১.৫ অপহরণ

অপহরণ

১১৭১ সালের জুন মাস। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী নিজ কক্ষে উপবিষ্ট. অনুমতি নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে খলীফা আল-আজেদের দূত। সালাম দিয়ে বলে, খলীফা আপনাকে স্মরণ করেছেন। বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠে সুলতান আইউবীর চেহারায়। ভ্রূ কুঞ্চিত করে দূতকে বললেন–খলীফাকে আমার সালাম দিয়ে বলবে, জরুরী কোন কাজ থাকলে যেন তিনি আমাকে ডেকে পাঠান; অন্যথায় নয়। এ মুহূর্তে আমার এতটুকু অবসর নেই। তাঁকে আরো বলবে, আমার সামনে যে কাজ পড়ে আছে, তা হুজুরের দরবারে হাজেরী দেয়া অপেক্ষা অধিক গুরুত্বপূর্ণ।

দূত ফিরে যায়। মাথা নুইয়ে কক্ষে পায়চারী করতে শুরু করেন সুলতান আইউবী।

ফাতেমী খেলাফতের যুগ। আল-আজেদ মিসরে এ খেলাফতের খলীফা। সে যুগের খলীফারা হতেন রাজা। জুমার খুতবায় আল্লাহ ও রাসূলের নামের পরে খলীফার নামও উচ্চারণ করতে হতো। বিলাসিতা ছাড়া তাদের আর কোন কাজ ছিলো না। নুরুদ্দীন জঙ্গী আর সুলতান আইউবী যদি না থাকতেন, কিংবা তারাও যদি অপরাপর আমীর-উজীরদের ন্যায় আয়েশী ও ঈমান-বিক্রেতা হতেন, তাহলে সে যুগের খলীফারা ইসলামী সাম্রাজ্যকে বিক্রি করে খেয়ে-ই ফেলেছিলেন।

আল-আজেদও তেমনি এক খলীফা। মিসরের গভর্নর হয়ে আগমন করার পর তিনি সুলতান আইউবীকে প্রথম প্রথম বেশ কবার দরবারে ডেকে নিয়েছিলেন। সুলতান আইউবী বুঝে ফেলেছিলেন, খলীফা তাঁকে অযথা বারবার তলব করার উদ্দেশ্য, তাকে এ কথা বুঝানো যে, মিসরের সম্রাট, সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী আইউবী নয় তিনি।

খলীফা সুলতান আইউবীকে বেশ শ্রদ্ধা করতেন। তাকে ডেকে নিয়ে নিজের কাছে বসাতেন। কিন্তু ভাবগতিক ছিলো রাজকীয়। কথা বলার ভঙ্গি ছিলো তার শাসক-সুলভ। সুলতান আইউবীকে তিনি যতবার ডেকে পাঠিয়েছিলেন ডেকে পাঠিয়েছিলেন সম্পূর্ণ অকারণে এবং অনর্থক খোশগল্প করে কোন কাজ ছাড়াই বিদায় দিয়েছেন। এ কারণে নোম উপসাগরে ক্রসেডারদের পরাজিত করে এবং সুদানী সৈন্যদের বিদ্রোহ দমন করে সুলতান আইউবী খলীফাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করেন।

খলীফার মহলের জাঁকজমক আগুন ধরিয়ে রেখেছিলো সুলতানের বুকে। সোনার তৈরি পাত্রে পানাহার করেন তিনি। মদের পিপা-পেয়ালা তাঁর হীরা-খচিত। সুন্দরী মেয়েদের দ্বারা পরিপূর্ণ তাঁর হেরেম। আরবী, মিসরী, মারাকেশী, সুদানী ও তুর্কী ছাড়াও ইহুদী-খৃষ্টান মেয়েও আছে তাঁর রংমহলে। এ সেই জাতির খলীফা, যে জাতির দায়িত্ব ছিলো বিশ্বময় আল্লাহর বাণী প্রচার করা, যে জাতি বিশ্ব কুফরী শক্তির ভয়াবহ সামরিক প্রতিরোধের মুখোমুখি।

খলীফার আরো কয়েকটি বিষয় শূলের ন্যায় বিদ্ধ করছিলো সুলতানকে। প্রথমত খলীফার ব্যক্তিগত রক্ষী বাহিনীর সদস্যরা ছিলো সুদানী, হাবশী ও কাবায়েলী। তাদের আনুগত্য ছিলো সংশয়পূর্ণ । দ্বিতীয়ত বিদ্রোহী ও ক্ষমতাচ্যুত সুদানী ফৌজের কমাণ্ডার ও নায়েব সালার ছিলো দরবারে খেলাফতের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি–খলীফার ডান হাত।

সালাহুদ্দীন আইউবীর পরামর্শে আলী বিন সুফিয়ান চাকর-চাকরানী ও অন্যান্য দায়িত্বশীলদের বেশে খলীফার মহলে গুপ্তচর ঢুকিয়ে দেন। হেরেমের দুটি মেয়েকেও হাত করে তাদের উপর গুপ্তচরবৃত্তির দায়িত্ব অর্পণ করেন। তাদের রিপোর্ট মোতাবেক খলীফা ছিলেন সুদানী কমাণ্ডারদের দ্বারা প্রভাবিত। . খলীফা ষাট-পয়ষট্টি বছর বয়সের বৃদ্ধ। তবুও সুন্দরী মেয়েদের নাচ-গান ছাড়া রাত কাটে না তার। তার এই চারিত্রিক দুর্বলতা সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর প্রতিপক্ষের মোক্ষম সুযোগ। এই সুযোগকে কাজে লাগাতে তারা। ***

১১৭১ সালের ফেব্রুয়ারী কি মার্চ মাস। খলীফা আল-আজেদের হেরেমে আগমন ঘটে নতুন একটি মেয়ের। অস্বাভাবিক সুন্দরী এক তরুণী। আরবী পোশাক পরিহিত জনাচারেক লোক এসে উপহার হিসেবে মেয়েটিকে খলীফার হাতে তুলে দিয়ে যায় । দিয়ে যায় আরো মূল্যবান বেশ কিছু উপঢৌকনও।

মেয়েটির নাম উম্মে আরারাহ। রূপের ফাঁদে ফেলে অল্প কদিনে-ই খলীফাকে বশ করে ফেলে নবাগতা এই মেয়েটি। মহলের মেয়ে গুপ্তচর মারফত ঘটনা সম্পর্কে অবগত হন আলী বিন সুফিয়ান।

কসরে খেলাফতের এই কাণ্ড-কীর্তি সবই সুলতান আইউবীর জানা। কিন্তু খলীফার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার শক্তি তাঁর এখনো হয়নি। পূর্বেকার গভর্নর ও আমীরগণ চলতেন খলীফার সামনে মাথা নত করে। তাদের সেই চাটুকারিতার ফলে মিসর আজ বিদ্রোহের অগ্নিগর্ভ। তাদের আমলে খেলাফত ছিলো বটে, তবে ইসলামের পতাকা ছিলো অবনমিত। সেনাবাহিনী ছিলো ইসলামী সাম্রাজ্যের। কিন্তু সুদানী সেনাপতি রাজ্য শাসনের ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছিলেন নিজের হাতে । তার সম্পর্ক ছিলো খৃষ্টানদের সঙ্গে। তার-ই সক্রিয় সহযোগিতায় কায়রো ও ইস্কান্দারিয়ায় খৃষ্টানরা বসতি স্থাপন করতে শুরু করেছিলো। এই বসতি স্থাপনকারীদের মধ্যে ছিলো অসংখ্য গুপ্তচর।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী সুদানী সৈন্যদের দমন করেছিলেন ঠিক; কিন্তু বেশ কজন সেনাপতি রয়ে গেছে এখনো। যে কোন সময় তারা বিপদ হয়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। কসরে খেলাফতে তাদের বেশ প্রভাব।

খেলাফতের বিলাসপূর্ণ এই গদির উপর এখনই হাত দিতে চাইছেন না সুলতান। কারণ, কিছু লোক এখনো খেলাফতের ব্যাপারে আবেগপ্রবণ। কতিপয় তো খলীফার সক্রিয় সহযোগী। তন্মধ্যে চাটুকারদের সংখ্যাই অধিক। এই চাটুকারদের মধ্যে উচ্চপদস্থ এমন কর্মকর্তাও আছেন, যাদের স্বপ্ন ছিলো মিসরের গভর্ণর হওয়া। কিন্তু সেই মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত এখন সুলতান আইউবী।

খৃষ্টান গুপ্তচর ও বিশ্বাসঘাতকদের দ্বারা পরিপূর্ণ দেশ। গাদ্দারদের বিরুদ্ধে এ্যাকশন নিলে খৃষ্টানদের পাল্টা আক্রমণের আশঙ্কা প্রবল। তাই সুলতান আইউবী খেলাফতের মদদপুষ্ট শাসকবর্গকে এখন-ই শত্রুতে পরিণত করতে চাইছেন না।

কিন্তু ১৯৭১ সালের জুনের একদিন খলীফা তাকে ডেকে পাঠালে তিনি যেতে পারবেন না বলে পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন। সুলতান কক্ষে পায়চারী করছেন। দারোয়ানকে ডেকে বললেন–আলী বিন সুফিয়ান, বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ, ঈসা এলাহকারী ফকীহ ও আন-নাসেরকে এক্ষুনি আমার কাছে আসতে বলো।

***

এই ব্যক্তিগণ সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর খাস উপদেষ্টা ও বিশ্বস্ত। সুলতান আইউবী তাদের উদ্দেশে বললেন–এইমাত্র খলীফার দূত আমাকে নিতে এসে গেলো। আমি যেতে পারবে না বলে জানিয়ে দিয়েছি। খেলাফতের ব্যাপারে আমি কঠোর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে চাই। এর প্রথম ধাপে আমিজুমার ধুতরা থেকে খলীফার নাম তুলে দিতে চাই। এ ব্যাপারে আপনারা আমাকে পরামর্শ দিন।

এ পদক্ষেপ নেয়ার সময় এখনো আসেনি। খলীফাকে মানুষ এখনো পয়গম্বর মনে করে, এতে জনমত আমাদের বিপক্ষে চলে যাবে। বললেন বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ।

এখনোর মানুষ তাকে পয়গম্বরু মনে করে। কদিন পর খোদা ভাবতে শুরু করবে। খুতবায় আল্লাহ-রাসূলের নামের পাশে তার নাম উচ্চারণ করে আমক্কা-ই অে তাকে পয়গম্বর ও খোদার আসনে বসিয়েছিঃ কি ঈসা ফকীহ। আপনার পরামর্শ বলুন। বললেন আইউবী।

আপনার মতের সঙ্গে আমিও একমত। কোন মুসলমান জুমার খুতবায় আলাহ-রাসূলের পাশাপাশি অন্য কোন মানুষের নাম সহ্য করতে পারে না। তা-ও আবার এমন মানুষ, যিনি মদ-নারীসহ সব রকম পাপে নিমজ্জিত। শত শত বছর ধরে খলীফাকে পয়গম্বরের মর্যাদা দিয়ে আনা হচ্ছে বলে চিরদিন তা বহাল রাখতে হবে এমন কোন কথা নেই। কুরআন-সুন্নাহর দৃষ্টিতে আমি এমন-ই বুঝি। তবে রাজনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে এ পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়া কী হবে, তা আমি বলতে পারবো না। বললেন ঈসা এলাহকারী ফকীহ।

প্রতিক্রিয়া হবে অত্যন্ত তীব্র। আর হবে আমাদের বিপক্ষে। তথাপি আমার পরামর্শ, হয়তো এই কু-প্রথার অবসান ঘটাতে হবে কিংবা খলীফাকে খাঁটি মুসলমান বানিয়ে জনগণের সামনে উপস্থিত করতে হবে। তবে আমার দৃষ্টিতে দ্বিতীয়টি সম্ভব হবে না। বললেন বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ।

আলী বিন সুফিয়ান বললেন–জনমত সম্পর্কে আমার চেয়ে আর কে ভালো জানলে জনগণ খলীফা আল-আজেদু নামের সঙ্গে নয়–সালাহুদ্দীন আইউরী নামের সাথে পরিচিত আমার গোয়েন্দা বিভাগের নির্ভরযোগ্য রিপোর্টে আমি নিশ্চিত হয়েছি যে, আপনার দু বছরের শাসনামলে জনগণ এখন বহু সমস্যার সমাধান পেয়েছে, যার কল্পনাও তারা কখনো করেনি। দেশে উন্নত কোন হাসপাতাল ছিলো না। চিকিৎসার অভাবে সাধারণ রোগেও মানুষ মারা যেতো। এখন উন্নতমানের সরকারী হাসপাতাল আছে। স্থানে স্থানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু হয়েছে। আগে চুরি-ডাকতি, হাইজ্যাক-ছিনতাইয়ের কারণে ব্যবসায়ীর নিরাপদে ব্যবসা করতে পারতো না। এখন তারও অবসান ঘটেছে। অপরাধ প্রবণতা আগের তুলনায় এখন অনেক কম। মানুষ এখনদের সমস্যার সমাধানের জন্য সরাসরি আপনার শরণাপন্ন হতে পারছে। জানাতে পারছে তাদের আর্জি-ফরিয়াদ। আপনার গভর্নর হয়ে মিসর আগমনের আগে মানুষ সরকারী কর্মকর্তা ও সেনারাহিনীর নামে সন্ত্রস্ত থাকতো সব সময়। আপনি তাদেরকে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করেছেন। মানুষ এখন নিজেদেরকে দেশ ও জাতির অংশ ভাবতে শিখেছে। খেলাফত থেকে তারা অবিচার আর নির্দয়তা ছাড়া আর কিছু-ই পায়নি। আপনি তাদেরকে সুবিচার উপহার দিয়েছেন, দিয়েছেন নাগরিক অধিকার। আমি প্রত্যয়ের সঙ্গে বলতে পারি,–জাতি খেলাফতের নয়–ইমারাতের সিদ্ধান্তই মেনে নেবে।

সুলতান আইউবী বললেন–জাতিকে আমি সুবিচার দিতে পেরেছি কি পারিনি তাদের অধিকার তাদেরকে বুঝিয়ে দিতে পারলাম কি পারলাম না, আমি বলতে চাই না আমি শুধু এটুকু জানিয়ে দেশের:ঈমানদার জনসাধারণের ঘাড়ে কোন বাজে প্রথা চাপিয়ে রাখা যায় না। শিরক-কুফরী থেকে আমি জাতিকে মুক্তি দিতে চাই। দ্বীন-ধর্মের অঙ্গ বলে পরিচিত এসব কু-প্রথাকে আমি ছিন্নভিন্ন করে অতীতের আঁস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করতে চাই। এ প্রথা বহাল থেকে যায়, তাহলে বিচিত্র কি যে, কাল-পরশু আমিও নিজের নাম খুতবায় শামিল করে নেবো। বাড়ি থেকে বাতি জ্বলে শিরকের এই বাতি আমি নিভিয়ে ফেলতে চাচ্ছি। কসরে খেলাফত পাপের আড্ডায় পরিণত হয়েছে। সুদানী বাহিনী যে রাতে মিসর আক্রমণ করেছিলো, সে রাতেও খলীফা মদ পান করে হেরেমের মেঝে বুঁদ হয়ে পড়ে ছিলো আমার কৌশল যদি ব্যর্থ হতো, তাহলে সেদিন-ই মিসরের বুক থেকে ইসলামের পতাকা হারিয়ে যেতো। সে রাতে আল্লাহর সৈনিকরা যখন ইসলাম ও দেশের জন্য শহীদ হচ্ছিলো, খলীফা তখন মদ খেয়ে পড়েছিলো মাতাল হয়ে।

সুদানীদের হামলা প্রতিহত করে আমি যখন তাঁকে ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করতে গেলাম, তিনি তখন মাতাল ষাড়ের ন্যায় ঢুলু ঢুলু কণ্ঠে বলেছিলেন, শাবাশ! শুনে আমি বেশ খুশী হলাম। বিশেষ দূত মারফত আমি তোমার পিতার কাছে এর মোকারকবাদ ও পুরস্কার প্রেরণ করছি। তখন আমি তাকে বলেছিলাম–খলীফাতুল মুসলিমীন। আমি আমার কর্তব্য পালন করেছি মাত্র এ কতব্য আমি পাল করেছি। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে–পিতার মনোরঞ্জনের জন্য নয়।

খলীফা বললেন–সালাহুদ্দীন! বয়সে তুমি এখনো নবীন; কিন্তু কাজ করে দেখালে বিজ্ঞ প্রবীণের মতো!

খলীফা আমার সঙ্গে এমনভাবে কথা বলেছিলেন, যেন আমি তার গোলাম। তা ছাড়া এই ধর্মহারা লোকটি রাষ্ট্রীয় কোষাগারের জন্য এক শ্বেত হস্তিতে পরিণত হয়ে বসেছে।

পকেট থেকে একখানা পত্র বের করে সুলতান সবাইকে দেখালেন এবং বললেন, ছয়-সাত দিন হলো নুরুদ্দীন জঙ্গী আমাকে এ পত্রখানা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন–

খেলাফত তিনভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। দুই অধীন খলীফার উপর বাগদাদের কেন্দ্রীয় খেলাফতের প্রভাব শেষ হয়ে গেছে। আপনি লক্ষ্য রাখবেন, পাছে মিসরের খলীফা স্বাধীন শাসক হয়ে না বসেন। প্রয়োজনে তিনি সুদানী ও ক্রুসেডারদের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতেও কুণ্ঠিত হবেন না। আমি ভাবছি, খেলাফত থাকবে শুধু বাগদাদে। খলীফা থাকবেন স্রেফ একজন। অধীন খলীফার প্রথা বিলুপ্ত করা হবে। কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে, তারা আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের ফাঁদ পেতে রেখেছে। মিসরের খলীফার রাজত্বকে যদি আপনি তার মহলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে পারেন, তাহলে আমি আপনাকে সামরিক ও আর্থিক সাহায্য দিয়ে যাবোর সাবধানতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। কারণ, মিসরের আভ্যন্তরীণ অবস্থাও অনুকূল নয়। মিসরে আরো একটি বিদ্রোহ ঘটতে যাচ্ছে। আপনি সুদানীদের উপর কড়া নজর রাখুন।

পত্রটি পাঠ করে সুলতান আইউবী বললেন, আমাদের খেলাফত যে সাদা হাতী, তাতে সন্দেহ কি? আপনারা দেখছেন না, খলীফা আল-আজেদ যখন পরিভ্রমণে বের হন, তখন অর্ধেক সৈন্যকে তার নিরাপত্তার নামে চারদিকে ছড়িয়ে দেয়া হয়? খলীফার চলার পথে গালিচা বিছিয়ে দেয়ার জন্য জনসাধারণের প্রতি চাপ সৃষ্টি করা হয়। যুবতী মেয়েদেরকে খলীফার গায়ে ফুলের পাপড়ি ছিটাতে বাধ্য করা হয়।

ইসলামী সাম্রাজ্যের প্রতিরক্ষা, সম্প্রসারণ এবং জাতির উন্নয়নে যে অর্থ ব্যয় হতে পারতো, সে অর্থ ব্যয় করছেন তিনি নিতান্ত বিনোদনমূলক পরিভ্রমণে। আমাদের আর সময় নষ্ট করা যাবে না। মিসরী জনগণ, এদেশের খৃষ্টসমাজ এবং . অপরাপর সংখ্যালঘুদের কাছে আমাদের প্রমাণ দিতে হবে, ইসলাম–রাজ-রাজড়াদের ধর্ম নয়। ইসলাম আরব মরুভূমির রাখাল-কিষাণ ও উষ্ট্ৰচালকদের সাচ্চা ধর্ম। ইসলাম মানবজাতিকে মানবতার মর্যাদাদানকারী অনুপম জীবন-ব্যবস্থা।

বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ বললেন–খলীফার বিরুদ্ধে এ্যাকশন নিতে গেলে আপনার নামে এই অপবাদ রটানো হতে পারে যে, খলীফাকে অপসারিত করে আপনি তার মসনদ দখল করতে চাচ্ছেন। সত্যের বিরোধিতা চীরদিন হয়েছে এবং হতে থাকবে।

সুলতান আইউবী বললেন–আজ মিথ্যা ও বাতিলের শিকড় এতো শক্ত হওয়ার কারণ, প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধাচারণের ভয়ে মানুষ সত্য বলা ছেড়ে দিয়েছে। সত্যের বাণী আজ নিভৃতে কাঁদে।

আমাদের শাসকরা জনসাধারণকে অনাহারে রেখে, তাদের উপর জবরদস্তি শাসন চাপিয়ে দিয়ে তাদেরকে গোলামীর শৃংখলে বেঁধে রেখেছেন, যে শৃংখল ভেঙ্গে মানবতার মুক্তি নিশ্চিত করেছিলেন আমাদের রাসূল (সাঃ)। আমাদের রাজা-বাদশাহগণ এতো-ই অধঃপাতে নেমে গেছেন যে, নিজেদের ভোগ-বিলাসের স্বার্থে তারা খৃষ্টানদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতছেন, তাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়াচ্ছেন। আর এ সুযোগে খৃষ্টানরা ধীরে ধীরে ইসলামী সাম্রাজ্যকে হাত করে চলেছে। শুনুন শাদ্দাদ! আপনি বলেছেন, জনগণ আমাদের বিরুদ্ধে চলে যাবে, তাই না? সাহস নিয়ে গা ঝাড়া দিয়ে উঠুন। এসব বিরোধিতাকে ভয় করলে আমাদের চলবে না।

সুলতান আইউবীর নায়েব সালার আন-নাসের বললেন, বিরুদ্ধাচারণকে আমরা ভয় করি না শ্রদ্ধেয় আমীর! আপনি আমাদেরকে রণাঙ্গনে দেখেছেন। শর্কর বেষ্টনীতে অবরুদ্ধ হয়েও আমরা নির্ভীকচিত্তে লড়াই করেছি। ক্ষুধা-পিপাসায় কাতর হয়েও জীবনপণ লড়েছি। সংখ্যায় যখন আমরা নিতান্ত নগণ্য ছিলাম, শত্রু বাহিনীর সয়লাব প্রতিরোধ তখনও করেছি। কিন্তু এ মুহূর্তে আমি আপনাকে আপনার-ই বলা একটি কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। আপনি একবার বলেছিলেন, যে আক্রমণ বাইরে থেকে আসে, আমরা তা প্রতিরোধ করতে পারি। কিন্তু আক্রমণ যখন হয় ভেতর থেকে আর আক্রমণকারীরা হয় নিজেদের-ই লোক, তখন আমরা থমকে যাই, কিংকর্তব্যবিমূঢ় দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকি, হায়! একি হলো আল্লাহ? মোহতারাম আমীরে মেসের! দেশের শাসনকর্তা-ই যখন দেশের শত্রু হয়ে যাবে, আপনার তরবারী তখন কোষের ভিতরে-ই ছটফট করতে থাকবে।

সুলতান আইউবী বললেন–আপনি ঠিকই বলেছেন, নাসের! তরবারী আমার খাপের মধ্যে-ই তড়পাচ্ছে! স্বদেশের শাসকদের বিরুদ্ধে বেরুতে চাইছে না আমার শাণিত অসি। দেশের শাসকবর্গ জনগণের মর্যাদার প্রতীক। শাসকমণ্ডলীকে আমি বরাবরই শ্রদ্ধার চোখে দেখি কিন্তু ভেবে দেখুন, তারা সেই মর্যাদা রক্ষা করছে কতটুকু? শুধু খলীফা আল-আজেদে্র কথাই বলছি না। আলী বিন সুফিয়ানকে জিজ্ঞেস করুন। তার গোয়েন্দা বিভাগ মসুল, হাল্‌ব, দামেশ্‌ক ও মক্কা-মদীনা থেকে যে রিপোর্ট নিয়ে এসেছে, তা হলো বিলাসপ্রিয়তার কারণে যে যেখানকার গভর্নর বা শাসক; সে-ই সেখানকার সার্বভৌম ক্ষমতাধর হয়ে বসেছে। সালতানাতে ইসলামিয়া খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে। খেলাফত এতই দুর্বল যে শাসক-গভর্নর এখন ব্যক্তিগত রাজনীতি চর্চার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে।

আমি জানি, জাতির এই বিক্ষিপ্ত শক্তিগুলোকে যদি আমরা একত্রিত করতে যাই, তাহলে তা আরো বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়বে। আমাদের সামনে সমস্যার পাহাড় এসে দাঁড়াবে। কিন্তু নির্ভয়ে আমি কাজ করতে চাই। আশা করি আপনারাও সাহসিকতার সঙ্গে আমাকে সহযোগিতা দিয়ে যাবেন। সালতানাতে ইসলামিয়ার এই ধস আমাদের ঠেকাতেই হবে। আপনারা যে যা পরামর্শ দিয়েছেন, আমি তার মূল্যায়ন করবো। তবে এখন থেকে আমি খলীফার ডাকে তখন-ই সাড়া দেবো, যখন জরুরী কোন কাজ থাকবে। কি কাজে ডেকে পাঠালেন, খলীফাকে আগেই আমাকে তা অবহিত করতে হবে। অন্যথায় তার ডাকে একটি মুহূর্তও আমি নষ্ট করতে চাই না। আর আপাতত আমি জুমার খুতবা থেকে খলীফা্র নাম তুলে দিচ্ছি।

উপস্থিত সকলে সুলতান আইউবীর এ সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেন এবং তার বাস্তবায়নে পূর্ণ সহযোগিতা ও সর্বপ্রকার ত্যাগ স্বীকার করার প্রতিশ্রুতি দেন।

***

খলীফা আল-আজেদ তার খাস কামরায় উপবিষ্ট। দূত ফিরে এসে জানায়, সুলতান আইউবী বলেছেন, কোন জরুরী কাজ থাকলে তিনি আসতে পারবেন। অন্যথায় তিনি বেজায় ব্যস্ত।

শুনে খলীফা অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠেন। দূতকে বললেন, রজবুকে আসতে বলো।

রজব খলীফার নিরাপত্তা বাহিনীর কমাণ্ডার। নায়েব সালারের সমান তার মর্যাদা। এক সময় ছিলো মিসরের সেনাবাহিনীর অফিসার। খলীফার বডিগার্ড-এর কমাণ্ডারের দায়িত্বপ্রাপ্তির পর সে কসরে খেলাফত ও খলীফার নিরাপত্তা বাহিনীতে দেখে দেখে সুদানী হাবশীদের নিয়োগ দান করে। রজব আইউবী বিরোধী এবং খলীফার চাটুকারদের অন্যতম।

খলীফার খাস কামরায় উম্মে আরারাও উপস্থিত। দূতের রিপোর্ট শুনে সে বলে ওঠলো, সালাহুদ্দীন আইউবী আপনার একজন নওকর বৈ নয়। অথচ আপনি তাকে মাথায় তুলে রেখেছেন। লোকটাকে আপনি বরখাস্ত করছেন না কেন?

কারণ, তার ফল ভাল হবে না। সেনাবাহিনীর কমাণ্ড তার হাতে। ইচ্ছে করলে এ বাহিনীকে সে আমার বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারে। কম্পিত কণ্ঠে বললেন খলীফা।

ইত্যবসরে এসে উপস্থিত হয় রজব। মাথা ঝুঁকিয়ে খলীফাকে সালাম করে। রাগে কাঁপছেন খলীফা। ক্রুদ্ধ ও কম্পিত কণ্ঠে বললেন, আমি পূর্ব থেকেই জানতাম, কমবখত একটা অহংকারী ও অবাধ্য লোক। সালাহুদ্দীন আইউবীর কথা বলছি …….। দূত মারফত লোকটাকে আমি ডেকে পাঠিয়েছিলাম। সে এই বলে আমার আহ্বান প্রত্যাখ্যান করলো যে, কোন জরুরী কাজ থাকলে আসব; অন্যথায় আপনার আহ্বান আমার নিকট অর্থহীন। কারণ, আমার সামনে জরুরী কাজ পড়ে আছে।

রাগের মাথায় বলতে বলতে হেঁচকি উঠে যায় খলীফার । তারপর প্রবল বেগে কাশি। দু হাতে বুক চেপে ধরেন তিনি। চেহারার রং যেন হলুদ হয়ে গেছে তাঁর। এমনি অবস্থায় তিনি ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন বদমাশটা এতটুকুও বুঝলো না যে, আমি একে তো বৃদ্ধ, তার উপর হৃদরোগের রুগী; অপ্রীতিকর সংবাদ আমাকে ক্ষতি করতে পারে। আমি এখানে শরীর-স্বাস্থ্যের চিন্তায় অস্থির আর ও কিনা দেখাচ্ছে তার কাজের গরজ!

তাকে আপনি কেন ডেকেছিলেন? আমাকে আদেশ করুন। বললো রজব।

ডেকেছিলাম তাকে একথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য যে, তার মাথার উপর একজন শাসকও আছেন। তুমি-ই তো বোধ হয় আমাকে বলেছিলে, সালাহুদ্দীন সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হতে যাচ্ছে। আমি বার বার তাকে এখানে ডেকে আনতে চাই, তাকে আদেশ করতে চাই, যেন সে আমার অনুগত থাকে। ডেকে পাঠাতে হলে জরুরী কোন কাজ থাকতে হবে, এমন তো কথা নেই! বুকের উপর হাত রেখে হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন খলীফা।

উম্মে আরারাহ খলীফার ঠোঁটের সঙ্গে মদের পেয়ালা ধরে বললো–আপনাকে শতবার বলেছি, মাথায় রাগ তুলবেন না। কতবার বলেছি, গোৰা আপনার জন্য ক্ষতিকর!

মদের পেয়ালা শূন্য হয়ে গেলে মেয়েটি একটি সোনার কৌটা থেকে এক চিমটি তামাকচূর্ণ নিয়ে খলীফার মুখে দেয় এবং পানি পান করিয়ে দেয়। খলীফা মেয়েটির বিক্ষিপ্ত রেশমী চুলে আঙ্গুল বুলিয়ে বিলি কাটতে কাটতে বললেন–তুমি না হলে, আমার উপায় কি হতো, বলো তো? সকলের দৃষ্টি এখন আমার সম্পদ ও মর্যাদার প্রতি। আমার ব্যক্তিসত্ত্বার উপর কারো এক বিন্দু নজর নেই। আমার একজন স্ত্রীর পর্যন্ত আমার প্রতি এতটুকু আন্তরিকতা নেই। এ মুহূর্তে তুমি। আমার একমাত্র ভরসা। তুমি না হলে আমার উপায় ছিলো না। খলীফা উম্মে আরারাহকে টেনে কাছে এনে গা ঘেঁষে বসিয়ে তার সরু কটি বাহুবন্ধনে জড়িয়ে ধরেন।

খলীফাতুল মুসলিমীন! আপনি বড় কোমল-হৃদয় ও মহৎ মানুষ। সে কারণেই সালাহুদ্দীন আইউবী এমন গোস্তাখী করতে পারলো। আপনি ভুলে গেছেন, সালাহুদ্দীন আরব বংশোদ্ভুত লোক নয়, আপনার বংশের লোক নয়। সে কুর্দী। আমি ভেবে অবাক হই, এতো বড় স্পর্ধা তাকে কে দিলো! তার গুণ তো শুধু এটুকুই যে, লোকটা একজন দক্ষ সৈনিক; রণাঙ্গনের শাহ্সাওয়ার। লড়তেও জানে, লড়াতেও জানে। কিন্তু এই গুণ এতো গুরুত্বপূর্ণ নয় যে, মিসরের গভর্নরী। তার হাতে তুলে দিতে হবে! সুদানের এতো বিশাল, এতো সুদক্ষ বাহিনীটিকে এমনভাবে ধ্বংস করে দিলো, যেভাবে শিশুরা তাদের হাতের খেলনা ভেঙ্গে নষ্ট করে দেয়। মহামান্য খলীফা! আপনি একটু চিন্তা করুন, এখানে যখন সুদানী সেনারা ছিলো, নাজি এবং ঈদরৌসের ন্যায় সালারগণ ছিলো, তখন মানুষ আপনার কুকুরের সামনেও মাথা নত করতো। সুদানী বাহিনীর সালার আপনার নির্দেশের অপেক্ষায় আপনার দ্বারে সারাক্ষণ করজোড়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। আর এখন? এখন ডেকে পাঠালে একজন অধীন পর্যন্ত আপনার আহ্বান মুখের উপর প্রত্যাখ্যান করে। বললো রজব।

রজব! সব দোষ তোমার। হঠাৎ গর্জে উঠে বললেন খলীফা।

অকস্মাৎ পাংশু হয়ে যায় রজবের মুখ। ভয়ার্ত বিস্ফারিত নয়নে তাকিয়ে থাকে খলীফার প্রতি। খলীফার বন্ধন ছাড়িয়ে চকিতে সরে পড়ে উম্মে আরারাহ। খলীফা পুনরায় তাকে কাছে টেনে পূর্বাপেক্ষা অধিক শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চিবুক টিপে সস্নেহে বলেন–কী, ভয় পেয়েছো বুঝি? আমি রজবকে বলতে চাচ্ছি, আজ দু বছর পর সে আমার কানে দিচ্ছে, আমার পুরনো বাহিনী ও তার সালার ভালো ছিলো; সালাহুদ্দীনের তৈরি বাহিনী খেলাফতের পক্ষে কল্যাণকর নয়! কেন রজব! একথা কি তুমি আগেও জানতে? জানলে বললে না কেন? আজ যখন মিসরের গভর্নর তার খুঁটি শক্ত করে ফেলেছে, এখন কিনা তুমি আমাকে বলছো, সে খেলাফতের অবাধ্য!

বিষয়টা আমি পূর্ব থকে-ই জানতাম। কিন্তু হুজুরের তিরস্কারের ভয়ে কখনো বলিনি। সুলতান আইউবীকে নির্বাচন করেছে বাগদাদের খেলাফত। আমি ভেবেছিলাম, কাজটা আপনার পরামর্শেই হয়ে থাকবে। খেলাফতের মনোনয়নের বিরুদ্ধে মুখ খোলার দুঃসাহস আমি দেখাতে পারি না। আজ আমীরে মেসেরের গোস্তাখী আর আপনার মনোকষ্ট আমাকে মুখ খুলতে বাধ্য করেছে। এর আগেও একাধিকবার আমি সালাহুদ্দীন আইউবীকে হুজুরের সঙ্গে গোস্তাখী করতে দেখেছি। বিপদ সম্পর্কে আপনাকে অবহিত করা আমি আমার কর্তব্য মনে করি। বললো রজব।

খলীফার বাহুবন্ধনে আবদ্ধ উম্মে আরারাহ খলীফার হাতের আঙ্গুলে আঙ্গুল ঢুকিয়ে শিশুর ন্যায় খেলছে। এবার দু হাতে খলীফার চিবুক স্পর্শ করে জিজ্ঞেস করে মনটা এবার ঠিক হয়েছে?

খলীফা তার চিবুক টেনে দিয়ে পুলকভরা কণ্ঠে বললেন–ঔষধ-পথ্যে ততোটা কাজ হয় না, যতটুকু কাজ হয় তোমার ভালোবাসায়। আল্লাহ তোমাকে যে রূপ দিয়েছেন, তা-ই আমার সব রোগের মহৌষধ। খলীফা উম্মে আরারার মাথা নিজের বুকের উপর রেখে রজবকে বললেন–কিয়ামতের দিন যখন আমাকে জান্নাতে প্রেরণ করা হবে, তখন আমি আল্লাহকে বলবো, আমি হুর চাই না–আমার উম্মে আরারাকে এনে দাও।

উম্মে আরারাহ শুধু রূপসী-ই নয়–বড় বিচক্ষণও বটে। হুজুরের হেরেম ষড়যন্ত্রের আড্ডাখানায় পরিণত হয়েছিলো। উম্মে আরারাহ এসে সব কুচক্রীর মুখে ঠুলি পরিয়েছে। এখন আপনার কসরে খেলাফতে আপনার স্বার্থ বিরোধী কোন আচরণ করার সাধ্য কারও নেই। বললো রজব।

উম্মে আরারার প্রেম-পরশে নিজেকে হারিয়ে ফেলছেন খলীফা। নিশ্চল মূর্তির মতো উদাস বসে আছেন তিনি। রজবের এইসব কথার একটি শব্দও যেন কানে গেলো না তার। তাঁর চৈতন্য ফিরিয়ে আনবার চেষ্টা করে উম্মে আরারাহ। বলে–রজব সালাহুদ্দীন আইউবীর প্রসঙ্গে কথা বলছিলো। আপনি মনোযোগ সহকারে তার বক্তব্য শুনুন এবং আইউবীকে বাগে আনার চেষ্টা করুন।

সম্বিৎ ফিরে পান খলীফা। বলেন–এ্যা, কি যেন বলছিলে রজর।

বলছিলাম, আমি এ কারণে এতদিন মুখ বন্ধ রেখেছি যে, আমীরে মেসেরের বিরুদ্ধে কথা বললে আপনি তা মেনে নেবেন না। আর যা হোক, সালাহুদ্দীন আইউবী একজন দক্ষ সেনানায়ক তো বটে! বললো রজব।

সালাহুদ্দীন আইউবীর এই একটি গুণই আমার নিকট পছন্দনীয় যে, যুদ্ধের ময়দানে সে ইসলামের পতাকাকে পদানত হতে দেয় না। তার মত সেনানায়কদের-ই আমার বড় প্রয়োজন, যারা রণাঙ্গনে খেলাফতে ইসলামিয়ার মর্যাদাকে সমুন্নত রাখে। বললেন খলীফা।

গোস্তাখী মাফ করবেন খলীফাতুল মুসলিমীন! সালাহুদ্দীন আইউবী খেলাফতে ইসলামিয়ার মর্যাদার জন্য লড়াই করে না, লড়াই করে নিজের মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে। আপনি ফৌজের সালার থেকে নিয়ে একজন সাধারণ সিপাহীকে জিজ্ঞেস করে দেখুন; সালাহুদ্দীন আইউবী তাদের এই দীক্ষা প্রদান করেছে যে, লড়াই করে এমন একটি ইসলামী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত করবে, যার কোন সীমা-পরিসীমা থাকবে না। এতে পরিষ্কার বুঝা যায়, সে এমন একটি সাম্রাজ্যের স্বপ্ন দেখছে, যার সম্রাট হবে সে নিজে। তার পৃষ্ঠপোষকতা করছেন নুরুদ্দীন জুঙ্গী। আইউবীর হাতকে শক্তিশালী করার জন্য তিনি দু হাজার অশ্বারোহী এবং সমসংখ্যক পদাতিক বাহিনী প্রেরণ করেছেন। আপনি-ই বলুন, তিনি কি এ সৈন্য মিসরের খলীফার অনুমতি নিয়ে প্রেরণ করেছেন? খেলাফতের কোন দূত কি আপনার নিকট পরামর্শ নিতে এসেছিলো যে, মিসরে অতিরিক্ত সৈন্যের প্রয়োজন আছে কি-না? যা কিছু হয়েছে, খেলাফতকে উপেক্ষা করেই হয়েছে। বললো রজব।

তুমি ঠিকই বলছো রজব! এ ব্যাপারে আমাকে কিছু-ই জিজ্ঞাসা করা হয়নি। আর ওদিক থেকে আসা বাহিনীটিকে তত ফেরতও পাঠান হয়নি! বললেন খলীফা ।

ফেরত এ জন্যে দেয়া হয়নি যে, তাদের পাঠানোই হয়েছিলো মিসরে আইউবীর হাতকে শক্ত করার জন্য। মিসরের পুরাতন বাহিনীকে কিষাণ আর ভিখারীতে পরিণত করার জন্য নুরুদ্দীন জঙ্গী এ বাহিনী প্রেরণ করেছেন। নাজি, ঈদরৌস, ককেশ, আবদে ইয়াদান, আবু আজর এবং এদের ন্যায় আরো আটজন সালার এখন কোথায়? হুজুর হয়তো কখনো ভেবে দেখেননি, এদের প্রত্যেককে সালাহুদ্দীন আইউবী গুপ্তভাবে খুন করিয়েছে। তাদের একটি মাত্র অপরাধ ছিলো, তারা ছিলেন রণনায়ক হিসেবে আইউবী অপেক্ষা যোগ্য। আইউবী প্রচার করেছেন, গাদ্দারী ও বিদ্রোহের অপরাধে খলীফা তাদের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। বললো রজব।

মিথ্যে–নির্জলা মিথ্যে। সালাহুদ্দীন আমাকে বলেছিলো ঠিক যে, এরা বিশ্বাসঘাতক। আমি তাকে বলেছিলাম, সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করো, আদালতে মোকদ্দমা দায়ের করো। ঝাঝালো কণ্ঠে বললেন খলীফা।

আর মোকদ্দমা না চালিয়ে তিনি নিজেই সেই রায় প্রদান করেন, খেলাফতের মোহর ছাড়া যার কোন কার্যকারিতা নেই। ঐ হতভাগা সালারদের অপরাধ ছিলো, তারা খৃষ্টান সম্রাটদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিলো খৃষ্টানদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে দেশ ও দশের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করা। বললে হয়তো আপনি বিশ্বাস করবেন না; কিন্তু বাস্তব সত্য হলো, খৃষ্টানরা আমাদেরকে শত্রু মনে করে না। নুরুদ্দীন জঙ্গী আর শেরকোহর আক্রমণ-আশঙ্কায়-ই কেবল তারা আমাদের বিরুদ্ধে সামরিক প্রস্তুতি নিয়ে আছে। এখন শেরকোহ নেই ঠিক, কিন্তু তার স্থান দখল করেছে সালাহুদ্দীন আইউবী। এ লোকটি মূলত শেরকোহর-ই হাতে গড়া। শেরকোহ তার সারাটা জীবন খৃষ্টানদের সঙ্গে লড়াই করে, ইসলামের দুশমন সৃষ্টি এবং দুশমনের সংখ্যাই শুধু বৃদ্ধি করেছে। সালাহুদ্দীনের স্থলে অন্য কেউ যদি মিসরের গভর্নর হতো, তাহলে খৃষ্টান সম্রাটগণ আজ আপনার দরবারে বন্ধুরূপে আগমন করতেন। হত্যা-লুণ্ঠন হতো না, আমাদেরকে এতগুলো প্রবীণ ও সুদক্ষ সেনানায়ক হারাতে হতো না। বললো রজব।

কিন্তু রজব! খৃষ্টানরা যে রোম উপসাগর থেকে আক্রমণ করলো? বললেন খলীফা।

এর জন্যেও আইউবী-ই দায়ী। তিনি-ই এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিলেন, যা প্রতিহত করার জন্যে খৃষ্টানরা আক্রমণ করতে বাধ্য হয়েছিলো। সমস্যা যেহেতু তার-ই সৃষ্টি, তাই আক্রমণ যে হবে, তা পূর্ব থেকেই তার জানা ছিলো। সেজন্য তিনি আগাম প্রতিরোধ ব্যবস্থাও করে রেখেছিলেন। অন্যথায় তিনি কি করে জানলেন যে, রোম উপসাগর থেকে খৃষ্টানরা আক্রমণ করবে? তিনি তো অন্তর্যামী নন! এটি ছিলো তার সাজানো নাটক, যে খেলায় এতীম হলো হাজার হাজার শিশু, বিধবা হলো অসংখ্য নারী। আর তার এ কাজে আমার উপস্থিতিতে আপনি তাকে বাহবা দিয়েছিলেন। তারপর তিনি সুদানী ফৌজকে যারা ছিলো আপনার একান্ত অনুগত–সামরিক মহড়ার নাম করে রাতের বেলা বাইরে নিয়ে যান এবং অন্ধকারে তাদের উপর তার নতুন বাহিনীকে লেলিয়ে দেন। পরে প্রচার করেন যে, নাজির ফৌজ বিদ্রোহ করেছিলো; তাই তাদের এই পরিণতি বরণ করতে হয়। আপনি এতো সরল-সহজ মানুষ যে, আইউবীর এই চাল আর প্রতারণা বুঝে উঠতে পারলেন না! বললো রজব।

উম্মে আরারাহ খলীফার বুকে মাথা রেখে এমন কিছু অশ্লীল আচরণ করে যে, খলীফার তীব্র মদের নেশা জেগে ওঠে। খলীফা এখন মেয়েটির হাতের খেলনা। রজবের কোন কথা-ই যেন শুনতে পাচ্ছেন না তিনি। রূপসী কন্যা উম্মে আরারাকে নিয়েই ঘুরপাক খাচ্ছে খলীফার সব ভাবনা।

এই ফাঁকে সালাহুদ্দীন আইউবীর প্রতি নিতান্ত অমূলক আরেকটি আঘাত হানে রজব। বলে–আইউবী আরো একটি প্রতারণামূলক আচরণ শুরু করেছেন। সুন্দরী যুবতী মেয়েদের ধরে এনে তিনি তাদের উপভোগ করেন। কয়েকদিন আমোদ-ফুর্তি করে এই বলে তাদের খুন করান যে, এরা খৃষ্টানদের গুপ্তচর। দেশবাসীর মনে খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা সৃষ্টি করার জন্য তিনি সেনাবাহিনী ও জনগণের মধ্যে প্রোপাগাণ্ডা ছড়িয়ে রেখেছেন, খৃষ্টানরা গুপ্তচরবৃত্তির জন্য তাদের মেয়েদেরকে মিসর প্রেরণ করেছে। খৃষ্টানরা কুলটা নারীদের লেলিয়ে দিয়ে এই জাতির চরিত্র নষ্ট করছে। আমি তো এদেশের-ই নাগরিক। দেশে কী ঘটছে সবই আমার জানা। দেশের পতিতালয়গুলোতে যারা বেশ্যাবৃত্তি করছে, তারা মিসর ও সুদানী নারী। দু চারজন খৃষ্টান থাকলেও তারা, গুপ্তচর নয়, এটা তাদের পেশা।

হেরেমের তিন-চারটি মেয়েও আমাকে জানিয়েছে, সালাহুদ্দীন আইউবী ডেকে নিয়ে তাদের সম্ভ্রমহানি করেছে। বললো উম্মে আরারাহ।

শুনে তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠেন খলীফা। বললেন–আমার হেরেমের মেয়েঃ তুমি এতোদিন আমাকে বলেনি কেন?

বলিনি তার কারণ, এই অসুস্থ অবস্থায় আপনি সে দুঃসংবাদ সহ্য করতে পারতেন না। এখন আমার অলক্ষ্যে কথাটা মুখ থেকে ফসকে বেরিয়ে গেলো। হেরেমে আমি এমন ব্যবস্থা করে রেখেছি যে, এখন আর কোন মেয়ে কারো আহ্বানে মনে চাইলে-ই বাইরে যেতে পারবে না। জবাব দেয় উম্মে আরারাহ।

এক্ষুনি ডেকে এনে ওকে আমি বেত্রাঘাত করবো। আমি এর প্রতিশোধ নেবো! বললেন খলীফা।

প্রতিশোধ নিতে হবে অন্যভাবে। বর্তমানে দেশের জনসাধারণ আইউবীর পক্ষে। এভাবে সরাসরি প্রতিশোধ নিতে গেলে মানুষ আপনার বিরুদ্ধে ক্ষেপে ওঠবে। বললো রজব।

তবে কি আমাকে এই অপমান চোখ বুজে সহ্য করতে হবে? বললেন খলীফা।

না। আপনার অনুমতি ও সহযোগিতা পেলে আমি সালাহুদ্দীন আইউবীকে এমনভাবে গায়েব করে ফেলতে পারি, যেভাবে গুম করেছিলেন তিনি আমাদের প্রবীণ সালারদের। বললো রজব।

এ কাজ তুমি কীভাবে করবে? জিজ্ঞেস করেন খলীফা।

এ কাজ আমি হাশীশীদের দ্বারা করাবো। তবে তারা বিপুল অর্থ দাবি করছে। বললো রজব।

টাকা যতো প্রয়োজন আমি দেবো। তুমি আয়োজন সম্পন্ন করো। বললেন খলীফা।

***

দুদিন পর জুমার নামায। ঈসা এলাহকারী কায়রোর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের খতীবকে বলে দিয়েছেন, যেন তিনি জুমার খুতবায় খলীফার নাম উল্লেখ না করেন।

তুরস্কের অধিবাসী এ খতীবের নাম ইতিহাসে উল্লেখিত হয়নি। সাধারণ্যে তিনি আমীরুল ওলামা” উপাধীতে প্রসিদ্ধ ছিলেন। তিনি নিজেও বেশ কবার খুতবা থেকে এ বিদআত তুলে দেয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। এক বর্ণনায় এমনও পাওয়া যায় যে, সালাহুদ্দীন আইউবী এ খতীবের-ই। পরামর্শে খুতবা থেকে খলীফার নাম তুলে দেয়ার নির্দেশ জারি করেছিলেন। তবে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর কথোপকথনের যে সব দলীল-দস্তাবেজ পাওয়া যায়, তাতে প্রমাণিত হয়, এ সাহসী পদক্ষেপের কৃতিত্বের দাবিদার তিনি-ই।

শুক্রবার দিন। খতীব আমীরুল ওলামা খুতবা পাঠ করলেন; কিন্তু খলীফার নাম উল্লেখ করলেন না। মসজিদের মধ্যম সারিতে উপবিষ্ট সুলতান আইউবী। খানিক দূরে অপর এক সারিতে বসা আছেন আলী বিন সুফিয়ান। জনগণের প্রতিক্রিয়া আন্দাজ করার জন্য জনতার মাঝে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসেছেন সুলতান আইউবীর অপরাপর উপদেষ্টামণ্ডলী ও বিশ্বস্ত কর্মকর্তাবৃন্দ। আলী বিন সুফিয়ানের বিপুলসংখ্যক গোয়েন্দা সদস্যও মসজিদে উপস্থিত। খুতবা থেকে খলীফার নাম মুছে ফেলা একটি শক্ত পদক্ষেপ-ই নয়, খেলাফতের আইনে গুরুতর অপরাধও বটে। সুলতান আইউবীর নির্দেশে সে অপরাধ-ই সংঘটিত হলো আজ। খলীফা আল-আজেদ ব্যতীত খেলাফতের বহু কর্মকর্তা সরাসরি প্রত্যক্ষ করলেন সে অপরাধ কম।

নামায শেষ হলো। মুসল্লীরা যার যার মতো চলে গেলো। উঠে দাঁড়ালেন সুলতান আইউবী। ধীরপায়ে এগিয়ে গেলেন খতীবের কাছে। সালাম মোসাফাহার পর বললেন–আল্লাহ আপনার সহায় হোন মহামান্য ইমাম!

খতীব আমীরুল ওলামা বললেন–এ নির্দেশ জারি করে আপনি জান্নাতে নিজের ঠিকানা করে নিলেন।

মসজিদ থেকে বেরুতে উদ্যত হন আইউবী। কয়েক পা অগ্রসর হয়ে হঠাৎ দাঁড়িয়ে যান। আবার খতীবের নিকট গিয়ে বললেন–খলীফার পক্ষ থেকে যদি আপনার ডাক আসে, তাহলে সরাসরি তার কাছে না গিয়ে আপনি আমার কাছে চলে আসবেন। আমি আপনাকে খলীফার নিকট নিয়ে যাবো।

মোহতারাম আমীরে মেসের! যদি গোস্তাখী মনে না করেন, আমি বলবো মিথ্যা ও শেরেকের বিরুদ্ধে কাজ করা ও সত্য বলা যদি অপরাধ হয়ে থাকে, তাহলে সে অপরাধের শাস্তি আমি একাই ভোগ করবো। এর জন্য আমি আপনাকে কষ্ট দিতে যাবো না। খলীফা যদি আমাকে তলব করেন, আমি একাই গিয়ে তার কাঠগড়ায় হাজির হবো। মূলত আপনার নির্দেশে নয়–আল্লাহর হুকুমে আমি খুতবা থেকে খলীফার নাম বাদ দিয়েছি। আল্লাহ আমার সহায় হোন। বললেন খতীব।

***

সন্ধ্যার পর।

আলী বিন সুফিয়ান, বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ এবং উপদেষ্টামণ্ডলীর নিকট থেকে দিনের রিপোর্ট শুনছেন সালাহুদ্দীন আইউবী। আলী বিন সুফিয়ান ছদ্মবেশে শহরময় গুপ্তচর ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। নামাযের পর ঘুরে ঘুরে তারা সর্বসাধারণের প্রতিক্রিয়া সংগ্রহ করে। আলী বিন সুফিয়ান আইউবীকে জানান, এমন কোন সংবাদ পাওয়া যায়নি যে, কেউ স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে বলেছে, আজ খুতবায় খলীফার নাম নেয়া হয়নি। জনগণের মুখ থেকে কথা নেয়ার জন্য এক গোয়েন্দা কয়েক স্থানে এমনও বলেছে, জামে মসজিদের খতীব আজ জুমার খুতবায় খলীফার নাম উচ্চারণ করেননি; কাজটা বোধ হয় তিনি ভাল করলেন না। প্রত্যুত্তরে অনেকে এমন ভাব প্রকাশ করেছে, যেন খুতবায় আজ খলীফার নাম উচ্চারণ করা হলো কিনা, তা তারা বলতেই পারে না। যেন খলীফার নাম উল্লেখ করা না করা তাদের নিকট তেমন কোন ঘটনা-ই নয়। বেশ কজন মানুষ এমনও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে, এতে কি আর আসে যায়! খলীফা আল্লাহ-রাসূল তো আর নন! এসব রিপোর্টে সুলতান আইউবী আশ্বস্ত হন যে, তাকে জনগণের যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা দেখানো হয়েছিলো, বাস্তবে কোথাও তার প্রতিফলন ঘটেনি।

সে বৈঠকেই সুলতান আইউবী নুরুদ্দীন জঙ্গীর নামে পয়গাম লিখেন। তাতে তিনি লিখেন–জুমার খুতবা থেকে আমি খলীফার নাম তুলে দিয়েছি। জনসাধারণের পক্ষ থেকে অনুকূল প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। আপনিও. খুতবা থেকে কেন্দ্রীয় খেলাফতের আলোচনা তুলে দিন।

এ মর্মে দীর্ঘ এক পত্র লিখে সুলতান আইউবী নির্দেশ জারি করেন, আগামীকাল সকাল সকাল দূতকে রওনা করাও। তারপর আলী বিন সুফিয়ানকে বললেন, খলীফার মহলে গুপ্তচরদের আরো সতর্ক থাকতে বলুন। সেখানে সামান্যতম সন্দেহজনক আচরণ দেখা মাত্র যেন সঙ্গে সঙ্গে তারা আমাদেরকে অবহিত করে।

***

সুলতান আইউবী রজবকে ভাল করেই জানতেন। তিনি জানতেন, রজব খলীফার আজ্ঞাবহ নায়েব সালার । তাই তিনি আলী বিন সুফিয়ানকে বললেন, রজবের পিছনে একজন লোক সর্বক্ষণ ছায়ার মতো লাগিয়ে রাখুন।

রাতের বেলা। রজব মহলে নেই। সুলতান আইউবীকে হত্যা করার আয়োজন সম্পন্ন করতে বাইরে চলে গেছে সে। হাসান ইবনে সাব্বাহর হাশীশীদের সঙ্গে যোগসাজশ করে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে রজব।

আমোদে মেতে উঠেছেন খলীফা। প্রতিদিনকার ন্যায় আজও তিনি বহির্জগত সম্পর্কে উদাসীন। উম্মে আরারার যাদুময়ী রূপ-দেহে মাতোয়ারা তিনি। জুমার খুতবা থেকে নাম উঠে যাওয়ার সংবাদ এ যাবত কেউ তাকে দেয়নি। সালাহুদ্দীন আইউবীকে হত্যা করার প্রস্তুতি চলছে, সে আনন্দেই তিনি আত্মহারা।

তাড়াতাড়ি ঘুম পাড়ানোর জন্য উম্মে আরারাহ অতিরিক্ত মদ পান করায় তাকে। মদের সঙ্গে নিদ্রাজনক পাউডারও খাইয়ে দেয়। বৃদ্ধের জ্বালাতন থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য সব সময় এ প্রক্রিয়া অবলম্বন করে থাকে উম্মে আরারাহ। বৃদ্ধকে শুইয়ে দিয়ে, বাতি নিভিয়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায় মেয়েটি । হাঁটা দেয় নিজের কক্ষের প্রতি। রাতে চুপিসারে এ কক্ষে-ই তার কাছে আসা-যাওয়া করে।–রজব।

উম্মে আরারাহ কক্ষে প্রবেশ করছে। তার এক পা কক্ষের ভিতরে, এক পা বাইরে। এমন সময় পিছন থেকে কে একজন একটি কম্বল ছুঁড়ে মারে তার গায়ে। মুখ থেকে তার একটি শব্দ বের হতে না হতেই দৌড়ে এসে লোকটি আরেকখণ্ড কাপড় দ্বারা বেঁধে ফেলে তার মুখ। মেয়েটিকে কাঁধে তুলে নিয়ে হাঁটা দেয় লোকটি।

তারা ছিলো দুজন। মহলের আঁকা-বাঁকা গোপন পথ সবই যেন তাদের চেনা। অন্ধকার সিঁড়িতে নেমে পড়ে তারা। উপরে লম্বা রশি বেঁধে রেখেছিলো আগেই। সেই রশি ধরে ধরে ঘোর অন্ধকারে চোরা পথ বেয়ে মেয়েটিকে কাঁধে করে নেমে পড়ে একজন। অপরজন হাঁটছে তার পিছনে। মহল থেকে নেমে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে যায় দুটি লোক।

দূরে দাঁড়িয়ে আছে চারটি ঘোড়া। ঘোড়াগুলোর নিকটে সতর্ক বসে আছে আরো দুজন লোক। আঁধার চিরে সঙ্গীদের আসতে দেখে তারা। আরো দেখে, কাঁধে করে কম্বল পেঁচানো কি যেন নিয়ে আসছে একজন।

চারটি ঘোড়ায় চড়ে বসে চার সঙ্গী। একজন মেয়েটিকে কম্বল মোড়ানো অবস্থায়-ই নিজের সামনে বসিয়ে দেয়। একজন বলে ঘোড়াগুলোকে এখনই দ্রুত ছুটানো যাবে না। ঘোড়র পায়ের আওয়াজে প্রহরীরা সতর্ক হয়ে যাবে। ধীরে ধীরে এগুতে শুরু করে চারটি ঘোড়া। বেরিয়ে যায় শহর থেকে।

***

এটি সালাহুদ্দীন আইউবীর-ই কাজ।

মিসরের গভর্নর ছাড়া এ দুঃসাহস আর কেউ দেখাতে পারে না।

তিনি ছাড়া এ-কাজ আর করতে-ই বা পারে কে?

উম্মে আরারাহ অপহরণের খবর ছড়িয়ে পড়ে রাজমহলে। সকলের মুখে এক-ই কথা, সালাহুদ্দীন আইউবী ছাড়া আর কেউ এ-কাজ করাতে পারে না।

ফিরে এসেছে রজব। মহলের সর্বত্র তন্ন তন্ন করে খোঁজ নেয় সে। রক্ষী বাহিনীর সদস্যদের গালাগাল করছে কমাণ্ডারগণ। স্বয়ং কমাণ্ডারগণ সিপাহীদের ন্যায় থর থর করে কাঁপছে।

মহলের একটি মেয়ে অপহরণ মামুলী ঘটনা নয়। তা-ও আবার সেই মেয়ে, খলীফা যাকে মহলের হীরক মনে করেন।

মহলের পিছনের গোপন পথে একটি রশি ঝুলছে দেখা গেলো। মাটিতে পায়ের ছাপ, যা একটু দূরে গিয়ে ঘোড়ার খুরের চিহ্নে মিলিয়ে গেছে। এতে প্রমাণ পাওয়া গেলো, মেয়েটিকে রশি বেয়ে নীচে নামানো হয়েছে। কেউ কেউ এমন সন্দেহও ব্যক্ত করেছে যে, মেয়েটি হয়তো স্বেচ্ছায় কারো সঙ্গে বেরিয়ে গেছে। খলীফা উড়িয়ে দেন এ সংশয়। বলেন, অসম্ভব, উম্মে আরারাহ স্বেচ্ছায় কারো হাত ধরে উধাও হতে পারে না। সে আমাকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসতো।

এ সালাহুদ্দীন আইউবীর কাজ। কসরে খেলাফতের সকলের মুখে এই একই কথা, আইউবী ছাড়া এ কাজ করার সাহস আর কেউ করতে পারে না। খলীফার উদ্দেশে বললো রজব।

কথাটা রজব-ই সকলের কানে দিয়েছিলো। উম্মে আরারার নিখোঁজ হওয়ার সংবাদ শোনামাত্র সে মহলময় ঘুরে ঘুরে প্রত্যেকের নিকট মেয়েটির ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করেছিলো আর বলেছিলো, সুলতান আইউবী-ই এ-কাজ করেছে। রজবের উস্কানিতে মহলের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়ে সাধারণ কর্মচারীদের পর্যন্ত সকলে এই একই কথা আওড়াতে শুরু করে। আর যখন কথাটা খলীফার কানে দেয়া হলো, তখন তিনি একটুও ভাববার প্রয়োজনবোধ করলেন না, এ অভিযোগ ভিত্তিহীন হতে পারে। তাকে আগেই জানানো হয়েছিলো, সুলতান আইউবী নারী-লোলুপ পুরুষ। তিনি মহলের মেয়েদের নিয়ে নিয়ে নষ্ট করছেন। তাই সঙ্গে সঙ্গে খলীফা দূতকে ডেকে পাঠান। দূত আসলে তাকে তিনি বললেন, মিসরের গভর্নরের নিকট যাও। গিয়ে বলো, যেনো গোপনে তিনি মেয়েটিকে ফিরিয়ে দিয়ে যান। তাহলে আমি এর প্রতিশোধ নেবো না।

***

খলীফা আল-আজেদ যখন দূতকে এ পয়গাম প্রদান করছিলেন, ঠিক তখন কায়রো থেকে দশ মাইল দূরে তিনজন উষ্ট্রারোহী ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছিলো শহর অভিমুখে। এরা মিসরী ফৌজের টহলসেন। তারা ডিউটি শেষ করে শহরে ফিরছিলো। তাদের সম্মুখে মাটি ও পাথরের বিস্তীর্ণ পাহাড়ী অঞ্চল। তারা একটি উপত্যকা দিয়ে অতিক্রম করছিলো।

হঠাৎ নারীকণ্ঠের এক আর্ত-চীৎকার ভেসে আসে তাদের কানে। সাথে পুরুষালী কণ্ঠও শুনতে পায়। তারা পরিষ্কার বুঝতে পারে, কোন এক হতভাগী নারীর উপর নির্যাতন চলছে। দাঁড়িয়ে যায় তারা। উটের পিঠ থেকে নীচে নামে একজন। একজন টিলার উপরে উঠে চীৎকার-ধ্বনির দিক অনুসরণ করে উত্তীর্ণ হয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে যায়। দেখে, টিলার অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে চারটি ঘোড়া। চারজন মানুষও আছে সেখানে। সকলে সুদানী হাবশী। দৌড়ে পালাবার চেষ্টা করছে অপরূপ এক যুবতী। এক হাবশী ধরে ফেলে তাকে। দু বাহু দিয়ে জড়িয়ে ধরে তুলে আনে মেয়েটিকে। সঙ্গীদের মধ্যখানে দাঁড় করিয়ে তার সামনে হাটু গেড়ে বসে পড়ে লোকটি। দু হাত নিজের বুকে চেপে ধরে বলে তুমি পবিত্র মেয়ে। অযথা নিজেকে কষ্টে ফেলে আমাদের গোনাহগার করো না। অন্যথায় দেবতাদের রোষানল আমাদের পুড়ে ছারখার করে দেবে কিংবা পাথরে পরিণত করবে।

আমি মুসলিম! আমি তোমাদের দেবতাদের অভিসম্পাত করি। আমাকে ছেড়ে দাও। অন্যথায় আমি খলীফার কুকুর দিয়ে তোমাদের টুকরো টুকরো করাবো। চীৎকার করে বললো মেয়েটি।

তোমার মালিকানা এখন খলীফার হাতে নয়। আকাশের বিজলী, সাপের বিষ আর সিংহের শক্তি যে দেবতার হাতে, তোমার মালিক এখন তিনি। তিনি তোমাকে পছন্দ করে ফেলেছেন। এখন যে-ই তোমাকে রক্ষা করার চেষ্টা করবে, মরুভূমির তপ্ত বালুকারাশি তাকে-ই ভস্ম করে ফেলবে। বললো একজন।

হাবশীদের একজন আরেকজনকে বললো–আমি তোমাকে বলেছিলাম, এখানে থেমো না। কিন্তু তোমার কিনা বিশ্রাম নেয়ার প্রয়োজন। ওকে বাঁধা অবস্থায় লাগাতার এগিয়ে চললে সন্ধ্যার আগে আগেই আমরা গন্তব্যে পৌঁছে যেতে পারতাম।

কেন, ঘোড়াগুলো পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছে দেখতে পাচ্ছো না? তাছাড়া সারাটা রাত গেলো আমরা এক তিল ঘুমুতে পারিনি। আমাদেরও তো একটু। বিশ্রামের প্রয়োজন আছে। যাক, চলো, একে আবার বেঁধে রওনা হই। বললো। দ্বিতীয়জন।

উম্মে আরারাকে ঝাঁপটে ধরে রাখে একজন। হঠাৎ পিছন দিক থেকে একটি তীর এসে বিদ্ধ হয় তার পিঠে। উম্মে আরারাকে জড়িয়ে ধরা হাত শিথিল হয়ে আসে তার। ঝাঁপটা দিয়ে বন্ধন-মুক্ত হয়ে পালাতে উদ্ধত হয় মেয়েটি। সঙ্গে সঙ্গে আরেকজন ঝাঁপটে ধরে টেনে ঘোড়ার আড়ালে নিয়ে যায় তাকে। শা করে ছুটে আসে আরেকটি তীর। বিদ্ধ হয় অপর একজনের ঘাড়ে ছটফট করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সে-ও। উম্মে আরারাকে ঝাঁপটে ধরে রাখা লোকটি ঘোড়ার বাগ ধরে উম্মে আরারাহ এবং ঘোড়াটিকে নিয়ে নেমে পড়ে নিম্নভূমিতে। চার হাবশীর অপরজনও দৌড়ে নেমে পড়ে নীচে।

উষ্ট্রারোহী সাথীদের যে লোকটি টিলার উপরে উঠে দাঁড়িয়েছিলো, সে-ই নিক্ষেপ করে তীর দুটি। সে জানায়, দেবতার কথা শুনে প্রথমে আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু পরে যখন শুনলাম, মেয়েটি বলছে, আমি মুসলমান; তোমাদের দেবতাকে আমি অভিসম্পাত করি; তখন আমার ঈমান জেগে উঠে। মেয়েটি যখন খলীফার নাম উল্লেখ করে, তখন আমি বুঝলাম, এ তো হেরেমের মেয়ে। তা ছাড়া মেয়েটির পোশাক-পরিচ্ছদ ও গঠন-আকৃতিতে পরিষ্কার বুঝা গেলো, এ কোন সাধারণ মেয়ে নয়। নিশ্চয় মেয়েটিকে অপহরণ করা হয়েছে এবং সুদান নিয়ে গিয়ে তাকে বিক্রি করে ফেলা হবে। সান্ত্রীর জানা ছিলো, অল্প কদিন পর সুদানী হাবশীদের মেলা বসছে। সুন্দরী মেয়েদের বেচা-কেনা হয় সে মেলায়।

সুলতান আইউবী সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন, যেন তারা নারীর ইজ্জতের হেফাজত করে। একজন নারীর সম্ভ্রম রক্ষা করতে প্রয়োজনে এক ডজন মানুষ হত্যা করার অনুমতিও দেয়া ছিলো তাদের। এ বিষয়গুলোকে সামনে রেখে সান্ত্রী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো, যে করে থোক মেয়েটিকে উদ্ধার করতেই হবে। দুটি তীর নিক্ষেপ করে দু হাবশীকে খুন করে ফেলে সে।

মেয়েটিকে নিয়ে পালিয়ে যায় দুই হাবশী। সান্ত্রীর তীরের আঘাতে নিহত দুজনের ঘোড়া দুটোও নিয়ে যায় তারা। ফেলে যায় শুধু দুটি লাশ।

সান্ত্রীদের সকলেই উষ্ট্রারোহী। একটি ঘোড়াও নেই তাদের কাছে। উটে চড়ে অশ্বারোহীদের ধাওয়া করা বৃথা। অগত্যা লাশ দুটো উটের পিঠে তুলে নিয়ে কায়রো অভিমুখে রওনা হয় তারা।

অপহৃতা মেয়েটি কে এবং লাশ দুটো কাদের, তা অনুমান করতে সক্ষম হয়েছিলো সান্ত্রীরা। তাই হেরেমের একটি মেয়েকে কারা অপহরণ করলো, তার প্রমাণের জন্য লাশ দুটো নিয়ে যাওয়া আবশ্যক মনে করে তারা।

***

কক্ষে অস্থিরচিত্তে পায়চারী করছেন সুলতান আইউবী। রাগে-ক্ষোভে আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছেন যেন তিনি। তার নায়েব-উপদেষ্টাবৃন্দও কক্ষে উপস্থিত। নতমুখে বসে আছেন সবাই।

সুলতান আইউবী বরাবর-ই সহনশীল মানুষ। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখেই কাজ করেন তিনি। তিনি কখনো আবেগপ্রবণ হন না। রাগের মাথায় কিছু বলেনও না, করেনও না। যত প্রতিকূল পরিস্থিতির-ই শিকার হন না কেন, সর্বাবস্থায় ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করা-ই তার অভ্যাস। প্রবল থেকে প্রবলতর রাগ-ও তিনি হজম করে ফেলেন। এমন কঠিন পরিস্থিতিতেও ধৈর্যের পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হয়েছেন, যে পরিস্থিতিতে প্রবল প্রতাপশালী যোদ্ধাও অস্ত্র সমর্পণ করতে বাধ্য হয়। শত্রুর বেষ্টনীতে অবরুদ্ধ হয়েও ঠাণ্ডা মাথায় তিনি লড়াই করেছেন। এমন কঠিন পরিস্থিতিতেও যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন, যখন বাহিনীসহ তিনি শত্রুর হাতে অবরুদ্ধ, সাহস হারিয়ে ফেলেছে তার সৈন্যরা, খাবার নেই, পানি নেই। সৈন্যদের তুনীরে একটি তীরও নেই। তার বাহিনী অপেক্ষা করছে, কখন তিনি আত্মসমর্পণ করে তাদের এ কষ্ট থেকে মুক্তি দেবেন, তাদের জীবন রক্ষা করবেন। কিন্তু সুলতান আইউবী নিজের সাহস অটুট রেখে শুধু লড়াই-ই অব্যাহত রাখেননি, তার সৈন্যদের মধ্যেও নবজীবন সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছিলেন।

কিন্তু আজ আজ তিনি আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছেন। রাগে-ক্ষোভে দু চোখ থেকে আগুন ঠিকরে পড়ছে যেনো তার। চেহারায় ক্ষোভ ও যন্ত্রণার ছাপ। ফলে কথা বলার সাহস পাচ্ছে না কেউ। মাথা নুইয়ে কপালে হাত ঠেকিয়ে নীরবে বসে আছে সকলে।

এই আজ-ই আমি প্রথমবার আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললাম। পায়চারী করতে করতে বললেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী।

খলীফার এ পয়গামকে মস্তিষ্ক থেকে ঝেড়ে ফেলা কি সম্ভব নয়? সাহস সঞ্চয় করে জিজ্ঞেস করলেন নায়েব সালার আন-নাসের।

আমি সে চেষ্টাই করছি। কিন্তু অভিযোগের ধরণটা দেখো । আমি কিনা খলীফার হেরেমের একটি মেয়েকে অপহরণ করিয়েছি। আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করুন। আমাকে অপমান করতে লোকটা কোন পন্থা-ই বাদ রাখলো না। সবশেষে কিনা আমার নামে হেরেমের মেয়ে অপহরণ করানোর অবপদ! পয়গাম–বরং হুশিয়ারী পাঠালেন দূতের মুখে। তা না করে তিনি আমাকে ডেকে নিয়ে সরাসরি কথা বলতেন। বললেন সুলতান আইউবী।

তারপরও আপনাকে আমি পরামর্শ দেবো, আপনি মাথা ঠাণ্ডা করুন, মনের উত্তেজনা দূর করুন। বললেন বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ।

সুলতান আইউবী বললেন–আচ্ছা, সত্যিই কি হেরেমের কোন মেয়ে অপহৃতা হয়েছে? আমার তো মনে হচ্ছে, সংবাদটা মিথ্যে। এতক্ষণে হয়তো খলীফা জেনে ফেলেছেন, আমি জুমার খোতবা থেকে তার নাম তুলে দিয়েছি। তার-ই প্রতিশোধ স্বরূপ বোধ হয় তিনি আমার উপর অপবাদ আরোপ করেছেন যে, আমি তার হেরেমের একটি মেয়েকে অপহরণ করিয়েছি। ঈসা এলাহকারীকে উদ্দেশ করে সুলতান বললেন–আজই আপনি মিসরের সব মসজিদে এই নির্দেশনামা জারি করে দিন, আগামীতে যেন কোন ইমাম জুমার খুতবায় খলীফার নাম উল্লেখ না করেন।

আপনি খলীফার নিকট চলে যান; তার সঙ্গে কথা বলুন। তাকে বলুন, খলীফা জাতির মর্যাদার প্রতীক বটে, কিন্তু আঁর আদেশ-নিষেধ এখন অচল। বিশেষত যখন সারাদেশে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে, তখন তো খলীফার আইন মান্য করার জন্য কেউ-ই প্রস্তুত নয়। শক্রর আশঙ্কা বাইরে থেকে যেমন, ভিতর থেকেও তেমনি। আমি তো আপনাকে এন্দুর পরামর্শও দেবো যে, আপনি খলীফার রক্ষী বাহিনীর সংখ্যা কমিয়ে দিন। সুদানী হাবশীদের বাদ দিয়ে মিসরী সৈন্য নিয়োগ করুন এবং খলীফার মহলের বরাদ্দ হ্রাস করুন। এসব পদক্ষেপের পরিণাম আমার জানা আছে। পরিস্থিতির মোকাবেলা আমাদের করতেই হবে। তবু আল্লাহর উপর ভরসা রেখে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আন-নাসের বললেন।

আল্লাহ এ অপমান থেকেও আমাকে রক্ষা করবেন। বললেন সুলতান।

এমন সময় কক্ষে প্রবেশ করে দারোয়ান। আলোচনা বন্ধ করে সকলে তাকায় তার প্রতি। সালাম দিয়ে বলে–মরুভূমির টহল বাহিনীর কমান্ডার এসেছেন। সঙ্গে তার তিনজন সিপাহী। তিনি দু জন সুদানীর লাশ নিয়ে এসেছেন।

দারোয়ানের এই আকস্মিক প্রবেশে বিরক্তি বোধ করে সকলে। কারণ, সুলতান আইউবী তখন অতীব গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছিলেন। দারোয়ানের অনুপ্রবেশে ছেদ পড়ে সেই আলোচনায়। কিন্তু সুলতান আইউবী দারোয়ানকে বললেন–তাকে ভেতরে পাঠিয়ে দাও। সুলতান আইউবী আগেই দারোয়ানকে বলে রেখেছিলেন, কেউ তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসলে যেন সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে অবহিত করা হয়। রাতে ঘুম থেকে জাগানোর প্রয়োজন হলেও অশংকোচে যেন তাকে জাগিয়ে তোলে।

ভেতরে প্রবেশ করে কমাণ্ডার। ধুলো-মলিন তার চেহারা। দেখে পরিশ্রান্ত মনে হলো তাকে। সুলতান আইউবী তাকে বসতে বলে দাওরায়ানকে বললেন, এর আহারের ব্যবস্থা করো । কমাণ্ডার জানালেন, একটি অপহৃতা মেয়েকে উদ্ধার করার জন্য আমরা চারজন সুদানী হাবশীর দুজনকে তীরের আঘাতে হত্যা করেছি। অপর দুজন মেয়েটিকে নিয়ে পালিয়ে গেছে। নিহত দুজনের লাশ আমরা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। কমাণ্ডার আরো জানায়, মেয়েটি যাযাবর কিংবা সাধারণ ঘরানার কন্যা নয়। দেখে তাকে রাজকন্যা বলে মনে হলো। কথা প্রসঙ্গে নিজেকে খলীফার মালিকানাধীন বলে দাবি করতেও শুনেছি।

মনে হয় আল্লাহ আমার সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন। বলেই বসা থেকে উঠে সুলতান কক্ষ থেকে বের হয়ে যান। কক্ষে উপবিষ্ট সকলে তার পিছনে পিছনে বেরিয়ে আসেন।

কক্ষের বাইরে মাটিতে পড়ে আছে দুটি লাশ। একটি উপুড় হয়ে। পিঠে বিদ্ধ একটি তীর। অপর লাশের ঘাড়ে একটি তীর গাঁথা। পার্শ্বে দাঁড়িয়ে আছে তিনজন সিপাহী। মিসরের গভর্নর সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীকে এই প্রথমবার দেখলো তারা। পরিচয় পেয়ে সালাম করে পিছনে সরে যায়। সুলতান আইউবী তাদের সালামের জবাব দেন এবং হাত মিলিয়ে বলেন, এ শিকার তোমরা কোথা থেকে মেরে আনলে? যে সান্ত্রী টিলায় দাঁড়িয়ে তীর ছুঁড়ে এদেরকে হত্যা করেছিলো, সে সুলতান আইউবীকে পুরো ঘটনার বিবরণ দেয়।

উপদেষ্টাদের প্রতি তাকিয়ে সুলতান আইউবী বললেন–আমার মনে হয়, মেয়েটি খলীফার সেই রক্ষিতা-ই হবে। আপনারা কী বলেন?

আমারও তা-ই মনে হয়। এদের খঞ্জরগুলো দেখুন– বলেই আলী বিন সুফিয়ান নিহতদের খঞ্জর দুটো আইউবীকে দেখান। সান্ত্রী যখন সুলতানকে ঘটনার বিবরণ দিচ্ছিলো, তখন আলী বিন সুফিয়ান লাশ দুটোর সুরতহাল পর্যবেক্ষণ করছিলেন। পরনে সুদানের কাবায়েলী পোশাক। পোশাকের ভেতরে কটিবন্ধ, যাতে বাঁধা আছে একটি করে খঞ্জর । এগুলো খলীফার নিরাপত্তা বাহিনীর বিশেষ ধরনের খঞ্জর। খঞ্জরের হাতলে কসরে খেলাফতের মোহর, অঙ্কিত।

আলী বিন সুফিয়ান বললেন–এরা যদি খঞ্জরগুলো চুরি করে না থাকে, তাহলে এরা কসরে খেলাফতের নিরাপত্তা বাহিনীর সিপাহী। আপাতত আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, আমাদের সান্ত্রীরা যে মেয়ের ঘটনা জানালো, সে হেরেমের-ই অপহৃতা মেয়ে, যার অপহরণকারীরা খলীফার নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য।

লাশগুলো তুলে খলীফার কাছে নিয়ে চলো। বললেন সুলতান আইউবী।

আগে নিশ্চিত হওয়া দরকার, এরা প্রকৃত-ই খলীফার নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য কিনা। বলেই আলী বিন সুফিয়ান সেখান থেকে চলে যান।

বেশীক্ষণ অতিবাহিত হয়নি। কসরে খেলাফতের এক কমাণ্ডার এসে পড়ে আলী বিন সুফিয়ানের সঙ্গে। লাশ দুটো দেখান হলো তাকে। দেখেই সে লাশ দুটো চিনে ফেলে এবং বলে–এরা তো খলীফার নিরাপত্তা বাহিনীর সিপাহী। গত তিনদিন ধরে এরা ছুটিতে ছিলো। সাত দিনের ছুটি নিয়েছিলো।

আরো কোন সিপাহী ছুটিতে আছে কি? জিজ্ঞেস করেন আইউবী।

আছে আরো দুজন। 

তারা কি এদের সাথে এক সঙ্গে ছুটি নিয়েছিলো?

হ্যাঁ, চারজন একত্রে-ই ছুটি নিয়েছিলো।

জবাব দিয়ে কমাণ্ডার আরো এমনি এক তথ্য প্রকাশ করে, যা চমকিত করে তোলে সকলকে। কমাণ্ডার বলে–এরা সুদানের এমন একটি গোত্রের লোক, যারা রক্তপায়ী বলে খ্যাত। ফেরআউনী আমলের কিছু জঘন্য প্রথা এখনো তাদের সমাজে প্রচলিত। প্রতি তিন বছর অন্তর তারা একটি উৎসব পালন করে। উৎসব হয় মেলার মতো। তিন দিন তিন রাত চলে এই মেলা। দিনগুলো তারা এমনভাবে ঠিক করে, যাতে চতুর্থ রাতে পূর্ণিমা থাকে। এ গোত্রের বাইরের অনেক লোকও মেলায় অংশ নেয়। তারা আসে শুধু আমোদ করার জন্য। সুন্দরী যুবতী মেয়েদের বেচা-কেনার জন্য রীতিমত হাট বসে মেলায়। এই মেলা বসার অন্তত একমাস পূর্ব থেকে পার্শ্ববর্তী এলাকা, বরং কায়রোতে পর্যন্ত যাদের ঘরে ঘুরতী মেয়ে আছে, তারা সতর্ক হয়ে যায়। কেউ মেয়েদেরকে ঘর থেকে বের হতে দেয় না। যাযাবর পরিবারগুলো পর্যন্ত এ সময়ে এ এলাকা থেকে অনেক দূরে চলে যায়। এই একমাস চতুর্দিকে মেয়ে অপহরণ হয় আর এ মেলায় বিক্রি হয়। চার সুদানী ফৌজ-ও এ মেলা উপলক্ষ্যে ছুটিতে গিয়েছিলো। আর মাত্র তিনদিন পর মেলা শুরু হচ্ছে।

আচ্ছা, তাদের ব্যাপারে কি একথা বলা যায় যে, তারাই খলীফার হেরেমের মেয়েটিকে অহপরণ করেছে? জিজ্ঞেস করলেন আলী বিন সুফিয়ান।

একথা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি না। আমি শুধু এতটুকু বলতে পারি, এ দিনগুলোতে উক্ত গোত্রের লোকেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়েও মেয়ে অপহরণ করার চেষ্টা করে। তারা এতো-ই রক্তপায়ী যে, যদি কোন মেয়ের অভিভাবক মেলায় গিয়ে নিজ কন্যার সন্ধান পায় এবং তাকে ফিরিয়ে আনতে চায়, তবে নির্ঘাত তাকে জীবন হারাতে হয়। মেয়েদের খদ্দেরদের মধ্যে মিসরের আমীর-উজীর-হাকীমও থাকেন। মেলায় এমন একটি অস্থায়ী পতিতালয় স্থাপন করা হয়, যেখানে সর্বক্ষণ মদ-জুয়া আর নারী নিয়ে আমোদ চলে। এ উৎসব-অনুষ্ঠানের শেষ রাতটি হয় অত্যন্ত রহস্যময়। কোন একটি গোপন স্থানে একটি অস্বাভাবিক সুন্দরী যুবতী মেয়েকে বলী দেয়া হয়। কোন্ স্থানে কিভাবে এই নারী-বলী হয়, তা নির্দিষ্ট কজন ছাড়া আর কেউ বলতে পারে না। হাবশীদের এক ধর্মগুরু–যাকে তারা খোদা বলেও বিশ্বাস করে–এ কাজ সম্পাদন করে। তার সঙ্গে থাকে স্বল্পসংখ্যক পুরুষ আর চার-পাঁচটি মেয়ে। বলী দেয়া মেয়ের কর্তিত মাথা ও রক্ত প্রদর্শন করা হয় সর্বসাধারণকে। কর্তিত মস্তক দেখে গোত্রের মানুষ মাতালের ন্যায় নাচতে-গাইতে ও মদপান করতে শুরু করে।

***

অপহরণ ঘটনার তথ্য উদ্ধার করার জন্য খলীফা নিরাপত্তা বাহিনীর উপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করেন। তথ্য বের করার জন্য সেই ভোর থেকে সমগ্র বাহিনীকে প্রখর রোদে দাঁড় করিয়ে রাখেন তিনি। কমাণ্ডারদের পর্যন্ত এক তিল দানা-পানি মুখে দিতে দেননি সারা দিন। রজব বার বার আসছে আর ঘোষণা করছে–মহলের নিরাপত্তা বাহিনীর সহযোগিতা ছাড়া মেয়ে অপহরণ করা যেতে পারে না। যে-ই এ অপহরণে সাহায্য করেছে, সামনে এসে হাজির হও। অন্যথায় সকলকে এভাবে ক্ষুৎপিপাসায় মেরে ফেলা হবে। যদি মেয়েটি স্বেচ্ছায়ও পালিয়ে গিয়ে থাকে, তাহলেও তো কেউ না কেউ দেখে থাকবে নিশ্চয়। বলো, কে তার অপহরণে সাহায্য করেছ! কিন্তু না, এতোসব হুমকি-ধমকিতে কোন-ই ক্রিয়া হচ্ছে না। সকলের মুখে একই কথা, এ ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না, আমি নির্দোষ।

খলীফা রজবকে এক পা দাঁড়াতে দিচ্ছেন না। তাকে তিনি বলেছিলেন–উম্মে আরারার জন্য আমার আফসোস নেই। আমার পেরেশানীর কারণ হলো, যে বা যারা এত কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে মহলের একটি মেয়েকে অপহরণ করে নিয়ে যেতে পারে, তারা আমাকে অনায়াসে হত্যাও তো করতে পারে! তুমি বলেছিলে, এ ঘটনা সালাহুদ্দীন ঘটিয়েছে; আমি তার প্রমাণ চাই।

কিন্তু রজব প্রমাণ দেবে কোত্থেকে? প্রখর রৌদ্রে দাঁড়িয়ে থাকা নিরাপত্তা বাহিনীর নিকট আবার ছুটে যায় সে। রাগে পাগলের মতো হয়ে গেছে লোকটি। সৈন্যদের উদ্দেশে পূর্বের বলা কথাগুলোর পুনরাবৃত্তি করতে শুরু করে। ঠিক এ সময়ে মহলের দরজায় দণ্ডায়মান সান্ত্রীরা দরজা খুলে দেয় এবং চেঁচিয়ে উঠে বলে–ঐ তো আমীরে মেসের আসছেন।

প্রধান ফটকে প্রবেশ করে সুলতান আইউবীর অশ্ব। সামনে তার দুজন । রক্ষীর ঘোড়া। আটজন আরোহী পিছনে। একজন ডানে আর একজন বয়ে। সকলের পিছনে সুলতান আইউবীর একজন উপদেষ্টা আর গোয়েন্দা প্রধান আলী বিন সুফিয়ান।

সুলতান আইউবীর এই বহরের পেছনে চার চাকাবিশিষ্ট একটি গাড়ী। দুটি ঘোড়া টেনে এনেছে গাড়ীটি। গাড়ীতে পড়ে আছে দুটি লাশ। একটি চীৎ হয়ে আর অপরটি উপুড় হয়ে। লাশ দুটির গায়ে বিদ্ধ দুটি তীর। লাশের সঙ্গে আছে তিনজন সিপাহী।

সংবাদ পেয়ে বাইরে বেরিয়ে আসেন খলীফা। সুলতান আইউবী ও তাঁর সঙ্গীগণ নেমে পড়েন ঘোড়া থেকে। সুলতান খলীফাকে যথাযযাগ্য মর্যাদার সাথে সালাম করেন, মোসাফাহা করেন ও হাতে চুমো খান। তারপর কোন ভূমিকা ছাড়া-ই বলে ওঠেন–

আপনার হেরেমের মেয়েকে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য আপনি পয়গাম পাঠিয়েছেন। সে পয়গাম আমি পেয়েছি। আমি আপনার দুই নিরাপত্তা কর্মীর লাশ নিয়ে এসেছি। এই লাশ দুটো-ই আমাকে নির্দোষ প্রমাণিত করবে। আর হুজুরের খেদমতে আমি এই আরজি পেশ করার আবশ্যক মনে করছি যে, সালাহুদ্দীন আইউবী আপনার ফৌজের সিপাহী নয়। আপনি যে খেলাফতের প্রতিনিধিত্ব করছেন, সালাহুদ্দীন সে খেলাফতের-ই প্রেরিত গভর্নর।

সালাহুদ্দীন আইউবীর ভাব-গতিক বুঝে ফেলেন খলীফা। পাপের ভারে কুঁকিয়ে ওঠে এই ফাতেমী খলীফার হৃদয়। সুলতান আইউবীর প্রভাব আর মহান ব্যক্তিত্বের সামনে দাঁড়িয়ে প্রত্যুত্তর করার সৎ সাহস নেই তার। সুলতানের কাঁধে হাত রেখে বললেন–আমি তোমাকে আপন পুত্র অপেক্ষা অধিক স্নেহ করি । ভেতরে এসে বসো সালাহুদ্দীন!

আমি এখনো একজন আসামী। এক্ষুনি আমার প্রমাণ দিতে হবে, হেরেমের মেয়ে অপহরণে আমার কোন হাত নেই। আল্লাহ আমাকে সাহায্য করেছেন, তিনি দুটি লাশ প্রেরণ করেছেন। এই দুটো লাশ কথা বলবে না ঠিক, কিন্তু তাদের নীরবতা, তাদের গায়ে বিদ্ধ হয়ে থাকা তীর-ই সাক্ষ্য দেবে, সালাহুদ্দীন কসরে খেলাফতে সংঘটিত এ অপরাধের সাথে জড়িত নয়। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণিত না করা পর্যন্ত আমি ভেতরে যাবো না, আসুন। বলেই সালাহুদ্দীন আইউবী লাশের গাড়ীর দিকে হাঁটা দেন। খলীফাও তার পিছনে পিছনে রওনা হন।

খানিক দূরে দাঁড়িয়ে আছে চার থেকে সাড়ে চার শত নিরাপত্তা বাহিনী। সুলতান আইউবী গাড়ীর লাশ দুটো উঠিয়ে তাদের কাছে নিয়ে রাখেন এবং উচ্চকণ্ঠে বলেন–আট আটজন করে সিপাহী সামনে এগিয়ে আসে এবং লাশ দুটো দেখে বলল, এরা কারা?

প্রথমে আসে কমাণ্ডার ও প্লাটুন দায়িত্বশীলগণ। লাশ দুটো দেখেই তারা নাম উল্লেখ করে বলে–এরা তো আমাদের বাহিনীর সিপাহী ছিলো। তারপর আসে অপর আটজন। তারাও লাশ সনাক্ত করে বলে, এরা আমাদের সহকর্মী সিপাহী। এভাবে আটজন আটজন করে সকল কমাণ্ডার-সিপাহী এসে দেখে লাশ দুটোর পরিচয় প্রদান করে।

সালাহুদ্দীন! আমি মেনে নিলাম, এ দুটো লাশ কসরে খেলাফতের দুই নিরাপত্তা কর্মীর। কিন্তু আমি শুনতে চাই, এদের হত্যা করলো কে? বললেন খলীফা।

টহল বাহিনীর যে সান্ত্রী এদের হত্যা করেছিলো, সালাহুদ্দীন আইউবী তাকে সামনে ডেকে এনে বললেন, সমবেত মজলিসে তোমার কাহিনী পুনর্ব্যক্ত করো।

ঘটনাটি আনুপুংখ বিবৃত করে শোনায় সান্ত্রী। তার বক্তব্য শেষ হলে সুলতান আইউবী খলীফাকে বললেন–অপহরণ করে আপনার মেয়েটিকে আমার নিকট নিয়ে যাওয়া হয়নি–নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাকে সুদানী হাবশীদের মেলায় বিক্রি করার জন্য। প্রথা অনুযায়ী হাবশীরা তারা বলীও দিতে পারে।

লজ্জায় ও দুঃখে অথোবদন হয়ে ওঠেন খলীফা। তিনি সুলতান আইউবীকে বললেন, বসুন, ভেতরে আসুন। কিন্তু ভেতরে যেতে অস্বীকার করলেন আইউবী। বললেন, আমি মেয়েটিকে জীবিত হোক, মৃত হোক উদ্ধার করে এনে আপনার খেদমতে হাজির হবো। তবে আপনি মনে রাখবেন, হেরেমের এমন একটি মেয়ের অপহরণ–যে এসেছিলো উপহারস্বরূপ এবং যে আপনার বিবাহিত স্ত্রী নয়–রক্ষিতা আমার কাছে বিন্দু বরাবর গুরুত্ব রাখে না। আল্লাহ আমাকে এর চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব অর্পণ করেছেন।

আমার পেরেশানীর কারণ এই নয় যে, হেরেমের একটি মেয়ে অপহৃত হয়ে গেছে। পেরেশানীর আসল কারণ, যদি এভাবে নারী অপহরণ চলতে থাকে, তাহলে দেশের আইন-শৃংখলার পরিণতি কী হবে! বললেন খলীফা।

আর আমি পেরেশান এই ভেবে যে, খোদ ইসলামী সাম্রাজ্য-ই অপহৃত হয়ে যাচ্ছে। যা হোক, আপনি এতো অস্থির হবেন না। আমার গোয়েন্দা বিভাগ মেয়েটিকে উদ্ধার করে আনার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবে। বললেন সুলতান আইউবী।

খলীফা সুলতান আইউবীকে খানিকটা আড়ালে নিয়ে গেলেন এবং বললেন, সালাহুদ্দীন! বেশ কিছুদিন ধরে আমি দেখছি, তুমি আমাকে এড়িয়ে চলছে। তোমার পিতা নাজমুদ্দীন আইউবকে আমি অনেক শ্রদ্ধা করি। কিন্তু তোমার মনে আমার প্রতি সামান্যতম শ্রদ্ধাবোধও নেই দেখছি। তাছাড়াও এই আজই আমি জানতে পারলাম, কায়রোর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের খতীব আমীরুল ওলামা জুমার খোতবা থেকে আমার নাম তুলে দেয়ার মতো গোস্তাখী করেছে। কাজটা সে তোমার ইন্ধনে করেনি তো?

আমার ইন্ধনে নয়–সরাসরি আমার নির্দেশে তিনি খোতবা থেকে আপনার নাম তুলে দিয়েছেন। শুধু আপনার নাম-ই নয়, আপনার পরে যারা খেলাফতের মসনদে আসীন হবেন এবং তাদেরও পরে যারা আসবেন, সকলের নাম-ই আমি খোতবা থেকে তুলে দিয়েছি। বলিষ্ঠ কণ্ঠে বললেন সুলতান আইউবী।

এ নির্দেশ কি ফাতেমী খেলাফতকে দুর্বল করার জন্য জারি করা হলো? আমার তো সন্দেহ হচ্ছে, ফাতেমী খেলাফতকে উৎখাত করে আব্বাসীয় খেলাফত প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র চলছে। বললেন খলীফা।

হুজুর বেশ বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। তাছাড়া মদপানের ফলে মস্তিষ্কও দুর্বল হয়ে গেছে। তাই কথাগুলো আপনার প্রলাপের মত শোনা যাচ্ছে ……। বললেন সুলতান আইউবী। তারপর খানিক চিন্তা করে বললেন, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, কাল থেকে আপনার নিরাপত্তা বাহিনীতে রদবদল হবে। রজবকে প্রত্যাহার করে নিয়ে আমি তার স্থলে নতুন কমাণ্ডার দেবো।

কিন্তু রজবকে যে আমি এখানে রাখতে চাই। বললেন খলীফা

হুজুরের সমীপে আমার বিনীত নিবেদন, সামরিক কর্মকাণ্ডে আপনি হস্তক্ষেপ করতে চেষ্টা করবেন না। বলেই সুলতান আইউবী আলী বিন সুফিয়ানের প্রতি মনোযোগী হন। আলী বিন সুফিয়ান তখন পাঁচজন হাবশী রক্ষীসেনা নিয়ে এদিকে আসছিলেন।

এরা পাঁচজন ঐ গ্রোত্রের লোক। আমি নিরাপত্তা বাহিনীকে উদ্দেশ করে বললাম, ঐ গোত্রের কেউ এখানে থাকলে বেরিয়ে আসো। সারি থেকে বেরিয়ে আসে এরা পাঁচজন। কমাণ্ডার বললো, এরা আগামী পরশু থেকে ছুটিতে যাচ্ছে। আমি এদেরকে সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছি। মেয়েটির অপহরণে এদের হাত থাকতে পারে। বললেন আলী বিন সুফিয়ান।

সালাহুদ্দীন আইউবী রজবকে ডেকে বললেন, আগামীকাল এখানে অন্য কমাণ্ডার আসছে। আপনি আমার নিকট চলে আসবেন। আমি আপনাকে মিনজানীকের দায়িত্ব দিতে চাই।

শুনে ফ্যাকাশে হয়ে যায় রজবের চেহারা।

***

উম্মে আরারাকে ঘোড়ায় তুলে নিয়ে হাবশী দুজন চলে যায় অনেক দূর। এখন আর কারো পশ্চাদ্ধাবনের আশঙ্কা নেই। ঘোড়া থামায় তারা। মেয়েটি পুনরায় মুক্ত হওয়ার জন্য ছটফট করতে শুরু করে। হাবশীরা তাকে বলে, এই তড়পানি তোমার অনর্থক। আমরা তোমাকে ছেড়ে দিলেও এখন আর এ বালুকাময় প্রান্তর অতিক্রম করে তুমি করে খেলাফতে জীবিত যেতে পারবে না। তারা মেয়েটিকে এই বলে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে যে, আমরা তোমাকে অপমান করতে চাই না। বাস্তবিক, যদি তাদের উদ্দেশ্য খারাপ হতো, তাহলে এতক্ষণে তারা মেয়েটির সঙ্গে হায়েনার মতো আচরণ করতো। কিন্তু তারা তেমন কিছুই করেনি। এমন একটি চিন্তাকর্ষক সুন্দরী মেয়ে যে তাদের হাতের মুঠোয়, সে অনুভূতি-ই যেন নেই তাদের। তাদের যে দুজন লোক মারা পড়েছে, তার একজন মৃত্যুর আগে উম্মে আরারার সামনে হাটু গেড়ে বসে করজোরে নিবেদন করেছিলো, পালাবার চেষ্টা করে যেন সে নিজেকে কষ্টে না ফেলে। মেয়েটি তাদের জিজ্ঞেস করলো, তোমরা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো? জবাবে তারা। বললো, আমরা তোমাকে আসমানের দেবতার রাণী বানানোর জন্য নিয়ে যাচ্ছি।

তারা মেয়েটির চোখে পট্টি বেঁধে ঘোড়ায় বসায়। মেয়েটি পালাবার চেষ্টা ত্যাগ করে। এ চেষ্টা যে বৃথা, তা বুঝে ফেলে সে।

ছুটে চলে ঘোড়া। এক হাবশীর সামনে ঘোড়ায় বসে ফোফাতে থাকে উম্মে আরারা। দীর্ঘক্ষণ চলার পর শীতল বায়ুর পরশে সে বুঝতে পারে রাত হয়ে গেছে। আরো কিছুক্ষণ চলার পর এক স্থানে থেমে যায় ঘোড়া। একটানা পথ চলায় পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ে মেয়েটি। সমস্ত শরীর ভেঙ্গে আসে যেনো তার। ভয়ে অকেজো হয়ে গেছে তার মস্তিষ্ক।

ঘোড়া থামতেই আশে-পাশে তিন-চারজন পুরুষ আর জনতিনেক মেয়ের মিশ্র স্বর শুনতে পায় মেয়েটি। অবোধ্য এক ভাষায় কথা বলছে তারা। অপহরণকারী হাবশীরা পথে তার সঙ্গে কথা বলেছে আরবী ভাষায়। কিন্তু তাদের বাচনভঙ্গি আরবী নয়।

চোখের পট্টি খোলা হয়নি উম্মে আরারার। সে অনুভব করে, একজন তাকে তুলে একটি মরম বস্তুর উপর বসিয়ে দেয়। বস্তুটি পালকি। উপরে উঠে যায় পালকিটি। শুরু হয় তার নতুন আরেক সফর। পালকি কাঁধে করে এগিয়ে চলে বেহারা। তার সঙ্গে দফের মৃদু-মধুর গুঞ্জরণ কানে আসতে শুরু করে তার। গান গাইতে শুরু করে মেয়েরা। গানের শব্দগুলো বুঝতে পারছে না মেয়েটি। কিন্তু গানের সুর-লয়ে জাদুর ক্রিয়া। তাতে উম্মে আরারার ভয়ের মাত্রা বেড়ে যায় আরো। এই ভয়ের মাঝে এমনও প্রতিক্রিয়া হতে শুরু করে, যেন নেশা বা আচ্ছন্নতা চেপে ধরছে তাকে। রাতের হীম বায়ু সে আচ্ছন্নতায় এক প্রকার মধুরতা সৃষ্টি করে চলেছে। উম্মে আরারার একবার ইচ্ছা জাগে, পালকি থেকে লাফিয়ে পড়ে পালাবার চেষ্টা করি আর ওরা আমাকে মেরে ফেলুক। কিন্তু পরক্ষণেই সে ভাবে, না, আমি যাদের কজায় আটকা পড়েছি, তারা মানুষ নয় অন্য কোন শক্তি। স্বেচ্ছায় আমার কিছুই করা চলবে না।

উম্মে আরারা টের পায়, বেহারারা একের পর এক সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে। উঠছে তো উঠছে-ই। অন্তত ত্রিশটি সিঁড়ি অতিক্রম করে এবার তারা সমতল জায়গায় চলতে শুরু করে। কয়েক পা এগিয়ে-ই থেমে যায় পাকি। পালকিটি নামিয়ে রাখা হয় নীচে। উম্মে আরারার চোখ থেকে পট্টি খুলে দুচোখে হাত রাখে একজন। কিছুক্ষণ পর চোখের উপর থেকে হাতের আঙ্গুল সরতে শুরু করে এক এক করে। চোখে আলো দেখতে শুরু করে মেয়েটি। ধীরে ধীরে চোখ থেকে সরে যায় হাত।

চোখ ঘুরিয়ে এদিক-ওদিক তাকায় উম্মে আরারা। হাজার হাজার বছরের পুরনো একটি প্রাসাদে দাঁড়িয়ে আছে সে। একদিকে প্রশস্থ একটি হল। তাতে বিছিয়ে রাখা ফরশ আলোয় ঝম করছে। দেয়ালের সঙ্গে স্থানে স্থানে দাঁড়িয়ে আছে কতগুলো দণ্ড। প্রদীপ জ্বলছে সেগুলোর মাথায় এক প্রকার সুঘ্রাণ নাকে আসে তার, যার সৌরভ সম্পূর্ণ নতুন মনে হলো তার কাছে। দফের মৃদু শব্দ আর নারী কণ্ঠের গানের আওয়াজ কানে আসে উম্মে আরারার। এই বাদ্য-শব্দ আর গানের লয়-তাল অপূর্ব এক গুঞ্জরণ সৃষ্টি করে চলেছে হলময়।

সম্মুখে তাকায় উম্মে আরারা। একটি চবুতরা চোখে পড়ে। চবুতরায় পাথর-নির্মিত একটি মূর্তির মুখমণ্ডল ও মাথা। চিবুকের নীচে সামান্য একটু গ্রীবা। এই পাথরের মুখমণ্ডলটি দীর্ঘকায় একজন মানুষের চেয়েও দেড়-দু ফুট উঁচু। মুখটা খোলা, যা এতো-ই চওড়া যে, একজন মানুষ একটুখানি ঝুঁকে অনায়াসে তাতে ঢুকে পড়তে পারে। ধবধবে সাদা দাঁতও আছে মুখে। দেখতে মনে হচ্ছে, খিলখিল করে হাসছে মুখমণ্ডলটি। উভয় কান থেকে তার বেরিয়ে এসেছে দুটি দণ্ড। প্রদীপ জ্বলছে সেগুলোর মাথায়। হাত দুয়েক করে চওড়া চোখ দুটো তার অকস্মাৎ জুলজুল করে ওঠে। আলো বিচ্ছুরিত হতে শুরু করে তা থেকে। পাল্টে যায় মেয়েদের গানের লয়। তীব্র হয়ে ওঠে দফের বাজনা। আলোকিত হয়ে ওঠে পাথরের অভ্যন্তর। ধপধপে সাদা চোগা পরিহিত দুজন মানুষ ঝুঁকে বেরিয়ে আসে মুখের ভেতর থেকে। লোক দুটির গায়ের রং কালো। মাথায় বাঁধা লম্বা লম্বা রং-বেরংয়ের পাখির পালক। মুখের অভ্যন্তর থেকে বাইরে এসেই একজন ডান দিকে একজন বাঁ দিকে দাঁড়িয়ে যায়।

পরক্ষণেই মুখের ভেতর থেকে আত্মপ্রকাশ করে আরেকজন মানুষ। ঝুঁকে বাইরে বেরিয়ে আসে সে-ও। বয়সে খানিকটা বৃদ্ধ মনে হলো তাকে। পরনে লাল বর্ণের চোগা, মাথায় মুকুট। দু কাঁধে কুণ্ডলী পাকিয়ে ফনা তুলে বসে আছে মিশমিশে কালো দুটি সাপ। সাপ দুটো কৃত্রিম। ভয়ে গা শিউরে উঠে উম্মে আরারার। নির্জীব নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকে সে।

এ লোকটি অত্র গোত্রের ধর্মগুরু বা পুরোহিত। চবুতরার সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে আসেন তিনি। ধীরে ধীরে উম্মে আরারার নিকটে এসে মেয়েটির সামনে হাটু গেড়ে বসে তার দুটি হাত নিজের দুহাতে নিয়ে চুমো খান। আরবী ভাষায় মেয়েটিকে বলেন, তুমি-ই সেই ভাগ্যবতী মেয়ে, আমার দেবতা যাকে পছন্দ করেছেন। আমি তোমাকে মোবারকবাদ দিচ্ছি।

চৈতন্য ফিরে পায় উম্মে আরারা। কাঁদ কাঁদ কণ্ঠে বলে, আমি কোন দেবতা মানি না। তোমাদের যদি দেবতায় বিশ্বাস থাকে, তো আমি তাদের দোহাই দিয়ে বলছি, আমাকে ছেড়ে দাও। তোমরা আমাকে এখানে কেন আনলে!

এখানে যে-ই আসে, প্রথম প্রথম একথা-ই বলে। কিন্তু পরে যখন চোখের সামনে এ পবিত্র ভূখণ্ডের মাহাত্ম্য খুলে যায়, তখন বলে–আমি এখানে চিরদিন থাকতে চাই। আমি জানি, তুমি মুসলমানদের খলীফার প্রেমাস্পদ। কিন্তু যিনি পছন্দ করেছেন, দুনিয়ার সব খলীফা আর আকাশের ফেরেশতাকুল তাকে সেজদা করে। তুমি জান্নাতে এসে গেছে।

পুরোহিত চোগার পকেট থেকে একটি ফুল বের করে। উম্মে আরারার নাকের কাছে ধরে ফুলটি। উম্মে আরারাহ হেরেমের রাজকন্যা। এমনসব আতর-সুগন্ধি ব্যবহার সে করেছে, রাজকন্যারা ব্যতীত কেউ যার কল্পনাও করতে পারে না। কিন্তু এ ফুলের সৌরভ তার কাছে নিতান্তই অভিনব বলে মনে হলো। এ ফুলের সৌরভ হৃদয় ভেদ করে যায় উম্মে আরারার। সঙ্গে সঙ্গে ভাবনার রং-ও পাল্টে যায় তার। পুরোহিত বললেন–এটি দেবতার উপহার। মেয়েটির নাক থেকে ফুলটি সরিয়ে নেন পুরোহিত।

ধীরে ধীরে ডান হাতটা আগে বাড়ায় উম্মে আরারা। পুরোহিতের ফুল-ধরা হাতটা টেনে আনে নিজের কাছে। নাকের কাছে নিয়ে ফুল শুঁকে আবেশমাখা কণ্ঠে বলে–কি মন ভুলানো উপহার দেবেন এটি আমায়?

তুমি কি দেবতার এ উপহার গ্রহণ করেছো? জিজ্ঞেস করেন পুরোহিত। ঠোঁটে তার হাসি।

হ্যাঁ, দেবতার এ উপহার আমি কবুল করে নিয়েছি। বলে উম্মে আরারাহ পুনরায় ফুলটি নাকের কাছে ধরে। নিজের চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলে, যেন ফুলের সৌরভে বিমোহিত হয়ে পড়েছে সে।

দেবতাও তোমায় কবুল করে নিয়েছেন। বললেন পুরোহিত। তারপর জিজ্ঞেস করলেন–এতক্ষণ তুমি কোথায় ছিলে?

ভাবনায় পড়ে যায় মেয়েটি। যেন কিছু স্মরণ করার চেষ্টা করছে সে। খানিক পর মাথা দুলিয়ে বলে–আমি এখানেই তো আছি।

–না, না আমি অন্য এক জায়গায় ছিলাম–ধুত্তুরি ছাই! মনে-ই পড়ছে না, কোথায় ছিলাম।

এখানে তোমাকে কে নিয়ে এসেছে?

কেউ নয়। আমি নিজেই এসেছি?

কেন, তুমি ঘোড়ায় চড়ে আসোনি?”

না, আমি উড়ে এসেছি।

কেন, পথে মরুভূমি, পাহাড়-জঙ্গল, বিরাণভূমি দেখোনি?

দেখিনি মানে! কত সবুজের সমারোহ আর কত রং-বেরংয়ের ফুল দেখেছি! শিশুর ন্যায় আপুত কণ্ঠে জবাব দেয় মেয়েটি।

তোমার চোখে কেউ পট্টি বাঁধেনি?

পট্টি? কই না তো! আমার চোখ তো ভোলাই ছিলো! কত সুন্দর সুন্দর মন ভুলানো পাখি দেখেছি আমি!

উচ্চশব্দে কি যেন বললেন পুরোহিত। উম্মে আরারার পিছন দিক থেকে ধেয়ে আসে চারটি মেয়ে। এসেই পরনের পোশাক খুলে বিবস্ত্র করে ফেলে উম্মে আরারাকে। উম্মে আরারাহ হেসে জিজ্ঞেস করে–দেবতা এ অবস্থায় আমাকে পছন্দ করবেন? পুরোহিত বললেন–না, তোমাকে দেবতার পছন্দের পোশাক পরানো হবে। মেয়েরা উম্মে আরারার কাঁধের উপর চাদরের মত দীর্ঘ একটি কাপড় ঝুলিয়ে দেয়। কাঁধ থেকে পা পর্যন্ত লম্বিত চাদরে আপাদমস্তক আবৃত হয়ে যায় তার। চাদরের পাড়ে কতগুলো রঙ্গিন রশির টুকরো বাঁধা। দুই পাড় একত্র করে বেঁধে দেয় মেয়েরা। চমৎকার এক চোগায় পরিণত হয় চাদরটি। উম্মে আরারার মাথার চুল রেশমের মত কোমল। একটি মেয়ে চুলগুলো আচড়িয়ে পিঠের উপর ছড়িয়ে দেয়। আরো বেড়ে যায় উম্মে আরারার রূপ।

পুরোহিত হাসিমুখে তাকায় উম্মে আরারার প্রতি। পাথর-নির্মিত ভয়ঙ্কর মুখমণ্ডলটির প্রতি হাঁটা দেন তিনি। দুটি মেয়ে উম্মে আরারারকে নিয়ে পুরোহিতের পেছনে পেছনে এগিয়ে যায়। রাজকন্যার মত হাঁটছে উম্মে আরারাহ। আশে-পাশে দৃষ্টি নেই তার। রাজকীয় ভঙ্গিমায় চলছে সে। পুরোহিতের অনুসরণে মেয়ে দুটোর হাত ধরে চবুতরার সিঁড়িতে উঠতে শুরু করে। পাথরের পাহাড়সম মুখমণ্ডলের গহ্বরে ঢুকে পড়ে পুরোহিত। উম্মে আরারাও তিনটি সিঁড়ি অতিক্রম করে ঝুঁকে ঢুকে পড়ে মুখের অভ্যন্তরে। মেয়ে দুটো দাঁড়িয়ে থাকে বাইরে। উম্মে আরারার হাত ছেড়ে দেয় তারা; ধরে । পুরোহিত নিজে। মুখের অভ্যন্তরটা যথেষ্ট প্রশস্থ, অনায়াসে সোজা হয়ে হাঁটতে পারছে মেয়েটি। কণ্ঠনালী থেকে নীচে নেমে গেছে কয়েকটি সিঁড়ি। এই সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামে দুজন।

আবার একটি কক্ষ। কক্ষটি তেমন প্রশস্থ নয়। বেশ কটি প্রদীপ জ্বলছে। এখানেও ফুলের সৌরভ। কক্ষের ছাদ তেমন উঁচু নয়। দেয়াল ও ছাদ গাছের পাতা ও ফুল দিয়ে ঢাকা। ফরাশের উপর নরম ঘাস। ঘাসের উপর ফুল ছিটানো। এক কোনে মনোরম একটি পিপা ও একটি পেয়ালা। পিপা কাৎ করে দুটি পেয়ালা ভর্তি করেন পুরোহিত। একটি উম্মে আরারার হাতে ধরিয়ে দেন আর অপরটি রাখেন নিজের হাতে। ঠোঁটের সঙ্গে লাগিয়ে পেয়ালা খালি করে ফেলেন দুজনে।

দেবতা কখন আসবেন? জিজ্ঞেস করে উম্মে আরারা।

এখনো তুমি তাকে চিনতে পারোনি? তোমার সামনে কে দাঁড়িয়ে আছেন? বললেন পুরোহিত।

পুরোহিতের পায়ে লুটিয়ে পড়ে উম্মে আরারা। বলে, হ্যাঁ, এবার আমি দেবতাকে চিনতে পেরেছি। তুমি কি সে নও, যাকে আমি উপরে দেখেছিলাম? আমাকে তুমি কবুল করেছো?

হ্যাঁ, আজ থেকে তুমি আমার দুলহান। বললেন পুরোহিত।

***

আমি আপনাকে আর কিছু জানাতে পারছি না। আমার আব্বা আমাকে বলেছিলেন, পুরোহিত মেয়েটিকে একটি ফুল শোকান, যার সৌরভ তাকে ভুলিয়ে দেয়, সে কে ছিলো, কোথা থেকে এসেছে এবং কিভাবে তাকে এখানে আনা হয়েছে। স্বেচ্ছায় সে পুরোহিতের দাসীতে পরিণত হয়ে যায়। জগতের যত্তোসব বিশ্রী বস্তু সুশ্রী হয়ে দেখা দেয় তার চোখের সামনে। পুরোহিত তাকে পাতাল কক্ষে নিজের সঙ্গে রাখেন তিন রাত।

খলীফার নিরাপত্তা বাহিনী থেকে নিয়ে আসা পাঁচ হাবশীর একজন আলী বিন সুফিয়ানের সামনে ব্যক্ত করছিলো উপরোক্ত তথ্যগুলো। যে গোত্রের চার সিপাহী উম্মে আরারাকে অপহরণ করেছিলো, এই পাঁচজনও সে গোত্রের লোক। যেহেতু অল্প কদিন পর তাদের মেলা বসছে আর এরা পাঁচজন সে মেলায় অংশ নেয়ার উদ্দেশ্যে ছুটিতে যাচ্ছে, তাই আলী বিন সুফিয়ান ধরে নিলেন, হেরেমের মেয়ে অপহরণের বিষয়টি তাদের জানা থাকতে পারে। সেমতে খলীফার নিরাপত্তা বাহিনী থেকে সঙ্গে করে নিয়ে এসে আলী বিন সুফিয়ান এদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন। প্রথমে পাঁচজন-ই বলে, তারা এ ব্যাপারে কিছুই জানে না। আলী বিন সুফিয়ান তাদের আশ্বস্ত করেন, সত্য কথা বললে তাদের কোন শাস্তি দেয়া হবে না। তবু তারা অজ্ঞতার কথা-ই প্রকাশ করতে থাকে। হায়েনা চরিত্র আর রক্ত-পিয়াসী বলে প্রসিদ্ধ এ গোত্রটি। সাজা-শাস্তির ভয়-ডর নেই তাদের মনে। আলী বিন সুফিয়ানের ধৃত পাঁচজনও বেশ সাহসিকতার সঙ্গে অস্বীকার করে চলে। অগত্যা আলী বিন সুফিয়ান ঐসব পদ্ধতি প্রয়োগ করতে বাধ্য হন, যা পাথরকেও মোমের মত গলিয়ে দেয়।

আলী বিন সুফিয়ান আলাদা আলাদাভাবে পঁচজনকে এমন স্থানে নিয়ে যান, যেখানকার আহ-চীৎকার বাইরের কেউ শুনতে পায় না। বিরামহীন অত্যাচার-নির্যাতনে কোন আসামী মরে গেলেও জানতে পারে না কেউ।

এই পাঁচ সুদানী বড় কঠিন-হৃদয়ের মানুষ বলে মনে হলো আলী বিন সুফিয়ানের কাছে। তারা রাতভর কঠোর নির্যাতন সইতে থাকে। আর আলী বিন সুফিয়ানও রাত জেগে তাদের মুখ খোলানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু কোন স্বীকারোক্তি আদায় করা যাচ্ছে না তাদের মুখ থেকে। অবশেষে সর্বশেষ কঠোর পন্থাটি অবলম্বন করলেন আলী।

কঠোর নির্যাতনের মুখে শেষ রাতে মধ্য বয়সী এক হাবশী আলী বিন সুফিয়ানকে বলে–আমি সবকিছু জানি। কিন্তু বলছি না দেবতার ভয়ে। বললে দেবতা আমাকে নির্মমভাবে মেরে ফেলবে।

এর চেয়ে নির্দয় শাস্তি আর কী হতে পারে, যা আমি তোমাদের দিচ্ছি? তোমার দেবতা যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে তোমাকে এই নির্যাতনের যাতাকল থেকে বের করিয়ে নেয় না কেন? মৃত্যুকেই যদি তোমরা ভয় করে থাকো, তাহলে মৃত্যু এখানেও আছে। তোমরা কথা বলো। আমার হাতে এমন দেবতা আছে, যিনি তোমাদেরকে তোমাদের দেবতার কবল থেকে রক্ষা করবেন। বললেন আলী বিন সুফিয়ান।

আলী বিন সুফিয়ানের কঠোর শাস্তির মুখে বেশ কবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলে লোকটি। দেবতা নয়–বার বার মৃত্যু এসে চোখের সামনে হাজির হয় তার। আলী বিন সুফিয়ান তার মুখ খোলাতে সক্ষম হন। প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে নির্যাতন থেকে মুক্তি দিয়ে পানাহার করিয়ে আরামে শুইয়ে দেন তাকে।

সে স্বীকার করে, উম্মে আরারাকে তার-ই গোত্রের চার ব্যক্তি অপহরণ করে নিয়ে গেছে। তারা খলীফার নিরাপত্তা বাহিনীর সিপাহী। তারা আগেই ছুটিতে গিয়েছিলো। পরিকল্পনা সম্পন্ন করে যাওয়ার সময় আমাদের অপহরণের রাত-ক্ষণ বলে গিয়েছিলো। সে রাতে পাহারায় ডিউটি ছিলো আমাদের পাঁচজনের। প্রধান ফটক দিয়ে তাদের দুজনকে ভেতরে ঢুকতে দেয়ার সুযোগ আমরা-ই করে দিয়েছিলাম। আমরা তাদের অপহরণ ও পলায়নে সার্বিক সহযোগিতা দিয়েছি।

হাবশী জানায়, মেয়েটিকে দেবতার বেদীতে বলী দেয়া হবে। প্রতি তিন বছর পর পর আমাদের গোত্রে চার দিনব্যাপী একটি উৎসব মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এই মেলার শেষ দিন মেয়েটির বলীপর্ব সম্পন্ন হওয়ার কথা। আমাদের নিয়ম, বলীর মেয়ে ভিনদেশী, শ্বেতাঙ্গী, উচ্চ বংশের এবং চোখ ধাঁধানো রূপসী হতে হয়।

তার মানে প্রতি তিন বছর পর পর তোমার গোত্র বাইরে থেকে একটি করে রূপসী মেয়ে অপহরণ করে নিয়ে আসে। বললেন আলী বিন সুফিয়ান।

না, এটা ভুল প্রচারণা। তিন বছর পর পর মেলা বসে। আর মেয়ে বলী হয় প্রতি পাঁচ মেলার পর। তবে মানুষ এটাই জানে যে, প্রতি তিন বছর পর মেয়ে বলী হয়। জবাব দেয় হাবশী।

কোন্ স্থানে মেয়ে বলী হয়, হাবশী তাও জানায়। যে জায়গায় মেলা বসে, তার থেকে এক-দেড় মাইল দূরে একটি পাহাড়ী এলাকা। এ এলাকায় দেবতারা বাস করে বলে জনশ্রুতি আছে এবং তাদের সেবার জন্য নিয়োজিত আছে অসংখ্য জিন-পরী। এ এলাকায় ফেরআউনী আমলের একটি জীর্ণ প্রাসাদ আছে। আছে একটি ঝিল, যাতে বাস করে ছোট-বড় অনেক কুমীর।

গোত্রের কেউ গুরুতর অপরাধ করলে তাকে পুরোহিতের হাতে তুলে দেয়া হয়। পুরোহিত তাকে জীবন্ত ঝিলে নিক্ষেপ করেন। কুমীররা অপরাধীকে খেয়ে ফেলে।

সেই প্রাসাদেই বাস করেন পুরোহিত। প্রাসাদের এক স্থানে পাথর-নির্মিত বৃহদাকার একটি মুখ ও মাথা আছে। এর-ই অভ্যন্তরে বাস করেন দেবতা। প্রতি পনের বছরের শেষ দিনগুলিতে বাইরে থেকে একটি মেয়ে অপহরণ করে এনে তুলে দেয়া হয় পুরোহিতের হাতে। পুরোহিত মেয়েটিকে একটি ফুল শোকান। সেই ফুলের সৌরভে বিমোহিত হয়ে মেয়েটি ভুলে যায় সে কে ছিলো, কোথা থেকে এসেছে এবং তাকে কে এনেছে। ফুলের সাথে এক প্রকার নেশাকর ঘ্রাণ। মিশিয়ে দেয়া হয়, যার প্রভাবে মেয়েটি পুরোহিতকে দেবতা এবং নিজের স্বামী ভাবতে শুরু করে। ওখানকার পুঁতিগন্ধময় বস্তুও তার চোখে আকর্ষণীয় বলে মনে হয়।

পনের বছর পূর্ণ হওয়ার পথে। এই অল্প কদিন পর-ই মেয়েটিকে বলী দেয়া হবে। আমরা নয়জন লোক মিসরের ফৌজে ভর্তি হয়েছিলাম। নির্ভীক এবং জংলী হওয়ার কারণে আমাদেরকে খলীফার নিরাপত্তা কর্মী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। দুমাস আগে হেরেমের এই মেয়েটি আমাদের চোখে পড়ে। আমরা এমন রূপসী নারী জীবনে কখনো দেখিনি। আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি, একেই অপহরণ করে নিয়ে এবার বলীর জন্য পুরোহিতের হাতে তুলে দেবো। আমাদের এক সঙ্গী–যে গতকাল সান্ত্রীর হাতে মারা গেলো এলাকায় গিয়ে গোত্রের মোড়লকে বলে এসেছিলো, এবার বলীর জন্য আমরা মেয়ে এনে দেবো। মেয়েটিকে আমরাই অপহরণ করে নিয়ে গেছি। বললো হাবশী ।

***

রিপোর্ট শুনে ভাবনার সমুদ্রে ডুবে যান সালাহুদ্দীন আইউবী। আলী বিন সুফিয়ান তার নির্দেশের অপেক্ষায় দণ্ডায়মান। সুলতান আইউবী ম্যাপ দেখলেন। বললেন–জায়গা যদি এটি-ই হয়, তাহলে স্থান তো আমাদের নাগালের বাইরে। শহরের প্রবীণ লোকদের নিকট থেকে তুমি যে তথ্য নিয়েছে, তাতে–প্রমাণিত হয়, ফেরআউনের পতনের পর শত শত বছর অতিবাহিত হলেও ফেরআউনী কালচার এখনো বহাল আছে। মুসলমান হিসেবে আমাদের কর্তব্য, বেশী দূরে যেতে না পারলেও এই নিকট প্রতিবেশী সমাজ থেকে অন্তত কুফর-শিরকের অবসান ঘটাতে হবে। কি জানি, এ পর্যন্ত কত বাবা-মায়ের নিষ্পাপ কন্যা ওদের হাতে বলীর শিকার হয়েছে! কত মেয়ে অপহৃতা হয়ে বিক্রি হয়েছে এ মেলায়! দেবতার বিশ্বাসের-ই মূলোৎপাটন করতে হবে। দেবতার নাম ভাঙ্গিয়ে মেয়ে অপহরণ করিয়ে অপকর্ম আর আমোদ-ফুর্তিতে মেতে ওঠে তথাকথিত ধর্মগুরুরা। এই বর্বরতার অবসান ঘটাতে হবে।

গুপ্তচর মারফত আমি জানতে পেরেছি, আমাদের ফৌজের কয়েকজন কমাণ্ডার এবং মিসরের কিছুসংখ্যক ধনাঢ্য ব্যক্তি এ মেলায় অংশ নেয় এবং মেয়ে ক্রয় করে কিংবা নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য মেয়েদের ভাড়া আনে। বরখাস্তকৃত সুদানী সৈন্যদের বিপুল সংখ্যক লোকও এ মেলায় অংশ নিয়ে থাকে। কাজেই আমি মনে করি, আমাদের ফৌজ এবং বেসামরিক লোকদের ও প্রাক্তন সুদানী ফৌজদের সঙ্গে একত্রিত হওয়া ও একত্রে উৎসব করা ঠিক নয়। এ যৌথ বিনোদন জাতির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর প্রমাণিত হতে পারে। আর বলীর শিকার হওয়ার আগে আগেই মেয়েটিকে উদ্ধার করে খলীফার সামনে এজন্যে পেশ করা প্রয়োজন, যাতে প্রমাণিত হয় যে, খলীফা আপনার উপর অপহরণের যে অপবাদ দিয়েছেন, তা কত ভিত্তিহীন। বললেন আলী বিন সুফিয়ান।

আমার এর বিন্দুমাত্র পরোয়া নেই আলী! আমার দৃষ্টি আমার ব্যক্তিসত্ত্বার উপর নয়। আমাকে যে যতো তুচ্ছ-ই ভাবুক, আমি ইসলামের মর্যাদা ও সমুন্নতির কথা ভুলতে পারি না। আমি নিজে কি আর ছাই! কথাটা তুমি মনে রেখো আলী! নিজের ব্যক্তিসত্ত্বা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সালতানাতের কর্তৃত্ব রক্ষা, দেশের উন্নতি ও ইসলামের প্রসার-প্রতিষ্ঠার কাজে নিজেকে কোরবান করে দাও। ইসলামের মর্যাদা রক্ষা করার দায়িত্ব ছিলো খলীফার । কিন্তু কালক্রমে খলীফা এখন হয়ে পড়েছেন আত্মকেন্দ্রিক, প্রবৃত্তির দাস। আজ আমাদের খেলাফত ফোলা ও দুর্বল। আমাদের এই দুর্বলতাকে কাজে লাগাচ্ছে খৃষ্টানরা। সফলতার সঙ্গে যদি তুমি নিজের কর্তব্য পালন করতে চাও, তাহলে আত্মকেন্দ্রীকতা পরিহার করে চলতে হবে। খলীফা আমার প্রতি যে অপবাদ আরোপ করেছেন, বড় কষ্টে আমি তা বরদাশত করেছি। ইচ্ছে করলে আমি এর উপযুক্ত জবাব দিতে পারতাম। কিন্তু তখন আমি ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়তাম। আমার তো আশঙ্কা হচ্ছে, কদিন পর আমার আশ-পাশের লোকেরাই ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতি, আত্মপ্রিয়তা ও ক্ষমতার মোহে আচ্ছন্ন হয়ে পড়বে। বললেন সুলতান আইউবী।

গোস্তাখীর জন্য ক্ষমা চাই, মোহতারাম আমীর! বলী হওয়ার আগেই যদি আপনি মেয়েটিকে উদ্ধার করাতে চান, তাহলে আদেশ করুন। সময় বেশী নেই। পরশু থেকে মেলা শুরু হচ্ছে। বললেন আলী বিন সুফিয়ান।

সেনাবাহিনীতে ফরমান জারি করে দিন, এ মেলায় কারো অংশ নেয়ার অনুমতি নেই। বলেই নায়েব সালারকে ডেকে সুলতান বললেন–এ নির্দেশ যে অমান্য করবে, পদমর্যাদা যা-ই হোক, তাকে জনসমক্ষে পঞ্চাশ বেত্রাঘাত করা, হবে। এক্ষুনি এ নির্দেশ সেনাবাহিনীকে জানিয়ে দিন।

পরিকল্পনা শুরু হয়ে যায়। সুলতান আইউবী সংশ্লিষ্ট অফিসারদের ডেকে পাঠান। ঘোষণা দেন, এই জঘন্য কুসংস্কারের আড্ডা আমাদের ভাজতে হবে। স্থানটি ফেরআউনী কালচারের শেষ নিদর্শন বলে মনে হয়। সরাসরি সেনা অভিযানের প্রস্তাব আসে। কিন্তু সে প্রস্তাব এই বলে প্রত্যাখ্যান করা হয় যে, একে গোত্রের মানুষ সরাসরি আক্রমণ মনে করবে। সংঘর্ষ বাধবে। মেলায় অংশ নেয়া নিরীহ মানুষ ও নারী-শিশু মারা যাবে। স্বীকারোক্তি প্রদানকারী সুদানী হাবশীকে রাহবার হিসেবে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার এবং যে স্থানে মেয়ে বলী দেয়া হয়, সেখানে অতর্কিতে কমাণ্ডে আক্রমণ পরিচালনার প্রস্তাব আসে। সুলতান আইউবী হাবশীকে নিয়ে যাওয়া ভালো মনে করলেন না। তিনি তাকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না।

সুলতান আইউবীর নির্দেশে আগেই একটি দুর্ধর্ষ কমাণ্ডে বাহিনী গঠন করে রাখা হয়েছিলো। দীর্ঘদিন যাবত প্রশিক্ষণ দিয়ে অভিজ্ঞরূপে গড়ে তোলা হয়েছে । তাদের। একটি সুইসাইড স্কোয়াডও আছে তাদের সঙ্গে। ঈমানদীপ্ত এই স্কোয়াড এততাই চেতনা-সমৃদ্ধ যে, কোন অভিযান থেকে জীবিত ফিরে না আসতে পারাকে তারা গৌরবের বিষয় মনে করে।

নায়েব সালার আন-নাসের ও আলী:বিন সুফিয়ানের পরামর্শে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, যে স্থানে পুরোহিত বাস করেন এবং মেয়ে বলী হয়, সেই দুর্গম পাহাড়ী এলাকায় মাত্র বারজন কমাণ্ডো সেনা ঢুকে পড়বে। হাবশীর দেয়া তথ্য মোতাবেক বলীর রাতে মেলা বেশ জমে ওঠে। কারণ, এটি মেলার শেষ দিন। গোত্রের লোকদের ছাড়া মেয়ে বলির ঘটনা আর কেউ জানে না। জানলেও এই বলি কোথায় হয়, বলতে পারে না কেউ।

এসব তথ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, পাঁচশত মিসরী সৈন্য অস্ত্র-সজ্জিত হয়ে দর্শক হিসেবে এদিন মেলায় ঢুকে পড়বে। তাদের দুশ জনের কাছে থাকবে তীর-ধনুক। সে যুগে সঙ্গে এসব অস্ত্র রাখা ছিলো স্বাভাবিক ব্যাপার। এসবের উপর কোন পাবন্দি ছিলো না। কমান্ডো সদস্যদের বলির স্থানটি স্পষ্টরূপে চিহ্নিত করে দেয়া হবে। তারা সরাসরি আক্রমণ করবে না। তারা কমাণ্ডো স্টাইলে পাহাড়ে ঢুকে পড়বে। অতর্কিতে প্রহরীদের হত্যা করে পৌঁছে যাবে আসল জায়গায়। মেয়েটিকে যখন বলির জন্য বেদীতে নিয়ে আসা হবে, হামলা করবে তখন। অন্যথায় তারা আক্রান্ত হয়ে মেয়েটিকে পাতাল কক্ষে গুম কিংবা খুন করে ফেলতে পারে।

তথ্য পাওয়া গেছে, মধ্য রাতের পূর্ণ চন্দ্রালোকে বলীপর্ব সম্পন্ন করা হয়। পাঁচশত সিপাহীকে এ সময়ের পূর্বে বলীর স্থান সংলগ্ন পাহাড়ের আশে-পাশে পৌঁছে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। তাদের জানিয়ে দেয়া হয়, কমাণ্ডো সেনারা যদি প্রতিপক্ষের ঘেরাওয়ে পড়ে যায় কিংবা অভিযান ব্যর্থ হয়ে পড়ে, তাহলে তারা একটি সলিতাওয়ালা অগ্নিতীর উপর দিকে নিক্ষেপ করবে। এ তীরের শিখা দেখে তারা হামলা চালাবে।

নির্বাচন করে নেয়া হয় চারজন জানবাজ। দু বছর আগে নুরুদ্দীন জঙ্গী সুলতান আইউবীর সাহাযার্থে যে বাহিনী প্রেরণ করেছিলেন, তাদের থেকে নেয়া হয় বাছা বাছা পাঁচশত সৈন্য। এরা এসেছিলো আরব থেকে। এদের উপর মিসর ও সুদানের রাজনীতি এবং তাদের ভ্রান্ত আকীদা-বিশ্বাসের কোন প্রভাব ছিলো না। ইসলাম পরিপন্থী আকীদার বিরুদ্ধে ছিলো তারা উচ্চকণ্ঠ। কুসংস্কার নির্মূলে ছিলো তারা বদ্ধপরিকর। তাদেরকে ধারণা দেয়া হয়, তারা এক ভ্রান্ত বিশ্বাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে যাচ্ছে এবং নিজেদের তুলনায় অধিক সৈন্যের মোকাবেলা করতে হতে পারে। লড়াই হতে পারে রক্তক্ষয়ী। আবার এমনও হতে পারে যে, তাদের সামনে দাঁড়াতেই পারবে না কেউ, যুদ্ধ ছাড়াই অভিযান সফল হয়ে যাবে। তাদেরকে পরিকল্পনা বুঝিয়ে দেয়া হয়। সেখানকার পরিবেশ-পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেয়া হয়। পাহাড়ে আরোহণ, মরুভূমিতে দৌড়ানো এবং উটের মত দীর্ঘ সময় পিপাসায় অতিবাহিত করেও অকাতর লড়াই চালিয়ে যাওয়ার প্রশিক্ষণ আছে তাদের পূর্ব থেকেই।

বলীর রাত আসতে আর ছয় দিন বাকী। কমাণ্ডো বাহিনী ও পাঁচশত সৈন্যকে মহড়া দেয়া হয় তিনদিন তিনরত। চতুর্থ দিন কমান্ডোদের উটে চড়িয়ে রওনা করানো হয়। উটের মধ্যম গতিতে গন্তব্যে পৌঁছতে সময় লাগবে একদিন একরাত। উট চালকদের নির্দেশ দেয়া হয়, তারা কমাণ্ডোদের পাহাড়ী অঞ্চল থেকে দূরে কোথাও নামিয়ে দিয়ে ফিরে আসবে।

পাঁচশত সৈন্যের বাহিনীটি মেলার দর্শক বেশে দুজন দুজন চারজন চারজন করে লরি ও উটে চড়ে মেলার দিকে রওনা হয়। তাদের কমাণ্ডারও একই বেশে তাদের সঙ্গে রওনা হয়েছে। তাদের পশুগুলো থাকবে তাদের সঙ্গে।

***

মেলার শেষ রাত।

আকাশের ঝলমলে চাঁদ পূর্ণতা লাভ করতে আর অল্প বাকি। স্বচ্ছ কাঁচের মত পরিষ্কার মরুর পরিবেশ। মেলায় বিপুল দর্শকের ভীড়। পিনপতনের স্থান নেই যেন কোথাও। একধারে অর্ধনগ্ন মেয়েরা নাচছে-গাইছে। সুন্দরী মেয়েদের দেদারছে বেচা-কেনা চলছে এক জায়গায়। বেশী ভীড় সেখানেই। একটি মঞ্চ পাতা আছে সেখানে। একটি করে মেয়ে আনা হয় মঞ্চে। চারদিক থেকে খুটিয়ে। খুটিয়ে দেখে ক্রেতা। মুখ হা করিয়ে দাঁত দেখে। নেড়ে চেড়ে দেখে মাথার চুল। দেহের কোমলতা-কঠোরতাও পরখ করা হয়। তারপর শুরু হয় দর-দাম নিয়ে আলোচনা। অবশেষে বেচা-কেনা। জুয়ার আসরও আছে মেলায়। আছে মদের, আড়া। মেলার চার ধারে বহিরাগত দর্শকদের থাকার আয়োজন।

উৎসবে যোগদানকারী লোকদের ধর্ম ও চরিত্রের কোন বালাই নেই। আদর্শিক অনুশাসন থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত তারা। মেলাঙ্গন থেকে খানিক দূরের পাহাড়ী অঞ্চলের কোন এক নিভৃত ভূখণ্ডে যে সুন্দরী নারী বলির আয়োজন চলছে, তাদের তা অজানা। একজন মানুষ যে সেখানে দেবতা হয়ে বসে আছে, তাও তারা জানে না। তারা শুধু এতটুকুই জানে, পাহাড়-বেষ্টিত এ এলাকাটি তাদের দেবতাদের আবাস। জিন-ভূত পাহারা দেয় তাদের। সেখানে যাওয়ার কল্পনাও করতে পারে না কোন মানুষ।

তাদের এ-ও জানা নেই যে, আল্লাহ্র পাঁচশত সৈনিক তাদের মাঝে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং বারজন রক্ত-মাংসের মানুষ তাদের দেবতাদের রাজত্বের সীমানায় ঢুকে পড়েছে। পাহাড়ের অভ্যন্তরে কিভাবে প্রবেশ করতে হবে, সালাহুদ্দীন আইউবীর চার জানবাজকে আগেই তা বলে দেয়া হয়েছিলো। কঠোর পাহারার কারণে তারা সে পথে ঢুকতে পারেনি। অন্য এক দুর্গম পথ দিয়ে ঢুকতে হয়েছে তাদের। তাদের বলা হয়েছিলো, পাহাড়ের আশেপাশে কোন মানুষ থাকবে না। কিন্তু এসে তারা দেখতে পায়, মানুষ আছে। তার মানে ধৃত হাবশীর দেয়া তথ্য ভুল । পাহাড়টি দৈর্ঘ্য-প্রস্থে এক বর্গমাইলের বেশী নয়। অতি সাবধানে বিক্ষিপ্তভাবে এগিয়ে যায় তারা।

হঠাৎ একটি গাছের তলায় স্পন্দনশীল একটি ছায়ামূর্তি চোখে পড়ে এক কমাণ্ডোর। সঙ্গে সঙ্গে হাটু গেড়ে বসে পড়ে সে। অতি সন্তর্পণে হামাগুড়ি দিয়ে পিছনে চলে যায় ছায়াটির। নিকটে গিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়ে তার উপর। দু বাহু দ্বারা ঘাড় ঝাঁপটে খঞ্জরের আগা ঠেকিয়ে ধরে তার বুকে। জিজ্ঞেস করে, বল্ল, এখানে কি করছিস্ তুই? আর কে আছে তোর সাথে?

ছায়া মূর্তিটি একজন হাবশী লোক। কমাণ্ডো কথা বলছে আরবীতে। হাবশী আরবী বুঝে না। এমন সময়ে এসে পড়ে আরেক কমাণ্ডো। সে-ও খঞ্জর তাক করে ধরে হাবশীর বুকে। ইংগিতে প্রশ্ন করে তারা হাবশীকে। হাবশীও ইংগিতে জবাব দেয়। তার জবাবে সন্দেহ হয়, এখানে কঠোর পাহারা আছে। দুই কমাণ্ডো ধমনি কেটে দেয় হাবশীর। মাটিতে পড়ে যায় সে। আরো সতর্কতার সাথে সম্মুখে এগিয়ে চলে তারা। গহীন জঙ্গল। সামনে একটি পাহাড়। চাঁদ উঠে এসেছে আরো উপরে। ঘন পাহাড়ের ভেতরটা গাছ-গাছালিতে ঘোর অন্ধকার। তারা পাহাড় বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করে।

পাহাড়ের অভ্যন্তরে–যেস্থানে মেয়েটিকে পুরোহিতের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে–চলছে আরেক তৎপরতা। পাথরের মুখের সামনে চবুতরায় একটি জাজিম বিছানো। তার উপর বিশাল এক কৃপাণ । নিকটে-ই বড় একটি পেয়ালা। জাজিমে ছড়িয়ে আছে কতগুলো ফুল। পার্শ্বে একস্থানে আগুন জ্বলছে। চবুতরার চারদিকে জ্বলছে কতগুলো প্রদীপ। ঘোরাফেরা করছে চারটি মেয়ে। পরণে তাদের দুটি করে গাছের চওড়া পাতা। বাকি শরীর নগ্ন। আছে চারজন হাবশী। কাঁধ থেকে পায়ের গোড়ালী পর্যন্ত তাদের সাদা চাদর দিয়ে আবৃত।

উম্মে আরারা পাতাল কক্ষে পুরাহিতের সঙ্গে উপবিষ্ট। তার এলোচুলে বিলি কেটে খেলছেন পুরোহিত। মেয়েটি আচ্ছন্ন কণ্ঠে বলছে–আমি আংগুকের মা। তুমি আংগুকের পিতা। আমার সন্তানরা মিসর ও সুদানের রাজা হবে। তাদেরকে আমার রক্ত পান করিয়ে দাও। আমার লম্বা লম্বা সোনালী চুলগুলো তাদের ঘরে রেখে দাও। তুমি আমার থেকে দূরে সরে গেলে কেন? এসো, আমার কাছে এসো।

পুরোহিত তেলের মত একটি পদার্থ মালিশ করতে শুরু করে উম্মে আরারার গায়ে।

আংগুক এ গোত্রটির নাম। মদের নেশা একটি আরব মেয়েকে এই গোত্রের মা বানিয়ে দিয়েছে। বলীর জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে সে। পুরোহিত সম্পন্ন করছে তার নিয়ম-নীতির শেষ পর্ব।

পদে পদে হোঁচট-ধাক্কা খেতে খেতে চড়াই বেয়ে উপরে উঠছে বারজন কমাণ্ডো সৈন্য। দুর্গম পথ অতিক্রম করতে হচ্ছে তাদের। পাহাড়ের বেশীর ভাগ ঝোঁপ-ঝাড়, কাঁটাল। আকাশের পূর্ণ চাঁদ এখন মাথার উপর। আস্তে আস্তে গাছ-গাছালির ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলোকরশ্মি চোখে পড়তে শুরু করে। সেই কিরণে তারা একস্থানে একজন হাবশীকে দাঁড়িয়ে আছে দেখতে পায়। তার এক–হাতে একটি বর্শা। অপর হাতে ঢলি। লোকটি দেব-জগতের পাহারাদার। নীরবে মেরে ফেলতে হবে তাকেও। কিন্তু লোকটি যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে পিছন দিক থেকে হামলা করার সুযোগ নেই। সামনাসামনি মোকাবেলা করাও ঠিক হবে না। তাই ঝোঁপের মধ্যে নীরবে বসে পড়ে এক কমাণ্ডো। লোকটির ঠিক সম্মুখে একটি পাথর ছুঁড়ে মারে আরেকজন। চমকে ওঠে হাবশী। পাথরটি কোত্থেকে আসলো দেখার জন্য এগিয়ে আসে এদিকে। ঝোঁপের মধ্যে লুকিয়ে থাকা কমাণ্ডোর ঠিক সামনে এসে পৌঁছামাত্র ঘাড়টা তার এসে পড়ে কমাণ্ডোর দু বাহুর মাঝে। সঙ্গে সঙ্গে একটি খঞ্জর বিদ্ধ হয় তার বুকে। প্রহরীকে খুন করে বারজনের কমাণ্ডো বাহিনী খানিকটা বিলম্ব করে সেখানে। পরক্ষণেই এগিয়ে যায় অতি সাবধানে। পা টিপে টিপে অগ্রসর হয় সামনের দিকে।

বলীর জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে উম্মে আরারা। তাকে শেষবারের মত বুকে জড়িয়ে ধরেন পুরোহিত। হাতে ধরে সিঁড়ি বেয়ে হাঁটা দেন তিনি। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা চার হাবশী পুরুষ ও মেয়েরা পাথরের মুখ ও মস্তকে আলোর ঝলক দেখতে পায়। মুখের সামনে সেজদায় লুটিয়ে পড়ে তারা। মুখে কি এক মন্ত্র পাঠ করতে করতে পাথরের মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসেন পুরোহিত। উম্মে আরারা তার সঙ্গে।

উম্মে আরারাকে জাজিমের উপর নিয়ে যান পুরোহিত। হাবশী পুরুষ ও মেয়েরা দাঁড়িয়ে আছে তার চারদিকে। উম্মে আরারা আরবীতে বলে–আমি আংগুকের ছেলে ও মেয়েদের জন্য গলা কাটাচ্ছি। আমি তাদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত্ব করছি। আর বিলম্ব না করে এবার আমার গলা কেটে দাও। আমার মাথাটা রেখে দাও আঙ্গুকের দেবতার পায়ে। এই মাথার উপর মিসর ও সুদানের মুকুট রাখবেন দেবতা।

চার হাবশী পুরুষ ও মেয়েরা সেজদায় লুটিয়ে পড়ে পুনর্বার। উম্মে আরারাকে জাজিমের উপর আসন গেড়ে বসিয়ে মাথাটা নত করে দেন পুরোহিত। ঘাড় বরাবর সুতীক্ষ্ম ধারাল কৃপাণ উত্তোলন করেন তিনি।

সকলের সামনে হাঁটছে যে কমাণ্ডো, থেমে যায় সে। হাতের ইশারায় থামতে বলে পিছনের সঙ্গীদের। পাহাড়ের চূড়া থেকে চবুতরা ও পাথরের মাথা দেখতে পায় তারা। চবুতরার উপরে নতমুখে আসন গেড়ে বসে আছে একটি মেয়ে। ধবধবে জোৎস্নালোক। বেশ কটি প্রদীপ ও বড় বড় মশালের আলোয় দিবালোকের ন্যায় উজ্জ্বল করে রেখেছে স্থানটা। মেয়েটির কাছে দণ্ডায়মান লোকটির হাতে কৃপাণ। মেয়েটি সম্পূর্ণ উলঙ্গ। তার দেহের রং-ই বলছে, সে হাবশীদের গোত্রের মেয়ে নয়।

কমাণ্ডো সেনারা এখনো বেশ দূরে এবং পাহাড়ের চূড়ায় তাদের অবস্থান। সেখান থেকে তীর ছুঁড়লে ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। আবার সেখান থেকে নীচে নেমে আসাও অসাধ্য। নীচের দিকে কোন ঢালু নেই। সামনে খাড়া দেয়াল।

কমান্ডোরা বুঝে ফেলে মেয়েটিকে বলীর জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। ধারাল তরবারীর আঘাত তার মস্তক দ্বি-খণ্ডিত করলো বলে। হাতে সময় এতই কম যে, উড়ে গিয়ে বলীর স্থলে পৌঁছুতে না পারলে রক্ষা করা যাবে না তাকে। চূড়া থেকে নীচে তাকিয়ে তারা একটি ঝিল দেখতে পায়। এই সেই ঝিল, যেখানে বাস করে অসংখ্য কুমীর।

ডান দিকে খানিকটা ঢালু পথ। তা-ও প্রায় খাড়া দেয়ালের-ই মত। ঝোঁপ-জঙ্গল এবং গাছ-পালাও আছে এখানে। সেটি অবলম্বন করে একে অপরের হাত ধরে ঢালু বেয়ে নামতে শুরু করে তারা। পিছনের কমাণ্ডো হঠাৎ দেখতে পায়, সামনের চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছে এক হাবশী। তার এক হাতে ঢাল, অপর হাতে বর্শা। নিক্ষেপের জন্য তীরের মত তাক করে রেখেছে বর্শাটি। কমাণ্ডোদের উপর চাঁদের আলো পড়ছে না। নিশ্চিত কিছু বুঝে উঠতে পারেনি হাবশী এখনো। ধনুকে তীর জুড়ে দেয় পিছনের কমাণ্ডে। ছুটে যায় তীর। রাতের নিস্তব্ধতায় তীরের শাঁ শাঁ শব্দ কানে বাজে সকলের। হাবশীর ধমনিতে গিয়ে বিদ্ধ হয় তীরটি। মাটিতে পড়ে গিয়ে গড়িয়ে পড়তে শুরু করে সে। ঢালু বেয়ে নীচে নেমে আসে কমান্তোরা।

***

তরবারীর ধারাল বুক উম্মে আরারার ঘাড়ে রাখেন পুরোহিত। আবার উপরে তোলেন। পার্শ্বস্থিত নারী-পুরুষরা সেজদা থেকে উঠে আসন গেড়ে বসে ধীর অথচ জ্বালাময়ী কণ্ঠে কী যেন পাঠ করতে শুরু করে। তরবারী উঁচু করে দাঁড়িয়ে পুরোহিত। দু-একটি নিঃশ্বাসের বিলম্ব আর। তরবারী নীচে নামলো বলে। ঠিক এমন সময়ে একটি তীর এসে বিদ্ধ হয় পুরোহিতের বগলে। তরবারী ধরা হাতটা তার নীচে পড়ে যায়নি এখনো। একই সঙ্গে আরো তিনটি তীর এসে বিদ্ধ হয় পাজরে। চীৎকার জুড়ে দেয় মেয়েরা। জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে হাবশী পুরুষরা। দেখতে না দেখতে আরো এক ঝাঁক তীর এসে আঘাত করে পুরোহিতের সহচরদের। ধরাশায়ী হয়ে পড়ে দু ব্যক্তি। এদিক-সেদিক দৌড়ে পালিয়ে যায় মেয়েরা। উম্মে আরারার বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ নেই সেদিকে। দিব্যি মাথা নত করে বসে আছে সে।

দ্রুত দৌড়ে বেদীতে এসে পৌঁছে কমান্ডোরা। চবুতরায় উঠে তুলে নেয় উম্মে আরারাকে। নেশার ঘোরে প্রলাপ বকছে সে এখনো। এক জানবাজ নিজের গায়ের জামা খুলে পরিয়ে দেয় তাকে। উম্মে আরারাকে নিয়ে রওনা দেয় তারা।

হঠাৎ বার-তেরজন হাবশী বর্শা ও ঢাল নিয়ে ছুটে আসে একদিক থেকে। বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে সুলতান আইউবীর কমাণ্ডোরা। তীর-কামান ছিলো তাদের চারজনের কাছে। তীর ছুঁড়ে তারা। অবশিষ্টরা লুকিয়ে থাকে এক জায়গায়। হাবশীরা নিকটে এলে পিছন দিক থেকে তাদের উপর হামলা চালায় লুকিয়ে থাকা কমাণ্ডোরা। এক তীরন্দাজ কমাণ্ডো কামানে সলিতাওয়ালা তীর স্থাপন করে। সলিতায় আগুন ধরিয়ে ছুঁড়ে মারে উপর দিকে। বেশ উপরে উঠে থেমে যখন তীরটি নীচে নামতে শুরু করে, তখন প্রজ্বলিত হয়ে উঠে তীরের মাথায়। জড়ানো সলিতার শিখা।

মেলার জাঁকজমক মন্দীভূত হয়নি এখনো । উৎসবে অংশগ্রহণকারীদের পাঁচশত লোক মেলাঙ্গন থেকে পৃথক হয়ে তাকিয়ে আছে পাহাড়ী ভূখণ্ডের প্রতি। বেশ দূরে শূন্যে একটি শিখা দেখতে পায় তারা। হঠাৎ প্রজ্বলিত হয়ে নীচে নামছে শিখাঁটি। তারা উট-ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে আছে। কমার আছে তাদের সঙ্গে। প্রথমে ধীরপায়ে এগিয়ে চলে তারা, যেন সন্দেহ না জাগে কারুর মনে। খানিক দূরে গিয়েই দ্রুতগতিতে ঘোড়া ছুটায়। মেলার লোকেরা মদ-জুয়া, উলঙ্গ নারীর নাচ-গান আর গণিকাদের নিয়ে এতই ব্যস্ত যে, তাদের দেবতাদের উপর কি প্রলয় ঘটে যাচ্ছে, তার খবরও নেই তাদের।

কমান্ডো বাহিনী এই আশঙ্কায় অগ্নি-তীর নিক্ষেপ করেছিলো যে, হাবশীদের সংখ্যা বোধ হয় অনেক হবে। কিন্তু পাঁচশত সৈন্য অকুস্থলে পৌঁছে মাত্র চৌদ্দ-পনেরটি লাশ দেখতে পায়। তেরটি হাবশীদের আর দুটি তাদের দু । কমাণ্ডোর। হাবশীদের বর্শার আঘাতে শাহাদাতবরণ করেছিলো কমাণ্ডো দুজন।

ঘটনাস্থলে পৌঁছে চারদিকের খোঁজ-খবর নেয় সৈন্যরা। তারা পাথরের মুখমণ্ডলের নিকট ও পাতাল কক্ষে যায়। যা পেলো কুড়িয়ে নেয় সব। তন্মধ্যে ছিলো একটি ফুল। ফুলটি প্রাকৃতিক নয়–কৃত্রিম। কাপড় দিয়ে তৈরী করা হয়েছিলো ফুলটি। নির্দেশনা মোতাবেক পাঁচশত সৈন্য জায়গাটি দখল করে অবস্থান নেয় সেখানে। আর উম্মে আরারাকে ঘোড়ার পিঠে তুলে কায়রো অভিমুখে রওনা হয় কমাণ্ডো বাহিনী।

ভোর বেলা।

মেলার রওনক শেষ হয়ে গেছে। রাতভর মদপান করে এখনও অচেতন পড়ে আছে বহু লোক। দোকানীরা যাওয়ার জন্য মালামাল গুটিয়ে নিচ্ছে। মেয়ে-বেপারীরাও যাচ্ছে চলে। মেলাঙ্গন থেকে বের হওয়ার জন্য মরুবাসীদের ভীড় পড়ে গেছে রাস্তায়।

আংগুক গোত্রের লোকেরা-অধীর অপেক্ষায় প্রহর গুণছে কখন তাদের মাঝে বলী দেয়া মেয়ের চুল বিতরণ করা হবে।

এ গোত্রের যারা দূর-দূরান্তের পল্লি অঞ্চলে বাস করে, তারা এক নাগাড়ে পাহাড়ী অঞ্চল থেকে দূরে দাঁড়িয়ে দেবপুরীর প্রতি তাকিয়ে আছে। বৃদ্ধ ও প্রবীণরা নবীনদের সান্ত্বনা দিচ্ছে, একটু অপেক্ষা করো, পুরোহিত এক্ষুনি চলে আসবেন, দেবতাদের সন্তুষ্টির সুসংবাদ প্রদান করবেন এবং আমাদের মাঝে চুল বিতরণ করবেন। কিন্তু দেবতাদের কোন পয়গাম যে আসবে না, তা কেউ জানে না।

দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। দেবতাদের কোন সংবাদ আসছে না। সংশয়ে পড়ে যায় এক শ্রেণীর যুবক। সব মিথ্যা বলে সন্দেহ জাগে তাদের মনে। কিন্তু কারুর এতটুকু সাহস নেই যে, ওখানে গিয়ে দেখে আসবে, পুরোহিত আসছেন না কেন।

***

ডাক্তারকে ডেকে আন। মেয়েটা নেশার ঘোরে এমন করছে। বললেন সুলতান আইউবী।

উম্মে আরারা সুলতান আইউবীর সামনে বসে আছে এবং বিড় বিড় করে বলছে–আমি আঙ্গুকের মা। তুমি কে? তুমি তো দেবতা নও। আমার স্বামী কোথায়? আমার মাথাটা কেটে ফেলো এবং দেবতাকে দিয়ে দাও; আমাকে আমার ছেলেদের জন্য উৎসর্গ করো।

অনর্গল-বকে যাচ্ছে উম্মে আরারা। নেশার ঘোরে আচ্ছন্ন সে। মাথাটা দুলছে তার।

ডাক্তার আসেন। মেয়েটির অবস্থা দেখেই তিনি সব বুঝে ফেলেন। সামান্য ঔষধ খাইয়ে দেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই তার চোখ দুটো বুজে আসে। বিছানায় শুইয়ে দেয়া হলো তাকে। গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে উম্মে আরারা।

ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ শুনলেন আইউবী। অভিযান চালিয়ে সেই পার্বত্য অঞ্চলে কী কী পাওয়া গেলো, তা-ও শোনানো হলো তাকে। সুলতান আইউবী নায়েব সালার আন-নাসের ও বাহাউদ্দীন শাদ্দাদকে নির্দেশ দেন, পাঁচশত সৈন্য নিয়ে আপনারা এক্ষুনি রওনা হন। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সঙ্গে নিন। মূর্তিটিকে ধুলায় মিশিয়ে দিন। জায়গাটিকে ঘেরাও করে রাখুন। আক্রমণ আসলে মোকাবেলা করবেন। এলাকার মানুষ যদি নতি স্বীকার করে, তাহলে তাদেরকে স্থানটি দেখিয়ে মমতার সাথে বুঝিয়ে দেবেন, এ ছিলো স্রেফ প্রতারণা।

বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ তার ডায়রীতে লিখেছেন

পাঁচশত সৈন্য নিয়ে আমরা ওখানে পৌঁছি। পূর্ব থেকে আমাদের যে বাহিনীটি ওখানে অবস্থান নিয়েছিলো, তার কমাণ্ডার আমাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। হাজার হাজার সুদানী কাফ্রী দূরে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের কেউ কেউ উট-ঘোড়ায় সওয়ার হাতে তাদের বর্শা, তরবারী ও কামান-ধনুক।

আমাদের সমুদয় সৈন্যকে আমরা সেই পার্বত্য অঞ্চলের চারদিকে এমনভাবে দাঁড় করিয়ে দেই যে, তাদের মুখ বাইরের দিকে। তারা তীর-ধনুক বর্শা নিয়ে প্রস্তুত দাঁড়িয়ে থাকে। আমরা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আশঙ্কা করছিলাম।

আমি আন-নাসেরের সঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করি। মূর্তিটি দেখেই আমি বললাম, এতো ফেরাউনদের প্রতিকৃতি।

আশে-পাশে পড়ে আছে হাবশীদের লাশ। আমরা পুরো এলাকা ঘুরে-ফিরে দেখি । দুটি পাহাড়ের মাঝে একটি জীর্ণ প্রাসাদ। ফেরআউনী আমলের একটি মনোরম প্রাসাদ এটি। দেয়ালের গায়ে সে যুগের কিছু লিপি। আমাদের সন্দেহ রইলো না, এখানে ফেরআউনের-ই বাস ছিলো।

দেয়ালের মত খাড়া একটি পাহাড়ের পাদদেশে একটি ঝিল। ঝিলে অনেকগুলো কুমীর। পাহাড়ের কোল ঘেষে পাহাড়ের ভিতরে ঢুকে গেছে ঝিলের পানি। পানির উপর পাহাড়ের ছাদ। বড় ভয়ঙ্কর জায়গা। আমাদের দেখে সবগুলো কুমীর এসে পড়ে কুলে । চেয়ে চেয়ে আমাদের দেখতে থাকে।

আমি সৈনিকদের বললাম, হাবশীদের লাশগুলো ধরে ধরে ঝিলে নিক্ষেপ করো; ক্ষুধার্ত প্রাণীগুলোর ভাল আহার মিলবে। সৈনিকরা লাশগুলোকে টেনে-হেঁচড়ে ঝিলে নিক্ষেপ করে। কুমীরের সংখ্যা যে কতো, তার হিসেব নেই। ফেলা মাত্র দেখলাম, লাশগুলো যেন দৌড়ে পাহাড়ের অভ্যন্তরে চলে গেলো। সব শেষে আসলো পুরোহিতের লাশ। বহু মানুষকে সে কুমীরের মুখে নিক্ষেপ করেছিলো। আর আজ সে নিজেই নিক্ষিপ্ত হলো সেই কুমীরের মুখে।

দুজন সিপাহী চারটি সুদানী মেয়েকে ধরে আনে। তারা এক স্থানে লুকিয়ে ছিলো। মেয়েগুলো বিবস্ত্র । কোমরে বাঁধা দুটি পাতা। একটি সামনে, অপরটি পিছনে। আমি ও নাসের অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। সৈনিকদের বললাম, জলদি এদের ঢাকো। সৈনিকরা তাদের পোশাক পরায়। এবার আমরা তাদের পাণে তাকালাম। মেয়েগুলো বেশ রূপসী। তারা কাঁদছে। ভয়ে থ থ করে কাঁপছে। তারা অভয় পেয়ে কথা বলে। খুলে বলে সেখানকার সব ইতিবৃত্ত। বড় লজ্জাকর সেসব ঘটনা। নারী জাতির এ অবমাননা কোন মুসলমানের সহ্য হওয়ার কথা নয়। আপন-পর, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ইসলাম সব নারীকে সমান ইজ্জত করে। একজন মুসলমানের নিকট একজন মুসলিম নারীর যে মর্যাদা, একজন অমুসলিম নারীর মর্যাদা তার চেয়ে কোন অংশে কম নয়। যা হোক, মেয়েগুলোর বক্তব্যে আমরা বুঝলাম যে, তারা ফেরআউনদের খোদা বলে বিশ্বাস করে। তাদের গোত্রের মানুষ মানুষকে খোদা মানে।

স্থানটি বেশ মনোরম। সবুজ-শ্যামলিমায় ঘেরা সমগ্র এলাকা। ভেতরে পানির ঝরনা। এই ঝরনার পানি থেকেই ঝিলের উৎপত্তি। ঘন সন্নিবিষ্ট বৃক্ষরাজি ছায়া দিয়ে রেখেছে। কোন এক সৌখিন ফেরআউনের স্থানটি পসন্দ হয়ে গেলে একে সে বিনোদপুরি বানিয়েছিলো। নিজের খোদায়িত্বের প্রমাণস্বরূপ তৈরী করেছিলো এ মূর্তিটি। নির্মাণ করেছিলো পাতাল-কক্ষ। বহুদিন আমোদ করে গেছে সে এখানে।

অবশেষে এক সময় দিন বদলে যায়। খসে পড়ে ফেরআউনদের ক্ষমতার নক্ষত্র। মিসরে আসে আরেক মিথ্যা ধর্ম। কেটে যায় কিছু দিন। সবশেষে জয় হয় সত্যের। লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর মুখরিত ধ্বনি শুনতে পায় মিসর। আল্লাহর সমীপে মাথা নত করে মিসরের মানুষ। কিন্তু সকলের চোখে ধুলো দিয়ে মিথ্যা তখনো টিকে থাকে এই পার্বত্য অঞ্চলে। আল-হামদু লিল্লাহ, মহান আল্লাহর অপার কৃপায় আমরা মিথ্যার এই শেষ চিহ্নটুকুও মুছে ফেললাম। মূর্তিপূজাসহ জঘন্যতম কুসংস্কার থেকে এ ভূখণ্ডটিকে পবিত্র করলাম।

***

সৈন্যরা স্থানটিকে ঘিরে ফেলে। প্রস্তর-নির্মিত বেদীটি ভেঙ্গে চুরমার করে। চবুতরাটিও গুঁড়িয়ে দেয়। পাতাল-কক্ষটি ভরে দেয় ইট-পাথর দিয়ে। বাইরে হাজার হাজার হাবশী বিস্ময়াভিভূত দাঁড়িয়ে কাণ্ড দেখছে। ডেকে তাদেরকে ভিতরে নিয়ে দেখান হয়, এখানে কিছু-ই ছিলো না। বলা হয়, ধর্ম-বিশ্বাসের নামে তোমাদের সাথে এতোকাল শুধু প্রতারণা-ই করা হয়েছে। মেয়ে চারটিকে তাদের হাতে তুলে দেয়া হলো। মেয়েদের বাপ-ভাইরাও উপস্থিত ছিলো সেখানে। আপন আপন কন্যা ও বোনকে নিয়ে যায় তারা। তাদেরকে বলা হলো, এখানে একজন অসৎ লোক বাস করতো। ধর্মের নামে নারীর ইজ্জত ও মানুষের জীবন নিয়ে তামাশা করতো সে। এখন সে কুমীরের পেটে। এই হাজার হাজার হাবশীকে সমবেত করে তাদের উদ্দেশে কমাণ্ডার বক্তৃতা করেন তাদের ভাষায়। তারা সকলে-ই নীরব। তাদেরকে ইসলামের প্রতি আহ্বান করা হয়। এবারও তাদের মুখে কোন কথা নেই। কখনো কখনো মনে হচ্ছিলো, রক্ত নেমে এসেছে তাদের চোখে। প্রতিশোধের আগুনে পুড়ে মরছে যেন তারা। অবশেষে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে বলা হয় যদি তোমাদের সত্য খোদাকে দেখার ইচ্ছে থাকে, তাহলে এসো দেখিয়ে দিই। আর এখন তোমরা যে স্থানে বসে আছে, যদি তাকে মিথ্যা দেব-দেবীর আবাস মনে করে থাকো, তা-ও বলো; এই পাহাড়গুলোকেও আমরা ধুলোয় মিশিয়ে দিই। তার পরে তোমরা দেখবে কোন্ খোদা সত্য।

জ্ঞান ফিরে এসেছে উম্মে আরারার। মেয়েটি সুলতান আইউবীকে সে নিজের সব ঘটনা খুলে বলে। চৈতন্য ফিরে আসার পর এবার তার সব ঘটনা-ই মনে আসে। সে বলে, পুরোহিত দিন-রাত যখন-তখন তাকে উপভোগ করতো। বারবার একটি ফুল শোকাত তার নাকে। বলি দেয়ার কথাও পুরোহিত বলে রেখেছিলো তাকে। কমাণ্ডা বাহিনী যথাসময়ে গিয়ে না পৌঁছুলে এখন তার মস্তক থাকতো গর্তে আর দেহ থাকতো কুমীরের পেটে। ভয়ে কাঁপতে লাগলো মেয়েটি। চোখে অশ্রু নেমে আসে তার। সুলতান আইউবীর হাতে চুমো খেয়ে বললো, আল্লাহ আমাকে আমার পাপের শাস্তি দিয়েছেন। আমি জীবনে বহু পাপ করেছি। আপনি আমাকে আশ্রয় দিন। মানসিকভাবে বড় বিধ্বস্ত উম্মে আরারা।

সিরিয়ার এক বিত্তশালী ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে উম্মে আরারা জানায়, আমি তার কন্যা। লোকটি মুসলমান। বিখ্যাত ব্যবসায়ী। সিরিয়ার আমীরদের সঙ্গে তার বন্ধুত্বের সম্পর্ক।

তৎকালে আমীরগণ একটি শহর কিংবা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভূখণ্ড শাসন করতো। কেন্দ্রীয় শাসনের অধীনে কাজ করতো তারা। দশম শতাব্দীর পর এই আমীরগণ সম্পূর্ণরূপে বিলাসিতায় ডুবে যায়। বড় বড় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে। তারা তাদের সঙ্গে ব্যবসা করতো এবং সুদও গ্রহণ করতো। সুন্দরী মেয়েদের দ্বারা পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে তাদের হেরেম। তারা নারী আর মদে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে পড়ে।

উম্মে আরারাও এমনি এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর কন্যা। বার-তের বছর বয়সেই সে পিতার সঙ্গে আমীরদের নাচ-গানের আসরে যোগ দিতে আরম্ভ করে। অসাধারণ সুন্দরী বলে-ই বোধ হয় পিতা শৈশব থেকেই তাকে আমীরদের কালচারে অভ্যস্ত করে তুলতে শুরু করেছিলো।

উম্মে আরারাহ জানায় আমার বয়স যখন চৌদ্দ, তখন-ই আমীরগণ আমার প্রতি প্রলুব্ধ হয়ে ওঠে। দুজন আমীর আমাকে বহুমূল্যবান উপহারও দিয়েছিলেন। আমি নিজেকে পাপের হাতে তুলে দেই। মোল বছর বয়সে পিতার অজান্তে গোপনে রক্ষিতা হয়ে যাই এক আমীরের। কিন্তু বাস করতাম নিজের ঘরে।

বিত্তশালী পিতার কন্যা উম্মে আরারা। ঐশ্বর্যের মাঝে তার জন্ম, লালন-পালন ও যৌবন লাভ। লাজ-লজ্জার সঙ্গে কোন পরিচয় ছিলো না তার। তিন বছরের মাথায় পিতার হাত থেকে বেরিয়ে যায় সে। স্বাধীন চিত্তে আরো দুজন আমীরের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে নেয়। বাকপটু রূপসী কন্যা হিসেবে উম্মে আরারার নাম এখন সকলের মুখে মুখে।

অবশেষে পিতা তার সঙ্গে সমঝোতা করেন। পিতার সহযোগিতায় তিনজন। আমীর তাকে নতুন এক প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন। ইসলামী সাম্রাজ্য ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত এই তিন আমীর। উম্মে আরারার পিতাও এই ষড়যন্ত্রে জড়িত। খেলাফতের মূলোৎপাটন করার কাজে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে উম্মে আরারাকে। এক সময়ে এক খৃষ্টানও এসে যোগ দেয় এ প্রশিক্ষণে।

স্বাধীন শাসক হওয়ার স্বপ্ন দেখছিলেন এই আমীরগণ। এর জন্যে প্রয়োজন খৃষ্টানদের সহযোগিতা। নুরুদ্দীন জঙ্গী ও খেলাফতের মাঝে ভুল-বুঝাবুঝির কাজে ব্যবহার করা হয় উম্মে আরারাকে। এ অভিযানে তিন খৃষ্টান মেয়েকে যুক্ত করে একটি টিম গঠন করে ক্রুসেডাররা।

কঠোর প্রশিক্ষণ দিয়ে উম্মে আরারাকে, তারা উপহারস্বরূপ খলীফা আল-আজেদের খেদমতে প্রেরণ করে। তার দায়িত্ব, প্রথমত খলীফার অন্তরে সালাহুদ্দীন আইউবীর প্রতি বিদ্বেষ ও শত্রুতা সৃষ্টি করা এবং সাবেক সুদানী ফৌজের যে কজন অফিসার এখনো বাহিনীতে রয়ে গেছে, তাদেরকে খলীফার কাছে ভিড়িয়ে সুদানীদেরকে আরেকটি বিদ্রোহের প্রতি উৎসাহিত করা। দ্বিতীয়ত সুদানী ফৌজকে বিদ্রোহে নামিয়ে অস্ত্র ও নানাবিধ উপায়ে তাদেরকে সহযোগিতা করার জন্য খলীফাকে প্রস্তুত করা এবং সম্ভব হলে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর একটি দলকে প্ররোচনা দিয়ে বিদ্রোহী বানিয়ে তাদেরকে সুদানীদের সঙ্গে যুক্ত করা। খলীফা আর কিছু করতে না পারলেও তাকে দিয়ে অন্তত এতটুকু করানো যে, নিজের নিরাপত্তা বাহিনীকে সুদানীদের হাতে অর্পণ করে নিজে সুলতান আইউবীর নিকট চলে যাবেন এবং তাকে বলবেন, আমার রক্ষী বাহিনী বিদ্রোহী হয়ে গেছে। সারকথা, সালাহুদ্দীন আইউবীর বিরুদ্ধে এমন একটি যুদ্ধক্ষেত্র প্রস্তুত করা, যা তাকে মিসর ছেড়ে পালাতে বাধ্য করে এবং বাকি জীবনটা তার একঘরে হয়ে কাটাতে হয়।

উম্মে আরারাহ সুলতান আইউবীকে জানায়, সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে তার জন্ম হয়েছিলো। কিন্তু পিতা তাকে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর-ই মূলোৎপাটনের প্রশিক্ষণ প্রদান করে এবং ইসলামী সাম্রাজ্যের আমীরগণ শত্রুর সঙ্গে যোগ দিয়ে তাকে আপন সাম্রাজ্যের পতনের কাজেই ব্যবহার করে।

রূপ-যৌবন, বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা ও বাকচাতুর্যে অল্প কদিনে খলীফাকে নিজের মুঠোয় নিয়ে আসে উম্মে আরারা। সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলে সে খলীফাকে। রজবকে-ও জড়িত করে নেয় এ ষড়যন্ত্রে। আরো দুজন সামরিক কর্মকর্তাকে সঙ্গে নিয়ে আইউবীর বিরুদ্ধে মাঠে নামে রজব। ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে খলীফার নিরাপত্তা বাহিনীতে মিসরীদের বাদ দিয়ে সুদানীদের টেনে আনতে শুরু করে সে।

উম্মে আরারা খলীফার মহলে এসেছে দু-আড়াই মাস হলো। এই স্বল্প সময়ে-ই সে রাণী হয়ে গেছে মহলের। গোটা কসরে খেলাফত এখন ওঠে-বসে তার-ই ইঙ্গিতে।

উম্মে আরারা সুলতান আইউবীকে আরো জানায়, খলীফা আপনাকে হত্যা করাতে চান। হাশীশীদের সঙ্গে যোগ দিয়ে হত্যার আয়োজন সম্পন্ন করেছে। রজব।

ইসলাম ও রাষ্ট্রদ্রোহী তৎপরতা এবং বিলাস-প্রিয়তায় বিরক্ত হয়ে সুলতান আইউবী খলীফার বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে দিয়েছিলেন আগেই। এর মধ্যে কাকতালীয়ভাবে ঘটে গেলো এসব ঘটনা। খলীফা যাদের দ্বারা সুলতান আইউবীকে কোণঠাসা করাতে চেয়েছিলেন, তাদেরই হাতে মহলের রাণী উম্মে, আরারার অপহরণ এবং আইউবীর হাতে তার উদ্ধারের মধ্য দিয়ে দৈবাৎ ফাঁস হয়ে গেলো অনেক তথ্য। অবশেষে সুলতান কর্তৃক আইউবীর হত্যার ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনাও গোপন রইলো না। উম্মে আরারার অপহরণকে কেন্দ্র করেই। ইতিমধ্যে সুলতান আইউবী খলীফার নিরাপত্তা বাহিনী থেকে বদলি করে দিয়েছেন রজবকে। তার স্থলে প্রেরণ করেছেন নিজের বিশ্বস্ত এক নায়েব সালারকে। কিন্তু এসব ঘটনা সুলতান আইউবীর জন্য জন্ম দেয় নতুন এক বিপদ।

উম্মে আরারাকে নিজের আশ্রয়ে রাখলেন সুলতান। অনুতাপের আগুনে পুড়ে মরছে মেয়েটি। অতীত পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চায় সে। ভয়াবহ এক বিপদে ফেলে আল্লাহ তার চোখ খুলে দিয়েছেন। ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ নেবেন, ঠাণ্ডা মাথায় ভাবছেন সুলতান আইউবী। 

ফেরআউনদের শেষ চিহ্ন ধুলোয় মিশিয়ে পরদিন আন-নাসের ও বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ ফিরে আসেন কায়রো।

***

আট দিন পর।

রাতের শেষ প্রহর। ঘুমিয়ে আছেন সুলতান আইউবী। চাকর এসে তাকে জাগিয়ে বলে, আন-নাসের, আলী বিন সুফিয়ান এবং আরো দুজন নায়েব এসেছেন। ধড়মড় করে উঠে বৈঠকখানায় ছুটে যান সুলতান। অভ্যাগতদের একজন এক টহল বাহিনীর কমাণ্ডার।

সুলতান আইউবীকে জানানো হলো, প্রায় ছয় হাজার সুদানী সৈন্য মিসরের সীমান্ত অতিক্রম করে একস্থানে শিবির স্থাপন করেছে। তাদের মধ্যে আছে পদচ্যুত সুদানী বাহিনীর কিছু সদস্য এবং কাফ্রী গোত্রের বেশ কিছু লোক। এই কমাণ্ডার তথ্য জানার জন্য ছদ্মবেশে দুজন উষ্ট্রারোহীকে তাদের ছাউনিতে প্রেরণ করেছিলো। প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক কায়রো আক্রমণ করা তাদের উদ্দেশ্য। নিজেদেরকে পর্যটক দাবি করে উষ্ট্রারোহীদ্বয় বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সালাহুদ্দীন আইউবীর বিরুদ্ধে কথা বলে এবং এই বলে ফিরে আসে যে, এ অভিযানকে সফল করার জন্য প্রয়োজনে তারা সৈন্য দিয়ে তাদের সাহায্য করবে। প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক তারা এদিক-ওদিক থেকে আরো সৈন্য আগমনের অপেক্ষা করছে এবং আগামী কাল-ই সেখান থেকে কায়রো অভিমুখে রওনা হবে।

সব শুনে সুলতান আইউবী আদেশ করলেন, খলীফার নিরাপত্তা বাহিনীতে মাত্র পঞ্চাশজন সৈন্য আর একজন কমাণ্ডার রেখে অন্যদের ছাউনিতে ডেকে আনন। খলীফা আপত্তি জানালে বলবে, এ আমার আদেশ।

সুলতান আইউবী আলী বিন সুফিয়ানকে বললেন, আপনার ব্রাঞ্চের সুদানী ভাষায় পারদর্শী এমন একশত লোককে সুদানী বিদ্রোহী বেশে এই কমাণ্ডারের সঙ্গে এক্ষুনি রওনা করিয়ে দিন। কমাণ্ডারের প্রতি দৃষ্টিপাত করে বললেন, এ একশত লোক ঐ দু উজ্জ্বারোহীর সঙ্গে সুদানী বাহিনীতে গিয়ে যোগ দেবে। উষ্ট্রারোহী সান্ত্রী দুজন বলবে, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আমরা তোমাদের সাহায্য নিয়ে এসেছি। তাদেরকে বলে দেবে, যেন তারা বাহিনীর গতিবিধি সম্পর্কে আমাদের অবহিত করে এবং রাতে তাদের পশু ও রসদ কোথায় থাকে, তা চিহ্নিত করে রাখে সুলতান আইউবী আন-নাসেরকে বললেন, আপনি অতি দ্রুতগামী অশ্বারোহী, কমাণ্ডা বাহিনী এবং ক্ষুদ্র একটি মিনজানিক প্লাটুন প্রস্তুত করে রাখুন।

আমি ভেবেছিলাম, সরাসরি আক্রমণ চালিয়ে শহর থেকে দূরে থাকতেই ওদের শেষ করে দেবো। বললেন আন-নাসের।

না, মনে রেখো নাসের! দুশমনের সংখ্যা তোমাদের অপেক্ষা কম হলেও মুখোমুখি সংঘাত এড়িয়ে চলবে। রাতে কমাণ্ডো বাহিনী ব্যবহার করবে, দুশমনের উপর অতর্কিতে হামলা চালাবে। পার্শ্ব থেকে, পিছন থেকে আঘাত হেনে পালিয়ে যাবে । দুশমনের রসদ নষ্ট করবে, পশু ধ্বংস করবে। তাদের অস্থির করে রাখবে ও শত্রু বাহিনীতে বিশৃংখলা সৃষ্টি করবে। তাদের সামনে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ দেবে না। ডানে-বাঁয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যেতে বাধ্য করবে। মুখোমুখি সংঘাতে লিপ্ত হতে হলে মনে রাখবে, রণাঙ্গন মরুভূমি। সর্বপ্রথম পানির উৎস দখল করবে। সূর্য এবং বায়ুকে তাদের প্রতিকূলে রাখবে। তাদের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি করে নিজের যুৎসই জায়গায় নিয়ে যাবে। মনে রাখবে, সুদানীদের কায়রো পর্যন্ত পৌঁছার কিংবা আমাদের সৈন্যদেরকে মুখোমুখি লড়াইয়ে জড়িয়ে ফেলার স্বপ্ন আমি পূরণ হতে দেব না।

সুলতান আইউবী আলী বিন সুফিয়ানকে বললেন, যে একশত সৈন্যকে সুদানী বাহিনীর সঙ্গে যোগ দিতে পাঠাবে, তাদের বলে দেবে যেন তারা ছাউনিতে গুজব ছড়ায়, ছয়-সাত দিনের মধ্যে সালাহুদ্দীন আইউবী ফিলিস্তীন আক্রমণ করতে যাচ্ছেন। কাজেই আমাদের কটা দিন অপেক্ষা করে তার অনুপস্থিতির সময়টাতে কায়রো আক্রমণ করতে হবে।

এমনি বেশ কিছু আদেশ-নির্দেশনা দিয়ে সুলতান আইউবী বললেন, আজ আমি কায়রো থাকবো না। কায়রো থেকে বেশ দূরের একটি জায়গার নাম বললেন তিনি। সেখানে তিনি দুশমনের কাছাকাছি তার হেডকোয়ার্টার রাখতে চান; যাতে সরাসরি নিজে যুদ্ধের তত্ত্বাবধান করতে পারেন।

বৈঠকখানায়-ই ফজর নামায আদায় করেন সকলে। সুলতান আইউবীর পরিকল্পনা মোতাবেক কর্মতৎপরতা শুরু হয়ে যায়। প্রস্তুতির জন্য সুলতান নিজ কক্ষে চলে যান।

সুদানীদের সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে চলেছে। ইতিপূর্বে তাদের একটি বিদ্রোহ শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছিলো দু বছর হলো। আবার বিদ্রোহ করার জন্য প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছিলো তখন থেকেই। সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছিলো খৃষ্টানরা। বিপুলসংখ্যক গুপ্তচর ছড়িয়ে দিয়েছিলো তারা মিসরে। একদিন যে সুদানীরা কায়রো আক্রমণ করবে, তা ছিলো সুনিশ্চিত। কিন্তু তা এতো তাড়াতাড়ি, এমন আচম্বিত হয়ে যাবে, তা ভাবেননি সুলতান আইউবী। হাবশী গোত্রের উপর সুলতান আইউবীর সামরিক অভিযানে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলো সুদানীরা। তার-ই প্রতিশোধ নেয়ার উদ্দেশ্যে তার এই আকস্মিক সেনা অভিযান। হাবশীদের উপর আইউবীর সামরিক অভিযানের পর পাঁচ-সাত দিনের মধ্যেই তারা সেনা সমাবেশ ঘটায় এবং কায়রো আক্রমণের জন্য রওনা হয়।

দু উষ্ট্রারোহীর সঙ্গে একশত সশস্ত্র মুসলিম সেনা যখন সুদানী বাহিনীতে যোগ দেয়, সুদানীরা তখন মিসর সীমান্ত থেকে বেশ ভিতরে পৌঁছে গিয়ে ছাউনী ফেলেছে। সুলতান আইউবী রাতে শহর ত্যাগ করে এমন স্থানে চলে যান, যেখান থেকে সুদানীদের গতিবিধির খবর নেয়া ছিলো নিতান্ত সহজ। সুদানী বাহিনীতে অনুপ্রবেশকারী আইউবীর সেনারা কর্মকর্তাদের জানায়, সুলতান আইউবী কয়েকদিনের মধ্যে ফিলিস্তীন আক্রমণ করতে যাচ্ছেন। এ সংবাদ শুনে সুদানী সেনা কর্মকর্তারা উফুল্ল হয়ে ওঠে। আইউবীর অনুপস্থিতির সময়টিতে-ই তারা কায়রো অভিযান পরিচালিত করবে বলে স্থির করে। ফলে এ ছাউনী আরো দু দিন বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। পরদিন রাত থেকে সুলতান আইউবীর নিকট তাদের খবরা-খবর আসতে শুরু করে।

তারও পরের রাতে সুলতান আইউবী পাঁচটি মিজানিক, বেশ কিছু অগ্নিগোলা ও অগ্নিতীর দিয়ে পঞ্চাশজন অশ্বারোহী প্রেরণ করেন।

মধ্য রাত। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সুদানী বাহিনী। এমন সময়ে তাদের রসদ-ডিপোতে অগ্নিগোলা নিক্ষিপ্ত হতে শুরু করে। পরক্ষণেই ছুটে আসতে শুরু করে অগ্নিতীর। ভয়ঙ্কর অগ্নিশিখায় আলোকিত হয়ে ওঠে মধ্য রাতের নিঝুম শূন্য আকাশ। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে সুদানী বাহিনীতে। সঙ্গে সঙ্গে মিনজানিকগুলোকে সেখান থেকে পিছনে সরিয়ে নিয়ে যায় আইউবীর সেনারা। পঞ্চাশজন অশ্বারোহী তিন-চারটি খণ্ডে বিভক্ত হয়ে দ্রুত ঘোড়া ছুটায় এবং সুদানী বাহিনীর ডান ও বাম পার্শ্বের সৈন্যদের পায়ে পিষে এবং বর্শা দ্বারা দমাদম আঘাত হেনে চোখের পলকে উধাও হয়ে যায়। খাদ্য-সম্ভারে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে আর আতঙ্কিত উট-ঘোড়াগুলো দিগ্বিদিক ছুটাছুটি করছে। সুলতান আইউবীর সৈন্যরা এ ছাউনীতে আরো একবার হামলা চালায় এবং বৃষ্টির মতো তীর নিক্ষেপ করে হাওয়া হয়ে যায়।

পরদিন সংবাদ পাওয়া গেলো, আগুনে পুড়ে, ঘোড়া ও উটের পদতলে পিষ্ট হয়ে ও সুলতান আইউবীর কমাণ্ডা বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে অন্তত চারশত সুদানী সৈন্য নিহত হয়েছে। সমুদয় খাদ্যসম্ভার ও তীরের ডিপো পুড়ে ভস্ম হয়ে গেছে।

অবশেষে সুদানী সৈন্যরা ছাউনী তুলে সেখান থেকে চলে যায় এবং রাতে এমন এক স্থানে শিবির স্থাপন করে, যার আশে-পাশে উঁচু উঁচু মাটির টিলা । কমাণ্ডো হামলার আশঙ্কা নেই এখানে। এবার টহল বাহিনী ছাউনীর চারপাশে অনেক দূর পর্যন্ত পাহারা দিতে শুরু করে। কিন্তু তারপরও আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পেলো না। তারা ঠিক আগের রাতের মত আক্রমণের শিকার হয়। দুজন প্রহরীকে কাবু করে খুন করে ফেলে সুলতান আইউবীর কমাণ্ডোরা। টিলার উপর থেকে অগ্নিতীর ছুঁড়তে শুরু করে তীরন্দাজ বাহিনী। ভোরের আলো ফোঁটার পূর্ব পর্যন্ত এ হামলা চালিয়ে তারা উধাও হয়ে যায়। আক্রমণকারীরা কোত্থেকে এলো, কোথায়-ই বা গেলো কিছুই বুঝতে পারলো না সুদানী বাহিনী। এ হামলায় তারা গত রাত অপেক্ষা বেশী ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়।

সন্ধ্যার পর আলী বিন সুফিয়ান সুলতান আইউবীকে গুপ্তচর মারফত প্রাপ্ত রিপোর্ট সম্পর্কে অবহিত করেন। তিনি জানান, সুদানী বাহিনী আমাদের কমান্ডো বাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে অবগত হয়ে এ্যাকশন নেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এ পরিকল্পনা মোতাবেক তারা আগামী কাল-ই অভিযান পরিচালনা করবে। সুলতান আইউবী একটি রিজার্ভ ফোর্স আটকে রেখেছিলেন নিজের কাছে। গত দু রাতের অভিযানে অংশ নেয়নি তারা। তিনি জানতেন, দু একটি অপারেশনের পর দুশমন সতর্ক হয়ে যাবে। পর দিন তিনি সুদানী বাহিনীর ডানে ও বাঁয়ে চারশত করে পদাতিক বাহিনী প্রেরণ করেন। তাদেরকে বলে দেন, যেন তারা সুদানী বাহিনী থেকে আধা মাইল দূর দিয়ে সম্মুখে অগ্রসর হতে থাকে। সুদানীরা যখন দেখলো, শত্রু বাহিনীর দুটি দল রণসাজে তাদের পার্শ্ব দিয়ে এগিয়ে চলছে, তখন তারা সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে এবং শত্রুবাহিনী পিছন অথবা পার্শ্ব থেকে আক্রমণ করতে পারে, এ আশঙ্কায় দু পার্শ্বের সৈন্যদেরকে দুদিকে ছড়িয়ে দেয় এবং সুলতান আইউবীর এ দু পদাতিক বাহিনীর মোকাবেলার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।

সুলতান আইউবীর নির্দেশনা মোতাবেক তারা সামনে এগিয়ে চলে। ধোঁকায় পড়ে যায় সুদানীরা। ঠিক এমন সময়ে আচমকা পাঁচশত অশ্বারোহী টিলার আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে সুদানী বাহিনীর মধ্যস্থলে হামলা করে বসে। অশ্বারোহীদের এ আকস্মিক তীব্র আক্রমণে প্রলয় সৃষ্টি হয়ে যায় সমগ্র বাহিনীতে। পার্শ্ব থেকে তীরন্দাজ বাহিনী বৃষ্টির মত তীর ছুঁড়তে শুরু করে তাদের প্রতি। এভাবে সুলতান আইউবীর মাত্র তেরশত সৈন্য অন্তত ছয় হাজার শত্রুসেনাকে ক্ষণিকের মধ্যে বিপর্যস্ত করে তোলে। সু-কৌশলে গ্যাড়াকলে আটকিয়ে এমন শোচনীয়ভাবে তাদের পরাজিত করে যে, মিসরের মরুপ্রান্তর তাদের লাশে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। জীবনে রক্ষা পাওয়া সুদানীদের দু চারজন পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও বেশীর ভাগ-ই বন্দী হয় আইউবী বাহিনীর হাতে।

এ ছিলো সুদানীদের দ্বিতীয় বিদ্রোহ, যাকে তাদের-ই রক্তে ডুবিয়ে নিঃশেষ করে দিয়েছিলেন সুলতান আইউবী।

বন্দীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে তথ্য সংগ্রহ করেন সুলতান। গ্রেফতারকৃত সুদানী সব কমাণ্ডার এবং বিদ্রোহের ষড়যন্ত্রে জড়িত সকল কর্মকর্তা ও সিপাহীদের তিনি কারাগারে প্রেরণ করেন। জিজ্ঞাসাবাদে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত লোকদের নাম-পরিচয়ও পেয়ে যান সুলতান আইউবী। তিনি তাদের মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। রজব এবং তার মতো আরো যেসব সালার এই রাষ্ট্রদ্রোহী কর্মতৎপরতায় জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলো, তাদেরকে আজীবনের জন্য জেলখানার অন্ধকার প্রকোষ্ঠে নিক্ষেপ করা হলো। এ ষড়যন্ত্র এমন কতিপয় কর্মকর্তার সম্পৃক্ততার তথ্যও পাওয়া গেলো, যাদেরকে সুলতান আইউবীর একান্ত অনুগত ও বিশ্বস্ত মনে করা হতো। এ তথ্য পেয়ে সুলতান আইউবী স্তম্ভিত হয়ে যান। তিনি তাঁর নির্ভরযোগ্য সালার ও অন্যান্য কর্মকর্তাদের জানিয়ে দেন, এ পরিস্থিতিতে মিসরের প্রতিরক্ষা এবং সালতানাতের অস্তিত্ব সুদৃঢ় করার জন্য এখনই আমাদের সুদান দখল করা একান্ত আবশ্যক।

সুলতান আইউবী খলীফা আল-আজেদের নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রত্যাহার করে নেন। খেলাফতের মসনদ থেকে খলীফাকে অপসারণ ঘোষণা দেন, এখন থেকে মিসর সরাসরি বাগদাদের খেলাফতের অধীনে পরিচালিত হবে। খেলাফতের একমাত্র মসনদ থাকবে বাগদাদে।

সুলতান আইউবী আটজন রক্ষীর সঙ্গে উম্মে আরারাকে নুরুদ্দীন জঙ্গীর নিকট পাঠিয়ে দেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *