বখতিয়ার খলজি (শাসনকাল ১২০১ থেকে ১২০৬ সাল)
তুর্কি সেনাপতি বখতিয়ার খলজির পুরো নাম ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজি। বখতিয়ার খলজি যাকে মালিক গাজি’ ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজি হিসাবেও উল্লেখ করা হয়। ইনি ছিলেন মুসলিম এবং খলজি উপজাতির। খলজি উপজাতি উত্তর-পূর্বের প্রায় সমস্ত দখল-যুদ্ধে যোগদানকারী সেনাবাহিনীর অধিপতিদের কাজে নিযুক্ত ছিল। বখতিয়ার খলজি ছিলেন জাতিতে তুর্কি আর পেশায় ভাগ্যান্বেষী সৈনিক। জীবনের প্রথম ভাগে। তিনি ছিলেন আফগানিস্তানের গরমশির বা আধুনিক দশত-ই-মার্গের অধিবাসী। তাঁর বাল্যজীবন সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না। তবে মনে করা হয় দারিদ্রের পীড়নে তিনি স্বদেশ ত্যাগ করেন এবং নিজের কর্মশক্তির উপর আস্থা রেখে ভাগ্যান্বেষণে বেরিয়ে পড়েন। প্রথমেই তিনি গজনির সুলতান মোহাম্মদ ঘুরির সৈন্যবাহিনীতে চাকুরিপ্রার্থী হয়ে ব্যর্থ হন। আকারে খাটো, লম্বা হাত এবং কুৎসিত চেহারার অধিকারী হওয়ায় সেনাধ্যক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হন। গজনিতে ব্যর্থ হয়ে তিনি দিল্লিতে কুতুবউদ্দিন আইবেকের দরবারে হাজির হন। এখানেও তিনি চাকরি পেতে ব্যর্থ হন। এরপর তিনি বাউনে যান। সেখানকার শাসনকর্তা মালিক হিজবরউদ্দিন বখতিয়ার খলজিকে নগদ বেতনে সেনাবাহিনীতে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। কিন্তু উচ্চভিলাষী বখতিয়ার সামান্য বেতনভোগী সেনা হয়ে পরিতৃপ্ত হতে পারেননি। অল্প কিছুকাল পর তিনি বাউন ত্যাগ করে অযোদ্ধায় চলে আসেন। সেসময় অযযাদ্ধার শাসনকর্তা ছিলেন হুসামউদ্দিন। তিনি বখতিয়ারকে পূর্ব-দক্ষিণ কোণে ভগবৎ ও ভিউলি (বর্তমান মির্জাপুর জেলার অন্তর্ভুক্ত) নামক দুইটি পরগনার জায়গির দান করেন। এখানেই বখতিয়ার তার ভবিষ্যৎ উন্নতির উৎস খুঁজে পান এবং এই দুটি পরগনাই পরবর্তীকালে তাঁর শক্তির উৎস হয়ে ওঠে। ১২০১ সালে বখতিয়ার মাত্র ২০০০ সৈন্য সংগ্রহ করে পার্শ্ববর্তী হিন্দু ও বৌদ্ধ রাজ্যগুলো আক্রমণ করতে থাকেন। সেই সময়ে তাঁর বীরত্বের কথা চারিদিক ছড়িয়ে পড়তে থাকে এবং অনেক মানুষ তাঁর বাহিনীতে যোগদান করতে থাকে, এতে করে তাঁর সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এভাবে চলতে থাকলে তিনি একদিন এক প্রাচীরবেষ্টিত দুর্গের মতো স্থানে আসেন এবং আক্রমণ করেন। প্রতিপক্ষ কোনো বাধাই দেয়নি। দুর্গজয়ের পর তিনি দেখলেন যে দুর্গের অধিবাসীরা প্রত্যেকেই মুণ্ডিতমস্তক এবং দুর্গটি বইপত্র দিয়ে ভরা। জিজ্ঞাসাবাদের পর তিনি জানতে পারলেন যে, তিনি একটি বৌদ্ধবিহার জয় করেছেন। এটি ছিল ওদন্ত বিহার বা ওদন্তপুরী বিহার। সেইসময় থেকেই মুসলমানেরা জায়গাটিকে বিহার বা বিহার শরিফ নামে ডাকে। বিহার জয়ের পর বখতিয়ার খলজি অনেক ধনরত্ন সহ। কুতুবউদ্দিন আইবকের সঙ্গে দেখা করতে যান এবং কুতুবউদ্দিন কর্তৃক সম্মানিত হয়ে ফিরে আসেন। এর পরই তিনি বাংলা জয়ের জন্য সাহস এবং শক্তি সঞ্চয় করতে থাকেন।
১২০৫ সালে তৎকালীন বঙ্গের শাসক সেন রাজবংশের চতুর্থ এবং শেষ রাজা লক্ষ্মণ সেনকে পরাজিত করে বখতিয়ার গৌড় দখল করেন। এখানে একটু বুঝে নিতে হবে সেনযুগের বঙ্গ বলতে ঠিক কোন্ অঞ্চল বা অংশকে বোঝাচ্ছে। অর্থাৎ বখতিয়ার কোন দখল বা জয় করেন। লক্ষ্মণ সেন বা বখতিয়ারের বঙ্গ কিন্তু মোগল আমলের কিংবা ব্রিটিশ-ভারতের কিংবা বর্তমানের বাংলা বা বাংলাদেশকে বোঝায় না। সেন যুগে বাংলার বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল। যেমন –বঙ্গ, পুণ্ড, বরেন্দ্র, রাঢ়, গৌড়, সমতট, হরিখেল, চন্দ্রদ্বীপ, তাম্রলিপ্ত ইত্যাদি। এই প্রত্যেকটা অঞ্চলের পৃথক পৃথক রাজা শাসক ছিলেন। তেমনই একটি অংশ গৌড়ের রাজা বা শাসক ছিলেন লক্ষ্মণ সেন। গৌড় হল মালদহ, মুর্শিদাবাদ ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহকে বোঝাত। বঙ্গ বলতে বোঝা হত ঢাকা, ফরিদপুর ও ময়মনসিংহ অঞ্চলসমূহকে। পুণ্ডু হল বগুড়া, রংপুর, রাজসাহি ও দিনাজপুর অঞ্চলসমূহকে। পুরে আবার একটা অংশকে বরেন্দ্র বলা হত, এখন রাজসাহি জেলার অন্তর্গত। রাঢ় বলতে বলতে বোঝাত ভাগীরথীর পশ্চিমতীরের অঞ্চলসমূহকে। সমতট হল দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল এবং কুমিল্লা ও নোয়াখালি জেলা। চন্দ্রদ্বীপ বলতে যে অঞ্চল বোঝাত সেটা বর্তমানে বরিশাল জেলার অন্তর্গত। তাম্রলিপ্ত হল সমগ্র মেদিনীপুর জেলা, এই মেদিনীপুর একসময় ওড়িশার অন্তর্গত ছিল। বিদেশি শত্রুর (বিদেশি শত্রু বলতে এখানে পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলি বুঝতে হবে) আক্রমণ থেকে বাঁচতে প্রত্যেকটি অঞ্চলের রাজারা নিজের নিজের এলাকাকে সুরক্ষিত রাখতে ১০ গজ উঁচু ও ২০ গজ বিস্তৃত বিশাল প্রাচীর বা ‘আল’ নির্মাণ করে রাখতেন। এই ‘আল’ থেকেই সেই এক একটা অঞ্চলের মানুষদের বলা হত বঙ্গাল বা বাঙ্গাল। সমস্ত আল তথা বঙ্গালকে এক ছাতার নীচে প্রথম নিয়ে আসে মুসলিম শাসক শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ ১৩৪২ সালে। এরপর বাংলা আরও বিস্তৃতি লাভ করে ১৩৫২ সালে। সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের শাসনকাল ছিল ১৩৪২ থেকে ১৩৫৭ সাল পর্যন্ত। শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ সারা বাংলার অধীশ্বর ‘শাহ-ই-বাঙ্গালা’ এবং ‘সুলতান-ই-বাঙ্গালা’ উপাধি গ্রহণ করেন।
বখতিয়ার খিলজির দখল বলতে তখন কেবলমাত্র গৌড়। আল’ গড়ে তুলে স্থানীয় রাজাদের আক্রমণ প্রতিরোধ করা গেলেও দক্ষ ও সাহসী মুসলিম সেনানায়কদের প্রতিরোধ করা সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশের প্রায় কোনো রাজার পক্ষেই সম্ভব হয়নি। জনশ্রুতি, নদিয়ায় আসার কিছু আগে রাজসভার কিছু দৈবজ্ঞ পণ্ডিত রাজা লক্ষ্মণ সেনকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, এক তুর্কি সৈনিক তাঁকে পরাজিত করতে পারে। এই সতর্কবাণী শুনে লক্ষণ সেনের মনে ভীতির সঞ্চার হয় এবং নদিয়ার প্রবেশপথ রাজমহল ও তেলিয়াগড়ের নিরাপত্তা জোরদার করেন। লক্ষণ সেনের ধারণা ছিল যে, ঝাড়খণ্ডের শ্বাপদশংকুল অরণ্য দিয়ে কোনো সৈন্যবাহিনীর পক্ষে নদিয়া আক্রমণ করা সম্ভব নয়। কিন্তু বখতিয়ার সেইপথেই তাঁর সৈন্যবাহিনীকে নিয়ে আসেন। নদিয়া অভিযানকালে বখতিয়ার ঝাড়খণ্ডের মধ্য দিয়ে এত দ্রুতগতিতে অগ্রসর হয়েছিলেন যে, তাঁর সঙ্গে নাকি মাত্র ১৭ জন সৈনিকই তাল মেলাতে পেরেছিলেন (একটা বাহিনীর কত জন সৈন্য প্রাসাদের মধ্যে ঢুকেছিল সেই হিসাব কে রেখেছে? এই প্রশ্নের জবাব পাওয়া না-গেলেও আমাদের পাঠ্যবইয়ে পড়ানো হয় বখতিয়ার খলজি ১৭ জন সৈন্য নিয়ে বাংলা দখল করেছিল। ব্যাপারটা বেশ হাস্যকর বটে।)। অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘বখতিয়ারের নবদ্বীপ জয়’ গ্রন্থে লিখেছেন –“মাত্র সতেরোজন (উনিশজন) হাতিয়ারধারী লুঠেরা বণিকের বেশে হানা দিয়া এত বড়ো কাণ্ডকারখানা ঘটাইল, ইতিহাসে তাহার দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত নাই।” সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও এ বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করে একটু অন্যরকমভাবে লিখেছেন– “সপ্তদশ অশ্বারোহী লইয়া বখতিয়ার খিলজি বাঙ্গালা জয় করিয়াছিল, একথা যে বাঙ্গালীতে বিশ্বাস করে, সে কুলাঙ্গার।” ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় স্পষ্টতই লিখেছেন– “অষ্টাদশ অশ্বারোহী লইয়া মহম্মদ-ই-বখতিয়ারের গৌড়বিজয় কাহিনি বিশ্বাসযোগ্য বলিয়া বোধ হয় না।” বখতিয়ার সোজা রাজা লক্ষ্মণ সেনের প্রাসাদদ্বারে উপস্থিত হন এবং দ্বাররক্ষী ও প্রহরীদের হত্যা করে প্রাসাদের ভিতরে প্রবেশ করেন। এতে করে প্রাসাদের ভিতরে হইচই পড়ে যায়। লক্ষণ সেন দিশেহারা হয়ে প্রাসাদের পিছনের দরজা দিয়ে নৌপথে বিক্রমপুরে পালিয়ে যান।
বস্তুত বখতিয়ার খলজির হাত ধরেই বাংলায় মুসলিম শাসনের সুত্রপাত হয়। মাত্র ১৭ জন সৈন্য নিয়ে কীভাবে একটা দেশ (বঙ্গদেশ) দখল করা সম্ভব? স্বাভাবিকভাবে ছুরি তলোয়ার হাতে ১৭ জন মানুষ ২০০ জন নিরস্ত্র মানুষ খুব সহজে ঘায়েল করে ফেলতে পারেন। বাংলায় ইসলামি শাসনব্যবস্থার শুরু এটুকু বলেই আমাদের ঐতিহাসিকরা দায়িত্ব শেষ করেছেন। কিন্তু তাঁরা যে বিষয়টাকে পুরোপুরি আষাঢ়ে গল্প বানিয়ে ফেলেছেন, সেটা খেয়াল করেননি। কিন্তু এক্ষেত্রে বাঙালিরা ব্যর্থ হল কেন? সে সময় পার্শ্ববর্তী বাঙালি অধ্যুষিত স্টেটগুলিতে অনেক রাজা ছিল, তাঁদের নিজস্ব পতাকা সহ সেনাবাহিনী ছিল। তাঁরা সম্মিলিতভাবে আক্রমণ না-করে হাত গুটিয়ে বসে থাকলেন কেন? কেন ভিনদেশি যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুললেন না? সেসময় নিজেদের গা বাঁচিয়ে থাকলেও তাঁরাও শেষপর্যন্ত গা বাঁচাতে পারেননি। ওর বাড়িতে আগুন লেগেছে তো ওরাই সামলাক। আমার বাড়িতে তো আগুন লাগেনি। এই ধরনের মানসিকতাই বঙ্গভূমির মাটি বখতিয়ারের কবজা হয়ে গেল। সেনরাজা লক্ষ্মণ সেনই-বা পূর্ণ শক্তি দিয়ে বখতিয়ারের বিরুদ্ধে লড়াই দিতে দিতে পারলেন না? মাত্র ১৭ জন সেনার কাছে। লক্ষ্মণ সেন হার মেনে নিলেন? এই যুদ্ধে লক্ষ্মণ সেনের পরাজয়ের পিছনের সামাজিক কারণগুলো নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। মুসলিম হানাদারদের সম্বন্ধে প্রচারিত গুজব, বর্ণবাদী হিন্দু সমাজের অত্যাচার, বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের প্রতি অত্যাচার, সামন্তপ্রভুদের স্বেচ্ছাচারী নীতি, বৃদ্ধ রাজা, রাজার যোগ্য উত্তরসুরির অভাব, মুসলিম সুফি সাধকদের প্রতি নিম্নবর্ণের হিন্দুদের আকর্ষণ ও শাসক শ্রেণির উদাসীনতাই এই যুদ্ধে পরাজয়ের কারণ। বাস্তবিকই এই সময়ে লক্ষ্মণ সেন অতিমাত্রায় বৃদ্ধ ছিলেন। তাঁর পক্ষে দেশ চালানোই সম্ভব হচ্ছিল না। আর এই সুযোগে বাংলার সামন্তপ্রভুরা নিজেদের ইচ্ছামতো প্রজাদের উপর অত্যাচার করত এবং খাজনা আদায়ের কোনো ধরাবাঁধা নিয়মও ছিল না। প্রজামঙ্গলকারী রাজাদের কখনোই পতন হয় না। তেমন হলে সমগ্র প্রজারা সেই রাজাদের রক্ষা করতে অকাতরে প্রাণ পর্যন্ত বিসর্জন দিয়ে দিতে পারে। যেহেতু লক্ষ্মণ সেন ৫০ বছর বয়সের পরে আর কোনো যুদ্ধ করেননি, সেহেতু তাঁর সৈন্যবাহিনীর হাতে বিনোদন বলতে ছিল নিম্নবর্ণের হিন্দুদের প্রতি অত্যাচার, নারীভোগ এবং মদ ইত্যাদি। অপরদিকে সুফিসাধকদের সাদামাটা জীবন ও বর্ণবিহীন সমাজ দেখে নিম্নবর্ণের হিন্দুসমাজ ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। তাই মনে মনে সেই সময়ে তাঁরা অক্ষম শাসকের পরিবর্তে সক্ষম নতুন শাসকই কামনা করছিল, তা সে ধর্মেরই হোক না-কেন। সে সময়কার মানুষ ধর্ম নিয়ে মোটেই মাথা ঘামাত না। অন্যদিকে বাংলার ভোগবিলাসী সামন্তপ্রভুরাও বখতিয়ারের সংগঠিত সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়তে প্রস্তুত ছিল না। তাই খলজির আগমন প্রতিহত করার বদলে তাঁরা খলজির প্রতি দলে দলে আনুগত্য প্রকাশ করতে শুরু দিল। এবং এদেশীয় সুযোগসন্ধানীরা খলজির বাহিনীতে যোগ দিল লুটের মালের লোভে, হিন্দু যুদ্ধনীতি অনুযায়ী গণিমতের মাল ভোগ করার কোনো সুযোগ নেই। ধর্মীয় সমর্থনও নেই। কিন্তু যখন সুযোগ এল তখন বাঙালিরা ধর্মের মুখে লাথি কষিয়ে মুসলিম সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন এবং গণিমতের মাল ভোগের ব্যাপারে তাঁদের আগ্রহ কোনোদিক থেকেই মুসলিম সেনাদের চাইতে কম ছিল না। ফলে লক্ষ্মণ সেন রাজা হয়েও একরকম একা হয়ে যান। তাঁর পক্ষে দুর্ধর্ষ খলজি বাহিনীকে ঠেকানোর কোনো উপায় ছিল না। কারণ জনগণ এবং সৈন্যবাহিনী উভয়ই লক্ষ্মণ সেনের হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল।
বস্তুত সেনরাজারা বাংলায় বহিরাগত। দক্ষিণ ভারতের কর্ণাট (বর্তমানে কর্ণাটক) থেকে বাংলায় কেন কীভাবে এসেছিলেন, তার যথাযথ উত্তর মেলে না। সামন্ত সেনই প্রথম বাংলায় প্রবেশ করেন। এরপর সামন্ত সেনের পুত্র হেমন্ত সেনের বংশধর বিজয় সেন, বল্লাল সেন, লক্ষ্মণ সেন বাংলা শাসন করেন। বখতিয়ারের প্রবেশের পর বিশ্বরূপ সেন এবং কেশব সেন ১২২৫ সাল পর্যন্ত সেন-শাসন ছিল। লক্ষ্মণ-পরবর্তী সেনরাজাদের ধরলে সেনবংশের শাসনকাল ১৩০ বছর (১০৯৬ থেকে ১২২৫)। সেনরাজারা চারপুরুষ ধরে বাংলা সর্বনাশ করে ছেড়েছিলেন। দক্ষিণ ভারতের কর্ণাট দেশ থেকে আগত সেন রাজন্যবর্গের পূর্বপুরুষ বাংলায় বসতি স্থাপন করেন এবং ক্রমান্বয়ে শক্তি সঞ্চয় করে তাঁরা বাংলার রাজক্ষমতা দখল করেন। আর সেই শক্তি হল ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্মীয় শক্তি। ব্রাহ্মণ্যবাদী কঠোর অনুশাসনের প্রয়োগ শুরু হয় সেন যুগেই। সেনরাজারা ছিলেন গোঁড়া ব্রাহ্মণ্যধর্মের ধারক ও বাহক। বর্তমানে বাংলার হিন্দু বলতে সেন আমলের ব্রাহ্মণ্যবাদ। কর্ণাট থেকে আগত সেন রাজবংশ নিজেদেরকে ‘ব্ৰহ্ম ক্ষত্রিয়’ বলে অভিহিত করত। ঐতিহাসিক ড. আর, ভাণ্ডারকরের মতে, সেনরাজগণ প্রথমে ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের ছিলেন। পরবর্তীকালে ক্ষত্রিয় হয়ে যোদ্ধাবৃত্তি গ্রহণ করেছিলেন। দক্ষিণ ভারতে এরকম ব্রাহ্মণ থেকে ক্ষত্রিয়, ক্ষত্রিয় থেকে ব্রাহ্মণে পরিবর্তন হওয়ার ইতিহাস আমরা পাই। দক্ষিণ ভারতের সাতবাহন রাজবংশও প্রথমে ব্রাহ্মণ ছিল, পরে ক্ষত্রিয় হন। ব্রাহ্মণ থেকে ক্ষত্রিয় হলেও বামনাই প্রবৃত্তি তাঁদের ঘুচত না। ক্ষত্রিয় বৃত্তি গ্রহণ করলেও তাঁরা ছিলেন ব্রাহ্মণ্য রীতিনীতিতে গভীর বিশ্বাস এবং বর্ণাশ্রম প্রথার পরম ও কঠোর পৃষ্ঠপোষক। আমরা রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণগুলিতে দ্রোণাচার্য, বশিষ্ঠদের পরিচয় পাই, যাঁরা ব্রাহ্মণ থেকে ক্ষত্রিয় হয়ে কার্যসিদ্ধি করেছিলেন। সেন আমলের আগে বাংলায় বৌদ্ধধর্মের বিস্তার ছিল। বাংলায় সেনদের অনুপ্রবেশের পর বৌদ্ধধর্ম বিপন্ন হতে শুরু করল। মূলত বৌদ্ধ পাল রাজবংশের পতন হল এবং ব্রাহ্মণ্যবাদী সেন রাজবংশের উত্থান হল। সেনরাজারা ব্রাহ্মণ্য রীতিনীতির প্রচলন ও বাস্তবায়নে খুবই কঠোর ছিলেন। ফলে সমাজ তখন বিভিন্ন বর্ণে বিভক্ত হয়ে যায়। সেনরাজাদের অনুশাসনে উচ্চবর্ণের মানুষরা সামাজিক সুযোগসুবিধা বেশি বেশি করে পেতে থাকায় অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের দাপট সমাজে ভীতির সঞ্চার করল। অপরদিকে অন্য বর্ণের মানুষরা অর্থনৈতিক শোষণের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছিল। ধর্মীয় ফতোয়ায় তখন বর্ণে বর্ণে ও অর্থনৈতিক শ্রেণিতে শত বিভক্ত সমাজে নিম্ন বর্ণ ও শ্রেণির মানুষ উচ্চবর্ণ শ্রেণিদের করুণা ও অবহেলা পাত্র হয়ে উঠেছিল। সেনযুগে বৌদ্ধধর্ম বিলুপ্ত না-হলেও একাবারেই কোণঠাসা পড়েছিল। সেনরাজাদের দাপটে সমগ্র বাংলা কঠোর ব্রাহ্মণ্যবাদী দেশ হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। বলা ভালো, বৌদ্ধধর্মাবলম্বী পাল রাজবংশের ধ্বংসস্থূপের উপর ব্রাহ্মণ্যবাদী সেন রাজবংশের ব্রাহ্মণবাদী দেশ প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলায়। এই সময় বৌদ্ধধর্মের আচার-অনুষ্ঠান এবং সাধনপদ্ধতিগুলি ক্রমশ ব্রাহ্মণ্যধর্মের আচার-অনুষ্ঠান ও পুজোপদ্ধতির সঙ্গে মিলেমিশে যাচ্ছিল। সেই সময়কার সেনরাজাদের রচিত ‘নবধর্মগ্রন্থ’ দানসাগর, অদ্ভুতসাগর, প্রতিষ্ঠাসাগর, আচারসাগর, ব্রাহ্মণসৰ্বস্বম, মীমাংসাসৰ্ব্বস্বম, বৈষ্ণবসৰ্বম, শৈবসৰ্ব্বস্বম ও পণ্ডিতসৰ্বস্বমের নিয়মনীতিগুলি বাংলায় ব্যাপকভাবে গেঁড়ে বসেছিল। সেনরাজারা এককথায় ব্রাহ্মণ্যবাদী হলেও বিজয় সেন ও তাঁর পুত্র বল্লাল সেন শৈবধর্মের অনুরাগী ছিলেন, বল্লাল সেনের পুত্র লক্ষ্মণ সেন আবার বৈষ্ণবধর্মের অনুরাগী ছিলেন এবং লক্ষ্মণ সেনের পুত্রদ্বয় বিশ্বরূপ সেন ও কেশব সেন সৌরধর্মের অনুরাগী ছিলেন। সেনযুগটি ছিল সামন্ততন্ত্রের অপ্রতিহত যুগ। এছাড়া সেন আমলে ব্রাহ্মণ্যধর্মের সংস্কার ও সংস্কৃতি বিস্তারের সঙ্গে। সঙ্গে ব্রাহ্মণরাই অপ্রতিহত প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। এই সময়ে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদ তাঁরাই দখল করে নেন। সেন রাজবংশের শাসনামলে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদ থেকে শুরু করে সর্বত্র তাঁদের প্রাধান্য স্থাপিত হয়। এইসব ব্রাহ্মণরা একাধারে মন্ত্রী, মহামন্ত্রী, ধর্মাধ্যক্ষ, রাজপণ্ডিত, স্মৃতিশাস্ত্র রচয়িতা ছিলেন। রাজা ও বিত্তবান শ্রেণিরা তাঁদের পরিপোযণ করতেন। তাঁরা ভূমিদান, অর্থদান ইত্যাদি লাভ করে ভূমি ও সম্পদের অধিকারী হতেন এবং রাষ্ট্র ও সমাজে প্রথম শ্রেণি নাগরিকের মর্যাদা লাভ করতেন। বস্তুত ব্রাহ্মণদের এই প্রভাব অবশ্য পাল যুগ থেকেই শুরু হয়েছিল। বৌদ্ধ রাজা হওয়া সত্ত্বেও ব্রাহ্মণদেরকে ভূমি অনুদানসহ সবরকমের সহায়তা করতেন। পাল শাসনামলেও সভাকবি থেকে শুরু করে মন্ত্রী, উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী পদ পর্যন্ত ব্রাহ্মণরাই বিশেষভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। সম্ভবত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পালরাজারা তৎকালীন বাংলার ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্রাহ্মণ্যপ্রভাব প্রতিরোধ করতে না-পেরে ব্রাহ্মণ্যপ্রভাব ও প্রতিপত্তির প্রতি অত্যাধিক সহিষ্ণু হওয়ার কারণেই ব্রাহ্মণ্য প্রভাব পালশাসনে দারুণভাবে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছিল এবং তা পরবর্তী গোঁড়া হিন্দু সেনরাজাদের শাসনকালে বাংলায় ব্রাহ্মণ্যপ্রভাব অপ্রতিদ্বন্দ্বী করে তুলেছিল। অপরদিকে অন্ত্যজ এবং অস্পৃশ্য সম্প্রদায়ের প্রতি রাষ্ট্র সুপ্রসন্ন ছিল না। ফলে অস্পৃশ্যরাও রাষ্ট্র, ধর্ম ও সমাজের আদর্শকে সুনজরে দেখত না। ব্রাহ্মণ্যবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা অধিকাংশ মানুষকে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাষ্ট্রের ভিত্তিকে দুর্বল করে তুলেছিল। দেশের বড়ো অংশের মানুষ অভেদ্য বর্ণের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে নিপীড়িত হচ্ছিল। একদিকে বর্ণে বর্ণে বিভাজন বা কঠোর বিধিনিষেধ, অপরদিকে অর্থনৈতিক শ্রেণিস্তর বিভক্তি মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। কারণ এই সময় প্রাচীন বাংলার সামাজিক আদর্শকে পুরোপুরি অধিকার ও বিনষ্ট করা হয়। সামাজিক বন্ধনে উচ্চশ্রেণি ও অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল মানুষেরা সুযোগসুবিধা ভোগ করলেও নিম্নবর্ণ ও নিম্নবর্ণের জনসাধারণের দুঃখদৈন্যের শেষ ছিল না। এই ঘৃণিত অধিকারবঞ্চিত মানুষেরাই ছিল প্রাচীন ভারতের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়, আজও। অথচ মুষ্ঠিমেয় উচ্চবর্ণের লোকের হাতে সম্পদ কুক্ষিগত হয়ে পড়েছিল। এর ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠরা তাঁদের উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিল। তার বহিঃপ্রকাশ সুদূরপ্রসারী হয়েছিল। ইতিহাস সাক্ষী।
মোট কথা, সেনরাজাদের আমলে ব্রাহ্মণ্যধর্ম ছাড়া অন্য কোনো ধর্মীয় আদর্শ ও ব্যবস্থার স্বীকৃতি ছিল না। সেনরাজাদের শাসনকালে বৌদ্ধদের অবস্থা ছিল সংকটজনক। বেদবিরোধী বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা অনেকেই ব্রাহ্মণ্যধর্মে মিশে যেতে বাধ্য হলেও, যাঁরা মিশলেন না তাঁরা পরে ইসলাম ধর্মে চলে আসেন ব্রাহ্মণ্যবাদীদের সঙ্গে যুঝতে। হয় মিশে যাও, নয় দূর হও’– ব্রাহ্মণ্যবাদীদের এই নীতিতে বৌদ্ধধর্ম বাংলায় সাইনবোর্ডে পরিণত হয়েছিল। অবশ্য কেবলমাত্র সেনরাজাদেরই-বা দোষ কীভাবে দিই! ব্রাহ্মণ্যবাদের পুনরুত্থানের অন্যতম তাত্ত্বিক কুমারিল ভট্ট (ব্রাহ্মণ কুমারিল ভট্ট ছিলেন বৌদ্ধদের বিনাশকারী) অষ্টম শতকেই বিধান দিয়ে রেখেছিলেন– “বৌদ্ধ মাত্রই বধ্য”। সেই কারণেই বোধহয় মাদুরার রাজা অষ্টম শতাব্দীতে কবি ও সাধু সম্বন্দরের সম্মতিক্রমে ৮০০০ গোঁড়া জৈনপণ্ডিতকে শূলে চড়িয়ে হত্যা করেছিলেন। শঙ্কর-বিজয়’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে– রাজা সুধন্থা অসংখ্য জৈন ও বৌদ্ধ পণ্ডিতদের মস্তক উলুখলে নিষ্পেষণ করে চূর্ণ-বিচূর্ণ করেছিলেন (প্রাচীন বাঙ্গালা সাহিত্যে মুসলমানদের অবদান –দীনেশচন্দ্র সেন)। আর নিম্নজাতিরা ক্রমশ অস্পৃশ্য ও ঘৃণ্য হয়ে যেতে থাকল। তৎকালীন হিন্দু সমাজে বিভিন্ন জাতির মধ্যে ব্রাহ্মণদের সঙ্গে অন্যান্য শ্রেণির অনুগ্রহণ ও পরিণয় সম্পর্কগত বিষয়ে কঠোরভাবে বিধিনিষেধ ছিল। চণ্ডাল ও অন্ত্যজ জাতির পাত্রের জল পান করলে ব্রাহ্মণদের প্রায়শ্চিত্ত করতে হত।
এখানে একটা প্রশ্ন মনে উদয় হতেই পারে –যৌবনকালে লক্ষ্মণ সেন এত এত যুদ্ধ করে শেষে এসে এরকম নিষ্ক্রিয় হয়ে গেলেন কীভাবে? বল্লাল সেন কলিঙ্গ আক্রমণ করেন, যুদ্ধে কাশীরাজকে পরাজিত করেছিলেন, প্ৰাগজ্যোতিষের রাজা বশ্যতা স্বীকার করেছিলেন তাঁর কাছে। লক্ষ্মণ সেন এইসব যুদ্ধে স্বয়ং অংশগ্রহণ করেছিলেন। তবে লক্ষ্মণ সেনকে পুনরায় এইসব অঞ্চল এককভাবে জয় করতে হয়েছিল। তার মানে বল্লাল সেনের রাজত্বকালে সম্পূর্ণরূপে করায়ত্ত করা হয়েছিল না। পুরী, কাশী প্রয়াগেও তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তার করেন। এই সময় গঙ্গাবংশীয় রাজারা কলিঙ্গ ও উৎকলে রাজত্ব করতেন। বখতিয়ার যখন নদিয়া আক্রমণ করেন, তখন লক্ষ্মণ সেন অশীতিপরবৃদ্ধ, ৮০ বছর বয়স। অত্যন্ত বেশি বয়সেই ইনি রাজক্ষমতা লাভ করেন, সম্ভবত বয়স তখন ৫৪। বয়সের ভার ছাড়াও আর-একটি বড় কারণ হল, জনৈক ব্রাহ্মণ গুরুর প্রকোপে পড়ে মাঝবয়সে এসে লক্ষ্মণ সেন বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করেন। বৈষ্ণবরা নিরামিষ আহার শুরু করেন, মদ পরিহার করেন। বৈষ্ণবধর্ম হল অহিংসবাদী। এঁরা কখনোই রক্তপাত ঘটান না। মশার কামড়ে মরে গেলেও মশা মারবেন না। যে রাজা রক্তপাতের বিরোধী সে রাজা যুদ্ধ করে দেশরক্ষা করবে কীভাবে? রক্তপাতহীনভাবে মুসলিম আক্রমণকে প্রতিহত করতে লক্ষ্মণ সেন তাঁর গুরুর নির্দেশে বিশাল এক যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। যজ্ঞ সফলভাবে শেষও হয়েছিল। কিন্তু তার ফল চূড়ান্তভাবে পরাজয় এবং পলায়ণ। শত্রু আসার খবর পেয়ে লক্ষ্মণ সেন রাজ্যের রক্ষা করার মতো রাজধর্ম পালন না-করে উলটে পলায়ণের সুব্যবস্থা করে রাখলেন। অর্থাৎ ভাগীরথীর ঘাটে তাঁর নৌকা বাঁধা ছিল, প্রস্তুত ছিল মাঝিমাল্লারাও। পলায়ণের আরও একটি কারণ, বিপদকালে শত্রুপক্ষকে রুখে দেওয়ার মতো কারোকে পাশে না পাওয়া। লক্ষ্মণ সেনের আমলে রাজ্যের আর্থিক দূরবস্থা এমন অধঃপতন হয়েছিল যে, গ্রামস্তর পর্যন্ত বেতনভুক রাজস্ব আদায়কারী নিয়োগের ক্ষমতা পর্যন্ত ছিল না। অপরদিকে সামন্তব্যবস্থার মাধ্যমে রাজস্ব ও সেনা সংগ্রহ। কোনোমতেই সম্ভব হচ্ছিল না। সম্ভবত পুরোনো সামন্তব্যবস্থার অবসান হচ্ছিল এসময় থেকেই। বাংলায় জমিদারি প্রথার সূত্রপাতও ছিল এসময় থেকেই। এইসব জমিদাররা গ্রামের দরিদ্র প্রজাদের উৎপীড়ন করত কর আদায়ের নামে। প্রজাদের উপর জমিদারদের এহেন উৎপীড়ন ব্রিটিশ শাসনকালে এসে চরম সীমায় পৌঁছেছিল। ঘরবাড়ি, গোলা আগুনে পুড়িয়ে দিত, হত্যা করত এবং উচ্ছেদ করে দিত ভিটেমাটি থেকে। বলাবাহুল্য জমিদারদের এইসব কার্যকলাপে রাজা বা রাজতন্ত্রের (পরে ব্রিটিশ শাসকদের) প্রত্যক্ষ সমর্থন ছিল। নানাবিধ অত্যাচারে সাধারণ মানুষ তথা প্রজারা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন।
এহেন অস্থির পরিস্থিতিতেই বখতিয়ারের আগমন। শত্রুর মোকাবিলা না-করে লক্ষ্মণ সেন তাঁর রাজধানী তুর্কিবাহিনীর হাতে সঁপে দিয়ে গৌড় ত্যাগ করে বঙ্গরাজ্যে চলে আসেন। সেখানে তাঁর বংশধররা প্রায় দুই দশক ব্যাপী রাজত্ব চালিয়েছিলেন। তবে ঐতিহাসিক মিনহাজের কলম থেকে জানা যায় রাজা লক্ষ্মণ সেন কারও প্রতি কখনোই কোনো অন্যায় অত্যাচার করেননি। কেউ তাঁর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলে তিনি অকাতরে দান করতেন। লক্ষ্মণ সেন প্রতিদিন অন্তত এক লক্ষ কড়ি দান করতেন (তখন কড়িই ছিল বিনিময় মুদ্রা)।
লক্ষ্মণ সেনকে ছেড়ে এবার বখতিয়ারের প্রসঙ্গে আসা যাক। বখতিয়ার নদিয়া জয় করে পরবর্তীতে লক্ষণাবতীর (গৌড়) দিকে অগ্রসর হন এবং সেখানেই রাজধানী স্থাপন করেন। এই লক্ষণাবতীই পরবর্তীকালে লখনৌতি নামে পরিচিত হয়। গৌড়জয়ের পর আরও পূর্বদিকে বরেন্দ্র বা উত্তর বাংলায় নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। হিন্দুরাজাদের মধ্যে ঐক্য না-থাকার কারণে বখতিয়ার একের পর হিন্দুরাজ্য দখল নিয়ে নেন অনায়াসেই। বখতিয়ার সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এলাকাগুলোকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে একজন করে সেনাপতিকে শাসনভার। অর্পণ করেন। বখতিয়ারের সেনাধ্যক্ষদের মধ্যে দুজনের নাম পাওয়া যায়। এদের মধ্যে আলি মর্দান খলজি বরসৌলে, হুসামউদ্দিন ইওজ খলজি গঙ্গতরীর শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। এরপর বখতিয়ারের রাজ্য পূর্বে তিস্তা নদী ও করতোয়া নদী, দক্ষিণে পদ্মা নদী, উত্তরে দিনাজপুর জেলার দেবকোট হয়ে রংপুর শহর পর্যন্ত এবং পশ্চিমে পূর্বে অধিকৃত বিহার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। যদিও বৃহৎ বঙ্গদেশের বৃহদাংশই তাঁর রাজ্যের বাইরে ছিল, ওইসব অঞ্চল দখল না-করে তিনি তিব্বত আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। উদ্দেশ্য ছিল তুর্কিস্তানের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করা। তিব্বত আক্রমণের রাস্তা আবিষ্কারের জন্য বখতিয়ার বাংলার উত্তর-পূর্বাংশের উপজাতী গোষ্ঠীর সদস্য আলি মেচকে নিযুক্ত করেন। সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন করার পর তিনি তিন জন সেনাপতি ও প্রায় ১০,০০০ সৈন্যসামন্ত নিয়ে লখনৌতি থেকে তিব্বতের দিকে রওনা দেন। সৈন্যবাহিনী বর্ধনকোট শহরের কাছে পৌঁছোলে তাঁরা তিস্তা নদীর চেয়েও তিন গুণ চওড়া বেগমতী নদী পার না-হয়ে নদীর তীর ধরে তিনদিন দূরত্ব চলার পর একটি পাথরের সেতুর কাছে আসেন। সেখানে তাঁর দুইজন সেনাপতিকে সেতুর সুরক্ষায় রেখে সামনের দিকে অগ্রসর হন। সামনে একটি কেল্লা পড়ে। ওই কেল্লার সৈন্যদের সঙ্গে যুদ্ধে বখতিয়ার জয় করলেও তাঁর সেনাবাহিনী ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। কেল্লার সেনাদের থেকে বখতিয়ার জানতে পারেন যে, অদূরে করমবত্তন। নামক শহরে কয়েক লক্ষ সেনা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। এই কথা শুনে বখতিয়ার সামনের দিকে অগ্রসর না-হয়ে ফিরে আসেন। ফেরার পথে তার সৈন্যরা চূড়ান্ত কষ্ট সহ্য করে। সেতুর কাছে এসে বখতিয়ার খলজি দেখেন পার্বত্য লোকেরা তাঁর দুই সেনাপতির উপর আক্রমণ চালিয়ে তাঁদের মেরে ফেলে এবং সেতুটি পুরোপুরি বিধ্বস্ত করে দেয়। বখতিয়ারের বাহিনী যে-কোনো উপায়েই নদী পার হওয়ার জন্য চিন্তা করতে লাগল। সামনে একটি মন্দির দেখতে পেয়ে বখতিয়ার বাহিনী সেই মন্দিরের ভিতর আশ্রয় নেয়। কামরূপ রাজ্যের বাহিনী তখন মন্দিরের চারদিক ঘিরে ফেলে। এই আক্রমণে বখতিয়ারের বহু সৈন্যের মৃত্যু হয়। এরপর বখতিয়ার খুব অল্প সংখ্যক সেনা সহ ফিরে আসতে সক্ষম হন। কামরূপ অভিযান বিফল হওয়ার ফলে তাঁর শক্তি মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছিল এবং এতে তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। বখতিয়ার দেবকোটে ফিরে আসেন। গৌহাটির কাছে ব্রহ্মপুত্রের তীরে কানাই বঁড়শি বোয়া নামক স্থানে তুর্কি সেনাদলের বিধ্বস্ত হওয়ার বিভিন্ন সংবাদ পাওয়া যায়। তিব্বত অভিযান বিফল এবং সৈন্যবাহিনীর ব্যাপক ক্ষতির ফলে লখনৌতির মুসলিম রাজ্যের প্রজাদের মধ্যে বিদ্রোহ ও বিরোধ দেখা দিতে শুরু করেছিল। এরই ফলে বাংলার ছোটো ছোটো মুসলিম রাজ্যগুলো দিল্লির সঙ্গে সম্ভাব্য বিরোধে আগে থেকেই কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল। তবে তিনি তিব্বত অভিযান করতে গিয়েছেন বলে মনে হয় না। কারণ সমগ্র বাংলা জয় না-করে কেনই-বা তিব্বতে যাবেন? কামরূপ বাহিনীর কাছে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে কামরূপেই তাঁর অভিযান শেষ হয়। পরাজয়ের গ্লানিতে বখতিয়ার অসুস্থ এবং পরে শয্যাশায়ী হন। এর অল্প কিছুদিন বাদে ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি শয্যাশায়ী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। মিনহাজ-ই-সিরাজের বর্ণনানুসারে, তিনি আলি মর্দান খলজি কর্তৃক ছুরিকাঘাতে নিহত হন।
১১৯৩ খ্রিস্টাব্দে নালন্দা মহাবিহার তথা বিশ্ববিদ্যালয় পুরোপুরি ধ্বংস করার জন্য বখতিয়ার খিলজিকে দায়ী করা হয়। নালন্দার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ-পঞ্চম শতাব্দী থেকে। তখন নালন্দা ছিল নিছকই একটি সমৃদ্ধ শহর। তবে ভৌগোলিকভাবে নালন্দার অবস্থান সম্বন্ধে ঐতিহাসিকরা সন্দিহান। পালি বৌদ্ধ সাহিত্য ও জৈন উপাদান থেকে নালন্দার যে বর্ণনা পাওয়া যায়, তা হল, বর্তমান বিহার রাজ্যের রাজগীর শহরের উপকণ্ঠ। বৌদ্ধভিক্ষুদের আবাসস্থলই সংস্কৃত বা পালি ভাষায় ‘বিহার”। অর্থাৎ নালন্দা মহাবিহার তথা বিশ্ববিদ্যালয় বৌদ্ধদের সম্পত্তি, হিন্দুদের নয়। এই বিহার বা মহাবিহারই পরবর্তীকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়। তার মধ্যে অন্যতম নালন্দা মহাবিহার তথা বিশ্ববিদ্যালয়। নালন্দা মহাবিহারের বিকাশ ঘটেছিল খ্রিস্টীয় পঞ্চম-ষষ্ঠ শতাব্দীতে গুপ্ত সম্রাটদের এবং পরবর্তীকালে কনৌজের সম্রাট হর্ষবর্ধনের পৃষ্ঠপোষকতায়। গুপ্ত যুগের উদার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের ফলশ্রুতিতে খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দী পর্যন্ত ভারতে এক বিকাশ ও সমৃদ্ধির যুগ চলেছিল। পরবর্তী। শতাব্দীগুলিতে অবশ্য সেই পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। সেই সময় পূর্ব ভারতে পাল শাসনকালে বৌদ্ধধর্মের তান্ত্রিক বিকাশ ছিল ভারতের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
উপমহাদেশের ইতিহাস বিশাল বৈচিত্র্যে ভরপুর। এখানে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন জাতি গোষ্ঠী ধর্মের নানামুখী সংঘাত ও সংমিশ্রণের ইতিহাস, একই সঙ্গে আছে শিক্ষা সভ্যতার প্রগতি ও বিলয়ে ভরা ইতিহাস। মধ্যযুগে এই ইতিহাস রচনায় কাণ্ডারি ছিলেন বৌদ্ধ নৃপতিরা। সংসারত্যাগী বুদ্ধ মতবাদের প্রচার প্রসার ও পৃষ্ঠপোষকতা করতে গিয়ে তাঁরা রাজ্য জুড়ে স্থাপন করেছেন অসংখ্য বৌদ্ধবিহার। এই সব বিহার থেকে কিছু কিছু বিহার পরে অবাধ জ্ঞানচর্চা করতে গিয়ে ধীরে ধীরে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের খোলস ছাড়িয়ে হাজার বছর আগে খ্যাতি পেয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপে।
নালন্দার মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অবকাঠামোর ভিত্তি ভূমি স্থাপন করে দিয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষু ও বৌদ্ধ শাসকরা আমাদের প্রগতির পথে এগিয়ে যাওয়ার যে রাস্তা তৈরি করে গিয়েছিলেন। যে সহজ সরল। উত্তরটি আমাদের সামনে ভেসে আসে তা হল ধর্মীয় বিদ্বেষ ও হিংসা। বৌদ্ধশাসন আমলে হিন্দু ব্রাহ্মণদের আয় রোজগারের পথ বন্ধ ও সামাজিক প্রভাব প্রতিপত্তি হ্রাস পাচ্ছিল। ব্রাহ্মণদের মনের ভিতর যে আগুন বংশপরম্পরায় হাজার বছর ধরে গোপনে অতি কষ্টে সংরক্ষিত ছিল, তার বিস্ফোরণ ঘটায় হিন্দু রাজাদের শাসনামলে এসে। সুযোগ হাতে পেয়েই তাঁরা নিরীহ প্রগতিশীল অহিংসবাদী বৌদ্ধদের উপর নির্মম অত্যাচার, উৎপীড়ন, দমন ও হত্যা করে উপমহাদেশ থেকে বিতাড়িত করে। রাজানুকূল্য বন্ধ করায় ধস নামে এই সব সর্বজনীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের। উপরন্তু ব্রাহ্মণ্যবাদের পূর্ণ কর্তত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠায় জোরালো করেছিল দেবদাসী, সহমরণ ও তীব্র জাতি ভেদ প্রথার মতো ঘৃণ্য সব প্রথার।
দেখব নালন্দার সফল অগ্রগতি ও শেষে করুণ পরিণতি নিয়ে। পালরাজাদের শাসনামলে সোমপুর, বিক্রমশীলা ও নালন্দা একই প্রশাসনের অধীনে কাজ করত। প্রয়োজনে শিক্ষকরা এই তিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসা-যাওয়া করে উন্নত শিক্ষার মান বজায় রাখার চেষ্টা করতেন। চিনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ এবং ভারতীয় ইতিহাসবিদ প্রজ্ঞাবর্মণ গুপ্ত রাজা কুমারগুপ্তকে নালন্দা বিশ্ব বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা বলে উল্লেখ করে গেছেন। খনন কার্যে প্রাপ্ত একটি সিলমোহর থেকেও এই দাবির পক্ষে জোরালো প্রমাণ দেয়। নালন্দা’ শব্দটি এসেছে ‘নালম’ এবং ‘দা’ থেকে। নালম’ শব্দের অর্থ পদ্ম ফুল, যা জ্ঞানের প্রতীক রূপে প্রকাশ করা হয়েছে। আর ‘দা’ দিয়ে বোঝানো হয়েছে দান করা। তার মানে নালন্দা’ শব্দের অর্থ দাঁড়াল ‘জ্ঞান দানকারী’। প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৮০০ বছর ধরে জ্ঞান বিতরণের মতো দুরূহ কাজটি করে গেছে নিরলসভাবে। নালন্দা ঠিক কবে স্থাপিত হয়েছিল তা আজ সঠিক ভাবে বলা হয়তো সম্ভব নয়। কোথাও পাওয়া যায় ৪২৭ সাল, আবার এক জায়গায় পাওয়া ৪৫০ সাল। যাই হোক, ধরে নিই ৪২৭ থেকে ৪৫০ সালের কোনো এক সময়ের মধ্যে এটি স্থাপিত হয়ে থাকবে। এই বিশ্ববিদ্যালয়টির অবস্থান ভারতের বিহার রাজ্যের রাজধানী পাটনা থেকে ৫৫ মাইল দক্ষিণ-পূর্বদিকে অবস্থিত বড়গাঁও গ্রামের পাশেই। পাটনার আদি নাম পাটালিপুত্র। ২৩০০ বছর আগে মৌর্যদের রাজধানী ছিল এই পাটালিপুত্র। সম্রাট অশোক এখান থেকেই রাজ্য পরিচালনা করতেন বলে জনশ্রুতি আছে। ‘বিহার’ শব্দের অর্থ ‘বিচরণ’, বৌদ্ধভিক্ষুরা যেখানে অবস্থান করেন বা বিচরণ করেন তাকে বলে বৌদ্ধবিহার। প্রাচীন বৌদ্ধসভ্যতার স্বর্ণযুগে এই অঞ্চলে প্রচুর বৌদ্ধবিহারের উপস্থিতি থাকায় পরবর্তীতে ভারতের এই রাজ্যের নামকরণ হয়েছে ‘বিহার। মৌর্যদের পর বিহার চলে আসে গুপ্তরাজাদের শাসনে। পরে মোগল সম্রাট আকবর ১৫৭৪ সালে বিহার দখল করেন। মোগলদের পর বিহার হাত বদল হয়ে আসে নবাবদের দখলে। নবাব সিরাজদৌল্লাকে পরাজিত করে ইংরেজরা বিহার দখল নেয়। ১৯১১ সালে বাংলা থেকে বিহার ও ওড়িশা পৃথক হয়।
নালন্দা প্রাথমিক অবস্থায় ছিল একটি মহাবিহার। যেখানে মূলত বৌদ্ধদর্শনের খুঁটিনাটি, বুদ্ধের শিক্ষা, বুদ্ধের অনুশাসন বিষয়ে পাঠ দান চলত। স্থিতিশীল রাজ্য পরিচালনা, দেশ ও জাতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে বিকল্প নেই একটি সভ্য, উন্নত ও প্রগতিশীল মনন সম্পন্ন জাতির। যা তৈরি করতে শুধু ধর্মীয় শিক্ষাই যথেষ্ট নয়, এ সত্য সম্যকভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন সেসময়কার নেতৃস্থানীয় বৌদ্ধভিক্ষু এবং তাঁদের পৃষ্ঠপোষক বৌদ্ধশাসকরা। তাঁদের যৌথ আন্তরিক প্রচেষ্টা ও ত্যাগ স্বীকারের বিনিময়ে বৌদ্ধধর্মের পাশাপাশি তৎকালীন শিক্ষাব্যবস্থার উপযোগী, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও আন্তর্জাতিক জ্ঞানবিজ্ঞানের আরও অনেক শাখা যুক্ত করে তাঁরা নালন্দাকে ধর্মের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করেন। সম্রাট অশোক এখানে একটি বিহার তৈরি করেন। গুপ্তসম্রাটরাও কয়েকটি মঠ নির্মাণ করে এর ব্যাপকতা বৃদ্ধিতে অবদান রাখেন। মূলত গুপ্ত সম্রাট কুমারগুপ্তের আমলেই এই মহাবিহারটির পূর্ণ বিকাশ লাভ করে। পরবর্তীতে বৌদ্ধ সম্রাট হর্ষবর্ধন ও বাংলার পাল সম্রাটরা পৃষ্ঠপোষকতা করে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে খ্যাতির চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছে দেন।
নালন্দাকে তাঁরা গড়ে তুলেছিলেন তৎকালীন সময়ের বিশ্বে শ্রেষ্ঠ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে অন্যতম সেরা হিসাবে। তবে যে কেউ ইচ্ছে করলেই নালন্দায় লেখাপড়ার সুযোগ পেত না। এর জন্য প্রয়োজন হত শিক্ষার্থীর যোগ্যতার। শিক্ষার্থীরা সত্যিই নালন্দায় লেখাপড়া করার যোগ্য কি না, তা প্রমাণের জন্য প্রবেশদ্বারে দিতে হত মৌখিক পরীক্ষা। সাফল্যের সঙ্গে এই ভর্তি পরীক্ষায় উতরে গেলেই মিলত এখানে বিদ্যালাভের নিশ্চয়তা। পরীক্ষা মোটেই সহজ ছিল না। এতটাই কঠিন ছিল প্রতি দশ জনে মাত্র তিন জন ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারত। ভাবতে অবাক লাগে তৎকালীন সময়ে নালন্দায় বিদ্যা শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল প্রায় ১০,০০০। তাঁদের শিক্ষাদান করতেন প্রায় আরও ২,০০০ শিক্ষক। গড়ে প্রতি ৫ জন ছাত্রের জন্য ১ জন শিক্ষক। কত বড়ো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলে তবেই এত বিপুল সংখ্যক ছাত্রের বিদ্যাদান সম্ভব এত শিক্ষক নিয়ে, তাও আবার থাকা খাওয়ার সুব্যবস্থাসহ। এই বিশ্ববিদ্যালয়টির বিশাল খরচ চালানোও যেনতেন ব্যাপার ছিল না। অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় যাতে নালন্দার প্রশাসনকে কারও উপর নির্ভরশীল হতে না হয় সেদিক বিবেচনা করে ২০০ গ্রামকে শুধু মাত্র নালন্দার ব্যয় মিটানোর জন্য উৎসর্গ করেছিলেন বিদ্যোৎসাহী বৌদ্ধশাসকরা। এই সব গ্রামগুলোর অবস্থান শুধু নালন্দার আশেপাশে ছিল না, ছিল সমগ্র বিহার রাজ্যের ৩০টি জেলা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। চিনতে পারার সুবিধার্থে বিশেষ চৈত্য বা স্তূপ তৈরি করে গ্রামগুলোকে পৃথক করে রাখা হয়েছিল অন্য গ্রাম থেকে। এই সব গ্রামের করের টাকা থেকেই ছাত্র ও শিক্ষকদের খাদ্যদ্রব্য সহ প্রয়োজনীয় সব খরচের জোগান আসত।
বাইরের কোনোপ্রকার উটকো ঝামেলা যাতে শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশের বিঘ্ন ঘটাতে না-পারে সেজন্য উঁচু লাল ইটের বেষ্টনি দিয়ে ঘেরা ছিল সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর। ভিতরে ঢোকার জন্য ছিল বিশাল প্রবেশদ্বার। সেসময় যখন-তখন ভারতীয় উপমহাদেশের দেশীয় রাজাদের অন্য রাজ্যে হামলা করা এবং দখল করা ছিল নিত্যনৈমন্তিক ব্যাপার। শিক্ষার প্রাকৃতিক পরিবেশ যথাসাধ্য স্নিগ্ধ ও কোমল রাখতে সমগ্র বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ জুড়ে তৈরি করা হয়েছিল সুরম্য উদ্যান, যেগুলো সেজে উঠেছিল বিচিত্র ফুল ও ফলের গাছ দিয়ে। স্নান ও প্রয়োজনীয় জলের সুবিধার জন্য খনন করা হয়েছিল কয়েকটি দীঘিও। ছাত্রদের জন্য ছিল ছাত্রাবাস। জলের সমস্যার জন্য ছাত্রদের জ্ঞান অর্জনে যাতে কোনো অসুবিধা না হয় সেদিকটা মাথায় রেখে প্রতিটি ছাত্রাবাসে পানীয় জলের অসুবিধা দূর করতে তৈরি করা হয়েছিল বেশ কিছু কুয়ো। মোট কথা সমগ্র নালন্দা ছিল নিখুঁত পরিকল্পনায় গড়া একটি শিক্ষাস্বৰ্গ। বৌদ্ধধর্মের পাশাপাশি বেধ, বিতর্ক, দর্শন, যুক্তিবিদ্যা, ব্যাকরণ, সাহিত্য, গণিত, জ্যোতিষবিদ্যা, শিল্পকলা, চিকিৎসাশাস্ত্র সহ তৎকালীন সর্বোচ্চ শিক্ষাব্যাবস্থার উপযোগী আরও বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে নিয়মিত পাঠ দান চলত। এখানে। শিক্ষকদের পাঠদান আর ছাত্রদের পাঠ গ্রহণে সর্বদা মুখরিত থাকত এই বিদ্যাপীঠ। নালন্দার সুশিক্ষার খ্যাতির সুবাতাস এতটাই ছড়িয়ে পড়েছিল যে অনুন্নত প্রতিকুল এবড়োখেবড়ো শ্বাপদসংকুল দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থাও বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। সুদূর তিব্বত, চিন, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, পারস্য, গ্রিস তুরস্ক থেকে ছুটে আসত বিদ্যানুরাগীরা।
ছাত্রদের প্রয়োজনীয় বইয়ের অভাব দূরীকরণ এবং একই সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন শাখার জ্ঞানের সমাবেশ ঘটাতে তৈরি করা হয়েছিল তিনটি সুবিশাল গ্রন্থাগার। গ্রন্থাগারের সমস্ত বইই ছিল হাতে লেখা। তখন ছাপার যুগ শুরু হয়নি। বিশাল সংখ্যক কপি-লেখক নিযুক্ত ছিল এইসব বইয়ের অনুলীখনের জন্য। গ্রন্থাগার ভবনগুলো পরিচিত ছিল যথাক্রমে রত্নসাগর, রত্নদধি ও রত্নরঞ্জক নামে। গ্রন্থাগারের নামকরণ থেকেই অনুমান করা যায় নালন্দার শিক্ষকদের জ্ঞানের গভীরতা। চিনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙের মতে, এখানে যে সমস্ত শিক্ষক শিক্ষার কাজে নিযুক্ত ছিলেন তাঁদের জ্ঞানের খ্যাতি প্রসারিত ছিল বহুদূর ব্যাপী, চারিত্রিক দিক দিয়েও তাঁরা ছিলেন অত্যন্ত সৎ চরিত্রের অধিকারী। নির্লোভী এই শিক্ষকরা ভালো করেই জানতেন বহুদূর দূরান্তের ছাত্ররা বন্ধুর পথের কষ্ট মাথায় নিয়ে তাঁদের কাছে ছুটে আসতেন বিদ্যাতৃষ্ণায়। তাই তাঁরাও আন্তরিকতার সঙ্গে তাঁদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট ছিলেন।
এত সুবিশাল একটি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার দায়িত্ব অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পালন করেছিলেন বঙ্গদেশের সন্তান শীলভদ্র। যিনি ছিলেন হিউয়েন সাঙের গুরু। প্রায় ২২ বছর হিউয়েন সাঙ তাঁর কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি কুমিল্লা জেলার চান্দিনাতে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। আরও একজন বঙ্গীয় স্বনামধন্য পণ্ডিত ব্যক্তির কথা উল্লেখ না-করে উপায় নেই। তিনি হলেন ঢাকার বিক্রমপুরে বজ্রযোগিনী গ্রামে জন্ম গ্রহণ করা অতীশ দীপঙ্কর। বর্তমানে অতীশ দীপঙ্করের বাসস্থান নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা’ নামে পরিচিত। তিনি ১৫ বছর ওদন্তপুরী ও সোমপুর বিহারের শিক্ষকতা ও পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন বেশ সফলতার সঙ্গে।
ইন্দোনেশিয়ার শৈলেন্দ্র রাজবংশও যে এই মহাবিহারের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিল, তাও পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণ থেকে স্পষ্ট। কথিত আছে, জৈন তীর্থঙ্কর মহাবীর ১৪টি চতুর্মাস নালন্দায় অতিবাহিত করেছিলেন। আরও বলা হয় যে, গৌতম বুদ্ধও নালন্দার নিকটবর্তী পাবরিক নামক আম্রবনে উপদেশ দান করেছিলেন। বুদ্ধের দুই প্রধান শিষ্যের অন্যতম সারিপুত্ত নালন্দা অঞ্চলেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং এখানেই নির্বাণ লাভ করেন। উক্ত দুই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম-ষষ্ঠ শতাব্দীতেও একটি গ্রাম হিসাবে নালন্দার অস্তিত্ব ছিল।
গুপ্তযুগেই বিহার থেকে মহাবিহারে রূপান্তর হয়েছিল। এই বিশ্ববিদ্যালয় ছিল বিশ্বমানের। পালরাজা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। কারণ পালরাজারা ছিলেন মহাযান বৌদ্ধধর্মের অনুসারী। আর নালন্দা ছিল তাঁদেরই অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। একটি সিলমোহর থেকে জানা যায় যে, এই মহাবিহারের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শাদিত্য নামে এক রাজা।
ভারত থেকে বৌদ্ধধর্মের অন্তর্ধানের সঙ্গে নালন্দা মহাবিহারের অবলুপ্তির একটি সম্পর্ক রয়েছে। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে ভারতের বিভিন্ন স্থান পর্যটনের সময় হিউয়েন সাঙ লক্ষ করেছিলেন যে, বৌদ্ধধর্ম ধীরে ধীরে পতনের দিকে এগিয়ে চলেছে। শুধু তাই নয়, তিনি নালন্দার পরিসমাপ্তির দুঃখজনক পূর্বাভাসও পেয়েছিলেন। সেই সময় বৌদ্ধধর্ম দ্রুত জনপ্রিয়তা হারাচ্ছিল। কেবলমাত্র অধুনা বিহার ও বাংলা অঞ্চলের রাজারাই এই ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করছিলেন। পাল শাসনকালে বৌদ্ধধর্মের প্রথাগত মহাযান ও হীনযান সম্প্রদায়ে গোপন আচার-অনুষ্ঠান ও জাদুবিদ্যা-কেন্দ্রিক তান্ত্রিক ক্রিয়াকর্ম অন্তর্ভুক্ত হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে বৈষ্ণব ও শৈব দার্শনিকদের আবির্ভাব এবং একাদশ শতাব্দীতে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল রাজবংশের রাজ্যচ্যুতির ঘটনা থেকেই বোঝায় যায় যে, সেই সময় বৌদ্ধধর্মের উপর ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজনৈতিক, দার্শনিক ও নৈতিক আঘাত নেমে এসেছিল।
বখতিয়ারের বিরুদ্ধে নালন্দা মহাবিহার তথা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করার নিরঙ্কুশ অপবাদ বহুল প্রচারিত। কোনো কোনো ঐতিহাসিক লিখেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়টি ১১০০ সালে বখতিয়ার খিলজি ধ্বংস করেছেন। ভারতীয় ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ বখতিয়ারের এই আক্রমণের তারিখ জানিয়েছেন ১১০০ সাল। অথচ স্যার উলসলি হেগ বলছেন, বখতিয়ার ওদন্তপুরী আক্রমণ করেছেন ১১৯৩ সালে। আর স্যার যদুনাথ সরকার এই আক্রমণের সময়কাল বলছেন ১৯৯৯ সাল। সবচাইতে মজার যে, বখতিয়ার খলজি বঙ্গ বিজয় করেন ১২০৪ সালের ১০ মে। স্যার যদুনাথ সরকার বখতিয়ারের বঙ্গ আক্রমণের সময়কাল বলছেন ১৯৯৯ সাল। অন্যদিকে অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে বৌদ্ধদের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করা হয় ১৯৯৩ সালে। যে লোকটি ১২০৪ সালে বঙ্গে প্রবেশ করেন, সে কীভাবে ১১৯৩ সালে নালন্দা ধ্বংস করেন? বখতিয়ার খলজি মাত্র ১৭ জন সঙ্গী নিয়ে ঝাড়খণ্ডের জঙ্গলের ভিতর দিয়ে দ্রুত বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে কৌশলে সেনরাজা লক্ষণ সেনের প্রাসাদে হামলা করেন। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় জানা যাচ্ছে, ধ্বংস করা তো দূরের কথা, বখতিয়ার নালন্দার ধারেকাছেই যাননি। শরৎচন্দ্র দাশ তাঁর ‘Antiquity of Chittagong’ প্রবন্ধে লিখেছেন, বিক্রমশীলা ও ওদন্তপুরী বিহার দুটিকে ধ্বংস করা হয়েছিল ১২০২ সালে। এই তালিকায় নালন্দার উল্লেখ নেই। ঐতিহাসিক মিনহাজের ‘তবকাত-ই-নাসিরি’ গ্রন্থেও নালন্দা ধ্বংসের উল্লেখ নেই। এই গ্রন্থে বখতিয়ার খিলজির অভিযান থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে। ১২৩৪-৩৬ সাল নাগাদ, অর্থাৎ বখতিয়ারের (মৃত্যু হয় ১২০৬ সালে) বিহার জয়ের ৩১ বছর পরও নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠনপাঠন চালু ছিল। সেসময়ে তিব্বত থেকে ধর্মস্বামী এসে নালন্দা বিহারকে চালু অবস্থাতেই দেখেছেন। সেখানে মঠাধ্যক্ষ রাহুল শ্রীভদ্রের পরিচালনায় ৭০ জন সাধু পড়াশোনা করেছেন। কিন্তু সবাই যখন বলেন নালন্দা ধ্বংস হয়েছে, তাহলে তো ধ্বংস হয়েছেই। কিন্তু ধ্বংসটা কে করল? অনেকে মনে করেন নালন্দা ধ্বংস আসলে হিন্দু-বৌদ্ধ সংঘাত। বুদ্ধগয়া গয়া-দৰ্শন রাজগীর নালন্দাপাওয়াপুরী’ নামক এক পর্যটক সহায়ক পুস্তিকায় বলা হয়েছে– পঞ্চম শতাব্দীতে ব্রাহ্মণ দার্শনিক এবং প্রচারক কুমারভট্ট এবং শংকরাচার্যের প্রচেষ্টাতেই বৌদ্ধধর্মের প্রভাব ক্ষয় হয়ে গিয়েছিল। … বারো বৎসর ব্যাপী সূর্যের তপস্যা করে তাঁরা (ব্রাহ্মণরা) যজ্ঞাগ্নি নিয়ে নালন্দার প্রসিদ্ধ গ্রন্থাগারে এবং বৌদ্ধ বৌদ্ধবিহারগুলিতে অগ্নিসংযোগ করেন। ফলে নালন্দা অগ্নিসাৎ হয়ে যায়। অন্য এক সুত্র তিব্বতীয় শাস্ত্র ‘পাগসাম ইয়ান জাং’-এ বলা হয়েছে উগ্র হিন্দুরা নালন্দার গ্রন্থাগার পুড়িয়ে দিয়েছে। তবে ডি আর পাতিল মনে করেন নালন্দার গ্রন্থাগার পুড়িয়েছিল শৈব সম্প্রদায়ের মানুষরা। কিন্তু বিশিষ্ট তাত্ত্বিক লেখক ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত নালন্দা মহাবিহার ধ্বংসের জন্য ব্রাহ্মণ্যবাদীদের আক্রমণকেই স্বীকার করে নিয়েছেন। তিনি তাঁর ‘বাঙ্গলার ইতিহাস’ গ্রন্থে লিখেছেন– “নালন্দায় লাইব্রেরি কয়েকবার বিধ্বস্ত হয়।” P. al. Jor-এর তিব্বতীয় পুস্তকে উল্লিখিত হয়েছে যে, “ধর্মসগন্ধ অর্থাৎ নালন্দার বৃহৎ লাইব্রেরি তিনটি মন্দিরে রক্ষিত ছিল। তীর্থিক (ব্রাহ্মণ) ভিক্ষুদের দ্বারা অগ্নিসংযোগে তাহা ধ্বংস হয়। মগধের রাজমন্ত্রী কুকুতসিদ্ধ নালন্দায় একটি মন্দির নির্মাণ করেন। সেখানে ধর্মোপদেশ প্রদানকালে জনাকতক তরুণ ভিক্ষু দুজন তীর্থিক ভিক্ষুদের গায়ে নোংরা জল ছিটিয়ে দেয়। তার ফলে তাঁরা ক্ষুব্ধ হয়ে ‘রত্নসাগর’, ‘রত্নধনুক’ এবং নয়তলাযুক্ত ‘রত্নদধি’ নামক তিনটি মন্দির অগ্নিসংযোগে ধ্বংস করে। উক্ত তিনটি মন্দিরেই সমষ্টিগতভাবে ধর্মগ্রন্থ বা গ্রন্থাগার ছিল।” এস দাস সম্পাদিত ‘P. al. Jor : History of the Rise, Progress and Downfall of Buddhism in India’ গ্রন্থখানি পড়ে দেখতে পারেন। পেয়ে যাবেন আরও বিস্ফোরক তথ্য। বুদ্ধপ্ৰকাশ তাঁর ‘Aspects of Indian History and Civilisation’ গ্রন্থে স্পষ্ট করে বলেছেন –“নালন্দায় অগ্নিসংযোগের জন্য হিন্দুরাই দায়ী।” ষষ্ঠ শতকের রাজা মিহিরকুল বৌদ্ধদের মোটই সহ্য করতে পারতেন না। তাঁর পাটলিপুত্র আক্রমণ করার সময়ই নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস হয়। যতদূর জানা যায়, সেই সংখ্যাটা মোট তিনবার। প্রথমবার স্কন্দগুপ্তের সময়ে (৪৫৫-৪৬৭ সালে) মিহিরকুলের নেতৃত্বে মধ্য এশিয়ার যুদ্ধবাজ হানদের দ্বারা। উল্লেখ্য, মিহিরকুলার নেতৃত্ব হানরা ছিল প্রচণ্ড রকমের বৌদ্ধ-বিদ্বেষী। বৌদ্ধ ছাত্র ও ধর্মগুরুদের হত্যা করা হয় নির্মমভাবে। স্কন্দগুপ্ত ও তাঁর পরবর্তী বংশধরেরা একে পুনর্গঠন করেন। প্রায় দেড় শতাব্দী পরে আবার ধ্বংসের মুখে পড়ে। আর তা হয় বাংলার শাসক শশাঙ্কের দ্বারা। শশাঙ্ক ছিলেন বাংলার অন্তর্গত গৌড়ের রাজা। তাঁর রাজধানী ছিল আজকের মুর্শিদাবাদ। রাজা হর্ষবর্ধনের সঙ্গে তাঁর বিরোধ ও ধর্মবিশ্বাস এই ধ্বংসযজ্ঞে প্রভাব বিস্তার করে। রাজা হর্ষবর্ধন প্রথমদিকে শৈব (শিবকে সর্বোচ্চ দেবতা মানা) ধর্মের অনুসারী হলেও পরে বৌদ্ধ ধর্মের একজন পৃষ্ঠপোষকে পরিণত হন। কথিত আছে, সেই সময়ে ধীরে ধীরে গজিয়ে উঠা ব্রাহ্মণদের বিদ্রোহও নিষ্ঠুরভাবে দমন করেছিলেন। অন্যদিকে রাজা শশাঙ্ক ছিলেন ব্রাহ্মণ্যধর্মের একজন শক্তিশালী পৃষ্ঠপোষক। উল্লেখ্য, হিন্দু রাজা শশাঙ্কের সঙ্গে বুদ্ধের অনুরক্ত রাজা হর্ষবর্ধনের সবসময় শক্রতা বিরাজমান ছিল এবং খুব বড়ো একটি যুদ্ধও হয়েছিল। রাজা শশাঙ্ক যখন মান্ধায় প্রবেশ করেন তখন বৌদ্ধদের পবিত্র স্থানগুলোকে ধ্বংস করেন, খণ্ড-বিখণ্ড করেন বুদ্ধের ‘পদচিহ্ন’। বৌদ্ধধর্মের প্রতি তাঁর বিদ্বেষ এত গভীরে যে তিনি বৌদ্ধদের ধর্মীয় স্থান ছাড়াও, বুদ্ধগয়াকে এমনভাবে ধ্বংস করেন, যাতে এর আর কিছু অবশিষ্ট না থাকে। হিউয়েন সাঙ এভাবে বর্ণনা করেছেন– “Sasanka-raja, being a believer in heresy, slandered the religion of Buddha and through envy destroyed the convents and cut down the Bodhi tree (at Buddha Gaya), digging it up to the very springs of the earth; but yet be did not get to the bottom of the roots. Then he burnt it with fire and sprinkled it with the juice of sugar-cane, desiring to destroy them entirely, and not leave a trace of it behind. Such was Sasanka’s hatred towards Buddhism.” বিষয়ে ঐতিহাসিক এইচ হিরাস তাঁর ‘The Royal Petrons of the University of Nalanda’ গ্রন্থে কী জানিয়েছেন, একটু দেখি –“Nalanda University was not far from the capital, Pataliputra and its fame had also reached Mihirkula’s ears. The buildings of Nalanda were then probably destroyed for the first time, and its priests and students dispersed and perhaps killed.” রাজাদের মধ্যে অন্তর্কলহ, শত্রুতা, হত্যা ও উপাসনালয় ধ্বংস সেসময় খুব অস্বাভাবিক কিছু একটা ছিল না।
বস্তুত এ সময়ে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা বৌদ্ধের অসংখ্য মহাবিহার হয় অগ্নিসংযোগ নয় গুঁড়িয়ে দিয়েছে। সমসাময়িক রচিত গ্রন্থগুলিতে এসব ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ আছে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ‘বৌদ্ধধর্ম’, রাহুল সাংকৃত্যায়নের ‘ভারতে বৌদ্ধধর্মের উত্থান পতন’ গ্রন্থেও স্পষ্ট উল্লেখ আছে। একাদশ শতকের শেষভাগে বৌদ্ধ চন্দ্রবংশ উৎখাত করে বাংলায় (অবিভক্ত দক্ষিণ-পূর্ব) ব্রাহ্মণ্যবাদী বর্মারাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই বংশেরই এক রাজা জাতবর্মা। জাতবর্মা ছিলেন পরম বিষ্ণুভক্ত। জাতবর্মা সোমপুর বৌদ্ধবিহারটি অবরুদ্ধ ও লুণ্ঠন করে এবং অগ্নিসংযোগে মহাবিহারটি ধ্বংস করেন। ওই মহাবিহারের মঠাধ্যক্ষ করুণাশ্রী মিত্রকেও অগ্নিদগ্ধ করে খুন করে। হিন্দুরাজা ভোজবর্মার বেলাবলিপিতে জাতবর্মা কর্তৃক সোমপুরের মহাবিহার ধ্বংসের ইতিহাস উল্লেখ আছে। ঐতিহাসিক মিনহাজের বর্ণনায় বিহার ও নদিয়া জয়ের কাহিনি পাওয়া যায়। নালন্দা অভিযান, নালন্দা জয়, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের কোনো ঘটনা বা তথ্য বর্ণিত হয়নি। বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ ইতিহাসবিদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ভিসি ড. আবদুল করিমও সহমত। আবদুল করিম ও সুখময় মুখোপাধ্যায়— এই দুজন গবেষকই বখতিয়ার খলজির উপর ব্যাপক গবেষণা করেছেন (আবদুল করিম– বাংলার ইতিহাস সুলতানি আমল’, সুখময় মুখোপাধ্যায়– ‘বাংলার ইতিহাস’) এছাড়া শ্রী রমেশচন্দ্র মজুমদার— ‘বাংলা দেশের ইতিহাস’ গ্রন্থ থেকেও বখতিয়ার সম্বন্ধে জানা যায়। মিনহাজের ‘তাওয়ারিখ’ গ্রন্থে বখতিয়ার সংক্রান্ত তথ্যাবলির বিশদ ব্যাখ্যা করেছেন। ইসামি রচিত ‘ফুতুহ উস-সালাতিন’ এবং হাসান নিজামি রচিত ‘তাজ-উল-মাসির’ গ্রন্থেও নালন্দা অভিযানের কোনো ঘটনার উল্লেখ নেই।
অনেকে মনে করেন, বখতিয়ার দুর্গ ভেবে বৌদ্ধভিক্ষুদের আবাসস্থল ওদন্তপুর মহাবিহার আক্রমণ করেন বিনা বাধায়। দুর্গ দখলের পর উনি লক্ষ করলেন দুর্গের বাসিন্দারা সকলেই মুণ্ডিতমস্তক। জিজ্ঞাসাবাদের পর জানতে পারলেন, তাঁরা বৌদ্ধ আর দখলিকৃত দুর্গটি আসলে বৌদ্ধবিহার। ড. দীনেশচন্দ্র সরকার দেখিয়েছেন, ওদন্তপুর বৌদ্ধবিহার ধ্বংস হয় ১৯৯৩ সালে। এ ছাড়া আরও অনেক গবেষক বলেছেন, ওদন্তপুর ধ্বংস হয় ১১৯১-৯৩ সময়কালে। অথচ সুখময় মুখোপাধ্যায় দেখিয়েছেন, বখতিয়ার বিহার বিজয় করেন ১২০৪ সালে। অতএব বখতিয়ার কর্তৃক উদন্তপুর বা ওদন্তপুর বিহার ধ্বংসের কাহিনিও নিশ্চিতভাবে বলা যায় না।
একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দীতেই বাংলার বর্মন-সেনবংশীয় রাজাদের শাসনকালেই বৌদ্ধধর্ম অত্যন্ত বিপন্ন হয়েছিল। দ্বাদশ শতাব্দীতে এসে সেনরাজাদের শাসনকালে বৌদ্ধরা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়। ওদন্তপুরে কিছু বৌদ্ধ কোনোরকমে টিকে থাকার কারণ বাংলার পূর্বাঞ্চলে বর্মন-সেনরাজাদের অধিকার তেমন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। প্রসঙ্গত বলে রাখি, বখতিয়ারের সময়কালেই বাংলায় ইসলাম ধর্মের সবচেয়ে প্রসার ও প্রচার হয়েছিল। সবচেয়ে বেশি সংখ্যক অমুসলিম মুসলিম হয়েছিলেন তাঁর সময়েই। তার বড় কারণ সুফি ধর্মপ্রচারক। দক্ষিণবঙ্গ মুসলিম শাসনে আসার বহু বছর আগে একদল সুফি ধর্মপ্রচারক বাস করতেন। সুফিদের প্রভাবেই এখানকার মানুষ ইসলাম ধর্মে চলে আসে। তবে বেশিরভাগ নীচু জাতি ও বৌদ্ধধর্ম থেকেই মানুষ ধর্মান্তরিত হয়। কেবলমাত্র অস্ত্রের আস্ফালনেই নিজ ধর্ম ত্যাগ করে বিজয়ী বাহিনীর ধর্মকে গ্রহণ করেছিলেন আত্মরক্ষার তাগিদে, বাংলার মানুষদের এতটা কাপুরুষ ভাবার কোনো যুক্তি দেখি না। নিম্নবর্ণের প্রতি উচ্চবর্ণের উপযুপরি ঘৃণা আর অবজ্ঞাই ধর্মান্তরের মূল কারণ।
কেমন ছিল বখতিয়ার খিলজির বাংলা? সাল-তারিখের হিসাবে বাংলায় মুসলিম শাসন শুরু হয় ১২০১ থেকে এবং শেষ হয় বাংলায় ব্রিটিশদের আগমন পর্যন্ত, প্রায় টানা ৫০০ বছর। বীরত্ব, নির্ভীকতা, সামরিক দক্ষতার ফলে বখতিয়ারই স্বীয় প্রতিভায় এক সুদীর্ঘ অঞ্চল অধিকার করতে সক্ষম হন। বখতিয়ারের আগমনকালে বাংলায় এমন দুর্দশা অবস্থা যে, তাঁকে প্রতিরোধ করার মতো কোনো শক্তি অবশিষ্ট ছিল না। বখতিয়ারের সময়কালে ইসলামে ব্যাপক প্রসার হয়েছিল ঠিকই, তবে তাতে সেনাবাহিনীদের কোনো অবদান ছিল না। অবদান ছিল সুফি সাধক আর বখতিয়ার-পূর্ব শাসকদের কুশাসন। আর এই সুফি সাধকরা বখতিয়ারের আগেই বাংলায় এসেছিলেন। তবে সুফিদের প্রকৃত প্রবেশ ঘটেছিল বখতিয়ারের সময়েই। বিখ্যাত সুফি সাধক শাহ জালাল ৩৬০ জন শিষ্য সহ এদেশে আসেন। ইসলামের সাম্য ও সংহতির বাণী এইসব সুফি সাধকরা ধর্মপ্রচারকদের মাধ্যমে বাংলায় ইসলামের প্রচার ও প্রসার হয়। তলোয়ারের ফলায় নয়, সততা-নিষ্ঠায় ইসলামের প্রসার সম্ভব হয়েছে। এ সময়ে প্রচুর হিন্দুরা ধর্মান্তরিত হয়। বিভিন্ন জায়গা থেকে মুসলমানরাও আসতে শুরু করেন এই বাংলায় এবং স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন। পির, আউলিয়ারাও বসতি স্থাপন করেন। বলা যায়, অল্প সময়ের মধ্যে বখতিয়ার তাঁর নবপ্রতিষ্ঠিত মুসলিম রাজ্যে সুশাসন প্রবর্তন করেন। তিনি রাজ্যকে একপ্রকার সাজিয়েগুছিয়ে বসেন। তাঁর অধিকৃত অঞ্চলকে কয়েক ভাগে ভাগ করে নেন শাসনের সুবিধার জন্য। প্রত্যেক ভাগে একজন করে সামরিক তত্ত্বাবধায়কের উপর দায়িত্ব অর্পণ করেন। এইসব শাসনকর্তাকে বলা হত মুকতা। প্রাক-সুলতানি যুগে বাংলা যতদিন দিল্লির অধীনে ছিল ততদিন পর্যন্ত গৌড় প্রাদেশিক রাজধানীর মর্যাদা পেয়েছিল। তিনিই প্রথম সুসংবদ্ধ শাসনকাঠামো তৈরি করেন। তবে বখতিয়ার বাংলাকে কিছুটা সংঘবদ্ধ করলেও সুলতান ইলিয়াস শাহ ১৩৫২ খ্রিস্টাব্দে পূর্ববঙ্গ অধিকারের মধ্য দিয়ে পুরো বাংলাকে একটি স্বাধীন দেশের মানচিত্রে নিয়ে আসেন। এইভাবে ইলিয়াস শাহ চোদ্দো শতকের মাঝপর্বে সর্বপ্রথম সম্পূর্ণ বাংলাকে একই শাসনের শাসনের আওতায় আনেন। স্থাপত্যকলার পৃষ্ঠপোষকতা করেন। মধ্য এশিয়া ও বিভিন্ন দেশের স্থাপত্যকলার প্রভাব পড়েছিল বাংলার মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকা, প্রাসাদ, দুর্গগুলিতেও। নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে বাংলায় এক স্বতন্ত্র মুসলিম-স্থাপত্য প্রতিষ্ঠা লাভ করে। দিল্লির নির্দেশের ধার কখনো ধারেনি বখতিয়ার। তিনি স্বাধীনভাবে বাংলায় শাসন পরিচালনা করেন। তিনি কেবল দক্ষ শাসকই নন, দক্ষ ও কৌশলী সেনানায়কও। শাসক হিসাবে তাঁর ন্যায়পরায়ণতা সর্বজনবিদিত। তবে সঙ্গে সঙ্গে এটাও বলে রাখা প্রয়োজন, বখতিয়ারের বাংলায় প্রবেশের পর থেকেই বহিরাগত মুসলমানদের উন্মুক্ত হয়ে যায়। পরবর্তী ৫০০ বছরেও বাংলাতে আর বীরযোদ্ধা হিন্দু বা বৌদ্ধ রাজাদের টিকিই খুঁজে পাওয়া যায়নি। বিনা প্রতিরোধেই সব শীতঘুমে চলে গেলেন! তুর্কি আক্রমণের সংবাদ পেয়ে লক্ষ্মণসেন খালি পায়ে খিড়কি দরজা দিয়ে বজরায় চেপে বিনাযুদ্ধেই নদিয়া থেকে পূর্ব বাংলায় পালিয়ে গেলেন। অতঃপর লক্ষ্মণসেনের ধনসম্পদ, তাঁর প্রজাবর্গ ও পরিজন এবং দাসদাসীদের বক্তিয়ার অধিকার করেন। এই হল ভারতের হিন্দু রাজা! এমন রাজা যে দেশে থাকে সে দেশে বহিঃশত্রু আক্রমণ করবে না তো কি করবে!! ইনি বাংলায় শুধু মুসলমান শাসনের প্রবেশই ঘটাননি, উনি আর উনার বাবা বল্লালসেন হিন্দুদের মধ্যে জাতপাতের বিভাজন সৃষ্টি করে হিন্দুসমাজের সর্বনাশ। করে দিয়েছেন।