গাড়িটা বাংলো ত্যাগ করার সময় গাড়ির শব্দে হুকুম চাঁদের ঘুম ভাঙলো। বারান্দায় ঝুলানো চিক তখন গুটিয়ে ছাদের কলামের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। চুনকাম করা সাদা বারান্দায় তখন সূর্যাস্তের আলতো আভা মিশে অপরূপ দৃশ্যের অবতারণা করেছে। জমাদার ছেলেটা হাতে টানা পাখার দড়ি নিয়ে মেঝের ওপর দলা পাকিয়ে শুয়ে ছিল। তার পিতা বাংলোর চারপাশে পানি ছিটিয়ে দিচ্ছিল। মাটির স্যাঁতসেঁতে গন্ধের সাথে তারের জাল দিয়ে ঘেরা দরজা দিয়ে ভেসে আসছিল জুই ফুলের সুগন্ধ। বাড়ির সামনে ভৃত্যরা পেতে দিয়েছিল একটা বড় মাদুর এবং তার ওপর একটা কাৰ্পেট। কার্পেটের এক পাশে পাতা ছিল একটা বড় বেতের চেয়ার, একটা টেবিলের ওপর এক বোতল হুইস্কি, কয়েকটা মনোরম পানপত্র ও প্লেট। টেবিলের নিচে সারি দিয়ে রাখা ছিল বেশ কয়েকটা সোডা পানির বোতল।
হুকুম চাঁদ ভৃত্যকে ডেকে গোসলের পানি দিতে বললেন এবং দাড়ি কামাবার তাকিয়ে রইলেন অপলক দৃষ্টিতে। তাঁর মাথার ওপর তখন দু’টো টিকটিকি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তার হামাগুড়ি দিয়ে পরস্পরের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় তাদের মুখ থেকে মৃদু হুংকার ধ্বনি শোনা যাচ্ছিল। দু’টো প্রাণীর মধ্যে আধা ইঞ্চি ব্যবধান থাকার সময় তারা থেমে গেল, তাদের লেজ নড়তে লাগল। মনে হলো, তারা একে অপরকে ভয় দেখাচ্ছে। এরপর শুরু হলো সম্মুখ যুদ্ধ। হুকুম চাঁদ সরে যাওয়ার আগে তারা পড়ে গেল তার বালিশের ওপর। ধপাস করে একটা শব্দ হলো। তাঁর মনে হলো, তাঁর দেহের ওপর ঠাণ্ডা আঁঠাল কিছু একটা লেগে গেছে। তিনি আঁতকে উঠে শোয়া থেকে বিছানায় বসলেন এবং টিকটিকি দু’টোর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। টিকটিকি দু’টো, মনে হলো, তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। তখনও তারা পরস্পরকে দাঁত দিয়ে কামড়ে ছিল, যেন উভয়ে ছিল চুম্বনরত। বেয়ারার পদধ্বনি শোনা গেল। টিকটিকি দু’টোর দিকে ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেবের এবং ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের দিকে টিকটিকি দু’টোর যে সম্মোহনী দৃষ্টি আবদ্ধ ছিল তা ভেঙে গেল। তারা বিছানা থেকে নেমে এসে দেয়াল বেয়ে আবার উঠে গেল ছাদের নিচের অংশে। হুকুম চাঁদের মনে হলো, তিনি যেন টিকটিকির গায়ে হাত দিয়েছেন। তাঁর হাত দু’টো যেন তারা ময়লা করে দিয়েছে। কিন্তু হাতের ময়লা এমন ছিল না যা মুছে বা পানি দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করা যায়।
বেয়ারা এক মগ গরম পানি ও সেভিং-এর জিনিসপত্র ড্রেসিং টেবিলের ওপর রাখল। একটা চেয়ারের ওপর সে রেখে দিল তার প্রভুর কাপড়াচোপড়। একটা পাতলা মসলিনের জামা, এক জোড়া পাজামা। ময়ূরের মতো নীল রংয়ের মধ্যে রূপালী সাদা সূতায় পাকানো পাজামার দড়ি। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কালো জুতা জোড়া চকচকে না হওয়া পর্যন্ত সে ব্রাশ করল। পরে জুতা জোড়া সে সযত্নে রেখে দিল চেয়ারের পাশে।
হুকুম চাঁদ শেভ ও গোসল করলেন বেশ যত্ন নিয়ে। গোসলের পর তিনি মুখমণ্ডল ও দুই বাহুতে স্কিন লোশন লাগালেন এবং সুগন্ধি ট্যালকম পাউডার ছড়িয়ে দিলেন দেহের বিভিন্ন অংগে। এ্যাডুকোলন দিয়ে হাতের আঙ্গুলগুলো ভিজিয়ে নিলেন। চুলের জন্য ব্যবহৃত তেল জাতীয় প্রসাধনী মাখার ফলে তাঁর চুল ছিল নরম ও ভেজা ভেজা। কিন্তু চুলের গোড়া যে সাদা হয়ে গিয়েছিল তা স্পষ্টভাবে দেখা যায়। গত এক পক্ষ কাল তিনি চুলে রং করতে পারেন নি। তিনি তাঁর মোটা গোঁফে হাত বুললেন, পাঁক দিয়ে গোঁফের শেষাংশ সুচাল করে তুললেন। গোঁফের গোড়াও সাদা হয়ে গেছে। তিনি গায়ে চড়ালেন ফিনিফিনে মসলিনের জামা। জামার ওপর দিয়ে আবছা হলেও দেখা যাচ্ছিল দেহের বিভিন্ন অংশ। পাজামা পরার পর ইন্ত্রি করার ভাঁজ স্পষ্ট হয়ে উঠল কয়েকটি স্থানে। জামার বিভিন্ন অংশে তুলোয় করে তিনি লাগিয়ে দিলেন সুগন্ধি আন্তর। সব কিছু শেষ হলে তিনি দৃষ্টি ফেরালেন। ছাদের নিচের অংশে। দেখলেন, টিকটিকি দু’টোর উজ্জ্বল কালো চোখ আপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
মার্কিন দেশে তৈরি গাড়িখানা ফিরে এসে পাড়ি বারান্দায় থামল। হুকুম চাঁদ তারের জালিবিশিষ্ট দরজার কাছে এসে উকি দিয়ে দেখলেন। তখনও গোঁফে তা দিচ্ছিলেন তিনি। দুজন লোক এবং দুজন মহিলা গাড়ি থেকে নামল। ঐ দুজন লোকের একজনের কাছে ছিল একটা হারমোনিয়াম এবং অন্য জনের কাছে ছিল দু’টো তবলা। দুজন মহিলার মধ্যে একজন বয়স্ক, মাথায় সাদা চুলে কমলা রং মাখানো। অন্য জন যুবতী। মুখে পান। চওড়া নাকের এক পাশে উজ্জ্বল হীরার অলংকার চকচক্ করছে। তার কাছে ছিল একটা পুটুল। আকারে ছোট। সে যখন গাড়ি থেকে নামল তখন পুটুলিটা ঝনঝনি করে বেজে উঠল। তারা সবাই ঘরে গিয়ে কার্পেটের ওপর বসল।
হুকুম চাঁদ আয়নায় নিজেকে ভাল করে দেখলেন। মাথার চুলের গোঁড়ার সাদা অংশ বেশ স্পষ্ট করে দেখা যাচ্ছিল। আঙ্গুল দিয়ে চুলগুলো তিনি নাড়াচাড়া করলেন। একটা সিগারেট ধরালেন। এরপর আগের মতোই তিনি সিগারেটের টিনের বাক্সের ওপর দেশলাই বাক্সটি রেখে এক সাথে দু’টোই হাতে নিলেন। তারের জালি দেয়া দরজা অর্ধেক খুলে তিনি বেয়ারাকে হুইস্কি আনার নির্দেশ। দিলেন। হুইস্কির বোতল আগেই টেবিলে রাখা ছিল, এ কথা তিনি জানতেন। তবু বেয়ারাকে তিনি ঐ নির্দেশ দিলেন এ কারণে যে, ঘরে যারা বসে আছে তারা যেন তাঁর আগমন বার্তা পায়। তিনি দরজাটা বন্ধ করলেন একটু শব্দ করেই। ধীরে অথচ দৃঢ় পদক্ষেপে হাঁটার জন্য জুতোর মচমচে শব্দ হলো। তিনি সোজা বেতের চেয়ারটায় গিয়ে বসলেন।
যারা বসে ছিল তারা উঠে দাঁড়াল। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবকে তারা সসম্মানে অভিবাদন জানোল। বাদক দুজন মাথা নত করে তাঁকে সালাম জানোল। দন্তবিহীন মহিলা প্রশংসার বান দুটালো: আপনার যশ-সম্মান বাড়ুক, খোদাবন্দ আপনার জয় হোক। যুবতী মেয়েটি শুধু তাঁর দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। চোখ দু’টো তার বড়, কাজলমাখা। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব হাতের ইশারায় তাদের বসতে বললেন। বৃদ্ধা মহিলার একঘেয়েমি চিৎকার স্তিমিত হলো। তারা চারজনেই কার্পেটের ওপর বসে পড়ল।
বেয়ারা তার প্রভুর গ্লাসে মদ ও সোডা ঢেলে দিল। হুকুম চাঁদ একটা বড় ব্লকমের হাই তুলে হাতের পিছন দিক দিয়ে মুখগহ্বর থেকে গোঁফ সরিয়ে দিলেন। অলস মেজাজে তিনি গোঁফে তা দিতে লাগলেন। মেয়েটি তার পুটুলি খুলে পায়ে ঘুঙুর বাধল। হারমোনিয়াম বাদক তার হারমোনিয়ামে একটা সুর তুলল। তবলা বাদক তবলার উপরিভাগের চারপাশে চামড়ার দড়ি দিয়ে বাঁধা গিরে ঢ়িলে বা শক্ত করে বাঁধার চেষ্টা করল ছোট হাতুড়ির আঘাত দিয়ে। হারমোনিয়ামের সুরের সাথে তবলার শব্দ মধুময় না হওয়া পর্যন্ত সে তবলার উপরিভাগের সাদা অংশে আঙ্গুল দিয়ে চাটি মারুল। এভাবেই শেষ হল তাদের প্রস্তুতি।
যুবতী মেয়েটি মুখ থেকে পানের পিক্ ফেলে দিল, খুব খুকু করে কেশে কফি ফেলে গলা পরিষ্কার করে নিল। বৃদ্ধ মহিলাটি বলল:
খোদাবন্দ। আপনি কি শুনতে ভালবাসেন? পুরোনো গান, পুককা না ফ্লিমের গান?
না, পুককা না। কিছু সিনেমার গান শোনাও, ভাল সিনেমার গান, বিশেষ করে পাঞ্জাবী গান।
যুবতী মেয়েটি সালাম করল। বলল, আপনি যা হুকুম করেন।
যন্ত্রী দুজন নিকটবর্তী হয়ে কি যেন বলাবলি করল। অতঃপর তারা মেয়েটির সাথে সামান্য কথা বলে বাজনা শুরু করল। তবলা ও হারমোনিয়াম এক সাথে বেজে ওঠার পরও মেয়েটিকে নীরবে কিছুটা অস্বস্তি ও উদাসভাবে বসে থাকতে দেখা গেল। তাদের প্রাথমিক বাজনা শেষ হলে মেয়েটি তার নাক ঝাড়ল এবং পুনরায় গলা পরিষ্কার করে নিল। সে তার বাম হাত কানের কাছে রেখে অন্য হাতটি ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের দিকে প্রসারিত করে তাকেই লক্ষ্য করে কৃত্রিম চড়া স্বরে গাইল:
ওহে আমার প্রিয়, যে চলে গেছে
আমি বেঁচে আছি, কিন্তু মরে যাওয়াই ভাল ছিল।
ঝরা আশ্রুজল আমি দেখি না।
আমি শ্বাস নেইনা, দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলি।
আলোর শিখাকে পোকা ভালবাসে
সেই শিখাই তার মৃত্যুর কারণ হয়
আমি আমার মাঝে অগ্নিশিখা জ্বালিয়েছি
সেই শিখা আমার শ্বাস হরণ করেছে
রাত কাটাই আমি আকাশের তারা গুণে।
দিন কটাই সুদিনের স্বপ্ন দেখে।
তুমি কখন ফিরে আসবে
আমি দেখব আবার
তোমার সেই চাঁদ মুখখানি।
মেয়েটি থামল। বাদকরা এমনভাবে বাজনা বাজাল যেন মেয়েটি তার গানের শেষাংশ শুরু করতে পারে।
এই পত্রের কথা আমার প্রিয়াকে জানাবে
পৃথক থাকার জ্বালা কিভাবে পোড়ায়।
মেয়েটির গান শেষ হলে হুকুম চাঁদ পাঁচ টাকার একটি নোট কার্পেটের ওপর জুড়ে দিলেন। মেয়েটি ও দুই যন্ত্রী তাদের মাথা নত করে কৃতজ্ঞতা জানাল। বৃদ্ধা মহিলাটি টাকাটা তুলে নিয়ে বলল, খোদাবন্দ, আপনার জয় হোক।
আবার গান শুরু হলো। হুকুম চাঁদ এবার নিজেই এক পেগ মদ ঢেলে এক ঢোকে গিলে ফেললেন। হাত দিয়ে মুখ থেকে গোঁফ সরিয়ে দিলেন। মেয়েটির দিকে ভাল করে তাকানোর অবস্থা তাঁর ছিল না। মেয়েটি যে গানটি গাচ্ছিল, তা হুকুম চাঁদের কাছে খুবই পরিচিত মনে হলো। ঐ গানটি তিনি তাঁর মেয়েকে গাইতে শুনেছেন।
মৃদুমন্দ বায়ুতে
আমার মসলিনের
লাল উড়নাখানি উড়ছে।
হো স্যার, হো স্যার।
হুকুম চাঁদ অস্বস্তি বোধ করলেন। তিনি আর এক পেগী হুইস্কি পান করে বিবেকের তাড়না থেকে মুক্তি পেতে চাইলেন। মানুষের জীবন অতি সংক্ষিপ্ত। এর মধ্যে অত বিবেকের তাড়না না থাকাই ভাল। তিনি হো স্যার, হো স্যার কথার তালে তালে আঙ্গুলো তুড়ি এবং উরুর ওপর চাপড় দিতে শুরু করলেন।
গোধূলির রক্তিম আভা মিলিয়ে যাওয়ার পর চন্দ্রবিহীন রাতের অন্ধকার বিস্তৃত হলো চারদিকে। নদীর ধারের জলাভূমিতে ব্যাঙ ডেকে উঠল। নল খাগড়ার বনে কিচমিচ করে উঠল পতঙ্গের দল। বেয়ারা স্ফটিকাবৎ একটা বাতি নিয়ে এল। ঐ বাতি থেকে বিছুরিত হচ্ছিল নীলাভ আলো। বাতির ফ্রেমের মধ্য থেকে আবছা! আলো হুকুম চাঁদ-এর গায়ে গিয়ে পড়ল। আলো থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখার চেষ্টায় রত মেয়েটির দিকে তিনি অপালক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। মেয়েটি নেহায়েত শিশু এবং খুব বেশি সুন্দরীও নয়। তবে সে যুবতী ও মাসুম। তার স্তন দু’টোও খুব স্বীত হয়নি। ঐ স্তনে এখনও কোন পুরুষের হাত পড়েনি বলেই মনে হয়। মেয়েটি বোধ হয় তাঁর নিজের মেয়ের চেয়েও বয়সে ছোট। এই ধারণা তাঁর মনে উদয় হতেই হুকুম চাঁদ আর এক পেগ হুইস্কি ঢেলে নিলেন। এটাই জীবন। জীবনকে গ্রহণ করে নাও যখন যেভাবে আসে, অসঙ্গত প্রথা ও মূল্যবোধকে দূরে রেখে মৌখিক ভদ্রতাকে স্বাগত জানাও। মেয়েটি হুকুম চাঁদ-এর টাকা চায় আর হুকুম চাঁদ চায়… ব্যস। সব কিছুই যখন বলা হয়েছে যে, মেয়েটি পতিতা এবং সেইভাবে তাকে দেখা হয়েছে। ফলে মূল্যবোধ অবাস্তর। মেয়েটির কালো রঙের শাড়ির পাড়ের রূপালী পাতা ঝলমল করে উঠল। নাকে লাগানো হীরা তারার মতো চিকচিক করে উঠল। সব সন্দেহ দূর করার জন্য হুকুম চাঁদ আর এক চুমুক মদ গলায় ঢেলে দিলেন। এ সময় হুকুম চাঁদ তাঁর গোঁফ মুছে নিলেন সিল্কের রুমাল দিয়ে। তিনি বেশ জোরেই অফুট শব্দ করতে শুরু করলেন এবং কটা কট করে হাতের আঙ্গুল ফোটালেন।
হুকুম চাঁদ যেসব সিনেমার গান জানতেন তার সবই গাওয়া শেষ হলো।
রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতার স্বরে হুকুম চাঁদ হুকুম করলেন, তুমি যা জান তাই গাও, নতুন ও আনন্দঘন গান।
মেয়েটি এমন একটা গান শুরু করল। যার মধ্যে ইংরেজী শব্দ ছিল একাধিক :
সানডে আফটার সানডে,
এই আমার জীবন।
হুকুম চাঁদ উল্লাসে ফেটে পড়লেন। তাঁর মুখ দিয়ে প্রশংসাসূচক ধ্বনি বাহ বাহু বেরিয়ে এল। মেয়েটি তার গান শেষ করলে তিনি তার দিকে পাঁচ টাকার নোট জুড়ে দিলেন না। তাকে তাঁর কাছে এসে তাঁর হাত থেকে টাকা নিতে বললেন। বৃদ্ধা মহিলাটি তাকে তাঁর কাছে যেতে বলল, যাও, হুজুর তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন।
মেয়েটি উঠে দাঁড়াল এবং টেবিলের কাছে গেল। টাকার নোটটি নেয়ার জন্য সে হাত বাড়ােল; হুকুম চাঁদ তাঁর হাত সরিয়ে নিলেন এবং নোটখানা তাঁর বুকের মধ্যে রাখলেন। তিনি দাঁত বের করে হাসলেন কামাসক্তভাবে। মেয়েটি তার সাথীদের দিকে তাকাল সাহায্যের আশায়। হুকুম চাঁদ এবার নোটটা রাখলেন টেবিলের ওপর। মেয়েটি তা নেয়ার আগেই তিনি তা তুলে নিয়ে পুনরায় বুকের মাঝে লুকিয়ে রাখলেন। তাঁর ব্যাপক কামাসক্ত হাসিতে দাঁত বেরিয়ে পড়ল। মেয়েটি তার সাথীদের কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াল। হুকুম চাঁদ তৃতীয় বারের মতো নোটটি তুলে ধরলেন।
হুজুরের কাছে যাও, বৃদ্ধা মহিলাটি অনুরোধ করল। মেয়েটি আজ্ঞাবাহের মতো ঘুরে দাঁড়াল এবং ধীর পদক্ষেপে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কাছে গেল। হুকুম চাঁদ তার কোমর জড়িয়ে ধরে বললেন: তুমি গাও ভাল।
মেয়েটি তার সাথীদের দিকে বিস্ময়ে তাকাল।
হুজুর তোমার সাথে কথা বলছেন, তুমি তাঁর কথার জবাব দিচ্ছ না কেন? বুদ্ধা মহিলাটি তাকে গালাগাল করল। হুকুম চাঁদকে সে ব্যাখ্যা করে বলল, খোদাবন্দ, মেয়েটির বয়স কম এবং খুব লাজুক। আস্তে আস্তে সে সব কিছু শিখে যাবে।
হুকুম চাঁদ মেয়েটির ওষ্ঠে হুইস্কি ভরা গ্লাসটি ধরে অনুনয় করে বললেন, সামান্য একটু পান কর। আমার খাতিরে মাত্র একবার খাও।
মুখ না খুলেই মেয়েটি উদাসীনভাবে উঠে দাঁড়াল।
বৃদ্ধা মহিলাটি অনুনয় করে বলল খোদাবন্দ, মদ পান সম্পর্কে সে কিছুই জানে না। তার বয়স ষোল হবে না এবং সে একেবারেই সরল। এর আগে সে কোনদিন কোন পুরুষের কাছে যায়নি। আমি আপনার সম্মানেই তাকে যোগাড় করে এনেছি।
হুজুম চাঁদ বললেন, সে যদি মদ পান না করে তাহলে অন্য কিছু খাবে। তিনি বৃদ্ধা মহিলার কথার শেষাংশ উপেক্ষা করাই শ্ৰেয় মনে করলেন। তিনি প্লেট থেকে একটা গোসতের টুকরা তুলে নিয়ে তার মুখে পুরে দেয়ার চেষ্টা করলেন। মেয়েটি টুকরাটি হাতে নিয়ে নিজেই খেয়ে নিল।
হুকুম চাঁদ মেয়েটিকে টেনে নিজের কোলের ওপর বসিয়ে তার চুল নাড়াচাড়া করতে লাগলো। মেয়েটির চুল ছিল তৈলাক্ত এবং ক্লিপ দিয়ে বাঁধা। তিনি কয়েকটা ক্লিপ খুলে মেয়েটির চুলের বাঁধন খুলে দিলেন। খোলা চুল মেয়েটির ঘাড়ের ওপর এসে পড়ল।
বৃদ্ধা মহিলা ও বাদ্যযন্ত্রীরা উঠে দাঁড়াল।
দয়া করে আমাদের যাওয়ার অনুমতি দিন।
হ্যাঁ, যাও। ড্রাইভার তোমাদের বাড়িতে পৌঁছিয়ে দেবে।
বৃদ্ধা মহিলাটি আবার একঘেয়েমি চিৎকার শুরু করে দিল খোদাবন্দ, আপনার জয় হোক। আপনার বিচার প্রতিভার সুনাম ছড়িয়ে পড়ুক সর্বত্র।
হুকুম চাঁদ এক তোড়া টাকার নোট টেবিলের ওপর রাখলেন বৃদ্ধা মহিলার জন্য। টাকা নিয়ে তারা গাড়িতে গিয়ে উঠল। মেয়েটি বসে রইল ম্যাজিস্ট্রেটের কোলের ওপর। বেয়ারাটি অপেক্ষা করে রইল। পরবর্তী আদেশের অপেক্ষায়।
রাতের খাবার দেব, স্যার। বেয়ারা জিজ্ঞাসা করল।
না। টেবিলের ওপর খাবার রেখে যাও। আমরা খেয়ে নেব। তুমি যাও।
বেয়ারাটি টেবিলের ওপর খাবার রেখে নিজের কোয়ার্টারে চলে গেল।
হুকুম চাঁদ হাত বাড়িয়ে স্ফটিকবৎ ল্যাম্পটি নিভিয়ে দিলেন। একটা শব্দ করে ল্যাম্পটি নিভে গেল। ঘরটা অন্ধকারে আচ্ছন্ন হলেও দরজার ফাঁক দিয়ে আসা শোয়ার ঘরের জ্বলন্ত বাতির কিছুটা আভা দেখা যাচ্ছিল। হুকুম চাঁদ দরজার বাইরে থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন।
মালগাড়িটা তখন মানো মাজরায় ওয়াগন রেখে চলে যাচ্ছিল ব্রিজের দিকে। বেশ শব্দ করেই ওটা এগুচ্ছল। ইঞ্জিন থেকে নির্গত ধোঁয়ার পরিমাণ দেখে গাড়ির গতিবেগ আন্দাজ করা যাচ্ছিল। গাড়ির লোকেরা অগ্নিকুণ্ডে কয়লা ভরছিল। উজ্জ্বল লাল ও হলুদ আলো ব্রিজের খিলানের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ব্রিজের অপর পারের জঙ্গলের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছিল। ট্রেনের শব্দ আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল। ট্রেনটি চলে যাওয়ার পর ব্যক্তিগত অন্তরঙ্গতার পরিবেশ অনুভূত হলো।
হুকুম চাঁদ আর এক পেগ হুইস্কি ঢেলে নিয়ে নিজেকে যেন সংহত করলেন। মেয়েটি তখনও তার কোলে বসেছিল শক্ত ও অনড় হয়ে।
তুমি কি আমার ওপর রাগ করেছ? তুমি কি আমার সাথে কথা বলবে না? মেয়েটিকে আরও নিজের দিকে টেনে এনে হুকুম চাঁদ জিজ্ঞাসা করলেন। মেয়েটি সে কথার জবাব দিল না বা তাঁর দিকে ফিরেও তাকাল না।
ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব মেয়েটির প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারে খুব বেশি আগ্রহী ছিলেন না। সব কিছুর জন্য তিনি আগেই টাকা দিয়েছেন। তিনি মেয়েটির মুখটা নিজের দিকে টেনে তার গলা ও কানে চুম্বন দিলেন। তিনি মালগাড়ির শব্দ আর শুনতে পাচ্ছিলেন না। মালগাড়িটা তখন নির্জন প্রত্যন্ত এলাকায় চলে গিয়েছিল। হুকুম চাঁদ তাঁর নিজের দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দই শুনতে পাচ্ছিলেন। তিনি মেয়েটির অন্তর্বাসের হুক খুলে দিলেন।
রাতের নিস্তব্ধতা একটা গুলির শব্দে প্রকম্পিত হলো। মেয়েটি নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
একটা গুলির শব্দ শুনেছ?
মেয়েটি মাথা নাড়াল। হতে পারে একজন শিকারী। মেয়েটি জবাব দিল। এই প্রথম সে হুকুম চাঁদের সাথে কথা বলল। ইতিমধ্যে সে অন্তর্বাসের হুক লাগিয়ে দিল।
এই অন্ধকার রাতে কোন শিকারী হতে পারে না।
দুজন কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে রইল। হুকুম চাঁদের মনে কিছু একটা আশঙ্কা ছিল; মেয়েটা মুক্ত হলো মদ, তামাক ও মুখে দুৰ্গন্ধভরা প্রেমিকের বন্ধন থেকে। কিন্তু এরপর কিছুক্ষণ নীরবতা হুকুম চাঁদকে নিশ্চিন্তু করল যে, সব কিছু ঠিক আছে। এই নিশ্চিন্ততাকে আরও নিশ্চিত করার জন্য তিনি আর এক পেগী হুইস্কি নিলেন। মেয়েটি অনুধাবন করল যে, তার পলায়নের কোন পথ নেই।
এটা নিশ্চয় পটকার আওয়াজ। কেউ হয়ত বিয়ে করতে যাচ্ছে বা অন্য কিছু, হুকুম চাঁদ মেয়েটিকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরলেন। তিনি তার নাকে চুমু খেলেন। তারপর হাসতে হাসতে বললেন, চল আমরাও বিয়ে করি।
মেয়েটি কোন উত্তর দিল না। সিগারেটের ছাই, গোশতের টুকরা ও প্লেট ভর্তি টেবিলের ওপর হুকুম চাঁদ যখন তাকে নিয়ে যেতে চাইলেন, তখনও সে কোন বাধা দিল না। হুকুম চাঁদ হাত দিয়ে টেবিলের ওপর সব কিছু ঠেলে ফেলে দিলেন এবং শুরু করলেন আদিম মিলনের প্রক্রিয়া। দুই হাতে তিনি চেপে ধরলেন মেয়েটির প্রস্ফুটিত যৌবন। তাঁর আদিম থাবায় মেয়েটি ক্ষত-বিক্ষত হলেও কোন বাধা দিল না। তিনি মেয়েটিকে টেবিলের ওপর থেকে নামিয়ে কার্পেটের ওপর শুইয়ে দিলেন। মেয়েটি তার শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে নিল এবং মুখটা এক পাশে সরিয়ে নিল হুকুম চাঁদ-এর মুখের দুৰ্গন্ধ থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য।
হুকুম চাঁদ শুরু করলেন মেয়েটির বিন্যস্ত পোশাক অবিন্যস্ত করতে।
মানো মাজরা থেকে মানুষের চিৎকার ও উত্তেজিত কুকুরের ডাক শোনা গেল। হুকুম চাঁদ শব্দ লক্ষ্য করে কান পেতে রইলেন। আবার দু’টো গুলির শব্দ হল এবং সাথে সাথেই থেমে গেল মানুষের চিৎকার আর কুকুরের ডাক। ধুৎতরি ধরনের শব্দ উচ্চারণ করে হুকুম চাঁদ মেয়েটিকে ছেড়ে দিলেন। মেয়েটি উঠে দাঁড়িয়ে তার চুল আঁচড়ালো, পোশাক ঠিক করল। সার্ভেন্ট কোয়ার্টার থেকে বেয়ারা ও জমাদার হারিকেন নিয়ে ছুটে এল। তাদের আলোচনায় উত্তেজনা প্রকাশ পাচ্ছিল। একটু পরে ড্রাইভার গাড়ি বারান্দায় গাড়ি থামাল। গাড়ির হেড লাইটে বাংলো আলোকিত হলো।