প্রথম খণ্ড – পঞ্চম অধ্যায়: মহাপুরুষের জন্মকথা
চন্দ্রাদেবীর আশঙ্কা ও স্বামীর কথায় আশ্বাসপ্রাপ্তি
শরৎ, হেমন্ত ও শীত অতীত হইয়া ক্রমে ঋতুরাজ বসন্ত উপস্থিত হইল। শীত ও গ্রীষ্মের সুখসম্মিলনে মধুময় ফাল্গুন স্থাবরজঙ্গমের ভিতর নবীন প্রাণ সঞ্চারিত করিয়া আজ ষষ্ঠ দিবস সংসারে সমাগত। জীবজগতে একটা বিশেষ উৎসাহ, আনন্দ ও প্রেমের প্রেরণা সর্বত্র লক্ষিত হইতেছে। শাস্ত্রে আছে, ব্রহ্মানন্দের এক কণা সকলের মধ্যে নিহিত থাকিয়া তাহাদিগকে সরস করিয়া রাখিয়াছে – ঐ দিব্যোজ্জ্বল আনন্দকণার কিঞ্চিদধিক মাত্রা পাইয়াই কি এই কাল সংসারের সর্বত্র এত উল্লাস আনয়ন করিয়া থাকে?
৺রঘুবীরের ভোগ রাঁধিতে রাঁধিতে আসন্নপ্রসবা শ্রীমতী চন্দ্রা প্রাণে আজ দিব্য উল্লাস অনুভব করিতেছিলেন, কিন্তু শরীর নিতান্ত অবসন্ন জ্ঞান করিতে লাগিলেন। সহসা তাঁহার মনে হইল, শরীরের যেরূপ অবস্থা তাহাতে কখন কি হয়; এখনই যদি প্রসবকাল উপস্থিত হয় তাহা হইলে গৃহে এমন দ্বিতীয় ব্যক্তি নাই যে, অদ্যকার ঠাকুরসেবা চালাইয়া লইবে। তাহা হইলে উপায়? ভীতা হইয়া তিনি ঐকথা স্বামীকে নিবেদন করিলেন। শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরাম তাহাতে তাঁহাকে আশ্বাস প্রদানপূর্বক বলিলেন, “ভয় নাই, তোমার গর্ভে যিনি শুভাগমন করিয়াছেন, তিনি ৺রঘুবীরের পূজাসেবায় বিঘ্নোৎপাদন করিয়া কখনই সংসারে প্রবেশ করিবেন না – ইহা আমার ধ্রুব বিশ্বাস; অতএব নিশ্চিন্তা হও, অদ্যকার মত ঠাকুরসেবা তুমি নিশ্চয় চালাইতে পারিবে; কল্য হইতে আমি উহার জন্য ভিন্ন বন্দোবস্ত করিয়া রাখিয়াছি এবং ধনীকেও বলা হইয়াছে যাহাতে সে অদ্য হইতে রাত্রে এখানেই শয়ন করিয়া থাকে।” শ্রীমতী চন্দ্রা স্বামীর ঐরূপ কথায় দেহে নবীন বলসঞ্চার অনুভব করিলেন এবং হৃষ্টচিত্তে পুনরায় গৃহকর্মে ব্যাপৃতা হইলেন। ঘটনাও ঐরূপ হইল – ৺রঘুবীরের মধ্যাহ্ন-ভোগ এবং সান্ধ্যশীতলাদি কর্ম পর্যন্ত সেদিন নির্বিঘ্নে সম্পাদিত হইয়া গেল। রাত্রে আহারাদি সমাপন করিয়া শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরাম ও রামকুমার শয়নকক্ষে প্রবেশ করিলেন এবং ধনী আসিয়া চন্দ্রাদেবীর সহিত এক কক্ষে শয়ন করিয়া রহিল। ৺রঘুবীরের ঘর ভিন্ন বাটীতে বসবাসের জন্য দুইখানি চালাঘর ও একখানি রন্ধনশালা মাত্র ছিল, এবং অপর একখানি ক্ষুদ্র চালাঘরে একপার্শ্বে ধান্য কুটিবার জন্য একটি ঢেঁকি এবং উহা সিদ্ধ করিবার জন্য একটি উনান বিদ্যমান ছিল। স্থানাভাবে শেষোক্ত চালাখানিই শ্রীমতী চন্দ্রার সূতিকাগৃহরূপে নির্দিষ্ট রহিল।
গদাধরের জন্ম
রাত্রি-অবসান হইতে প্রায় অর্ধদণ্ড অবশিষ্ট আছে, এমন সময়ে চন্দ্রাদেবীর প্রসবপীড়া উপস্থিত হইল। ধনীর সাহায্যে তিনি পূর্বোক্ত ঢেঁকিশালে গিয়া শয়ন করিলেন এবং অবিলম্বে এক পুত্রসন্তান প্রসব করিলেন। শ্রীমতী চন্দ্রার জন্য ধনী তখন তৎকালোপযোগী ব্যবস্থা করিয়া জাতককে সাহায্য করিতে অগ্রসর হইয়া দেখিল, ইতিপূর্বে তাহাকে যেখানে রক্ষা করিয়াছিল, সেই স্থান হইতে সে কোথায় অন্তর্হিত হইয়াছে! ভয়ত্রস্তা হইয়া ধনী প্রদীপ উজ্জ্বল করিল এবং অনুসন্ধান করিতে করিতে দেখিতে পাইল, রক্তক্লেদময় পিচ্ছিল ভূমিতে ধীরে ধীরে হড়কাইয়া ধান্য সিদ্ধ করিবার চুল্লীর ভিতর প্রবেশপূর্বক সে বিভূতিভূষিতাঙ্গ হইয়া পড়িয়া রহিয়াছে, অথচ কোন শব্দ করে নাই। ধনী তখন তাহাকে যত্নে উঠাইয়া লইল এবং পরিষ্কৃত করিয়া দীপালোকে ধরিয়া দেখিল, অদ্ভুত, প্রিয়দর্শন বালক যেন ছয় মাসের ছেলের মত বড়। প্রতিবেশী লাহাবাবুদের বাটী হইতে তখন প্রসন্নপ্রমুখ চন্দ্রাদেবীর দুই-চারিজন বয়স্যা সংবাদ পাইয়া তথায় উপস্থিত হইয়াছে – ধনী তাহাদিগের নিকটে এ সংবাদ ঘোষণা করিল এবং পূতগম্ভীর ব্রাহ্মমুহূর্তে শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরামের তপস্বী দরিদ্র কুটির শুভ শঙ্খারাবে পূর্ণ হইয়া মহাপুরুষের শুভাগমনবার্তা সংসারে প্রচার করিল।
অনন্তর শাস্ত্রজ্ঞ ক্ষুদিরাম নবাগত বালকের জন্মলগ্ন নিরূপণ করিতে যাইয়া দেখিলেন, জাতক বিশেষ শুভক্ষণে সংসারে প্রবেশ করিয়াছে। দেখিলেন –
গদাধরের শুভ জন্ম–মুহূর্ত সম্বন্ধে জ্যোতিষশাস্ত্রের কথা
ঐদিন সন ১২৪২ সালের অথবা ১৭৫৭ শকাব্দের ৬ই ফাল্গুন, ইংরাজী ১৮৩৬ খ্রীষ্টাব্দের ১৭ই ফেব্রুয়ারি, শুক্লপক্ষ, বুধবার। রাত্রি একত্রিশ দণ্ড অতীত হইয়া অর্ধদণ্ডমাত্র অবশিষ্ট থাকিতে বালক জন্মগ্রহণ করিয়াছে। শুভা দ্বিতীয়া তিথি ঐ সময়ে পূর্বভাদ্রপদ নক্ষত্রের সহিত সংযুক্তা হইয়া সংসারে সিদ্ধিযোগ আনয়ন করিয়াছিল। বালকের জন্মলগ্নে রবি, চন্দ্র ও বুধ একত্র মিলিত রহিয়াছে এবং শুক্র, মঙ্গল ও শনি তুঙ্গস্থান অধিকারপূর্বক তাহার অসাধারণ জীবনের পরিচায়ক হইয়া রহিয়াছে। আবার মহামুনি পরাশরের মত অবলম্বনপূর্বক দেখিলে রাহু ও কেতু গ্রহদ্বয়কে তাঁহার জন্মকালে তুঙ্গস্থ দেখিতে পাওয়া যায়। তদুপরি, বৃহস্পতি তুঙ্গাভিলাষিরূপে বর্তমান থাকিয়া বালকের অদৃষ্টের উপর বিশেষ শুভ প্রভাব বিস্তার করিয়া রহিয়াছে।
গদাধরের রাশ্যাশ্রিত নাম
অতঃপর বিশিষ্ট জ্যোতির্বিদ্গণ নবজাত বালকের জন্মক্ষণ পরীক্ষাপূর্বক তাঁহাকে বলিলেন, জাতক যেরূপ উচ্চলগ্নে জন্মগ্রহণ করিয়াছে, তৎসম্বন্ধে জ্যোতিষশাস্ত্র নিঃসন্দেহে নির্দেশ করে যে, ঐরূপ ব্যক্তি ধর্মবিৎ ও মাননীয় হইবেন এবং সর্বদা পুণ্যকর্মের অনুষ্ঠানে রত থাকিবেন। বহুশিষ্যপরিবৃত হইয়া ঐ ব্যক্তি দেবমন্দিরে বাস করিবেন; এবং নবীন ধর্মসম্প্রদায় প্রবর্তিত করিয়া নারায়ণাংশসম্ভূত মহাপুরুষ বলিয়া জগতে প্রসিদ্ধিলাভপূর্বক সর্বত্র সকল লোকের পূজ্য হইবেন।1 শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরামের মন উহাতে বিস্ময়পূর্ণ হইল। তিনি কৃতজ্ঞহৃদয়ে ভাবিতে লাগিলেন, ৺গয়াধামে তিনি যে দেবস্বপ্ন সন্দর্শন করিয়াছিলেন, তাহা সত্য সত্যই পূর্ণ হইল। অনন্তর জাতকর্ম সমাপনপূর্বক বালকের রাশ্যাশ্রিত নাম শ্রীযুক্ত শম্ভুচন্দ্র স্থির করিলেন এবং ৺গয়াধামে অবস্থানকালে নিজ বিচিত্র স্বপ্নের কথা স্মরণ করিয়া তাঁহাকে সর্বজনসমক্ষে শ্রীযুক্ত গদাধর নামে অভিহিত করিতে মনস্থ করিলেন।
1.
ধর্মস্থানাধিপে তুঙ্গে ধর্মস্থে তুঙ্গখেচরে।
গুরুণা
দৃষ্টিসংযোগে
লগ্নেশে
ধর্মসংস্থিতে।।
কেন্দ্রস্থানগতে সৌম্যে গুরৌ চৈব তু কোণভে।
স্থিরলগ্নে
যদা
জন্ম
সম্প্রদায়প্রভুঃ হি সঃ।।
ধর্মবিন্মাননীয়স্তু পুণ্যকর্মরতঃ সদা।
দেবমন্দিরবাসী চ বহুশিষ্যসমন্বিতঃ।।
মহাপুরুষসংজ্ঞোঽয়ং নারায়ণাংশসম্ভবঃ।
সর্বত্র
জনপূজ্যশ্চ
ভবিষ্যতি
ন
সংশয়ঃ।।
ইতি
ভৃগুসংহিতায়াং সম্প্রদায়প্রভুযোগঃ তৎফলঞ্চ।
শ্রীযুক্ত
নারায়ণচন্দ্র
জ্যোতির্ভূষণ–কৃত ঠাকুরের জন্মকোষ্ঠী হইতে উক্ত বচন উদ্ধৃত হইল।
গদাধরের জন্মকুণ্ডলী
পাঠকের বোধসৌকর্যার্থে আমরা শ্রীরামকৃষ্ণদেবের বিচিত্র জন্মকুণ্ডলীর1 সহিত তাঁহার কোষ্ঠীর কিয়দংশ নিম্নে প্রদান করিতেছি। জ্যোতিষশাস্ত্রাভিজ্ঞ পাঠক তদ্দৃষ্টে বুঝিতে পারিবেন, উহা ভগবান শ্রীরামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীশঙ্কর ও শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যাদি অবতারপ্রথিত পুরুষসকলের অপেক্ষা কোন অংশে হীন নহে।
1.
ঠাকুরের
জন্মকাল
সম্বন্ধে
কয়েকটি
কথা
আমরা
এখানে
পাঠককে
বলা
আবশ্যক
বিবেচনা
করিতেছি।
দক্ষিণেশ্বরে
শ্রীরামকৃষ্ণদেবের নিকট যাতায়াত করিবার কালে আমরা অনেকে তাঁহাকে বলিতে শুনিয়াছিলাম, ‘তাঁহার যথার্থ জন্মপত্রিকা হারাইয়া গিয়াছে এবং উহার স্থলে বহুকাল পরে যে জন্মপত্রিকা করান হইয়াছে, তাহা ভ্রমপ্রমাদপূর্ণ।‘ তাঁহার নিকটে আমরা একথাও বহুবার শুনিয়াছি যে, তাঁহার জন্ম ‘ফাল্গুন মাসের শুক্লপক্ষে দ্বিতীয়া তিথিতে হইয়াছিল, ঐদিন বুধবার ছিল।‘ তাঁহার কুম্ভরাশি এবং তাঁহার ‘জন্মলগ্নে রবি, চন্দ্র ও বুধ ছিল।‘ ‘লীলাপ্রসঙ্গ‘ লিখিবার কালে তাঁহার জীবনের ঘটনাবলীর যথাযথ সাল–তারিখ–নির্ণয়ে অগ্রসর হইয়া আমরা শেষোক্ত জন্মপত্রিকাখানি আনাইয়া দেখি, উহাতে তাঁহার জন্মকাল সম্বন্ধে এইরূপ লেখা আছে – ‘শক ১৭৫৬।১০।৯।৫৯।১২ ফাল্গুনস্য দশমদিবসে বুধবাসরে গৌরপক্ষে দ্বিতীয়ায়াং তিথৌ পূর্বভাদ্রনক্ষত্রে‘ তাঁহার জন্ম হইয়াছিল। ঐ সালের পঞ্জিকা আনাইয়া দেখা গেল, উক্ত কোষ্ঠীতে উল্লিখিত সালের ঐ দিবসে কৃষ্ণপক্ষ নবমী তিথি এবং শুক্রবার হয়। সুতরাং উক্ত জন্মপত্রিকাখানিকে ঠাকুর কেন ভ্রমপূর্ণ বলিতেন, তাহা বুঝিতে পারিয়া উহা পরিত্যাগপূর্বক পুরাতন পঞ্জিকাসকলে অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম, কোন্ শকের ফাল্গুন মাসের শুক্লা দ্বিতীয়ায় বুধবার এবং রবি, চন্দ্র ও বুধ কুম্ভরাশিতে একত্র মিলিত হইয়াছে। অনুসন্ধানের ফলে ঐরূপ দুইটি দিন পাওয়া গেল, একটি ১৭৫৪ শকে এবং দ্বিতীয়টি ১৭৫৭ শকে। তন্মধ্যে প্রথমটিকে আমরা ত্যাগ করিলাম। কারণ ১৭৫৪ শক ঠাকুরের জন্মকাল বলিয়া নির্ণয় করিলে, তাঁহার মুখে তাঁহার বয়স সম্বন্ধে যাহা শুনিয়াছি, তদপেক্ষা ৩ বৎসর ২ মাস বাড়াইয়া তাঁহার আয়ুগণনা করিতে হয়। পক্ষান্তরে, ১৭৫৭ শককে তাঁহার জন্মকাল বলিয়া নির্ণয় করিলে তাঁহার জীবৎকালে দক্ষিণেশ্বরে ভক্তগণ তাঁহার যে জন্মোৎসব করিতেন, তৎকালে তিনি নিজ বয়স সম্বন্ধে যেরূপ নির্ণয় করিতেন, তাহা বৃদ্ধি করিয়া তাঁহার পরমায়ু গণনা করিতে হয় না। সুদ্ধ তাহাই নহে, আমরা বিশ্বস্তসূত্রে শুনিয়াছি, ঠাকুরের বিবাহকালে তাঁহার বয়স ২৪ বৎসর এবং শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরানীর বয়স ৫ বৎসর মাত্র ছিল – ঐবিষয়েও কোন ব্যতিক্রম করিতে হয় না। তদ্ভিন্ন, ঠাকুর দেহরক্ষা করিলে সমবেত ভক্তগণ কাশীপুর–শ্মশানের মৃত্যু–নির্ণায়ক (রেজেস্টারী) পুস্তকে তাঁহার বয়স ৫১ বৎসর লিখাইয়া দিয়াছিলেন – তাহারও কোনরূপ পরিবর্তনের আবশ্যক হয় নাই। ঐসকল কারণে আমরা ১৭৫৭ শককেই ঠাকুরের জন্মকাল বলিয়া অবধারিত করিলাম।
ঐরূপ
করিয়াই
আমরা
ক্ষান্ত
হই
নাই;
কিন্তু
কলিকাতা,
বহুবাজার,
২
নম্বর
রাসবিহারী
ঠাকুর
লেন–নিবাসী শ্রীযুক্ত শশিভূষণ ভট্টাচার্যের নষ্ট কোষ্ঠী–উদ্ধারের অসাধারণ ক্ষমতার কথা জানিতে পারিয়া তাঁহার নিকটে শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরানীর জন্মকুণ্ডলী প্রেরণ করি এবং তদ্দৃষ্টে গণনা করিয়া ঠাকুরের জন্মকুণ্ডলী নির্ণয় করিয়া দিতে অনুরোধ করি। তিনিও ঐ বিষয় গণনাপূর্বক ১৭৫৭ শককেই ঠাকুরের জন্মকাল বলিয়া স্থির করেন।
ঐরূপে
১৭৫৭
শকে
বা
সন
১২৪২
সালেই
ঠাকুরের
জন্ম
হইয়াছিল,
এ
কথায়
দৃঢ়নিশ্চয়
হইয়া
আমরা
শ্রদ্ধাস্পদ
পণ্ডিত
শ্রীযুক্ত
নারায়ণচন্দ্র
জ্যোতির্ভূষণ
মহাশয়কে
তদনুসারে
ঠাকুরের
জন্মকোষ্ঠী
গণনা
করিয়া
দিতে
অনুরোধ
করি
এবং
তিনি
বহু
পরিশ্রম
স্বীকার
করিয়া
উহা
সম্পন্ন
করিয়া
আমাদিগকে
কৃতজ্ঞতাপাশে
আবদ্ধ
করেন।
ঠাকুরের
ব্রাহ্মমুহূর্তে জন্মের কথা আমরা কেবলমাত্র কোষ্ঠীগণনায় স্থির করি নাই; কিন্তু ঠাকুরের পরিবারবর্গের মুখে শ্রুত নিম্নলিখিত ঘটনা হইতেও নির্ণয় করিয়াছি। তাঁহারা বলেন, ঠাকুর জন্মগ্রহণ করিবার অব্যবহিত পরে হড়কাইয়া সূতিকাগৃহে অবস্থিত ধান্য সিদ্ধ করিবার চুল্লীর ভিতর পড়িয়া ভস্মাচ্ছাদিত হইয়াছিলেন। সদ্যোজাত শিশুর যে ঐরূপ অবস্থা হইয়াছে, তাহা অন্ধকারে বুঝিতে পারা যায় নাই। পরে আলোক আনিয়া অনুসন্ধান করিয়া তাঁহাকে উক্ত চুল্লীর ভিতর হইতে বাহির করা হইয়াছিল।
সে
যাহা
হউক,
১৭৫৭
শকের
ফাল্গুন
মাসের
দ্বিতীয়ায়
ঠাকুরের
জন্ম
যেরূপ
অদ্ভুত
লগ্নে
হইয়াছিল,
তাহা
শ্রীযুক্ত
নারায়ণচন্দ্র
জ্যোতির্ভূষণ–কৃত তাঁহার কোষ্ঠী দেখিয়া সম্যক্ উপলব্ধি হয়। সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুরের অলৌকিক জীবন–ঘটনাসমূহ কোষ্ঠীর সহিত মিলাইয়া দেখিয়া ইহাও স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায় যে ভারতের জ্যোতিষশাস্ত্র যথার্থই সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত।
পরিশেষে
ইহাও
বক্তব্য
যে,
ঠাকুরের
ভ্রমপূর্ণ
পুরাতন
কোষ্ঠী,
শ্রীযুক্ত
নারায়ণচন্দ্র
জ্যোতির্ভূষণ–কৃত তাঁহার বিশুদ্ধ কোষ্ঠী এবং শ্রীযুক্ত শশিভূষণ ভট্টাচার্য শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরানীর জন্মকুণ্ডলীদর্শনে গণনাপূর্বক ঠাকুরের যে জন্মকুণ্ডলী প্রস্তুত করিয়া দেন, সে সমস্ত বেলুড় মঠে সযত্নে রক্ষিত আছে।
গদাধরের জন্মপত্রিকার কিয়দংশ
“শুভমস্তু। শক-নরপতেরতীতাব্দাদয়ঃ ১৭৫৭।১০।৫।৫৯।২৮।২৯ সন ১২৪২ সাল, ৬ই ফাল্গুন, বুধবার, রাত্রি অবসানে (অর্ধদণ্ড রাত্রি থাকিতে) কুম্ভলগ্নে প্রথম নবাংশে জন্ম। কুম্ভরাশি, পূর্বভাদ্রপদ নক্ষত্রের প্রথম পাদে জন্ম। রাত্রিজাত দণ্ডাদিঃ ৩১।০।১৪, সূর্যোদয়াদিষ্ট দণ্ডাদিঃ ৫৯।২৮।২৯, অক্ষাংশ ২২।৩৪, পলভা ৫।১।৫।১০।
চান্দ্রফাল্গুনস্য শুক্লপক্ষীয়-দ্বিতীয়া জন্মতিথিঃ।
পূর্বভাদ্রপদ-নক্ষত্র-মানং ৬০।১৫।০
তস্য ভোগ্যদণ্ডাদিঃ ৫২।১২।৩১
ভুক্ত-দণ্ডাদিঃ ৮।২।২৯
(শকাব্দা ১৭৫৭), এতচ্ছকীয় সৌর-ফাল্গুনস্য ষষ্ঠ-দিবসে, বুধবাসরে, শুক্লপক্ষীয়-দ্বিতীয়ায়াং তিথৌ, পূর্বভাদ্রপদ-নক্ষত্রস্য প্রথমচরণে সিদ্ধিযোগে, বালবকরণে এবং পঞ্চাঙ্গ-সংশুদ্ধৌ, রাত্রি চতুর্দশ-বিপলাধিকৈকত্রিংশদ্দণ্ড-সময়ে অয়নাংশোদ্ভব-শুভ-কুম্ভলগ্নে (লগ্নস্ফুট-রাশ্যাদি ১০।৩।১৯।৫৩।২০”’), শনৈশ্চরস্য ক্ষেত্রে, সূর্যস্য হোরায়াং সূর্যসুতস্য দ্রেক্কাণে, শুক্রস্য নবাংশে, বৃহস্পতের্দ্বাদশাংশে, কুজস্য ত্রিংশাংশে এবং ষড়্বর্গ পরিশোধিতে পূর্বভাদ্রপদনক্ষত্রাশ্রিতকুম্ভরাশিস্থিতে চন্দ্রে বুধস্য যামার্ধে, জীবস্য দণ্ডে, কোণস্থে গুরৌ কেন্দ্রস্থে বুধে চন্দ্রে চ লগ্নস্থে চন্দ্রে, ত্রিগ্রহযোগে, ধর্মকর্মাধিপয়োঃ শুক্রভৌময়োঃ তুঙ্গস্থিতয়োঃ, বর্গোত্তমস্থে লগ্নাধিপে শনৌ চ তুঙ্গে, পরাশরমতেন তু রাহুকেতোস্তুঙ্গস্থয়োঃ (যতঃ উক্তং, ‘রাহোস্তু বৃষভং কেতোর্বৃশ্চিকং তুঙ্গসঙ্গিতম্’ ইত্যাদিপ্রমাণাৎ) অতএব উচ্চস্থে গ্রহপঞ্চকে, অসাধারণ পুণ্যভাগ্যযোগে, শুক্লপক্ষে নিশিজন্মহেতোঃ বিংশোত্তরী দশাধিকারে জন্ম, এতেন বৃহস্পতের্দশায়াং, তথা দেশভেদেন দশাধিকারনিয়মাচ্চ অষ্টোত্তরীয়-রাহোর্দশায়াং, অশেষগুণালঙ্কৃত-স্বধর্মনিষ্ঠ-ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায়-মহোদয়স্য (সহধর্মিণী-দয়াবতী-চন্দ্রমণি-দেবী-মহোদয়ায়াঃ গর্ভে) শুভ তৃতীয়পুত্রঃ সমজনি। তস্য রাশ্যাশ্রিতং নাম শম্ভুরাম দেবশর্মা। প্রসিদ্ধনাম গদাধর চট্টোপাধ্যায়ঃ। সাধনাসিদ্ধিপ্রাপ্ত-জগদ্বিখ্যাতনাম শ্রীরামকৃষ্ণপরমহংসদেব-মহোদয়ঃ।”1
অনন্তর প্রিয়দর্শন পুত্রের মুখ দর্শন এবং তাহার অসাধারণ ভাগ্যের কথা শ্রবণ করিয়া শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরাম ও শ্রীমতী চন্দ্রমণি আপনাদিগকে কৃতার্থম্মন্য জ্ঞান করিলেন এবং যথাকালে তাহার নিষ্ক্রামণ ও নামকরণাদি সম্পন্ন করিয়া অশেষ যত্নের সহিত তাহার লালনপালনে মনোনিবেশ করিলেন।
1. শ্রীযুক্ত নারায়ণচন্দ্র জ্যোতির্ভূষণ–কৃত ঠাকুরের জন্মকোষ্ঠী হইতে পূর্বোক্তাংশ উদ্ধৃত হইল।