১.৫.০২ সুলতান মামুদ (শাসনকাল : ৯৯৭ সাল থেকে ১০৩০ সাল)

সুলতান মামুদ (শাসনকাল : ৯৯৭ সাল থেকে ১০৩০ সাল)

সুলতান মামুদের প্রসঙ্গে এলেই আমাদের সবার আগে মনে পড়ে যায় স্কুল-কলেজের পাঠ্যবইয়ে পড়া সতেরোবার ভারত আক্রমণের ইতিহাসের কথা। আর মনে পড়ে সোমনাথ মন্দির ধ্বংসের কথা। সুলতান মামুদের বিরুদ্ধে ইসলাম ধর্ম প্রচারক, মূর্তিভঙ্গকারী, অর্থলোলুপ, নরহন্তা, লুণ্ঠনকারী নানাবিধ অপবাদে ভূষিত করা হয়েছে। আমরা দেখব প্রকৃত ঘটনাটা কী। তার আগে বলি উগ্র হিন্দুবাদীরা সবসময়ই বলে থাকেন, মুসলমানরা সব আরব থেকে। এসে ভারত আক্রমণ ও শাসন করেছে। বাস্তবিক আরব থেকে যে গুটিকয়েক মুসলমান এসেছেন, তা হাতে গোনা। বেশির ভাগই এসেছেন অন্য দেশ থেকে, কখনোই আরব নয়। সুলতান মামুদ, তৈমুর লঙ, চেঙ্গিস খান, বাবর, হুমায়ুন, আকবর, নাদির শাহ, জাহাঙ্গির, আওরঙ্গজেব, শাহজাহান ইত্যাদি এরা কেউই আরব থেকে আসেনি। এদের মধ্যে চেঙ্গিস খান মুসলমানই নন। ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতকে ব্রিটিশ-ভারত বলা হত। অর্থাৎ সম্প্রসারিত ব্রিটেন। ব্রিটেনের পতাকা উড়ত ভারতে। সব নির্দেশ ব্রিটেন থেকে আসত। লাট, লর্ড, গভর্নর সব ব্রিটেন থেকে আসত। কোনো ভারতীয় এসব পদ পেতেন না। লর্ড মাউন্টব্যাটেন ব্রিটেন থেকে এসেই ভারত ভেঙে দিয়ে গেল। মুসলিম শাসনে কখনো বলা হত না আরব-ভারত। ভারতের বুকে আরবের পতাকাও কোনো মুসলিম শাসক ওড়াতো না। প্রত্যেক শাসকদের নিজস্ব পতাকা ছিল। যেমন বিভিন্ন পৃথক সাম্রাজ্যের হিন্দুরাজাদের পৃথক পতাকা ছিল। এই উপমহাদেশে এ সময় অসংখ্য সাম্রাজ্যের অসংখ্য রাষ্ট্রীয় পতাকা উড়ত।

যাই হোক, এবার আসি গজনির মামুদের কথায়। ইতিহাস লেখক শ্রীবিনয় ঘোষ লিখেছেন— “মন্দিরের ভিতর কত যে মণিমুক্তা ও সোনার জিনিস ছিল তাহার হিসাব নাই। রাজপুত রাজার প্রাণ অপেক্ষাও প্রিয় ছিল এই মন্দির। তাঁহারা সকলে মিলিত হইয়া মন্দির রক্ষা করিবার চেষ্টা করেন। গুজরাটের রাজা ভীমদেব প্রতিরোধ সংগ্রামে অগ্রণী হন। প্রায় ৫০০০ হিন্দু যোদ্ধা এই মন্দির রক্ষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেন। কিন্তু মন্দির রক্ষা হয় নাই। মাহমুদ মন্দিরের ভিতর প্রবেশ করিয়া সব ধ্বংস করিবার আদেশ দেন। ব্রাহ্মণরা প্রচুর ধনসম্পদের বিনিময়ে মন্দিরটি ভিক্ষা চান। কিন্তু মাহমুদ তাহার উত্তরে বলেন যে তিনি হিন্দু দেবমূর্তি বিক্রেতা হইতে চান না, দেবমূর্তি বিনাশী হইতে চান।”

খুবই করুণ দৃশ্য রচনা করেছেন শ্রীবিনয়। এই দৃশ্য ‘দর্শন করে মনে হয় এই পৃথিবীটাকে মুসলমানশূন্য করে দিই! না, তার আগে সুলতান মামুদকে একটু চেনার চেষ্টা করা যাক পর্যায়ক্রমে। সুলতান মামুদ হলেন গজনির সুলতান সবুক্তগিনের পুত্র। মামুদ উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং শ্রেষ্ঠ সৈন্যাধ্যক্ষের অন্যতম। শ্রীবিনয় ঘোষ লিখেছেন, “১০০০ ১০২৬ সালের মধ্যে অর্থাৎ ২৬ ধরিয়া ক্রমান্বয়ে সুলতান মাহমুদ ১৭ বার ভারত অভিযান করেন।” কিন্তু প্রকৃত ইতিহাস মামুদ ৯৯৭ থেকে ১০৩০ সাল পর্যন্ত এই ৩৩ বছর ছিল মামুদের রাজত্বকালের সময়সীমা।

কেন ভারত আক্রমণ করার প্রয়োজন বোধ করল মামুদ? অধ্যাপক হাবিব এবং এস এম জাফরের মতে, সুলতান মামুদের ভারত অভিযানের মূল উদ্দেশ্য ছিল অর্থনৈতিক, ধর্মীয় নয়। তাঁর বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন ছিল বলেই সম্ভবত তিনি প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ ভারতের বিপুল ধনসম্পদের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। তিনি এক-একবার অভিযান করে দেশে ফেরার সময় প্রচুর অর্থসম্পদ সঙ্গে নিয়ে গিয়েছেন। মধ্য-এশিয়ার শত্রু দমন এবং গজনিকে কেন্দ্র করে একটি বিরাট সাম্রাজ্য গড়ে তোলার জন্য তাঁর এই অর্থসম্পদের প্রয়োজন ছিল। সুতরাং এ পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়েই সুলতান মামুদ ভারত অভিযান করেছিলেন। মধ্য-এশিয়ার অন্যান্য শাসকের মতো সুলতান মামুদ স্থায়ীভাবে ভারতে বসবাস করতে চাননি। তাই দেশ জয় করে এবং শত্রুদের ক্ষমতা খর্ব করেই তিনি স্বদেশে ফিরে যেতেন। কাজেই তিনি ভারতীয় ঐতিহাসিকদের কাছে বিজেতা অপেক্ষা আক্রমণকারী হিসাবেই অধিক পরিচিত। মামুদের ভারত ও অন্যান্য রাজ্যবিজয় স্থায়ী কোনো ফলদান না করলেও, তিনি যে একজন বিজেতা ছিলেন এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের জন্য অর্থের প্রয়োজন তিনি অনুভব করেছিলেন এবং ভারত সে সুযোগ দান করলে তিনি তা গ্রহণ করেন। ভারত থেকে সংগৃহীত অর্থ তিনি স্বীয় রাজধানী গজনির উন্নতির জন্য ব্যয় করেছিলেন।

তবে ঐতিহাসিক গোলাম আহমাদ মোস্তাফার ভাষ্য মতে, গজনির আমির আলপতিগিনের মৃত্যুর ১৪ বছর তাঁর জামাতা সুবুক্তিগিন সুলতান হন। তিনি প্রভাবশালী শাসক ছিলেন। এ সময় ভারতের পাঞ্জাব শাহি রাজা জয়পালের চিন্তা হল কাবুল থেকে যদি তিনি ভারত আক্রমণ করেন, তাহলে তাঁকে প্রতিরোধ করা অসম্ভব একার পক্ষে। অতএব রাজা জয়পাল উত্তর ভারতের প্রায় প্রত্যেক হিন্দু রাজাদের সংগঠিত করেন সুবুক্তিগিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন বলে। সেই সম্মিলিত শক্তি নিয়ে সুবুক্তিগিনের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। যুদ্ধটি সংঘটিত হয় গজনি ও লাঘমানের মধ্যবর্তী ঘুজুক নামে এক অঞ্চলে। এতকিছু করেও এই যুদ্ধে জয়পাল সাংঘাতিকভাবে পরাজিত হন। জয়পাল প্রাণ নিয়ে কোনোমতে স্বদেশে ফিরে আসেন। তবে বিজয়ী মুসলমান রাজার সঙ্গে কয়েকটা সন্ধিতে সই করে ফেরেন। স্বদেশে ফিরেই জয়পাল সেই সন্ধিচুক্তি ভঙ্গ করে বসেন। এর ফলে সুবুক্তিগিন খুবই ক্ষুব্ধ হন জয়পালের উপর। প্রতিশোধস্পৃহা জেগে ওঠে তাঁর। সুরজিৎ দাশগুপ্ত তাঁর ‘ভারতবর্ষ ও ইসলাম’ গ্রন্থে লিখেছেন– “কোনোমতে প্রাণ বাঁচিয়ে দলবলসহ স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের অল্পকাল পরেই জয়পাল স্বীকৃত সন্ধি ভঙ্গ করেন। জয়পালের আগ্রাসী মনোভাব ও বিশ্বাসঘাতকতা সুলতান সুবুক্তিগিনের মনে স্বভাবতই উন্মুক্ত উষ্ম জাগাল। কিন্তু শঠ জয়পালকে শাস্তি দিয়ে যাওয়ার সুযোগ তিনি পেলেন না। সে দায়িত্ব একাধারে জ্ঞানী ও যোদ্ধা পুত্র মামুদের উপর অর্পণ করে ৯৯৭ সালে তিনি মারা গেলেন।”

মামুদের ভারতের অভিযানের কারণ যাইই হোক না-কেন, তাঁর বিরুদ্ধে সবচেয়ে অভিযোগ বা অপবাদ হল তিনি সোমনাথ মন্দির ভেঙেছেন, সম্পদ লুঠ করেছেন এবং বিগ্রহ ভেঙেছেন। তাই সেই সূত্রেই সুলতান মামুদ ধর্মীয় কারণেই ভারত আক্রমণ এবং মন্দির ধ্বংস করেন বলা হয়। বস্তুত মামুদ যদি ধর্মীয় কারণেই ভারত আক্রমণ করতেন, তাহলে সতেরোবার করেও ষোলোতম আক্রমণের সময় সোমনাথ ধরতেন না। সতেরোবারই ভারত অভিযান করে ভারতকে মন্দিরহীন করে ফেলতে পারতেন। তাঁর লোকবল, অস্ত্রবল ও মনোবল তো কিছু কম ছিল না।

সতেরোবার ভারতে ঢুকে সশস্ত্র মামুদ কী করল? সঙ্গত প্রশ্ন। উত্তর কি হিন্দুদের জোর করে মুসলিম বানিয়েছিল? হিন্দুদের ধরে ধরে কচুকাটা করেছিল? বস্তুত উনি কোনোদিন ভারতের সুলতান ছিলেন না, ছিলেন গজনির সুলতান। গজনি আফগানিস্তান ভূখণ্ডে অবস্থিত। সুলতান মামুদ প্রথমবার ভারত আক্রমণ করেন ১০০০ সালে। লামঘান (জালালাবাদ) ও পেশোয়ারের মধ্যবর্তী অঞ্চল খাইবার গিরিপথে অবস্থিত ভারতের কিছু সীমান্তবর্তী দুর্গ ও শহর দখল করে নিজের সীমান্ত সুরক্ষিত করেন। দ্বিতীয় অভিযান ১০০১ সালে। জয়পালের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণ। জয় পাল পুত্র-পৌত্রসহ বন্দিত্ব বরণ করলেন। তবে আড়াই লক্ষ দিনার, ১৫০টি হাতি এবং কিছু অঞ্চলের বিনিময়ে পরিবার-পরিজনসহ জয়পালকে মুক্তি দেন। কিন্তু জয়পাল আত্মগ্লানি থেকে মুক্তি পেতে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। জয়পালের মৃত্যুর পর পুত্র আনন্দপাল সিংহাসনে বসেন। এরপর প্রায় চার বছর (১০০১ থেকে ১০০৪) মামুদ আর ভারতের দিকে আসেনি। ১০০৫ সালে মামুদের তৃতীয় ভারত অভিযান। এই অভিযানে ঝিলাম নদীর তীরবর্তী ভীরা রাজ্যের রাজার বিরুদ্ধে। ভীরা রাজ্যের রাজা বিজয় রায়ে বিরুদ্ধে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের অভিযোগে মামুদ তিনদিন টানা যুদ্ধ করার পর চতুর্থ দিনে বিজয় রায় যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সুযোগ বুঝে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে মামুদ পিছু নেন। দাসত্ব ও নির্যাতনের ভয়ে নিজের ছুরির আঘাতে আত্মহত্যা করেন। অবশেষে ভীরাও মামুদের দখলে চলে আসে। ১০০৬ সাল ছিল মামুদের চতুর্থ ভারত অভিযান। মামুদের এই অভিযান কোনো হিন্দু বা বৌদ্ধ রাজার বিরুদ্ধে নয়। এ অভিযান ছিল মুলতানের শাসনকর্তা শেখ আবদুল হামিদ। লোদির পৌত্র ফতেহ দাউদের বিরুদ্ধে। এদিকে জয় পালের পুত্র আনন্দপালের সঙ্গে জোট বেঁধে ফতেহ দাউদ মামুদের বিরুদ্ধে মিত্ৰতা স্থাপন করলেন। এই সংবাদ শুনে মামুদ মুলতানের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। আনন্দপালই ফতেহ দাউদের পক্ষে দাঁড়িয়ে মামুদের অভিযান প্রতিরোধ করে। কিন্তু শেষরক্ষা করতে পারেননি আনন্দপাল। মামুদের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে আনন্দপাল কাশ্মীরের দিকে গা-ঢাকা দেন। এরপর টানা সাতদিন মুলতান অবরোধ করলে ফতেহ দাউদ উপায়ান্তর না-দেখে বছরে ২০,০০০ দিরহাম কর প্রদানের শর্তে মামুদের কাছে বশ্যতা স্বীকার করেন। আনন্দপালের পুত্র নওয়াজ শাহর (আনন্দপালের পুত্র সুখপালের ইসলামে আসার পর নতুন নাম।) হাতে মুলতানের শাসনভারের দায়িত্ব দিয়ে মামুদ গজনিতে ফিরে যান। ফিরে এসে গজনি আক্রমণকারী মোঙ্গল নেতা ইলাককে চরম শিক্ষা দেন। এদিকে নওয়াজ শাহ শাসনভার পাওয়ার পর ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করেন। ১০০৭ সালে মামুদের পঞ্চম অভিযানে সুখ পাল ওরফে নওয়াজ শাহের ধৃষ্টতার জবাবে তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন এবং নওয়াজ পরাজিত হন। নওয়াজের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়, সেইসঙ্গে ক্ষতিপূরণ হিসাবে ৪ লক্ষ দিনার জরিমানাও দিতে হয়। ১০০৮ সাল। আনন্দপাল মামুদের বিরুদ্ধে উজ্জয়িনী, গোয়ালিয়র, কালিঞ্জর, কনৌজ, দিল্লি ও আজমিরের রাজাদের শক্তিকে একত্রিত করছিলেন। এ সংবাদ পেয়ে সুলতান মামুদ ষষ্ঠ অভিযানে আসেন। তুমুল যুদ্ধের পর আনন্দপালের শোচনীয় পরাজয় হয়। ১০০৯ সালে সপ্তম অভিযান। এই অভিযানে কাংড়া পাহাড়ের নগরকোট দুর্গ আক্রমণ ও অধিকার করেন। সেখানকার মন্দিরের ভিতর রক্ষিত যা কিছু ধনসম্পদ সব নিজ হস্তগত করেন। জানা যায়, এই মন্দিরে প্রচুর ধনসম্পদ মজুত ছিল। ১০১০ সালে অষ্টম অভিযান। এই অভিযান পুনরায় মুলতানের আবুল ফতেহ দাউদের বিরুদ্ধে। ঘোর উপজাতিদের বশ্যতা স্বীকার করে বিশ্বাসঘাতকতার জবাব দিতেই এই অভিযান। ফতেহ বশ্যতা স্বীকার করেন। এরপর প্রায় দু-বছর অভিযান স্থগিত রেখে নবম অভিযানটি করেন ১০১৪ সালে। আনন্দপাল বারবার পরাজিত হলেও সে সময়ের নিয়ম অনুযায়ী মামুদ কখনোই তাঁকে হত্যা করেননি। বারবার শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দিয়েছেন। কথায় বলে যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। অতএব আনন্দপাল হৃতরাজ্য ফিরে পেতে লবণগিরি অঞ্চলে শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে মামুদের বিরুদ্ধে। তবে মামুদের সঙ্গে তাঁকে যুদ্ধ করতে হয়নি। অতৃপ্ত অপূর্ণ স্বপ্ন নিয়ে যুদ্ধের আগেই তাঁর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়। এরপর আনন্দপালের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র ত্রিলোচন রাজধানী স্থানান্তর করে সুসংবদ্ধ একটি সেনাবাহিনী গড়ে তুলতে সক্ষম হন। কিন্তু সেই সেনাবাহিনী মামুদের ঝড়ে উড়ে গেছে। মামুদের অতর্কিত আক্রমণে ত্রিলোচন দিশাহারা হয়ে পড়েন এবং পরাজিত হন। মৃত্যুভয়ে তিনি কাশ্মীরে পালিয়ে গিয়ে আত্মগোপন করেন। পরে শিবলি পাহাড়ে নিজের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করলে বুন্দেলখণ্ডের চান্দেলরাজের সঙ্গে জোট বাঁধেন। সেই জোট ভাঙতে মামুদ ত্রিলোচনকে পুনরায় চূড়ান্তভাবে পরাস্ত করেন। মামুদ নয়, ত্রিলোচন নিহত হলেন গুপ্তঘাতকের দ্বারা। ১০১৪ সালে দশম অভিযানে ছিল থানেশ্বর বিজয়। থানেশ্বরের হিন্দুরাজা বশ্যতা স্বীকার করলে প্রচুর ধনসম্পদ সহ মামুদের হস্তগত হয় থানেশ্বর দুর্গ। ১০১৫ ও ১০১৬ সালে মামুদ দু-বার কাশ্মীর বিজয়ের চেষ্টা করলেও প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর দুর্ভেদ্য দুর্গের কারণে অভিযান ব্যর্থ হয়। এক বছর পর, ১০১৮ সালে দ্বাদশ (হিসাবমতো এয়োদশ) অভিযানে কনৌজ বিজয়ের লক্ষ্য। কনৌজের দিকে ধেয়ে আসার পথে ঝিলাম নদী পার হয়ে বুলন্দ শহরের হরদত্ত নামে এক হিন্দু রাজা বশ্যতা স্বীকার করেন এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এরপর মেহওয়ানের হিন্দু শাসনকর্তাকে পরাস্ত করে মথুরার দিকে চলে আসেন। মথুরা দখল নেন। দখল হল বৃন্দাবনও। লাভ করলেন প্রচুর ধনদৌলত। সাতটি দুর্গ দ্বারা পরিবেষ্টিত কনৌজে মামুদ পৌঁছোতেই ভীত-সন্ত্রস্ত প্রতিহার রাজা রাজ্যপাল নিঃশর্তে আত্মসমর্পণ করেন। বৃন্দাবনের হিন্দু নগরপাল তো মামুদ আসছে শুনেই এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। কনৌজে মামুদ হস্তগত করেন তিরিশ লক্ষ দিরহাম, ৫০,০০০ দাস এবং ৩৫০ টি হাতি। ১০১৯ সালে মামুদ আক্রমণ করেন কালিঞ্জর। এটি মামুদের ত্রয়োদশ আক্রমণ। কালিঞ্জরের চান্দেলরাজ ছিলেন গোণ্ডা। প্রতিহার রাজা রাজ্যপাল মামুদের কাছে বশ্যতা স্বীকার করাতে কোণ্ডা খুবই ক্ষুব্ধ হন। ফলে চান্দেরাজ কোপ্তা গোয়লিয়রের রাজার সঙ্গে মিলিত হয়ে সৈন্যবাহিনী নিয়ে রাজ্যপালের উপর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এই আক্রমণে রাজ্যপালের মৃত্যু হয়।

নৈতিক কারণেই মামুদ গোণ্ডার হাতে রাজ্যপালের অকস্মাৎ মৃত্যু মেনে নিতে পারেননি। তাই এ সংবাদ শুনে মামুদ কালিঞ্জর আক্রমণ করেন। চান্দেলরাজ যুদ্ধক্ষেত্র থেকেই পলায়ণ করেন। ১৯২১ সালে মামুদ চতুর্দশ ভারত অভিযান করেন। এবারের লক্ষ্য গোয়ালিয়র। কারণ গোয়ালিয়রের রাজাই রাজ্যপালকে হত্যা করেছিলেন চান্দেলরাজ গোণ্ডার প্ররোচনায়। সোয়াত বাজাউর ও কাফিরিস্তানের বিদ্রোহী উপজাতিদের দমন করে গোয়ালিয়রের উদ্দেশ্যে রওনা দিলে গোয়ালিয়ের রাজা মামুদের আনুগত্য স্বীকার করে নেন। এক বছর পর ১০২৩ সালে পঞ্চদশ ভারত অভিযানে আসেন। হিন্দুরাজা নন্দার বিরুদ্ধে কালিঞ্জর আক্রমণ করেন। এমতাবস্থায় নন্দা বার্ষিক কর প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিলে মুক্তি পান। মামুদের ষোলোতম ভারত অভিযান ১০২৫ খ্রিস্টাব্দে। এবারের লক্ষ্য সৌরাষ্ট্রের সোমনাথ মন্দির। মন্দিরটি গুজরাটের কাথিওয়াড়ের সমুদ্র উপকূলে অবস্থিত। এই মন্দিরে সোমনাথ দেবই ছিল প্রধান বিগ্রহ। সোমনাথের বিগ্রহ ছাড়াও ছিল বেশকিছু দ্বাররক্ষক ও দেহরক্ষীর বিগ্রহ। মন্দিরে কয়েক হাজার পুরোহিত নিযুক্ত থাকত। এছাড়া ছিল প্রচুর দেবদাসী। সাধারণ ভক্ত ও রাজরাজড়াদের কল্যাণে এই মন্দির ছিল ধনসম্পদে পরিপূর্ণ। সোমনাথ অভিযান পথে অনহিলওয়াড়ার চালুক্যবংশীয় রাজা ভূদেব মামুদকে কোনোরকম বাধা না-দিলেও হিন্দুদের কাছ থেকে প্রথম বাধা এল অনহিলওয়াড়ার কাছে মুন্ধীর নামক এক স্থানে। প্রতিপক্ষের প্রায় ২০,০০০ সৈন্যের মোকাবিলা করে মামুদ পৌঁছে গেলেন আজমিরে। আজমির থেকে সোজা কাথিওয়াড়ে পৌঁছে তাঁর সেনাবাহিনী সোমনাথ মন্দিরের দুর্গ-প্রাচীরের চারদিক সন্নিবেশিত করলেন। এখানে রাজপুত নৃপতিরা সকলে একত্রিত হয়ে মামুদকে প্রতিরোধ করতে এলে তাঁরা সম্পূর্ণভাবে পর্যদস্ত হয়। পরাজিত হন সোলাঙ্কিরাজ ভীমদেব। এরপর মামুদের সেনাবাহিনী দুর্গপ্রাচীর অতিক্রম করেন এবং মন্দিরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে দুই কোটি স্বর্ণমুদ্রা লুঠ করেন। যদিও মামুদের বিরুদ্ধে মন্দিরের মূর্তি ভাঙার অপবাদ সর্বজনবিদিত। কিন্তু এর কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। মামুদ নিজের হাতে মূর্তি ভেঙেছেন, এমন কোনো নথিই পাওয়া যায় না সমসাময়িক বর্ণনায়। “A Sort History of Muslim Rule in India” গ্রন্থে ঈশ্বরীপ্রসাদ লিখেছেন, পুরোহিতরা যখন ধনসম্পদের প্রতিদানে মূর্তিটিকে অক্ষত রাখার জন্য মামুদের আবেদন করছিলেন, তখন মামুদ মন্দিরের পুরোহিতদের বলেছিলেন, তিনি মূর্তি বিক্রেতা হিসাবে নয় মূর্তি ধ্বংসকারী হিসাবে পরিচিত হতে চান। তারপরই নাকি মামুদ তলোয়ার দিয়ে মূর্তিটি টুকরো টুকরো করে দিয়েছিলেন। ফলে মূর্তির ভিতর থেকে ঝরঝর করে ধনরত্ন ঝরে পড়ে। সোমনাথ মন্দিরের মূর্তি কেন, এত বছর ধরে এত দীর্ঘ পথে এতবার ভারত অভিযানে মামুদ একটি মন্দিরও স্পর্শ করেছেন বলে কোনো নথিই পাওয়া যায় না। হঠাৎ কী এমন হল, সোমনাথের মূর্তি ভাঙতে যাবেন! নির্লজ্জের মতো এহেন অপবাদ মামুদের ঘাড়ে চাপানো হয়েছে। রচিত হয়েছে কল্পকাহিনি। এ প্রসঙ্গে আমিনুল ইসলামের “ভারতবর্ষের ইতিহাস রাষ্ট্র ধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতা” গ্রন্থে যে যুক্তিগুলি উপস্থাপন করেছেন, সেগুলি বিবেচনায় রাখা যেতে পারে– (১) মামুদ স্বহস্তে মুর্তি ভেঙেছেন, এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে দুর্গ। বিজিত হলে সেনাবাহিনীরা এটা ভেঙে ফেলতে পারে। (২) আলবেরুনি বলেছেন, সোমনাথের মূর্তির একটি খণ্ড গজনির মসজিদের প্রবেশপথে রাখা হয়। ঐ খণ্ডটি যে সোমনাথ মূর্তিরই খণ্ড তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। (৩) সোমনাথের মূর্তিটি ভাস্কর্য ছিল না, এটি ছিল নিরেট পাথরের। অতএব মূর্তির অভ্যন্তর থেকে ধনরত্ন বেরিয়ে আসার কোনো প্রশ্নই আসে না। (৪) কেউ বলেছেন মূর্তিটি লিঙ্গম, আবার কেউ বলেছেন মানবাকৃতি। কেউ বলেছেন মূর্তিটি নারীর, কেউ বলেছেন পুরুষের। এই মূর্তির অভ্যন্তরে নাকি কুড়ি মণ ওজনের জহরত ছিল। অন্য এক বিবরণ অনুসারে ২০০ মণ ওজনের একটি সোনার শিকল সোমনাথ মূর্তিটিকে যথাস্থানে সংরক্ষিত রেখেছিল। অপর এক বর্ণনায়, এটি ছিল একটি লোহার মূর্তি। উপরে স্থাপিত একটি চুম্বকের আকর্ষণে শূন্যে ত্রিশঙ্কু এই মূর্তিটির দর্শনে ভক্তবৃন্দের মনে এক ভয়মিশ্রিত শ্রদ্ধাভাব জাগিয়ে তুলত। প্রসঙ্গত এটাও জেনে রাখা ভালো– সোমনাথ মন্দির ধ্বংসকারী মামুদের যে সৈন্যবাহিনী ছিল, তার মধ্যে পঞ্চাশ শতাংশ সেনা ছিল হিন্দুসম্প্রদায়ের। ১২ জন ছিল হিন্দু সেনাধ্যক্ষ, এর দুজন ছিল ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের। তিলক রায় নামে মামুদের এক হিন্দুসেনাপতির কথা জানতে পারি, যাঁকে দিয়ে মামুদ নিজেরই মুসলিম প্রধান সেনাপতি নিয়ালতিগিনের বিদ্রোহ দমন করিয়েছিলেন। মামুদের নির্দেশে এঁরা যেমন মন্দির ভেঙেছিল, তেমনি মসজিদও ভেঙেছিল প্রচুর। মামুদ যদি মূর্তিবিরোধীই হতেন, তাহলে স্বদেশে বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি আস্ত রাখতেন না, আস্ত রাখতেন না ভারতের বিখ্যাত খাজুরাহো মন্দির। ১০২৭ খ্রিস্টাব্দ ছিল মামুদের সতেরোতম তথা শেষবারের মতো ভারত অভিযান। সোমনাথ বিজয়ের পর স্বদেশ গজনিতে ফেরার পথে মামুদ জাঠদের দ্বারা প্রচণ্ডভাবে নিপীড়িত হন। তারই বদলা নিতে মামুদের এই অভিযান। এই অভিযানে জাঠদের চূড়ান্ত পরাজয় হয়।

একথা বুঝতে হবে, গজনির সুলতান মামুদ সতেরোবার ভারত আক্রমণ করেছেন, ভারত দখল ও শাসন করতে নয়, বিধর্মীদের কচুকাটা করতেও নয়, অমুসলিমদের উপর ইসলাম ধর্ম চাপিয়ে দেওয়ার জন্য নয়, মন্দির ভাঙার জন্য নয়– তিনি ভারত অভিযান করেছেন প্রচুর ধনসম্পদ লুঠ করে নিজ মুলুক গজনিতে নিয়ে নিজের বৈভব বৃদ্ধি করেছেন, সেনাবাহিনীদের প্রতিপালন করেছেন, নিজের দেশে জ্ঞানবিজ্ঞনেরও প্রচুর উন্নতি সাধন করেছেন। যুদ্ধরত প্রতিপক্ষের সৈন্য ছাড়া মামুদ কোনো সাধারণ মানুষদের হত্যা করেননি। যুদ্ধের কারণে মামুদ যেমন পঞ্চাশ হাজার অমুসলিম হত্যা করেছিলেন, তেমনি সমসংখ্যক মুসলিম হত্যা করেছেন। উপরন্তু সাধারণ প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মামুদের হিন্দুসৈন্যরাও মুসলমান সৈন্যদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছেন। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে অস্বীকার করায় হিন্দুদের কচুকাটা করা হয়েছে এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। কয়েকজন স্থানীয় রাজা স্বেচ্ছায় স্বধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন বটে, কিন্তু মামুদ গজনি ফিরে গেলেই তাঁরা পুনরায় স্বধর্মে ফিরে যান। বোঝাই যায় এ ধর্মান্তর ছিল সম্পূর্ণ রাজনৈতিক, জোরপূর্বক নয়। গজনির সুলতান মামুদ কখনোই ভারতকে নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করেননি। যেটা তিনি অনায়াসেই করতে পারতেন। মথুরা, সোমনাথ, থানেশ্বর, বৃন্দাবনের মন্দির আক্রমণ করা ছাড়া সতেরোবারের ভারত আক্রমণে একটিও মন্দিরে প্রবেশ করেননি, একটিও দেবতার মূর্তি ধ্বংস করেননি। তাও হত না, যদি-না সেইসব মন্দিরগুলোর অভ্যন্তরে প্রচুর গুপ্তধনের সন্ধান পেতেন। শুধু মন্দির নয়, ধনসম্পদের লুঠ করার জন্য তিনি প্রচুর মসজিদও ধ্বংস করেছেন। মুলতান ছিল মুসলিম বাদশাহের শাসন। মামুদ সেই বাদশাহকে পরাজিত করে মুলতানের একটা মসজিদও অক্ষত রাখেননি। কলহনের ‘রাজতরঙ্গিনী’ গ্রন্থে এসব ঘটনার উল্লেখ আছে। মামুদ যে শুধু ভারতেই অভিযান করেছেন, তা কিন্তু নয়। অন্যান্য দেশ অভিযান করেও লুণ্ঠন করে ধনসম্পদ অর্জন করেছেন। এর মধ্যে ইরান অন্যতম। মধ্য এশিয়ায় প্রায় সমস্ত অভিযান তাঁর স্বধর্মীদের বিরুদ্ধেই পরিচালিত হয়েছিল। নিজের সম্পদ বৃদ্ধির জন্যে রাজারাজড়ার হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকলেইই এসব কর্ম করতেন। সে যুগে এটাই ছিল দস্তুর। এ ধরনের ঘটনায় বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। আমরা যদি ভারতের স্থানীয় অমুসলিমদের দিকে যদি দেখি, তাহলে দেখব ১৫০ খ্রিস্টপূর্বে রচিত পতঞ্জলির মহাভাষ্যে, অথবা ৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পাণিনির ব্যাকরণে উল্লেখ আছে, মৌর্যরা তাঁদের কোষাগারকে সমৃদ্ধ করতে মূল্যবান ধাতব দেবদেবীর মূর্তি পর্যন্ত গলিয়ে ফেলতেন। আর মন্দির ধ্বংস? সে আলোচনা অন্য অধ্যায়ে বিস্তারিত করব।

গজনির সুলতান মাহমুদ ৯৯৭ সাল থেকে ১০৩০ সাল পর্যন্ত মোট ৩৩ বছর শাসন ক্ষমতায় ছিলেন। এই দীর্ঘ সময়ের মাঝে তিনি ইরানের পূর্বাঞ্চলের বিস্তীর্ণ ভূমি নিজের অধীনে আনতে সক্ষম হন। এছাড়া হিন্দুস্তানের উত্তর পশ্চিম অংশে তাঁর নিয়ন্ত্রণ বজায় ছিল। বর্তমান আফগানিস্তান, পাকিস্তান আর ইরানের পূর্বাঞ্চল সহ বিশাল এক ভূখণ্ড শাসন করতেন তিনি। তবে শক্তি আর যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তিনি কেন হিন্দুস্তানের ভূখণ্ডকে নিজের সরাসরি শাসনাধীনে নেননি, সেই প্রশ্নের উত্তরে কেবলই বিস্ময়। সুলতান মাহমুদ মৃত্যুবরণ করেন ১০৩০ সালে ৩০ এপ্রিল। তাঁর মৃত্যুর পর ক্ষমতার দ্বন্দ্ব নিয়ে রাজ পরিবারের মাঝেই বিরোধ লেগে যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *