2 of 3

১.৫৯ মনে করি এইখানে শেষ

মনে করি এইখানে শেষ
কোথা বা হয় শেষ।
আবার তোমার সভা থেকে
আসে যে আদেশ ।।

হাসপাতালের লোহার খাটে পিতৃদেব বাবু হয়ে বসে আছেন। গায়ে একটি সিল্কের চাদর। জামা পরার উপায় নেই। পইতে গোল করে গলায় ঝুলিয়ে রেখেছেন বৈষ্ণবের কঞ্চির মতো। কোলের ওপর হলুদ মলাটের একটি বই খোলা। দেখলেই চেনা যায়, শ্রীশ্রীসদ্গুরু সঙ্গ। সেদিন বলছিলেন, ধর্মজগতে এইরকম একটি ক্যানডিড ডায়েরি আর দ্বিতীয় নেই। মানুষকে মানুষ বলে মেনে নিয়ে ধর্মের পথে এগিয়ে যাবার এমন শিক্ষা আর কোনও গ্রন্থে আছে কি না জানা নেই। খুঁজে দেখতে হবে। কোনও লুকোচুরি নেই, ওপরচালাকি নেই। পড়তে পড়তে সেই কথাই আর একবার মনে হবে, নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্যঃ। কেউ মোড়কে মুড়ে দেবত্ব তোমার খোলে পুরে দিয়ে যাবে না। ভেতরটাকে আগে খালি করো, ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করো। এই আমির মৃত্যু হলে তবেই সেই আমি এসে ধরা দেবে। সহসা একদা আপনা হইতে/ভরি দিবে তুমি তোমার অমৃতে। গোস্বামীজি যদি আজ থাকতেন, ব্রহ্মচারীজি যদি থাকতেন, সামনে গিয়ে একবার দাঁড়াতুম। গুরু একদিনে যা পারেন একা তা করতে কয়েক জীবন লাগে। দুর্ভাগ্য আমার এই ধর্মভূমি আজ শূন্য।

ঘরে ঢোকার আগে কাকিমা ফিসফিস করে বললেন, খাবার আগে কোনও কিছু বোলো না যেন! অসুস্থ মানুষ, একবার মাত্র আহার করেন। সব পণ্ড হয়ে যাবে। আমার যা হবার তা তো হয়েইছে।

অবাক হয়ে মহিলার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলুম। আমি সন্তান হয়ে এই নিঃসঙ্গ মানুষটির জন্যে কখনও এভাবে ভাবিনি। ইনি কি তা হলে দেবী! আমার চিনতে ভুল হয়েছিল।

গ্রন্থে বড় তন্ময় হয়ে আছেন। মুখে কয়েকদিনের না কামানো দাড়ি একটা ঋষি-ঋষি ভাব এনেছে। পেছনে ছবির ফ্রেমের মতো জানলায় শরতের নীল আকাশ। মেঘের পেঁজা তুলো ভাসছে। সামনে গিয়ে দাঁড়াতে চোখ তুলে তাকালেন। চোখে অদ্ভুত এক সুদূরের দৃষ্টি। বেশ বোঝা যায় বহু দূরে চলে গেছেন। আমার অত্যন্ত ঈর্ষা হয়। অন্তরের হোমাগ্নি ধীরে ধীরে আমার চেয়ে প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠছে। এত কাণ্ড করে আগে শুরু করেও আমি হেরে যাচ্ছি।

বই মুড়তে মুড়তে পিতা বললেন, একী, তোমরা এরই মধ্যে এসে গেছ!

এরই মধ্যে কী, আজ একটু দেরিই হয়ে গেছে।

বউঠান, তুমিও আজ এসেছ! আজকের দিনটা বড় ভাল। আকাশের দিকে একবার তাকাও। মা আসছেন।

ভেবেছিলুম উত্তর দিতে গিয়ে কাকিমা হয়তো ভেঙে পড়বেন। অদ্ভুত সংযম। নিজেকে ঠিক ধরে রাখলেন। মৃদু হেসে বললেন, পৃথিবী উলটে গেলেও আজ আমি আসতুম। কেউ আটকাতে পারত না।

সত্যিই তাই। ওঁর পৃথিবী তো উলটেই গেছে। পিতৃদেব পা নামিয়ে চটি খুঁজতে খুঁজতে বললেন, একদিকে আমি বড় ভাগ্যবান। তোমাদের অযাচিত স্নেহ ভালবাসায় দিন আমার বেশ ভালই কাটছে। আচ্ছা, প্রফুল্লর কোনও খবর পেলে?

প্রশ্ন করে তিনি হাত ধোয়ার জন্যে ঘরের কোণের দিকে এগিয়ে গেলেন। আমি কাকিমার মুখের দিকে ভয়ে ভয়ে তাকালুম। কী উত্তর দেবেন? মিথ্যে বলবেন? কাকিমা ঠোঁটের ওপর। একটা আঙুল রাখলেন। কী আশ্চর্য, আমাকেই সাবধান করছেন।

টেবিলের ওপর টিফিন কেরিয়ার রেখে ঢাকনা খুলতে খুলতে বললেন, আপনি যা যা ভালবাসেন, সবই আজ বেঁধেছি। জানি না তাড়াহুড়োয় কেমন হল!

তোয়ালেয় হাত মুছতে মুছতে টেবিলের কাছে এসে পিতা বললেন, তুমি এ কী করেছ বউঠান? এত খাবার ক্ষমতা কি আমার আছে? তোমার যত্নে, এই ক’দিনে আমার ভুড়ি নেমে গেল।

চাদরটা বুক থেকে সরে গেছে। সাবধানে চাপা দিতে দিতে বললেন, কী অস্বস্তিকর হয়েছে। একবার দেখেছ? ঘষা লাগলেই শিউরে উঠছে। ভগবান আর ক’দিন যে ফেলে রাখবেন!

কথা বলতে বলতে আহারে বসলেন। কাকিমা পাশে দাঁড়িয়ে বাটি সাজিয়ে সাজিয়ে দিচ্ছেন। সরষে মাখা আস্ত একটি পার্শেমাছ ন্যাজা আর মুড়ো দু’পাশে বের করে ধনুকের মতো হয়ে আছে। কাকিমা তার ওপর ফোঁটাফোঁটা পাতিলেবুর রস ফেলছেন। কেউ জানে না, আমি জানি, এ হল চোখের জলের ফোঁটা। একই জগৎ মানুষের কাছে কীরকম ভিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়! যিনি আহারে বসেছেন, তার আকাশে ঝলমলে আলো, যিনি আহার করাচ্ছেন তার আকাশ কালো। আলো আর অন্ধকারের কেমন পাশাপাশি অবস্থান।

পিতা খেতে খেতে বললেন, আজ যা বেঁধেছ বউঠান! বহুকাল এমন সুস্বাদু রান্না খাইনি। আজ তুমি চুটিয়ে বেঁধেছ। এখন মনে হচ্ছে, আমি যদি হরিশঙ্কর না হয়ে ভীমসেন হতুম, তা হলে গোগ্রাসে সব খেয়ে ফেলতুম। রান্নাও এক সাধনা, তুমি সিদ্ধিলাভ করেছ। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন।

কাকিমা হাসার চেষ্টা করলেন। এইবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। বর্ষার প্রথম। বৃষ্টির মতো দু’দানা বড় বড় অশ্রুর ফোঁটা টিন-মোড়া টেবিলের ওপর শব্দ করে ঝরে পড়ল। পিতা হাত ধোয়ার জন্যে আসন ছেড়ে সবে উঠতে যাচ্ছিলেন, কাকিমার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে। বললেন, কী হল? আঘাত দিয়ে ফেললুম নাকি!

কাকিমা দাঁতে ঠোঁট চেপে ভীষণ চেষ্টা করছেন, আর যেন কান্না না আসে! পারলেন না। বাঁধন আলগা হয়ে গেছে। গাল বেয়ে হুহু করে জল নামছে। চোখে আঁচল চেপে ধরেছেন। এই প্রথম লক্ষ করলুম, ফরসা গোল হাতে কবজির কাছে রক্তের ধারা নেমে শুকিয়ে গেছে। জোর করে শাখা ভেঙে ফেলার সময় অসাবধানে ফুটে গেছে।

পিতা উঠে দাঁড়িয়েছেন। মাথায় দুজনেই প্রায় সমান সমান। দু’জনেরই সুঠাম শরীর। পিতাকে আজ রাজযোগীর মতো দেখাচ্ছে। কাকিমা যেন নিরাভরণ আশ্রমবালিকা। কিছুই বুঝতে না পেরে পিতা আমার দিকে তাকালেন, কী হল বলো তো!

আর চেপে রাখার কোনও মানে হয় না। ধীরে ধীরে বলেই ফেললুম, প্রফুল্লকাকা মারা গেছেন।

সেকী? তা কী করে হয়? ওর তো মরার বয়েস হয়নি। আমার চেয়ে অনেক ছোট। আমি এখনও বেঁচে, সে কেন মরবে এত তাড়াতাড়ি! কোথা থেকে তোমরা খবর পেলে?

একটু আগে বাড়িতে পুলিশ এসেছিল, সি আই ডি।

কী হয়েছিল?

খুন। মেরে ফেলেছে। পুলিশ তিনজনকে অ্যারেস্ট করেছে।

সেকী? ভদ্রলোকের ছেলে খুন হয়? ভুল কথা, মিথ্যে কথা।

কাকিমা দেয়ালে কাঁধ ঠেকিয়ে একপাশে কাত হয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে উঠছেন। আমাকে আবার বলতে হল, আজ্ঞে মিথ্যে নয়, ওঁর শেষ মুহূর্তে ব্যবহার করা বিভিন্ন জিনিস আমাদের দেখালেন, আর দেখালেন মৃত অবস্থায় ভোলা একটা ছবি।

সে তো নিদ্রিত অবস্থাও হতে পারে!

আজ্ঞে না, ঘুমন্ত অবস্থা আর মৃত অবস্থার তফাত দেখলেই ধরা পড়ে।

পিতৃদেব কোনওরকমে হাতমুখ ধুয়ে এলেন। কী পরিহাস ভাগ্যের! একটু আগে না জেনেই বলেছিলেন, আজ দিনটা কী ভাল! নীল আকাশ। দেখো মা আসছেন।

হাত মোছার কথা ভুলে গেছেন। মেঝেতে জল পড়ছে টপটপ করে। ভিজে হাতেই বুকের কাছে চাদর চেপে ধরে বললেন, তা হলে কী হবে? ডেডবডি আনার কী ব্যবস্থা হবে!

ডেডবডি আর নেই। ডিসপোজড অফ।

কেন, কার হুকুমে?

মৃত্যু হয়েছে বেশ কিছুদিন আগে।

বাঃ বেশ মজা! এক পাশ দিয়ে নিঃশব্দে এল, আর এক পাশ দিয়ে মাথা নিচু করে চলে গেল। কাউকে একবার জানতে দিলে না। ও কি ফুল ছিল? ও কি পাতা ছিল? ও তো মানুষ ছিল। শিল্পী ছিল। অমন তবলা কে আর বাজাবে? তা বলে বেঁচেও জ্বালাবে, মরেও জ্বালাবে!

পিতা ধীরে ধীরে কাকিমার দিকে এগোতে লাগলেন। আমার ভেতরটা বহুক্ষণ শূন্য হয়ে গেছে। সাধক এই শূন্যতায় ঈশ্বর লাভ করেন। আমি তো এক মিনমিনে কল্পবিলাসী। আমি আর কী পাব! পিতৃদেবের ডান হাত সামান্য ইতস্তত করে কাকিমার মাথার পেছন দিক স্পর্শ করল।

বউঠান, যা হবার তা তো হয়েইছে। সহ্য করা ছাড়া মানুষের আর কী করার আছে? ভাগ্যকে যে মানতেই হবে।

জল-ভরা চোখে পিতার দিকে তাকিয়ে কাকিমা বললেন, আমি এখন কী করব? আমি এখন কোথায় যাব? আমার যে কেউ নেই বটঠাকুর!

কেন, তোমার মামাশ্বশুর? পয়সাঅলা মানুষ। ভোগ করার কেউ নেই।

প্রবল আতঙ্কে কাকিমা বললেন, না না, মরে গেলেও আমি আর ওখানে যাব না।

তা হলে, তুমি আমাদের কাছেই থাকবে। আমাদের জন্যে তুমি যা করেছ, সে ঋণ ভোলার নয়। আমাদের দিন চলে গেলে, তোমার দিনও চলে যাবে।

যদি জোর করে নিয়ে যেতে চায়?

তুমি যাবে না।

কী অধিকারে থাকব?

মহিলার আকস্মিক বাস্তববাদী প্রশ্নে আমার আদর্শবাদী পিতা থতমত খেয়ে গেলেন। মহিলারা সমাজ নামক পাঁচকলটিকে পুরুষদের চেয়ে অনেক বেশি চেনে। কিছু ভেবে না পেয়ে পিতা বললেন, সেসব পরে ভাবা যাবে। তুমি থাকবে তোমার অধিকারে, আমাদের শ্রদ্ধার আসনে।

কাকিমা আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। বলা হল না। ঘরে একসঙ্গে অনেকে এসে হাজির হলেন। সিস্টার, ডাক্তার, সেই কাজের মেয়েটি। ট্রে-তে গরম জল, ভাসমান বরিক তুলল, ওষুধের শিশি, অ্যান্টিসেপটিক, ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ। লটবহরের শেষ নেই।

সন্ন্যাসীভাবাপন্ন সেই ডাক্তারবাবু কোনও দিকে না তাকিয়েই বললেন, শুয়ে পড়, শুয়ে পড়, একটু মেরামতির কাজ আছে। ভালই হিল আপ করছে। পারফেক্ট সিস্টেম। এই বয়েসে ভোগী মানুষের সুগার দেখা দেয়। তুই বেঁচে গেছিস। কৃচ্ছসাধনের এই গুণ।

ডাক্তারবাবু নিজের খেয়ালে কথা বলছেন। সিস্টার মাঝে মাঝে কাকিমার দিকে তাকাচ্ছেন। অদ্ভুত এক দৃষ্টিতে। এক মহিলার আর এক মহিলার প্রতি স্বভাবসুলভ কৌতূহল। প্রফুল্লকাকা মারা গেছেন। ব্যাপারটা আমার কাছে আর তেমন শোকাবহ নয়। আমারও চোখ আছে। সে চোখ জলে ঝাঁপসা নয়। বেমানান হলেও বলতে বাধ্য হচ্ছি, কাকিমাকে আজ কালিদাসের বিরহী নায়িকার মতো দেখাচ্ছে। উড়ুউড়ু চুল, ছলছলে চোখ, সাদা শাড়ি। উত্থান পতনে জায়গায় জায়গায় সামান্য ধুলোময়লা লেগেছে। জানি, আমার এ দৃষ্টি ভাল নয়। জানলে কী হবে! বিল্বমঙ্গলের সাহস কোথায়! কাটা ফুড়ে অন্ধ করে দিতে পারছি কই!

সিস্টার হঠাৎ হাসপাতালের কণ্ঠে বললেন, ঘর খালি করুন, ঘর খালি করুন।

কাকিমাকে কি তার অসহ্য মনে হচ্ছে। তাই নিজের কর্তৃত্ব ফলাতে ব্যস্ত? পিতৃদেব বললেন, তড়িৎ, আজ তুমি আমাকে ছেড়ে দাও। আমার আর পড়ে থাকার উপায় নেই। চারপাশ থেকে চাপ আসছে প্রচণ্ড।

আর দু’-একদিন, তারপর ছুটি।

না, আজই। আমার আর উপায় নেই।

বাড়িতে এইসব ড্রেসিংট্রেসিং তোমার করবে কে? ট্রেইন্ড হ্যান্ড চাই।

ও আমি নিজেই করে নিতে পারব।

দিন দুয়েক বাড়ির বাইরে থাকলে কী এমন হবে?

সে তুমি বুঝবে না ডাক্তার! অনেক রকম সমস্যা এসে গেছে।

সেভেন্টি পার্সেন্ট সেরে এসেছে অবশ্য। ছেড়ে দেওয়া যায়। সিস্টার, ছাড়া যায়?

আমাদের সেবাযত্ন ওঁর যখন সহ্য হচ্ছে না, তখন তো ছেড়ে দিতেই হবে।

পিতৃদেব আশার আলো দেখতে পেলেন, তা হলে ড্রেসিংটা তাড়াতাড়ি সেরে ফেলুন। একটা ট্যাক্সি ডেকে আনুক, ওদের সঙ্গেই চলে যাই।

সিস্টার আবার বললেন, ঘর খালি করুন, ঘর খালি করুন।

লটবহর নিয়ে আমরা বাইরে এসে লম্বা একটা বেঞ্চে বসে পড়লুম। সময় ধীরে ধীরে এগোতে লাগল। চাঁদরে ঢাকা একটা দেহ চাকা-লাগানো স্ট্রেচারে চেপে আমাদের সামনে দিয়ে ধীরে ধীরে দূর থেকে দূরে চলে গেল। একটি মাত্র মানুষ, একটি মাত্র দেহ, শূন্য করিডর। পায়রা ডাকছে। একঘেয়ে মন কেমন করা সূরে। অন্ধকার-অন্ধকার জায়গায় পালিশ করা ঢাউস বেঞ্চে বসে থাকতে থাকতে মনে হচ্ছে, পৃথিবী যেন থেমে গেছে। আমাদের কারুর মুখেই কোনও কথা নেই। মাঝে। মাঝে পুরনো দিন উঁকি মেরে যাচ্ছে। প্রথম যেদিন দু’জনে এলেন। সাজিয়েগুজিয়ে সংসার পাতা। ঘোর বর্ষণে ভেজা। মুখোমুখি বসে লুডো খেলা। সরষের তেল আর পেঁয়াজ মেখে মুড়ি খাওয়া। ঝালে হুসহাস করা। এই পৃথিবীতে কোনও কিছুই স্থায়ী নয়। আজ এক রকম কাল এক রকম। মানসিক প্রস্তুতি না থাকলে পৃথিবী এক দুঃসহ যন্ত্রণা।

ডাক্তার আর সিস্টার দু’জনে মার্চ করে বেরিয়ে গেলেন। যাবার সময় একবার মাত্র আমাদের। দু’জনের দিকে তাকালেন। পৃথিবীতে সকলেই বড় ব্যস্ত। ঘরের দরজার সামনে এসে পিতৃদেব আমাদের ইশারায় ডাকলেন। অ্যান্টিসেপটিকের চড়া উগ্র গন্ধ বেরোচ্ছে।

আচ্ছা, তুমি তা হলে এবার একটা ট্যাক্সি ডেকে আনো। আমি রেডি।

ট্যাক্সিতে উঠে ঘড়ি দেখলুম, বেলা দুটো বেজে পনেরো মিনিট। আজ আর মাতামহের আহার জুটল না।

সব দিক কি সামলানো যায়! পেছনের আসনে দু’জনে পাশাপাশি বসে আছেন। আমি সামনের আসনে। আমাদের জীবনে এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল, বাইরের জগতে কোথাও কোনও পরিবর্তন নেই। পৃথিবীর সাংঘাতিক হজমশক্তি। মাতামহের জন্যে ভীষণ মন খারাপ হচ্ছে। মাঝে মাঝে চিন্তাও হচ্ছে, পিতৃদেব এই সমস্যার কী সমাধান করবেন।

বাড়ি ফিরে একটি অসহায় ছবি দেখা গেল। বাহাদুর রকে বসে আছে গালে হাত দিয়ে। খিদেতে মুখ শুকিয়ে গেছে। মাতামহ মা-হারা শিশুর মতো ঘুমিয়ে পড়েছেন। পাশবালিশটা খাট থেকে মেঝেতে পড়ে গেছে।

ঘরে পা দিয়েই পিতৃদেব বললেন, তোমাদের কারুরই নিশ্চয়ই খাওয়া হয়নি। নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হচ্ছে। আমার নার্ভ ভীষণ শক্ত, তোমার নার্ভ বউঠান আরও শক্ত। টেম্পার্ড স্টিল। এতটুকু জানতে দিলে না!

পিতার গলা পেয়ে মাতামহ ধড়মড় করে উঠে বসলেন। মুখের অবস্থা দেখে মনে হল, যেন স্বপ্ন দেখছেন! ভাবাবেগে মুখে কথা আটকে যাচ্ছে, তুমি এলে হরিশঙ্কর! তাড়াতাড়ি উঠতে গিয়ে মাথা ঘুরে আবার বিছানাতেই বসে পড়লেন। শিশু যেমন অনেকদিন পরে প্রবাসী পিতাকে দেখে আনন্দ পায়, বৃদ্ধের চোখমুখে সেইরকম আনন্দ খেলছে। পিতৃদেব এগিয়ে গিয়ে হেঁট হয়ে পায়ের ধুলো নিলেন।

মাতামহ বললেন, শুনেছ নিশ্চয়, আর একজন চলে গেল! বুঝলে, এরা সব মজা পেয়ে গেছে, শাসনের বাইরে চলে গেছে। আসছে যাচ্ছে। সবই যেন নিজেদের খেয়ালখুশি! পৃথিবী একটা কুৎসিত জায়গা। তুমি আছ বলেই থাকতে ইচ্ছে করে, তা না হলে কবে পগারপার হয়ে যেতুম। বড় ভয় হয় হরিশঙ্কর! যেই যাব আবার সঙ্গে সঙ্গে পোটলা বেঁধে ফেরত পাঠিয়ে দেবে।

আপনি কিছুই জানেন না, এটা আপনার শেষ জন্ম। আর আপনাকে আসতে হবে না।

ধুত, তোমার হিসেবে ভুল হচ্ছে। আমাকে এখনও বার তিনেক আসতে হবে। আবার সেই নব ধারাপাত, প্রথম ভাগ, দ্বিতীয় ভাগ, স্কুল, নিলডাউন, বেত্রাঘাত। আবার সেই টোপর মাথায় পিড়েতে বসা, আবার সেই এক এক করে চলে যাওয়া। পরের বার তোমাকে যেন একটু আগেভাগে পাই বাপু! এবার তুমি বড় দেরি করে ফেলেছ। সামনের বার আমি গৌরীদান করব। তখন তুমি যেন আবার না না করে বেঁকে বোসো না। আর আমিও মেয়েটাকে প্রথম থেকেই খুব যত্ন করব। স্বাস্থ্যই সম্পদ। অসুখ করলে হাতুড়ে আর ডাকব না। প্রথম থেকেই ভাল ডাক্তার। পয়সা একটু বেশি লাগে লাগুক, একেবারে বিধান রায়। ওই হেরম্ব কবিরাজ আর নয়। হ্যাঁগো, তোমার এটা শেষ জন্ম নয় তো! আমার কিন্তু কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে?

আমাকে এখনও লাখখাবার জন্মাতে হবে। কয়লা ধুয়ে ধুয়ে হিরে। আপনার এখনও খাওয়াদাওয়া হয়নি, এই অবেলায় না খাওয়াই ভাল।

মাতামহ অবাক হয়ে বললেন, কেন, আমার আজ খাওয়া হয়নি? কে বললে খাইনি?

কাকিমা ধরাধরা গলায় বললেন, না, খাওয়া হয়নি। আমাদের আসতে দেরি হয়ে গেল।

মাতামহ প্রতিবাদের গলায় বললেন, কে বললে আমার খাওয়া হয়নি। তোমরা বড় তাড়াতাড়ি ভুলে যাও।

পিতৃদেব উৎকণ্ঠিত মুখে মাতামহের দিকে তাকালেন। বুঝতে পেরেছি কীসের আশঙ্কায় তাকাচ্ছেন। মাতামহের স্মৃতি নষ্ট হয়ে আসছে নাকি? যাকে বলে ভীমরতি। মাতামহও বুঝতে পেরেছেন। একগাল হেসে বললেন, একদিন খাওয়া হয়নি তো কী হয়েছে? সারাজীবন তো খেয়েই আসছি। কতজনকে খেলুম বলো তো?

এইসব অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলার সময় এ নয়। তবু বলছেন। এলোমেলো কথা বলে সময় নিচ্ছেন। এমন এক সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন, যার সমাধান খুব সহজ নয়। কাকিমা দেয়াল ঘেঁষে মেঝেতেই বসে পড়েছেন। কতক্ষণ আর দাঁড়াবেন! স্বামী অপঘাতে মারা যাবার পর কী কী করার আছে, শাস্ত্রের কী বিধান আছে, এঁরা মনে হয় সঠিক জানেন না। এখুনি আমাকে ছুটতে হবে কুলপুরোহিতের কাছে। অশৌচ হবে কি না, শ্রাদ্ধশান্তির প্রয়োজন হবে কি না, জেনে আসতে হবে। হলে কোথায় হবে? কে করবে? বংশধর তো কেউ নেই।

মাতামহ বললেন, তুমি কি খুব পুড়ে গেছ হরিশঙ্কর? ৪৫০

আজ্ঞে হ্যাঁ, তা বেশ ভালই পুড়েছি। শরীরটা মনে হয় দাগরাজি হয়ে গেল। ভেবেছিলুম অক্ষত শরীরে চিতায় শোব, সে আর হল না।

অত ভেবো না হরিশঙ্কর। ক্ষত আর অক্ষত, আগুনের কাছে সবই সমান।

না, সে অনেক পরের কথা। আসুন এখনকার কথা ভাবা যাক। এই মহিলাটির কী হবে?

বউমার? কী হবে বলো তো? বেচারা এত বড় এই পৃথিবীতে একেবারে একা হয়ে গেল। পাশে তো কাউকে দাঁড়াতে হয়।

কে দাঁড়াবে?

কেন, আমরা সবাই মিলে দাঁড়াব। আমরা সব বউ-মারার দল। এইবার আমরা প্রায়শ্চিত্ত করব।

সমাজ?

জুতো পেটা। তুমি জানো, যৌবনে আমার মেজাজ আর শক্তি দুটোই ছিল। মুখের চেয়ে হাত দুটোই চলত বেশি। সমাজের কাছ থেকে আমরা কী পেয়েছি হরিশঙ্কর! উৎসবে, পালপার্বণে, অনেক তো পাতা পেড়ে খাওয়ানো হয়েছে, সেজেগুঁজে গিয়ে অনেক উপহার দিয়ে আসা হয়েছে, লাভ কী হয়েছে? এই তো তুমি হাসপাতালে পড়ে ছিলে, ক’জন পাড়ার লোক তোমাকে দেখতে গিয়েছিল?

তা না যাক, সমাজের কিছু নিয়ম তো মেনে চলতেই হবে! বুঝতে পারছেন কী বোঝাতে চাইছি? খুব পারছি। বদনাম একবার রটে গেলেই হল। তা সে পথ তো আমি মেরে রেখেছি। মাথার ওপর বসে আছি এক পাকা বুড়ো। আমি থাকতে থাকতেই নাতিটার বিয়ে দিয়ে দাও। অনেক মৃত্যু। দেখলুম হরিশঙ্কর, এইবার একটা ভাল কিছু দেখি। মৃত্যু কী মূর্খ! ব্যাটা বেহেড, গবেট। জানে না। বারেবারে এলে মৃত্যুর ধার কমে যায়। যারা যাত্রার পালা লেখে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করলে নিজেরই উপকার হত। মাঝে মাঝে একটু নাচ-গান, বিবাহ-জন্ম, হাসি-তামাশা না ঢোকালে দুঃখের জোর বাড়ে না। এলিয়ে যায়। বিয়েটা লাগিয়ে দাও হরিশঙ্কর। সানাই বাজুক। অনেক দিন লুচি, ছোলার ডাল, কুমড়োর ছক্কা খাইনি। শাঁখের শব্দ, উলুধ্বনি। কোমর বেঁধে লেগে পড়ো। দরজায় দরজায় আলপনা। সিল্কের ঝালর, ছাদে ম্যারাপ। রজনীগন্ধার গন্ধ। আহা নাকে যেন এখনও লেগে আছে। রজনীগন্ধার গন্ধ নাকে এলে তোমার মন কেমন করে না হরিশঙ্কর! আমার যে কত কথাই মনে পড়ে!

পিতৃদেব বললেন, ওসব কথা এখন থাক। আমার মনে হয় মামাশ্বশুরের কাছে থাকাটাই সেফ হবে।

কাকিমা সারাশরীরে একটা ঝাঁকুনি তুলে প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন, না না। এর চেয়ে আমার আত্মহত্যা করাই ভাল।

পিতৃদেব বোঝাতে চাইলেন, কেন বউঠান, তিনি তোমার আত্মীয়, আমরা তোমার পাশে থাকব।

উত্তরে আঁচলে মুখ ঢেকে কাকিমা ছেলেমানুষের মতো মাথা ঝাঁকালেন।

দুই অভিভাবক পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে অসহায়ের মতো বসে রইলেন। কঠিন সমস্যা। জোর করে একজন অসহায় মহিলাকে তো আর দূর করে দেওয়া যায় না। ভগবানের তাজ্জব খেলা। খোঁড়ার পা-ই গর্তে পড়ে! যাঁর কেউ কোথাও নেই তাঁর স্বামীটিকে কেড়ে নিলেন!

কাকিমা হঠাৎ বললেন, আপনারা কোনও বাড়িতে আমাকে একটা রাঁধুনিগিরি জুটিয়ে দিন। কোনওরকমে আমার দিন চলে যাবে।

মাতামহ বললেন, তোমার এখন মাথার ঠিক নেই। যা-তা আবোলতাবোল বোকো না। হরিশঙ্কর রাগী মানুষ। মুখ দেখে মনে হচ্ছে, তোমার কথা শুনে রেগে গেছে।

পিতা বললেন, না, আজ আর রাগারাগি নয়। আজ আমাদের মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। আজ। আর কোনও আলোচনাও নয়। তবে মামাশ্বশুরকে খবরটা দিতে হবে। খবর তো দিতে হবে বউঠান!

কাকিমা নিরুত্তর।

খবর না দিলে খারাপ দেখাবে। আমাদের দোষারোপ করবেন।

কাকিমা নিরুত্তর।

মাতামহ বললেন, তুমি এখন আর ওকে খোঁচাখুঁচি কোরো না। এমন একটা কিছু করো যাতে বেচারা শান্তি পায়। কী করলে মানুষ শান্তি পায় বলো তো?

শান্তি! সংসারী মানুষ পায় না। শান্তি পেতে হলে সন্ন্যাসী হতে হবে। সংসারে শান্তি নেই। সাময়িক যুদ্ধবিরতি আছে। ভুলে থাকা যায়, শান্তি পাওয়া যায় না।

কীভাবে তা হলে ভোলানো যায়?

সময়। সময়ের স্রোত পলি ফেলতে ফেলতে দুঃখ সুখ সবই চাপা দিয়ে দেবে। প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের মতো, কোনওদিন খুঁড়তে খুঁড়তে এক-একটা স্মৃতি বেরিয়ে আসবে। দুঃখের স্মৃতি, সুখের স্মৃতি।

তা যা বলেছ! কত কী-ই তো আমাদের জীবনে ঘটে গেল, সব কি আর মনে আছে! টেনে বের করলে তবেই বেরোয়। এসরাজ বাজাতে বাজাতে তোমার ওই আঙুলের কড়ার মতো, জীবন যত। দিন যায় তত দরকচা মেরে যায়।

পিতৃদেব ঘড়ির দিকে তাকাতে-না-তাকাতেই চারটে বাজতে শুরু করল। শেষ ঘণ্টাটি বেজে যাবার পর বললেন, এইবার একটু চায়ের জোগাড় করা যাক। আপনিও হালকা কিছু একটা খান।

তুমি চায়ের কী জোগাড় দেখবে? সে তো আমাদের হাতে।

কাকিমা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন, আমি চা করে আনছি। বাবাকেও খেতে দিচ্ছি।

মাতামহ বললেন, আজ আর তোমার কিছু করে দরকার নেই।

পিতা বললেন, সেটা ঠিক হবে না। নিজেকে যত কাজে ব্যস্ত রাখবে ততই ভাল। আমি তো তাই করেছিলুম। ওর মা মারা যাবার পর আমি সারাদিনরাত নিজেকে গাধার মতো খাটাতুম। রাতেও ছাড়তুম না। সারারাত বসে বসে অঙ্ক কষতুম। একটা টেলিস্কোপ কিনেছিলুম। সারারাত

আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতুম। সেই সময় আমার কত কী যে দর্শন হয়েছিল।

কী দেখেছিলে হরিশঙ্কর? গ্রহ, নক্ষত্র, উল্কা, ধূমকেতু!

সেসব তো ছিলই। প্রকৃতির জিনিস। অতিপ্রাকৃত কত কী যে দেখেছি! একদিন দেখলুম একটা মালা ভেসে চলেছে। দুধের মতো সাদা আলোর ফুলে গাঁথা গোড়ের মালা। দুলে দুলে ভেসে চলছে।

অ্যাঁ, বলো কী? তুমি তো তা হলে সিদ্ধপুরুষ হরিশঙ্কর। আমি শুনেছি। কখনও দেখিনি। ওই মালা কোথায় যায় জানো? কাশীর অন্নপূর্ণার মন্দিরে। তোমার হয়ে গেছে। তুমি পেয়ে গেছ।

আর একদিন কী দেখলুম জানেন? একটা সোনার খাট ভেসে চলেছে। ধীরে ধীরে পালতোলা নৌকোর মতো।

মাতামহ আর কথা বলতে পারলেন না। চোখে জল এসে গেছে। ঠোঁট কাঁপছে। হঠাৎ যেন ভেঙে পড়লেন, যা ভেবেছি তাই হরিশঙ্কর। এই তোমার শেষ জন্ম। ওই পালঙ্ক তোমার! দেখা দিয়ে চলে গেল। আমি একা পড়ে গেলুম। তোমার সঙ্গে আবার দেখা হবে সেই তিনশো বছর পরে। তিনবার আসব। তিনবারের মেয়াদ শেষ করে তারপর ফিরে যাব। মাতামহ স্তব্ধ। ঘর স্তব্ধ। উত্তরের রান্নাঘরে প্রাইমাস স্টোভ হুহু করছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *