ইলতুৎমিস (শাসনকাল : ১২১১ সাল থেকে ১২৩৬ সাল)
কুতুবউদ্দিনের মৃত্যুর পর ১২১০ সালে তাঁর পুত্র আরাম শাহ নিজেকে দিল্লির সুলতান ঘোষণা করে ও দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন। কিন্তু তাঁর অপদার্থতা লক্ষ করে দিল্লির আমির-ওমরাহরা ইলতুৎমিসকে দিল্লির সিংহাসন দখল করতে আহ্বান জানান। এই আবেদনে সাড়া দিয়ে ইলতুৎমিস আরাম শাহকে পরাজিত করে দিল্লির সিংহাসন দখল করেন।
প্রথম জীবনে ইলতুৎমিস ছিলেন কুতুবউদ্দিনের ক্রীতদাস। পরে তাঁর কর্মদক্ষতা ও বিচক্ষণতায় মুগ্ধ হয়ে কুতুবউদ্দিন তাঁর সঙ্গে নিজের কন্যার বিয়ে দিয়ে তাঁকে বাদাউনের শাসনকর্তা হিসাবে নিয়োগ করেন। মসনদে আরোহণ করেই ইলতুৎমিস জিহাদি অভিযান শুরু করেন বিধর্মীদের বিরুদ্ধে। তিনি ভারতে বিধর্মীদের নির্মূল করে ইসলামি সামাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্যে উলেমাদের পরামর্শ গ্রহণ করে। সেই অনুযায়ী তিনি ভারতের বিধর্মীদের আহ্বান জানান ইসলাম হতে, না-হলে মৃত্যুকে বেছে নিতে। তবে কোনো কোনো ঐতিহাসিক মনে করেন ইলতুৎমিস ব্যক্তিগতভাবে খুবই ধর্মপরায়ণ ছিলেন বটে, তিনি কখনো তাঁর রাজত্বকালে অমুসলিমদের ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করার জন্য কোনো চেষ্টাই করেননি। তিনি রাজপুত রাজাদের প্রতি জেহাদ ঘোষণা করেননি। যেসব লেখকরা তাঁকে ধর্মীয় গোঁড়ামির অভিযোগে অভিযুক্ত করেন তা নাকি ইংরেজ ঐতিহাসিকদের অপপ্রচার, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সিংহাসনে আরোহণের পর ইলতুৎমিসকে একাধিক বৈদেশিক আক্রমণ ও আঞ্চলিক বিদ্রোহের সম্মুখীন হতে হয়। সিংহাসনে আরোহণ করেই ইলতুৎমিস অসাধারণ ধৈর্য ও সাহসের সঙ্গে কয়েকটি জটিল সমস্যার সমাধান করেন। দিল্লির সিংহাসনে বসার পরে পরেই নাসিরউদ্দিন কুবাচা সিন্ধুতে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। গজনির শাসনকর্তা তাজউদ্দিন ইলদিজও ভারতে প্রাধান্য বিস্তারে উৎসুক ছিলেন। বাংলার শাসক আলিমর্দান দিল্লির বশ্যতা অস্বীকার করেন। হিন্দু রাজারাও তাঁদের হৃত গৌরব উদ্ধারে বদ্ধপরিকর ছিলেন। গোয়ালিয়র ও রণথম্বোর দিল্লির হস্তচ্যুত হয়। এমনকি দিল্লির কিছু আমির-ওমরাহ তাঁর বিরুদ্ধাচারণ করেন। এরপর তিনি মান্দোর ও মালব রাজ্যের কিছু অংশ ভিলসা ও উজ্জয়িনী অধিকার করে নেন। কিছুদিনের মধ্যেই ইলতুৎমিসকে দুর্ধর্ষ মোঙ্গল নেতা চেঙ্গিস খাঁর আক্রমণের সম্মুখীন হতে হয়, কিন্তু সৌভাগ্যবশত চেঙ্গিস খাঁ পাঞ্জাব বিধ্বস্ত করার পর আর বেশি দূর অগ্রসর না হয়ে ভারত ছেড়ে চলে যান। যার ফলে দিল্লির সুলতানি সাম্রাজ্য নিদারুণ এক সংকট থেকে রক্ষা পায়। মোঙ্গল সেনা চেঙ্গিস খাঁ মধ্য ও পশ্চিম এশিয়া জয় করে খাইবার শাসক জালালউদ্দিন মঙ্গবার্নির পিছু নিলে তিনি পাঞ্জাবে পালিয়ে ইলতুৎমিসের কাছে আশ্রয় ভিক্ষা করেন। ইলতুৎমিস বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে এই আবেদন অগ্রাহ্য করেন। ফলে মঙ্গবার্নি ভারত ত্যাগ করতে বাধ্য হয় এবং চেঙ্গিস খাঁর অনিবার্য আক্রমণ থেকে ভারত রক্ষা পায়। ইলতুৎমিস অবশ্য উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত সুরক্ষিত করার কোনো ব্যবস্থা করে যাননি। ফলে ভবিষ্যতে মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিহত করা কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে। তবে চেঙ্গিস খাঁর ভারতত্যাগের পর তিনি এরপর বাংলার দিকে নজর দেন। উল্লেখ্য ১২১০ সালে কুতুবুদ্দিন আইবকের মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরাধিকারদের মধ্যে গোলোযোগ সৃষ্টি হয়। এই সুযোগে আলি মার্দান স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ক্রমে ক্রমে তিনি অত্যাচারী সুলতান হয়ে উঠেন। ফলে বাংলার খলজি আমিররা যড়যন্ত্র করে তাঁকে হত্যা করে এবং নতুন সুলতান হিসেবে হুসামউদ্দিন আইওয়াজ সিংহাসনে বসেন। ১২১৩ সালে নতুন সুলতান হিসেবে নাম গ্রহণ করেন হুসামউদ্দিন আইওয়াজ গিয়াস উদ্দিন আইওয়াস। তিনি নিজের নামে মুদ্রা প্রচলন করেন। নানাবিধ সংস্কার করে রাজ্যের ভিতর শান্তিস্থাপন করতে সমর্থ হন। ১২২৫ সালে দিল্লির সুলতান ইলতুৎমিস বাংলা ও বিহার দখলের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। বিহারে উভয় বাহিনী মুখোমুখী হলে শান্তি চুক্তি হয়। এই চুক্তি বলে, হুসামউদ্দিন আইওয়াজ দিল্লির অনুগত্য স্বীকার করে নেন। ফলে বাংলার শাসনকর্তা হিসেবে তিনি থেকেই যান এবং ইলুৎমিস দিল্লিতে ফিরে যান। ১২২৬ খ্রিষ্টাব্দে ইলতুৎমিস রথোম্ভর জয় করেন। এই সময় বাংলায় হুসামউদ্দিন আইওয়াজ বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। ফলে তাঁকে শায়েস্তা করার জন্য ইলতুৎমিস তাঁর পুত্র নাসিরউদ্দিনের নেতৃত্বে একটি সেনাবাহিনী পাঠান। ১২২৭ সালে উভয় বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ হলে আইওয়াজ সপরিবারে নিহত হন। এই সময় নাসিরউদ্দিন বাংলার শাসনকর্তা মনোনীত হন। এই সময় তিনি অযোধ্যাকে বাংলার সঙ্গে যুক্ত করেন। ১২২৯ সালে বাগদাদের খলিফা তাকে ‘সুলতান-ই-আজম’ উপাধি দিলে দিল্লি সালতানাতের গৌরব বৃদ্ধি পায় এবং এই সালতানাত স্বতন্ত্র ও সার্বভৌম অস্তিত্ব মুসলিম জগতে স্বীকৃত হয়। কৃতজ্ঞতাবশত ইলতুৎমিস তাঁর মুদ্রায় নিজেকে ‘খলিফার সেনাপতি’ বলে উল্লেখ করেন। ১২২৯ সালে নাসিরুদ্দিনের মৃত্যুর পর, হুসামউদ্দিন আইওয়াজের বল্কা নামক এক অনুচর নিজেকে স্বাধীন সুলতান হিসাবে ঘোষণা দেন। ফলে ১২৩০ সালে ইলতুৎমিস পুনরায় বাংলা আক্রমণ করেন। যুদ্ধে বন্ধা পরাজিত ও নিহত হন। এরপর আলাউদ্দিন জনিকে বাংলা শাসনকর্তা নিযুক্ত করে আবার দিল্লিতে ফিরে যান। ১২৩২ সালে তিনি গোয়ালিয়র অধিকার করেন। ১২৩৪ সালে তিনি মালব অধিকার করেন। এই সময় উজ্জয়িনীর বিখ্যাত মহাকালের মন্দির ধ্বংস হয়ে যায় বলে বহুল প্রচারিত। ১৯৩৬ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর, তাঁর কন্যা রাজিয়া সিংহাসনে বসেন।
ইলতুৎমিসের কেমন ভারত (সমগ্র ভারত নয়) রচনা করেছিলেন? (১) সুদক্ষ যোদ্ধা ও কূটনীতিজ্ঞ ইলতুৎমিসই ভারতে সর্বপ্রথম মুসলিম সাম্রাজ্যের একটি সুপরিকল্পিত রাজধানী, সুসংহত সরকার ও শাসকগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠা করে যান। (২) দিল্লির সুলতানির বিপদের দিনে শুধু যে তিনি রাজত্ব রক্ষা করতে পেরেছিলেন তাই নয়, দিল্লি সুলতানির শক্তি বৃদ্ধি করতেও সক্ষম হন। নিঃসন্দেহে প্রথম যুগের সুলতানদের মধ্যে অন্যতম প্রধান ও যোগ্য শাসক ছিলেন। এই সব কৃতিত্বের স্বীকৃতি হিসাবে বাগদাদের সুলতানের কাছ থেকে তিনি ‘সুলতান-ই-আজম’ উপাধি পান। তিনি দিল্লির সুলতানিকে একটি শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করিয়ে দেন। যেভাবে তিনি অভ্যন্তরীণ ও বহিঃশত্রুর মোকাবিলা করেছিলেন, তা প্রশংসনীয়। (৩) শিল্প ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক হিসাবে তাঁর অবদান উল্লেখযোগ্য। মিনহাজ-উস-সিরাজের মতে তিনি যেভাবে গুণী, হৃদয়বান এবং শিক্ষিত ও ধার্মিক ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছিলেন, তা অন্য কোনো সুলতান কখনও করেননি। এই সব কারণেই ইলতুৎমিসকে দিল্লি সুলতানির প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়।