১.৫.০৫ কুতুবউদ্দিন আইবক (শাসনকাল : ১২০৬ সাল থেকে ১২১০ সাল)

কুতুবউদ্দিন আইবক (শাসনকাল :১২০৬ সাল থেকে ১২১০ সাল)

কুতুবউদ্দিনকে উত্তর ভারতের প্রতিনিধি নিযুক্ত করে মোহম্মদ ঘুরি রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও সাংগঠনিক প্রতিভার পরিচয় দেন। কুতুবউদ্দিন আইবকের প্রচেষ্টায় ভারতে মুসলিম সাম্রাজ্য বিস্তৃত ও সুদৃঢ় হয়। কুতুবউদ্দিন আইবকের মাধ্যমে তথাকথিত দাস বংশের প্রতিষ্ঠা ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় ঘটনা। এ দাস বংশ কৃতিত্বের সঙ্গে সাম্রাজ্য শাসন করায় এতদঞ্চলে মুসলিম শাসনের ভিত্তি সুদৃঢ় হয়েছিল।

কেমন ছিল তুর্কি কুতুবউদ্দিনের শাসনব্যবস্থা সেটা বিস্তারিত জানার চেষ্টা করব। ১২০৬ সালে মোহম্মদ ঘুরির মৃত্যু হলে ভারতে তাঁর প্রতিনিধি দাস কর্মচারী কুতুবউদ্দিন আইবক তাঁর প্রভুর ভারতীয় রাজ্যের শাসনভার নিজের হাতে তুলে নেন। ১২০৬ সালে নিঃসন্তান মোহাম্মদ ঘুরির মৃত্যু হলে গজনির সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে কুতুবউদ্দিন আইবক নিজেকে স্বাধীন সার্বভৌম নরপতি ঘোষণা করেন। ১২০৬ সালে তিনি শাসনভার গ্রহণ করলেও নিজেকে ‘সুলতান’ হিসাবে ঘোষণা করেননি। নিজেকে দিল্লির স্বাধীন সুলতান’ হিসাবে ঘোষণা করলেন ১২০৮ সালে এসে। কুতুবউদ্দিনকেই দিল্লির প্রথম সুলতানের মর্যাদা দেওয়া হয়ে থাকে। তাঁর সময় থেকেই মুসলমানরা ভারতে অভিযান প্রেরণ করার পরিবর্তে স্থায়ীভাবে রাজ্যশাসনের দিকে নজর দেন। তিনি ও তাঁর উত্তরাধিকারীরা ‘ইলবেরি তুর্কি গোষ্ঠীভুক্ত ছিলেন বলে এদের রাজত্বকাল ইতিহাসে ‘ইলবেরি তুর্কি আমল হিসাবে পরিচিত। অমুসলিমদের প্রতি কুতুবউদ্দিন কেমন নজরে দেখতেন সে বিষয়ে এম এ খান তাঁর ‘জিহাদ’ গ্রন্থে লিখেছেন– “সুলতান হয়ে তিনি পৌত্তলিক ভারতীয়দের বিরুদ্ধে জিহাদে অবতীর্ণ হন। তিনি ১,০০,০০০ (এক লাখ) হিন্দু হত্যা করেন। কুতুবউদ্দিন আইবক ইসলামি জিহাদ অভিযানে দিল্লি ছাড়িয়ে মিরাট, রণথম্ভোর, আলিগড়, গুজরাট, লক্ষ্মোতি থেকে লাহোর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। কুতুবউদ্দিন নিজে ‘দাস’ হওয়া সত্ত্বেও প্রতিটি বিজয়েই হত্যা, লুণ্ঠন ছাড়াও প্রচুর বিধর্মীকে বন্দি করে ক্রীতদাস করা হয়। ক্রীতদাসদের ভারতীয় বাজারে বিক্রি করা হত।” তবে এই হিন্দুহত্যা যুদ্ধের কারণে, নাকি অমুসলিম হওয়ার ‘অপরাধে’– সেটার কোনো তথ্য স্পষ্ট নয়। বিধর্মী হত্যাই যদি হয় তাহলে তাঁর সামরিক বাহিনীতে এত হিন্দু মুসলমান না-হয়ে হিন্দু হিসাবে রয়ে গেলেন কীভাবে?

নিশাপুরের দাস বাজার থেকে কাজী ফকরউদ্দিন কুফি তাঁকে কেনেন। এ সময়েই শাস্ত্র ও শস্ত্রে কুতুবউদ্দিনের শিক্ষা হয়। পরে ফকরউদ্দিনের মৃত্যু হলে পুনরায় দাস হিসাবে বিক্রিত হন এবং সুলতান মোহম্মদ ঘুরি কুতুবউদ্দিনকে কিনে নেন। যদিও দক্ষতার প্রমাণ দিয়ে মোহম্মদ ঘুরির খাস সেনাপতি হয়ে যান কুতুবউদ্দিন। বাজারে দাস বিক্রির এই প্রথা ভারতের ইতিহাসে প্রথম। মোহম্মদ ঘুরির অধিকাংশ সময়ে রাজ্যজয়ের নেশায় যুদ্ধবিগ্রহের মধ্যেই কাটাতেন। ফলে রাজ্যের প্রকৃত শাসক হয়ে উঠেছিলেন কুতুবউদ্দিন। সে কারণেই দেখা যায়, ১২০১-০২ সালের দিকে বখতিয়ার খলজি প্রচুর ধন-সম্পদসহ কুতুবুদ্দিন আইবকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁকে বহুমূল্যবান উপহার প্রদান করেন। কুতুবুদ্দিন আইবক তাঁকে বিশেষভাবে সম্মানিত করেন এবং বিহারের ওই অঞ্চল শাসনের অনুমতি দেন। এক্ষেত্রে কুতুবউদ্দিন মোহম্মদ ঘুরির অনুমোদনের প্রয়োজন মনে করেননি। বখতিয়ার খিলজি কুতুবউদ্দিন আইবকের অনুগত ছিলেন। ১২০৫ সালে বখতিয়ার খিলজি মৃত্যুর পর, গৌড়ে যে কয়জন খিলজি শাসক বাংলা শাসন করেছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই কুতুবউদ্দিনের অনুগ্রহভাজন ছিলেন।

কুতুবউদ্দিনের কপালে হিন্দুহত্যার কলঙ্ক লাগলেও সুলতানি সাম্রাজ্য বিস্তারের অপেক্ষা সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা ও সংগঠনের দিকে বেশি দৃষ্টি দেন। তিনি রাজপুত শক্তিকে সম্পূর্ণ জয় করার চেষ্টা থেকে বিরত থাকেন। তুর্কি মালিক ও আমিরদের তিনি নিজ বশ্যতায় এনে দিল্লি সুলতানির ঐক্য ও সংহতি রক্ষা করেন। তাঁর প্রধান কৃতিত্ব ছিল গজনির তাজউদ্দিন ইলদুজের আগ্রাসন থেকে দিল্লি সুলতানিকে রক্ষা করা। তিনি গজনির মতো মধ্য এশিয়ার রাজনীতিতে দিল্লিকে না জড়িয়ে দিল্লি সুলতানির সম্পূর্ণ ভারতীয় চরিত্র দেন। দিল্লি ও আজমিরে নির্মিত তাঁর দুটি মসজিদ ইসলামের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ও শিল্পানুরাগের সাক্ষ্যবহন করছে। অকস্মাৎ ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে কুতুবউদ্দিনের মৃত্যু হয়। সিংহাসনে আরোহণের পর কুতুবউদ্দিন আইবেক মাত্র চার বছর জীবিত ছিলেন। এই সময়কালে তিনি রাজ্য বিজয় বা প্রশাসন পরিচালনায় বিশেষ কোনো কৃতিত্ব দেখাতে পারেননি। তবে দানশীলতার জন্য তিনি ‘লাখবক্স’ বা ‘লক্ষদাতা’ নামে পরিচিত ছিলেন। কুতুবউদ্দিন দিল্লির উপকণ্ঠে সুফিসাধক বখতিয়ার কাকির স্মৃতিতে তিনি এক স্তম্ভ নির্মাণের কাজ শুরু করেন ১১৯৩ সালে। এই স্তম্ভটি বর্তমানে কুতুবমিনার নামে পরিচিত। কিন্তু এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছিল ইলতুৎমিসের সময়। কোনো কোনো ঐতিহাসিক বলেন মিনারের উপরের তলাগুলোর কাজ সম্পূর্ণ করেন ফিরোজ শাহ তুঘলক ১৩৮৬ সালে। অবশ্য হিন্দুত্ববাদীদের একটা অংশ মনে করেন প্রাচীন হিন্দু মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের পাথর দিয়ে কুতুব কমপ্লেক্স এবং মিনারটি তৈরি করা হয়েছে। তবে হিন্দু মন্দিরটি কোন্ দেবতার ছিল, কবে নির্মিত হয়েছিল, কে নির্মাণ করেছিল, কীভাবে ধ্বংস হয়েছিল –সে ব্যাপারে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়নি। কুতুবমিনার বিভিন্ন নলাকার শ্যাফট দিয়ে গঠিত, যা বারান্দা দ্বারা পৃথকীকৃত। মিনার লাল বেলেপাথর দিয়ে তৈরি, যার আচ্ছাদনের উপরে কোরানের আয়াত খোদাই করা। ফিরোজ শাহের শাসনকালে মিনারের দুই শীর্ষতলা বজ্রপাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু তা ফিরোজ শাহ দ্বারা সংশোধিত হয়েছিল। ১৫০৫ সালে আবার মিনারটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবার সিকান্দার লোদি দ্বারা সংশোধিত হয়েছিল। তবে কেউ কেউ বলেন বজ্রপাত নয়, কুতুবমিনার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ভয়ংকর ভূমিকম্পে। ১৫০৫ সালে একটি ভয়ংকর ভূমিকম্পে এটি প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে এটিকে পুনরায় নির্মাণ করা হয়। সেইরকমই ১৮০৩ সালে আরও একটি ভয়ংকর ভূমিকম্প এই মিনারটি অনেক ক্ষতি হয়েছিল এবং আবার এটিকে পুনরায় মেরামত করা হয়। কুতুবমিনারের দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে ২৫ ইঞ্চি একটি ঢাল আছে, যা ‘নিরাপদ সীমার মধ্যে বিবেচিত হয়। ভারতীয় মুসলিম স্থাপত্যশৈলীর গুরুত্বপূর্ণ এবং অন্যতম প্রাচীন নিদর্শন বলে কুতুবমিনার বেশ উল্লেখযোগ্য।

কুতুবমিনারের আশেপাশে আরও বেশ কিছু প্রাচীন এবং মধ্যযুগীয় স্থাপত্য এবং ধ্বংসাবশেষ আছে, যেগুলি একত্রে কুতুব কমপ্লেক্স হিসাবে পরিচিত। এই কমপ্লেক্সটি ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসাবে তালিকাবদ্ধ হয়েছে এবং এটি দিল্লির অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য এবং এটি ২০০৬ সালে সর্বোচ্চ পরিদর্শিত সৌধ এবং পর্যটকের সংখ্যা ছিল ৩৮.৯৫ লাখ, যা তাজমহলের চেয়েও বেশি, যেখানে তাজমহলের পর্যটন সংখ্যা ছিল ২৫.৪ লাখ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *