সামবেদ-সংহিতা — পবমান পর্ব [৫ম অধ্যায়]
প্রথমা দশতি
ছন্দ আর্চিক। কৌথুমী শাখা। পবমান পর্ব। পঞ্চম অধ্যায়।
দেবতা পবমান সোম৷৷
ছন্দ গায়ত্রী৷৷
ঋষি ১।৪ অমহীয়ু আঙ্গিরস, ২ মধুচ্ছন্দা বৈশ্বামিত্র, ৩ ভৃগু বারুণি বা জমদগ্নি ভার্গব, ৫ ত্রিত আপ্ত্য, ৬ কশ্যপ মারীচ, ৭ জমদগ্নি ভার্গব, ৮ দৃঢ়চ্যুত আগস্ত্য, ৯।১০ কাশ্যপ অসিত বা দেবল।
উচ্চা তে জাতমন্ধসসা দিবি সদভূম্যা দে। উগ্রং শৰ্ম মহি শ্ৰবঃ U১৷ স্বাদিষ্ঠয়া মদিয়া পবস্ব সোম ধারয়া। ইন্দ্রায় পাতবে সুতঃ। ২। বৃষা পবস্ব ধারয়া মরুত্বতে চমৎসরঃ। বিশ্বা দধান ওজসা৷৷ ৩৷৷ যস্তে মদো বরেণ্যস্তেনা পবস্বান্ধসা। দেবাবীরশংসহা৷৷ ৪৷ তিম্রো বাচ উদীরতে গাবো মিমন্তি ধেনবঃ।হরিরেতি কনিক্ৰদৎ ৫৷৷ ইন্দ্রায়েন্দা মরুত্বতে পবস্ব মধুমত্তমঃ। অকস্য যোনিমাসদ৷৬৷৷ অসাব্যংশুমদায়াপসূ দক্ষো গিরিষ্ঠাঃ। শ্যোনো ন যোনিমাসদৎ৷৷ ৭৷৷ পবস্ব দক্ষসাধনো দেবেভ্যঃ পীতরে হরে। মরুদ্ভো বায়বে মদঃ ॥ ৮৷৷ পরি স্বানো গিরিষ্ঠাঃ পবিত্রে সোমো অক্ষরৎ। মদেষু সর্বধা অসি৷৷ ৯৷৷ পরি প্রিয়া দিবঃ কবিয়াংসি নপ্ত্যোহিতঃ। স্বানৈর্যাতি কবিক্রতুঃ। ১০৷৷
মন্ত্রার্থ— ১। হে শুদ্ধসত্ত্ব! স্বর্গলোকে তোমার সম্বন্ধীয় রসের জন্ম; অর্থাৎ সত্ত্বভাব। দেবলোকজাত; স্বলোকে অবস্থিত হয়ে আমাদের ন্যায় পাপীদের তেজোময় কল্যাণ এবং মহতী শক্তি প্রদান কর। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রকাশক ও প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, পরম কল্যাণলাভের জন্য আমরা যেন সত্ত্বভাবপূর্ণ হই)। [সত্ত্বভাব দেবতার করুণারূপে মানুষের মস্তকে নেমে আসে। দেবতার ধন, দেবতাই কৃপা করে মানুষকে সেই স্বর্গীয় অমৃতের আস্বাদ দেন। এই মন্ত্রে সত্ত্বভাবকেই সাক্ষাত্তাবে সম্বোধন করা হয়েছে। প্রচলিত ব্যাখ্যায় (ভাষ্যকারের মতানুযায়ী) কল্পিত সোমরস নামক মাদকদ্রব্যকে সম্বোধন করা হয়েছে। একটা মাদকদ্রব্য, যা মানুষকে অধঃপতনের দিকে টেনে আনে, তা যে কেমন করে শক্তি ও কল্যাণ দিতে পারে, তা বোঝা দুষ্কর। শুধু তাই নয়, সোমকে সেখানে স্বর্গজাত বলা হয়েছে, অর্থাৎ সোম দিব্যশক্তিসম্পন্ন। আমরা পূর্বাপর সোম শব্দে সত্ত্বভাব অর্থ গ্রহণ করে আসছি, এখানেও তা-ই করা হয়েছে এবং এটাই সঙ্গতিপূর্ণ। সত্ত্বভাবই দেবভাব, দিব্যশক্তিসম্পন্ন ও কল্যাণদায়ক। তাই মানুষকে অনন্ত কল্যাণের পথে নিয়ে যায়; তা-ই মানষকে অসীম শক্তির অধিকারী করতে পারে। সত্ত্বভাবই পরমব্রহ্মের শক্তি (মাদকদ্রব্য সোম নয়), যে ভাব হৃদয়ে সঞ্জাত হলে মানুষ ব্রহ্মের শক্তি লাভ করে]। [এর তেরটি গেয়গান আছে। সেগুলির নাম—আজীগম, আভীকম, ঋষভ পাবমানম, ব্রাভ্রবে দ্বে, ইন্দ্ৰণ্যাঃসাম শৈশবে দ্বে, দোহসাম, দোহীয়সাম আমহীয়বম্]।
২। হে আমার হৃদয়-নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! বিশুদ্ধতা প্রাপ্ত হয়ে আমাদের ভগবৎ-সমীপে নিয়ে যাবার জন্য প্রীতিজনক পরমানন্দদায়ক ধারারূপে প্রবাহিত হও। (ভাব এই যে, ভগবানকে লাভের জন্য আমাদের হৃদয়স্থ শুদ্ধসত্ত্ব উদ্বোধিত হোক)। [সত্ত্বভাব সকলের হৃদয়েই বর্তমান আছে। সাধনার দ্বারা বিশুদ্ধ হলে তা মানুষকে মোক্ষলাভের পথে প্রেরণ করে]। [এর আটটি গেয়গানের নাম– আজীগম, সুরূপম, সুরূপোত্তরম, জমদগ্নে শিল্পে দ্বে, উহুবাই, সংহিতম, শকুলং, গম্ভীরম্।
৩। অভিমতফলবৰ্ষক অথবা অভীষ্টপূরক হে শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি আনন্দদায়ক হয়ে বিবেকজ্ঞান প্রদানের জন্য ধারারূপে আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হও। অপিচ, আত্মশক্তি দ্বারা পরমধন আমাদের প্রদান কর। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা সত্ত্বভাবসমন্বিত হয়ে যেন পরমধন মোক্ষ প্রাপ্ত হই)। [সভাব মানুষের অভিমত-ফলবর্ষক–অভীষ্টপূরক। মানুষের জীবনের চরম উদ্দেশ্য–মুক্তিলাভ। সেই পরম আকাঙ্ক্ষার ধন মুক্তি বা মোক্ষ দিতে পারে–শুদ্ধসত্ত্বভাব। হৃদয়ে সত্ত্বভাবের উপজন হলে মানুষ পাপপঙ্কিলতার হাত থেকে নিস্তার পায়] [এই সাম-মন্ত্রের গেয়গান নটি। তাদের নাম–সোমসাম, বৈশ্বদেবম, ইন্দ্র সাম, যৌজাস্বম ইত্যাদি]।
৪। হে শুদ্ধসত্ত্ব! তোমাতে দেবভাবপ্রদায়ক পাপনাশক সর্বলোক বরণীয় সকলের আকাঙ্ক্ষণীয়। পরমানন্দদায়ক যে রস আছে, সেই রসের–অমৃতের সাথে আমাদের প্রাপ্ত হও। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক; ভাব এই যে–আমাদের হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্বভাব উপজিত হোক)। [মানুষের মধ্যে সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ আছে। সেইজন্য মানুষের মধ্যে দেবত্ব ও পশুত্বের মিলন হয়েছে। সত্ত্বগুণ দেবভাবের পরিচালক এবং রজঃ ও তমঃ পশুত্ব নির্দেশ করে। সাধনার বলে যখন মানুষ এই রজঃ ও তমের উর্ধ্বে উত্থিত হয়, তখনই তার মধ্যে প্রকৃত দেবভাবের বিকাশ দেখতে পাওয়া যায়। অর্থাৎ রজঃ ও তমঃ বিহীন বিশুদ্ধ সত্ত্বভাবই দেবভাব। –শুদ্ধসত্ত্বকে পাপনাশক বলা হয়েছে; কারণ রজঃ ও তমের বিনাশে পাপনাশ অবশ্যম্ভাবী। পাপের জনক রজঃ ও তমের বিনাশে পাপের অস্তিত্বও নষ্ট হয়। তাই শুদ্ধসত্ত্ব পাপনাশক হৃদয় থেকে পাপ দূরীভূত হলে মানুষ বিমল আনন্দ লাভ করে। সকলেই প্রার্থনীয় সেই আনন্দকে লাভ করলে মানুষের প্রার্থনীয় আর কিছুই থাকে না। তাই এই আনন্দের মূলীভূত কারণ শুদ্ধসত্ত্বের জন্য প্রার্থনা]। [এর গেয়গানের নাম–ভাসম্, সোমসাম, প্রব্যোপত্যম।
৫। ঋক-যজুঃ-সাম মন্ত্রের দ্বারা আমরা প্রার্থনা করছি। তার দ্বারা জ্ঞানীকরণসমূহ আমাদের হৃদয়ে উদ্দীপিত হোক; অপিচ, জ্ঞানরশ্মিসমূহ আমাদের চিত্তবৃত্তিকে উদ্বোধিত করুক; পাপহারক সত্ত্বভাব আমাদের হৃদয়ে আগমন করুক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, -সত্ত্বভাবসমন্বিত জ্ঞান আমাদের পরমধন প্রদান করুক)। [গাব ও ধেনবঃ পদদুটিতে সঙ্গতভাবেই যথাক্রমে জ্ঞানকিরণ ও জ্ঞানরশ্মি অর্থ গৃহীত হয়েছে। দুটি পদই একার্থক, কেবলমাত্র প্রার্থনার দৃঢ়তা বোঝাবার জন্য দুটি বিভিন্ন পদের ব্যবহার]। [এই সাম-মন্ত্রের ছটি গেয়গান আছে। তাদের নাম–বৈষ্টম্ভে দ্বে, পার্ষ্টৌ হে দ্বে, ক্ষুল্লকবৈষ্টম্ভম, পার্ষ্টৌহম]।
৬। হে শুদ্ধসত্ত্ব! বিবেকলাভের জন্য জ্ঞানযজ্ঞের উৎপত্তিমূল আমার হৃদয়কে প্রাপ্ত হও; অপিচ, ভগবৎপ্রাপ্তির জন্য মধুরতম অর্থাৎ অভীষ্টপূরক হয়ে করুণাধারায় আমার হৃদয়ে উপজিত হও। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, ভগবানকে লাভের নিমিত্ত আমার হৃদয়ে সত্ত্বভাব আবির্ভূত হোক)। [হৃদয়েই জ্ঞানের জন্ম। তাই অকস্য যোনিংপদ দুটিতে হৃদয়কে লক্ষ্য করে। হৃদয়ই সকল জ্ঞানবিজ্ঞানের উৎসস্থানীয়। হৃদয় নির্মল হলে, পবিত্র হলে সেখানে বিবেক জ্ঞানের–পরাজ্ঞানের আবির্ভাব হয়। তাই সেই পরমজ্ঞানলাভের জন্য সত্ত্বভাবের আবাহন করা হয়েছে। দেবতা ও সত্ত্বভাব অভিন্ন]। [এর আটটি গেয়গানের নাম-ইষবুধীয়ম, ইন্দ্ৰসাম, বৈশ্যদেবে দ্বে, আগ্নেয়ং দ্বে, বৈশ্বদেবম, আগ্নেয়ং]।
৭। আমাদের পরমানন্দ দানের নিমিত্ত শ্রেষ্ঠতম অর্থাৎ ভক্তগণের অভীষ্টপ্রাপক জ্ঞানকিরণ পবিত্র এবং শুদ্ধসত্ত্বের সাথে মিলিত হয়ে অনন্তশক্তিবিধায়ক হোক এবং শ্যেনের মতো ক্ষিপ্রসঞ্চরণশীল হয়ে আমাদের হৃদয়কে প্রাপ্ত হোক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাবার্থ–আমাদের হৃদয় সত্ত্বভাবসমন্বিত দিব্যজ্ঞানে পরিপূর্ণ হোক) [ভাষ্যকার অংশুঃ পদে সোমঅর্থ ধরেছেন তারফলে সোমকে গিরিষ্ঠা পর্বতে জাত বলা হয়েছে, কিংবা, সোমকে আকাশে গিয়ে বসানো হয়েছে। এখানে অংশু পদে জ্ঞান, জ্ঞানকিরণ অর্থেরই সঙ্গতি রয়েছে। গিরিষ্ঠা পদে শ্রেষ্ঠতম, যথা–ভক্তদের অভীষ্টপ্রাপক অর্থই সঙ্গত। জ্ঞান যখন সত্যভাবের সাথে মিলিত হয়, তখনই তা বিশুদ্ধ মোক্ষদায়ক হয়]। [এর গেয়গান আটটি। সেগুলির নাম–শৈশবানি চত্বারি চ্যাবনানি চত্বারি।
৮। হে পাপহারক শুদ্ধসত্ত্ব! আত্মশক্তি-সাধক পরমানন্দদায়ক তুমি শুদ্ধসত্ত্বস্বরূপ বিবেকরূপী দেবগণের এবং আশুমুক্তিদায়ক দেবতার প্রীতির নিমিত্ত আমাদের হৃদয়ে উপস্থিত হও। (এ মন্ত্রও প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবানকে লাভের জন্য সত্ত্বভাব আমাদের হৃদয়ে উপজিত হোক)। [এখানে হরে পদে হে পাপহারক শুদ্ধসত্ত্ব, মদঃ পদে পরমানন্দদায়ক, ইত্যাদি অর্থ গৃহীত হয়েছে। প্রচলিত ব্যাখ্যায় হরে পদে সোমকে লক্ষ্য করে তাকে হরিবর্ণ বলা হয়েছে। বলা হয়েছে–সে মদকর, দেবগণের ও মরুৎগণের ও বায়ুর জন্য ক্ষরিত হয়। অথচ মরুদ্ভঃ–বিবেকরূপী দেবতা, বায়বে–আশুমুক্তিদাতা দেবতার–এমন অর্থই সমীচীন] । [এর গেয়গানের নাম–প্রাজাপত্যে দ্বে]।
৯। শ্রেষ্ঠতম অর্থাৎ ভক্তগণের অভীষ্টপূরক পবিত্রতা-সাধক শুদ্ধসত্ত্ব আত্ম-উৎকর্ষসম্পন্ন হৃদয়ে আপনা-আপনি সঞ্চারিত হয়। অতএব হে শুদ্ধসত্ত্ব! আমাদের পরমানন্দ-দানের জন্য তুমি সর্ব অভীষ্টের পূরক হও। (নিত্যসত্য-প্রকাশক এই মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাবার্থ–আত্ম-উৎকর্ষসম্পন্ন সাধকদের হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্ব আপনা-আপনিই সঞ্জাত হয়। অকিঞ্চন আমরা শুদ্ধসত্ত্বকে প্রার্থনা করছি। শুদ্ধসত্ত্ব আমাদের সকল অভীষ্ট পূরণ করুন)। [নির্মল স্ফটিকেই সূর্যকিরণ যেমন প্রতিবিম্বিত হয় পবিত্র সাধুর হৃদয়েই তেমনি পবিত্রতার স্বরূপ সত্ত্বভাবের উপজন সম্ভবপর। হৃদয়ে সত্ত্বভাবের আবির্ভাব হলে মানুষের প্রার্থনীয় আর কিছুই থাকে না; মানুষ ক্রমশঃ আরও উন্নতির পথেই অগ্রসর হতে থাকে। এই জন্যই সত্ত্বভাবকে সকল অভীষ্টের পূরক বলা হয়েছে। [এই সাম-মন্ত্রের ছটি গেয়গান আছে; সেগুলির নাম–আদ্যং বৈদস্যতম্, দ্বিতীয়ং বৈদস্যতম, তৃতীয়ং বৈদস্যতম্, চতুর্থং বৈদস্যতম্, আঙ্গিরসস্য পদস্তোতৌ দ্বৌ]।
১০। প্রজ্ঞানসম্পন্ন বুদ্ধিমান্ ব্যক্তি সৎকর্মসাধনের দ্বারা দ্যুলোকের প্রিয় শক্তি আত্মশক্তি অর্থাৎ নিত্যকাল প্রাপ্ত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রকাশক; ভাব এই যে, –জ্ঞানী এবং সৎকর্মের সাধকগণই আত্মশক্তি লাভ করেন)। অথবা–মেধাবী কান্তপ্রজ্ঞ শুদ্ধসত্ত্ব (ভগবান) সাধকদের হৃদয়ে সর্বদা বর্তমান আছেন। হৃদয়রূপ দ্যুলোকের প্রিয়শক্তিসমূহ সৎকর্মসাধনের দ্বাবাই উদ্বোধিত হয়ে থাকে। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রকাশক সাধকের হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্ব নিত্যকাল বিরাজিত। সৎকর্মের সাধনের দ্বারা শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে সে শক্তি উদ্বোধিত হয়ে থাকে)। [জ্ঞান ও কর্ম এই উভয় পন্থার অনুসরণেই মানুষ। আত্মশক্তির অধিকারী হন। জ্ঞান-সাধনের সাথে কর্ম-সাধনেরও সাদৃশ্য আছে। সৎকর্মের সাধনা দ্বারা হৃদয়ের মলিনতা দূরীভূত হয়। শাস্ত্রনির্দিষ্ট সৎ-মার্গে নিজেকে চালিত করলে, সৎ-ভাবে জীবন-যাপন করলে, অন্তঃশত্রু ও বহিঃশত্রুও হীনবল হয়। এই সৎকর্মজনিত শক্তির কাছে তারা পরাজিত হয়ে পলায়ন করে। তাই সৎকর্ম-সাধনের দ্বারাই সাধক বিনা আয়াসে আত্মশক্তির সাক্ষাৎকার লাভ করেন। সুকর্মের প্রেরণাই তাকে ঊর্ধ্বমুখে পরিচালিত করে। সাধক পরিণামে মুক্তিলাভ করেন]। [এই সাম মন্ত্রের ঋষির নাম–কাশ্যপ অসিত এর গেয়গানের নাম—পূর্বমৌর্ণায়বম এবং উত্তরমৌর্ণায়বম্]।
.
দ্বিতীয়া দশতি
ছন্দ আর্চিক। কৌথুমী শাখা। পবমান পর্ব। পঞ্চম অধ্যায়।
দেবতা পবমান সোম৷৷
ছন্দ গায়ত্রী৷
ঋষি ১ কবি মেধাবী, ১ শ্যাবাশ্ব আত্রেয়, ৩ ত্রিত আপ্ত্য, ৪।৮ অমহীয়ু আঙ্গিরস, ৫ ভৃগু বারুণি, ৬ কাশ্যপ মারীচ, ৭ নিধ্রুবি কাশ্যপ, ৯।১০ কাশ্যপ অসিত বা দেবল৷ (এই দশতির মন্ত্রগুলির দেবতা বিষয়ে মতান্তর আছে)।
প্র সোমাসো মদচ্যুতঃ শ্রবসে নো মঘোনা। সুতা বিদথে অমুঃ ৷৷ ১৷৷ পবমান পর্ব প্র সোমাসো বিপশ্চিতোহপো নয়ন্ত ঊর্ময়ঃ। বনানি মহিষা ইব৷৷ ২. পবস্বেন্দো বৃষা সুতঃ কৃধী নো যশসোজনে।বিশ্বা অপ দ্বিমোজহি৷৷ ৩৷ বৃষা হসি ভানুনা দুমন্তং ত্বা হবামহে। পবমান স্বদৃশ৷৷ ৪৷৷ইন্দুঃ পবিষ্ট চেতনঃ প্রিয়ঃ কবীনাং মতিঃ। সৃজদশং রথীরিব। ৫। অসৃক্ষত প্র বাজিনো গব্যা সোমাসো অশ্বয়া। শুক্রাসো বীরয়াশবঃ৷৷ ৬৷৷ পবস্ব দেব আয়ুষগিং গচ্ছতু তে মদঃ। বায়ুমা রোহ ধর্মণা৷৷ ৭৷ পবমাননা অজীজনদ দিবশ্চিত্ৰং ন তন্যতুম৷ জ্যোতিবৈশ্বানরং বৃহৎ ৮৷৷ পরি স্বানাস ইন্দবোমদায় বীণা গিরা। মধো অর্ষন্তি ধারয়া৷৷ ৯৷৷ পরিসিষ্যদৎ কবিঃ সিন্ধোরূৰ্মাবধি শ্রিতঃ। কারুং বিভ্রৎ পুরুস্পৃহ৷৷ ১০৷৷
মন্ত্রার্থ— ১। পরমানন্দদায়ক পবিত্রকারক শুদ্ধসত্ত্ব সৎকর্মসাধনশীল আমাদের সৎকর্ম-সাধনে সিদ্ধিপ্রদানের জন্য আমাদের প্রাপ্ত হোক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, –সৎকর্মের সাধনে সিদ্ধিলাভের জন্য আমরা যেন শুদ্ধসত্ত্বকে প্রাপ্ত হই)। [সৎকর্ম সাধনের দ্বারা হৃদয় পবিত্র না হলে, হৃদয়ে বিশুদ্ধ সত্ত্বভাবের সঞ্চার না হলে, সিদ্ধিলাভ সম্ভব নয়। সৎকর্মসাধনের পরিণতি মোক্ষলাভ। তাই সেই মোক্ষ বা পরাগতি প্রাপ্তির জন্য সত্ত্বভাব লাভের প্রার্থনা]। [এর গেয়গানের নাম—সৌভরম]।
২। অপের (জলের) ঊর্মিমালা যেমন সকল সময়ে আপনা-আপনি উদ্ভূত হয়, অথবা বনসমূহ যেমন আপনা-আপনিই প্রবৃদ্ধ হয়ে থাকে; তেমনই পরাজ্ঞানসম্পন্ন আত্ম-উৎকর্ষ সাধনশীল সাধকদের হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্ব আপনা-আপনিই উদ্ভূত হয়ে থাকে। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য প্রকাশ করছেন। ভাব এই যে, –আত্ম-উৎকর্ষের প্রভাবে শুদ্ধসত্ত্ব আপনা-আপনিই সঞ্জাত হয়)। [মন্ত্রের অপঃ উর্ময়ঃ উপমার দ্বারা বোঝাচ্ছে–হৃদয় পবিত্র কর। সত্ত্বভাব আপনিই জাগরিত হবে। দ্বিতীয় উপমা বনানি মহিষা ইব-তেও একই ভাব দ্যোতনা করে। প্রকৃতির প্রভাবে তরুগুল্মলতা প্রভৃতি যেমন আপনা আপনিই পরিবর্ধিত হয়, তেমনই আত্ম-উৎকর্ষ সাধনের দ্বারা শুদ্ধসত্ত্ব হৃদয়ে আপনা-আপনিই প্রবর্ধিত কা হয়ে থাকে। দ্বিতীয় অন্বয়ে মন্ত্রের ভাব মূলতঃ একই। দুই ক্ষেত্রেই সৎ-ভাব আহরণের উপদেশ প্রদত্ত হয়েছে। সত্ত্বভাব আমাদের হৃদয়ে আগমন করুক কি ভাবে? বন্য পশুগণ যেমন বনের দিকে এর ধাবিত হয়, তেমন ভাবে। পশুগণ বনে থাকে, সুতরাং অন্য স্থানে থাকলেও তারা শেষপর্যন্ত অত্যন্ত আগ্রহের সাথে বনেই চলে যায়। মানুষের মধ্যে সত্ত্বভাবের আবির্ভাবও তেমন স্বাভাবিক। অসৎকর্ম ॥ পরিত্যাগ করলে, কিংবা সৎ-সাধনের ফলে মানুষের মধ্যে পুনরায় সত্ত্বভাবের উপজন হবে। এইদিক দিয়ে বনানি মহিষা ইব উপমার সার্থকতা উপলব্ধি করা যায়। অপঃ উর্ময়–অমৃতের প্রবাহ সদৃশ। এই উপমা সত্ত্বভাবের স্বরূপ নির্দেশ করছে। অমৃতপানে মানুষ অমর হয়। সত্ত্বভাবের উপজনেও মানুষ অমৃতত্ব লাভ করে। [এই সাম-মন্ত্রে গেয়গানের নাম—সৌভরম্]।
৩। হে শুদ্ধসত্ত্ব! বিশুদ্ধ অভিমতফলবর্ষক তুমি আমাদের হৃদয়ে উপজিত হও অর্থাৎ ভগবানের করুণাধারারূপে ক্ষরিত হও; এবং তুমি আমাদের ইহজগতে সৎকর্মপরায়ণ কর; এবং তুমি আমাদের সবরকম রিপুশত্রুদের বিনাশ কর। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। মন্ত্রের ভাব এই যে, –শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে সৎকর্মপরায়ণ হয়ে আমরা যেন রিপুশবর্গকে জয় করতে পারি)। [মন্ত্রটির প্রার্থনা বিশ্বপ্রেমের দ্যোতনা করে। শুধু নিজের জন্য এই প্রার্থনা নয়–এই প্রার্থনা বিশ্ববাসী সকলের মঙ্গলের জন্য। অন্য দিক দিয়েও এই বিশ্বজনীন প্রার্থনার সার্থকতা দেখতে পাওয়া যায়। বিশ্ব ভগবানেরই বিকাশ। সুতরাং এই পরিদৃশ্যমান জগৎকে অবহেলা করে সেই বিশ্বপ্রভুর সন্ধান পাওয়া যায় না। তিনি এই বিশ্বের মধ্যেও আছেন। মন্ত্রে যে নঃ পদ পরিদৃষ্ট হয়, সেই পদেই বিশ্বভাব দ্যোতনা করছে। [এর গেয়গানের নাম—বৃষকম]।
৪। হে শুদ্ধসত্ত্বরূপ ভগবান্! আপনি নিশ্চয়ই অভিমতফলবর্ষক হন। পবিত্রকারক হে দেব! সর্বজ্ঞ তেজোময় আপনাকে প্রার্থনা করছি। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য প্রকাশক ও প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, আমরা যেন ভগবৎ-পরায়ণ হই। ভগবান্ আমাদের পরিত্রাণ করুন)। [ভগবান্ কল্পতরু–তিনি সকলের সকল অভীষ্টপূর্ণ করেন। মানুষের এমন যে হিতৈষী, কার মন না তার প্রতি আকৃষ্ট হয়? কিন্তু মোহমায়ায় আচ্ছন্ন মানুষ তাকে ভুলে থাকে। তাই প্রার্থনা–যাতে সেই পরম দেবতার চরণে আশ্রয় গ্রহণ করতে পারি, রিপুগণ আমাদের যাতে পথ ভুলিয়ে না দেয়, ভগবান্ যেন তেমন ব্যবস্থা করে দেন]। [এর গেয়গানের নাম–বৃষকাণি ত্রীণি]।
৫। জ্ঞানদায়ক চৈতন্যস্বরূপ দেবতাগণের প্রিয় সত্ত্বভাব আত্ম-উৎকর্ষসম্পন্নদের স্তুতির দ্বারা ক্ষরিত হন অর্থাৎ তাদের হৃদয়ে উপজিত হন। রথী যেমন সজ্জীকৃত অশ্বসমূহের গতিবেগ-উৎপাদনে আপনা-আপনিই ঊর্মিসমূহের সৃষ্টি করেন, তেমনই শুদ্ধসত্ত্ব সাধকদের হৃদয়ে দেবভাবসমূহের সৃষ্টি করে থাকেন। (ভাব এই যে, -সাধকগণ প্রার্থনা-পরায়ণ হয়ে সত্ত্বভাব লাভ করেন; আমরাও তেমনি ভগবনকৃপায় যেন সত্ত্বভাব লাভ করি)। [এখানে ঊর্মি পদের বিশ্লেষণে মন্ত্রের তাৎপর্য স্পষ্টীকৃত হতে পারে। উপমার অর্থে, ঊর্মি শব্দের অর্থ সজ্জীকৃত অশ্বসমূহের গতিতরঙ্গ। (গতিবিশিষ্ট হলে তরঙ্গের উৎপত্তি খুবই স্বাভাবিক)। অশ্বের গতিবেগ থেকে উৎপন্ন তরঙ্গের সাথে শুদ্ধসত্ত্ব থেকে উৎপন্ন দেবভাবের তুলনা করা হয়েছে। অথবা ভগবানের প্রতি গতিবিশিষ্ট হলেই হৃদয়ে সৎ-ভাবের সমাবেশ আপনা-আপনিই হয়ে থাকে]। [এর গেয়গানের নাম–কৌন্তস্য সামানিত্ৰীণি]।
৬। জ্ঞানলাভের ইচ্ছায়, পরাজ্ঞান প্রাপ্তির জন্য, এবং কর্মসামর্থ্য লাভের জন্য বীর্যন্ত বলবন্ত। আশুমুত্তিয়ক সত্ত্বভাব সাধকগণ কর্তৃক হৃদয়ে প্রকৃষ্টরূপে উৎপাদিত হয়। (ভাব এই যে, সৎকর্মের সাধনের দ্বারা সাধকগণ অভীষ্টপূরক সত্ত্বভাব লাভ করেন)। [সত্ত্বভাবের সঙ্গে জ্ঞানেরও। এ উন্মেষ হয়। তা মানুষকে মুক্তির পথে নিয়ে যায়। তাই সত্ত্বভাব আশুমুক্তিপ্রদ। মানুষের চরম কামনা, যে মোক্ষলাভ–সত্ত্বভাবের দ্বারা সেই পরম আকাঙক্ষণীয় মোক্ষলাভ হয়। [এর গেয়গানের নাম বার্তবেশস্য ত্রীণি]।
৭। হে শুদ্ধসত্ত্ব! দ্যুতিমান্ তুমি আমাদের হৃদয়ে উদ্ভূত হও; অপিচ তোমার সম্বন্ধি পরমানন্দ আনন্দময় ভগবানকে প্রাপ্ত হোক; এবং তুমি বায়ুর ন্যায় ক্ষিপ্রগতিতে আমাদের প্রাপ্ত হও। (ভাব এই যে, আমরা সত্ত্বভাব লাভ করে তার সাহায্যে যেন ভগবানকে লাভ করতে পারি)। [এর গেয়গানের নাম–শান্মনে দ্বে]।
৮। পবিত্রকারক শুদ্ধসত্ত্ব দুলোক-সম্বন্ধি বিচিত্র, মহাতেজসম্পন্ন, অর্থাৎ মুক্তিপ্রদ, মহৎ, বিশ্বব্যাপক জ্ঞানালোক সৃষ্টি করেন। (ভাব এই যে, –ভগবান্ জগতের হিতের জন্য মুক্তিদায়ক জ্ঞান আলোক জগতে বিচ্ছুরিত করেন)। [জ্ঞান-স্বরূপ ভগবান্ থেকে জ্ঞান-জ্যোতিঃ জগতে প্রকাশিত হয়। সেই জ্ঞান নিখিল বিশ্বে অনুচ্যুত হয়ে আছে। জ্ঞানই শক্তি। ভগবৎ-প্রদত্ত সেই শক্তির বলে মানুষ নিজের অসীম উন্নতি সাধন করতে পারে নিজেকে ব্রহ্মপদে নিয়ে যেতে সমর্থ হয়। সৃষ্টির মূলে এই জ্ঞান বিদ্যমান। ভগবান ও মানুষের মিলন-সেতু এই জ্ঞান। ভগবান্ কৃপা করে জগতের কল্যাণের জন্য এই স্বর্গীয় সম্পদ–জ্ঞান–জগতে প্রকাশিত করেন]। [এই সাম-মন্ত্রের গেয়গানের নাম জনিত্রে দ্বে]।
৯। মধুর ন্যায় আনন্দদায়ক সত্ত্বভাবসমূহ মহত্ত্ব ইত্যাদি সম্পন্ন স্তুতিরূপ সৎকর্ম ইত্যাদির দ্বারা পরিশুদ্ধ এবং দিব্যজ্যোতিঃ সম্পন্ন হয়ে পরমানন্দ দানের নিমিত্ত ভগবানের করুণাধারারূপে ভক্তদের হৃদয়ে ক্ষরিত হচ্ছে। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রকাশক। ভাব এই যে, –সাধকবর্গ সৎকর্মের প্রভাবে সত্ত্বভাব প্রাপ্ত হন)। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানের নাম–সঙ্ক্রীড়ম, নিক্রীড়ম্]।
১০। সত্ত্বসমুদ্রের প্রবাহে আশ্রয়প্রাপ্ত অর্থাৎ সত্ত্বগুণান্বিত প্রাজ্ঞজন সর্বলোক-প্রার্থনীয় জ্ঞান ধারণ করে তা জগতে প্রদান করেন। (ভাব এই যে, সত্ত্বভাবান্বিত জ্ঞানিজন জগতে পরাজ্ঞান প্রদান করেন)। অথবা-ঊর্মিসমূহ যেমন সিন্ধুকে আশ্রয় করে অবস্থিতি করে অথবা সিন্ধু যেমন আপন আশ্রিত ঊর্মিসমূহকে স্যন্দিত করে; তেমনই ক্ৰান্তপ্ৰজ্ঞ সাধকগণ সকলের আকাঙক্ষণীয় পরাজ্ঞান আশ্রয় করে কৃতার্থম্মন্য হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাবার্থ–আত্ম-উৎকর্ষ-সম্পন্ন সাধক সাধনার প্রভাবে পরাজ্ঞান বা মুক্তিলাভ করেন)। [সত্ত্বগুণান্বিত জন বিশ্বকে ভালবাসেন বলে বিশ্বের মঙ্গলের জন্য নিজের শক্তিকে নিয়োজিত করেন। প্রতিটি মানুষের মঙ্গল হোক, সকলে সেই দুর্লভ পরাজ্ঞান লাভ করুক–এই বিশ্বজনীন ভাব হৃদয়ে পূর্ণবিকশিত হলে ত্বংও অহং-এর পার্থক্য ঘুচে যায়। মন্ত্রের উপমাবাক্য–সিদ্ধোরূৰ্মাবধিশ্রিত। এর তাৎপর্য–ঊর্মিসমূহ সিন্ধুকে আশ্রয় করে অবস্থিতি করে, সিন্ধুতেই তার উৎপিত্ত, তাতেই তার লয়। উভয়ের যেমন আধার ও আধেয় সম্বন্ধ, সাধকের ও পরাজ্ঞানের সম্বন্ধেও তাই বুঝতে হবে। আত্ম-উৎকর্ষের ফলে, হৃদয়ে আপনা-আপনি জ্ঞানের সঞ্চার হলে, সিন্ধুতে ঊর্মিমালার মতো, হৃদয়েও জ্ঞানের তরঙ্গ খেলতে থাকে। আর সেই তরঙ্গে ভেসে সাধক জ্ঞানাধারের বক্ষে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এখানে উল্লেখ্য-কারুং পদের গৌঃ অর্থ নিরুক্তসম্মত। গো অর্থে জ্ঞান। সুতরাং কারুং পদে জ্ঞানং অর্থ গৃহীত হয়েছে। সিন্ধোঃ পদে সত্ত্বসমুদ্রস্য অর্থ নেওয়া হয়েছে। এইগুলি সবই সঙ্গত]। [এই সাম-মন্ত্রের গেয়গানের নাম ঔশনম]।
.
তৃতীয়া দশতি
ছন্দ আর্চিক। কৌথুমী শাখা। পবমান পর্ব। পঞ্চম অধ্যায়।
দেবতা পবমান সোম৷৷
ছন্দ গায়ত্রী৷
ঋষি ১।৮।৯ অমহীয়ু আঙ্গিরস, ২ বৃহন্মতি আঙ্গিরস, ৩ জমদগ্নির্ভাগবঃ, ৪ প্রভুবসু আঙ্গিরস, ৫ মেধ্যাতিথি কাণ্ব, ৬।৭ নিধ্রুবি কাশ্যপ, ১০ উচথ্য আঙ্গিরস।
উপো যু জাতমপুরং গোভিভঙ্গং পরিষ্কৃতম্। ইন্দুং দেবা অযাসিযুঃ ১। পুনানো অক্রমীদভি বিশ্বা মৃধো বিচৰ্ষণিঃ। শুম্ভন্তি বিপ্রং ধীতিভিঃ ২। আবিশন্ কলশং সুতো বিশ্বা অষন্নভি শ্রিয়ঃ। ইন্দুরিন্দ্রায় ধীয়তে৷৷ ৩৷৷ অসর্জি রথ্যো যথা পবিত্রে চম্বোঃ সুতঃ। .. কাৰ্মন বাজী ন্যক্রমীৎ৷৷ ৪৷৷ প্র যদ গারো ন ভূয়ত্তে অযাসো অমুঃ। ঘন্তঃ কৃষ্ণামপত্ব৷৷ ৫ অপ ঘন পবসে মৃধঃ ক্রতুবিৎসোম মৎসরঃ। নুদদা দেবয়ুং জন৷ ৬ ৷৷ অয়া পবস্ব ধারয়া যয়া সূর্যমরোচয়ঃ। হিব্বানো মানুষীরপঃ॥৭॥ স পবস্ব য আবিথেন্দ্রং বৃত্ৰায় হবে। বৰ্বিবাংসং মহীরপঃ ৮৷৷ অয়া বীতী পরি সব যস্ত ইন্দো মদে্যু। অবাহন নবীনব৷৷ ৯৷ পরি দুক্ষং সনদ রয়িং ভরদ্বাজং নো অন্ধসা। স্বাননা অর্য পবিত্র আ৷ ১০৷
মন্ত্রাৰ্থ–১। সৎকর্ম ও সৎ-ভাবের দ্বারা পূর্ণবিকশিত সৎকর্মসঞ্জাত অমৃতসদৃশ, রিপুনাশক, এ বিশুদ্ধ জ্ঞানের দ্বারা সুসংস্কৃত সত্ত্বভাবকে দেবভাবসম্পন্ন সাধকগণ প্রাপ্ত হন। (ভাব এই যে, এ দেবভাবান্বিত ব্যক্তিগণ সৎকর্ম সাধনের দ্বারা শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করেন)। [অপ শব্দে অমৃত বোঝায়, এ তাই এখানে ঐ পদে অমৃতসদৃশ ব্যাখ্যা গৃহীত হয়েছে। দেবা পদে ইন্দ্রদেব নয়, দেবভাবসম্পন্ন সাধকগণ অর্থই সঙ্গত। –দেবভাব ও সত্ত্বভাবের মধ্যে অতি নিকট সম্বন্ধ বর্তমান। একটির আবির্ভাবে অন্যটির উপস্থিতি প্রায়ই পরিলক্ষিত হয়]। [এই সাম-মন্ত্রের গেয়গানের নাম–যামাণি ত্রীণি]।
২। সর্বজ্ঞ পবিত্র শুদ্ধসত্ত্ব সমস্ত রিপুকে পরাজিত করেন। (ভাব এই যে, হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্বের উপজন হলে হৃদয়-গত সমস্ত রিপু বিদূরিত হয়ে যায়)। তখন ভগবান্ সৎবৃত্তির দ্বারা সেই মেধাবী ব্যক্তিকে অলঙ্কৃত করেন। (ভাব এই যে, –আত্ম-উৎকর্ষসম্পন্ন সাধক রিপুজয়ী হন; তিনি ভগবানের কৃপায় শুভবুদ্ধি লাভ করেন)। [যার যেমন ভাবনা তিনি তেমনই ফল লাভ করে থাকেন। যিনি নিজেকে সবরকমে পবিত্র রাখতে ইচ্ছা করেন, ভগবান তাকে তারই উপযুক্ত শক্তি দান করেন। যিনি আত্ম-উৎকর্ষ সাধনে তৎপর, তিনি জ্ঞান ও বুদ্ধি প্রাপ্ত হন]। [এই সাম-মন্ত্রের গেয়গানের নাম– বৈরূপম]।
৩। বিশুদ্ধ সত্ত্বভাব সকল সম্পদ ধারণ করে আমাদের হৃদয়রূপ আধারে অধিষ্ঠিত হয়ে (সেই সত্ত্বভাব) ভগবানের প্রীতির নিমিত্ত আমাদের অভিসিঞ্চিত করুক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, পরমসম্পদদায়ক বিশুদ্ধ সত্ত্বভাব ভগবানকে লাভের জন্য আমরা যেন প্রাপ্ত হই)। [মন্ত্রে ভগবানের প্রীতির জন্য হৃদয়ে সৎ-ভাব উন্মেষণের সঙ্কল্প পরিদৃষ্ট হয়। এখানে কলশ শব্দে আধার বোঝাচ্ছে; সত্ত্বভাব ধারণের সবচেয়ে উপযোগী আধার বা পাত্র আমাদের হৃদয়]। [এই সাম-মন্ত্রের গেয়গানের নাম–ঔশনে দ্বে]।
৪। অশ্ব যেমন রথে যুক্ত হয়, তেমনই সর্বত্র বিদ্যমান বিশুদ্ধ সত্ত্বভার পবিত্র হৃদয়ে সমুদ্ভূত হন; শক্তিসম্পন্ন সত্ত্বভাব রিপু-সংগ্রামে শত্রুদের পরাজয় করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রকাশক। ভাব এই যে, –পবিত্র-হৃদয় সাধক বিশুদ্ধ সত্ত্বভাব লাভ করেন এবং রিপুজয়ী হন)। [হৃদয়ে সত্ত্বভাবের সাধক যে অপূর্ব শক্তিসমন্বিত হন, তার সাহায্যে তিনি রিপুদের পরাজিত করতে সমর্থ হন। এখানে সত্ত্বভাবের সেই শক্তির কথাই বলা হয়েছে। রথ্যো যথা উপমার ভাব এই যে, –অশ্ব যেমন রথে যুক্ত হয়, তেমনই সম্ভাবগুলি পবিত্র হৃদয়ে সঞ্জাত হয়ে থাকে। চম্বোঃ–দ্যাবাপৃথিবীতে, দ্যুলোকে। ভূলোকে, সর্বত্র বিদ্যমান]। [এই সাম-মন্ত্রটির গেয়গানের নাম–সোমসাম]।
৫। জ্ঞানরশ্মিসমূহ যেমন জ্যোতির দ্বারা অজ্ঞজনের হৃদয়কে উদ্ভাসিত করে, অথবা স্তুতিবাক্য যেমন ক্ষিপ্রতার সাথে স্তুত্যকে প্রাপ্ত হয়, তেমনই স্তোতৃদের পোষক, জ্যোতিষ্মান, আশুমুক্তিদায়ক অজ্ঞান-অন্ধকার বিনাশকারী যে সত্ত্বভাব, সেই সত্ত্বভাব আমাদের সৎকর্মে মোক্ষপথে প্রবর্তিত করুক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, –জ্ঞানসমন্বিত সত্ত্বভাবের সাহায্যে আমরা যেন মোক্ষলাভ করি)। [আলোকের আবির্ভাবে যেমন অন্ধকার পলায়ন করে, জ্ঞানের বিকাশে তেমন অজ্ঞানতা দূরীভূত হয়। জ্ঞানসমন্বিত সত্ত্বভাবের সাহায্যে মানুষ মোক্ষের পথে অগ্রসর হতে পারে। সুতরাং আমরাও পরিণামে মোক্ষলাভ করতে সমর্থ হব। এখানে গাবঃ–জ্ঞান, (গরুসকল নয়)]। [এর গেয়গানের নাম কার্ষ্ণে দ্বে]।
৬। হে শুদ্ধসত্ত্ব! পরমানন্দদায়ক তুমি রিপুশত্রুগণকে বিনাশ করে আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হও; জ্ঞানদায়ক তুমি পাপরূপ শত্রুদের আমাদের নিকট হতে বিদূরিত করো। (ভাব এই যে, –সত্ত্বভাব এ আমাদের রিপুজয়ী করে আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোক এবং পাপিদের পাপ বিনাশ করুক)। [মানুষের হৃদয়ে যখন সত্ত্বভাবের উদয় হয়, তখন সে পাপ-পথ, পাপ-জীবন ত্যাগ করে নূতন জীবন পায়। তাই প্রার্থনা–জগতে পাপিদের রক্ষা করো প্রভু! তোমার অমৃতময় সত্ত্বভাব বিতরণে পাপীর এ পাপজীবন ধ্বংস করে দাও, তোমার অমৃত-প্রবাহে জগৎ অভিষিক্ত হোক)। [এর গেয়গানের নাম—বৈশ্বদেবম]।
৭। হে শুদ্ধসত্ত্ব! পবিত্রকারক তুমি মনুষ্যগণের হিতজনক অমৃত-সম্বন্ধি যে প্রবাহের দ্বারা জ্ঞানরশ্মি প্রকাশিত করো, সেই প্রবাহের সাথে আমাদের হৃদয়ে উপজিত হও। (ভাব এই যে, –অমৃত স্বরূপ জ্ঞান আমাদের হৃদয়ে উপজিত হোক)। [এই মন্ত্রে সত্ত্বভাবজনিত জ্ঞানলাভের জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। জ্ঞান ও সত্ত্বভাব একত্র হলে মানুষ সহজেই অমৃতত্ব-লাভে সমর্থ হয়। [এর গেয়গানের নাম–বৈশ্বদেবঃ সূর্যসাম]।
৮। হে শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি অমৃতপ্রবাহ-নিরুদ্ধকারী পাপকে নাশ করবার জন্য বলৈশ্বর্যাধিপতি দেবতাকে রক্ষা করো অর্থাৎ তার শক্তিস্বরূপ হও; তুমি আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হও। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবানের পাপনাশিকা শক্তি আমরা যেন লাভ করতে পারি)। [প্রচলিত ব্যাখ্যায় বৃত্র নামক অসুরের উল্লেখ দেখা যায়। সেখানে সোমকে (অর্থাৎ মাদককে) উদ্দেশ করে বলা হচ্ছে-হে সোম! যখন বৃত্র তাবৎ জলভাণ্ডার রোধ করে রেখেছিল, সেই সময়ে ইন্দ্রের বৃত্রসংহাররূপ ব্যাপারের সময় তুমি ইন্দ্রকে রক্ষা করেছিলো। সেই তুমি এখন ক্ষরিত হও। অর্থাৎ সোমপানে প্রমত্ত হয়ে ইন্দ্র বৃত্রকে বধ করেছিলেন। কিন্তু এতসব গালগল্পের অবতারণার প্রয়োজন হতো না, যদি বৃত্র অর্থে পাপ, অর্থাৎ বৃত্রায় হন্তবে অর্থে পাপকে নাশ করবার জন্য এমন সঙ্গত ভাব বোধগম্য হতো]। [এই সাম-মন্ত্রের গেয়গানের নাম—বার্ত্রঘ্নম]।
৯। হে শুদ্ধসত্ত্ব! তোমার যে দীপ্তি পরমানন্দ দানের জন্য (অথবা, রিপুসংগ্রামে) অসংখ্য রিপু বিনাশ করে, সেই দীপ্তির সাথে আমাদের প্রাপ্ত হও অর্থাৎ আমাদের হৃদয়ে প্রকৃষ্টরূপে আবির্ভূত হও। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, আমরা যেন দীপ্তিমান্ সত্ত্বভাব লাভ করি)। [প্রচলিত ব্যাখ্যায় নবতীর্নব পদের সাথে শম্বরপুরী বা শম্বর নামক অসুরের সম্বন্ধ দেখানো হয়েছে। কিন্তু ব্যাখ্যায় শম্বর শব্দকে টেনে আনার কোনই সার্থকতা নেই। নবতীর্নব পদে সংখ্যার বহুত্ব প্রকাশ করে মাত্র। নবতীর্নব অবাহন পদ দুটিতে অসংখ্য শত্রুর বিনাশ বোঝায়। চারিদিকে অসংখ্য যে সব শত্ৰু মানুষকে মোক্ষপথ থেকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করে, সেই রিপুদের জয় করে মোক্ষপথে অগ্রসর হতে হয়। হৃদয়ে সত্ত্বভাবের সঞ্চার হলে এই সব রিপু ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। এখানে সত্ত্বভাবের সেই শক্তি এবং মানুষের এই অসংখ্য রিপুর কথাই বিবৃত হয়েছে-কোনও দৈত্য বা অসুরের কথা বলা হয়নি। ভাষ্যকার (সায়ণাচাৰ্য্য মন্ত্রের) যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তাতে ইন্দ্রকে একজন মদ্যপায়ী বলেই অনুমান হয়। অর্থাৎ সোমরস পান করে মত্ত হয়ে ইন্দ্রদেবতা নাকি নবনবতি শম্বরপুরী ধ্বংস করেছিলেন। ভগবানের ভাববিকাশে এমনতর ব্যাখ্যার কোনও সার্থকতা আছে কি? সঙ্গত অর্থেই ই পদে ভগবানকে লক্ষ্য করা উচিত; এবং সোম বলতে তারই বিভূতিরাজি শুদ্ধসত্ত্ব বোঝা উচিত]। [এই সাম-মন্ত্রের গেয়গানের নাম–সোমগামানী ত্রীণি]।
১০। দেবতা আমাদের সত্ত্বভাবের সাথে আত্মশক্তি এবং নিত্যধন প্রদান করুন; হে সত্ত্বভাব! বিশুদ্ধ তুমি আমাদের পবিত্র করে আমাদের হৃদয়ে উপজিত হও। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই এ যে, ভগবান কৃপা করে আমাদের আত্মশক্তি এবং সত্ত্বভাব প্রদান করুন)। [মন্ত্রের ভগবৎ- এ সম্বোধনের, সাথে তারই শক্তি সত্ত্বভাবের সম্বোধন একই সূত্রে গ্রথিত। ভগবানের শক্তিকে সম্বোধন করায় ভগবানকে সম্বোধন করা হয়। এই মন্ত্রের দ্বিতীয় অংশে ভগবৎশক্তি সত্ত্বভাবের কাছেই প্রার্থনা করা হয়েদ্বে]। [এই সাম-মন্ত্রের গেয়গানের নাম—ভারদ্বাজম]।
.
চতুর্থ দশতি
ছন্দ আর্চিক। কৌথুমী শাখা। পবমান পর্ব। পঞ্চম অধ্যায়।
দেবতা পবমান সোম৷৷
ছন্দ গায়ত্রী।
ঋষি ১ মেধাতিথি কাণ্ব, ২।৭ ভৃগু বারুণি বা জমদগ্নি ভার্গব, ৩ উচথ্য আঙ্গিরস, ৪ অবৎসার কাশ্যপ, ৫।৬ নিধ্রুবি কাশ্যপ, ৮।৯ কাশ্যপ মারীচ, ১০ অসিত কাশ্যপ বা দেবল, ১১ কবি ভার্গব, ১২ জমদগ্নি ভার্গব, ১৩ অয়াস্য আঙ্গিরস, ১৪ অমহীয়ু আঙ্গিরস৷
অচিদদ বৃষা হরিমন্মিত্রো ন দর্শতঃ। সং সূর্যেণ দিতে৷৷ ১৷৷ আ তে দক্ষং ময়োর্ভুবং বহ্নিমদ্যা ৰূণীমহে। পান্তম পুরুস্পৃহ৷ ২৷৷ অধ্বৰ্যো অদ্রিভিঃ সুতং সোমং পবিত্র আ নয়। পুনাহীন্দ্রায় পাতবে৷৷ ৩৷৷ তরৎ স মন্দী ধাবতি ধারা সুতস্যান্ধসঃ। তরৎ স মন্দী ধাবতি৷৷.৪৷৷ আ পবস্ব সহণিং রয়িং সোম সুবীর্য। অস্মৈ শ্ৰবাংসি ধারয়। ৫৷৷ অনু প্রত্নাস আয়বঃ পদং নবীয়ো অমূঃ। রুচে জনন্ত সূর্য৷৷ ৬৷৷ অর্ষা সোম দুমত্তমোহভি দ্রোণাণি রোরুবৎ। সীদ যোনৌ বনে। ৭৷৷ বৃষা সোম দুম অসি বৃষা দেব বৃষব্রতঃ। বৃষা ধর্মাণি দখ্রিষে৷৷ ৮। ইষে পবস্ব ধারয়া মৃজ্যমানো মনীষিভিঃ। ইন্দো রুচাভি গাইহি৷৷ ৯ মন্দ্রয়া সসাম ধারয়া বৃষা পবস্ব দেবেয়ুঃ। অব্যা বারেভিস্ময়ুঃ। ১০। অয়া সোম সুকৃত্যয়া মহাৎসন্নভ্যবধথা। .. মন্দান ইদ বৃষায়সে৷ ১১। অয়ং বিচৰ্ষণিৰ্হিতঃ পবমানঃ স চেততি। হিব্বান আপ্যং বৃহৎ৷৷ ১২ প্র ন ইন্দো মহে তুন ঊর্মি ন বিভ্রদসি। অভি দেবাঁ অয়াস্যঃ ৷৷ ১৩৷৷ অপঘ্ন পবতে মৃধোপ সোমো অরাণঃ। গচ্ছন্নিস্য নিষ্কৃত৷৷ ১৪৷৷
মন্ত্ৰাৰ্থ— ১। সর্বাভীষ্টপূরক পাপহারক মহত্ত্ব ইত্যাদিসম্পন্ন ও সকলের বরণীয়, সখির ন্যায় পরমপ্রিয় এবং সকলের প্রীতিকর শুদ্ধসত্ত্ব সকলের জ্ঞান-উন্মেষণ করে। সেই শুদ্ধসত্ত্ব পরমজ্যোতিঃর সাথে অন্তরকে সম্যকরূপে উদ্ভাসিত করে। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রকাশক ও প্রার্থনামূলক। মন্ত্র শুদ্ধসত্ত্বের শক্তি প্রকটন করছেন। শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে লোকসকল জ্ঞানের জ্যোতিঃ লাভ করে। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে পরাজ্ঞান লাভ করি)। অথবা–জ্ঞানদায়ক, অভীষ্টবর্ষক, পাপহারক পূজ্য মিত্রতুল্য সর্বজ্ঞ ভগবান্ জ্ঞানকিরণের সাথে আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন ভগবানকে প্রাপ্ত হই)। [প্রথম অন্বয়ে অচিক্রদৎ অর্থে সকলের জ্ঞান-উন্মেষণ করে এমন ভাব গৃহীত। দ্বিতীয় অন্বয়ে ঐ পদে জ্ঞানপ্রকাশক বা। জ্ঞানদায়ক ভাব নেওয়া হয়েছে। তেমনি প্রথম অন্বয়ে বৃষা পদে অভীষ্টবর্ষক বা সর্বাভীষ্টপূরক অর্থ গৃহীত এবং দ্বিতীয় অন্বয়েও ঐ একই ভাব গৃহীত। এই মন্ত্রের মিত্রঃ ন পদদুটি বিশেষ অনুধাবনযোগ্য। ভগবান্ মানুষের মিত্রতুল। বন্ধু যেমন বন্ধুকে সাহায্য করে, বিপথে চললে যেমন তাকে হাত ধরে সুপথে আনে, ভগবানও তেমনি মানুষকে তার জ্ঞানের আলোক প্রদান করে প্রকৃত গন্তব্যপথে (মুক্তির পথে, মোক্ষের পথে) পরিচালিত করেন]। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানের নাম বার্ষাহরম]।
২। হে দেব! আপনার সম্বন্ধি সুখকর সর্বলোকস্পৃহণীয় রিপুনাশক ও পরমধনপ্রাপক প্রজ্ঞানশক্তি আমরা নিত্যকাল বিশেষভাবে প্রার্থনা করি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, হে ভগবন! আমাদের পরাজ্ঞান এবং আত্মশক্তি প্রদান করুন)। [সিদ্ধিলাভের মূল কারণ–শক্তি। প্রজ্ঞানশক্তি ও ভাবশক্তির সাহায্যে মানুষ নিজের অভীষ্ট সম্পাদন করতে পারে। সেই শক্তিলাভের জন্যই ভগবানের চরণে প্রার্থনা জানানো হয়েদ্বে]। [এর গেয়গানের নাম–বার্ষাণি ত্ৰীণি]।
৩। সৎকর্মে নিয়োজিত হে আমার মন! তুমি কঠোর কৃচ্ছসাধনের দ্বারা পবিত্ৰীকৃত শুদ্ধসত্ত্বকে হৃদয়রূপ যজ্ঞাগারে প্রতিষ্ঠিত করো; তারপর সেই শুদ্ধসত্ত্বকে পরমৈশ্বর্যশালী ভগবানের গ্রহণের জন্য পবিত্র (অর্থাৎ উৎকর্ষ সাধন) করো। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধনমূলক। এখানে সত্ত্বভাবের প্রভাবে ভগবানকে প্রাপ্তির জন্য যাজ্ঞিক আত্মাকে উদ্বোধিত করছেন। মন্ত্রের ভাব এই যে, সভাবের প্রভাবে সৎকর্মের দ্বারা আমরা যেন ভগবানকে প্রাপ্ত হই)। অথবাসৎকর্ম-সাধন-সমর্থ হে আমার মন! কঠোর সত্যৰ্ম-সাধনের দ্বারা হৃদয় পবিত্র করে বিশুদ্ধ সত্ত্বভাব প্রাপ্ত হও; বলৈশ্বর্যাধিপতি দেবের গ্রহণের জন্য সত্ত্বভাবকে পবিত্র করো। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধনমূলক; ভাব এই যে, –শুদ্ধসত্ত্বলাভের জন্য আমরা যেন কঠোর তপোপরায়ণ হই)। [মনই কর্মের নিয়ামক। মন ইন্দ্রিয়সমূহের রাজা। আমরা ইন্দ্রিয়সমূহের দ্বারা সমস্ত কার্য নির্বাহ করি বটে; কিন্তু ইন্দ্রিয়কে নিয়ন্ত্রিত করে–মন। তাই দুরকম: অন্বয়ে অধ্বর্যো পদে সৎকর্মসাধনসমর্থ হে আমার মন! অর্থ গৃহীত হয়েছে। কারণ মনই সৎকর্মের বা অসৎকর্মের সম্পাদক। মোক্ষপথে অগ্রসর হতে হলে, সৎকর্মসাধন প্রয়োজন। কঠোর তপস্যাপরায়ণ হওয়া ভিন্ন গত্যন্তর নেই। তার দ্বারা হৃদয় পবিত্র হলে, মানুষ সত্ত্বভাব লাভ করতে সমর্থ হয় এবং পরিণামে মুক্তিলাভ করে। তাই জীবনের সেই চরম লক্ষ্যে পৌঁছাবার জন্য সাধক নিজের মনকে সৎকর্মপরায়ণ করতে চেষ্টিত হচ্ছেন]। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানের নাম–বৈরূপে দ্বে]।
৪। বিশুদ্ধ সত্ত্বভাবের পরমানন্দদায়ক সেই প্রবাহ স্তোতৃদের পাপ হতে ত্রাণ করে তাদের হৃদয়ে প্রবাহিত হয়; সেই সত্ত্বপ্রবাহ স্তোতৃদের পাপ হতে ত্রাণ করে তাদের হৃদয়ে প্রবাহিত হয়। (মন্ত্রটি, নিত্যসত্য প্রকাশক। আদরার্থে পুনরুক্তি; ভাব এই যে, সত্ত্বভাব স্তোতৃদের পাপনাশক হয়)। [সত্ত্বভাবের পাপনাশিনী-শক্তি এই মন্ত্রে বিশেষভাবে প্রকটিত হয়েছে। তরৎস মন্দী ধাবতি-মন্ত্রে দুবার উক্ত হয়েছে। এটা নিশ্চয়জ্ঞাপক। সত্ত্বপ্রবাহ দেবতাদেরও আনন্দদায়ক, মানুষের তো কথাই নেই। মানুষের হৃদয়ে সত্ত্বভাব সঞ্চার হলে দেবতার–দেবভাবের আবির্ভাব হয়, সুতরাং পাপ দূরে পলায়ন করে]। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানের নাম-তরন্তঃ]।
৫। হে শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি প্রভূতপরিমাণে আত্মশক্তিদায়ক পরমধন আমাদের প্রদান কর; অপিচ, আমাদের শ্রেয়স্কর বল প্রদান কর। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমাদের হৃদয়ে বিশুদ্ধ পরম মঙ্গলকর সত্ত্বভাব (মাদকরস সোম নয়) আবির্ভূত হোক)। [সত্ত্বভাব লাভ হলে মানুষ নিজের স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারে, সে যে জাগতিক মোহমায়ার অতীত পরম চৈতন্য-সত্তা তা, বুঝতে পারে। সুতরাং তার নিজের অসীম শক্তিরও সন্ধান পায়, মেষের বৃত্তিধারী সিংহ আপন পরিচয় জানতে পারে। তখন সে মোহনিদ্রা থেকে জাগরিত হয়ে আপন স্বকার্য-সাধনে তৎপর হয়। স্বরূপতঃ মানুষের যে অসীম শক্তি, তাই তিনি লাভ করেন]। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানের নাম—সোমসাম]।
৬। সনাতন ঊর্ধ্বগতিদায়ক দেবভাবসমূহ লোকদের নূতন জীবন প্রদান করেন; এবং দিব্যজ্যোতিঃ প্রদানের জন্য জ্ঞানের আলোক সৃজন করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক। ভাব এই যে, ভগবান্ লোকসমূহকে নবজীবন প্রদান করবার জন্য তাদের হৃদয়ে জ্ঞান প্রদান করেন)। [ভাষ্যকার এই মন্ত্রের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিখেছেন যে, এখানে রূপকের সাহায্যে সোমরসের স্তুতি করা হয়েছে। কিন্তু সেই রূপকমূলক ব্যাখ্যাও পরিষ্কার হয়নি। একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ–কোন পুরাণ অশ্ব নূতন পদ অনুসরণ করে, সূর্যকে দীপ্ত করে। বলা বাহুল্য ঐ ব্যাখ্যা ভাষ্যের চেয়েও দুর্বোধ্য। –এখানে প্রকৃতপক্ষে বলা হয়েছে হৃদয়ে দেবভাবের সঞ্চার হলে মানুষ নবজীবন লাভ করে–মানুষ দেবতা হয়। নবীয়ঃ পন্থা পদ দুটিতে এই নবজীবনকেই লক্ষ্য করেছে। অজ্ঞান মানুষকে দিব্যজ্যোতিঃ প্রদান করে তাদের মোক্ষপথে চালিত করবার জন্যই ভগবান্ তাদের হৃদয়ে জ্ঞানের আলোক সৃষ্টি করেন। রুচে অনন্ত সূর্যংবাক্যাংশে এই সত্যই বিস্তৃত হয়েছে। সূর্য পদে জ্ঞানং জ্ঞানালোকং প্রভৃতি অর্থ গ্রহণ করাই সঙ্গত। যার দ্বারা বিশ্বের অজ্ঞানতাতমস দূরীভূত হয়, যার দ্বারা মানুষ প্রকৃত স্বরূপ জানতে পারে, সেই পরমবস্তু জ্ঞানকেই সূর্যং পদে লক্ষ্য করে]। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানের নাম–সোমসাম]।
. ৭। হে শুদ্ধসত্ত্ব! জ্যোতিঃসম্পন্ন, তুমি পরাজ্ঞান প্রদান করবার জন্য আমাদের হৃদয়ে আগমন করো; স্ব-স্বরূপে আমাদের স্থাপন করো। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন সত্ত্বভাব লাভ করে মোক্ষপ্রাপ্ত হই)। [এই পর্বের এই অধ্যায়ের এই খণ্ডের ১ম সাম-মন্ত্রে অচিক্রদৎ পদ সম্পর্কে যা ব্যক্ত হয়েছে, এখানে রোরুবৎ পদ সম্পর্কে তা-ই প্রযোজ্য। বন শব্দে জ্যোতিঃ অর্থাৎ বনে যোনৌ পদ দুটিতে জ্যোতিঃর পরম উৎপত্তি স্থান বা ভগবৎ-চরণকে লক্ষ্য করা হয়েছে। সেই স্থানে পৌঁছালে মানুষ স্ব-স্বরূপে অবস্থিত হয়। তাই ঐ পদ দুটিতে স্ব-স্বরূপেঅর্থই। সঙ্গত হয়েছে। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানের নাম–দাঢ়ে চ্যুতানি ত্ৰীণি]।
৮। হে শুদ্ধসত্ত্ব! দীপ্তিমান্ আপনি লোকদের অভীষ্টবর্ষক করেন; হে ভগবন! অভীষ্টপূরণশীল আপনি আমার প্রতি অভীষ্টবর্ষক হোন; কামনাপূরক আপনি সকলের মঙ্গল ধারণ করেন অর্থাৎ আপনিই সর্বমঙ্গলের নিদান। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক এবং প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, হে ভগবন! কৃপা করে আমাদের পরম-অভীষ্ট পূর্ণ করুন)। [এই মন্ত্রের প্রথম দুভাগে জীবনের পরম অভীষ্ট পূরণের অর্থাৎ মোক্ষলাভের জন্য প্রার্থনা রয়েছে। শেষ অংশে ভগবানের মঙ্গল স্বরূপ প্রখ্যাপিত হয়েছে। তিনি কল্পতরুঅভীষ্টবর্ষক। মানুষের যা কল্যাণকর, পরম আকাঙ্ক্ষার বস্তু, মোক্ষ, তা ভগবানের কৃপাতেই লাভ হয়ে থাকে]। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানের নাম—বৃষকম]।
৯। হে শুদ্ধসত্ত্ব! সাধকগণের সৎকর্মের দ্বারা বিশুদ্ধ তুমি আমাদের শক্তিদান করবার জন্য ধারারূপে আমাদের হৃদয়ে উপজিত হও; এবং জ্যোতিঃর সাথে জ্ঞানকিরণসমূহ আমাদের প্রাপ্ত করাও। (প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন জ্ঞানসমন্বিত সত্ত্বভাব প্রাপ্ত হই)। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানের নাম–ঐষম্]।
১০। হে শুদ্ধসত্ত্ব! অভীষ্টবর্ষক দেবত্বপ্রাপক তুমি আনন্দদায়ক অমৃতধারারূপে আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হও। আমাদের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী তুমি রিপু-নিবারক অস্ত্রের–জ্ঞানের দ্বারা আমাদের রক্ষা করো। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন পরমানন্দদায়ক সত্ত্বভাব লাভ করি, এবং রিপুজয়ী হই)। [মানুষের মধ্যে ভগবৎ-প্রদত্ত দেবভাবগুলি বীজ-অবস্থায় থাকে। উপযুক্ত সাধন প্রভাবে তা ফলফুলসমন্বিত সুশোভন শান্তিদায়ক বৃক্ষে পরিণতি লাভ করে। মানুষ ভগবানের কাছ থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন নয়, মানুষ ও ভগবানের মধ্যে মিলন-সূত্র–সত্ত্বভাব। তাই মন্ত্রের সত্ত্বভাবকে দেবয়ুঃ ও অস্ময়ুঃ বলা হয়েছে)। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানের নাম–শ্যাবাশ্বম্]।
১১। হে শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি আমাদের সৎকর্মসাধনের দ্বারা আমাদের হৃদয়ে বর্ধিত হও; আমাদের আনন্দদায়ক হয়ে আকাঙক্ষণীয় তুমি আমাদের পরাজ্ঞান প্রদান করো। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন সত্ত্বভাবের সাথে পরাজ্ঞান লাভ করতে পারি)। [শুদ্ধসত্ত্ব ও পরাজ্ঞানের একত্র মিলনই পরমানন্দ লাভের–অমৃত লাভের উপায়। আর এই অমৃতের সন্ধানেই মানুষ ব্যাকুল হয়ে বেড়ায়। সত্ত্বভাব আনন্দ দান করে, সেই আনন্দ নিত্য ও শাশ্বত, তা-ই মানব-জীবনের একমাত্র কাম্য বস্তু। মন্ত্রের মধ্যে সেই অমৃতলাভের জন্যই প্রার্থনা ধ্বনিত হয়েদ্বে]। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানের নাম—অয়ামোমীয়ম্]।
১২। পবিত্রকারক আত্ম-উৎকর্ষ-বিধায়ক আমাদের হৃদয়স্থিত সত্ত্বভাব আমাদের জ্ঞান প্রদান করে; সেই সত্ত্বভাব অমৃতজাত মহৎ ধন আমাদের প্রদান করুক। (ভাব এই যে, –সত্ত্বভাব আত্ম-উৎকর্ষ সাধক এবং জ্ঞানদায়ক; তার দ্বারা আমরা যেন পরমধন লাভ করি)। [সত্ত্বভাবের বিশেষণ বিচৰ্ষণিঃ পদের আত্ম-উৎকর্ষ-বিধায়ক অর্থই সঙ্গত। বাস্তবিক পক্ষে সত্ত্বভাবের নিজের উৎকর্ষসাধন বললে কোন অর্থ সঙ্গতি থাকে না। যাঁরা প্রার্থনা করেন তারা আত্মার উৎকর্ষের জন্যই প্রার্থনা করেন। সত্ত্বভাব সেই উৎকর্ষ প্রদান করতে সমর্থ। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানের নাম-আগ্নেয়ম]।
১৩। হে শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি মহৎ ধন প্রদান করবার জন্য আমাদের প্রাপ্ত হও; ঊর্ধ্বগমনশীল সাধকের ন্যায় তোমার প্রবাহ অর্থাৎ সত্ত্বপ্রবাহ ধারণ করে আমরা যেন ভগবানের উদ্দেশে গমন করতে পারি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, –সত্ত্বভাব লাভ করে আমরা যেন ভগবানকে প্রাপ্ত হই)। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানের নাম–আয়াস্যম, আয়াস্যমুত্তরম]।
১৪। হিংস্ৰকশত্রুদের বিনাশ করে, এবং লোভ-মোহ ইত্যাদি অপসরণ করে সত্ত্বভাবু সাধকদের হৃদয়ে উপজিত হয়; সত্ত্বভাবপ্রাপ্ত সেই ব্যক্তি ভগবানের সান্নিধ্য প্রাপ্ত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য প্রখ্যাপক। ভাব এই যে, সত্ত্বভাব লাভের দ্বারা মানুষ রিপুজয়ী হয় এবং ভগবৎ-পদ প্রাপ্ত হয়)। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানের নাম—ভারদ্বাজম]।
.
পঞ্চমী দশতি
ছন্দ আর্চিক। কৌথুমী শাখা। পবমান পর্ব। পঞ্চম অধ্যায়।
দেবতা পবমান সোম৷৷
ছন্দ বৃহতী।
ঋষি : এই দশতির মন্ত্রগুলির সপ্তঋষিগণ যথাক্রমে ভরদ্বাজ বার্হস্পত্য, কশ্যপ মারীচ, গোতম রাহুগণ, অত্রিভৌম, বিশ্বামিত্র গাথিন, জমদগ্নিভাৰ্গর, বসিষ্ঠ মৈত্রাবরুণি৷৷
পুনানঃ সোম ধারয়াপো বসানো অসি। আ রত্নধা যোনিমৃতস্য সীদস্যুৎসসা দেবো হিরণ্যয়ঃ ৷৷ ১। পরীত যিঞ্চতা সুতং সোমো য উত্তমং হবিঃ। দধাঁ যো নৰ্যো অস্বন্তরা সুষাব সোমমদ্রিভিঃ। ২৷৷ আ সোম স্বাননা অদ্রিভিস্তিররা বারাণ্যব্যয়া। জনো ন পুরি চম্বোর্বিশদ্ধরিঃ সদো বনেষু খ্রিষে৷৷ ৩৷৷ প্ৰ, সোম দেববীতয়ে সিন্ধুর্ন পিপ্যে অর্ণসা। অংশেঃ পয়সা মদিনো ন জাগৃবিরচ্ছা কোশং মধুশ্রুত৷৷ ৪৷৷ সোম ঊষাণঃ সোতৃভিরধি ফুভিরবীনা। অশ্বয়েব হরিতা যাতি ধারয়া মন্দ্রয়া যাতি ধারয়া৷৷ ৫৷৷ তবাহং সোম রারণ সখ্য ইন্দো দিবেদিবে। পুরুণি বল্লো নি চরন্তি মামব পরিধী রতি তা ইহি মৃজ্যমানঃ সুহত্যা সমুদ্রে বাচমিসি। রয়িং পিশঙ্গং বহুলং পুরুস্পৃহং পবমানাভ্যর্ষসি৷৷ ৭ অভি সোমাস আয়বঃ পবন্তে মদ্যং মদ। সমুদ্রস্যাধি বিষ্টপে মনীষিণো মৎসরাসসা মদ্যুতঃ। ৮৷৷ পুনানঃ সোম জাগৃবিরব্য বারৈঃ পরিপ্রিয়। ত্বং বিপ্রো অভরোহঙ্গিরস্তম মধ্ব যজ্ঞং মিমি ণঃ৷৷ ৯৷৷ ইন্দ্রায় পবতে মদঃ সোমো মরুত্বতে সুতঃ। সহস্রধাররা অত্যব্যমৰ্ষতি তমীং মৃত্যায়বঃ৷৷ ১০৷৷ পবস্ব বাজসাতমোহভি বিশ্বানি বার্যা। ত্বং সমুদ্রঃ প্রথমে বিধর্মন্ দেবেভ্যঃ সোম মৎসরঃ৷৷ ১১৷৷ পবমানা অসৃক্ষত পবিত্ৰমতি ধারয়া। মরুত্বান্তো মৎসরা ইন্দ্রিয়া হয়া মেধামভিপ্রয়াংসি চ৷৷ ১২
মন্ত্ৰার্থ— ১। হে শুদ্ধসত্ত্ব! পবিত্রকারক তুমি অমৃত প্রদান করবার জন্য ধারারূপে আমাদের প্রাপ্ত হও; জ্যোতির্ময় লোকের পরম হিতসাধক, শ্রেষ্ঠধনের উৎসস্বরূপ, পরমধনদাতা, সত্ত্বস্বরূপ তুমি আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হও। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, –সত্যস্বরূপ পরমধনদাতা সত্ত্বভাবকে আমরা যেন প্রাপ্ত হই)। [প্রচলিত ব্যাখ্যানুসারে একটি বঙ্গানুবাদ–হে সোম (মাদকরস)! তুমি শোধিত হতে হতে জলের সাথে মিশ্রিত হয়ে ধারার আকারে যাচ্ছ। হে দেব! তুমি সুবর্ণের আকরস্বরূপ, তুমি উত্তম উত্তম বস্তু দেবে বলে যজ্ঞস্থানে উপবেশন করছ। সোমকে। মাদকরসরূপে কল্পনা করে তার কত স্তুতি! আমাদের প্রাচীন ঋষিবর্গকে ধেনোপানকারী বলে অঙ্কিত করার কতই প্রয়াস। সোম অর্থে শুদ্ধসত্ত্বভাব–এমন ধারণাই সঙ্গত। ঋতস্য যোনিং– সৎকর্মসমূহের উৎপত্তিস্থল বা সত্যস্বরূপ। [এই সামমন্ত্রের ষোলটি গেয়গান আছে। সেগুলির নাম–আয়স্যম, মাণ্ডবম দ্বে, আপদাসম সোমসাম, ঐড়মায়াস্যিমি, উদ্বৎ প্রাজপত্যম, এীণিধনমায়াস্যম, কণ্বরথন্তরম, তিবশ্চীনিধনমায়াস্যম, সদোবিশীয়ম, স্ববাসিনী দ্বে, প্লব, রৌরবম্, যৌধাজয়ম]।
২। হে আমার মন! যে সত্ত্বভাব শ্রেষ্ঠ দেবপূজার উপকরণ, সেই বিশুদ্ধ সত্ত্বভাবকে হৃদয়ে উৎপাদন করো; কঠোর তপঃ-সাধনের দ্বারা বিশুদ্ধ, অমৃতপ্রাপক, মানুষের হিতসাধক যে সত্ত্বভাব, সেই সত্ত্বভাবকে প্রাপ্ত হও। (প্রার্থনার ভাব এই যে, সৎকর্ম সাধনের দ্বারা, লোকের হিতসাধক বিশুদ্ধ সত্ত্বভাব আমরা যেন লাভ করতে পারি)। [সায়ণাচার্যের ভাষ্যে এই মন্ত্রটি ঋত্বিকদের উদ্দেশে উচ্চারিত বলা হয়েছে। সেখানে সোম অর্থে মাদকরস বোঝানো হয়েছে। কিন্তু উত্তমং হবিঃ অর্থাৎ দেবপূজার শ্রেষ্ঠ উপকরণ-কে মাদকরস মনে করা কেমন যুক্তিযুক্ত বোঝা দুষ্কর; বরং ভক্তহৃদয়ের সত্ত্বভাবকেই দেবপূজার শ্রেষ্ঠ উপকরণ মনে করাই সঙ্গত; অর্থাৎ সোম–শুদ্ধসত্ত্ব। হৃদয়ের বিশুদ্ধ (সুতং) ভাব দিয়েই ভগ্নবানের প্রকৃত পূজা হতে পারে]। [এই সামমন্ত্রের পনেরটি গেয়গান আছে। সেগুলির নাম–অছিদ্রম, রয়িষ্টম, ভারদ্বাজে দ্বে, আভীশবম, উত্তরমাভিশবম্, মাত্তবম, মাত্তবমুত্তরম, অভীবাসঃ সাম, পরিবাসাঃ সাম, বৈণবম, সৌমক্রতবীয়ম, গর্দা, প্রতোদঃ, মহাযৌধাজয়ম]।
৩। হে শুদ্ধসত্ত্ব! কঠোর সৎকর্মের দ্বারা বিশুদ্ধ, অমৃতযুক্ত, অবিনাশী তুমি আমাদের হৃদয়কে প্রাপ্ত হও; লোক যেমন নগরে প্রবেশ করে, তেমনি দ্যুলোক ও ভূলোকে স্থিত পাপের হারক তুমি, জ্ঞানের দ্বারা আলোকিত করে আমাদের হৃদয়ে প্রবেশ করো। (প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন জ্ঞান সমন্বিত পাপনাশক সত্ত্বভাবকে লাভ করি)। [এই পর্বের ৪র্থ খণ্ডের ৩য় সামের মতো এখানেও অদ্রিভিঃ পদে কঠোরকৃচ্ছসাধনৈঃ বা কঠোরসৎকর্মসাধনৈ অর্থ গৃহীত হয়েছে। অব্যয়া পদের আভিধানিক অর্থ তো নিত্য, অবিনাশী বটেই। সত্ত্বভাব চিরবিদ্যমান, অক্ষয়, অব্যয়। ভগবৎ-শক্তির বিনাশ নেই। ধ্বংস নেই। নিরুক্তসম্মতভাবেই তীর্ণং কুরু অর্থে অভিভূত করো অর্থাৎ আমাদের হৃদয়ে প্রবিষ্ট হয়ে হৃদয়কে পরিপ্লুত করো–এই অর্থ গ্রহণ করা হয়েছে। এই পর্বের ৩য় খণ্ডের ৪র্থ সামের মতো এখানেও চম্বো পদে সর্বত্র বিদ্যমানঃ অর্থ গৃহীত হয়েদ্বে]। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানের নাম–আশম, সোমসাম]।
৪। হে শুদ্ধসত্ত্ব! সমুদ্র যেমন জলের দ্বারা সমস্ত পূর্ণ করে, তেমনই তুমি ভগবানের আরাধনার জন্য অমৃতের দ্বারা আমাদের পূর্ণ করো; চৈতন্যস্বরূপ পরমানন্দদায়ক তুমি নিত্যকাল জ্ঞান-অমৃতের সাথে অমৃতধারণে সমর্থ আমাদের হৃদয়কে প্রাপ্ত হও। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমাদের হৃদয় সত্ত্বভাবে পূর্ণ হোক)। [এই পদে সোম শব্দের বিশেষণরূপে ব্যবহৃত কয়েকটি পদের প্রতি এবং সেগুলির প্রচলিত ব্যাখ্যার প্রতি লক্ষ্য করলেই সোম শব্দে কি বস্তু নির্দেশ করে, তার সুন্দর মীমাংসা পাওয়া যাবে। সোম পদের বিশেষণ জাগৃবিঃ। তার ভাবার্থ–জাগরণশীল অর্থাৎ সর্বদা সচেতন থাকাই যার স্বভাব মদিরা (সোম)যা মোহকারক অচেতনকারী, তা কেমন করে জাগরণশীল হতে পারে? এ থেকেই বোঝা যায়, ভাষ্যকার এবং প্রচলিত ব্যাখ্যাকারগণ সোমের সত্যস্বরূপ ধরতে পারেননি। তারা এক সঙ্গেই সোমকে মত্ততা-উৎপাদক ও জাগরণশীলদুই বিশেষণেই বিশেষিত করেছেন। এতে অসঙ্গতি দোষ অবশ্যই প্রকটিত হয়েছে। এখানেও জাগৃবিঃ পদে জাগরণশীলঅর্থই– গৃহীত হয়েছে আর সত্ত্বভাব সম্বন্ধে এই বিশেষণ সম্পূর্ণ উপযোগী। সোম নামক মদিরা নয়, সত্ত্বভাবই মানুষের মনে অনন্ত চৈতন্যের জাগরণ এনে দেয়, মানুষ পরম চৈতন্য সত্ত্বার সন্ধান পায়। তাই বেদে। উল্লিখিত সোমঅবশ্যই সত্ত্বভাব এবং সত্ত্বভাবই চিরজাগরণশীল। সিন্ধু ন উপমার দ্বারাও সত্ত্বভাবের বিশেষত্ব প্রখ্যাপিত হয়েছে। অসীম অনন্ত সমুদ্র স্বরূপ এই সত্ত্বভাব বিশ্ব ব্যেপে আছে। এর আদি নেই, ( অন্ত নেই। সত্ত্বভাবের উৎপত্তি নেই, বিলয় নেই কারণ তা ভগবানেরই শক্তি। এই সত্ত্বভাবামৃত লাভের জন্যই মন্ত্রে প্রার্থনা পরিদৃষ্ট হয়]। [এই সামমন্ত্রের পাঁচটি গেয়গানের নাম–ত্রীণিধনমাগ্নেয়ম, অগ্নের্বৈশ্বানরস্যম সাম, দিহিঙ্কারংবামদেব্যম্, উৎসেধঃ, নিষেধঃ]।
৫। পূজাপরায়ণ ব্যক্তিগণ কর্তৃক জ্ঞানপ্রবাহের দ্বারা বিশুদ্ধ হয়ে সত্ত্বভাব নিশ্চিতই তাদের প্রাপ্ত হন; ব্যাপকজ্ঞান যেমন সাধককে প্রাপ্ত হয়, তেমনই সত্ত্বভাব পাপহারক প্রবাহরূপে সাধককে প্রাপ্ত হন; তিনি আনন্দদায়ক ধারারূপে সাধককে প্রাপ্ত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক। ভাব এই যে, পূজাপরায়ণ ব্যক্তিগণ জ্ঞানসমন্বিত সত্ত্বভাব লাভ করেন)। [এখানে অসঙ্গতিপূর্ণ প্রচলিত ব্যাখ্যাকে পরিহার করে সোতৃভিঃ পদে পূজাপরায়ণৈঃ জনৈঃ, অবীনাং মুভিঃ পদে জ্ঞানস্য প্রবাহৈঃ– এমন অর্থ গৃহীত হয়েছে। উ অব্যয় এখানে নিশ্চয়ার্থক। ঐ অর্থেই এখানে সঙ্গতি লক্ষ্য করা যায়]। [এই সামমন্ত্রের ঋষির নাম—অত্রিভৌম। এর গেয়গানের নাম—সোমসামানিষট]।
৬। হে শুদ্ধসত্ত্ব। প্রার্থনাকারী আমি তোমার সখিত্ব নিত্যকাল যেন প্রার্থনা করি; হে আশ্রিতপালক সত্ত্বভাব! রিপুগণ আমাকে কষ্ট দিচ্ছে, তুমি সেই শত্রুদের বিনাশ করো। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, ভগবান্ কৃপা করে আমাদের সত্ত্বভাব প্রদান করুন, আমরাও রিপুজয়ী হতে পারি)। [অনাদিকাল থেকে মানুষের অন্তরে বাহিরে অসুরকুলের, মানুষের ভীষণ শত্রুর তাণ্ডব চলেছে। তার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে–সহায়হীন দুর্বল মানুষ। জগতের কোথাও কেউ নেই যে, তাকে এই ভীষণ দৈত্যদের হাত থেকে উদ্ধার করবে। তাই মানুষ জগতের একমাত্র আশ্রয়, সর্বশক্তিমান্ ভগবানের চরণে নিজের দুর্বলতার কথা নিবেদন করে করুণা ভিক্ষা করে]। [এই সামমন্ত্রের পাঁচটি গেয়গানের নাম–বৈষ্ণবম, দ্বিতীয়ং বৈষ্ণবম, আঙ্গিরসানি ত্ৰীণি]।
৭। হে পরমদাতা! পবিত্রতাস্বরূপ আপনি ইহজগতে অথবা সমুদ্রের ন্যায় বিশাল হৃদয়-প্রদেশে জ্ঞান প্রদান করেন; হে পবিত্রকারক দেব! আপনি প্রার্থনাকারী আমাদের প্রভূতপরিমাণ সর্বলোক প্রার্থনীয় পরমধন প্রদান করুন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রকাশক ও প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! কৃপাপূর্বক আমাদের পরাজ্ঞানরূপ পরমধন প্রদান করুন)। [এখানে সমুদ্র পদে নিরুক্ত সম্মত ইহজগতি অর্থ গৃহীত হয়েছে। [এই সামমন্ত্রের গেয়গান আটটি। সেগুলির নাম স্বারমৌক্ষ্ণেরন্ধ্রম, ঔক্ষ্ণোরন্ধ্রম, আগ্নেয়ানি ত্রীণি, ঐড়মৌক্ষ্ণোরন্ধ্রম, বাজজিৎ]।
৮। আশুমুক্তিদায়ক প্রজ্ঞানস্বরূপ, আনন্দজনক, পরমানন্দ-প্রদায়ক সত্ত্বভাব পৃথিবীর উপরে অর্থাৎ হৃদয়ের পরম পবিত্র প্রদেশে আনন্দজনক অমৃতের স্রোত প্রবাহিত করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য প্রখ্যাপন করছে। ভাব এই যে, সত্ত্বভাবের দ্বারা মানুষ অমৃত লাভ করে)। [তথাপি মন্ত্রে প্রচ্ছন্নভাবে প্রার্থনার ভাবও বিদ্যমান রয়েছে। ভগবানের বিভূতিস্বরূপ শুদ্ধসত্ত্ব হৃদয়ে উপজিত হয়ে আমাদের পরমানন্দ দান করে–সেই চিদঘন চিদানন্দময় ভগবানকে প্রাপ্ত করিয়ে–সর্বার্থসিদ্ধি বা অমৃতত্বের অধিকারী করুক-মন্ত্রে এই প্রার্থনার ভাবও বিদ্যমান]। [এই সামমন্ত্রের আটটি গেয়গানের নাম–বৈশ্যদেবে দ্বে, ইন্দ্ৰসামনো দ্বে, স্বঃ পৃষ্টম, ইন্দ্ৰসামানি ত্ৰীণি]।
৯। হে শুদ্ধসত্ত্ব! সর্বলোকপ্রিয় চিরজাগরণশীল (অর্থাৎ চৈতন্যস্বরূপ) পবিত্রতাস্বরূপ আপনি জ্ঞানামৃতের সাথে আমাদের হৃদয়ে উপজিত হোন; হে শ্রেষ্ঠ জ্ঞানাধার! সর্বজ্ঞ আপনি সর্বভূতে
বর্তমান রয়েছেন; আপনি আমাদের সৎকর্ম আপনার সম্বন্ধি অমৃতের দ্বারা অভিষিক্ত করুন। (মন্ত্রটি এ প্রার্থনামূলক ও নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক। ভাব এই যে, আমরা যেন জ্ঞান-সমন্বিত হয়ে সত্ত্বভাব লাভ করি; আমাদের সকল রকম কর্ম অমৃত-লাভের জন্য নিয়োজিত হোক)। [সত্ত্বভাব-ভগবানের বিভূতি, ভগবৎশক্তি। সুতরাং এটি নিত্যকাল বর্তমান। আদিতে ছিল, বর্তমানে আছে, এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। শুদ্ধসত্ত্বই সত্য। সত্য চিরকালই সত্য। মিথ্যা কখনও সত্যকে চির-আবৃত করে রাখতে পারে না। সত্য অক্ষয় অব্যয়–ভগবানেরই স্বরূপ]। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানের নাম–সোমসাম]।
১০। প্রজ্ঞানস্বরূপ ভগবানের প্রীতির নিমিত্ত পরমানন্দদায়ক পবিত্ৰীকৃত শুদ্ধসত্ত্ব আমাদের হৃদয়ে সমুদ্ভূত হোক; তারপর সেই শুদ্ধসত্ত্ব পরমমঙ্গলপ্রদ হয়ে জ্ঞানপ্রদীপ্ত আধারভূত হৃদয়কে প্রাপ্ত হোক; আরও, আয়ুকাময়মান অর্থাৎ সৎকর্মময় চিরজীবন অভিলাষী সাধকগণ সেই শুদ্ধসত্ত্বকে আত্মশোধনের নিমিত্ত সর্বদা হৃদয়ে ধারণ করেন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক ও আত্ম-উদ্বোধক। শুদ্ধসত্ত্বই পরমানন্দদায়ক এবং ভগবৎ-প্রাপ্তিমূলক। শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবেই ভগবানকে পাওয়া যায়। অতএব ভগবানের প্রতিকামী ব্যক্তির শুদ্ধসত্ত্ব সঞ্চয় করা কর্তব্য। প্রার্থনার ভাব এই যে, –ভগবানে সম্মিলিত হবার জন্য আমরা যেন শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করি)। অথবা-বলৈশ্বর্যাধিপতি দেবতাকে এবং বিবেকজ্ঞান লাভের জন্য, আনন্দদায়ক বিশুদ্ধ সত্ত্বভাব আমাদের হৃদয়ে উপজিত হোক; জ্ঞানযুক্ত সেই সত্ত্বভাবকে নিশ্চিতই উধ্বগমনশীল সাধকগণ তাদের হৃদয়শুদ্ধির জন্য লাভ করেন; বহুকল্যাণপ্রদ সেই সত্ত্বভাব আমাদের প্রাপ্ত হোক। (ভাব এই যে, –সাধুগণের দ্বারা সেবিত বহু কল্যাণপ্রদ সত্ত্বভাব আমরা যেন লাভ করতে পারি)। [সত্ত্বভাব লাভ করলে হৃদয় ভগবৎ-অভিমুখী হয়–মানুষ বিবেকজ্ঞান লাভ করে। হৃদয় থেকে হীন কামনা-বাসনা দূরীভূত হয়, তখন মানুষের মনে যে সব আকাঙ্ক্ষা জাগরিত হয় তা ঈশ্বরের বিশ্বমঙ্গলনীতির অনুগামী হয়ে থাকে। সুতরাং সেই আকাঙ্ক্ষা অনায়াসেই পূর্ণ হয়;কামনার অপূর্ণতার জন্য নৈরাশ্যজনিত দুঃখ পেতে হয় না। সুতরাং হৃদয় পরমানন্দে পূর্ণ হয়। তাই সত্ত্বভাবকে আনন্দদায়ক বলা হয়েছে। হৃদয়-বিশুদ্ধকারক এই বহুকল্যাণপ্রদ সত্ত্বভাবের জন্য মন্ত্রের মধ্যে প্রার্থনা করা হয়েছে। [এই সামমন্ত্রের গেয়গান তিনটির নাম–স্ব রূষ্টমাঙ্গিরসম্, সোমসাম]।
১১। হে শুদ্ধসত্ত্ব! সৎকর্ম-সামর্থ্য-দায়ক তুমি আমাদের সকল রকম স্তোত্ররূপ সৎকর্মকে লক্ষ্য করে ক্ষরিত হও। (ভাব এই যে, আমাদের স্তোত্রসমূহ সত্ত্বভাবসমন্বিত হোক)। হে শুদ্ধসত্ত্ব! পরমানন্দদায়ক আশ্রিতপালক সমুদ্রের ন্যায় সমুন্দনশীল অর্থাৎ সকলের ধারক তুমি দেবভাব প্রাপ্তির জন্য আমাদের সকর্মে পরিক্ষরিত হও অর্থাৎ আগমন করো। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, ভগবানকে প্রাপ্তির জন্য আমাদের সৎকর্ম সত্ত্বভাবান্বিত হোক)। [এই সামমন্ত্রটির গেয়গানের নাম– সোমসাম]।
১২। বিবেকজ্ঞানযুক্ত অর্থাৎ প্রজ্ঞানস্বরূপ পরমানন্দদায়ক দেবগণের প্রিয় সৎকর্মাধিপতি, পরমপবিত্র সত্ত্বভাবসমূহ, প্রার্থনাকারীদের প্রজ্ঞা এবং আত্মশক্তি প্রদানের জন্য ধারারূপে সাধকের পবিত্র হৃদয়কে পরিপ্লাবিত করে ভগবানের প্রতি প্রধাবিত হয়। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক। ভাব এই যে, সত্ত্বভাব পরমানন্দদায়ক এবং পরম শক্তি প্রদায়ক; সৎ-ভাব-সমন্বিত সৎকর্মপরায়ণ সাধকেরা সেই সম্ভারে দ্বারা ভগবানকে অর্চনা করেন)। [যেখানে সত্ত্বভাব বিদ্যমান থাকে, সেখানে সৎ ছাড়া অসৎ থাকতে পারে না। সত্ত্বভাবই মানুষকে সৎপথে নিয়োজিত করে। তাই সত্ত্বভাবকে এ সৎকর্মের অধিপতি বলা হয়েছে। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানের নাম—সোমসাম]।
.
ষষ্ঠী দশতি
ছন্দ আর্চিক। কৌথুমী শাখা। পবমান পর্ব। পঞ্চম অধ্যায়।
দেবতা পবমান সোম৷
ছন্দ ত্রিষ্টুপ৷
ঋষি ১।৯ উশনা কাব্য, ২ বৃষগণ বাসিন্ঠ, ৩।৭ পরাশর শাক্ত্য, ৪।৬ বসিষ্ঠ মৈত্রাবরূণ, ৫।১০ প্রতর্দন দৈবদাসি, ৮ প্রস্কণ্ব কাণ্ব৷
প্ৰ তু দ্রব পরি কোশং নি যীদ নৃভিঃ পুনানো অভিবাজমর্ষ। অশ্বং ন জ্বা বাজিনং মর্জয়ন্তোহচ্ছা বীরশনাভির্নয়ন্তি। ১৷৷ প্র কাব্যমুশনেব বুব্রাণো দেবো দেবানাং জনিমা বিবক্তি। মহিব্রতঃ শুচিবন্ধুঃ পাবকঃ পদা বরাহো অভ্যেতি রেভ৷৷ ২৷৷ তিম্রো বাচ ঈরয়তি প্র বহ্নিখুঁতস্য ধীতিং ব্ৰহ্মণণা মনীষাম। গাবো যন্তি গোপতিং পৃচ্ছমানাঃ সোমং যন্তি মতয়ো বাবশানাঃ৷৷ ৩৷৷ অস্য প্রেষা হেমনা পূয়মাননা দেবো দেবেভিঃ সমপৃক্ত রস। সুতঃ পবিত্রং পর্ষেতি রেভন্ মিতেব সদ্ম পশুমন্তি হোতা৷৷ ৪৷ সোমঃ পবতে জনিতা মতীনাং জনিতা দিবো জনিতা পৃথিব্যাঃ। জনিতাগ্নের্জনিতা সূর্যস্য জুনিতেন্দ্রস্য জনিতোত বিষ্ণোঃ। ৫৷৷ অভি ত্রিপৃষ্ঠং বৃষণং বয়োধামঙ্গোষিণমবাবশন্ত বাণীঃ। বনা বসানো বরুণো ন সিন্দুর্বি রত্নধা দয়তে বার্যাণি৷৷ ৬৷৷ অক্রানুৎসমুদ্রঃ প্রথমে বিধর্মন্ জনয়ন্ প্রজা ভুবনস্য গোপাঃ। বৃষা পবিত্রে অধি সানো অব্যে বৃহৎসোমো বাবৃধে স্বানো অদ্রিঃ। ৭ কনিক্ৰন্তি হরিরা সৃজ্যনানঃ সীদম্বনস্য জঠরে পুনানঃ। নৃভির্যতঃ কৃণুতে নির্ণিজং গোমতো মতিং জনয়ত স্বধাভিঃ ৷৷ ৮. এষ স্য তে মধুম ইন্দ্র সোমো বৃষা বৃষ্ণঃ পরি পবিত্রে অক্ষাঃ। সহস্রদাঃ শতদা ভূরিদাবা শশ্বত্তমং বহিরা বাজ্যস্থা৷ ৯৷৷ পবস্ব সোম মধুম ঋতাবাপো বসানো অধি সানো অব্যে। অব দ্রোণানি ঘৃতবন্তি রোহ মদিন্তমো মৎসর ইন্দ্রপানঃ ১০
মন্ত্ৰাৰ্থ— ১। হে শুদ্ধসত্ত্ব! শীঘ্র আগমন করুন; এবং আমাদের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হোন; সৎকৰ্মকারী জনের দ্বারা পবিত্রতাসম্পন্ন আপনি শক্তি প্রদান করুন; আত্ম-হৃদয় পবিত্রকারী সাধকগণ অশ্বের ন্যায় মার্জনে প্রবৃদ্ধ, শক্তিসম্পন্ন ও পবিত্র আপনাকে প্রার্থনাদ্বারা পূজা করছে। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক। ভাব এই যে, ভগবান্ সাধকদের আত্মশক্তি প্রদান করেন; সাধকেরাও ভগবৎ- এ পরায়ণ হন)। [মন্ত্রের প্রথমাংশে ভগবানকে পাবার আকাঙ্ক্ষা এবং দ্বিতীয় অংশে সাধকের সাধনার পর চিত্র উদ্ঘাটিত হয়েছে। [এই সামমন্ত্রের পাঁচটি গেয়গানের নাম–অশনম, বৃষোশনং সাম
জানস্যতীবর্তৌ দ্বে, ত্রিষ্টুত্রৌশনম]।
২। ভগবৎ-কর্মকারী মোক্ষাভিলাষী আত্ম-উৎকর্ষসম্পন্ন সাধকদের ন্যায় অর্থাৎ তারা যেমন ভগবৎপরায়ণ হন, তেমনই প্রার্থনা উচ্চারণকারী দেবভাবসম্পন্ন ব্যক্তি দেবভাবসমূহের কর্মসমূহ অথবা উৎপত্তির কারণসমূহ কীর্তন করেন; দীপ্ততেজস্ক পাপনাশক দৃঢ়চিত্ত সৎকর্মকারী স্তুতিপরায়ণ হয়ে পরমপদ প্রাপ্ত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, সৎকর্মকারীজন সর্বদা প্রার্থনাপরায়ণ হন; তারা দেবভাবসমূহের উৎপত্তির প্রকার জগতে বিঘঘাষিত করেন। সৎকর্মের প্রভাবে মানুষ মোক্ষলাভ করে থাকেন)। [জনিমা পদের অর্থ হয়েছে-উৎপত্তিপ্রকারাণি। কিভাবে, কেমন সাধনার দ্বারা হৃদয়ে সৎ-ভাবের উদয় হয়, ভগবৎ-পরায়ণ জনই সে তথ্য অবগত আছেন। এ সংসারে তাদের দ্বারাই সে তত্ত্ব ব্যক্ত হয়ে থাকে। এইজন্য সাধুসঙ্গের, সৎপ্রসঙ্গের মহিমা। পুষ্পের মধ্যে অবস্থিত কীট যেমন পুষ্পের সঙ্গে সঙ্গে দেবতার মস্তকে আরোহণ করে, তেমনই অসৎ পাপী জনও সৎ-জনের সহবাসে সৎ-প্রসঙ্গের আলাপনে সৎ-চিন্তার উন্মেষণে পাপমুক্ত হয়ে সৎ-স্বরূপের সামীপ্য লাভের অধিকারী হয়]। [এই সামমন্ত্রের ঋষির নাম–বৃষগণ বাসিত। এর চারটি গেয়গানের নাম বাজসনো দ্বে, বাজজিৎ সাম, বারাহম]।
৩। অগ্নিপ্রতিম সৎকর্মসাধক ঋক্-যজুঃ-সামাত্মিকা স্তুতি উচ্চারণ করেন অর্থাৎ দেবমার্গের অনুসরণে ভগবানকে আরাধনা করেন, এবং সত্যের ধারণকারী ভগবানের প্রার্থনা উচ্চারণ করেন (অথবা সত্যের ধারণকারী বেদোক্ত কর্ম সম্পাদন করেন); জ্ঞানরশ্মি যেমন জ্ঞানীকে প্রাপ্ত হয়, তেমনই জ্ঞানার্থী মোজাভিলাষী স্তোতাগণ সত্ত্বভাবকে প্রাপ্ত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক। ভাব এই যে, -সাধক বেদমার্গ অনুসরণ করে ভগবানের আরাধনা করেন, এবং সৎকর্ম সম্পাদন করেন; প্রার্থনাপরায়ণ সৎকর্মের সাধক সত্ত্বভাব লাভ করেন)। [বেদই জ্ঞান, বেদই মানুষের মুক্তিপথের আলোকবর্তিকা। অনন্ত রত্নের আকর বেদই মানুষকে পরাশান্তির পথ প্রদর্শন করছেন। যিনি প্রকৃত সাধক, যিনি নিজের জীবনকে পূর্ণ ও সফল করে তুলতে চান, তিনি বেদের আশ্রয় গ্রহণ করেন। বেদ-প্রদর্শিত পন্থায় চললেই মানুষের চরম অভীষ্ট লাভ হয়, এটা জেনে তিনি বেদমার্গেরই অনুসরণ করেন। তিনি বেদ অনুযায়ী প্রার্থনা করেন, বেদ অনুযায়ী সৎকর্মে আত্মনিয়োগ করেন। দুঃখ-তাপ ইত্যাদি ভবরোগের মহৌষধ সেই পরমপূজ্য সনাতন জ্ঞানভাণ্ডার-স্বরূপ বেদের মহিমা কীর্তনই এই মন্ত্রের মধ্যে ব্যক্ত হয়েছে। [এই সামমন্ত্রের তিনটি গেয়গানের নাম–সশ্চক্রাশান্তেয়ঃ, চয়ণার্বিশালে দ্বে]।
৪। পরমধনদানে পবিত্রকারক ভগবান্ তার অমৃতকে লোকগণের হিতের জন্য দেবভাবের সাথে সংযোজিত করেন। (ভাব এই যে, -দেবভাবের দ্বারা মানুষ অমৃত লাভ করে)। অপাপবিদ্ধ দেবতা যেমন পবিত্র হৃদয়কে প্রাপ্ত হন, তেমনই প্রার্থনাপরায়ণ সৎকর্মসাধক রিপুগণকে বিনাশ করবার জন্য সৎকর্মের সাধনস্থল প্রাপ্ত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক। ভাব এই যে, সুকর্মের সাধনের দ্বারা রিপুনাশ হয়)। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানের নাম–অগস্তস্য যমিকে দ্বে]।
৫। সত্ত্বভাব আমাদের হৃদয়ে উৎপন্ন হোন; তিনি বুদ্ধিবৃত্তির উৎপাদক, দেবভাবের জনক, পৃথিবীস্থিত সকল লোকের সৃষ্টিকর্তা, তিনি জ্ঞানের উৎপাদক, জ্ঞানকিরণের প্রকাশক, আত্মশক্তির এ মূল কারণ; অপিচ, অখিল দেশের ধারণকর্তা। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, ভগবানের শক্তি যে সত্ত্বভাব, তা থেকে নিখিল বিশ্ব উৎপন্ন হয়েছে)। [এই মন্ত্রের মধ্যে সত্ত্বভাবের পরোক্ষে ২ ভগবানের মহিমা কীর্তন উপলক্ষে এটিকে জগতের সৃষ্টির মূল কারণ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। সব কিছু সৃষ্টিস্থিতিলয়–ভগবানেরই লীলা। আদিতে তিনি, অন্তে ও মধ্যে তিনি। তিনিই বিশ্বরূপে নিজেকে প্রকাশিত করেছেন। দেশ ও কাল তাতেই অপরিচ্ছিন্নরূপে বর্তমান। তার প্রদত্ত জ্ঞানামৃত পানেই মানুষ অমর হয়। তারই শক্তি ঐ সত্ত্বভাব। তার যা মহিমা, তা সবই সত্ত্বভাবে প্রযোজ্য। ভাষ্যকার সেই সোম অর্থে মদিরা ধরেই ব্যাখ্যা করেছেন। যাস্ক সোম পদে সূর্য এবং আত্মা অর্থ গ্রহণ করেছেন। কিন্তু বেদোক্ত সোম অর্থে সত্ত্বভাব বোঝা সম্পূর্ণ সঙ্গত]। [এই মন্ত্রের গেয়গানের নাম–কালক্রাবন্দৌ, জনিত্রে দ্বে]।
৬। সর্বলোকপূজিত অভীষ্টবর্ষক শক্তিদাতা স্তুতিদ্বারা আরাধিত দেবতাকে কামনাকারী আমাদের প্রার্থনা, সেই দেবের অভিমুখে গমন করুক। (ভাব এই যে, আমরা যেন ভগবানের স্তুতিপরায়ণ হই)। কারুণ্যরূপ দেবতার তুল্য জ্যোতিঃধারণকারী, পরমধন দাতা, অভীষ্টপূরক দেবতা বরণীয় ধন আমাদের প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, –ভগবান কৃপা পূর্বক আমাদের পরমধন প্রদান করুন)। [সর্বলোকপূজিত সেই পরমদেবতার চরণে যেন আমরা প্রার্থনাপরায়ণ হই। তিনিই মানুষের অভীষ্ট প্রদানকারী। তার চরণ থেকেই অমৃতধারা প্রবাহিত হয়ে মানুষকে বিমল শান্তি প্রদান করে। তিনি জ্যোতিঃস্বরূপ করুণানিধান]। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানর নাম–অঙ্গিরসাং ব্রতোপোহঃ]। .
৭। বিশ্বের ধারণকারী সকলের রক্ষক দেবতা লোকদের সৃজন করেন; আদিভূত সমুদ্রের ন্যায় অসীম তিনি সমস্তকে অতিক্রম করেন, অর্থাৎ সকলের শ্রেষ্ঠ হন। (ভাব এই যে, সকলের অধিপতি ভগবান বিশ্ব সৃষ্টি ও রক্ষা করেন); কামনাপূরক, বিশুদ্ধ, পাপনাশে পাষাণের ন্যায় কঠোর, অভীষ্টবর্ষক, মহান সত্ত্বভাব জ্ঞানযুক্ত পবিত্ৰহৃদয়ে বর্ধিত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, পবিত্র হৃদয়ে বিশুদ্ধ সত্ত্বভাব উপজিত হয়)। [ভগবান্ অনন্ত। জগতে এমন কিছুই নেই যার সাথে তার তুলনা হতে পারে–তিনি অতুলনীয়। এই পরিদৃশ্যমান জগৎ তারই সৃজিত এবং এ-সবই তার প্রতিরূপ। নিজে অসীম হয়েও তিনি এই সান্তবিশ্বের মধ্য দিয়েও নিজেকে প্রকাশ করছেন। মন্ত্রের দ্বিতীয় অংশে সত্ত্বভাব লাভের উপায় কীর্তিত হয়েছে। সেই উপায় হৃদয়ের পবিত্রতা। মানুষের কাম্যবস্তু মোক্ষলাভ সম্ভবপর হয়–এই সত্ত্বভাবের প্রভাবে]। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানর নাম সামসামানি দ্বে]।
৮। বিশেষভাবে আরাধনায়, পবিত্রকারক, পাপহারক দেবতা জ্যোতির্ময় সাধকের হৃদয়ে অবস্থিত হয়ে তার চিত্তবৃত্তিকে উদ্বোধিত করেন। (ভাব এই যে, -সাধকদের হৃদয় ভগবৎ-পরায়ণ হয়)। যে সত্ত্বভাব লাভের দ্বারা সৎকর্মসাধক জ্ঞানকে বিশুদ্ধ করেন, সেই সত্ত্বভাব লাভ করে মানুষ প্রার্থনার দ্বারা সৎবুদ্ধি হৃদয়ে উৎপন্ন করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক। ভাব এই যে, -সত্ত্বভাব লাভের দ্বারা জ্ঞান বিশুদ্ধ হয় এবং হৃদয়ে সুবুদ্ধি উৎপাদিত হয়)। [ভগবানই ভাগ্যবানের সহায়। যিনি সুকৃতির বলে ভগবানের চরণে আত্মনিবেদন করেন, ভগবানই তাঁকে পথ প্রদর্শন করে থাকেন। তার হৃদয়ে ॥ অধিষ্ঠিত হয়ে ভগবান্ সাধকের সকল চিত্তবৃত্তিকে ঊর্ধ্বমুখী করেন]। [এই মন্ত্রে গেয়গানের নাম– সোমসামনি দ্বে]।
৯। বলৈশ্বর্যাধিপতি হে দেব! কামনাপূরক আপনাকে পাবার জন্য এই অভীষ্টবর্ষক অমৃতস্বরূপ সত্ত্বভাব আমাদের হৃদয়কে পবিত্র করে যেন সমুদ্ভূত হন; অসীম দানশীল, শক্তিমান্ তিনি নিত্যকাল আমাদের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত থাকুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবৎ-প্রাপ্তির জন্য আমরা যেন সত্ত্বভাব লাভ করি)। [ভগবানের দানশীলতা বিশেষভাবে ব্যক্ত করবার জন্যই একার্থবাচক শত্তদাঃ, সহস্রদাঃ, ভূরিদাবা এই তিন পদ ব্যবহৃত হয়েছে। পরম দানশীল ভগবানের কাছ থেকে সত্ত্বভাব নামক পরম কল্যাণদায়ক বস্তু লাভ করবার জন্য ভগবানের কাছে প্রার্থনা করা। হয়েদ্বে]। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানের নাম–ঐষম্]।
১০। হে শুদ্ধসত্ত্ব! মধুযুক্ত অমৃতময় অভীষ্টবর্ষণশীল আপনি সত্য এবং জ্ঞান প্রদান করবার জন্য। আমাদের হৃদয়ে উপজিত হোন; অমৃতযুক্ত, পরমানন্দদায়ক, আনন্দস্বরূপ, ভগবানের গ্রহণযোগ্য পূজার উপহারস্বরূপ আপনি আমাদের হৃদয়কে প্রাপ্ত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, পরমানন্দদায়ক অমৃতময় সত্ত্বভাব আমরা যেন লাভ করতে পারি)। [হৃদয়ের সত্ত্বভাবই ভগবানের পূজার শ্রেষ্ঠ উপাদান। জপ, তপ, যোগ, আরাধনা প্রভৃতির মূলে যদি পবিত্র হৃদয় ও ব্যাকুল আকাঙ্ক্ষা না থাকে, তা হলে সকল পূজা বিফল হয়, হৃদয়ের দেবতা বিমুখ হয়ে ফিরে যান–সকল বাহ্যিক অনুষ্ঠান ভস্মে ঘৃতাহুতি হয় মাত্র। শুদ্ধসত্ত্ব বিশুদ্ধ আনন্দেরও জনক। শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে হৃদয়ের দীনতা, হীনতা কালিমা দূরীভূত হলে কোনই অপ্রাপ্তির জন্য দুঃখ বা অপূর্ণতা থাকে না। ফলে, হৃদয় পূর্ণতাজনিত পরমানন্দে পূর্ণ হয়ে যায়। তাই সত্ত্বভাব মধুযুক্ত ও অমৃতময়। –সোম শুদ্ধসত্ত্ব। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানের নাম-মাধুচ্ছন্দসম]।
.
সপ্তমী দশতি
ছন্দ আর্চিক। কৌথুমী শাখা। পবমান পর্ব। পঞ্চম অধ্যায়।
মন্ত্রগুলির দেবতা–পবমান সোম।
ছন্দ–ত্রিষ্টুপ।
ঋষি ১ প্রতর্দন দৈবদাসি, ২।১০ পরাশর শাক্ত্য ৩ ইন্দ্ৰপ্ৰমতি বাসিষ্ঠ, ৪ বশিষ্ঠ মৈত্রাবরুণ, ৫ কর্ণশ্রুৎ মৃড়ীক বা বাসিষ্ঠ, ৬ নোধা গৌতম, ৭ কণ্ব ঘৌর, ৮ মন্যু বাসিষ্ঠ, ৯ কুত্স আঙ্গিরস, ১১ কশ্যপ মারীচ, ১২ প্ৰস্কণ্ব কাণ্ব।
প্র সেনানীঃ শূরো অগ্রে রথানাং গব্যন্নেতি হতে অস্য সেনা। ভদ্রা কৃনিন্দ্ৰহবাৎসখিভ্য আ সোমো বস্ত্রা রভসানি দত্তে৷৷ ১৷৷ প্র তে ধারা মধুমতীরগ্র বারং যৎ পৃতো অতোষ্যব্য। পবমান পবসে ধাম গোনাং জয়সূর্যমপিন্বো অর্কৈঃ৷৷ ২৷ প্র গায়তাভ্যৰ্চাম দেবাৎসোমং হিনোত মহতে ধনায়। স্বাদু পবতামতিবারমব্যমা সীতু কলশং দেব ইন্দুঃ ৷৷ ৩৷৷ প্র হিন্বনো জনিত রোদস্যো রথোন বাজং সনিষন্নয়াসীৎ। ইন্দ্রং গচ্ছন্নায়ুধা সংশিশানো বিশ্ব বসু হস্তয়োরাধানঃ ৪৷৷ তক্ষ্যদী মনসা বেনতো বা জ্যেষ্ঠস্য ধর্মং দুক্ষেরনীকে। আদীমায়াম্বরমা বাবশানা জুষ্টং পতিং কলশে গাব ইন্দু৷৷ ৫৷৷ সামুক্ষো মজয়ন্ত স্বসারো দশ ধীরস্য ধীতয়ো ধনুত্রীঃ। হরিঃ পর্যদ্রবজ্জাঃ সূর্যস্য দ্রোণং ননক্ষে অত্যো না বাজী৷৷ ৬৷৷ অধি যদস্মিৰাজিনী শুভঃ স্পর্ধন্তে ধিয়ঃ সুরে ন বিশঃ। অপো বৃণানঃ পবতে কবীয়ান্ ব্রজং ন পশুবর্ধনায় মন্ম৷৷ ৭৷৷ ইন্দুর্বাজী পবতে গোন্যোঘা ইন্দ্রে সোমঃ সহ ইন্মদায়। হন্তি রক্ষো বাধতে পৰ্যরাতিং বরিবস্কৃথন্ বৃজনস্য রাজা। ৮। অয়া পবা পবস্বৈনা বসূনি মাংশ্চত্ব ইন্দো সরসি প্রধ। ব্ৰশ্চিদ্যস্য ঝতো ন জুতিং পুরুমেধাশ্চিত্তকবে নরং ধাৎ৷৷ ৯৷৷ মহত্তসোমো মহিষশ্চকারাপাং যদুগর্ভোহবৃণীত দেবা৷ অধাদিন্দ্রে পবমান ওজোহজনয়ৎ সূর্যে জ্যোতীরিঃ। ১০ ৷ অসর্জি বা রথ্যে যথাজৌ ধিয়া মনোতা প্রথমা মনীষা। দশ স্বসারো অধি সানো অব্যে মৃজন্তি বহ্নিং সদনেচ্ছ৷৷ ১১৷৷ অপামিবেদূর্ময়স্ততুরাণাঃ প্ৰ মনীষা ঈরতে সোমমচ্ছ। নমস্যন্তীরুপ চ যন্তি সং চা চ বিশন্তুশতীরুশন্ত৷৷ ১২৷৷
মন্ত্ৰার্থ— ১। রিপুসংগ্রামে সেনানায়ক, শত্রুনাশক, স্তোতাদের জ্ঞানপ্রদায়ক সত্ত্বভাব সৎকর্মের প্রারম্ভে স্তোতৃদের প্রাপ্ত হন; এই সত্ত্বভাবের সৎ-ভাবরূপ সৈন্যগণ পরমানন্দ প্রদান করে। (ভাব এই যে, রিপুসংগ্রামে সত্ত্বভাবের অধিনায়কত্বে সৎ-ভাবসমূহ বর্ধিত হয়)। সত্ত্বভাব ভগবৎ আরাধনাকে মঙ্গলজনক করেন; তিনি সখিস্থানীয় প্রার্থনাপরায়ণ আমাদের আশুমুক্তিদায়ক সৎ ভাবসমূহ প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, –সত্ত্বভাব প্রাপ্ত হয়ে আমরা যেন তার সহায়তায় মোক্ষলাভ করতে পারি)। [প্রচলিত একটি বঙ্গানুবাদ–এই দেখ সোম বীরপুরুষ ও সেনাপতির ন্যায় বিপক্ষদের গোধন হরণ করবার জন্য রথের অগ্রে যাচ্ছেন, এঁর সেনা এঁকে দেখে উৎসাহিত হচ্ছে। যজ্ঞকর্তা ব্যক্তিরা এঁর সখা, তারা ইন্দ্রের আহ্বান করে, ইনি তাদের সেই কার্য সুসম্পন্ন করেন, যে সকল দুগ্ধ আদি বস্তু দেখে ইন্দ্র শীঘ্র আসবেন, ইনি সেই বস্তুর সাথে মিশ্রিত হচ্ছেন। জিজ্ঞাস্য-সোমরস নামক মাদকদ্রব্য কেমন সেনাপতি এবং তার সেনাই বা কারা? আর তিনি বিপক্ষের গোধনই বা হরণ করবেন কিভাবে ও কেন?–প্রকৃত অর্থে. সোম বেদোক্ত সত্ত্বভাব–মাদক বা মদিরা নয়। হৃদয়ে যখন সত্ত্বভাবের উন্মেষ হয় তখন অন্যান্য সৎ-ভাবরাজিও শক্তিলাভ করে, তারা সত্ত্বভাবকে সেনাপতিরূপে গ্রহণ করে রিপুনাশে (কাম-ক্রোধ ইত্যাদি রিপুদের ধ্বংসে) ব্রতী হয়। সেই মহাশক্তির কাছে রিপুগণ মাথা নত করতে বাধ্য হয়। সৎ-ভাবের শিবিরে আনন্দের কল্লোল ওঠে। সত্ত্বভাবসমন্বিত প্রার্থনা পরম কল্যাণজনক। কারণ পবিত্রতা থেকে উৎপন্ন পবিত্র প্রার্থনা অনায়াসেই সেই পবিত্রস্বরূপ ভগবানের চরণে পৌঁছতে পারে। [এর গেয়গানের নাম কুৎস্যাধিরথীয়াণি ত্রীণি]।
২। হে শুদ্ধসত্ত্ব! পবিত্র আপনি যখন জ্ঞানপ্রবাহ প্রাপ্ত হন অর্থাৎ জ্ঞানের সাথে সম্মিলিত হন, তখন আপনি আপনার অমৃতযুক্ত প্রবাহ জগতে বিতরণ করেন; পবিত্রকারক আপনি জ্ঞানের উৎপত্তিস্থান অর্থাৎ সাধকের হৃদয় অভিমুখে ক্ষরিত হন। (ভাব এই যে, -সাধকগণ জ্ঞানসমন্বিত সত্ত্বভাব লাভ করেন)। সাধকগণের হৃদয়ে উৎপাদিত হয়ে আপনি আপনার তেজের দ্বারা জ্ঞানকে পূর্ণ করেন। — (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, সত্ত্বভাব লাভের দ্বারা সাধকের জ্ঞান পূর্ণত্ব প্রাপ্ত হয়)। [জ্ঞান ও পবিত্রতা পরস্পরের অনুগামী। যেখানে একটির আবির্ভাব হয়, সেখানে অন্যটিও উপস্থিত হয়ে থাকে। অবশ্য এই উভয় বস্তুকেই ধারণ করবার উপযোগী হৃদয় থাকা চাই। শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে সৎকর্ম সাধনের দ্বারা সেই হৃদয় প্রস্তুত হয়। জ্ঞান ও সত্ত্বভাব উভয় একত্র সম্মিলিত হলে, সাধক অনায়াসেই মোক্ষপথে অগ্রসর হতে পারেন। একটি অন্যটির সহকারী]। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানের নাম–বৈয়শ্বজ্যোতিষানি ত্ৰীণি]।
৩। হে মম চিত্তবৃত্তিনিবহ! ঐকান্তিকতার সাথে ভগবানের আরাধনা করো; আমরা যেন ভগবানের অনুসরণ করি। (ভাব এই যে, আমি যেন ভগবৎপরায়ণ হই)। শ্রেষ্ঠ পরমধন লাভের জন্য সত্ত্বভাবকে হৃদয়ে উৎপাদন করো; অমৃতোপম সত্ত্বভাব জ্ঞানপ্রবাহের সাথে আমার হৃদয়ে সমুদ্ভূত হোন; জ্যোতির্ময় সত্ত্বভাব আমার হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, –আমি যেন অমৃতোপম সত্ত্বভাব লাভ করি)। মন্ত্রটি উদ্বোধন ও প্রার্থনামূলক। ভগবৎপরায়ণ হবার জন্য ব্যাকুল আকাঙ্ক্ষা এই মন্ত্রে দেখা যায়। সত্ত্বভাব লাভ করে হৃদয়কে ভগবৎ-অভিমুখী করবার জন্য প্রার্থনা আছে। হে আমার মন! তুমি ভগবানের গুণকীর্তনে তন্ময় হও, তাকে লাভ করবার উপায়ভূত সত্ত্বভাব পাবার জন্য ঐকান্তিক চেষ্টা করো। পরাশান্তি লাভ করবে, জীবন ধন্য হবে]। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানের নাম–সোমসাম]।
৪। দ্যুলোক-ভূলোকের উৎপাদনকারী সত্ত্বভাব, সৎকর্ম যেমন আত্মশক্তি প্রদান করে, তার মতোই আত্মশক্তি প্রদান করে আমাদের হৃদয়ে উৎপাদিত হোন; তিনি ভগবৎ-প্রাপ্তির জন্য সৎ-ভাবসমূহকে সম্যক প্রকারে বিকশিত করে সকল ধন অর্থাৎ পরমধন আমাদের দান করবার জন্য হস্তে ধারণ করে আমাদের প্রাপ্ত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, –আত্মশক্তিপ্রদ সত্ত্বভাবকে আমরা যেন লাভ করতে পারি)। [শুদ্ধসত্ত্বময় ভগবান্ থেকেই এই পরিদৃশ্যমান জগতের সৃষ্টি হয়েছে, তাই সত্ত্বভাবকে দ্যুলোক-ভূলোকের জনয়িতা বলা হয়েছে। যখন মানুষ এই মহান্ সত্ত্বভাবকে লাভ করে, তখন তার হৃদয়ে ঐশীশক্তির আবির্ভাব হয়। এই শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবেই তার সাথে ভগবানের যোগ অনুভব করে সে অসীম শক্তি লাভ করে। আবার, সত্ত্বভাবের উন্মেষের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের অন্তরস্থিত সম্ভাবসমূহও বিকশিত হয়। রিপুসংগ্রামে জয়লাভ করবার প্রধান অস্ত্র এই সৎ-ভাবরাজী]। [এই সামমন্ত্রের একটি গেয়গান আছে। নাম অনুল্লেখিত]।
৫। রিপুসংগ্রামে যখন জ্যোতির্ময় অন্তঃকরণ হতে সৎ-ভাবযুক্ত সাধকের স্তুতি দেব-অভিমুখে গমন করে, তখন শ্রেষ্ঠ, দেব সেবিত, সকলের পালক এই সত্ত্বভাবকে কামনাকারী জ্ঞানরশ্মিসমূহ সাধকের হৃদয়ে আগমন করে। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক। ভাব এই যে, রিপুসংগ্রামে জয়লাভের জন্য প্রার্থনাপরায়ণ সাধকের হৃদয়ে পরাজ্ঞান উপজিত হয়)। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানের নাম বাচ সামন্বি দ্বে]।
৬। সৎ-বৃত্তির বর্ধনকারী জ্ঞানরশ্মিসমূহ সাধকের হৃদয়কে বিশুদ্ধ করে; প্রাজ্ঞ জনের সমস্ত সৎকর্ম মোক্ষপদ হয়। (ভাব এই যে, জ্ঞানিগণ মোক্ষ লাভ করেন)। পাপহারক দেবতা জ্ঞানশক্তি আমাদের প্রদান করুন; আত্মশক্তি তুল্য ঊর্ধ্বগতিপ্রাপক জ্ঞান আমাদের হৃদয়কে প্রাপ্ত হোক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন পরাজ্ঞান লাভ করতে পারি)। [মহাপুরুষদের হৃদয়বৃত্তিই এমনভাবে বিশুদ্ধ হয় যে, তা কখনও বিপথে চালিত হয় না। তারা যা করেন, তাই তাদের মোক্ষলাভে সাহায্য করে; তারা যা চিন্তা করেন তা-ই তাদের ঊর্ধ্বপথে নিয়ে যায়; তাদের বাক্যমাত্রই ভগবানের স্তুতিতে পরিণত হয়। বিশুদ্ধ জ্ঞানের বলেই এই অবস্থা লাভ সম্ভবপর হয়। তাই সেই পরমকল্যাণদায়ক জ্ঞান লাভের জন্যই এই মন্ত্রে প্রার্থনা করা হয়েছে। প্রচলিত ব্যাখ্যাকারগণ নানাভাবে এই মন্ত্রেরও গবেষণা করেছেন। প্রচলিত এক বঙ্গানুবাদে দেখা যায়–দশ ভগ্নী অর্থাৎ দশ অঙ্গুলি একসঙ্গে জল সেচন করতে করতে সোমকে শোধন করছে, সেই দশ অঙ্গুলি সুস্থির সোমকে চালিয়ে, দিচ্ছে। হরিৎবর্ণ ধারণ পূর্বক সোম সূর্যের পত্নীর দিকে ধাবিত হচ্ছিল, বেগবান ঘোটকের ন্যায় সোম কলস পূর্ণ করলেন। ভাষ্যকার সায়ণাচাৰ্য্য সূৰ্য্যস্ব জা পদদুটিতে দি অর্থ করেছেন। বিবরণকার ঐ পদদুটিতে সূৰ্য্যস্ব অপত্যং বা সূর্যের দুহিতা অর্থ করেছেন। ব্যাখ্যাকারের টীকায় আছে — আমরা জানি বেদে সোম-অর্থে সোমরস। তবে তার সাথে সূর্যের দুহিতার বিবাহের প্রকৃত মৌলিক অর্থ কি? ……সূর্যের দুহিতা পরিসুত সোমকে বিশুদ্ধ করেন। সূর্যকিরণে সোমরস মাদকতা প্রাপ্ত হয়, এই কি সূর্যার সোমের সঙ্গে বিবাহের উপাখ্যানের প্রকৃত উৎপত্তি?–এতসব উদ্ভট কল্পনার প্রয়োজনই হতো না, যদি সূৰ্য্যস্য জাঃ পদ দুটির প্রকৃত অর্থ জ্ঞানের জায়া বা জ্ঞানের শক্তি বোঝ যেত। তালের বা খেজুর রসের মতো সোমলতার রসকে সূর্যের কিরণে মাদকতা দানের ইতিকথার, দরকার ছিল কি? এখানে স্বসারঃ পদের জ্ঞানরশ্মিসমূহ এবং ধীরস্য পদের প্রাজ্ঞজনের অর্থ নিরুক্ত-সম্মত]। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানের নাম–দাশস্পত্যে দ্বে]।
৭। আত্মশক্তিতে যেমন মঙ্গল বর্ধিত হয়, এবং জ্ঞানলাভ করে যেমন সাধকগণ আনন্দিত হন, তেমনই যখন সাধকের হৃদয়ে প্রজ্ঞা অধিষ্ঠিত হয়, তখন রক্ষণীয় পশু ইত্যাদি, বৃদ্ধির জন্য যেমন আশ্রয় স্থান প্রাপ্ত হয়, তেমনই স্তোতাদের পেতে অভিলাষী অমৃতসংযুক্ত সত্ত্বভাব সাধকের হৃদয়কে প্রাপ্ত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, –প্রার্থনাপরায়ণ সাধকেরা সত্ত্বভাব লাভ করেন)। [মন্ত্রটির মধ্যে একসঙ্গে তিনটি উপমা ব্যবহৃত হয়েছে; এবং বিভিন্ন ধরনের উপমার একত্র সংযোগে মন্ত্রটির জটিলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রথম উপমা বাজিণীর শুভঃ–আত্মশক্তি লাভ করলে যেমন পরম মঙ্গল সাধিত হয়। আত্মশক্তির ফল–রিপুজয়। রিপুজয় হলে মানুষ আপনা থেকেই মঙ্গলের পথে চালিত হয়। সুতরাং এই উপমা পরোক্ষভাবে সত্ত্বভাব জনিত মঙ্গলকে নির্দেশ করছে। দ্বিতীয় উপমা, সূরে ন বিশঃ–সাধকগণ যেমন জ্ঞানলাভে আনন্দিত হন। সূরঃ অর্থ দ্যোতনশীল। সূরে পদে দ্যোতনশীলের শক্তি–জ্যোতিঃ, জ্ঞানকে বোঝাচ্ছে। সাধকগণ এই পরম প্রার্থনীয় বস্তুটি লাভ করলে তার আর আনন্দের সীমা থাকে না। এখানে এই উপমা সত্ত্বভাব জনিত আনন্দকে লক্ষ্য করছে। তৃতীয় উপমা, ব্রজং ন পশুবৰ্ধনায়–পশুগণ যেমন বৃদ্ধি হেতু, পোষণের জন্য, আশ্রয় স্থান প্রাপ্ত হয়। পশুর আশ্রয়স্থান প্রাপ্তির সাথে সত্ত্বভাবের সাধকদের হৃদয় প্রাপ্তির তুলনা করা হয়েছে। সত্ত্বভাব কবীয়ান অর্থাৎ সাধককে পেতে ইচ্ছা করেন, অর্থাৎ ভগবান্ মোক্ষাভিলাষী সাধকের হৃদয়ে সত্ত্বভাব এ প্রদান করে তার বাসনা পূর্ণ করেন]। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানের নাম-কাশ্যপস্য চ শোভনম]।
৮। শক্তিদায়ক সত্ত্বভাব আমাদের হৃদয়ে উপজিত হোন; বলৈশ্বর্যাধিপতি দেবতাকে লাভ করবার জন্য বলদায়ক ঊর্ধ্বগতিপ্রাপক জ্ঞানকিরণনিবহ আমাদের হৃদয়ে উপজিত হোক; পরমানন্দলাভের জন্য সত্ত্বভাব উৎপন্ন হোন; তিনি শত্রুদের বিনাশ করুন, রিপুগণকে সম্যক প্রকারে সংহার করুন; পরমশক্তিমান্ তিনি আমাদের পরমধন প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, — আমরা যেন ভগবৎ-পরায়ণ হই; রিপুনাশক সত্ত্বভাব আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন)। [এই মন্ত্রটি পাঁচ অংশে বিভক্ত। প্রত্যেক অংশেই জ্ঞান অথবা সত্ত্বভাব লাভের জন্য প্রার্থনা পরিদৃষ্ট হয়। মন্ত্রের অন্তর্গত গোন্যোঘাঃ পদের গো শব্দে ভাষ্যকার গমনশীল অর্থ গ্রহণ করেছেন। অন্যত্র গাভী অর্থ দেখা যায়। প্রচলিত বঙ্গানুবাদে গাভীঅর্থ গৃহীত হলেও গাভীদুগ্ধে পরিতুষ্ট অর্থ কেমন করে গৃহীত হয়েছে, বোঝা যায় না। প্রকৃতপক্ষে গোন্যোঘাঃ পদে ঊর্ধ্বগতিপ্রাপকাঃ জ্ঞানকিরণনিবহা অর্থই সঙ্গত। বাজী অর্থে ঘোটক নয়, শক্তিমান, শক্তিদায়ক এমন বোঝাই সঙ্গত। সোমঃ তো সত্ত্বভাবই]। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানের নাম–দাশস্যতানি চত্বারি]।
৯। হে সত্ত্বভাব! তোমার পবিত্রকারক ধারার সাথে পরমধন প্রদান করো; হে সত্ত্বভাব! তোমাকে কামনাকারী আমার হৃদয়ে আবির্ভূত হও। (ভাব এই যে, আমরা যেন:সত্ত্বভাব লাভ করি)। প্রাজ্ঞ ব্যক্তি যে দেবতার আশুমুক্তিদায়ক জ্যোতিঃ প্রাপ্ত হন, সকলের মূলীভূত সেই ব্ৰহ্ম সৎকর্মের নেতাকে প্রাপ্ত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, জ্ঞানী ব্যক্তি ভগবানকে লাভ করেন)। [এই সাম মন্ত্রের গেয়গানের নাম–শ্নৌষ্ঠানি ত্রীণি]।
১০। হেমহান তেজঃ সম্পন্ন সত্ত্বভাব অমৃত উৎপাদন করেন, সেই সত্ত্বভাব দেবভাবসমূহের সাথে মিলিত হন। (ভাব এই যে, –সত্ত্বভাব অমৃত এবং দেবভাবকে সাধকের হৃদয়ে উৎপাদন করেন)। পবিত্রকারক সত্ত্বভাব ভগবানে শক্তি প্রদান করেন, অর্থাৎ সত্ত্বভাবই ভগবানের পরমশক্তি; সত্ত্বভাব জ্ঞানেতে তেজ উৎপাদন করেন, অর্থাৎ সত্ত্বভাব হতে জ্ঞানের শক্তি বিকশিত হয়। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, সত্ত্বভাবই সকল শক্তির মূল কারণ)। [সত্ত্বভাবের শক্তিতে জগৎ সৃষ্ট হয়েছে ও পরিচালিত হচ্ছে। এরই কল্যাণে মানুষ অমৃতলাভে সমর্থ হয়, তাই সত্ত্বভাবকে অমৃতের জনয়িতা বলা হয়েছে। শুদ্ধসত্ত্বের সাথে ভগবানের সম্বন্ধ অতি নিকট। তাই হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্বের উদয় হলে মানুষ দেবভাব লাভ করে। এই মহাশক্তির বলেই মানুষের অন্য সবরকম শক্তি লাভ হয়। জ্ঞানও পূর্ণজ্যোতিতে বিকশিত হয়, কর্মশক্তি তীক্ষ্ণ হয়। সত্ত্বভাবের বলে মানুষের আত্মশক্তি জাগরিত হয়– তার দ্বারা তিনি নিজের চরম লক্ষ্যের অভিমুখে চলতে সমর্থ হন]। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানের নাম–অত্রিম্]।
১১। সৎকর্মের সাধনে যেমন জ্ঞান উৎপাদন হয়, তেমন রিপুসংগ্রামে প্রার্থনার দ্বারা। দেবভাবপ্রাপক, শ্রেষ্ঠ, ধীশক্তিদায়ক জ্ঞান সৃষ্ট হয়; দশ-ইন্দ্রিয়ের দ্বারা সাধ্য অভীষ্টবর্ষণশীল যে জ্ঞানকিরণনিবহ, মোক্ষপথপ্রাপক সেই জ্ঞানজ্যোতিঃ সাধকগণ জ্ঞানদায়ক সৎকর্মের সাধনস্থলে অর্থাৎ সৎকর্মের সাধনের দ্বারা সম্যক প্রকারে প্রাপ্ত হন। (ভাব এই যে, সাধকেরা প্রার্থনা এবং সৎকর্মের সাধনের দ্বারা জ্ঞান লাভ করেন)। [মানুষের কর্মশক্তি ও ভগবানের অনুগ্রহ এই দুরকম উপায়েই জ্ঞান লাভ হতে পারে। ভগবান্ মানুষকে কিছু পরিমাণ কর্ম-স্বাধীনতা দিয়েছেন। কর্মশক্তির উপযুক্ত ব্যবহার করে ভগবৎ-নিয়মের পরিচালনাধীন থেকে মানুষ জ্ঞানলাভ করতে পারে। অথবা ভগবান কৃপাপরবশ হয়ে সাধককে সাধনসিদ্ধ বলে, দ্বিতীয় রকমের সাধককে কৃপাসিদ্ধ বলে]। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানের নাম–বাসিষ্ঠ]।
১২। অমৃতের প্রবাহ যেমন আশুমুক্তি প্রদান করে–তেমন আশুমুক্তি কামনাকারী সাধকগণ নিশ্চিতভাবে সত্ত্বভাব পাবার জন্য সম্যক্ প্রকারে ভগবৎ-স্তুতি প্রেরণ করেন। (ভাব এই যে, সাধকেরা সত্ত্বভাব লাভের জন্য প্রার্থনা করেন)। এবং সাধকদের সৎকর্মযুক্ত সত্ত্বভাবকামনাকারী প্রার্থনা, সাধক-কামনাকারী সত্ত্বভাবকে প্রাপ্ত হয়, এবং তার সাথে সম্মিলিত হয়, তাতে প্রবিষ্ট হয়। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, –ঐকান্তিক প্রার্থনার দ্বারা সাধকেরা সত্ত্বভাব লাভ করেন)। [মন্ত্রের প্রথম ভাগে একটি উপমা আছে। অমৃতের প্রবাহে অভিষিক্ত হলে মানুষ যেমন আশুমুক্তি লাভ করে, তেমনই আশুমুক্তি পাবার জন্য সাধকেরা প্রার্থনা করে থাকেন। দ্বিতীয় অংশে সত্ত্বভাব লাভের জন্য ব্যাকুল প্রার্থনা আছে। সাধক যেমন সত্ত্বভাব কামনা করেন, সত্ত্বভাবও তেমনই সাধককে পেতে ইচ্ছুক, অর্থাৎ ভগবান্ সাধকের হৃদয়ে সত্ত্বভাব প্রেরণ করে তাকে মোক্ষপথে চলতে সমর্থ করেন]। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানের নাম-অপাঞ্চ সাম]।
.
অষ্টমী দশতি
ছন্দ আর্চিক। কৌথুমী শাখা। পবমান পর্ব। পঞ্চম অধ্যায়।
দেবতা পবমান সোম।
ছন্দ অনুষ্টুপ, ৭ বৃহতী ॥
ঋষি ১ অন্ধীগুঃ শ্যাবাশ্বি, ২ নহুষ মানব, ৩ যযাতি নাহুষ, ৪ মনু সাংবরণ, ৫/৮ অম্বরীষ বার্ষাগির ও ঋজিশ্বা ভারদ্বাজ, ৬/৭ রেভ ও সূনূ কাশ্যপ, ৯ বাক্ বা বিশ্বামিত্র পুত্র প্রজাপতি।
পুরোজিতীববা অন্ধসঃ সুতায় মাদয়িত্নবে। অপ শানং থিষ্টন সখায়ো দীর্ঘজিহ্ব৷১৷৷ অয়ং পূষা রয়ির্ভগঃ সোমঃ পুনানো অৰ্ষতি। পতির্বিশ্বস্য ভূমনো ব্যখ্যদরোদসী উভে৷৷ ২৷৷ সুতাসো মধুমত্তমাঃ সোমা ইন্দ্রায় মন্দিনঃ। পবিত্রবন্তো অক্ষর দেবান্ গচ্ছন্তু বো মদাঃ ॥৩৷৷ সোমাঃ পবন্ত ইন্দবোহস্মভ্যং গাতুবিত্তমা। মিত্রাঃ স্বানা অরেপসঃ স্বাধ্যঃ স্ববিদঃ ॥৪॥ অভী নো বাজসাতমং রয়িমর্ষ শতস্পৃহম। ইন্দো সহস্ৰভর্ণসং তুবিদ্যুম্নং বিভাসহ ৷৷ ৫৷৷ অভী নবন্তে অদ্ৰহঃ প্রিয়মিন্দ্রস্য কাম্য। বৎসং ন পূর্ব আয়ুনি জাতং রিহন্তি মাতরঃ ৷৬৷ আ হৰ্যতায় ধৃষ্ণবে ধনুষ্টথন্তি পৌংস্যম্। শুক্ৰা বিযন্ত্যসুরায় নির্ণিজে বিপামগ্রে মহীযুবঃ ॥৭৷ পরি ত্যং হতং হরিং বভ্রং পুনন্তি বারেণ। যো দেবান্ বিশ্ব ইৎ পরি মদেন সহ গচ্ছতি ॥ ৮. প্র সুন্বনায়ান্ধসো মর্তো ন বষ্ট তচঃ। অপ শ্বানরাধসং হতা মখং ন ভগবঃ।
মন্ত্ৰার্থ–১। সৎকর্মের সাধনে সখিভূত হে আমার চিত্তবৃত্তিনিবহ! রিপুসংগ্রামে জয়প্রদানকারী সত্ত্বভাবের বিশুদ্ধ পরমানন্দ লাভের জন্য তোমরা সৎ-ভাবের নাশক রিপুনিবহকে বিনাশ করো। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধক। ভাব এই যে, -মোক্ষলাভের জন্য যেন আমি রিপুজয়ী হই)। [মানুষ-নিজের ইচ্ছাশক্তিকে কর্মসম্পাদন করে। এই ইচ্ছাশক্তির প্রেরয়িতা চিত্তবৃত্তি। সৎকার্য বা অসৎকার্য যাই করা হোক না কেন, তার মূলে থাকে এই চিত্তবৃত্তি। এই চিত্তবৃত্তিগুলি যখন মানুষকে সৎপথে পরিচালিত করে, তখন তারা মানুষের পরম উপকারী.বন্ধু। অর্থাৎ মানুষের জীবনের যা প্রকৃত কাম্যবস্তু, যা পেলে মানুষ আর কিছুই আকাঙ্ক্ষা করে না, সেই পরমধন মোক্ষকে লাভ করবার জন্য যখন চিত্তবৃত্তিগুলি ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে, তখন তাদের মতো উপকারী বন্ধু আর কে হতে পারে? তাই সৎকার্যের সাধনে সহায়ভূত চিত্তবৃত্তিগুলিকে সখায়ো বা সখা বলে সম্বোধন করা হয়েছে।–ভাষ্যকার শূনং পদে রাক্ষস বলেছেন। অন্য একজন ব্যাখ্যাকার কুকুর অর্থ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে শ্বানং পদে হৃদয়স্থিত পশুকেই বোঝানো হয়েছে। তার দীর্ঘজিহ্বা, আমাদের হৃদয়ের সকল সৎবৃত্তি, সত্ত্বভাবপ্রবাহ প্রভৃতি বিনষ্ট করে]। [এই সামমন্ত্রের গেয়গান ছটি। সেগুলির নাম– প্রঙ্খৌ দ্বৌ, কার্তয়সম, ঔর্ধ্বসন্মনম, শাবাশ্বম, আন্ধীগবম]।
২। সকলের পোষক, পরমধনদায়ক, পবিত্রকারক এই সত্ত্বভাব আমাদের হৃদয়ে আগমন করুন। (ভাব এই যে, আমরা যেন পরমধনদাতা সত্ত্বভাব লাভ করি)। সকল সৃষ্টবস্তুর পালক তিনি দুলোক-ভূলোককে আপন জ্যোতিঃতে প্রকাশিত করেন। ( মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক এবং প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, -সত্ত্বভাবই বিশ্বসৃষ্টির মূল কারণ )। [পূষাসকলের পোষক। — সাম্যাবস্থাপ্রাপ্ত ত্রিগুণাত্মিকা প্রকৃতিতে যখন আভ্যন্তরিক আকর্ষণ বিকর্ষণের ফলে সত্ত্বভাব প্রাধান্য লাভ করে, তখনই বিশ্বসৃষ্টির সূচনা হয়, কারণবারিতে বুদ্বুদের উদ্ভব হয়। বিশ্বকারণে সংলীন বীজগুলি থেকে সৃষ্টির পত্তন আরম্ভ হয়। তাই সত্ত্বভাব বিশ্বসৃষ্টির মূল কারণ। এই সত্ত্বভাবের জ্যোতিঃতে নিখিল বিশ্ব জ্যোতিঃ পায়, এই মহান জ্যোতিঃ সমুদ্রের বিন্দুমাত্র আলোক পেয়ে চন্দ্র-সূর্য জ্যোতিষ্মান্ হয়। তাই সত্ত্বভাব সম্বন্ধে বলা হয়েছে-উভে রোদসী ব্যখ্যৎ। –সকল ধনের শ্রেষ্ঠ ধন মোক্ষ–এই সত্ত্বভাবের দ্বারা লভ্য। তাই সত্ত্বভাবকে পরমধনদাতা বলা হয়েছে]। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানের এ এ নাম–ক্রৌঞ্চানি ত্রীণি]।
৩। অমৃতোপম বিশুদ্ধ পরমানন্দপ্রদ পবিত্রকারক সত্ত্বভাবসমূহ ভগবৎ-প্রাপ্তির জন্য আমাদের হৃদয়ে ক্ষরিত হোন। (ভাব এই যে, আমরা যেন সত্ত্বভাব লাভ করি); হে সত্ত্বভাব! আমাদের হৃদয়স্থিত আপনাদের পরমানন্দদায়ক রস ভগবানের অভিমুখে উধ্বর্গমন করুক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন ভগবানকে প্রাপ্ত হই)। [মন্ত্রটির প্রথম অংশে হৃদয়ে সত্ত্বভাব উপজনের জন্য এবং দ্বিতীয় অংশে প্রত্যক্ষভাবে সত্ত্বভাবকে সম্বোধন করে তার সাহায্যে ভগবৎ-প্রাপ্তির জন্য প্রার্থনা পরিদৃষ্ট হয়]। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানের সংখ্যা আটটি। সেগুলির নাম–ত্বাষ্ট্ৰী সাম, উর্ধ্বেউত্বাষ্ট্রি, বাসিষ্টম, আষ্কারণিধনং ত্বাষ্ট্ৰী, বাসিষ্টম, স্বারত্বাষ্ট্রী, .. দ্বিরভ্যস্তত্বান্ত্রী, বাসিষ্টম]।
৪। সৎ-মার্গের প্রাপক সৎকর্মের সাধনে সখিভূত সত্ত্বভাব আমাদের জন্য হৃদয়ে সমুদ্ভুত হোন; সত্ত্বভাব বিশুদ্ধ, অপাপবিদ্ধ, প্রার্থনীয় এবং সর্বজ্ঞ হন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, –আমরা যেন পরমধনপ্রাপক সত্ত্বভাব লাভ করি)। [সত্ত্বভাব মানুষকে ভগবানের দিকে প্রেরণ করে, ভগবৎ-প্রাপ্তির পথ প্রদর্শন করে। তাই সত্ত্বভাবকে গাতুবিত্তমাঃ সৎমার্গ-প্রদর্শক বলা হয়েছে। যিনি আমাদের এমনতর কল্যাণসাধনের উপায় বিধান করেন তিনিই প্রকৃত মিত্র। পরম প্রার্থনীয় সত্ত্বভাবকে তাই মিত্রাঃ বলা হয়েছে]। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানের নাম ক্রৌঞ্চে দ্বে।
৫। হে শুদ্ধসত্ত্ব! আমাদের আত্মশক্তিপ্রদায়ক, সর্বলোকবরণীয় সকলের পোষক জ্যোতির্ময়, শত্রুনাশক ধন প্রদান করো। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, –আমরা যেন আত্মশক্তিদায়ক পরমধন লাভ করি )। .[সত্ত্বভাব মানুষকে তার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কাম্যবস্তু দিতে পরে, কাজেই সকলে তা পাবার জন্য আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে। সেইজন্যই সত্ত্বভাবকে শতশৃহ বলা হয়েছে। [এই সামমন্ত্রটির গেয়গান পাঁচটি। সেগুলির নাম–সোম সামাণি ত্রীণি, ক্রৌঞ্চং, সোমসাম]।
৬। মাতা যেমন প্রথম বয়সে জাত সন্তানকে আদর করেন, তেমনই রিপুজয়ী ব্যক্তিগণ ভগবানের প্রিয় সকলের আকাঙক্ষণীয় জ্ঞানকে আদরের সাথে গ্রহণ করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক। ভাব এই যে, রিপুজয়ী সাধকগণ পরম আকাঙক্ষণীয় পরাজ্ঞান প্রাপ্ত হন)। [মা সব সন্তানকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসেন। তার মধ্যে আবার প্রথমজাত সন্তান সব চেয়ে বেশী প্রিয় হয়। জীবনের এই প্রথম অপূর্ব অনুভূতি, স্নেহের মূর্তিমান বিগ্রহের আবির্ভাব, মায়ের হৃদয়কে অভিভূত করে ফেলে। এই নবসৃষ্টির আনন্দে তিনি আত্মহারা হয়ে যান। যার দ্বারা এই পরম শান্তি ও তৃপ্তি আসতে পারে। যার দ্বারা (সন্তানহীনদের জন্য নির্দিষ্ট) পুন্নাম নরক থেকে ত্রাণ পাওয়া যায়, সেই সন্তানের প্রতি মায়ের আনন্দের সীমা থাকে না। এই উপমাটির দ্বারা সাধকের হৃদয়ের অবস্থা চিত্রিত হয়েছে। সাধক তেমনি আগ্রহে, তেমনি ব্যাকুলতার সাথে, জ্ঞানলাভের জন্য সচেষ্ট হন; যেমনভাবে মা তার প্রিয়তম সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরেন]। [এই সামমন্ত্রটির গেয়গানের নাম–আঙ্গিরসানি ত্রীণি]।
৭। সৎকর্মনিরত ব্যক্তি সর্বলোক-বরণীয় রিপুবিমর্দক দেবতাকে লাভ করবার জন্য আত্মশক্তি উৎপাদন করেন; শ্রেষ্ঠ সাধক তমোগুণাত্মক রিপু বিনাশের জন্য বিশুদ্ধতা হৃদয়ে উৎপাদন করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, -সাধকগণ ভগবৎ-প্রাপ্তির জন্য রিপুজয়ী এবং পবিত্ৰ-হৃদয় হন)। [এই মন্ত্রের একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ–এই সুশ্রী অসুর সোমের জন্য পুরুষের ধারণযোগ্য ধনুকে গুণ যোজনা করছে। পূজা করবার জন্য পুরোহিতগণ এই অসুরের জন্য শুভ্রবর্ণ বস্ত্র বিস্তার ৫ করছেন, দেবতারা দেখছেন। এই ব্যাখ্যাকার শুক্রাপদে শুভ্রবর্ণ বস্ত্র অর্থ গ্রহণ করেছেন। ভাষ্যকার ঐ পদে শুভ্রবর্ণ দুধের সম্বন্ধ কল্পনা করেছেন। মন্ত্রটির মূলে না থাকলেও দুটি ক্ষেত্রেই সোমরসের কথা আনবার কোন প্রয়োজন পরিলক্ষিত হয় না। শুক্রা পদে বিশুদ্ধ শুভ্রবর্ণের চরমোৎকর্ষ, হৃদয়ের বিশুদ্ধতাকেই লক্ষ্য করে। ঐ বাংলা অনুবাদে অথবা ভাষ্যে যোজনা করছে কর্মের কর্তার উল্লেখ নেই। বিশেষত প্রথমাংশের ব্যাখ্যা মোটেই পরিষ্কার হয়নি। সেটির কোন সঙ্গত অর্থ খুঁজে পাওয়া যায় না। অসুর শব্দে ভাষ্যকার বলবান অর্থ গ্রহণ করেছেন এবং বাংলা অনুবাদকেরও ঐ মত দেখা যায়। কিন্তু অসুরের প্রকৃত অর্থ সুরবিদ্বেষী অর্থাৎ দেবভাববিদ্বেষী। যা দেবভাবের প্রতিকূল, তা-ই অসুর। তাই এখানে অসুর পদের রিপবে–রিপু বিনাশের জন্য অর্থই সঙ্গত। এই রিপু কেমন? –নির্ণিজে, অর্থাৎ তমোগুণাত্মকায়। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানের নাম–গৃৎসমদস্য সূক্তানি চত্বারি]।
৮। সাধককে পরমানন্দ দেবার জন্য যে সত্ত্বভাব-সমস্ত দেবভাবকে নিশ্চিতরূপে প্রাপ্ত হন, অর্থাৎ তাদের সাথে মিলিত হন, সেই পাপহারক, সর্বলোকের স্পৃহণীয়, সৎ-জন-পালক সত্ত্বভাবকে অমৃতের দ্বারা সাধকগণ সর্বতোভাবে শোধন করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, -সাধকগণ অমৃতদায়ক বিশুদ্ধ সত্ত্বভাবকে প্রাপ্ত হন)। [ভাষ্যকার এই মন্ত্রের অন্তর্গত বং পদের অর্থ করেছেন–ববর্ণ অর্থাৎ পিঙ্গলবর্ণ। অন্যত্র তাঁর মত অনুসারেই সোমরস হরিত্বর্ণ। একই জিনিষ, একই অবস্থায়, দুটি বর্ণ হয় কেমন করে? প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে বং পদ সোমরসের বিশেষণরূপে গৃহীত হয়েছে। পালনার্থক ভৃ ধাতু-নিষ্পন্ন বশব্দে পালক, সৎজনের পালক প্রভৃতি ভাবকেই লক্ষ্য করে। এটাই সঙ্গত]। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানের নাম–দ্বিরভ্যন্তমাকূ পারম্]।
৯। সাধক যেমন বিশুদ্ধ সত্ত্বভাব সম্বন্ধীয় জ্ঞান গ্রহণ করেন এবং সাধকগণ যেমন সৎকর্ম সম্পাদন করেন, তেমনই হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ! তোমরা সাধনবিঘ্নকারী রিপুবর্গকে বিনাশ করো, অর্থাৎ বিনাশ করে জ্ঞানসম্পন্ন এবং সৎকর্মের সাধনে রত হও। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধক। ভাব এই যে, –আমরা যেন সৎকর্মান্বিত এবং জ্ঞানসম্পন্ন হই]। [এখানে দুটি উপমা ব্যবহৃত হয়েছে। প্রথমটি মৰ্ত্তঃ ন অর্থাৎ সাধকেরা যেমন জ্ঞান-গ্রহণে আগ্রহান্বিত থাকেন অথবা যেমন জ্ঞান লাভ করেন, তেমনভাবে জ্ঞানলাভে আমরা যেন সচেষ্ট হই–এটাই উপমাটির মর্মার্থ। দ্বিতীয় উপমা-ভৃগবঃ ন মখং। সাধকগণ যেমন সৎকর্ম সাধন করেন, তেমন সৎকর্ম-সাধনের জন্য আত্ম-উদ্বোধনই এই উপমার লক্ষ্য। প্রচলিত ভাষ্য ইত্যাদিতে এই দ্বিতীয় উপমার ব্যাখ্যায় এক আখ্যানের অবতারণা দেখা যায়। –মখ নামক সাধনকর্মরহিত এক ব্যক্তিকে ভৃগুগণ নিহত করেছিলেন। এই উপাখ্যান কোথা থেকে এল, জানা যায় না। আমরা ভৃগু পদে সৎকর্মসাধনশীল অর্থ পূর্বাপর গ্রহণ করেছি, এখানেও সেই অর্থই গৃহীত হয়েছে। মখং শব্দ নিরুক্তে যজ্ঞ সৎকর্ম ইত্যাদিবাচক পর্যায়ভুক্ত। তা হঠাৎ অরাধসং অর্থাৎ সাধনকর্মরহিতং হলো কেমন করে বোঝা যায় না]। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানের নাম—বৈরূপম]।
.
নবমী দশতি
ছন্দ আর্চিক। কোথুমী শাখা। পবমান পর্ব। পঞ্চম অধ্যায়।
দেবতা পবমান সোম ৷
ছন্দ জগতী।
ঋষি ১/২, ৩/৫ কবি ভার্গব, ৪/৬ সিকতা নিবাবরী, ৭ রেণু বৈশ্বামিত্র, ৮ বেন ভার্গব, ৯ বসু ভারদ্বাজ, ১০ বৎসপ্রি ভালন্দন, ১১ অত্রি ভৌম, ১২ পিবত্র আঙ্গিরস ॥
অভি প্রিয়াণি পবতে চনোহিতো নামানি যহহা অধি যে বর্ধতে আ সূর্যস্য বৃহততা বৃহন্নধি রথ বিষুঞ্চমরুহদ বিচক্ষণঃ৷৷ ১. অচোদ্দসো নো ধন্বন্দিবঃ প্র স্বাসো বৃহদ্দেবেষু ইরয়ঃ। বি চিদানা ইষয়ো অরাতয়োহযো নঃ সন্তু সনিষন্তু নো ধিয়ঃ৷ ২৷৷ এষ প্র কোশে মধুম অচিকদদিন্দ্রস্য বজো বপুষো বপুষ্টমঃ। অভ্যততস্য সুদুঘা ঘৃতশ্রুত বাস্রা অর্ষন্তি পয়সা চ ধেনবঃ৷৷৩৷৷ প্রো অযাসীদিন্দুরিন্দ্রস্য নিষ্কৃতং সখা সখন প্র মিনাতি সঙ্গির। মর্য ইব যুবতিভিঃ সমর্ষতি সোমঃ কলশে শতযামনা পথা৷৷ ৪৷৷ ধর্তা দিবঃ পবতে কৃত্বো রসো দক্ষো দেবানামনুমাদ্যো নৃভিঃ। হরিঃ সৃজানো অত্যো ন সত্বভিবৃথা পাজাংসি কৃণুসে নদী৷৷৷৷ বৃষা মতীনাং পবতে বিচক্ষণঃ সোমো অহ্নাং প্রতরীতোষসাং দিবঃ। প্রাণা সিন্ধুনাং কলশী অচিক্রদদিস্য হার্দাবিশ মনীষিভিঃ ৷৷ ৬৷৷ ত্রিরস্মৈ সপ্ত ধেনবো দুদুব্রিরে সত্যামাশিরং পরমে ব্যোমনি। চত্বাৰ্যন্যা ভুবনানি নির্ণিজে চারুণি চক্রে যদৃতৈরবর্ধত ॥৭॥ ইন্দ্রায় সোম সুষুতঃ পরিবাপামীবা ভবতু রক্ষসা সহ। মা তে রসস্য মৎসত দ্রুয়াবিনো দ্রবিণস্বন্ত ইহ সনিত্বন্দবঃ ॥ ৮৷৷ অসাবি সোমো অরুষো বৃষা হরী রাজেব দম্মো অভি গা অচিক্ৰদৎ। পুনানো বারমত্যেষ্যব্যয়ং শ্যেনো ন যোনিং ঘৃতবন্তমাসদৎ ॥ ৯৷৷ প্র দেবমচ্ছা মধুমন্ত ইন্দবোহসিষ্যদন্ত গাব আ ন ধেনবঃ। বহিষদো বচনাবন্ত উধভিঃ পরিস্রতমুষিয়া নিৰ্ণিজং ধিরে। ১০৷৷ অঞ্জতে ব্যঞ্জতে সমঞ্জতে তুং রিহস্তি মধাহভ্যঞ্জতে ॥ সিন্ধোরুহচ্ছাসে পতয়ন্তমুক্ষণং হিরণ্যপাবাঃ পশুমন্দু গৃতে৷৷ ১১। পবমান পর্ব পবিত্রং তে বিততং ব্ৰহ্মণস্পতে প্রভুর্গাত্ৰানি পর্যেষি বিশ্বতঃ। অতপ্ততদূর্ন তদামো অণুতে শৃতাস ই বহন্তঃ সং তদাশত৷ ১২।
মন্ত্ৰার্থ– ১। আত্মশক্তিদায়ক সত্ত্বভাব সকলের প্রিয় অমৃতপ্রবাহ অভিমুখে ক্ষরিত হন। (ভাব এই যে, সত্ত্বভাব অমৃতের প্রবাহের সাথে মিলিত হন)। অমৃতপ্রবাহে এই সত্ত্বভাব সম্যক্ প্রকারে প্রবৃদ্ধ হন; মহান সর্বদর্শী সত্ত্বভাব মহাজ্ঞানমূলক ভগবনপ্রাপক সৎকর্মরূপ ধনকে প্রাপ্ত হন। (ভাব এই যে, বিশুদ্ধ সৰ্বভাব জ্ঞান এবং সৎকর্মের সাথে মিলিত হন। মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক)। [সত্ত্বভাব অমৃত-প্রাপক। মানুষের হৃদয়ে সত্ত্বভাবের উন্মেষ হলেই তিনি অমৃতের সন্ধানে নিজেকে নিয়োজিত করেন। সুতরাং আপনা থেকেই হৃদয় সৎকর্মের প্রতি আসক্ত হয়। তার বাক্য চিন্তা ও কর্মের বাহিরে চলে যায় যত অসৎ। সত্ত্বভাবের সাথে জ্ঞান ও কর্ম মিলিত হলে মানুষের আকাঙ্ক্ষা করবার মতো আর কিছুই থাকে না। যা কিছু মানুষের প্রার্থনীয়, তা সমস্তই তিনি প্রাপ্ত হন। কিন্তু প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে সেই সোমকে সেই মাদকরূপে চিহ্নিত করার অভিপ্রায় দেখা যায়। যেমন–সোমরস অন্ন উৎপাদনকারী। তিনি সকলের প্রীতিকর জলের দিকে ক্ষরিত হচ্ছেন, তিনি প্রবল হয়ে জলের মধ্যে বৃদ্ধি পাচ্ছেন। তিনি নিজে প্রকাণ্ড ও বিচক্ষণ। প্রকাণ্ড সূর্যের বিশ্ববিহারী রথের উপর আরোহণ করলেন। –এই কি বেদবাক্য?]। [এই সামমন্ত্রের ছটি গেয়গানের নাম–কাবম, ঐড়কাবম, বাজসান, বাজজিৎ, বাজজিৎসাম, স্বারকাবম]।
২। স্বতন্ত্র বিশুদ্ধ পাপহারক সত্ত্বভাব ভগবৎপ্রাপ্তির জন্য আমাদের বিশেষভাবে প্রাপ্ত হোন, আমাদের সত্ত্বগুণবর্জিত রিপুগণ শক্তিহীন হোক; আমাদের চিত্তবৃত্তি ইত্যাদি ভগবানকে প্রাপ্ত হোক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন সত্ত্বভাব লাভ করি, রিপুজয়ী হই, তারপর ভগবানকে যেন প্রাপ্ত হতে পারি)। [মন্ত্রটি তিনভাগে বিভক্ত। প্রথমতঃ সত্ত্বলাভ। হৃদয়ে সত্ত্বভাব সঞ্চার হলে মানুষের অন্তরস্থিত রিপুগণ আপনা থেকেই দূরে পলায়ন করে। সাধক-হৃদয়ের অপূর্ব তেজ তারা সহ্য করতে পারে না, বলে আলোকের আগমে পেচকের মতো নরকের অন্ধকারে আত্মবিলোপ করে। হৃদয় থেকে রিপুর উপদ্রব দূরীভূত হলে মানুষ নিরুপদ্রবে সাধনমার্গে অগ্রসর হয়। সুতরাং সহজেই ভগবৎ-চরণে পৌঁছাতে পারে। সাধনা ও সিদ্ধির এই ধারাই এই মন্ত্রে প্রখ্যাপিত, হয়েছে। অথচ প্রচলিত ভাষ্য ইত্যাদিতে সম্পূর্ণ অন্যভাবে মন্ত্রটিকে দেখা হয়েছে। যেমন–যজ্ঞের সময় উজ্জ্বল ও শান্ত-স্বভাব সোমরসগুলি নিষ্পীড়িত হয়ে আমাদের নিকট আগমন করুক, আমাদের অন্নের হিংসাকারী শত্রুবর্গ নষ্ট হোক, আমাদের শত্রুরাও নষ্ট হোক, আমাদে সৎকর্মগুলি দেবতারা গ্রহণ করুন। প্রাচীন ঋষিগণ সোমরসের জন্য ব্যাকুল, তাঁরা তাঁদের অন্ন রক্ষার জন্য ব্যাকুল, শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবার জন্য ব্যাকুল, এমন ব্যাখ্যা বেদ থেকে উদ্ধার করার মধ্যে কৃতিত্ব কোথায় বোঝা যায় না]। [এই সামমন্ত্রের ছটি গেয়গানের নাম–অঙ্গিরসানি ত্ৰীণি, সামরাসম, সোমরাসম, সামরাজন, সিমানাং নিষেধঃ]।
৩। পরমরিপুনাশক, অমৃততুল্য দীপ্তিমান্ হতে পরম দীপ্তিমান্ এই সত্ত্বভাব আমাদের হৃদয়ে প্রকৃষ্ট জ্ঞান প্রদান করেন; অমৃতকামনাকারী জ্ঞানরশ্মিসমূহ যেমন অমৃত-প্রবাহের সাথে মিলিত হয়, সে তেমনই সত্যজ্ঞানবৰ্ষক অমৃতস্রাবী সত্ত্বভাব আমাদের সাথে মিলিত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন সত্ত্বভাব এবং পরাজ্ঞান লাভ করি)। [সত্ত্বভাবকে ইন্দ্রস্য বজ্রঃ বলা হয়েছে। এই বজ্রশক্তি মানে আকাশ থেকে পড়া বজ্র নয়, বজ্রের মতো শক্তি। ভগবান্ যে শক্তির ২ দ্বারা জগতের শত্রু নাশ করেন, অমঙ্গল বিদূরিত করেন, সেই বজ্রশক্তি কখনও মদিরা সোমের থাকতে, পারে না–তা অবশ্যই সত্ত্বভাব। সত্ত্বভাবেরই শক্তিতে পাপ কালিমা বিদূরিত হয়, সত্ত্বভাবের প্রবাহেই তমোজনিত মলিনতা অপবিত্রতা দূরে চলে যায়। তাই এই অমোঘশক্তিসম্পন্ন সত্ত্বভাবকে ভগবানের রিপুনাশক মহাস্ত্র (বজ্র) বলা হয়েছে। শুধু তাই নয়। সত্ত্বভাব বজের চেয়েও কঠোর এবং কুসুমের চেয়েও কোমল। এটি মধুমা–অমৃততুল্যও বটে। যাঁরা সৎকর্মান্বিত সাধক, তাদের পক্ষে এটি পরম মঙ্গলের নিধান। যারা দুর্বলহৃদয়, ক্ষীণশক্তি তাদের পক্ষেও এটি অমৃততুল্য সঞ্জীবনী সুধা। তাদের মধ্যে এই সত্ত্বভাবের উন্মেষ হলে তারা অমিতবলসম্পন্ন হন, জড়তা-হীনতা তাদের কাছ থেকে দূরে পলায়ন করে। সত্যভাব ঋতস্য সুদুঘঃ তা থেকে সত্য ক্ষরিত হয়। সত্ত্বভাবের সঙ্গে সত্য জ্ঞানের অবিচ্ছিন্ন সম্বন্ধ]। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানের নাম–বাসিষ্টম]।
৪। সখিভূত সত্ত্বভাব আমাদের প্রার্থনীয় মুক্তি প্রদান করুন; তিনি সখিভূত ভগবানের উপাসককে হিংসা করেন না; মানুষ যেমন যুবতী সহধর্মিণীর সাথে সম্যক্ প্রকারে মিলিত হয়, তেমনই ভাবে সত্ত্বভাব সকল রকমে আমাদের হৃদয়ে আগমন করুন, অর্থাৎ আমাদের সাথে সম্যক্ প্রকারে মিলিত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, পূর্ণভাবে মুক্তিদায়ক সত্ত্বভাবকে আমরা যেন লাভ করি)। [প্রচলিত বঙ্গানুবাদ–সোম ইন্দ্রের উদরে প্রবেশ করেন, কারণ ইন্দ্র তার বন্ধু। তিনি ইন্দ্রের উদরের কোন অনিষ্ট করেন না। মানব যেমন যুবতীদের সাথে মিলিত হয়, তেমনই ইনি শতছিদ্র পথ দিয়ে নির্গত হয়ে জলের সাথে মিশ্রিত হয়ে যাচ্ছেন। পেটে মদিরা (সোম) পড়লে তা যে কেমন অনিষ্ট করে না, তা জানা নেই। যুবতীদের সাথে মিলনও কি সুরার অবদান? যাই হোক, এই মন্ত্রের দুটি পদ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রথমটি ইন্দুর পদের বিশেষণ সখা। সত্ত্বভাব আমাদের পরম বন্ধুর মতো উপকারী। মানুষের পরম আকাঙক্ষণীয় বস্তু মুক্তি। সত্ত্বভাব সেই মুক্তি দান করতে পারে। তাই সত্ত্বভাব মানুষের মিত্র। দ্বিতীয়টি ইস্য পদের বিশেষণ সখৃঃ। ভগবানও মানুষের পরম বন্ধু। তাঁর কৃপাতেই মানুষ বেঁচে আছে, জীবনের যা পরম বস্তু, তা-ও পাচ্ছে। সকল সময়ে সকলেরই বন্ধু তিনি]। [এই সামমন্ত্রের ঋষি –ঋষিগণ (মতান্তরে সিকতা নিবাবরী)। এর পাঁচটি গেয়গান আছে। সেগুলির নাম–লৌশম, উত্তরলৌশম, প্রবদ্ভার্গবম, তন্ত্রম, যামম]।
৫। সকলের ধারণকর্তা, স্বর্গজাত, অমৃতময়, বিশুদ্ধ, দেবভাবসম্পন্নদের শক্তিদায়ক, সাধকদের দ্বারা স্তবনীয় অর্থাৎ সাধকবর্গের প্রার্থনীয় সত্ত্বভাব আমাদের হৃদয়ে সমুদ্ভুত হোন। (ভাব এই যে, আমরা যেন পরম মঙ্গলজনক সত্ত্বভাব লাভ করি)। সৎকর্ম যেমন শক্তিপ্রদান করে, তেমন মানুষবর্গের হৃদয়ে উৎপন্ন হয়ে পাপহারক সত্ত্বভাব আপনা-আপনিই হৃদয়ে বল প্রদান করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, –সত্ত্বভাব পাপনাশক এবং আত্মশক্তিদায়ক হন)। [প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে সোমরসের (মদিরার) সম্বন্ধ করা হয়েছে। কিন্তু এই দ্বিধাবিভক্ত মন্ত্রটির উভয় অংশেই সোম অর্থাৎ সত্ত্বভাবের মহিম প্রখ্যাপিত হয়েছে। এবং প্রথমাংশে বিশেষ ভাবে সত্ত্বভাব প্রাপ্তির জন্য প্রার্থনা আছে। সত্ত্বভাব কেবল দ্যুলোকেরই নয়, তা সর্বলোকের ধারণকর্তা। সত্ত্বভাব অমৃতময়, অমৃতপ্রাপক। সত্ত্বভাব মানুষের হৃদয়ে দিব্যশক্তি তথা স্বর্গীয় শক্তি দান করে। তারই নাম দেবভাব। এ এই শক্তি দ্বারা চালিত হয়ে মানুষ অমৃতস্বরূপ ভগবানের চরণ লাভ করতে পারেন]। [এই মন্ত্রের গেয়গানের নাম–বাৎসশিরসী দ্বে]।
৬। স্তোতাদের অভীষ্টবর্ষক, সর্বজ্ঞ সত্ত্বভাব আমাদের হৃদয়ে সমুদ্ভুত হোন। ( ভাব এই যে, আমরা যেন সত্ত্বভাব লাভ করি )। তিনি জ্ঞান ও জ্ঞানের উন্মোষিকা দেবী (উষষং) এবং দেবভাবের বর্ধনকারী হন; অমৃতপ্রবাহের কর্তা সত্ত্বভাব আমাদের হৃদয়ে ধারারূপে প্রবেশ করুন; তিনি আমাদের স্তুতির সাথে ভগবানের নিকটে গমন করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, প্রার্থনার দ্বারা আমরা যেন ভগবানকে লাভ করি )। সত্ত্বভাব জ্ঞানের বর্ধনকারী। জাগতিক জ্ঞানকে বিশুদ্ধ পরাজ্ঞানে পরিণত করতে পারে সত্ত্বভাব। শুদ্ধসত্ত্বই দেবভাবকে ডেকে আনে, মানুষকে দেবতা করে। [এই সামমন্ত্রের ঋষি–ঋষিগণ (মতান্তরে সিকতা নিবাবরী )৷ এর গেয়গানের নাম–ঐড্যাসম, যামম]।
৭। দ্যুলোকে স্থিত সত্ত্বভাবকে পাবার জন্য অর্থাৎ তার সাথে মিলিত হবার জন্য সমস্ত জ্ঞানরশ্মি যথার্থ লোকদের আশ্রয়স্বরূপ শত্রুকে দোহন করে। (ভাব এই যে, –সত্ত্বভাব প্রাপ্তির জন্য জ্ঞান : সত্যাশ্রয়ী হয় )। যখন সত্ত্বভাব সত্যের দ্বারা প্রবর্ধিত হন, তখন তিনি তমোগুণাত্মক অমঙ্গলকে বিনাশ করবার জন্য সকল ভুবনকে অর্থাৎ বিশ্বকে মঙ্গলপূর্ণ করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, সত্যজ্ঞানসমন্বিত সত্ত্বভাব জগতের হিত সাধন করেন)। [মন্ত্রটি অত্যন্ত জটিল। ভাষ্যে ৰা ব্যাখ্যা ইত্যাদিতেও মন্ত্ৰার্থ খুব স্পষ্ট হয়নি। কেউ কেউ ত্রিসপ্ত পদে (৩x৭=২১) একুশ অর্থ গ্রহণ করেছেন। কিন্তু একুশটি গাভী এই বাক্যাংশের দ্বারা কি অর্থ সূচিত হতে পারে, তা বোঝা যায় না। গাভীসমূহের সংখ্যাই বা নির্দিষ্ট হবে কেন? ভাষ্যকার অবশ্য দ্বিতীয় অর্থের ব্যাখ্যায় একটি রূপকমাত্রের অনাবশ্যক অবতারণা করেছেন। কিন্তু এমন স্থলে অর্থাৎ ত্রিসপ্ত-এর মতো সংখ্যাবাচক শব্দে বহুৰ্থে অর্থাৎ বহুসংখ্যক বা সর্ব অর্থই গ্রহণ করা সমীচীন]। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানের নাম—মরুতান্ধেনুসাম]।
৮। হে সত্ত্বভাব! বিশুদ্ধ আপনি ভগবৎপ্রাপ্তির জন্য আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন। ভবব্যাধি রিপুদের সাথে নিরাকৃত হোক। কপটচারী ব্যক্তিগণ অমৃত লাভে পরমানন্দ প্রাপ্ত হয় না; সত্ত্বভাবসমূহ আমাদের হৃদয়ে অমৃতস্রাবী হোন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক এবং প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, আমরা সত্ত্বভাব লাভ করে যেন রিপুজয়ী হই, যেন ভগবানকে প্রাপ্ত হই; পাপীব্যক্তি সত্ত্বভাব লাভ করতে সমর্থ হয় না)। [বাহিরে খুব সত্ত্বভাবের আড়ম্বর দেখিয়ে মানুষের কাছে অন্ততঃ কিছুকালের জন্য প্রতিপত্তি লাভ করা যায়, কিন্তু ভগবানের সেই সহস্র চক্ষুকে, যা অনিমেষে বিশ্বকে পরিদর্শন করছে, তাকে ফাঁকি দেওয়া যায় না। মানুষকে প্রতারণা করতে গিয়ে স্বভাবতঃই সর্বনাশকারী আত্ম-প্রতারণা এসে পড়ে। সেটি ক্রমশঃই আলেয়ার আলোর মতো মানুষকে গভীর থেকে গভীরতম পাপপঙ্কে পতিত করে। ভগবৎসাধনা অন্তরের কাজ। হৃদয়ের পূজাই প্রকৃত পূজা। হৃদয়ের বিশুদ্ধতা না থাকলে এই পূজা সার্থকতা লাভ করে না। মন্ত্রের প্রথম অংশে সত্ত্বভাব লাভের জন্য, দ্বিতীয়ভাগে রিপুনাশ ও ভবব্যাধি নাশের জন্য প্রার্থনা আছে। তৃতীয় অংশে নিত্যসত্য প্রখ্যাপিত আছে এবং শেষাংশে আছে সত্ত্বভাব প্রাপ্তি ও রিপুনাশের জন্য প্রার্থনা]। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানের নাম–অপাপীবম, বায়োবভিদঃন]।
৯। অজাতশত্রু, অভীষ্টবর্ষক, পাপহারক, পরম রমণীয়, আমাদের হৃদয়স্থিত সত্ত্বভাব বিশুদ্ধ হয়ে এ জ্ঞানের সাথে সম্মিলিত হোন; পবিত্রকারক তিনি অমৃতের প্রবাহকে প্রাপ্ত হন; ক্ষিপ্রগতিশীল সাধক এ যেমন ভগবানকে প্রাপ্ত হন, তেমনভাবে সত্ত্বভাব আমাদের হৃদয়কে অমৃতময় করে প্রাপ্ত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, –জ্ঞানসমন্বিত অমৃতপ্রাপক সত্ত্বভাবকে আমরা যেন লাভ করি)। [শেনঃ ন পদ দুটির দ্বারা প্রার্থনাকারীর মনের একটা ধারার সন্ধান পাওয়া যায়। ক্ষিপ্রগতিশীল, অর্থাৎ সম্পূর্ণভাবে ভগবানে আত্মসমর্পিত, সৎকর্মান্বিত সাধক যেমন আশুমুক্তি প্রাপ্ত হন, ঊর্ধ্বগতিশীল সাধক যেমন ভগবানের চরণে শীঘ্রই আত্মবিলয় করেন, তেমনি ভাবে, তেমনি ক্ষিপ্রতার সাথে অমৃতপ্রাপক সত্ত্বভাব আমাদের হৃদয়ে উপজিত হোক; আমাদের হৃদয়কে অমৃতের প্লাবনে অভিষিত করুক। -মন্ত্রের প্রার্থনায় এই সুরই ধ্বনিত হয়ে উঠেছে। হৃদয়ে বিশুদ্ধ সত্ত্বভাবের সঞ্চার হলে হৃদয় অমৃতময় হয়]। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানের নাম–যামানি ত্ৰীণি]।
১০। জ্ঞানকিরণসমূহ যেমন সাধককে আশ্রয় করে, তেমনই জ্ঞানযুক্ত, অমৃতময়, আমাদের হৃদয়স্থিত সত্ত্বভাব ভগবানের প্রতি গমন করুক। (ভাব এই যে, –সত্ত্বভাবের প্রভাবে আমরা যেন ভগবানকে লাভ করি)। আমাদের হৃদয়স্থিত জ্ঞানদায়ক জ্যোতিঃকণাসমূহ অমৃতের প্রবাহের দ্বারা পরিষ্কৃত–বিশুদ্ধীকৃত হয়ে সত্ত্বভাবকে ধারণ করুক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন জ্ঞানসমন্বিত সত্ত্বভাব লাভ করি)। [সত্ত্বভাব সর্বত্রই বিদ্যমান আছে; যেমন সর্ব ভূতে ভগবান্ বিরাজিত আছেন। আমাদের প্রকার ভেদে সেই সত্ত্বভাব প্রকাশের পার্থক্য হয় মাত্র। সুতরাং বীজের আকারে আমাদের হৃদয়স্থ সত্ত্বভাবকে বিকশিত করে তোলবার জন্য সাধনার প্রয়োজন। সাধক প্রার্থনা ও আরাধনা করেন–হৃদয়কে পবিত্র করে নির্মল করে তাতে ভগবানের শক্তিবিকাশের জন্য। এই মন্ত্রে সেই অন্তরস্থায়ী শক্তিবীজের বিকাশের জন্যই প্রার্থনা করা হয়েছে। এখানে ধেনয়ঃ ন আঅর্থে জ্ঞানকিরণসমূহ যেমন সাধককে আশ্রয় করে, তেমন বোঝাই সঙ্গত। গাবঃ–জ্ঞানাগ্নি, জ্ঞানযুক্ত। মধুমন্ত –অমৃতময়। ইন্দবঃসত্ত্বভাব, আমাদের হৃদয়স্থিত সত্ত্বভাব। উদভিঃ– অমৃতপ্রবাহের দ্বারা]। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানের নাম-মরুতান্ধেনু]।
১১। সাধকগণ সত্ত্বসমুদ্রের তরঙ্গে পতনশীল, অর্থাৎ সত্ত্বভাবের প্রাপক, অভীষ্টের বর্ষক সৎকর্ম সম্যকপ্রকারে সম্পাদন করেন, অমৃতের সাথে মিশ্রিত করেন। (ভাব এই যে, -সাধকেরা সত্ত্বভাবের প্রাপক অমৃতময় সৎকর্মগুলি সাধন করেন); পবিত্ৰহৃদয় সাধকগণ অজ্ঞানতাকে অমৃতের প্রবাহে নিয়ে যান। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য প্রখ্যাপক। ভাব এই যে, সাধকেরা অমৃতের দ্বারা অজ্ঞানতা দূর করেন)। [সাধকগণ সৎকর্মগুলি সম্পাদন করেন। সাধনার ঐকান্তিকতা বোঝাবার জন্য অঞ্জতে ব্যঞ্জতে সমঞ্জতে প্রভৃতি পদগুলি ব্যবহৃত হয়েছে। সাধকেরা কেবল বাহ্য আড়ম্বরের জন্য সৎকর্মপরায়ণ .. হন না, পরন্তু তাঁদের সমস্ত হৃদয়-মন তাতে ঢেলে দেন। তাঁদের প্রত্যেক নিঃশ্বাস পতনেও সৎকর্মের চিন্তা জাগরূক থাকে। সেই সত্ত্বভাবের স্বরূপ বোঝাবার জন্যই কয়েকটি বিশেষণ ব্যবহৃত হয়েছে। সিন্ধোরুচ্ছ্বাসে পতয়ন্তং–সত্ত্বসমুদ্রের তরঙ্গে পতনশীল অর্থাৎ সত্ত্বভাবপ্রাপক। সৎকর্ম স্বভাবতঃই সত্ত্বভাবের সাথে মিলিত হয়। সাধকের পবিত্রহৃদয়ে অর্থাৎ সত্ত্বভাব-উপজিত হৃদয়ে অজ্ঞানতা থাকতে পারে না। অজ্ঞানতা তাদের হৃদয়ের অমৃতময় পবিত্রতায় ডুবে যায়, অজ্ঞানতার অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়]। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানের নাম–শার্গনি ত্ৰীণি]।
১২। হে পরমব্রহ্ম! আপনার পবিত্রতা সর্বত্র ব্যাপ্ত আছে; সকলের অধীশ্বর আপনি সর্বতোভাবে আমাদের (অথবা বিশ্ববাসী সকলকে), প্রাপ্ত হোন। (ভাব এই যে, -সকল লোক ভগবানকে প্রাপ্ত হোন)। অপরিপক্কমতিজন শান্তিদায়ক আপনাকে লাভ করে না; সত্যশীল জ্ঞানীবর্গ আপনাকে প্রাপ্ত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক। ভাব এই যে, সত্যের দ্বারা জ্ঞানের দ্বারা ভগবানকে পাওয়া যায়)। [ব্ৰহ্মণস্পতি-জ্ঞানাধিপতি, পরমব্রহ্ম। তিনি এই বিশ্ব ব্যেপে রয়েছেন। এই বিশ্ব তারই বিভূতির বহিঃপ্রকাশমাত্র। যা কিছু হয়েছে, হচ্ছে বা হবে–সমস্তই তার বিভূতি। সত্যশীল জ্ঞানিবর্গ সেই বিশ্বাধীশ্বর জগৎ-নিয়ন্তা পরম পুরুষকে লাভ করতে সমর্থ হন; কারণ তিনি জ্ঞানের দ্বারাই লভ্য। অদূরদর্শী ব্যক্তিগণ, জ্ঞানের অভাবের জন্যই, আপাতমনোহর সুখের সন্ধানে ব্যাপৃত থেকে সেই পরম বস্তু লাভ করতে পারে না। –এই মন্ত্রের মধ্যে একটি বিশ্বজনীন ভাবও আছে। এখানে বিশ্বের সকলেই যাতে মোক্ষলাভ করতে পারে, তার জন্য ভগবানের কাছে প্রার্থনা করা হয়েছে]। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানের নাম–অক্কপুষ্পম, অক্কপুষ্পোত্তরম]।
.
দশমী দশতি
ছন্দ আর্চিক। কৌথুমী শাখা। পবমান পর্ব। পঞ্চম অধ্যায়।
দেবতা পবমান সোম ৷
ছন্দ উষ্ণিক।
ঋষি ১।৭।১১ চাক্ষুষ অগ্নি, ২ মানব চক্ষু, ৩।১০ পর্বত ও নারদ কাণ্ব (শিখণ্ডিনী ও অপ্সরা কাশ্যপা), ৪।৯ পর্বত ও নারদ কাণ্ব, ৫ ত্রিত আপ্তা, ৬ আপসব মনু, ৮।১২ দ্বিত আপ্তা।
ইন্দ্ৰমচ্ছ সুতা ইমে বৃষণং যন্তু হরয়ঃ। শুষ্টে জাতাস ইন্দবঃ স্ববিদঃ ॥১॥ প্র ধন্বা সোম জাগৃবিরিন্দ্রায়েন্দো পরি সব। দ্যুমন্তং শুম্মা ভর স্ববিদ৷ ২৷৷ সখায় আ নিষীদত পৃনানায় প্র গায়ত। শিশুং ন যজ্ঞৈ পরিভূষত শিয়ে৷৷ ৩৷৷ তং বঃ সখায়ো মদায় পুনানমভি গায়ত। হব্যৈঃ স্বদয়ন্ত গুৰ্তিভিঃ৷৷ ৪৷৷ প্রাণা শিশুমহীনাং হিমৃতস্য দীধিতি। বিশ্ব পরি প্রিয়া ভূবদধ দ্বিতা৷৷৷৷ পবস্ব দেববীতয় ইন্দো ধারাভিরোজসা। আ কলশং মধুমাৎসোম নঃ সদঃ ॥ ৬৷ সোমঃ পুনান ঊর্মিণাব্যং বারং বি ধাবতি। অগ্রে বাচঃ পবমানঃ কনিকদৎ৷৷ ৭৷ প্র পুনায় বেধসে সোমায় বচ উচ্যতে। ভৃতিং ন ভরা মতিভিৰ্জুজোষতে৷৷ ৮৷৷ গোমন্ন ইন্দো অশ্ববৎসুতঃ সুদক্ষ ধনিব। শুচিং চ বর্ণমধি গোষু ধারয়৷৷৷৷ অস্মভ্যং ত্বা বসুবিদমভি বাণীরনুষ। গোভিষ্টে বর্ণমভি বাসয়ামসি৷৷ ১০৷৷ পবতে হতো হরিরতি হরাংসি রংহ্যাঁ। অভ্যর্ষ স্তোতৃভ্যো বীরব যশঃ ॥১১৷৷ পরি কোশং মধুশ্রুতং সোমঃ পুনাননা অৰ্ষতি। অভি বাণীষীণাং সপ্তানূষত ৷৷ ১২৷৷
মন্ত্ৰাৰ্থ— ১। আশুমুক্তিদায়ক, সর্বজ্ঞ, আমাদের হৃদয়ে উৎপন্ন, পাপহারক, সত্ত্বভাব বিশুদ্ধ হয়ে অভীষ্টবর্ষক ভগবানের প্রতি গমন করুক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, -সত্ত্বভাবের সহায়ে আমরা যেন ভগবানকে প্রাপ্ত হই)। [এই সামমন্ত্রটির পাঁচটি গেয়গানের নাম–পদে দ্বে, অনুপদে ছে, পৌষ্কলম্]।
২। হে শুদ্ধসত্ত্ব! চৈতন্যস্বরূপ আপনি আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন; হে সত্যভাব! আপনি ভগবৎ প্রাপ্তির জন্য আমাদের হৃদয়ে সমুদ্ভুত হোন; এবং আমাদের দীপ্তিযুক্ত পরাজ্ঞানসমন্বিত রিপুনাশক বল প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, -ভগবৎপ্রাপ্তির জন্য যেন পরাজ্ঞানসমন্বিত রিপুনাশক সত্ত্বভাব লাভ করি)। [মন্ত্রের প্রথম ভাগে সত্ত্বভাবপ্রাপ্তির জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। কিন্তু সত্ত্বভাব প্রাপ্তিই কি জীবনের চরম লক্ষ্য? এই প্রশ্নের উত্তর স্বরূপই যেন বলা হয়েছে ইন্দ্রায় পরিব–ভগবৎ প্রাপ্তির জন্য ক্ষরিত হও–আমাদের হৃদয়ে উপজিত হও। সত্ত্বভাব অবশ্যই কাম্যবস্তু, কিন্তু সেটি সেই পরম অভীষ্টের অর্থাৎ ভগবৎ-প্রাপ্তির উপায় মাত্র; কারণ হৃদয়ে সত্ত্বভাব সঞ্চারিত হলেই ভগবানকে লাভ করা যায়। মন্ত্রে সাধনা ও সিদ্ধির এই ধারারই পরিচয়– পাওয়া যায়। আবার সত্ত্বভাব উপজিত হলে সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞানজ্যোতিঃও এসে পড়েরিপুগণ দূরে পলায়ন করে। মন্ত্রের শেষাংশে তা-ই প্রখ্যাত হয়েছে। [এই মন্ত্রের পাঁচটি গেয়গানের নাম– ঐষিরাণি]।
৩। সৎকর্মে সখিভূত হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ! তোমরা ভগবানকে আরাধনা করো; ভগবৎপ্রাপ্তির জন্য প্রার্থনাপরায়ণ হও; শোভাসম্পাদনের জন্য মানুষ যেমন শিশুকে ভূষিত করে, তেমনভাবে সৎকর্মসাধনের দ্বারা ভগবানকে অলঙ্কৃত করো, অর্থাৎ তাকে পূজা করো। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমি যেন ভগবানকে লাভ করার জন্য পূজাপরায়ণ হই)। [যিনি মনকে জয় করেছেন, তিনি জগৎকে জয় করেছেন। প্রকৃতপক্ষে মনই মানুষকে উন্নতি বা অবনতির পথে নিয়ে যায়। যখন মন মানুষকে সৎপথে নিযুক্ত করে, তখন সে মানুষের পরম বন্ধু। কারণ এই সৎকর্মের সাধনার দ্বারাই মানুষ মোক্ষপথে অগ্রসর হয়। আবার মনকে বশীভূত করা, মনের উপর আধিপত্য। করা সহজ কাজ নয়। তাই মনের বন্ধুত্বলাভই মঙ্গলকর বলে বিবেচিত হয়। মন্ত্রের উপমা শিশুকে যেমন মানুষ (অথবা তার পিতা) অলঙ্কার দ্বারা ভূষিত করে, তেমনভাবে আমরা যেন সৎকর্মের দ্বারা ভগবানকে ভূষিত করি। মর্মার্থ এই যে, -[শিশুকে যেমন স্নেহের সাথে, আনন্দের সাথে, মানুষ উপহার প্রদান করে। তেমনি আনন্দ ও ভক্তির সাথে আমরা যেন ভগবানের চরণে আমাদের প্রার্থনা নিবেদন করতে পারি]। এই সামমন্ত্রের পাঁচটি গেয়গানেরই নাম–শৌক্তানি]।
৪। সৎকর্মে সখিভূত হে আমার চিত্তবৃত্তিনিবহ! তোমরা পরমানন্দলাভের জন্য পবিত্রকারক ভগবানকে পূজা করো; মানুষ যেমন শিশুকে ক্ষীর ইত্যাদি দ্বারা তৃপ্ত করে, তেমন ভাবে সৎকর্ম সাধন ও প্রার্থনা দ্বারা ভগবানকে আরাধনা করো। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, — ভগবনপ্রাপ্তির জন্য আমি যেন সৎকর্মসমন্বিত প্রার্থনাপরায়ণ হই)। ( এই সামমন্ত্রের তিনটি গেয়গানেরই নাম কার্ণশ্রবসামি]।
৫। মহত্ত্বসম্পন্ন সৎকর্মসাধনকর্তা সত্যের জ্যোতিঃ জগতে প্রকাশিত করেন; এবং তিনি স্বর্গে ও পৃথিবীতে বর্তমান সকল প্রিয় বস্তু প্রাপ্ত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক। ভাব এই যে, –সৎকর্মসাধক সকল অভীষ্ট লাভ করেন)। [ভগবানের কৃপাধন্য মহাপুরুষদের জীবনে ভগবানের অসামান্য করুণার পরিচয় পেয়ে সাধারণ মানুষ ভক্তিভরে তাঁর চরণে প্রণত হয়, –সেই পরম করুণাময়ের কৃপা লাভ করার জন্য আত্মনিয়োগ করে। তিনি মহত্ত্বসম্পন্ন, সৎকর্মপরায়ণ, তিনি তার সকল কাম্যবস্তুই লাভ করেন–ভগবান্ তার কোন কামনাই অপূর্ণ রাখেন না। ইহলোকে ও পরলোকে স্বর্গে ও মর্ত্যে, কোথাও তার কামনা করবার কিছু থাকে না]। [এই সামমন্ত্রের ঋষি–ত্রিত। এর গেয়গানের নাম–বাচঃ সামনী দ্বে, ইন্দ্রাসামনী দ্বে, মরুতাং প্রেঙ্খম]।
৬। হে শুদ্ধসত্ত্ব! আপনি ভগবৎপ্রাপ্তির জন্য আত্মশক্তির সাথে প্রভূত পরিমাণে আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন; হে শুদ্ধসত্ত্ব! অমৃতময় আপনি আমাদের প্রাপ্ত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবৎপ্রাপ্তির জন্য আমাদের হৃদয়ে অমৃতপ্রাপক সত্ত্বভাব আবির্ভূত হোন)। সিত্ত্বভাব অমৃতপ্রাপক। এই শুদ্ধসত্ত্ব হৃদয়ে উপজিত হলে মানুষ অমর হয়। দেবতাগণ এই সত্ত্বভাবের অধিকারী–তাই তারা অমর]। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানের নাম–প্রাজাপত্যে দ্বে]।
৭। পবিত্রকারক সত্ত্বভাব ধারারূপে জ্ঞানপ্রবাহকে বিশেষভাবে প্রাপ্ত হন; অর্থাৎ জ্ঞানের সাথে মিলিত হন; পবিত্রকারক তিনি আমাদের স্তোত্র লাভ করে আমাদের জ্ঞান প্রদান করুন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক এবং প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, সত্ত্বভাব ও জ্ঞানের মধ্যে অচ্ছেদ্য সম্বন্ধ বর্তমান আছে। আমরা যেন জ্ঞানসমন্বিত সত্ত্বভাব লাভ করি)। [ভগবানের দুই শক্তি–জ্ঞান ও সত্ত্বভাব বা শুদ্ধসত্ত্ব–একত্র অবস্থিতি করে। মন্ত্রের দ্বিতীয় অংশে সত্ত্বভাবের কাছে পরোক্ষভাবে প্রার্থনা করা হয়েছে তিনি কৃপা করে, আমাদের জ্ঞান প্রদান করুন। সত্ত্বভাবসমুদ্ভূত যে জ্ঞান, তাই পরাজ্ঞান। তার দ্বারাই মানুষ মুক্তি লাভে সমর্থ হয়। এই মন্ত্রে সেই পরাজ্ঞান লাভের জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। প্রচলিত ব্যাখ্যায় বলা হচ্ছে–ক্ষরণশীল সোম (অবশ্যই মদিরা) শব্দ করেছেন, তাঁর সামনে স্তুতিবাক্য উচ্চারিত হচ্ছে; তিনি শোধিত হতে হতে তরঙ্গের আকারে মোষের লোম অতিক্রম করছেন। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন]। [এই সামমন্ত্রের ছটি গেয়গানের নাম-সুজ্ঞানে দ্বে, দ্যৌতে দ্বে, অতিবাদীরে দ্বে]।
৮। হে আমার মন! পবিত্রকারক সৎকর্মের বিধাতা সত্ত্বভাবকে লাভ করবার জন্য তোমার কর্তৃক প্রার্থনা উচ্চারিত হোক। (ভাব এই যে, –সত্ত্বভাব প্রাপ্তির জন্য আমি যেন প্রার্থনাপরায়ণ হই)। মানুষ যেমন উপকারী কর্মসাধককে পুরস্কার প্রদান করে, তেমনভাবে স্তুতির দ্বারা প্রীত দেবতাকে স্তুতি প্রেরণ করো অর্থাৎ আরাধনা করো। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধক। ভাব এই যে, ভগবানকে লাভ করবার জন্য আমি যেন সর্বতোভাবে পূজাপরায়ণ হই)। [ভগবান্ প্রার্থনার দ্বারা প্রীতি লাভ করেন। প্রার্থনাই ভগবৎপূজার শ্রেষ্ঠ উপকরণ। প্রার্থনার শক্তিতে মানুষ নিজে যেমন উন্নত হয়, ভগবানও তেমনি সাধকের দিকে অগ্রসর হন। প্রার্থনার শক্তির মধ্য দিয়েই মানুষ সেই সকলশক্তির উৎস ভগবানের সাথে মিলিত হয়]। [এই সামমন্ত্রের চারটি গেয়গানের নাম–সোমসামানি চত্বারি]।
৯। মহাশক্তিসম্পন্ন হে সত্ত্বভাব! বিশুদ্ধ আপনি আমাদের ব্যাপকজ্ঞানযুক্ত পরাজ্ঞানরূপ ধন প্রদান করুন; তারপর আমাদের জ্ঞানযুক্ত হৃদয়ে পবিত্র অমৃত প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! আমাদের অমৃতত্ব প্রাপ্ত করান)। [মন্ত্রের মধ্যে সিদ্ধিলাভের যে ক্রম বিধৃত হয়েছে, তা লক্ষ্য করবার বিষয়। প্রথমে পরাজ্ঞান লাভের জন্য প্রার্থনা। সত্ত্বভাবের কাছে প্রার্থনার দ্বারা তা বোঝা যায়–প্রথমে সত্ত্বভাব প্রাপ্তি, তারপর পরাজ্ঞান লাভ। জ্ঞানলাভের পর অমৃতত্বের প্রাপ্তি। মন্ত্রে সাধনার এই ক্রমই বর্ণিত হয়েছে। অথচ সোমকে মাদকরূপে চিহ্নিত করে প্রচলিত এক বঙ্গানুবাদে বলা হয়েছে–হে সোম! তোমার শুভ্রবর্ণ রস আমি দুগ্ধের সাথে মিশ্রিত করছি, তোমার বর্ণ অতি চমৎকার; তোমাকে প্রস্তুত করা হয়েছে; তুমি আগমন করো এবং গো-অশ্ব সঙ্গে নিয়ে এস। –প্রাচীন বৈদিক ঋষিদের ভাঙখোর রূপে প্রতিপন্ন করবার পক্ষে এই অনুবাদ খুবই উপযোগী সন্দেহ নেই]। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানের নাম উল্লেখিত নেই]।
১০। হে ভগবান্! আমাদের পরমধন দান করবার জন্য পরমধনদাতা আপনাকে আমাদের বাক্যসমূহ স্তুতি করছে অর্থাৎ আমরা স্তুতি করছি; আপনি জ্ঞানের সাথে আপনার অমৃত আমাদের প্রদান করুন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, –হে ভগবন! প্রার্থনাকারী আমাদের কৃপা পূর্বক জ্ঞানামৃত প্রদান করুন)। [ভগবান্ পরমধনদাতা। তার ধনরাশি জগতে অবিরত বর্ষিত হচ্ছে। তাঁর সেই অসীম দান অধিকারী ও অনধিকারী সকলেই পেতে পারে, কেউই প্রত্যাখ্যাত হয় না। তবু এই ধনলাভের জন্য প্রার্থনা কেন? প্রার্থনা, তাঁর দান ধারণ করবার উপযোগী শক্তিলাভের জন্য]। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানের নাম উল্লেখিত নেই]।
১১। হে ভগবন! পরম আকাঙ্ক্ষণীয় পাপহারক সত্ত্বভাব ক্ষিপ্রগতিতে আমাদের কুটিল হৃদয়কে প্রাপ্ত হোক। (ভাব এই যে, আমরা যেন পাপনাশক সত্ত্বভাব লাভ করি)। হে দেব! আপনি প্রার্থনাকারী আমাদের আত্মশক্তিদায়ক সঙ্কীর্তি অর্থাৎ সৎকর্মসাধনের সামর্থ্য প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন ভগবানের কৃপায় আত্মশক্তি এবং সৎকর্মসাধনের সামর্থ্য লাভ করি)। [মানুষ কর্ম করতে পারে বটে, কিন্তু ফললাভ ভগবানের কৃপার উপর নির্ভর করে। সৎকর্মের অনুষ্ঠানের দ্বারা মোক্ষপথে অগ্রসর হওয়া যায় সত্য, কিন্তু সেই সৎকর্ম সম্পাদনের উপযোগী শক্তিলাভ সকলের ভাগ্যে ঘটে না। ভগবানের কৃপা না হলে মানুষ সৎকর্মে আত্মনিয়োগ করতে পারে না। চারিদিকের ভীষণ রিপুকুল, অন্তরের কাম-ক্রোধ ইত্যাদি রিপুদল, পদে পদে মানুষকে সৎকর্মের সাধনে, সৎ-চিন্তার ধারণে বাধা দেয়। দুর্বল মানুষ। পদে পদে তার পা পিছলিয়ে যায়। এই দুর্বলতা, এই রিপুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে হলে তাঁর চরণে শরণ গ্রহণ ব্যতীত উপায় নেই। তিনি কৃপা করলে মানুষের হৃদয়ে ঐশীশক্তির সঞ্চার করতে পারেন। সেই শক্তি লাভ করলে, তবেই মানুষ বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করতে পারে, মোক্ষপথে অগ্রসর হতে সমর্থ হয়। তাই সেই পরমশক্তির আধার ভগবানের চরণে আত্মশক্তির জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে]। [এই সামমন্ত্রের। গেয়গানের নাম-যশাংসি ত্ৰীণি]।
১২। পবিত্রকারক সত্ত্বভাবের অমৃত আমাদের হৃদয়কে প্রাপ্ত হোক; সেই অমৃতকে জ্ঞানিগণের বহুবিধ প্রার্থনা (অথবা সপ্তছন্দ) আরাধনা করছে, অর্থাৎ জ্ঞানিগণ অমৃত প্রার্থনা করেন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, জ্ঞানিগণের প্রার্থনীয় অমৃত আমরা যেন লাভ করতে পারি)। [মূলতঃ মানুষ ও দেবতার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। অমৃত লাভে মানুষও দেবতা হতে পারে। জ্ঞানিগণ ভগবানের সেই পরম চরণামৃত লাভ করে অমর হন, –দেবত্ব প্রাপ্ত হন। জ্ঞানিগণের পদাঙ্ক অনুসরণ করে সাধারণ মানুষও সেই দেবত্ব লাভের জন্য উন্মুখ হয়, মন্ত্রের মধ্যে এইরকম ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ঈশ্বরের কাছে সত্ত্বভাবজনিত অমৃতলাভের প্রার্থনা পরিদৃষ্ট হয়]। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানের নাম–ভারদ্বাজম]।
.
একাদশী দশতি
ছন্দ আর্চিক। কৌথুমী শাখা। পবমান পর্ব। পঞ্চম অধ্যায়।
একাদশ খণ্ড : মন্ত্র সংখ্যা ৮ ॥ দেবতা পবমান সোম৷৷
ছন্দ ককুপ, ৫ যবমধ্যা গায়ত্রী
ঋষি ১ গৌরিবীত শাক্ত্য, ২ ঊর্ধ্বসদ্মা আঙ্গিরস, ৩/৮ ঋজিশ্বা ভারদ্বাজ, ৪ কৃতযশা আঙ্গিরস, ৫ ঋণঞ্জয় রাজর্ষি আঙ্গিরস, ৬ শক্তি বাসিষ্ঠ, ৭ ঊরু আঙ্গিরস৷
পবস্ব মধুমত্তম ইন্দ্রায় সোম ক্রতুবিত্তমো মদঃ। মহি দুক্ষতমো মদঃ ॥১॥ অভি দ্যুম্নং বৃহদ যশ ঈষম্পতে দীদিহি দেব দেবযুম। বি কোশং মধ্যমং যুবঃ। ২৷৷ আ সোতা পরি যিষ্ণতাশ্বং ন স্তোমমণ্ডুরং রজস্তুরম্। বনপ্রক্ষমুদপুত৷৷ ৩৷৷ এতমু ত্যং মদ্যুতং সহস্রধারং বৃষভং দিবোদুহম্। বিশ্বা বসূনি বিভ্রত৷৷ ৪৷৷ স সুন্থে যো বসুনাং যো রায়ামানে য ইড়ানা। সামো যঃ সুক্ষিতীনাম্৷৷৷৷ ত্বং হ্যাঁতঙ্গ দৈব্যং পবমান জনিমানি দ্যুমত্তমঃ। অমৃতত্বায় ঘোষয়৷৬৷৷ এষ স্য ধারয়া সুতোহব্যা বারেভিঃ পবতে মদিন্তমঃ। ক্রীড়মূর্মিরপামিব৷৷৭৷৷ য উসিয়া অপি যা অন্তরশ্মনি নির্গা অকৃন্তদোজসা। অভি ব্ৰজং তত্নিষে গব্যমখ্যং বর্মীব ধৃষ্ণবা রুজ। ৮৷৷
মন্ত্ৰার্থ–১। হে শুদ্ধসত্ত্ব! অমৃতময়, পরমানন্দদায়ক, সৎকর্মপ্রাপক, (অথবা প্রজ্ঞাদায়ক) মহান, পরমদীপ্তিমান্ আপনি আমাদের পরমানন্দদায়ক হয়ে ভগবৎ-প্রাপ্তির জন্য আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন অমৃতপ্রাপক সত্ত্বভাব লাভ করি)। [ভগবান্ তো পরমানন্দদায়কই, তবে তাকে আবার পরমানন্দদায়ক হবার জন্য প্রার্থনা কেন? তার উত্তর এই যে, সূর্যের আলোকে তো জগৎ উদ্ভাসিত হয়, কিন্তু তাতে কি অন্ধের কোন উপকার হয়। ভগবান্ তো আনন্দং অমৃতরূপং–তার আনন্দের প্রবাহে জগৎ প্লাবিত হচ্ছে, কিন্তু আমাদের হৃদয়ে কি সেই আনন্দের স্পন্দন আপনা-আপনি অনুভূত হয়? সত্ত্বভাব ঈশ্বরেরই অপর এক রূপ। এই সত্ত্বভাবও আনন্দদায়ক নিশ্চয়ই, সত্ত্বভাবের সঙ্গে আনন্দের মিলন হয় সত্য, কিন্তু ভগবানের কৃপা না হলে আমরা সেই আনন্দ লাভ করব কেমন করে? তাই বলা হয়েছে-পরমানন্দদায়ক আপনি আনন্দদায়ক হয়ে… ইত্যাদি। অমৃতময় সত্ত্বভাবই মানুষকে সৎপথে প্রবর্তিত করে; সুতরাং তা অমৃততুল্য উপকারী]। [এই সামমন্ত্রের পাঁচটি গেয়গানের নাম—বাসিষ্ঠম দ্বে, সফম দ্বে ইত্যাদি]।
২। সিদ্ধিপ্ৰদাতা হে দেব! আপনি আমাদের দেবপ্রাপক দ্যোতমান্ মহান্ সৎকর্মসাধনসামর্থ্য প্রদান করুন; এবং আপনার অমৃতময় করুণার প্রবাহ বর্ষণ করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! আমাদের সৎকর্মসাধনের সামর্থ্য প্রদান করুন; আমরা যেন আপনার করুণামৃত লাভ করি)। [ভগবানের করুণার উপর মানুষের উন্নতি নির্ভর করে। তাঁর দয়া না হলে মানুষ কেবল ইচ্ছা করলেই উন্নতির পথে অগ্রসর হতে পারে না। ভগবানের কাছ থেকে শক্তি না পেলে মানুষ চারদিকের ভীষণ রিপুদের সঙ্গে সংগ্রামে কিছুতেই জয়লাভ করতে পারবে না। তাই প্রার্থনা–কৃপা করে আমাদের তোমার অসীম শক্তিভাণ্ডারের একটু শক্তিকণা দান করে দয়া করো]। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানের নাম –ঐষিরাণি চত্বারি]।
৩। হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ! ব্যাপকজ্ঞানতুল্য আশুমুক্তিদায়ক প্রার্থনীয় অমৃতপ্রাপক (অথবা ত্রাণকারক) শক্তিদায়ক জ্যোতির্ময় অমৃতময় সত্ত্বভাবকে তোমরা হৃদয়ে উৎপাদন করো এবং তাকে বিশুদ্ধ করো। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন মোক্ষপ্রাপক সত্ত্বভাব লাভ করতে পারি)। [মানুষের জীবনের চরম লক্ষ্যসাধনের উপায়ভূত বিশুদ্ধ সত্ত্বভাব লাভ করবার জন্য আত্ম-উদ্বোধন আছে। সাধক-গায়ক যেন নিজেকে সম্বোধন করে বলছেন–ভগবান্ কৃপা করে তোমাকে মানব-জন্ম দিয়েছেন, তার সার্থকতা সম্পাদন করবার জন্য যত্নবান্ হও]। [এই সামমন্ত্রের ছটি গেয়গানের নাম–কাণএষানি শ্রীণি, বাচঃ সামানি ত্ৰীণিঃ]।
৪। ভগবৎপরায়ণ সাধক পরমানন্দদায়ক অভীষ্টবর্ষক সর্বধনপ্রদায়ক প্রসিদ্ধ সেই সত্ত্বভাবকে প্রভূতপরিমাণে নিশ্চিতরূপে প্রাপ্ত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক। ভাব এই যে, ভগবৎপরায়ণ ব্যক্তিগণ মোক্ষদায়ক সত্ত্বভাব লাভ করেন)। [ভাষ্যকার ত্যং পদে সোমরস অর্থ করেছেন; এবং প্রচলিত অনেক ব্যাখ্যাকারই তার অনুসরণ করেছেন। কিন্তু দিবঃ অর্থাৎ, তারই ব্যাখ্যানুযায়ী, দেবান্ কাময়মানাঃ ঋষিবর্গ সোমরস চাইবেন অথবা পাবেন কেন? এখানে ত্যং পদে সত্ত্বভাবকে লক্ষ্য করে বলে মনে করলে মন্ত্রের সঙ্গতিও রক্ষা হয়]। [এই মন্ত্রের ছটি গেয়গানের নাম কৌন্মলবর্হিষে দ্বে, শঙ্ক, কৌল্মলবর্হিষাণি ত্রীণি]।
৫। যে সত্ত্বভাব ধনপ্রদায়ক, যিনি পরমধনপ্রাপক, যিনি জ্ঞানরশ্মিসমূহের প্রেরক, যিনি সাধকদের রক্ষক, সেই সত্ত্বভাব আমাদের দ্বারা স্তুত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন সত্ত্বভাব প্রাপ্তির জন্য প্রার্থনাপরায়ণ হই)। [মন্ত্রের মধ্যে সত্ত্বভাবের মহিমা প্রখ্যাত হয়েছে। সেই সত্ত্বভাব কেমন? তিনি পরমধন-প্রদায়ক। মানুষ যে ধনলাভের জন্য ব্যাকুল, যে ধন পেলে মানুষের আর চাইবার মত কিছু থাকে না, তিনি সেই পরমধনের দাতা। যে ধন লাভ করলে সাম্রাজ্য তুচ্ছজ্ঞান হয়, যা লাভ করলে মানুষ স্থিতধী হয়, তিনি সেই ধন প্রদান করেন। কিন্তু মানুষের কি সেই ধন রক্ষা করবার মতো শক্তি আছে? চারদিকে দস্যুতস্কর, রিপুকুল রয়েছে। তারা তো সেই ধন লুণ্ঠন বা বিনষ্ট করে দিতে পারে?–না, তিনি শুধু ধনদাতাই নন, তিনি সেই ধনের রক্ষাকর্তাও বটেন। সুতরাং তার শরণাপন্ন হলে আমাদের ভয়ের কারণ নেই। ভাষ্যকার ইউনাম্পদের ব্যাখ্যা করেননি। এখানে ঐ পদের অভিধান-সম্মত ধেনুনাং, জ্ঞানরশ্মীনাং অর্থ-গ্রহণই সঙ্গত]। [এই সামমন্ত্রের পাঁচটি গেয়গানের নাম–দীর্ঘম, লোমোসাম, সোমসামাণি ত্ৰীণি]।
৬। পবিত্রকারক হে সত্ত্বভাব! পরমদীপ্তিসম্পন্ন আপনিই দেবতাদের জানেন; আপনিই শীঘ্র অমৃতলাভের জন্য লোকদের আহ্বান করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক। ভাব এই যে, -সত্ত্বভাবের দ্বারা লোকগণ আশুমুক্তি লাভ করেন)। [সত্যভাব লাভ করলে মানুষ পরাজ্ঞান লাভ করে অর্থাৎ সত্ত্বভাব দেবতাকে জ্ঞাত আছেন। দেবতা অথবা দেবভাব শুদ্ধসত্ত্ব থেকে উৎপন্ন। সুতরাং সেই শুদ্ধসত্ত্বলাভ করলে মানুষ দেবভাবের অধিকারী হয়। দেবগণ যে অমৃত পান করেন, তা সত্ত্বভাব ব্যতীত আর কিছুই নয়। –ভাষ্যকারের অনুসরণে মাদক সোমরসকে এনে প্রচলিত ব্যাখ্যাকার অর্থান্তর ঘটিয়েছেন, অর্থবিকৃতি ঘটিয়েছেন। যেমন, –হে সোম! তোমার ন্যায় উজ্জ্বল কিছুই নেই। তুমি যখন ক্ষরিত হও, তখন দেবতা-বংশজাত তাবৎ ব্যক্তিকে অমরত্ব দেবার নিমিত্ত আহ্বান করতে থাক। মদিরার নেশায় বুঁদ হলে হয়তো এমনই মনে হয়]। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানের নাম– শৌতস্নানি চত্বারি]।
৭। অমৃততরঙ্গতুল্য আনন্দময়, পরমানন্দদায়ক, বিশুদ্ধ এই প্রসিদ্ধ সত্ত্বভাব জ্ঞানপ্রবাহের সাথে ধারারূপে আমাদের হৃদয়ে সমুদ্ভুত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, জ্ঞানসমন্বিত পরমানন্দদায়ক সত্ত্বভাব আমরা যেন লাভ করতে পারি)। [এই সামমন্ত্রের পাঁচটি গেয়গানের নাম গায়ত্রপার্শ্বম, সন্তনি, সোমসামানি ত্ৰীণি]।
৮। হে পরমদেব! আপন শক্তিতে পাষাণের ন্যায় কঠোর হৃদয়ে দুলোকজাত প্রবহমান (অথবা? ও জ্যোতিঃকণাসমূহকে এবং) জ্ঞানকিরণসমূহকে উৎপাদন করেন, হে ভগবন! সেই আপনিই পরাজ্ঞান আমাদের হৃদয়ে প্রদান করুন; হে শত্রুধর্ষণশীল দেব! আপনি অপরাজেয় যোদ্ধার ন্যায় আমাদের রিপুবর্গকে বিনাশ করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! কৃপা করে আপনি আমাদের পরাজ্ঞান প্রদান করুন এবং আমাদের রিপুজয়ী করুন)। [মন্ত্রের প্রথমভাগে বিবৃত নিত্যসত্যের মধ্যে দুর্বল মানুষের জন্য কি আশার বাণীই ধ্বনিত হয়ে উঠেছে। পাষাণের মতো কঠোর হৃদয়ধারী, পাপমোহে কলঙ্কিত নরনারীর হৃদয়েও জ্ঞানের জ্যোতিঃ প্রদান করেন, মোক্ষলাভের পথ প্রদর্শন করেন। দ্বিতীয় ভাগে রিপুনাশ করবার জন্য ভগবানের কাছে প্রার্থনা আছে। এখানে উল্লেখ্য এই যে, প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে মন্ত্রটি সম্পূর্ণ ভিন্নরূপ পরিগ্রহ করেছে। অর্থবিকৃতিও বলা যায়। উদাহরণ স্বরূপ একটি বঙ্গানুবাদ-হে সোম! তুমি আকাশ থেকে ক্ষরণশীল জল সমস্ত মেঘের মধ্য থেকে নির্গত করেছিলে, সেই তুমি দুর্ধর্ষ কবচধারী বীরের ন্যায় শত্ৰু সংহার করো। প্রচলিত এই রকম ব্যাখ্যা অনুসারে, আকাশ থেকে জল নির্গত করা, ইন্দ্রের কাজ বলে ব্যাখ্যাত হয়। কিন্তু এই মন্ত্রে সেই বিশেষত্ব সোমরসের প্রতি প্রযুক্ত হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন এই যে, -সোমরস আকাশ থেকে জল নির্গত করে কেমন করে কিভাবে এবং গো-অশ্বকে রক্ষা করেই বা কেমন করে? প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে তার কোনও কারণও উল্লেখিত হয়নি। অথচ প্রায় সর্বত্রই সোমরসকে নানারকম ঐশ্বরিক শক্তির আধাররূপে বর্ণনা করা হয়েছে। ঋগ্বেদে ও সামবেদে সোমের স্থান অতি উচ্চে। মন্ত্রের সংখ্যা হিসেবে ঋগ্বেদে সোমের স্থান তৃতীয়ে, সামবেদেও তা-ই। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে–বৈদিক আর্যগণ কি এতই অপদার্থ ছিলেন যে, সামান্য একটা মাদক দ্রব্যকে এত উচ্চস্থান দিয়ে গেছেন? এই প্রশ্নের সহজ ও সঙ্গত উত্তর এটাই মনে হয় যে, সোম বলতে কোন মাদকদ্রব্যকে লক্ষ্য করে; ওটি ভগবানের ঐশ্বরিক শক্তি। নতুবা আর্য হিন্দুগণ কখনও সোমকে এত উচ্চাসন দিতেন না। আমরা সর্বত্রই সোম শব্দে সত্ত্বভাবকে লক্ষ্য করেছি এবং কোথাও এই অর্থে অসঙ্গতি লক্ষিত হয়নি। –ভাষ্যকার এই মন্ত্রের অন্তর্গত গাঃ পদে জল অর্থ করেছেন, যদিও অন্যত্র প্রায়ই গরু অর্থ দৃষ্ট হয়। ব্ৰজংপদেও এখানে সমূহঅর্থ করেছেন। কিন্তু অন্যান্য স্থলে গরুর মাঠ অর্থই গ্রহণ করেছেন। আমরা পূর্বানুসারেই গাঃ পদে জ্ঞানকিরণন এবং ব্রজং পদে অস্মাকং হৃদি অর্থ গ্রহণ করেছি। এতে নিঃসন্দেহভাবে মন্ত্রার্থের সামঞ্জস্য বা সঙ্গতি রক্ষিত হয়েছে]। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানটির নাম উল্লেখিত নেই]।
— পঞ্চম অধ্যায় সমাপ্ত —