয়া আছিলো কাশেম কাকার উপরে। মাইরা ধইরা বাইত থিকা খেদাই দিয়াও রাগ মিডে নাই। আইজ গরুচোর বানাইয়া, পিডাইয়া আড্ডিগুড্ডি ভাইঙ্গা হেই রাগ মিডাইতাছে।

এতক্ষণ নূরজাহানের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল হামিদা। মেয়ের কথা শেষ হতেই স্বামীর দিকে তাকিয়ে চিন্তিত গলায় বলল, মাকুন্দা অহন কো?

রান্নাচালার পিছন দিককার বাঁশঝাড়ের মাথার ওপর দিয়ে রোদে ভেসে যাওয়া আসমানের দিকে তাকাল দবির। দারগা পুলিশে ধইরা লইয়া যাইতাছে। মাইরের চোডে হাত পায়ের গিড়া (গাট) ভাইঙ্গা গেছে। হাঁটতে পারে না কাইশ্যা। আতুড় লুলা মাইনষের লাহান হেউড়াইয়া হেউচভূইয়া যাইতাছে। তার মইদ্যেও মাজায় দড়ি বানছে পুলিশে। য্যান দড়ি না বানলে দৌড় দিয়া পলাই যাইবো কাইশ্যা। আহা রে, কাইশ্যার কি আর দৌড় দেওনের জোরবল আছে! জিন্দেগি ছেমড়ার বিনাশ কইরা দিছে মাওলানা সাবে টুন্ডা (অথর্ব) কইরা দিছে।

এবার হঠাৎ একটা দৌড় দিল নূরজাহান। ছনুবুড়ির মৃত্যুর কথা শুনে যেমন দৌড় দিয়েছিল ঠিক তেমন করে দৌড়ে চকে নেমে গেল। পিছন থেকে চিৎকার করে হামিদা তাকে ডাকল। নূরজাহান শুনল না, নূরজাহান ফিরে তাকাল না।

দবির বলল, যাউক, ডাইক্কো না। কাইশ্যারে শেষ দেহা দেইক্কাহুক।

মুখ ঘুরিয়ে স্বামীর দিকে তাকাল হামিদা। এইডা কেমুন কথা কইলা! শেষ দেহা দেখবো ক্যা? মাকুন্দা কি মইরা গেছেনি! জেলে গেলে মানুষ মইরা যায় না, ফিরা আহে।

দবির আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কাইশ্যা আইবো না। কেমতে আইবো কও! মানুষ জেলে গেলে চেষ্টা তদবির কইরা, টেকা পয়সা খরচা কইরা তারে ছাড়াইয়া আনতে অয়। কাইশ্যার লেইগা চেষ্টা করবো কে! টেকা পয়সা খরচা করবো কে! আছে কেডা অর!

হামিদা কথা বলল না। চিন্তিত চোখে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

বাঁশঝাড়ের মাথায় রোদ ঝলমল নীল আসমান। সেই আসমানের দিকে তাকিয়ে উদাস গলায় দবির বলল, কাইশ্যা আর কোনওদিন ফিরত আইবো না। কাইশ্যার লগে আমগো আর কোনওদিনও দেহা অইবো না। দিনে দিনে দিন যাইবো। পয়লা পয়লা দুই চাইরদিন কাইশ্যার প্যাচাইল পাড়বো দেশ গেরামের মাইনষে। তারবাদে ভুইল্লা যাইবো। কে কারে কয়দিন মনে রাখে, কও! ছনুবুজির কথা কেডা মনে রাখছে। কাইশ্যার কথাও কেঐ মনে রাখবো না। এই গেরামে যে কাশেম নামে একজন মানুষ আছিলো, মাইনষে যে তারে কইতো মাকুন্দা কাশেম, এই কথা কেঐ মনে রাখবো না। কোনও কিছুই বেশিদিন মনে রাখে না মাইনষে। মা বাপ মইরা গেলে দুই চাইরদিন বাদে ভুইল্লা যায়, কইলজার টুকরার লাহান পোলাপান মইরা গেলে ভুইল্লা যায়। জামাই মইরা গেলে বউয়ে ভুইল্লা যায় তার কথা। বউ মইরা গেলে তার কথা ভুইল্লা জামাই আবার বিয়া করে। কেঐ কাঐরে মনে রাখে না। মানুষ এই রকমঐ।

.

১.৬৫

হাঁটতে না পারা আতুর লুলা মানুষ যেমন করে পথ চলে, সড়কের মাটিতে তেমন করে ছেড়ে ছেছড়ে আগাচ্ছে মাকুন্দা কাশেম। তার মুখ আর মানুষের মুখ নাই, শরীর আর মানুষের শরীর নাই। মাথার কত জায়গায় ফেটেছে, কত জায়গা ফেটে যে রক্ত বের হয়েছে কে জানে। গোসল করবার পরও কোন কোনও সৌখিন গিরস্ত যেমন করে তেল দেয় মাথায়, মাথার চুলে সর্বক্ষণ যেমন থাকে তাদের ভিজা ভিজা ভাব, মাকুন্দা কাশেমের মাথা তেমন করে ডিজে আছে রক্তে। কোথাও কোথাও রক্ত শুকিয়ে জট বেঁধেছে চুল। ডানদিককার জুলপির পাশ দিয়ে কখন নেমেছিল কাইয়া লউঙের (কড়ে আঙুল) মতন মোটা একখান রক্তের ধারা, কখন শুকিয়ে কালে চটচটে হয়েছে সেই রক্ত, কাশেম নিজেও তা জানে না। কপালের তিনচার জায়গা গানের মুচির মতন ফুলে আছে। বাইল্লামাছের মতন সাদা গাল থুতনি কালচে, থেতলানো। ছাল চামড়া উঠে থকথক করতাছে সারামুখ। দুইচোখের কোলও গাল থুতনির মতনই। থেতলে ফুলে চোখ দুইটা প্রায় ঢেকে দিয়েছে। বাঁ দিককার কান ছিঁড়ে ঝুলে পড়েছে। নাকের ডগা ভেঙে মিশে গেছে ওপরের ঠোঁটের লগে। নিচের ঠোঁট যে গরুর খুরে থেতলে যাওয়া টুকটুকি (টিকটিকি)। মুখের ভিতর, সামনের মারির এ দাঁতটাও নাই। কদুবিচির মতন কখন খসে পড়েছে সব। জিভবান হয়েছে ফালা ফালা। কদিন আগে কিনা নতুন পিরন লুঙ্গি ছিঁড়ে ফেঁসে একাকার। পিরনের বুকের কাছে একটাও বুতাম নাই। একটা হাতা কোথায় উড়ে গেছে। লুঙ্গি আর লুঙ্গি নাই। ত্যানার টুকরার মতন ঝুলে আছে মাজায়। তবে লুঙ্গির গিট শক্ত করে দেওয়া। এত মারের পরও গিটটা কেন যে খোলেনি!

লুঙ্গি পিরনের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে কাশেমের শরীর, কালসিটে, রক্তাক্ত, থকথকে। লাঠির বাড়িতে গুড়া হয়েছে দুইহাতের কনই, দুইপায়ের হাঁটু গুড়গুড়া। হাত পায়ের চার পাঁচখান চারি উধাও হয়ে গেছে।

এমন মারও মানুষ মানুষকে মারে! এত মার খেয়েও বেঁচে থাকে মানুষ। কেমন করে বেঁচে আছে মাকুন্দা কাশেম!

কাশেমের দুইপাশে দুইজন পুলিশ। মাজায় প্যাঁচিয়ে যে দড়ি দিয়ে বাঁধা হয়েছে তাকে সেই দড়ির মাথা ধরে রেখেছে একজন পুলিশ। বিরক্তিতে মুখ হেঁয়ে আছে পুলিশটির। তাদের লগে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না বলে কাশেমের ওপর বেদম রেগেছে সে। প্রায়ই বুট পরা পা তুলে লাথথি মারছে। যা তা ভাষায় গালিগালাজ করতাছে। এই সব তুচ্ছ গালিগালাজ আর সামান্য মার এখন গায়ে লাগছে না কাশেমের। সে তার মতো আগাচ্ছে।

পুলিশ দারোগার ভয়ে কাশেমের সামনে কোনও লোক নাই, পিছনে ভেঙে পড়েছে সারা গ্রামের লোক। মান্নান মাওলানা আছেন কাশেমের একবারে পিঠের কাছে, ঘাড়ের ওপর। যেন ঘাড় পিঠ ঠেলে ঠেলে তিনিই মাকুন্দা কাশেমকে বের করে দিচ্ছেন গ্রাম থেকে।

মান্নান মাওলানার পাশে আছে আরেকজন পুলিশ। বোধহয় অন্য দুইজনের তুলনায় সে একটু বড়। দারোগা। হাসিমুখে তোয়াজের স্বরে তার লগে কথা বলছেন মান্নান মাওলানা। দারোগা সাহেব ফুক ফুক করে সিগ্রেট টানছেন আর মান্নান মাওলানার কথা শুনে মাথা দোলাচ্ছেন।

নূরজাহান এসবের কিছুই দেখল না, কিছুই খেয়াল করল না। পাগলের মতন ছুটতে ছুটতে কাশেমের একেবারের সামনে এসে দাঁড়াল। দারোগা পুলিশের ভয়ে যে কাশেমের আগে আগে কেউ হাঁটছে না, সবাই হাঁটছে পিছন পিছন, নূরজাহান তাও খেয়াল করল না। সব জেনেও, সব বুঝেও আকুল গলায় বলল, কী অইছে কাশেম কাকা? কী অইছে আপনের?

নূরজাহানকে এভাবে সামনে এসে দাঁড়াতে দেখে নিজেদের অজান্তেই যেন দাঁড়িয়ে গেছে সবাই। কাশেমও থেমেছে, থেমে অচেনা মুখ তুলে নূরজাহানের দিকে তাকিয়েছে। সেই মুখের দিকে তাকিয়ে নূরজাহান আবার বলল, কী অইছে?

অনেকক্ষণ ধরে কাঁদছিল না মাকুন্দা কাশেম। ধরা পড়ার পর থেকে, মার শুরু হওয়ার পর থেকে কাঁদতে কাঁদতে কখন যে চোখের পানি শেষ করে ফেলেছে উদিস পায়নি। এখন নূরজাহানের কথা শুনে কোথা থেকে, কেমন করে যেন পানি এল চোখে। চোখের কোণ ভরে গেল। ভাঙাচোরা কাতর গলায় কাশেম বলল, আতাহার দাদারে কইলাম, গেরামের বেবাক মাইনষেরে কইলাম, কেঐ বিশ্বাস করলো না মা, কেঐ আমার কথা বিশ্বাস করলো না। কত পায় হাতে ধরলাম, কত কানলাম, কেঐ বিশ্বাস করলো না।

কাশেম শব্দ করে কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, এই গেরাম ছাইড়া আমি কোনওদিন যাইতে চাই নাই। এই গেরোমে আমার কেঐ নাই, খালি গেরামডা আছিলো আমার। গেরামের গাছগাছলা, বাড়িঘর, ক্ষেতখোলা, তোমগো লাহান কয়েকজন মানুষ আর ঐ গরুডি, এই হগল লইয়া এই গেরামে জীবনভর পইড়া থাকতে চাইছি আমি। অইলো না, এই গেরামে, তোমগো কাছে থাকন আমার অইলো না। গরুডির কাছে থাকন অইলো না। আইজ এই গেরাম ছাইড়া আমার যাইতে অইতাছে। তাও চোর অইয়া। মা, মাগো আমি কোনও দোষ করি নাই মা। কের লগে কোনওদিন খারাপ ব্যভার করি নাই, গাইল দেই নাই কেরে, মিছাকথা কই নাই। তাও আমার কপাল এমুন অইলো!

গভীর কষ্টের কান্নায় রুদ্ধ হয়ে এল কাশেমের গলা। মাথা নিচু করে চোখের পানি সামলাতে লাগল সে। ভেঙে ঝুলে পড়া ডানহাত অতিকষ্টে তুলে চোখ মুছতে চাইল। পারল না। তার আগেই দড়ি ধরা পুলিশকে মান্নান মাওলানা বললেন, যান আউগগান। কী হোনেন অর কথা! চোরে তো কত কথাই কয়!

মাকুন্দা কাশেমের কথা শুনে বুক তোলপাড় করছিল নূরজাহানের। চোখ ভরে আসছিল পানিতে। মান্নান মাওলানার কথা শুনে সেই ভাব কেটে গেল। বুকের ভিতর ফুঁসে উঠল তীব্র ঘৃণা। ইচ্ছা হল একহাতে মুঠ করে ধরে মান্নান মাওলানার দাঁড়ি, অন্যহাতে সর্বশক্তি দিয়ে একটার পর একটা থাবড় মারে তার দুইগালে। মেরে গাল মুখ ফাটিয়ে ফেলে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে, তুই তো মানুষ না। তুই অইলি শুয়োরের বাচ্চা। তুই অইলি কুত্তার বাচ্চা।

নূরজাহান তা করল না। ফণা তোলা জাতসাপের মতো একদৃষ্টে খানিক তাকিয়ে রইল মান্নান মাওলানার মুখের দিকে, তারপর কোনও কিছু না ভেবে মাকুন্দা কাশেমের মাথার উপর দিয়ে থু করে একদলা থুতু ছিটিয়ে দিল মান্নান মাওলানার মুখ বরাবর। থুতু গিয়ে লাগল মান্নান মাওলানার দুই ঠোঁটের ঠিক মাঝখানে। এমন আচমকা ঘটল ঘটনা, মান্নান মাওলানা স্তব্ধ হয়ে গেলেন। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন নূরজাহানের মুখের দিকে।

মাকুন্দা কাশেমের পিছনে দাঁড়ানো শয়ে শয়ে লোকও তখন মাওলানা সাহেবের মতন স্তব্ধ হয়ে আছে। স্তব্ধ হয়েছে দারোগা পুলিশরা, স্তব্ধ হয়েছে বেদম মার খাওয়া মাকুন্দা কাশেম। চোখে পলক ফেলতে ভুলে গেছে সবলোক, নড়তে ভুলে গেছে, শ্বাস ফেলতে ভুলে গেছে। যেন সাত আসমান ভেঙে মাথায় পড়ছে তাদের, যেন আশ্চর্য এক জাদুমন্ত্রে মাটির মতো মৌন হয়েছে তারা।

তখন প্রকৃতি ছিল প্রকৃতির মতন উদাস, নির্বিকার। শীতের বেলা তেজাল হচ্ছিল। তীক্ষ্ণরোদ উষ্ণ করে তুলছিল দেশ গ্রাম। স্বচ্ছ আকাশ ছুঁয়ে দূর নদীচরের দিকে উড়ে যাচ্ছিল ভিনদেশী পাখি। পথপাশের হিজল ছায়ায় বসে একাকী ডাকছিল এক ডাহুকী। আর বহুদূরের কোন অচিনলোক থেকে আসা উত্তরের হাওয়া বইছিল হু হু করে।

.

প্রথম পর্ব সমাপ্ত

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *