মোহম্মদ ঘুরি (শাসনকাল :১১৭৩ সাল থেকে ১২০২ সাল)
ঘুরি রাজবংশের সন্তান মোহাম্মদ ঘুরি জন্মেছিলেন আফগানিস্তানে। পুরো নাম মুইজুদ্দিন মোহম্মদ ঘুরি। বড় ভাই গিয়াসুদ্দিন মোহম্মদ ঘুরির নির্দেশে তিনি গজনি অধিকার করেন। কিন্তু মুইজুদ্দিন মোহম্মদ ঘুরি শুধুমাত্র গজনি নিয়ে খুশি থাকতে পারেনি। ফলে পূর্ব সীমান্তে ভারতের অভিমুখে তিনি তাঁর রাজ্য বিস্তারের চেষ্টা করেন। সুলতান মামুদ ভারত থেকে যে বিরাট ধনরত্ন লুঠ করে নিয়ে যান সেই কিংবদন্তী আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল। সুতরাং মোহম্মদ ঘুরিও ভারতের ধনসম্পদের জন্য প্রলুব্ধ হন। তবে সুলতান মামুদের মতো শুধুমাত্র ধনসম্পদ লুঠ করে তাঁর আশ মেটেনি, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল অধিকার করে নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। তিনি লাহোরের যুদ্ধে মোহম্মদ খসরু শাহকে পরাস্ত করে লাহোর দুর্গ অধিকার করেন। শিয়ালকোট সহ সমগ্র পশ্চিম পাঞ্জাব অধিকার করেন। পূর্ব পাঞ্জাব তখন ছিল আজমির ও দিল্লির অধিপতি চৌহান বংশীয় তৃতীয় পৃথ্বীরাজ।
বর্তমান ভারতের উত্তরপ্রদেশের কনৌজের রাজা ছিলেন রাজপুত বংশোদ্ভুত জয়চন্দ্র। রাজা জয়চন্দ্রের কন্যা সংযুক্তাকে পছন্দ করতেন রাজপুত রাজা বীর পৃথ্বীরাজ চৌহান। পৃথ্বীরাজ সংযুক্তাকে বিয়ে করতে চাইলেন। কিন্তু রাজা জয়চন্দ্র এই প্রস্তাব মেনে নিলেন না। ফলে পৃথ্বীরাজ সংযুক্তাকে অপহরণ করে নিয়ে যান। কথিত আছে, তাঁদের ভিতরে পত্রযোগে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। নিজের মেয়ে অপহরণের পর রাজা জয়চন্দ্র প্রায় এক বছর কূটনৈতিকভাবে প্রচেষ্টা চালালেন মেয়েকে নিজের কাছে ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু কোনোভাবেই সফল হলেন না। পৃথ্বীরাজের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ক্ষুব্ধ রাজা জয়চন্দ্র মোহম্মদ ঘুরিকে আমন্ত্রণ জানালেন ভারত আক্রমণ করতে। যেসব শাসকের এক চোখ সবসময় হিন্দুস্তানের উপরে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে চেয়ে থাকত, সেইসব শাসক হিন্দুস্তানের এই অভ্যন্তরীণ গোলযোগের সুযোগ নেবেন না কেন? আর তাই রাজা জয়চন্দ্রের আমন্ত্রণ পেয়ে ১১৯১ সালে শিহাবুদ্দিন মোহম্মদ ঘুরি আর দেরি না-করে হিন্দুস্তানের দিকে রওনা দেন। খাইবার গিরিপথের মাঝখান দিয়ে দ্রুতগতিতে তিনি পাঞ্জাবে এসে পৌঁছোন। পাঞ্জাবের বাতিন্ডায় পৃথ্বীরাজের একটি দুর্গ ছিল। মোহম্মদ ঘুরি বাতিন্ডার এই দুর্গটি দখল করে নেন। এ সংবাদ পৃথ্বীরাজ চৌহানের কানে মোহম্মদ ঘুরির হিন্দুস্তান অভিমুখী অগ্রযাত্রার সংবাদ পৌঁছোতে খুব বেশি সময় লাগল না। মোহম্মদ ঘুরির আগমনের সংবাদ পেয়ে তিনি রাজা জয়চন্দ্রের কাছেই সাহায্য চান। জয়চন্দ্র সম্পর্কে পৃথ্বীরাজের শ্বশুর। কিন্তু মেয়ের অপহরণকারীকে রাজা জয়চন্দ্র সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন না। সেটাই স্বাভাবিক। উপায়ান্তর না-পেয়ে পৃথ্বীরাজ তাঁর ভাইপো গোবিন্দ তাইকে নিয়ে মোহম্মদ ঘুরির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন। তাঁর সঙ্গে ছিল ২০,০০০ অশ্বারোহী এবং প্রায় ৫০,০০০ বিশাল এক সেনাবাহিনী। মোহম্মদ ঘুরির সঙ্গে পৃথ্বীরাজ চৌহানের সাক্ষাৎ হয়ে গেল হরিয়ানার থানেশ্বরের তরাইন গ্রামে। মোহম্মদ ঘুরির কাছে অশ্বারোহী আর পদাতিক মিলে প্রায় ৩৫ হাজার সৈন্য আছে। যুদ্ধ হল শুরু। মোহম্মদ ঘুরি যুদ্ধ শুরুর আগেই পরাজিত হয়ে বসেছিলেন। কারণ তিনি তাঁর বাহিনীকে রাজপুতদের সঙ্গে সামনাসামনি লড়াই করার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। বাহিনীর সাজিয়েছিলেন সেইভাবেই। অপরদিকে পৃথ্বীরাজের সেনাবাহিনী ছিল যুদ্ধের নিয়মনীতি মেনেই। মোহম্মদ ঘুরির বাহিনীর বেশিরভাগ যোদ্ধাই ছিলেন তুর্কি। এসব যোদ্ধারা সম্মুখ লড়াইয়ের পরিবর্তে তুর্কিদের বিশেষ কৌশলে যুদ্ধ করতেই অভ্যস্ত ছিলেন। প্রতিপক্ষের তীব্র আক্রমণের সময় তুর্কি যোদ্ধারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পালিয়ে যাওয়ার ভান ধরতেন। প্রতিপক্ষ পলায়নরত যোদ্ধাদের তাড়া করতেন। ঠিক এই সময়টির জন্য তুর্কি যোদ্ধারা অপেক্ষা করতেন। তাঁরা পলায়নরত ঘোড়ার পিঠ থেকে উল্টো হয়ে প্রতিপক্ষের দিকে তীর ছুঁড়তেন। এমন যুদ্ধরীতিতে তুর্কিরা সবসময়ই জয়ী হতেন। কিন্তু মোহাম্মদ ঘুরি তুর্কি সৈন্যদের সম্মুখ যুদ্ধে তাঁদের লড়াই করতে পাঠান। ফলে অনভ্যস্ত রীতিতে ঘুরির তুর্কি যোদ্ধারা খুব সহজেই শক্তি হারান। মোহম্মদ ঘুরি যুদ্ধক্ষেত্রে আহত হন। রাজপুতদের তীব্র তীরবৃষ্টি আর সম্মুখ আক্রমণে মোহম্মদ ঘুরির বেশিরভাগ সৈন্যই নিহত হন। যাঁরা জীবিত ছিলেন তাঁদের অবস্থাও কাহিল। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে কোনোমতে তাঁরা আফগানিস্তান ফিরে যান। এদিকে পৃথ্বীরাজও একটা ভুল করে বসলেন। তিনি মহানুভবতা দেখিয়ে পরাজিত এবং আহত প্রতিপক্ষ সেনাপতি মোহম্মদ ঘুরিকে হত্যা না-করে মুক্ত করে দেন।
পরাজিত হয়ে ঘুরি এতটাই অপমানিত বোধ করছিলেন যে, তিনি নাকি খাবার-দাবার প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন। এমনকি নিজের পরিবারের সঙ্গেও দেখা করতেন না। টানা এক বছর তিনি তাঁর সেনাবাহিনী পুনর্গঠন আর যুদ্ধ পরিকল্পনা করতে ব্যয় করতেন। ১১৯২ খ্রিস্টাব্দ, মোহম্মদ ঘুরি প্রভূত শক্তি সঞ্চয় করে এক বছর বাদে পুনরায় ভারত আক্রমণ করেন। তরাইনের প্রথম যুদ্ধে যেসব সেনা ও সেনাপতি দুর্বলতা দেখায় তিনি তাদের কঠোর শাস্তি দেন। তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে মোহম্মদ ঘুরির সঙ্গে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজারের বিশাল এক সেনাবাহিনী ছিল। এই বিশাল বাহিনীতে অশ্বারোহী সেনা ছিল প্রায় ৫২ হাজার এবং তিনজন বিশ্বস্ত সেনাপতির (কুতুবউদ্দিন আইবক, নাসিরউদ্দিন কুবাচা ও তাজউদ্দিন ইলদুজ) সাহায্য নিয়ে পৃথ্বীরাজকে আক্রমণ করেন। পৃথ্বীরাজ নিজের শক্তি বৃদ্ধির জন্য তিনি অন্যান্য রাজপুত রাজা আর অভিজাত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে সাহায্য চান। পৃথ্বীরাজের সহায়তায় প্রায় ১৫০ জন রাজপুত রাজা এগিয়ে আসেন। হিন্দুরাজাদের এহেন ঐক্য মধ্যযুগের একটি বিরল ঘটনা। আশেপাশের রাজ্যের সাহায্য পেয়ে পৃথ্বীরাজ বিশাল এক সেনাবাহিনী গঠন করতে সক্ষম হন। ঐতিহাসিক ফারিস্তার বর্ণনায় জানা যায়, পৃথ্বীরাজের বাহিনীতে হাতি ছিল প্রায় ৩,০০০-এর বেশি। আর অশ্বারোহীসহ সেনাবাহিনীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৩ লাখে। মোহম্মদ ঘুরি তাঁর বাহিনীকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করেন— অগ্রবর্তী বাহিনী, মধ্য বাহিনী, ডান বাহু, বাম বাহু আর পশ্চাৎ বাহিনী। প্রতিটি অংশে সৈন্যসংখ্যা ছিল ১০ হাজার করে। মোহম্মদ ঘুরি তাঁর নিজের কমান্ডে প্রায় ১২ হাজার সৈন্য রিজার্ভ হিসাবে রাখেন। অন্যদিকে রাজপুত সেনাবাহিনী প্রচলিত ভারতীয় ঐতিহ্য অনুযায়ী নিজেদের মতো করে সেনাবিন্যাস করে।
মোহম্মদ ঘুরি ভোরের দিকে রাজপুত শিবিরে আক্রমণ চালালেন। রাজপুত সেনারা তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল। তাঁদের ঘুম ভাঙে মোহম্মদ ঘুরির সেনাবাহিনীর আক্রমণে। চারপাশ থেকে রাজপুত সেনাবাহিনীদের ঘিরে তীর বৃষ্টি হচ্ছিল। রাজপুত সেনারা দ্রুত নিজেদের সামলে নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। রাজপুতরা ছিলেন সহজাত যোদ্ধা জাতি। যুদ্ধক্ষেত্রে পিঠ দেখানোর কথা তাঁদের খুব কমই শোনা যেত। দ্রুতই রাজপুত সেনাবাহিনী মোহম্মদ ঘুরির সেনাবাহিনী তীব্র বাঁধা প্রদান করেন। কিন্তু মোহম্মদ ঘুরির তীরন্দাজ ও অশ্বারোহী বাহিনীর আক্রমণে পৃথ্বীরাজের বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। পৃথ্বীরাজ চৌহানের সবচেয়ে অভিজ্ঞ সেনাপতি খান্ডে রাও নিহত হন, যা রাজপুত বাহিনীর চূড়ান্ত পতন তরান্বিত করে। রাজপুত সেনারা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ব্যাপকহারে পালিয়ে যেতে বাধ্য হলেন। এই যুদ্ধের রাজপুত বীর রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহান মৃত্যুবরণ করেন। ১৫০ রাজ্যের ১৫০ রাজার সম্মিলিত সেনাবাহিনী একা মোহম্মদ ঘুরির সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুঝতে পারননি, এটা একেবারেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। যদি ১৫০ রাজা তাঁদের সেনাবাহিনী নিয়ে রণক্ষেত্রে সত্যিই ঘুরির সেনাবাহিনীর সঙ্গে সর্বশক্তি ব্যবহার করে লড়াই দিতেন, মোহম্মদ ঘুরি ফুঙ্কারেই উড়ে যেত। মনে রাখতে হবে সে সময় ভারতীয় উপমহাদেশে প্রতিবেশী বন্ধু রাজা পাওয়া খুবই দুর্লভ ছিল।
যাই হোক, পৃথ্বীরাজ চৌহানই ছিলেন হিন্দুস্তানের শেষ স্বাধীন রাজা যিনি বিক্রমাদিত্য হিমুর আগে দিল্লির সিংহাসন দখলে রাখতে পেরেছিলেন। ভারতের হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা আজও পৃথ্বীরাজ চৌহানকে বীরের মর্যাদা দেন, যিনি একটি স্বাধীন হিন্দু রাজ্যের জন্য নিজের জীবন দান করেছিলেন। এদিকে মোহম্মদ ঘুরির ইচ্ছা তো আর ‘ঘরশত্রু’ রাজা জয়চন্দ্র জানতেন না। মোহম্মদ ঘুরি তো আসলেই ভারতে মুসলিমদের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাইছিলেন। এদিকে নিজের স্বপ্নপূরণের উদ্দেশ্যে রাজা জয়চন্দ্র মোহম্মদ ঘুরির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন। ফলে মোহাম্মদ ঘুরি পুনরায় ভারতের দিকে অগ্রসর হন। বর্তমান ফিরোজাবাদের চন্দ্রবারে মোহম্মদ ঘুরি আর রাজা জয়চন্দ্র পরস্পরের মুখোমুখি হন। যুদ্ধে রাজা জয়চন্দ্র চোখে তীরবিদ্ধ হয়ে হাতির পিঠ থেকে পড়ে যান এবং হাতির পায়ের নীচে চাপা পড়ে মারা যান।
হাসান নিজামির মতে, মোহম্মদ ঘুরি পৃথ্বীরাজকে তাঁর সামন্ত রাজা হিসাবে আজমিরে রাজত্ব করতে অনুমতি দেন। কিন্তু পৃথ্বীরাজ মোহম্মদ ঘুরির বিরোধিতা করলে তাঁকে হত্যা করা হয়। তবে কঙ্কর সিংহ তাঁর ‘ইসলামের ভারত অভিযান’ গ্রন্থে লিখেছেন– “পৃথ্বীরাজের ঔদার্যের প্রতিদানে তিনি সেবার পরাজিত পৃথ্বীরাজকে হত্যা করেন। … যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পূর্বেই পৃথ্বীরাজকে তিনি সুযোগ দিয়েছিলেন, রাজাকে আহ্বান জানিয়েছিলেন ইসলাম কবুল করতে। হতভাগ্য পৃথ্বীরাজ আল্লাহর সত্য ধর্মের মহিমা বুঝতে পারেননি, আল্লাহ তো বলেই দিয়েছেন মুসলমানদের, যেখানে পাবে সত্যধর্ম প্রত্যাখানকারী কাফেরদের বধ করতে।” মুসলিম ঐতিহাসিক পারস্যের হাসান নিজামি তাঁর ‘তাজ-উল-মাসির’ গ্রন্থে বলেছেন –“এক লক্ষ হীন ও বিপর্যয়গ্রস্ত হিন্দু দ্রুত নরকের আগুনে নিষ্ক্রান্ত হল।… যুদ্ধক্ষেত্রে রক্তের বন্যা বয়ে গেল।” নিজামি লিখেছেন– “তলোয়ারের ডগায় তাঁরা (হিন্দুরা) নরকের আগুনে নিপতিত হল।… তাঁদের ছিন্ন মস্তকে গড়া তিনটি বুরুজ যেন আকাশ সমান হয়ে গেল এবং তাঁদের শবদেহ শিকারি পাখির খাদ্যে পরিণত হল। অঞ্চলটিকে মূর্তি ও মূর্তিপূজা মুক্ত করা হয় ও অবিশ্বাসের ভিত্তি ধ্বংস করা হয়। … যা ছিল হিন্দু রাজ্যের কেন্দ্রস্থল সেখানে তাঁরা ধ্বংস করে প্রায় এক হাজার মন্দির। সেগুলির ভিতের উপর মসজিদ স্থাপন করা হয়।” কুতুবউদ্দিন আইবকের গুজরাটের রাজধানী নাহরওয়ালা অভিযান প্রসঙ্গ নিজামি লিখেছেন –“তরবারির দ্বারা পঞ্চাশ হাজার অবিশ্বাসীকে নরকে প্রেরণ করেন এবং মৃতদেহের স্কুপে পাহাড় ও সমতল ভূমি সমান হয়ে যায়।” কুতুবউদ্দিনের কালিনজর অভিযানের সাফল্যের বর্ণনায় নিজামির কলম বলছে –“ মন্দিরগুলিকে মসজিদে রূপান্তরিত করা হয় এবং নামাজে আহ্বানের আওয়াজ আকাশের উচ্চমার্গে পৌঁছে যায় ও পৌত্তলিকতার নাম সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত করা হয়।… পঞ্চাশ হাজার মানুষ ক্রীতদাসত্বের অধীনে আসে এবং হিন্দুদের রক্তে সমতলভূমি পিচের মতো কালো বর্ণ ধারণ করে।”
মোহম্মদ ঘুরি ১২০২ সালে শেষবারের মতো ভারতে আসেন। তখন তিনি খোঙ্কর উপজাতিকে দমনের জন্য কাংড়া ও কাশ্মীর সীমান্তে অবস্থান করেন। ঠিক এই সময়েই এক অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি তথা গুপ্তঘাতক তাঁকে হত্যা করে। ভারতের ইতিহাসে সুলতান মামুদ লুণ্ঠনকারীরূপে চিহ্নিত হয়ে থাকলেও মোহম্মদ ঘুরী কিন্তু রাজ্য স্থাপয়িতার সম্মান পেয়েছেন। ভারত-ইতিহাসে মোহম্মদ ঘুরি নিঃসন্দেহে স্থায়ী কীর্তিলাভ করেছেন। তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধ ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই যুদ্ধে হিন্দুস্তানে পরবর্তী মুসলিম আক্রমণের সাফল্যকে সুনিশ্চিত করে। যদিও মোহম্মদ ঘুরি দিল্লিকে তাঁর নিজ রাজধানী হিসাবে গণ্য করেননি। তাঁর নিজ পৈত্রিক নগর ঘুর ও অর্জিত নগর গজনিকে কেন্দ্র করে তিনি তাঁর রাজধানী স্থাপন করেন। তথাপি তিনি তাঁর শাসনকর্তা কুতুবউদ্দিন আইবককে দিল্লিতে তাঁর প্রাদেশিক শাসনকেন্দ্র গঠনের অনুমতি দেন। এভাবেই মধ্যযুগের দিল্লির ‘গৌরবের ভিত্তি স্থাপিত হয়। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ায় মুসলিম শাসনের ভিত্তি তিনি স্থাপন করেছেন। মোহম্মদ ঘুরি ভারতের শাসনের ক্ষেত্রে একটি বাস্তবসম্মত নীতি গ্রহণ করেছিলেন। রাজপুত রাজারা বশ্যতা স্বীকার করলে তিনি তাঁদের স্বায়ত্বশাসনের অধিকার দেন। সে সময় গ্রাম ও শহরগুলি স্থানীয় রায়াত বা রাণারা শাসন করতেন। এইসব রাজপুতদের বশ্যতা স্বীকার করিয়ে সামন্তরাজায় পরিণত করেছিলেন তিনি। মোহম্মদ ঘুরি ঘুর রাজ্যে বসেই ভারতের দিকে সর্বদা নজর রাখতেন এবং শাসন পরিচালনা করতেন। মোহম্মদ ঘুরি যে কেবল হিন্দুরাজ্যগুলিই আক্রমণ দখল করেছিলেন, তা নয়। তিনি মুসলিম পরিচালিত রাজ্যেও সমান আক্রমণ চালান। তাঁর শাসনাধীন অঞ্চলসমূহের মধ্যে ছিল বর্তমান আফগানিস্তান, ইরান, তুর্কমেনিস্তান, তাজিকিস্তান এবং অবশ্যই ভারত উপমহাদেশের একটা অংশ। তিনি ভারতের ঘুণে ধরা বিপর্যস্ত রাজনৈতিক অবস্থার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করেছিলেন। সীমাবদ্ধ শক্তি নিয়ে তিনি আফগানিস্তান থেকে বঙ্গদেশ পর্যন্ত এক বৃহৎ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত করে গিয়েছিলেন।
ভারত উপমহাদেশে প্রবেশের সময় গুজরাটে তখন অল্পবয়স্ক শাসক দ্বিতীয় ভীমদেব সোলাঙ্কি শাসন করছিলেন। রাজার মা নাইকিদেবী সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দেন। মরুভূমির মধ্য দিয়ে যাত্রার সময় মোহম্মদ ঘুরির সেনাবাহিনী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নাইকিদেবী কায়াদারা গ্রামের কাছে মুইজউদ্দিনকে পরাজিত করতে সক্ষম হন। মোহম্মদ ঘুরি ও তাঁর সেনাদল মরুভূমির মধ্য দিয়ে মুলতান ফিরে আসেন। ঘুরি এরপর ঘুর ফিরে আসেন। বামিয়ান ও সিস্তানের শাসকদের সঙ্গে তিনি সুলতান শাহের বিরুদ্ধে তাঁর ভাই গিয়াসউদ্দিনকে সহায়তা করেন। ১৯৭৩ সালে মুইজউদ্দিন গজনি শহর দখল করে নেন। তিনি উত্তর ভারতে অভিযানের জন্য এই শহরকে সূচনাস্থল হিসাবে ব্যবহার করেন। এ সময়ে পশ্চিম এশিয়ায় বৃহত্তর খোরাসানের আধিপত্য নিয়ে খোয়ারিজমীয় সাম্রাজ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় তিনি তাঁর ভাই গিয়াসউদ্দিনকে সহায়তা করেন। ১৯৭৩ সালে তাঁরা গজনি আক্রমণ করে অগুজ তুর্কিদের বিতাড়িত করেন। এটি ছিল তাঁর সর্বশেষ পারস্যায়িত প্রতিপক্ষ। ইতিপূর্বে অগুজ তুর্কিরা গজনভিদের কাছ থেকে শহরটি দখল করে নিয়েছিল। মুইজউদ্দিনকে গজনির শাসক নিযুক্ত করা হয়। ১৯৭৫ সালে দুই ভাই হেরাতের সেলজুক গভর্নর বাহাউদ্দিন তুগরিলের কাছ থেকে হেরাত জয় করেন। ১৯৭৫ সালে হামিদ লুদি রাজবংশের কাছ থেকে মুইজউদ্দিন মুলতান জয় করেন। হামিদ লুদিরা পশতু ছিল তবে ইসমাইলি শিয়াদের সঙ্গে তাদের সংযোগের কারণে অনৈসলামিক বলে অভিযোগ ছিল। মুলতানের ইসমাইলি শাসকদের বিরুদ্ধে মুইজউদ্দিনের অভিযান সফল হয়। তিনি দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হন এবং তাঁর সেনাবাহিনীকে মুলতান থেকে উচের দিকে নিয়ে আসেন। ১৯৭৫ সালে তিনি উচ অধিকার করেন। সিস্তান থেকে মোহম্মদ ঘুরি অভিযান শেষে ফিরে এলে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য কান্দাহারের শাসনভার লাভ করেন। এছাড়া পুশান জয় করেন। সিস্তানের শাসক তাজউদ্দিন হারব ইবনে মোহম্মদ এবং কিরমানের অন্যান্য অঘুজ তুর্কিরা ঘুরিদের সার্বভৌমত্ব মেনে নেয়। একই সময়ে খোয়ারিজমীয় সুলতান শাহ তাঁর ভাই আলাউদ্দিন তেকিশ কর্তৃক বহিষ্কৃত হন। তিনি ঘুরে আশ্রয় নেন এবং গিয়াসউদ্দিনের কাছে সামরিক সহায়তা চান। তবে গিয়াসউদ্দিন এই আহ্বানে সাড়া দেননি। সুলতান শাহ কারা-খিতান খানাতের কাছ থেকে সহায়তা অর্জন করতে সক্ষম হন এবং উত্তরের ঘুরি অঞ্চলে হামলা চালান। ১৯৯০ সালে মার্ভে সুলতান শাহকে পরাজিত করেন। এরপর তিনি সুলতান শাহের অধীনস্থ বৃহত্তর খোরাসানের অধিকাংশ অঞ্চল নিজ রাজ্যে যুক্ত করেন।
১২০২ সালে গিয়াসউদ্দিনের মৃত্যুর পর মোহম্মদ ঘুরি সাম্রাজ্যের শাসক এবং ১২০৬ সালে নিহত হওয়ার আগে পর্যন্ত শাসন করেন। গজনি ফেরার সময় তাঁর কাফেলা শোহাওয়ার কাছে দামিয়াকে বিশ্রামের জন্য থামেন। এটি বর্তমানে পাকিস্তানের পাঞ্জাবের অন্তর্গত। ১২০৬ সালের ১৫ মার্চ মাগরিবের নামাজ পড়ার সময় তিনি নিহত হন। তাঁর হত্যাকারীর প্রকৃত পরিচয় নিয়ে বিতর্ক আছে। কারও কারও মতে এই হত্যাকাণ্ড স্থানীয় গাখারদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছিল। আবার কারও মতে তিনি খোখার বা ইসমাইলিদের হাতে নিহত হয়েছিলেন। হাসান নিজামি ও ফিরিশতার বর্ণনা অনুযায়ী মোহম্মদ ঘুরি গাখারদের হাতে নিহত হন।
হাসান নিজামি তাঁর ‘তাজ-উল-মাসির’ গ্রন্থে যাই-ই বলুক এ. কে. এম. শাহনাওয়াজ তাঁর ‘বিশ্বসভ্যতা (মধ্যযুগ) গ্রন্থে লিখেছেন— মোহম্মদ ঘুরি ভারতের উপর চূড়ান্ত রকমের আধিপত্য কায়েম করেও হিন্দুদের প্রতি উদারনীতি গ্রহণ করেছিলেন। পূর্বের মতোই অনেক হিন্দুরাজা তাঁদের নিজস্ব রাজ্য পরিচালনা করতে থাকেন। প্রশাসনের উঁচু পদে হিন্দুদের স্থান দেওয়া হয়। ভারতের অধিবাসীদের নিজ নিজ ধর্ম পালনে কোনো প্রকার বাঁধা দেওয়া হত না। এমনকি মোহম্মদ ঘুরির ভারত বিজয়ের পূর্বে হিন্দুদেবী লক্ষ্মীর প্রতিকৃতি সহ যে মুদ্রা প্রচলিত ছিল, সেগুলোরও কোনো পরিবর্তন করা হয়নি। সেই শাসনের তরঙ্গ পরবর্তী ৫০০ বছর কম/বেশি জারি ছিল। ভারতে ইসলামের রক্ষকরূপে কোরানের শাসন প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার নিয়ে ভারতে ‘সুলতানাত’ প্রতিষ্ঠা হয়। মুসলমানরা সেসময় থেকে শাসক হয়ে ভারতে স্থায়ীভাবে বাস করতে থাকেন এবং ভারতকে নিজের দেশ বলেই ভাবতে শুরু করেন।
এ সময় ঘুরি নেতৃবৃন্দের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা দেয়। ১২১৫ সালের দিকে খোয়ারিজমীয়রা ঘুরি সুলতানাতের উপর জয়ী হয়। ঘুরি সাম্রাজ্য ভেঙে পড়লেও তৈমুরীয়দের আগমনের আগে পর্যন্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিছু ঘুরি রাজ্য টিকে ছিল। মোহম্মদ ঘুরির কোনো সন্তান ছিল না। তিনি তাঁর তুর্কি দাসদের সঙ্গে সন্তানের মতো আচরণ করতেন। তাঁরা সৈনিক ও প্রশাসক, উভয় হিসাবে প্রশিক্ষণ লাভ করেছিল এবং তাঁদের উৎকৃষ্ট মানের শিক্ষা দেওয়া হয়। তাঁর সেনাবাহিনী ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে অনেক দাস অধিষ্ঠিত ছিল। মোহম্মদ ঘুরির মৃত্যুর পর তাঁর সাম্রাজ্য দাসদের মধ্যে বিভক্ত হয়। এদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলেন –(১) কুতুবউদ্দিন আইবক ১২০৬ সালে দিল্লির শাসক হন এবং দিল্লি সুলতানাত প্রতিষ্ঠা করেন। এর মাধ্যমে ভারতে মামলুক রাজবংশের সূচনা হয়। (২) নাসিরউদ্দিন কাবাচা ১২১০ সালে মুলতানের শাসক হন। (৩) তাজউদ্দিন ইলদিজ গজনির শাসক হন। (৪) ইখতিয়ার উদ্দিন মোহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি বাংলার শাসক হন। (তথ্যসূত্র : roar.media)