৫
সাকেত যেতে হলে গঙ্গা পার হয়ে বাম দিকে বেঁকে যেতে হয়। রাজগৃহ থেকে শ্রাবস্তী পঁয়তাল্লিশ যোজন পথ। ঘন অরণ্য না থাকলেও ছোটখাটো বন আছে। তা ছাড়া সবটাই ধানক্ষেত, যবক্ষেত, তিলক্ষেত। ছোট ছোট গ্রাম, বড় বড় কানন। এই পথ দিয়ে তথাগত বুদ্ধ রাজগৃহ থেকে শ্রাবস্তীতে যান বলে এক যোজন অন্তর অন্তর বিশ্রামাগার নির্মিত হচ্ছে। শ্রাবস্তীর মহাশ্রেষ্ঠী সুদত্ত শ্রাবস্তীতে গৌতম বুদ্ধর বসবাসের জন্য এক বিশাল উদ্যান অষ্টাদশ কোটি সুবর্ণ দিয়ে কিনেছেন নাকি। বহু সহস্র ইষ্টকবর্ধকী এবং তক্ষা মিলে অত্যন্ত শীঘ্র শেষ করছে সেই জেতবনের মহাবিহার। এখনও কাজ চলছে। বিশেষত, বিশ্রামাগারগুলির অলঙ্করণ তো এখনও অবশিষ্ট। গত বর্ষা ওই জেতবনেই অবস্থান করেছেন গৌতম। পরে এসেছেন রাজগৃহে। বেণুবনে বাস করছেন, বহু ভিক্ষু সহ। রয়েছেন বুদ্ধের বিমাতা মহাপ্রজাবতী এবং বুদ্ধজায়া যশোধরাদেবীও। ভিক্ষুণী সংঘে সম্প্রতি বুদ্ধজনক শুদ্ধোদনের মৃত্যুর পর মহাপ্রজাবতী নাকি আলুলায়িত কুন্তলে, সামান্য বস্ত্র ধারণ করে, আরও বহু অভিজাত শাক্যরমণীর সঙ্গে বহু যোজন পথ অতিক্রম করে বৈশালীতে বুদ্ধ সকাশে গিয়ে উপস্থিত হন। রাজকন্যা, রাজরানি। বিশেষ শুদ্ধোদন ছিলেন অতিশয় বিলাসী। মহাপ্রজাবতী কখনও মাটিতে পা রাখেননি। ভিক্ষা করতে করতে ছিন্নমলিন বেশে তিনি যখন বৈশালীর মহাবনে কূটাগারশালায় উপস্থিত হলেন তখন স্ফোটকে তাঁর চরণ দুটি নাকি ভীষণ আকার ধারণ করেছিল। রক্তাক্তচরণ গৌতমমাতাকে সেবায় সুস্থ করে তোলেন আনন্দ। এবং বহু কষ্টে বুদ্ধকে সম্মত করান ভিক্ষুণী সংঘ প্রতিষ্ঠা করতে। পরে যশোধরাদেবীও তাঁর পিতৃকুল শ্বশুরকুল সর্বত্র থেকে যে অতুল সম্পদ পেয়েছিলেন শাক্যবংশীয় কোন রাজকুমারকে অর্পণ করে এসে ভিক্ষুণী সংঘে যোগ দেন।
বিশ্রামাগার নির্মিত হচ্ছে ভালো। কিন্তু পথ? পথটি তো বাণিজ্যপথও, এটিকে সংস্কার করাবে তো? এই পথটিও যে বড়ই উচ্চাবচ, কঙ্করময়, ধূলিমলিন! গ্রামের বা জনপদের মধ্যে প্রবেশ করলে অপেক্ষাকৃত সুপথ পাওয়া যায়। সে মগধের গ্রাম্যজনেরা নিয়মিত গ্রামকৃত্য করে বলে। গ্রামের পথগুলি, অতিথিশালা, চারণভূমি, নদীপার্শ্ব, পুষ্করিণীগুলি এরা পরিচ্ছন্ন রাখে। কিন্তু রথ যাবার উপযুক্ত পথ নয় সেগুলো। সেনিয় বলেছিল শিবিকায় যেতে, সুমনাদেবীর ইচ্ছা ছিল তাঁর নিজস্ব সিন্ধুদেশীয় অশ্ব চিত্ররথে চড়ে যাওয়াআসা করেন। কিন্তু এখন আর তিনি সেই দুরন্ত বালিকাটি নেই, নেই সেই দুঃসাহসী কিশোরীও। মনে মনে আছেন। কিন্তু বাইরের আকৃতিতে তিনি অতি সম্ভ্রান্ত কুলের বধূ, গৃহিণী। সেনিয় রাজি হল না। সাত ঘোড়ার রাজরথ নির্দিষ্ট হয়েছে সুমনার জন্য। ভালোই হয়েছে, দ্রুত পথ পার হয়ে যাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু অশ্বগুলি তো বন্য অশ্ব নয়, হাজার হলেও রাজ-মন্দুরায় লালিত-পালিত, যুদ্ধরথের অশ্বও নয়। বড় পাথরের টুকরোর আঘাতে একটি তো রীতিমতো কাতর হয়ে পড়েছিল। একটি নিগমগ্রামে তাকে শুশ্রুষার জন্য রেখে আসা হয়েছে। অন্য একটি শিক্ষিত অশ্বকে জোতা হয়েছে রথে। ছ’টি শ্বেত অশ্বের মধ্যে সেই কপিশবর্ণ অশ্বটিকে সর্বদাই তাঁর সুখাসন থেকে দেখতে পান দেবী সুমনা। আহত অশ্বটির কথা মনে পড়ে যায়।
আবরণী সরিয়ে তিনি দেখলেন অদূরে কয়েকটি কুটির দেখা যাচ্ছে। তিনি সারথিকে থামতে নির্দেশ দিলেন।
—কী গ্রাম এটা, সূতপুত্র?
—বোধ হয় কম্মার গাম দেবী।
—খুব বড় গাম কী?
—খুব বড় নয়। প্রধানত কস্মারদের গ্রাম, ওই যে কুটিরগুলি দেখছেন, ওর পাশে পাশেই সংলগ্ন কামারশালাগুলি। এদের সূক্ষ্ম বস্তু প্রস্তুত করার খ্যাতি আছে দেবী। খুব সরু সুঁচ, তীক্ষ্মধার ছুরিকা, সরু দাঁতের করাত গজদন্ত কাটবার জন্য, এইসব। জীবকভদ্র তো এই গ্রাম থেকেই তাঁর শল্য চিকিৎসার যাবতীয় বস্তু নির্দেশ দিয়ে প্রস্তুত করান। সন্দংশ, অন্তর্মুখ, দন্তশংকু, স্বস্তিক..
—তাই নাকি!
—হ্যাঁ দেবী, ওই যে সুবন্ন সেট্ঠির শিরঃপীড়ায় মারা যাবার মতো হয়েছিল! মনে হত কেউ তীক্ষ্ণ ছুরিকা দিয়ে তাঁর মস্তক কেটে ফেলছে। বৈদ্য শুদ্ধশীল এবং সন্নতি আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। জীবক বৈদ্য এই গ্রামের কামারশালা থেকে তীক্ষ্ণধার শস্ত্র নিয়ে গেলেন। সুবন্ন সেট্ঠির করোটি ভেদ করে দুটি কৃমিকীট বার করে দিলেন। তিন সপ্তাহের মধ্যে সেট্ঠি সুস্থ হয়ে উঠল।
সুমনা অবাক হয়ে রইলেন। করোটি ভেদ করা যায়! তারপর আবার জুড়ে দেওয়াও যায়! এ তো অলৌকিক কাণ্ড! তাঁর শ্বশুরগৃহে কিছু ইন্দ্রজাল-বিদ্যার চর্চা আছে। বাইরের দর্শকের কাছে তা অলৌকিক মনে হলেও তিনি জানেন, সেগুলির মধ্যে নিপুণতা আছে, চর্চা আছে, কিন্তু সমস্তটাই কৌশল। কিন্তু করোটি ভেদ করে কীট বার করা! এ তো গৌতম বুদ্ধর করার কথা! তিনি সম্যকসম্বুদ্ধ। স্বর্গ-মর্ত্য-নরক কোথায় কী হচ্ছে সব তাঁর নখদর্পণে থাকবার কথা। তিনি করলে বোঝা যেত। মক্খলি গোসালকে দেখেছেন এমনি কারুর উদরে হাত বুলিয়ে দারুণ যন্ত্রণার উপশম করতে। ব্যথায় পা ফেলতে পারছে না, তার নিমেষে পা সোজা হয়ে গেল, সে সহজভাবে চলতে লাগল। কিন্তু শস্ত্র দিয়ে করোটি ভেদ!
অশ্বগুলি ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। সারথি এখানে কিছুকাল থামবার অনুমতি চাইছে। সুমনা তো আগেই তাকে থামতে বলেছেন। তাঁর চিত্ত অধীর হয়ে রয়েছে। প্রায় দু মাসের কাছাকাছি তিনি নিজগৃহে অনুপস্থিত। কন্যাকে দেখেননি, স্বামীকে দেখেননি, কতকাল হয়ে গেল! মনে হচ্ছে দূরগামী পাখির মতো যদি দুটি ডানা থাকত, এখনি উড়ে সাকেতের একমাত্র সপ্ততালিক প্রাসাদের চূড়ায় গিয়ে বসতেন।
কিন্তু মগধের এই প্রত্যন্ত গ্রামে পৌঁছেছে রথ মাত্র দু দিন সময়ে। ঘোড়াগুলির মুখের দুপাশে সাদা ফেনা। ওরা নিকটবর্তী কোনও সরোবরে জল-পান করবে, কিছুকাল চরবে। খাবে। তারপর আবার চলতে পারবে।
দুই দাসীর সাহায্যে রথ থেকে নামলেন সুমনা। সাহায্যের প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু এমনিই রীতি। সুমনা রাজগৃহের অতি সম্ভ্রান্ত ক্ষত্রিয়কন্যা। বালিকা বয়সে বিম্বিসারের সহাধ্যায়িনী ছিলেন। তখন কে জানত, এই সামান্য ক্ষত্রিয়কুমার সেনিয় রাজা হবে! অঙ্গরাজ্য জয় করবে! কোশল-বৈশালীর সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করে রীতিমতো মহারাজ বিম্বিসার! সবচেয়ে কৌতুকের কথা সেনিয় ভারি সুদর্শন এবং রূপগর্বী ছিল। দীর্ঘিকা দেখলেই সে কোন-না-কোনও ছলে সেখানে গিয়ে মুখ দেখে আসত। আচার্য খানিকটা আদরে, খানিকটা তিরস্কারে তাকে বিম্বং সারং যস্য সঃ বিম্বসারঃ বলে ডাকতেন। চাঁচর কেশ, তীক্ষ্ণ নাসাগ্র, মসৃণ শ্যাম গাত্রত্বক, দীর্ঘায়ত চক্ষু এই বন্ধুকে সহাধ্যায়ীরা সবাই তখন বিম্বিসার বলেই ডাকতে শুরু করে। মাত্র ষোল বছর বয়সে তাকে যখন পিতা ক্ষেত্রৌজা সামান্য একটি চতুষ্পায়ী আসনে হরিদ্রাবর্ণ সিংহচর্ম বিছিয়ে রাজা বলে অভিষিক্ত করলেন, তখন আচার্য প্রদত্ত সেই বিম্বিসার নামটাই রয়ে গেল, লোকে বলে বটে সেনিয়, কিন্তু সেটা নামের একটা অপ্রধান বিশেষণের পুচ্ছ যেন। সুমনা চলতে চলতে আপনমনেই হেসে ফেললেন। দুজনের বন্ধুত্ব বেশ গভীর ছিল। অর্থাৎ যে কোনও সূত্র ধরে দুজনের মধ্যে মারামারি লেগে যেত। সুমনা শুধু প্রখর বুদ্ধিশালিনীই ছিলেন না, অনুশীলন করেছিলেন দৈহিক বল, ধনুর্বাণ এবং অসিচালনা। যে কোনও ব্যাপারেই সুমনাকে পরাজিত করতে সেনিয়কে যথেষ্ট শক্তিক্ষয় করতে হত। সহজে হত না। শেষ পর্যন্ত দ্বন্দ্বযুদ্ধে সুমনাকে পরাস্ত করে সেনিয় তাকে মাটিতে ফেলে দিয়ে বুকের ওপর চড়ে বসত, চুলের মুঠি ধরে বলত, ‘আমি হব রাজা আর তুই তখন হবি আমার প্রতীহারী।’
এক ঝটকায় তাকে ফেলে দেবার চেষ্টা করতে করতে সুমনা বলত, ‘প্রতীহারী না আরও কিছু। রাজা না আরও কিছু! আমি হব নিষাদরানি, তুই আমার অনুচর, আমার তূণ-টুন বইবি।
—তবে রে, তবে তুই প্রতীহারীও নয়, আমার তাম্বুলের পাত্র বইবি। কি যেন বলে তাম্বুলকরঙ্কবাহিনী। দাসী, দাসী, দাসী।
সেনিয় এর পর এলোপাথাড়ি মার খেত। বালিকার তীক্ষ্ণ নখ এবং দাঁতের প্রহারে জর্জরিত হয়ে বলত, ‘নারী, নারী, নারীরা এমনিই হয়। এত তো অস্ত্রের ব্যবহার শিখছিস, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বার করলি সেই দাঁত, নখ আর শিঙ্। বন্যপশু আর রমণীর এই-ই তো প্রকৃতিদত্ত প্রহরণ!’
স্থানটি ভারি মনোরম। সিন্ধুবার, সপ্তপর্ণী, শাল্মলী, পিপ্পল—বহু বৃক্ষে ঘেরা বন? না উদ্যান? বনই মনে হয়। কিন্তু গ্রামজনেরা বনটিকে নিজেদের ইচ্ছা মতো পরিষ্কার করেছে। ছায়াবৃক্ষগুলি রেখেছে, পুষ্পবৃক্ষ রোপণ করেছে। শুষ্ক পত্ৰ কাঠিকুঠি ঝাঁট দিয়ে ঝুড়িতে তুলছিল একটি প্রৌঢ়া, সুমনাকে দেখে বিস্ময়ে সম্ভ্রমে সোজা হয়ে দাঁড়ালো, তারপর একটু দূরে সরে গেল। অদূরে একটি বকুল গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো আরও দুটি যুবতী। তাদেরও হাতে ঝাঁটা, ঝুড়ি।
সুমনা বললেন, ‘এখানে কোনও বিশ্রামগৃহ আছে? কি লতামণ্ডপ?’
—না তো মা, গাঁয়ে আছে অতিথ্শালা। এ বনে তো নাই।
—পানীয় জলের সরোবর আছে?
—ওই তো পুকুর রয়েছে। আমরা স্নান করি, পান করি, সবই..।
—কী করছ এখানে?
ঝুড়ি দেখিয়ে প্রৌঢ়া বলল, ‘এইসব কুড়িয়ে নিয়ে আগুন করি মা। আমরা তো আর অগ্নিহোত্রী নই যে, ঘরে অগ্নিদেব থাকবেন! বনটি পরিষ্কারও হল, আমাদের গ্রামকৃত্যও হয়ে গেল। একসঙ্গে দুটি।’
—ওই মেয়ে দুটি কি তোমার?
—‘মেয়ে নয় মা, বউ’, সগর্বে বলল প্রৌঢ়া ‘সাত ছেলে আমার, বড়বউ রাঁধে, মেজবউ জোগান দেয়, সেজবউ ঘর নিকায়, নবউ গরুছাগলগুলি দেখে। এই দুটি সব্ব কনিট্ঠা এখনও। এদের নিয়ে আমি এইসব করি। ছোটটির এখনও বিয়ে হয়নি।’
—ছেলেরা তোমার কী করে মা?
সন্ত্রস্ত হয়ে প্রৌঢ়া বলল, ‘ক্ষেত চষে মা, সব ক্ষেত চষে।’
—ক্ষেত্রপাল?
—না, মা, না। ক্ষেত্রপালের ভূমি, শুধু চষে তারা।
সুমনা অন্যমনে এগিয়ে গেলেন। বধূ দুটি এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বলাবলি করতে লাগল, ‘কী রকম সোঁদাল ফুলের মতো রং দেখেছিস?’
—অঙ্গেও বোধ হয় বারাণসীর বস্তর? তাই না?
—কাঞ্চীটা দেখেছিলি? পুরো সুবন্নের নয়? যখন পেছন ফিরে চলে গেল, ভরা ঘটের মতো নিতম্ব দুটি দুলিয়ে, কাঞ্চীটি কী মানিয়েছিল?
—হ্যাঁ হ্যাঁ মানিয়েছিল। চল চল এখন কাজ সারি।’ তাঁদের শাশুড়ি তাড়া দিল।
এই সময়ে সুমনা লাফ দিয়ে একটি নীপশাখা থেকে দুটি অপূর্ব সুন্দর নীপকুসুম পাড়লেন, ভালো করে দেখেশুনে কানের ওপর দিয়ে সুকৌশলে আটকাতে লাগলেন, যাতে প্রস্ফুটিত কেশরময় গোলাকার ফুলগুলি কানের পাটার ওপর এসে দুলতে লাগল।
গ্রামবধূদের একজন সবিস্ময়ে বলে উঠল, ‘দ্যাখ দ্যাখ, ধনী ঘরনীর কাণ্ড দেখ। কানে মণিরত্নের কন্নপুর। উনি আবার কদমফুল দোলাচ্ছেন!’ অন্যজন বলল, ‘আদিখ্যেতা!’ তার ঠোঁট বিকৃত হয়ে রয়েছে।
প্রৌঢ়া ধমক দিয়ে বললেন, ‘কী হচ্ছে? নিজের নিজের যেমন যেমন আছে খেয়ে পরে থাকতে পারলেই তো হল। বড় মানুষের গহনার দিকে দৃষ্টি দেওয়ার দরকার কী? শুধু শুধু তেষ্টা বাড়বে। চল, এখন চল দিকিনি!’
কিছুদূর চলে এসে প্রৌঢ়া আবার বলল, ‘সুবন্ন, সুবন্ন! দেখলি তো অত সুবন্ন পেলেও মন ভরে না, ওই রূপুসী তো সে-ই কদমফুলের দিকেই হাত বাড়াল! তোরা যখন মল্লিকার কাঞ্চী পরিস, কন্নিকারের কন্নপুর কানে ঝোলাস, তোদের ওতেই মানায়। আমার ছেলেদের সুবন্ন-সুবন্ন, রুপা-রুপা করে বিরক্ত করিসনি। এ জন্মে পুণ্যসঞ্চয় কর। পরজন্মে নিশ্চয় সুবন্ন পরতে পাবি।’
ঘন তমালবৃক্ষের শ্রেণীর ওপারে সরোবর দেখতে পেলেন সুমনা। তিনি একা প্রবেশ করেছেন বনে। দাসীদের আসতে নিষেধ করেছেন। সব সময় সঙ্গে দাসী। লোকজন যেন অসহ্য লাগছে। ওরা এখন তাঁর ভোজ্য প্রস্তুত করছে। করুক। যতক্ষণ ধরে পারে করুক। এই রাজবাড়ির দাসীদের আবার আচার-আচরণ একটু বেশি মাত্রায় শীলিত। আভূমি প্রণত না হয়ে কথা বলে না। চোখে চোখ ফেলে না। তিনি সোজাসুজি সারথির সঙ্গে কথা বললে, আপাদমস্তক কেমন কঠিন হয়ে যায় তাদের। সেনিয়র মতো সাধারণ ঘরের ছেলে দিবারাত্র এসব সহ্য করে কী করে?
সরোবরটি খুবই প্রশস্ত। ওপরে শৈবালের একটি পাতলা স্তর। ওপারে তাঁর রথের ঘোড়ারা জলপান করছে। লতামণ্ডপ একটি আছে। কিন্তু শুঁয়োপোকায় ভর্তি। লতামণ্ডপটি দেখে মনে হল কেউ কোনও সময়ে সযত্নে রচনা করেছিল, তারপর কালের প্রকোপে এখন সে স্বামীও নেই, সে ধনও নেই, সব নষ্ট হয়ে গেছে। তাহলে হয়ত এ বন এক সময়ে উদ্যানই ছিল, এই লতাকুঞ্জে সুখী সৌভাগ্যশালী ভূস্বামী পত্নী পরিবৃত হয়ে বসতেন বসন্তের পূর্ণিমায়, গ্রীষ্মের সন্ধ্যাবকাশে। যেমন ভদ্দিয়তে দেখেছেন শ্বশুর মেণ্ডক শ্ৰেষ্ঠীকে। কপিশ বর্ণের ঘোড়াটি দীর্ঘ সময় জল পান করে আকাশের দিকে মুখ করে হ্রেষাধ্বনি করে উঠল। আহা! সুমনার মন বাৎসল্যে ভরে উঠল। সত্যিই, অনেক যোজন পরে ওদের জলপানের ও বিশ্রামের অবসর দেওয়া হল। তিনি খুব তাড়া দিচ্ছিলেন। হলকর্ষণ উৎসবের পূর্বেই তাঁর পৌঁছবার কথা। বহু খুঁটিনাটি করণীয় আছে। বিশাখাকে তেমন কিছুই বলে আসা হয়নি। রাজবাড়িতে বিশেষ কারণে দেরি হয়ে গেল। পঞ্চকষায়, পঞ্চগব্য, পঞ্চশস্য, পঞ্চপল্লব… ঘটস্থাপনের জন্য সুবর্ণঘট গড়াতে দিয়ে আসা হয়নি। ধনঞ্জয়ের কি মনে থাকবে ঘটের পরিমাপের জন্য পুরোহিত আচার্য ক্ষত্ৰপাণির কাছে বিধান নেওয়া প্রয়োজন! এবার হলকর্ষণোৎসবের দিনে তাঁদের পুষ্করিণী প্রতিষ্ঠার সংকল্প ছিল। প্রাসাদের শ্রীমণ্ডপটি নতুন করে তোলবার কথা। তৎসংক্রান্ত বাস্তুযোগেরও অনেক ঝামেলা। সে সমস্ত কি ওই পনেরো-ষোল বছরের মেয়ে সামলাতে পারবে? বস্তুত, সারা বছরই তো যাগ-যজ্ঞ পূজা-সংস্কার চলছেই। তিনি শিখেছিলেন পিতামহী, পরে শ্বশ্রূমাতা পদ্মাবতীর কাছে, ভদ্দিয়তে থাকলে বিশাখা সবই আপনাআপনি শিখে যেত। কিন্তু সাকেতে তাঁরা খানিকটা একা হয়ে গেছেন। সব কিছুই স্বয়ং উপস্থিত থেকে নিষ্পন্ন করতে হয়। উপরন্তু, তিনি বিশাখাকে নিজের মতোই অশ্বারোহণ, অসিচালনা ইত্যাদি বিদ্যায় পারদর্শী করবার জন্য একাধিক আচার্য আচার্যা নিয়োগ করেছেন। ব্যায়াম এবং অধ্যয়নের জন্য তাকে অনেক সময় দিতে হয়। ধনঞ্জয়ের এগুলিতে খুব অনুমতি ছিল না। তিনি সুমনাকে বলেছিলেন, ‘তুমি ছিলে ক্ষত্রিয়কন্যা, তাই অস্ত্রশিক্ষা, ভারোত্তোলন এসব তোমার পিতামহ তোমাকে শিখিয়েছিলেন বংশের ধারা অনুসরণ করেই! আমার কন্যার এসবে প্রয়োজন কী?’
—কোথায় আবার কজন ক্ষত্রিয়কন্যাকে তুমি অস্ত্রশিক্ষা করতে দেখলে সেট্ঠি। আমি তো দেখি না। পিতামহী বলতেন যবে থেকে মেয়েরা অস্ত্রচালনা করতে ভুলে গেল তবে থেকেই তাদের দাসীর দশা!
ধনঞ্জয় হেসে বলেছিলেন, ‘আমার গৃহে অস্ত্রশিক্ষা না করে এলেও তোমার দাসীর দশা হত না প্রিয়ে। তুমি তো জানো পাঁচটি বাণ তুমি প্রথমেই আমার ওপর ব্যয় করে তবে এ গৃহে এসেছ।’
সুমনা বলেছিলেন, ‘কৌতুক রাখো সেট্ঠি, আমি অস্ত্রচালনা না জানলে কোথায় থাকতে আজ তুমি আর কোথায় থাকতাম আমি! মনে পড়ে? মনে পড়ে পূর্বদেশে বাণিজ্যযাত্রার কথা?’
এটুকু স্মরণ করিয়ে দেওয়াই ছিল যথেষ্ট। ধনঞ্জয় বিশাখার শস্ত্রশিক্ষায় আর আপত্তি করেননি।
এখন কর্মকার গ্রামের প্রত্যন্ত বনে তমালশ্রেণীর তলায় হরিতাভ সরসীর জলের দিকে তাকিয়ে সুমনা আক্রান্ত হলেন মধুর, রোমাঞ্চময় অতীতস্মৃতিজ্বরে। সুমনা এখন আর রাজগৃহ থেকে সপ্তাশ্ববাহিত রথে সাকেতে ধনীশ্রেষ্ঠ ধনঞ্জয়ের গৃহে আদৌ ফিরছেন না। এখন বর্ষারম্ভও নয়। সুন্দর, শোভন সময় এখন। বর্ষা অতিক্রান্ত, কিন্তু হিমঋতু আরম্ভ হয়নি। সুনীলবর্ণ নভস্তল। মেঘরাজি যেন শুভ্র কাপার্সবস্ত্রখণ্ড। কোনও দেবতা তাদের ফুঁ দিয়ে দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছেন আকাশময়। যেন শারদ পৃথিবীর অতুলনীয় স্বর্ণশোভা দেখে চেল ওড়াচ্ছে দিগ্দেবতারা। তাদের ছোটিকার শব্দও একটু কান পাতলেই কাষ্ঠকুট্ট পাখিদের মাধ্যমে শুনতে পাওয়া যাবে। টুক টুক টুক। কুট্ট কুট্ট কুট্ট।
সুমনা তখন সপ্তদশী। শ্বশ্রূমাতা পদ্মাবতী বললেন—‘যুবতী বধূ বাণিজ্যে যাবে পতির সঙ্গে এমন অদ্ভুত সাধের কথা আমি কখনও শুনিনি। ছিঃ। পথে কত বিপদ!’
শ্বশুর মেণ্ডক বললেন—‘আমিও কখনও শুনিনি, সত্যি বলছি প্রিয়ে। কিন্তু এই বধুটি ক্ষত্রিয়কুমারী, উচ্চশিক্ষিতা, তার ওপর ব্যায়ামশালায় প্রথম যখন ওকে দেখি তখন থেকেই ওই দুঃশীলা লৌহমুষলের মতো কি যেন একটা অস্ত্র দিয়ে আমাকে একেবারে ভূতলশায়ী করে ফেলেছে।’
শেষের কথাগুলি অবশ্যই মেণ্ডকের স্নেহকৌতুক। তিনি রাজগৃহের এক শস্ত্র প্রতিযোগিতা উৎসবে সুমনাকে প্রথম দেখেছিলেন। এবং দেখে মন্ত্রমুগ্ধবৎ ধনঞ্জয়ের বধূ নির্বাচন করেছিলেন।
পদ্মাবতী বললেন—‘এই বিশাল পরিবার। বিশাল গৃহ। এতগুলি পুত্র-কন্যা, বধূ, পৌত্র-পৌত্রী, আত্মীয়, পরিজন। তুমি গহপতি হয়ে যদি এমন স্বেচ্ছাচারিতা কর তবে কে তোমায় মানবে? আমি বরং অবসর নিই। তুমি তোমার পুত্রবধূ কোকিলাকেই এবার থেকে সংসারের ভার দাও। আমি সমনদের কাছে ধর্মদেশনা শুনে কাল কাটাব।’ তিনি দ্রুত পদক্ষেপে চলে যাচ্ছিলেন।
সুমনা তাড়াতাড়ি গিয়ে তাঁর হাতদুটি ধরল—‘আমি যাব না মাতা, যাব না, আপনি ক্ষুব্ধ হবেন না।’ সুমনার চোখে সহসা জল আসত না, সেদিন চোখ দুটি ভিজে উঠেছিল।
—‘আমি কি তাই বলেছি মা?’ পদ্মাবতী তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, ‘আসল কথা কি জানো, তুমি যদি এভাবে যেতে চাও, তবে গৃহের অন্য বধূ-কন্যাগুলিও অসম্ভব সব ইচ্ছা প্রকাশ করতে থাকবে। তখন কী করে সেসব পূরণ করব বল?’
শ্বশুর মেণ্ডক মৃদু হেসে বললেন—‘সে ভয় কর না প্রিয়ে, এত বধূই তো এসেছে এ গৃহে, কে কবে দেশে দেশে ভ্রমণ করবার আশায় সার্থবাহর পিছু নিয়েছে বলো? কে-ই বা শিক্ষা করেছে ধনুর্বেদ! পরশু আর কার হাতেই বা এমন মানায়?’
দেবি পদ্মাবতীর অনুমতি এবং আশীর্বাদ নিয়ে সুমনা যখন যাত্রার জন্য প্রস্তুত হলেন, তখন তাঁর পরনে যোদ্ধৃবেশ। পুরুষদের মতো অধোবাস। ঊর্ধ্বাঙ্গে কবচ। মাথার চুলগুলি চুড়ো করে বেঁধে একটি উষ্ণীষ পরে নিয়েছিলেন। গৃহের অন্য বধুগুলি নিন্দা করেছিল, অবশ্য প্রকাশ্যে নয়। ভদ্দিয়র-আত্মীয় বন্ধু-প্রতিবেশীরাও কি আর সমর্থন করেছিলেন? কিন্তু মেণ্ডক শ্ৰেষ্ঠীর মুখের ওপর কথা বলবে কে?
অঙ্গদেশ পেরোলেই পথে খালি জঙ্গল, জঙ্গল আর জঙ্গল। রথ চলবার যোগ্য পথ তো ছিলই না। গো-শকটগুলি নিয়ে ধনঞ্জয় প্রায়ই সমস্যায় পড়ছিলেন। সুমনা ও ধনঞ্জয় ছিলেন অশ্বের ওপর। শরৎকাল, রোদ অসহ্য হয়ে উঠলে মাথার ওপর ছত্র ছিল। বৃষ্টি হয়নি। জঙ্গলগুলি হিংস্র শ্বাপদে পূর্ণ। বিশ্রাম করবার সময়ে তিন-চার জন দাসকে বৃক্ষের ওপরে পর্যবেক্ষক নিযুক্ত করা হয়েছিল, তারা প্রহরা দিচ্ছে। শকটগুলি বৃত্তাকারে রেখে, তার বাইরে অগ্নিকুণ্ড জ্বালানো হয়েছিল। বৃত্তের ভেতরে বস্ত্রাবাসে মূল্যবান পণ্যদ্রব্যের থলিগুলি নিয়ে বলবান সশস্ত্র দাস এবং দলের অন্যান্য বণিকরা। কিন্তু সুমনার আগ্রহে তাঁদের স্কন্ধাবারটি রচিত হয়েছিল কয়েকটি ঘনপত্র সু-উচ্চ বৃক্ষের আড়ালে। তখন সদ্য বিবাহিত। পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য যেন দ্বিগুণ, চতুর্গুণ মনে হচ্ছিল নতুন প্রণয়যুক্ত হয়ে। কার্তিকী পৌর্ণমাসীর অবারিত জ্যোৎস্না দুধের ধারায় স্নান করিয়ে দিচ্ছে সেই অরণ্যের অচেনা গাছগুলি, বন্য কুসুমের উগ্র গন্ধ ছুটেছে মুক্তধারায়। অগ্নিবলয়ের বাইরে নিচ্ছিদ্র অমিস্রা। তার ভেতরে শকটগুলির, বলদগুলির, বস্ত্রাবাসগুলির কালো কালো আকৃতি।
—কী সুন্দর দ্যাখো দ্যাখো? সুমনা বললেন ধনঞ্জয়কে।
—ধনঞ্জয় একবার চারদিকে দৃষ্টিপাত করেই বললেন—‘কাকে সুন্দর বলছো প্রিয়ে, ওই ঘন কৃষ্ণগিরিসন্নিভ দুর্ভেদ্য অন্ধকারকে? না এই ভৌতিক ছায়াগুলিকে, যারা আগুনের শিখার মধ্যে কাঁপছে, আকার হারাচ্ছে আবার আকার পাচ্ছে?
সুমনা বিস্মিত হয়ে বললেন—‘সবই, আর্যপুত্র, এ ছাড়াও আছে পত্রালির ফাঁকে ফাঁকে গলে-পড়া চান্দ্রেয় দুধের ধারা, উতল করা সৌরভ, মাঝে মাঝে নৈশ পাখির তীব্র ডাক!’
—‘ভয়ঙ্কর বলো, নারকীয় বলো, পরিচিত পৌর্ণমাসী জ্যোৎস্নাধারাটা পর্যন্ত যে বৈতরণীর স্রোতোধারা মনে হচ্ছে আমার! যেন পরপারে যাবার জন্যে আমাদের আহ্বান করছে! আর ওই কটু গন্ধকে তুমি সৌরভ বলছ প্রিয়ে, রাতের পাখিগুলিকে কি জন্মের সময়ে কেউ জিভে মধু দেয়নি?’
হেসে ফেললেন সুমনা। হঠাৎ মনে হল সেনিয়, সেনিয় থাকলে তাঁর কথার অর্থ বোধ করতে পারত। কিন্তু সেনিয় তো এখন রাজা, এমন শৌর্যবীর্য দেখাচ্ছে যে, শ্রাবস্তী থেকে স্বয়ং মহারাজ মহাকোশল তাঁর কন্যাকে তার হাতে অর্পণ করেছেন। অনেক গুণ হয়েছে সেনিয়র। সে আজকাল গুপ্তভাবে বৈশালীতে বিখ্যাত জনপদশোভিনী অম্বপালির গৃহে যায়।
—‘দীর্ঘশ্বাস ফেলছ কেন সুমনা?’ তরুণ ধনঞ্জয় ততক্ষণে গাঢ় আলিঙ্গনে বেঁধে ফেলেছেন সুমনাকে—ধনঞ্জয় বললেন, ‘অবশ্যই সুন্দর এই রাত্রি, তোমায় আমায় গোপনতা দিচ্ছে বলে, সুন্দর ওই অগ্নিবলয়, আমাদের সুখরাত্রিটি রক্ষা করছে বলে, আর জ্যোৎস্না, তোমার বর্ণকে মোহময় করেছে বলে। বনকুসুমের ওই উগ্র গন্ধ আমাকে কেমন কামোত্তেজিত করেছে দেখো! পাখিগুলি ডাকতে থাকুক, আমার গদ্গদ ভাষণ আর তোমার শীৎকার ধ্বনি চাপা পড়ে যাবে।’
বস্ত্রাবাসের বাইরে চলে এলেন দুজনে। চুম্বনমত্ত ধনঞ্জয়। সুমনার অঙ্গ শিথিল হয়ে আসছে। তাঁর বক্ষের বর্মটি খুলতে খুলতে ধনঞ্জয় বলছেন—‘পুরুষ বেশে তোমায় আরও মোহময়ী দেখায় সুমনা, এই বর্মের বাধাগুলি তোমার-আমার মধ্যে রেখে তুমি আমাকে আরও দুর্দম, আরও উদ্দাম, উন্মাদ করে তুলছ।’
সহসা একটা শব্দ হল। সুমনা নিমেষে ধনঞ্জয়ের মুখের ওপর হাত-চাপা দিয়ে বললেন—‘শুনতে পেলে?’
—‘আরে বন্য বিড়াল কি ওই জাতীয় প্রাণী হবে, আমি তো আমার শরীরে দ্রুত রক্ত সঞ্চালন শব্দ ছাড়া আর কিছুই শুনতে পাচ্ছি না।’
ধনঞ্জয়ের কথা শেষ হল না, সুমনার হাতের তীর ক্ষিপ্রগতিতে ছুটে চলে গেল শব্দ লক্ষ্য করে। অর্ধোত্থিত সুমনা, মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছেন ধনঞ্জয়। তীব্র চিৎকারে রাত ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। পর্যবেক্ষকদের হাতে উল্কা জ্বলে উঠেছে। হিংস্র জন্তু নয়। হিংস্র মানুষই আক্রমণ করেছে তাঁদের। অস্তোন্মুখ চাঁদের মৃদু আলোয়, অন্ধকারের সঙ্গে গা মিলিয়ে বলবান কালো রঙের মানুষ সব। পর পর তিনজনকে ধরাশায়ী করলেন সুমনা। অন্যরা পালিয়ে গেল। আহত তিনটি বনেচরকে দাসেরা ক্ষতস্থান বেঁধে সঙ্গে নিয়ে নিল। পণ্যসম্ভার বইতে এরকম দাস যত পাওয়া যায়, ততই ভালো। স্থলনিয়ামক বলল—‘এরা দুর্দান্ত নর মাংসভোজী যক্ষ।’ লোকগুলি রক্তচক্ষে তাঁদের দিকে তাকাচ্ছিল। সবাই ভয় পাচ্ছিল, তাদের ভাষা কেউ বুঝছিল না। হাত রজ্জুবদ্ধ অবস্থায়, পানীয় জল ও সামান্য খাদ্য দিয়ে তাদের চম্পা পর্যন্ত নিয়ে আসা হল। কী আশ্চর্যের কথা, তারা কিন্তু একবারও অরণ্যে ফিরে যেতে চায়নি। হাতের-ইঙ্গিতে জানিয়েছিল অরণ্যে ফিরে গেলে তাদের কৌমের লোকেরা তাদের গ্রহণ তো করবেই না। বরং মেরে ফেলবে। আর্যদের স্পর্শে তারা নাকি দৃষিত হয়ে গেছে! অদ্ভুত! অবশেষে নৌদাস হিসেবে যখন তাদের পট্টনে বিক্রি করে দেওয়া হল, তখন তাদের কী গোঙানি! অশ্রুচ্ছন্ন তাদের চোখগুলি দেখে মনে হয়েছিল তারা জীবনের সমস্ত আশা-ভরসা হারিয়ে ফেলেছে! নরমাংসাশী মানুষগুলিকে তো সঙ্গে রাখাও যায় না!
—‘দেবি, আপনার আহারের আয়োজন হয়েছে।’ চমকে মুখ তুলে সুমনা দেখলেন দাসী দুটি দুদিকে বিনীতভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। জোড়হস্ত।
তিনি বললেন—‘এখানে নিয়ে এসো।’
—‘এখানে?’ দাসী দুটি পরস্পরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করল।
গত কয়েক মাস ধরে রাজগৃহে রোমাঞ্চক সব ঘটনা ঘটছে। কয়েক মাস না বলে কয়েক বছর বলাই ভাল। সন্দেহ নেই, সাকেতের দেবি সুমনা সেইজন্যেই এতো আনমনা। কিছু ভাল লাগছে না তাঁর। নির্জনে, একা থাকতে চান।
ওরা চলে যাচ্ছিল, সহসা সুমনা ডেকে উঠলেন—‘সিরিমা, রতি কি ভোজ্য আনছ?”
—‘কেন দেবি মাংসোদন, ঘৃতপক্ক রোহিত…’
—‘এই গ্রাম থেকে কিছু ফল, দধি এসব কেনা যায় না?’
—‘কিনতে হবে কেন দেবি? সব সঙ্গে আছে।’
—‘তাহলে তাই দাও, আর শোনো শাল কিম্বা পদ্মপুটে দিও।’
কিছুক্ষণের মধ্যেই ভোজ্য নিয়ে এলো দাসীরা। পাটুলি গ্রামের উৎকৃষ্ট চিপিটক, একটু ভিজিয়ে দিলেই নরম হয়ে যায়। সেই চিপিটক, দধি ও মধু দিয়ে মেখে এনেছে দাসীরা। সুপুষ্ট সোনার রঙের কদলী। মোদক ছিল তিন-চার রকমের। স্পর্শ করলেন না সুমনা। চারদিকে গাছের পাতার মধ্যে দিয়ে মৃদু হাওয়া বওয়ার সিরসির শব্দ। মাথায়, কোলে, আশেপাশে ঝরে পড়ছে শুকনো পাতা, পাখিদের মধ্যাহ্নকূজন, সরোবরের সবুজ জলে লাফ দিয়ে বেড়াচ্ছে জলকীট। পদ্মপত্রের সুশোভিত পাত্রে ভোজন সমাধা করে, পাতাগুলি মুড়ে একটু দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন সুমনা, অমনি একটি কাক সেটি ছোঁ মেরে নিয়ে গেল। দাসীরা রৌপ্যভৃঙ্গারে করে আচমনের জল দিতে দিতে বলল—‘ভাগ্যে ভোজনের পরে নিয়েছে, আমরা তো ভয় পাচ্ছিলাম…’ একটি কাঠবিড়ালি আর একটির পেছন পেছন লেজ তুলে একটি শাল্মলী গাছের গুঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেল।
ধীরে ধীরে মধ্যাহ্নের অরণ্যের মধ্যে বনদেবীর মতো ঘুরে বেড়াচ্ছেন সুমনা। এখন তাঁর সঙ্গের লোকজন আহার করবে। একটু বিশ্রাম। তার পর যাত্রা। হঠাৎ মনে পড়ে গেল সেবার বাণিজ্যযাত্রায় এক দস্যুদলপতিকেও তিনি হত্যা করেছিলেন। এক প্রকার দৈবাৎ তাকে আবিষ্কার করেছিলেন তিনি। সেই অঞ্চলের ভূমি ছিল ঢেউ খেলানো, মাঝে মাঝেই ছোট ছোট টিলা উঁচু হয়ে আছে। গুল্ম তো আছেই, বৃক্ষও নেহাত অল্প না। অপরাহ্ণে ধনঞ্জয় যখন গণনাকার্যে ব্যস্ত, তিনি ধীরে ধীরে টিলায় উঠে গিয়েছিলেন সন্ধ্যাসুর্য দেখবেন বলে। তখনই একদল লোকের মাথা দেখতে পেলেন টিলার ওধারে। তারা নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করছিল ঠিক কখন কীভাবে এই বণিকদের হত্যা করে তাদের ধন হস্তগত করবে। সুমনা একটি বনমহিষের মুণ্ডের মতো পাথর আলগা করে ফেললেন কয়েকবার নাড়িয়ে নাড়িয়ে, তারপর সমস্ত শক্তিতে গড়িয়ে দিলেন ওধারে। সম্ভবত দলপতিটিই ছিল পাথরটির অবতরণের মুখে। তার মাথাটি চূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। সেই পৈশাচিক আর্তনাদ জীবনে কখনও ভুলবে না সুমনা। প্রথমটায় তিনি থেমে গিয়েছিলেন বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো। তারপর ত্বরিতে নেমে এসে নিজের বস্ত্রাবাসের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিলেন। চারদিকের টিলায় টিলায় প্রতিহত হয়ে সেই আর্তনাদ তাঁদের সার্থকে চঞ্চল করে তুলেছিল। দস্যুরা বোধ হয় দেবতার কোপ মনে করে পালিয়ে গিয়েছিল। তাঁদের স্থলনিয়ামকও পর্বতদেবতার পূজা দিয়েছিল। কেউ টের পায়নি এটি তাঁরই কীর্তি এবং পূজার নৈবেদ্যটি আসলে তাঁরই প্রাপ্য। কিন্তু সেই দস্যুদলপতির বিদলিত মস্তক, রক্তে মস্তিষ্কের শুভ্র অংশে মাখামাখি দেহ ও ভূমি, শকুন-শৃগালের উৎসব, এসব দেখে তাঁর এমন অসুখ করেছিল যে, বহুদিন সুষ্ঠু সুগন্ধি স্নিগ্ধকর পানীয় বা ফলের রস ছাড়া আর কিছু মুখে করতে পারেননি।
কথাটা চেপে রেখেছিলেন অনেকদিন। ভদ্দিয়তে ফেরবার পর পূর্বদেশের সুনীলবর্ণ সূক্ষ্ম কার্পাস বস্ত্র পরে কপালে কুঙ্কুম-চন্দনের পত্ৰলেখা এঁকে, গন্ধমালা, এবং শঙ্খকঙ্কন পরে অতি সুন্দর হয়ে যেদিন ধনঞ্জয়ের শয্যায় গেলেন, মিলিত হবার পূর্ব মুহূর্তে কেঁদে ফেলেছিলেন।
—‘আর্যপুত্র, আমি হত্যা করেছি, আমার হাতে রক্ত লেগে আছে।’
—‘সে কী?’
তখন সব কথা খুলে বলতে ধনঞ্জয় হেসে বলেছিলেন—‘এই কথা! অন্যায় তো কিছু করনি। দলপতি ওভাবে না মারা গেলে ওরা আমাদের যথাসর্বস্ব কেড়ে নিত হয়তো। হয়তো আমাদের সঙ্গে পুরোপুরি পারত না, তবু কিছু লোকক্ষয় তো হতই! এত তাম্র, রুপা, মণিমুক্তা, সূক্ষ্মবস্ত্র, স্বর্ণ এসব নিয়ে ফেরা হত না। তবে তুমি বড় দুঃসাহসিকা। আমি আর তোমায় নিয়ে কোথাও যাচ্ছি না।’
ধনঞ্জয়ের বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন সুমনা। ধনঞ্জয় বলেছিলেন—‘তোমার দেহে শক্তি থাকলে কি হবে প্রিয়ে তোমার হৃদয় কুসুমগুচ্ছের মত কোমল।’
পথের দিকে এগিয়ে গেলেন সুমনা। রক্ষীপ্রধানকে জিজ্ঞাসা করলেন—কতক্ষণে সাকেত পৌঁছব?’
—‘কাল সন্ধ্যার মধ্যে পৌঁছে যাবার চেষ্টা করছি দেবি। সকালে অতটা বর্ষণ না হলে দ্বিপ্রহরেই পৌঁছে যেতাম।’
সে কথা সুমনা জানেন। সকালের ওই সময়টা মধ্যজৈষ্ঠে অমন বৃষ্টি। খুবই শুভঙ্কর। ফসল ভাল হবে। ধনধান্যে পূর্ণ হবে বসুন্ধরা। তবে মধ্যশ্রাবণ অবধি যদি এই প্রকার চলে বা এর চেয়ে অধিক বৃষ্টি হয়, নদীগুলিতে জলস্ফীতি হবে, প্লাবনের ভয় থাকবে। অচিরবতী ভীষণ আকার ধারণ করবে। সে এক এক সময়ে এতই ক্ষীণা থাকে যে, হেঁটে পার হওয়া যায়, কিন্তু বর্ষায় তারই রূপ ভয়ঙ্করী। সরযূ অবশ্য সারা বছরই সমান নাব্য। যথেষ্ট গভীর। সহসা জলস্ফীতি হয় না।
দাসীরা এসে ডাকল। সুমনা উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর ভেতরটা উৎকণ্ঠায় অধীর হয়ে আছে। বিশাখার জন্য হঠাৎ কেমন উৎকণ্ঠা হচ্ছে। রাজপ্রাসাদ থেকে যেসব বার্তা তিনি বহন করে নিয়ে যাচ্ছেন সেসব কি শুভ? ধনঞ্জয় কী বলবেন? বিশাখা? বিশাখার মাত্র পনেরো বছর পার হয়েছে। এইটুকু বয়সের পক্ষে সে একটু বেশি শিখেছে, বুদ্ধিমতীও, কিন্তু বালিকাই তো! তাঁর একমাত্র। ভদ্দিয়তে তাঁর দেবরবধূরা বহু পুত্রবতী। কিন্তু ধনঞ্জয় প্রায় সারাটা যৌবনই কাটিয়েছেন বাণিজ্যযাত্রায়। একটির বেশি সন্তান দিতে পারেননি সুমনাকে। বিশাখা তাঁর মাথার মণি, তাঁর হৃৎ-কমল। অন্য নারী যেমন চোখে কন্যাকে দেখে—লালন-পালন করা হল, বিবাহ হল, হয়তো বহুদূরে, সারা জীবনে আর দেখা হল না, তিনি কেন এভাবে দেখতে পারেন না! কেন মনে হয়, বিশাখা চোখের আড়াল হলে তিনি বুঝি ব্যর্থ হয়ে যাবেন, হয়তো-বা উন্মাদ হয়ে যাবেন! কেন এমন হল? ঘোড়াগুলো আরও জোরে ছুটছে না কেন? সারথি কি প্রচুর মোদক খেয়ে মদ্য পান করে উদরে হাত বোলাতে বোলাতে রথচালনা করছে?
হঠাৎ সুমনা ডাকলেন—‘সূতপুত্র?’
—‘বলুন দেবি।’
—‘আমাকে একটু রথ চালনা করতে দাও।’
—‘বলেন কি দেবি! আপনি? না, না, আমায় ক্ষমা করুন।’
—‘আমার কথা শোনো সূত, আমি পারি, শিক্ষা করেছি।’
—‘সাত ঘোড়ার রথ দেবি, এ চালানো খুব কঠিন কাজ। তাছাড়া ঘোড়াগুলি আপনার পরিচিত নয়।’
সুমনা উঠে দাঁড়ালেন। দাসী দুটি উৎকণ্ঠিত। রক্ষী কজন বিস্মিত, উদ্বিগ্ন মুখে চেয়ে আছে, সুমনা সূতের হাত থেকে রশি নিলেন। ঘোড়াগুলি প্রথমটা কেমন অশ্বস্তিতে গা মোড়ামুড়ি করছিল, তারপর সহসা তারা স্বচ্ছন্দ গতিতে ছুটে চলল।
৬
মাথার ওপর অর্ধবৃত্তাকার সোনালি রঙের চাঁদোয়া। তা থেকে ঝুলছে মুক্তার ঝালর। চতুষ্কোণ সিংহাসনের ওপর কোমল স্থূলাসন নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু সবার ওপরে রয়েছে সিংহচর্মের আস্তরণ। সিংহাসনের বাহুগুলিও সিংহমুখ। স্ফটিকের পাদপীঠের ওপর পা দুটি। দু’ধারে সারি সারি বসেছেন অমাত্যরা, রাজন্যরা, সবারই পেছনে চামর দোলাচ্ছে যুবতীরা। মণিকুট্টিমের ওপর নানা রঙের পাথরের চিত্র করা। কস্তুরীর সুবাস ভেসে বেড়াচ্ছে হাওয়ায়। শ্রেণীক বিম্বিসারের রাজসভা। গান্ধার দেশ থেকে রাজদূত সভায় আসছেন ঘোষক জানাল। মহারাজ বাম ঊরুর ওপর ডান ঊরু ন্যস্ত করে বসেছিলেন। নামিয়ে নিয়ে আবার পাদপীঠের ওপর দুটি পা-ই রাখলেন। চণক লক্ষ করলেন রাজার প্রগাঢ় যৌবন। ব্যায়ামপুষ্ট, তামার পাটার মতো বুকখানা। তার ওপর শ্বেতচন্দনের অনুলেপন। গলায় রক্তাভ মুক্তার দীর্ঘ মালা। বাহুর সুপুষ্ট পেশীর ওপর সোনার অঙ্গদ। কানে মুক্তাখচিত স্বর্ণাভরণ। শুভ্র পট্টবস্ত্রে সোনার পাড়। রাজমুকুটে বহুমূল্য হীরক ঝকঝক করছে। একটু আধটু মুখ ফেরালেই চতুর্দিকে আলো ঠিকরে যাচ্ছে। শ্মশ্রু নেই, গুম্ফদ্বয় নাতিদীর্ঘ, অতি সুপুরুষ, সুমুখ সন্দেহ নেই। দেখতে দেখতে চণকের কেমন রোমাঞ্চ হচ্ছিল। ইনিই তাহলে সেই বিম্বিসার! অতি অল্প সময়ের মধ্যে যিনি সমগ্র উত্তর দেশে মধদেশে খ্যাতিমান হয়ে উঠেছেন! মুখে একটা হাস্যচঞ্চল ভাব, চোখে সামান্য কৌতুক, কিন্তু মুখের ভাব পরক্ষণেই পালটে অতি গম্ভীর হয়ে যেতে পারে।
গান্ধারের রাজদূত সংখ্যায় তিনজন। যদিও সহচর এবং রক্ষী আরও অনেক। যথাযোগ্য মর্যাদা সহকারে তাঁদের রাজ-অতিথিগৃহে রাখা হয়েছিল সাত দিন। আজ অষ্টম দিন রাজাজ্ঞায় সভায় উপস্থিত করা হচ্ছে।
প্রথমেই দূত-প্রধান মহামাত্র দর্ভসেন মহারাজকে সসম্ভ্রমে নমস্কার জানিয়ে প্রথম উপঢৌকন নিবেদন করলেন। তাঁর আদেশে দুজন দাস এসে দূরে সভাকক্ষের দরজার কাছে একটি গোটানো গালিচা রাখল তারপর সহসা খুলে গড়িয়ে দিল। মুহূর্তে সভার এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত ঢেকে গেল জমাট রক্তের মতো বর্ণের কোমল পশমে। গালিচার ওপর বহু চিত্র করা। সবুজ, নীল, শুষ্ক তৃণরাশির মতো হলুদ। রমণীরা আসনে বসে আঙুরগুচ্ছ থেকে আঙুর নিয়ে খাচ্ছে লীলায়িত ভঙ্গিতে, বিচিত্র সব পাখি, পাত্রমিত্র সহ রাজারা সভায় বসে আছেন। সভাস্থ সকলেই চমৎকৃত হয়ে গেলেন। রাজা মৃদু হেসে বললেন, ‘পারস্যের গালিচাশিল্পী কি মগধের সভাকক্ষের পরিমাপ নিয়ে গিয়েছিলেন!’
বিনীত হেসে দর্ভসেন বললেন, ‘মহারাজ, ভৃগুকচ্ছের বণিকদের কথাবার্তা থেকে অনুমান হয় আমাদের জম্বুদ্বীপে সভাকক্ষের যেসব আয়তন ব্যবহার করা হয়, পারস্য দেশেও তাই-ই সিদ্ধ। মাপ-জোকের তত্ত্ব কারুশিল্পীরা সর্বদেশেই একভাবে বোঝেন। আমাদের শুল্বসূত্র পরিমাপের আদর্শ। তার থেকেই সব এসেছে। ঋষিরা দেবতাদের কাছ থেকে পেয়েছিলেন তো!’
দ্বিতীয় দূত চণক নত হয়ে হাত জোড় করে বলে উঠলেন, ‘জ্ঞান এবং শিল্পের রাজ্য সম্ভবত সসাগরা ধরণীতলে একটাই। আহা যদি রাষ্ট্রশিল্পও অনুরূপ হত?’
মহারাজ বিম্বিসার চকিত হয়ে বললেন, ‘কী বললেন?’
দর্ভসেন সবার অলক্ষ্যে ক্রুদ্ধ কটাক্ষ হানলেন চণকের দিকে। চণক আবার নমস্কার করে বললেন, ‘অপরাধ মার্জনা করবেন মহারাজ, অধীন তক্ষশিলার দেবরাত-পুত্র চণক। অধীত বিষয়গুলি নিয়ে মনে মনে আলোচনা করতে করতে এসব কথাই মনে উদয় হয় কি না!’
বিম্বিসার যেন শরের মতো সোজা হয়ে গেলেন, ‘আপনি আচার্য দেবরাতের পুত্র? অহো, আজ আমার কী সৌভাগ্য! সময়ান্তরে আপনার সঙ্গে আলাপ করতে উৎসুক রইলাম।’
রাজা সামান্য অন্যমনস্ক হয়ে গেছেন, লক্ষ করলেন চণক। শরীর একটু শিথিল। শরীর থেকে মন অন্যত্র সরে গেলে যেমন হয়। কিন্তু মুখে একটা রাজকীয় প্রসন্নতা, সুভদ্র মনোযোগের আভাস ফুটিয়ে রেখেছেন। প্রতারিত হচ্ছেন দর্ভসেন এবং সম্পাতি। হয়তো সমবেত রাজন্য ও অমাত্যরাও। কিন্তু চণক বুঝতে পারছেন, এই সুদর্শন রাজার ভেতরে কোথাও অধৈর্য প্রবেশ করেছে।
দর্ভসেন দ্বিতীয় উপঢৌকন নিবেদন করলেন। আগাগোড়া অপূর্ব সূচীকর্মে খচিত আটটি পশমি শাল। উভয় পিঠেই কারুকাজ একরকম। রঙগুলি অত্যুজ্জ্বল নীলকান্তমণির, পদ্মরাগের, গলিত স্বর্ণের, গজদন্তের, প্রস্ফুটিত কিংশুকের, শ্যামশষ্পের, এবং দুটি একেবারে বলাক-পাখার মতো শুভ্র। সভাস্থল যেন ঝলমল করে উঠল। সূক্ষ্ম সূচীকর্ম দেখতে দেখতে সকলে সাধুকার দিয়ে উঠলেন।
তৃতীয় উপঢৌকন এলো সূক্ষ্ম দুকূল পরিহিত অপরূপ সুন্দরী একটি রমণী। দর্ভসেন বললেন, ‘এই রমণী অসাধারণ নৃত্যকুশলা, সঙ্গীতেও এঁর জুড়ি মেলা ভার। স্বয়ং রাজার তত্ত্বাবধানে চৌষট্টি কলায় শিক্ষিত হয়েছেন ইনি।’ রমণী জোড় হাতে অপরূপ ত্রিভঙ্গে দাঁড়িয়েছিলেন। অমাত্যরা বিস্ফারিত চোখে দেখছিল। রাজাগুলির চোখে কামমোহ ও লোভ যাওয়া-আসা করছিল। খালি বিম্বিসারের মুখের ওপর দিয়ে একটি লঘু মেঘের মতো কালো ছায়া ভেসে গেল। খুব সূক্ষ্ম একটি ভ্রূকুটি উঠেই মিলিয়ে গেল তাঁর কপালে। চণক দেখলেন।
দর্ভসেন এবার গান্ধাররাজ পূষ্করসারীর বার্তা শোনাবার জন্য চণককে ইঙ্গিত করলেন। চন্দন কাঠের আবরণ থেকে বার করে—শ্বেত রেশমের ওপর স্বর্ণসূত্র দিয়ে প্রস্তুত লিপিটি মেলে ধরলেন চণক।
‘হর্যংককুলপ্রদীপ মগধাধিপ মহারাজ বিম্বিসারের প্রতি গান্ধাররাজ পুষ্করসারীর প্রার্থনা—আজীবন প্রীতি, সৌহার্দ্য ও পারস্পরিক কুশলে প্রযত্ন। মহারাজ পুষ্করসারী পুনশ্চ নিবেদন করছেন গত কয়েক মাস যাবৎ অবন্তীরাজ প্রদ্যোত মহাসেন বিনা কারণে গান্ধাররাজ্যকে উত্ত্যক্ত করছেন। প্রান্তিক গ্রাম ও জনপদগুলি অবন্তীর লুণ্ঠনশীল সৈন্যদের দ্বারা বিপর্যস্ত। শোনা যাচ্ছে আগামী শরৎকালে অবন্তীরাজ স্বয়ং গান্ধার আক্রমণে আসবেন। এমত সময়ে প্রতিবেশী সাগলরাজ্যের জামাতা মহামান্য মগধাধিপ যদি অবন্তীকে প্রশমিত করবার জন্য সহযোগিতা করেন তবে এই বন্ধুত্বকে দেব পুষ্করসারী তাঁর শিরোভূষণ করবেন। এবং মগধের অনুরূপ বিপৎপাতে সহযোগিতা করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকবেন।’
শুনতে শুনতে মহারাজ বিম্বিসারের মুখমণ্ডল ভাবলেশহীন হয়ে যাচ্ছিল। লিপিটি চণকের মুখস্থ, তিনি সামনে সেটা ধরে অর্ধনিমীলিত চোখ মেলে রেখেছিলেন রাজার মুখের দিকে। ক্ষণপূর্বের রহস্যালাপ, ঔৎসুক্য, এ সবের চিহ্ন আর সেখানে নেই। তিনি মনোযোগ দিয়ে শুনছেন। কথা শেষ হতে আর একটু শিথিল হয়ে বসলেন। পেছনে ঠেস দিয়েছেন। তুলে দিয়েছেন ডান ঊরুর ওপরে বাম ঊরু। মুখ প্রসন্ন। যেন বরাভয় আপনি প্রকাশিত হচ্ছে মুখমণ্ডলে। সামান্য পরে বললেন, ‘গান্ধাররাজ পরমপ্রাজ্ঞ দেব পুক্কুসাতীকে আমার নমস্কার জানাই। দু-এক দিনের মধ্যেই তিনি উত্তর পাবেন। আপনারা দূত মহোদয়রা এখন বিশ্রাম করুন। রাজগৃহে আছে বহু শোভনোদ্যান, চিত্ৰগৃহ, নাট্যশালা, প্রাসাদেও নৃত্য-গীতাদি প্রমোদের ব্যবস্থা আছে। অন্যত্রও আছে। মহামান্য দূতগণ যেভাবে কালক্ষেপ করতে চাইবেন, তাঁদের দাস-দাসীরা সেভাবেই সব কিছুর ব্যবস্থা করে দেবে।
উঠে দাঁড়ালেন দর্ভসেন, সঙ্গে সম্পাতি, চণক। তিন জনে নমস্কার জানালেন। রাজা বললেন, ‘সত্থি সত্থি।’ তাঁর চোখ দুটি নিমেষের জন্য চণকের চোখ ছুঁয়ে গেল।
দুজন আধিকারিক আভূমি প্রণত হয়ে জানাল নগরবধূ শ্ৰীমতীর গেহে নৃত্য-গীত এবং কাব্য-পাঠের আয়োজন হয়েছে। রাজগৃহের অনেক গুণিজনই আজ সেখানে যাচ্ছেন। গান্ধারদূতদের নিয়ে যাবার জন্য রথ প্রস্তুত।
দর্ভসেন তাকালেন চণকের দিকে। চণক বললেন, ‘দুশ্চিন্তায় বহুদিন কেটেছে। মন্দ কী? সম্পাতি, তুমি কি বলো?’
সম্পাতি বিনীত স্বরে বলল, ‘মহামাত্য দর্ভসেন যা আদেশ করেন!’
আকাশে নীল মেঘ। গুরু গুরু ধ্বনি হচ্ছে। দর্ভসেন শঙ্কিত হয়ে সেদিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এই বৃষ্টিটা এসে পড়বার আগেই নগরবধূর গৃহে পৌঁছতে পারবে তো?’
তাঁর পেছন পেছন রথে উঠতে উঠতে চণক বললেন, ‘আর্য, এই প্রথম আষাঢ়ী বৃষ্টির দৃশ্য কিন্তু খুব সুন্দর। রথে যেতে যেতে যদি বৃষ্টি এসেই যায়, খুবই উপভোগ্য হবে সেটা।’
দর্ভসেন ভ্রূকুটি করে নিম্নকণ্ঠে বললেন, ‘কার্যোদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত কোনও সুদৃশ্যই আমার রুচিকর লাগবে না, সে তো তুমি জানো চণক!’
চণক প্রায় আত্মগত বললেন, ‘কার্যোদ্ধার কি সে অর্থে হবে?’
সম্পাতি ফিরে তাকাল। রথ ছুটেছে। দর্ভসেন বললেন, ‘কী বললে?’
—কিছু না।
দর্ভসেন জোর গলায় বললেন, ‘এই যে শ্রীমতীর গৃহে যাচ্ছি, নৃত্য-গীত কি আর তেমন করে মনকে স্পর্শ করবে? কিছুক্ষণ শিথিল হওয়া একটু। এর চেয়ে অধিক কিছু নয়।’
সম্পাতি চণকের দিকে তাকিয়ে খুব সূক্ষ্ম একটি হাসি হাসল। অমাত্য দর্ভসেনের রমণীপ্রীতি তক্ষশিলার কারও অজানা নয়। এই যে রাজান্তঃপুর থেকে জিতসোমাকে উপঢৌকন পাঠানো হল মগধরাজের কাছে, এ পরিকল্পনা খুব সম্ভব তাঁরই। দর্ভসেনের পাঁচটি স্ত্রী। এ ছাড়াও তক্ষশিলার নগরশোভিনী গণিকা চন্দ্রাননা তাঁর বিশেষ পক্ষপাতপুষ্ট। নগরপ্রান্তে তাঁর যে উপবন এবং উদ্যানগৃহ আছে, সেখানে রাজান্তঃপুরের অনেক সুন্দরী নটী ও দাসীই অভিসারে যায়। দর্ভসেন অবশ্য বলেন গূঢ়পুরুষ আর গণিকা, এরা একে অপরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। গূঢ়পুরুষের বৃত্তিই তাকে গণিকার কাছে যেতে বাধ্য করে। রাজপুরীর রমণীগুলিই কি অল্প সংবাদ রাখে! তাদের সাহায্য গূঢ়পুরুষদের সর্বাধিনায়ক হিসেবে তাঁর সর্বদা প্রয়োজন হয়।
শ্ৰীমতীর গৃহের শ্রী-মণ্ডপটি বৃত্তাকার। চারদিকে ঘিরে আছে ছোট ছোট কাঠের স্তম্ভ। তাতে সুন্দরী রমণীমূর্তি তক্ষণ করা। স্তম্ভের ওপর থেকে মালা ঝুলছে, তার ওপর দীপবর্তিকা; এখন দিনের বেলা, তাই সেগুলি জ্বলছে না। প্রত্যেকটি স্তম্ভের সামনে অতিথিদের জন্য আসন। অদূরে একটি কৃষ্ণকায় বাদক মৃদঙ্গ নিয়ে বসেছিল। আর একটি মেয়ের হাতে বীণা। স্নিগ্ধ সবুজ রঙের বসন পরে শ্রীমতী বসেছিল। দীর্ঘ চোখে দীর্ঘতর কাজলরেখা। ভুরু দুটি কান ছুঁয়েছে। বর্ণ শ্যাম, গালে লালিমা। ঠোঁট দুটিও টুকটুক করছে। বুকের ওপর কুমকুম ও চন্দনের কারুকাজ। মনে হচ্ছিল সে পট্টবস্ত্রের ওপর লাল সুতোর কাজ করা একটি স্তনপট্ট পরে আছে। গলায় একটি দীর্ঘ রত্নহার। কণ্ঠ বেড়ে রয়েছে একটি অদ্ভুত সুন্দর অলঙ্কার। তার মুখ দুটি উদ্যত সর্পের মতো। হাত নেড়ে যখন সে কথা বলছিল তখন অঙ্গুরীয়গুলি ঝলমল করে উঠছিল, কেয়ূর ও কঙ্কণের রত্নগুলিও ঝিকমিক করছিল। উঠে দাঁড়িয়ে জোড় হাতে নমস্কার করে তাঁদের স্বাগত জানাল শ্রীমতী। উপস্থিত অতিথিদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। ‘ইনি বোধিকুমার, রাজগৃহের বিখ্যাত কবি, ইনি বাষ্পভদ্র, আমরা বলি বপ্পকুমার। মহাশ্রেষ্ঠী কাকবলীয়র পুত্র, সঙ্গীত বোঝেন খুব ভালো। ইনি কাকবর্ণ, এ নগরের মহাপর্ণিক, ভালোবাসেন কাব্য ও সঙ্গীতসুধা পান করতে। এই যে এঁর সঙ্গে আলাপ করুন আর্য দর্ভসেন, ইনি নটশ্রেষ্ঠ চারুবাক। দু-চার দিনের মধ্যেই শ্রেষ্ঠীমহলে একটি সমাজোৎসব আছে। তাতে আর্য চারুবাক শক্রদেবের মহিমা দেখাবেন, লিখেছেন মহামান্য বোধিকুমার। যদি থাকেন, অবশ্যই আহ্বানপত্র পাঠানো হবে, আসবেন নিশ্চয়। আসবেন তো সম্পাতি ভদ্র? চণক ভদ্র?’
চণক দেখলেন শ্যামশ্রীমণ্ডিত তরুণীটি তাঁর দিকে যেন বিহ্বল চোখে চেয়ে আছে। তিনি সামনের দিকে কোন দুর্লক্ষ্য বিন্দুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এত বড় কবি যখন উপস্থিত রয়েছেন, কাব্যসুধা পান করা যাক, কী বলেন শ্রেষ্ঠী বাষ্পভদ্র? মহামাত্য দর্ভসেন, ভদ্র চারুবাক আপনাদেরও তাই মত তো?’
—নিশ্চয়। হোক, হোক। সকলেই সম্মতি জানালেন।
বোধিকুমার তাঁর পুঁথির দুপাশের তাম্রপট্ট খুলতে লাগলেন। বললেন, ‘সামান্যই রচনা হয়েছে।’ মগধের চলিত ভাষায় তিনি যে কাব্যাংশটি পড়লেন তার অর্থ এই রকমঃ
‘কত বসন্ত গর্ভে ধারণ করে তুমি অন্তর্বত্নী হয়েছ হে আষাঢ়ী পৌর্ণমাসী। মধুমাসের মাধুর্যবিলাস এমন শ্যামশোভা তোমায় কেন দিল? যাতে বাসন্তী জ্যোৎস্না নিজেকে পরিপূর্ণভাবে হারিয়ে ফেলেছে? কবি ভেবেছিল বাসন্তীবিলাস থেকে জন্ম নেবে স্বয়ং রতিপতির মতো কোনও চিরযুবা, জন্মযুবা কুমার। তার বদলে তুমি এক রুদতী কৃষ্ণা কল্যাণীর জন্ম দিলে। প্রতি মুহূর্তে আপনাকে ক্ষয় করে যে দিয়ে যাচ্ছে, দিয়ে যাচ্ছে আর দিয়ে যাচ্ছে॥’
শেষ হতে না হতেই সভার মধ্যে সাধু সাধু রব উঠল। বোধিকুমার নত হয়ে সবাইকে নমস্কার জানালেন। মহাপর্ণিক কাকবর্ণ বললেন, ‘এর পর শ্রীমতীর সঙ্গীত ছাড়া আর কিছু ভালো লাগবে না। কাব্যালোচনায় উৎসাহিত হয়ে উঠেছিল বোধ হয় কুমার বাষ্প এবং চারুবাক্, তারা ভ্রূকুটি করে থেমে গেল। দর্ভসেন নিচু সুরে বললেন, ‘ওহে চণক, এরা যে দেখি এদের কথ্য ভাষা দিয়ে কাব্য রচনা করতে শুরু করেছে। বলি কালে কালে আর দেখব কত?’ তাঁর কথার কিছু কিছু বোধ হয় কুমার বাষ্পের কানে গিয়ে থাকবে। সে বলে উঠল, ‘ঋগ্বেদীয় ভাষার সঙ্গে আমাদের এখনকার দেবভাষার পার্থক্যটা তো মানেন আর্য? ভাষা বহতা নদীর মতো। বদলে যায়, ‘মর্যো ন ঘোষাম্ অভ্যেতি পশ্চাৎ’ এখানে উপমানের পরে এসেছে বলে ন বলতে ইব অর্থাৎ মতো বোঝাচ্ছে। এ প্রকার ব্যবহার কি এখন আর পাওয়া যায়? তারপরে ধরুন উত। বৈদিক ভাষায় এবং অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে। পরে উত-র অর্থ দাঁড়িয়েছে বা। ভাষাকে আপনি ধরে রাখতে পারবেন না।’
দর্ভসেন চুপ করে গেলেন। চণক বললেন, ‘আপনার কথা ভাববার মতো বপ্পভদ্র। একেবারেই উড়িয়ে দেবার যোগ্য নয়।’
বপ্প বললেন, ‘আপনি তা হলে অনুমোদন করছেন? জানেন বোধিকুমার আমার অন্তরঙ্গ বান্ধব, তাকে এই কাব্যটি কথ্য ভাষায় লিখতে আমিই উৎসাহ দিয়েছি। দেবভাষাতেও একটি রূপ আছে এর। সেও ভারি সুন্দর। বিদ্বানরা যদি কথ্যটিকে গ্রহণ না করেন তাহেল দেবভাষার রূপটি তো রইলই! কবির যশোহানি হবে না। কী বলেন?’ বপ্প বোধিকুমারের দিকে চেয়ে কৌতুকের হাসি হাসলেন।
শ্রীমতী গান ধরল। ভ্রমরগুঞ্জনের মতো বীণার সুরপুঞ্জগুলি তার উচ্চারিত শব্দগুলিকে ঘিরে ঘিরে লীলায় মেতে উঠল। মৃদঙ্গের মধুর গম্ভীর ধমৎকার তার সঙ্গে। শ্রীমতী শব্দগুলি উচ্চারণ করছিল যেন অস্ফুট ভোরের কাকলির মতো।
‘পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘের সঙ্গে কুঞ্জে কে এলে মঞ্জুভাষ?
রঞ্জিত এই হৃদয় যে আজ বাজছে নূপুর-শিঞ্জিতে॥
বারে বারে ঘুরে ফিরে এই দুটি চরণ নানা সুরে নানা ভাবে নানা তালে ও লয়ে গাইতে লাগল শ্ৰীমতী।
সে খুবই অল্পবয়সী। মুখে এখনও সরলতার রেশ। গাইতে গাইতে তার সুন্দর চোখের দৃষ্টি কখনও পড়ছে তরুণ বাষ্পের ওপর, কখনও চারুবাকের প্রসাধিত মুখমণ্ডলে, কখনও দর্ভসেনের শঙ্খশ্বেত কপালের ওপর। কাউকেই সে তার দৃষ্টিপ্রসাদ থেকে বঞ্চিত করছিল না। গান শুনতে শুনতে বুঝতে পারছিলেন চণক এই বারবিলাসিনী অনেক শিখেছে। কিন্তু হয়তো অতর্কিত প্রণয়ের আক্রমণ এখনও লুকোতে শেখেনি। গাইতে গাইতে তার দৃষ্টি যখনই চণকের ওপর পড়ছিল, তখনই চেষ্টা করছিল চোখে চোখ মেলাতে। চোখে যেন এক নিভৃত আমন্ত্রণ-লিপি। এ কি বারবধূর লাস্য? না প্রণয়িনীর সঙ্কেত! অভিজ্ঞতা না থাকায় তিনি বুঝতে পারছিলেন না। গানের শেষে সুসজ্জিত দাসীরা সুরাভৃঙ্গারে করে মৈরেয় পরিবেশন করে গেল। এই দ্বিতীয়বার। একটু পরেই নৃত্য আরম্ভ হবে। দর্ভসেন উঠে দাঁড়ালেন। সবাইকে নমস্কার করে বললেন, ‘আপনারা নৃত্যচ্ছন্দ উপভোগ করুন। আমরা তিনজন এবার যাই। বহু কাজ।’ শ্ৰীমতীর দিকে ফিরে বললেন, ‘অপরাধ নিও না যেন ভদ্রে।’
চণক অনুভব করলেন শ্রীমতীর আকুল দৃষ্টি যেন তাঁরই পেছনে। অস্ফুট কণ্ঠে সে বলল, ‘সন্ধ্যায় আসছেন তো?’ কার দিকে চেয়ে সে প্রশ্ন করছে বোঝা গেল না।
দর্ভসেন বললেন, ‘আসব বইকি, সময় পেলে নিশ্চয়ই আসব সুন্দরি!’ বাইরে এসে তিনি জোর গলায় বললেন, ‘আমাদের গৃহে নিয়ে চলুন মহাশয়, কিছু বিশ্রামের প্রয়োজন।’
—যথা আজ্ঞা! রথ ছুটল।
রাজপুরীর প্রাচীরবেষ্টিত অঞ্চলের মধ্যেই রাজ- অতিথিশালা। তিন জনে নেমে দ্বিতলে নিজেদের জন্য নির্দিষ্ট কক্ষায় ঢুকতেই দাস-দাসীরা ছুটে এলো। কারও হাতে পানীয়, কারও হাতের থালিতে ফল ও মিষ্টান্ন, ব্যজনী হাতে ছুটে এলো অনেকে।
দর্ভসেন রুক্ষস্বরে বললেন, ‘মধ্যাহ্নভোজনের আগে শীতল পানীয় ছাড়া আর কিছুই স্পর্শ করব না। ফুলমালাগুলো শুকিয়ে উঠেছে নতুন মাল্য দাও। বড় গরম। চন্দনাবলেপও নতুন করে দাও।’
তিন জনে আসনে বসলে দাসীরা হাত-পা সমস্ত স্নিগ্ধ, সুবাসিত জলে ধুইয়ে, তারপর মুছিয়ে দিল। বুকে, কপালে চন্দনের প্রলেপ দিয়ে দিল, মল্লিকার মালা জড়িয়ে দিল মাথায়, কণ্ঠে, হাতে। তারপর দধির সুগন্ধী শীতল পানীয় নিয়ে এলো। পাত্রে চুমুক দিয়ে দর্ভসেন ইঙ্গিত করলেন দাসীগুলি সব চলে গেল। ঘরের সামনেই প্রশস্ত অলিন্দ। হঠাৎ ঝরঝর শব্দে বৃষ্টি আরম্ভ হল। চণক বললেন, ‘ওইখানে উচ্চাসন পাতা আছে, চলুন গিয়ে বসা যাক। বৃষ্টি দেখা যাবে।’
পানীয় হাতে উঠতে উঠতে দর্ভসেন বললেন, ‘বৃষ্টি বৃষ্টি করে কি তুমি পাগল হয়ে যাবে চণক? রহস্যময় তোমার এই হঠাৎ কবিত্ব। খুব বিরক্তিকরও। কী বলো সম্পাতি?’
সম্পাতি শুধু মৃদু হাসল। চণক বললেন, ‘কাব্য শুনলেন না? আপনাকে ক্ষয় করে সে দিয়েই যাচ্ছে, দিয়েই যাচ্ছে, দিয়েই যাচ্ছে!’
দর্ভসেন বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘ওই গর্ভস্রাবটার কথা ছাড়ো। বোধিকুমার না গর্দভকুমার! বর্ষার ওপর কাব্য! ঋষি অত্রির পর্জন্য সূক্তটা মনে কর দেখি!
‘কনিক্ৰদদ্ বৃষভো জীরদানূ
রেতো দধাতি-ওষধীষু গর্ভম্॥
—পঞ্চম মণ্ডল, ত্রিষ্টুপ ছন্দ। মনে পড়ছে?’
চণক বললেন, ‘গর্জাচ্ছে পজ্জুন্ন বৃষ ক্ষিপ্র অতি
রেতধারা ওষধিকে করে গব্ভবতী॥’
‘ধিক্ চণক ধিক,’ দর্ভসেন বলে উঠলেন, ‘এখুনি এখুনি কি তুমি মগধ-জ্বরে আক্রান্ত হলে? ঋষি অত্রির সূক্তে কী পৌরুষ! কী দার্ঢ্য! গর্জমান বজ্রগর্ভ বর্ষার অনুভব সঙ্গে সঙ্গে হয় না কি?
চণক বললেন, ‘নিশ্চয়ই। কিন্তু একটি সূক্ত চমৎকার বলে আর একটি সূক্ত চমৎকার হবে না, হতে পারে না, আপনার এ যুক্তি আমি মানতে পারি না মহামাত্র। রুদতী বর্ষার দুঃখী অথচ দাত্রী মূর্তিটিও আমার বড় ভালো লেগেছে। কৃষ্ণা, বিদ্যুতের আভরণে ভূষিতা, বসন্তগর্ভা, কিন্তু দিতে দিতে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে, ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে, আর চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে শ্যামল বক্ষযুগ। দিয়েই যাচ্ছে দিয়েই যাচ্ছে। কবিকে দিচ্ছে, নটকে দিচ্ছে, ধনীপুত্রকে দিচ্ছে, অমাত্যদের দিচ্ছে…’
বিস্ফারিত চোখে তাঁর দিকে চেয়ে দর্ভসেন বললেন, ‘তুমি কি শ্রীমতী নামে ওই গণিকার কথা বলছ?’
‘হয়তো!’ চণক উদাস স্বরে বললেন, ‘ভানুমতী, করেণুমতী, সানুমতী এদের কথাও বলছি হয়তো।’
—বাঃ এই বয়সেই তুমি অনেকগুলি বারবধূকে চিনে ফেলেছ তো? সানুমতী তো দেব পুষ্করসারীর মণ্ডনকারিণীদের প্রধান। অন্যগুলি কে?
সম্পাতির স্বভাব খুব মৃদু। সে সহসা মুখ খোলে না। এখন আর থাকতে না পেরে বলে ফেলল, ‘চণক কোনও বিশেষ বারবধূর কথা তো বলছে না আর্য! ও বোধ হয় সাধারণভাবে সব বারবধূর জীবনের কথা ভেবে বলছে।’
‘বারবধূর জীবন?’ অবাক হয়ে দর্ভসেন বললেন, এ নিয়ে এত ভাববার কী আছে? রাজভাণ্ডার থেকে বৃত্তি পাবে, কর দেবে, বিদগ্ধ পুরুষের মনোরঞ্জন করবে, বৃদ্ধ হলে অভিজাত গৃহের নারীদের শিল্পশিক্ষা দেবে! তেমন তেমন নৃত্যগীতনিপুণা এবং সুন্দরী হলে তো জম্বুদ্বীপভরা খ্যাতি। বৈশালীর আম্রপালীর কথাই ধরো না! কিংবা রাজগৃহের শালবতী! এদের এক রাত্রির মূল্য কত জানো?’
কেউ কোনও উত্তর দিল না। বৃষ্টির গতিবেগ বাড়ছে। দর্ভসেন সেদিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তবে এখানে বসার একটা সুবিধে আছে। বৃষ্টিপাতের শব্দে আমাদের কথাবার্তা ডুবে যাবে, অলিন্দ পার হয়ে, ওই বৃহৎ কক্ষ পার হয়ে আর ওধারে পৌঁছবে না। ভালো কথা চণক, তুমি তখন রথে উঠতে উঠতে নিম্নস্বরে যেন বললে কর্যোদ্ধার হবে না। কেন?’
চণক উদ্যানের একটি বিশালকায় জম্বুবৃক্ষের দিকে তাকিয়ে উদাস স্বরে বললেন, ‘হবে না তো বলিনি! সংশয় প্রকাশ করেছি। আপনি দেখেননি নর্তকী জিতসোমাকে অর্পণ করবার পর মহারাজ বিম্বিসারের কেমন ভাবান্তর হল?’
দর্ভসেন বললেন, ‘অবশ্যই দেখেছি। মনের আনন্দ গোপন করবার একটা উপায় হল ভ্রূকুটি, ওষ্ঠাধর কুঞ্চন। আমাদের মনোবৃত্তি সম্পর্কে নানা পাঠ নিতে হয় চণক, পর্যবেক্ষণও করতে হয়। মগধের রাজা অতিশয় পুলকিত হয়েছেন। গান্ধার রমণীরা তো গাত্রবর্ণেই প্রথমে সবার চোখ ঝলসে দেয়। তারপর গঠন, দেহসৌষ্ঠব! এখানকার ওই নটীটি? শ্রীমতী? ও তো কালো!’
সম্পাতি মৃদু স্বরে বলল, ‘মেয়েটি লাবণ্যময়ী।’
দর্ভসেন বললেন, ‘তোমাদের এখন প্রথম যৌবনের চোখ। তোমাদের ব্যাপার আলাদা। শোনো চণক, আমি শুনেছি এই বিম্বিসার অতি অল্প বয়স থেকেই খুব ইন্দ্রিয়পরায়ণ। অন্তঃপুরে মহিষীই নাকি পাঁচ’শ, দাসী নটীদের সংখ্যা করা যায় না এত। এক বণিক বধূকে বাতায়নে দেখে ইনি নাকি এমনই কামগ্রস্ত হয়েছিলেন যে, সেই বণিককে নানা ছলে বিদেশে পাঠিয়ে তার ভার্যাকে ভোগ করেন। তার পুত্রের নাম অভয়কুমার। তো সেই অভয় তো স্বতন্ত্র প্রাসাদে বাস করে। যথেষ্ট সম্মান। সেই নাকি আবার জীবক বৈদ্যর পালক্, শত্রু জানেন পিতাও কি না। জিতসোমার মতো নগরশোভিনীকে উপঢৌকন দিয়েই আমার অর্ধেক কাজ হয়ে গেছে।’
চণক বললেন, ‘ক্ষমা করবেন আর্য, আপনার ধারণা ভ্রান্ত, বলতে বাধ্য হচ্ছি। আমি এক মাস আগে থেকে রাজগৃহে শুধু শুধু ঘুরছি না। শুধু শুধু সম্পাতি, অনঘ আর সুভদ্রকে বৈশালীতে, শ্রাবস্তীতে পাঠাইনি। একটু ধৈর্য ধরে আমার বিশ্লেষণ শুনুন।’
—বলো শুনছি। উদার একটা ভঙ্গি করলেন দর্ভসেন।
চণক বললেন, ‘ভ্রূকুটি এবং ওষ্ঠাধর কুঞ্চন মনের আনন্দ গোপন করবার জন্য ব্যবহার হয় ঠিকই। কিন্তু বিরক্তি প্রকাশ করবারও এটাই আদি উপায়। মহারাজ বিম্বিসার জিতসোমাকে দেখা মাত্র ভ্রূকুটি করেন, পরক্ষণেই বিরক্তি গোপন করবার প্রয়াসে মুখের স্বাভাবিক গাম্ভীর্য ও প্রসন্নতা ফিরিয়ে আনেন। আমার বিশ্বাস উনি জিতসোমাকে দেখে অত্যন্ত অপ্রতিভ হয়েছেন।’
দর্ভসেন হাত তুলে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, চণক তাঁকে বাধা দিয়ে বললেন, ‘আমার কথা শেষ করতে দিন। মগধরাজের চরিত্র সম্পর্কে যে কাহিনীগুলো শুনছেন সেগুলো রটনা। তাঁর অগ্রমহিষী তিনটিই। কোশলকুমারী, সাগলকন্যা দেবী ক্ষেমা এবং বৈশালীর এক গণরাজ চেতকের কন্যা ছেল্লনা দেবী। আরও কিছু মহিষী থাকতে পারেন, খ্যাতিমান রাজাকে বহুজনেই কন্যাদান করতে উৎসাহী। যে অসম্ভব সংখ্যাগুলো শুনেছেন সেগুলো প্রাসাদের দাসীদের সংখ্যা হতেই পারে। আমাদের গান্ধারেও কি অন্তঃপুরিকাদের সংখ্যা অজস্র নয়? কুমার অভয় মহারাজ বিম্বিসারের একেবারে প্রথম বয়সের পুত্র হতে পারেন, কিন্তু জীবক বৈদ্য সম্পর্কে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে আর্য। মহারাজের বয়স আর কুমার অভয়ের বয়স বিচার করলে কি মনে হয় না, কোথাও একটা বোঝার ভুল আছে? জীবক কৌমারভৃত্য কী করে মহারাজের পৌত্র হতে পারেন আমার মাথায় আসে না। তক্ষশিলার স্নাতক, অতি অল্প সময়ের মধ্যে শিক্ষা সমাপ্ত করে যশস্বী হয়েছেন কিন্তু বাইশ তেইশ তো তার বয়স হবেই! মহারাজকে দেখলে মনে হয় তিনি এখনও ঠিক মধ্যবয়স্ক নন। কুমার অভয় তো একেবারেই যুবাপুরুষ। পালন করেছেন হয়তো অতি অল্প বয়স থেকে। হয়তো তিনি পথে পড়ে থাকতে দেখেছিলেন বলে, তাঁরই গৃহে জীবক পালিত হয়েছেন। ক্ষমতাবান মানুষ মাত্রেই নানা রটনার লক্ষ্য হন। তা ছাড়া…।’
সম্পাতি বলল, ‘চণক বয়ঃক্রমের যে হিসেব দিল তাতে সত্যিই…’
দর্ভসেন অধৈর্য হরে বললেন, ‘আর কি বলছে চণক, বলতে দাও।’
—বলছিলাম, বেশ কয়েক বছর হল মগধরাজ তথাগত বুদ্ধর শরণ নিয়েছেন। এখন তিনি নতুন করে ইন্দ্রিয়ভোগে লিপ্ত হতে চাইবেন না।
দর্ভসেন রুষ্ট হয়ে বললেন, ‘তথাগত, তথাগত, তথাগত! ওই গর্ভস্রাবটার কথা এভাবে বলছ কেন? বড় জোর বল শ্ৰমণ গৌতম। হুঁঃ! বুদ্ধ বললেই বুদ্ধ হওয়া যায়। না? ইন্দ্রজাল শিখে এসেছে অঙ্গদেশ থেকে। ইন্দ্রজাল শিখে আমাদের সভার দুজন সুযোগ্য আধিকারিককে হরণ করে নিল। তোমার জন্য। এই তোমার জন্য চণক। কে বলেছিল ওদের শ্রাবস্তীতে পাঠাতে?’
চণক বললেন, ‘আপনি বৃথাই রাগ করছেন। ওদের কাছ থেকে যেটুকু তথ্য পাবার সে তো আমরা পেয়েই গেছি। কোশলরাজ প্রসেনজিৎ যে অবন্তীর বিরোধিতা করবেন না, এই তথ্যটুকু আমাদের প্রয়োজন ছিল। এখন, অনঘ আর সুভদ্রর ব্যক্তিগত জীবনের ওপর আমাদের কী অধিকার? তা ছাড়া এই তথাগত বুদ্ধ সম্পর্কে আমি বিন্দুবিসর্গও জানতাম না। এখানে এসে ভাসা ভাসা শুনছি কে এক শাক্যবংশীয় শ্রমণকে নাকি মগধরাজ রাজগৃহে সম্পত্তি দিয়ে, সেনাধ্যক্ষর পদ দিতে চেয়েছিলেন। সেই শ্ৰমণ নাকি তা প্রত্যাখ্যান করে চলে গিয়েছিলেন, ছয় বছর পরে বুদ্ধ হয়ে ফিরে এসেছেন। এই পর্যন্ত। তিনি যে ওই সময়ে শ্রাবস্তীতে অবস্থান করছিলেন, এবং সেখানে দলে দলে লোক বুদ্ধশাসনে প্রবেশ করছিল, সুভদ্র এবং অনঘ যে সম্পূর্ণ আত্মবিস্মৃত হয়ে যাবে এত কথা কি আমি জানতাম? বলো সম্পাতি?’
সম্পাতি বলল, ‘সত্যি কথা মহামান্য দর্ভসেন, চণক আমাদের দলপতি হলেও আমরা চারজনেই পরামর্শ করে স্থির করি শ্রাবস্তী ও বৈশালী যাওয়া দরকার। অনঘ ও সুভদ্র নিজেরাই শ্রাবস্তী বেছে নেয়। আমি নির্বাচন করি বৈশালী। চণক তখন বলে সে রাজগৃহের ওপর দৃষ্টি রাখবে। চণক বহু সংবাদ সংগ্রহ করেছে। প্রশংসনীয় চরকর্ম সন্দেহ নেই। আমি বৈশালী থেকে শ্রাবস্তীতে গিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে অনঘদের সন্ধান করতে গিয়ে শুনি তারা দুদিন হল প্রব্রজিত হয়েছে। আমি তো শুনে অবাক! অনেক কষ্টে জেতবনের প্রান্তে সুভদ্রর সঙ্গে দেখা হয়। তার মুণ্ডিতকেশ আকৃতিতে পুরনো সুভদ্রর আর কিছুই অবশিষ্ট নেই আর্য। শুধু শ্মশ্রুগুম্ফকেশই নয়, আরও অনেক কিছুই যে সে বিসর্জন দিয়েছে তা তার জ্যোতির্বর্ণ মুখশোভা থেকে সহজেই বুঝতে পেরেছি। দ্বিতীয়বার তাকে ফিরে আসতে বলার সাহস আমার হয়নি। কিন্তু সে তার কর্তব্য করেছে। কোশলরাজ সম্পর্কে যেটুকু জানবার ছিল সে তা আমাদের জানিয়ে দিয়েছে। আমার পক্ষ থেকে বলতে পারি লিচ্ছবিরা যথেষ্ট শক্তিশালী হলেও, কোনও ঝঞ্ঝাটে নিজেদের জড়াতে চায় না। যদিচ প্রদ্যোত মহাসেনকে কেউ পছন্দ করে না। নিষ্ঠুরতা ও উগ্রতার জন্য সবাই বলে চণ্ডপ্রদ্যোত। কিন্তু সহসা তাঁর বিরুদ্ধে দলবদ্ধ হবে গান্ধাররাজের আবেদনে, এমন আশা নেই। এখন মগধরাজই ভরসা।’
দর্ভসেন চিন্তিত হয়ে বললেন, ‘চণক, তুমি কি বলছ জিতসোমাকে পাঠিয়ে আমরা একটি কূটনৈতিক ভুল করে ফেলেছি? এবং তারই জন্য মগধরাজের অপ্রীতিভাজন হলাম?’
—না, তা আমি বলছি না মহামাত্র। জিতসোমাকে পাঠানো আমাদের ভুল হয়েছে। সে কথা আমি আপনাকে আগেই বলেছি। কিন্তু, শুধু সেই জন্যই মগধরাজ আমাদের দৌত্য বিমুখ করবেন বলে আমার মনে হয় না। প্রাথমিক বিরক্তিটুকু জয় করতে না পারলে তিনি আর মহারাজা কিসের? আসলে জিতসোমাকে আমরা পুরোপুরি অপব্যয় করলাম। কোনও প্রয়োজন ছিল না এর। আর এঁরা অর্থাৎ কোশলরাজ, লিচ্ছবিরা, মগধরাজ, এমন কি দূরে হলেও কৌশাম্বী এঁরা একটি সংঘ। অবন্তী আরও দূরে হলেও প্রতিবেশী রাজ্য বলেই মনে করেন। সুদূর গান্ধারের জন্য প্রতিবেশীকে ঘাঁটাতে রাজি হবেন না মগধরাজ।’
—তাহলে শুধু শুধু আমাদের এতদিন অপেক্ষা করিয়ে রাখলেন কেন? কোনও অর্থ হয় এর? দর্ভসেন খুবই উত্তেজিত।
এই সময়ে মুষলধারে বৃষ্টি আরম্ভ হল। শ্যামবীথিকা সমেত সমস্ত উদ্যানটি ঘন বৃষ্টির আড়ালে সবুজ রঙের একটি চাদরের মতো দেখতে হল। চণক বললেন, ‘মগধরাজ ধুরন্ধর কূটনীতিক। তাঁর “না”টা তিনি আমাদের কীভাবে জানান, শুনতে আমি অত্যন্ত উৎসুক রয়েছি।’
দর্ভসেন দারুণ বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘তুমি তো ক্রমশই মগধ রাজ্য এবং রাজার ভক্ত হয়ে পড়েছ হে চণক!’
চণক হেসে বললেন, ‘গুণগ্রাহিতা বলে কোনও বস্তু কি রাজনীতি শাস্ত্রে নেই? না থাকলে আমি তার পত্তন করবার চেষ্টা করব।’
—গুণগ্রাহিতা না হয় খুব ভালো বস্তু। কিন্তু কী বিশেষ গুণ তুমি দেখলে মগধের রাজার?
এই সময়ে একটি দাস এসে জানাল রাজপুরী থেকে দূত এসেছে। মহারাজ তাঁর আচার্যপুত্রের সঙ্গে আলাপ করতে উৎসুক। যদি কাত্যায়ন চণক অনুগ্রহ করে দ্বিপ্রাহরিক ভোজনের সময়ে রাজাকে সঙ্গ দেন, তিনি সুখী হবেন।
চণক উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘অবশ্যই। আমি এক্ষুনি প্রস্তুত হয়ে নিচ্ছি।’
দাস জানাল, ‘রথ প্রস্তুত আছে।’
দর্ভসেন অবাক হয়ে বললেন, ‘তুমি বিম্বিসারের আচার্যপুত্র? কাত্যায়ন দেবরাত এই বিম্বিসারের আচার্য ছিলেন? এ কথা তো জানতাম না!’
চণক বললেন, ‘হ্যাঁ। দীর্ঘকাল আগে পিতা একবার মগধদেশে এসেছিলেন। তাঁর সেই সময়ের কিছু স্মৃতি তিনি আমায় বহুবার গল্পচ্ছলে বলেছেন। মগধ আমায় বহুদিন ধরে আকর্ষণ করছে। আচ্ছা বিদায় মহামাত্র, বিদায় সম্পাতি। রাজদর্শন করে আসি। গান্ধার রাজ্যের সমস্যার কথা যতদূর পারি বুঝিয়ে বলবার চেষ্টা করব আবার।’
চণক বেশ পরিবর্তন করে চলে গেলে দর্ভসেন গম্ভীর মুখে পদচারণা করতে করতে বললেন, ‘সম্পাতি! তিনজন দূতের মধ্যে একজনকে যিনি বিশেষভাবে নিমন্ত্রণ করেন তাঁকে কি কোনক্রমেই যথার্থ কূটনীতিক বলা চলে? তোমার গুণগ্রাহিতা কী বলে?’
সম্পাতি ইতস্তত করে বলল, ‘মহামাত্র, আপনার ব্যথিত হবার কিছু নেই। মগধরাজ আচার্যপুত্রের সঙ্গে আলাপ করবার অন্য কোনও সময় বার করতে পারছেন না বলেই বোধ হয় ভোজনের সময়ে…’
অসন্তুষ্ট মুখে থেমে গেলেন দর্ভসেন, বললেন, ‘কি জানি! আমি এ রাজার আচার-আচরণে কোনও আভিজাত্য খুঁজে পাচ্ছি না। নীতিজ্ঞানও খুঁজে পাচ্ছি না। পথ থেকে সন্ন্যাসীকে ডেকে এনে সেনাধ্যক্ষ করতে চায়, যেচে যেচে এক দুষ্ট রাজার অসুখে নিজের বৈদ্য পাঠিয়ে দেয়। গান্ধারের মতো মাননীয় রাজ্যের মহামান্য রাজাকে নিজেদের অসংস্কৃত ভাষার পুক্কুসাতী বলে উল্লেখ করে! আর হবে নাই বা কেন? ছিল তো এক গোষ্ঠীনেতার পুত্র। রাজবংশও নয়, কিছুই নয়। নাগেদের সঙ্গে কী একটা সম্পর্ক আছে সেটা ঢাকতে চায় হর্যংক বংশ হর্যংক বংশ করে। তা সে যতই গলা ফাটাক না কেন আসলে তো জাতে উঠেছে কোশল সাগল আর লিচ্ছবি কন্যা ঘরে এনে। ও কি যথার্থ ক্ষত্রিয় নাকি?’
সম্পাতি ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘চুপ চুপ মহামাত্র, আপনি যে দেখি স্থান কাল বিস্মৃত হলেন! আমরা রাজ-অতিথিশালার অলিন্দে বসে। কে জানে কোথা থেকে কে শুনে ফেলবে!’
বৃষ্টিধারার দিকে চেয়ে দর্ভসেন বললেন, ‘শুনতে পাচ্ছ? কী কলরোল! এই নিরবচ্ছিন্ন শব্দে বোধ হয় দামামার শব্দও শোনা যাবে না। সম্পাতি, আমি একটু বিশ্রাম করতে যাই। তোমার ইচ্ছা হয় এই বিচিত্র দেশের বিচিত্র বৃষ্টি উপভোগ কর, আমার কিছুই ভালো লাগছে না।
৭
রত্নহারটি হাতে করে ধনঞ্জয় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘শ্রাবস্তী থেকে আসছেন? কোন শ্রেষ্ঠী? সুদত্ত?’ সুদত্তর নাম তিনি রাজগৃহে শুনেছেন। সেখানে রাজগৃহ শ্ৰেষ্ঠীর সঙ্গে কুটুম্বিতা আছে তাঁর। কিন্তু শ্ৰেষ্ঠী সুদত্তর পুত্ররা যতদূর শুনেছেন বিবাহিত। আর ভ্রাতুস্পূত্ৰ ক্ষেম খুব রূপবান, কিন্তু দুশ্চরিত্র। রূপগর্বে ধরাকে সরাজ্ঞান করে।
জ্যেষ্ঠ ব্রাহ্মণ বললেন, ‘না, না, সুদত্ত নয়। মিগার শ্রেষ্ঠী।’
—মিগার? মৃগধর? নাম শুনিনি তো দেব! কত আয় তাঁর, বার্ষিক?
—চারশত কোটির মতো হবে।
‘ওহ,’ ধনঞ্জয় বললেন, ‘আমার সঙ্গে তুলনায় তো সে এক কাহনও নয়! তা তাঁর পুত্রটি?’
—আজ্ঞে পুন্নবদ্ধন। সদ্য যুবা। সুন্দর, সুকুমার। মিগার শ্রেষ্ঠীর একমাত্র উত্তরাধিকারী। স্বভাব দোষশূন্য। সঙ্গীত-নৃত্য-নাটক ইত্যাদির গুণগ্রাহী, সূক্ষ্মরুচির যুবক। পঞ্চকল্যাণী কন্যা না হলে বিবাহই করবে না। এমনই তার প্রতিজ্ঞা। বহুকষ্টে যে তাকে বিবাহে রাজি করা গেছে এ কথা ব্রাহ্মণরা উচ্চারণ করলেন না আর। তাঁরা অভিজ্ঞ লোক। বুঝে ফেলেছেন ধনঞ্জয়ের চিত্ত দোলাচল।
—শিক্ষাদি কেমন যুবাটির?
—আজ্ঞে। পিতামাতার একটি মাত্র সন্তান। বারাণসীতে আচার্য রন্তিদেবের কাছে দশ বছর নানা বিষয়ে শিক্ষা করেছে।
ভ্রূ কুঞ্চিত করে ধনঞ্জয় বললেন, ‘অনেক দূর থেকে আসছেন। ক্লান্ত আছেন, কদিন আমার গৃহে বিশ্রাম করুন। আমার পত্নী গেছেন রাজগৃহে। তিনি না ফিরলে তো কোনও সিদ্ধান্ত হবে না।’
তা ভালোই। দেশে দেশে ঘুরে, পায়ে ব্যথা হয়ে গেছে। কাশী, অযোধ্যা, ভোগনগর, দাহিগ্রাম বহু স্থান ঘুরে এসেছেন তারা। এখন দিন কয়েক সাকেতের শ্রেষ্ঠীর গৃহে কোমল শয্যা, দাস-দাসীর সেবা। মধ্যাহ্নভোজনে নরম তুলতুলে গোবৎসের মাংসের সঙ্গে দধিতণ্ডুল, মৎস্যের বিচিত্র পদ, নানা ব্যঞ্জন, মিষ্টান্ন থাকবে নিশ্চয়ই। মাধ্বী ও মৈরেয়ও যত চাও তত। মিগারের চেয়েও শতগুণ ধনী! ব্রাহ্মণরা ব্যাপারটা ঠিক কল্পনা করতে পারলেন না। নিভৃতে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করলেন—লোকটি দাম্ভিক কিনা। মতভেদ হল। ‘দম্ভ হলেই বা আমাদের কী? মিগার বুঝবে? মিগার তো ধমক দিয়ে ছাড়া কথা কয় না!’ একজন বললেন। আর একজন বললেন, ‘এ বিবাহ হবে না, দেখো।’ শ্রেষ্ঠীপত্নী ফিরে এলেই আমরা ভদ্রভাবে বিতাড়িত হবো। শ্ৰেষ্ঠীরই এত দ্বিধা, এত দম্ভ। তার পত্নী তো আরও অহংকারী হবে।’
জ্যেষ্ঠ বললেন, ‘মেয়েটির যে প্রকার রূপ, হাব-ভাব, তাতে কিন্তু ওকে রানি হলেই মানায়। কেমন একটা সহজাত মর্যাদাবোধ। ঠিক দম্ভ একে যেন বলা যায় না। নদীতীরে আমাদের কেমন কথার জালে বদ্ধ করল! রূপেও রানি, কথাবার্তাতেও রানি।’
—তা ঠিক, কনিষ্ঠ বললেন।
মধ্যম বললেন, ‘বৈশালীতে বা অন্য কোনও গণরাজার দেশ হলে এ মেয়েকে জনপদবধূ নির্বাচন করা হত। আর সেটাই হত এর যোগ্য সমাদর।’
‘কথাটা তুমি কি ঠিক বললে?’ জ্যেষ্ঠ বললেন, ‘এর রূপ শ্রদ্ধাসম্ভ্রম উদ্রেক করে, আর অম্বপালী হল গিয়ে মোহিনী, নৃত্যগীতে তার জুড়ি নেই সারা মধ্যদেশে। সে মেয়েটি তো পালক পিতার কাছে মানুষ। পিতা তাকে নগরশোভিনী হবার জন্যই প্রস্তুত করেছিল। তা মেয়ে পিতার মান রেখেছে। এ কথা বলতেই হবে। বৈশালীর তো গর্ব বটেই, অম্বপালী সারা মধ্যদেশেরই গর্ব।’
মধ্যম বললেন, ‘আপনি জানেন না আর্য। ব্যাপারটা মোটেই তা নয়। পালক পিতা হলেও আম্রপালীর পিতা মহানামভদ্র মেয়েটিকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। বয়ঃপ্রাপ্ত হলে তার রূপের খ্যাতি চারিদিকে এমন ছড়িয়ে পড়ল যে, রাজারাজড়া, রাজকুমার থেকে আরম্ভ করে মহাধনবান শ্রেষ্ঠী, ইত্যাদি কেউ আর তার পাণিপ্রার্থী হতে বাকি রইল না। তখন মহানামভদ্র সংস্থাগারে নিজের সমস্যার কথা নিবেদন করলেন। বাস্। যেমনি দেখা অমনি গণরাজারা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলে এ মেয়ে জনপদশোভিনী হবার যোগ্য। ওদের দেশে তো সংস্থাগারে যা ঠিক হবে তার বিরুদ্ধে যাবার ক্ষমতা কারও নেই।’
—এত কথা তুমি জানলে কি করে? জ্যেষ্ঠর মুখে সকৌতুক হাসি।
—পাণিপ্রার্থীদের মধ্যে তোমার শিষ্য-টিষ্য কেউ ছিল না কি?
কনিষ্ঠ বলল, ‘আমরা সবাই-ই কিন্তু মোটামুটি এই রূপই জানি আর্য। মহানামভদ্র নাকি বুক চাপড়ে হাহাকার করেছিলেন, বলেছিলেন ‘এই আপনাদের বিচার হল? ধিক ধিক আপনাদের।’ অম্বপালী নাকি প্রথমে পাথরের মূর্তির মতো হয়ে যায়। তারপর পিতার শোক দেখে তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে তার কয়েকটি শর্ত আছে সেগুলি যদি লিচ্ছবিকুল মানেন তাহলে সেও তাঁদের সিদ্ধান্ত মেনে নেবে। নইলে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করবে।’
জ্যেষ্ঠ বললেন, ‘আশ্চর্য! এত কথা আমি জানি না তো! আসলে কোশল রাজ্যের বাইরে কমই গিয়েছি। তা ছাড়া যজন-যাজন আর ভাটের কর্ম করি, অত সংবাদ আমার কাছে আসবেই বা কী করে? বয়সও গিয়েছে।’
কনিষ্ঠ হেসে বললেন, ‘আপনার আমার বয়সের সঙ্গে আর এসব সংবাদের সম্পর্ক কি, আর্য? শুনেছি অম্বপালীর এক রাত্রির মূল্য নিয়ে বৈশালী ও রাজগৃহে রীতিমত বিবাদ হয়ে গেছে।’
জ্যেষ্ঠ বললেন, ‘তা সে যাই হোক। এমন নারী-রত্ন একজন পুরুষ ভোগ করবে, নৃত্যগীতকাব্যাদি কলার চর্চা না করে অন্তঃপুরে সপত্নীদের সঙ্গে কলহ করে আর যাউ রান্না করে কাল কাটাবে এটা আমার ঠিক মনে হয় না। রুচিমান বিদগ্ধ পুরুষগুলি যাবে কোথায়, নাট্য ও নৃত্য-গীতের উন্নতিই বা হবে কি করে!’
মধ্যম বললেন, ‘তা ছাড়াও একটা কথা আছে। অতি সুন্দরী, গুণবতী রমণীরা গর্বিত হয়ে থাকে। তারা সবসময়েই স্বেচ্ছাচারিতা করতে চায়। কাউকে তেমন শ্রদ্ধাভক্তি করে না। এরূপ রমণী কুলে না আনাই ভাল। অশান্তির সৃষ্টি হয় এতে। এই দেখুন না, আমার প্রথমা পত্নী জ্যোতির্লেখা, অতি রূপসী, তার ওপর কুলপতি পিতার কন্যা। দশ সহস্র না হলেও বহু ছাত্রের অধ্যাপনা ভরণপোষণ করেন। দক্ষিণা পাঁচশত কার্ষাপণ, কিন্তু পূণ্য শিষ্যও আছে অনেক।’
‘এমন কুলপতির কন্যা তোমার পত্নী হল কি করে?’ জ্যেষ্ঠ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘খ্যাতিমান আচার্যরা সাধারণত শ্রেষ্ঠ ছাত্রটির সঙ্গেই কন্যার বিবাহ দেন। তুমি তো তেমন নও বাপু।’ কনিষ্ঠ মৃদু মৃদু হাসতে লাগলেন।
মধ্যম অপ্রতিভ হয়ে বললেন, ‘তা নই। কিছু করতে পারিনি ঠিকই। কিন্তু এখনও আমার রূপ দেখছেন তো আর্য! যখন আমার শ্বশুর মহাশয়ের ওখানে ব্রহ্মচর্য পালন করছিলাম, তখন ক্ষত্রিয়দের মতো অশ্বচালনা, কিছু কিছু অস্ত্রচালনাতেও নিপুণ হয়েছিলাম। জ্যোতির্লেখা আমার প্রতি আকৃষ্ট হয়।’
—আর তুমি? তুমি বুঝি অশ্বচালনা, অসিচালনা কোনও রণে যাবার জন্য অভ্যাস করতে? জ্যেষ্ঠের কথায় কনিষ্ঠ সশব্দে হেসে উঠলেন।
মধ্যম ব্রাহ্মণের গৌরবর্ণ মুখ আরক্ত হয়ে উঠেছিল, তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমিও আকৃষ্টই হয়েছিলাম। অমন রূপবতী কন্যা, বল্কলে যার যৌবন বাঁধতে পারে না, অমন গাঢ় কৃষ্ণতার চক্ষু দুটি, হ্যাঁ হ্যাঁ আমরা গান্ধর্ব বিবাহ করেছিলাম। শ্বশুর মহাশয় ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। প্রাণ খুলে আশীর্বাদও করেননি। কিন্তু অস্বীকার আর করবেন কি করে?’
—তারপরে?
—প্রথম প্রথম জ্যোতির্লেখা আমার গৃহে এসে ভালোই ছিল। সুন্দর মানিয়ে নিয়েছিল। বলত দেবতারা যেমন রাখবেন তেমনই থাকব। পিতা-মাতাও কোনও অভিযোগ করতেন না। কিন্তু তারপর একদিন দুঃখ করে বলল, পিতার গৃহে এত শিখলাম, কিছুই কি চর্চা করতে পারব না? আগে সর্বদা পিতৃশিষ্যদের সমবেত মন্ত্রপাঠ শুনতাম, গৃহশুকটি যখন-তখন ব্যাকরণের সূত্রগুলি মুখস্থ বলে বলে কান ঝালাপালা করে দিত। তুমি তো খালি যজন-যাজনই কর, আমাকে অনুমতি দাও না আমি শ্ৰেষ্ঠীগৃহের মেয়েগুলির আচাৰ্যা হবো! ওরা বলছিল!
‘সে তো ভাল কথা। জ্যেষ্ঠ বললেন, ‘যদিও প্রব্রাজিকাদের কাছেই নারীদের শিক্ষা পাওয়ার বিধান।’
—ভালো তো আমিও ভেবেছিলাম। সে নিয়মিত শ্ৰেষ্ঠীগৃহে যাতায়াত শুরু করল। তারপরই তার রূপগর্ব, বিদ্যাগৰ্ব বেড়ে গেল। মাতা অভিযোগ করতে লাগলেন, সে সময়মতো তাঁদের আর আহার দেয় না। তিরস্কার করলে বলে, আপনি তো অথর্ব হয়ে যাননি অজ্জা। নিলেনই না হয় একদিন নিজেদের অন্ন নিজেরা বেড়ে। শ্ৰেষ্ঠী কন্যাগুলিকে ছন্দ বোঝাতে দেরি হয়ে গেলে কী করব! তখন আমি দ্বিতীয়া পত্নী ঘরে আনলাম।’
কনিষ্ঠ বললেন, ‘আপনার একটি ছেলেও তো আছে!’
—একটি নয়, দুটি। সেই তো হল সমস্যা! জ্যোতির্লেখা ক্রুদ্ধ হয়ে বলল, “আমি তোমাকে দুটি পুত্র দিয়েছি। শ্ৰেষ্ঠীগৃহ থেকে ধন এনে গৃহের শ্রীবৃদ্ধি করেছি। তা সত্ত্বেও তুমি আমায় সপত্নীদুঃখ দিলে?” দিলাম যে তার দম্ভ ভাঙতে সে কথা আর ভেঙে বলিনি।
মধ্যম ব্রাহ্মণ ঊরুতে চপেটাঘাত করে হাসতে লাগলেন।
জ্যেষ্ঠ বললেন, ‘তো তাঁর দম্ভ গেছে?’
—গেছে বইকি! তবে কি জানেন এই সব স্ত্রীলোক ভেঙেও ভাঙে না, আগেরই মত শ্রেষ্ঠীগৃহে যায়, ধন যা পায় আমার পিতার হাতে তুলে দেয়, রন্ধন, গৃহশাসনের দায়িত্বগুলিও নির্বিবাদে পালন করে কিন্তু আমার শয়নগৃহে আর আসে না। কখনও না। পুত্র দুটিকে পিতৃগৃহে শিক্ষার জন্য পাঠিয়ে দিয়েছে।
—তা আপনার লাভ হল? না ক্ষতি হল?
—লাভই হল একরকম। জ্যোতির্লেখার তখন ছাব্বিশ সাতাশ বছর বয়স হবে, দুই সন্তানের মা, এদিকে আমার দ্বিতীয়া তো সবে সতের পার হয়েছে, দরিদ্র ঘরের মেয়ে। যা বলি তাই শোনে।
জ্যেষ্ঠ বললেন, ‘ভাল, ভাল।’
জ্যেষ্ঠ বাইরে গেলে কনিষ্ঠ বললেন, ‘আচ্ছা আর্য একটা কথা জিজ্ঞাসা করব? প্রথমার জন্য আপনার উৎকণ্ঠা হয় না!’
মধ্যম বললেন, ‘উৎকণ্ঠা? উৎকণ্ঠা ছেড়ে একেক সময় তার জন্য কামনা এত প্রবল হয় যে শ্ৰেষ্ঠীগৃহ থেকে ফেরবার পথে একটি উপবন আছে সেখানে আমি তার জন্য লুকিয়ে থাকি। দুই সন্তানের জননী হলে কি হবে, জ্যোতির্লেখা যৌবনকে বলতে গেলে একইভাবে ধরে রেখেছে। আমার তো সন্দেহ হত তার কোনও জার জুটেছে, না হলে আমাকে এত উপেক্ষা সে করে কী করে? এতগুলি ঋতুই বা ব্যর্থ করে কোন সাহসে? তা দেখলাম, শ্রেষ্ঠীগৃহ থেকে দু-তিনটি বালক তার সঙ্গে সঙ্গে আসে। একদিন একলা পেয়ে পেছন থেকে আলিঙ্গন করতে গিয়েছিলাম, লজ্জার কথা বলবো কি ভাই। “দুবৃত্ত” বলে সে আমাকে মাটিতে ফেলে পদাঘাত করলে।’
—না জেনে করেছেন। ভালোই তো। আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে গেলেন তিনি অন্য পুরুষকে প্রশ্রয় দেন না।
মাথা নাড়তে নাড়তে মধ্যম বললেন, ‘না রে ভাই, আমার বদ্ধমূল ধারণা সে বুঝতে পেরেই করেছিল। পরে যখন দেখল আমি, অবাক হবার ভান করে বলল, “এ কি, তুমি?” বলে আমায় প্রণাম করল। তারপর একটি কথাও না বলে চলে গেল।’
—কী করে ধারণা করছেন সে বুঝতে পেরেছিল?
মধ্যম ব্রাহ্মণ আরক্ত মুখে বললেন, ‘কেন সে আমি তোমাকে কী করে বোঝাব? আমাদের আলিঙ্গনের একটি বিশেষ ধরন ছিল, কুলপতির ওখানে ওইভাবেই তার কাছে প্রণয় নিবেদন করেছি। সে সব গুহ্য কথা কোনও সমবয়সী বয়স্যকেই বলতে লজ্জা হয়, তো তুমি!’
মধ্যম ব্রাহ্মণ হঠাৎই কথা থামিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লেন।
কনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ চিন্তিত মুখে বাইরের উদ্যানে চলে গেলেন। রাত বেশি হয়নি। আকাশটি সুন্দর। এ উদ্যানটি তাঁদের অতিথিশালার সংলগ্ন। সুন্দর, সুসজ্জিত, একটি ছোট্ট কহ্লার-সরোবর আছে, তার আশেপাশে বড় বড় পাথরের টুকরো। গুল্ম জাতীয় গাছ। দেখতে হয়েছে যেন পর্বতের মধ্যে সরোবর কিংবা চাঁদকে ঘিরে নক্ষত্রমণ্ডলী। বড় গাছগুলির তলায় শিলাসন। কনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ বড় চিন্তিত। মধ্যম ব্রাহ্মণের মতো একটি সমস্যা তাঁরও হয়েছে। অবশ্য একেবারে একই প্রকার নয়। একটু স্বাতন্ত্র্য আছে। শিলাসনে বসে তিনি তাঁর নিজের সমস্যাটির কথা চিন্তা করতে লাগলেন। তাঁর প্রথমা পত্নীটিকে কাশীতে গঙ্গাস্নানের সময়ে কুমিরে নিয়ে যায়, দ্বিতীয়টির প্রতি স্বভাবতই তাঁর গভীর স্নেহ, যতদূর সাধ্য সাবধানে রাখেন তিনি এই প্রিয়া পত্নীকে। কিন্তু চারটি কন্যা সন্তানের জন্ম দিলেও, এখনও পুত্রমুখ দেখাতে পারেনি তাঁর প্রিয়া। তৃতীয়া গ্রহণ করবার জন্য জোর করছেন পিতা, পিতামহ। বংশে এমনিতেই পুত্রসন্তান অল্প। বংশই বা রাখবে কে? মৃত্যুর পর পিতৃপুরুষকে অন্নজলই বা দেবে কে? তাঁর জ্ঞাতি ভ্রাতাদের সবারই দুটি তিনটি করে পত্নী। ভ্রাতৃজায়ারা তো তাঁর ব্রাহ্মণীকে সর্বক্ষণই উত্ত্যক্ত করে। কিন্তু এসে থেকে স্বামীর বিশেষ সমাদর পেয়ে পেয়ে তাঁর পত্নী অভিমানিনী হয়ে উঠেছে। এখনই সে অলঙ্কার, গন্ধদ্রব্যাদি উপহার দিলে প্রত্যাখ্যান করতে শুরু করে দিয়েছে। এবার যাত্রার আগে ব্রাহ্মণী বলেছিল, ‘সেট্ঠি পুতুরের জন্য যেমন, নিজের জন্যেও তেমন একটি ভালো দেখে গাই নিয়ে এসো। এঁড়ে বাছুর বিয়োবে এমন গাই। লক্ষণ পড়তে পারে এমন পণ্ডিতের সাহায্য নিও না হয়। নিজে তো কিছুই শেখোনি।’
এমন নয় যে আমোদ-প্রমোদের সন্ধানে তিনি কখনও কোথাও যাননি। আগেও গিয়েছেন, এখনও যান। গান তিনি ভালোবাসেন। নাট্য কিংবা গোষ্ঠীসভা হলে শ্রাবস্তী নগরের যেখানেই হোক, তিনি আগে গিয়ে বসে থাকবেন। সুগায়িকা বারবধূগুলি চেনা হয়ে গেছে। কোনও সম্পন্ন শ্ৰেষ্ঠীকুমার জুটলে, সঙ্গে সঙ্গে তিনিও চলে যান। কিন্তু, গৃহে কুলস্ত্রী একাধিক থাকলে অনেক সময়ে বড় বিড়ম্বনা হয়। তাঁর জ্যেষ্ঠদের সবার ঘরে তো শান্তি নেই! তাঁর গৃহটি যেমন শ্রীমণ্ডিত, তেমনি শান্তিপূর্ণ। তিনি নিজেও মৃদঙ্গ বাজান, সময় পেলে যখন মৃদঙ্গটি নিয়ে বসেন, মাটির মাত্রে তুষের আগুন করে তাতে সুগন্ধিচূর্ণ দিয়ে একপাশে রেখে যায় ব্রাহ্মণী। দীপটি নিষ্কম্প শিখায় জ্বলে, দুটি কন্যা তাঁরই মতো সংগীতপ্রিয়, বেশ ভালো গাইতে পারে। তাঁর মৃদঙ্গ বাদনের মান এমন নয় যে কোনও উৎসবে সুযোগ পাবেন, কিন্তু গৃহের মধ্যেই এমন শ্রোতা! কন্যা দুটি, গৃহিণী তদ্গত চিত্তে শোনে। আবারও বিবাহ করলে ব্রাহ্মণীর যা মতিগতি দেখা যাচ্ছে, মৃদঙ্গটি হয়তো দুই সপত্নীই বাজাতে থাকবে, তাঁকে পথে পথে ঘুরতে হবে।
পেছনে কাশির শব্দ শোনা গেল। ব্রাহ্মণ মুখ ফিরিয়ে দেখলেন জ্যেষ্ঠ।
—বসব নাকি একটু? জিজ্ঞাসা করলেন জ্যেষ্ঠ।
—নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই, কনিষ্ঠ একটু সরে বসলেন।
জ্যেষ্ঠ বললেন, ‘যেন চিন্তিত মনে হচ্ছে! মিগারের পুত্তুরের জন্য এত চিন্তা?’
কনিষ্ঠ কপাল চাপড়ে বললেন, ‘মিগারের পুতুরের আর কি? একটা ছেড়ে দশটা বিয়ে করুক না, কেউ কিছু বলতে আসবে না। ধনী শ্রেষ্ঠীদের ঘরে তো এক এক পত্নীর এক এক গৃহ। কাংস্যপাত্রগুলি আলাদা আলাদা থাকলে তো আর ঠোকাঠুকির সম্ভাবনা নেই!’
—আহা, শ্রেষ্ঠীদের কথাই যখন বললে তখন রজতপাত্র, সুবর্ণপাত্রর কথা বলো। কাংস্যপাত্র তো তোমার আমার ঘরে। তা হলো কি? বলই না। বয়সে বড়, সংসারে দেখলাম শুনলামও অনেক। তোমার সমস্যাটা কী হে!
কনিষ্ঠ ইতস্তত করে নিজের সমস্যাটির কথা বলেই ফেলেন। শুনে জ্যেষ্ঠ বললেন, ‘দেখো গুণপতি। শাস্ত্রে বলেছে স্ত্রীলোককে কখনও বাড়তে দেবে না।’
—বলেছে নাকি? কনিষ্ঠ দুর্বল কণ্ঠে বললেন।
—সন্দেহ প্রকাশ করছ? একস্য পুংসো বহ্বো জায়া ভবন্তি। শোননি? যা বা অপুত্ৰা পত্নী সা পরিবৃত্তী। অপুত্রা পত্নীকে তো পরিত্যাগই করতে পারো। যে স্ত্রী শুধু কন্যাসন্তানের জন্ম দেয় তাকে বারো বছর পরেই ত্যাগ করা যায়। তা তুমি তো ত্যাগ করছ না হে, শুধু শাস্ত্রানুযায়ী দ্বিতীয়া ভার্যা গ্রহণ করছ! অপরাধ তো কিছু করছ না!
—তা করছি না। কিন্তু গৃহশান্তি? গৃহশান্তির কথা ভেবেই…
জ্যেষ্ঠ বললেন, ‘ওই যে বললাম, বাড়তে দিয়েছ। বড়ই বাড় হয়েছে।’
জ্যেষ্ঠ উঠে পড়লেন। বেশি কথা বাড়ানো ঠিক নয়। তাঁর নিজের গৃহে সবার বড় ব্রাহ্মণীটি খুবই ধৈর্যশীল, ক্ষমাপরায়ণ, গৃহকর্ম নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু দ্বিতীয়টি ছিল বেশবাসপ্রিয়, কলহপরায়ণ, তৃতীয়াকে গৃহে আনার পর সে পুংশ্চলী হয়ে যায়। পিতৃগৃহে চলে গেল, আর এলো না। শ্রাবস্তীতে কেউ এ কথা শুনে না। জানলে তাঁর মর্যাদাহানি হবে। তিনি রটিয়ে দিয়েছেন তাঁর মৃত্যু হয়েছে। বহুদিন হয়ে গেল, এখনও সেসব কথা মনে হলে তাঁর যন্ত্রণা হয়।
নির্বিঘ্নে পূজার্চনা করবেন, কোনও ধনী শ্রেষ্ঠীর কি ক্ষত্রিয় পরিবারের বাঁধা পুরোহিত থাকবেন, দানগুলি গৃহে এসে জ্যেষ্ঠ ব্রাহ্মণীর হাতে তুলে দেবেন, সে সব ভাণ্ডারজাত করবে, অপেক্ষাকৃত অল্পবয়স্ক ছেলেমেয়েগুলি দানের জিনিস দেখবার জন্য গোলমাল করবে, মনে মনে খুশি হলেও বাইরে তিনি বিরক্তি প্রকাশ করবেন তখন দ্বিতীয়া এসে তাদের হাতে মোদক দিয়ে টেনে নিয়ে যাবে। পা ধুইয়ে দেবে তৃতীয়া, ভোজ্য এবং খাদ্য নিয়ে আসবে জ্যেষ্ঠা। রাত্রে সবচেয়ে ছোটটি অর্থাৎ তৃতীয়াকে নিয়ে সহবাস সুখ উপভোগ করবেন। এই তো জীবন! সুখের পরাকাষ্ঠা! স্বাদ বদলাতে দ্বিতীয়া, কখনও কখনও প্রথমাও থাকবে বইকি। পত্নীগুলিকে তিনি শাস্ত্রানুযায়ী সমান ভালোবাসতে না হোক সমদৃষ্টিতে দেখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, না? তা ভালোবাসা তো শুধু শয্যাতেই প্রমাণ হয় না! এই যে তিনি গাৰ্হস্থ্যের কোনও ব্যাপারে জ্যেষ্ঠা ব্রাহ্মণী ছাড়া আর কারও উপর নির্ভর করতে পারেন না, দানের দাসী, গবাদি পশু, তৈজস ইত্যাদি বিক্রয়ের জন্য মধ্যমপুত্র ছাড়া আর কাউকে দায়িত্ব দিতে চান না, এগুলো কি ভালোবাসা নয়? শাট্ক যেগুলি পান সবার মধ্যে সমান ভাগ করে দেবার নির্দেশ দেন জ্যেষ্ঠাকে। নির্দেশ দিতেও হয় না। সব কাজই সুন্দরভাবে নিষ্পন্ন হয়ে যায়। তার হাতের অপূপ, পায়স কিংবা প্রতিদিনের সেব্য যে যাগু তার স্বাদ কী! তখন তিনি প্রেমপূর্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকান, সে কি তা বোঝে না? শয্যায় তার শিথিল প্রত্যঙ্গগুলি যদি কামোন্মাদনা জাগাতে না পারে বিশেষ তিনিও তো পক্ককেশ বৃদ্ধই হলেন অথচ ভোগবাসনা যায়নি। ক্রমশই তরুণী আরও তরুণী প্রয়োজন হয়। এই সামান্য কথাটা না বুঝে দ্বিতীয়া তার একটি ছেলে একটি মেয়েকে নিয়ে পিতৃগৃহে চলে গেল! আর এলো না। একবার তাকে আনতে গিয়ে কী অপদস্থই না হয়েছিলেন! ছেলেমেয়ে দুটি তাঁর সঙ্গে চলে এলো। দুই রাত্রি সেখানে থেকেও তার দেখা পেলেন না। শ্যালকরা বলল—সে নাকি সখীর গৃহে গেছে। পুত্র-কন্যা দুটিকে নানাভাবে প্রশ্ন করে তিনি যা বোঝবার বুঝলেন। ফিরে এলেন এবং কদিন পরেই রটনা করলেন সে অকস্মাৎ সর্পাঘাতে মারা গেছে। কিন্তু একটি সুখী, শান্তিময়, কল্যাণশ্রী সম্পন্ন সংসারের গৃহপতি বলে গৌরব আর কি তিনি মনে মনে করতে পারেন?
৮
সকালে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়ে গেছে। এখন কিন্তু তার চিহ্ন মাত্র নেই। রাতের আকাশে অজস্র তারা। দিক্সুন্দরীরা যেন অমলনীল বসন পরে হীরককুচির আভরণে সজ্জিত করেছেন নিজেদের। উদ্যানে অনেক দূরে দূরে দীপদণ্ড। গ্রীষ্মে, বর্ষায় অন্তঃপুরের এই উদ্যানটি বিসাখার বড় প্রিয়। স্বল্প আলোয় সর্বত্র গাছগুলির অবয়ব চেনা যায় না। খালি পুঞ্জীভূত অন্ধকার দিয়ে তাদের আকার গড়া। পুষ্পিত তরুগুলি থেকে সুবাস আসছে। সপ্তপর্ণীর অঙ্গ থেকে, বকুল, নীপতরু থেকে মাতাল করা সুগন্ধ তরুণ আষাঢ়ের সিক্ত বাতাসের সঙ্গে বয়ে চলেছে। নীপতরুমূলে পাষাণ বেদিকার ওপর বসল বিশাখা। পাঁচজন অনুচরী চার দিক থেকে তাকে ঘিরে আছে। কারও হাতে ময়ূরপাখার ব্যজনী, কেউ স্নিগ্ধ পানীয় হাতে, কেউ কেউ তার পদ বা হস্ত সংবাহন করবার জন্য গুছিয়ে বসল। বিশাখার রাত্রের সাজ মনোরম গাঢ় নীল রঙের সূক্ষ্ম কাশীর কার্পাস-বস্ত্র। আভরণগুলি খুলে ফেলে কুসুমসজ্জা করেছিল সকালে একবার। আর একবার অপরাহ্ণে, এখন সেগুলি শুকিয়ে উঠেছে। দাসীরা কণ্ঠে মুক্তামালা দুলিয়ে দিল, কানে মুক্তার কর্ণভূষা, হাতে রত্নখচিত গজদন্তের কঙ্কণ। তার ক্ষুদ্র কোমল পা দুটি কোলে তুলে নিয়ে ধীরে ধীরে টিপে দিচ্ছিল ধনপালী। কিছুক্ষণ পর বিশাখা বলল, ‘আহ্, ধনপালি, আর কতক্ষণ এভাবে সংবাহন করবি?’
‘কেন ভদ্দে, তোমার ভালো লাগছে না?’
‘আমি কি বৃদ্ধা? না রোগিণী? সে যখন তখন সংবাহন ভালো লাগবে?’
‘কিন্তু এ তো বৃদ্ধা বা রোগিণীর সংবাহন নয় ভদ্দে, এই সংবাহন পদ্ধতি আমি আমার পিতামহীর কাছে শিখেছি। তিনি মহারানী ক্ষেমার মণ্ডনধাত্রী ছিলেন। সুদূর মদ্ররাজ্য থেকে মহারানীর সঙ্গে মগধে আসেন। আমাদের কত কিছু শিখিয়েছেন! এতে শরীরে রক্ত চলাচল সাবলীল হয়। ত্বকের শোভা বাড়ে। কোনও গ্লানি থাকে না কখনও।’
বিশাখা তার মণির মতো উজ্জ্বল, মৃণালের মতো সুগঠন, ফুলের পাপড়ির মতো মসৃণ সুখস্পর্শ বাহু বাড়িয়ে বলল, ‘ধনপালি, আমার কি আরও উজ্জ্বলতা, আরও মসৃণতা, আরও শোভার প্রয়োজন আছে? এর চেয়েও বেশি হলে উপযুক্ত বর কোথায় পাবেন পিতামাতা?’
ধনপালী হাসিমুখে চুপ করে রইল। যদিও বিশাখা তার দাসীদের সঙ্গে সখীর মতোই ব্যবহার করে, তবু প্রভুকন্যার সব কথার উত্তর দেওয়ার শিক্ষা তার নেই।
আর এক দাসী কহ্না বলল, ‘তা যদি বলো ভদ্দে, রূপে গুণে বিচার করলে তোমার যোগ্য বর পূর্ব দেশেই বলো, উত্তর দেশেই বলো, কোথাও পাওয়া যাবে না। যদি বা পাওয়া যায়ও অতি সুন্দরী অতি গুণবতী ভার্যার মর্যাদা কি পুরুষরা দিতে পারে?’
‘এ কথা কেন বলছিস?’ সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করল বিশাখা।
‘আমি দেবী রাহুলমাতার কথা ভেবে বললাম। সমন গৌতম তো এখন বুদ্ধ হয়েছেন। তিনি কি বিবাহের সময়ে সবঙ্গসুন্দরী, অনুপম গুণবতী কন্যা চাননি? তা সেই কন্যা তাঁর কী কাজে লাগল? পুত্ৰও তো দিয়েছিল? পুত্রবতী সেই ভার্যার কী মর্যাদা তিনি দিলেন? শুনতে পাই সদ্য প্রসূতি রাহুলমাতা গৌতমের গৃহত্যাগের পর মাটিতে শুতেন, দিনান্তে সামান্য পকান্ন একবার মাত্র গ্রহণ করতেন, মেঘদামের মতো কেশ কেটে ফেলেছিলেন। এত তপস্যা, এত পাতিব্ৰত্যের পরও তো গৌতম তাঁকে পা দিয়েও স্পর্শ করে দেখেননি।’
‘কোথা থেকে এত শুনলি?’ অন্যমনস্ক হয়ে বিশাখা বলল।
‘আমরা তো আর তোমার মতো অন্তঃপুরে থাকি না, নানা দিকে ঘুরতে হয় কাজে। সমন গৌতমের শিষ্যরাই তো এসব কথা গৌরবের সঙ্গে বলাবলি করে। নাকি কপিলাবস্তুতে তাঁকে দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করতে দেখে দেবী নিদারুণ কষ্ট পেয়েছিলেন, তাঁদের বংশের অনুপযুক্ত কাজ বলে নিষেধ করে পাঠিয়েছিলেন শ্বশুরকে দিয়ে। নাকি গৌতম তাঁকে বলেন তিনি শাক্যবংশের নন, বুদ্ধবংশের। একাকী রাহুলমাতার সঙ্গে তিনি দেখা পর্যন্ত করতে চাননি। যিনি দীর্ঘদিন তপস্যা করে কাম জয় করেছেন, নিজের স্ত্রীকে তিনি ভয় পেলেন, না কি? সঙ্গে ওই উপতিষ্য বলে প্রৌঢ় ভিক্ষুটা ছিল, দেহরক্ষীর মতো, ওই যে গো যাকে সবাই সারিপুত্ত সারিপুত্ত করে। অগ্গসাবক হয়েছে না কি আবার!’
ময়ূরী বলল, ‘শুধু দেবী রাহুলমাতা না কি? আমি আরও মর্মস্পর্শী কাহিনী শুনেছি কপিলাবস্তুর। কিন্তু ভদ্দে অল্পবয়স্কা, ব্যথা পাবেন, তাই না বলাই ভালো মনে করছি।’
বিশাখা মৃদু হেসে ময়ূরপুচ্ছ দিয়ে তাকে তাড়না করে বলল, ‘কৌতূহল কী করে বাড়াতে হয় খুব শিখেছিস, না? কার কাছ থেকে এ বিদ্যা আয়ত্ত করলি? ধনপালি তো তার পিতামহীর কথা বলে, তোর কি মাতামহী?’
ময়ূরী হাসতে লাগল, তারপর ভঙ্গি করে বলল, ‘সত্যি গো বিসাখাভদ্দে, সমন গৌতম তাঁর বৈমাত্রেয় ছোট ভাই নন্দর বিয়ের দিনে তার হাতে ভিক্ষাপাত্র ধরিয়ে দিয়ে তাকে ন্যগ্রোধ-আরামে টেনে আনেন। বটগাছের ওই কাননটা শাক্য আর কোলিয়দের রাজ্যের সীমায় বোধহয়, রোহিণী নদীর তীরে। রাজপুরী থেকে অনেক দূর। তারপর অনেকক্ষণ বসিয়ে রেখে নন্দকে জোর করে পব্বজ্জ্যা দেন। ওদিকে তো বিয়ের সাজ পরে তার বধূ বসে আছে। একই সঙ্গে বধূও হবে, রানীও হবে। গৌতম চলে যাবার পর ওই কুমার নন্দই তো শুদ্ধোদনের সম্পত্তি পাবেন! শাক্যরা গৌতমের বংশকেই সবচে মানে। শুদ্ধোদনের ধনও নাকি অনেক।
বিশাখা তাকে আবার তাড়া দিয়ে বলল, ‘গল্প বলতে জানিস না? অন্য দিকে যাচ্ছিস কেন? নন্দর বিয়ের গল্পটা বল্!’
‘বিয়ের গপ্পো নয় গো, মরণের গপ্পো! শোনো, শুনলেই বুঝতে পারবে। নন্দর তো ওই বধূর সঙ্গে বাল্য থেকে প্রণয়। বধূ তো তোমারই মতো জনপদকল্যাণী।’
‘এই ময়ূরি, মিথ্যা বলবি না, আমি কখনও জনপদকল্যাণী নই।’
‘মিথ্যা বলছি না ভদ্দে, ওই সব গণরাজার দেশে সুন্দরী কন্যাদের জনসমক্ষে হাজির করতে হয় সৌন্দর্যের প্রতিযোগিতা হয় গো, তাই উপাধি পায়। তোমাকে তো তোমার পিতা ভয়ে ঘরের বারই করতে পারেন না। পাছে অমূল্য নিধিটি হারিয়ে যায়! সেদিন সরযূতীরে ওই বটুদের কথা শুনছিলে না? অস্থিকল্যাণী, কেশকল্যাণী, মাংসকল্যাণী, একজন আবার বলল কণ্ঠকল্যাণী। তো সবেতেই যদি অমন কল্যাণী হও, মাথার থেকে পা পর্যন্ত শ্রেষ্ঠ, তো জনপদকল্যাণী তুমি হবে না তো কি সেট্ঠি ভবদেবের মেয়ে খুজ্জ উত্তরা হবে?’
বিশাখা রাগ করে বলল, ‘কারও শারীরিক ত্রুটি নিয়ে এমন অকারণ পরিহাস করা আমি সইতে পারি না ময়ূরি, ছি! উত্তরা দুর্ভাগিনীর দুঃখের কথা কখনও ভেবে দেখেছিস? পিঠে ওই রকম কুঁজ! আহা, সে সোজা হয়ে চলতে পারে না।’
ধনপালী বলল, ‘ময়ূরির গপ্পোটা যে শেষ হল না ভদ্দে, এই ময়ূরি ক্ষমা চা। আগে ক্ষমা চা, তারপর গপ্পোটা বল।’
ময়ূরী জোড়হাত করে ক্ষমা চাইল, কিন্তু তার ওষ্ঠাধরপ্রান্তে দুষ্টুমির হাসি লেগেছিল। বিশাখা গম্ভীরভারে বলল, ‘ঠিক আছে, বল্।’
‘কুমার নন্দর প্রণয়িণী ওই শাক্যকন্যা অসামান্য রূপসী ছিল। নন্দকে ভালোবাসত প্রাণ দিয়ে। চিন্তা করো ভদ্দে, বধূসাজে সজ্জিত মেয়েটির কাছে সংবাদ এলো তার বর যে নাকি কিছুক্ষণ পরই বিয়ে করতে আসবে, সে পব্বজ্জ্যা নিয়েছে।’
‘তারপর? তখন কী হল? শ্ৰমণ কি দয়া করলেন?’
‘সমন করবেন দয়া! তা-ও নারীকে। যে নারীকে তৈজসপত্তরের মধ্যে গোনা হয়? কন্যাটি মারা গেল। পূর্ণ বধূবেশে সজ্জিত সেই অপরূপা কন্যার হৃদয়ে বিষের তীর বিঁধল। শুনেছি চম্পক গৌরী কন্যাটি নাকি নীল হয়ে গিয়েছিল ব্যথায়। এত যাতনা যে টেনে টেনে গা থেকে আভরণ, বস্তর, উত্তরীয় সব খুলে ফেলে তারপর আপাদমস্তক নীল হয়ে ঢলে পড়ে।’
উপস্থিত সকলেই শিউরে উঠল।
অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে গাঢ় নিশ্বাস ফেলে বিশাখা মৃদুস্বরে বলল, ‘নন্দ শুনেছেন সে কথা?’
‘শুনেছেন কি না জানি না, তবে এটুকু জানি যে সমন গৌতম তাকে নাকি ওই বধুর চেয়েও শতগুণে সুন্দরী দেবকন্যার লোভ দেখিয়ে বিনয় পালন করাচ্ছেন। তার নাকি মন ইতিমধ্যেই শান্ত হয়ে এসেছে। অর্হত্ত্ব লাভ করল বলে।’
বিশাখা বলল, ‘বাঃ, দায়িত্বহীন মোহান্ধতার পুরস্কার হল অর্হত্ত্ব? আর অনন্য প্রণয়ের পুরস্কার হল অপঘাত?’
‘তবেই বলো ভদ্দে, সুন্দরী গুণবতী হয়েই বা কী লাভ! যোগ্য পতিলাভ করেই বা কী! রাহুলমাতার যখন বিবাহ হয়, তখন শাক্যকুমারীরা, কোলিয় কন্যারা তো সবাই তাঁকে ঈর্ষাই করেছিল!’
‘কেন?’ বিশাখা অন্যমনস্ক হয়ে বলল।
‘তুমি সমন গৌতমকে দেখনি?’
‘হ্যাঁ একদা দেখেছিলাম বটে।’
‘তাহলে জিজ্ঞেস করছো? মগধরাজ বিম্বিসার নাকি তাঁকে বাতায়ন থেকে দেখতে পেয়ে নিচে নেমে এসে মগধ রাজ্যটাই অপ্পন করতে চেয়েছিলেন।’
‘সে কি শুধু রূপ দেখে ময়ূরি!’
‘বাতায়ন থেকে প্রথম দর্শনে রূপ ছাড়া আর কী-ই বা দেখা যায় ভদ্দে!’
‘তা অবশ্য,’ বিশাখা স্বীকার করল, তারপর বলল, ‘ময়ূরি, রূপেরও তো প্রকারভেদ আছে! যে রূপ দেখে শাক্যকন্যারা রাহুলমাতাকে ঈর্ষা করত, আর যে রূপ দেখে মগধরাজ রাজ্য দিয়ে দিতে চাইলেন তা নিশ্চয়ই এক নয়। একটি যদি রমণীমনোহর হয় তো অন্যটি হয়তো সর্বোত্তম পৌরুষব্যঞ্জক, হয়তো অসীম শক্তির কোনও দ্যোতনা ছিল সেই রূপে।’
‘কি জানি তোমার মতো অত বিদ্যে তো শিখিনি ভদ্দে, এভাবে বিচার করতে পারব না, তবে আমার মতো সামান্য মেয়ে এটুকু বলতে পারে, তোমার মতো রূপসী গুণবতীর যোগ্য যদি কেউ হয় তো সে হবে ওই কুমার সিদ্ধার্থ।’
শিউরে উঠে কানে আঙুল দিল বিশাখা, ভর্ৎসনা করে বলল, ‘ছি, ময়ূরি, এ কথা মুখে আনলেও যে পাপ হয়। শ্ৰমণ আমার পিতার বয়সী, পিতৃসম, তাছাড়া প্রব্রজিত, সন্ন্যাসী।’
‘আমি কি তোমাকে সিদ্ধার্থকে প্রার্থনা করতে বলেছি ভদ্দে, আমরা মুর্খ নারী, সব কথা ঠিক মতো বোঝাতে পারি না, বলছি সিদ্ধার্থর মতো কেউ থাকলে সে হতো তোমার যোগ্য বর। কিন্তু তাতেই বা কী? ওই রকম যোগ্য বরের হাতে পড়ে আমাদের আদরিণী প্রভুকন্যার যদি রাহুলমাতার মতো দশা হয়?’
‘আমি অন্তত কেশ কর্তন করব না’—মল্লিকার মালা জড়ানো বেণীটিকে দুহাতে যেন আদর করতে করতে বিশাখা বলল,—‘কর্কশ বস্ত্রও পরবো না, কদন্ন ভোজনও আমার দ্বারা হবে না।’ সে অনুচরীদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছিল, তার কণ্ঠস্বরে ক্রমশই চাপা গর্ব এবং রোষ প্রকাশ পাচ্ছিল।
‘তুমি কখন সমনকে দেখেছিলে, ভদ্দে, আমাদের সে গপ্পো শোনাও না! আমরা তোমাকে কত গপ্পো শোনালাম!’
তার দাসীরা প্রভুকন্যার ভাবান্তর অনুভব করেছে। তারা তাকে সম্ভ্রম করে, ভালোবাসে, ভয় করে না। প্রভুকন্যার সঙ্গে তাদের সখিসম্বন্ধ। তার কাছ থেকে তারা অনেক কিছু শেখেও।
বিশাখা ধীরে ধীরে বলল, ‘সে তো অনেক দিনের কথা। তখন ভদ্দিয় নগরে পিতামহের গৃহে থাকতাম। তোরা সে সময়ে ছিলি না।’
ধনপালী বলল, ‘ভাগ্যিস তুমি সাকেতে এসেছিলে, নইলে যে আমাদের কী দশা হত! খুজ্জ উত্তরার, না, না, উত্তরাদেবীর মা একটি দাসীকে এমনই প্রহার করেছেন যে তার পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটেছিল আর কি!’
শিউরে উঠে বিশাখা বলল, ‘পঞ্চত্বপ্রাপ্তি! সে কী?’
‘সে এক মহা কলঙ্কের ব্যাপার ভদ্দে, এই কহ্না তুই বল না! তুই বেশ ভালো বলতে পারিস।’
কহ্না বলল, ‘ছি, ওসব কথা বিসাখাভদ্দার কানে তুলে কাজ নেই।’
বিশাখা বলল, ‘আবার! বল বলছি শিগগিরই!’
কহ্না বলল, ‘সত্যি কথা বলতে কি উত্তরামাতারও খুব দোষ নেই। মেয়ে খুজজ বলে তো দুশ্চিন্তার সীমা নেই। বিয়ে ছাড়া মেয়েদের গতি কী? কিন্তু কী করে দোষযুক্ত কন্যাকে পার করবেন।’
বিশাখা বলল, ‘উত্তরা কিন্তু সুশ্রী। ওই একটিই দোষওর, আহা।’
‘দোষ বলে দোষ! তা অনেক দেখে-শুনে শেষ পর্যন্ত এক দরিদ্র ব্রাহ্মণকে পাত্র স্থির করেছিলেন ভবদেব সেট্ঠি। প্রথম স্ত্রীটি মারা গেছে। যমজ দুটি পুত্র। আহা অল্পবয়স্ক! এর অসুখ করলে ওরও অসুখ করে। একসঙ্গে হাসে, একসঙ্গে কাঁদে। ব্রাহ্মণ তো একেবারে সারা হয়ে যাচ্ছিলেন। বুঝতেই পারছো অবিলম্বে পত্নী দরকার। ভবদেব অনেক সুবন্ন, ধান্য ক্ষেত্র ইত্যাদি যৌতুক দেবেন স্বীকার করে ব্রাহ্মণকে নিমন্ত্রণ করে ঘরে নিয়ে আসেন। ভদ্দা উত্তরা স্বহস্তে পলান্ন, পায়স, মণ্ড, মোক সব প্রস্তুত করেছিল। যখন মাতা-পিতা-কন্যা ব্রাহ্মণের সঙ্গে কথা বলছে তখন পদ্মিনী ভোজ্য খজ্জ সব নিয়ে ঘরে ঢোকে। ভোজনপর্ব সমাধা করে বটু বলে কি জানো? “যে দাসীটি ভোজ্য এনেছিল, ও ভৃতিকা, না ক্রীতদাসী? যদি ক্রীতদাসী হয় তো কত নিষ্ক্রয় দিলে ওকে মুক্তি দেবেন বলুন, আমি ওকেই বিবাহ করব।”
‘বলিস কী?’ বিশাখা আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘একজন ব্রাহ্মণ হয়ে লোকটি এমন করল?’
‘ব্রাহ্মণ তো কী’, কহ্নার ওষ্ঠাধর স্ফুরিত হল। সে বলল, ‘শূদ্রা বলে, দাসী বলে কি আমরা আর মানুষ নই না কি, ওরকম অনেক বটু-বামুন, অনেক ক্ষত্তিয়-সেট্ঠিকুমারের নাক কেটে দিতে পারি।’
ধনপালী বলল, ‘আহ্ কহ্না কী বাচালতা হচ্ছে?’
বিশাখা হাসিমুখে বলল, ‘না না ওকে বলতে দে পালি। অবশ্যই পারিস। নাক কান কাটতে পারিস, মাথা ঘুরিয়ে দিতে পারিস। তোর শক্তিতে কে সন্দেহ প্রকাশ করছে! আমি ব্রাহ্মণের দিক থেকে কথাটা চিন্তা করছি। একটি কন্যাকে বিবাহ করার জন্য গিয়ে তার…’ বিশাখা অপ্রতিভ হয়ে চুপ করে গেল। তার পাঁচজন দাসী তাকে ঘিরে রয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে তাদের মনে সামান্য হলেও কিছু অভিমানের সঞ্চার হয়েছে। এই প্রসঙ্গ থামানো ভালো।
ময়ূরী বলল, ‘তারপর জানো ভদ্দে, ব্রাহ্মণকে দুর্ব্যবহার করে বিদায় দিয়ে খুজ্জ উত্তরার মা পদ্মিনীর গলা টিপে ধরে। এমন জোরে যে উত্তরাভদ্দা আর ভবদেব সেট্ঠি কেউ ছাড়াতে পারছিলেন না। উত্তরার মা কেমন স্থূলাঙ্গী জানোই তো! অবশেষে পদ্মিনী অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলে, সেট্ঠি বলতে থাকেন তুমি অতি কোপনস্বভাব, হ্রস্বদীর্ঘ জ্ঞান নেই, নাও এবার হত্যার অপরাধে তোমাকে নগরপালের লোকেরা ধরে নিয়ে গিয়ে হাত পা কেটে দেবে। তখন হাই-মাই করে কাঁদতে থাকে স্থূলাঙ্গিনী। ইতিমধ্যে উত্তরাভদ্দা চোখে মুখে জল দিয়ে, কণ্ঠ পৃষ্ঠ ডলে দিয়ে, উত্তম সুরা পান করিয়ে পদ্মিনীকে সুস্থ করে তোলে।’
‘এখন ভালো আছে?’ বিশাখা জিজ্ঞাসা করল।
‘এখনও হাতে পায়ে তেমন বল পায়নি শুনতে পাই।’
‘মেয়েটি কি অতি সুন্দরী!’
‘কী যে বলো ভদ্দে, অতি সুন্দরী আর কোথা থেকে হবে! ভস্মের মতো বন্ন, কিন্তু মাথায় কেশ খুব, পৃথুল শ্রোণী। বক্ষ দুটিও বৃহৎ মৃৎ-হণ্ডিকার মতো। পুরুষদের আর কী চাই বলো! তবে মানুষটি খুব শান্ত পদ্মিনী। এবার হয়তো ওকে বিক্রি করে দেবে সেট্ঠি।’
বিশাখা উৎকর্ণ হয়ে ছিল, বলল, ‘ওকে বিক্রি করলে আমি কিনব। দেখিস তো! আর ওই ব্রাহ্মণ? ওর একটু সন্ধান আনতে পারিস?’
ময়ুরী বলল, ‘কালই পদ্মিনীর খোঁজ আনব। কেন গো ভদ্দে?’
বিশাখা সহসাই প্রভুকন্যা হয়ে উঠল। বলল, ‘তাতে তোর প্রয়োজন কী? আর এবার তোরা যা তো।’
‘কোথার যাবো? তুমি একা থাকবে নাকি?’
‘কেন! আমাকে একা থাকতে নেই! দিবারাত্র তোদের কেকারব শুনতে হবে?’
‘দেবী তোমায় একা রাখতে বারণ করে গেছেন কিন্তু।’
‘আচ্ছা আচ্ছা যা, দেবী এলে আমি নিজে তাঁকে বুঝিয়ে দেবো এখন, কতক্ষণ একা থেকেছি।’
ওদের পাঁচজনেরই খুব ঘুম পেয়ে গেছে বুঝতে পারা যাচ্ছে। ছাড়া পেয়ে ওরা বাঁচল। এখন ওদের কক্ষে গিয়ে শোওয়া মাত্র ঘুম এসে যাবে। অমন অন্তর্ভেদী নাসিকাগর্জন সবার দাসীরই হয়ে থাকে কি না জানা নেই বিশাখার। হলে বুঝতে হবে অভিজাত কন্যাদের সবারই রাত্রিজাগরণ অভ্যাস আছে। এক এক জনের নাসিকার আওয়াজ এক-একরকম। কহ্না ঘুমোলেই ঘরে হরিৎ ফড়িং উড়তে থাকে, জোরালো পাখার শব্দ। ময়ূরী তার সঙ্গে যুক্ত করে একটা গুঞ্জনধ্বনি, ধনপালী ঘুমোয় মুখ হাঁ করে। এবং এক নিমেষ অন্তর তার খোলা মুখ থেকে একটি ছোট্ট পাখি উড়ে যায় ফুড়ুৎ, ফুড়ুৎ করে।
প্রহরখানেক পরে বিশাখা ওদের কারও মুখ বন্ধ করে দেয়, কাউকে জোর করে পাশ ফিরিয়ে দেয়, কারুর গড়িয়ে পড়া মাথা উপাধানে তুলে দেয়, তারপর সত্যিকার নিস্তব্ধ নিশা নামে তার কক্ষায়। আগে সব গৃহের নিয়মমতো তার দাসীরা তার ঘরেই মাটির উপর শুতো। বিশাখা তার বারো বছর বয়স হবার পর নিজের ঘর আলাদা করে নিয়েছে। দাসীরা শোয় সংলগ্ন ঘরে। দ্বার খোলাই থাকে। তবু তো রাত্রির পরিসরে আপন কক্ষে কুমারী বিশাখা একা!
এখন এই কাননে সেই বহু আকাঙ্ক্ষার ধন একাকিত্ব সে পেল। ওই বৃক্ষগুলি! সপ্তপর্ণী, এই নীপ, ওই বকুল, অদূরে ধ্রুব আম্রফলের বৃক্ষগুলি সব কাছাকাছি, তবু কেমন একা! আকাশের তারাগুলি! কাছাকাছি, তবু কত দূর! নিজেদের একাকিত্ব কী দীপ্তির সঙ্গে রক্ষা করে চলেছে! সাতটি ঋষি যেন নিজ নিজ আসনে ধ্যানমগ্ন, ওই তো অরুন্ধতী! দ্যুতিময়ী, স্বতন্ত্রা। এমন কি এই আকাশ? এত মেঘ, দিবানিশি এত রঙ, সূর্য, চন্দ্র, তারকা সব নিয়েও কেমন একাকী! উদাসীন! বিশাখা জানে তার চিত্তের মধ্যে কোথাও কোনও গর্ভগৃহে এই একাকিত্ব যেন ন্যগ্রোধবৃক্ষতলে এক বৃক্ষদেবের মতো বসে আছে। তাকে ভালো করে দেখবার চেনবার অবসর সে পায় না।
হঠাৎ কাছাকাছি কোথাও ধুপ করে একটা শব্দ হল। বিশাখা চকিত হয়ে উঠে দাঁড়াল। মার্জার? অন্য কোনও জানোয়ার হওয়া তো সম্ভব নয়! সুরক্ষিত এই উদ্যান! কিন্তু মার্জার অতি লঘুশরীর, এমন ভারী আওয়াজ…
‘রত্নমালা ভালো লাগবে জানলে কুন্দমালা নিয়ে অপদস্থ হতে আসতাম না।’ খুব কাছ থেকে কেউ বলে উঠল।
‘কে?’ বিশাখা মৃদুস্বরে বলল।
নীপগাছটির উত্তর দিকে একটি ছায়া নড়ল, ‘আমার বোঝা উচিত ছিল অবশ্য। ধনীকন্যার কাছে প্রণয়যোগ্যতা সুবর্ণ-মণি দিয়েই বিচার হবে এ আমার বোঝা উচিত ছিল। ভুল করেছি, কারণ ধনীকন্যাকে সুবর্ণপ্রতিমা মনে করিনি, বরং রক্তমাংসের কুসুমস্তবক মনে করেছিলাম।’
বিশাখা বলল, ‘কাপুরুষের মতো আড়ালে দাঁড়িয়ে আছো কেন? সামনে এসো!’
‘বাঃ, বেশ বিচার তো! সামনে এলে বলবে হঠকারী, প্রগল্ভ, আড়ালে থাকলে বলবে কাপুরুষ! চমৎকার বিসাখা, অতি চমৎকার!’
বিশাখা বলল, ‘জানো না তিষ্য? অত্যন্ত বেশি প্রকাশ্যও লজ্জাকর অত্যন্ত বেশি অপ্রকাশ্যও আবার অশ্বস্তির বস্তু, নিতে হয় মধ্যপন্থা। কোন বস্তু কী ভাবে চাইতে হয় শেখোনি?’
‘না, শিখিনি বিসাখা। কখনও ভাবিনি দূর দেশ থেকে আগত কতকগুলি বটু না-জানা না-দেখা কোনও পুরুষের সঙ্গে বিসাখার মতো মেয়ের বিবাহের ঠিক করে ফেলতে পারবে একেবারে পথের মাঝখানে, সহস্র ইতরজনের চোখের সামনে, এবং ঠিক সেই দিনই যে দিন বিসাখা তার আন্তরিক শুভার্থী, প্রণয়প্রার্থী, সুশিক্ষিত, ক্ষত্রিয়যুবাকে অতি সঙ্গত পূর্বে-লিপিতে-জানানো বিবাহ প্রস্তাবের জন্য গণ্ডে চপেটাঘাত করেছে।’
সহসা বিশাখার দুই চোখ জলে ভরে উঠল। সে কোনও কথা বলল না। চাঁদের আলো পড়েছে তার মুখে। জলভরা চোখদুটি সরোবরের মতো চকচক করছে।
মধ্যজ্যৈষ্ঠের সেই হলকর্ষণের দিনটি থেকে তিষ্য অনেক ভেবেছে। একা একা ঘুরেছে, সাকেত-অযোধ্যা গ্রামাঞ্চলে গিয়ে বসে থেকেছে দিনের পর দিন। কিন্তু বিশাখার সঙ্গে একটা মুখোমুখি বোঝাপড়া না হলে সে শান্তি পাচ্ছে না।
‘আমাকে যে ভালো লাগে না সে কথা তো লিপিতেই জানালে পারতে বিসাখা, আমি এই তিন বছর যে স্বপ্ন দেখে কাটিয়েছি তা দেখতাম না। কষ্ট হতো অতিশয়, কিন্তু আত্মসংবরণ কী করে করতে হয়, বৃশ্চিক দংশনের জ্বালা কী করে হাসিমুখে সহ্য করতে হয়, প্রকৃত ক্ষত্রিয় তা জানে।’
বিশাখা মাথা নেড়ে মৃদুতর স্বরে বলল, ‘তোমাকে ভালো লাগে না সে কথা তো সত্য নয় তিষ্য।’
‘সত্য নয়।’ তিষ্য আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো, তারপর লক্ষ করল বিশাখার চোখে জল। সে অভিভূত হয়ে বলল, ‘সখি বিসাখে, তুমি কাঁদছো?’ সে তার উত্তরীয় প্রান্ত বিসাখার চোখের জল মোছাবার জন্য তুলল।
বিশাখা একটু পিছিয়ে গিয়ে ধরা গলায় বলল, ‘আমাকে স্পর্শ করো না তিষ্য। জানো না, কৌমার্যরক্ষার জন্য আমাদের পিতা-মাতা অনুক্ষণ আমাদের প্রহরা দিয়ে রাখেন! জানো না, স্নানাগারে, শয়নকক্ষে পর্যন্ত দাসীরা আমাদের অনুসরণ করে। বিন্দুমাত্র সংশয় হলে স্বয়ং পিতা পর্যন্ত পরীক্ষা করে দেখতে কুণ্ঠা বোধ করেন না যে আমরা প্রকৃতই কুমারী কি না! যতই আদরিণী হই তিষ্য, আমরা, এই সাকেতের, রাজগৃহের, শ্রাবস্তীর, বারাণসীর সর্বত্র যেখানে যে আছি যত নারী, সবাই বন্দিনী। আভিজাত্য একটা ছলমাত্র। সুকৌশলে বন্দিত্ব আমাদের অভ্যাস করিয়ে নেওয়া।
তিষ্য অবাক হয়ে বলল, ‘বিসাখা, তুমি এই সব ভাবো! মুক্তি চাও? কোনদিন তো বুঝিনি? তুমি যদি বলো তো এই মুহূর্তে আমার অশ্বী মন্দ্রার পিঠে চাপিয়ে তোমাকে নিয়ে এই সাকেত থেকে উধাও হয়ে যেতে পারি।’
‘মুক্তি চাই, একথা তো বলিনি তিষ্য! চোখের জল মুছে বিসাখা বলল। ‘স্বর্ণশৃঙ্খলের যন্ত্রণা, আভিজাত্য-সর্পের দংশন- বেদনা যে কী ভাবে হাসিমুখে সহ্য করতে হয়, শ্রেষ্ঠীকন্যা তা জানে।’
‘সে কী? তাহলে কী চাও বিসাখা!’
‘এখনও ভালো করে জানি না তিষ্যভদ্র। জানি না কী চাই। কী চাওয়া উচিত এটুকুই চিরকাল শিখে এসেছি। অনুক্ষণ মনে সংশয় উপস্থিত হয়।’
‘আমাকে যদি ভালোবাসো বিসাখা, তো অনুমতি দাও।’
‘কী? মন্দ্রার পিঠে অনির্দেশ্যের পথে বেরিয়ে পড়বো?’
‘ধরো তাই।’
‘তারপর যখন ব্যালকান্তার এসে পড়বে, হিংস্র শ্বাপদেরা আক্রমণ করবে, যখন দস্যুরা আমাকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে, একজন দুজন নয় অসংখ্য দস্যু। অরণ্যে যখন রাক্ষস-যক্ষ আমাদের বেঁধে ফেলে কাঁচা ভক্ষণ করবার ব্যবস্থা করবে, কিংবা যখন অনুদক কান্তারে পড়ে হা জল যো জল করে প্রাণ যাবে?’
‘অত চিন্তা করলে মুক্তি পাওয়া যায় না বিসাখা। আমি ক্ষত্রিয়কুমার, দেহে বল আছে। অস্ত্রচালনা করতে পারি, তুমিও পারো শুনেছি, ভয় কী?’
‘ভয় নয় তিষ্য, হঠকারিতা করতে আমার প্রকৃতি আমাকে বাধা দেয়। আমি পিতামাতাকে প্রাণাধিক ভালোবাসি। তাঁদের প্রাণে দুঃখ দেবার চেয়ে বরং আমি মৃত্যুবরণ করবো।’
‘তাহলে? তাহলে বলো পিতাকে বলি তিনি বিবাহ-প্রস্তাব নিয়ে দূত পাঠান শ্ৰেষ্ঠীর কাছে। বিসাখা আমি হবো রাজা, সাকেতে নয়, বিন্ধ্য পেরিয়ে চলে যাবো দক্ষিণ দেশে, তুমি হবে আমার রানী।’
‘অগ্রমহিষী?’
‘নিশ্চয়ই।’
‘তারপর দ্বিতীয়া তৃতীয়া চতুর্থী? থাকবে না? বাবাতা পরিবৃত্তী, পালাগলী…. শাস্ত্রের সব নির্দেশ, ছাড়পত্র আছে না? রাজাদের জন্য?
‘বিসাখা আমি একপত্নীক থাকবো।’
‘রাজ্যাকাঙ্ক্ষী ক্ষত্রিয়ের পক্ষে একপত্নীক থাকা সম্ভব নয় তিষ্য। দেখো না, মহারাজ বিম্বিসার কোশলকুমারীর পর, ছেল্লনা দেবী, তারপর ক্ষেমা দেবীকে বিবাহ করলেন! কৌশাম্বীরাজ উদয়নের প্রথম যৌবনের গল্প শোননি? অবন্তী রাজকুমারী বাসুলদত্তাকে কত কাণ্ড করে অপহরণ করলেন। আর এখন? এখন তো কৌশাম্বীরাজের মহিষী সংখ্যা বছরে একবার করে বেড়ে যাচ্ছে। দোষ দিচ্ছি না। রাজ্যরক্ষা করবার জন্যেই অনেক সময়ে রাজাদের বারবার বিবাহ করতে হয়।’
‘তাই কি তুমি অজানা-অচেনা শ্ৰেষ্ঠীকুমারের মাল্য গ্রহণ করলে বিসাখা? একবার আমাকে জিজ্ঞাসা করলে না? প্রণয়ের কোনও মূল্য নেই?’
‘প্রণয় কী আমি জানি না তিষ্য।’ বিশাখা সহসা তার দীর্ঘপক্ষ্ম নীলাভ চোখ দুটি পরম সরলতার সঙ্গে তিষ্যর দিকে মেলে ধরে বলল।
‘জানো না? এই যে বললে আমাকে ভালোবাসো?’
‘তা তো বলিনি। তোমাকে ভালো লাগে না, এ কথা সত্য নয় এটুকুই বলেছি। তুমিই বলো না, পরস্পরের প্রতি কিছুদিনের আকর্ষণ, সন্তান উৎপাদন, গৃহস্থালী দেখা, তারপর ক্রমশ ক্রমশ বয়স বাড়া, জরার আক্রমণ, তারপর মরণের কোলে ঢলে পড়া। এই তো জীবন! এর মধ্যে প্রণয় কোনটা? মিলনের পূর্বের আকর্ষণটা? না নিয়মিত সন্তান উৎপাদনটা? না সুষ্ঠুভাবে গৃহস্থধর্ম পালন। করাটা? কোনটা?’
তিষ্য বলল, ‘সখি বিসাখে তুমি অতিসরলা না অতি বাক্পটু আমি বুঝতে পারছি না। আমার তক্ষশিলার শীলিত মস্তকটিও তুমি ঘুরিয়ে দিলে। বেশ, সহজ সরল কথায় বলো, রাজা উগ্রসেনের দূত যদি তাঁর জ্যেষ্ঠ কুমার তিষ্যর সঙ্গে ধনঞ্জয়-পুত্রীর বিবাহ-প্রস্তাব নিয়ে যায়, তুমি সম্মত হবে?’
‘আমার সম্মতির তো কোনও গুরুত্ব নেই তিষ্য! পিতা বুঝবেন কী করবেন।’
‘বুঝলাম বিসাখা,’ এতক্ষণে তিষ্য হতাশ হয়ে বলল, ‘আবার বুঝলামও না। আচ্ছা বিদায়। তবে তুমি রাণী হলে সে রাজ্যে আর কূটনীতিকের প্রয়োজন হবে না।’ তিষ্য কাননের ছায়ার মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর নিশীথরাত্রির বুকে ধাবমান অশ্বক্ষুরধ্বনি শোনা গেল।
মধ্যরাত পর্যন্ত উদ্যানেই বসে রইল বিশাখা। মা নেই বলেই হয়ত অন্তঃপুরের শাসন এখন কিছুটা শিথিল। নইলে, এই বিরাট আকাশ, এই শুন্য উদ্যান, জনমানবহীন এমন নিশীথরাত্রির অভিজ্ঞতা তার আগে কখনও হয়নি। কখনও কখনও অবশ্য সে তাদের সপ্তমতলের ছাতেও ওঠে। সেখান থেকে ধনধান্যময় বসুন্ধরা কত নিচে, কত দূরে মনে হয়। কিন্তু আকাশ কি কাছে আসে? আসে না তো! থেকে যায় ঠিক সেই একই প্রকার দূর। আর সেখানেও অনুচরী ব্যতীত ওঠবার অনুমতি তার নেই। ধনঞ্জয় শ্রেষ্ঠীর গৃহে তাঁর কন্যাকে কোনও নিষেধাজ্ঞা কখনও স্পষ্টভাবে শুনতে হয় মনে করলে ভুল হবে। কিন্তু গৃহের পরিমণ্ডলই কয়েকটি সামাজিক, পারিবারিক রীতি-নীতি, উচিত অনুচিতের অনুজ্ঞা দিয়ে গড়া, বুদ্ধিমতী বিশাখার বুঝে নিতে অসুবিধে হয় না কোথায় তার কাছ থেকে কী প্রত্যাশিত। তার বাইরে গেলে পিতা মাতাকে ব্যথা দেওয়া হবে। যেখানেই যাক বিশাখা, সে সরযূতীরেই হোক, কোনও শোভনোদ্যানেই হোক, বা নিজের গৃহের সপ্তমতলবর্তী ছাতেই হোক, পিপীলিকা-শ্রেণীর মতো দাসীরা তাকে অনুসরণ করে। এই প্রকারই রীতি। পিতা মাতার কখনও মনে হয়নি এই রীতির পরিবর্তন প্রয়োজন। বিশাখার জন্যে, অন্তত বিশাখার জন্যে। পিতা মাতাকে বিশাখা অত্যন্ত শ্রদ্ধা করে। তাঁদের বিচক্ষণতাতেও তার আস্থা আছে। পিতা তো এত পরিশ্রমী উদ্যোগী যে ভদ্দিয়তে পিতামহর সঙ্গে থাকবার সময়ে দ্বিতীয় শ্রেণীর ধনী ছিলেন। সাকেতে আসবার পর কয়েক বছরের মধ্যেই অক্লান্ত পরিশ্রমে যোতীয়, কাকবলীয় এঁদের সমকক্ষ হয়ে গেছেন! তাঁর বাণিজ্য স্থলে, জলে উভয়তই প্রসারিত হয়েছে। সূক্ষ্ম কার্পাস, ক্ষৌম, পট্টবস্ত্র, রেশম, পুব দেশের মধু এসব পাঠান পশ্চিমে, উত্তর-পূর্বের ঘন অরণ্যময় ভূমির একদিকে যেমন মধু ও কাঠ, অন্যদিকে অপেক্ষাকৃত উচ্চ ভূমিতে তেমন তাম্রপিণ্ড, অয়স্, নদীর বালুতে মিশ্রিত স্বর্ণরেণু, পাহাড়ের গহ্বরে প্রচুর মণিরত্ন পাওয়া যায়। আর কেউ জানে না, পিতা জানেন সেসব রত্নভাণ্ডারের ঠিকানা। এ ছাড়াও অজিন আসে পেটিকার পর পেটিকা, আসে চিত্র-বিচিত্র সাপের খোলস, ব্যাঘ্রচর্ম, গজদন্ত।
আর মা? তিনি এতই বিচক্ষণ যে রাজান্তঃপুরে কোনও দুরূহ সমস্যা হলেই তাঁর ডাক পড়ে। পিতামাতার বিবাহিত জীবনের প্রথম পর্ব রাজগৃহেই কেটেছে। সেই সময় থেকেই মহাদেবী ক্ষেমা ও কোশলকুমারীর সঙ্গে মায়ের অন্তরঙ্গতা। মহারাজ বিম্বিসার তো তাঁর শিশুকালের বন্ধু। মাস দুয়েক আগে দ্রুতগামী রথ এসে মাকে রাজগৃহে নিয়ে গেছে। কে জানে আবার কী সমস্যার উদয় হল সেখানে! যে কোনদিন মা এবার এসে পড়বেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে এই বিরাট শ্রেষ্ঠীসংসার বিশাখাই চালাচ্ছে। মা তো তাকে সম্পূর্ণ দায়িত্ব দিয়ে গেছেন। তবু কেন চলাফেরার বিধিনিষেধ ঘোচে না! তা কি সে কুমারী বলে? বিবাহের পর তাহলে এগুলি ঘুচবে? মাকে দেখে অন্তত এই মনে হয়। কিন্তু মায়ের কথা স্বতন্ত্র। অন্যান্য সব পরিবারের বধুরা তো কই…!
শুক্লপক্ষের জ্যোৎস্নায় বিধৌত হয়ে যাচ্ছে এখন কাননভূমি। বহুদূর থেকে শৃগালের রব শোনা যাচ্ছে। সহসা বিশাখা রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল। ছ-সাত বছর আগেকার একটি দিনের কথা তার মনে পড়ছে। বসন্তকাল। ভদ্দিয়র দিনান্ত শিমুলে পলাশে অশোকে সিঁদুরবর্ণ হয়ে রয়েছে। লাল মাটির পেটা পথটা চলে গেছে শস্যক্ষেতগুলির পাশ দিয়ে দিয়ে। কুম্ভকার পল্লী, কর্মকার পল্লী, সূত্রধর পল্লী পেরিয়ে চলে যাচ্ছে বিশাখার রথ গ্রামপ্রান্তের শালবনে। এখানে যেমন অঞ্জনবন, তেমনি নিবিড় সুন্দর সেই বনবীথি। বিশাখার সঙ্গে তার সখীরা, ভগ্নীরা, দাসীরা। দূর থেকে যেই বনটি দেখা অমনি সে নেমে পড়েছে। সবাই অবাক। বিশাখা চলেছে তার বসন সংবৃত করে, শালমঞ্জরী মাড়িয়ে মাড়িয়ে।
সবাই জিজ্ঞেস করছে, ‘নামলি কেন?’
‘শুনলি না, পিতামহ বললেন ভগবান বুদ্ধ তথাগত এসেছেন। তথাগতকে দেখতে কেউ রথে চড়ে যায়?’
বয়সে বড় এক পিতৃব্যকন্যা বলল, ‘তুমি কি ভেবেছ তথাগত মানে আকাশ থেকে এসেছেন? যিনি ইন্দ্র বরুণ যম অশ্বিনীকুমার এঁদেরও ওপরে থাকেন? যাঁর কথা সেদিন আচার্য দেবল বলছিলেন? মোটেই না। ইনি একজন সন্ন্যাসী। তথাগত একটা সম্ভ্রমের ডাক।’
বিশাখা হারবার পাত্রী নয়। সে বলল, ‘তাহলে তথাগত কেন বলে, বলো তো? তথা হতে আগত। সেখান থেকে এসেছেন। সেইখান, যেখানে দেবতারা থাকেন। সেখানে দেবতাদেরও পতি স্বয়ং ছাড়া আর কে থাকবেন?’
পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে সুলোচনা বলেছিল, ‘দুর, দেবতা কি চোখে দেখা যায়? যজ্ঞের সময়ে এত দেবতাদের ডাকা হয়, হবিঃ দিয়ে, পশুমাংস দিয়ে, দুগ্ধ দিয়ে, তা তাঁদেরই কি দেখা যায়, বল্?’
বিশাখার মনটা দমে গেল। তারপর শালবনের মর্মরধ্বনির মধ্যে তারা প্রবেশ করল। কেমন একটা মৃদু গুঞ্জন! প্রকৃতি কি মৃদুস্বরে গান গাইছে! না তো! আরও কিছুদূর এগোতে ওরা দেখল একটি শিংশপার মূলে একটি উঁচু মৃৎ-বেদীর ওপর একজন মানুষ বসে রয়েছেন। তাঁকে ঘিরে বনের মাটির ওপর আরও বহু জন। কথা বলছেন সেই পুরুষ। দূর থেকে তাকেই প্রকৃতির স্ব-কণ্ঠের সঙ্গীত বলে মনে হয়েছিল। উনি কথা বলছেন, একটি কাহিনী। থামলেন। বিশাখা এবং তার সখীদের দিকে তাকালেন, বললেন, ‘এসো বচ্চে বিসাখা, সুলোচনা, সিরিমা, কালী, রম্ভা এসো।’ উনি কী করে ওদের নাম জানলেন, তারা যে কজন সামনে দাঁড়িয়েছিল। সবার নাম! বিশাখা তার সখী ও ভগ্নীদের নিয়ে বসল। একেবারে ওঁর মুখোমুখি। দশ হাত দূরে। উনি বলতে আরম্ভ করলেন। সমস্ত মুখ প্রসন্নতায় ভরা, হাসছেন না তবু যেন হাসছেন। চোখ দিয়ে, ত্বক দিয়ে হাসছেন। ‘পৃথিবীতে যেদিকেই চাও দুঃখ, হে ভদ্দিয়বাসীরা। জরা, ব্যাধি, মৃত্যু, বিচ্ছেদ, অপমান, অকল্যাণ। যেদিকেই যাবে কোনও না কোনও রূপে দুঃখ এসে পথরোধ করে দাঁড়াবেই। করাল তার মুখ, লোল তার জিহ্বা, অতি ভীষণ তার দৃষ্টি। এ দুঃখ কি পরের করা? পরং কতং? এই জড় প্রকৃতি থেকে উৎপন্ন হচ্ছে? না কি আমাদের ভেতরে কেউ আছে সেই উৎপন্ন করছে? সয়ং কতং? না কি সয়ংকতং চ পরং কতং চ দুক্খম! নিজেরও করা, আবার পরেরও করা। অনেকে অনেক কিছু বলছেন। কিন্তু নানাভাবে তপস্যা করে অবশেষে আমি দেখলাম দুক্খ আত্মা নামক কোনও বস্তু থেকেও উৎপন্ন হয় না, আবার জড় প্রকৃতি থেকেও হয় না, আবার দুক্খ আকস্মিকও নয়। প্রকৃত কারণ হচ্ছে তন্হা। যতক্ষণ তন্হা ততক্ষণ দুক্খ।’
সভায় একটি দস্তুর বৃদ্ধ সহসা কেঁদে উঠল, ‘ভগবন, ভগবন, জরায় আমাকে আচ্ছন্ন করছে, মরণ আমার দ্বারে উপস্থিত। মহাদুঃখ সমাসন্ন, আমিও তার লোল জিহ্বা দেখতে পাচ্ছি। যে আমি সারা দিনে একটি গোটা গোবৎস শুলে পাক করে আহার করতে পারতাম, গোটা মহাশোল এবং রোহিত পলান্নের সঙ্গে প্রতিদিন দুই বেলা যার জঠরের পক্ষে কিছুই ছিল না, দুই ভৃঙ্গার ভর্তি বারুণী, মাধ্বী পান করেও যে অবিচলিত থাকত, চারটি বরারোহা স্ত্রী গৃহে বর্তমান, আরও ছটি সুদেহী শূদ্রা দাসী সব সময়ে সেবা করতে প্রস্তুত, তা সত্ত্বেও যার পৌরুষ এমন দুর্বার ছিল যে ভদ্দিয়র বারবধূ মদালসা তো বটেই, দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে যে রাজগৃহের শালবতীর গৃহে কামনা চরিতার্থ করতে যেত সেই আমি অশক্ত হয়ে পড়েছি ভগবন। খাদ্যে রুচি নেই। মাংসদর্শনে বিবমিষা আসে। এখন আমার চোখের সামনে দিয়ে স্বয়ং অম্বপালী হেঁটে গেলেও বোধহয় কামেচ্ছা হবে না।’
সভায় উপস্থিত একটি যুবক ঈষৎ হেসে নিম্নকণ্ঠে বলল, ‘এখানে কেন বৃদ্ধ শৃগাল, তুই তক্ষশিলায় আত্রেয় পুনর্বসুর কাছে চলে যা, দ্যাখ্ যদি সিংহবসা বা বানরলিঙ্গ থেকে তোর জন্য কিছু ওষুধ করে দিতে পারে! আরও দশ বছর রতিসম্ভোগ কর পথকুক্কুরের মতো! খালি ভদ্দিয়র এই সব সুন্দরী বালিকা কিশোরীগুলিকে সাবধানে রাখতে হবে।’ বলতে বলতে যুবক বিশাখার দিকে দৃষ্টিপাত করছিল। কেন কে জানে বিশাখার মধ্যে একটা ভয়ের শিহরন জাগল।’
এমন সময়ে শোনা গেল বুদ্ধ বলছেন : ‘তোমার এই নিরবচ্ছিন্ন ভোগেচ্ছা এই-ই তনহা। তনহা থেকেই জন্ম, জন্ম থেকেই জরা, মরণ। … সম্ভোগ করতে চাও কেন?’
‘সুখ হয় ভগবন, বড় সুখ, রোমকূপে, রোমকূপে। জঙ্ঘায়, লিঙ্গে, জিহ্বায়, ওষ্ঠে, বক্ষে, উদরে বড় সুখ!’
‘কিন্তু তার পরে?’
তার পরে দেহে অবসাদ, গ্লানি, তা দূর করতে আরও মৈরেয় আরও মৈথুন, আরও মৎস্য মাংস।’
‘তারপরে?’
‘তারপরে এখন অজীর্ণ, অগ্নিমান্দ্য, নিরুত্তেজিত ব্যর্থ দিনরাত। কিছু পারি না, কিছু পারি না আর। এর থেকে মুক্তির উপায় কী?’
গম্ভীর মধুর স্বরে তথাগত বললেন, ‘নিব্বানং পরমং সুখম্।’ কথা কটি কেমন ঢেউয়ের পরে ঢেউয়ের মতো সমস্ত বনে ছড়িয়ে গেল। নিব্বানং নিব্বানম্, উন্নতদেহ শালতরুগুলি ঊর্ধ্বমুখ করে যেন বলছে—নিব্বানম্ম্ম্ বনস্থলীর রক্তবর্ণ মাটি থেকে সুগন্ধিচুর্ণের মতো বাতাসে উথিত হচ্ছে পরমং সুখম্, পরমং সুখম্ম্ম্।
প্রতিটি ঘটনা, প্রতিটি কথা এখনও অবিকল মনে করতে পারে বিশাখা। কিন্তু এর পর? আর কিছু মনে নেই। শুধু অস্পষ্ট একটা অনুভব ছিল যে বিশাল সেই জনমণ্ডলী একদম স্তব্ধ। সেই বৃদ্ধের কান্নার শব্দ হঠাৎ যেন এক বিপুল গর্ভবতী নির্জনতা গ্রাস করে নিল। বিশাখার মা নেই, বাবা নেই, সখীরা, দাসীরা, ভ্রাতা-ভগ্নীরা নেই, খেলা নেই, গহনা নেই, উৎসব নেই, অথবা আছে, সব আছে। বর্জিত বস্তুর স্তূপের মতো অনেক নিচে পড়ে আছে। বিশাখা নিজেও নেই, আছে এক জ্যোতিঃসমুদ্র। তাতে ভাসছে তিনটি শব্দ নিব্বানং পরমং সুখম্।
কতক্ষণ সে এভাবে ছিল জানে না। যখন জ্ঞান হল দেখল সামনে পিতার মুখ। তিনি তাকে কোলে তুলে নিয়েছেন। পেছনে মা। হঠাৎ দৃষ্টিপথে এলো শালবন, বৃহতী জনসভা, সবার পেছনে অস্তাচলের আরক্ত আকাশ। পিতার চোখে বিন্দু বিন্দু অশ্রু। জিজ্ঞাসা করছেন, ‘ভগবন্, হঠাৎ কন্যার এমন অবস্থা হল কেন? কোনও অসুখ নয় তো? অপস্মার কি অন্য কিছু? আমাদের স্নেহের পুতলি যে এই কন্যা!’
‘না সেট্ঠি, বিসাখা সোতাপত্তি মার্গে প্রবেশ করেছে।’
‘সোতাপত্তি? সে কী ভগবন্?’
‘এখানে তথাগত চত্তার অরিয়সচ্চ (চার আর্যসত্য) ব্যাখ্যা করছিলেন, বিসাখা শুদ্ধ আধার। শুনতে শুনতে হৃদয়ঙ্গম করেছে। একেই সোতাপন্ন বলে। এ বিকার নয় সেট্ঠি। এ বিস্তার, বিহার।’
‘আমরা এতজন বয়স্ক মানুষ রয়েছি। কত বণিক, কত সেট্ঠি, কত গোট্ঠি জেট্ঠক, গহপতি, শিক্ষাবান যুবক সব। সবার মাঝখান থেকে এতটুকু একটি বালিকা কী করে এমন উচ্চতত্ত্ব হৃদয়ঙ্গম করল ভগবন্।’
‘মস্তিষ্ক দিয়ে তো নয়, জাগ্রত বোধি দিয়ে এ তত্ত্ব বোধিচিত্তে প্রবেশ করে সেট্ঠি, তুমি চিন্তা করো না। বিসাখাকে গেহে নিয়ে যাও।’
জ্যোৎস্নার সমুদ্র এখন কানন প্লাবিত করে দিচ্ছে। বিশাখা সেই জ্যোতিঃসত্ত্ব বুদ্ধ তথাগতকে দৃষ্টিপথে আনবার চেষ্টা করল, পারল না। স্মরণে আসছে, কিন্তু সেদিনকার দেখা সেই মূর্তি নয়। তাঁর অন্য রূপ। মেণ্ডক-গৃহে ভোজনে বসেছেন এক অনিন্দ্যকান্তি যুবাপুরুষ। উজ্জ্বল গলিত স্বর্ণের মতো গাত্রবর্ণ। মাথায় কেশপুঞ্জ সবে গজাতে আরম্ভ করেছে। কুঞ্চিত পুঞ্জ পুঞ্জ কৃষ্ণকেশ। আকর্ণবিস্তৃত পদ্মপলাশের মতো নয়ন দুটি। সিংহকটি। মেরুদণ্ড শালবৃক্ষের মতোই সোজা। পুরস্ত্রীরা অনেকেই তদ্দণ্ডে তাঁর কাছে দীক্ষিত হবার জন্য আবেদন করেছিল। তার এক পিতৃষ্বসা, যিনি নাকি প্রথম স্বামী বাণিজ্যে যাবার বারো বছর পরে তখন সবে মোক্ষ (বিবাহ-বিচ্ছেদ) নিয়েছেন, পিতামহ তার আবার বিবাহের ব্যবস্থা করছেন, তিনি হঠাৎ নিজের কেশগুচ্ছ ধরে লুটিয়ে পড়েছিলেন সেই যুবার চরণে।
‘বিবাহ নয়, পব্বজ্জা দিন, ভগবন্।’
বিশাখা দেখল জ্যোৎস্নাময় বীথিপথ ধরে তার পিতা এগিয়ে আসছেন। শেষ রাত। চাননা আকাশটির কপালে শুকতারার টিপটি ক্রমশই জ্বলজ্বল করতে শুরু করেছে। সে এতক্ষণ কাননে ছিল?
পিতা সস্নেহে বললেন, ‘মা বিসাখা, তুমি ঘুমোতে যাওনি?’
বিশাখা সহসা উত্তর দিতে পারল না। এবার ধনঞ্জয়ের কণ্ঠে উদ্বেগ গোপন রইল না। তিনি তাকে সামান্য নাড়িয়ে বললেন—‘মা, কোনও কারণে অভিমান করেছ? ঘরে চলো। মায়ের জন্যে কি উৎকণ্ঠিত হয়েছ? কিছুক্ষণ আগে অগ্রদূত এসেছে তোমার মায়ের সংবাদ নিয়ে। তিনি আজ দ্বিপ্রহরের মধ্যেই পৌঁছে যাবেন।’ বিশাখা দেখল সে উঠতে পারছে না। অথচ হাত পা ধরে যায়নি, সে কথাও বলতে পারছে না। অথচ জিভ দাঁত সবই সে পরিষ্কার নাড়াতে পারছে। ভেতরে কেমন একটা স্তব্ধতা। অনুভূতপূর্ব। তখন ধনঞ্জয় তাকে দুই হাতে করে তুলে নিলেন। যেন দুই হাতে তুলে নিয়েছেন তিনি একটি পদ্মের মালা। সেইভাবে চলতে চলতে ধনঞ্জয় ভাবলেন—‘কী হল? প্রথম বুদ্ধ দর্শনে মায়ের আমার এমনই যেন ভাবান্তর হয়েছিল! আবার, কি তেমনি হল?’ অন্তঃপুরের দ্বারে গিয়ে তিনি ডাকতে লাগলেন, ‘কহ্না, ধনপালি, কোথায় গেলি সব? বিসাখাকে ঘরে নিয়ে যা।’
বিশাখা ধীরে ধীরে বাবার কোল থেকে নেমে দাঁড়াল। স্বপ্নোত্থিতর মতো বলল, ‘পিতা, ওদের বকো না। আমিই ওদের জোর করে শুতে পাঠিয়েছিলাম? ওরা যেতে চায়নি।’
‘কী হয়েছে মা তোর?’ ধনঞ্জয় যেন প্রাণ ফিরে পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
‘কিছু হয় নি তো! তোমার কোলে ওঠবার সাধ হয়েছিল হয় তো। পিতা। শীঘ্রই তো পরহস্তগতং ধনম্ হয়ে যেতে হবে। তাই…।’
ধনঞ্জয় বিশাখার মাথাটি বুকে চেপে ধরে বললেন, ‘এমন করে বলো না মা। পিতা-মাতার থেকে তোমাকে কেউ বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না। দেখো, তুমি কত সুখী হবে।’ কোথায় উদ্যানের মধ্যে কোন গাছ থেকে একটা তক্ষক ডাকছে। তক্ খক্ তক্ খক্ তক্ খক্। ভোরের অরুণাভা এসে রাঙিয়ে দিতে আরম্ভ করেছে উঁচু উঁচু গাছের শীর্ষ শাখাগুলি। পাখি ডাকছে।
৯
কয়েকটি দীর্ঘ কটাক্ষে কক্ষটি ভালো করে দেখে নিল চণক। একজন রাজার শয়নকক্ষ, ভোজনকক্ষ এসব দেখে কি তাঁর মন বোঝা যায়! হয়তো যায় না, কারণ রাজপুরীর বিভিন্ন অংশ কেমন হবে না হবে সেটা একটা রাজকীয় প্রথার ব্যাপার। তবে, রুচির প্রশ্নও নিশ্চয় আছে। যা প্রথা তার থেকে রুচিকে স্বতন্ত্র করে ফেলার চেষ্টা করে চণক। গান্ধাররাজের ভোজনশালার সঙ্গে এ কক্ষের কোনও তুলনাই হয় না। সরল, নিরাড়ম্বর, ইস্টক নির্মিত কক্ষ। বৃহৎ। কিন্তু খুব বেশি বৃহদায়তন নয়। দেয়ালে রঙিন ভিত্তিচিত্র, হর্ম্যতল কাঠের। অতি মসৃণ। ঘরটির মধ্যে চারটি চারটি আটটি স্তম্ভ রয়েছে। পীঠগুলি চতুষ্কোণ। তার ওপর প্রস্ফুটিত কমলের মধ্যে থেকে সুগোল স্তম্ভগুলি উঠে গিয়ে ছাদটিকে ধরে রেখেছে। ছাদ সমান, মসৃণ। শুধু মাঝখানে একটি সহস্রদল পদ্ম। রাজার বসবার আসনের পিছনে একটি ভাস্কর্য। দুদিক থেকে দুটি হাতি সামনের পা এবং শুঁড় তুলে উভয়ের মাঝখানে একটি প্রকোষ্ঠের মততা সৃষ্টি করেছে। তারই সামনে চিত্রবর্ণ স্থূল রাজাসন। চণককে এনে দাসীরা বসিয়েছে অতি স্থূল, অতি কোমল আসনে, সামনে ভোজন ফলক।
কিছুক্ষণের মধ্যেই কক্ষের একদিকের শুক্ল বস্ত্রাবরণী সরিয়ে দু পাশে দুটি সুন্দরী যুবতী নিয়ে বিম্বিসার প্রবেশ করলেন। চণক লক্ষ করল যুবতী দুটি পিঙ্গল বর্ণ। রাজার পরনে পীতাভ কাপার্সবস্ত্র, নগ্ন বক্ষে চন্দন আর হরিতালের অবলেপ। পীত উত্তরীয়। শুভ্র মার্জিত উপবীত। কপালেও চন্দন হরিতালের তিলক। ঘন কেশ সুবিন্যস্ত, স্নানান্তের স্নিগ্ধতা সর্ব অঙ্গে। শালপ্রাংশু ভুজের ওপর মুক্তার অঙ্গদ, কানে মুক্তার কুণ্ডল, কিন্তু কণ্ঠে শুধু একটি অতি স্থূল জাতী পুষ্পের মালা। মহারাজ বিম্বিসার সত্যিই অতি সুপুরুষ।
চণক উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করেছিল। রাজার মুখে চণককে দেখে একটি বিচিত্র হাসি ফুটে উঠেছে। প্রতিনমস্কার করলেন সুভদ্র ভঙ্গিতে। বাতায়নপথে বর্ষার সজল হাওয়া প্রবেশ করছে, সেদিকে তাকিয়ে বীজনকারিণী দাসী দুটির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোমাদের ছুটি, সুনন্দে, সুভদ্দে,’ আভূমি প্রণাম করে ছন্দিত পায়ে দাসীদুটি চলে গেল। ভারে ভারে খাদ্যবস্তু আসতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর গন্ধে, বর্ণে ভোজনকক্ষটি আমোদিত হয়ে উঠল।
রাজা বললেন, ‘চণকভদ্র, এ ভাবে আপনার দেখা পাবো, কখনও ভাবিনি। আমাকে অনুগ্রহ করে আচার্যদেবের কথা শোনান। আমার যা কিছু সত্যিকারের শিক্ষা তা আচার্য কাত্যায়ন দেবরাতের কাছেই।’
চণক ধীরে ধীরে বলল, ‘মহারাজ, পিতা গত হয়েছেন, কিন্তু তাঁর শেষ আদেশ ছিল আমি যেন মগধে এসে আপনার সঙ্গে মিলিত হই।’
বিম্বিসার পরম বিস্ময়ভরে বললেন, ‘আচার্য বলেছিলেন! এর নিশ্চয় কোনও গূঢ়ার্থ আছে। বলুন ভদ্র?’
চণক একই সুরে বলল, ‘পিতা আমাকে বলেছিলেন তাঁর আশীর্বাণীর কথা আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিতে।’
জোড়াসনে বসে ডান কনুইয়ে ডান ঊরুর ওপর ভর দিয়ে বসেছিলেন বিম্বিসার। ধীরে ধীরে সোজা হয়ে বসলেন, মৃদু স্বরে বললেন ‘আপনি জানেন!’
‘জানি। সবটাই।’
কিছুক্ষণ নীরব থেকে গবাক্ষের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে রাজা বললেন, ‘সে তো আশীর্বাদ যতটা, আদেশ তার চেয়েও অধিক।’
চণক বলল, ‘হয়তো তার চেয়েও অধিক প্রার্থনা।’
‘কী বলছেন! আচার্য আমার জীবনে সবচেয়ে মাননীয়।’
‘কোনও কোনও ব্যাপারে ক্ষত্রিয়ের কাছে ব্রাহ্মণকে প্রার্থী হতে হয়, প্রজ্ঞাদৃষ্টিকে নির্ভর করতে হয় বলবীর্যের ওপর।’
নীরবে খেতে লাগলেন দুজনে। কিছুক্ষণ পর বিম্বিসার বললেন, ‘ভদ্র, আপনি আমার থেকেও অনেক শেখবার সুযোগ পেয়েছেন আচার্যর কাছ থেকে, তিনি ছিলেন আশ্চর্য মানুষ, যেন একটি জ্বলন্ত উল্কা। কিন্তু সে তাঁর ভেতরটা। অনির্বাণ অগ্নিশিখার মতো জ্বলছে, জ্বলছে। এমন আগুন যা পোড়ায় না, দীপ্তি দেয়, যে ইচ্ছে করবে তার থেকে আত্মদীপ জ্বালিয়ে নিতে পারে। ভেতরে অমন আগুন, কিন্তু বাইরেটা স্নিগ্ধ যেন চন্দনতরু।’ এতক্ষণ যেন আত্মগত বলছিলেন, এবার চণকের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনি বয়সে তরুণ, কিন্তু নানা বিদ্যায় পারদর্শী বলেই মনে হচ্ছে আমার। আপনার নিজস্ব বিচারবুদ্ধি কী বলে?’
চণক বলল, ‘পিতার আশীর্বাণী সত্য হবে।’
হঠাৎ যেন ব্যাকুলভাবে বিম্বিসার বলে উঠলেন, ‘আচার্যপুত্ৰ চণক, আপনি কি শুধু এই কথা স্মরণ করিয়ে দেবার জন্যেই এসেছেন?’
না মহারাজ আগেই বলেছি, পিতা আদেশ করেন আমি যেন আপনার সঙ্গে মিলিত হই। ঠিক এই ভাষা। এর কোনও ব্যাখ্যা তিনি দেননি, বা দেবার সময় পাননি। কণ্ঠরোধ হয়ে গিয়েছিল। দেব পুষ্করসারী যখন এই দৌত্যকর্মে আমায় নিযুক্ত করলেন, একমাত্র তখনই আমি পিত্রাদেশ পালন করবার সুযোগ পেলাম।’
বিম্বিসার বললেন, ‘আহার্য সব পড়ে রয়েছে ভদ্র। গ্রহণ করুন।’ নীরবে ভোজন চলতে লাগল। সুবাসিত পলান্ন, তিন প্রকারের। চণক বুঝতে পারলেন বিম্বিসার এখন ভাবছেন। তিনি কি সেই অল্পসংখ্যক মানুষদের একজন যাঁরা কোনও সময়ই বৃথা যেতে দেন না! তিনি ভোজন করছেন ঠিকই, হাতের তিনটি আঙুল ঘোরাফেরা করছে মৎস্যের পাত্রে, কিন্তু তিনি ভাবছেন। নানাবিধ মৎস্য ও মাংসের পদ পরিবেশন শেষ হয়ে গেলে, মহারাজ আবার কথা বললেন, ‘দৌত্যকার্যটি কি আপনার গৌণ?’
চণক হেসে বলল, ‘না মহারাজ, একেবারেই না। এই আমার প্রথম দৌত্য। বিফল হলে বড়ই অপযশ হবে। বিশেষত দেব পুষ্করসারী আমাকে নবীন এবং অল্পদর্শী ভেবে আমার বয়োজ্যেষ্ঠ মহামাত্রকে যথাযথ উপদেশ ও লোকজনসহ আমার পেছনে পাঠিয়েছেন।’
বিম্বিসার মৃদু হেসে বললেন, ‘চণক ক্ষুব্ধ বোধ করছেন তাহলে!’
চণক নীরব রইলো।
কিছুক্ষণ পর বিনা ভূমিকায় বিম্বিসার বলে উঠলেন, ‘মগধরাজ্যের স্বার্থে প্রদ্যোত মহাসেনকে আমায় শান্ত রাখতে হয়। তাঁর জামাতা কৌশাম্বীরাজ উদয়নের সঙ্গে আমার প্রীতির সম্পর্ক। এদিকে কোশলরাজ ও লিচ্ছবিরা আমার মিত্র; শুধু এই কারণেই প্রদ্যোত এখনও আমায় উত্ত্যক্ত করেননি। কিন্তু কোনও কারণ পেলে করতে দ্বিধা করবেন না। কদিন আগেই আমার বৈদ্য জীবককে হত্যা করতে ছুটেছিলেন।’
‘জীবককে! হত্যা?’ চণক আশ্চর্য হয়ে বলল।
‘সে এক কাহিনী! জীবককে তিনি চেয়ে পাঠালেন তার খ্যাতি শুনে। যাবার সময়ে আমি তাকে সাবধান করে দিই। যে কোনও সূত্র পেলে অতি ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেন এই রাজা। জীবক গিয়ে শুনল উনি তৈলাক্ত বা ঘৃতসিক্ত কোনও আহার্য সহ্য করতে পারছেন না। কামলা রোগে এমনই হয়। কিন্তু জীবককে তার ভৈষজ ঘৃতে মিশ্রিত করে দিতেই হবে। বমনোদ্রেক হবে কিন্তু ওই ভৈষজ শরীরে গেলেই উনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। আমার সতর্কবাণী জীবকের মনে ছিল। সে রাজার কাছ থেকে আগেই একটি দ্রুতগামী হাতী সংগ্রহ করে রেখেছিল। ভৈষজ পাঠিয়েই জীবক ওই হাতীতে চড়ে সারারাত ভ্রমণ করে উজ্জয়িনীর সীমানা অতিক্রম করে আসে। ঔষধ খাওয়ার কিছুক্ষণ পরই প্রদ্যোত বুঝতে পারেন ঘৃত মিশ্রিত আছে, বমনও হয়। অমনি জীবকের প্রাণদণ্ডাজ্ঞা হয়ে গেল। পেছনে লোক ছুটল। চিন্তা করুন, মগধের রাজবৈদ্য! নিজে তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন, কোনও দিক ভাবলেন না, ভদ্রতা না, করুণা না কূটনীতি না। ভাগ্যে জীবক বুদ্ধি করে পালিয়ে এসেছিল!’
‘তারপরে?’ চণক সকৌতুকে জিজ্ঞেস করল।’
‘তারপর তো সেরে গেলেন। ওই একবারের ওষুধ প্রয়োগে! তখন আনন্দিত হয়ে মূল্যবান বস্ত্র ইত্যাদি পাঠিয়ে দিয়েছেন। তা, এই তো মগধের চিত্র, আর এই মহাসেনের চরিত্র! একেবারে খ্যাপা রাজা। এখন ভদ্র চণক, আপনিই বলুন আমার কী করা উচিত।’
চণক হেসে বলল, ‘আপনার কর্তব্য কি চণকের পরামর্শের ওপরই নির্ভর করে আছে? চণক আচার্যপুত্র বলে?’
বিম্বিসার হেসে একটি স্থূল গোমাংসখণ্ড মুখে পুরলেন, তার পরে বললেন, ‘না। তা নয়। তবু আপনি বলুন।’
চণক বলল, ‘প্রথমে দেব পুষ্করসারীর আস্থাভাজন দূত এবং গান্ধারাজসভার একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী অমাত্য রূপে বলছি, ‘মহারাজ অবিলম্বে গান্ধাররাজকে লিপি পাঠিয়ে আশ্বস্ত করুন, তারপর সৈন্যবাহিনী নিয়ে এদিক থেকে অবন্তীকে উত্ত্যক্ত করুন। ছোট ছোট সেনাদল দস্যু সেজে গিয়ে অবন্তীর প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলি ছারখার করে দিতে থাক। যাতে প্রদ্যোতরাজ অপরের রাজ্যের গ্রামগুলি বিনষ্ট করা থেকে বিরত হয়ে, নিজের রাজধানীর দিকে নজর ফেরাতে বাধ্য হন।’
বিম্বিসার বললেন, ‘প্রদ্যোত যখন ক্রুদ্ধ হয়ে কারণ জানতে চাইবেন, কী বলব?’
চণক বলল, ‘ওরা তো দস্যু দল! মোটেই মগধের সেনা নয়! প্রদ্যোত ওদের দমন করুন। আপনি বলবেন আপনিও করছেন। কিন্তু আসলে আপনি মোটেই কিছু করবেন না!’
বিম্বিসার সবিস্ময়ে বললেন, ‘মিথ্যা বলব? মিথ্যাচরণ করব?’
চণক বলল, ‘বৃহত্তর স্বার্থে মিথ্যাচরণ তো করতেই হয়। আপনি কি এই রাজগৃহ গিরিব্রজর পুরনো কাহিনীটি শোনেননি মহারাজ?’
‘কোন কাহিনী?’
‘রাজা জরাসন্ধের পতনের কাহিনী! কীভাবে তিনি বিভিন্ন দেশের রাজাদের বন্দি করে রেখে দিতেন। তারপর কুরুবংশের দুই বীর ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে আসে। ভীমসেন নামে একজন তাঁকে মল্লযুদ্ধে আহ্বান করে মেরে ফেলে। ব্রাহ্মণ নয় বুঝলে তো জরাসন্ধ সম্মতই হতেন না—কিন্তু মিথ্যাচরণ যেন রাজকৃত্যের অঙ্গ না হয়ে যায়, আতুরে সত্যাচারো নাস্তি। কিন্তু সে শুধুই আতুরে…।’
বিম্বিসার সারাক্ষণ চণককে নিরীক্ষণ করছিলেন, এবার হেসে বললেন, ‘ভালো। ভালো। আর মগধরাজের সতীর্থ, পরামর্শদাতা, মন্ত্রী হিসেবে চণক কী বলেন?’
চণক গম্ভীরভাবে বলল, ‘মহারাজ পূর্বাস্য হয়ে থাকুন আপাতত, দক্ষিণ দিকেও মুখ ফেরান, কদাপি পশ্চিমাস্য হবেন না।’
বিম্বিসার চমকে হাতের পাত্র নামিয়ে রাখলেন, বললেন, ‘আচার্যপুত্র, আপনি আমার মনের কথা জানলেন কী করে?’
চণক স্মিত মুখে বলল, ‘আপনার মনের কথা আমি কী করে জানবো বলুন! তবে উত্তর থেকে মধ্যদেশে এসেছি। এসেছি দেখতে দেখতে, ভাবতে ভাবতে।’
বিম্বিসার হঠাৎ কোমল অনুনয়ের সুরে বললেন, ‘ভদ্র চণক, সতীর্থ হিসেবে বিম্বিসার আপনার কাছে অনুরোধ করছে, আপনি রাজগৃহে থাকুন, মগধরাজসভায় আপনার অর্থধর্মানুশাসক পদপ্রাপ্তির কথা আমি অবিলম্বে ঘোষণা করছি।’
চণক বলল, ‘মহারাজ, দেব পুষ্করসারীকে আপনি কী ভাবে সাহায্য করবেন, বললেন না তো।’
‘আমি অবিলম্বে তাঁকে আশ্বস্ত করে লিপি পাঠাচ্ছি। কিন্তু আপনি তো জানেন, এই লিপিই সব। আমার আশ্বাসের পেছনে শুভকামনা থাকবে কিন্তু কোনও অস্ত্রের টংকার থাকবে না। তবে একটা কথা, প্রদ্যোত মহাসেন কোনও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করেন না। বললাম না, খ্যাপা রাজা! এখন ইচ্ছে হয়েছে গান্ধারসীমান্তে বীরত্ব ফলাচ্ছেন। ঝোঁক চলে গেলেই আবার সৈন্য গুটিয়ে নেবেন। বরং তোড়জোড় করে ভিন্নরাজ্যের সঙ্গে মিলিত হয়ে তাঁকে বাধা দেবার চেষ্টা করলেই তিনি ক্ষিপ্ত ও উগ্র হয়ে আরও ক্ষতি করবার দিকে ঝুঁকবেন!’
চণক বলল, ‘বুঝলাম। মহারাজ অসাধারণ কূটনীতিজ্ঞ। এবং মহারাজের চর চরাচর ছেয়ে আছে। কিন্তু আমি তো মগধরাজসভায় যোগ দিতে পারবো না। মহারাজ ক্ষমা করবেন।’
‘সে কী!’
‘প্রথম কথা, দেব পুষ্করসারী তাতে অত্যন্ত ব্যথিত ও ক্রুদ্ধ হবেন। আমি তা চাই না। দ্বিতীয়, আমার উদ্দেশ্য অন্য। মহারাজের মন্ত্রিসভায় থাকলে সে উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে না যে!’
দাসীরা এইবার মিষ্ট পদগুলি নিয়ে আসছে। আগেকার ভোজনফলকগুলি তুলে নিয়ে, গজদন্তের কারুকার্যময় ছোট দুটি ফলক রেখে গেল সে জায়গায়। বিম্বিসার বললেন, ‘কী তোমার জীবনের উদ্দেশ্য, জানতে পারি, আচার্যপুত্র?’
‘আমি পরিব্রাজক।’
‘পরিব্রাজক! তুমি কি সন্ন্যাস নিতে চাও?’
‘সন্ন্যাসী নয়, সংসারত্যাগী নয়, মহারাজ। শুধু দেখতে চাই। এই জম্বুদ্বীপের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত দেখতে চাই। বুঝতে চাই।’
‘তুমি তাহলে একজন ভ্রমণাসক্ত কর্মভীরু? এত শিক্ষা, এত পাণ্ডিত্য, এত বুদ্ধি, মেধা, বিষয়জ্ঞানের পরেও! চণক ভদ্র, তুমি আমাকে হতাশ করলে।’
‘আমি কর্মভীরু নই মহারাজ। আপাতত শুধু বন্ধনভীরু। আমি শুধু ভ্রমণের জন্যই ভ্রমণ করতে চাই, তা নয়। আমি বুঝতে চাই জম্বুদ্বীপ কি গান্ধার, মদ্র, মিথিলা, চেদি, অবন্তী, মগধ, বৎস, কোশল, কলিঙ্গ এইরূপ! না নদীবিধৌত, অরণ্যঋদ্ধ, পর্বতসমুদ্র দ্বারা সুরক্ষিত এক বিশাল ভূমি। দেবতা প্রদত্ত, দেব পরিকল্পিত এক বিশাল ভূখণ্ড, যা আদৌ খণ্ড নয়। আর যদি খণ্ড-খণ্ডই হয় তো কী সেই সূত্র যা উজ্জ্বল মণিগণের মতো এই খণ্ডগুলিকে গাঁথবে? আপনি জানেন নিশ্চয়ই মহারাজ, উত্তর-পশ্চিমে উপরিশ্যেন পর্বতের ওপারে গড়ে উঠছে এক বিরাট সাম্রাজ্য। সেই সম্রাটের নাম কুরুস। ইনি অত্যন্ত ক্ষমতাশালী। এমন আরও আছে। আরও হবে, আসবে—এরা কিন্তু আসবে। তখন গান্ধার, মগধ, অবন্তী, আমরা একলা একলা দাঁড়িয়ে মার খাবো, নিঃশেষ হয়ে যাবো, না সমবেত হবো। সমবেত হলে কী ভাবে হবো? সমস্ত জম্বুদ্বীপবাসীরা তাদের একমাত্র রাজার পতাকার তলায়? না ছোট ছোট রাজার ছোট্ট ছোট্ট সৈন্যদলে, তাদের মধ্যে কোনও কোনও রাজা সমুদ্র পার থেকে আসা রাজাদের সঙ্গে যোগ দিতেও পারেন। যদি পিতার আশীর্বাদ সত্য করার পথে অগ্রসর হতে চান, তাহলে যত দূরেই থাকি আমি আপনাকে সাহায্য করব। আমার পরিব্রজন আপনার কার্যসাধনই করবে।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিম্বিসার বললেন, ‘এভাবে ভ্রমণ করলে কিন্তু আপনার বহু ব্যবহারিক অসুবিধে হবে। তখন কী করবেন?’
‘মহারাজ যদি অনুগ্রহ করে সেই অসুবিধাগুলি দূর করবার ব্যবস্থা করে দেন, তো উত্তম। না দিলেও আমি নিজেই সেগুলি অতিক্রম করার চেষ্টা করে যাবো। তবে তাতে কিছু অমূল্য সময় বৃথা ব্যয় হয়ে যাবে। এখন মহারাজের যা ইচ্ছা! পিতা আমাকে আপনার সঙ্গে মিলিত হতে বলেছিলেন।’
চমকে উঠে বিম্বিসার বললেন, ‘আচার্য কি এইভাবে জম্বুদ্বীপ পরিক্রমা করে আমাকে সংবাদ দিয়ে সাহায্য করতে বলে গেছেন আপনাকে?’
চণক হেসে বলল, ‘না মহারাজ। আচার্য কাত্যায়ন দেবরাত শিষ্যকে চিরকাল পুরনো পরামর্শের শৃঙ্খলভারে বন্দী করে রাখবার মানুষ নন। তিনি আমাদের বুদ্ধি-বৃত্তির উন্মেষ ঘটিয়েছেন। এখন আমরা স্বাধীনভাবে সেই ইচ্ছাশক্তি ও বুদ্ধির ব্যবহার করবো। আমি এবং আপনি। তা ছাড়া সেভাবে সংবাদ সংগ্রহ করা তো চরের কাজ মহারাজ, আমি সে ভার নিতে পারি না। মানুষের ব্যবহার, কার্যকলাপ, উদ্দেশ্য, স্বার্থ, ভাষা, এই সবের ভেতরে তার একটা অন্য পরিচয় আছে। আমি সেই পরিচয় পেতে আগ্রহী।’
‘ওহ্, আপনি তবে আত্মার সন্ধানী? সন্ন্যাসীর সঙ্গে সে ক্ষেত্রে আপনার পার্থক্য কী রইল ভদ্র! আমি আপনাকে ঠিক বুঝতে পারছি না।’
মহারাজ মুখ প্রক্ষালন করলেন।
‘আত্মা নয়। আত্মা তো পণ্ডিতেরা বলছেন এমনই বস্তু যা দেখা যায় না, বাঁধা যায় না, মরে না, জন্মায় না। আমি যা খুঁজছি তার জন্ম মরণ সবই আছে। এই বিচিত্র ভূখণ্ডকে তার বিভিন্ন মানবগোষ্ঠী সহ আমি বুঝতে চাই। এই যাত্রার যা সুফল তা আপনিই ভোগ করবেন। আমি আপনার সঙ্গে মৈত্রীবন্ধনে বাঁধা। আর কোনও বন্ধন স্বীকার করব না।’
অভিভূত হয়ে বিম্বিসার বললেন, ‘তোমাকে ভালো বুঝলাম না চণক। কিন্তু এটুকু বুঝেছি, তোমার মৈত্রী অমূল্য। ঠিক আছে। তুমি তোমার পথে চলো। রাজগৃহে তোমার জন্য আমি একটি গৃহ ঠিক করে দিচ্ছি। রাজকোষ থেকে তুমি প্রয়োজনমতো অর্থাদিও পাবে। পরিব্রজন কালে তোমার অসুবিধা না হয় এ আমি দেখব। চরেদের ওপর তোমার সম্পর্কে যথাযথ নির্দেশ দেওয়া থাকবে। এখন আলিঙ্গন দাও বন্ধু।’
চণক ক্ষিপ্রগতিতে উঠে দাঁড়িয়ে দুহাত বাড়িয়ে রাজাকে আলিঙ্গন করল। দৈর্ঘ্যে তারা প্রায় সমান সমান। চণক অল্প বড় মাথায়। কিন্তু মহারাজ যাকে বলে বৃষস্কন্ধ মহাভুজ। চণক দেখল, মহারাজের চোখ চকচক করছে। তিনি বললেন, ‘চণক, আমি বন্ধুহীন, বড় একা। রাজপদ আমাকে এরূপ করেছে। আচার্য কাত্যায়নের শিক্ষাও আমাকে এমন করেছে। আমি কি একজন বন্ধু পেলাম?’
চণক বলল, ‘সমগ্র জম্বুদ্বীপে যদি কোথাও একবিন্দু বন্ধুত্ব থাকে আপনার জন্যে তবে তা থাকবে চণকের কাছে। আমি কোনও স্বার্থসিদ্ধির জন্য আপনার কাছে আসিনি মহারাজ। আপনি সবকিছুতে জ্যেষ্ঠ হয়েও যখন এমন অকপটে আমাকে এত কথা বললেন, আমিও অকপটে বলি আপনি আমার স্বপ্নদৃষ্ট মানুষ।’
রাজপুরী থেকে ফেরবার সময়ে চণক হেঁটে ফিরছিল। মহাবিদ্যালয়নগরী তক্ষশিলার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যেতে সে কি তার দুটি পা-কেই প্রধান অবলম্বন মনে করেনি? এতদিন রাজকার্য ছিল, সে ছিল গান্ধারের মহামান্য দূত। কিন্তু এখন? এখন তো সে পরিব্রাজক চণক। যেতে যেতে সে মনে মনে স্বীকার করতে বাধ্য হল, বিম্বিসার খুব নরম মনের মানুষ। তার মতো কঠিন ধাতুর নন। বিম্বিসার বুদ্ধিমান, চতুর কূটনীতিক, সবই ঠিক। কিন্তু স্নেহ বা মোহের বশে হঠকারিতা করতে পারেন। যেমন শ্ৰমণ গৌতমকে সেনাধ্যক্ষ না সবাধ্যক্ষ কীসের একটা পদ দিতে চেয়েছিলেন। যেমন আজ প্রথম আলাপেই তাকে অর্থধর্মানুশাসক করতে চাইলেন। এ পদগুলিতে কেউ না কেউ আছেন নিশ্চয়। হঠাৎ তাঁকে বিনা কারণে অপসারিত করলে সে রাজপুরুষ তো নিমেষেই রাজার ঘরশত্রু হয়ে উঠবেন! চম্পা নগরীর বিপুল রাজস্বও সোনদণ্ড নামে এক ব্রাহ্মণকে দান করেছেন রাজা, যজ্ঞের দক্ষিণা হিসেবে। এ কি তিনি পুরুষানুক্রমিক রাজবংশের উত্তরাধিকারী নয় বলে? রাজারা যে ভালো কাজ করেন না, অতিরিক্ত দান করেন না তা নয়, কিন্তু করেন রাজকর্তব্য বলে, কখনও বা গোপন কোনও স্বার্থের কথা চিন্তা করে। কিন্তু বিম্বিসার যখন করেন, করেন তিনি ভালো মানুষ বলে। দয়া, মায়া, স্নেহ, প্রেম যে-সব উপাদান দিয়ে মানুষ গঠিত হয় সেই সব উপাদান বিম্বিসারের চরিত্রে। চণক অনুভব করল, মহারাজ বিম্বিসারের কাছাকাছি কোনও শক্ত ধাতুর লোক থাকা প্রয়োজন, এবং নিজেকে বন্ধনভীরু বলে বর্ণনা করলেও সে একটা বন্ধনে জড়িয়ে পড়েছে।
রাজপুরীর সীমা পেরিয়ে গেছে। মুখ্য তোরণের তলা দিয়ে চণক পথে বেরিয়ে এলো। সে উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটছে। ধীরে ধীরে অপরাহ্ণ ঘন হয়ে উঠবে। আবার আরেকটা দিনের মতো সূর্য অস্ত যাবে। গোধূলির আলোয় ভরে যাবে চারিদিক। তারপর সন্ধ্যা নামবে। সহস্রচক্ষু, অযুত-নিযুতচক্ষু সন্ধ্যা। আর সঙ্গে সঙ্গে আবৃতচক্ষু হয়ে যাবে এই পৃথিবী। নিমীলিতাক্ষী জননী। শান্তির সময়। ক্ষান্তির সময়।
শান্তা দৌঃ শান্তা পৃথিবী
শান্তম্ ইদম উর্বন্তরিক্ষম।
শান্তা উদ্ন্বতীর আপঃ
শান্তা নঃ সন্তু ওষধীঃ।
শান্ত দ্যুলোক শান্ত পৃথিবী। মহাশান্তি ওই মহা-অন্তরিক্ষে। শান্ত সলিলাদি। শান্ত ওষধিরা। এইভাবেই গড়িয়ে যাবে দিনের পরে রাত, রাতের পরে দিন, কর্মের পর ক্ষান্তি, ক্ষান্তির পর আবার কর্ম। নতুন জীবন অঙ্কুরিত হচ্ছে, পুরনো জীবন খসে পড়ছে। চলছে চলছে, থেমে থাকছে না। কিন্তু চলছে এক ভাবে, এক নিয়মে। ব্যতিক্রমগুলিও নিয়মে বাঁধা। পূর্ণিমা, অমানিশা, চন্দ্রগ্রহণ, সূর্যগ্রহণ, ঋতু-পরিবর্তন। কী অর্থ এই অনন্ত পুনরাবৃত্তির? কী চান দেবতা? আমরা মানুষরাও কি এই পৌনঃপুনিকতার অন্তর্গত! না কি কোথাও পথ আছে এই চক্র থেকে প্রজ্বলন্ত উল্কার মতো বেরিয়ে যাবার! কোনও পরিবর্তন ঘটাবার? এই বিশাল ঘূর্ণমান অন্তরিক্ষের দিকে তাকালে, হঠাৎ, বালুকণার মতো ক্ষুদ্র মনে হয় নিজেকে, সংকল্পকে, সিদ্ধিকে। না না। চণক মাটির দিকে মুখ ফেরাল। সে এভাবে হারিয়ে যাবে না। হারিয়ে যাবে না। হারিয়ে গেলে চলবে না।
বোধিকুমার না? কিছুটা আগে আগে চলেছে সেই অল্পবয়স্ক কবি বোধিকুমার। চণক পেছন থেকে গিয়ে তার কাঁধ ছুঁলো। বোধিকুমার ফিরে দাঁড়ালো। চণককে দেখে তার মুখ হাসিতে ভরে গেল। বলল, ‘আপনি! এখনও গান্ধারে ফেরেন নি? শ্ৰীমতীর ধারণা ছিল আপনি…’
‘থামলেন কেন? বলুন!’
বোধিকুমার হেসে বলল, ‘আমি বিট নই। কিন্তু শ্ৰীমতী বোধহয় আপনার বিরহে বড়ই ক্লিষ্ট। করবারও কিছু নেই। আপনি বিদেশী দূত, ফিরে যাচ্ছেন তো!’
চণক বলল, ‘কবি বোধিকুমার তাকে রুদতী বসন্তগর্ভা আষাঢ়ী বর্ষাধারার সঙ্গে তুলনা করে অপূর্ব কবিতা রচনা করলেন, আর তিনি ক্লিষ্ট হলেন কাষ্ঠকঠিন চণকের জন্য? আশ্চর্য!’
বোধিকুমার বলল, ‘পৃথিবীতে প্রত্যাশিত ঘটনা কখনওই ঘটে না। কবিদের ভাগ্য ভালো নয় ভদ্র। কিন্তু আপনি সেদিন বুঝতে পেরেছিলেন শ্লোকগুলিতে আমি শ্ৰীমতীকেই বর্ণনা করেছি!
চণক বলল, ‘নিশ্চয়ই!’
‘তাহলে আপনার মতো সাহিত্য-ভাবক আমি আগে রাজগৃহে দেখিনি চণক ভদ্র। সপ্রশংস দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বোধিকুমার বলল, যদি আপত্তি না থাকে চলুন না ওই আম্রবীথিতে একটু বসি। যাবেন?’
চণক বলল, ‘চলুন!’