‘গৌরাঙ্গের মর্ম লোকে বুঝিতে নারিলা’
বইয়ের পাতা থেকে পাওয়া অজ্ঞান আর পথচলতি জীবন থেকে উঠে আসা জ্ঞানে কত তফাত। সেই কত দিন আগে ভাষাতত্বের ক্লাসে পড়েছিলাম সেমানটিক্স্ অর্থাৎ কিনা শব্দার্থতত্ত্ব। শব্দের এখন যে-অর্থ আমরা জানি, আদৌ সে-শব্দের অর্থ নাকি অনেক সময় থাকে আলাদা। তার কারণ উচ্চবর্গের মানুষ হয়তো তৈরি করল একটা শব্দ আর নিম্নবর্গের মানুষ সেই শব্দ ব্যবহার করতে করতে মুখে মুখে মানেটাই দিল পালটে। ভারী সুন্দর একটা উদাহরণ মনে পড়ছে, সেই কবেকার ছোটবেলায় পড়া: ‘উট চলেছে মুখটি তুলে/ ঊর্ণনাভ ঊর্ধ্বে ঝুলে।’ ঊর্ণনাভ, যাকে বলে মাকড়শা। সেমানটিক্স পড়তে গিয়ে জানলাম ঊর্ণনাভ নয়, কথাটা মূলে ছিল ঊর্ণবাভ। বয়নার্থক বভ্ ধাতু থেকে তৈরি শব্দ। ঊর্ণা বোনে যে। কিন্তু হলে কী হবে, সাধারণ মানুষের ধারণা হল মাকড়শার নাভি থেকে একরকম রস বেরিয়ে জাল তৈরি হয়। বাস ঊর্ণবাভ হয়ে গেল ঊর্ণনাভ। অশিক্ষিত মানুষের এ সব হালচাল, যারা নাকি উচ্চারণকেই বলে উশ্চারণ, অধ্যাপকমশাই খুব ঠোঁট বেঁকিয়ে বলেছিলেন তাদের কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজকর্মের আরও নানা নমুনা। তখন জানতে পারিনি যে, উচ্চারণ যারা বাঁকায়, যারা উলটে পালটে দেয় অর্থ সেই সব মানুষদেরও আবার পণ্ডিতদের বিষয়ে এরকম ঠোঁট বাঁকানো আছে।
কাটোয়ার কিছু দূরের এক গ্রামে থাকেন প্রাণকৃষ্ণ গোঁসাই। সহজিয়া বৈষ্ণব। হেসে বললেন, ‘কৃষ্ণ মানে কী?’
বৈষ্ণব-শাস্ত্ৰ-পড়া চুলবুলে পণ্ডিতকে আর পায় কে? বুক ফুলিয়ে বললাম: ‘কৃষ্ণস্তু ভগবানস্বয়ম্।’
: কী করে জানলেন?
: বৈষ্ণব শাস্ত্রে লেখা আছে। উজ্জ্বল নীলমণি…
গোঁসাই থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘থামুন থামুন। ও তো অনুমানের কথা। আমরা বর্তমানের ধারায় চলি। এবারে শুনুন, কৃষ্ণ মানে ভগবান নয়, কৃষ্ণ মানে মানুষ। কৃষ্ণ মানে যে কর্ষণ করতে পারে। কৃষ্ণ মানে ক্ষেত্রজ্ঞ পুরুষ। যে ক্ষেত্র বুঝে কর্ষণ করতে পারে। বুনতে পারে বীজ। বীজ মানেও কৃষ্ণ, অর্থাৎ বিন্দু। বুঝলেন?’
অতল জলে ডুবতে ডুবতে বললাম, ‘তা হলে রাধা কে?’
: রাধা? রাধা হল ক্ষেত্র।
আমি সচকিত হয়ে বললাম, ‘তবে কি চৈতন্য মানে আমরা যা বুঝি তা নয়? অদ্বৈত নিত্যানন্দ এ সবেরও কি অন্য মানে আছে নাকি?’
মুচকি হেসে প্রাণকৃষ্ণ গুনগুন করেন:
যে-রাধাকৃষ্ণের কথা পদে গায়
সে তো বৃন্দাবনের কৃষ্ণ রাধা নয় ॥
আমি বললাম, ‘এ কী? এ পদ কি এক্ষুনি মুখে মুখে বানালেন না কি?’
গোঁসাই খিল খিল করে হেসে বললেন, ‘কী? আয়নাটা ভেঙে গেল তো?’
: আয়না?
: হ্যাঁ, একখানা বড় আয়না ছিল। তাতে একখানা সূর্য দেখা যেত। এবার? হাত থেকে আয়নাটা হঠাৎ পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। এখন কী হবে? আর তো একখানা সূর্য দেখা যাবে না। যত টুকরো তত সূর্য, তাই নয়?
প্রাণকৃষ্ণ আস্তে আস্তে উঠে যান তাঁর আখড়ার দিকে। সাদা আলখাল্লা পরা উদাসীন। শুভ্র জটাজুট। হঠাৎ আবার কাছে ফিরে এসে আমার বিভ্রান্ত মুখের দিকে খর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ‘শাস্ত্র পড়ে কতটুকু জানবে? সব শাস্ত্রই কি মান্য? কবিরাজ গোঁসাই শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত লিখেছিলেন। জানো কি সে সম্বন্ধে কেউ কেউ কী বলে? বলে,
চৈতন্যচরিতামৃত
কারো কারো লাগে তিতো।
তা হলে? কোনও গ্রন্থই অকাট্য নয়। অকাট্য সেই পরমতত্ত্ব। তোমাকে কী বলি বলো? সংশয় পথের পথিক তুমি। আর আমি ভাবের পথিক। অচৈতন্য আছ, সচৈতন্য হও।’
সেই শুরু। তা দু’দশকের বেশি বই কম নয়। সচৈতন্য হবার চেষ্টা আমার যবে থেকে শুরু তখন ধারে কাছে কোথাও চৈতন্যের পাঁচশত বছরের দুন্দুভি বাজেনি। অর্থাৎ আমার চৈতন্য প্রাপ্তির পথটি ছিল বড়ই নিঃসঙ্গ। কিন্তু আর একটা কথাও বলা দরকার। গোঁসাই মশায়ের বলা অচৈতন্য থেকে সচৈতন্য হওয়া বরং সহজ কিন্তু একটা মতামত তৈরি হয়ে গেলে তাকে ভেঙে নতুন মত গড়া কঠিন। বৈষ্ণবতা আর চৈতন্যবাদ বিষয়ে অনেকটাই যে ধারণা তৈরি হয়েছিল আমার মনে আগে থেকেই, তাকে কি বদলানো সোজা? যেমন একটা গান যদি একবার ভুল সুরে শেখা হয়ে গিয়ে থাকে তবে সেই সুর ভুলে শুদ্ধ সুর আয়ত্ত করা কঠিনতর। আমায় এই ব্যাপারটা পদে পদে বাধা দিল। সুশীল দে-র লেখা ‘An early history of Vaisnava faith and movement’, শশিভূষণ দাশগুপ্তর ‘শ্রীরাধার ক্রমবিকাশ: দর্শনে ও সাহিত্যে’ কিংবা বিমানবিহারী মজুমদারের ‘শ্রীচৈতন্য চরিত্রের উপাদান’ রাধাগোবিন্দ নাথের ‘শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতের ভূমিকা’যে কখনও মন দিয়ে পড়েছে তার পক্ষে কি সম্ভব সেই পুরনো পড়া ভুলে যাওয়া? সেই সঙ্গে পরে পরে পড়ে নিয়েছি কেনেডি বা ডিমক সাহেবের ইংরাজি বই। প্রয়োজনে ঘেঁটেছি হরিদাস দাসের ‘শ্রীগৌড়ীয় বৈষ্ণব অভিধান’ মণীন্দ্রমোহন বসুর ‘সহজিয়া সাহিত্য’। উলটে পালটে বুঝতে চেয়েছি ‘হরিভক্তিবিলাস’কিংবা ‘শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’। এ সবই কি বাহ্য পথ? তা হলেও ক্রমে বুঝতে পারি চৈতন্যকে বোঝবার দুটো খুব সোজা পথ আছে। একটা হল পণ্ডিতদের বই পড়ে বোঝা, আরেকটা বৈষ্ণব নৈষ্ঠিকমতে দীক্ষা নিয়ে আচরণের পথে বোঝা। প্রথম পথটা আমার খানিক জানা ছিল, দ্বিতীয় পথটা আমার পক্ষে জটিল। কেননা আমার তো অন্তরে ভক্তির আকুলতা নেই, দীক্ষা নেব কেন? কিন্তু হঠাৎ কোথাও কিছু নেই খুলে গেল তৃতীয় একটা পথ। সহজিয়া পথ। প্রায় তৃতীয় নয়নের মতো সে পথ এমন সব কথা আমাকে জানান দিল যা কোনওদিন যে জানব ভাবিনি।
বেথুয়াডহরি স্টেশনের পরের স্টেশন সোনাডাঙা। সেই সোনাডাঙার রেলগুমটির গায়ে একটা অন্ধকার ঘরে থাকত এলা ফকির। অন্ধ ফকির কিন্তু মনটা ছিল ঝলমলে। আমাকে প্রথম দিন বলল, ‘যদি গোরাকে জানতে চাও তো লালনের পদ পড়ো ভাল করে।’
আমি বললাম, ‘সে কী? ফকিরের চোখ দিয়ে বৈষ্ণবকে বুঝব?’
এলা অন্ধ চোখের হাসি ছড়িয়ে বলল, ‘সে-ই তো আদি ফকির গো। গোরা ফকির। মাথা মুড়িয়ে কস্থা নিয়ে করঙ্গ হাতে গৌরাঙ্গই আদি ফকির। লালন বলছে,
শুনে অজানা এক মানুষের কথা
গৌরচাঁদ মুড়ালেন মাথা।
কী বুঝলে? অজানা মানুষ কিনা আলেখ। তার খবর পেয়েই গৌরাঙ্গের সন্ন্যাস। তো তুমি প্রথমে লালন পড়া। কিন্তু তার আগে তীর্থগুলো দ্যাখো। নবদ্বীপ শান্তিপুর বাগনাপাড়া কালনা কাটোয়া কেঁদুলি ফুলিয়া অগ্রদ্বীপ শ্রীখণ্ড খড়দহ গুপ্তিপাড়া জিরাট মঙ্গলডিহি গোপীবল্লভপুর এ সব দেখেছ?’
আমি বললাম, ‘কিছু দেখেছি কিছু দেখিনি কিন্তু তীর্থ ঘুরে কী পাব? লালন যে বলেছেন ‘ওসব তীর্থব্রতের কর্ম নয়’ তা হলে?’
এলা বলল, ‘তীর্থব্রত কাদের জন্য নয় জানো? যাদের আপ্ততত্ত্ব সারা হয়েছে। তোমার তো পরতত্ত্বই জানা হয়নি। ও সব ধন্দ ছাড়ো। আগে তীর্থগুলো পরিক্রমা করে তারপরে এসো।’
আমি এমনই করে কত জায়গায় কত দিন ঘুরে ঘুরে বৈষ্ণবদের ভোগরাগ, সেবাপূজা, পঞ্চতত্ত্ব সব বুঝে এলা ফকিরের কাছে আবার গেলাম।
ফকির বললে, ‘বুঝলে সব? দেখলে সব বাহ্যের সাধন? মন্দিরে দেখলে তো গৌরাঙ্গকে শয়ন দিচ্ছে আবার জাগাচ্ছে? কাঠের মূর্তি আর ছবি পুজো দেখলে? রসকলির ছাপ দেখলে? ডোরকৌপীন দেখলে? তা কেমন লাগল?’
: ভালই তো। বেশ ভক্তি ভাবে আছেন সব। গ্রন্থ পড়ছেন। কীর্তন হচ্ছে।
: কোন কীর্তন আসল।
: কেন? নামকীর্তন। হরি নামেই মুক্তি কলিযুগে।
‘তাই নাকি?’ এলা ফকির সন্দিগ্ধ হাসল। ‘তা হলে হরি বললেই হবে? এবারে তা হলে শোনো লালন কী বলে:
না জেনে করণ কারণ কথায় কী হবে
কথায় যদি ফলে কৃষি তবে বীজ কেন রোপে?’
আমি বললাম, ‘তার সঙ্গে হরিনামের কী? নামের শক্তি জানেন?’
এলা আমার কথার জবাব না দিয়ে গানের অন্তরাটা ধরলে বেশ তান লাগিয়ে:
‘গুড় বললে কি মুখ মিঠা হয়?
দিন না জানলে আঁধার কি যায়?
তেমনই জেনো হরি বলায়
হরি কি পাবে?
কী বুঝলে?
: বুঝলাম শুধু হরি হরি বললেই হবে না। বুঝতে হবে তার মর্ম।
: উঁহু, শুধু মর্ম বুঝলেই হবে না। বুঝতে হবে তাঁর অবস্থান। অর্থাৎ কিনা দেহের কোথায় আছেন হরি, কী তাঁর কাজ কারবার।
আমি বললাম, ‘সে সব বোঝার উপায় কী?’
: ওইখানটাতেই গুরুর দরকার। গুরু ছাড়া গৌরকে বোঝা অসম্ভব। সেইজন্যই লালন বলে,
গুরু ছেড়ে গৌর ভজে
তাতে নরকে মজে।
আমার মনে হল চৈতন্যকে বা গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মকে এতদিন যেমন করে বুঝে এসেছি তার উলটো একটা দিকও তা হলে আছে। এলা ফকির খুব কৌশলে আমাকে টানতে চাইছে সেদিকে। প্রথমে সে বোঝাল মূর্তিপূজা নিষ্ফল, তারপর দেখাল হরিনামের অন্তঃসার কত কম। কিন্তু গৌড়ীয় মতে যে নৈষ্ঠিক সাধনা সে কি ভুল? সমান্তরাল সাধনা কি হয় না? কথাটা আরেক দিন এলার কাছে তুলতে সে তো হেসেই আকুল। বলে, ‘সত্য কি দুরকম হয়? ফলাফল আলাদা হতে পারে অবশ্য।’
‘কীরকম?’ আমি জানতে চাই।
: পাত্রভেদে ফলাফল জানিয়ে নিশ্চয়। ভাল বীজ যদি পাষাণে রোপন কর তবে কি শস্য হবে? তেমনই দই যদি রাখ তামার পাত্রে তবে বিষ হয়ে যাবে। একটা গানে বলছে সিংহের দুগ্ধ মাটির ভাণ্ডে টিকে না। তা হলে? সিংহের দুগ্ধ রয়না দ্যাখো স্বর্ণপাত্র বিহনে। এবারে বুঝলে পাত্রভেদে ফলাফলের ভেদ?
: বুঝলাম। কিন্তু চৈতন্যকে দুরকমভাবে সাধনা করা কি যায় না? নৈষ্ঠিক বৈষ্ণবরা যদি শুদ্ধাচারে দারু বিগ্রহে বা নামাশ্রয়ে সাধনা করে তবে ক্ষতি কী?
: ক্ষতি? শোনো লালনের জবানিতে। সে বলছে,
যে স্তনের দুগ্ধ খায়রে শিশু ছেলে
জোঁকে মুখ লাগালে রক্ত এসে মেলে।
আমি চমকে উঠে বললাম, ‘কী সাংঘাতিক যুক্তির দাপট। এখানে তবে পাত্রভেদে নয়, অধিকারী ভেদ। দুধও সত্য রক্তও সত্য। কিন্তু অধিকারী ভেদে ভিন্ন ফলপ্রাপ্তি। বেশ। তা তোমরা যেভাবে চৈতন্যকে বুঝছ সেটাই ঠিক আর ওদেরটা বেঠিক? কী করে নিঃসংশয়ে বুঝলে?
: বুঝলাম আমরা মানুষকে ধরেছি বলে। ওই জন্যে আমাদের ডোর কৌপীন, তিলক, মালা, ব্রহ্মচর্য, বৃন্দাবন, মথুরা কিছুই লাগে না। আমরা বরং বলি,
সত্য বলে জেনে নাও এই মানুষলীলা।
ছেড়ে দাও নেংটি পরে হরি হরি বলা ॥
: বেশ বুঝলাম। তা ব্রহ্মচর্যে আপত্তি কোথায়? সব ধর্মে ত্যাগ বৈরাগ্য ব্রহ্মচর্যের খুব বড় সম্মান।
: সম্মান কে করে? তোমরাই ব্রহ্মচারী হও আবার তোমরাই বলিহারি দাও। আমরা দিইনে। প্রকৃতি ছাড়া জীবন চলে কি? এলে কোথা থেকে? সয়ো থেকে ভুঁইয়ে পড়লে না মা-র কোলে জন্মেছ? সেই মা কে? তোমার বাবার প্রকৃতি নয়? ‘পুরুষের লক্ষণ প্রকৃতিআশ্রয়’, আমরা বলি। তা ছাড়া প্রকৃতি ছেড়ে নেংটি পরে যাবা কোথায়, কদ্দূর? একটা সার কথা শুনবে? স্বয়ং মহাপ্রভু প্রকৃতিসঙ্গ করেছিলেন। লক্ষ্মীপ্রিয়া আর বিষ্ণুপ্রিয়া। অদ্বৈতর ছিল দুই প্রকৃতি। নিত্যানন্দরও তাই। তুমি তো অনেক লেখাপড়া করেছ, বলো তো চৈতন্যের আগে পরে কজন ব্রহ্মচারী ছিল?
আমি গুনে গেঁথে বললাম, ‘সে কথা ঠিক। শ্রীনিবাস আচার্যর দুই পত্নী আর শ্যামানন্দের তো তিনজন। রূপ, সনাতন, শ্রীজীব ছিলেন ব্রহ্মচারী।’ মুখের কথা কেড়ে নিয়ে এলা বলে, ‘অ্যাই, এবারে তুমি ধরেছ ঠিক। প্রকৃতি ত্যাগের ভুলটা ওরাই চালু করেছে। মহাপ্রভু কখনই ওকথা বলেননি। জানো, তাঁর পার্ষদ রামানন্দ রায় দুজন সেবাদাসী নিয়ে সাধনা করতেন। চৈতন্য কি তাঁকে ত্যাগ করেছিলেন না তার সঙ্গেই সবচেয়ে গুহ্য আলাপ করতেন? যাই হোক, তুমি বাপু তোমার বইপত্র ঘেঁটে দ্যাখো আমার কথা ঠিক না বেঠিক।ֹ’
বইপত্র ঘেঁটে যা পেলাম তা অবশ্য এল ফকিরকে বলা হয় না আমার। কেন না ততদিনে সে মাটির তলায়। কিন্তু ঘাঁটতে গিয়ে যা সব জানা গেল সেও তো কম রোমাঞ্চকর নয়। প্রথমে নজরে পড়ল ঢাকার বাংলা একাডেমি পত্রিকার মাঘ-চৈত্র ১৩৭০ সংখ্যায় বাংলাদেশের নামকরা পণ্ডিত আহমদ শরীফের একটি নিবন্ধে আশ্চর্য এক উক্তি। শরীফ লিখেছেন:
জনশ্রুতিজাত ধারণা স্বয়ং চৈতন্যদেবের একটি গুহ্য সাধন প্রণালী ছিল। এই সাধনা ছিল পরকীয়া মৈথুনাত্মক।
এর চেয়েও বিস্ফোরক খবর পাওয়া গেল বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকার ৯১ বর্ষের ১ম সংখ্যার এক নিবন্ধে। সেখানে অধ্যাপক রমাকান্ত চক্রবর্তী নৃসিংহের লেখা এক চৈতন্য জীবনীর পরিচয় দিয়েছেন। নৃসিংহ লিখেছেন সংস্কৃতে ‘শ্রী চৈতন্য মহাভাগবতম্’ পুঁথি। কলকাতার বাঞ্ছারাম অক্রুর লেনের গোপীনাথ আঢ্য মশাই পুঁথিটি দান করেছিলেন। সাহিত্য পরিষদে। অন্ধকার পরিষদ প্রকোষ্ঠ থেকে পুঁথির উদ্ধার করে পরিচয় দিয়েছেন রমাকান্তবাবু। রচনাকাল ১৬৬৫ সাল। বইটি অর্বাচীন তো বটেই। কিন্তু রমাকান্ত চক্রবর্তীর এই মন্তব্যও যথার্থ যে, ‘একটি স্থানীয়, মিশ্র, এবং হয়তো সপ্তদশ শতকের মধ্যভাগে কোন অর্বাচীন বৈষ্ণব গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ গৌরাঙ্গ লীলার একটি বিচিত্র ভাষ্যরূপে যথেষ্ট মূল্যবান।’
এখন দেখা যাচ্ছে নৃসিংহের লেখা ‘শ্রীচৈতন্য মহাভাগবতম্’ পুঁথির ৫১ক পৃষ্ঠায় রয়েছে এমন এক তথ্য যে,
‘কায়ব্যূহ’ প্রক্রিয়ার সাহায্যে ‘কামশাস্ত্র প্রবীণ’ গৌরাঙ্গ অসংখ্য নায়িকার সহিত রতিলীলা করিতেন।’*
বলতেই হয় মারাত্মক সংবাদ এবং আহমদ শরীফের মন্তব্যের সঙ্গে কোথায় যেন মিলও রয়েছে ঘটনাটির। অতএব খুঁজতেই হয় আরও। তবে ভাবের পথে নয় পুঁথির জগতে।
একজন কথায় কথায় জানালেন, বার্নিয়া গ্রামের শ্রীনন্দন ঘোষ অনেক কলমি পুঁথির মালিক। মানুষটা কালোকোলো দশাসই। গলার স্বরও বাজখাই। খবর দেওয়া ছিল। বাস থেকে নামতেই আশপাশের সবাইকে জানান দিয়ে অভ্যর্থনা জানালেন আমাকে।
শ্রীনন্দন অচিরে নিয়ে গেলেন তাঁর কুঁড়েয়। বললেন, ‘আমরা সহজিয়া। জানেন তো সহজিয়া বৈষ্ণবদের অনেক ধারা। নিত্যানন্দের স্রোত, পাটুলীর স্রোত, রূপকবিরাজী স্রোত, বীরভদ্রের স্রোত। আমরা পাটুলীর স্রোত। দীক্ষাশিক্ষা পাটুলী ধামে। গোঁসাইয়ের নাম সত্যদেব মহান্ত। তিনি অপ্রকট হয়েছেন গত শ্রাবণে। হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন, আমার কাছে অনেক কলমি পুঁথি আছে। কিন্তু কী জানতে চান? চাঁদের সাধন না করোয়াতত্ত্ব? দেহ কড়চা না রাধাতত্ত্ব?’
অতশত কি জানি? শ্রীচৈতন্যের পরকীয়া সাধনের কোনও হদিশ কি মেলে কোনও পুঁথিতে, জানতে চাইলাম সেইটা। প্রসন্ন হেসে কাঠের সিন্দুক থেকে লাল খেরোয় বাঁধা লম্বাটে এক পুঁথি বার করে মাথায় ঠেকালেন। আমাকে দিয়ে বললেন, ‘মুকুন্দ দাসের লেখা “আদ্য কৌমুদী”। পড়ে দেখুন। টুকে নিন। আছেন তো সারা দিন। সেবা হতে দেরি হবে। ততক্ষণ নাড়াচাড়া করুন পুঁথি। মহাপ্রভুর পরকীয়া সাধনের খবর আছে এই গ্রন্থে।’
অনেকক্ষণ ধরে পড়তে পড়তে হঠাৎ চোখ আটকে গেল আদ্য কৌমুদীর একটি শ্লোকাংশে। সেখানে বলা হচ্ছে:
সন্ন্যাস করিয়া প্রভু সাধে পরকীয়া
সার্বভৌম নন্দিনী শাটি কন্যাকে লইয়া॥
মহাপ্রভুর পরকীয়া শাটি কন্যা লইয়া
অটল রতিতে সাধে সামান্য মানুষ হইয়া ॥
এ সব পড়ে আমি পড়লাম আরও ধন্দে। শাটি কে? বোঝা গেল সার্বভৌম কন্যা। কোন সার্বভৌম? বাসুদেব সার্বভৌম? এমন কথা তো কোথাও পড়িনি। শ্রীনন্দনকে এ কথা জানাতে সে বলল, গৌড়ীয় মতের লোকরা এ সব কথা জানাবেন না স্বভাবতই। এ যে ব্রহ্মচর্যের বিরোধী কথা।
যুক্তি আছে কথাটায়, মনে হল। কিন্তু চৈতন্য কেন সামান্য মানুষ হয়ে অটল সাধন করবেন? এ প্রশ্নের জবাবে তাত্ত্বিক শ্রীনন্দন বেশ প্রত্যয় নিয়ে বলেন, ‘আসল কথাই তো আপনার জানা নেই তাহলে। আপনি জানেন মহাপ্রভুর আবির্ভাবের কারণ? তাঁর তিন বাঞ্ছা?’
‘এ আর জানব না?’ গড়গড় করে বললাম:
‘যাকগে বাংলাতেই বলি। অর্থাৎ শ্রীরাধার প্রণয় মহিমা কেমন। শ্রীরাধার আস্বাদ্য কৃষ্ণের অদ্ভুত মধুরিমা কেমন এবং কৃষ্ণকে অনুভব করে রাধার কেমন সুখ হয় এই তিন বাঞ্ছার অভিলাষে গৌরাঙ্গের জন্ম নবদ্বীপে, শচীসিন্ধুগর্ভে।’
শ্রীনন্দন বললেন, ‘এ কথা কোথায় পেলেন? কে বলেছে?’
: কেন? শাস্ত্রে আছে। স্বরূপ দামোদরের লেখা।
: ধুস্। ও শাস্ত্র মানছে কে? ও তো বামুন-বোষ্টমের লেখা শাস্তর। সব বাজে। সব বাহ্য। আসল কারণ শুনবেন—মহাপ্রভু কেন এলেন নবদ্বীপে? তবে শুনুন।
গুনগুন করে উঠল প্রথমে সুর। তারপর বাণী:
বৃন্দাবনে রসরাজ ছিল
রসের তাক না বুঝে ধাক্কা খেয়ে
নদেতে এল।
এই এক আশ্চর্য। কেবল গান আর গান। লোকধর্মের লজিকগুলো সবই গানে গাঁথা। কিন্তু ব্ৰজে বৃন্দাবনে কৃষ্ণ কোন রসের তাক বোঝেননি যার জন্যে তাঁর নবদ্বীপে লীলা? গান থামাতেই হল। বাধা দিয়ে বললাম, ‘কী সব গাইছেন? ব্রজধামে নন্দের নন্দনের কীসের অভাব ছিল?’
: জানেন না? তাঁর ছিল না সহজ স্বভাব তাই করতে পারেননি সহজসাধনা। ঈশ্বরের কি সহজ স্বভাব হতে পারে? কী করে হবে? পিতামাতার কামনায় রজবীজে জন্ম হয়নি তাঁর। তাই স্বভাবে কামনা-শূন্য। কাম-ছাড়া প্রেমের উদ্দীপন নেই। প্রেম ছাড়া সহজ সাধন হয় না। তাই তাঁকে জন্মাতে হল নদীয়ায়। রজবীজে জন্ম এবার। কামনাময় দেহধর্ম। সেই কামনাকে অতিক্রম করতে নিলেন সন্ন্যাস। শাটিকে নিয়ে পরকীয়াসাধনে এবারে হল সহজানন্দ। তিন বাঞ্ছা শুনুন এবারে গানে,
এক, ওরে আমি কটিতে কৌপীন পরবো।
দুই, করেতে করঙ্গ নেবো।
তিন, মনের মানুষ মনে রাখবো।
এবারে বুঝলেন শেষ বাঞ্ছটাই আসল, ‘মনের মানুষ মনে রাখবো’।
বুঝলাম, অচৈতন্য থেকে ক্রমশ সচৈতন্য হচ্ছি। বাড়ি এসে শাটি কন্যার খোঁজে আরও অনেক বইপত্তর ঘাঁটতে লাগলাম। না, বৈষ্ণব শাস্ত্র নয়। নিতান্ত সহজিয়া সব পদাবলী বা ফকিরি গানের সংকলন উলটোতে উলটোতে দুদ্দু শাহের গানে পেয়ে গেলাম শাটি প্রসঙ্গ। কী রোমাঞ্চ। তা হলে তো শুধু পাটুলীস্রোতেই নয়, মারফতি গানেও। এই যে রয়েছে।
শাটি সে গোবিন্দচাঁদের পরকীয়া কয়।
কোন চাঁদ সাধিতে গোরা শাটির কাছে যায়।
ধরে শাটির রাঙা চরণ
সোধে নয় সহজ সাধন।
কিন্তু এরপরেই লোকগীতিকার স্ববিরোধ তুলে ধরে এক অস্বস্তিকর প্রশ্ন করে। জানতে চায়:
ত্রিজগৎ যাহাতে কাঙাল
তারই তরে গোরা বেহাল।
তবে নারীত্যাগের ভেজাল
কেন গোরা দেয়?
বাস্তবিকই খুব জ্বলন্ত প্রশ্ন। স্বর্গ মর্ত্য পাতালের সব প্রাণী যে সঙ্গমসুখের কাঙাল, স্বয়ং গৌরাঙ্গ যে নারীর সাহচর্যে বেহাল, সেই মানুষই কেমন করে দিতে পারে নারীত্যাগের পরামর্শ? এর মধ্যে তবে কি ভেজাল আছে কিছু? মনে পড়ে গেল এলা ফকিরের অনুমান। প্রকৃতিত্যাগের নির্দেশ বোধহয় মহাপ্রভু দেননি। ও সব বৃন্দাবনের ছয় গোস্বামীর কূটকচাল। হবেও না। কিন্তু আমার মন জানতে চায় অন্য একটা কথা। রজবীজে জন্ম বলে মানুষের মধ্যে থাকে কামনার সংস্কার—এ কথায় একটা স্পষ্ট জীবনবোধ আর সুস্থ যৌনতার স্বীকৃতি রয়ে গেছে।
আসলে আমাদের জন্মেরও একটা ধরন আছে। হঠাৎ শুনলে অশ্লীল লাগতে পারে আমাদের উচ্চশিক্ষিত মেট্রোপলিটন মনে, কিন্তু সত্যি সত্যিই আমার খারাপ লাগেনি যখন অগ্রদ্বীপের মেলায় জীবন গোঁসাই আমাকে অবলীলাক্রমে বলেছিল, ‘জন্মের ব্যাপারটা দৈব। ক্ষেত্রজ্ঞ পুরুষ নারীর গর্ভের ঠিক সময় বুঝে বীজ ফেলে। ঠিক যেন দুধের মধ্যে দইয়ের সাঁজাল। মাতৃগর্ভের বিম্বমধ্যে জলে ভাসতে লাগলেন ব্রহ্মবস্তু। নিরাশ্রয় নিরুপাধি। হঠাৎ আত্মারাম দেখা দিলেন। বীজ ভাসতে ভাসতে ঢেউ খেতে খেতে বর্তুলাকার থেকে হঠাৎ লম্বা আকার নিল। এবারে সেই লম্বা থেকে হঠাৎ বেরোল দুটো খেই। ব্যস হয়ে গেল দেহ আর দুখানা পা। আরেক ঢেউয়ে তৈরি হল দুখানা হাত আর মুণ্ড। এবারে বৃদ্ধি।’
এই পর্যন্ত বলে জীবন গোঁসাই এক গুরু শিষ্যের জবাবি গান ধরে দেন। দীন শরতের রচনা কি অনবদ্য। শিষ্য বলে,
এমন উল্টা দেশ গুরু কোন জায়গায় আছে
উর্ধ্বপদে হেঁটমুণ্ডে সে দেশের লোক চলতেছে।
সে দেশের যত নদনদী
উর্ধ্ব দিকে জলের স্রোত যায় নিরবধি
আছে নদীর নীচে আকাশ বায়ু
তাতে মানুষ বাস করতেছে॥
সে দেশে যত লোকের বাস
মুখে আহার করে না কেউ নাকে নাই নিঃশ্বাস
মলমূত্র যে ত্যাগ করে না
আবার আহার করে বাঁচতেছে।
স্পষ্টই দেহতত্ত্বের গান। গর্ভবাসকালে মানবসন্তানের বিবরণ। গানটা হঠাৎ থামিয়ে জীবন গোঁসাই ক্ষণ-বিরতির পর শুরুর জবানিতে প্রথম গানের জবাব দিতে লাগলেন আরেক গানে:
মন রে সেই দেশের কথা এখন ভুইলা গিয়াছ।
উর্ধ্বপদে হেঁটমুণ্ডে সে দেশে বাস কইরেছ॥
বিদ্রূপে পিতার মস্তকে ছিলে
কামবশে গর্ভাবাসে প্রবেশ করিলে
শুক্র আর শোণিতে মিলে
বর্তলাকার ধরিয়াছ।
ক্ষিতি অপ তেজ মরুৎ ব্যোমেতে
হল পঞ্চমাসে পঞ্চপ্রাণ ভৌতিক দেহেতে
সপ্তম মাসে গুরুর কাছে
মহামন্ত্র লাভ করেছ।
চন্দ্র সূর্যের নাইরে প্রকাশ
জলের নীচে অন্ধকারে ছিলে দশ মাস
ছিল নাভিপদ্মে মাতৃনাড়ী।
তাই দিয়ে আহার কইরছ।
দীন শরৎ বলে সাধনার ফলে
অন্ধকার কারাগার হতে এদেশে এলে
মিছে মায়ায় ভুইলে রইলে
যাবার উপায় কি করেছ।
জীবন গোঁসাইয়ের এই গানে কোনও অস্পষ্টতা নেই। কেবল রয়েছে মনুষ্যজন্মের একটা আখ্যান। তার শেষকালে একটা মর্যাল, যেমন থাকে সব ভারতকথায়। মর্যালটার কথা ভাবলে অন্য আরেকটা দিক জেগে ওঠে। মর্যালের সার কথাটা এই যে, বহু যোনি ভ্রমণ শেষে অনেক সাধনায় পেলে মানুষজনম। কিন্তু এদেশে এসেই অর্থাৎ মাটিতে নেমেই মায়ায় ভুলে গেলে তোমার প্রতিজ্ঞা। মানুষ হয়ে মানুষের সাধন করার কথা ছিল গুরুর নির্দেশে আর তুমি আটকে গেলে কামনা কুহকে? এর পরের কথা হল; এখনও উপায় আছে, ধরো খুঁজে নাও ইহজীবনের গুরুকে, শিখে নাও সহজসাধন। মনে রেখো চৈতন্যকেও। এই মানুষ জনম নিয়ে তাঁকেও সহজসাধন করতে হয়েছিল শাটিকে নিয়ে। তবে তাঁর মুক্তি হয়েছে।
এইখানে লালনের সেই গানটার কথা উঠবে যেখানে বলা হয়েছে:
আর কি গৌর আসবে ফিরে
মানুষ ভ’জে যা করো গৌরচাঁদ গিয়েছে সেরে।
এই কথার পূর্বসূত্রে বেছে নেওয়া যায় আরেকটা গান, সেটাও লালনের। সেখানে দেখা যাচ্ছে, ব্রজ থেকে নদীয়ায় গৌরজন্মের একটা ক্রম ছিল:
ব্রজ ছেড়ে নদেয় এল
তার পূর্বান্তরে খবর ছিল
এবে নদে ছেড়ে কোথা গেল
যে জানো বলো মোরে ॥
চৈতন্যের মৃত্যুর কোনও প্রামাণ্য বাস্তব খবর সত্যিই তো নেই। কোনও চৈতন্য জীবনীতেই জানা যায় না তাঁর অপ্রকট লীলার বর্ণনা। কেউ লেখেন, তিনি জগন্নাথের দেহে মিশে গেছেন, কেউ লেখেন তিনি ভাবাবেশে লীন হলেন মহাসমুদ্রে। একমাত্র জয়ানন্দ লেখেন পুরীতে নৃত্যকালে পায়ে ক্ষত হয়ে তাঁর প্রয়াণ ঘটে। এইখানে লোকধৰ্ম করে এক সহজ সমাধান। তাদের যুক্তির ক্রম এইরকম—চৈতন্য কেন আবির্ভূত হলেন? মানুষকে, মায়াবদ্ধ জীবকে বোঝাতে সহজসাধনের মাহাত্ম্য এবং নিজেও বুঝতে তার গভীরতা। ওইটুকুই শুধু তাঁর জানা হয়নি ব্রজলীলায়, অপূর্ণতা ছিল তাই। কিন্তু সেই সহজসাধনে পূর্ণতা পেয়ে শেষপর্যন্ত চৈতন্য গেলেন কোথায়? তার একটা উত্তর:
কেউ বলে তার নিজ ভজন
করে নিজ দেশে গমন
মনে মনে ভাবে লালন
এবার নিজদেশ বলি কারে॥
চৈতন্য চলে গেলেন তাঁর নিজদেশে, তাঁর সাধনোচিত ধামে। তাঁর তো লোকশিক্ষা দিতেই আসা। সে কাজ সাঙ্গ করে, জাতিবর্ণের ভেদ ঘুচিয়ে, মানুষের মধ্যে ভক্তির আকুলতা এনে, মানুষের সামনে রেখে এক ভাবোন্নত আদর্শ তিনি চলে গেলেন। এখন আমাদের কী হবে? আমরা কেমন করে তাঁকে পাব বুঝব? তাঁকে কীভাবে পাওয়া যাবে? কেবল অনুমানে?
জবাব মিলল গোৱাডাঙা গ্রামে বাউল-ফকির সংঘের সম্মেলনে। পৌষের প্রচণ্ড শীতের মধ্যরাত। চারপাশ নদীয়া-মুর্শিদাবাদের তাবৎ বাউল-ফকিরে ছয়লাপ। গাঁজার গন্ধে বাতাস মত্ত। একটা মোটা কম্বলে জাড় কমছে না কিছুতে। গান ধরেছেন সনাতন দাস। সত্তর বছর পেরোনো উদাসীন। গান তো নয়, যেন আত্মনিবেদন। কতক গান আর কতক বোঝান। গায়ক আবার কথক। হঠাৎ হঠাৎ নেচেও ওঠেন। কী সে নাচ, কত তার আর্তি। গেয়ে উঠলেন:
হিসাব আছে এই মানব-জমিনে
গড়েছে তিন কারিগর মিলিয়ে শহর
টানা দিয়ে তিনগুণে।
শুভাশুভ যোগের কালেতে
জীব মায়াগর্ভে প্রবেশ করে ক্ষিতির পথেতে
উলোট দল কমল যথা বিশেষ মতেতে ॥
মাতৃগর্ভের কথা বলছি গো। তিন কারিগর হল ব্রহ্ম বিষ্ণু মহেশ্বর আর তিন গুণ হল সত্ত্ব রজ তম। উলোট্ দল কমল হল মাতৃগর্ভের ফুল। সেখানেই জীবনের সূচনা গো। এবারে শোনো:
এইবার সৃষ্টিকর্তা গড়লেন আত্মা
জীবের কর্মসূত্রের ফল জেনে।
প্রথম মাসে মাংস শোণিতময়
দুই মাসে নর নাভী কড়া অস্থি-র উদয়—
তিন মাসে তিন গুণে জীবের মস্তক জন্মায়
চতুর্থেতে নেত্র কর্ণ ওষ্ঠ চর্মলোম…।
মানুষ কি একদিনে হয়? এ কি পশু যে শুধু জীবনধারণ করবে? মানুষকে যে ক্রিয়াকরণ করতে হবে। বুঝতে হবে সব কিছু। চেতনা চাই। চাই ভালমন্দের জ্ঞান, সৎ অসতের বিবেচনা। তাই ধীরে ধীরে তার গঠন।
পঞ্চমেতে হস্ত পদাকার
পঞ্চতত্ত্ব এসে করলেন আত্মাতে সঞ্চার।
সেইদিন হলো জীবের আকার ও প্রকার
ছয় মাসেতে ষড়রিপু বসিল স্থানে স্থানে॥
পঞ্চতত্ত্ব মানে পঞ্চভূত। পৃথিবীর যত ফুল ফল দানাশস্যের মধ্যে থাকে পঞ্চভূত। সেই গর্ভফুলের শোণিত থেকে সন্তান পায় পঞ্চভূত। ছ মাসে জীব যেই আকার আকৃতি পায় অমনি কাম ক্রোধ লোভ মোহ মদ আর মাৎসর্য এই ষড়রিপু তাকে ভর করে।
সপ্তমেতে সপ্তধাতু যে—
এরা আপন আপন শক্তি লয়ে বসিল এসে।
অষ্টমেতে অষ্টসিদ্ধি এল ভোগের কারণে ॥
নয় মাসেতে নয় দ্বার প্রকাশ
দশ মাসে দশ ইন্দ্রিয় না রহে গর্ভধামে ॥
নবদ্বার বলতে বোঝায় দুই চোখ, দুই কান, দুই নাক, মুখবিবর, পায়ু আর লিঙ্গ। দশ মাস পুরে গেলে পাঁচ জ্ঞানেন্দ্রিয় আর পাঁচ কর্মেন্দ্রিয় ফুটে ওঠে। তখন গর্ভমধ্যে সন্তান ছটফট করে। বলে, ‘মুক্তি দাও এ অন্ধকার থেকে বাঁচাও আমাকে এই গর্ভকষ্ট থেকে; এ যে শোণিতময় পিচ্ছিল।’ স্রষ্টা তখন বলে, ‘জনম হলে কী করবি মনে থাকবে তো?’ ‘হ্যাঁ, মনে থাকবে। করব মানুষ ভজন। নির্বিকার হয়ে করব সাধন।’ কিন্তু ঘটে ঠিক উলটো। তাই—
গোঁসাই কালা বলছেন শোন্ রে গোপালে
বায়ু কর্তা নেত্র এলো বাহির মহলে—
এইবার জীব মূলে ভুলে কাঁদিছে পড়ে ভূতলে।
প্রসবের সময় প্রথমে তো মুণ্ডই বেরোয়, তাতে থাকে চোখ। সেই চোখ প্রথম পৃথিবী দেখে আর মায়ার ঝাপট লাগে সেই চোখে। সে কেঁদে ফেলে আর সেই সুবাদে মূলেই ঘটে যায় ভুল।
সে কাঁহা কাঁহা কাঁহা কাঁহা বলে
জীবের সম্বন্ধ তাই ঠিক থাকে না
যখন উদয় যেখানে ॥
সে কেবল কাঁহা কাঁহা বলে। কোথায় সে কোথায় আমি? কোথায় ছিলাম আর কোথায় এলাম? কোথায় গেল আমার স্রষ্টা। তখন জননী দিল স্তন। আঁকড়ে ধরে দুহাতে শিশু দিল টান। জন্মাল তার কামনা। ভেসে গেল প্রতিজ্ঞা। এই তো জীবন বাবাসকল। কথক সনাতন দাস থামলেন।
বাপরে, এ যে পুরো ফ্রয়েডিয়ান চিন্তা-ভাবনা। কিন্তু এর সঙ্গে চৈতন্যের সম্পর্ক কোথায়? গানের শেষে সনাতন দাস বসে গাঁজা টানছেন টোঙের ঘরে। আমি অকুতোভয়ে ঢুকে পড়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘যে গান গাইলেন তার সঙ্গে গৌরাঙ্গ তত্ত্বের যোগ আছে কিছু?’
সনাতন নিখিল চোখে বললেন, ‘গৌরাঙ্গ বা চৈতন্যতত্ত্বের সঙ্গে সবকিছুর যোগ আছে। এই যেমন ধরো আমাদের দুই গুরু—দীক্ষাগুরু আর শিক্ষাগুরু। এখন দীক্ষাগুরু হলেন কৃষ্ণস্বরূপ আর শিক্ষাগুরু রাধাস্বরূপ। তা হলে দীক্ষাগুরু আর শিক্ষাগুরুর সংযোগ হচ্ছে এই শিষ্যদেহে। তা হলে শিষ্যই চৈতন্য। আর শুনবেন?’
খুবই নতুন কথা সন্দেহ কি। তাই উদ্বুদ্ধ হয়ে বললাম, ‘আরও বলবেন? বলুন। এ সব কথা আগে শুনিনি।’
.. হু। ভ্রান্ত বুদ্ধি। আমাদের সব এই শরীর দিয়ে জানতে হয়। যাক শুনুন তা হলে চৈতন্যতত্ত্ব। চৈতন্য কোথায় জন্মালেন, কার বীজে? তাঁর জন্মদাতা জগন্নাথ মিশ্র। জগন্নাথ কে? জগতের প্রভু অর্থাৎ জীব আর ঈশ্বরের মিশ্রণ যেখানে। সেই মিশ্র বীজে তাঁর জন্ম। বীজ ও হ্লাদিনীর সমন্বয় এই হল চৈতন্য। চৈতন্যতত্ত্ব বোঝার জন্য সেই কারণে প্রকৃতি লাগে। প্রকৃতি ছাড়া ধর্ম হয়? আনন্দস্বরূপ রসের প্রয়োজনে প্রকৃতি। অদ্বয় চৈতন্য লাভের জন্যও প্রকৃতি। সব বুঝতে পারছেন?
: সবটাই কি আর বুঝছি? কিছু বুঝছি, কিছু আবছা থাকছে। খুব সহজ তো নয়।
‘তবে এই মুখে কুলুপ আটলাম’ সনাতন দাস বললেন, ‘আর কোনওভাবেই কিছু বলাতে পারবেন না। তবে হ্যাঁ, গাঁজার ঘোর লেগেছে ভাবও লেগেছে। একটা গান গাই বরং। যদি জিজ্ঞেসের জবাব পান—
আছে রূপের দরজায় শ্রীরূপ মহাশয়
রূপের তালা ছোড়ান
তার হাতে সদাই।
যে জন শ্রীরূপ গত হবে
তালা ছোড়ান পাবে।
কী বুঝলেন গো?’
আমি বললাম, “শ্রীরূপ মানে তো নারীদেহ। ঠিক বলেছি?’
সনাতন এগিয়ে এসে আমার মাথার চুল এলোমেলো করে দিলেন দুহাতে। তারপর জ্বলজ্বলে চোখে হেসে বললেন, তবে তো নিত্যানন্দ বোঝা সারা হয়েছে। এখোন, আর একটু এগোন। তা হলেই চৈতন্য আর অদ্বৈত বুঝবেন।’
আমার সারা দেহে কাঁটা দিয়ে উঠল।
আমি বললাম, ‘যেন অনেকটাই বুঝতে পারছি তবু সব তো পরিষ্কার হল না। কী করি বলুন তো? কোথায় যাই?’
: কোথায় কোথায় গেছেন?
: সব বৈষ্ণবতীর্থে। নবদ্বীপ শান্তিপুর খড়দহ বাগনাপাড়া অগ্রদ্বীপ কাটোয়া আদি সপ্তগ্রাম…
: ও সবই শ্রীপাট। কিন্তু সহুজেদের আখড়ায় বেশি যাননি। একবার নসরৎপুর যান দিকিনি। আর পাটুলী।
অগ্রদ্বীপ থেকে বারুণীর স্নান সেরে ফেরার পথে পাটুলী নামলাম। সুন্দর গ্রাম একধারে। আরেকধারে গড়ে উঠছে গঞ্জ। নতুন নতুন বাড়ি বাজার হিমঘর। ওদিকে আমার কাজ কী? বরং গঙ্গার দিকে ছড়ানো-ছিটানো অনেক কুঁড়েঘর আর মেটে দাওয়া। এখানেই দু-তিনশো বছর ধরে সহজিয়াদের ডেরা। এঁরা করেন এক গোপন দেহসাধনা। বিশেষ এক ক্রিয়াকরণ থেকে এঁদের সাধনধর্মের নাম হয়েছে পাটুলী-স্রোত। এঁদের বহির্বাস বলতে সস্তাদরের সাদা মার্কিনের আলখাল্লা আর জনতা ধুতির লুঙ্গি। মাথায় চূড়াকেশ। গলায় তুলসীকাঠের মালা। হাতে নারকোল মালার কিস্তি। অনেকে করেন দুই চাঁদের সাধনা, অনেকে চার চাঁদের। খাঁটি ব্রহ্মচারী বাবাজি বৈষ্ণব সম্প্রদায় এই সহজিয়াদের খুব ঘৃণা করেন। বলেন, পাষণ্ডী, ভ্রষ্ট। বলেন সহুজেরা কদর্য ভক্ষণ করে আবার গৌরের নাম করে। ছিঃ।
এ সব খানিকটা জানা ছিল বলে পাটুলীর সদাব্ৰত অধিকারীর আখড়ায় আমার খুব অসুবিধা হয়নি। কথায় কথায় বরং অন্য কথা তুললাম। বললাম, ‘আচ্ছা এই যে চূড়াকেশ রেখেছেন, পরেছেন আলখাল্লা আর তুলসীমালা—এর তাৎপর্য কী? লোক দেখানো না অন্য কিছু?
সদাব্রত বললেন, ‘খুব ভাল কথা জিজ্ঞেস করেছেন, কিন্তু কেউ কখনও জানতে চায়নি এ কথাটা। তবে শুনুন, কেন এই পোশাক। শাকের ক্ষেত দেখেছেন তো। সামান্য জিনিস। কিন্তু তাকেও রক্ষা করতে একটু বেড়া দিতে হয়। নইলে ছাগলে মুড়িয়ে খাবে। সাধকের পোশাক তেমনই তার বেড়া, রক্ষাকবচ। হাজার হলেও আমরা তো মানুষ। কুচিন্তা কুকর্মে মন যায় না কি? যায়। তখনই হাত রাখি কন্ঠিতে, চূড়াকেশে, আলখাল্লায়। বলি, তুমি না সাধু, ধরেছ উদাসীনের বেশ, তবে? ব্যাস, আত্মসংযম ফিরে এল। পতনের হাত থেকে রক্ষে। বুঝলেন?’
বুঝলাম, মানুষটার ভিতরে বিশ্লেষণ আছে, অর্থাৎ জ্ঞানী। হয়তো পেতেও পারি কিছু গৌরতত্ত্বের হদিশ। কিন্তু এ সব ক্ষেত্রে যা নিয়ম, হঠাৎ কথাটা তোলা যাবে না। খেলাতে হবে খানিক। তাই বললাম, ‘বেশ বলেছেন। কিন্তু এমন করে তো সবাই বলতে পারে না। এই বলা কি ভেতর থেকে আসছে?’
: না, ভেতর পরিষ্কার হলেই বাক্য আসে না। বাক্যের চর্চা করতে হয়। খুব বড় সাধক দেখেছেন? তাঁদের ভেতরটা পরিষ্কার জ্ঞানে টইটইম্বুর। কিন্তু দেখলে বুঝতে পারবেন না। স্তব্ধ শান্ত। প্রকাশ নেই। আর বাচক যারা তাদের ভেতরে যেমনই হোক, বাইরে শান দিতে হয়। যেমন ধরুন এই হ্যারিকেন লণ্ঠন, ভেতরে হয়তো আলো আছে কিন্তু কাচটা চকচকে করে না মাজলে তেমন আলো পাবেন কি? সাধকের সেইজন্যে ভেতর বার দুই-ই পরিষ্কার রাখতে হয়।
: তার মানে মন ও শরীর।
: হ্যাঁ, তবেই নিয়ন্ত্রণে থাকবে ইচ্ছা ক্রিয়া জ্ঞান। ওই তিনেই এক। অদ্বৈত।
মনে হল এবারে কথাটা তোলা যেতে পারে। তাই বলে ফেললাম, ‘আচ্ছা খুব সংক্ষেপে গৌরাঙ্গতত্ত্বটা কী?’
: খুব সংক্ষেপে তো একটা বীজমন্ত্র। সেটা গোপন। আমাদের পাটুলী-ঘরের শ্রীমন্ত্র। দীক্ষা শিক্ষা ছাড়া তা দেওয়া যায় না। তবে একটু বিস্তারে বলতে গেলে:
পূর্বে রাধা ছিলে তুমি আমার অন্তরে।
এবে রাধা আমি রই তোমার অন্তরে ॥
কিছু বুঝলেন?
: হ্যাঁ বুঝলাম। ব্রজে কৃষ্ণের অন্তরে ছিলেন রাধা আর নবদ্বীপলীলায় রাধার অন্তরে ছিলেন কৃষ্ণ। সেইজন্যেই অন্তৰ্কৰ্য বহিরাধা। সেইজন্য চৈতন্যের গৌর অঙ্গ।
সদাব্রত বললেন, ‘প্রায় বুঝেছেন, তবে গৌর অঙ্গের অন্য মানে আছে। একটা গানে সে তত্ত্বটা আছে। ওহে, হরিদাসী, আমার সারিন্দাটা দাও দিকি। একটু মহতের পদ গাই।’
এতক্ষণে হরিদাসীকে দেখা গেল। সাদা ব্লাউজ আর সাদা থান-পরা বৈরাগিনী। নাকে, কপালে গেরিমাটির তিলকসেবা। গায়ের বর্ণ গৌর। খুব ভক্তিভরে মেটে দাওয়ায় বাদ্যযন্ত্রটি নামিয়ে একপাশে নতমুখে বসল। তার যন্ত্র টুং টাং শব্দে বাঁধা হচ্ছে সেই ফাঁকে আমি বলে বসি, ‘হরিদাসীর গান শুনব না?’
হরিদাসী মধুর হেসে ঘাড় কাত করে সায় দেয়। কতজন আমাকে বলেছে, গান যদি শোনেন তো রাঢ়ের বোষ্টমীদের গলায়। শুনেছি অবশ্য অগ্রদ্বীপের মীরা মহান্তের আখড়ায় অনেক বোষ্টমীর গান। তবে সে হল মাঠে মেলায়। সেখানে নিগূঢ় গান কম হয়। ইতিমধ্যে সারিন্দা বাঁধা শেষ। সদাব্ৰত গলা চড়িয়ে ধরেছেন:
গৌর তুমি দেখা দাও আবার
অগ্নিকুণ্ডের কোলাহলে
কান ফেটে যায় ভূমণ্ডলে
ঝাপ দাও সেই চিতানলে
যদি বাঞ্ছা হয় আবার ॥
এরকম গান কখনও তো শুনিনি। গৌর তুমি দেখা দাও আবার। কোথায় দেখা দেবেন? কোন রূপে? অগ্নিকুণ্ডের কোলাহল আর ঝাঁপ দাও বলতে কামাগ্নি বোঝাচ্ছে কি? তবে তো গৌরকে সাধক তার নিজের দেহেই আহ্বান করছে। আশ্চর্য গান তো? গানের বাকি অংশ:
সে-অগ্নিতে হলে দাহন
হয়ে যাবে অগ্নিবাহন
কর্ম হবে সিদ্ধ কারক
কাঞ্চন বর্ণ হবে তার।
গৌর তুমি দেখা দাও এবার ॥
গান থামিয়ে সদাব্রত বললেন, ‘গোরা রূপের মানে পেলেন? কামের রং কালো, ঘোর কৃষ্ণ। সেই কামে ঝাঁপ দিয়ে শোধন করে প্রেমের জন্ম। সেই প্রেমের বরণ কাঞ্চন। গৌরাঙ্গই প্রেমস্বরূপ। তাঁর বরণ হেম।’
আশ্চর্য, সকল লোকধর্মই গানে গানে আমাকে বোঝাতে চাইছে যে, চৈতন্য কোনও ব্যক্তি নন, অবতার নন, চৈতন্য একটা স্তরান্বিত চেতনা। তাঁকে মূর্তিতে বা মন্ত্রে পাওয়া যাবে না। পেতে হবে সাধনার বিমিশ্রণে, শোধনে। ব্যাপারটা আমাকে টানতে লাগল এবার। আমি বললাম, “গৌরাঙ্গকে নিয়ে সহজ সরল গান নেই আপনাদের?’
: সরল মানে? শুনতে না বুঝতে? আমি যেটা গাইলাম সেটাও খুব সরল গান, অবশ্য যদি বোঝেন। আচ্ছা এবারে একটা শুনতে সহজ গান শুনুন। নাও হরিদাসী, সুর ধরো।
সদাব্রত চোখ বন্ধ করে সারিন্দায় চড়া পর্দায় সুর তোলেন আর সেই পর্দা থেকে হরিদাসী ধরে:
গুরু হে, চেয়ে দেখতে পাই গৌরময় সকলই
চাঁদ গৌর আমার জপের মালা
গৌর গলার মাদুলি
আমি গৌর গহনা গায়ে দিয়ে
ধীরে ধীরে পা ফেলি॥
নয়নের অঙন গৌর।
গৌর নোলক অলক তিলকা চন্দ্রহার
গৌর কঙ্কন গৌর চাঁপাকলি।
গৌর নাম করি গায়ে নামাবলী।
গৌর আমার শঙ্খ শাড়ি
গৌর মালা পুঁইচে পলা চুলবাঁধা দড়ি
দুই হাতের চুড়ি গৌর আমার
গৌর কাঁচুলি॥
গান শেষ হতে দেখি হরিদাসীর চোখভরা জল। বিশ্বাসের জগতে আমি জিজ্ঞাসু নাস্তিক। খুব বেমানান লাগে। আমি বললাম, ‘এই কি গৌরনগর ভাবের পদ?’
‘তা হবে’ খুব উদাস ভঙ্গিতে বললেন সদাব্রত, ‘ও সব কথা তো আপনাদের। আর আমাদের কথা হল একটাই—কবে গৌর পাব।’
জিজ্ঞাসুর সঙ্গে ভক্তের এইখানটায় তফাত, জ্ঞানের সঙ্গে বিশ্বাসের। আমি তো বুঝতে চাই স্তরে স্তরে, বিন্যাসে এবং শ্রেণীকরণ করে। ওঁরা উপলব্ধি করেন প্রবর্ত-সাধক-সিদ্ধ এইসব থাকে থাকে। ওঁদের জানাটি খাড়াখাড়ি, আমারটা আড়াআড়ি। আমি সমাজসত্যের ব্যাপ্তিতে ধরতে চাই চৈতন্যকে, ওঁরা ব্যক্তিক বোধের সীমায় নিজের করে চান চৈতন্যকে। অথচ ওঁদের, মানে লোকধর্মে লজিক ছাড়া মিথ ছাড়া কিছুই গৃহীত হয় না। সেইজন্যেই নিজেদের মধ্যে গুটিয়ে থাকতে ভালবাসেন ওঁরা। লড়াই লাগে না উচ্চবর্গের সঙ্গে। তাই ওঁদের মিথ সম্পর্কে আমাদের কৌতুহলের মূলে থাকে কৌতুক। আমাদের বেদপুরাণ আর শ্রেণীবর্ণ চেতনা সম্বন্ধে ওঁদেরও কৌতুক আছে কিন্তু কৌতূহল নেই। চৈতন্য সম্পর্কে দুটো শ্লোক তো আমি কতবার শুনেছি। তার একটা:
সত্য ত্রেতা দ্বাপর কলি হয়
তার মাঝে গোরা এক দিব্যযুগ দেখায়।
এখানে তো স্পষ্টই আমাদের পৌরাণিক যুগবিন্যাস আর অবতারতত্ত্বকে বাতিল করা হয়েছে। নিম্নবর্গের উদার-ভাবনায় দিব্যযুগ শব্দটি এক নতুন সৃষ্টি। এখানে দিব্যযুগ এক আদর্শ স্বপ্নের যুগ যা ব্রাহ্মণ্যপোষিত নয়, রাজন্যশাসিত নয়, নয় শ্রেণীবর্ণে দীর্ণ। গৌরাঙ্গ যদি কোনও সুস্থ সমাজ গঠনের আদর্শ এনে থাকেন তবে তা মুক্ত সমাজ। মানবিকতায় সমুজ্জ্বল, দেহধর্মে উষ্ণ, কামনা-বাসনায় মর্ত্যধর্মী। এই বোধে দাঁড়িয়ে লোকধর্মের আরেকটা বক্তব্য হল:
গোরা এনেছে এক নবীন আইন দুনিয়াতে।
বেদপুরাণ সব দিচ্ছে দুষে সেই আইনের বিচারমতে॥
গোরার এই নবীন আইনই তা হলে নিম্নকোটির অভয়মন্ত্র। এই আইনের বলেই তাঁরা শাস্ত্রকে খাটো করেন মানুষকে বড় করে দেখেন। ঘটে-পটে পূজার বিরোধিতা করেন। পুরুষ আর নারীর মধ্যে আরোপ করেন কৃষ্ণরাধার মিথ। সহজিয়াদের এই ধর্মের ছক এমনকী এম. টি. কেনেডির মতো বিদেশিরও বুঝতে অসুবিধে হয় না। তিনি স্বচ্ছভাষায় লেখেন:
The worshipper is to think of himself as Krishna and to realise within himself the passion of Krishna for Radha, who is represented by the female companion of his worship. Through sexual passion salvation is to be found, The Radha-Krishna stories are held as the justification of their practices which are secret and held at night,
এখন এই রাধা-কৃষ্ণ কাহিনী, বড়ই বুড়ি-চন্দ্রাবলী-আইহনের মিথ, গৌরাঙ্গ-বিষ্ণুপ্রিয়া-শচীমা-র ত্রি-কাহিনী এ সবের পেছনে স্পষ্ট যুক্তি পরম্পরাও যে আছে তা অন্তত আমি কোনও নিবন্ধে পড়িনি। লোকধর্মের আরেক স্ফুরণ তরজা-পাঁচালি-কবিগান-বঁদগান ও কথকতায় পুরাণের এত ভাঙাগড়া হয় মুখে মুখে গায়কে গায়কে, যার কোনও বিশ্লেষণ কেউ লিখে রাখেনি। রাখলে বাংলায় পেতাম আর এক দামোদর ধৰ্মানন্দ কোশাম্বীকে।
এই সব ভাবনা থেকে দুপুরবেলার অন্নসেবার পরে আমি সদাব্রতকে বললাম, ‘কিছু খুচরো প্রশ্ন আছে। জবাব দেবেন?’ সদাব্রত রাজি হতে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা আপনাদের বিশ্বাসে কী বলে, বিষ্ণুপ্রিয়ার কী অপরাধ? কেন তাঁকে মহাপ্রভু ত্যাগ করলেন?’
সর্বজ্ঞের মতো হেসে সদাব্রত বললেন, ‘ত্রেতা যুগে যিনি সীতা, কলিতে তিনিই বিষ্ণুপ্রিয়া। মায়ামৃগের ঘটনা মনে আছে তো? লক্ষ্মণের নিষেধ না মেনে গণ্ডী পেরিয়ে সীতা যেই রাবণকে ভিক্ষা দিলেন অমনি রাবণ সীতাহরণ করলেন। সেবারের নিষেধ অমান্য করার জন্যেই এবারে মহাপ্রভু ত্যাগ করলেন বিষ্ণুপ্রিয়াকে। কী, এবারে শচীমা-র কথা মনে জাগছে তো?’
: অবশ্যই। মাতৃঋণ শোধ না করে চৈতন্য কেন তাঁকে কাঁদালেন?
: শচী মা ত্রেতা যুগে যে ছিলেন কৈকেয়ী। পুত্রবিরহের বেদনায় মা কৌশল্যা কৈকেয়ীকে অভিশাপ দিয়েছিলেন, ছেলে ছেড়ে থাকার কষ্ট তুই পাবি কলিযুগে। তাই নিমাই সন্ন্যাস।
: জগাই মাধাইয়েরও এরকম ব্যাখ্যা আছে নাকি?
: হ্যাঁ, যুগে যুগেই তো ভগবানের সঙ্গে শত্রুভাবে ভজনা চলছে। কলিতে যারা জগাই মাধাই মূলে তারা স্বর্গের দারোয়ান জয় বিজয়। ব্রহ্মশাপে তাদের নরদেহ আর শত্রুভাব। এরাই আগে হয়েছিল রাবণ-কুম্ভকর্ণ ত্রেতায়, শিশুপাল-দন্তবক্র দ্বাপরে।
চমৎকার। আমাকে তারিফ করতেই হয়। এবারে শেষ প্রশ্ন করি, ‘আচ্ছা চৈতন্যকে দীক্ষা দিলেন কেশবভারতী এর তাৎপর্য কী? ভগবানের আবার দীক্ষা কেন?’
: গুরুতত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা দিতেই এমন ঘটেছে। আর এ ঘটনাও তো নতুন নয়। সত্যযুগে সনক ঋষি, ত্রেতায় বিশ্বামিত্র, দ্বাপরে গর্গ যেমন, তেমনই কলিতে কেশবভারতী।
সদাব্রত নিজেই যে ক্রমে নিজের জটে জড়িয়ে পড়ছেন তা বুঝতে পারছিলেন না। অথচ এ তো খুব স্বচ্ছভাবেই বোঝা যাচ্ছে যে, সত্য ত্রেতা দ্বাপর কলির বাইরে যাঁরা দিব্যযুগ মানেন তাঁরা কেন তাঁদের মিথের সমর্থনে সেই সত্য ত্রেতা দ্বাপরকে টানবেন? এইখানে নিম্নবর্গের চিন্তাভাবনার স্বরূপটাই ধরা আছে। একদিকে উচ্চবর্গের পুরাণ ও মিথের প্রতিবাদী চেতনা থেকে তাঁরা নিজেদের নতুন মিথ তৈরি করেন অথচ আবার নিজেদের যুক্তি দিয়ে বানানো মিথের সমর্থন খোঁজেন উচ্চবর্গের পুরাণেই। একইসঙ্গে প্রতিবাদ আর সহকারিতা।
সেদিন সদাব্রত আমাকে এগিয়ে দিলেন পাটুলী স্টেশন পর্যন্ত। দুপুর শেষের ব্যান্ডেল-কাটোয়া লোকালের স্বরূপ চৈতন্যতত্ত্বের মতোই দুর্জ্ঞেয়। কখন আসবে কে জানে? বসে আছি স্টেশন চত্বরের সিমেন্টের বেঞ্চে। মাথার উপর কাঠমল্লিকা ফুল পড়ছে টুপটাপ। বইছে এলোমেলো বাতাস। জমছে দুটো-পাঁচটা করে যাত্রীর দল। হঠাৎ এসে পড়ল একদল বাউল। কোনও মেলামচ্ছব থেকে আসছে বোধহয়। খানিক গাঁজা খেল সবাই। আমি গুটিগুটি তাদের মাঝখানে বসে পড়লাম তারপর ঘষটাতে ঘষটাতে গিয়ে বসলাম বাউলদের মাল্তে অর্থাৎ দলনেতার সামনে। বললাম, ‘কিছু তত্ত্বকথা জানতে চাই, বলবেন?’
গাঁজায় টং চোখ লাল বাউল গোঁসাই বলেন, ‘তত্ত্ব জানতে চাও, তা আত্মতত্ত্ব সেরেছ?’
আমি বুঝলাম, সেই বাঁধা ফরমুলা। আমার পরীক্ষা হবে। বললাম, ‘জিজ্ঞাসা করুন।’
: তুমি কে? এলে কোথা থেকে?
: আমি মানুষ। ছিলাম পিতার মস্তকে, বিন্দুরূপে।
: বাঃ বেশ। পিতার বিন্দু কোথা থেকে এল?
: দানা শস্য ফলমূল থেকে। তার মূলে পঞ্চভূত।
: ভাল। খুব ভাল। তো পঞ্চভূত কী?
সব প্রশ্নই পটপট জবাব দিলে প্রশ্নকারীর অহং আহত হয় জানি, তাই বোকা সেজে মুখ বিপন্ন করে বলি, ‘ক্ষিতি অপ তেজ মরুৎ ব্যোম পর্যন্ত জানি। তাঁরা যে কে জানি না।’
অজ্ঞতা এ সব সময়ে কাজ দেয়। ঠিক তাই হল। বাউল গোঁসাই দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, ‘ব্যোম মানে চৈতন্য, মরুৎ নিতাই, তেজ অদ্বৈত, ক্ষিতি গদাধর আর অপ হল শ্রীবাস।’
: তা হলে পঞ্চতত্ত্বে দেহের গঠন?
: ঠিক বলেছ। তোমার প্রবর্ত দশা ঘুচেছে। আচ্ছা, আর একটা কথা তোমারে আমি শুধাবো। জবাব দিলে তবে তোমার তত্ত্ব কথার জবাব পাবে। কী, রাজি তো? আচ্ছা বলো তো, হনুমানের কেন মুখ পুড়ল? লঙ্কার আগুন ল্যাজে লেগেছিল, সেই আগুন মুখে ঘষেছিল—এ সব বাজে কথা বলবে না কিন্তু। নাও, এবারে বলো।
হা ঈশ্বর। শেষকালে আমাকেই বানাতে হবে মিথ এবং তা নিম্নবর্গের অদ্ভুত যুক্তি মেনে? এমন বিপদ থেকেই মিথের জন্ম নাকি? যাই হোক, খেলে গেল বুদ্ধি। গ্রামের মানুষের স্পর্শকাতর ভাবনা কিছু কিছু জানতাম। তাই মনে রেখে বললাম, ‘হনুমানকে রামচন্দ্র বলেছিলেন অশোকবনে গিয়ে জানকীকে রামের অঙ্গুরীয় দেখাতে এবং বলতে যে, মা জননী তোমার ভয় নেই। তোমার উদ্ধারের জন্যে যুদ্ধের জোড়জোড় চলছে। কিন্তু হনুমান সীতাকে এইসব বলে তারপরে এক বাড়তি কথা বলে ফেললে। ‘মা জানকী রামচন্দ্রকে দেখবে? তবে ওঠো আমার কাঁধে। তোমাকে নিয়ে একলাফে আমি সাগরপারে যাব।’ এতে দুটো দোষ হল। আরে মূর্খ হনুমান, তুই করবি সীতার উদ্ধার? এই অহংকার তার এক নম্বর অপরাধ। আর তার চেয়েও গুরুতর অপরাধ এই যে হনুমান সীতাকে কাঁধে চড়াতে চেয়েছিল। তার মানে তার অঙ্গস্পর্শের বাসনা হয়েছিল। পশু তো? এই দুই পাপে তার মুখ পুড়ল।
বাউল গোঁসাই বললেন, ‘সাবাশ।’ আমার ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল।
বাউল গোঁসাইয়ের মনটা বেশ খুশি খুশি। বললেন, ‘একটা গান শোনো। দেখি তুমি এ-তত্ত্বটা ধরতে পারো কি না। শোনো আর ভাবো:
তুমি ঘুমালে যিনি জেগে থাকেন
সেইতো তোমার গুরু বটে
সে যে আছে, দেহের মাঝে
তারে ভালোবাসা অকপটে॥’
আমি ভাবলাম এ-তত্ত্ব তো বেশ কঠিন। এই কি চৈতন্যতত্ত্ব? আমি ঘুমালে জেগে থাকে আমার চেতনা। কিন্তু ততক্ষণে গানের পরের অংশ এসে গেছে:
জীব চলে বলে ফিরে
শুধু তো তাহারই জোরে
সুখ দুঃখ আদি করে
সকলই ঘটায় এই ঘটে।
চেতনার বশেই কি মানুষ চলে বলে? নাকি প্রাণের কথা বলা হচ্ছে এখানে? কিন্তু প্রাণই কি সুখ দুঃখের কারক? এবারে পরের অংশ:
করিলে তাঁর সাধনা
সকলই যাইবে জানা
হবে না আর আনাগোনা
এ ভব সংসার সংকটে।
না, নিশ্চয়ই প্রাণ বা চেতনার কথা বলা হচ্ছে না এ-গানে। প্রাণ বা চেতনার সাধনা খুবই ভাববাদী কথা। বস্তুবাদী বাউল এ গান গাইবে কেন? এমন কীসের এই সাধনা তা হলে যাতে জন্মমরণ পার হওয়া যায়? এবারে শেষ অংশ:
সে যেদিনে ছেড়ে যাবে
তোমারে তো শব করিবে
কেনা বেচা ফুরিয়ে যাবে
এত সাধের ভবের হাটে।
চমৎকার। এবারে বুঝেছি। বললাম, ‘শ্বাসের কথা বললেন তো? শ্বাসই তা হলে গুরু? সেই চালায় তাই চলি। সে না থাকলেই আমি শবমাত্র। আর সেই শ্বাসকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে জ্যান্তে মরার অনুভূতি হয় অর্থাৎ দেহমনের বাস্তব চেতনা থাকে না। ঠিক বুঝেছি তো?’
: বেশ বুঝেছ। আর একটু বোঝে। ওই শ্বাসের চলাচল থেকেই বিন্দুর চলাচল। শ্বাস নিয়ন্ত্রণ থেকেই বিন্দু রক্ষা। বিন্দুই চৈতন্য বিন্দুই কৃষ্ণ। বিন্দুর আরেক নাম মণি।
যেন একটা দমকা হাওয়ার ঝাপট লাগে সহসা। ‘তাঁকে জানতে গেলে গুরুকে বশ করো’ গানের মানে এবারে এতদিনে কি তবে বুঝলাম? গুরু মানে শ্বাস? তিনি মানে কৃষ্ণ অর্থাৎ চৈতন্য। একেবারে দিশেহারা হয়ে, আবার আনন্দে উত্তেজনায় বললাম, ‘তবে কি চৈতন্যতত্ত্ব বুঝে ফেললাম?’
‘বোঝো নি, তবে বোঝার পথে এবারে খানিক দাঁড়িয়েছ’ বললে বাউল, ‘গরম থাকতে থাকতে আরেকটা গান শুনে নাও:
কোন কৃষ্ণ হয় জগৎপতি
মথুরায় কৃষ্ণ নয় সে
সে কৃষ্ণ হয় প্রকৃতি।
গান থামিয়ে বললে, ‘কী বুঝলে? প্রকৃতি মানে কী?’
বললাম, ‘প্রকৃতি মানে বিন্দু।’
: ঠিক ঠিক। এবারে শোনো:
জীবদেহে শুক্ররূপে
এ ব্ৰহ্মাণ্ড আছে ব্যেপে
কৃষ্ণ তারে কয়।
পুরুষ যেই হয় সেই রাধার গতি॥
এ কী তত্ত্ব? কৃষ্ণ যদি হয় বিন্দু তবে তাকে ধারণ করে আছে যে পুরুষ দেহ সেই রাধা। অন্তর্কৃষ্ণ বহিরাধার তা হলে এমন ব্যাখ্যাও হতে পারে? আমি বাউল গোঁসাইয়ের দুহাত জড়িয়ে ধরে বলি, ‘বলুন বলুন, আর একটু বলুন। গানের বাকিটুকু।’
কিন্তু হঠাৎ দারুণ হইচই চারধারে। দৌড়াদৌড়ি। শতশত লোক চারদিকে উথাল পাথাল। ব্যান্ডেল কাটোয়া লোকাল দেখা দিয়েছে দু ঘণ্টা লেটে। উঠে দাঁড়িয়ে আমার ছলছল চোখের দিকে চেয়ে বাউল বললে, ‘তোমার একটু দেরি আছে। তবে জানতে পারবে তাঁকে।’
চৈতন্যকে বোঝার একটা সোজা পথ তো ইতিহাসে, শাস্ত্রে, জীবনীগ্রন্থে ধরা আছে। আর একটা পথ গোপ্য ও নির্জন। সে পথ একবার আমাকে অনেক দূর এগিয়ে দেয় আবার উলটো টানে গভীর রহস্যে ফেলে সরে দাঁড়ায়। আমার মনে তাই কিছুতেই স্থির সিদ্ধান্ত আসে না যে চৈতন্যকে আমি কোন দিক থেকে বুঝব। তাঁকে কি ভাবব একজন ঐতিহাসিক যুগপুরুষ, ধর্মনেতা ও সমাজত্রাতা ব্যক্তিরূপে? না কি ভাবব গভীর নির্জন পথের এক আলোকচেতনার উপলব্ধি রূপে? এ দ্বৈধ থেকে আরেকটা প্রশ্ন জাগে। উচ্চবর্গের বৈষ্ণব সমাজ যাকে অধিনেতা ভাবে, মনে করে অবতার ও পূজ্য, এমনকী গড়ে মূর্তি ও পূজাপদ্ধতি; নিম্নবর্গের মানুষ কেন তাকে মানতে চায় অমূর্ত আচরণে, গোপন সাধনে? এরমধ্যেই কি রেখায়িত হয়ে আছে কোনও অভিমানী প্রতিবাদের অনচ্ছ সমাজচিত্র? কোনও অধিকার বিচ্যুতির গহন দুঃখ থেকে কি তারা চৈতন্যকে গোপন করল ব্যক্তি থেকে ভাবে?
এইসব সূত্র চৈতন্য সমকাল ও তাঁর প্রয়াণ পরবর্তী বৈষ্ণবমণ্ডলীর ইতিহাসে খোঁজ করা উচিত। আসলে চৈতন্য থেকেই বাংলা সমাজে একধরনের ভাঙনের শুরু। কীসের ভাঙন? ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র তথা বৈদিক সংস্কৃতির ভাঙন। তার মানে, জাতিবর্ণ শাস্ত্র সামন্ত সমাজের ভাঙন। এক দিকে ব্রাহ্মণ ও উচ্চবর্ণের সমাজনেতৃত্ব আরেক দিকে মুসলমান রাজতন্ত্র আর তার মাঝখানে ছিল চৈতন্যের বৈষ্ণব সমাজের স্বপ্ন ও আহ্বান। লড়াইটা ছিল অসম কিন্তু আদর্শ ছিল মানবিক। সব মানুষ সমান, শুধু হরি বললেই মুক্তি, বৈষ্ণবকে হতে হবে অতিসহিষ্ণু দীনাতিদীন—চৈতন্য তো এই তিনটে সার কথা বলেছিলেন তাঁর ধর্ম-আন্দোলনে। কথাগুলি শুনতে চমৎকার, ভাবতেও ভাল কিন্তু আচরণে ফুটিয়ে তোলা কঠিন। তাঁর এই নতুন ভাবনার সঙ্গে ছিল ভক্তি ও সাহস আর অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত দেহের দীপ্তি। সেই ব্যক্তিত্বের টানে কত লোক ভক্তিতে ভালবাসায় আবার আত্মরক্ষা বা প্রতিবাদে ছুটে এল তাঁর পাশে, নিল শরণ। এখানে মনে রাখতে হবে চৈতন্য ব্রাহ্মণ বলেই তাঁর বাণীগুলি মানিয়ে গেল, হল সকলের গ্রহণীয়, সবাই তাঁকে মানল। তিনি নিচুজাতির মানুষ হলে ধর্মভেদ, মন্ত্রমূর্তি ও শাস্ত্রাচারের বিরুদ্ধে তাঁর বিক্ষোভ কি সেকালে মানাত বা তাঁকে সবাই অমন করে মানত? এইখানেই চৈতন্য আন্দোলনের দুটো ফাঁক রয়ে গেল। তিনি ব্রাহ্মণ বলেই স্বাভাবিক নেতৃত্ব পেলেন, তাঁকে তা অর্জন করতে হল না এবং এই ব্রাহ্মণত্বের রন্ধ্রপথেই ভবিষ্যৎ বৈষ্ণব-সমাজের পতনের বীজ পোঁতা রইল। তাঁর প্রয়াণের একশো বছরের মধ্যে ‘ব্রাহ্মণ-বৈষ্ণব’ অংশ হটিয়ে দিল ব্রাত্য ও জাত-বৈষ্ণবদের মূল স্রোত থেকে। নবদ্বীপের চেয়ে বড় হয়ে উঠল বৃন্দাবন। যাঁরা হটে গেলেন তাঁরা তো চৈতন্যকে ভালবাসতেন তাই বৈষ্ণবতার উচ্চবর্গে স্থান না পেয়ে গড়ে নিলেন আরেক ধরনের বৈষ্ণবতা। এখান থেকেই চৈতন্যকে ঘিরে গৌণধর্মগুলির উদ্ভাবনের বীজ খুঁজতে হবে। এই পরাজয় ও প্রত্যাখ্যান থেকেই তাঁদের গোপনতার সাধনা। চৈতন্যকে ব্যক্তিরূপে না ভেবে সংকেতের মধ্যে বোঝার সূচনা হয়তো এইভাবেই।
ইতিহাস আরেকটা কথাও বলে। চৈতন্য তাঁর ধর্ম আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে মুসলমান রাজশক্তির কাছ থেকে যতটুকু প্রতিরোধ পেয়েছিলেন তার শতগুণ প্রতিরোধ এসেছিল সমকালীন ব্রাহ্মণ সমাজ ও হিন্দু সমাজপতিদের কাছ থেকে। তাঁর সমকালে স্মার্ত রঘুনন্দন ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রচুর নিয়মকানুন তৈরি করেন এবং তাঁর সহপাঠী কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ (শোনা যায় ইনিই কালীমূর্তি ও কালীপূজার প্রবক্তা) গড়ে তোলেন বহুতর শাক্ততান্ত্রিক তামসিকতা। এখানেই শেষ নয়। শেষপর্যন্ত চৈতন্যকে নবদ্বীপ ত্যাগ করতে হয় কেন এবং কেন তিনি তাঁর জীবনের শেষ আঠারো বছরে গৌড়বঙ্গেই প্রবেশ করেননি তার সদুত্তর কে দেবে? একটা উত্তর অবশ্য লোকগীতিকারদের রচনায় কৌশলে গাঁথা আছে। সেখানে বলা হয়েছে:
মহাপ্রভুর বিজয়ের কালে
যত দেশের বিটলে বামুন
তারে পাগল আখ্যা দিলে।
মানুষ অবতার গোঁসাই
সাত্ত্বিক শরীরে উদয়
দেখে তাই পামর সবাই
ভির্মি রোগ বলে॥
তা হলে প্রথমে পাগল, তারপরে ভির্মিরোগী বলে তাঁকে অবজ্ঞা করা হয়েছিল। কিন্তু তাতেও যখন মহাপ্রভুর বিজয় অভিযান ঠেকানো গেল না তখন কূটবুদ্ধি ব্রাহ্মণরা কী করলেন?
যখন দেখে মিথ্যা কিছু নয়
বৈষ্ণব এক গোত্রসৃষ্টি পায়
দেশের বামুন মিলে সবাই
শাস্তর টীকা লিখে নিলে॥
এই হল চিরকালের বাঙালি ব্রাহ্মণ্যসমাজের কৌশল। মনে পড়া উচিত যে, চৈতন্যজন্মের অনেক আগে তুর্কি আক্রমণের মুখে, অত্যাচারের ভয়ে অনেক ব্রাহ্মণ ও উচ্চবর্ণের মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলেন বর্ধিষ্ণু জনপদ থেকে বহু দূরের অনুন্নত প্রত্যন্ত গ্রামে। সেখানে অনার্য সমাজ কাঠামোর এক কুসংস্কারান্ধ জনমণ্ডলী পূজা করত তাদের কৌম দেবদেবী চাণ্ডী, মনসা, ধর্ম বা অন্যকিছুকে। যাদের কোনও Anthropomorphic গঠন ছিল না, যাদের তারা খুঁজে নিয়েছিল পাথুড়ে নুড়ি বা সিজবৃক্ষে এবং এমনকী বন্য জন্তু ও সাপে। তাদের বানানো অপদেবতাদের রুদ্ৰকাহিনী ও প্রতিহিংসাপ্রখর ভয়ংকরতা নিয়ে তারা মুখে মুখে বানিয়েছিল মেয়েলি ব্রতকথা। ব্রাহ্মণ ও অন্য উচ্চবর্ণযুক্ত নবাগত শিষ্টসমাজ অচিরে হিন্দু পুরাণের সঙ্গে কল্পনা কৌশলে ব্রতকথাগুলিকে মিলিয়ে মিশিয়ে তৈরি করে নিলেন মঙ্গলকাব্য। এইভাবে মুখে-মুখে চলা গ্রাম্য ব্রতকথা পেয়ে গেল মার্জিত সাহিত্যের উচ্চ সম্মান। কথক ঠাকুররা সেই মঙ্গলগান গাইতে লাগলেন গ্রামে-গ্রামান্তরে। জীবিকার একটা পথও খুলে গেল। কেন না আসর বসত এক মঙ্গলবার থেকে আরেক মঙ্গলবার পর্যন্ত। এইভাবেই অনার্যসমাজের কাঁধে হাত রেখে ব্রাহ্মণ ও বৈদ্যরা (দু দলই উপবীতধারী) পেয়ে গেলেন সম্মান ও সম্ভ্রম। অন্ত্যজরাও খুশি হল। কেন না তাদের কাহিনী পেল মান্যতা। তারা তো উঁচু হল। এইভাবে সাপের দেবী মনসা হলেন শিবের কন্যা, আদিবাসী চণ্ডী হলেন দুর্গার প্রতীক চণ্ডী। অচ্ছুৎ অশ্রুত ব্রাত্যকাহিনী পেল অভিজাত বর্গের স্বীকৃতি। ব্রাহ্মণ্যকরণ সম্পূর্ণ হল।
শ্রীচৈতন্যের বেলাতেও ঠিক এমনই হল। ব্রাহ্মণরা যখন দেখল চৈতন্যের বিপুল প্রভাব, বৈষ্ণবধর্মের ব্যাপক গ্রহণীয়তা, যখন সমাজের বণিক সম্প্রদায় ও বৈশ্যশূদ্ররা তাঁকে মানতে লাগল, তখন ব্রাহ্মণসমাজ চৈতন্যকে নিয়ে লিখতে লাগল শাস্ত্রটীকা-ভাষ্যজীবনী। হিসেব নিলে দেখা যাবে এখন পর্যন্ত যত বৈষ্ণব শাস্ত্র গ্রন্থ টীকা ও পদ সংকলন হয়েছে তার পনেরো আনাই ব্রাহ্মণপ্রণীত। অবশ্য তাঁরা হিন্দু ব্রাহ্মণ নন তখন আর। ‘ব্রাহ্মণ-বৈষ্ণব’ অর্থাৎ ব্রাহ্মণ থেকে মন্ত্রদীক্ষা নিয়ে বৈষ্ণব। বৈষ্ণবস্মৃতিশাস্ত্রে এরকম পরিষ্কার নির্দেশ ছিল যে কোনও ব্রাহ্মণকে বৈষ্ণব-দীক্ষা নিতে গেলে নিতে হবে ব্রাহ্মণ-বৈষ্ণবের কাছে। শূদ্র বৈষ্ণবের অধিকার নেই ব্রাহ্মণকে মন্ত্রদানের। নরহরি, নরোত্তম ও শ্যামানন্দ এ নিয়ম মানেননি। অবশ্যই তাঁরা বিরল ব্যতিক্রম। এ কথা ঐতিহাসিক সত্য, বাংলা ও বৃন্দাবনের বৈষ্ণবতার মূল ধারা ছিল ব্রাহ্মণমুখী। চৈতন্য নিজে ছিলেন ব্রাহ্মণ। তাঁর প্রধান দুই সহকারী অদ্বৈত আর নিত্যানন্দ ছিলেন ব্রাহ্মণ। বৃন্দাবনের বড় গোস্বামীর মধ্যে রূপ-সনাতন জীব রঘুনাথ ও গোপালভট্ট এই পাঁচজনই ছিলেন ব্রাহ্মণ। চৈতন্যপরবর্তী কালের নেতৃস্থানীয় বৈষ্ণব জাহ্নবাদেবী, রামচন্দ্র, বীরভদ্র ছিলেন ব্রাহ্মণ। সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকের বৈষ্ণবধর্মের বাঙালি তাত্ত্বিক শ্রীনিবাস আচার্য, বিশ্বনাথ চক্রবর্তী, নরহরি চক্রবর্তী ও রাধামোহন ঠাকুর ছিলেন ব্রাহ্মণ।
সহকর্মী এক অধ্যাপক বন্ধু বললেন, ‘বৈষ্ণব আন্দোলন আসলে এক ফ্র্যাগমেন্টেশনের ইতিহাস। চৈতন্য যতই জাতিবর্ণভেদ ঘোচাতে চান, এক নিত্যানন্দ, নরোত্তম আর শ্যামানন্দ ছাড়া আর কেউ ব্রাহ্মণত্বের প্রভাব ও প্রতিপত্তি অগ্রাহ্য করতে পারেননি। বিমানবিহারী মজুমদার জানিয়েছেন শ্রীচৈতন্যের ৪৯০ জন প্রত্যক্ষ শিষ্যের মধ্যে ২৩৯ জন ছিল ব্রাহ্মণ, ৩৭ জন বৈদ্য, ২৯ জন কায়স্থ, ২ জন মুসলমান, ১৬ জন স্ত্রীলোক আর ১১৭ জন শূদ্র। আরেকটা কথা বিচার্য যে চৈতন্য-সমকালে ও পরে গৌড়ীয় বৈষ্ণবের কোনও কেন্দ্রীয় সংগঠন ছিল না। বৃন্দাবন ও নবদ্বীপে অর্থাৎ ব্রজমণ্ডল ও গৌড়মণ্ডলে কোনও সংহতির সম্পর্কও ছিল না। ফলে যে যার মতো কাজ করে গেছেন। জাতিভেদ প্রথা বিলোপের ব্যাপারে গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের কোনও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা বা নির্দেশও ছিল না।’
আমি বললাম, ‘নিত্যানন্দ সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?’
: নিত্যানন্দ ছিলেন উদার প্রকৃতির জীবনরসিক। সাজগোজ ভালবাসতেন। ভালবাসতেন শোরগোল, হইচই। একটু তান্ত্রিক ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল। জীবনরসে ভরপুর। জাতিবর্ণ চেতনা একেবারে ছিল না। চৈতন্য পুরী থেকে নিত্যানন্দ আর অদ্বৈতকে বলে দেন গৌড়বঙ্গে বৈষ্ণব ধর্ম ব্যাপকভাবে প্রচার করতে। আর রূপ-সনাতনকে বলেন বৃন্দাবনে গিয়ে শাস্ত্ৰটীকা রচনা করতে। দুটোর মধ্যে প্রথম থেকে সমন্বয় ছিল না। এর ফলে খুব খারাপ হয়েছে। যাই হোক নিত্যানন্দের কথা হচ্ছিল। খুব বড় ব্যক্তিত্ব। ‘প্রেম বিলাস’ পড়লে দেখবেন বৃদ্ধ বয়সে অদ্বৈত ভক্তির চেয়ে জ্ঞানমার্গের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়েন, ফলে প্রচার আর বৈষ্ণবীয় দীক্ষার দিকটা বেশি নেন নিত্যানন্দ। সারা দেশ কাঁপিয়ে দেন। বৌদ্ধ বিকৃত বামাচারী বারোশো নেড়া আর তেরোশো নেড়িকে নিত্যানন্দই গৌরমন্ত্র দিয়ে জাতে তোলেন।* তাঁর দৃপ্ত ও দর্পিত ঘোষণা ছিল:
নিত্যানন্দ স্বরূপ সে যদি নাম ধরো।
আচণ্ডাল আমি যদি বৈষ্ণব না করোঁ॥
জাতিভেদ না করিমু চণ্ডাল যবনে।
প্রেমভক্তি দিয়া সভে নাচামু কীর্তনে॥
নিত্যানন্দের এই সমদর্শী উদার নীতি উচ্চবর্ণের এবং বিশেষত বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের উচ্চবর্গের ভাল না লাগারই কথা। তাঁর নিজের শিষ্য বৃন্দাবন দাস চৈতন্যভাগবতে এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন যে,
দেখি নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর বিলাস।
কেহ সুখ পায় কারো না জন্মে বিশ্বাস॥
এবং এমনকী বৈষ্ণবদের মধ্যে কেউ কেউ তাঁর সম্পর্কে এতদূর বিদ্বিষ্ট ছিলেন যে, ‘নিত্যানন্দ নাম শুনি উঠিয়া পলায়’। তা হলে?
আমি বললাম, ‘ওই জন্যেই নিত্যানন্দের প্রয়াণের পর তাঁর স্ত্রী জাহ্নবা দেবী আর ছেলে বীরভদ্র পরবর্তীকালে বৃন্দাবন গিয়ে সেখানকার গোস্বামীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন ও নির্দেশ নেন। তার মানে নিত্যানন্দের গণআন্দোলন আবার পড়ল গিয়ে উচ্চবর্ণের খপ্পরে।’
অধ্যাপক বন্ধু তাঁর আলমারি থেকে ননীগোপাল গোস্বামীর লেখা ‘চৈতন্যোত্তর যুগে গৌড়ীয় বৈষ্ণব’ বইখানা নিয়ে পড়ে শোনালেন:
শ্রীচৈতন্য যতদিন বর্তমান ছিলেন ততদিন বৈষ্ণব সমাজের মধ্যে কোনও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় নাই। কিন্তু তাঁহার তিরোধানের পর নেতৃত্বের স্বার্থ বজায় রাখিবার জন্য সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ বহ্নি প্রজ্জ্বলিত হইয়া উঠিল এবং দেখিতে দেখিতে কয়েক বছরের মধ্যেই নিজেদের মধ্যে দলাদলির সৃষ্টি হইয়া পরস্পর বিবদমান কতকগুলি উপশাখার সৃষ্টি হইল—গৌরনগরবাদিগণ, অদ্বৈত সম্প্রদায়, গদাধর সম্প্রদায় ও নিত্যানন্দ বিদ্বেষী সম্প্রদায়।… যিনি যেভাবে পারিলেন নেতা হইয়া বসিলেন। এইভাবে গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজ যখন বিপর্যস্ত, তখন সেখানে আরও বিশৃঙ্খলা দেখা দিল ‘গুরুবাদের’ প্রবর্তনে।
আমি বললাম, ‘এই গুরুর হাতেই রইল দীক্ষাশিক্ষার ভার, তাই গুরুছাড়া গৌরভজন হল অসাধ্য। ভক্ত আর গৌরের মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন গুরু। এদিনে বৈষ্ণব-আচারের বই ‘হরিভক্তিবিলাস’ স্পষ্টই ব্রাহ্মণের স্বার্থ দেখল বড় করে। ব্রাহ্মণ মানে ‘ব্রাহ্মণ-বৈষ্ণব’। হরিভক্তি বিলাস মেনে নিল সমাজের বর্ণভিত্তি, ব্রাহ্মণের শীর্ষভূমিকা। এই শাস্ত্র শূদ্রদের বিরুদ্ধাচরণ করল, শূদ্রদের কাছ থেকে কোনও দান গ্রহণে দিল নিষেধাজ্ঞা এমনকী চণ্ডালকে দেখলে প্রায়শ্চিত্তের বিধান দিল। ফতোয়া জারি করল যে, ব্রাহ্মণ শুরু শ্রেষ্ঠ এবং সববর্ণের মানুষকে দীক্ষা দিতে পারে ব্রাহ্মণ। অবশ্য বলা হল শূদ্রও দীক্ষা দিতে পারে তবে স্ববর্ণে বা আরও নীচের বর্ণস্তরে কিন্তু কখনই ব্রাহ্মণকে নয়।’
বন্ধু বললেন, ‘ওই জন্যেই নিম্নবর্ণের মানুষ চলে গেল সহজিয়া লাইনে। নিম্নবর্ণে তো সংস্কৃতে লেখা ‘হরিভক্তিবিলাস’ চলত না, ব্রাহ্মণরাও ছিল ওদের সম্পর্কে নিস্পৃহ। তাদের নজর ছিল মহন্তগিরির দিকে। আর এই সুযোগে অল্পশিক্ষিত, অশিক্ষিত এমনকী বিকৃত বুদ্ধি অনেক মানুষ শূদ্রদের গুরু সেজে বসল। ওরা তাদের মতো ব্যাখ্যা করল পরকীয়াবাদের, মঞ্জরী সাধনার, চৈতন্যের গুহ্যসাধনার। কে সে সব দেখতে গেছে তখন? এইখানে রমাকান্ত চক্রবর্তীর বক্তব্য শুনুন। Society and change পত্রিকার প্রথম খণ্ড চতুর্থ সংখ্যা থেকে আমি পড়ছি:
Non-Brahmana Vaisnava gurus sought new field in rural and tribal areas when they freely preached their own versions of the legends of Radha Krishna and Caitanya. Most of these versions were deeply mixed with sex and fundamentally different from the orthodox Vaisnava concepts which had been couched in Sanskrit and which were, therefore, incom-prehensible to the common people.
এই মন্তব্য শুনেই আবার মনে পড়ে গেল গোরাডাঙ্গা গ্রামের মযহারুল খাঁ-র কথা। নিজে পদও লেখেন। উনি আমাকে একবার বলেছিলেন চৈতন্য ভাগবতের অন্ত্যখণ্ড পড়তে, সেখানে নাকি লেখা আছে চৈতন্য নয় নিত্যানন্দই আসল। খুঁজে খুঁজে জায়গাটা বার করলাম। পানিহাটি গ্রামে রাঘব পণ্ডিতকে মহাপ্রভু বলেছিলেন,
রাঘব তোমারে আমি নিজ গোপ্য কই।
আমার দ্বিতীয় নাই নিত্যানন্দ বই॥
এই নিত্যানন্দ যেই করাবেন আমারে।
সেই করি আমি এই বলিল তোমারে॥
আমার সকল কর্ম নিত্যানন্দ-দ্বারে।
এই আমি অকপটে কহিল তোমারে॥
এর পরে যখন ময্হারুল ফকিরের কাছে আবার গেলাম তখন জানতে চাইলেন চৈতন্য ভাগবতের সেই জায়গাটা খুঁজে পেয়েছি কি না। যেই ঘাড় নাড়লাম অমনি ফকির বললেন, ‘বলুন তো নিত্যানন্দ-দ্বার মানে কী? বলতে পারলেন না তো? ওর মানে স্ত্রী লোকের যোনি। গৌরাঙ্গ ঠারেঠোরে বলে গেছেন চৈতন্যতত্ত্বের মূল বুঝতে গেলে নিত্যানন্দ-দ্বারে যেতে হবে।’
ঘরে হঠাৎ বাজ পড়লেও এতটা চমকাতাম না, সেদিন যা চমক লেগেছিল। ব্যাখ্যার চকিত অভিনবত্বে শুদ্ধ শাস্ত্র কীভাবে উলটে দেওয়া যায় তার চরম নমুনা বোধহয় ময্হারুল দিলেন। কিন্তু এ তো তাঁর নিজের উদ্ভাবন নয়, কথাটা মুখে মুখে গোপনে চলছে বাউল ফকিরদের ভেতরে ভেতরে কয়েক শতক নিঃসন্দেহে। শাস্ত্রকে দুভাবে ব্যাখ্যা যে কতরকম স্তরে হতে পারে তার নানা রোমাঞ্চকর নমুনা বৈষ্ণব সম্প্রদায়ে পাওয়া যায়। আজ পর্যন্ত খুব ভালভাবে এদিকটা অনুধাবন করা হয়নি। কিন্তু বিশেষভাবে বলবার কথা হল ময্হারুল ফকির বা তাঁর পূর্ব পূর্ব লোকায়ত গুরু কয়েক শতক ধরে ‘নিত্যানন্দ-দ্বার’ বলতে যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা বেশ অনেক দূর পর্যন্ত চারিয়ে গেছে। এ সব শুনে অনেকে বিরক্ত হবেন, নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব মনে খুব আঘাত পাবেন, কিন্তু লোকায়ত বিশ্বাসকে তো টলানো যাবে না। লৌকিক গুরু বৈরাগী উদাসীনরা এমন অনেক কথা বৈধী ধারার সমান্তরালে চিরকাল বলে গেছেন যাচ্ছেন এবং যাবেন।
আসলে জট পাকিয়ে আছে চারশো বছর আগে থেকে। চৈতন্য-নিত্যানন্দ-অদ্বৈত-গদাধর-শ্রীবাস পর্বের পর বাংলার বৈষ্ণবধর্ম যে বিচ্ছিন্নতা ও শীর্ণতার মধ্যে আত্মকুণ্ঠ হয়ে পড়ে তার থেকে তাকে বাঁচাতে বৃন্দাবন থেকে শ্রীজীব গোস্বামীর দীক্ষিত-শিক্ষিত নরোত্তম-শ্রীনিবাস-শ্যামানন্দ এবং পরে কৃষ্ণদাস কবিরাজ, বিশ্বনাথ চক্রবর্তী, নরহরি ও রাধামোহন যতই চেষ্টা করুন তবু বৈষ্ণবধর্মের পতন ও বিচ্ছিন্নতা রোখা যায়নি। খেতুরিতে মহাসম্মেলন ডেকে সপ্তদশ শতকের শেষার্ধে নরোত্তম বাংলার সব বৈষ্ণব নেতাকে এক জায়গায় বসিয়ে সমন্বয়ের শেষ চেষ্টা করেন। কিন্তু হরিভক্তিবিলাসের কাঠিন্য, শুদ্ধিকরণ আর ব্রাহ্মণত্বের নেতৃত্ব কি ঠেকাতে পারে কোনও স্ফূর্ত বৈষ্ণব গণশক্তিকে? মহাসম্মেলনে সেই মানুষগুলোকে ডাকা হল কই যারা অবহেলিত মানহারা? ‘জাত বৈষ্ণব’ নাম দিয়ে তাদের কি কেবলই ঠেলে দেওয়া হয়নি ভ্রষ্টবুদ্ধি মূর্খ গুরুদের হাতে? আর সেই সুযোগে প্রকৃতি-সাধনার এক জীবনস্পন্দী আহ্বানে সহজিয়া আর বাউল ফকিররা কি ধীরে ধীরে অশিক্ষিত নিম্নবর্গের অনেককে টেনে নেয়নি রসের পথে? এইভাবেই ঐতিহাসিক পুরুষ শ্রীচৈতন্য হয়ে যান গোপ্য সাধনার এক স্তরান্বিত সংকেত। নিত্যানন্দ হয়ে যান দেহকেন্দ্রিক যৌনসাধনার এক গূঢ় ইঙ্গিত। কৃষ্ণ আর রাধাকে তত্ত্বরূপে ‘আরোপ’ করা হয় মানুষ-মানুষীর শরীরী মিলনে। অন্য দিকে নৈষ্ঠিক বৈষ্ণবরা ব্যস্ত থাকেন কৃষ্ণরাধা আর গৌরাঙ্গকে দারুভূত বা প্রস্তরীভূত মূর্তি করে মঠে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা দিতে। গড়ে তোলেন তাঁরা পূজা ও বিধান, শাস্ত্র ও পদাবলী। সবকিছুকে ঐশী ও অপ্রাকৃত বিশেষণ দিয়ে প্রবহমান জীবনের উলটো মুখে নিশ্চিন্তে বসতে চান তাঁরা। ‘চৈতন্যের মর্ম লোকে বুঝিতে নারিলা’ তো সত্যিই এক ট্র্যাজিক উচ্চারণ।
এখানে অবশ্য বলে নেওয়া উচিত যে চৈতন্যকে এই গৌড়বাংলাতেই অবতার বলে, পরমতত্ত্ব বলে প্রতিষ্ঠা করাও খুব সহজ হয়নি। কেননা বৃন্দাবনের বৈষ্ণবরা কখনই কৃষ্ণতত্ত্বের বাইরে স্বতন্ত্র চৈতন্যতত্ত্বকে মানেননি। তাঁরা মনে করতেন চৈতন্য ‘উপায়’ এবং কৃষ্ণ ‘উপেয়’। অন্য দিকে গৌড়ীয় বৈষ্ণবকুল চাইছিলেন গৌর পারম্যবাদকে প্রতিষ্ঠা দিতে। এদিকে বাংলাতেই একদল বৈষ্ণব গৌর-নিতাই বিগ্রহ গড়ে মন্দিরে বসালেন, আরেকদল বসালেন গৌরগদাধর মূর্তি, খেতুরি মহোৎসবের পর নরোত্তম চালু করলেন গৌরবিষ্ণুপ্রিয়া যুগল মূর্তি—এটা চাননি বৃন্দাবনের গোঁসাইরা। নিত্যানন্দপত্নী জাহ্নবাদেবীর পালিত পুত্র রামচন্দ্র গোঁসাই বাঘনাপাড়ায় যে শ্রীপাট গড়েন সেখানে সহজিয়া বৈষ্ণব ভাবনার বেশ কিছু স্ফূরণ ঘটে এ কথা সত্য। চৈতন্যকে পরমতত্ত্বরূপে প্রতিষ্ঠায় দেশের রাজশক্তির পক্ষ থেকেও বাধা আসে। আঠারো শতকে ব্রাহ্মণ সমাজপতি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের ভয়ে নবদ্বীপে ‘শ্রীগৌর মূর্তিকে ছয় মাস যাবৎ মৃত্তিকাভ্যন্তরে লুক্কায়িত রাখা হয়েছিল।’* নদীয়া রাজবংশের দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র রায় ১৮৭৫ সালে স্পষ্ট ভাষায় লিখে গেছেন:
ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের অধিকার প্রায়ই শাক্ত ও অত্যল্পাংশ বৈষ্ণব, এবং শূদ্রবর্ণের অধিকাংশ বৈষ্ণব ও কিয়দংশ শাক্ত ছিল। রাজারা শাক্ত কিন্তু বৈষ্ণব ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ করিতেন।**
উনিশ শতকের শেষ পর্যায়ের এই প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে শূদ্রবর্ণের অধিকাংশ বৈষ্ণব ছিল। অর্থাৎ সহজিয়া বৈষ্ণব ও জাত-বৈষ্ণব। ব্রাহ্মণ অংশের মূল ভাগ ঝুঁকে পড়েছিল শাক্ততন্ত্রে। হতমান, সম্পত্তিহীন (চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইনে) জমিদার ব্রাহ্মণ ও রাজন্যবর্গ তখন কৃষ্ণের প্রতি দীন ভক্তি প্রদর্শনের চেয়ে শক্তিময়ী কালীর কাছে শরণ ও পঞ্চ ম-কারে বেশি আস্থা দেখাবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সপ্তদশ শতকের শেষ থেকে রাজন্য বণিক ও জমিদাররা বৈষ্ণবধর্মকে একবার নতুন করে জাগাতে চেয়েছিলেন। সেই ইতিহাস জেনে নেওয়া উচিত।
সপ্তদশ শতকে খেতুরিতে যে বৈষ্ণব মহাসম্মেলন হয় সেখানে গৃহীত কয়েকটি প্রস্তাবের মধ্যে একটি ছিল বৈষ্ণব ধর্ম প্রসারের ব্যাপক প্রয়াস। বিষ্ণুপুর ও খেতুরি এই দুই কেন্দ্র থেকে ধর্মপ্রচার ও প্রসারের কাজ শুরু হয়। বিষ্ণুপুরের রাজা বীর হাম্বীর ও খেতুরির রাজা সন্তোষ দত্ত প্রত্যক্ষভাবে এই আন্দোলনে যুক্ত হন। ক্রমে এগিয়ে আসেন ময়ূরভঞ্জের রাজা, পঞ্চকোটের রাজা, পাইকপাড়ার রাজা। ঝাড়িখণ্ড-উড়িষ্যা অঞ্চলে শ্যামানন্দ-শিষ্য রসিকানন্দের চেষ্টায় এগিয়ে আসেন উড়িষ্যার অনেক রাজা ও রাজন্য। গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে বৈষ্ণবীয়ানার একটা হুজুগ উঠল। গঙ্গার এপারে বরাহনগর, আড়িয়াদহ, পানিহাটি, সুখচর, খড়দহ, কাঞ্চনপল্লী ও কুমারহট্ট এবং ওপারে মাহেশ, আকনা, বিষখানি, জিরাট, গুপ্তিপাড়া, আদি সপ্তগ্রাম জেগে উঠল নতুন বৈষ্ণব কেন্দ্ররূপে। বর্ধমান জেলার কুলীনগ্রাম ছাড়াও কালনা, পূর্বস্থলী, পাটুলী, কাটোয়া, দাঁইহাট, অগ্রদ্বীপ, কুলাই, শ্রীখণ্ড, দক্ষিণখণ্ড, বীরভূমের ময়নাডাল ও মঙ্গলডিহি, মুর্শিদাবাদ ও মালদহের অনেক জায়গায় তৈরি হল বৈষ্ণবী বাতাবরণ। লেখা হতে লাগল বহুতর বৈষ্ণব স্মৃতিগ্ৰন্থ, মহান্তজীবনী, পদসংকলন, বৈষ্ণব শাখা নির্ণয় ও ব্রতদিন নির্ণয়ের বই। হরিভক্তি বিলাসের নিয়মে চলল চব্বিশ ঘণ্টার ভজনসাধন কীর্তন। বৈষ্ণব গুরু ও আচার্যরা কৌলিক পদবি ত্যাগ করে সবাই নিলেন গোস্বামী পদবি। গৃহী ও সন্ন্যাসী দুরকমের বৈষ্ণবই সমাজে মান্যতা পেলেন।
ইতিমধ্যে সমাজবিবর্তনের লক্ষণ দু’ভাবে সূচিত হল। অষ্টাদশ শতকে একদিকে জাগল শাক্তধর্মের ও শাক্তগানের অভ্যুত্থান, আরেক দিকে শূদ্র সমাজে ঘটল ব্যাপক সহজিয়া যোগাযোগ। সহজিয়া ধারা এদেশে নতুন নয়। বৌদ্ধ মহাযান মতের একটা স্রোত এবং তান্ত্রিক বামাচারের ধারা আগেই ছিল লোকায়ত জীবনে। বৈষ্ণব সহজিয়া এদের ভাবধারা ও ক্রিয়াকরণ অনেকটাই নিলেন। সুফি প্রভাব ও মারফতি প্রভাব ইসলাম ধর্মেও কিছুটা বিবর্তন আনল। সত্য সংঘ, কর্তাভজা, সাহেবধনী, খুশি বিশ্বাসী এইসব হিন্দু-মুসলমান সমন্বয়াত্মক গৌণ লোকধর্মগুলি জেগে উঠল গ্রামে গ্রামে। হয়তো চৈতন্যকে আদর্শ করেই প্রবর্তক-কেন্দ্রিক নানা উপধর্ম রূপ নিল। সবচেয়ে আশ্চর্য যে, সহজিয়া বৈষ্ণব নানা উপশাখা তাদের প্রবক্তা বা শাস্ত্রপ্রণেতা রূপে ব্যবহার করতে লাগল বিখ্যাত বৈষ্ণব গুরুদের নাম। নিত্যানন্দ-বীরভদ্র-নরোত্তম-কৃষ্ণদাস কবিরাজ-রূপ কবিরাজ—এইসব মহান ব্যক্তির নাম তাদের মূলধারায় জড়িয়ে নিল। এইভাবেই কি তারা চাইল তাদের শাস্ত্ৰছুট প্রকৃতিসাধনায় একরকমের বৈধতা আনতে? প্রতিবাদের গভীরে রাখতে চাইল একরকমের সহকারিতাও?
গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজে এককালে ছিলেন সন্ন্যাসী অথচ এখন গৃহী এমন একজন হলেন সুকান্ত মজুমদার। মঠে মন্দিরে অন্তত পনেরো বছর কাটিয়েছেন, শাস্ত্র পড়েছেন, নিয়েছেন গৈরিক বাস, কিন্তু শেষপর্যন্ত নানা কারণে বীতশ্রদ্ধ হয়ে ছেড়ে এসেছেন সেই পথ। তবে আচরণ তো রক্তে মেশা। বৈষ্ণব বিনয় ও নিরভিমান স্বভাব সুকান্তবাবুর মধ্যে মজ্জাগত হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে যাই তাঁর কাছে খটকা ঘোচাতে। সেদিন কথায় কথায় এমনই এক জিজ্ঞাসায় তাঁকে বললাম, ‘বাংলায় সহজিয়াবাদের উৎস ও প্রসার সম্বন্ধে কিছু বলুন। গোঁড়া বৈষ্ণবদের প্রতিক্রিয়াতেই কি তার ব্যাপকতা?’
প্রথমে ‘আমি কী জানি বলুন’, ‘কতটুকুই বা পড়াশুনা করেছি’ এইসব গৌরচন্দ্রিকা করে সুকান্ত বললেন, ‘আসলে সহজিয়াদের সূচনা মহাপ্রভুরও আগে। চণ্ডীদাসের পদে পাবেন অনেক ইঙ্গিত। গৌড়বঙ্গে কৃষ্ণ ধামালীর একটা লৌকিক গল্প চালু ছিল, কৃষ্ণ রাধা আয়ান ঘোষ আর বড়াই বুড়িকে নিয়ে। অবৈধ প্রেমের দেহকেন্দ্রিক গল্প। জানেন তো ভাগবতে রাধার নাম কোথাও নেই? জয়দেব লৌকিক কাঠামো থেকেই রাধাকে তৈরি করেন। বড়ু চণ্ডীদাস সেই কৃষ্ণরাধার গল্পে কামনা আকুলতা ছলনা আর বিরহ বুনে তাকে জনপ্রিয় করে দেন। সহজিয়ারা এই গল্প ও গান খুব পছন্দ করত। এরপরে বৌদ্ধ সহজিয়া, তান্ত্রিক ক্রিয়াকলাপ ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে কিছু এসে যায়। এ সব ছিল খুব গোপন।’
: কিন্তু সহজিয়ারা কি তখন ধর্মসম্প্রদায় ছিল এখনকার মতো?’
: মনে হয় না। ওটা ছিল গোপন আচরণ, সমাজের খুব অন্ত্যজবর্গে। কিন্তু মহাপ্রভুর পরে যারা সহজিয়া বলে ফুটে বেরোল তারা কিন্তু বেশ সংগঠিত ও সচেতন। আসলে গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের গোঁড়ামি, বৃন্দাবনের সংস্কৃতি অনেক শূদ্রের পক্ষে সহ্য হয়নি। তারা প্রতিবাদ খুঁজছিল। শ্রীখণ্ডের নরহরি সরকারের ‘গৌরনাগর সাধনা’, নবদ্বীপের ‘মঞ্জরী সাধনা’ আর পরকীয়াবাদের অন্য ব্যাখ্যা থেকে সহজিয়া বৈষ্ণবরা জেগে ওঠে। শ্রীচৈতন্যের গুহ্যসাধনাকে সামনে রেখে দেহ-কড়চা নামে অজস্র পুঁথি লেখা হয়। সে সবই কি শূদ্রের লেখা বলতে চান? উচ্চবর্ণের লোকেরাও ভেতরে ভেতরে সহজিয়াদের মদত দেয়নি কি আর? তবে পরে ওই নবদ্বীপ শান্তিপুর খড়দহ শ্রীখণ্ড এইসব জায়গাতেই কেবল খাঁটি গৌড়ীয় বৈষ্ণবরা ঘাঁটি গাড়ে, সহুজেরা ছড়িয়ে যায় গ্রামে গ্রামে আখড়ায় আখড়ায়। বিকৃতিও আসে তাদের মধ্যে। তারপরে গড়ে ওঠে নানা বৈষ্ণব উপসম্প্রদায়।
: কিন্তু ঠিক কোন সময়ে এই সব উপসম্প্রদায় মাথা চাড়া দেয় বলুন তো?
: একেবারে আঠারো শতকের শেষার্ধে। সেটা বোঝাতে গেলে আপনাকে সিদ্ধ বৈষ্ণব তোতারাম বাবাজির ঘটনা বলতে হয়। শুনবেন?
: ‘অবশ্যই শুনব। এ সব বলবার মতো যোগ্য লোক তো আপনিই’ আমি বললাম।
বিনত মুখে সুকান্ত শুনলেন আত্মপ্রশংসা। তারপর খানিক ভেবে নিয়ে বললেন, ‘শ্রীনিবাস আচার্যের বংশের সন্তান রাধামোহন ঠাকুর ছিলেন আঠারো শতকের মানুষ। ১৭৮১ সালে তাঁর দেহান্ত ঘটে। বলতে পারেন রাধামোহনই বাংলার শেষ বৈষ্ণব ইনটেলেকচুয়াল। একবার বৃন্দাবনে দুজন বৈষ্ণবের মধ্যে স্বকীয়া আর পরকীয়াবাদ নিয়ে বিতর্ক হয়। কোন পথ সঠিক? জয়পুরের রাজসভার বিচারে স্বকীয়া মত জেতে। তাতে প্রতিপক্ষ খুশি না হয়ে গৌড়ের পণ্ডিতদের মতামত দাবি করেন। জয়পুরের রাজা তখন তাঁর সভাসদ ও স্বকীয়াপন্থী কৃষ্ণদেব ভট্টাচার্যকে বাংলায় পাঠান। নবাব মুর্শিদকুলী জাফর খাঁর দরবারে বিচার বিতর্ক হয়। রাধামোহনের কাছে তর্কে হেরে কৃষ্ণদেব অজয়-পত্র লিখে দেন। ব্যাস, সেই থেকে বাংলায় পরকীয়া মত চেপে বসল। এখানে একটি কথা বলি। গৌড়ীয় বৈষ্ণব মতে পরকীয়াবাদ এক শুদ্ধ নিষ্কাম conception। সহজিয়ারা কিন্তু সে conception নেয়নি। তারা পরকীয়া বলতে বুঝল ও বোঝাল, অবিবাহিতা সাধনসঙ্গিনী। ক্রমে কিশোরীভজন এবং পরস্ত্রীগমন হল পরকীয়া সাধনার পক্ষে প্রশস্ত।’
আমি বললাম, ‘এই পরকীয়াবাদের সমর্থনে তারা পয়ার বানাল না?’
সুকান্ত বললেন, ‘অবশ্যই। জানেন না গৌড়ীয় বৈষ্ণবরা কথায় কথায় যেমন বৃন্দাবনি সংস্কৃত শ্লোক আওড়ায়, সহুজেরা তেমনই পয়ার ওগড়ায়। পরকীয়ার পক্ষে পয়ার শুনবেন?
স্বকীয়াতে বেগ নাই সদাই মিলন।
পরকীয়া দুঃখসুখ করিল ঘটন॥
এবারে যুক্তিটা শুনুন। গৌরাঙ্গকে বুঝতে পরকীয়া সঙ্গিনী কেন? স্বকীয়ার ত্রুটি কোথায়? জবাব হল, স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের সত্যভামা-রুক্মিণী-কুব্জা এইসব স্বকীয়া থাকতেও তিনি কেন রাধা প্রেমকে আশ্রয় করলেন? বিশ্লেষণে বলা হল, স্বকীয়া প্রেমধর্মে বাধাবন্ধ নেই, সমাজের অনুশাসন নেই, তাই ওতে বেগ নেই। পরকীয়ায় আছে দুঃখকষ্ট ভোগের রোমাঞ্চ। উৎকণ্ঠা থেকে মিলনে পৌঁছানোর জন্য দারুণ আত্মপীড়ন, কুলত্যাগের সাহস, সমাজের ভ্রূকুটিকে উপেক্ষা করার শক্তি। প্রেমের সত্যিকারের গভীরতা তো এ সবেই ফুটে ওঠে।’
: কিন্তু তোতারাম বাবাজির কথা কেন তুললেন?
: ওই পরকীয়াবাদ থেকেই তো সব বৈষ্ণব গৌণ সম্প্রদায়ের উদ্ভব। তারা দেখল কৃষ্ণরাধা তত্ত্বের সঙ্গে তাদের পুরুষ প্রকৃতিবাদ বেশ খাপ খায়। কৃষ্ণ হলেন তাদের সাধনার ‘বিষয়’ আর রাধা হলেন ‘আশ্রয়’। চলল নির্বিচার ‘আরোপ’ সাধনা। তোতারাম বাবাজি এদের সম্পর্কে তাঁর অসহিষ্ণুতা জানান। তার থেকেই প্রথম তেরোটি উপসম্প্রদায়ের বিষয়ে খবর মেলে। দ্রাবিড় দেশের পণ্ডিত তোতারাম ছিলেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আমলের মানুষ। ন্যায় পড়তে আসেন নবদ্বীপ। সেখান থেকে যান বৃন্দাবন। আবার নবদ্বীপে এসে আখড়াধারী বাবাজি হন। কিন্তু সহুজে বৈষ্ণব আর অন্য গৌণধর্মীদের আচরণে ব্যথিত হয়ে ঘোষণা করেন:
আউল বাউল কর্তাভজা নেতা দরবেশ সাঁই।
সহজিয়া সখীভাবুকী স্মার্ট জাত গোঁসাই॥
অতিবড়ী চুড়াধারী গৌরাঙ্গনাগরী।
তোতা কহে—এই তেরোর সঙ্গ নাহি করি॥
লক্ষ করতে হবে, যে-তেরোটি উপসম্প্রদায় সম্পর্কে এখানে বিরুদ্ধতার কথা বলা হয় তার মধ্যে আউল বাউল নেড়া সাঁই আর দরবেশিরা আদৌ বৈষ্ণব নয়। কিন্তু তোতারাম যে জাত-গোঁসাই আর গৌরনাগরীদেরও অপাঙ্ক্তেয় করেছেন এখানেই বৈষ্ণব বিচ্ছিন্নতাবাদের খুব বড় প্রমাণ রয়ে গেছে। এই অসহিষ্ণুতা ও বিচ্ছিন্নতায় বৈষ্ণবরা আরও টুকরো হতে থাকে। এর পরের আরেক পয়ারে তার প্রমাণ। বলা হচ্ছে:
পূর্বকালে তেরো ছিল অপসম্প্রদায়।
তিন তেরো বাড়লো এবে ধর্ম রাখা দায়॥
এইভাবে বাহান্নটা উপসম্প্রদায় তো তখনই জন্মে গেছে। কিন্তু প্রশ্ন হল কোন ধর্ম রাখা দায় বলা হচ্ছে এখানে?
আমি বললাম, ‘কেন? নৈষ্ঠিক বৈষ্ণব ধর্মের কথা বলা হচ্ছে। অবশ্য হ্যাঁ, কথাটা ঠিকই তুলেছেন আপনি। মহাপ্রভু যে উদার জাতিবর্ণহীন বৈষ্ণবতার স্বপ্ন দেখেন, নিত্যানন্দ যাকে রূপ দিতে চান, সে কি শেষপর্যন্ত আচণ্ডাল জনসমাজের কল্যাণকামী ছিল আর কোনওভাবেই? তা কি রুদ্ধ হয়ে যায় নি সংস্কৃত শাস্ত্রবাণী আর গুরু মহান্তের ব্যাখ্যায়? সেখানে সেই উচ্চ বৈষ্ণবদের গজদন্ত মিনারে সাধারণ মুমুক্ষু নিচু জাতের মানুষ আর কী করে আশ্রয় নেবে? সহজিয়া বৈষ্ণব, জাত বৈষ্ণব আর নানা খণ্ডিত বৈষ্ণবই তো সংখ্যায় বাড়বে। ওদিকে সামাজিক স্মার্ত মত মেনে চলে যারা তারাই বৈষ্ণব ধর্মের আধ্যাত্মিক বিধি নিয়ে ক্রমে হয়ে উঠেছে এখনকার উন্নত বৈষ্ণব। তোতারাম যে স্মার্তদের অপাঙ্ক্তেয় মনে করেছেন এখন তো তারাই সবচেয়ে মান্য বৈষ্ণব। দেখুন ইতিহাসের কী অদ্ভুত কৌতুক। ঠিক এখন মানে এই সময়ে বৈষ্ণব কারা? এক নম্বর, মঠ ও আখড়াধারী ব্রহ্মচারী গোঁসাই। দু নম্বর, এদের দ্বারা উপেক্ষিত জাত-গোঁসাই এবং ঘৃণিত সহজিয়া বৈষ্ণব। তিন নম্বর, গৃহী বৈষ্ণব ভদ্রলোক, যাঁদের মন্ত্রদীক্ষা হয়, হরিনাম করেন যারা অথচ মেনে চলেন হিন্দুসমাজের প্রচলিত স্মাৰ্তমত। জন্ম মৃত্যু বিবাহে এঁদের ব্রাহ্মণ পুরোহিত লাগে। এঁরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। কী সুকান্তবাবু, ঠিক বললাম?’
‘একেবারে ঠিক’ সুকান্তবাবু সায় দেন এবং বলেন, ‘চৈতন্য মহাপ্রভুকে সঠিক কেউ বুঝল না তা হলে। কিন্তু দেহবাদী সহজিয়ারা তাদের সাধনায় যে সব কড়চা ও শাস্ত্রের দোহাই পাড়ে সেও খুব অদ্ভুত। তারা লিখেছে সে সব শাস্ত্র কড়চা নিজেরাই অথচ চালায় রূপ কবিরাজ, কৃষ্ণদাস কবিরাজ, বীরভদ্র, নিত্যানন্দ এমনকী নরোত্তমের নামে। এমনও বলে কবিরাজ ছিলেন বীরভূমের লোক শ্রীনিবাস আচার্যের শিষ্য। পরকীয়াবাদের সমর্থন করেছিলেন বলে গৌড়ীয় বৈষ্ণব অংশ থেকে বিতাড়িত হন। প্রতিবাদী বিতাড়িত মানুষটাই নাকি তাদের আদিগুরু। এই বলে গান গায় যে,
শ্রীরূপের পদে যার নিষ্ঠা হলো
মানুষের করণ সেই সেধে গেল।
শ্রীরূপের চরণ সাধি
শ্রীরূপের পেল সিদ্ধি শাস্ত্রদেবতা দুষে গেল॥’
আমি বললাম, ‘এখানে তো শ্রীরূপের দুটো মানে রয়েছে। শ্রীরূপ মানে রূপ কবিরাজ, শ্রীরূপ মানে নারী। ঠিক তো? কিন্তু লৌকিক স্তরে যে গৌরঙ্গতত্ত্ব খুব গোপনে চালু আছে আপনি তা জানেন? আমি যতদূর বুঝেছি, পুরুষ দেহ রাধা আর তার মধ্যে মণিবিন্দু কৃষ্ণ। একাঙ্গে এটাই গৌরাঙ্গ। সেই গৌরাঙ্গের উপলব্ধি করতে লাগে নিত্যানন্দের দ্বার।’
সুকান্ত বললেন, ‘এ যে ফরমুলার মতো বলে গেলেন। না না অত সহজ নয়। মাঝখানে আপনার জানার একটু ফাঁক আছে। কৃষ্ণ রাধার আরেকটু জটিলতা আছে। সেটা আমিও জানি না। আচরণঘটিত সেটুকু। শুনেছি একমাত্র দরবেশি মতের কেউ কেউ সেটা জানে। আমি ঠিক ঠিক দরবেশি মতের লোক পাইনি। আপনি খোঁজে থাকুন।’
আমি ভাবলাম, আবার কোথায় খুঁজব? গৌরাঙ্গের মর্ম তবে কি আমার অজানাই থেকে যাবে?
শেওড়াতলার আহাদের মাজারে অম্বুবাচীতে মচ্ছব হয় প্রতি বছর। সেবার সেখানে খুব আলাপ হল বাদলাঙ্গীর খেজমৎ ফকিরের সঙ্গে। ফকির বললেন, ‘আপনি তো চাপড়া থানার কাঁহা কাঁহা সব গৈ-গেরামে ঘুরেছেন কিন্তু কখনও আমাদের বাদলাঙ্গী গাঁয়ে আপনাকে দেখিনি। একবার আসুন এবারে, হ্যাঁ, কার্তিক মাসের পুন্নিমে, ওই দিন আমার গোঁসাইয়ের পারুণী। খুব বড় মচ্ছব হবে। বসবে শব্দ গানের আসর। বাংলাদেশ থেকে বর্ডার পেরিয়ে অনেক আলেম দরবেশ ফকির আসবে। গান শুনবেন তাদের। খুব ভাল তত্ত্বের গান। আসবেন তো?’
এ সব ক্ষেত্রে ওই যেমন সায় দিতে হয় সেই রকম ঘাড় নেড়েছিলাম। পরে যথারীতি ভুলে গিয়েছিলাম। আমাদের শহুরে ক্যালেন্ডারে কার্তিক মাসের পূর্ণিমা আর কোথায়? কিন্তু খেজমৎ ভোলেনি। লাল কালিতে লিখে এক পোস্টকার্ড ঠিকই পাঠিয়েছে মচ্ছবের সাত দিন আগে। আরও আশ্চর্য, ‘সুধীর চক্রবর্তী, প্রোপেসর কৃষ্ণনগর’ এমন অসম্পূর্ণ ঠিকানা সত্ত্বেও সে চিঠি ডাক বিভাগ আমাকে পোঁছেও দেয়। এর পর কি না গিয়ে চলে?
বাসে যেতে যেতে অবশ্য ভাবছিলাম একটা গোলমেলে কথা। খেজমৎ ফকির যার নাম, তার গুরু কী করে হন পরমানন্দ গোঁসাই? গুরুর প্রয়াণ দিবসের স্মরণেই তো এই মচ্ছব। পোঁছেই প্রথমে সেই কথা পাড়লাম। বসতে দিয়েছে খাতির করে এক অসামান্য কারুকার্য খচিত কাঁথায়। কাঁথায় সুতোর ফোঁড়ে হাতি ঘোড়া পদ্ম শঙ্খ বোনা আর এক কোণে লেখা ময়দানী বিবি বাদলাঙ্গী’। তারিফ করতেই লাজুক মুখে খোদ ময়দানীবিবি হাতপাখা নিয়ে এসে সামনে বসে৷ খিজমৎ বলে, ‘বাবুকে ভক্তি দাও।’ ময়দানী গড় হয়ে প্রণাম করে।
এও কম আশ্চর্য নয়। কোনও ফকিরের বাড়িতে কখনও আমি প্রণাম পাইনি। আসলে প্রণাম ওরা করে না। আর প্রণাম না বলে ‘ভক্তি দেওয়া’ এ জিনিস আমি ফরিদপুরের থেকে আসা নমঃশূদ্র সমাজ ছাড়া কখনও শুনিনি। অবাক হয়ে তাকাতেই খেজমৎ বলে, ‘কী অবাক হলেন তো? আমাদের গোঁসাই যে ফরিদপুরের এড়াকান্দির সিডিউলড্ কাস্ট ছিলেন। তাঁর কাছ থেকেই এ সব শেখা। আমি জন্মে ফকির, কর্মে নই। লিয়াকত ফকিরের ছেলে বলে লোকে আমাকে খেজমৎ ফকির বলে। অবশ্য ফকিরিতন্ত্রে অনেকটা রাস্তা আমি হেঁটেছি। তারপরে বছর দশেক আগে হঠাৎ বেতাই-জিৎপুরে মতুয়াদের মেলায় আমার সদগুরু লাভ হল। গোঁসাইয়ের আখড়া কুলগাছি। সেখানেই আমার দীক্ষাশিক্ষা। সহজিয়া মত আমাদের। নিত্যানন্দের ধারা।’
ধীরে ধীরে বিকেল শেষ হয়। একটু একটু হিমেল হাওয়া। গাঁয়ের লোক দুটো-চারটে করে জমছে। খেজমৎ খুব ব্যস্ত, আহ্বান আপ্যায়নে। বাউল বৈরাগীরা এসে গেছে। দুটো একটা গান হচ্ছে। শিক্ষানবিশদের গান। বুঝলাম ট্রেনিং চলছে। বাংলাদেশের দল এই এসে পড়বে আর কী। আমি এদিক ওদিক খানিক ঘুরিফিরি। উঠোনের একদিকে বিশাল কড়ায় খিচুড়ি পাক হচ্ছে। খেজমৎ সেখানে আমাকে দেখে বলে, ‘বাবুর খুব একা একা লাগছে তো? গান তো হবে সেই রাতে। তো আসুন এদিক পানে। নসরৎপুর থেকে একজন গাহক এসেছে। যাদুবিন্দুর গান জানে। গলা খুব আহামরি নয়, তবে ভাব আছে। তত্ত্ব জানে। তার গান শুনুন।’
নসরৎপুরের গাহকের নাম মোহন খ্যাপা। বিনয় সহকারে বসালে। খেজমৎ বললে, ‘বাবু, আমি যাই, ওদিকে বোধহয় বাংলাদেশের দলের খবর এল।’ আমি মোহন খ্যাপাকে বললাম, ‘যাদুবিন্দুর গৌরাঙ্গতত্ত্বের গান শোনাবে? তত্ত্ব বোঝাতে হবে কিন্তু।’
‘তত্ত্ব আর কতটুকু জানি বলুন? যিনি বোঝাবার তিনিই আমার বাক্য হয়ে আপনারে বোঝাবেন বইকী। তবে আগে যাদুবিন্দুর গুরু কুবির গোঁসাইয়ের পদ গাই একটা, শুনুন।’ দোতারা বেঁধে গান ধরে:
দয়াল গুরু হে তোমা বই কেউ নাই
আমি খেতে শুতে আসতে যেতে
তোমারই গুণ গাই।
তুমি ব্রহ্মা তুমি বিষ্ণু তুমি যিশু তুমি কৃষ্ণ,
অন্তিম কালে যেন তোমার স্বরূপ বুঝে যাই॥
চমকে গিয়ে গান থামাই। কী বললে মোহন খ্যাপা? আশ্চর্য, কোথায় যে কী মিলে যায় কে জানে? তুমি ব্রহ্মা তুমি বিষ্ণু তুমি কৃষ্ণ ঠিকই তো আছে? কিন্তু তুমি যিশুটা কী ব্যাপার? এ কি ধর্ম সমন্বয়ের কথা? আমার বিশ্লেষণ শুনে মোহন বলে, ‘না বাবু, আমার গোঁসাই এ গানের অন্য তত্ত্ব দিয়েছেন।’
: কী রকম?
: উনি বলেন আর সেটাই ঠিক যে বিন্দু বা শুক্র ছাড়া কেউ তাঁকে ব্রহ্মা, বিষ্ণু বা কৃষ্ণ যে নামেই ডাকি আসলে তিনি তো এক! সেই জন্য আরেকটা পদে বলছে, ‘গৌর গৌর বলছো যারে/ সে গৌর তোমার সঙ্গে ফেরে।’ এ কথার কি ওই অর্থই নয়?
কার্তিকের কুয়াশা কেটে পূর্ণিমার চাঁদ জাগছে। আমার চেতনালোক উদ্ভাসিত করে যেন নতুন একটা চাঁদ উঠছে। কেটে যাচ্ছে কুয়াশা। আমি মনে মনে বিড়বিড় করি শাস্ত্রে-পড়া শ্লোক: একশ্চৈতন্যচন্দ্রঃ পরম করুণয়া সর্বমাবিশ্চকার। এ শ্লোক কতবার ক্লাসে নিষ্প্রাণ আউড়েছি ছাত্রদের সামনে। আজকে সেই আবিষ্কার কি তবে পূর্ণ হতে চলেছে? ইতিমধ্যে আমাদের ঘিরে অনেক জমেছে। বাংলাদেশের দলও এসে গেছে। মোহন গাইছে যাদুবিন্দুর পদ:
যাদের আছে সুসঙ্গ
দেখে গঙ্গা গৌরাঙ্গ
সময় সময় সুরধুনীর বাড়ে তরঙ্গ।
গান চলে। আমি কেবল কার্তিকের কুয়াশা ভেঙে এগিয়ে যাই খেজমতের ভিটে ছেড়ে বাইরে, মাঠে যেখানে রাশি রাশি ধানের পাঁজা। গানটার মানে নিজে নিজেই খুঁজে পাই। স্পষ্টই বুঝি এ গানে ‘গঙ্গা গৌরাঙ্গ’ একসঙ্গে বলতে বোঝাচ্ছে ইড়া পিঙ্গলা সুষুম্নর পথে বিন্দুর চলাচল। মাঝে মাঝে সেই তরঙ্গ বাড়া বলতে বোঝায় উদ্দীপন। নিজের দেহকে জানা, নিজের মধ্যে গতিময় কৃষ্ণকে জানা যায়, তার গতায়াতকে নিয়ন্ত্রণ করে সম্ভোগ করা এই তা হলে গৌরতত্ত্ব? এ তো শাস্ত্রেও থাকতে পারে না, কাব্যেও না। এ তো লিখে বোঝানো যাবে না। সেই জন্যই কি এই তত্ত্ব গুরুশিষ্য পরম্পরায় লোকায়তিক। মৌখিক অথচ সর্বত্র উচ্চাৰ্য নয়! ক্রিয়াত্মক অথচ গোপন।
অথচ তখনও কতটা বোঝা বাকি ছিল বুঝিনি। একটা ঘোরের মধ্যেই যেন রাতটা কেটে গেল। অন্নসেবা, গানের পর গান, চাঁদনি রাত সব কোথা দিয়ে কেটে গেল আমি বুঝিনি। বসেছিলাম শেষরাতে ময়দানী বিবির কাঁথা পেতে ঘরের দাওয়ায়। গান থেমে গেছে। সব দিক চুপচাপ। কে কোথায় ঘুমিয়ে পড়েছে। অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে চেঁকির পাড় দেবার শব্দ ঢুপ ঢুপ ঢুপ। শেষরাতে বউ-ঝিরা উঠে ধান ভানছে। বাংলাদেশের দলটা আশ্রয় নিয়েছে আমার কিছু দূরে দাওয়ায়। সবাই পথক্লান্ত নিবিড় ঘুমে আচ্ছন্ন। কেবল একজন বৃদ্ধ ফকির বসে বসে তসবি মালা জপছে বিড়বিড় করে। খানদানি দরবেশ। জেল্লাদার আলখাল্লা। কুষ্টিয়ার বারখেদা অঞ্চলের ফকির।
বারখেদার ফকিরকে দেখে একটা কথাই মনে হতে লাগল যে মানুষটা খিদে তেষ্টা শ্রান্তি সবকিছুকেই জয় করেছেন। এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশের কুষ্টিয়া যশোর রাজশাহী এ সব জায়গায় শুনেছি অনেক ক্ষমতাশালী ফকির আছে। ক্ষমতাশালী বলতে আত্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা শ্বাসের কাজ আর শরীরী দুঃখকষ্টকে জয় করা। কুষ্টিয়া থেকে তিনদিন আগে রওনা হয়ে বেশির ভাগ হাঁটাপথে এই দল এসে পৌঁছেছে বাদলাঙ্গী। কিছু না হোক ষাট-সত্তর মাইল হাঁটতে হয়েছে। অথচ এখানে আসা ইস্তক এই মানুষটা খাড়া বসে আছেন। মাঝরাত পর্যন্ত সারাক্ষণ বসে ছিলেন শব্দগানের আসরে। এখন দলের সবাই ঘুমে কাদা অথচ ফকির একলা বসে আপন মনের গভীরে জপ করছেন। এরা নাকি শ্বাসের মধ্যেই জপক্রিয়া করে, শ্বাসেই এদের নামাজ। সে নামাজ অবশ্য বাতুন বা অপ্রকাশ্য। রাতের এয়সা নামাজ থেকে শুরু হয়েছে শ্বাসের ক্রিয়া, শেষ হবে খুব ভোরে, সেই ফজর নামাজের সময়।
আমার ঘুমও নেই, নামাজও নেই। আমি নিঃসঙ্গ জিজ্ঞাসু। আমার সঙ্গী বলতে রবীন্দ্রনাথের সেই গান: ‘ফিরি আমি উদাস প্রাণে/তাকাই সবার মুখের পানে’। সত্যিই কত জনের মুখের দিকে তাকিয়েই যে আমার জীবনের অর্ধেক কাটল। এই সব আপাত অর্থে অজ্ঞ মূর্খ মানুষগুলো আমাকে যা শিখিয়েছে জানিয়েছে তার কণামাত্রও কি পেয়েছি শিষ্ট বিদ্বান মহলে? এই তো সন্ধ্যাবেলাতেই মোহন খ্যাপার মতো সাধারণ স্তরের গাহক আমাকে যে-পথরেখা দেখাল তা কি আমার বিদ্যেবুদ্ধির পুঁজি থেকে কোনওদিন বেরোত? বসে আছি ময়দানী বিবির হাতে তৈরি নকশি কাঁথায়। তাতে জড়িয়ে আছে যে-সেবাধর্মের তাপ, যে-সুন্দরের অভিবন্দনা তার কি আমি প্রতিদান দিতে পারব কোনওদিন? অনিমীল চোখে বসে আছেন বারখেদার ফকির। জীবনের কত বড় সম্পদ আর সম্পন্নতা পেয়ে গেছেন আপন অন্তরে। সে শান্তি, সে নিশ্চিতি কি একটুও আছে আমার অর্থ-কীর্তি-সচ্ছলতায়? এই সবই ভাবছি, আবার নবলব্ধ চৈতন্যতত্ত্বের কথাও ভাবছি। সেই যে পাটুলী স্টেশনে বাউল গোঁসাই বলেছিল, ‘তোমার একটু দেরি আছে, তবে জানতে পারবে তাঁকে’ কত দেরি আর? রাতচরা পাখির হঠাৎ ডাকে চিন্তার সূত্র কেটে যায়। রাত কি তবে শেষ হয়ে এল? যেন একটা শীতের কাঁপন শেষরাতে শরীরকে জানান দেয়। একটু একটু চোখ জ্বলে। আমি খুব নির্ভার শূন্য মনে আশ্চর্য এই মানব পরিবেশে খানিকটা বিস্ময় পোহাই। শস্যের গন্ধ ওঠে উদাসী।
চিন্তায় ডুবে ছিলাম আনমনা। হঠাৎ সংবিৎ ফিরল খস্খস্ আওয়াজে। দেখি, দাওয়া থেকে খুব চুপিসারে উঠে ফকির যাচ্ছেন পুকুরে গোসল সারতে। আর সঙ্গে সঙ্গে যেন মাটি খুঁড়ে উঠে এল মোহন খ্যাপা। রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনায় ফিসফিস করে বলল, ‘আমি খবর নিয়ে জেনেছি। মস্তবড় জাননেওয়ালা মুর্শিদ ওই আলাল ফকির। একশো বছরের ওপরে বয়স। শেষ রাত থেকে ঘাপটি মেরে বসে আছি। চলুন বাবু পুকুর ঘাটে যাই, ধরি ওনাকে। এই তো সময়। বারখেদার ওই লোকগুলো আমারে বলেছে, ফজরের আগে গোসল সারার ঠিক পরে ফকিরকে যা জিজ্ঞেস করা যাবে তার জবাব মিলবে। তারপর সারাদিন তো থাকবেন মৌনী। চলুন চলুন। আপনার কোনও নিগূঢ় তত্ত্ব জানতে ইচ্ছে নেই?’
নিগূঢ় তত্ত্ব? হ্যাঁ, চৈতন্যতত্ত্বই তো সঠিক জানা হয়নি। সুকান্ত বলেছিলেন দরবেশরা জানেন তা। তবে কি সেই সুযোগ এল এতদিনে? স্বপ্নতাড়িতের মতো গিয়ে দাঁড়ালাম লুকিয়ে এক বকুল গাছের আওতায়। এবারে শুধু অপেক্ষা। গন্ধে বুঝছি, বুনো ফুলের আর্দ্র অস্তিত্ব। আবছা অন্ধকার। এক, দুই, তিন, চার…..মুহূর্ত এগোচ্ছে। কোন সাধক বলেছিলেন যেন, This is the hour of God’s awakening। ওই তো ওই যে আলাল ফকির সোজা উঠে আসছেন। সপসপ আওয়াজ উঠছে। আলখাল্লার শেষপ্রান্ত ভিজে গেছে না কি? তাঁর চোখ সুদূর মগ্ন উদাস, অন্য জগতে। ঠিক আততায়ীর মতো চকিতে গিয়ে সামনে দাঁড়াই আমি আর মোহন খ্যাপা। প্রথমে সামান্য ত্রস্ত, তারপরেই ক্ষমার উজ্জ্বল শান্ততায় চোখ ভরে তাকালেন, ‘বলো বাবা, কী জানবে?’ বহু বাসনায় বহুদিনের আকুলতা মিশিয়ে জানালাম অভিলাষ। হাসলেন সামান্য। তারপরে হাতটা ওপর দিকে তুলে বললেন, ‘কী জান বাবা, মাথার মণি বিন্দুই কৃষ্ণ। তাঁর যাতায়াত দেহের মেরুদাঁড়া ধরে বায়ুর ক্রিয়ায় লিঙ্গের মুখে। তাঁর রসরতির খেলা নিত্যানন্দের দ্বারে। প্রথমে কৃষ্ণ মণিকোঠা থেকে যাবেন অধোবেগে যোনিমুখে। এবার সাধক তেনারে দমের বলে উলটে নিয়ে ঊর্ধ্ব বেগে নিয়ে যাবেন মণিকোঠায় ফিরিয়ে। যখন তিনি অধোমুখী তখন তিনি ‘ধারা’। যখন উলটে গিয়ে হলেন ঊর্ধ্বমুখী তখন তিনি হলেন ‘রাধা’। এইভাবে চলবে ধারা থেকে রাধা আবার রাধা থেকে ধারা। এই চলাচল আর স্থিতির নাম গৌর। বুঝলে? ধারার বরণ শ্বেত, রাধার বরণ পীত। দেহের মধ্যে গৌরকে কায়েম করতে বহু বহু বছর লাগে বাবা। নিত্যানন্দ সহায় হলে তবে তো গৌর পাবে। গৌরচাঁদকে ধরো। শান্তি পাবে।’
চলমান পদশব্দ জানিয়ে দিল ফকিরের প্রস্থান। দাঁড়িয়ে রইলাম গাছের মতো স্তব্ধ গভীরতায়। খুব ধীরে সামনে এসে দাঁড়াল এক বর্ণময় নিষ্পাপ বায়ুপূরিত স্বচ্ছ দিনের ঊষাকাল।
* কায়ব্যূহ ধরো গৌরঃ কামশাস্ত্র প্রবীণকঃ।
অসংখ্যনায়িকাঃ প্রাপ্য শৃঙ্গারৈ অতষয়ৎ ॥
* দ্ৰ শ্ৰীশ্রী গৌড়ীয়-বৈষ্ণব-জীবন (২য় খণ্ড): শ্রীহরিদাস দাস। পৃষ্ঠা ৮৪
** ক্ষিতীশ-বংশাবলী-চরিত। মঞ্জুষা সংস্করণ ১৯৮৬। পৃষ্ঠা ১৯
২