১.৫.১৭ জাহাঙ্গির (শাসনকাল : ১৬০৫ সাল থেকে ১৬২৭ সাল)

জাহাঙ্গির (শাসনকাল : ১৬০৫ সাল থেকে ১৬২৭ সাল)

আকবরের মৃত্যুর পর কে হবেন দিল্লির পরবর্তী শাসক? উত্তরাধিকারের প্রশ্নচিহ্ন দীর্ঘতর হয়। স্বভাবতই। খসরু শাহ, খসরু শাহ ছিলেন নুরুদ্দিন মোহম্মদ সেলিমের (জাহাঙ্গির) রাজপুত স্ত্রীর গর্ভজাত পুত্র এবং মানসিংহের ভাগিনেয়। খসরু ছিলেন সুদর্শন, আকবরের প্রিয় পাত্র, উদারপন্থী এবং আকবরের মতোই পরধর্মসহিষ্ণু। অতএব যোগ্যতার বিচারে সেলিমের তুলনায় অনেক গুণ এগিয়ে খসরু। আকবরেরও পছন্দ। কিন্তু আকবরের পছন্দ হলেই তো হবে না! দরবারের অভিজাতরা খসরুর দাবি সমর্থন করেনি। ফলে মানসিংহের দল সংখ্যালঘু হয়ে পড়ে। অবশেষে ১৬০৫ সালের ২১ অক্টোবর (হিজরি ১০১৪) আকবর তাঁর রাজকীয় পাগড়ি সেলিমের মাথায় পড়িয়ে দেন। আকবরের মৃত্যুর পর সেলিম ওরফে জাহাঙ্গির দিল্লির সিংহাসন অলংকৃত করেন। জাহাঙ্গিরের বয়স তখন ৩৮। জাহাঙ্গিরের স্ত্রীর সংখ্যা মন্দ নয়। স্ত্রীরা হলেন– নুরজাহান, শাহিব-ই-জামাল, তাজ বিবি মিলকিস, মাকানি সহ আরও ১৭ জন। সন্তানসন্ততি– খসরু, পারভেজ, শাহজাহান ও অন্যান্য। জাহাঙ্গিরের জন্ম ভারতের ফতেপুর সিক্রি, মৃত্যু ভারতের কাশ্মীরে। অর্থাৎ জাহাঙ্গির জন্মসূত্রেও ভারতীয়, মৃত্যুসূত্রেও ভারতীয়। আকবরের মতো জাহাঙ্গিরকে কখনোই বিদেশি শাসক বলা চলে না।

ব্রিটিশদের রচিত ইতিহাস’ নয়, জাহাঙ্গিরকে জানতে হলে জাহাঙ্গিরের লেখা জীবনী পড়তে হবে। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে ‘তারিখ-ই-সেলিম-শাহি’, তারিখ-ই-জাহাঙ্গিরনামা-সেলিমী’, ‘জাহাঙ্গিরনামা’, ‘তুজাক-ই-জাহাঙ্গিরী’, ‘দোয়াজিদা-সালা-জাহাঙ্গিরী’, ‘ওয়াকিয়াত-ই-জাহাঙ্গিরী’, ‘ইকবালনামা’ ইত্যাদি গ্রন্থগুলি জাহাঙ্গিরের আত্মজীবনী বলে চালানো হলেও, এগুলোর প্রামাণিকতা নিয়ে প্রচুর মতভেদ ও বিতর্কের অবকাশ আছে। যতদূর জানা গেছে, সম্রাট জাহাঙ্গির নিজেই তাঁর আত্মজীবনী কিছুকাল পর্যন্ত লিখেছিলেন। পরে অবশ্য মৌখিক নির্দেশ দিয়ে অন্য কারোর সাহায্যে সেই লেখা শেষ করার জন্য বলেছিলেন। তাঁর রাজত্বকালের ১২ বছরের বিবরণ সংবলিত আত্মকথা ‘দোয়াজদা-সালা-জাহাঙ্গিরী’ নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হওয়ার পর সম্রাটেরই মাধ্যমেই বিতরণ করা হয়। গ্রন্থখানি মূল ফারসি পাণ্ডুলিপি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন ব্রিটিশ অনুবাদক মেজর ডেভিড প্রাইস। ওরিয়েন্টাল ট্রানস্লেশন কমিটি ১৮২৯ সালে লন্ডন থেকে প্রথম প্রকাশ করে।

জাহাঙ্গির নিজেই লিখেছেন– “জাহাঙ্গির বাদশাহের অর্থ ‘পৃথিবী পদানতকারী সম্রাট’, আর জাহাঙ্গির শাহের অর্থ ‘পৃথিবী পদানতকারী রাজা’। শাহানশাহ আকবরের পুত্র, বিশ্বাসের প্রতীক জাহাঙ্গির, বিশ্বের প্রতিরক্ষক খসরু কর্তৃক আগ্রায় তৈরি’ –এই কথাগুলো সাম্রাজ্যের মুদ্রায় উত্তীর্ণ করার জন্য আমি ফরমান জারি করলাম।” আরও অনেক কিছু কোনো লুকোছাপা না করে অকপটে লিখেছেন তিনি। এমনকি তিনি যে তাঁর পিতা সম্রাট আকবরের সিংহাসনটি বহু অর্থব্যয়ে নতুনভাবে সাজিয়েছেন, সে কথাও তিনি উল্লেখ করতে ভোলেননি। সিংহাসন নতুন করে সাজাতে কত খরচ তিনি করেছিলেন, সেটা বলেছেন এইভাবে –“সিংহাসনের জালি মণিমাণিক্য দিয়ে তৈরি করতে ব্যয় হয়েছে দশ কোটি আশরফির মতো।এক একটি আশরাফি পাঁচ মিসকাল ওজনের। এক কোটি হল একশো লক্ষে, এক লক্ষ হল একশো হাজারে। তা বাদেও নকশা ও কারুকার্যে হিন্দুস্তানী ও জনমতে তিনশো মন সোনা লেগেছে। হিন্দুস্তানে এক মণ ইরাকে দশ মণের সমান। স্থান থেকে স্থানান্তরে নিয়ে চলাফেরার সুবিধার জন্য সিংহাসনটি এমনভাবে বানানো হয়েছে যে ইচ্ছামতো খণ্ড খণ্ড করে খুলে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো যায় এবং পরে জোড়া লাগানো যায়। সিংহাসনের পায়া ও পিঠের মধ্যে পঞ্চাশ মণ মৃগনাভি ভরে দেওয়া হয়েছে। তার দরুন যে-কোনো জায়গার দরবারে সুগন্ধের দরকার পড়ে না।” শুধু সিংহাসনই নয়, তিনি অকপটে লিখেছেন তাঁর মুকুটের বিবরণও। লিখছেন –“এভাবে আমার প্রত্যাশিত ও কাঙ্ক্ষিত সিংহাসনে বসে রাজকীয় মুকুট আনার হুকুম দিলাম। আমার পিতা মুকুটটি ইরানের মহান নৃপতিদের মুকুটের অনুকরণে বানিয়েছিলেন। তারপর সমবেত আমিরদের সামনে মুকুটটি আমি আমার ভ্রুর উপর পুরো এক ঘণ্টার জন্য স্থাপন করলাম। এর মানে হচ্ছে আমার রাজত্বকালের স্থায়ী সমৃদ্ধির লক্ষণ। মুকুটে বারোটি কোণ, প্রতিটি কোণে একটি করে রত্ন বসানো, তার দাম এক লক্ষ আশরফি, আর এই আশরফি পাঁচ মিসকাল পরিমাণের। পুরো মুকুটটিই আমার পিতা তাঁর সময়ে সরকারি সঞ্চয় থেকে কিনেছিলেন। পূর্ববর্তীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত ওয়ারিশসূত্রে প্রাপ্ত অর্থ থেকে নয়। মুকুটটির চূড়ার কেন্দ্রে একটি চার মিসকালের মুক্তো বসানো, তার দাম এক লক্ষ আশরফি, আর নানা জায়গায় বসানো দুশো রুবি, প্রতি রুবি এক মিসকাল পরিমাণের, প্রতিটির দাম দু-হাজার টাকা।”

১৬০৬ সাল। জাহাঙ্গিরের সিংহাসন লাভের বিরুদ্ধে খসরুকে বসানোর জন্য আকবরের মৃত্যুর কিছু আগে দরবারে মানসিংহ, মির্জা আজিজ কোকারা এক জোট গড়েন। তবে সেই পরিকল্পনা বিফল হয়। জাহাঙ্গির সিংহাসনে বসার পর পুত্র খসরুকে ক্ষমা প্রদর্শন করেন। কিন্তু খসরুকে আগ্রা দুর্গে নজরবন্দি অবস্থায় রাখেন। সেখান থেকে খসরু পালিয়ে গিয়ে মথুরার শাসনকর্তা হুসেন বেগের সঙ্গে যোগ দেন। লাহোর যাত্রার সময় সরকারি অর্থ লুঠ করার অপরাধে লাহোর দুর্গের শাসনকর্তা দিলওয়ার খাঁ খসরুকে বাধা দেয়। ফলে খসরু দুর্গ অবরোধ করে। এই খবর শুনে জাহাঙ্গির তাঁর সেনাদল নিয়ে লাহোর ছুটে আসেন। খসরু-বাহিনী বিধ্বস্ত হয়। সেলিম-পুত্র খসরু শাহ মোগল সেনাদের হাতে বন্দি হন এবং কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। খসরুর সহচরদের হত্যা করা হয়। ১৬০৭ সালে জাহাঙ্গিরকে হত্যা করার চক্রান্তে সম্রাটের নির্দেশে মহাবৎ খাঁ খসরুর দুই চোখ শরীর থেকে খুবলে নেয়। অবশ্য খসরুর প্রতি এ ধরনের নিষ্ঠুরতা জাহাঙ্গিরের চরিত্র কালিমালিপ্ত হয়। বস্তুত পিতামহ আকবরের ভাবধারা ও গুণাবলির প্রকৃত উত্তরাধিকারী ছিলেন খসরু শাহ। সেই কারণে খসরুর জনপ্রিয়তাও কিছু কম ছিল না। কিন্তু জাহাঙ্গিরের ক্রোধের সামনে দাঁড়ানোর ক্ষমতা কারোর ছিল না।

লাহোর যাত্রার পথে শিখগুরু অর্জুন খসরুকে সহানুভূতি জানান এবং অর্থ সাহায্য করেন। এ খবরে সম্রাট জাহাঙ্গির ক্রুদ্ধ হয় এবং শিখগুরুর কাছে আড়াই লক্ষ টাকা জরিমানা করেন। শিখগুরু অর্জুন সম্রাটকে জানান, তাঁর কাছে একটি পয়সাও নেই। যা আছে সেসব শিখপন্থের সম্পত্তি। সম্রাটের হুকুমে শিখগুরুকে কারারুদ্ধ করা হল এবং কারারক্ষীরদের অত্যাচারে গুরু অর্জুনের মৃত্যু হয়। ডাঃ ঈশ্বরীপ্রসাদের মতে, সম্রাট জাহাঙ্গির ক্রোধবশত ভুলে যান যে, সে সময় পাঞ্জাবে শিখধর্ম নব প্রেরণায় উদীয়মান হয়েছিল। ফলে তিনি এই ধর্ম এবং ধর্মের গুরুকে শ্রদ্ধা না-দেখিয়ে নির্যাতন করে শিখ সম্প্রদায়ের সঙ্গে মোগল-বিরোধের বীজ পুঁতে দেন। শিখগুরু হরগোবিন্দকেও গোয়ালিয়র দুর্গে ১২ বছর বন্দি করে করেছিলেন পিতা অর্জুনের প্রদেয় জরিমানা দিতে অসমর্থ হওয়ায়। জাহাঙ্গিরের শাসনকালে পাঞ্জাবের শিরহিন্দে শেখ আহমেদ শিরহিন্দের প্রভাবে এক গোঁড়া সুন্নি মৌলবাদী আন্দোলনের উদ্ভব হয়। ঈশ্বরীপ্রসাদ যাই-ই বলুন, মনে রাখতে হবে খসরু রাজদ্রোহী ছিলেন। রাজদ্রোহীকে যে বা যাঁরা আশ্রয় দেয় সেও রাজদ্রোহিতার সামিল। রাজদ্রোহিতার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। যেখানে পিতা হয়ে পুত্র খসরুকে শাস্তিপ্রদান করে রাজ্য থেকে বিতাড়ন করেছেন, সেই শিখগুরুদের কি উচিত হয়েছিল রাজদ্রোহী খসরুকে সঙ্গ দেওয়া?

জাহাঙ্গির সিংহাসনে বসার পর তাঁর পিতার মতোই রাজ্যবিস্তার নীতি ও সাম্রাজ্যে সংহতি রক্ষা নীতি মেনে চলেন! জাহাঙ্গিরের রাজত্বকালে পাঞ্জাবের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত কাংড়া বিজয় ছিল এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। কাংড়ার দুর্গ ছিল দুর্ভেদ্য ও পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত। এর কাছেই ছিল দেবীতীর্থ জ্বালামুখীর মন্দির। হাজার হাজার হিন্দু তীর্থযাত্রী এই মন্দিরে পুজো দিত। আকবরের আমলে কাংড়া দুর্গ জয়ের একবার ব্যর্থ চেষ্টা হয়েছিল। জাহাঙ্গির এই দুর্গ অধিকারের জন্য যুবরাজ খুররম ও রাজা বিক্রমজিৎকে নিয়োগ করেন। ১৪ বছর (চার মাস?) দুর্গ অবরোধ করার পর দুর্গটি মোগলদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। এছাড়া রাজা টোডরমলের পুত্র কল্যাণমল খদ্দার রাজা পুরুষোত্তমকে পরাস্ত করে ওড়িশা জয় করেন। এমনকি পুরুষোত্তমের কন্যাকে জাহাঙ্গির বিয়েও করেন। ‘ইন্তিখাব-ই জাহাঙ্গির শাহি’ থেকে জানা যায়, জাহাঙ্গির গুজরাটের একটি অপূর্ব সুন্দর নয়নাভিরাম জৈন মন্দির ধ্বংস করে জৈনদের দেশ থেকে উৎখাত করার নির্দেশ দেন এবং মন্দিরের মূর্তিগুলিকে মসজিদের প্রবেশপথে এমনভাবে রাখতে নির্দেশ দেন যাতে মুসলমান নামাজিরা মসজিদে প্রবেশ এবং বাইরে আসতে সেগুলিকে পদদলিত করতে পারে। জাহাঙ্গিরের পরিষদের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সৈয়দ খান চাগতাই একাই ১২০০ খোঁজাকৃত ক্রীতদাসের মালিক ছিলেন। স্মর্তব্য, সেসময় বাংলায় রাজস্ব পরিশোধে অপারগ পিতামাতারা আপন সন্তানদের খোঁজা করে গভর্নরকে দিত রাজস্বের পরিবর্তে। একথা জাহাঙ্গিরের স্মৃতিকথায় পাওয়া যায়। কে. এস. লাল দলিল দস্তাবেজ পর্যালোচনা করে লিখেছেন– জাহাঙ্গির শুধুমাত্র ১৬১৯ থেকে ১৯২০ সালেই ২,০০,০০০ বন্দিকৃত ভারতীয় ক্রীতদাসকে বিক্রির জন্য ইরানে পাঠিয়েছিলেন। ধর্মের ব্যাপারে তিনি ছিলেন এক অদ্ভুত রহস্যস্বরূপ। প্রকৃতপক্ষে তিনি কোন্ ধর্ম পালন করতেন সেই বিষয়ে বিভিন্ন মত আছে। তিনি একাধারে পরধর্মসহিষ্ণুতা এবং ধর্মোন্মত্ততার এক রহস্যময় সংমিশ্রণ। কোনো কোনো সময়ে পরধর্মের প্রতি চরম উদারতা প্রদর্শন, কখনো-বা অসহিষ্ণুতবশত চরমতম নিষ্ঠুর ছিল তাঁর চরিত্র। তাঁর দয়া ও মমত্ববোধের সীমা ছিল না, উলটোদিকে ক্রোধের বশবর্তী হলে নৃশংসতার চূড়ান্ত করতেও কুণ্ঠিত হতেন না। তবে জাহাঙ্গির তাঁর পিতার মতো কঠোর সুন্নি মুসলমান ছিলেন না। তিনি সর্বজনীন বিতর্কে বিভিন্ন ধর্মের মানুষদের অংশগ্রহণ করতে দিতেন। জাহাঙ্গির তার লোকদের কাউকে জোড়পূর্বক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বারণ করতেন। তিনি সকল প্রকার ধর্মের লোকেদের থেকে সমান খাজনা নিতেন। থমাস রো, এডওয়ার্ড টেরি সহ অনেকেই তাঁর এইপ্রকার আচরণের প্রশংসা করেন। থমাস বোর। মতে জাহাঙ্গির নাস্তিকতায় বিশ্বাসী ছিলেন।

সম্রাট জাহাঙ্গিরের শাসনব্যবস্থা কেমন ছিল? জাহাঙ্গিরের জীবনীতে স্পষ্ট করে লিখেছেন তাঁর শাসনব্যবস্থার হালহদিস। জীবনীর বয়ান অনুসারে জানা যায়, তিনি সাম্রাজ্য সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য ১২টি বিশেষ বিধি জারি করেছিলেন। সেই বিধিবিধান সাম্রাজ্যের বিভিন্ন কর্মচারীরা আচরণবিধি হিসাবে পালন করবেন। এর অন্যথা হতেই পারবে না। বারোটি বিশেষ বিধিগুলি হল –(১) আমি আমার প্রজাদের তিনপ্রকার কর থেকে অব্যাহতি দিলাম। সেই করগুলি হল– জাকাত, সাবমোহরি ও তমগা। আমার পিতার কোশাগারে ওই করগুলি থেকে মোলোশো মণ হিন্দুস্তানি ওজনের সোনা আসত। সেই সোনা ইরাকের ষোলো হাজার মণের সমান। (২) আমি আদেশ জারি করলাম যে, আমার শাসনভুক্ত অঞ্চলের কোনো ব্যক্তির সম্পত্তি যদি কেড়ে নেওয়া হয়, সে ডাকাতি কিংবা যে কোনো ব্যক্তির হিংসাত্মক কাজের মাধ্যমে হোক না, ওই জেলার অধিবাসীদের হয় সম্পত্তি ফেরত দিতে বাধ্য করা হবে, নয়তো লুণ্ঠনকারীকে হাজির করতে হবে। আমি নির্দেশ দিলাম যে, যদি কোনো জেলা পতিত কিংবা জনবসতি বিরল হয়ে উঠে, তাহলে সেখানে শহর তৈরি করতে হবে, জনসাধারণকে তালিকাভুক্ত করতে হবে এবং সমস্ত রকম পন্থা অবলম্বন করতে হবে, যাতে করে প্রজাদের নিরাপত্তা নিশ্চিদ্র হতে পারে। আমি জায়গিরদারদের আদেশ দিলাম তাঁরা যেন এইরূপ জনবিরল অঞ্চলে মসজিদ নির্মাণ করে এবং যাত্রীদের থাকার জন্য সরাইখানা তৈরি করে। এভাবেই জেলাটি পুনর্বার জনবসতিতে পূর্ণ হয়ে উঠবে এবং ভ্রমণকারীরা শঙ্কাহীন চিত্তে আনাগোনা করতে পারবে। এই উদ্দেশ্যে যেসব জেলা শাহি এক্তিয়ারভুক্ত, সেখানকার কর্মচারী ক্রোড়ীকে শাহি তহবিল থেকে এইসব কাজ করার জন্য আমি আদেশ প্রদান করলাম। (৩) দেশের ভিতর যেসব বণিক ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাঁদের সম্মতি ছাড়া তাঁদের বাক্সপেটরা কিংবা বস্তা যেন না খোলা হয়। কিন্তু যেক্ষেত্রে তাঁরা পণ্য বিক্রি করতে উৎসুক, সেক্ষেত্রে খরিদ্দাররা কোনো জোরজবরদস্তি না-করে তাঁদের সঙ্গে দরাদরি করতে পারবে। (৪) সরকারি কর্মচারী নয় এমন কোনো ব্যক্তি যদি সন্তানসন্ততি রেখে মারা যায়, সেক্ষেত্রে কারোকেই তাঁর সম্পত্তিতে হস্তক্ষেপ কিংবা তাঁর সন্তানসন্ততিদের উপর জবরদস্তি করতে দেওয়া হবে না। কিন্তু যদি সন্তানসন্ততি কিংবা কোনো ওয়ারিশ না থাকে, সেক্ষেত্রে সেই সম্পত্তি মসজিদ ও পুকুরের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য উৎসর্গ করে দেওয়া হবে, যাতে করে মৃত ব্যক্তির আত্মার চিরস্থায়ী সদগতির ব্যবস্থা হয়। (৫) কোনো ব্যক্তিকে মদ অথবা মাদকদ্রব্য তৈরি কিংবা বিক্রির অনুমতি দেওয়া হবে না। আমি নিজেই এই আদেশ জারি করলাম, যদিও ষোলো বছর বয়স থেকেই আমি অত্যধিক মদ্যাসক্ত। সত্যি কথা বলতে, তরুণ পার্শ্বচরদের সহচারিতা ও নমনীয় পরিবেশে দিনযাপন –বৃহৎ ও সুসজ্জিত কামরা, চিত্র ও ভাস্কর্যে সুশোভিত, মেঝেয় বিছানো সিল্ক ও সোনার মূল্যবান কার্পেট– সেই পরিবেশ থেকে চিত্ত উৎফুল্লকারী পানীয় প্রত্যাখ্যান করা বোকামির লক্ষণ হত না কি? আর দ্রাক্ষারসের মতো পানীয় আর কীই-বা হতে পারে? পানীয় বা আফিমের যেন আসক্তি না দেখা যায়। অমন হলে আল্লাহ না করুন, মানুষ তাঁর স্বভাবদত্ত ক্ষমতা হারিয়ে বসে। আর এ কথা স্বীকার করতেই হয়, অমন পানাসক্তি ও অত্যধিক আফিম-প্রীতি মানুষকে দুর্বল করে ফেলে, তাঁর প্রকৃতিকে শৌর্যবীর্য নাজুক করে দেয় ও বিকৃতি কামনা উন্মীলিত করে। উত্তেজক দ্রব্যের তালিকাভুক্ত সবকিছুর গুণাবলি ওই ধরনের। সেইসঙ্গে একথাও মনে না রেখে পারি না যে, কেলুরিকা হচ্ছে। থিরাবুকের ভাইপো। নিজের কথা বলতে গেলে এ স্বীকার করতেই হয় যে, আমার আসক্তির পরিমাণ এত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম যে, প্রতিদিন বিশ পেয়ালা, কখনো-বা বিশ পেয়ালারও বেশি পান করতাম। প্রতি পেয়ালায় ধরত আধ সের করে। আর আট পেয়ালা হল ইরাকের এক মণের সমান। ক্ষতির মাত্রা এতদূর গড়িয়েছিল যে, এক ঘণ্টা মদ ছাড়া থাকলে হাত কাঁপতে শুরু করত। (৬) আমার তাম্রাজ্যের কোনো প্রজার বাসভবনে কোনো ব্যক্তির জোর করে প্রবেশ করা চলবে না। সেনাবাহিনীর লোকেরা যদি কোনো শহরে আগমন করে এবং জোরজবরদস্তি ছাড়া ভাড়া দিয়ে কোনো থাকার জায়গা পায়, তাহলে তা প্রশংসার যোগ্য। তা নাহলে তাঁদের তাঁবু খাঁটিয়ে থাকার ব্যবস্থা করে নিতে হবে। প্রজার পক্ষে এই অভিযোগের চেয়ে বিরক্তিকর আর কিছুই নেই, যখন সে দেখে অজানা একজন লোক জোর করে তাঁর বাড়িতে ঢুকে সবচেয়ে ভালো জায়গাটির দখলি নিয়ে নেয়, তাঁর সন্তানসন্ততি পরিবার পরিজনদের তখন মাথা গোঁজার ঠাঁই পর্যন্ত থাকে না। (৭) যে অপরাধই হোক না কেন কোনো ব্যক্তির নাক কিংবা কান কাটা চলবে না। যদি চুরি করা অপরাধ হয়, তাহলে দোষীকে কাঁটায় ক্ষতবিক্ষত করতে হবে, নয়তো কোরান হাতে শপথ করতে হবে ভবিষ্যতে সে যেন আর চুরি না করে। (৮) প্রজাদের জমি জোর দখল না করার জন্য ক্রোড়ী ও জায়গিরদারদের নিষেধ করে দেওয়া হয়েছে, তাঁরা ওইসব জমি নিজেদের ক্ষমতায় সীমা লঙ্ঘন করতে পারবে না। অন্য জেলাভুক্ত মানুষ অথবা পশুপ্রাণীকে জোর করে নিজের জেলাভুক্ত করতে পারবে না। বরং যে জেলার ভার তাঁর উপর সেই জেলার চাষাবাদের উন্নতির দিকেই তাঁর সমগ্র শক্তি নিয়োজিত করতে হবে। (৯) গ্রন্থটিতে এই ধারাটি বেশ দুর্বোধ্য। তবে মনে হয় ধারাটিতে প্রতিষেধক কিংবা আফিমের অবৈধ প্রয়োগের উপর বিধিনিষেধ আরোপের কথা উল্লেখ আছে। অথবা খুব সম্ভব ওই বিধিনিষেধ কীভাবে প্রয়োগ করা হবে, তার নিদান আছে। (১০) বড়ো শহরগুলির সমস্ত গভর্নরদের নির্দেশ দেওয়া হল যে তাঁরা যেন পীড়িতদের চিকিৎসার সুবন্দোবস্তের জন্য হাসপাতাল কিংবা আরোগ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করেন। অসুখ হলে তাঁদের এখানে স্থানান্তরিত করতে হবে। রোগী সুস্থ না-হওয়া পর্যন্ত সব খরচপত্র সরকারি খাজাঞ্চীখানা থেকে দেওয়া হবে। সুস্থ হয়ে উঠলে সংকটকালের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ দিয়ে তাঁকে বিদায় দিতে হবে। (১১) আমার জন্মমাস রবিউল আউয়ালে গ্রামে নগরে গোশত খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করা নিষিদ্ধ করে দেওয়া হল এবং বছরের সমতা রেখে একদিন নির্ধারিত হল। সেইদিন পশু জবেহ একেবারে নিষিদ্ধ হল। সপ্তাহে বৃহস্পতিবার, সেদিন আমি সিংহাসনে আরোহণ করেছিলাম বলে গোশত গ্রহণ নিষিদ্ধ করে দেওয়া হল। আর রবিবার পৃথিবী সৃষ্টির সম্মানিত দিন বলে পশুজবেহ সংগত নয়। এগারো বছরেরও বেশি আমার পিতা আহারে এই সংযম পালন করে এসেছিলেন। ওই সময়ে রবিবারে তিনি কোনোমতেই গোশত গ্রহণে রাজি হতেন না। এই কারণেই ওইদিন আমার রাজ্যজুড়ে অমন খাদ্যগ্রহণ নিষেধ করে দেওয়া আমি সংগত মনে করেছিলাম। (১২) আমার পিতার শাসনকালে যেসব আমির ওমরাহ সম্মান ও শিরোপা পেতেন, সেসব আমি অব্যাহত রাখার জন্য নির্দেশ জারি করলাম এবং যেসব ক্ষেত্রে যোগ্যতা পরিলক্ষিত হল সে সব ক্ষেত্রে বিভিন্ন পর্যায়ে পদোন্নতির আদেশ দিলাম। দশ ঘোড়ার মালিককে পনেরো ঘোড়ার মালিকানা দিলাম এবং এভাবে সমতা বজায় রেখে সাম্রাজ্যের উচ্চতম আমিরদের সম্মানে ভূষিত করলাম।

কারোকে জানতে হলে তাঁর নিজের লেখা জীবনীটা পাঠ করতে হয়। তবে অন্যের লেখা জীবনীতে কিছু অতিরঞ্জিত থাকেই। জাহাঙ্গিরের জীবনী কোথাও একটি লাইন পেলাম না, যেখান থেকে সনাক্ত করা যায় যে, তিনি একজন হিন্দু বা বিধর্মী-বিদ্বেষী। একটি লাইন পেলাম না, যেখান থেকে সনাক্ত করা যায় যে, তিনি হিন্দুদের ধরে ধরে ইসলামের ছায়াতলে আনার নির্দেশ দিয়েছেন। একটি লাইন পেলাম না, যেখান থেকে সনাক্ত করা যায় যে, তিনি হিন্দুদের মন্দির গুঁড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। একটি লাইন পেলাম না, যেখান থেকে সনাক্ত করা যায় যে, তিনি হিন্দুদের অত্যাচার ও নির্যাতন করার নির্দেশ দিয়েছেন। তাঁকে ঠিক আদর্শ শাসক বলা না-গেলেও অত্যাচারী ও ধর্মান্ধ শাসক কোনোভাবেই বলা যায় না। শুধু জাহাঙ্গিরের জীবনেই নয়, জাহাঙ্গির বিষয়ক যত দেশি-বিদেশি বই পড়েছি, কোথাও তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পাইনি। এক-আধজন অত্যাচারী শাসককে সামনে রেখে সমগ্র শাসকদের অত্যাচারীর তকমা লাগানো গর্হিত অন্যায়। শাসকের কোনো ধর্ম-পরিচয় হয় না। শাসকের কোনো জেন্ডার হয় না। শাসক শাসকই হয়। সম্পূর্ণ ভালো শাসক যেমন হয় না, তেমনি সম্পূর্ণ মন্দ শাসকও হয় না।

অনেক ভালো গুণ থাকা সত্ত্বেও, মদ্যপান ও নারী এই দুই আসক্তির জন্য জাহাঙ্গির সমালোচিত হন। কোনো এক শাসকের শুধুমাত্র খারাপ দিকই থাকে না, ভালোর দিকও থাকে –সে যে ধর্মাবলম্বীর শাসকই হোক না-কেন। কেন-না শাসকের কোনো ধর্ম-পরিচয় হয় না। শাসকের পরিচয় শাসক। বস্তুত জাহাঙ্গির ছিলেন ক্রিয়েটিভ শাসক। শাসন ও বিচারবব্যস্থা নিয়ে তিনি গঠনমূলক চিন্তাভাবনা করতেন। ভাবতেন তাঁর শাসনের সুফল নিয়ে কীভাবে প্রজাদের কাছাকাছি যাওয়া যায়। সেই কারণে তিনি বিচারের ব্যাপারে ব্যক্তি ও ব্যক্তির পরিচয়ের মধ্যে কোনো তফাত রাখতেন না। ধনী, দরিদ্র সকলেই যাতে তাঁর কাছে সরাসরি বিচারপ্রার্থী হতে পারে সেজন্য তিনি ষাটটি ঘণ্টাযুক্ত একটি সোনার শিকল প্রস্তুত করে সেটা আগ্রার প্রাসাদ থেকে যমুনা নদীর তির পর্যন্ত ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন। এই শিকল টানলেই বিচারপ্রার্থীর আবেদন সম্রাটের কাছে পৌঁছে যেত। জাহাঙ্গিরই সর্বপ্রথম লিখিত বারোটি আইন প্রণয়ন করেছিলেন।

জাহাঙ্গির শিল্প, বিজ্ঞান এবং স্থাপত্য সেইসঙ্গে মুগ্ধ হয়ে তরুণ বয়স থেকেই চিত্রকলার প্রতি ঝোঁক দেখিয়েছেন এবং তাঁর নিজের একটি কর্মশালাও ছিল। মোগল চিত্রকলা, শিল্প জাহাঙ্গিরের শাসনামলে মহান উচ্চতায় পৌঁছেছিল। তাঁর সময় উস্তাদ মনসুর জন্তু ও পাখির ছবি এঁকে বিখ্যাত হন। জাহাঙ্গিরের ছিল একটি বিশাল পক্ষিশালা ও পশুশালা। জাহাঙ্গির ইউরোপীয় এবং ফারসি শিল্পকলাকেও ভালোবাসতেন। তিনি ফারসি রানি নুরজাহান দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তাঁর সাম্রাজ্য জুড়ে ফারসি সংস্কৃতি প্রচার করেন। তাঁর সময়েই শালিমার গার্ডেন তৈরি হয়। জাহাঙ্গিরের মৃত্যুর পর বিভিন্ন গল্প, সিনেমা ও সাহিত্যে তাঁর ও আনারকলির রহস্যে ভরা সম্পর্ক স্থান পায়। কিছু সত্য বটে, অনেকটাই বনোয়াট।

১৬২২ সালে জাহাঙ্গিরের পুত্র খুররম প্রথম বিদ্রোহ করেন পিতার বিরুদ্ধে। এমন বিদ্রোহ অবশ্য ইতিহাসে প্রথম নয় –স্বয়ং জাহাঙ্গিরই পিতা আকবরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন, তৈমুর বংশে পিতার বিরুদ্ধে পুত্রের বিদ্রোহের বহু নজির আছে। ১৬২৬ সালে জাহাঙ্গিরের বিশাল সেনাবাহিনীর কাছে কোণঠাসা হয়ে তিনি নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণ করেন। শাহজাদা খুররমের বিদ্রোহ দমনের পর জাহাঙ্গির একে একে মহবত খান (১৬২৫), মুকাররম খান (১৬২৬) এবং ফিদাই খানকে (১৬২৭-২৮) বাংলার সুবেদার পদে নিযুক্ত করেন। তাঁদের শাসনকাল ছিল সংক্ষিপ্ত এবং ঘটনাবিহীন। ১৬২৭ সালে কাশ্মীর থেকে ফিরে আসার পথে জাহাঙ্গীরের মৃত্যু হয় এবং লাহোরের নিকটে শাহদারাতে তাঁকে সমাহিত করা হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *