2 of 3

১.৫৩ দিয়েছিলে জ্যোৎস্না তুমি

দিয়েছিলে জ্যোৎস্না তুমি, নিয়ে আছি অন্ধকার

সারাশহরের যানচলাচল বিপর্যস্ত করে বিশাল এক মিছিল বেরিয়েছে। কোনও এক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের। সিংহাসনে বসে আছেন ধর্মগুরু। সিল্কের গেরুয়া পরে। সিংহাসন চলছে কলে। একটা হুড-খোলা মোটরগাড়িকেই ওইভাবে সাজানো হয়েছে। ফুলে ফুলে ছয়লাপ। ধর্মগুরুকে দেখতে ভারী সুন্দর। তপ্তকাঞ্চনের মতো গাত্রবর্ণ। মুখশ্রী যিশুখ্রিস্টের প্রায় কাছাকাছি। অতি সুন্দরী দুই মহিলা দু’পাশে বসে চামর ব্যজন করছেন। তার মধ্যে একজন বিদেশিনী।

জ্যামে আটকে পড়া বাসের জানলায় বসে বসে মিছিল দেখছি। ধর্মোন্মাদ নরনারী সুললিত সংগীত করতে করতে গুরুকে নিয়ে চলেছেন। এই যে সব বলেন ধর্মজগতে নারীসঙ্গ বর্জন করে চলতে হয়! ও না, সে মনে হয় প্রাথমিক স্তরে। একটু এগিয়ে গেলে, কী বা নারী, কী বা পুরুষ! ‘সেক্সলেস’ দৃষ্টিতে পৃথিবীকে দেখা। সে দেখাটা কেমন কে জানে! অমন কন্দর্পকান্তি চেহারা পেলে বুক ঠুকে সংসার ত্যাগ করে সাধনজগৎ তোলপাড় করে দেখা যেত। পৃথিবী মোটেই মর্কটের জন্যে নয়। মিছিলে দু’একজন ভক্ত মহিলার ভাবোন্মেষ হয়েছে। তারা টলেটলে চলেছেন। শাড়ির আঁচল শরীর থেকে খুলে পথে লুটোচ্ছে। একেই বলে, সুরাপান করিনে আমি সুধা খাই জয়কালী বলে।

অফিস থেকে যেটুকু আগে বেরোবার সুযোগ পাওয়া গিয়েছিল, সেটুকু সময় পথেই পড়ে রইল। বাড়ি ফেরার জন্যে মন ছটফট করছে। মুকুর রেখে যাওয়া খাম আমাকে আজ খুলতেই হবে। পৃথিবী যদি উলটেও যায় আজ আমি খুলে দেখবই।

মিছিল ধীরে ধীরে দক্ষিণে চলে গেল। ট্রাম আর বাসের জট একটু একটু করে খুলছে। ভেবেছিলুম সন্ধের আগে বাড়ি পৌঁছে যাব, তা আর হল না। মুকুরা এতদিনে বাড়ি পৌঁছে গেছে। সেখানে কী হচ্ছে কে জানে! এসেছিলেন তিনজন, ফিরে গেলেন দু’জন। আমার মাতুলও মনে হয় এতক্ষণে তার নতুন কর্মস্থলে পৌঁছে গেছেন। কতক্ষণের পথ। মাতামহকে পিতা আটকে দিয়েছেন। আগে শরীর, তারপর তীর্থধর্ম। আজ আসবেন একজন বড় ডাক্তারবাবু। তারই নির্দেশে চিকিৎসা চলবে। রক্ত পরীক্ষা, দেহনির্যাস পরীক্ষা। ছুটোছুটি আমারই বাড়বে। তা বাড়ুক, কাউকে আমি হারাতে চাই না। জীবন হবে পূর্ণ, তা নয় কেবলই শূন্য হয়ে আসছে। সবাই যেন পা নামিয়ে বসে আছেন। ঈশ্বর একবার স্টার্ট বললে হয়। দৌড়োতে শুরু করবেন। যে-সূর্য রোজ সকালে ফিরে আসেন, দিবাশেষে তার অস্তমুহূর্তে মন বিষণ্ণ হয়ে ওঠে। মানুষের অস্তের তো আর উদয় নেই। সব সম্পর্ক শেষ করে, সব ঘুচিয়ে চলে যাওয়া। নাঃ, ক্ষমতা থাকলে ধর্মগুরুই হতুম। তাকে ধরেই পড়ে থাকতুম, যার উদয় নেই, অস্ত নেই, ক্ষয় নেই। সদা পূর্ণ।

বাস এতক্ষণ আটকে থাকার শোধ তুলে নিচ্ছে। ঝড়ের গতিতে ছুটছে। যাত্রীরা খুব খুশি। গতির উত্তেজনায় সব বাহবা বাহবা করছেন। আমার পাশে বসে ছিলেন এক বৃদ্ধ। তিনি কেবলই বলতে লাগলেন, যখন ভিড়িয়ে দেবে তখন বুঝবে মজা, বাহবা বেরিয়ে যাবে। একটু গলা চড়িয়ে কনডাক্টরকে বললেন, ওহে, আমরা বাড়ি যেতে চাই, হাসপাতালে নয়। পেছন থেকে এক ভদ্রলোক ব্যঙ্গ করলেন, দাদু, এখনও এত প্রাণের মায়া! ঘাড় না ঘুরিয়ে বৃদ্ধ বললেন, নাতি, আমার জন্যে নয়, ভাবছি তোমার জন্যে, নাতবউ যে কাঁচা বয়েসে বিধবা হবে।

নাতির মুখে আর কথা সরল না। দুটো স্টপেজ পরে বৃদ্ধ নেমে গেলেন। তিনটে স্টপেজ পরে নেমে গেলেন ব্যঙ্গকারী যুবক। আকাশের আজ খুব শোভা। পুব আকাশে গুটিগুটি শামুকের গতিতে চঁদ উঠে পড়েছে। আমাদের এ তল্লাটে এখনও বড় বড় গাছ আছে। ডালপালা থেকে জলের ফোঁটার মতো ভিজেভিজে চাঁদের আলো চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে।

বাড়ি একেবারে শান্ত। কাকিমা সবে গা ধুয়ে তারে ভিজে জামা মেলছেন। ভিজে শাড়ি জড়ানো শরীর। আমার পায়ের শব্দে ফিরে তাকালেন। সামান্য অনুযোগের গলায় বললেন, তুমি বলেছিলে আজ তাড়াতাড়ি আসবে, এই তোমার তাড়াতাড়ি?

কী করব! এক ঘণ্টার পথ আসতে দু’ঘণ্টা সময় লাগল। আমার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তারে বোধহয় বেশি টান পড়েছিল, পটাং করে ছিঁড়ে সায়াব্লাউজ সমেত উঠোনে নেমে এল।

কাকিমা বললেন, যাঃ হয়ে গেল, আবার কাচো।

আগে ভিজে কাপড়টা শরীর থেকে খুলুন। ঋতু পরিবর্তনের সময়, জ্বরে পড়লে কে দেখবে?

দেখার মানুষ আছে।

সে কে?

এই যে, আমার সামনে দাঁড়িয়ে।

কাকিমা নিচু হয়ে জামাকাপড় তুলতে লাগলেন। হঠাৎ মনে হল, আমি সংসার পেতে ফেলেছি। আমাকে আর গৃহী করার প্রয়োজন কী? গৃহী তো হয়েই গেছি। আবার সেই রাত আসছে। আজ কী হবে! কে কোথায় থাকবে? আসুক রাত, তখন ভাবা যাবে।

কাকিমা বললেন, আজ সারাদুপুর বসে বসে তোমার জামাকাপড় সব কেচে দিয়েছি। ওপরের চেয়ারে পাট করা আছে। ইস্ত্রিতে দেবার হলে দিয়ে দিয়ে।

এত কষ্ট করতে গেলেন কেন?

আমার খুশি। তুমি এখন চা খাবে?

খাব।

তা হলে হাত মুখ ধুয়ে এসো।

সিঁড়ির ধাপ দুয়েক উঠেছি, সদর দরজার কড়া নড়ে উঠল খড়খড় করে। কাকিমা তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে পড়লেন। আবার নেমে আসতে হল। দরজা খুলেই চমকে উ’তে হল। কী আশ্চর্য, ইনি তো সেই ভদ্রলোক। হাতিবাগানে সোনালি খরগোশ দর করছিলেন, সাথে এক ঢলে-পড়া সুন্দরী মহিলা, নিয়ে।

আমি চিনতে পেরে চমকে উঠলেও, ভদ্রলোক আমাকে চিনতে পেরেছেন বলে মনে হল না। কাকিমার নাম করে বললেন, আছে?

খুবই ঘাবড়ে যেতে হল, কে এই ভদ্রলোক? সাজপোশাক ঠিক সেদিনকার মতোই। শরীর থেকে ফিনফিনে ধারালো এক গন্ধ উঠে এসে নাকে লাগছে। মুখে পাউডার মেখেছেন, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহই নেই। এইরকম একজন মানুষ কাকিমাকে খুঁজছেন কেন? বেশ সাবধানে সংযত হয়ে বললুম, কেন বলুন তো?

ভদ্রলোক হাসলেন। বাঁধানো দাঁত। ভয় নেই। তুমি আমাকে চেনো না। আমি তার মামাশ্বশুর। আমার কথা নিশ্চয়ই শুনেছ?

তাড়াতাড়ি সরে দাঁড়ালুম। বললুম, আসুন, আসুন।

কালো ফিতেপাড় ধুতির কেঁচাটিকে সাবধানে হাতে ধরে ভদ্রলোক চৌকাঠ টপকে ভেতরে এলেন। জুতোর বার্নিশ ঝিলিক মেরে উঠল। আমি জানি ভদ্রলোকের শরীরে তেমন জোর নেই। সেদিনে সেই ‘বাকসম’ মহিলার উৎসাহের আকর্ষণে উলটে পড়ে যাচ্ছিলেন। ভেতরে পা রেখেই ভদ্রলোক গ্রাম্যসুরে চিৎকার করে উঠলেন, কই গো, কোথায় গেলে?

কাকিমা কোনওরকমে একটা শাড়ি জড়িয়ে বেরিয়ে এসেছেন, আসুন মামাবাবু, আসুন।

নিচু হয়ে প্রণাম করতে গেলেন, ভদ্রলোক হাতদুটো খপ করে চেপে ধরে মহিলাকে প্রায় বুকের কাছে টেনে নিতে চাইলেন। এক সার সোনার বোম বুকের কাছে সঁত বের করে হাসছে। বয়েস মানুষকে কিছু লাইসেন্স দেয়; কিন্তু এ মানুষটি তো লাইসেন্সস। কেউ না জানুক আমি জানি।

কাকিমা সরে যাবার চেষ্টা করতে করতে বললেন, মামাবাবু, আপনি তা হলে ওপরেই বসুন।

ওপরে কেন? নীচেটাই তো বেশ ভাল।

না না, বড় ড্যাম্প, মশা। আপনি বসতে পারবেন না।

এখন আমি সব পারি গো। একসময় ছিল যখন গোকুল আড়ি ওয়েলার ঘোড়া জুতে ফিটন চাপত। স্কচ ছাড়া কিছু গলায় ঢালত না। এখন সব শেষ। কলসির জল গড়াতে গড়াতে এখন সব ফৌত।

মনে মনে ভাবলুম ফৌত তো হবেই, অসুখটা যে খুব সিরিয়াস। সোনার হরিণ ধরে দিতে গিয়ে রামচন্দ্র কাত হয়ে গিয়েছিলেন, ইনি আবার সোনার খরগোেশ কেনেন।

কাকিমা বললেন, তা হোক, আপনি ওপরেই বসুন, আমি চা চাপাচ্ছি।

কাকিমা যেমন করেই হোক ভদ্রলোককে ওপরে পাঠাতে চান, ভদ্রলোকও নাছোড়বান্দা। নীচেটাই তার পছন্দ। শেষে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বাবা কোথায়?

এখনও ফেরেননি। অফিসে।

তা হলে একা একা আমি ওপরে কী করব? এলুম তোমার কাছে, তুমি আমাকে ওপরে পাঠিয়ে দিচ্ছ! ভদ্রলোকের মতিগতি ভাল নয়। সন্ধেবেলা শাখের শব্দে ঘরে ঘরে দেবতারা আসেন, কোথা থেকে এই বৃদ্ধ মদন-মঞ্জরি এসে হাজির হলেন! মেয়েদের জীবন কী ক্যাডাভারাস! খোলা পড়ে থাকার উপায় নেই। মিষ্টির মতো। ভ্যানভ্যান করে মাছি আসবে, বোলতা আসবে। তা আমার এত গায়ের জ্বালা কেন? কারণ আছে। অবচেতনায় একটা অধিকারবোধ জন্মেছে। ঘটার আগেই ঘটনা দেখতে পাচ্ছি। যাক গে, মরুক গে, এই কচলাকচলি দেখতে আর ভাল লাগছে না। আমার অত মাথাব্যথার কোনও কারণ নেই। আমার চেয়েও মামাশ্বশুর নিশ্চয়ই আপনার জন। অন্যের চরিত্রে ছিদ্র অন্বেষণ করার আগে নিজের চরিত্র সামলানো উচিত। চালুনির কি আর ছুঁচের বিচার চলে!

ওপরটা একেবারে পরিপাটি করে সাজানো। দেখলেই বোঝা যায় এর পেছনে বেশ রুচিবান একজন মহিলার সারাদিনের হাতের স্পর্শ রয়েছে। রাগতে গিয়েও রাগা যায় না। অভিমান ফেলে দিতে হয় ছুঁড়ে। চান করে নিতে পাঁচ মিনিটেরও বেশি সময় লাগল না। চায়ের আশায় বসেই আছি, বসেই আছি। কাকস্য পরিবেদনা। নীচে নামতেও ভরসা পাচ্ছি না। কী দেখতে কী দেখে ফেলব! চোখে উড়ে এসেছে পাপীর দৃষ্টি। বৃদ্ধ, তায় আবার আপনজন, তার ওপর ভোগী। অসীম ছাড়পত্র হাতে। মাঝখান থেকে এক কাপ চা জুটল না বরাতে। নিজে করে খাব, সে উৎসাহেও ভাটা পড়ে গেল।

হঠাৎ বুকসেলফের দিকে নজর চলে গেল। পিতৃদেবের ধর্মভাব আসায় একের পর এক আধ্যাত্মিক বই কিনে চলেছেন। সম্প্রতি পাঁচ খণ্ডে সম্পূর্ণ শ্রীমৎ কুলদানন্দ ব্রহ্মচারী শ্ৰীশ্রীসদ্গুরু সঙ্গ কিনে এনেছেন। পাঁচটি খণ্ড পরপর পাশাপাশি সাজানো। এখনও পর্যন্ত একদিনও আমি খুলে দেখিনি। কী খেয়াল হল, দ্বিতীয় খণ্ডটা টেনে নিয়ে পাতা ওলটাতে লাগলুম। শুনেছি ধর্মজগতে এর চেয়ে খোলাখুলি ডায়েরি বিরল। পাতা ওলটাতে ওলটাতে মনে হল, বইটির অদ্ভুত আকর্ষণী শক্তি। যেখানেই খুলছি, সেইখানেই চোখ আটকে যাচ্ছে। সংস্কারমুক্ত প্রকৃত সাধকের উপলব্ধি বলেই এমন

পাতার পর পাতা ঘুরতে ঘুরতে একটি পরিচ্ছেদে এসে চোখ আটকে গেল। হেডিং, প্রলোভনে অবিকার, অহংকারে পতন। অংশটি পড়ে অবাক হয়ে গেলুম। মায়ের অসুখের খবর পেয়ে ব্রহ্মচারী বাড়ি ফিরছেন। তার নিজের ভাষায়, কিন্তু বিধির পাকে দুৰ্ম্মতিবশতঃ এদিকে সেদিকে মাসাধিককাল ঘুরিয়া বেড়াইলাম। এই সময়ে কিছুদিন এক পরিচিত লোকের ভবনে আমায় অবস্থান করিতে হইল। যে-ভদ্দরলোকের বাড়িতে উঠলেন, তিনি একদিন বিষয়কর্মে কিছুদিনের জন্যে বাইরে যেতে বাধ্য হলেন। যাবার সময় ব্রহ্মচারীজির ওপর বাড়ি এবং এক অবিবাহিতা মহিলার তত্ত্বাবধানের ভার দিয়ে গেলেন। চাকর চাকরানী ব্যতীত অন্য পরিজন না থাকায়, কামিনীর তত্ত্বাবধানের ভার বাবু আমারই ওপর রাখিয়া গেলেন। বিশেষ ঘনিষ্ঠতা হেতু সজনে নির্জনে নিঃসংকোচে আমার সহিত ভঁহাদের আলাপন, উপবেশন বহুকাল যাবৎ চলিয়া আসিতেছে। আমার আসন ও শয়নের স্থান উহাদের আগ্রহে ও জেদে ভিতরেই হইল। বেলা বারটা পর্যন্ত আমি নির্জনে সাধনভজনে কাটাইতাম, রমণী তখন আপন গৃহকর্মে রত থাকিতেন। মধ্যাহ্নে আহারান্তে ভৃত্যবর্গ বাহিরে চলিয়া যাইত। কামিনী তখন একাকিনী এক ঘরে না থাকিয়া আমার ঘরে আসনের কিঞ্চিৎ অন্তরে শয়ন ও বিশ্রাম করিতেন। এই সময়ে তিনি ধর্মপ্রস্তাব তুলিয়া, সরলতার ভানে, নিজের আভ্যন্তরিক কুভাব আমার নিকটে ধীরে ধীরে প্রকাশ করিতে লাগিলেন। আমি বিষম সংকট সমস্যায় পড়িয়া কি করিব ভাবিতে লাগিলাম।

ব্রহ্মচারীজি এরপর লিখছেন, “উঁহার কোন চেষ্টায়ই বাধা দিতে আমি সাহস পাইলাম না। মনে হইল এই অবস্থায় উঁহাদের অসাধ্য কার্য কিছুই নাই। আমার কোন বিরুদ্ধ ব্যবহারে যদি উঁহার মর্মে ও অভিমানে আঘাত পড়ে, এখনই যুবতী আমার নামে কুৎসিত কথা বলিয়া, চিৎকার করিয়া দশজনকে একত্রে করিবেন, এবং মুহূর্ত মধ্যে আমাকে অপদস্থ করিয়া চিরকালের মতো। আমার অখ্যাতি অপযশ দেশে বিদেশে রটনা করিবেন। এক দিবস আমি বিষম বিপদ উপস্থিত বুঝিয়া আতঙ্কে অন্ধকার দেখিতে লাগিলাম। ঠাকুর কতবার বলিয়াছেন– পুরুষ অভিভাবক : উপস্থিত না থাকলে কোন গৃহস্থের বাড়ীতে ক্ষণকালও অবিবাহিত যুবকের থাকা উচিত নয়।মনে হইল ঠাকুরের এই অনুশাসন বাক্য, সামান্য জ্ঞানে অগ্রাহ্য করিয়াই আজ আমি বিপন্ন হইলাম। তখন গুরুদেবের অভয়-চরণ স্মরণ করিয়া পুনঃ পুনঃ তাঁহাকে প্রণাম করিতে লাগিলাম। কিছুক্ষণ কামিনী অতিরিক্ত সাহসে বিষম চঞ্চলতা প্রকাশ করিয়া অবশেষে “ও হরি! তাই তুমি ব্রহ্মচারী।” বলিয়া সলজ্জ হাসিমুখে অন্যঘরে চলিয়া গেলেন।

তারপর কী হল! নিজের জীবনের প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি। দেখতে পাইনি কাকিমা কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন চা হাতে।– কী পড়ছ অত মন দিয়ে?

গম্ভীর গলায় বললুম, বই।

সে তো দেখতেই পাচ্ছি। কী বই?

একটা বই।

বাবুর রাগ হয়েছে?

রাগ হতে যাবে কোন দুঃখে?

হ্যাঁ, হয়েছে তো। কাটা কাটা কথাতেই বোঝা যাচ্ছে। কী করব বলো? বুড়োর যেন ছেলেমানুষের মতো বায়না!

কাকিমা টেবিলের ওপর চায়ের কাপ রেখে আমার চেয়ারের পিঠে বুক ঠেকিয়ে মাথায় হাত রেখে দাঁড়ালেন। মাথার চুলে সরু সরু আঙুল খেলছে। চুড়ির শব্দ হচ্ছে রিনিঠিনি। শ্বাসপ্রশ্বাসে ঘাড়ের কাছে অতি কোমল কিছুর ওঠা-পড়া। গা শিরশির করছে। আয়েশে চোখ বুজে আসছে। শিথিল থেকে শিথিলতর হয়ে পড়ছি। কোমল অন্ধকার কম্বলের মতো ঘিরে আসছে চারপাশ থেকে। আমিও কি সাধক ব্রহ্মচারীর মতো এঁকে প্রণাম করব? পায়ে ধরব? পা যে বড় সর্বনেশে অঙ্গ। পদযুগলে যে আমার মাতৃদর্শন হয় না। মন যে অন্যভাবে উতলা হয়ে ওঠে।

চিবুকটি মাথার ব্রহ্মতালুতে রেখে, আলগা দুটো হাত আমার দু’কাঁধের ওপর দিয়ে বুকের কাছে। মৃণালকাণ্ডের মতো ফেলে, মহিলা বড় আদরের গলায় বললেন, কী, তুমি চা খাবে না?

আমার ভেতরে আমার মৃত্যু হল। রমণীর সোহগে গলে গিয়ে, শুভ্র সুগোল দুটি হাত নিজের মুঠোয় চেপে ধরে বললুম, নিশ্চয়ই খাব। না খেয়ে পারি!

চিবুকটা ঘষে দিয়ে, বুকের কাছে হাত খেলিয়ে কাকিমা বললেন, আমার লক্ষ্মী ছেলে। তুমি চা খাও, আমি আসছি। বুড়োকে ভাগাই।

ঘাড় ঘুরিয়ে কাকিমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসতে গিয়ে ছোট্ট চুল-ঘেরা কপালের দিকে নজর পড়ে গেল। কপালের মাঝখান থেকে টিপটা অনেকখানি ডানপাশে সরে গেছে। কেন গেছে? কী করে গেছে? নানা সন্দেহে মন আবার জল থেকে সদ্যতোলা এক মুঠো কুচো কঁকড়ার মতো লাফাতে লাগল। কাকিমা নীচে যাবার জন্যে ঘুরে দাঁড়ালেন। সেই চেকচেক শাড়িটা আজ পরেছেন। স্বাস্থ্যেরও যেন কিছু উন্নতি হয়েছে। মুখ যেন মোমের মতো মসৃণ, কপালের দুটো পাশ ঝকঝক করছে। শাড়ির আঁটসাঁট বাঁধনে শরীরে অদ্ভুত এক ছন্দ খেলা করছে। দেখব না, দেখতে চাই না, তবু চোখ উড়ে যাচ্ছে।

রমণীরে, সৌন্দর্য্যে তোমার
সকল সৌন্দৰ্য্য আছে বাঁধা।
বিধাতার দৃষ্টি যথা
জড়িত প্রকৃতি সনে
দেব-প্রাণ বেদ-গানে সাধা!

এ আবার কোথা থেকে কী লাইন এসে গেল! পড়ছিলুম সাধকের সাধন-জীবনের বিভ্রান্তির কথা। আলো আসতে আসতে অন্ধকার ঘিরে এল। অবশেষে ব্রহ্মচারীজির কী হল–

‘আমি তখন স্পর্ধিত মনে ভাবিতে লাগিলাম–”ব্রহ্মচর্যের নিয়ম পালন করিয়া, নিশ্চয়ই আমার অপূর্ব শক্তিলাভ হইয়াছে; তাই ঈদৃশ ব্যাপারে আমি নির্বিকার অবস্থান করিতে সমর্থ হইয়াছি। আমি যথার্থই সাধনরাজ্যের পিচ্ছিল পন্থা অতিক্রম করিয়া, নিরাপৎ ভূমি লাভ করিয়াছি।” কিন্তু হায়, এই প্রকার অযথা অহংকারের কয়েকদিন পরেই আমার সর্বনাশ হইয়াছে বুঝিলাম। ঘটনার সূত্র ধরিয়া ধীরে ধীরে আমার ভিতরে আগুন লাগিল। বেড়াপাক বহ্নির কালধূমে দুর্লভ ব্রহ্মচর্যের উজ্জ্বল দীপ্তিকে অন্তর্হিত করিল। আমি পূর্বের অপূর্ব পবিত্র অবস্থা হইতে স্খলিত হইলাম।‘

বৈদ্যুতিক করাত দিয়ে কাঠ কাটার সময় যেরকম শব্দ হয় সেইরকম একটা শব্দ সদর রাস্তায় উঠেই থেমে গেল। গাড়ির দরজা বন্ধের শব্দ হল। আবার গাড়ি! আবার এই অসময়ে কে এলেন! চকোলেট রঙের নতুন একটা গাড়ি বাড়ির সামনে থেমেছে। বিদেশি গাড়ি। বেশ লম্বাটে চেহারা। এ গাড়ির পেট্রলেও বিদেশি সুবাস। পেছনের দরজা খুলে পিতৃদেব নেমে এসে ওপর দিকে মুখ তুলে তাকালেন। সোজা অফিস থেকে আসছেন। সেই ধরনের ব্যক্তিত্ব মুখেচোখে এখনও লেগে রয়েছে। পোশাক পরিচ্ছদ অনেকটা ডক্টর বি সি রায়ের মতো। চেহারাতেও বেশ কিছুটা মিল আছে।

এতক্ষণের সৎ-অসৎ চিন্তা মাখানো আমার মুখটি দোতলার বারান্দায় ঝুলে ছিল। আঙুলের ইশারায় নীচে ডাকলেন। যেন মুক্তি পেলুম! নিজের চেষ্টায় নিজের থেকে বেরোতে পারছিলুম না। ক্রমশই এক অতলান্ত ইন্দ্রিয়ের জগতে ডুবতে বসেছিলুম।

পিতা বললেন, তুমি প্রস্তুত?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

সামনে উঠে বোসো। ডক্টর সেন।

নামেই বাঙালি। চেহারায়, সাজপোশাকে পাকা সাহেব। টকটকে ফরসা মুখে সোনার ফ্রেমের চশমা। চোখদুটো চাপা অন্ধকারেও জ্বলজ্বল করছে। গাড়ি মুখ ঘুরিয়ে মাতামহের বাড়ির দিকে ছুটল। আমার ডান পাশে ডাক্তারি ব্যাগ, যন্ত্রপাতি শুয়ে আছে। একটু পরেই লাফিয়ে উঠবে। গাড়িতে যেতে যেতে মনে হল, আমার জীবনে শূন্যতার পরিমাণ খুব বেড়ে গেছে, যে কারণে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে পড়ছি ক্রমশই। আমি যদি মুটেমজুরও হতে পারতুম মনের চেহারা ফিরে যেত!

ডক্টর সেন খুব মৃদু স্বরে কথা বলেন। গলা কিন্তু বেশ গম্ভীর, একধরনের ঝংকারও আছে। ডক্টর সেন বললেন, কে দেখছেন?

পিতা বললেন, কেউ না। জীবনের এই প্রথম অসুখ।

বয়েস?

প্রায় সেভেন্টি ফাইভ।

একেবারে ভার্জিন সিস্টেম। দেন ইট উইল বি ইজিয়ার ফর মি।

সারাপথে এই কটিমাত্র কথা। দু’জনে দু’জনের ভাব নিয়ে বসে রইলেন। গাড়ির চাকা মাইল খেয়ে চলেছে। সংকীর্ণ পথ, বিশাল গাড়ি। সবেগে সদম্ভে ছুটতে পারছে না। গাড়ির রূপ দেখে দু’পাশের মানুষ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ছেন। আর আমার বেশ অহংকার হচ্ছে। মনে হচ্ছে সাধারণ স্তর থেকে কত ঊর্ধ্ব স্তরে উঠে পড়েছি। মনের কতরকম মতিভ্রম!

বাহাদুর এসে দরজা খুলে দিল। পিতা জিজ্ঞেস করলেন, বাবু কোথায়?

বুড়াবাবু পুজোয় বসেছেন।

পিতার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন ডক্টর সেন। তিনি কপাল কুঁচকে বাড়িটার দিকে তাকালেন। নারকেল পাতা ঝুলে এসেছে। বাতাসে ঝিরিঝিরি কাঁপছে। ভেবেছিলাম মাতামহ বোধহয় দোতলায় আস্তানা নিয়েছেন। না, তিনি যেখানে যে-ঘরে ছিলেন, সেই ঘরেই আছেন। সেই নারকেল গাছের তলায় আউট হাউসে। ঘরের মাঝখানে বসে আছেন আসনে স্থির হয়ে। মায়ের ছবি ঝুলছে দেয়ালে, একপাশে কাত হয়ে। জগদম্বার সঙ্গে মাতামহের বড় সুন্দর সম্পর্ক। মা কখনও ডান পাশে কাত, কখনও বাঁ পাশে, কখনও সোজা। কখনও আদর, কখনও গালাগাল।

দরজার সামনে আমরা তিনজন দাঁড়িয়ে। মাতামহ বসে আছেন আমাদের দিকে পেছন ফিরে। স্থির অচঞ্চল দীপশিখার মতো। পিতা আমাকে ইশারা করে বললেন, যাও, ভেতরে যাও, আসন। থেকে ভোলো। ভেতরে গিয়ে আসনের পাশে হাঁটু মুড়ে বসে পড়লুম। চোখদুটো বোজা। মুখে একটা অলৌকিক উদ্ভাস। অত্যাশ্চর্য একটা কিছু দেখে যেন পুলকিত! শ্বাসপ্রশ্বাস অতি ধীর। ডাকতে সাহস পেলুম না। এমন মানুষের জন্যে ডাক্তার কী হবে! তবু ফিসফিস করে বাতাসের সুরে ডাকলুম, দাদু। দ্বিতীয়বার ডাকতেই শরীরে একটা মৃদু কম্পন লাগল। তৃতীয়বার ডাকতেই মাতামহর চোখদুটো নীচের দিকে অল্প একটু খুলে গেল। যেন করমচা দ্বিধাবিভক্ত হতে চলেছে। লাল ভেলভেট। আমাকে দেখতে পেয়েছেন। মৃদু একটুকরো হাসি নেমে এল ঠোঁটের কোণে। দুটো চোখ এবার পুরো খুলে গেল। শ্রীরামচন্দ্রের চোখের মতো আরক্তিম। দু’কোণে, তলার দিকে জল টলটল করছে। সারামুখে এমন এক ধরনের হাসি, যে-হাসি মানুষ চেষ্টা করে হাসতে পারে না। বাঁ হাত মাথায় রেখে বললেন, কী রে কখন এলি?

আমি একা নই। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখুন।

মাতামহ খুব ধীরে ধীরে ঘাড় ঘোরালেন। কোনও উত্তেজনা নেই, তাড়াহুড়ো নেই। গন্তব্যের সীমায় পৌঁছে গেলে মানুষ বোধহয় এইরকমই মন্থর হয়ে আসে। শূন্য ঘট আর পূর্ণ ঘটে যে তফাত। মেঝেতে বাঁ হাত ফেলে শরীরকে বাঁ দিকে সামান্য মোচড় মেরে মাতামহ আসন ছেড়ে উঠলেন, কী ব্যাপার! তোমরা?

পিতা বললেন, হ্যাঁ, আমরা। ডক্টর সেন এসেছেন। আপনাকে পরীক্ষা করবেন।

আসুন আসুন, ভেতরে আসুন।

পিতা বললেন, এখানে কেন? ওপরে গেলে হয় না?

হরিশঙ্কর, ইটাই যে আমার স্বস্থান।

ডক্টর সেন বললেন, এ ঘরেও কোনও অসুবিধে নেই।

মাতামহ বললেন, একটু আছে। তেমন সাজানো গোছানো নয়, তা ছাড়া পাখা নেই।

পাখা কী হবে? পাখার কোনও প্রয়োজন নেই। জুতো কি খুলতে হবে?

না না, জুতো পরেই আসুন। এ ঘরে সবই চলে।

ঘরে একটা হাতল-ভাঙা ধুমসো চেয়ার। পালিশ নেই। কাঠের দানা বেরিয়ে পড়েছে। চেয়ারে একটা কম্বলের আসন পাতা। মাতামহ চেয়ারটা দেখিয়ে ডক্টর সেনকে বললেন, বসুন।

আমরা বসলুম চৌকির ধারে। মাতামহ দাঁড়িয়ে রইলেন। পিতা বললেন, আপনি বরং শুয়ে পড়ুন।

মাতামহ ভয়ে ভয়ে বললেন, হরিশঙ্কর, এঁকে মনে হচ্ছে খুব বড় ডাক্তার। বড়লোকের ডাক্তার। অনেক টাকা ভিজিট। আমার যে ভীষণ লজ্জা করছে।

ডক্টর সেন বললেন, লজ্জার কোনও কারণ নেই। ডাক্তারদের চেহারা একটু ভারিক্কিই হয়। ইনি আমার মাস্টারমশাই। ছাত্রজীবনে এমন শিক্ষক পেয়েছিলুম বলেই আজ দাঁড়াতে পেরেছি। আমিও মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে।

মাতামহ যেন সামলে উঠলেন। খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। মুখে হাসি ফুটল, বললেন, তা হলে একটু করে চা হোক ভাড়ে।

হোক, আপত্তি নেই।

একটা করে নানখাতাই বিস্কুট।

সেটা কী জিনিস?

ওই যে গো, এত বড় বড়, সুজি আর মিষ্টি দিয়ে তৈরি করে, খাস্তা মুচমুচে।

আপনার তো বেশি মিষ্টি খাওয়া উচিত হবে না।

আমি তো খাব না। আমি তো কিছু খেতেই পারছি না।

কেন? কী অসুবিধে হচ্ছে?

ডাক্তার, আমি খুব ভোজনবিলাসী ছিলুম। অশিক্ষিত গেঁয়ো লোক যেমন হয় আর কী! লোভী। সেই লোভী বামুন এখন মরেছে। বেটি বললে, দাঁড়া, এমন করে দোব, যা মুখে দিবি সব অমনি গা গুলিয়ে বেরিয়ে যাবে।

তার মানে নশিয়া?

হ্যাঁ নশিয়া।

কী খাচ্ছেন তা হলে? আজ কী খেয়েছেন?

সত্যি কথা বলব?

সত্যিই তো বলবেন, তা না হলে চিকিৎসা হবে কী করে?

হরিশঙ্কর, তুমি রাগ কোরো না, আমি সত্যি বলছি। দুটো আলুর চপ আর একগাল মুড়ি।

দু’জনে সমস্বরে বললেন, আলুর চপ?

ওই যে বললুম, লোভ। লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। তারপর থেকেই পেট ফুলতে শুরু করল। বুকে পেটে এক হয়ে জয়ঢাক। খাদ্যটা বেশ বার করেছি কিন্তু। কম খরচে। একদিন খেলে দুদিন আর হাঁ করতে হয় না।

ডক্টর সেন বললেন, চা এখন থাক। আগে আপনাকে পরীক্ষা করি।

মাতামহ বললেন, একটা কথা বলব? তোমরা রাগ করবে না বলো? আমার নোটিশ এসে গেছে। ভেতরে যেখানে যা যেমন আছে, সেইরকম থাক। শুধু শুধু নাড়ানাড়ি করে লাভ কী? জমি থেকে গাছ উঠেছিল, শেকড় নামিয়েছিল, রস শুষেছিল, ডালপালা মেলেছিল, এবার শুকোবার পালা। দেখতে পাচ্ছি, কাঠুরিয়া আসছে কাঁধে কুড়ুল নিয়ে।

ঘরের বাতাস থমথমে হল। ডক্টর সেন বললেন, তবু তো বলে যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ।

পিতা হাত ধরে মাতামহকে চৌকির ছোবড়া-ওঠা বিছানায় বসিয়ে দিলেন। ডক্টর সেন এগিয়ে এসে নাড়ি টিপে ধরলেন। শুরু হল পরীক্ষা। বুক, পেট, পিঠ, পায়ের ফোলা পরীক্ষা। পিঠের দিকে কোমরের ওপরে ভীষণ ব্যথা। ডক্টর সেনের হাত পড়তেই মাতামহ কুঁকড়ে গেলেন। ফাঁস ফাঁস শব্দ করে প্রেশার মাপা হল। এই যন্ত্রটি দেখে মাতামহ ভীষণ আনন্দ পেলেন। হাতের ওপরে জড়ানো রবারের তাগাটি বারেবারে দেখছেন আর বলছেন, ঠিক যেন রেল কোম্পানির পোটার। বুকে একটা পেতলের চাকতি লাগালেই হয়। ফোঁস ফোঁস করে বাতাস ঠেলে, ফিস করে হাওয়া বের করে ডক্টর সেন যখন যন্ত্রের পারদস্তম্ভকে তুলছিলেন আর নামাচ্ছিলেন, তখন মাতামহের যেন আরও আনন্দ! প্রশ্ন করলেন, ডাক্তার, মানুষের ভেতরটা কি ঠিক এইরকমই ছটফট করে? লোভে, লালসায়, কামনায়?

শিরার ওপর স্টেথিসকোপের গোল ঠান্ডা চাকতি চেপে ধরে ডক্টর সেন নীরবে মাথা নাড়লেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *