শের শাহ সুরি (শাসনকাল : ১৪৮৬ সাল থেকে ১৫৪৫ সাল)
দিল্লির সুলতানির পতন আসন্ন হলে ষোড়শ শতকে ভারতের রাজনৈতিক ভাগ্য কয়েকজন দুঃসাহসিক, উচ্চাকাঙ্ক্ষী অভিযানকারীদের নিয়ন্ত্রিত হয়। পথপ্রদর্শক বাবর তো বটেই, বাবরের মৃত্যুর পর শের শাহের অভ্যুত্থান ঘটে। এই সময়ে সাহসী ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী লোকেরা তরবারি সম্বল করে ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তার করেন। বাবর আফগানিস্তান থেকে এসে যেমন তরবারির দ্বারা সাম্রাজ্য গড়েন, তেমনই শের শাহও বিহারের সামান্য জায়গিরদার থেকে তরবারির মাধ্যমে সাম্রাজ্য বিস্তার করেন। শের শাহ সুরি ছিলেন মধ্যযুগীয় দিল্লির একজন শক্তিশালী আফগান (পাশতুন) বিজয়ী। একজন সাধারণ সেনাকর্মচারী হয়ে নিজের কর্মজীবন শুরু করে পরবর্তীকালে তিনি মোগল সম্রাট বাবরের সেনাবাহিনীর সেনানায়কের পদে উত্তীর্ণ হন। শেষপর্যন্ত তাঁকে বিহারের শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হয়। ১৫৩৭ সালে নতুন মুঘল সম্রাট হুমায়ুন যখন অন্যত্র অভিযানে ব্যস্ত ছিলেন, সেই সময় শের শাহ সুরি বাংলা জয় করে সুরি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন এবং নিজেকে নতুন সম্রাট ঘোষণা করেন।
শের শাহ সুরি কেবলমাত্র একজন মেধাবী রণকৌশলবিদই ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন দক্ষ প্রশাসক ও যোগ্য সেনানায়ক। তাঁর সাম্রাজ্য পুনর্গঠনের মধ্যেই পরবর্তীকালের (বিশেষত হুমায়ুন-পুত্র আকবরের) মোগল সাম্রাজ্যের মূলভিত্তিটি নিহিত ছিল। ১৫৪০ থেকে ১৫৪৫ সালের মধ্যবর্তী সময়ে তাঁর পাঁচ বছরের স্বল্পকালীন রাজত্বে তিনি নাগরিক ও সামরিক প্রশাসনের এক নতুন ধারার সূচনা ঘটিয়েছিলেন। তিনি প্রথম ‘রুপিয়া’ নামক মুদ্রার প্রচলন করেন, যা বিংশ শতাব্দী অবধি চালু ছিল। তিনি ‘মোহর’ নামে ১৬৯ গ্রেন ওজনের স্বর্ণমুদ্রা ও ‘দাম’ নামে তাম্রমুদ্রাও চালু করেন। জনকল্যাণের লক্ষ্যে তিনি জনগণকে ধর্মীয় গোড়ামি থেকে রক্ষা করেন। এককথায় বলা যায়, শেরশাহ ছিলেন পরধর্মসহিষ্ণু। তিনি হিন্দুদের উচ্চ রাজপদে নিযুক্ত করেছিলেন। এছাড়া তিনি ডাকব্যবস্থারও আমূল সংস্কার করেন। তিনি হুমায়ুনের দিনপনাহ শহরের উন্নতি ঘটান এবং এর নতুন নামকরণ করেন শেরগড়। আবার খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দী থেকে পতনোন্মুখ পাটনা শহরেরও পুনরায় সংস্কার করেন। শের শাহের আসল নাম ফরিদ খান। বাহার খানের অধীনে চাকরি করার সময় শের খানের গুণপনায় বাহার খান মুগ্ধ হন। কথিত আছে, ভারতের কোনো এক জঙ্গলে তিনি একটি পূর্ণবয়স্ক বাঘকে সম্পূর্ণ খালি হাতে হত্যা করেছিলেন। সাহসিকতা দেখে বাহার খান তাঁকে ‘শের খান’ উপাধি দেন। গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড (সড়ক-এ-আজম) শের শাহ সুরির অমর কীর্তি। এটি সোনাগাঁও থেকে সিন্ধু পর্যন্ত ৩০০০ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। আজও ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রে এই সড়ক অন্যতম প্রধান রাস্তা। এই সড়কের ভারতের অংশটি বর্তমানে ‘স্বর্ণ চতুর্ভূজ’ প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
১৫৪৫ সালে চান্দেল রাজপুতদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় কালিঞ্জর দুর্গে বারুদের বিস্ফোরণে শের শাহ সুরির মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র জালাল খান ইসলাম শাহ সুরি নাম গ্রহণ করে সুরি সাম্রাজ্যের সিংহাসনে বসেন। সাসারামে একটি কৃত্রিম হ্রদের মাঝখানে তাঁর ১২২ ফুট উঁচু নয়নাভিরাম সমাধিসৌধটি আজও বিদ্যমান। তাঁর মৃত্যুর পর হুমায়ুনের নেতৃত্বে ভারতে মোগল সাম্রাজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। আকবরের রাজত্বকালে ১৫৮০ সালে আব্বাস খান সারওয়ানি নামে মোগল সম্রাটের এক ‘ওয়াকিয়া-নবিশ তারিখ-ই-শের শাহি’ নামক গ্রন্থে শের শাহ সুরির রাজত্বকালের বিস্তারিত ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেন।
১৫৩৮ সালে গৌড় বিজয় করে শেরশাহ্ বাংলার আফগান শাসন প্রতিষ্টা করেন। শেরশাহের উত্তরোত্তর শক্তি বৃদ্ধিতে শঙ্কিত হয়ে বিহারের আমিররা সম্মিলিতভাবে বাংলার সুলতান মাহমুদকে শের শাহের বিরুদ্ধে আক্রমণের জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। ১৫৩৪ সালে তাঁদের পরাজিত করেন। ফলে বিহার অঞ্চল পূর্ণরূপে তাঁর হস্তগত হয়। ১৫৩৭ সালে শেরশাহ পুনরায় বাংলা আক্রমণ করে গৌড় অধিকার করেন। ১৫৩৮ সালে মাহমুদ শাহকে পরাজিত করে মোগল সম্রাট হুমায়ুন ১৫৩৭ সালে চুনার দুর্গ আক্রমণ করে দখল করে নেন এবং শেরশাহের ভিন্ন পথে আক্রমণ করে বারাণসী জৌনপুর ও হুমায়ুনকে পরাজিত করেন এবং হুমায়ুন ফিরে যান আগ্রায়। ১৫৪০ সালে হুমায়ুন পুনরায় আক্রমণ করলে শের শাহ হুমায়ুনকে পরাজিত করেন। ফলে শেরশাহ দিল্লি আগ্রা জৌনপুর বারাণসী, বিহার ও বাংলাদেশের সম্রাট হন। তিনি ছিলেন স্বৈরাচারী শাসক, তবে তিনি প্রজাহিতৈষী ছিলেন। উঁচু-নিচু সকলের জন্যই সমান ছিলেন। সকলের সুপথে সুবিধার প্রতি তাঁর তীব্র দৃষ্টি ছিল। শাসনের সুবিধার্থে সমস্ত রাজ্য ৪৭টি সরকার ও প্রতিটি সরকার কয়েকটি পরগনায় বিভক্ত করেছিলেন। দক্ষ শাসক হিসাবে শের শাহের সুনাম আছে। শের শাহের বিচারব্যবস্থা জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সাম্য ও ন্যায়নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। বিচার ব্যবস্থা মুসলমান আইনের নিয়ম অবকাশ ছিল না। চুরি ডাকাতির জন্য প্রায়ই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত। প্রাকৃতিক দূর্যোগে ফসল নষ্ট হলে তিনি রাজস্ব মুকুব এবং কৃষি ঋণের ব্যবস্থা করতেন। এক্ষেত্রে তিনি সুলতান আলাউদ্দিন খলজির রাজনীতিকেই সম্প্রসারণ করেন। কিন্তু তাঁর সুশাসনের অন্য একটা চিত্রও আছে বলে অনেক ঐতিহাসিকরা মনে করেন। বস্তুত ‘সুশাসক’ হয়েও মহাজনেরা যে পথে গেছেন শের শাহও সেই পথেই ছিলেন। প্রচুর হিন্দুরাজার সঙ্গে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করে তাঁদের পরাজিত ও হত্যা করে। রায়সিনের হিন্দুরাজা পূরণমল এবং রোহতাসের হিন্দুরাজা হরেকৃষ্ণকে তিনি সেইভাবেই পরাজিত করেছিলেন। তবে শের শাহ মূলত তাঁর জনকল্যাণমূলক শাসনব্যবস্থার জন্য স্মরণীয় আছেন। তিনি ছিলেন একাধারে সংস্কারক ও উদ্ভাবক। তাঁর সমস্ত প্রথা মৌলিক না-হলেও প্রাচীন ব্যবস্থাগুলিতে তিনি নতুন প্রাণশক্তি দেন। তিনি আলাউদ্দিন খলজির সামরিক ব্যবস্থাকে অনুসরণ করতেন। তাঁর বিখ্যাত রাজস্বব্যবস্থাও পুরোপুরি মৌলিক ও উদ্ভাবন ছিল না। কিন্তু নিজ ব্যক্তিত্ব ও দক্ষতার জোরে তিনি প্রশাসনযন্ত্রে নতুন বেগ সৃষ্টি করে। তিনি নিজেকে জনসাধারণের ‘অভিভাবক’ বা ‘পালক’ বলে মনে করতেন। এর ফলে রাজকীয় অধিকারের সঙ্গে রাজকীয় কর্তব্যবোধ জড়িয়ে গেল।
কিছু কিছু ঐতিহাসিক শের শাহের কর্তৃক হিন্দুহত্যা (পড়ুন প্রতিপক্ষ হত্যা) নিয়ে যাই বলুন –শের শাহ মাত্র ৫ বছর রাজত্বে ধর্মনিরপেক্ষ, পক্ষপাতদুষ্টহীন শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের চেষ্টা করেছিলেন। যদিও তিনি ব্যক্তিগত জীবনে নিষ্ঠাবান সুন্নি মুসলমান ছিলেন, কিন্তু তাঁর শাসন গোঁড়ামি দ্বারা প্রভাবিত ছিল না। রায়সিন দুর্গ অধিকার ও মারবাড়ে যুদ্ধের সময় তিনি নিতান্তই সামরিক ও রাজনৈতিক প্রয়োজনে সংগ্রাম (জিহাদ) ঘোষণা করেন। কিন্তু এই সংগ্রামী মনোভাব তাঁর শাসননীতিকে কোনোরূপ প্রভাবিত করেনি। শের শাহ তাঁর আফগান সর্দারদের ঔপজাতিক, সংকীর্ণ মনোভাবের ঊর্ধ্বে ছিলেন। তিনি বিলক্ষণ জানতেন তাঁর প্রজাদের বেশিরভাগই অ-মুসলিম এবং অ আফগান। তাই তিনি তুর্কি-আফগান প্রথাগুলিকে ভারতীয় সংস্কৃতির সামঞ্জস্য রেখে প্রবর্তন করেন। শের শাহ একটি মধ্যপন্থা, ধর্মসহিষ্ণু নীতি নিয়েছিলেন। তিনি উলেমা-প্রভাব সম্পূর্ণভাবে ত্যাগ করতে না-পারলেও অনেকটা। নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর অন্যতম হিন্দু-সেনাপতি ব্রহ্মজিৎ গৌর। বস্তুত শের শাহের শাসনব্যবস্থায় হিন্দুদের ‘টাইট’ দেওয়ার জন্য কোনোরূপ বৈষম্যমূলক আইন প্রণয়ন হয়নি। জিজিয়া কর লুপ্ত করতে পারেননি ঠিকই, কিন্তু এই জিজিয়া কর নেওয়া হত অ-কৃষি কর হিসাবে –ধর্মকর হিসাবে নয়।
শের শাহ সড়কের ধারে যাত্রীদের বিশ্রামের জন্য সরাইখানা স্থাপন করেন। সরাইখানাগুলি কেবলমাত্র যাত্রীদের বিশ্রামের কাজে লাগত না, বণিকরা তাঁদের মাল এখানেই বিনিময় করত। প্রায় ১৭০০ সরাইখানা তিনি স্থাপন করেন। শের শাহ জাতিধর্মনির্বিশেষে দরিদ্র প্রজাদের জন্য দাঁতব্য বিভাগ খোলেন। অন্ধ, অশক্ত, বৃদ্ধ, বিধবাদের জন্য সরকারি খয়রাতের ব্যবস্থা করেন। তিনি প্রতি বছর সেই যুগে ১৮,২৫,০০০ টাকা খয়রাতি খাতে খরচ করতেন।
এই মহান সম্রাট মাত্র পাঁচ বছরের শাসনকালে যে অসাধারণ প্রতিভা ও যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছিলেন, সেই ইতিহাস বিশ্ব-ইতিহাসে দুর্লভ। ইউরোপে অষ্টাদশ শতকে যে কজন রাজা অবাধ ক্ষমতার অধিকারী হয়েও পরিশ্রম করতেন তাঁদের সঙ্গে শের শাহের তুলনা করা চলে। শেরশাহ নিঃসন্দেহে মুসলমান শাসকদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ। তাঁর শুধু বড়ো হওয়ার আকাঙ্ক্ষাই ছিল না, চেষ্টাও ছিল। ভারত ও বিশ্বের ইতিহাস শের শাহ সুরিকে কোনোদিন ভুলবে না।