2 of 3

১.৫৬ সুখের কথা বোলো না আর

সুখের কথা বোলো না আর
বুঝেছি সুখ কেবল ফাঁকি
দুঃখে আছি, আছি ভাল
দুঃখেই আমি ভাল থাকি।

ম্যানেজিং ডিরেক্টারের ঘরে ডাক পড়ল। আমার ওপর চায়ের ঘাট থেকে কেফিন নিষ্কাশনের ভার পড়েছে। ফ্লাস্কে চায়ের ঘট আর সলভেন্ট ভিজছে। কাজটা খুব একটা দুরূহ নয়, তবে বিপজ্জনক। আগুন আর দাহ্য পদার্থ নিয়ে খেলা। একটু অসাবধান হলেই অগ্নিকাণ্ড। ডাকছেন যখন, যে-অবস্থাতেই থাকি যেতে হবে।

ঘরে ঢুকতেই বললেন, তোমাকে অনেকদিন দেখিনি। কী হয়েছে তোমার? এত বিমর্ষ কেন?

আজ্ঞে, আমার দাদু ভীষণ অসুস্থ। মামা কলকাতা ছেড়ে বিদেশে চলে গেছেন।

কোন মামা? যিনি সিনেমা তুলছিলেন?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

বোসো। সংসারের ঘোলা জলে সকলকেই ভাই হাবুডুবু খেতে হবে। কাল ঊষা একটা গান গাইছিল। ভারী সুন্দর! সবটা মনে নেই। যে কটা লাইন মনে আছে:

এসেছ যখন ভবে
থাকার মাশুল দিতে হবে।
কত ডুববে উঠবে জীবন তরী
চঞ্চলতা এনো নাকো ।।

আজ্ঞে, পুরো গানটাই আমি জানি।

তাই নাকি! তুমি গান জানো?

অল্পস্বল্প চর্চা ছিল। বাবা এসরাজ বাজান। মামা গাইয়ে। এ গানটা আমি ঊষাদির কাছেই শিখেছি।

তাই নাকি? আচ্ছা প্রথম লাইনটা সুরে শোনাতে পারো?

আজ্ঞে হ্যাঁ। রোগ জানুক আর দেহ জানুক/মন তুমি আনন্দে থেকো/দেহাতীত হয়ে সদাই/আনন্দময়ীরে ডেকো ।।

যতদূর সম্ভব মোলায়েম করে প্রথম চারটে লাইন শুনিয়ে দিলুম। সংগীত এমন জিনিস, এম ডির চোখ ছলছল করছে। তিনি চেয়ার ছেড়ে আমার কাছে এগিয়ে এসে পিঠে হাত রাখলেন। তসরের পাঞ্জাবির ঢোলা হাতা পিঠের কাছে খসখস করছে।

তুমি তো বড় গুণী ছেলে হে!

আজ্ঞে না, এমন কী আর গুণ? গান অল্পবিস্তর সব বাঙালির ছেলেই গাইতে পারে।

হে, তোমার অনেক গুণ। নিজের গুণ নিজে বোঝা যায় না। তোমাকে একদিন আমাদের বাড়িতে যেতে হবে। বেশ নির্জনে একপাশে বসে তোমার গান শুনব।

এম ডি নিজের চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, বুঝলে, ঊষা মেয়েটি বড় ভাল। দেবী। এসব মেয়ে ক্ষণজন্মা। লাখে এক। ওর কাছাকাছি এলে মানুষের ধর্মভাব হয়। নতুন দিগন্ত খুলে যায়। কত কী যে শেখার আছে ওর কাছে! পৃথিবীটা বড় অদ্ভুত জায়গা, পলাশ। ছেড়ে চলে যেতে হবে এই যা দুঃখ। আর কি আসা হবে? আচ্ছা, তুমি ওই গানটা জানো, তোমার দ্বারে কেন আসি ভুলে যে যাই।

ঠিক সুরে পারি না, তবে মাঝে মাঝে গাইবার চেষ্টা করি।

আহা, কী লেখা। দিনের শেষে ঘরে এসে লজ্জা যে পাই। বাসনা সব বাঁধন যেন কুঁড়ির গায়ে। নাঃ আমার দ্বারা আর ব্যাবসাট্যাবসা হবে না। যত দিন যাচ্ছে তত রোমান্টিক হয়ে যাচ্ছি।

সে তো ভালই। শুষ্কং কাষ্ঠং না হওয়াই ভাল।

আর কি আমার সে বয়েস আছে, পলাশ! আমাদের ওই বৈদ্যুতিক চালুনি যন্ত্রটা কোনওদিন দেখেছ!

না স্যার।

আবার সেই বাঙালের মতো স্যার বলছ? ওই সম্বোধনে দূরত্ব বেড়ে যায়। হ্যাঁ যা বলছিলুম, যন্ত্রটা বড় মজার! প্রথমে এক পাশে কাত হয়ে কিছু জিনিস তুলে নিয়ে নাচাতে নাচাতে আর এক পাশে কাত হচ্ছে। একেবারে সঙ্গে সঙ্গে বড় দানার জিনিস গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে। থাকছে ছোট দানা। যন্ত্র তখন সেইগুলোকে নাচাচ্ছে। একেবারে পৃথিবীর কায়দা। এক প্রান্তে প্রবেশ, আর এক প্রান্তে প্রস্থান, মধ্যে নাচানাচি। আমরা সেই বৃদ্ধের দল, নাচতে নাচতে লাফাতে লাফাতে নির্গমন-পথের দিকে চলেছি। দিন এলে রাতের প্রদীপ ম্লান হবেই। কোনওদিন দাবার চাল দেওয়া দেখেছ?

আজ্ঞে না।

বড় মজার দৃশ্য! ছক থেকে মুন্ডু ধরে দাবাড়ু একটি খুঁটি অল্প একটু তুলে এক পাশে কাত করে ধরে আছেন। চাল ভাবছেন। এগোতে গিয়ে পেছিয়ে আসছেন। খুঁটির যাবার সময় হয়েছে। ঘরে স্থির হয়ে বসা আর চলবে না। খেলোয়াড়ের দ্বিধায় যাব কি যাব না ভঙ্গিতে ঘর ছুঁয়ে আছে। ঠিক আমার অবস্থা, একটা পা উঠে পড়েছে। আর একটা পা উঠল বলে। ডালে বসে থাকতে থাকতে পাখির ওড়া দেখেছ?

আজ্ঞে না।

কী দেখেছ তুমি! এবার দেরাদুনে গিয়ে, পাশেই ফরেস্ট, এইসব খুব ভাল করে লক্ষ করবে। পাখি যখন ডাল থেকে উড়তে চায় তখন তার চোখদুটো দেখবে উদাস হয়ে যায়। ডানাদুটো বারকতক খুলব কি খুলব না করে, তারপর কীসের তাগিদে ঝপ করে উড়ে চলে যায়। আচ্ছা যে কারণে তোমাকে ডেকেছি, গেট রেডি ফর দেরাদুন। তোমার শীতের ভাল পোশাক আছে?

আজ্ঞে না, করাতে হবে।

আজকালের মধ্যে অর্ডার দিয়ে দাও। শীত আসছে। ওখানে ভীষণ ঠান্ডা পড়ে।

আজ্ঞে হ্যাঁ।

কী করাবে?

একটা গলাবন্ধ কোট।

শুধু ওপরের দিকটা ভাবলেই হবে না, তলার দিকটাও ভাবো। আমরা কী বলি? শীত করে, শীত পায়। তার মানে? করে মানে হাতে, পায় মানে পায়ের পাতায়। একটা গরম সুট করাও। টাকা চাই?

আজ্ঞে না।

না কেন?

আছে। দরকার হলে বলব।

না, তোমাকে আমি উপহার দোব। এই এমপ্লয়ার-এমপ্লয়ি সম্পর্কটা ভাঙতে হবে। ওপন্ আপ মাই ডিয়ার বয়, ওপন আপ। আমি আমাদের ট্রাভেল এজেন্টকে বলে দিচ্ছি, সামনের সপ্তাহে তোমাদের জন্যে দুন এক্সপ্রেসে টিকিট বুক করুক। শুক্রবার ভাল বার। রবিবার সকালে পৌঁছে যাবে। এখনও যথেষ্ট সময় আছে, তাড়াহুড়োর কিছু নেই।

আমি তা হলে এখন আসি। একটা কাজ চাপিয়ে এসেছি।

হ্যাঁ যাও। তিনটের সময় তোমাকে নিয়ে আমি টেলারের কাছে যাব। সেইভাবে নিজেকে ফ্রি করে নিয়ো।

দুটো ব্লকের মাঝখানের ঝোলা বারান্দা দিয়ে আসতে আসতে আমার একটা কথাই কেবল মনে হচ্ছিল, সওদাগরি অফিসের ওপরঅলারা কর্মচারীদের সঙ্গে সাধারণত খুব একটা ভাল ব্যবহার করেন না। আমার বরাতে এ কী জুটছে! ঈশ্বরেরও তা হলে করুণা হয়। একসঙ্গে সব দিক শুকিয়ে দেন না। নীলকণ্ঠের গানের মতো, এক কূল নদী ভাঙে নিরবধি আবার অন্য কূলে তমকূলে সাজায়। বহু দূরে কোথায় কে জানে, তিনি বসে আছেন রত্নখচিত সিংহাসনে। তার জানলায় সোনার গরাদ। আয়ত দুটি চোখ পড়ে আছে জীবজগতের দিকে। সবই দেখছেন। দেখেছেন, জীবনের ভাণ্ডার থেকে এ ছেলেটা তো কিছু পায়নি। যা ধরতে গেছে, সবই পালিয়েছে হাত ফসকে। একে কিছু দেওয়া যাক। একটু স্নেহ, দুটো ভাল কথা। যা পাওয়া যায়! যা আসে, আসুক সেই অপার করুণাময়ের হাত গলে। যা চাই তা যখন পাই না, যা পাই তা মেনে নেওয়াই ভাল।

ল্যাবরেটরিতে ঘণ্টা দুয়েক চুটিয়ে কাজ করার পর জিনিসটা বাগে এসে গেল। কার ভেতর যে কী অদৃশ্য হয়ে থাকে। চা-বাগানের মেঝে ঝট দেওয়া আবর্জনার মধ্যে কী ঐশ্বর্য! বিকার থেকে সলভেন্ট উড়ে চলে গেছে, পড়ে আছে ধবধবে সাদা মিহি গুঁড়ো, যার নাম কেফিন। দামি একটি ওষুধ। আজ আমার দিনটা খুব ভাল। পিতার এক পুরিয়া চায়নায় মাতামহ আরোগ্যের পথে। এম ডি-কে গান শুনিয়ে খুশি করে দিয়েছি। বিকেলে যাব সুটের মাপ দিতে। চলেছি হিমালয়ের কোলে দেরাদুনে বসবাস করতে। মনে হয় পদোন্নতিও হবে। কেমিস্ট্রিতে হাত পেকেছে। তার হালফিল। প্রমাণ চোখের সামনে, বিকারে। প্রসেসটা কমার্শিয়ালাইজ করতে পারলে, টি-ওয়েস্ট থেকে কেফিন বের করে প্রতিষ্ঠান অনেক টাকা লাভ করবে। আর আমাকে পায় কে! আজ আবার জিমূতবাবু মাংসের কোরমা চাপিয়েছেন। সুগন্ধে সব পাগল হয়ে যাচ্ছেন। আর মিনিট পনেরো পরেই তিনি আসছেন নতুন ভাড়ে সি সি শব্দ ছাড়তে ছাড়তে।

মৃগ যেমন কস্তৃরীর গন্ধে পাগল হয়ে যায়, আমিও তেমনি নিজের অহমিকায় বিভোর। ঘুরতে ঘুরতে ওপরে উঠছি, আবার একটু নীচে নামছি। নিজেই নিজের গলায় বিজয়মাল্য পরাচ্ছি। কাঁধের পাশ থেকে কে বললেন, আপনাকে ডাকছেন।

এম ডি-র পিয়োন। কী ব্যাপার, এর মধ্যে তিনটে বেজে গেল? কই না তো, সবে একটা পনেরো। ভাব আর ভাবনার মাকড়সার জাল থেকে নিজেকে বের করে আনলুম। ঝুলবারান্দা দিয়ে যেতে যেতে নাকে নানারকম গন্ধ এসে লাগল। নীচের ফ্যাক্টরিতে সাবান তৈরি হচ্ছে। সুঁই ফুলের গন্ধ ভাসছে বাতাসে। হঠাৎ অপর্ণার কথা মনে পড়ে গেল। এমন একটা ব্লাউজ পরেছে, গায়ের রঙের সঙ্গে জামার রং মিলে গেছে। বুকের কাছে ছিলে কাটা সোনার হার দুষ্টু ছেলের মতো চিকমিক করে হাসছে। শরীরের ভেতর কোথাও কোনও একটা কিছু মুচড়ে উঠল। ঝিরঝিরে বৃষ্টি আর ভিজেভিজে বাতাসের মতো সুখের অনুভূতিতে শরীর যেন অবশ হতে চাইছে।

এম ডি মৃদু হেসেই মুখ গম্ভীর করলেন। আমাকে বললেন, বোসা।

বসলুম। টেবিল আর সকালের মতো খালি নেই। কাগজপত্রে ভরে উঠেছে। স্যাম্পল-ভরতি শিশি সারি সারি একপাশে। নীচের সিন্থেটিক ল্যাবরেটরি থেকে ওপরে উঠে এসেছে। এম ডি স্থির চোখে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, ঠিক আছ? স্থির আছ তো?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

নিজের ওপর নিজের কন্ট্রোল আছে?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

তা হলে, তুমি এখুনি একবার মেডিকেল কলেজে চলে যাও। আমি গাড়ি দিচ্ছি।

মেডিকেল কলেজে কেন?

তুমি এমার্জেন্সিতে যাবে। সেখানে তুমি পঙ্কজকে পাবে। হরিশঙ্করের অফিসের আরও কয়েকজনকে পাবে।

সেখানে তাঁরা কী করছেন?

একদম উতলা হবে না। লাগাম টেনে রাখো। হরির মাইনর একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। ভয়ের কিছু নেই।

হঠাৎ মনে হল আমি মহাশূন্যে উৎক্ষিপ্ত হয়েছি। প্যারাচুটের দড়ি না খুললে প্যারাট্রুপারের মনের অবস্থা যেমন হয়, আমার মনের অবস্থাও সেইরকম হয়ে গেল। আকাশ বেয়ে হুড়মুড় করে। নেমে চলেছি নীচের দিকে। এরই মধ্যে শুনতে পেলুম এম ডি বলছেন, বুঝতে পেরেছি। তোমাকে একা ছাড়া ঠিক হবে না। চলো আমিও তোমার সঙ্গে যাই। অনেকদিন আমার ওল্ড ফ্রেন্ডকে দেখিনি। বহুবার বলেছি, আয় চলে আয়, আমার পাশে এসে দাঁড়া। পশ্চিমবাংলার মাটিতে আচার্য রায়ের স্বপ্ন সফল করি। বোম্বাই আমাদের কান কেটে দিচ্ছে। শুনবে? কারুর কথা শুনবে? ভগবান একটা ষাঁড় তৈরি করতে গিয়ে হরিশঙ্কর করে ফেলেছেন। নিজের মাথার দাম নিজেই বুঝল না। নাও চলো। গেট আপ।

এম ডি কী করছেন, কী বলছেন, দেখেও দেখছি না, শুনেও শুনছি না। কেমন যেন ভোরের কুয়াশার ভেতর বসে আছি। শীতের সকালে ময়দানের ছবির মতো।

ধীরে ধীরে গাড়িতে এসে বসলুম। এম ডি আমার পাশে বসলেন। একটু আগে সাফল্যের স্বপ্নে বিভোর হয়ে ছিলুম। ভবিষ্যৎ উড়ে আসছিল বার্ডস অফ প্যারাডাইসের মতো রঙিন পাখা মেলে। আশঙ্কায় মন আর কোনও কাজ করছে না। স্থির হয়ে গেছে। দু’পাশ দিয়ে দৃশ্য ছুটে চলেছে। দেখেও দেখছি না।

এম ডি একবার শুধু বললেন, ঘটনার ওপর মানুষের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই, পলাশ। যখন যা ঘটার তখন তা ঘটবেই। আমরা শুধু দর্শক। তুমি অত মুষড়ে পোড় না। তুমিই না সকালে আমাকে গেয়ে শোনালে, কত ডুববে উঠবে জীবন তরী। চঞ্চলতা এনো নাকো। এই তো তার হাতেনাতে পরীক্ষা।

মানুষ কী মন নিয়ে ফাঁসির মঞ্চের দিকে যায় আমার জানা নেই। আমার এই মুহূর্তের মনের। অবস্থা দেখে হয়তো কিছুটা অনুমান করা যায়।

মেডিকেল কলেজের বিশাল চত্বরে গাড়ি এসে ঢুকল। এপাশে-ওপাশে এক-একটা ব্লক ইটের দৈত্যের মতো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। অদ্ভুত নিচু একটা সিঁড়ি দু’পাশ দিয়ে একটা চাপা বারান্দা মতো জায়গায় উঠে গেছে। বড় বড় অক্ষরে লেখা, ব্লাডব্যাঙ্ক। পাশেই এমার্জেন্সি। সামনেই পঁড়িয়ে আছেন পঙ্কজবাবু। আমাদেরই অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে, অথচ আমাদের দেখতে পাচ্ছেন না। এম ডি সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই চমকে উঠলেন

এ কী? আপনি? না, না তুমি।

হ্যাঁ, আমি। ছেলেটাকে একা ছাড়ি কী করে? ভীষণ নার্ভাস হয়ে পড়েছে। কী অবস্থা? মারাত্মক কিছু?

তেমন মারাত্মক নয়। তবে হতে পারত। ভগবান বাঁচিয়ে দিয়েছেন। তেমন হলে চোখদুটো যেত।

ও তো একজন নামকরা পাকা কেমিস্ট। কী করে কী হল?

আর বোলো না, এক জুনিয়ারের কীর্তি। কীসে কী হয় ধারণাই নেই। একোয়ারিজিয়া দিয়ে কী একটা করছিল, ফ্লেম কন্ট্রোল করতে পারেনি। এক টেস্টটিউব মাল ছিটকে বুকে এসে পড়েছে। গেঞ্জিতে সোক করে, খুলে ফেলতে ফেলতেই ড্যামেজ হ্যাঁজ বিন ডান।

ডাক্তার অ্যাটেন্ড করেছেন?

হ্যাঁ, সঙ্গে সঙ্গে। ভাগ্য ভাল, এমার্জেন্সিতে আজ তড়িৎ আছে।

তড়িৎ! আমাদের সেই তড়িৎ! যে বলত সাধু হয়ে সংসার ত্যাগ করব!

এখনও সেই ভাবই আছে। সুযোগ খুঁজছে। সংসারে একমাত্র বন্ধন মা। বুড়ি গেলে ওকে ধরে রাখা শক্ত।

চলো তা হলে, আমাদের বীর সৈনিককে এবার দেখে আসি। আজ ছাড়বে, না রেখে দেবে?

পড়েছে তড়িতের হাতে। সহজে নিষ্কৃতি পাবে বলে মনে হয় না।

যেতে যেতে পঙ্কজবাবু বললেন, ঘাবড়াবার কিছু নেই। স্কিনটা সামান্য পুড়ে গেছে। দিন পনেরোর মধ্যেই ঠিক হয়ে গেছে দেখবে। শুনলুম, তোমার মাতামহ ভীষণ অসুস্থ।

আজ্ঞে হ্যাঁ, বেশ ভালই অসুস্থ।

হরি সেইসব কথাই বলছিল, এমন সময় ওই কেয়ারলেস কেমিস্ট, সবই মানুষের নিয়তি! কার যে কখন কী হয়!

এমার্জেন্সিতে ঢুকতেই মাথা ঘুরে গেল। দিন আর কতটাই বা গড়িয়েছে, এর মধ্যেই আশেপাশে কত কী ঘটে গেছে! ফুটফুটে ডলপুতুলের মতো একটি মেয়ে বাবার সাইকেলের পেছনে বসে ইস্কুলে যাচ্ছিল। স্পোকের মধ্যে পা ঢুকে চুলের বিনুনির মতো পাকিয়ে গেছে। মেয়েটির পিতা হায় হায় করছেন, এ আমি কী করলুম, এ আমি কী করলুম।

খুড়ো ভাইপোর মাথায় শাবল ঝেড়ে দিয়েছে। মাথা একেবারে ফুটিফাটা হয়ে গেছে। পাশেই ছেলেটির মা দাঁড়িয়ে আছেন। বোধহয় ছেলেকে জড়িয়ে ধরে এনেছিলেন। রক্তে থানধুতি ভেসে গেছে। সঙ্গে একজন পুরুষ রয়েছেন। ভালমানুষ স্কুল শিক্ষকের মতো নিরীহ চেহারা।

কোনও এক কারখানার কর্মী এসেছেন। মেশিনে হাত ঢুকে ডান হাতের তিনটে আঙুল কেটে ঝুলে পড়েছে। সঙ্গীসাথীরা রক্ত দিতে হবে রক্ত দিতে হবে বলে চিৎকার করছেন।

এক তরুণী শেষরাতে বিষ খেয়ে বসে আছে। পেট থেকে পাম্প করে বিষ বের করার আয়োজ চলছে। মেয়েটির সাংঘাতিক চেহারার শাশুড়ি মাকে শাসাচ্ছেন, কী মেয়ের জন্ম দিয়েছিলেন। কুলটা। নিজে মরছে মরুক, আমার সোনারচাঁদ ছেলেটাকে জেল খাটাবার মতলব!

ডাক্তার আর সাদা পোশাক পরা সিস্টাররা ছুটোছুটি করছেন। সকলকে সামলাবার চেষ্টা করছেন। ছিন্নভিন্ন এক-একটি প্রাণী ওটিতে যাচ্ছেন। কারুর হাত যাবে, পা যাবে, কেউ সেলাইফেঁড়াই হয়ে বেরিয়ে আসবে। কারুর চোখ হয়তো আর খুলবেই না। কাঁদতে কাঁদতে এসে হাসতে হাসতে চলে যাবেন।

কেমন যেন দিশাহারা হয়ে যাবার মতো অবস্থা। এই কুরুক্ষেত্রের কোথাও আমার পিতৃদেব নেই। তিনি বসে আছেন ভেতরের একটি বিশেষ ঘরে। উর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত। পদ্মাসনে যেন ধ্যানে বসেছেন। বুকে হলদে মলমের প্রলেপ। ডানা মেলে হলুদ রঙের একটি হাঁস যেন উড়ে চলেছে। সুন্দর চেহারার অবাঙালি একজন সিস্টার তার পরিচর্যায় ব্যস্ত। কিছুদূরে বসে আছেন ডাক্তারবাবু। তিনি নানারকম নির্দেশ দিচ্ছেন।

আমাদের দেখে পিতৃদেব উঠে দাঁড়াতে গেলেন। সিস্টার মৃদু ধমক দিলেন, ডোন্ট মুভ, ডোন্ট মুভ। আই হ্যাভ নট ফিনিল্ড ইয়েট।

ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জে ডিসটিল্ড ওয়াটার ভরতে ভরতে তিনি আমাদের দিকে ভুরু তুলে তাকালেন।

প্রথমে কথা বললেন এম ডি, কী রে, চিনতে পারিস?

 পিতা দু’হাত তুলে বললেন, হ্যালো, মাই ওল্ড ফ্রেন্ড!

হাত তোলার ফলে বুকে বোধহয় টান পড়ল। যন্ত্রণার অভিব্যক্তি মুখে ফুটে উঠতে গিয়েও উঠল না। হাসির তলায় চাপা পড়ে গেল। একেই বলে পুরুষমানুষ। উত্তরাধিকার সূত্রে সিকির সিকি গুণও যদি পেতুম।

ইঞ্জেকশনের শিশির রবার ছ্যাঁদা করে জল ভরতে ভরতে সিস্টার বললেন, ইয়োর রেস্টলেসনেস উইল বি কস্টলি ফর মি। মাইন্ড ইট।

পিতা বললেন, আই অ্যাম সরি।

ডাক্তারবাবু উঠে দাঁড়ালেন। এ যেন কলেজ রিইউনিয়ন। চার বন্ধুর সঙ্গমে আমি এক উত্তরপুরুষ হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছি। ওপাশে দন্তুর জীবনের আক্রমণে শতছিন্ন প্রাণের আর্তনাদ, ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে জীবনমৃত্যুর সাপে নেউলে খেলা, এদিকে অতীতে বর্তমানে মহামিলন।

এম ডি বললেন, তড়িৎ, দাড়িটাড়ি রেখে কী হয়েছিস! র‍্যাসপুটিনের মতো চেহারা করেছিস।

ডাক্তার বললেন, তোর চেহারার মধ্যে একটা মুখ্যমন্ত্রী-মুখ্যমন্ত্রী ভাব এসেছে রে। পশ্চিমবাংলার নাম্বার ওয়ান শিল্পপতি।

পিতা বললেন, বুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। উপায় নেই। থাইমলের দাগ লেগে যাবে।

সিস্টার পুট করে ওপর বাহুতে উঁচ ফুটিয়ে দিলেন। হাসিমুখে বললেন, নড়িবেন না, উঁচ ভাঙিলে বন্ধুগণ কিছুই করিতে পারিবেন না।

এতক্ষণ লক্ষ করিনি, পিতৃদেবের ডান চোখের ঠিক নীচে একটা পোড়া দাগ। একোয়ারিজিয়া সাংঘাতিক বস্তু। সোনা গলে যায়। মানুষ তো গলবেই। ওই জায়গাটার দিকে ডাক্তারদের এখনও চোখ পড়েনি।

ডাক্তারবাবু বললেন, একটু চা হোক।

তিনজনে সমস্বরে বললেন, হয়ে যাক। হয়ে যাক।

ওয়ার্ডবয় ছুটলেন চা আনতে। মানুষের বুক বড় নরম জায়গা, সেখানে গরম হাইড্রোক্লোরিক আর নাইট্রিকের মিশ্রণ কী ক্ষতি করতে পারে ডাক্তার না হলেও আমার জানা আছে। শুধুমাত্র অসম্ভব মনের জোরে মানুষটি স্থির হয়ে বসে আছেন। ছাত্রজীবনের বন্ধুদের সঙ্গে মাপা রসিকতা করে যাচ্ছেন।

চা শেষ করে ডাক্তারবাবু বললেন, নাও চলো, তোমাকে ভি আই পি কেবিনে পুরে দিয়ে আসি। আমাদের সেবাযত্নে দিনকতক থাকো।

তার মানে? তুমি আমাকে হাসপাতালে ভরে রাখবে? আমার দুঃস্বপ্নেও এমন সম্ভাবনা দেখিনি। এমন আহামরি কিছু হয়নি যে হাসপাতালে পড়ে থাকতে হবে।

এম ডি বললেন, বার্নকেসে সেবাযত্নের প্রয়োজন। টোয়েন্টি ফোর আওয়ারস্ সাফারিং। তুমিও কেমিস্ট্রি আমিও কেমিস্ট্রি। কীসে কী হয় ভালই জানিস। গোঁয়ারতুমি করিসনি।

আমার থাকার উপায় নেই।

পঙ্কজবাবু বললেন, ছেলের কথা ভাবছিস?

শুধু ছেলে কেন? শ্বশুরমশাই অসুস্থ। আমার ভরসায় এখানে আছেন।

পঙ্কজবাবু বললেন, তোমার বাড়ির দায়িত্ব আমি নিচ্ছি।

পিতা চেয়ার থেকে পা নামিয়ে জুতো খুঁজতে লাগলেন। তার মানে জুতো পরেই দৌড় মারবেন। কারুর ক্ষমতা নেই ধরে রাখে।

ডাক্তারবাবু উঠে এসে বললেন, হরি, নাউ আয় অ্যাম সিরিয়াস। এখন আর আমি তোর বন্ধু নই, ডাক্তার। জীবন নিয়ে খেলতে গিয়ে মৃত্যুকে প্রশ্রয় দেওয়া চলে না। আমরা মৃত্যুর শত্রু। গেট আপ। তোমার ব্যাপারটাকে খুব সামান্য ভেবো না। পোড়ার ডিগ্রি আছে জানো! এটা তোমার কেমিস্ট্রি নয়। গেট আপ।

অসহায় মুখে পিতা উঠে দাঁড়ালেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কিছুদিনের জন্যে নন প্লেয়িং ক্যাপ্টেন হয়ে গেলুম। সামলাতে পারবে তো?

সেই সতীমার হাসি শুনতে পেলুম। গঙ্গার ঘাট ভেঙে ভেঙে উঠছেন আর বলছেন, ওই দেখ তোর পথ। ফণীমনসার ঝোঁপের পাশ দিয়ে চলে গেছে অন্ধকারের দিগন্তে। জীবনের কাছ থেকে কিছু আশা করিসনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *