প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড
চতুর্থ খণ্ড
পঞ্চম খণ্ড

১.৫ মঁতফারমেলের হোটেলে

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

যে মা একদিন মঁতফারমেলের হোটেলে তার শিশুকন্যাকে নিশ্চিন্তে রেখে চলে গিয়েছিল সে মায়ের কী হল এখন আমরা তা দেখব।

পথনার্দিয়েরের কাছে তার মেয়েকে যেদিন রেখে ফাঁতিনে চলে যায় মন্ত্রিউল-সুর-মেরে সেটা হল ১৮১৮ সাল।

তখন থেকে দশ বছর আগে মন্ত্রিউল ছেড়ে চলে আসে ফাঁতিনে। এদিকে সে যখন ধীরে ধীরে দারিদ্রের গভীর থেকে গভীরতর প্রদেশে ডুবে যেতে থাকে তখন তাদের এই জেলা শহরটা সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠতে থাকে ধীরে ধীরে। গত দুবছরের মধ্যে ওই অঞ্চল শিল্পের দিক থেকে এমনই উন্নত হয়ে ওঠে যে ওই অঞ্চলের অধিবাসীদের জীবনে এক বিরাট পরিবর্তন নিয়ে আসে।

মন্ত্রিউল শহরের পুরনো আঞ্চলিক শিল্প হল জার্মানির কালো কাঁচ আর ইংল্যান্ডের কালো পালিশ করা এক ধরনের ছোট ছোট বল, যা দিয়ে জপের মালা তৈরি হয়। কিন্তু কাঁচামালের দাম অত্যধিক বেড়ে যাওয়ায় এ শিল্পের কোনও উন্নতি হচ্ছিল না এবং শ্রমিকদের ঠিকমতো বেতন দেওয়া যাচ্ছিল না। কিন্তু সম্প্রতি এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। ১৮১৫ সালের শেষের দিকে শহরে কোথা থেকে একজন নবাগত আসে যে এই শিল্পের। ক্ষেত্রে কাঁচামালের রদবদল করে। সে আগে ব্যবহৃত গাছের রস থেকে তৈরি এক ধরনের আঠার পরিবর্তে গালা ব্যবহার করতে থাকে। তাতে উৎপাদন ব্যয় অনেক কমে যাওয়ায় শ্রমিকদের বেশি করে বেতন দিতে পারা যায়। ফলে এ অঞ্চলের অধিবাসীরা উপকৃত হয়। উৎপন্ন শিল্পদ্রব্যের দাম কমিয়ে দেওয়ায় বেশি পরিমাণে মাল বিক্রি হতে থাকায় লাভ বেশি হতে থাকে। ফলে মাত্র তিন বছরের মধ্যেই নবাগত এ অঞ্চলে এক বিরাট শিল্পবিপ্লব নিয়ে আসে। সে কম টাকায় উৎপাদকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে প্রচুর লাভ করে ধনী হয়ে ওঠে এবং সেই সঙ্গে তার চারপাশের গোটা অঞ্চলটাই সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠতে থাকে তার পথ অনুসরণ করে।

এ জেলার কোনও লোক তাকে চেনে না। তার জন্মপরিচয়ের কিছুই জানা যায়নি। সে কিভাবে কোথায় জীবন শুরু করে তা-ও কেউ জানতে পারেনি। লোকে শুধু বলত মাত্র কয়েকশ ফ্র্য নিয়ে এ শহরে সে প্রথম আসে। এই অল্প টাকা মূলধন হিসেবে খাঁটিয়ে কৌশলে এবং বুদ্ধি খাঁটিয়ে শিল্পে উন্নতি করে ধনসম্পদের অধিকারী হয়ে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে এ অঞ্চলের লোকদেরও উন্নতি হয়।

সে যখন প্রথম এখানে আসে তখন তার চেহারা ও বেশভূষা একজন শ্রমিকের মতো। ছিল। তখন ছিল ডিসেম্বর মাস। সেই ডিসেম্বরের কোনও এক সন্ধ্যায় সে যখন সকলের একরকম অলক্ষ্যে শহরে এসে ঢোকে, সেই সময় শহরে ভয়াবহ এক অগ্নিকাণ্ড ঘটে। তখন এই নবাগত ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়ে নিজের জীবন বিপন্ন করে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে দুটি বিপন্ন শিশুকে উদ্ধার করে আনে। তার অবশ্য বিশেষ কোনও ক্ষতি হয়নি। সেই শিশু দুটি ছিল পুলিশ বিভাগের এক ক্যাপ্টেনের। তাই কেউ তার পরিচয়পত্র দেখতে চায়নি এবং পুলিশের কর্তারা সন্তুষ্ট ছিল তার প্রতি। সবাই তাকে পিয়ের ম্যাদলেন বলে। ডাকত। প্রথম আসার দিনে তার পিঠে একটা ব্যাগ আর হাতে একটা ছড়ি ছিল।

.

তার বয়স হবে প্রায় পঞ্চাশ এবং আচরণ ও কথাবার্তা থেকে তাকে সৎ প্রকৃতির বলে মনে হত।

শিল্পের দ্রুত উন্নতি হওয়ায় মন্ত্রিউল শহর বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এক বাণিজ্যকেন্দ্র হয়ে উঠল। স্পেন থেকে অনেক অর্ডার আসতে লাগল। সেখানে উৎপন্ন শিল্পদ্রব্যের চাহিদা বেড়ে যেতে লাগল দিনে দিনে। বিক্রির পরিমাণ এত বেড়ে গেল যে পিয়ের ম্যাদলেন আরও দুটো নতুন কারখানা তৈরি করল–একটা পুরুষদের আর একটা শুধু নারীদের জন্য। বেকার লোকরা দলে দলে কাজের জন্য আবেদন করতেই তারা কাজ পেয়ে গেল এবং জীবন ধারণের উপযোগী ভালো বেতন পেতে লাগল। ম্যাদলেন চাইল পুরুষ-নারী সব কর্মীরা সৎ হবে, তাদের নীতিবোধ উন্নত হবে। পুরুষ ও নারী কর্মীদের পৃথকভাবে কাজ করার ব্যবস্থা করায় নারীদের শালীনতা হানির কোনও অবকাশ রইল না। এ ব্যাপারে ম্যাদলেন ছিল অনমনীয় ও আপোসহীন। কারও কোনও ত্রুটি-বিচ্যুতি সহ্য করত না সে। মন্ত্রিউল শহরে এক সৈন্যনিবাস থাকায় নারীদের চরিত্রহানির অনেক সুযোগ ছিল বলে ম্যাদলেন বিশেষভাবে কড়াকড়ি করত। যে শহর একদিন কাজকর্মের সুযোগ হারিয়ে স্থিতিশীল এক আবর্তে পরিণত হয়ে উঠেছিল আজ তা এক উন্নত শিল্পের ছত্রছায়ায় কর্মচঞ্চল হয়ে ওঠে। ক্রমে সমস্ত অঞ্চল থেকে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব দূর হয়ে যায়। প্রত্যেকের হাতেই কিছু না কিছু পয়সা এল। প্রতিটি ঘরে কিছু সুখশান্তি এল।

কর্মব্যস্ততার মাঝে অর্থসঞ্চয়ের দিকেও মন দিল ম্যাদলেন। ব্যবসা ছাড়া নিজে আলাদা করে একটা মোটা অঙ্কের টাকা ব্যাংকে রেখে দিল। ১৮২০ সালে লোকে জানত লাফিত্তের ব্যাংকে তার নামে মোট ৬ লক্ষ ৩৫ হাজার ফ্ৰাঁ জমা ছিল। তবে টাকাটাই তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল না। ব্যবসার উন্নতিই ছিল তার সবচেয়ে বড় লক্ষ্য। ব্যাংকে ওই জমা টাকা ছাড়াও সে শহরের গরিবদের অবস্থার উন্নতি সাধনের জন্য এক লক্ষ টাকা খরচ করে।

আগে শহরের হাসপাতালটা অর্থাভাবে ভুগছিল। ম্যাদলেন টাকা দিয়ে দশটা বেড় বাড়িয়ে দিল। মন্ত্রিউলের যে অঞ্চলে ম্যাদলেন থাকত সেখানে মাত্র একটা স্কুল ছিল। ম্যাদলেন সেখানে আরও দুটো স্কুল গড়ে তুলল–একটা ছেলেদের আর একটা মেয়েদের জন্য। সে তার টাকা থেকে স্কুলমাস্টারদের বেতন বাড়িয়ে দ্বিগুণ করে দিল। তাছাড়া অকর্মণ্য, অনাথ ও নিরাশ্রয় বৃদ্ধদের জন্য এক আবাস স্থাপন করল যেখানে তারা বিনা পয়সায় থাকা-খাওয়ার সুযোগ পেত। নতুন কারখানা স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিকদের থাকার জন্য কোয়ার্টার করে দিল। তখনকার দিনে ফ্রান্সে অসহায় দুস্থ বৃদ্ধদের এ ধরনের কোনও আবাস ছিল না।

ম্যাদলেন যখন প্রথম কাজ শুরু করে তখন শহরের সবাই বলত, লোকটা টাকা উপায় করতে এসেছে। সে ধনী হতে চায়। কিন্তু যখন তারা দেখল যে নিজে সব টাকা সঞ্চয় না করে এখানকার জনসাধারণের সর্বাঙ্গীণ উন্নতি সাধন করতে চায় তখন তারা বলাবলি করতে লাগল ও কোনও রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ পূরণ করতে চায়। অনেকে ভাবল এ কথার কিছুটা যুক্তি আছে, কারণ ম্যাদলেনের ধর্মের দিকে মতিগতি ছিল। সে প্রতি রবিবার সকালে চার্চে গিয়ে সমবেত প্রার্থনাসভায় যোগদান করত। স্থানীয় ডেপুটি সব বিষয়ে ম্যালেনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করত। ম্যাদলেন হাসপাতালে দশটা বেড রোগীদের জন্য দান করায় সে-ও দুটো বেড দান করে। ম্যাদলেন নিয়মিত চার্চে যাওয়ায় সে-ও সকাল-সন্ধে প্রার্থনায় যোগ দিত। অথচ আগে সে ঈশ্বরে বিশ্বাসই করত না।

১৮১৯ সালে গুজব শোনা গেল পুলিশের বড় কর্তাদের পরামর্শে এবং জনসেবার কাজ দেখে রাজা মঁসিয়ে ম্যাদলেনকে মন্ত্রিউলের মেয়র মনোনীত করেছেন। যারা আগে বলত ম্যাদলেনের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ আছে তাদের ধারণা সত্যি হয়েছে জেনে তারা খুশি হল। সমস্ত শহর উত্তেজনায় ফেটে পড়ল। গুজবটা ক্রমে সত্যে পরিণত হল। কয়েকদিন পরে লে মন্ত্রিউল পত্রিকায় রাজার মনোনয়নের খবরটা প্রকাশিত হল। কিন্তু পরের দিন মঁসিয়ে ম্যাদলেন এই মেয়রের পদ প্রত্যাখ্যান করল।

১৮১৯ সালে ম্যালেনের সব শিল্পকর্ম এক শিল্প প্রদর্শনীতে দেখানো হল। যেসব নতুন পদ্ধতি সে উদ্ভাবন করে সেইসব পদ্ধতি বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়। জুরিদের পরামর্শক্রমে রাজা আবার ম্যাদলেনকে লিজিয়ন দ্য অনার বা গ্র্যান্ড ক্রস উপাধি দান করার কথা ঘোষণা করেন। অনেকে তখন বলতে থাকে ম্যাদলেন মেয়রের পদ প্রত্যাখ্যান করলেও এই সম্মান ঠিক গ্রহণ করবে। ও হয়তো এই ধরনের সম্মানই চাইছিল। কিন্তু ম্যাদলেন গ্র্যান্ড ক্রসও প্রত্যাখ্যান করে।

আসলে ম্যাদলেন সকলের কাছে একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। যারা তার আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বরাবর জল্পনা কল্পনা করত এবং নানারকম ভবিষ্যদ্বাণী করত, তাদের সব ধারণা একে একে ব্যর্থ প্রতিপন্ন হওয়ায় তারা এই বলে কোনওরকমে মুখরক্ষা করে বলত, যাই হোক, ও যা হোক কিছু একটা চায়, মতলব কিছু একটা আছে।

সারা জেলা ম্যালেনের কাছে ঋণী এবং সারা জেলার গরিবরাও তার কাছে ঋণী। ম্যালেনের অবদান অমূল্য এবং তার জন্য তাকে সম্মান দেওয়া উচিত। তার কারখানার কর্মীরা তাকে শ্রদ্ধা করত। ম্যাদলেন যখন ব্যবসায়ে লাভ করতে করতে প্রচুর ধনী হয়ে ওঠে তখন শহরের লোকেরা তাকে সম্মান করে ‘সিয়ে ম্যাদলেন’ বলত। কিন্তু ম্যালেনের কারখানার সব কর্মী ও তাদের ছেলেমেয়েরা আগের মতোই তাকে পিয়ের ম্যাদলেন বলত। এই নাম শুনেই সবচেয়ে খুশি হত সে। তার মুখে হাসি ফুটে উঠত। সে ক্রমে বড় হয়ে উঠতেই বিভিন্ন জায়গায় যাবার জন্য তার কাছে নিমন্ত্রণ আসতে লাগল। সমাজের উঁচু তলার লোকরা তার খোঁজ করতে লাগল। মন্ত্রিউলের কিছু অভিজাত বাড়ির বৈঠকখানার যে দরজা সাধারণ ব্যবসায়ীদের সামনে উন্মুক্ত হত না কখনও সে দরজা লক্ষপতি মঁসিয়ে ম্যালেনের জন্য উন্মুক্ত ছিল সব সময়। অনেকে অনেক জায়গায় তাকে নিয়ে যাবার জন্য তার কাছে আসত। কিন্তু সবার সব নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করত সে।

এ নিয়ে তখন আবার এক লোকনিন্দার সৃষ্টি হয়। নিন্দুকরা বলতে থাকে, লোকটা আসলে অজ্ঞ আর অশিক্ষিত। কেউ জানে না সে কোথা থেকে এসেছে। উচ্চ ভদ্র সমাজে গিয়ে কিভাবে ব্যবহার করতে হয়, তা জানে না। সে লিখতে-পড়তে পারে কি না, তাতেও সন্দেহ আছে।

নিন্দুকরা সব সময়ই তাদের নিন্দার ভিত্তি হিসেবে একটা করে যুক্তি খুঁজে বার করত। প্রথমে যখন সে ব্যবসা করে টাকা করতে থাকে তখন তারা বলত, লোকটা পাকা ব্যবসাদার। যখন সে জনকল্যাণকর কাজে অনেক টাকা দান করতে থাকে তখন তারা বলত, লোকটা রাজনীতিতে নেমে নেতা হতে চায়। যখন সম্মান প্রত্যাখ্যান করে তখন তারা বলত লোকটা আরও বেশি সম্মান চায়। আবার সে যখন দ্র সমাজের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে তখন তারা বলত লোকটা নিরক্ষর চাষি।

১৮২০ সালে অর্থাৎ মন্ত্রিউলে তার আসার পাঁচ বছর পর সে অঞ্চলের শিল্পোন্নয়নে তার অবদান এমনই আশ্চর্যজনক হয়ে ওঠে এবং তার জনহিতকর কাজের জন্য জনগণ তার এমনই প্রশংসা করতে থাকে যে রাজা তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে তাকে আবার মন্ত্রিউলের মেয়র মনোনীত করেন। কিন্তু এবারও সে মেয়রের পদ প্রত্যাখ্যান করে। তবে এবার তার প্রত্যাখ্যান পুলিশের বড় কর্তারা স্বীকার করল না। তাছাড়া শহরের বিশিষ্ট লোকেরা এবং সাধারণ জনগণ তার ওপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকায় শেষ পর্যন্ত সে মেয়রের পদ গ্রহণে রাজি না হয়ে পারল না। একদিন রাস্তার ধারের একটি বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে এক বুড়ি ম্যাদলেনকে বলতে থাকে, মেয়রের কাজ হল জনগণের উপকার করা। সুতরাং জনগণের উপকার করার এই সুযোগ ছেড়ে দিতে চাইছ কেন তুমি?

এইভাবে ম্যালেনের জীবনে উন্নতির তৃতীয় স্তর শুরু হল। এ অঞ্চলে প্রথম এসে যে যখন ব্যবসা শুরু করে তখন সে ছিল পিয়ের ম্যাদলেন। তার পর তার ধনসম্পদ যখন বাড়তে থাকে, ব্যবসায় উন্নতি হতে থাকে তখন সে হয়ে ওঠে মঁসিয়ে ম্যাদলেন অর্থাৎ শহরের এক গণ্যমান্য ব্যক্তি। পরে সে হয়ে উঠল শহরের সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি মঁসিয়ে লে মেয়র।

.

কিন্তু মেয়র হলেও বিশেষ কোনও পরিবর্তন দেখা দিল না ম্যাদলেনের জীবনযাত্রায়। এখানে প্রথম আসার দিন যেমন ছিল তেমনি সাদাসিধে রয়ে গেল সে। তার গায়ের রংটা ছিল শ্রমিকদের গায়ের রঙের মতো তামাটে। কিন্তু মুখের ওপর ছিল চিন্তাশীল দার্শনিকের ছাপ। সে সবসময় একটা চওড়া টুপি আর গলা পর্যন্ত বোম লাগানো লম্বা ঝুলওয়ালা কোট পরত। সে মেয়রের কাজ করে যেত, কিন্তু কথা কম বলত। সে যতদূর সম্ভব অপরের অভিবাদন বা সৌজন্যমূলক কথাবার্তা এড়িয়ে চলত। যথাসম্ভব নীরবে সে ভিক্ষা বা দানের জিনিস অভাবগ্রস্ত লোকদের বিতরণ করত। মেয়েরা তার সম্বন্ধে বলাবলি করত, লোকটা যেন এক দয়ালু ভাবুক। অবসর সময়ে গ্রামাঞ্চলে গিয়ে একা একা বেড়িয়ে সে সবচেয়ে আনন্দ পেত।

সে সবসময় একা খেত। তার পাশে একটা বই থাকত খাবার সময়। তার একটা বাছাই করা বইয়ের ছোটখাটো লাইব্রেরি ছিল। সে বই ভালোবাসত। বই-ই ছিল আর একমাত্র বন্ধু যারা তার কাছ থেকে কিছু চাইত না। হাতে টাকা আসার সঙ্গে সঙ্গে তার অবসর সময় বেড়ে যায় এবং সেই সময়টা সে বই পড়ে সময়ের সদ্ব্যবহার করে আত্মোন্নতির চেষ্টা করত। তার ভাষা আগের থেকে আরও মার্জিত, ভদ্র, স্পষ্ট এবং ন্যায়সংগত হয়ে উঠল।

সে যখন একা একা বেড়াতে বার হত তখন তার হাতে একটা ছোেট শিকারি বন্দুক থাকত। কিন্তু সেটা কদাচিৎ ব্যবহার করত। তবে কখনও দরকার হলে সেটা ব্যবহার করলে তা নির্ভুল লক্ষ্যের পরিচয় দিত। সে কখনও কোনও নিরীহ নির্দোষ প্রাণী বধ করত না অথবা ছোট ছোট পাখি মারত না।

তার বয়স যৌবন পার হয়ে গেলেও তার গায়ে শক্তি ছিল প্রচুর। কোনও লোক বিপদে পড়লে সে তার দু হাত বাড়িয়ে তাকে সাহায্য করত। কোনও ঘোড়া পড়ে গেলে সে ঘোড়াটাকে তুলে দাঁড় করিয়ে দিত। কোনও গাড়ির চাকা মাটিতে বসে গেলে সে কাঁধ না দিয়ে হাত দিয়ে ধরে সেটাকে টেনে তুলে দিত। কোনও বলদ পালিয়ে গেলে সে তার শিং ধরে আটকে দিত তাকে। কোনও গাঁয়ের ভেতর গেলে সে গায়ের ছেলেমেয়েরা তাকে দেখে খুশি হত, তার চারদিকে মাছির ঝাঁকের মতো ভিড় করত।

সে নিশ্চয় আগে গাঁয়ে বাস করত। কারণ সে চাষিদের চাষের কাজ সম্বন্ধে প্রায়ই যেসব উপদেশ দিত তাতে তার চাষ সম্বন্ধে যে জ্ঞান আছে তা বোঝা যেত। ফসলের উপর কিভাবে ওষুধ ছড়িয়ে পোকা নষ্ট করতে হয় তা সে চাষিদের বলে দিত। কিভাবে জমিতে নুন দিতে হয় তা-ও সে বলে দিত। ফসলভরা জমিতে যেসব আগাছা গজিয়ে উঠে ফসল নষ্ট করে তার উপায় বলে দিত ম্যাদলেন। ইঁদুরের উৎপাত বন্ধ করারও ব্যবস্থা বলে দিত।

একদিন মাঠের ধার থেকে ম্যাদলেন দেখল একদল চাষি মাঠে পাটশাকের মতো এক ধরনের শুকনো আগাছা তুলে ফেলে দিচ্ছে। তা দেখে ম্যাদলেন তাদের বলল, এই চারাগাছগুলো এখন শুকিয়ে গেছে। কিন্তু কাঁচা অবস্থায় এর শাকগুলো রান্না করে খাওয়া যায়। এর গাছগুলো থেকে শনের মতো একরকমের সুতো বার হয়। সেই সুতো থেকে কাপড় পর্যন্ত বোনা যায়। শাকগুলো গবাদিপশুরা কাঁচা খেতে পারে। এর বীজগুলো ভূমির ধারে ধারে বা ফাঁকা জায়গায় ছড়িয়ে দিলেই প্রচুর পরিমাণে এই গাছ জন্মায়। এর জন্য আলাদা করে চাষ করতে বা যত্ন করতে হয় না।

ছেলেমেয়েরা ম্যাদলেনকে বেশি ভালোবাসত। কারণ সে খড় আর নারকেলের ভোলা থেকে খেলনা তৈরি করতে পারত।

যে কোনও মৃত্যুই দুঃখ জাগাত তার মনে। যে কোনও সময়ে চার্চের দরজায় শোকসূচক কালো রঙ দেখলেই ভেতরে ঢুকে পড়ত সে। কোনও লোক মারা গেলে মৃতের আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে মিশে গিয়ে সে-ও শোক প্রকাশ করত। কারও শোক-দুঃখ দেখলেই তার অন্তর কাঁদত। তার সহজাত বিষাদ আর শোকের সঙ্গীত যেন এক সুরে বাঁধা ছিল। মৃত্যুর অন্তহীন শূন্য গহ্বরের এপারে দাঁড়িয়ে কয়েকজন জীবিত মানুষ যে অন্ত্যেষ্টিকালীন গান গাইত সে গানের সকরুণ সুরধারা ম্যাদলেনের মনটাকে যেন মৃত্যুর ওপারে অনন্ত অজানিত এক পরলোকের দিকে ভাসিয়ে নিয়ে যেত।

অনেক সময় অনেক দয়ার কাজ খুব সতর্কভাবে গোপন করত ম্যাদলেন, যেন সে কাজ এক ঘৃণ্য কুকর্ম। অনেক সময় সে কোনও গরিব লোকের বাড়িতে দরজা ঠেলে চুপি চুপি ঢুকে সকলের অলক্ষ্যে অগোচরে টেবিলের উপর একটা স্বর্ণমুদ্রা রেখে আসত। বাড়ির মালিক বাইরে থেকে এসেই ঘরের দরজা খোলা দেখে ভাবত বাড়িতে চোর ঢুকেছিল। কিন্তু পরে সে আশ্চর্য হয়ে দেখত টেবিলের উপর স্বর্ণমুদ্রা পড়ে রয়েছে। কোনও চোর যদি ঢুকে থাকে তো সে চোর বাড়ির কোনও জিনিসপত্র বা টাকাকড়িতে হাত দেয়নি, বরং তাকে এক স্বর্ণখণ্ড দান করে গেছে। বুঝত সে চোর হল পিয়ের ম্যাদলেন।

সকলের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন হলেও ম্যাদলেন ছিল বড় বিষণ্ণ। লোকে বলত, লোকটা ধনী হলেও অহঙ্কারী নয়। সৌভাগ্যবান হলেও সে সুখী নয়

ম্যাদলেন মানুষ হিসেবে ছিল সত্যিই বড় রহস্যময়। লোকে বলত, সে নাকি তার শোবার ঘরে কাউকে ঢুকতে দেয় না। সে ঘরটা নাকি সন্ন্যাসীদের গুহার মতো করে মড়ার মাথার খুলি আর হাড়-কঙ্কালে ভর্তি। এইসব কথা শুনে অনেক সাহসী যুবতী মেয়ে সোজা ম্যাদলেনের কাছে গিয়ে বলত, মঁসিয়ে, আপনার শোবার ঘরটা একবার দেখতে পারি? লোকে বলে, ওটা নাকি একটা গুহা।

ম্যাদলেন মৃদু হেসে তাকে সঙ্গে করে তার শোবার ঘরে নিয়ে যেত। কিন্তু সে ঘরে ঢুকে কেউ আশ্চর্যজনক কোনও বস্তু দেখতে না পেয়ে হতাশ হত। তারা দেখত ঘরটা মেহগনি কাঠের সাধারণ সাদাসিধে ধরনের আসবাবে ভর্তি। সে ঘরের মধ্যে দুটো রুপোর বাতিদান ছিল।

তবু সবাই বলত, পিয়ের ম্যালেনের নির্জন শোবার ঘরটায় ঢুকলেই সন্ন্যাসীর গুহা অথবা সমাধিগহ্বর বলে মনে হয়।

লোকে এই বলে গুজব রটাত যে লাফিত্তে ব্যাংকে ম্যাদলেনের লাখ লাখ ফ্রাঁ জমা আছে এবং ব্যাংকের সঙ্গে তার ব্যবস্থা আছে সে যে কোনও সময়ে ব্যাংকে সোজা চলে গিয়ে লাখ লাখ ফ্রাঁ তুলে নিয়ে আসতে পারে। মাঝে মাঝে ব্যাংকে গিয়ে ম্যাদলেনকে অবশ্য কিছু করে টাকা তুলে আনতে হত। কিন্তু লোকে যেখানে লাখ লাখের কথা বলত সেখানে লাখটা ছিল আসলে হাজার।

.

১৮২২ সালে খবরের কাগজে দিগনের বিশপ মঁসিয়ে মিরিয়েলের মৃত্যুসংবাদ প্রকাশিত হল। তিনি বিরাশি বছর বয়সে পবিত্র ধর্মস্থানে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। সংবাদে আরও জানা যায়, মৃত্যুর কয়েক বছর আগে অন্ধ হয়ে যান বিশপ মিরিয়েল। তবে তাঁর বোন সব সময় তাঁর পাশে থেকে তাঁর সেবা করে যেত।

এখানে প্রসঙ্গক্রমে একটা কথা বলা যেতে পারে। এ জগতে কোনও জীবনই সম্পূর্ণরূপে সুখী নয়, কোনও মানুষই জীবনে পূর্ণতা লাভ করতে পারে না। তবু অন্ধ হয়েও অনেকে সুখী হতে পারে।

কোনও অন্ধ লোকের পাশে যদি তার স্ত্রী, কন্যা অথবা বোন সব সময় থেকে দরকারমতো সেবা করে যায়, যদি তার নিরন্তর উপস্থিতি থেকে তার অন্তরের মমতার একটা পরিমাণ বোঝা যায়, যদি তার পোশাকের খসখস শব্দ অথবা গানের গুনগুন শব্দ থেকে তার বাঞ্ছিত মধুর উপস্থিতির কথা জানা যায়, নক্ষত্রকেন্দ্রিক এক দেবদূতের মতো সেই মমতাময়ী সেবাকারিণী সেই অন্ধ লোকের সঙ্গ কখনও ত্যাগ না করে তা হলে সেই অন্ধ লোকের মতো সুখী আর কেউ হতে পারে না। জগতের সবচেয়ে বড় সুখ হল ভালোবাসার এক নিবিড় আশ্বাসে অভিষিক্ত হওয়া। সব দিক দিয়ে নিঃস্ব এবং ভালোবাসার অযোগ্য হয়েও শুধু ভালোবাসার খাতিরে ভালোবাসা পাওয়া সত্যিই কত সুখের! অন্ধ লোক এই ধরনের ভালোবাসা এবং সেবা পায়। এ ভালোবাসা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হয় কিছু না পেয়েও সব কিছু পেয়ে গেছে সে। ভালোবাসার আলোয় নিষিক্ত হয়ে তার মনে হয় সে আর আলো থেকে বঞ্চিত নয়। সে ভালোবাসা একেবারে বিশুদ্ধ এবং নিঃস্বার্থতায় পবিত্র, যে ভালোবাসা নিশ্চয়তার দৃঢ় ভিত্তিভূমির ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত সে ভালোবাসা লাভ করার সঙ্গে সঙ্গে আর কোনও অন্ধত্ব থাকে না। যে মানুষ কোনও ভালোবাসা পায়নি সে অন্তত আলোর মাঝেও অন্ধকার দেখে আর এই অন্ধকারে তার প্রেমহীন আত্মা এক প্রেমময় আত্মাকে হাতড়ে বেড়ায় যখন দেখে এক জীবন্ত নারীমূর্তি তার প্রেমময় আত্মাকে তার দিকে প্রসারিত করে দিয়ে তার সেবার জন্য সতত প্রস্তুত হয়ে আছে, যে নারীর ওষ্ঠাধর তার ললাটকে স্পর্শ করছে, তার হাত তার সেবায় সতত নিয়ত হয়ে আছে, তার মেদুর নিশ্বাস তার দেহগাত্রের উপর নিঃশব্দে ঝরে পড়ছে, যখন দেখে তা মমতা আর শ্রদ্ধার এক নিবিড়তম অনুভূতি তার নিঃসঙ্গতার অসহায়তাকে নিঃশেষে দ্রবীভূত করে দিয়ে তাকে ঘিরে আছে সব সময়ের জন্য, তখন তার মনে হয় ঈশ্বরের অনন্ত করুণা নেমে এসেছে সেই নারীর হাতের মধ্যে। স্বয়ং ঈশ্বরই মূর্ত হয়ে উঠেছেন সে নারীর মধ্যে। এ সুখের থেকে বড় সুখ আর কী হতে পারে? তখন তার সমগ্র অন্তরাত্মা স্বর্গীয় সুষমাসিক্ত এক অদৃশ্য ফুলের মতো ফুটে ওঠে, যার রহস্যময় আলোর উজ্জ্বলতা তার দুচোখের সব অন্ধত্বকে দূর করে দেয়। সে তখন আর কোনও আলো চায় না। যে অন্ধকার ভালোবাসার ছোঁয়ায় আলোর ফুল ফুটে ওঠে জীবনে সে অন্ধকারের বিনিময়ে কোনও আলোই চায় না মানুষ। এক জ্যোতিষ্মন দেবদূতের মতো সে নারী অন্ধকে ঘিরে থাকে সব সময়, তাকে ফেলে কোথাও যায় না। মাঝে মাঝে মুহূর্তের জন্য স্বপ্নের মতো অদৃশ্য হয়ে গেলেও পরমুহূর্তেই সে আবার ফিরে আসে বাস্তবতার মাঝে। সে আসার সঙ্গে সঙ্গে তার দেহমন হতে বিচ্ছুরিত জ্যোতির উষ্ণতার এক পরম আস্বাদ পাই আমরা, তার প্রশান্ত ব্যক্তিত্বের প্রেমময় উপস্থিতি আনন্দের উচ্ছ্বসিত প্লাবন নিয়ে আসে আমাদের নীরস প্রাণে। অন্ধকারের মাঝেও তার জ্যোতিতে জ্যোতির্ময় হয়ে উঠি আমরা। আমাদের সেবা, আরাম ও স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য সে নারীর মমতামধুর ভালোবাসা বারবার ধ্বনিত হয়, তার সেবায়, বারবার সিক্ত ও অভিস্নাত হয়ে নবজীবন লাভ করি আমরা। ছায়াচ্ছন্ন এক ব্যাপ্ত বিষাদের মাঝে এক স্বর্গসুখের সন্ধান পাই আমরা।

এই স্বর্গসুখের জগৎ থেকেই পরলোকে চলে যান মঁসিয়ে বিয়েনভেনু।

মন্ত্রিউলের এক পত্রিকায় বিশপ বিয়েনভেনুর মৃত্যুসংবাদ প্রকাশিত হয়। আর তার পরদিনই মঁসিয়ে ম্যাদলেন কালো পোশাক পরে শোক পালন করতে থাকে। এ নিয়ে শহরের লোকের মুখে আলোচনা চলতে থাকে। এই ঘটনার মাঝে কেউ কেউ ম্যালেনের অতীত জীবনের রহস্যের সন্ধান করতে থাকে। শহরে অভিজাত লোকেরা তাদের বৈঠকখানায় বসে বলাবলি করতে থাকে, ম্যাদলেন দিগনের বিশপের জন্য শোক পালন করছে। বিশপ হয়তো ওর কোনও আত্মীয় ছিলেন। এতে অভিজাত সমাজে তার খাতির বেড়ে যায়। শহরের বয়স্ক মহিলারা ঘন ঘন দেখা করতে আসে ম্যালেনের সঙ্গে। যুবতী মেয়েরা তাকে হেসে অভিবাদন জানাতে থাকেন।

একদিন সন্ধ্যার সময় এক বিধবা মহিলা এসে তাকে প্রশ্ন করে, আচ্ছা মঁসিয়ে মেয়র, দিগনের বিশপ কি আপনার জ্ঞাতিভাই ছিলেন?

ম্যাদলেন বলল, না মাদাম।

বিধবা বললেন, কিন্তু আপনি তো শোক পালন করছেন।

ম্যাদলেন বলল, কারণ যৌবনে আমি তাদের বাড়িতে ভৃত্য ছিলাম।

শহরে যখন কোনও ভবঘুরে ছেলে চিমনি পরিষ্কার বা ঝট দেওয়ার কাজ করতে আসত তখন ম্যাদলেন তাকে ডেকে পাঠাত। তার নাম জিজ্ঞাসা করত, তাকে টাকা দিত। কথাটা প্রচারিত হতে অনেক ভবঘুরে ছেলে প্রায়ই এ শহরে আসত।

.

ক্রমে মঁসিয়ে ম্যালেনের বিরুদ্ধে সব প্রতিকূলতা, যত নিন্দাবাদ স্তব্ধ হয়ে গেল। মানুষ বড় হলেই তাকে অনেক নিন্দা সহ্য করতে হয়। ম্যাদলেনকেও তাই করতে হয়েছিল। কিন্তু ক্রমে তা অতীতের ঈর্ষাত্মক ঘটনার কাহিনী হিসেবে চাপা পড়ে গেল লোকের মনের মধ্যে। ১৮২১ সাল পর্যন্ত ম্যালেনের প্রতি স্থানীয় জনগণের শ্রদ্ধাভক্তি বেড়ে যেতে থাকে ক্রমশ। তার খ্যাতি দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ায় প্রায় কুড়ি মাইল দূর থেকে বহু লোক মেয়র মঁসিয়ে ম্যালেনের নানা বিষয়ে আলোচনা করতে লাগল। ম্যাদলেন অনেক ঝগড়া-বিবাদ ও মামলা-মোকদ্দমা মিটিয়ে দিত। অনেকের অনেক শক্রতার অবসান ঘটিয়ে তাদের মধ্যে মিল করিয়ে দিত। সকলেরই তার বিচার-বিবেচনায় আস্থা ছিল। তার কথাই ছিল যেন আইন। এইভাবে মাত্র ছয়-সাত বছরে মধ্যে সারা দেশে তার যশ মহামারি রোগের মতো ছড়িয়ে পড়ল।

একটা মাত্র লোক এই ছোঁয়াচে রোগের সংক্রমণ থেকে মুক্ত ছিল। মাদলেন যত ভালো কাজই করুক না কেন, লোকটা তা কখনও স্বীকার করত না ভালো বলে। তার প্রতি সব সময় একটা সংশয় আর অবিশ্বাসকে পোষণ করে চলত। কতকগুলি লোকের মধ্যে পাপপ্রবৃত্তি খুব প্রবল থাকে যে প্রবৃত্তি নিখাদ ধাতুর মতো খাঁটি এবং যে প্রবৃত্তির দ্বারা মানুষের প্রতি অনুরাগ-বিরাগ নিয়ন্ত্রিত হয়। এই পাপপ্রবৃত্তির জন্য সেইসব মানুষ আত্মম্ভরিতার বশবর্তী হয়ে কোনও বুদ্ধি বা যুক্তির পরামর্শ মানতে চায় না। তারা সককেই শুধু ঘৃণা করে যায়। তাদের মনের সংশয় আর অবিশ্বাস কোনও অপরিচিত লোক দেখলেই বিড়ালের পেছনে কুকুর আর খেকশিয়ালের পেছনে সিংহের মতো ছুটে যায় তার পেছনে।

ম্যাদলেন যখন রাস্তা দিয়ে দু ধারের নাগরিকদের অভ্যর্থনা পেতে পেতে হাসিমুখে কোথাও যেত, লম্বা চেহারার ঝুল কোটপরা একটা লোক ছড়িহাতে দাঁড়িয়ে তাকে লক্ষ করত। ম্যাদলেন যতক্ষণ পর্যন্ত তার চোখের আড়াল হয় ততক্ষণ তাকে লক্ষ করতে যেত লোকটা। লক্ষ করত সে তার নিচের ঠোঁটটা উপরের ঠোঁটের উপর চাপিয়ে মাথাটা আপন মনে নাড়ত। যেন আপন মনে বলত, লোকটা কে? আমি আগে নিশ্চয় কোথাও দেখেছি, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

লোকটা দেখতে এমনই যে তাকে একবার দেখলেই মনে রেখাপাত করে। মনের মধ্যে কেমন এক অজানা ভয় জাগে। লোকটার নাম হল জেতার্ত এবং সে পুলিশের লোক।

মন্ত্রিউল-সুর-মের-এর পুলিশ ইন্সপেক্টর সে তার যথাকর্তব্য পালন করে গেলেও মাঝে মাঝে তার কাছের লোক তাকে ঘৃণা করত। ম্যাদলেন যখন প্রথম মন্ত্রিউলে আসে জেভার্ত তখনও আসেনি। ম্যাদলেন কিভাবে তার কাজ-কারবার শুরু করে তা সে দেখেনি। সে যখন মন্ত্রিউলের পুলিশ ইনস্পেক্টর হিসেবে তার কার্যভার গ্রহণ করে তখন ম্যাদলেন নাম আর টাকা দুটোই করেছে। সে তখন পিয়ের ম্যাদলেন থেকে মঁসিয়ে ম্যাদলেন হয়ে উঠেছে।

সাধারণত পুলিশ অফিসারদের মধ্যে কিছু ভালো প্রবৃত্তির সঙ্গে একটা প্রভুত্বের ভাব থাকে। কিন্তু জেভার্তের মধ্যে ছিল শুধু অবিমিশ্র প্রভুত্বের ভাব, তার মধ্যে ভালো কোনও প্রবৃত্তি ছিল না।

মানুষের আত্মা যদি মানুষে দেখতে পেত তা হলে সে বুঝতে পারত প্রাণিজগতের বিভিন্ন পশু-পাখিগুলো মানুষের আত্মারই এক একটা প্রতিরূপ। সামান্য ঝিনুক থেকে ঈগলপাখি, শুয়োর থেকে বাঘ–সব আছে মানুষের মধ্যে। কোনও কোনও মানুষের মধ্যে আছে আবার দু’ তিন রকমের জন্তুর স্বভাব।

আসলে প্রাণিজগতের সব জন্তুই মানুষের ভালো-মন্দ স্বভাবের এক একটা বস্তুর প্রতিরূপ। তাদের আত্মারই এক একটা বাস্তব প্রতিফলন। ঈশ্বর আমাদের চোখের সামনে পশুদের হাজির করিয়ে আমাদের শিক্ষা দিতে চান। তবে মানুষের আত্মার মধ্যে বুদ্ধি বলে একটা জিনিস আছে এবং শিক্ষালাভের একটা শক্তি আছে। সুপরিচালিত সামাজিক শিক্ষার দ্বারা মানুষ তার আত্মার অন্তর্নিহিত শক্তিকে বার করে এনে কাজে লাগাতে পারে। আমরা এই সামাজিক শিক্ষার দ্বারা কোনও মানুষকে বা পশুকে দেখে তাদের ভেতরকার স্বভাবের কথা জানতেও পারি। কোনও মানুষের চেহারা বা দেহাবয়ব দেখে তার অন্তরের স্বরূপটা বুঝতে না পারার কোনও কারণ থাকতে পারে না।

জেভার্তের জন্ম হয় কারাগারে। তার মা জ্যোতিষের কাজ করত। তার বাবা কাজ করত নৌবহরে। বড় হয়ে জেভার্ত বুঝতে পারল সমাজে প্রবেশ করার কোনও অধিকার নেই তার। সমাজের কাছে সে এক ঘৃণ্য জীব। কিন্তু সে সমাজের দুটো শ্রেণির লোককে ভয় করে এবং তাদের কাছ থেকে দূরে থাকতে চায়। এই দুটো শ্রেণির একটা সমাজের ক্ষতিসাধন করতে চায়, সমাজের মধ্যে বিশৃঙ্খলা আনতে চায় অর্থাৎ তারা সমাজবিরোধী, আর এক শ্রেণি হল সমাজের রক্ষাকর্তা। জেতার্ত দেখল এই দুটো শ্রেণির একটাকে তার বেছে নিতেই হবে।

ভবঘুরে ধরনের সমাজবিরোধীদের সে ঘৃণা করত, কারণ সে নিজে একদিন তাদের শ্রেণীভুক্ত ছিল। সে তাই পুলিশেই যোগদান করে।

এদিক দিয়ে সে বেশই উন্নতি করে। চল্লিশ বছর বয়সেই সে পুলিশ ইনস্পেক্টর হয়। অথচ যৌবনে সে মিদিতে ছিল এক জেলপ্রহরী। যাই হোক, এবার আমরা জেভার্তের মুখটা খুঁটিয়ে দেখব।

তার নাকটা ছিল থ্যাবড়া; নাসারন্ধ্র দুটো ছিল বেশ বড় বড়। নাকের দু দিকে ছিল দুটো লম্বা-চওড়া গালপাট্টা। একনজরে দেখলেই তার গালপাট্টা দুটো কালো ঝোঁপের মতো দেখায়। জেভার্ত খুব হাসত। কিন্তু যখন সে হাসত তার সব দাঁত আর দাঁতের মাড়ি দেখা যেত। তার নাকের দু ধারে দুটো বড় বড় টোল খেত। জেভার্ত যখন হাসত না তখন তাকে বুলডগের মতো দেখাত আর যখন সে হাসত তখন তাকে বাঘের মতো দেখাত। তার ভ্র দুটো সংকীর্ণ ছিল, কিন্তু চোয়াল দুটো বড় ছিল। তার লম্বা চুলগুলো কপালটাকে ঢেকে থাকত। তার ভ্রু দুটো প্রায় সব সময় কুঞ্চিত থাকত বলে তার ক্রোধটা প্রকটিত হয়ে উঠত। তার চোখ আর মুখ দুটোই ভয়ঙ্কর দেখাত।

তার মনের ভাবধারার দুটো প্রধান উপাদান ছিল। সরকারি কর্তৃপক্ষের প্রতি তার একটা কুটিল শ্রদ্ধা ছিল এবং সেই কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে যারা বিদ্রোহ করে তাদের প্রতি তার একটা ভয়ঙ্কর ঘৃণা ছিল। চৌর্য, নরহত্যা প্রভৃতি যে কোনও অপরাধকে সরকারি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বলে ধরে নিত সে।

সামান্য পিয়ন থেকে মন্ত্রী পর্যন্ত যেসব লোক প্রশাসনিক কাজে নিযুক্ত থাকত, জেভার্ত তাদের শ্রদ্ধার চোখে দেখত এবং যে কোনও প্রশাসনিক কাজকে সে পবিত্র মনে করত। যারা আইন ভঙ্গ করত তাদের প্রতি এক প্রবল ঘৃণা, বিরক্তি আর বিতৃষ্ণা অনুভব করত। কোনও বিষয়ে তার কোনও বিচারকে সে অভ্রান্ত বলে মনে করত। তার কেবলই মনে হত তার সে বিচারের মধ্যে কোনও ত্রুটি বা ফাঁক নেই। সে একদিকে বলত, সরকারি কর্মচারীরা কোনও অন্যায় করতে পারে না। ম্যাজিস্ট্রেটরা সব সময় ঠিক বিচার করে থাকে। আবার অন্যদিকে অপরাধীদের সম্বন্ধে বলত, ওরা একেবারে অধঃপতিত, ওদের দ্বারা আর কিছু হবে না, ওরা জীবনে আর কোনও ভালো কাজ করতে পারবে না। যেসব উগ্র মনোভাবাপন্ন লোক আইনের শক্তিকে সর্বোচ্চ, সার্বভৌম আর অবিসংবাদিত বলে মনে করে জেতার্ত তাদের সঙ্গে একমত। সে ছিল স্টইক সন্ন্যাসীদের মতো আত্মনিগ্রহে কঠোর, আবার ভোগে আগ্রহী। কল্পনাপ্রবণ ভাববাদী লোকদের মতো সে ছিল একই সঙ্গে বিনম্র এবং অহঙ্কারী। তার চোখের দৃষ্টি ছিল একই সঙ্গে হিমশীতল আর মর্মভেদী। প্রহরীর মতো সব সময় সজাগ থাকাই তার জীবনের মূলমন্ত্র ছিল। তার বিবেকটাকে সে তার নীতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছিল। যেটাকে সে কর্তব্য বলে মনে করত সেই কর্তব্যকর্মই ছিল তার ধর্ম। গুপ্তচরের মতো সে সবার কাজকর্ম অলক্ষ্যে লক্ষ করে যেত। একমাত্র অভিশপ্ত এবং হতভাগ্য ব্যক্তিরাই তার। কু-নজরে পড়ত বা তার হাতে ধরা পড়ত। জেল থেকে পালানোর জন্য সে হয়তো তার বাবাকেও গ্রেপ্তার করতে পারত এবং আইন ভঙ্গ করার জন্য সে হয়তো তার মাকেও দণ্ডদান করতে পারত এবং এ কাজকে সে পবিত্র ধর্মীয় কাজ বলে মনে করত। সে যে কঠোর কর্তব্যপরায়ণতায় অবিচল, আত্মনিগ্রহ আর নিষ্ঠুর সততার জীবন যাপন করত, তার মধ্যে কোনও ফাঁক বা বিন্দুমাত্র বিচ্যুতি ছিল না। সে ছিল মনে-প্রাণে নিঃসঙ্গ। পুলিশের কাজে তার এক অদ্ভুত সততা আর নিষ্ঠা ছিল। ব্রুটাস আর দাগি অপরাধী থেকে পুলিশের বড়কর্তা হওয়া ডিদোকের সংমিশ্রণে গড়া সে যেন ছিল মর্মর প্রস্তরনির্মিত এক নির্মম গুপ্তচরের প্রতিমূর্তি।

জেভার্তের স্বভাব ছিল সব কিছু গোপনে লক্ষ করা। যারা ছিল জোশেফ দ্য মেস্তারের দলের লোক এবং রাজতন্ত্রের উপাসক, যারা সৃষ্টিতত্ত্বের ব্যাখ্যার মাধ্যমে রাজতন্ত্রের সমর্থনে পত্রপত্রিকায় প্রবন্ধ লিখত তারা জেভার্তকে এক আদর্শ রাজকর্মচারীর প্রতীক। হিসেবে ভাবতে পারত।

সাধারণত জেভার্তের কপালটা দেখা যেত না। টুপিটা কপালের উপর নামানো থাকত। চোখ দুটো দ্রুযুগলের নিচে কেমন যেন চাপা পড়ে থাকত, তার হাত দুটো জামার আস্তিনের নিচে ছড়িটাকে ধরে থাকত বলে সাধারণত তা দেখা যেত না। কিন্তু দরকার হলে তার কপাল, চোখ, মুখ, হাত, হাতের ছড়ি এই সবকিছু ঝোঁপের আড়ালে লুকোনো শত্রুর মতো অকস্মাৎ বেরিয়ে এসে এক ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করত।

অবসর সময়ে বই পড়ত জেভাৰ্ত, যদিও বই পড়া কাজটাকে অলসদের কাজ হিসেবে ঘৃণা করত সে। যাই হোক, সে পড়তে পারত এবং একেবারে অশিক্ষিত ছিল না। তার কথাবার্তা থেকেও এটা প্রায়ই বোঝা যেত। তার কোনও নেশা ছিল না, বা সে কোনও কুকর্ম করত না। তবে তার মন ভালো থাকলে সে একটু করে নস্যি নিত। এটাই ছিল তার একমাত্র নেশা।

বিচার বিভাগীয় মন্ত্রীর বাৎসরিক পরিসংখ্যান তালিকায় পদমর্যাদাহীন নিচের তলার যেসব মানুষের নাম ছিল তাদের কাছে জেভার্ত ছিল এক ত্রাসের বস্তু। তার নাম শুনলে তারা ছিটকে পালাবার চেষ্টা করত, দেখা হয়ে গেলে তারা ভয়ে স্তম্ভিত হয়ে যেত। জেভার্ত তাদের কাছে ছিল এমনই ভয়ঙ্কর।

মঁসিয়ে ম্যালেনের ওপর কড়া নজর রেখে এক অপার সংশয় আর বিস্ময়ের সঙ্গে তাকে লক্ষ করে যেত জেভার্ত। ম্যাদলেনও ক্রমে এটা জানতে পারে। কিন্তু সে এটাকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। এ নিয়ে সে কোনওদিন প্রশ্ন করেনি জেভার্তকে, তাকে ডেকে পাঠায়নি অথবা তাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেনি। সে জেভার্তের এই গুপ্তচরগিরি সহ্য করে যায়। আর পাঁচজন লোকের সঙ্গে যেমন ব্যবহার করত তেমনি জেভার্তের সঙ্গেও ভালো ব্যবহার করে যেত।

এ বিষয়ে জেভার্ত যা দু-চারটে কথা বলেছিল তার থেকে বোঝা যায় সে মঁসিয়ে ম্যালেনের পূর্বজীবনের অনেক খোঁজ-খবর পেয়েছে, সে কোথায় কী কী করেছে, তা সে জানতে পেরেছে। এক দূর গ্রামাঞ্চলের যে একটি পরিবার অন্যত্র চলে যায় সেই পরিবার সম্বন্ধে অন্য একজন খোঁজ-খবর নিচ্ছে। জেভার্ত একদিন নিজের মনেই বলে ওঠে, এইবার বলছি তাকে।

কিন্তু এরপরই সে নীরব হয়ে যায় একেবারে। তার থেকে মনে হয় সন্ধানের যে সুতোটা সে খুঁজে পেয়েছিল সে সুতোটা হঠাৎ ছিঁড়ে গেছে।

কোনও মানুষের স্বভাব বা প্রবৃত্তি কখনও অভ্রান্ত হতে পারে না একেবারে। সে যত সতর্কভাবেই চলুক না কেন, কখনও কখনও সে অসতর্ক হয়ে পড়বেই। মঁসিয়ে ম্যালেনের মধ্যে শান্ত ভাব দেখে জেভার্ত হতবুদ্ধি হয়ে যেত। ম্যালেনের ব্যাপারে সে যে এত খোঁজ-খবর নিচ্ছে তা সে তাকে ঘুণাক্ষরেও জানতে বা বুঝতে দিত না। কিন্তু কোনও একদিনের ঘটনায় সে এমন একটা আচরণ করে ফেলল যাতে সে নিজেই মঁসিয়ে ম্যালেনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ফেলল।

.

একদিন শহরের একদিকে একটা কাঁচা পথ দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ একটা গোলমাল শুনতে পেল ম্যাদলেন। দেখল এক জায়গায় একদল লোক জড়ো হয়েছে। এগিয়ে গিয়ে ম্যাদলেন দেখল পিয়ের ফকেলেভেন্ত নামে একজন লোকের গাড়ির ঘোড়াটা পড়ে যাওয়ায় সে নিজে গাড়ির তলায় চাপা পড়ে গেছে।

পিয়ের ফকেলেভেন্ত ছিল সেইসব লোকের একজন যারা তখনও পর্যন্ত ম্যাদলেনকে বন্ধুভাবে গ্রহণ করতে পারেনি বা তার সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠেনি। সে অল্প লেখাপড়া শিখে দলিল নকলের কাজ করত। কিন্তু ম্যাদলেন যখন এ অঞ্চলে আসে তখন ফকেলেভেন্তের কারবার খারাপের দিকে যেতে থাকে। ফকেলেভেন্তু যখন দেখল তার চোখের সামনে কারবার করতে করতে ম্যাদলেন ফুলে উঠল, তার কারখানায় কত লোক কাজ করে ভালো বেতন পেতে লাগল তখন অবস্থা খারাপ হয়ে যাওয়ায় মাদলেনের ওপর দারুণ ঈর্ষা অনুভব করতে লাগল সে। অথচ সে শ্রমিকের কাজও করতে পারত না, কারণ তখন তার বয়স হয়েছিল এবং সে শক্তি তার ছিল না। বাড়িতে অবশ্য তার ছেলে-পরিবার কেউ ছিল না। তার একটা ঘোড়া আর একটা গাড়ি ছিল। অন্য কোনও উপায় না দেখে ফকেলেভেন্ত ঘোড়ার গাড়িটা বার করে ভাড়া খাটাতে লাগল। এর পর মাল বয়ে বেড়াত।

ঘোড়াটার পেছনে পা দুটো ভেঙে যায়। সে আর উঠতে পারবে না। ফকেলেভেন্ত গাড়ির তলায় এমনভাবে চাপা পড়ে যায় যে গাড়ির সমস্ত ভারটা তার বুকের উপর পড়ল। কারণ গাড়ির চাকাগুলো কাদার মধ্যে ডুবে যাচ্ছিল ক্রমশ। গাড়ির তলা থেকে ফকেলেভেন্তকে টেনে বার করার অনেক চেষ্টা করা হয়। কিন্তু করা যায়নি। জেভার্তও ঘটনাস্থলে গিয়ে পড়ে। সে গাড়িটা কেটে ফকেলেভেন্তকে বার করার জন্য একটা কর্মকারকে ডেকে পাঠায়।

এমন সময় ম্যাদলেন সেখানে যেতে সকলে সম্ভ্রমভরে সরে গিয়ে তার জন্য পথ করে দিতে লাগল। ম্যাদলেন জানত, কর্মকারকে ডাকতে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু তার আসতে পনেরো মিনিট সময় লাগবে।

আগের দিন জোর বৃষ্টি হওয়ায় মাটি ভিজে ছিল। তাই গাড়ির চাকাগুলো ক্রমশই বসে যাচ্ছিল। ফলে ফকেলেভেন্তের বুকের উপর বেশি করে চাপ পড়ছিল। আরও কিছুক্ষণ দেরি হলে তার বুকের পাঁজরগুলো ভেঙে যাবে।

ম্যাদলেন বলল, পনেরো মিনিট, অনেক সময়।

একজন বলল, কিন্তু কোনও উপায় নেই।

ম্যাদলেন ভিড় করা জনতার দিকে তাকিয়ে বলল, এমন কেউ নেই যে গাড়ির তলায় ঢুকে পিঠ দিয়ে গাড়িটা তুলে ধরবে? তা হলে সহজেই ফকেলেভেন্ত বেরিয়ে আসতে পারবে। আমি তা হলে তাকে পাঁচ লুই দেব।

কিন্তু কেউ এগিয়ে এল না ভিড়ের মধ্য থেকে।

ম্যাদলেন বলল, দশ লুই দেব। ভিড়ের মধ্য থেকে একজন বলল, এর তলায় যে ঢুকবে তাকে শয়তানের মতো শক্তিমান হতে হবে।

তা না হলে সে নিজেই চাপা পড়ে মরবে।

ম্যাদলেন বলল, কুড়ি লুই দেব।

তবু কেউ এগিয়ে এল না।

ম্যাদলেন এবার জেভার্তকে দেখতে পেল। এতক্ষণ তার নজর যায়নি সেদিকে।

জেভার্ত বলল, প্রচুর শক্তির দরকার। একটা বোঝাই করা গাড়ি পিঠ দিয়ে তোলা সহজ ব্যাপার নয়।

ম্যাদলেনের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে জেতার্ত কুটিলভাবে বলল, আমি মাত্র একজনকে জানি মঁসিয়ে ম্যাদলেন, যে এটা করতে পারে। সে ছিল একদিন কয়েদি।

ম্যাদলেন আশ্চর্য হয়ে বলল, তাই নাকি?

জেভার্ত বলল, হ্যাঁ, সে ছিল তুলোঁর জেলখানায়।

ম্যালেনের মুখখানা ম্লান হয়ে গেল।

এদিকে গাড়ির চাকাগুলো আরও বসে যাচ্ছিল। ফকেলেভেন্তু যন্ত্রণায় চিৎকার করতে করতে বলছিল, আমাকে বাঁচাও, আমার বুকের পাঁজরগুলো ভেঙে যাচ্ছে। আমার শাসরোধ হয়ে আসছে।

ম্যাদলেন আবার একবার ভিড়ের দিকে তাকিয়ে বলল, কুড়ি লুই-এর বিনিময়েও কেউ এই লোকটিকে বাঁচাবার জন্য একবার চেষ্টা করবে না?

জেভার্ত বলল, আমি যার কথা বললাম একমাত্র সে-ই পারে।

ম্যাদলেন ইতস্তত করতে লাগল। সে একবার জেভার্তের শকুনিসুলভ চোখের দিকে আর একবার স্তব্ধ জনতার দিকে তাকাল। তার পর নিজেই গাড়ির তলায় ঢুকে পড়ল।

ম্যাদলেন প্রথমে কনুই-এর ভর দিয়ে উপুড় হয়ে দুবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হল। বাইরে থেকে একদল লোক বলল, পিয়ের ম্যাদলেন, চলে এস ওখান থেকে।

ভেতর থেকে ফকেলেভেন্তও বলল, চলে যান মঁসিয়ে ম্যাদলেন, আমি আর বাঁচব না, আপনি চলে যান। আপনিও মারা যাবেন।

ম্যাদলেন কোনও কথা বলল না।

জনতা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সহসা বসে যাওয়া চাকাগুলো ধীরে ধীরে উঠতে লাগল। ম্যাদলেন চাপা গলায় বলতে লাগল, আমাকে একটু সাহায্য কর।

হঠাৎ সবই ছুটে এসে গাড়িটা তোলার চেষ্টা করতে লাগল। একটা লোকের শক্তি আর সাহস দেখে অবাক হয়ে গেল সবাই। ফকেলেভেন্ত বেঁচে গেল।

গাড়িটা উঠে যেতেই ম্যাদলেন উঠে দাঁড়াল। তার মুখটা ঘামে ভিজে গিয়েছিল। তবু একটা তৃপ্তির অনুভূতি ছড়িয়ে ছিল তার মুখে। তার পোশাকটা ছিঁড়ে গিয়েছিল এবং তাতে কাদা লেগে গিয়েছিল। ফকেলেভেন্ত ম্যালেনের সামনে নতজানু হয়ে বসে তাকে জড়িয়ে ধরল। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিতে লাগল। ম্যালেনের চোখে-মুখে এক তৃপ্তি ও বিজয়গর্বের সঙ্গে এক কাতর ভাব ছিল। সে ভাবের সঙ্গে জেভার্তের ভয়টা তখনও ছিল। সে শান্তভাবে জেভার্তের মুখপানে তাকাল। দেখল জেভাৰ্ত তখনও তার মুখপানে তাকিয়ে তাকে লক্ষ করছে।

.

সেদিনকার দুর্ঘটনায় গাড়িচাপা পড়ে ফকেলেভেন্তের হাঁটুর একটা চাকতি ভেঙে যায়। ম্যাদলেন তাকে সঙ্গে করে একটা হাসপাতালে ভর্তি করে তার দেখাশোনা করার জন্য দু জন নার্স নিযুক্ত করল। এ হাসপাতালটা তার শ্রমিকদের সুবিধার জন্য তার একটা কারখানার মধ্যেই করেছিল। পরের দিন সকালে ফকেলেভেন্তু তার ঘরে বিছানার পাশে একটা টেবিলের উপর এক হাজার ফ্রাঁ’র নোট পেল। তার সঙ্গে একটি কাগজে ম্যালেনের হাতে লেখা ছিল, আমি আপনার গাড়ি ও ঘোড়ার ব্যবস্থা করছি।

ফকেলেভেন্তের গাড়িটা ভেঙে যায় এবং ঘোড়াটা মারা যায়। ফকেলেভেন্ত সেরে উঠল কিছুদিনের মধ্যে। কিন্তু তার হাঁটুটা শক্ত আর খাড়া হয়ে রইল। হাঁটুটা আগের মতো মুড়তে পারল না। কয়েকজনের পরামর্শে মাদলেন প্যারিসের সেন্ট আঁতোনের অন্তর্গত এক কনভেন্টে এক মালীর কাজ জোগাড় করে দিল ফকেলেভেন্তকে।

এই ঘটনার কিছু পরেই মঁসিয়ে ম্যাদলেন দ্বিতীয়বারের জন্য মেয়র নির্বাচিত হল। শহরের সর্বময় কর্তা হয়ে উঠল সে। সে যখন মেয়রের পোশাক পরে বার হত তখন তাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে ঈর্ষার এক কাঁপন জাগত জেভার্তের বুকের মধ্যে, ভেড়ার চামড়া ঢাকা এক নেকড়ে দেখে এক শিকারি কুকুরের মধ্যে যেমন কাঁপন জাগে। তবে যতদূর সম্ভব মেয়রকে এড়িয়ে চলত জেভার্ত। সরকারি কোনও কর্তব্যের খাতিরে মেয়রের কাছে জেতার্তকে যেতে হলে সে প্রথম তো তাকে সম্মান জানাতে বাধ্য হত।

ম্যাদলেনের জন্য শহরের বহিরঙ্গটারই শুধু উন্নতি হয়নি, অদৃশ্য কয়েকটি দিকেও তার উন্নতি হয়। শহরের অধিবাসীদের অবস্থা আগে যখন খুব খারাপ ছিল তখন কর ঠিকমতো আদায় হত না। আবার সেই বাকি কর আদায় করার জন্য বেশি লোক লাগত এবং তার জন্য খরচ বেশি হত। কিন্তু বর্তমানে শহরবাসীদের আয়ের উন্নতি হওয়ায় কর সবাই সহজে দিয়ে দেয় এবং কর আদায়ের জন্য খরচও অনেক কম হয়। অর্থমন্ত্রী মন্ত্রিউল-সুর-মেরের কথা উল্লেখ করে অন্য শহরের মেয়রদের শিক্ষা দেন।

মন্ত্রিউল শহরের যখন এই রকম অবস্থা চলছিল তখন একদিন ফাঁতিনে ফিরে আসে সেখানে। কেউ তার কথা মনে রাখেনি। তবে তাকে কষ্ট পেতে হয়নি তার জন্য। কারণ ম্যালেনের কারখানার দরজা তখন খোলা ছিল। সে মেয়েদের কারখানায় একটা চাকরি পেয়ে যায়। কাজটা তার কাছে নতুন এবং সে কাজ সে ভালো জানতও না। বেতনও খুব একটা বেশি ছিল না। তবু এই চাকরিটা পাওয়াতে ফাঁতিনের খুবই উপকার হল। সে অন্তত তার জীবিকাটা অর্জন করতে পারল।

.

ফাঁতিনে যখন দেখল সে দু বেলা পেট ভরে খেতে পাচ্ছে তখন তার খুশির অন্ত রইল না। সদ্ভাবে পরিশ্রম করে জীবিকার্জন করতে পারাটা ঈশ্বরের আশীর্বাদ ছাড়া আর কিছুই নয়। এর ফলে কাজের প্রতি তার আগ্রহ আর নিষ্ঠা বেড়ে গেল। সে তার থাকার জন্য ছোটখাটো একটা ঘর ভাড়া করল। সে একটা আয়না কিনল। সেই আয়না দিয়ে সে তার মুখ-চোখ, যৌবন, দেহসৌন্দর্য, সাদা দাঁত, সুন্দর চুল–সব কিছু দেখত এবং দেখে আনন্দ পেত। অতীতের অনেক অবাঞ্ছিত ঘটনার কথা ভুলে গেল সে। সে শুধু তার মেয়ে কসেত্তের কথা ভাবত। তার ভবিষ্যৎ কিভাবে গড়ে তুলবে সে তার জন্য অনেক পরিকল্পনা করত মনে মনে।

তার বিয়ে হয়েছে এ কথা কারও কাছে বলেনি ফাঁতিনে। সুতরাং তার যে মেয়ে আছে এ কথাও বলতে পারেনি কাউকে। প্রথম প্রথম সরকারি চিঠি লেখানোর লোকের কাছে গিয়ে তাকে দিয়ে থেনার্দিয়েরদের কাছে চিঠি ও টাকা পাঠাত। কিন্তু পরে কথাটা জানাজানি হয়ে যায়। অনেকে মন্তব্য করতে থাকে, মেয়েটা মিথ্যা কথা বলে।

যাদের সঙ্গে আমাদের কোনও স্বার্থের ব্যাপার নেই, যাদের সঙ্গে আমাদের কোনও সম্পর্ক নেই, আমাদের চালচলন ও কাজকর্মের দিকে তাদের নজরই বেশি। তা না হলে সন্ধের দিকে একটা লোককে ফাঁতিনের বাসার কাছে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যাবে কেন? আবার পেছনের দিকে রাস্তাটাতেই বা দু-একজনকে দেখা যাবে কেন?

কতকগুলি লোক আছে যারা অবসর সময়ে ভালো কাজ না করে শুধু এক তরল কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে পরের খোঁজখবর নিয়ে বেড়াবে। তারা অপরের জীবনের কোনও অজানা রহস্যের সন্ধান করার জন্য দিনের পর দিন কষ্ট করবে, খরচ করবে আর সেই রহস্য অবশেষে উদ্ঘাটন করতে পারলে কৌতূহল নিবৃত্ত করতে পারার জন্য এক অকারণ আত্মতৃপ্তি লাভ করবে।

অনেকে আবার শুধু পরচর্চা করতে ভালোবাসে আর সেই পরচর্চা করতে গিয়ে অকারণে ঈর্ষায় ফেটে পড়ে। প্রতিবেশীদের প্রতি অনুভূত ঈর্ষার আগুনে পরচর্চা ইন্ধন জোগায়।

ফাঁতিনের জীবনযাত্রার ওপর অনেকেই লক্ষ রাখত। কয়েকজন মেয়েশ্রমিক তার দেহসৌন্দর্যের জন্য, বিশেষ করে তার চুল আর দাঁতের জন্য ঈর্ষাবোধ করত। তার সঙ্গে কারখানায় যেসব মেয়ে কাজ করত তারা মাঝে মাঝে দেখত ফাঁতিনে মুখটা ঘুরিয়ে চোখের জল মোছে। তার মেয়ের কথা বা তার পুরনো প্রেম আর প্রেমিকের কথা মনে পড়ে গেলে বেদনায় বিহ্বল হয়ে ওঠে তার অন্তরটা।

পরে একটা কথা জানাজানি হয়ে গেল। অনেকে জানতে পারল, প্রতি মাসে দু বার বিশেষ এক জায়গায় চিঠি পাঠায় ফাঁতিনে আর যার কাছে চিঠি পাঠায় তার নাম থেনার্দিয়ের এবং জায়গাটার নাম মঁতফারমেল।

যে লোকটা চিঠি লিখে দিত ফাঁতিনের সে কোনও কথা গোপন রাখতে পারল না শেষ পর্যন্ত। তাকে একদিন কয়েকজন লোক একটা মদের দোকানে নিয়ে এক পেট মদ খাইয়ে দিতেই সে আসল কথাটা বলে ফেলল। বলল, ফাঁতিনের একটি সন্তান আছে। তখন অনেকে বলতে লাগল, ও বাবা, মেয়েটা তা হলে এই ধরনের নোংরা প্রকৃতির! শহরের এক কৌতূহলী মহিলা সোজা মঁতফারমেলে গিয়ে থেনার্দিয়েরদের সঙ্গে কথা। বলল। সে ফিরে এসে বলল, যাওয়া-আসায় আমার তিরিশ ফ্রাঁ খরচ হয়েছে, তবে এখন আমি সব জানতে পেরেছি। আমি তার মেয়েকে দেখেছি।

এই মহিলা হল মাদাম ভিকতারনিয়েন। সমাজের সাধারণ মানুষের নীতির অভিভাবিকা। তার বয়স ছাপ্পান্ন। বয়স হওয়ার জন্য তার মুখটা কুৎসিত দেখাত। তার গলার স্বরটা ছিল কাঁপা কাঁপা, তবে মনটা ছিল তেজি। ১৭৯১ সালে তার যখন যৌবন ছিল, সে এক যাজককে বিয়ে করে। এখন তার বয়স হলেও এবং চেহারাটা শুকিয়ে গেলেও সে তার স্বামীর স্মৃতিটা বুকে ধরে বেঁচে আছে। সে ঈর্ষাকাতর এবং মনটা তার হিংসায় ভরা। তার স্বামী যতদিন বেঁচে ছিল, তাকে কড়া শাসনের মধ্যে রেখেছিল। তার অল্প যা কিছু সম্পত্তি ছিল সে ধর্মের কাজে দান করে। তার পর সে আরাসের বিশপের দয়ার ওপর নির্ভর করে জীবন ধারণ করত। এই মাদাম ভিকতারনিয়েন মিতফারমেল গিয়ে ফিরে এসে বলে, আমি তার সন্তানকে দেখেছি।

মাদাম ভিকতারনিয়েন যে মাসে থেনার্দিয়েরদের সঙ্গে দেখা করতে যায় সেই মাসে তারা কসেক্তের খরচ বাবদ সাত থেকে বারো ফ্ৰাঁ দাবি করে এবং পরে পনেরো ফ্ৰাঁ চায়।

এদিকে ফাঁতিনের অবস্থা শোচনীয় হয়ে ওঠে। সে মন্ত্রিউল জেলা ছেড়ে কোথাও যেতে পারছিল না, কারণ বাড়িভাড়া আর আসবাবপত্র বাবদ দেড়শো ফ্ৰাঁ ধার ছিল। সে কারখানার সুপারভাইজারকে এই টাকার কথা বলে। সুপারভাইজার তাকে টাকা দিয়ে বরখাস্ত করে। তার চাকরির স্থায়িত্ব ছিল না, অস্থায়ী কর্মী হিসেবেই সে ঢুকেছিল। লজ্জা আর হতাশার চাপে অভিভূত হয়ে সে বাসার ভেতরেই থাকত সব সময়। কারখানার কাজ ছেড়ে সে বাসাতেই আশ্রয় নিয়েছিল। তার দোষের কথাটা জানাজানি হয়ে যায়। মেয়রের কাছে গিয়ে সব কথা বুঝিয়ে বলার মতো সাহস ছিল না। মেয়রের কাছে যাওয়ার জন্য অনেকেই তাকে পরামর্শ দিয়েছিল, কিন্তু সে লজ্জার ও ভয়ে যেতে পারেনি। সুপারভাইজারের মাধ্যমে দয়াবশত মেয়র ম্যাদলেন পঞ্চাশ ঐ ফাঁতিনেকে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু কাজ থেকে তাকে ছাড়িয়ে দেয়, কারণ সে ছিল ন্যায়পরায়ণতার দিক থেকে ভীষণ কড়া। ফাঁতিনে তার মালিকের রায় মেনে নেয়।

.

এইভাবে মাদাম ভিকতারনিয়েনের কথার সত্যতা প্রমাণিত হয়।

এদিকে মঁসিয়ে ম্যাদলেন ফাঁতিনেকে কোনওদিন দেখেনি এবং তার সম্বন্ধে কিছুই জানত না। সুপারভাইজার মালিকের নামে যা কিছু করার নিজেই করেছে। মেয়েদের কারখানায় মোটেই যেত না ম্যাদলেন, তার কাজ দেখাশোনাও করত না। এর জন্য যে একজন অবিবাহিতা মেয়েকে সে কারখানা দেখাশোনা করার জন্য সুপারভাইজার নিযুক্ত করে তার ওপর সব ভার দেয়। সুপারভাইজার মেয়েটি ছিল সৎ এবং সরলমনা। তার অন্তরে দয়ামায়া ছিল। তবে যে পরিমাণ কঠোর নীতিজ্ঞান ছিল তার, সে পরিমাণ ক্ষমাগুণ ছিল না। তার কাজের ওপর সম্পূর্ণ আস্থা ছিল ম্যাদলেনের। সুপারভাইজারই ফাঁতিনের ব্যাপারটার সব কিছু বিচার করে। সে নিজেই রায় দেয়। ম্যাদলেনকে কিছুই জানায়নি এবং ফাঁতিনেকে ছাড়িয়ে দেওয়ার পর সে তাকে মেয়রের নাম করে যে পঞ্চাশ ফ্রাঁ দেয় তা গরিব-দুঃখীদের দান-খয়রাতের জন্য তার হাতে যে একটা ফান্ড ছিল তার থেকে দেয়। এই ফান্ডটা মেয়র তার কাছেই রেখেছিল।

ফাঁতিনে কারও ঘরে কাজ করার জন্য চেষ্টা করে। কিন্তু কেউ তাকে কাজ দিতে চায়নি। বাড়িভাড়া আর আসবাবের টাকা বাকি থাকায় সে শহর ছেড়ে কোথাও যেতে পারছিল না। শেষে যে পঞ্চাশ ফ্রাঁ সে পায় তা সে দু জন পাওনাদারকে ভাগ করে দেয়। সে মাত্র বিছানা ছাড়া আর সব আসবাব ছেড়ে দেয়। সব দেনা দেওয়ার পর তার কাছে মোট একশো ফ্রাঁ থাকে।

সে তখন সেনানিবাসের সৈন্যদের জামা সেলাই করে দিয়ে বারো স্যু করে পেত। তার থেকে তার মেয়ের খরচের জন্য দশ সু করে চলে যেত। এই সময় অভাবের জন্য প্রতি মাসে ঠিকমতো তার মেয়ের জন্য টাকা পাঠাতে পারত না।

দারিদ্র্য আর অভাবের মধ্য দিয়ে কিভাবে দিন কাটাতে হয়, তা ফাঁতিনে এক বৃদ্ধার কাছে আগেই শিখেছিল। শীতকালে কিভাবে আগুন ছাড়াই থাকতে হয়, কিভাবে পেটিকোট দিয়ে কম্বলের অভাব পূরণ করতে হয়, জানালা দিয়ে আসা রাস্তার আলোয় রাতের খাওয়া সেরে বাতির খরচ বাঁচাতে হয়–এ সব জানা ছিল তার।

ফাঁতিনে একদিন তার এক প্রতিবেশিনীকে বলল, আমি যদি রাতে মাত্র পাঁচ ঘণ্টা করে ঘুমোই এবং বাকি সময়টা কাজ করি তা হলে তাতে আমার চলে যাবে। মনে খাওয়ার চিন্তা না থাকলে কম খেয়েও বেঁচে থাকা যাবে।

মেয়েটা এই সময় কাছে থাকলে দুঃখের মাঝেও মনে কিছুটা শান্তি পেত ফাঁতিনে। কিন্তু কতকগুলি অসুবিধা ছিল এ বিষয়ে। প্রথম কথা, সে তার এই ভয়ঙ্কর দারিদ্র্যের কথা তার মেয়েকে জানতে দিতে চাইছিল না। দ্বিতীয় কথা, থেনার্দিয়েরদের কাছে তার যে ঋণ ছিল তা শোধ করে না দিলে মেয়েকে তারা ছাড়বে না। তার ওপর যাওয়া-আসার পথখরচ আছে।

যে অবিবাহিতা বৃদ্ধা মহিলা ফাঁতিনেকে দারিদ্র্যের মধ্যে কিভাবে জীবনযাপন করতে হয় তা শেখায়, তার নাম হল মার্গারিতে। সে লেখাপড়া বেশি জানত না, কোনওরকমে নাম সই করতে পারত। তবে সে খুব ধার্মিক ছিল এবং তার দয়া-দাক্ষিণ্যও ছিল।

ঘটনাটা জানাজানি হয়ে যাওয়ার পর প্রথম প্রথম লজ্জায় অভিভূত হয়ে পড়ে ফাঁতিনে। সে ঘর হতে বার হতে পারত না। তার মনে হত সে রাস্তায় একবার বার হলেই সকলেই তার পানে তাকাবে। ছোট শহরে অধঃপতিত নারী সকলের ঘৃণা আর অবজ্ঞার বস্তু হয়। প্যারিসের মতো বড় কোনও শহরে কেউ কারও খবর রাখে না। কেউ কারও বিচার করে না। প্যারিসে যেতে পারলে তার ভালো হত। কিন্তু এখন তা আর সম্ভব নয়। তাছাড়া দুঃখ ও দারিদ্র্যের মধ্যে জীবন কাটাতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে সে। দু তিন মাসের মধ্যেই একে একে সব লজ্জা কেটে গেল তার। সে এবার রাস্তায় বার হল, মাথা উঁচু করে হাঁটল, যেন কিছুই হয়নি। একদিন মাদাম ভিকতারনিয়েন ফাঁতিনেকে পথে দেখে খুশি হল। বেশি খেটে এবং ভালো করে খেতে না পেয়ে শরীরটা রোগা হয়ে গিয়েছিল ফাঁতিনের। তার দেহসৌন্দর্যের অনেকখানি শুকিয়ে গিয়েছিল। তার শুকনো কাশিটা আবার বেড়ে উঠেছিল। তার এই শোচনীয় অবস্থা দেখে মাদাম ভিকতারনিয়েনের শয়তান আত্মাটা এক কৃষ্ণকুটিল সুখের আস্বাদ, এক বিষাক্ত তৃপ্তি অনুভব করল।

তবুও এত দুঃখের মাঝে সকালের দিকে ফাঁতিনে যখন তার মাথার রেশমের মতো চুলের লম্বা গোছাটা হাতে ধরে চুল আঁচড়াত তখন একটা গর্ব অনুভব না করে পারত না সে।

.

১০

ফাঁতিনের যখন কারখানার কাজটা চলে যায় তখন শীতের শেষ। সে গ্রীষ্মকালটা কোনওরকমে কাটাল। তার পর আবার শীত এল। ভয়ঙ্কর শীত, উষ্ণতা বলতে নেই, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শুধু ধূসর কুয়াশা। বন্ধ জানালা দিয়ে বাইরের কোনও কিছু দেখা যায় না। সমস্ত আকাশ মেঘ আর কুয়াশায় ঢাকা থাকে। কখনও কখনও দরজায় একটুখানি ক্ষীণ সূর্যের আলো এসে দাঁড়ায়। ভয়ঙ্কর শীত শুধু আকাশ থেকে বৃষ্টি আনে আর হিমে মানুষের বুকগুলোর রক্ত জমিয়ে দেয়। ফাঁতিনের পাওনাদারেরা টাকার জন্য চাপ দিতে লাগল।

ফাঁতিনের রোজগার একেবারে কমে গেল আর ঋণের বোঝা বেড়ে যেতে লাগল। থেনার্দিয়েররা কড়া ভাষায় চিঠির পর চিঠি দিতে লাগল। সে চিঠি পড়লে ফঁতিনের বুক ফেটে যায়। একবার তারা লিখল কসেত্তে রাতে নগ্ন হয়ে থাকবে। তার পশমের পোশাকের জন্য দশ ফ্রাঁ লাগবে। চিঠিটা পড়ে সারাদিন ভাবতে লাগল ফাঁতিনে। সন্ধের সময় একটা নাপিতের দোকানে গেল সে। তার কোমর পর্যন্ত লম্বা চুলের গোছাটা দেখাল।

নাপিত বলল, কী সুন্দর চুল!

ফাঁতিনে বলল, এই চুলের জন্য তুমি কত দেবে?

নাপিত বলল, দশ ফ্রাঁ।

ফাঁতিনে বলল, ঠিক আছে, কেটে নাও।

তাই দিয়ে সে একটা পোশাক কিনে এনে থেনার্দিয়েরদের কাছে পাঠিয়ে দিল। তারা সেটা পেয়ে রেগে আগুন হয়ে গেল। কারণ তারা টাকা চেয়েছিল। তারা পোশাকটা তাদের মেয়ে এগোনিনেকে দিয়ে দিল। কসেতে শীতে কাঁপতে লাগল।

এদিকে চুলটা হারিয়ে ফাঁতিনের মনটা বড় খারাপ হয়ে গেল। সে আর চুল আঁচড়াতে বা বাঁধতে পারত না। সমস্ত মানুষের ওপর মনটা বিষিয়ে গেল তার। সকলের মতো আগে সে ম্যাদলেনকে শ্রদ্ধা করত। কিন্তু যখন দেখল ম্যাদলেন তাকে কারখানা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে এবং তার জন্যই এত দুঃখ-কষ্ট তখন সে তাকে ঘৃণার চোখে দেখতে লাগল। একদিন কারখানার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় যখন দেখল কারখানায় ঢোকার জন্য মেয়েরা দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে তখন সে পাগলের মতো হাসতে আর গান করতে লাগল। একজন বুড়ি তা দেখে বুঝতে পারল, মেয়েটা অকালে মারা যাবে।

অন্তরে ক্ষোভ আর প্রচণ্ড রাগ নিয়ে সে একটা লোককে প্রেমিক হিসেবে ধরল। লোকটা কুঁড়ে এবং পথে পথে গান গেয়ে বেড়াত। ফাঁতিনেকে মারধর করত, অবশেষে তাকে ছেড়ে একদিন চলে গেল।

এত কিছু সত্ত্বেও তার মেয়েকে ভালোবাসত ফাঁতিনে। যতই সে দুঃখ-কষ্টের গভীরে নেমে যেতে লাগল, ততই সে একটা আশাকে আঁকড়ে ধরল। সে আপন মনে বলত, একদিন আমি ধনী হব আর কসেত্তেকে তখন আমি আমার কাছে রাখব। এই ভেবে নিজের মনে হাসল। তার কাশিটা তাকে কায়দা করতে পারত না। রাত্রিতে মাঝে মাঝে ঘাম দিত।

থেনার্দিয়েররা আবার একটা চিঠি দিল। তাতে লেখা ছিল, কসেত্তের অসুখ করেছে। এই রোগটা এ অঞ্চলে খুব হচ্ছে। রোগটার নাম মিলিটারি ফিভার। এক ধরনের দূষিত জ্বর সৈনিকদের থেকে ছড়িয়ে পড়ে। তার জন্য তাদের ওষুধ কেনার পয়সা নেই। ফাঁতিনে যদি চিঠি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চল্লিশ ফ্রাঁ না পাঠায়, এক সপ্তার মধ্যে তা হলে তার মেয়ে মারা যাবে।

চিঠিটা পড়ে পাগলের মতো হাসতে লাগল ফাঁতিনে। সে মার্গারিতেকে বলল, চমৎকার! চল্লিশ ফ্রাঁ কোথা থেকে পাব? ওরা কি পাগল?

জানালার ধারে দাঁড়িয়ে চিঠিটা আবার পড়ল ফাঁতিনে। তাদের সে ঘর থেকে রাস্তায় চলে গেল হাসতে হাসতে। একজন জিজ্ঞাসা করল, এত হাসির কারণ কী? ফাঁতিনে বলল, চল্লিশ ফ্র। এক গ্রামের এক গরিব চাষি চল্লিশ ফ্রাঁ চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছে।

ফাঁতিনে দেখল রাস্তার উপর এক জায়গায় অনেক লোক ভিড় করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সে তখন এগিয়ে গিয়ে দেখল একটা লোক দাঁত বিক্রি করার জন্য বক্তৃতা দিচ্ছে আর তাকে ঘিরে একদল ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। যাদের দাঁত নেই তাদের কাছে এক একটা দাঁতের সেট বিক্রি করার চেষ্টা করছে সে। তার মজার মজার কথা শুনে অনেকে হাসছিল। ফাঁতিনেও ভিড়ের মধ্যে ঢুকে হাসতে লাগল। এমন সময় সেই দাঁত বিক্রেতা

ফাঁতিনেকে বলল, তোমার দাঁতগুলো তো বেশ সুন্দর। তোমার উপরকার পাটির দুটো দাঁতের জন্য দুটো স্বর্ণমুদ্রা দেব।

ফাঁতিনে বলল, উপরকার পাটির দুটো দাঁত?

লোকটা বলল, হ্যাঁ, দুটো সোনার মুদ্রা অর্থাৎ দুটো নেপোলিয়ঁ যা ভাঙালে চল্লিশ ফ্রাঁ পাবে।

ফাঁতিনে বলল, কী ভয়ঙ্কর কথা!

একজন বুড়ি কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। সে বলল, দুটো নেপোলিয়ঁ। তোমার ভাগ্য ভালো।

ফাঁতিনে কানে আঙুল দিয়ে পালিয়ে গেল। চিৎকার করে বলতে লাগল, ভালো করে ভেবে দেখ মেয়ে। চল্লিশ ফ্রাঁ। যদি তোমার মনের পরিবর্তন হয় তা হলে আজ সন্ধ্যায় তিলাক দার্জেন্তে আমাকে পাবে।

ফাঁতিনে রাগে আগুন হয়ে একরকম ছুটতে ছুটতে তার বাসায় গিয়ে মার্গারিতেকে সব কথা বলল। সে বলল, এই ঘৃণ্য লোকটাকে কেন ঘুরে বেড়াতে দেয়? ও বলল, আমার উপরকার পাটির দুটো দাঁত তুলে নেবে। আমাকে তা হলে ভয়ঙ্করভাবে বিশ্রী দেখাবে। চুল আবার গজাবে, কিন্তু দাঁত আর বেরোবে না। মানুষ নয়, লোকটা একটা রাক্ষস। তার থেকে জানালা থেকে ঝাঁপ দিয়ে মরা ভালো। ও আবার বলল, তিলাক দার্জেন্তে ওর সঙ্গে সন্ধেবেলায় দেখা হবে।

মার্গারিতে বলল, দাম কত দেবে বলল?

ফাঁতিনে বলল, দুটো নেপোলিয়ঁ বা স্বর্ণমুদ্রা।

মার্গারিতে বলল, তার মানে, চল্লিশ ফ্রাঁ।

ফাঁতিনে বলল, হ্যাঁ, চল্লিশ।

চিন্তান্বিত অবস্থায় ফাঁতিনে সেলাইয়ের কাজ করতে লাগল। মিনিট পনেরো কাজ করার পর সে একবার উঠে গিয়ে থেনার্দিয়েরদের চিঠিটা পড়ল। তার পর আবার তার জায়গায় গিয়ে মার্গারিতেকে বলল, আচ্ছা মিলিটারি ফিভারটা কী? তুমি এ রোগের নাম শুনেছ?

মার্গারিতে বলল, হ্যাঁ, একটা রোগ।

এ রোগের জন্য কি অনেক ওষুধ লাগে?

হ্যাঁ, খুব জোরালো ওষুধ দরকার।

কিভাবে রোগটা হয়?

যেমন করে সব রোগ হয়।

মেয়েদের এ রোগ হয়?

এ রোগ ছেলেদেরই বেশি হয়।

এ রোগে মৃত্যু হয়?

প্রায়ই মৃত্যু হয়।

ফাঁতিনে ঘর থেকে বেরিয়ে আবার চিঠিটা পড়তে গেল। সেদিন সন্ধ্যায় সে বাসা থেকে বেরিয়ে র‍্যু দ্য প্যারিসের দিকে চলে গেল দ্রুত পায়ে।

পরদিন সকালে মার্গারিতে যখন ফাঁতিনের ঘরে ঢুকল তখন দেখল সে বিছানায় শুয়ে নেই। সে মেঝের উপর বসে রয়েছে এক জায়গায় হাঁটু দুটো জড়ো করে এবং বাতিটা জ্বলতে জ্বলতে একেবারে পুড়ে গেছে। মার্গারিতে ফাঁতিনের সঙ্গে সেলাইয়ের কাজ করত বলে রোজ সকালে এসে ফাঁতিনেকে ওঠাত। একই বাতিতে তারা কাজ করত। মার্গারিতে বুঝল, সারারাত ঘুমোয়নি ফাঁতিনে।

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ভয়ে ভয়ে বলে উঠল, হা ভগবান! কী হল তোমার?

ফাঁতিনে বলল, আমার কিছুই হয়নি। আমি এখন সুখী, আমার মেয়ে আর ওষুধ অভাবে মরছে না।

এরপর টেবিলের উপর নামানো দুটো স্বর্ণমুদ্রার দিকে হাত বাড়িয়ে দেখাল ফাঁতিনে।

মার্গারিতে বলল, এ তো অনেক টাকা! কোথায় পেলে এত টাকা?

ফাঁতিনে বলল, আমি রোজগার করেছি।

বলতে বলতে হাসল ফাঁতিনে। মার্গারিতে দেখল তার হাসিটা রক্তমাখা। মুখে তখনো রক্ত লেগে ছিল ফাঁতিনের। তার উপরকার পাটিতে দুটো দাঁত ছিল না বলে ফাঁকা ফাঁকা দেখাচ্ছিল।

টাকাটা তফারমেলে পাঠিয়ে দিল ফাঁতিনে।

একথা বলা নিষ্প্রয়োজন যে থেনার্দিয়েররা মিথ্যা কথা বলেছিল। কসেত্তের কোনও অসুখ করেনি।

এদিকে চুল আর দাঁত হারিয়ে ফাঁতিনে রেগে আয়নাটা ফেলে দিয়েছিল। তিনতলার একটা ঘরে তাকে থাকতে হত। সেখানে শীত আরও বেশি। ফাঁতিনের কোনও খাট ছিল না। বিছানা বলতে মেঝের উপর একটা তোষক পাতা থাকত। আর একটা ছেঁড়া কম্বল। একটা আধভাঙা চেয়ার ছিল ঘরের এক কোণে। আর একটা জলের বালতি ছিল। তাতে জলটা জমে বরফ হয়ে গিয়েছিল শীতে। যারা ফাঁতিনের কাছে টাকা পেত সেইসব পাওনাদার রাস্তায় তাকে দেখতে পেলেই শান্তিতে পথ চলতে দিত না। অনেক সময় অনেক পাওনাদার বাসায় এসে তাগাদা করত। গোলমাল ও হৈ-চৈ করত টাকার জন্য। তার জামা ময়লা হয়ে গিয়েছিল। মোজা দুটো ছিঁড়ে গিয়েছিল। ছেঁড়া জামায় তালি বসিয়েছিল। সে প্রায় সারারাত চিন্তা করে আর চোখের জল ফেলে কাটাত। ঘুম হত না। পিঠে আর কাঁধের কাছে একটা ব্যথা অনুভব করত। খুব কাশি হত। সে পিয়ের ম্যাদলেনকে গভীরভাবে ঘৃণা করত বলে তার বিরুদ্ধে কিছুই বলত না কারও কাছে। সে প্রতিদিন সতেরো ঘণ্টা করে সেলাই করত, কিন্তু তাতে মাত্র নয় স্যু করে পেত। জেলখানার এক কন্ট্রাক্টার তাদের বেতন কমিয়ে দেয়। সতেরো ঘণ্টা কাজ করে মাত্র নয় স্যু পাওয়ায় তাতে কোনওরকমে খাওয়া ছাড়া আর কিছুই হত না। তার পাওনাদারেরা ক্রমশই অশান্ত হয়ে উঠতে লাগল। তারা আর কোনও কথা শুনতে চায় না। আর সে কী করবে? পাওনাদারদের অবিরাম তাগাদার জ্বালায় সে পশুর মতো হয়ে উঠল। এমন সময় একদিন থেনার্দিয়ের এক চিঠিতে জানাল, সে যদি একশো ফ্ৰাঁ না পাঠায় তা হলে তারা কসেত্তেকে তাদের বাড়ি থেকে বার করে দেবে। সম্প্রতি রোগ থেকে উঠে দুর্বল অবস্থায় পথে পথে ঘুরে বেড়াবে সে। তাতে সে অবশ্যই মরবে।

একশো ফ্ৰাঁ কী করে জোগাড় করবে সে? দিনে নয় স্যু’র জায়গায় একশো স্যু করে রোজগার করতে হবে তাকে। তবে একটামাত্র পথ আছে। সে ভাবল, ঠিক আছে, আমি তাই করব, আমি একবার আমার দেহ বিক্রি করব।

ফাঁতিনে বারবণিতা হয়ে গেল।

.

১১

ফাঁতিনের কাহিনী হল সমাজ একটি মানুষকে কিভাবে চিনে নেয় তার কাহিনী। দারিদ্র্য, ক্ষুধা, নিঃসঙ্গতা, শীতার্ত অসহায়তা, নিরাপত্তার অভাব, নিরাশ্রয়তা প্রভৃতির হাত থেকে বাঁচার জন্য মানুষ কিভাবে নিজেকে বিলিয়ে দেয়, আত্মবিক্রীত হয় তার এক সকরুণ কাহিনী। দারিদ্র্য তাদের বিলিয়ে দেয় আর সমাজ তাদের হাত বাড়িয়ে নিয়ে নেয়।

আমাদের সমাজ যিশু খ্রিস্টের উপদেশাবলির দ্বারা অনুশাসিত হয়। কিন্তু সেটা নামে মাত্র। সে উপদেশ তারা আসলে মেনে চলে না। আমরা বলি ক্রীতদাসপ্রথা ইউরোপীয় সভ্যতা থেকে চলে গেছে, কিন্তু ক্রীতদাসপ্রথা এখনও আছে এবং সেটা শুধু মেয়েদের ক্ষেত্রেই চলে এবং তার নাম হল বেশ্যাগিরি।

এ প্রথা নারীদের ওপর পীড়ন চালায়। তাদের যৌবন, সৌন্দর্য, মাতৃত্ব সব কেড়ে নেয়। অথচ তাতে পুরুষরা কোনও লজ্জা পায় না।

যে অবস্থার মধ্যে ফাঁতিনে এখন পড়েছে তাতে আগেকার সেই ফাঁতিনে নামে সুন্দরী মেয়েটির কিছুই অবশিষ্ট নেই। তার বাইরের সৌন্দর্য আর অন্তরের সত্তা সব অদৃশ্য হয়ে গেছে। এখন সে একেবারে যেন পাথর হয়ে গেছে ভেতরে-বাইরে। এখন তাকে স্পর্শ করা মানে হিমশীতল এক পাথরের মূর্তিকে স্পর্শ করা। কোনও লোক এলে তাকে গ্রহণ করে, নিজেকে বিলিয়ে দেয় তার কাছে, কিন্তু মনে মনে তাকে উপেক্ষা করে, ঘৃণার চোখে দেখে। তার ব্যক্তিজীবন এবং সমাজজীবন শেষ কথা বলে দিয়েছে তাকে। খারাপ যা কিছু ঘটার সব ঘটে গেছে। সে সব দুঃখ জেনে গেছে, সব দুঃখ সহ্য করে সে দেখেছে, শেষ অশ্রুবিন্দুটুকু সে পাত করেছে। নিদ্রা যেমন প্রসারিত হয়ে চিরনিদ্রা বা মৃত্যুতে পরিণত হয়, তেমনি ভাগ্যের কাছে তার নীরব আত্মসমর্পণ ধীরে ধীরে এক হিমশীতল ঔদাসীন্যে পরিণত হয়। আর সে কোনও দুঃখকষ্টকে ভয় করে না, আর সে কোনও দুঃখকষ্ট থেকে পরিত্রাণ বা মুক্তি পাওয়ার ইচ্ছা বা চেষ্টা করে না। এখন যদি সমস্ত আকাশটা তার মাথায় ভেঙে পড়ে, সমুদ্রতরঙ্গ যদি ছুটে এসে তাকে গ্রাস করে তা হলেও তাতে তার কিছু যায়-আসে না।

এখন ফাঁতিনের মনে হয় ভাগ্যের বিধানে পাওয়া দুঃখ আমরা ভোগ করি, কখনও করতে পারি না একথা মনে করা ভুল। ভাগ্য যত দুঃখই দিক না কেন, আমরা তা ভোগ করতে পারি, অপরিসীম আমাদের সহনশক্তি। ভাগ্যের নিষ্ঠুরতার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সহনশক্তিও অবশ্যই বেড়ে যায়।

কিন্তু এই ভাগ্য কী? কোথায় আমাদের নিয়ে যায় সে ভাগ্য? এই ভাগ্য কারও ওপর সুপ্রসন্ন আর কারও ওপর অপ্রসন্ন হয় কেন? এ প্রশ্নের উত্তর একমাত্র ঈশ্বরই দিতে পারেন।

.

১২

মন্ত্রিউল-সুর-মেরের মতো ছোট শহরে একশ্রেণির যুবক আছে যারা তাদের বছরে পনেরো হাজার ফ্ৰাঁ বাজে খরচ করে উড়িয়ে দেয়। প্যারিসে পিয়ার বা জমিদাররা বছরে আড়াই হাজার ফ্ৰাঁ বাজে খরচ করে। এই ধরনের লোকরা সাধারণত বড় অপদার্থ এবং অলস প্রকৃতির হয়। তারা কোনওরকমে একবার কিছু টাকা রোজগার করলেই হোটেলে ঘুরে বেড়ায় আর বড় বড় কথা বলে। তারা কখনও শিকার করে, কখনও বিলিয়ার্ড খেলে আর যখন-তখন মদ খায়। আসলে সারা জীবনের মধ্যে ভালো-মন্দ কাজই করে না, শুধু বাজে কাজে ঘুরে বেড়িয়ে জীবনটাকে নষ্ট করে।

মঁসিয়ে ফেলিক্স থোলোমায়েস যদি প্যারিসে না এসে গাঁয়েই থাকত তা হলে ওই ধরনের এক অলস ভবঘুরে হয়ে উঠত। তবে এই ধরনের লোক গরিব হলে তাকে ভবঘুরে বলত আর ধনী হলে বলত অমিতব্যয়ী ভদ্রলোক। এই ধরনের লোকরা মোচ রাখত। গাঁয়ের ভবঘুরেরা বেশি বড় বড় মোচ রাখত। তারা হাতে একটা করে ছড়ি রাখত এবং নাটকীয় ঢঙে কথা বলত।

সে যুগে স্পেনের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আমেরিকায় প্রজাতন্ত্রের যুদ্ধ চলছিল। মোরিলোর সঙ্গে লড়াই চলছিল বলিভার। যারা ছোট কানাওয়ালা টুপি পরত আর রাজতন্ত্রের সমর্থনে কথা বলত তাদের বলা হত মোরিলো। আর যারা উদারনীতিভাবাপন্ন ছিল আর চওড়া কানাওয়ালা টুপি পরত তাদের বলা হত বলিভার।

যে ঘটনার কথা বলা হয়েছে তার আট-দশ মাস পরে ১৮২৪ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথমে কোনও এক তুষারাচ্ছন্ন সন্ধ্যায় এক অলস ভবঘুরে ধনী অফিসারদের এক কাফেতে ভালো পোশাক আর মমারিলোদের মতো টুপি পরে একটি মেয়ের সঙ্গে বসে কথা বলছিল। মেয়েটি একটি লো-কাট গাউন পরেছিল আর তার মাথায় ফুল গোঁজা ছিল।

ভদ্রলোক ধূমপান করছিল। তখনকার দিনে ধূমপান খুব শৌখিনতার পরিচায়ক ছিল। লোকটি মেয়েটার মুখে বারবার ধোয়া ছাড়ছিল আর ঠাট্টা করে কী সব বলছিল। মেয়েটির মুখখানা বিষণ্ণ ছিল। সে তখন ক্লান্ত ও অবসন্ন থাকায় সে গ্রাহ্য করছিল না লোকটাকে।

ওরা কাফের বাইরে তুষারপাতের মধ্যেই বেড়াচ্ছিল। লোকটি যখন দেখল মেয়েটি তাকে তেমন গ্রাহ্য করছে না তখন পথ থেকে একমুঠো বরফ কুড়িয়ে মেয়েটির অনাবৃত ঘাড়ের উপর দিয়ে দিল। লোকটির নাম ছিল মঁসিয়ে বামাতাবয়। মেয়েটি একবার জোরে চিৎকার করে উঠে তার হাতের নখ দিয়ে লোকটার মুখটা ছিঁড়ে-খুঁড়ে দিতে লাগল। সে বাঘিনীর মতো উগ্র রূপ ধারণ করল। তার ফোকলা মুখ থেকে যত সব নোংরা গালাগালি বার হতে লাগল। মেয়েটি হল ফাঁতিনে।

গোলমাল শুনে কাফের ভেতর থেকে অফিসাররা ছুটে এল। ধস্তাধস্তি করতে থাকা একজন নারী আর একজন পুরুষকে ঘিরে একদল জড়ো হয়ে হাসাহাসি করতে লাগল। লোকটা আত্মরক্ষার চেষ্টা করছিল আর ফাঁতিনে তাকে চড়-লাথি মারছিল আর চিৎকার করছিল উন্মাদের মতো।

সহসা ভিড়ের মধ্য থেকে একজন লম্বা লোক এগিয়ে এসে ফাঁতিনের একটা হাত ধরে ফেলল। ফাঁতিনের পোশাকের উপর কাদা লেগে ছিল। যে লোকটি ফাঁতিনের হাত ধরেছিল সে তাকে বলল, তুমি আমার সঙ্গে এস। লোকটিকে দেখে চুপ করে গেল ফাঁতিনে। প্রচণ্ড রাগে আগুন হয়ে থাকা মুখখানা সহসা ম্লান হয়ে গেল আর ভয়ে কাঁপতে লাগল। সে চিনতে পেরেছিল লোকটি জেভাৰ্ত, পুলিশের লোক।

সুযোগ বুঝে মঁসিয়ে বামাতাবয় এক ফাঁকে তাড়াতাড়ি পালিয়ে গেল।

.

১৩

কৌতূহলী দর্শকদের ভিড় সরিয়ে জেতার্ত ফাঁতিনেকে টানতে টানতে কাছাকাছি একটা পুলিশ ফাঁড়ির দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। ফাঁতিনে কোনও বাধা দিল না। কেউ কোনও বাধা দিল না। দর্শকরা আনন্দে চিৎকার করতে করতে তাদের অনুসরণ করতে লাগল। দর্শকদের কুৎসিত আনন্দ দেখে চরম অপমান আর লজ্জাবোধ করতে লাগল ফাঁতিনে।

পুলিশ ফাঁড়ি রাস্তার ধারে একটা ঘর। ঘরের দরজাটা ছিল রাস্তার দিকে। ঘরের ভেতর একটা স্টোভ জ্বলছিল। ঘরের ভেতর তিনেকে নিয়ে ঢুকেই দরজাটা বন্ধ করে দিল জেভার্ত। এতে দর্শকরা হতাশ হল। দর্শকরা ঘাড় উঁচু করেও কিছু দেখতে পেল না।

ঘরের এক কোণে ফাঁতিনে গিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত এক জন্তুর মতো বসে রইল। অফিসে যে সার্জেন্ট কর্তব্যরত ছিল সে একটা বাতি জ্বালিয়ে টেবিলের উপর রাখল। জেভার্ত পকেট থেকে একটা সাদা কাগজ বার করে কী লিখতে লাগল।

দেশের প্রচলিত আইন অনুসারে এই ধরনের মেয়েরা সম্পূর্ণ পুলিশের দয়ার ওপর নির্ভর করে। পুলিশ তাদের যে কোনও শাস্তি দিতে পারে, তাদের ব্যক্তিস্বাধীনতা একেবারে কেড়ে নিতে পারে। জেভার্তের মনে চিন্তার আলোড়ন চলতে থাকলেও তার মুখে কোনও আবেগের চিহ্নমাত্র ছিল না। এসব ক্ষেত্রে সে পুরোপুরি তার বিবেকের নির্দেশে চলতে পারে, কোনও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে কোনও নির্দেশ চাইতে হবে না। এই অফিসের চেয়ারটাই হল বিচারপতির আসন। এই চেয়ারে বসেই সে আসামির বিচার করে রায় দেবে। সে অনেক চিন্তা-ভাবনা করে দেখল এটা একটা অপরাধ। মঁসিয়ে বামাতাবয় তার চোখে সমাজের এমনই এক গণ্যমান্য লোক যিনি এক তিনতলা বাড়ির মালিক এবং যার ভোটাধিকার আছে। এই ধরনের এক বিশিষ্ট নাগরিককে সমাজবহির্ভূতা এক বারবণিতা মারধর করেছে। জেভার্ত নিজে তা দেখেছে। সে আপন মনে লিখে যেতে লাগল।

তার লেখা শেষ হলে তাতে সই করে কাগজটা ভাজ করে সার্জেন্টের হাতে দিয়ে বলল, রক্ষীকে দিয়ে এই মেয়েটাকে জেলে পাঠিয়ে দাও।

এরপর সে ফাঁতিনের দিকে ঘুরে বলল, তোমাকে ছয় মাসের জন্য জেলে যেতে হবে। নিবিড় হতাশার সঙ্গে চিৎকার করে উঠল, ছয় মাস! ছয় মাস জেল! সারাদিনের। খাটুনির বিনিময়ে মাত্র সাত সু? কসেত্তের কী হবে? আমার মেয়ের কী হবে? মঁসিয়ে ইন্সপেক্টর, আপনি কি জানেন থেনার্দিয়েরের কাছে আমার একশো ফ্রাঁ ঋণ আছে?

জোড়হাত করে মেঝের উপর নতজানু হয়ে বসল ফাঁতিনে। তার পর বলতে লাগল, মঁসিয়ে জেভাৰ্ত, আমাকে দয়া করুন। এটা আমার দোষ নয়। আপনি যদি জানতেন ব্যাপারটার মূল কারণটা কী। আমি ঈশ্বরের নামে শপথ করে বলছি আমার কোনও দোষ নেই। একজন ভদ্রলোক যাকে আমি চিনি না, আমার ঘাড়ের উপর বরফ দেয়। আপনি দেখছেন আমার শরীর ভালো নেই। তার পর সে যত সব অবাঞ্ছিত অন্যায় কথা বলতে থাকে। সে বলে আমি দেখতে কুৎসিত এবং আমার দাঁত নেই, যেন আমি এসব জানি না। কিন্তু আমি কিছু বলিনি। আমি ভাবছিলাম ও আমাকে ঠাট্টা করছে। আমি নীরবে হাঁটছিলাম এমন সময় আমার ঘাড়ের উপর বরফ চাপিয়ে দেয়। মঁসিয়ে জেভাৰ্ত, যা ঘটেছিল তা বলার মতো কি কেউ নেই? আমার অবশ্য রেগে যাওয়াটা অন্যায় হয়েছিল, কিন্তু এই ধরনের ঘটনা যদি ঘটে, যদি কেউ অপ্রত্যাশিতভাবে আপনার ঘাড়ের উপর বরফ চাপিয়ে দেয় তা হলে আপনি নিশ্চয় আত্মবিস্মৃত হয়ে সব সংযম হারিয়ে ফেলতেন। ভদ্রলোকের টুপিটা নষ্ট করে দেওয়া আমার উচিত হয়নি। কিন্তু উনি কেন পালিয়ে গেলেন? উনি থাকলে আমি ক্ষমা চাইতাম, যদিও ক্ষমা চাওয়ার মন আমার নেই। মঁসিয়ে জেভাৰ্ত, এবারকার মতো আমাকে ছেড়ে দিন। আমার মনে হয় আপনি জানেন না জেলখানার খাটুনির জন্য প্রতিদিন মাত্র সাত স্যু করে দেওয়া হয়। আমার একশো ফ্ৰাঁ ধার আছে এবং তা না দিতে পারার জন্য আমার বাচ্চা মেয়েকে পথে বার করে দেওয়া হবে। অবশ্য সাত স করে দেওয়াটা সরকারের দোষ, তা বলছি না। তবে আমার এই অবস্থা। ঈশ্বর আমায় দয়া করুন। আমার মেয়েকে আমি এখন কাছে রাখতে পারি না। আমি যে ধরনের জীবনযাপন করি তাতে তাকে কাছে রাখা যায় না। আমার সন্তানের কী হবে? হোটেলমালিক থেনার্দিয়েররা ভালো লোক নয়, ওদের দয়ামায়া বা কোনও যুক্তিবোধ নেই, ওরা শুধু টাকা চায়। আমাকে জেলখানায় পাঠাবেন না। এই শীতে ওরা আমার সন্তানকে তাড়িয়ে দেবে। একটু ভেবে দেখবেন মঁসিয়ে জেতার্ত। ও যদি বড় হত তা হলে নিজের জীবিকা নিজেই অর্জন করতে পারত। কিন্তু ওর বয়স এত কম যে তা পারবে না। আমি সত্যি সত্যিই খারাপ নই। অবশ্য লোভ-লালসার জন্য আমার এ অবস্থা হয়নি। আমি অবশ্য মাদক বা নেশার পিল খাই, কিন্তু দুঃখের চাপে পড়েই তা খাই, কারণ তা আমার মনের দুশ্চিন্তাটা কাটিয়ে দেয়। আমি যেসব পোশাক পরতাম তা দেখলে আপনি বুঝতে পারতেন আমি হালকা প্রকৃতির মেয়ে ছিলাম না বা উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন করতাম না। আমি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন লিনেনের তৈরি ভদ্র পোশাক পরতাম। আমাকে দয়া করুন মঁসিয়ে জেভার্ত।

আধখোলা বুকের উপর হাত দুটো জড়ো করে নতজানু হয়ে কথা বলছিল ফাঁতিনে আর মাঝে মাঝে কাশছিল। তার চোখ জলে ভরে গিয়েছিল। চরম দুঃখ থেকে এমন এক জ্যোতি নির্গত হয়, যা যে কোনও মানুষের অসহায় ও শোচনীয় অবস্থাকেও কিছুটা রূপান্তরিত করে তোলে। ফাঁতিনে যখন সামনের দিকে ঝুঁকে জেভার্তের কোটের প্রান্তভাগটাকে তার ঠোঁটের উপর ঠেকিয়ে কথা বলছিল তখন তাকে সত্যিই সুন্দর দেখাচ্ছিল। তার মর্মবিদারক কথা শুনে যে কোনও পাথরের অন্তর গলে যেত, কিন্তু কাঠের অন্তর কখনও গলে না।

জেতার্ত বলল, আমি তোমার সব কথা শুনেছি। আর কিছু তোমার বলা আছে? এবার তুমি যেতে পার। তোমাকে ছয় মাসের কারাদণ্ড ভোগ করতেই হবে। স্বয়ং পরম পিতা ঈশ্বরও এ দণ্ড মকুব করতে পারবেন না।

পরম পিতার নাম শুনে ফাঁতিনে বুঝল জেভার্তের দেওয়া দণ্ড চূড়ান্ত। সে মেঝের উপর পড়ে গেল। তার মুখ থেকে শুধু একটা কথা বেরিয়ে এল, দয়া, দয়া কর।

জেভার্ত তার দিকে পেছন ফিরল এবং দু জন পুলিশ ফাঁতিনেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য ধরল।

কয়েক মিনিট আগে একজন লোক সকলের অলক্ষে ঘরে ঢুকে নীরবে দাঁড়িয়ে তিনের দুঃখের কথা শুনছিল। ফাঁতিনের কাতর আবেদনের সব কথা শুনেছিল সে। পুলিশরা যখন ফাঁতিনেকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল তখন সে এগিয়ে এল। সে জেভার্তকে লক্ষ করে বলল, একমুহূর্ত একটু অপেক্ষা করবেন?

জেতার্ত মুখ ফিরিয়ে দেখল, মঁসিয়ে ম্যাদলেন কথা বলছে। সে টুপিটা খুলে একটু নত হয়ে বলল, মাপ করবেন মঁসিয়ে মেয়র।

ম্যাদলেনের কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়ল ফাঁতিনে। সে উঠে দাঁড়িয়ে ম্যালেনের সামনে এসে বলল, তুমিই মেয়র?

পাগলের মতো হাসতে হাসতে ম্যালেনের মুখের উপর থুতু ফেলল।

ম্যাদলেন তার মুখ থেকে থুতুটা মুছে বলল, ইন্সপেক্টর জেভাৰ্ত, এই মেয়েটিকে ছেড়ে দিতে হবে। কথাটা শুনে জেভার্তের মনে হল সে পাগল হয়ে যাবে। এমন সব ভয়ঙ্কর আবেগের আঘাতে তার অন্তর আন্দোলিত হতে লাগল, যা এর আগে কখনও সে অনুভব করেনি। শহরের একটা সামান্য মেয়ে মুখের উপর থুতু ফেলবে, এটা তার কল্পনাতীত। এটা সে ভাবতেই পারে না। সঙ্গে সঙ্গে তার মনে একটা অস্পষ্ট ধারণা হল হয়তো এই মেয়েটির সঙ্গে মেয়রের একটা অবৈধ সম্পর্ক ছিল এবং মেয়র নিজেই প্রকটিত করে তুললেন সেই গোপন সম্পর্কটা। কিন্তু যখন সে দেখল মেয়র শান্তভাবে মুখ থেকে থুতু মুছে মেয়েটাকে ছেড়ে দিতে বলল তখন বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল সে।

ফাঁতিনেও কম আশ্চর্য হয়নি। সে গলার স্বরটাকে নিচু করে বলতে লাগল, আমাকে ছেড়ে দেওয়া হবে? ছয় মান জেলভোগ করতে হবে না? কিন্তু কথাটা কে বলল? একথা কেউ বলতে পারে না। আমি নিশ্চয় ভুল শুনেছি। এ কথা নিশ্চয় ওই দানব মেয়র বলেনি। হে সদাশয় মঁসিয়ে জেভাৰ্ত, আপনিই কি বললেন আমাকে ছেড়ে দেওয়া হবে? আমি সব কথা বলব, তা হলে আপনি আমাকে ছেড়ে দেবেন। এই সবকিছু ওই শয়তান মেয়রটার জন্যই হয়েছে। কয়েকজন মেয়ের কথা শুনে ও আমায় চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দেয়। এক সৎ মেয়ে-শ্রমিককে অকারণে বরখাস্ত করাটা কি এক ঘৃণ্য কাজ নয়? চাকরি না থাকার জন্য আমি কিছু রোজগার করতে পারতাম না এবং তার থেকেই যত বিপত্তির উৎপত্তি হয়। তবে পুলিশেরও কিছু করার আছে। জেলখানার কন্ট্রাক্টাররা কম টাকায় বাইরের গরিব মেয়েদের বেশি খাঁটিয়ে অবিচার করে তাদের প্রতি। এটা পুলিশ বন্ধ করতে পারে। আগে আমরা জামা সেলাই করে দিনে বারো স্যু করে পেতাম। পরে ওরা তা কমিয়ে নয় স্যু করে। আমার মেয়ে কসেত্তের কথা আমায় ভাবতে হত, তাই আমাকে কুপথে নামতে হয়। তা হলে এবার দেখতে পাচ্ছেন মেয়রই এই সবকিছুর মূলে? ঘটনাক্রমে আমি ওই কাফের বাইরে ভদ্রলোকের টুপিটা ঘুষি মেরে খারাপ করে দিই, কারণ আমার ঘাড়ে বরফ চাপিয়ে দিয়েছিল। আমি কিন্তু সত্যি সত্যিই কারও ক্ষতি করতে চাইনি। আমার থেকে কত খারাপ মেয়ে ভালো অবস্থার মধ্যে আছে। আপনি সবাইকে আমার কথা জিজ্ঞাসা করতে পারেন। আমার বাড়িওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করে দেখবেন আমি নিয়মিত ভাড়া দিয়ে যাই। আমি সৎ।

মঁসিয়ে ম্যাদলেন এতক্ষণ ফাঁতিনের সব কথা মন দিয়ে শুনছিল। ফাঁতিনে যখন কথা বলছিল তখন সে তার পকেট থেকে টাকার ব্যাগটা বার করে। কিন্তু দেখে ব্যাগটা খালি। পকেটের মধ্যে ব্যাগটা রেখে সে ফাঁতিনেকে বলল, কত টাকা তোমার দেনা আছে বললে?

ফাঁতিনে এতক্ষণ জেভার্তকে লক্ষ করে কথা বলছিল। সে এবার মুখ ফিরিয়ে ম্যাদলেনকে বলল, আমি তোমার সঙ্গে কথা বলছি।

ফাঁতিনে এবার জেভাৰ্তকে বলল, আপনি দেখলেন আমি ওর মুখের উপর থুতু ফেলেছি।

এবার ম্যালেনের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি অসভ্য, তুমি আমাকে ভয় দেখাতে চেয়েছ। কিন্তু তোমার ভয়ে আমি ভীত নই। আমি শুধু মঁসিয়ে জেতার্তকে ভয় করি।

ফাঁতিনে এবার জেভার্তকে লক্ষ্য করে বলতে লাগল, মানুষের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করাই উচিত। আমি জানি, আপনি ভালো লোক। আসলে ব্যাপারটা এমন কিছু নয়। একটা লোক একটি মেয়ের ঘাড়ে বরফ দেয় আর তা নিয়ে অফিসাররা হাসাহাসি করে। মেয়েদের এসব সহ্য করতে হয়। তার পর আপনি এলেন, শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখাই আপনাদের কর্তব্য। আমি গোলমাল করায় আপনি আমাকে ধরে নিয়ে এলেন। তার পর আমার কাতর আবেদন শুনে আমার মেয়ের কথা ভেবে আমার ওপর দয়া করে আমাকে ছেড়ে দিলেন। আপনি আমাকে বলতে পারেন, এ কাজ আর কখনও করো না। আমি বলছি, এ কাজ আর কখনও আমি করব না। শুধু এবারকার মতো আমাকে ক্ষমা করুন। আচমকা বরফটা দেওয়ায় আমার মেজাজটা গরম হয়ে ওঠে। আমার শরীরটা ভালো নেই। আমার কাশি হচ্ছে। ভেতরটা যেন জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। আমার গাঁয়ে হাত দিয়ে দেখতে পারেন।

আর কাঁদছিল না ফাঁতিনে। তার চোখে জল ছিল না। তার কণ্ঠটা শান্ত ও নরম ছিল। সে জেভার্তের রুক্ষ হাতটা টেনে নিয়ে তার গলার উপর রাখল। তার পর আলুথালু পোশাকটা ঠিক করে নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। পুলিশদের বলল, ইন্সপেক্টার আমাকে যেতে বলেছেন।

দরজার খিলটা খুলতেই একটা শব্দ হল।

জেভার্ত এতক্ষণ পাথরের মূর্তির মতো স্তব্ধ হয়ে মেঝের উপর দৃষ্টি রেখে দাঁড়িয়েছিল অন্য মনে। তার কোনও বিছু খেয়াল ছিল না। খিল খোলার শব্দে তার চমক ভাঙল। হিংস্র জন্তুর মতো সে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে চোখ তুলে তাকাল ফাঁতিনের দিকে।

জেভার্ত পুলিশদের বাল, সার্জেন্ট, দেখছ না মেয়েটা পালাচ্ছে? কে তাকে যেতে বলেছে?

ম্যাদলেন বলল, আমি বলেছি।

জেভার্তের কথা শুনে ফাঁতিনে দরজার খিল ছেড়ে পেছন ফিরে দাঁড়াল। যেন চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেছে।

ম্যাদলেনের কথা শুনে সে এবার তার পানে তাকাল। তার বিস্মিত ব্যথাহত চোখের দৃষ্টি পালাক্রমে জেভার্ত আর মাদলেনের মধ্যে ঘোরাফেরা করতে লাগল।

জেভার্ত যখন সার্জেন্টকে কড়া গলায় হুকুম দিয়েছিল তখন সে কি মেয়রের উপস্থিতির কথা জানত না? অথবা সে কি মনে ভেবেছিল এ ধরনের কথা মেয়রের মতো একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি বলতে পারেন না এবং যেন ভুল করে এ কথা বলে ফেলেছেন? সে কি ভেবেছিল এই মুহূর্তে সমস্ত নীতি, ন্যায়বিচার, সরকার, আইন, সমাজ সব মূর্ত হয়ে উঠেছে শুধু তারই মধে?

সে যাই হোক, মঁসিয়ে ম্যালেনের কথা শুনে জেভার্ত এবার তার দিকে ধীরে পায়ে এগিয়ে গেল। তার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল। ঠোঁটটা নীল হয়ে উঠেছিল। এক মৃদু কম্পনে শরীরটা কাঁপছিল তার। চোখ দুটো নামিয়ে অথচ দৃঢ় কণ্ঠে সে বলল, মঁসিয়ে মেয়র, তা তো হতে পারে না।

মঁসিয়ে ম্যাদলেন বলল, কেন হতে পারে না?

জেভার্ত বলল, কারণ এ নারী একজন বিশিষ্ট নাগরিককে অপমান করেছে।

ম্যাদলেন শান্ত কণ্ঠে বলল, শুনুন ইন্সপেক্টার জেতার্ত, আমি জানি আপনি একজন সম্মানিত ব্যক্তি, ব্যাপারটা আমি আপনাকে বুঝিয়ে বলছি। আসল ঘটনাটা হল এই। আপনি যখন একে ধরে আনছিলেন আমি তখন রাস্তা পার হচ্ছিলাম। তখন সেখানে কিছু লোক দাঁড়িয়েছিল। আমি তাদের জিজ্ঞাসা করি, কী হয়েছে। আমি সব কথা শুনেছি। যে নাগরিককে এ অপমান করেছে, দোষটা তার। আইন অনুসারে তাকেই গ্রেপ্তার করা উচিত।

জেভার্ত জোর দিয়ে বলল, কিন্তু এই শহরের মেয়র আপনাকেও অপমান করেছে।

মাদলেন বলল, সেটা আমার অপমান, আমার এক ধরনের সম্পত্তি। আমি তা নিয়ে যা খুশি করতে পারি।

জেভার্ত বলল, মাপ করবেন মঁসিয়ে মেয়র। অপমান শুধু আপনাকে নয়, ন্যায়বিচারকেই ও অপমানিত করেছে।

বিবেকই সবচেয়ে বড় বিচারক মঁসিয়ে জেভার্ত। আমি মেয়েটির সব কথা শুনেছি এবং আমি কী করেছি আমি তা জানি।

আমি নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছি না মঁসিয়ে মেয়র।

তা হলে আমার কথামতো কাজ করুন।

আমাকে আমার কর্তব্য করতে হবে। আমার কর্তব্য হল ওকে ছয় মাসের জন্য জেলে পাঠানো।

ম্যাদলেন তবু শান্ত কণ্ঠে বলল, আপনাকে এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে হবে। ও একদিনের জন্যও জেলে যাবে না।

ম্যালেনের কথাগুলোতে জেভার্ত আরও সাহস পেয়ে গেল। সে শ্রদ্ধার সঙ্গে ম্যালেনের পানে তাকিয়ে বলতে লাগল, মেয়রের সঙ্গে এ ব্যাপারে তর্ক করতে আমার বড় খারাপ লাগছে। এ ধরনের ঘটনা এর আগে কখনও ঘটেনি। কিন্তু আমি মঁসিয়ে মেয়রকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, আমি আমার ক্ষমতা অনুসারেই কাজ করছি। নাগরিকদের স্বার্থ দেখাই আমাদের কাজ। আমি সেখানে ছিলাম। মেয়েটি মঁসিয়ে বামাতাবয়কে মারধর করেছে। মঁসিয়ে বামাতাবয় একজন নাগরিক, নির্বাচকমণ্ডলীর তালিকায় তাঁর নাম আছে, এক তিনতলা বাড়ির মালিক। এ ব্যাপারটা পুলিশ আইনের আওতায় পড়ে। আমি তাই ফাঁতিনেকে ধরেছি।

এ কথায় মঁসিয়ে ম্যাদলেন হাত দুটো জড়ো করে এমন গলায় কথা বলতে লাগল, যা এর আগে কেউ কখনও শোনেনি। সে বলল, আপনি যে আইনের কথা বললেন সেটা মিউনিসিপ্যাল পুলিশের আইন এবং সেটা হল অপরাধবিধির নয়, এগারো, পনেরো আর ছেষট্টি ধারা এবং তার ওপর আমার পূর্ণ কর্তৃত্ব আছে। আমি সেই ধারা বলে মেয়েটিকে ছেড়ে দিতে বলছি।

জেভার্ত একবার শেষ চেষ্টা করে দেখল। বলল, কিন্তু মঁসিয়ে মেয়র

ম্যাদলেন বলল, আমি আপনাকে ১৭৯৯ সালের ১৩ ডিসেম্বর পাস করা আইনের একাশি ধারার কথাও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি যাতে কাউকে আটক রাখা যায়।

আমার কথা শুনুন মঁসিয়ে মেয়র।

খুব হয়েছে। এটাই যথেষ্ট বলে মনে করি।

কিন্তু–

আপনি দয়া করে এখান থেকে চলে যান।

জেতার্ত একজন কর্তব্যরত রুশ সৈনিকের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার পর মাথাটা একবার নুইয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ফাঁতিনে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল আর শুনছিল। সে আশ্চর্য হয়ে জেভার্তের যাওয়ার পথ করে দিল।

তার অন্তরেও তখন জোর আলোড়ন চলছিল। সে দেখেছে তাকে নিয়ে দু জন পদস্থ লোকের কত তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। এই দু জন লোকের ওপর তার স্বাধীনতা, তার মেয়ের জীবন নির্ভর করছিল। একজন তাকে গভীরতর অন্ধকারে টেনে নিয়ে যেতে চাইছিল আর একজন তাকে আলোর দিকে নিয়ে যেতে চাইছিল। সে ভয়ে ভয়ে লক্ষ করছিল এই দু জন শক্তিশালী পুরুষ দৈত্যের মতো বাকযুদ্ধ করছিল–একজন দৈত্যের মতো কথা বলছিল আর একজন দেবদূতের মতো কথা বলছিল। অবশেষে দেবদূতই জয়লাভ করে। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা এই যে, যে দেবদূত তাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করে সে হল তার চোখে সেই ঘৃণ্য মেয়র যাকে সে তার সকল দুঃখকষ্টের মূল কারণ হিসাবে ভেবে এসেছে। সে অপমান করা সত্ত্বেও সেই মেয়রই তাকে উদ্ধার করল। তবে সে কি অন্যায় করেছে? তবে কি তার অন্তরের পরিবর্তন করতে হবে? সে দাঁড়িয়ে কাঁপতে লাগল আর ম্যাদলেনের পানে বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকাতে লাগল। ক্ৰমে ম্যালেনের প্রতি তার ঘৃণার পাথরটা গলে যেতে লাগল। তার পরিবর্তে এক শ্রদ্ধা আর বিশ্বাসের অনুভূতি জাগতে লাগল।

জেতার্ত চলে গেলে ম্যালেন এবার ফাঁতিনের কাছে গিয়ে ধীরে ধীরে বলতে লাগল, তুমি যা বলেছ আমি সব শুনেছি। আমাকে এ সব কথা জানানো হয়নি। তবু আমি তোমার কথা বিশ্বাস করি। আমি জানতামই না তুমি কাজ ছেড়ে দিয়েছ। তুমি আমার কাছে গিয়ে আবেদন করনি কেন? যাই হোক, আমি তোমার ঋণ শোধ করে দেব এবং তোমার মেয়েকে আনার অথবা তার কাছে তোমার যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেব। তুমি এখানে থাকবে অথবা প্যারিসে ইচ্ছা করলে যেতে পারবে। তুমি না চাইলে তোমাকে কাজ করতে হবে না, তোমার যা টাকা লাগবে আমি দেব। তুমি আবার সত্তাবে জীবনযাপন করে সুখী হতে পারবে। তুমি যা বলেছ তা যদি সত্যি হয় এবং তাতে আমার কোনও সন্দেহ নেই, তা হলে তুমি ঈশ্বরের চোখে সৎ এবং খাঁটি।

ফাঁতিনে আর সহ্য করতে পারছিল না। সে কসেত্তেকে ফিরে পাবে। বর্তমানের এই ঘৃণ্য জীবন থেকে মুক্তি পাবে। সে স্বাধীনভাবে কসেত্তেকে নিয়ে সুখে জীবনযাপন করতে পারবে। তার দুঃখের অন্ধকারে এই স্বর্গসুখের সম্ভাবনা সহ্য করতে পারছিল না সে। সে শুধু অবাক হয়ে ম্যালেনের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। তার পা দুটো কাঁপছিল। সে কোনওরকমে নতজানু হয়ে ম্যালেনের একটা হাত টেনে নিয়ে তার ঠোঁটের উপর চেপে ধরল।

তার পর মূৰ্ছিত হয়ে প্যল ফাঁতিনে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *