মোহম্মদ বিন তুঘলক (শাসনকাল : ১৩২৫ সাল থেকে ১৩৫১ সাল)
তুঘলক বংশের এক বিতর্কিত শাসক মোহম্মদ বিন তুঘলক। ধারণকৃত নাম জুনা খাঁ মোহম্মদ আদিল বিন তুঘলক শাহ। আসল নাম মালিক ফখরুদ্দিন। গিয়াসুদ্দিন তুঘলক ছিলেন এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা। গিয়াসুদ্দিন তুঘলকের জ্যেষ্ঠপুত্র ছিলেন মোহম্মদ বিন তুঘলক। যাঁর কীর্তির কথা স্মরণে রেখে প্রবাদ-প্রবচন হয়ে গেল ‘তুঘলকি কাণ্ড। অর্থাৎ অস্থির বা খামখেয়ালি শাসকের কাজ। মোহম্মদ বিন তুঘলকের শাসনকাল ১৩২৫ থেকে ১৩৫১ সাল পর্যন্ত। ভারতে তুঘলক সাম্রাজ্যের আয়তনের বিস্তৃতি ছিল ৩২,০০,০০০ বর্গকিলোমিটার। রাজধানী ছিল দিল্লি। বর্তমানে সেই বিস্তৃত সাম্রাজ্য ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, বাংলাদেশে বিভাজিত হয়ে আছে। আশ্চর্যরকমভাবে বিন তুঘলকের বিরুদ্ধে হিন্দুদের কচুকাটা করা, মন্দির ধ্বংস করা, জোরপূর্বক ইসলামে ধর্মান্তরিত করা ইত্যাদি অপবাদ আরোপ করা হয়নি। তবে তাঁকে ‘পাগল রাজা’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। কেন তাঁকে পাগল রাজা বলা হয়? তিনি কি সত্যিই পাগল ছিলেন? কী ছিল তাঁর পাগলামি? শুধু পাগল নয়, বিকৃত ও রক্তলোলুপ বলেও তাঁকে আখ্যায়িত করা হয়। তাঁর দীর্ঘ ২৬ বছরের শাসনকালে যে চারটি কাজেই পরিমাণদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। মূলত চারটি কারণেই বিন তুঘলককে এইসব বিশেষণে ভূষিত করা হয়েছে– (১) রাজ্যজয়ের পরিকল্পনা, (২) দেবগিরিতে রাজধানী স্থানান্তরকরণ, (৩) দোয়াব এলাকায় করভার স্থাপন এবং (৪) তাম্রমুদ্রার প্রচলন। এগুলির মধ্যে কতটা পাগলামি ছিল মোহম্মদ বিন তুঘলকের?
‘পাগলা রাজা’— এমন বললে তো বহু শাসকেই এসব বিশেষণে ভূষিত করা যায়। যেমন পশ্চিমবঙ্গে মুখমন্ত্রী জ্যোতি বসুর প্রাথমিকে ইংরেজি ভাষা তুলে দিয়ে তেরো বছর পর পুনরায় তা ফিরিয়ে আনা, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মন্ত্রীসভায় আলোচনা না-করে কালো টাকা ও জাল টাকা ধরার নামে অত্যন্ত গোপনে বিমুদ্রাকরণ চালু করে দেশের কোটি কোটি সাধারণ মানুষকে প্রতিদিন লাইনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া ইত্যাদি। এগুলি কি ‘তুঘলকি’ নয়? বিন তুঘলকের কাজের বিশ্লেষণ আল্লামা গোলাম আহমাদ মোর্তাজার পর্যবেক্ষণে দেখতে পারি। কতটা যৌক্তিকতা আছে, তা অনুধাবন করার দায়িত্ব আপনাদের উপর ছেড়ে দিলাম।
(১) রাজ্যজয়ের পরিকল্পনা : বিন তুঘলক খোরাসান দখল তথা জয়ের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। প্রস্তুতি হিসাবে তিনি প্রায় ৩,৭০,০০০ সৈন্য সংগ্রহ করেছিলেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে মোহম্মদ বিন তুঘলক সেই সিদ্ধান্ত বাতিল করেন। ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বারনির মতে, এই সিদ্ধান্ত বাতিল আসলে বিন তুঘলকের অদূরদর্শিতার অভাব। সত্যিই কি অদূরদর্শিতার অভাব ছিল? সিদ্ধান্ত বাতিলের প্রকৃত কারণ ছিল –যে সময় বিন তুঘলক খোরাসান অভিযানের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তখন পারস্য ও মিশরের মধ্যে সম্পর্ক খুবই খারাপ, ছিল উভয়পক্ষের মধ্যে চরম মনোমালিন্য। কিন্তু পরিকল্পনার মাঝেই পারস্য ও মিশরের মধ্যে হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। সৈন্য সংগ্রহ করতে গিয়ে প্রচুর রাজস্ব অপচয় হলেও এমতাবস্থায় যুদ্ধ থেকে বিরত থাকাই মোহম্মদ বিন তুঘলক সমীচীন মনে করেছিলেন। রাজস্ব নষ্ট হলেও প্রচুর রক্তপাত হওয়া থেকে বিরত থাকা বিন তুঘলকের শান্তিকামী মানসিকতারই পরিচয় পাওয়া যায়। শুধুই কি রাজস্বের অপচয়? মোটেই না। যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসাবে যে অনভিজ্ঞ প্রজাদের দক্ষ সৈনিক তৈরি করতে করেছিলেন। এই লাভটাকে তো ফেলে দেওয়া যায় না।
বলা হয় মোহম্মদ বিন তুঘলক চিন অভিযান করেছিলেন। বাস্তবিক বিন তুঘলকের চিন অভিযানের কোনো নথি পাওয়া যায় না। তিনি স্বপ্নেও কোনোদিন চিন অভিযানের কথা ভাবেননি। যে অভিযান তিনি করেছিলেন, সেটা হল। চিন-ভারত সীমান্তে কারাচল ও কুর্মাচল অঞ্চলে। এই অভিযানের ফলে কারাচলের রাজা বিন তুঘলকের সান্নিধ্য স্বীকার করেন।
(২) দেবগিরিতে রাজধানী স্থানান্তরকরণ : দিল্লি থেকে দেবগিরিতে রাজধানী স্থানান্তরের ঘটনাটি মোহম্মদ বিন তুঘলককে সবচেয়ে বেশি কলঙ্কিত করেছে। বলা হয়েছে, দিল্লির জনসাধারণদের শাস্তি দেওয়ার জন্যই সুলতানের মাথায় এহেন কুটবুদ্ধি এসেছিল। এর ফলে প্রচুর অসহায় মানুষ দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে না-পেরে মৃত্যুমুখে ঢলে পড়েছিল, অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। এ কাহিনি ভিত্তিহীন, সত্যের অপলাপ। পিতা গিয়াসুদ্দিন তুঘলকের শাসনকালে বরঙ্গল অভিযানে নিযুক্ত থাকার সময় তিনি বুঝতে পারেন এখানে কিছু জটিলতা আছে। পিতার মৃত্যুর পর সিংহাসন লাভ করে মোহম্মদ বিন তুঘলক দাক্ষিণাত্যের জটিলতাকে মুক্ত করতে দেবগিরির দৌলতাবাদে একটি রাজধানী গড়ে তোলার কথা ভেবেছিলেন। দাক্ষিণাত্যের শাসনকার্য যথাযথভাবে পরিচালনার সুবিধার্থে অপেক্ষাকৃত মধ্যবর্তী ও অধিকতর নিকটবর্তী অঞ্চল ছিল দৌলতাবাদ। দিল্লিতে বসে যেটা ছিল একেবারেই অসম্ভব। তাছাড়া দিল্লি ভারত সীমান্তের কাছাকাছি হওয়ায় মোঙ্গলদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। রাজধানী স্থানান্তর প্রসঙ্গে ইবনে বতুতা তাঁর ভারতভ্রমণে লিখেছেন— দিল্লিবাসীদের তল্পিতল্পা নিয়ে ৭০০ মাইল পথ অতিক্রম করে দৌলতাবাদ যেতে বাধ্য করেছিলেন। পথে অনেক শিশুবৃদ্ধবৃদ্ধা মৃত্যুবরণ করেন। ফলে দিল্লি মরুভূমিতে পরিণত হয়। ইবনে বতুতা প্রত্যক্ষদর্শী নন। তাই আষাঢ়ে গল্প ফেঁদে রেখেছেন। সমসাময়িক লিপিতে এ ধরনের কাহিনির কোনো সমর্থন মেলে না। সুলতান কখনোই প্রজাদের দিল্লি ত্যাগ করতে বাধ্য করেননি। কেনই-বা বাধ্য করতে যাবেন অনর্থক? ব্রিটিশরাও তো রাজধানী কলকাতা থেকে সরিয়ে দিল্লি নিয়ে গিয়েছিল। কলকাতাবাসীদের কি দিল্লি যেতে বাধ্য করেছিল? ব্রিটিশের কলকাতা যেমন রাজধানীর মর্যাদা হারায়নি, ঠিক তেমনি দিল্লিও সেসময় রাজধানীর মর্যাদা হারায়নি। কারণ মোহম্মদ বিন তুঘলক রাজধানী স্থানান্তর করেছিল বলা হলেও তিনি মোটেই রাজধানী স্থানান্তর করেননি। দিল্লি যেমন রাজধানী ছিল তেমনই ছিল। দাক্ষিণাত্যে শাসনকার্যের সুবিধার জন্য দৌলতাবাদে দ্বিতীয় একটি রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। যেমন কাশ্মীরের শীতকালীন ও গ্রীষ্মকালীন দুটি পৃথক রাজধানী আছে। সব মানুষকে যদি সত্যিই দিল্লি থেকে সরিয়ে দৌলতাবাদে যেতে বাধ্য করাত, তাহলে ১৩২৯ সালে মুলতানে যে বিদ্রোহ ঘোষিত হয়েছিল, তার মোকাবিলা সম্ভব হত না। তবে দিল্লি থেকে দিল্লিবাসীদের দৌলতাবাদে কারোকেই পাঠাননি, তা কিন্তু নয়। সে সময় দাক্ষিণাত্যের মুসলমান সম্প্রদায়ের ধর্মবিমুখ হয়ে অত্যাচারী সম্প্রদায়ে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। তাঁদেরকে আলোর পথে ফিরিয়ে আনার জন্য দিল্লি থেকে শুধুমাত্র একদল ধর্মপ্রাণ মুসলমানদেরকেই দৌলতাবাদে পাঠান হয়েছিল। এই হল প্রকৃত ঘটনা। এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, ইবনে বতুতা কেন খামোকা মিথ্যাবর্ণন করতে যাবেন? অকারণে তো তিনি এই মিথ্যাচারগুলি করেননি, তার পিছনেও কাহিনি আছে। ১৩৩৩ সালে ইবনে বতুতা ভারতবর্ষে আসেন। আসার পর তিনি বিন তুঘলক দ্বারা প্রধান কাজী (Chief Justice) হিসাবে নিযুক্ত হন। এ সময়কালে তিনি এক অমার্জনীয় কাজ করে বসেন। সুলতান হিসাবে সেই বিচার মোহম্মদ বিন তুঘলককেই করতে হয়। বিচারে ইবনে বতুতা কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। সুলতানের কাছ থেকে এ ধরনের শাস্তি পেয়ে ইবনে বতুতা যারপরনাই অপমানিত হয়েছিলেন। সেই অপমানের ছাপ তাঁর লেখাতেও পড়বে, এতে আশ্চর্যের কী আছে। এখনকার দিনে ললিত মোদি, বিজয় মাল্যরা যেমন হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার মতো অপরাধ করেও বিচারব্যবস্থা ও রাষ্ট্রনায়কের হাত থেকে রেহাই পেয়ে যায়, তখনকার অপরাধ করে রেহাই পাওয়া মোটেই সহজলভ্য ছিল না। তাছাড়া ইবনে বতুতা, হিউয়েন সাঙ, ফা-হিয়েনের মতো পরিব্রাজকরা তাঁদের রচনায় অলীক ও অলৌকিক জনশ্রুতিকেই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। সেগুলি মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। তা সত্ত্বেও ইবনে বতুতা, হিউয়েন সাঙ, ফা-হিয়েনদের রচিত বিবরণগুলি একেবারেই ফেলে দেওয়া যায় না। এদের বিবরণ থেকে প্রচুর ঐতিহাসিক উপাদান পাওয়া যায়। শুধু প্রাজ্ঞতা দিয়ে দুধ আর জলকে আলাদা করে নিলেই হল।
(৩) দোয়াব এলাকায় করভার স্থাপন : সুলতান মোহম্মদ বিন তুঘলকের বিরুদ্ধে মোক্ষম অভিযোগ, দোয়াব অঞ্চলে তিনি দশ থেকে কুড়ি গুণ কর বৃদ্ধি করেছিলেন। কৃষক শ্রেণির উপর নিষ্ঠুর অত্যাচার চালিয়েছিলেন। এর ফলে রায়ত শ্রেণিকে ভিক্ষাবৃত্তি পর্যন্ত করতে হয়েছিল। এটাকে অভিযোগ না-বলে অপবাদ বলাই শ্রেয়। ইতিহাস ঘেঁটে যে পৃকত সত্য বেরিয়ে আসে, তা হল –খিলজি বংশের পতনের পর অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলার কারণে দোয়াব অঞ্চল বহু বছর যাবতীয় কর অনাদায়ী হয়ে পড়েছিল। সেই বকেয়া কর আদায় করতে আলাউদ্দিন খিলজির নির্ধারিত হারের অপেক্ষা কম হারে কর একসঙ্গে আদায় করা হয়। নিয়ম অনুসারে রাষ্ট্রের কোনো করই বকেয়া থাকতে পারে না। প্রজা বা নাগরিককে সব বকেয়া করই পরিশোধ করতে হবে। এ নিয়ম কেবলমাত্র মোহম্মদ বিন তুঘলকের শাসনামলেই নয়, আধুনিক ভারতেও কর বকেয়া রাখা যায় না। সবই পরিশোধ করতে হয়। সে পৌরসভার ট্যাক্সই হোক কিংবা বিএলআরও অফিসের খাজনাই হোক। কর বা রাজস্ব অনাদায়ী হয়ে থাকলে রাষ্ট্র পরিচালনা করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এর উপর বিন তুঘলকের শাসনামলে দোয়াবে পরপর সাত বছর অনাবৃষ্টি হওয়ার ফলে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, দুর্ভিক্ষ লেগে যায়। প্রায় এক যুগ ব্যাপী এই ভয়ংকর দুর্ভিক্ষ স্থায়ীত্ব লাভ করেছিল। ক্ষুধার জ্বালায় প্রজারাও বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল। এমতাবস্থায় তিনি উইনস্টোন চার্চিলের মতো বলেননি, “আমি ভারতীয়দের ঘেন্না করি। ওদের যেমন জানোয়ারের মতো জীবন তেমন জানোয়ারের মতো ধর্ম। খরগোশের মতো এত সন্তান উৎপাদন করলে দুর্ভিক্ষ তো হবেই।” দিল্লির সরকার যখন পরিস্থিতির গুরুত্ব সংবলিত দুর্দশার বিস্তারিত চিত্র ও মৃত্যুর পরিসংখ্যান টেলিগ্রাম করে তাঁর কাছে পাঠানো হয়। টেলিগ্রাম দেখে চার্চিলের সংক্ষিপ্ত উত্তর— “তাহলে গান্ধি এখনও মরেনি কেন?” পঞ্চাশের মন্বন্তরে (বাংলা ১৩৫০, ইংরেজি ১৯৪৩) মারা গিয়েছিল প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষ। কোথাও সংখ্যাটা ৫০ লক্ষের বেশি। তবে সরকারি হিসাবে বলা হয়েছিল ১৫ লক্ষ। কোনো ধরনের যুদ্ধ কোনো বুলেট-কার্তুজ ছাড়াই ৩০ লক্ষাধিক মানুষের প্রাণ অকাতরের ঝরে যায়, সেটা শিউরে ওঠার মতোই ব্যাপার। এই মৃত্যুমিছিলের জন্য সরাসরি দায়ী ছিলেন চার্চিল। সেই বিভীষিকাময় দুর্ভিক্ষে মর্মন্তুদ প্রসঙ্গ বিস্তারিত আলোচনা করব অন্য অধ্যায়ে। প্রসঙ্গে আসা যাক। সুলতান মোহম্মদ বিন তুঘলক কিন্তু তাঁর শাসনামলে দুর্ভিক্ষের সময়ে নীরব দর্শকের ভূমিকায় ছিলেন না। তিনি দুর্ভিক্ষপীড়িত প্রজাদের খাদ্য দান, ঋণ দান, কূপ খনন, চাষের বীজ ইত্যাদির ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি কর অবশ্যই নিয়েছিলেন এবং সেটা নির্ধারিত হারের চেয়ে কম, যা পূর্বারোপিত করের পুনঃপ্রবর্তনমাত্র।
(৪) তাম্রমুদ্রার প্রচলন : সুলতানের সময়ে ভারতে স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রার ছিল। সুলতান স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রার পরিবর্তে তাম্র বা তামার মুদ্রার প্রচলন করেছিলেন। এটাকে অবশ্যই তাঁর আমলে মুদ্রা সংস্কার। পুরোনো মুদ্রার বদলে নতুন মুদ্রার প্রচলন। আধুনিক পৃথিবীতে সেটাই ডিমানিটাইজেশন বা বিমুদ্রাকরণ। ২০১৬ সালে এমনই এক ডিমানিটাইজেশন হয়েছিল ভারতে। বাতিল হল ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট। খোলা বাজারে টাকার আকাল নেমে এল অকালে। সে এক অস্থির অবস্থা সারা ভারত জুড়ে। উদ্দেশ্য নিয়ে বিতর্কও কম হয়নি। যাই হোক, মোহম্মদ বিন তুঘলকের শাসনামলে রুপোর পরিমাণ ও সরবরাহ কমে যাওয়ায় তিনি রুপোর পরিবর্তে তামার মুদ্রার প্রচলন করতে চেয়েছিলেন। অবশ্য লোকে যাতে মুদ্রা নকল বা জাল করতে না-পারে তার জন্য কোনো ব্যবস্থা নেননি। ফলে জাল মুদ্রায় বাজার ছেয়ে গিয়েছিল। তবে তিনি দ্রুত এই সংকট কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছিলেন। কেউ কেউ বলেন তিনি পূর্বসূরীদের চেয়েও অনেক বেশি মুদ্রা বাজারে ছাড়েন। তাঁর চালুকৃত স্বর্ণমুদ্রাগুলি ওজনে অন্যান্য মুদ্রার চেয়ে অনেক ভারী ছিল আরবি হরফের ক্যালিগ্রাফি সংযুক্ত ছিল। কিন্তু চালুর সাত বছরের মধ্যে জনগণের কাছে এই মুদ্রার অগ্রহণযোগ্যতার জন্য তুলে নিতে বাধ্য হন। মোহম্মদ বিন তুঘলক কাগজে ছাপা নোটও চালু করার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু কিছু প্রভাবশালী প্রজা এবং কয়েকজন সভাসদের বিরোধিতার মুখে তিনি এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেন। কোনো কোনো ঐতিহাসিক লিখেছেন– সুলতানের অপরিমিত উদারতা, দুর্ভিক্ষ, রাজধানী স্থানান্তরকরণজনিত ব্যয়ভার এবং দিল্লিতে পুনর্বাসনের ব্যয়ের ফলে রাজকোশ প্রায় শূন্য হয়ে পড়লে সেই সমস্যা সমাধানের জন্যই তামার মুদ্রার প্রচলন করেন। যদি তাইই হয়, তাহলে কয়েক মাসের মধ্যেই স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রার বিনিময়ে তাম্র মুদ্রা ফিরিয়ে নিতে সক্ষম হলেন কীভাবে? একজন শাসক সব পরিকল্পনাই সফল হবে, এমন তো হয় না। অসফল হতেই পারে। সেখান থেকে অতি দ্রুত সংকট কাটিয়ে ওঠাটাই বড়ো কথা। সেই কাজে বিন তুঘলক চূড়ান্তভাবে সফল। সেই কারণেই ঐতিহাসিক টমাস ‘Prince of Moneyers’ বা ‘তঙ্কা নির্মাতার রাজা’ বলে অভিহিত করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন –“তাঁর প্রবর্তিত মুদ্রা নতুনত্ব এবং গঠন-বৈচিত্র্যের দিক থেকে দৃষ্টান্তস্বরূপ। নমুনা এবং কার্যকারিতার দিক দিয়ে দৃষ্টান্তস্বরূপ। এই মুদ্রার শিল্পসম্মত পরিপূর্ণতা প্রশংসনীয়।”
সুলতান মোহম্মদ বিন তুঘলককে যতই ‘পাগল-ছাগল’ বলে অভিহিত করা হোক না-কেন, তিনি ছিলেন যুগোত্তীর্ণ পণ্ডিত। তিনি একাধারে প্রতিভাশালী ও আদর্শ শাসক, উন্নত চরিত্রের মানুষ, অতুলনীয় বক্তা এবং দাতা। তর্কশাস্ত্র, গণিত, দর্শন, স্বাস্থ্যবিজ্ঞানে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল। মোহম্মদ বিন তুঘলকের ধর্মনীতি ছিল উদারপন্থী। তাঁর শাসনকালে হিন্দু, মুসলিম এবং অন্যান্য ধর্মের লোকেরা নির্বিঘ্নেই বসবাস করতেন। হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মের প্রসারে তিনি যথেষ্ট পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ডঃ ঈশ্বরীপ্রসাদ দ্ব্যর্থহীনভাবে লিখেছেন– “Muhammad Tughlak was unquestionably the ablest man among he crowned heads of the Middle ages.” এটাই রক্ষে, মোহম্মদ বিন তুঘলকে বিরুদ্ধে হিন্দুদের কচুকাটা করা, হাজার হাজার মন্দির ধ্বংস করা, জোর করে ইসলাম ধর্মে হিন্দুদের টেনে টানার মতো ভয়ংকর অভিযোগগুলি আনা হয়নি। ঐতিহাসিকরা তাঁকে ‘পাগল’ বলেই ক্ষান্ত হয়েছেন।
মোহম্মদ বিন তুঘলকের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিগ্রহের বিশেষ পাওয়া না-গেলেও ১৩৫১ সালে বর্তমান পাকিস্তানের সিন্ধু রাজ্যের ঠাট্টা অঞ্চলে সুমরু গোষ্ঠীর সঙ্গে যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করেন। দক্ষ যোদ্ধা হিসাবে তাঁর কোনো পরিচয় পাওয়া যায় না। তাঁর রাজত্বকালেই দাক্ষিণাত্যের মালভূমি অঞ্চল তাঁর রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তৎকালীন দক্ষিণ ভারতের কিছু অংশের শাসক প্রলয়ভেমা রেডিড ও মুসুনুরি কাঁপানিডু তাঁদের নিজ নিজ শাসিত অঞ্চল দিল্লির অধীন থেকে মুক্ত রাখতে সক্ষম হয়েছিল। সুলতান মোহম্মদ বিন তুঘলকের আমলে দিল্লির সুলতানি সাম্রাজ্যের সর্বাধিক বিস্তৃতি ঘটে। পূর্বে বাংলা থেকে পশ্চিমে সিন্ধু এবং হিমালয়ের পাদদেশ থেকে দক্ষিণে পাণ্ড্য রাজ্য পর্যন্ত তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল। সুলতান মোহম্মদ বিন তুঘলক সাধারণ সুলতান ছিলেন না। শুধুমাত্র সিংহাসনে বসে রাজ্য শাসন করা তাঁর লক্ষ্য ছিল না। তিনি তাঁর নিজস্ব রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণা নিয়ে রাজতন্ত্রকে গঠনের চেষ্টা করেন। মোহম্মদ তাঁর শাসনকালের গোড়ার দিকে খলিফার প্রতি আনুগত্য দেখাননি। কর্মচারী নিয়োগের প্রধান শর্ত ছিল যোগ্যতার ভিত্তিতে নির্বাচন। বংশ-কৌলিন্যের পরিবর্তে তিনি বুদ্ধি-কৌলিন্য যোগ্যতাকেই গুরুত্ব দেন। ধর্মান্তরিত মুসলিম এবং হিন্দু ধর্মীয় পরিবার থেকে তিনি যোগ্য মানুষদের বাছাই করে উচ্চপদে নিযুক্ত করতেন। মোহম্মদ বিন তুঘলক ধর্মশাস্ত্রে সুপণ্ডিত ছিলেন। এজন্য মৌলানা বা উলেমার তাঁর কাছে ধর্মনীতির ব্যাখ্যা করতে ভয় পেতেন। মোহম্মদ চিরাচরিত শরিয়তি অনুজ্ঞার পরিবর্তে তাঁর যুক্তিবাদকে প্রাধান্য দিতেন। এই কারণে ধর্মীয় আইন ও প্রথাকে অগ্রাহ্য করে তিনি যুক্তির বিচারকে শ্রেষ্ঠত্ব দেন। মালিক ও উলেমারা যতই তাঁর বিরোধিতা করেন মোহম্মদ ততই কঠোর হাতে তাঁদের দমন করেন।
মোহম্মদ তুঘলকের আমলে মুসলিম ধর্মনেতারা দুটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিলেন। যেমন– মৌলবাদী এবং গোঁড়া উলেমা সম্প্রদায়। এঁরা ইসলামের পুনরুজ্জীবনের জন্য রাজশক্তিকে ইসলামের বাহন হিসাবে ব্যবহার করতে চাইতেন। সুফি মতাবলম্বী, ভাববাদী মরমিয়া সম্প্রদায় ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে পৃথক রাখতে চাইতেন। সুলতান মোহম্মদ এই দুই সম্প্রদায়কে সমদূরত্বে রেখে একটি মধ্যপন্থা নিয়ে চলতেন। এজন্য তিনি যুক্তিবাদের আশ্রয় নেন। বরনির মতো মৌলবাদী লেখকদের চোখে মোহম্মদ বিন তুঘলকের যুক্তিবাদ ছিল বিধর্মিতার সামিল। কিন্তু মোহম্মদ কোনো চাপের কাছে নতি স্বীকার করেননি। তিনি ধর্মসহিষ্ণুতার আদর্শকে সামনে রেখেই শাসনকার্য চালিয়ে গেছেন। আলাউদ্দিনের মতোই তিনি বুঝেছিলেন যে, ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ও ধর্মান্তরিত মুসলিমদের অগ্রাহ্য করা যুক্তিযুক্ত হবে না। সেই কারণে তিনি হিন্দুদের ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে হস্তক্ষেপ করতেন না। হিন্দু যোগী ও জৈন সাধুরা নির্ভয়ে তাঁর রাজ্যে বসবাস করতে পারতেন। তিনি তাঁদের ধর্মীয় তত্ত্বের ব্যাখ্যাবিচার শুনতেন। দাক্ষিণাত্য যুদ্ধের কারণে হিন্দু মন্দির ধ্বংস হলে তিনি পুনর্নির্মাণ করে দেন।
তবে মোহম্মদ বিন তুঘলক তাঁর রাজত্বের শেষদিকে এসে গোঁড়া ও প্রতিক্রিয়াশীলদের বিদ্রোহ ও চক্রান্তে হতাশ হয়ে তাঁর যুক্তিবাদী নীতির পরিবর্তে আপোস নীতি নিয়ে নেন। তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করলেন যে, মৌলবাদীদের এবং প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরোধিতার ফলেই তাঁকে নিত্য বিদ্রোহের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। অতএব তিনি হঠাৎ নীতি বদল করে খলিফাঁকেই তাঁর প্রভু বলে স্বীকৃতি জানান। বিনিময়ে তিনি আশা করেন, এর ফলে গোঁড়া ও মৌলবাদীরা শান্ত হবে এবং তাঁর সিংহাসনের ন্যায্যতা স্বীকার করবেন। কিন্তু তাঁর এই আশা সম্পূর্ণভবে ধূলিস্যাৎ হয়ে যায়।
তিনি ধর্মপ্রাণ হলেও ধর্মগুরু ও উলেমাদের নির্যাতন করতেন। তিনি অসাধারণ পণ্ডিত হলেও নিষ্ঠুর ছিলেন। ইবন বতুতার মতে, তাঁর প্রাসাদ থেকে প্রতিদিন কোনো-না-কোনো ব্যক্তি পুরস্কৃত হতেন, আবার কোনো-না-কোনো ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হত। বস্তুত সুলতান মোহম্মদের ধর্ম ও রাজ্য শাসন নীতির উজ্জ্বল দিকও ছিল। তিনি নিজে নিষ্ঠাবান হলেও রাজ্যশাসনের ক্ষেত্রে উলেমাদের হস্তক্ষেপ ঘটতে দেননি। তাঁর রাজত্বকালে হিন্দুরা নিরাপদ ছিল। তিনি নগরকোট আক্রমণ করলেও জ্বালামুখীর বিখ্যাত হিন্দুমন্দির ধ্বংস করেননি। তিনি ধর্মপ্রাণ হলেও মোহম্মদ বিন কাসেম কিংবা মোহম্মদ ঘুরীদের মতো ধর্ম-সন্ত্রাসী ছিলেন না। তিনি তবলিগের সমর্থক ছিলেন এবং সংস্কৃত ভাষায় পণ্ডিতও ছিলেন। তিনিই প্রথম হিন্দুদের বর্বরোচিত প্রথা সতীদাহ নিষিদ্ধ করার কথা ভেবেছিলেন। তবে ভাবলেও শেষপর্যন্ত তাঁর সেই ভাবনাকে বাস্তবায়িত করেননি। কারণ পাছে হিন্দুধর্মে বিরোধিতা বা হস্তক্ষেপ হয়ে যায়! মোহম্মদ বিন তুঘলক তাঁর হিন্দু ও মুসলিম প্রজাবৃন্দের এক মিলন ঐক্য গড়ে তুলে মূল ইতিহাসে চির অমর ও অক্ষয় হয়ে আছেন। মোহম্মদ বিন তুঘলক ইতিহাসের পাতায় প্রথম শাসক, যিনি বিধর্মী তথা হিন্দুদের উপর হামলা করেননি। বিধর্মীদের তলোয়ার দেখিয়ে ধর্মান্তরিত করে মুসলিমের সংখ্যা বাড়াতে চাননি। মোহম্মদকে ‘খামখেয়ালি’ বা ‘উন্মাদ’ বলে যতটা-না ইতিহাস কুখ্যাত করেছে ততটা এই দিকটা নিয়ে একেবারই আলোকিত করা হয়নি। এটা খুবই দুঃখজনক।
মোহম্মদ বিন তুঘলকের পরে সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক, সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক শাহ, সুলতান আবু বকর শাহ, সুলতান মোহাম্মদ শাহ, সুলতান আলাউদ্দিন সিকান্দার শাহ, সুলতান নাসিরুদ্দিন মোহাম্মদ শাহ তুঘলক, সুলতান নাসিরুদ্দিন নুসরাত শাহ তুঘলক প্রমুখ শাসকদের শাসন চললেও ইতিহাসে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য ঠাঁই হয়নি। কেন ঠাঁই হয়নি, সেটা অনুধাবনযোগ্য।