In the great crisis of life when existence itself is
threatened the soul attains transcendent
powers.
মানুষের জীবনে ভাল আর খারাপ একই সঙ্গে আসে। কালো আর আলো। আকাশে যখন মেঘের খেলা তখন বিশাল প্রান্তরে আলোছায়ার অদ্ভুত খেলা চলে। ছায়ার পেছন পেছন তাড়া করে আসে আলো। আলোর পেছন পেছন ছুটে চলে ছায়া।
লেটারবক্সে পাশাপাশি দুটি চিঠি শুয়ে ছিল। কবে এসেছিল কে জানে! রোজ লেটারবক্স দেখার অভ্যাস এ বাড়ির কারুরই নেই। চিঠি লেখাতেও আলস্য, চিঠি দেখাতেও আলস্য। চিঠি আদানপ্রদানের পরিসরও খুব কম। আমাদের আত্মীয়স্বজনেরা কে যে কোথায় আছেন আজও জানা হল না। আমাদের বংশের ডালপালা মনে হয় খুবই কম। নেই বললেই চলে? শাখাপত্রশূন্য একটি বৃক্ষকাণ্ড, একটি মাত্র লিকলিকে ডাল মেলে ঊষর প্রান্তরে এক ঠ্যাঙে দাঁড়িয়ে আছে।
চিঠি দুটির একটি খাম, আর একটি পোস্টকার্ড। দুটিই আমার নামে। আমার সেই মানুষ নামক জ্ঞানগর্ভ, এখান থেকে ওখান থেকে মারা প্রবন্ধটি একটি নামকরা মাসিকপত্রে পাঠিয়েছিলুম। পত্রিকাটি বৃহৎ একটি ধর্মীয় সংস্থার। সন্ন্যাসী সম্পাদক লিখছেন,
মান্যবরেষু,
আপনার প্রবন্ধটি মনোনীত হয়েছে? দু-একটি জায়গা কিঞ্চিৎ অস্পষ্ট থাকায় আপনাকে দেখা করার অনুরোধ জানাচ্ছি। যে-কোনও দিন সকাল এগারোটার মধ্যে অথবা বিকেলে তিনটে থেকে ছ’টার মধ্যে দেখা করা যেতে পারে। ইতি সম্পাদক, নির্মলানন্দ।
সংক্ষিপ্ত চিঠি; কিন্তু মাথা ঘুরিয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। পৃথিবী যে ঘুরছে এই প্রথম টের পেলুম। নিজের ভেতর নিজে লাফাচ্ছে। চারপাশ থেকে স্বপ্ন ঘিরে আসছে। সাংঘাতিক সেই প্রবন্ধ অবশেষে ছাপা হবে। জ্বলজ্বল করে উঠবে আমার নাম। নিজের হাতে নিজেই একবার হাত বুলোলুম। পাঁচটা আঙুল, একটা মাথা, সমবেত হয়ে পাতার পর পাতা অক্ষর সাজিয়েছে। ছত্রে ছত্রে মানুষ নামক জন্তুর শ্রাদ্ধ। ভাব এসে গেল। চোখ ছলছল করছে। ঠোঁটে-ধরা পাত্র যেন শেষ মুহূর্তে হড়কে না। যায়! যদি না যায় তা হলে বাকি জীবন আমি হোমাপাখির মতো মহাশূন্যের ঊর্ধ্বলোকে লাট খেয়ে বেড়াব। পৃথিবীর মাস্তুলে আর পা ঠেকাব না। শেলির স্কাইলার্কের মতো দর্শনের গান গেয়ে ঊর্ধ্বে আরও উর্ধ্বে উঠে যাব। উপায় থাকলে আজই ছুটে যেতুম। এখনও এগারোটা বাজেনি। উপায় নেই। কাকিমা খাবার তৈরি করছেন। আজ তিনি আমার সঙ্গে হাসপাতালে যাবেনই। বাহাদুর এসেছে। মাতামহ তাকে ঘাটশিলার বাড়ির গল্প শোনাচ্ছেন। সুবর্ণরেখার স্বপ্ন দেখছেন। তিনিও যাবার বায়না ধরেছিলেন। ছেলেমানুষের মতো ভুলিয়ে রেখেছি।
খামের চিঠিটা কার বুঝতে পারছি না। হাতের লেখা চেনাচেনা মনে হচ্ছে। খামটা সাবধানে খুলতেই মুকুর চিঠি বেরিয়ে পড়ল। দীর্ঘ দু’পাতা। মুক্তোর মতো ছোট ছোট হাতের লেখা। পুঁতির কিংখাবের মতো ঠাসবুনোনে সাজানো।
এবার বুক কাঁপল অন্যভাবে। আর কেন? আবার কেন? আর আমার সময় নেই। পথ ঘুরে গেছে। মতির গতি অন্যরকম হয়ে গেছে। পিতা সেদিন পাপের কথা বলছিলেন। চমকে উঠেছিলুম। কার পাপে কী হয়ে গেল কে জানে! পিতৃদেব সব ব্যাপারেই একটু হুড়ম দুড়ুম করলেও সাবধানী মানুষ। সবরকমের রিফ্লেকস অটুট আছে। তবু একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল। কেন ঘটল? কেন কাল। রাতে বিশ্রী একটা স্বপ্ন দেখলুম? গরদের শাড়ি পরে মা এসেছেন, মাথার সামনে। ভোরের ফিকে আলোয় চারপাশ গোলাপি। আমি যেন শুয়ে আছি আমাদের খোলা ছাদে। আমি শুয়ে শুয়ে মাথার দিকে তাকিয়ে বললুম, মা, তুমি? মা ঠোঁটের উপর একটা আঙুল রাখলেন। মুখে ফুটে উঠল সেই বিখ্যাত হাসি। যে-হাসিতে গালে টোল পড়ত। মা বললেন, খোকা, তোর বাবাকে যদি নিয়ে যাই তোর খুব অসুবিধে হবে? আমি ধড়মড় করে উঠে বসে বললুম, সে কী বলছ মা? মা বললেন, তুই তো বড় হয়েছিস। আমার যে বড় একা লাগছে! আমি ভীষণ জোরে না বলে উঠলুম। অনেকটা ধমকের সুরে। মা যেন আমার শত্রু। এত জোরে না বললুম যে ঘুম ভেঙে গেল। তখনও ভোর হয়নি। রাত তিনটে। ঘর অন্ধকার। ঘড়ি যেন অশরীরীর ভয়ে ঠকঠক করছে। মনে এমন একটা ভয় হল! পাশবালিশটাকে মা বলে আঁকড়ে ধরলুম। মনে হল জাহাজ-ভাঙা নিঃসঙ্গ নাবিক অন্ধকার আকাশের তলায় উত্তাল সমুদ্রে মোচার খোলার মতো ভেসে চলেছে। মৃত্যু সুনিশ্চিত। যতক্ষণ ভেসে থাকা যায়।
যতই দেখব না ভাবি, মুকুর চিঠির দিকে চোখ চলে যাচ্ছে। ‘প্রিয় পলাশ’। পলাশ কারুর প্রিয় নয়। কেন অশান্তি করছ মুকু? ‘তোমাকে একটা সুখবর দিই।’ কার সুখবর? তোমার না আমার! আমার সব খবরই কুখবর। কবর খোঁড়ার খবর। ‘আমি অনার্সে ফার্স্টক্লাস নিয়ে পাশ করেছি।’ ও তাই তো! কয়েকদিন হল তোমার রেজাল্ট বেরিয়েছে। আমার নীরব অভিনন্দন গ্রহণ করো। এম এ পড়ার জন্যে আমি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভরতি হব ঠিক করেছি। কই তুমি তো আমার চিঠির উত্তর দিলে না! তোমাকে লিখতে আমার ভীষণ লজ্জা করছে। জানি না, তুমি আমাকে কী ভাবছ? মেয়েরা কোনও একজনের কাছে কিছু যে বলতে চায়। সেই একজন যে কে, তা কি বলা যায়? মানুষেই তো স্বপ্ন দেখে? স্বপ্নও তো বাস্তব হয়? বলো হয় না? অপর্ণাকে আমার কিন্তু একেবারেই ভাল লাগেনি। বড় কাঁচা মেয়ে। কাঠের বন্দুকের মতো সারাজীবন কাঁধে বয়েই বেড়াতে হবে। কেন তা জানি না। সেসব কথা তোমার কাছেই গোপন রেখো। ওপর দেখে মানুষ চেনা বড় শক্ত। সম্পর্কের খাতিরে সারাজীবন আমাদের অভিনয় করে যেতে হয়। মেয়েদের অভিধানে বিদ্রোহ শব্দটি নেই। লেখাপড়া শিখে আমরা স্বামীর ঘর করতে চলে যাই। এক কারাগার থেকে আর এক কারাগারে। ভারত স্বাধীন হলেও আমরা স্বাধীন নই। তুমি কি হোমচৌধুরির খোঁজ করেছিলে?
সে আবার কী? এ যেন গোটা চারেক কিস্তি বাদ দিয়ে ধারাবাহিক উপন্যাস পড়া। কিছুই বুঝতে পারছি না। হোমচৌধুরিটা আবার কে? মুকুর রেখে যাওয়া কাগজপত্র সব গভীর কুয়োর জলে। সলিল সমাধি হয়ে গেছে। জানার আর উপায় নেই। সব পারিবারিক গুপ্ত কথা লোপাট।
বিকট শব্দে মোটরবাইক বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। কে আসতে পারেন! ইলেকট্রিক সাপ্লাইয়ের ইন্সপেক্টর! না কি পিতার কোনও বন্ধু? মোটরবাইক-অলা বন্ধু তো কেউ নেই। মুকুর চিঠিটা সব আর পড়া গেল না। খামে ঢুকিয়ে রাখলুম। জানলা দিয়ে উঁকি মারতেই বুকটা ধড়াস করে উঠল। একজন পুলিশ অফিসার বাড়ির দিকে তাকিয়ে পঁড়িয়ে আছেন। চোখাচোখি হয়ে গেল। হাত নেড়ে নীচে ডাকলেন।
হঠাৎ পুলিশ কেন? কী আবার হল? কিছুই তো বুঝতে পারছি না। সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামতে নামতে মনে মনে খতিয়ে দেখার চেষ্টা করলুম, না জেনে নিজেকে কোনও অপরাধে জড়িয়ে ফেলেছি কি না! একটা কথা ভেবে বুকটা আবার ধড়াস করে উঠল, ভদ্রলোক হাসপাতাল থেকে কোনও খারাপ সংবাদ আনেননি তো! ভাবামাত্রই ভীষণ শীত করতে লাগল।
পুলিশ অফিসার রাস্তার ওপাশ থেকে এপাশে চলে এসেছেন। একেবারে সদরের সামনে। হাতে একটা সুটকেস। রাগীরাগী চেহারার বাইকটা ওপাশে রাস্তার ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। ভদ্রলোককে ‘কী বলছেন?’ বলতে গিয়ে মুখ দিয়ে কোনও কথা বেরোল না। এই প্রথম অনুভব করলুম, চোর আর পুলিশ দু’জনেই সমান। সামনে এসে দাঁড়ালে ভয়ে কণ্ঠরোধ হয়ে যায়।
বিশাল আকৃতির মানুষটি বেশ মিষ্টি গলায় বললেন, প্রফুল্লবাবু নামে এ বাড়িতে কেউ থাকেন?
মনে হল একটা ঘুষি খেলুম। নাকটা যেন থেবড়ে গেল। প্রথমে মনে হল বলি, না। তারপর ভাবলুম, মিথ্যে বললে জল আরও ঘোলা হয়ে যাবে। আমার তো কিছু জানার কথা নয়। আমি তো মর্গে কিছু দেখিনি। এই মুহূর্তে আমাকে অতি নিরীহ ভালমানুষের অভিনয় করতে হবে। বললুম, আজ্ঞে হ্যাঁ, থাকেন।
তিনি এখন কোথায়?
বেশ কিছুদিন হল বাইরে গেছেন।
আপনি তাঁর কে হন?
কেউ না। আমাদের বাড়ির নীচের তলায় তিনি থাকেন। নীচেটা খালি পড়ে ছিল।
প্রফুল্লবাবুর নিজের কেউ আছেন?
আজ্ঞে হ্যাঁ, স্ত্রী আছেন।
আমি ভেতরে আসতে পারি?
হ্যাঁ, আসুন না।
আমি তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে দু-একটা কথা বলতে চাই।
মনে হচ্ছে আমার পক্ষাঘাত হয়েছে। সারাশরীর অবশ। পা যেন চলছে না। অভিজ্ঞ চোখে আমার এই অস্বাভাবিক আচরণ ধরা না পড়ে যায়। আমি আগে আগে, জুতোর ভারী শব্দ তুলে পুলিশ অফিসার পেছন পেছন উঠছেন।
দোতলায় উঠে এলুম কোনওরকমে। ভদ্রলোকের বিশাল চেহারায় ঘরের উচ্চতা কেমন যেন খাটো হয়ে গেল। আমাকে কিছু বলতে হল না। তিনি নিজেই চেয়ার টেনে বসে বললেন, তিনি। কোথায়?
যেন তর সইছে না। কত তাড়াতাড়ি একটা মানুষকে গুঁড়ো করে ফেলা যায়, সুখের ডালিমকে দু’হাতে নিংড়ে রস ঝরানো যায়। চাপরাশ পরা এই মানুষটির জগতে কর্তব্য ছাড়া আর কোনও কিছুর অস্তিত্ব নেই।
ধীরে বললুম, বসুন, ডেকে আনছি।
ভেতরের ঘরে মাতামহ এখনও বাহাদুরের সঙ্গে বকবক করছেন। টের পাননি বাইরের ঘরে শমন এসে বসেছেন। গায়ে আইনের গন্ধ। মুখে মৃত্যুর শীতল হাসি। বৃদ্ধ সোনালি সুতো দিয়ে অতীতের জামদানি বুনে চলেছেন।
রান্নাঘরে কাকিমা বসে আছেন। হাসপাতালে যাবেন, সাজগোজ সারা। সাদা শাড়ি পরেছেন। পিঠে লুটোচ্ছে আঁচল, লতাপাতার কাজ করা। চান করেছেন। গাটবাঁধা ভিজে চুল কোমর ছাপিয়ে মেঝে ছুঁয়েছে। পরিষ্কার মাজা মুখে সিদুরের গোল টিপ চকচক করছে। ঝকঝকে টিফিন কেরিয়ারে বাটির ওপর বাটি সাজিয়ে চলেছেন। আমার দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে বললেন, বটঠাকুর যা যা ভালবাসেন সব আজ বেঁধেছি। কত কম সময়ের মধ্যে সব করে ফেললুম বলো!
সবই শুনছি, কিছু বলতে পারছি না। কাকিমা আমার চোখের সামনে ভোরের কুয়াশার মতো ক্রমশ সাদা হয়ে যাচ্ছেন। আমি অতি কষ্টে বললুম, ওসব এখন থাক। আপনার সঙ্গে একজন দেখা করতে এসেছেন।
বলেই মনে হল গাছের গুঁড়িতে কাঠুরিয়ার শেষ কোপ পড়ল। বিশাল একটি গাছ বনের মাথা কাঁপয়ে চারপাশে ভীষণ এক আলোড়ন তুলে আকাশ ছোঁয়ার আনন্দ ফেলে নেমে চলেছে মৃত্তিকার মৃত্যুর দিকে।
আমাকে আবার কে ডাকবে?
বাইরের ঘরে একবার আসুন।
হাতটা কোনওরকমে ধুয়ে কাকিমা আমার পেছন পেছন আসছেন। এখনও জানেন না কে এসেছেন। দরজার কাছে এসে হাত চেপে ধরে বললেন, একী! পুলিশ! আমি তো কিছু করিনি।
অফিসার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আসুন আসুন। কোনও ভয় নেই। পোশাক দেখে ভয় পাবেন না।
কাকিমা ঘোমটা টেনে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলেন। অফিসার বললেন, বসুন, আপনাকে দু’-একটা জিনিস দেখিয়ে কয়েকটা প্রশ্ন করব।
কাকিমা চেয়ারে আড়ষ্ট হয়ে বসলেন। আমি দূরে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করছিলুম। অফিসার বললেন, আপনিও আসুন। তা হলে একটু সাহস পাবেন ইনি।
অফিসার দু’হাঁটুর ওপর সুটকেস রেখে ডালা খুলে ফেললেন। খুলতে খুলতে বললেন, আপনার স্বামীর নাম প্রফুল্লচন্দ্র দাস?
কাকিমা ঘাড় নাড়লেন।
কতদিন হল বাইরে গেছেন?
খুব মৃদু সুরে কাকিমা বললেন, অনেকদিন।
কোথায় গেছেন?
কোন এক রাজবাড়িতে তবলা বাজাতে।
জায়গার নাম মনে আছে?
না।
কোনও চিঠিপত্র পেয়েছেন?
না।
এতদিন বাড়ি ছাড়া, চিঠিপত্র নেই, খোঁজখবর নেই, আপনি জানার চেষ্টা করেননি তিনি কোথায় আছেন কেমন আছেন?
আমি কেবলই ভেবেছি, এই ফেরেন এই ফেরেন। আপনি কি তার কোনও খবর পেয়েছেন, কোথায় আছেন, কেমন আছেন?
উত্তেজনায় কাকিমার মাথা থেকে আঁচল খুলে পড়েছে। অফিসার বললেন, উত্তেজিত হবেন না। আমার আরও প্রশ্ন আছে।
চেয়ারের হাতল ধরে দাঁতে দাঁত চেপে কাকিমা কোনওরকমে বসে রইলেন। অফিসার সুটকেসের ডালার খাপ থেকে একটি ফটো বের করলেন, আচ্ছা দেখুন তো ইনিই কি আপনার স্বামী?
ছবি দেখে কাকিমা নীরবে ঘাড় নাড়লেন। ভদ্রলোক ধীরে ধীরে খাদের দিকে নিয়ে চলেছেন। এ সেই ছবি। মর্গে শায়িত অবস্থায় তোলা। মুখ দেখে বুঝতে সামান্য সময় লেগেছিল। এইবার বুঝে ফেলেছেন। সিঙিমাছে কাটা মারলে মানুষ যেভাবে লাফিয়ে ওঠে, কাকিমার সারাশরীরে একটা। কঁপন বয়ে গেল। একেবারে শূন্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ‘পিন্টু এ কী হল’ বলে আঁচলে চোখ ঢাকলেন।
আমি ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে উঠেছি। যা হবার তা তো হবেই। আর তো রোখা যাবে না। উল্কার বেগে ট্রেন ছুটে আসছে। লাইন ছেড়ে সরে যাবার আর সময় নেই। মাথা দিতেই হবে। ভদ্রলোক বোকার মতো ছবিটা কেন সবার আগে দেখাতে গেলেন! সুটকেসে আরও তো অনেক কিছু দেখাবার ছিল।
কাকিমা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললেন, কী করে এমন হল! কোথায় তাকে রেখেছেন?
অফিসার বললেন, স্থির হন, স্থির হন। এখনও আমার অনেক প্রশ্ন আছে।
আর প্রশ্ন! অনেক প্রশ্ন প্রশ্নই থেকে যাবে। উত্তর আর পেতে হচ্ছে না। পাকা মানুষ, কী করে এমন কাঁচা কাজ করলেন? ভাবনার এই মুহূর্তটিতে মাতামহ ঘরে এলেন। অবাক হয়ে বললেন, একী, তোমাদের এসব কী হচ্ছে বউমা?
কাকিমা কোনওরকমে উঠে দাঁড়িয়ে মাতামহের প্রশস্ত বুকে আছড়ে পড়লেন। বাঁধভাঙা কান্না শুরু হল। অফিসার জিজ্ঞেস করলেন, ইনি কে?
আমার দাদু।
কাকিমা ধীরে ধীরে নীচের দিকে নেমে আসছেন। মাতামহের পায়ের কাছে হাঁটু ভেঙে পড়ে গেলেন। কিছু বুঝতে না পেরে মাতামহ বললেন, কী ব্যাপার বলে তো? হরিশঙ্কর ঠিক আছে?
আমি বললুম, আজ্ঞে হ্যাঁ।
তবে বউমা এমন ভেঙে পড়ল?
প্রফুল্লকাকা মারা গেছেন।
অ্যাঁ, সেকী? কোথায় মারা গেছে?
অফিসার উত্তর দিলেন, বসুন, সব বলছি। তার আগে কিছু কিছু জিনিস শনাক্ত করতে হবে। ওঁকে একবার দেখান তো, এই পাঞ্জাবিটা চিনতে পারেন কি না।
আমি বললুম, আমি পারি। পাঞ্জাবিটা প্রফুল্লবাবুর।
তবু একবার সামনে ধরুন না।
পাঞ্জাবিটার দিকে কাকিমা ফিরেও তাকালেন না। তাকাবার মতো অবস্থাও নেই। কেমন যেন হয়ে গেছেন। অফিসার একটা বিড়ির কৌটো আর লাইটার বের করে বললেন, চিনতে পারেন?
খুব পারি।
সুটকেসে আরও অনেক কিছু রয়েছে। সেসব আর বের করলেন না। যা যা বের করেছিলেন সব ঢুকিয়ে ফেললেন। বেরিয়ে এল আরও গোটা তিনেক ফটো। ছবি তিনটে সুটকেসের ওপর পাশাপাশি ফেললেন। জিজ্ঞেস করলেন, এদের মধ্যে কেউ কখনও এ বাড়িতে এসেছিল?
দু’জনকে চিনি না। তৃতীয়জনকে চিনি। সেই অষ্টাবক্র লোকটি, যে আমার ঘড়ি নিয়ে ভেগেছিল। একে চিনি বলতে গিয়েও বলা হল না। নিজেকে সামলে নিলুম। কী থেকে কী হয়ে যায়, বলা শক্ত। মনে হতে লাগল পুলিশের জাল ধীরে ধীরে আমার দিকেও এগিয়ে আসছে। এই মৃত্যুর খবর আমি যে অনেকদিন আগেই জেনেছি, অথচ বলিনি। অফিসার বললেন, কী হল, চেনেন? এসেছে কোনওদিন?
না।
ওঁকে একবার দেখান।
কাকিমা হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন। পঁড়িয়ে বললেন, আমি যাব। শেষ দেখা একবার দেখব।
অফিসার বললেন, কোথায় যাবেন? সব শেষ হয়ে গেছে। সে কি আজকের কথা! অনেক আগেই আপনাদের খোঁজখবর করা উচিত ছিল। মর্গে আনক্লেমড ডেডবডি কতদিন পড়ে থাকবে?
মাতামহ বললেন, আপনাদের খোঁজ করা উচিত ছিল।
খোঁজখবর করতে করতেই তো এসেছি।
তাতে আমাদের কী লাভ হল?
আপনাদের না হোক, আমাদের হল। কেসটা এখন সাজানো যাবে। তিনটেকে আমরা অ্যারেস্ট করেছি। খুনের উদ্দেশ্যটা তেমন ভাল করে বোঝা যাচ্ছে না। সব খুনেরই একটা উদ্দেশ্য থাকে, হয় নারী, না হয় টাকা, বিষয়সম্পত্তি। দেখা যাক কী করা যায়। ভদ্রমহিলাকে প্রস্তুত থাকতে বলবেন। দিন সাতেকের মধ্যেই কোর্টে ডাক পড়বে, তখন এইসব আর একবার শনাক্ত করতে হবে।
মাতামহ জিজ্ঞেস করলেন, ডেডবডি আপনারা পুড়িয়ে ফেলেছেন?
ভদ্রলোক সুটকেস হাতে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, ডিসপোজড অফ। আচ্ছা আজ চলি, প্রয়োজন হলে আবার আসব।
বাতাসে শব্দের ঘুসি মারতে মারতে মোটরবাইক দূর থেকে দূরে চলে গেল। ঘরের মাঝখানে কাকিমা উদভ্রান্তের মতো দাঁড়িয়ে। আজ বড় পবিত্র সাজে সেজেছিলেন। সব চুরমার হয়ে গেল। মোটরবাইকের শব্দটা যেন বুক থেকে উঠে দূরে মিলিয়ে গেল। মাতামহ চেয়ারে স্তম্ভিত। হঠাৎ নুয়ে-থাকা বাঁশের মতো ছিটকে উঠলেন। সোজা দাঁড়িয়ে হাহা করে হাসতে লাগলেন। ভয় হল, পাগল হয়ে গেলেন না তো! হাসি থেমে গেল। দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলেন, সবই বেটির খেলা, সবই বেটির খেলা। অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকায়ে যায়। সুখের সংসার জ্বলেপুড়ে যায়।
কাকিমা বাহাদুরের পাশ দিয়ে ভেতরের ঘরের দিকে ছুটলেন। মাতামহ বললেন, এবার তা হলে কী হবে! এমন সুন্দর মেয়েটা বিধবা হয়ে গেল। তুমি একবার দেখো, কী করতে কী করে ফেলে।
শোবার ঘরের আয়নার সামনে কাকিমা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। নিজের মুখোমুখি। সধবার সামনে বিধবা। প্রতিবিম্বের পাশে রাহুগ্রাসের মতো আমার মুখের কিছু অংশ ভাসছে। কাকিমা আঁচল দিয়ে কপালের টিপটা ঘষে তুলে ফেললেন। সিথির সিঁদুর তুলে ফেললেন ঘষে ঘষে। সেদিন দোরে ফেরিঅলা ডেকে শাঁখা পরেছিলেন। শাঁখাজোড়া নিজেই ভেঙে ফেললেন মটমট করে।
আমি সবই দেখছি। কিছু করার নেই। হঠাৎ আয়নার দিক থেকে আমার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললেন, চলো, অনেক দেরি হয়ে গেছে। বটঠাকুর না খেয়ে আছেন।
আচমকা আমি আবার একটা ধাক্কা খেলুম। মহিলা বলেন কী? এত মনের জোর! ইনি কি তা হলে সাধিকা? মায়া, মোহ, সংস্কার সবকিছু জয় করে বসে আছেন! চিনতে ভুল হয়েছিল। আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, আপনি বলছেন কী?
চোখের জল এখনও ভাল করে শুকোয়নি। ঠোঁটদুটো এখনও আবেগে কাঁপছে। পূর্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে একবার তাকিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন ধীর পায়ে। এতই কর্তব্যবোধ যে এত বড় একটা শোক মিলিয়ে গেল, চাপা পড়ে গেল।
নিচু হয়ে টিফিন কেরিয়ার হাতে তুলে নিলেন। খরখরে সিমেন্টের মেঝেতে টপটপ করে কয়েক ফোঁটা চোখের জল ঝরে পড়ল। দূরে চটকলের ভো বেজে উঠল। অদ্ভুত তার বুকখালি করা স্বর। পৃথিবীর সমস্ত মৃত্যুর জন্যে সমবেত এক আক্ষেপ বাঁশি হয়ে কেঁপে কেঁপে বাজছে। ঠাকুর বলতেন, সানাইয়ের সুরে সাধকের সমাধি হয়। এই বাঁশি শুনলে কী বলতেন!
হাতে টিফিন কেরিয়ার। সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত চেহারা। কাকিমা আমার সামনে। চাপা গলায় বললেন, চলল।
আপনি যাকেন কী করে? এই অবস্থায়।
ভাল করে কথা বলতে পারছি না। এই প্রথম অনুভব করলুম মন এক। আমার মন, তোমার মন, অহংবোধে খণ্ড খণ্ড। আসলে মন একটাই, বৃহৎ মন। তা না হলে আমার মনে হবে কেন আমিও বিধবা হয়েছি! এই মহিলার শূন্যতা আমার মধ্যেও এসে গেছে।
কাকিমা নিজের মুঠোয় আমার হাত চেপে ধরে বললেন, আর দেরি কোরো না। যার কাছে গেলে আমি শান্তি পাব তার কাছে আমাকে যেতেই হবে।
মহিলাদের মন বোঝার ক্ষমতা আমার নেই। শুনেছি ঈশ্বরও জানেন না। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে মাতামহ উঁকি মেরে মেরে দেখছেন। মাতামহ জগৎমাতাকে চেনেন, সাধারণ রমণীর ব্যাপারে তিনি বড়ই অজ্ঞ। কতকাল হয়ে গেল মাতামহী চলে গেছেন। তারপর থেকে তো একেবারেই নাঙ্গাবাবা। স্ত্রীবিয়োগে স্বামীর অবস্থা স্মৃতিতে গাঁথা থাকলেও থাকতে পারে, স্বামীবিয়োগে স্ত্রীর অবস্থা জানবেন কী করে! মঞ্চভীত অভিনেতার মতো উইংসের পাশ থেকে উঁকি মারছেন।
ওঁর পাশ দিয়ে যাবার সময় ছেলেমানুষের মতো ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় চললে তোমরা?
হাসপাতালে।
বউমাও!
আজ্ঞে হ্যাঁ।
তবু আমাকে কিছুতেই যেতে দেবে না। কী তোমাদের বিচার! হরিশঙ্কর কি শুধু তোমাদেরই? আমার কেউ নয়!
আর একটু সুস্থ হলেই আপনাকে নিয়ে যাব।
আর কত সুস্থ হব বলতে পারো? আমার বয়েসের মানুষ আর কত সুস্থ হবে? তোমরা মানুষের বয়েসটা ভুলে যাও।
কাকিমা গড়গড় করে কলের পুতুলের মতো কোনও দিকে না তাকিয়ে এগিয়ে চলেছেন, সোজা সিঁড়ির দিকে। আর বেশি কথা বাড়াবার সময় নেই। ঠাস বাঁধাকপির মতো এতকালের অবস্থা হঠাৎ শুকনো ফুলের মতো ঝরতে শুরু করেছে। সবকিছু সামাল দেবার ব্যর্থ চেষ্টা করে আর লাভ নেই। সময়ের চলন সহজে বোঝা যায় না। আজ যেন বুঝছি। মুহূর্ত নিমেষে মিনিটের সাঁকো পার হয়ে ঘণ্টার দিকে তরতর করে ছুটে চলেছে। কী দুর্বার তার গতি! একটা জিনিস এতকাল চাপা ছিল, হঠাৎ বাঁধ ভেঙে কন্যার মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
ট্যাক্সি চলেছে। পেছনের আসনে দু’জনের মাঝখানে টিফিন কেরিয়ার। এখনও গরম। কনুই লাগলে ছ্যাঁক করে উঠছে। দাঁতে দাঁত চেপে কাকিমা বসে আছেন। কোথায় গেল আনন্দ, কোথায় সেই বেশভূষা! সময় কী আশ্চর্য জিনিস! মুহূর্তের চৌকাঠ ডিঙোলে কে যে কোথায় গিয়ে পড়বে জানা নেই। একটু আগে কী ছিল, একটু পরে কী হল। কিন্তু আমি তো এতদিন এই মুহূর্তটাকে ধরে রেখেছিলুম। প্রায় সফলও হয়েছিলুম। অনেক আগেই যা হত তা হয়েছে অনেক পরে। সময়ও তা হলে চুরি করা যায়!
দূরে মেডিকেল কলেজের হলদে বাড়ি। গাড়ি তো ঢুকছে। ভাবছি এবার কী হয়!