১.৫১-৫৫ দুইপা তুলে বেশ গুছিয়ে

১.৫১

দুইপা তুলে বেশ গুছিয়ে পালঙ্কের মাথার দিকটায় ঢেলান দিয়ে বসলেন দেলোয়ারা। চোখ থেকে চশমা খুলে শাড়ির আঁচলে মুছতে মুছতে বললেন, সমবাত (সংবাদ) না দিয়াঐ যে বাইত্তে আইলা!

পালঙ্কের মাঝামাঝি জায়গায় একখান ছপ (মাদুর) বিছানো হয়েছে। সেই ছপে আসাম (আসনপিঁড়ি) করে বসে ভাত খাচ্ছে এনামুল। তার পরনে এখন আকাশি রঙের চেক লুঙ্গি আর সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি। গলায় মোটা সোনার চেন আছে। চেনের মাথায় সিকির মতো একখান লকেট। মাথা ঝুঁকিয়ে ভাতের লোকমা যখন মুখে তুলছে এনামুল, গলার চেন আর লকেট এসে পড়ছে পাতের ওপর। এক ফাঁকে চেনটা স্যান্ডো গেঞ্জির বুকের কাছে ঢুকিয়ে দিল এনামুল, দেলোয়ারার দিকে তাকাল। মুখভর্তি ভাত চাবাতে চাবাতে জড়ান গলায় বলল, সমবাত দিয়া সব সময় আহন যায়নি? আথকা আইয়া পড়নঐ ভাল।

চশমা মোছা শেষ করে চোখে পরলেন দেলোয়ারা। নিজেগ বাইত্তে সমবাত না দিয়া আইলেও অয়। তয় অসুবিদা খালি একখানঐ, খাওন দাওনের। আগে সমবাত পাইলে বাজার হাট করাইয়া রাখন যায়। দেহো তো কী দিয়া কী খাইতাছে আইজ!

এনামুল আরেক লোমা ভাত মুখে দিল। ভালঐ তো খাইতাছি। এত বড় বড় দুইডা কইমাছ, দুইডা হাসের আন্ডা, ডাইল দুদ, খারাপ কী!

এনামুলের সামনে সাজিয়ে রাখা ভাতের গামলা, তরকারির বাটি, ডাল আর দুধের বাটির দিকে একবার তাকালেন দেলোয়ারা। বললেন, আগে জানলে মাওয়ার বাজার থিকা বড় একখান ইলশা মাছ আনাইতাম। এক দেশসের দুদ আনাইতাম।

ইলশা মাছের থিকা কইমাছ অনেক ভাল। শীতকাইল্লা কই খাইতে খুব স্বাদ। এই দিনে বুকটা লাল টকটইক্কা অইয়া যায় কইমাছের। শইলভর্তি তেল। আর জোয়াইরা দিনের কই অইলো খারাপ। মুখে দেওন যায় না। পেটভর্তি আন্ডা। শইলডা যায় লাম্বা হইয়া, মাথাডা যায় বড় অইয়া, খাইতে লাগে টাকি মাছের লাহান।

একটা কই খাওয়া শেষ করেছে এনামুল। এখন বাটি উপুড় করে বাকি কইটাও নিল। প্রচুর তেল মশলা দিয়ে, প্রচুর পিয়াজ দিয়ে ভুনা করা হয়েছে কই। মাছটা পাতে নেওয়ার পর বাটির গায়ে লেগে থাকা ঝোল আঙুল দিয়ে কেচে প্লেটে নিল এনামুল। ভঙ্গি দেখে বোঝা যায় রান্না খুবই পছন্দ হয়েছে তার, আগ্রহ নিয়ে খাচ্ছে। যদিও প্রায় সব খাবারই সমান আগ্রহ নিয়েই খায় এনামুল। ছেলেবেলা থেকেই সে একটু পেটুক স্বভাবের। তবু আজকের এই খাবারের প্রতি তার এতটা আগ্রহ দেখে দেলোয়ারা খুশি হলেন। সরল গলায় বললেন, রান কেমুন অইছে?

আপনে রানছেন আম্মা?

না বাবা আমি রান্দি নাই। রানছে রাবি। আল্লায় বাচাইছে যে ছেমড়িডা আইজ বাড়া বানতে (ধানভানা। ঢেঁকি সংক্রান্ত কাজ) যায় নাই। গেলে আমি ঝামেলায় পড়তাম।

কই মাছটা এত বড়, এনামুলের প্লেট ভরে গেছে। ভাতও আছে বেশ খানিকটা, তবে ভাতের দিকে মন নাই তার। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কই মাছের পেটের দিকটা ভাঙছে আর মুখে দিচ্ছে। দেলোয়ারার দিকে তাকাচ্ছেও না, কথা টুকটাক বলছে। এখনও বলল। কী ঝামেলায় পড়তেন।

রান্দন বাড়নের কী করতাম?

ক্যা আপনের রান্দন রান্দেন নাই।

হেইডা তো রানছি। ঐ রান তুমি মুখে দিতে পারতা না। এক পোয়া চাউলের ভাত রান্দি আর ইট্টু ডাইল, ইট্টু দুদ। ঐ এক রানে দুফইরা খাওনও অয় রাইতের খাওনও অয়।

কিছু না থাকলে ঐডাঐ খাইতাম নে।

তারপর যেন হঠাৎ মনে পড়েছে এমন গলায় এনামুল বলল, ও আম্মা, এতবড় কই পাইলেন কই?

দেলোয়ারা হাসলেন। কইডি আমার না।

তয়?

রাবিগো।

অরা পাইলো কই?

বাদলকে কোলে নিয়ে রাবি দাঁড়িয়ে আছে পুব দিককার দুয়ারের সামনে। সেখান থেকে বলল, বাদলার বাপে ধরছেলো।

চোখ তুলে রাবির দিকে তাকাল এনামুল। কই থিকা?

বিলেরবাড়ির পুকর থিকা। বিলে কামলা দিতে গেছিলো, ফিরনের সমায় আইত্তাইয়া (হাতিয়ে) ধইরা আনছে।

হ বিলেরবাড়ির পুকঐরের কই বহুত বড় অয়।

বাদলা বলল, তিনডা ধরছিলো। একটা আমি খাইয়া হালাইছি।

বলেই হি হি করে হাসল। হাসিটা বেশ মজা লাগল এনামুলের। খেতে খেতে বাদলাকে সে বলল, কীরে ছেমড়া, মার কুলে উইট্টা রইছস ক্যা?

বাদলা কথা বলবার আগেই দেলোয়ারা বললেন, ছেমড়াডা এমনই। বেশি আল্লাইন্দা। মায় যহন বাড়া বানতে যায় তহন দেহগা (দেখ গিয়া) টই টই কইরা ঘোরতাছে। এক্কেরে ডাঙ্গর পোলাপানের লাহান। মায় বাইত্তে আইলো আর নান্নাবাচ্চা অইয়া গেল। কুলে উইঠা বইয়া থাকে।

রাবি হাসিমুখে বলল, না বুজি সব সমায় কুলে ওড়ে না। মানুষজন দেকলে ওডে। অহন উটছে মামারে দেইক্কা।

এনামুল আনমনা গলায় বলল, মামাডা আবার কেডা?

রাবি লাজুক গলায় বলল, ক্যা আপনে? আপনেরে আমি মামা কই জানেন না! আপনের মা খালারে যদি বুজি কই, আপনে তো তাইলে মামা!

বাদলা বলল, আর আমার অইলেন দাদা।

চোখ পাকিয়ে, কপট রাগে বাদলার দিকে তাকাল এনামুল। তোমার আর দাদা কওনের কাম নাই। কুল থিকা নামো।

দেলোয়ারা বললেন, হ ও আর নামছে। কতুক্ষণ পর দেইক্কোনে মার বুকের দুদ খাইতাছে।

একথা শুনে এনামুল মজা পেল, রাবি পেল লজ্জা। মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। মুখে লাজুক হাসি।

এসব কথার ফাঁকে ফাঁকে কই মাছটা খেয়ে শেষ করেছে এনামুল ভাত শেষ করেনি। কইয়ের কাটা একপাশে রেখে আঙুলের ডগায় ভাত নাড়াচাড়া করতাছে। দেলোয়ারা বললেন, আভা দুইডা খাও বাজান।

এনামুল ডিমের বাটির দিকে তাকাল। দুইডা খাইতে পারুম না আম্মা। একটা খাই।

খাও।

 এনামুল একটা ডিম নিল। ডিমও রাবি রানছে?

 হ। বেবাক রান্দনঐ রাবির।

এত তাড়াতাড়ি রানলো কেমতে?

ও কামের আছে। তুমি বাইত্তে আহনের লগে লগে রান্দনঘরে গিয়া হানছে। আমার কিছু কওন লাগে নাই, রান বাড়ন শেষ।

ডিম ভেঙে ভাতে মিশিয়ে বেশ পরিপাটি করে একটা লোকমা মুখে দিল এনামুল। মুখভর্তি ভাত, সেই অবস্থায়ই বলল, রান বাড়ন খুব ভাল শিখছে রাবি। আমগো বাড়ির মতন।

দেলোয়ারা বললেন, আগে এমুন রানতে পারতো না। আমি হিগাইছি। আগের রান্দন আছিলো চউরাগো রান। মুখে দেওন যাইতো না।

পারভীনের রান্দনও আগে মুখে দেওন যাইতো না।

ঐডা বউর দোষ না। বিয়ার আগে কোনওদিন রানছেনি? পারবো কেমতে।

অহন খুব ভাল রানে। মার কাছে শিখছে।

বুজির শইলডা কেমুন? ভাল আছে?

হ অহন ভালই। কয়দিন আগে বি চদরীরে (বদরুদ্দোজা চৌধুরী) দেহাইছি। এত বড় ডাক্তার চদরী সাবে, মারে দেইক্কা কইলো আরে কিছু হয় নাই আপনের। একদোম ভাল আছেন। সংসারের কাম কাইজ যত পারেন করবেন আর সকালে বিকালে যতক্ষণ পারেন হাটবেন। দুইডা না তিনডা অষইদ দিল। তার কথা মতন চলতাছে দেইক্কা মায় অহন একদোম ভাল। আপনে ইবার ঢাকা গেলে আপনেরেও দেহাইয়া আনুম।

দেলোয়ারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, হ দেহান ইট্টু লাগবো। বুকের মইদ্যে আইজ কাইল জানি কেমুন করে!

খাওয়া শেষ করে ঢক ঢক করে একগ্লাস পানি খেল এনামুল। দেখে হা হা করে উঠলেন দেলোয়ারা। দুদভাত খাইবা না?

না।

ক্যা?

খাজুরা মিডাই না অইলে দুদ ভাত খাওন যায় না।

খাজুরা মিডাই তো আছে। ঐ রাবি কারে (ঘরের চালার কাছাকাছি পাটাতন করা, কাঠের দোতলার উপরতলার মতো। দরকারি জিনিসপত্র রাখার জায়গা। কোথাও কোথাও আপারও বলে) ওট। মুড়ির জেরে দেক খাজুরা মিডাই আছে। লইয়ায়।

বাদলাকে কোল থেকে নামাল রাবি। বেতের ছোট্ট একখান সাজি (পাত্র) হাতে সিঁড়ি ভেঙে তরতর করে কারে উঠে গেল। একদলা গুড় নিয়ে নেমে এল। গুড়ের দলায় মুড়ি লেগে আছে দেখে দেলোয়ারা বললেন, কী লো রাবি, মিডাই গইল্লা গেছেনি?

রাবি বলল, হ। মুড়িডি ওদাইয়া (নরম হয়ে যাওয়া) গেছে। আরবচ্ছর যে মুড়ির জেরে মিডাই রাকলেন, মুড়িডি তো আর বদলান নাই।

হায় হায় মুড়ি বদলানের কথা তো আমার মনে আছিলো না।

এনামুল বলল, মিডাই গইল্লা গেছে কী অইছে। ঐ রাবি অন্য একখান পেলেট দে। এই পেলেটে তরকারি লাইগ্না রইছে, এই পেলেটে দুদভাত খাওন যাইবো না।

চটপটা হাতে অন্য একখান প্লেট দিল রাবি। একবার সেই প্লেটের দিকে তাকিয়ে আগের প্লেটটায় যত্ন করে হাত ধুয়ে ফেলল এনামুল। তারপর নতুন প্লেটে সামান্য ভাত নিল, বাটির দুধ অর্ধেকটা ঢালল, প্লেটের সামনে রাখা গুড়ের সাজি থেকে এক খামছা থকথকা গুড় নিল, নিয়ে নতুন করে খাওয়া শুরু করল।

এনামুলের দিকে তাকিয়ে একটু নড়েচড়ে বসলেন দেলোয়ারা। আবার চোখ থেকে চশমা খুললেন, শাড়ির আঁচলে কাঁচ মুছতে মুছতে বললেন, ইবার কী তুমি দুই একদিন থাকবা বাজান?

দুধভাত খেতে খেতে এনামুল বলল, হ থাকুম। কয়দিন আজাইর (বেকার) আছি।

ক্যা কনটেকদারি কাম নাই তোমার? কাপড়ের ব্যবসা চলতাছে না?

 চলতাছে, বেবাকঐ চলতাছে।

তয়?

তয় আগের থিকা ইট্টু কম চলতাছে। এর লেইগাঐ বাইত্তে আইলাম। মান্নান মাওলানা সাবে আমারে একখান পত্ৰ দিছিলো। তার বলে কী কথার কাম আছে আমার লগে!

হ আমারেও কইছিল তুমি বাইত্তে আইলে য্যান তারে খবর দেই।

দুধ ভাতের লগে এক কামড় গুড় মুখে দিয়ে এনামুল বলল, পত্রে মাওলানা সাবে আমারে লেকছিল আমার যুদি টাইম না থাকে তাইলে হেয়ঐ ঢাকা গিয়া আমার লগে দেহা করবো। আমার কাছে এমুন কী কাম পড়লো মাওলানা সাবের? আপনে কিছু জানেননি আম্মা?

চশমাটা চোখে পরে দেলোয়ারা বললেন, পুরা জানি না। তয় তার লগে একদিন কথা অইছিলো, কথা হুইন্না বোজলাম তোমারে দিয়া গেরামে একখান মজজিদ করাইতে চায়।

একথা শুনে খাওয়ার কথা যেন ভুলে গেল এনামুল। দেলোয়ারার মুখের দিকে তাকাল। মজজিদ করাইতে চায়? কোনহানে?

আমগ ছাড়া বাইত্তে।

কন কী?

দেলোয়ারা হাসলেন। হ আমার কাছে তো কইলো!

খানিক আনমনা হয়ে কী ভাবল এনামুল তারপর রাবির দিকে তাকিয়ে বলল, ঐ রাবি, আতাহারগ বাইত্তে যা তো। মাওলানা সাবরে ডাইক্কা লইয়ায়। আমার কথা কবি।

.

১.৫২

কোলাপাড়া বাজারের কাছাকাছি রিকশা থামাল রুস্তম। থামিয়ে লাফ দিয়ে রিকশা থেকে নামল। তছির দিকে তাকিয়ে অস্থির গলায় বলল, তুমি ইট্টু বহো। আমি খালি যামু আর আমু।

ঘোমটায় মুখ মাথা ঢেকে এখনও আগের মতোই বসে আছে তছি। কী রকম একটা ঘোরের মধ্যে যেন ছিল। রুস্তমের কথা শুনে ছটফট করে উঠল। দাঁতে কামড়ে রেখেছিল শাড়ির আঁচল, ছেড়ে দিয়ে বলল, কই আইলাম

আগের মতোই অস্থির গলায় রুস্তম বলল, কোলাপাড়া আইছি। এইডা কোলাপাড়া বাজার।

উঁকি মেরে বাজারের দিকটা দেখল তছি,। এত তাড়াতাড়ি কোলাপাড়া আইয়া পড়লাম? ও রিশকাআলা ভাই, রিশকা তো আপনের উড়াজাহাজের লাহান। চোক্কের নিমিষে মেদিনমোণ্ডল থন কোলাপাড়া আইয়া পড়লাম।

হ আমার রিশকা উড়াজাহাজঐ। তয় তুমি বহে আমি মুরলিভাজা কিন্না আনি।

আমিও আপনের লগে যামু।

ক্যা?

এইমিহি কোনওদিন আহিনাই। কোলাপাড়া গেরামডা কেমুন, বাজারডা কেমুন ইট্টু দেহি। ও রিশকাআলা ভাই, কাঁচারুগো (তামা পেতল কাঁচের জিনিসপত্র এবং এলুমিনিয়ামের ব্যবসা করেন যারা) বাড়ি কোনডি কন তো? কোলাপাড়ায় বলে বহুত কাঁচারু বাড়ি।

তছির কথায় রুস্তম একটু বিরক্ত হল তবে বিরক্তিটা প্রকাশ করল না। তছিকে বুঝতেও দিল না কিছু। ভিতরের অস্থিরতা ভিতরে চেপে হাসিমুখে নরম গলায় বলল, কাঁচাৰুগো বাড়ি তোমারে যাওনের সমায় দেহামুনে। কোলাপাড়া গেরামে কাঁচাৰুগো বাড়ি ছাড়া দেহনের কিছু নাই। আগে কইলে আহনের সমায়ঐ দেহাইতাম। খালপাড়ের লগে অনেক কাঁচাৰু বাড়ি আছে। পাডাতন করা ঘর, দোতালা ঘর। নতুন ঢেউটিনের বেডা ঝকঝক করে। কোনও কোনও ঘরের টিনে রঙ লাগাইন্না, জানলা কপাটে রঙ লাগাইন্না। যাওনের সমায় দেহামুনে।

তছি বাধুক শিশুর মতো বলল, আইচ্ছা দেহাইয়েন। তয় অহন খালি বাজার দেহান।

বাজার দেইক্কা কী করবা, আর বাজারে যাওন তোমার ঠিকও অইবো না।

ক্যা?

তোমগো গেরামের কোনও মাইনষে যুদি তোমারে এহেনে দেইক্কা হালায়?

কেমতে দেখবো? আমগো গেরামের কোনও মানুষ এই বাজারে আহে না। মাওয়ার বাজারে যায়, নাইলে যায় কাজির পাগলা বাজারে।

এই বাজারেও আহে। আমি দেকছি।

দেকতে পারেন। কেঐ মরলে কাফোনের কাপোড় কিনতে আহে। ছনু মামানি যেদিন মরলো হেদিন মেন্দাবাড়ির মোতালেইব্বা আইছিলো। আইজ তো আমগ গেরামের কেঐ মরে নাই। কেডা আইবো?

তছির কথা শুনে রুস্তম একটা ফাপরের মধ্যে পড়ে গেল। ভিতরে আগের অস্থিরতাটা আছেই। সে চাইছে একরকম, হতে যাচ্ছে অন্যরকম। এত কিছুর পরও যদি পরিকল্পনা মতো কাজ না হয় তাহলে কী লাভ হল এসব করে! তার লগে যদি বাজারে যায় তছি, তছির পরিচিত না হোক রুস্তমের পরিচিত কেউ না কেউ দেখবেই! কথা কিছু না কিছু উঠবেই। কেউ যদি জিজ্ঞাসা করে, কী রে রোসতইমা, লগে কেডা? কী জবাব দিবে রুস্তম! স্বভাব চরিত্রের কথা রুস্তমের এদিককার অনেকেই জানে। ভারি একটা প্যাঁচঘোচের মধ্যে রুস্তম পড়ে যাবে।

না তছিকে নিয়ে বাজারে সে কিছুতেই যাবে না।

হঠাৎ করে নিজেকে তারপর বদলে ফেলল রুস্তম। গভীর চিন্তার একখান ছায়া মুখে ফেলে বলল, আসলে এই হগল কোনও কামের কথা না। রিশকায় থিকা নামতে তোমারে ক্যান দিতাছি না, ক্যান বাজারে নিতে চাইতাছি না তার অন্য একধান কারণ আছে।

তছি উদ্বিগ্ন গলায় বলল, কী কারণ?

আমগ এইমিহি রিশকা চোর খুব বাইড়া গেছে।

কন কী?

হ। চোরডি খালি তালে থাকে কুনসুম কোন রিশকাআলা রিশকা রাইক্কা চোক্কের আঐল (আড়াল) অইলো। লগে লগে সিডে বইয়া রিশকা চালাইয়া দেয়। মাইনষে তো মনে করে যার রিশকা হেয়ঐ চালাইয়া যাইতাছে। কিছু কয় না। রিশকা যার চুরি অয় মাথায় বাড়ি পড়ে তার। পাছ ছয় হাজার টেকা দাম এহেকখান রিশকার। পুরা টেকাডা গলায় পাড়া দিয়া উসিল কইরা লয় মাহাজনে। এর লেইগা রিশকা থুইয়া কোনওহানে যাই না আমি।

যেন ব্যাপারটা খুবই ভাল ভাবে বুঝেছে তছি এমন গলায় বলল, ভাল করেন। রিশকা থুইয়া যাইবেন ক্যা?

এইত্তো বুজছো। তয় বহে, আমি মুরলিভাজা লইয়াহি।

তছি কাতর গলায় বলল, আমি যামু না?

শুনে হেসে ফেলল রুস্তম। অইছে কাম। আমি কই কী আর আমার সারিন্দায় (সারেঙ্গি) কয় কী! আরে রিশকা চুরি অওনের ডর আছে দেইক্কাইত্তো তোমারে বহাইয়া থুইয়া যাইতাছি। তুমি বইয়া রিশকাড়া পাহারা দেও, আমি আইতাছি।

এবার তছিও হাসল। বুজছি। যান আপনে। তয় তাড়াতাড়ি আইয়েন।

আইচ্ছা।

রুস্তম পা বাড়িয়েছে, তছি বলল, মুরলিডি দেইক্কা আইনেন। ওদাইন্না (ন্যাতানো) মুরলি আইনে না।

রুস্তম আবার বলল, আইচ্ছা।

.

১.৫৩

ছাই রঙের খাদায় ভাতের ফ্যান আর তরিতরকারির ছালবাকল নিয়ে মান্নান মাওলানার সীমানায় এসেছে ফিরোজা। গোয়াল ঘরের লগে মাটির ভিটির ওপর বসান জাবনা দেওয়ার গামলায় জিনিসগুলি ফেলে ফিরে যাবে, মান্নান মাওলানা তাকে দেখে ফেললো। দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষ করে মুখে একখান পান পুরেছেন তিনি। ছিলেন বড়ঘরের দুয়ারের সামনে, ফিরোজাকে দেখে পান চাবাতে চাবাতে গোয়ালঘরের দিকে এলেন। গরুর জাবর কাটার মত মুখখানা নাড়াতে নাড়াতে বললেন, সমবাত কী লো ফিরি।

খাদা কাত করে জিনিসগুলি মাত্র জাবনার গামলায় ফেলতে যাবে ফিরোজা, হাত থেমে গেল। মান্নান মাওলানাকে দেখলেই বুক ধুগৰুগ ধুগযুগ করতে থাকে, গলা শুকিয়ে আসে, হাত পা আড়ষ্ট হয়ে যায়। নড়াচড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে ফিরোজা। এখনও তেমন হল। বুকের কাছে খাদা ধরে দাঁড়িয়ে রইল সে। এক ফাঁকে বুকের আঁচল ভাল করে টেনে দিয়েছে। চোখ এখন মাটির দিকে। ভঙ্গি জড়সড়।

তাকিয়ে তাকিয়ে ফিরোজাকে দেখলেন মান্নান মাওলানা। তারপর বললেন, কথা কচ না ক্যা?

ফিরোজা তবু কোনও কথা বলল না, তবু নড়ল না।

মান্নান মাওলানা বললেন, আইচ্ছা ফ্যানডি হালা।

এবার নড়ল ফিরোজা। তবে মান্নান মাওলানার দিকে তাকাল না। খাদা কাত করে জিনিসগুলি জাবনার গামলায় ফেলল।

কাজ শেষ করবার পর এখানে আর দাঁড়িয়ে থাকবার কারণ নাই, যে রকম দ্রুত পায়ে এসেছিল সেইরকম পায়েই ফিরে যাওয়ার কথা ফিরোজার। এখনও কত কাজ বাকি রয়ে গেছে। ঘাটে গিয়ে গোসল করবে, ভিজা কাপড় রোদ দিবে উঠানের তারে, নানীকে খাওয়াবে, নিজে খাবে, তারপর যদি একটু আজার পাওয়া যায়। কিন্তু পা নড়াতে পারছে না ফিরোজা। মান্নান মাওলানা এসে সামনে দাঁড়াবার পর পা যেন মাটিতে গেঁথে গেছে। সেই পা টেনে তোলবার শক্তি নাই।

ফিরোজার মুখের দিকে তাকিয়ে পান চাবাতে চাবাতে মান্নান মাওলানা বললেন, মন্তার সমবাত কী লো?

ফিরোজা চোখ তুলে তাকাল না, কথার জবাবও দিল না।

 তিনি প্রশ্ন করেছেন অথচ সামনে দাঁড়ান মানুষ জবাব দিচ্ছে না এটা হতে পারে। এটা বরদাশত করবার মানুষ মান্নান মাওলানা নন। প্রথমেই প্রচণ্ড একখান ধমক দিবেন, তারপরও কথার জবাব না পেলে কোনওদিকে তাকাবেন না, কোনও কিছু খেয়াল করবেন না, গায়ে হাত তুলবেন।

তবে এখন তেমন কোনও অনুভূতি হল না মান্নান মাওলানার। একদমই রাগলেন তিনি। মুখখানা হাসি হাসি করে নরম গলায় বললেন, তুই আমারে এত ডরাচ ক্যা লো ছেমড়ি? আমি কি বাঘ ভাল্লুক যে তরে খাইয়া হালামু, নাকি তর লগে কোনওদিন রাগ করছি, তরে ধমক দিছি!

এবার পলকের জন্য মান্নান মাওলানার দিকে চোখ তুলে তাকাল ফিরোজা। তারপরই আগের মতো মাথা নিচু করল, কিন্তু কথা বলল না।

মান্নান মাওলানা বললেন, মন্তার সমবাত বেবাকঐ আমি জানি। দুই বউ লইয়া মোজে (মৌজে) আছে। এক রাইত এই বউর কাছে আরেক রাইত ঐ বউর কাছে। মাইনষে যা কউক আমি মনে করি কামডা মন্তা খারাপ করে নাই। ভাল করতাছে। মোসলমানের চাইরখান পইরযন্ত বিয়া জায়েজ।

বলেই চোখ মুখের অশ্লীল ভঙ্গি করলেন মান্নান মাওলানা। খিক করে একটু হাসলেন। জুয়ান মর্দ পুরুষ পোলাগো তিন চাইর বউ না অইলে কাম অয় না। একখান বউ থাকলে দুই তিনডা পোলাপান অওনের পর হেইডা যায় ভিজা কেথার লাহান লোতলোতা হইয়া। হেইডারে আর বউ মনে অয় না। তহন আরেকখান বিয়া করুন লাগে। দুইনম্বরডা যহন দুই তিনডা পোলাপান পয়দা কইরা আগেরডার লাহান অইয়া যায় তহন করতে হয় তিন নম্বরটা। এইভাবে চাইরখান জায়েজ।

আবার খি খি করে হাসলেন মান্নান মাওলানা। হোন ছেমড়ি, তুই তো ডাঙ্গর অইছস, দুইদিন বাদে বিয়া দিলে বচ্ছরও ঘোরতে দিবি না, পোলাপান পয়দা কইরা হালাবি, আমার কথা হুইন্না রাখ, কামে লাগবো। পুরুষ পোলাগো জুয়ানকি থাকে সইত্তর আশি বচ্ছর আর মাইয়া ছেইলাগ কুড়ি বহর। ডাকের কথা আছে, মাইয়া ছেইলারা কুড়িতে বুড়ি। আতাহারের মারে দেহচ না একদোম বুড়ি অইয়া গেছে। আর আমারে দেখ। অহনতরি কী জুয়ান! তর লাহান ছেমড়ির লগে বিয়া হইলে বচ্ছর বাদে পোলা অইবো।

মান্নান মাওলানার কথা শুনতে শুনতে ফিরোজার মনে হচ্ছিল সে যেন আর বেঁচে নাই, সে যেন মরে গেছে। এই ধরনের কথা সে জীবনেও শোনেনি, তাও বাপ দাদার বয়সী কোনও পুরুষ মানুষের কাছে। নাতনীর বয়সী মেয়েকে কেমন করে এসব কথা বলতে পারে একজন মানুষ! তাও যে মানুষ মাওলানা। পরহেজগার লোক।

মান্নান মাওলানা বললেন, হোন ছেমড়ি, তরে এই হগল কথা কওনের কারণ আছে। মাসে মাসে দোকানের কর্মচারি দিয়া মন্তার মারে টেকা পাডায় মন্তা। হেই বেডা দুই তিনদিন বাইত থাইক্কা বাজার হাট কইরা দিয়া যায়। মন্তার মায় বুড়ি তো আর দুইন্নাইদারি বোজে না অহন, বোজচ তুই। বেডা যে আহে, দুই তিনদিন যে থাকে বাইত্তে, তরা বলে একঘরে হোচ?

শেষ কথাটা এমনভাবে বললেন মান্নান মাওলান, ফিরোজা চমকে উঠল। নিজের অজান্তেই কথা বলে ফেলল। কে কইছে আপনেরে

আমি হুনছি।

কার কাছে হোনছেন?

হেইডা তরে কমু ক্যা? বাইত্তে কী কম মানুষ আছে! তিন শরিকের অউক আর যারঐ অউক বাড়ি তো আসলে আমার। এই বাড়ির কোনহানে কী হয় বেবাক আমি জানি।

তয় এইডা ঠিক জানেন না। যেই বেডারে মন্তাজ মামায় পাড়ায় হেই বেডার নাম মালেক। আমার বাপের বইশশা। আমি তারে মামা কই।

মান্নান মাওলানা আবার হাসলেন। বয়সের কথা কইচ না। এতক্ষুণ তো তরে আমি ঐ হগল বুজাইলাম।

তয় মালেক মামায় বড়ঘরে থাকে না। ঐ ঘরে থাকি আমি আর নানী। মামায় থাকে পুবের ঘরে।

চিরিক করে পানের পিক ফেললেন মান্নান মাওলানা। মুখখানা অমায়িক করে ফিরোজার দিকে তাকালেন। ঠিক আছে যা, তর কথা আমি বিশ্বাস করলাম।

তারপর একটু এগিয়ে গিয়ে ফিরোজা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার কাঁধে হাত দিলেন, দিয়ে খামচে ধরলেন। যেন ইচ্ছা করলেই হাতটা সরিয়ে দিতে না পারে ফিরোজা, দৌড় দিয়ে পালাতে না পারে।

মান্নান মাওলানা তারপর বললেন, তরে আমি বহুত ভাল জানি ফিরি। কেন জানি কইতে পারি না। তুই এই বাইত্তে আহনের পর থিকা, তর মুখখানা দেকলে আমার মায়া লাগে। মালেকরে লইয়া তর কথা আমি অনেকদিন আগেই হুনছি, তরে কিছু কই নাই এর লেইগাঐ। তুই অনাত এতিম মাইয়া। আমি পারি মালেকের লগে একখান বদলাম রটাইয়া তরে এই বাইত থিকা খেদাইয়া দিতে। দেই নাই। দিমুও না। ঐ যে তরে আমি ভাল জানি এর লেইগা। হোন, আজাইর পাইলে আমি তগ ঘরে যামু। তুই আমারে ইট্টু সেবা যত্ন করিস।

মান্নান মাওলানা তার কাঁধ খামছে ধরার পর থেকে ফিরোজা যেন আর ফিরোজা নাই, সে যেন মাটি হয়ে গেছে, মরা গাছ হয়ে গেছে। তার কোনও অনুভূতি নাই, জীবন মরণ বোধ নাই। ফ্যাল ফ্যাল করে মান্নান মাওলানার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল সে।

এ সময় বাদলার পিছু পিছু মান্নান মাওলানার বাড়িতে এসে উঠল রাবি।

দুইজন মানুষ যে বাড়িতে এসে উঠেছে মান্নান মাওলানা তা টেরই পেলেন না। ফিরোজার কাঁধ খামছে ধরে মুখে ওসব কথা তিনি বলছিলেন ঠিকই কিন্তু ভিতরে ভিতরে মশগুল হয়ে গিয়েছিলেন অন্য একটা ব্যাপারে। মুখের পান মুখে আছে, চাবানের কথা মনে নাই। শরীর ভরে গেছে অদ্ভুত এক পুলকে। মৃতের মতো অনুভূতিহীন চোখে ফিরোজা তাকিয়ে ছিল তার দিকে। সেই চোখে চোখ রেখে গদগদ কণ্ঠে গভীর কোনও আবেগের কথা বলতে যাবেন মান্নান মাওলানা তার আগেই লোকজন দেখে বাদলা তার স্বভাব মতন কাজটা করল। রাবির দিকে দুইহাত বাড়িয়ে বলল, কুলে লও মা।

বাদলার কথায় হিংস্র থাবা থেকে শিকার ফসকে যাওয়া জন্তুর মতো চোখ করে পিছন ফিরে তাকালেন মান্নান মাওলানা। এই ফাঁকে ফিরোজা যেন জান ফিরে পেল। ঝটকা মেরে মান্নান মাওলানার হাত কাঁধ থেকে নামিয়ে দিল, খাদা বুকের কাছে ধরে হন হন করে হেঁটে মন্তাজদের সীমানার দিকে চলে গেল।

ততক্ষণে বাদলাকে কোলে নিয়েছে রাবি। এই ফাকে ঘোমটাও দিয়েছে মাথায়। মান্নান মাওলানা ফিরে তাকাতেই বলল, মামায় আইছে বাইত্তে।

সাদা কালোয় মিশান বিছার মতো জোড়া ভুরু কুঁচকে, মুখখানা যতদূর সম্ভব বিকৃত করে খাই খাই করা গলায় মান্নান মাওলানা বললেন, মামাডা আবার কেডা?

প্রথমে ওইরকম হিংস্র চোখে তাকানো তারপর এমন মুখ করে কথা বলা, রাবি ভড়কে গেল। তার কাছে মান্নান মাওলানা রক্ত মাংসের তৈরি মানুষ না। মাটি দিয়ে নিশ্চয় এই রকম পরহেজগার বান্দা তৈরি করেননি আল্লাহতায়ালা। তৈরি করেছেন নূর দিয়ে। মান্নান মাওলানা তো আসলে ফেরেশতা। এই রকম একজন ফেরেশতা বদমাস মানুষদের মতো খাউ খাউ করতাছেন কেন? যুবতী মেয়েটার কাঁধে হাত দিয়েই বা কী করছিলেন তিনি!

রাবি একটা ঢোক গিলল। কাচুমাচু গলায় বলল, এনামুল মামায়।

এনামুল নামটা দোয়া দরুদের মতন কাজ দিল। চোখের পলকে চেহারা বদলে গেল মান্নান মাওলানার। চোখের হিংস্রতা কোথায় উধাও হল, কোথায় গেল মুখ বিকৃতি আর কুত্তার মতন খেউক্কানি! মুখ অমায়িক হয়ে গেল। গলার স্বর হল পুকুরের অনেক গভীরে লুকিয়ে থাকা কাদার মতো। হাসিমুখে মান্নান মাওলানা বললেন, কচ কী! এনামুল আইছে।

মাওলানা সাহেবের এই আচরণে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল রাবি। সেও হাসল। হ।

কুনসুম?

দুফইরা ভাত খাওনের আগে।

কেমতে আইছে। লনচে?

না। রিশকা কইরা।

রাবি কথা বলবার আগেই তার কোল থেকে বাদলা বলল, হ রিশকা কইরা আপনেগ বাড়ি ছাড়াইয়া হাজামবাড়ি মিহি আইয়া নামছে।

আমগো গেরামে তাইলে রিশকা আইয়া পড়ছে! বা বাবা বা।

তারপর আবার চিন্তিত হলেন মান্নান মাওলানা। ঢাকা থিকা রিশকা লইয়া বাইত্তে আইছে এনামুল! না, এইডা সম্ভব না। ছিন্নগর তরি গাড়ি লইয়াইছে তার বাদে লইছে রিশকা।

বয়স্ক লোকদের মতো মাথা নাড়িয়ে বাদলা বলল, হ। অমনেঐ আইছে।

এবার বাদলাকে একটা ধমক দিলেন মান্নান মাওলানা। ঐ বেডা, এত ডাঙ্গর অইছস অহনতরি মার কুলে উইঠা রইছস ক্যা?

রাবি বলল, হ হুজুর, বাদলা সব সময় খালি আমার কুলে উইট্টা থাকে। আপনে অরে ইট্টু ফুঁ দিয়া দেন।

তরে না আমি কইছিলাম, আহিচ আমার কাছে, পোলাডারে ঝাইড়া দিমুনে আর খাওনের লেইগা পানি পড়া দিমুনে। তুই তো আহচ ভাই।

কেমতে আমু! হারাদিন কাম থাকে।

পোলাডার ভালমন্দও কাম। এইডা করতে অইবো না?

হ করতে তো অইবোঐ।

আমি ঐদিন যে ঝাইড়া দিয়াইলাম তারবাদে মোতালেইব্বাগ ঐমিহি কইতর দেকতে যায়?

রাবি কথা বলবার আগেই বাদলা বলল, হ যাই।

মান্নান মাওলানা ভুরু কুঁচকালেন। কচ কী?

ছেলের দিকে তাকিয়ে তাকে একটা ধমক দিল রাবি। এই ছেমড়া মিছাকথা কচ ক্যা? ঐ দিনের পর থিকা তুই কি আর কইতর দেকতে যাচ? গেলে আমি জানতাম না। যহন বাইত্তে থাকি তহন তো দেকতামও!

বাদলা হাসল। আমি তো পলাইয়া পলাইয়া যাই। কেঐ দেহে না। চুপ্পে চুপ্পে মোতালেব নানাগো খোয়াড়ের সামনে খাড়ইয়া কইতর দেইক্কাহি। তোমারেও কই না।

মান্নান মাওলানা চিন্তিত গলায় বললেন, রাবি রে পোলাডা তর কমিনা। এই পোলায় বহুত ভোগাইবো তরে।

রাবি ভয়ার্ত গলায় বলল, তাইলে অহন কী করুম?

ভাল কইরা ঝাড়ন লাগবো অরে, তিনওক্ত পানি পড়া খাওয়ান লাগবো।

তাইলে আজ থিকাই ঝাড়েন, আইজ থিকাই পানি পড়া দেন।

ঐডা অইবো নে। তার আগে আরেকখান কথা ক আমারে। বাদলা বলে অহনতরি তর বুকের দুধ খায়?

একথায় লজ্জা পেল রাবি। মাথা নিচু করে বলল, হ।

এইডা তো সব্বনাইশা কথা। না না বুকে মুখ দিতে পারবো না পোলায়। দুধ ছাড়ান লাগবো।ইলে ফাড়া আছে পোলার কপালে।

রাবি ভয়ার্ত গলায় বলল, কেমতে ছাড়ামু?

মান্নান মাওলানা আশ্বাসের গলায় বললেন, ব্যবস্থা আছে। কইরা দিমুনে।

আইজঐ কইরা দেন।

আইজ মইবো না। সময় লাগবো। আমি যেদিন কমু ঐদিন আবি। বাদলারে লগে আনবি না। একলা আবি। ঝাড়ন লাগবো তরে, বাদলারে না।

রাবি চিন্তিত গলায় বলল, আমারে ঝাড়ন লাগবো ক্যা? ·

মান্নান মাওলানা হাসলেন। তর পোলার সামনে এই কথা কওন যাইবো না। পরে কমুনে।

আইচ্ছা।

অহন ক এনামুল কী কইছে।

এ কথায় রাবি চমকাল। হায় হায় আসল কথাঐত্তো ভুইল্লা গেছি। যেই কামে আইছি ঐ কামঐত্তো অহনতরি করি নাই। এনামুল মামায় আপনেরে যাইতে কইছে।

কুনসুম? অহনঐ?

না বিয়ালে।

বিয়ালে ক্যা? অহন কী করে?

দুফইরা ভাত খাইয়া লেপ মুড়া দিয়া যুমাইছে।

আইচ্ছা তাইলে বিয়ালেঐ যামুনে।ঐ  রাবি আমার পত্ৰডা এনামুল পাইছিলো?

 হ।

 তরে কইল কেডা?

এনামুল মামায় দেলরা বুজিরে কইতাছিল। আমি হুনছি।

মান্নান মাওলানা বেশ একটা ফুর্তির শব্দ করলেন। আমার পত্র পাইয়া যহন বাইত্তে আইছে এনামুল, তাইলে কাম অইয়া যাইবো।

রাবি কথা বলল না, বাদলা বিজ্ঞের মতো বলল, হ অইয়া যাইবো।

মান্নান মাওলানা ঘেটি ত্যাড়া করে বাদলার দিকে তাকালেন। ঐ বেডা, কী অইয়া যাইবো?

বাদলা হাসল। আপনের কাম।

আমার কী কাম তুই জানচ?

হ।

কী কাম ক তো?

আপনে একখান মজজিদ বানাইবেন।

মান্নান মাওলানা চমকে উঠলেন। তুই জানলি কেমতো

বাদলা না এবার কথা বলল রাবি। ভাত খাইতে বইয়া দেলরা বুজির লগে এই হগল প্যাচাইল পারতাছিল এনামুল মামায়। ও হোনছে।

মান্নান মাওলানা অতি উৎসাহের গলায় বললেন, তুই সামনে আছিলি না? কী প্যাচাইল পারছে আমারে ইট্টু ক তো।

ঐত্তো আপনে পত্র লেকছেন, মজজিদ বানাইতে চান এই হগল। এনামুল মামায় এর লেইগাঐ আপনেরে খবর দিছে।

মান্নান মাওলানার চোখ তখন কী এক আশায় চকচক করতাছে। খানিক আনমনা হয়ে কী ভাবলেন তিনি তারপর রাবির দিকে তাকিয়ে বললেন, ঠিক আছে তুই যা। আমি বিয়ালে আমুনে।

.

১.৫৪

সড়কের পাশে একটা ছাড়াবাড়ি। দুপুরের পর পর নিঝুম হয়ে আছে বাড়িটা। গাছপালা আর ঝোপঝাড়ের ছায়ায় বেশ একটা শীত শীত ভাব। ডালপালার ফাঁক ফোকর দিয়ে টুকরা টাকরা রোদ ছড়িয়ে পড়েছে গাছের তলায়, ঝোপঝাড়ের মাথায়। সেই রোদে শীত ভাব কমেনি। একটা ঝোপে অচেনা কিছু ফুল ফুটে আছে। বেশ ঝাঁঝাল গন্ধ। সেই গন্ধে বিভোর হয়ে আছে বাড়ি। কয়েকটা প্রজাপতি মাতাল হয়ে উড়ছে। জামগাছটার মগডালে বসে থেকে থেকে ডাকছে একটা ঘুঘু। ঘুঘুর ডাকে নিঝুম ভাব তো কাটেইনি আরও বেড়ে গেছে।

রিকশা নিয়ে এই বাড়িটার সামনে চলে এল রুস্তম। খানিক আগে কোলাপাড়া বাজার থেকে মুরলিভাজা কিনেছে। কিনে ঠোঙাটা দিয়েছে তছির হাতে। যেন হাতে চাঁদ পেয়েছে এমন ভঙ্গিতে মুরলির ঠোঙা তছি বুকে চেপে ধরেছে। আনন্দ আহল্লাদে বিগলিত হয়ে বলেছে, অহনঐ খামু রিশকাআলা ভাই?

রুস্তম হেসেছে। না ইট্টু পরে খাও।

ক্যা?

রাস্তাঘাডে খাওন ভাল না।

তয় কই গিয়া খামু?

লও অন্য একখান জাগায় যাই। ওহেনে গিয়া নিরালায় বইয়া দুইজনে মিল্লা সুখ দুর্কের কথা কমুনে আর মুরলিভাজা খামুনে।

বাইত্তে যাইতে তাইলে দেরি অইয়া যাইবো না আমার?

না, কীয়ের দেরি অইবো? রিশকা কইরা আমি তোমারে দিয়ামু না? এহেন থিকা রিশকা ছাড়ুম, চোঙ্কের নিমিষে তোমগো গেরামে যামু গা।

তয় লন।

রুস্তম তারপর রিকশায় চড়েছে। হাওয়ার বেগে রিকশা চালিয়ে এসেছে ছাড়াবাড়িটার সামনে।

তছির তখন আর মন মানছে না, মন চলে গেছে আঁচলের তলায়। কতক্ষণে আঁচল তুলবে সে, মুরলির ঠোঙায় হাত দিবে। মনে মনে ততক্ষণে আরেকটা পরিকল্পনাও করে ফেলেছে সে। এখনকার মুরলিটা রুস্তমই খাওয়াচ্ছে, ওইদিকে এনামুল দাদার দেওয়া টাকা দশটা পুরা রয়ে গেল। এটা একটা বিরাট লাভ। কাল থেকে রোজ সকালে সীতারামপুরের খালের ঘাটে যাবে সে। ওখানকার মুদি দোকান থেকে এক টাকার করে মুরলিভাজা কিনে খাবে। এক টাকার করে রোজ খেলে দশ টাকায় দশদিন। একটানা দশদিন খেলে মুরলিভাজা খাওয়ার লোভটা কমবে।

এসব চিন্তা ছিল বলে কোথায় এসে রিকশা থামাল রুস্তম তছি খেয়াল করল না।

রুস্তম তখল চঞ্চল চোখে চারদিক তাকাচ্ছে। তাকিয়ে নিচু গলায় বলল, নামো।

তছি লাফ দিয়ে রিকশা থেকে নামল। আঁচলে প্যাচিয়ে দুইহাতে যক্ষের ধনের। মতো ধরে রেখেছে মুরলির ঠোঙা। কোনওদিকে খেয়াল নাই তার।

রুস্তম বলল, ঐ যে ফুলের ঝাড়টা দেকতাছো ঐডার আঐলে গিয়া বহো। আমি আইতাছি।

তছি কোনওদিকে তাকাল না, কিছু খেয়াল করল না, ভর পেট মুরলিভাজা খাওয়ার আনন্দ উত্তেজনায় বনফুলের ঝোপটার দিকে ছুটে গেল। ঝোপের আড়ালে বসেই আঁচলের তলা থেকে মুরলিভাজার ঠোঙা বের করল। কোনওদিকে তাকাল না, হামহাম করে খেতে লাগল। কোথায় বসে আছে সে, কেমন করে এখানে এল, কখন বাড়ি ফিরবে কোনও কিছুই মনে রইল না। এমন কী রুস্তমের কথাও। অচেনা মানুষটা যে মেদিনীমণ্ডল গ্রাম থেকে এতটা দূরে নিয়ে এসেছে তাকে, তছির দশ টাকার নোটখান ভাঙাতে দেয়নি, নিজের তফিলের (তহবিল) পয়সা খরচা করে কোলাপাড়া বাজার থেকে মুরলিভাজা কিনে দিয়েছে তাকে, এরকম নির্জন ছাড়াবাড়িতে নিয়ে এসেছে এসব এখন একেবারেই ভুলে গেছে তছি। তার মন ঢুকে গেছে মুরলির ঠোঙায়, মন পড়ে আছে মুরলি খাওয়ায়।

শীতকালের দুপুরে তখন লেগেছিল আশ্চর্য সমাহিত ভাব। গাছপালার আড়াল সরিয়ে গাঁদাফুলের পাপড়ির মতন রোদের টুকরা এসে পড়েছিল ছাড়াবাড়ির এখানে ওখানে। বনফুলের ঝোপের কাছটা তীব্র গন্ধে মাতোয়ারা। তছির মাথার ওপর, বনফুলের গা ঘেঁষে ওড়াউড়ি করতাছে কয়েকটা প্রজাপতি। ফুলের মধু খেতে এসেছে অজস্র মৌমাছি। মধু খেতে খেতে গুনগুন গুনগুন করে শব্দ করতাছে। তুলতুলে হাওয়া। মন্থর হয়ে আছে শীত আর ফুলের গন্ধে। জামগাছের মগডালে বসে ঘুঘুর ঘুঘ, ঘুঘুর ঘুগ শব্দে ডাকছে একটা রাজঘুঘু। গাবগাছটার অন্ধকার খোড়লে স্থির হয়ে আছে একটা আরজিনা (গিরিগিটি)। বনফুলের ঝোপ ছাড়িয়ে ভাঙনের দিকে খাল। খালের শীতল কোমল পানিতে শ্বাস ফেলতে উঠেছিল পানির তলার মাছ। আর দূরের কোনও নির্জন গ্রাম প্রান্তরের একাকী বৃক্ষের ছায়ায় বসে প্রাণখুলে ডাকছিল এক কোকিল। শীতকালেই বসন্তের ডাক ডাকতে শুরু করেছে। আশ্চর্য ব্যাপার, মুরলিভাজা খেতে খেতে কোকিলের ডাকটা পরিষ্কার শুনতে পেল তছি। কেন যে সে একটু আনমনা হল! কেন যে সে একটু কান খাড়া করল!

তখনই রুস্তম এসে বসল তার পাশে।

মাজার গামছা খুলে মাফলারের মতো গলায় প্যাঁচিয়েছে। চোখ মুখে কী রকম উত্তেজনা। আচরণে মাছের মতো চাঞ্চল্য। পাশে বসেই তছির খোলা কাঁধে হাত রাখল। জড়ান গলায় আস্তে করে করে বলল, মুরলিভাজা খাইতে কেমুন লাগে?

তছির মুখভর্তি মুরলি। তবু রুস্তম এসে পাশে বসার পর আরেক মুঠ মুরলি মুখে দিল। যেন যত দ্রুত সম্ভব খেয়ে শেষ করতে হবে এক ঠোঙা মুরলি। নয়তো রুস্তম যদি ভাগ বসায়।

মুরলি মুখেই তছি বলল, খুব ভাল।

কথাটা একেবারেই জড়িয়ে গেল তার। কিছুই বোঝা গেল না। অবশ্য তছির কথা বোঝ না বোঝায় রুস্তমের কিছু আসে যায় না। সে কি আর মুরলির চিন্তায় আছে। সে আছে অন্য চিন্তায়, অন্য উত্তেজনায়। তবু কোনও একটা কথা দিয়ে শুরু করতে হয় বলে কথাটা সে বলেছে।

রুস্তম যতটা নিচু গলায় কথা বলছে তছি যেন বলছে ততটাই উঁচু গলায়। মুখে মুরলিভাজা ছিল বলে কথা বোঝা যায়নি, শব্দটা বোঝা গেছে। সেই শব্দে চমকেছে রুস্তম। চঞ্চল চোখে চারদিক তাকিয়েছে। তারপর নিজের শরীর তছির পিঠে ঠেকিয়ে ফিসফিস করে বলেছে, আস্তে কথা কও, আস্তে।

মুরলি চাবাতে চাবাতে তছি নির্বিকার গলায় বলল, ক্যা?

কেঐ হুনবো।

হুনলে কী হইছে?

তছির পিঠের উপর দিকে নিজের মুখ একটুখানি ঘষে দিয়ে রুস্তম বলল, হুনলে মন্দ কইবো?

ক্যা আমরা কী মন্দ কথা কইছি?

না।

তয়?

এমুন নিটাল জাগায় আমরা দুইজন মানুষ বইয়া রইছি দেকলে মাইনষে মনে করব অন্যকাম করতাছি।

কী কাম?

তুমি বোজ না?

না।

সত্যঐ বোজ না?

তয় কী মিছা? আমি আপনের লগে মিছাকথা কই?

না মিছাকথা কইবা ক্যা! বোজবা, আস্তে আস্তে বোজবা। বহো। মুরলিভাজা খাও। তয় আওজ কইরো না।

বলে মুখখানা গভীর আবেগে তছির পিঠের উপর দিকে, আগের জায়গায় ঘষতে লাগল রুস্তম। আর দুইহাতে হাতাতে লাগল তার দুইবাহু। প্রথম প্রথম ব্যাপারটা পাত্তা দিল না তছি। তারপরই ছটফট করে উঠল। উঁহুহু, এমুন কইরেন না রিশকাআলা ভাই।

আমার জানি কেমুন লাগে!

রুস্তম গুঙিয়ে গুঙিয়ে বলল, কেমুন লাগে?

শইল্লের পশম খাড়ইয়া যায়। ক্যাতকুতি (সুরসুরি) লাগে। উঁহু উঁহু। এমুন করতাছেন ক্যা আপনে? কী অইলো আপনের, এমুন করতাছেন ক্যা?

বোজ না ক্যান এমুন করি! বোজ না তুমি?

না বুজি না। আপনে আমার কাছ থিকা সরেন, সইরা বহেন। এমুন কইরেন না। মুরলিভাজা খাইতে দেন আমারে।

তছির কথা গ্রাহ্য করল না রুস্তম। তছির কাঁধে, পিঠে মুখ ঘষতে ঘষতে, তছির বাহুতে হাত বুলাতে বুলাতে, আকাতলির (বগল) দিকে হাত দিয়ে বেশ যত্নে, বেশ কায়দায় তার গা থেকে সরাতে লাগল কাপড়। শ্বাস প্রশ্বাস হঠাৎ জ্বর আসা রোগির মতন গরম। মুখে মৃদু গোঙানীর শব্দ। বুকের ভিতর অদ্ভুত উত্তেজনা। তলপেট ফেটে যেতে চাইছে যন্ত্রণায়। পিছন থেকে আস্তে ধীরে নিজের দুটি হাত তছির বুকের দিকে এগিয়ে দিল রুস্তম।

তখনই যা বোঝার বুঝে গেল তছি। ঠোঙায় তখনও রয়ে গেছে কিছু মুরলিভাজা। সেদিকে আর খেয়াল রইল না তার। সাপের ছোবল এড়াতে যেমন করে লাফিয়ে ওঠে সাবধানী পাখি ঠিক তেমন করে লাফ দিয়ে উঠল সে। দাঁতে দাঁত চেপে হিসহিস করে বলল, বুজছি। তোমার মতলব আমি বুজছি। তুমি তো মানুষ ভাল না! তুমি তো বদ! মুরলি খাওনের লোভ দেহাইয়া এর লেইগা ছাড়াবাইত্তে লইয়াছো আমারে

হিংস্র হাতে থাবা দিয়ে রুস্তমের গলার গামছাটা ধরল তছি। ধরে চোখের পলকে গিটঠু দিয়ে ফেলল। দুইহাতে দুইদিকে টেনে ধরল গামছার দুইমাথা। আগের মতোই দাঁতে দাঁত চেপে হিসহিস করে বলল, কীরে খানকি মাগির পোলা, কীরে ছিলানী মাগির পোলা, মা বইন নাই তর? এই হগল করতে অয় তর মার লগে কর, তর বইনের লগে কর। আমার লগে ক্যা?

রুস্তম এতটা কল্পনাও করেনি। প্রথমে সে হতভম্ব হল, তারপর গেল ভয় পেয়ে। শরীরের উত্তেজনা কোথায় উধাও হল! শুধু মনে হল যে রকম হিংস্র গলায় কথা বলছে তছি, শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে গলায় ফাঁস দিয়েছে গামছা, অবস্থাটা এরকম থাকবে না। এভাবে তাকে ধরে রেখে এখনই চিৎকার শুরু করবে সে। তোমরা কে কোনওহানে আছো, আউগগাও। রোস্তম রিশকাআলা আমার ইজ্জত নষ্ট করতে চায়। আর তছির সেই চিৎকার শুনে সড়ক পথে চলতে থাকা পথিকরা একজন দুইজন করে একত্রিত হবে। দল বেঁধে এগিয়ে আসবে ছাড়াবাড়ির বনফুলের ঝোপটার কাছে। তছির হাত থেকে ছাড়িয়ে নিবে রুস্তমকে। তারপর শুরু করবে মাইর। একেকজন একেক ভাষায় বকাবাজি করবে আর মারবে। কেউ কোকসা বরাবর লাথথির পর লাথি মারবে, কেউ মারবে নাকে মুখে ঘুষি। সেইসব ঘুষির কোনওটায় খাড়া হয়ে থাকা নাক যাবে চ্যাপটা হয়ে, দাঁতগুলি কদুবিচির মতন ছিটকে ছিটকে পড়বে এদিক ওদিক, জিভের অর্ধেকটা কেটে বউন্না গাছের বাকলার মতন খসে পড়বে। কারও কারও কিল ঘুষিতে ঠোঁট হবে ফালা ফালা, চোখের মণি গলে ভাঙা ডিমের মতন বেরিয়ে আসবে। কেউ হয়তো অতিরিক্ত ক্রোধে ভেঙে নেবে শক্ত কোনও গাছের ডাল। সেই ডাল দিয়ে বেছে বেছে বাড়ি মারবে হাত পায়ের জোড়ায়। জোড়াগুলি ভেঙে দিবে। অতিরিক্ত নৃশংস কোনও মানুষ হয়তো দুইখান থানইট জোগাড় করে আনবে। যে কর্মের উদ্দেশ্যে তছিকে সে এখানে নিয়ে এসেছে সেই কর্ম সমাধার অঙ্গ একটা থানইটের ওপর রেখে অন্য থানইট দিয়ে গিরস্ত বাড়ির বউঝিরা যেভাবে টাকিমাছ ভর্তা করে সেইভাবে ভর্তা করবে। গুহ্যদ্বার দিয়ে হাতের লাঠিও প্রবেশ করিয়ে দিতে পারে কেউ।

এরপর রুস্তম আর কিছু ভাবতে পারল না। দুইহাত মাফ চাওয়ার ভঙ্গিতে একত্র করে দিশাহারা গলায় তছিকে বুঝ দেওয়া, চেষ্টা করতে গেল। আমার ভুল অইয়া গেছে। মস্ত বড় ভুল হইয়া গেছে। তছি, ইন গো, বইন, তুমি আমারে মাপ কইরা দেও বইন। এমন ভুল জিন্দেগিতে আর করুম না। বইন কইলাম, তোমারে আমি বইন কইলাম, তুমি আমারে মাপ কইরা দেও। চিকইর দিও না বইন, মানুষজন ডাক দিও না। মানুষ ডাক দিলে আমার আর বাচন নাই। আমারে তারা মাইরা হালাইবো। বইন না, দরকার অইলে তোমারে আমি মা ডাকতাছি। মা, তছি মা, তুমি আমারে মাপ কইরা দেও মা।

আশ্চর্য ব্যাপার, রুস্তমের গলা দিয়ে শব্দ বের হল না। কথা বলতে গিয়েও রুস্তম দেখে কথা সে বলতে পারছে না। গলা বন্ধ হয়ে গেছে। বুকের ভিতর ফুরিয়ে আসছে দম। চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। জিবলাটাও থাকতে চাইছে না মুখের ভিতর, নিজের অজান্তেই অনেকখানি বের হয়ে আসছে। থুতনি ছাড়িয়ে নেমে গেছে। গামছার ফাঁস কঠিন থেকে কঠিন হয়ে আটকে গেছে গলায়।

রুস্তম তার তাগড়া জোয়ান শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে দুইহাতে টেনে ছাড়াতে চাইল গামছার ফাস। কোরবানী দেওয়া গরুর মতো দাপড়া দাপড়ি করতে লাগল। বিন্দুমাত্র আলগা করতে পারল না। কোরানী দেওয়ার সময় গরুর সর্বাঙ্গ যেমন চেপে ধরে আট দশজন তাগড়া জোয়ান পুরুষ, যতই দাপড়া দাপড়ি করুক লোকগুলিকে যেমন গা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিতে পারে না গরু, তছিকেও তেমন ঝেড়ে ফেলতে পারছে না রুস্তম। তছি যেন এখন আর কোনও নরম কোমল, ঢলঢল যৌবনের যুবতী মেয়ে না। তছি যেন এখন কোনও অবলা নারী না। তছি যেন এখন একাই আট দশজন তাগড়া জোয়ান পুরুষ। রুস্তম নামের গরুটাকে মাটিতে ফেলে জবাই করতাছে। রুস্তমের গলায় গিট দিয়ে ধরা গামছা যেন ঝকঝকা ধারের গরু জবাই করার বিশাল ছুরি। সেই ছুরি দিয়ে পুচিয়ে পুচিয়ে রুস্তমকে যেন সে জবাই করতাছে।

রুস্তমের ধ্বস্তাধ্বস্তি আর তছির রাগ ক্রোধের হিসহিস শব্দে বনফুলের মাথার ওপর ওড়াউড়ি করতে থাকা প্রজাপতিগুলি ভয় পেয়ে অন্যদিকে উড়াল দিয়েছে। মধু খেতে আসা মৌমাছিরা বন্ধ করেছে গুনগুন শব্দ, পালাবার পথ খুঁজছে। আমগাছের আগডালে বসা রাজঘুঘুটা আচমকাই স্তব্ধ হয়েছে। গাবগাছের গোড়লের কাছে স্থির হয়ে থাকা আরজিনাটা লুকাতে ব্যস্ত হয়েছে অন্ধকার খোড়লে। বনফুলের গন্ধে মাতায়োরা হাওয়া হয়েছে আরও ধীর। দূর থেকে ভেসে আসা কোকিলের ডাক আর শোনা যায় না।

কতক্ষণ, কতক্ষণ এভাবে চলেছে কে জানে। হঠাৎ করেই যেন নিজের মধ্যে ফিরে এল তছি পাগলনি। একে একে সব মনে পড়ল তার। মুরলিভাজার ঠোঙাটা পড়ে আছে রুস্তমের পায়ের কাছে। ধ্বস্তাধ্বস্তির ফলে যে কয়টা মুরলি তখনও ছিল ঠোঙায় সেগুলি ছড়িয়ে পড়েছে এদিক ওদিক। গামছার ফাস তখনও শক্ত হাতে টেনে রেখেছে তছি। রুস্তমের কোনও সাড়া নাই। একবোরেই স্থির হয়ে আছে সে। ধ্বস্তাধ্বস্তি দূরের কথা, হাত পা ছোঁড়া দূরের কথা, লড়াচড়াও নাই তার। কুকরার আন্ডার মতন চোখ দুইটা বেরিয়ে, ভুরুর তলায়, নাকের বাঁকের কাছে এসে ঠেকে আছে। হাঁ করা মুখ থেকে জিভ বেরিয়েছে বিঘতখানেক। থুতনির তলায় বরকির দাঁড়ির মতো ঝুলছে। এসব দেখেও ক্রোধ যেন কমল না তছির। গামছার ফাসে হ্যাঁচকা একটা টান দিল, দিয়েই ছেড়ে দিল। নুনের বস্তার মতো একদিকে কাত হয়ে পড়ল রুস্তম।

তছির বুক তখন হাপরের মতন ওঠানামা করতাছে। ফোঁস ফোঁস ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস পড়ছে। গভীর ক্লান্তিতে ভেঙে আসতে চাইছে শরীর। ইচ্ছা করে রুস্তমের পাশে সেও লুটিয়ে পড়ে থাকে।

তছি তা করে না। ক্রোধ এখন অচেনা এক দুঃখে রূপ নিয়েছে। গভীর কষ্টের এক কান্নায় বুক ফেটে যেতে চাইছে, চোখ জ্বালা করতাছে। তবু শেষ ক্রোধটা রুস্তমের ওপর মিটাল সে। ডান পা তুলে প্রচণ্ড একখান লাথি মারল রুস্তমের মুখ বরাবর। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, মিটছে না, মনের খায়েশ মিটছে না তর?

তছির লাথথি খেয়ে রুস্তমের দেহ তখন গাছের গুঁড়ির মতো গড়িয়ে যাচ্ছে ভাঙনের দিকে। দেখতে দেখতে ঝপ করে গিয়ে পড়ল খালের পানিতে। সেই শব্দে কী হল তছির, বুকের কান্না, চোখের কান্না আর ধরে রাখতে পারল না সে। মুখে আঁচল চেপে গুঙিয়ে গুঙিয়ে কাঁদতে লাগল। কাঁদতে কাঁদতে বনফুলের ঝোপের আড়াল থেকে বেরুল। বেরিয়ে পাগলের মতো সড়ক বরাবর ছুটতে লাগল।

.

১.৫৫

গলার চেন হাতাতে হাতাতে এনামুল বলল, বলেন মাওলানা সাব, খবর কী?

মান্নান মাওলানা বসে আছেন হাতলআলা ভারী চেয়ারে। বিকাল হতে না হতেই শীতের কাপড় পরে বাড়ি থেকে বেরিয়েছেন। খয়েরি রঙের ফ্লানেলের পানজাবি। পানজাবির উপর নীল রঙের হাফহাতা সোয়েটার। গলায় জড়ান হলুদ রঙের মাফলার। পায়ে উলের সাদা মোজা আর খয়েরি রঙের পাম্পসু। এমনিতেই পেট মোটা মানুষ তার ওপর পরেছেন এতগুলি কাপড়, মান্নান মাওলানাকে দেখাচ্ছিল গাবগাছের গুঁড়ির মতন। তার ওপর কাপড় একেকটা একেক রঙের। কাপড়ের কারণে তাকে মনে হচ্ছিল সার্কাসের জোকার। বসে আছেন ঘরের ভিতর, দেলোয়ারদের বড়ঘরের উত্তর দিককার কামরায়, তবু যেন শীতে কাতর।

এনামুলের কথা শুনে একবার নাক টানলেন মান্নান মাওলানা আছে, খবর আছে। আমার পত্র পাও নাই তুমি?

হ পাইছি।

পত্রে তো খবর আমি কিছু লেকছিলাম।

হ লেকছেন। তয় তেমুন খোলসা কইরা কিছু লেকেন নাই। বাড়িতে আসনের পর আম্মায় আমারে কইছে।

কী কইছে?

আমারে দিয়া গেরামে একখান মজজিদ করাইতে চান।

মান্নান মাওলানা আবার নাক টানলেন।

এনামুলের পাশাপাশি চৌকিতে পা ঝুলিয়ে বসে আছেন দেলোয়ারা। খানিক আগে চোখ থেকে চশমা খুলে মুছে নিয়েছেন। মন দিয়ে এনামুল আর মান্নান মাওলানার কথা শুনছিলেন। মান্নান মাওলানাকে পরপর দুইবার নাক টানতে দেখে বললেন, ঠাণ্ডা লাগছেনি মাওলানা সাব?

হ বইন। ভাল ঠাণ্ডা লাগছে। আমার ইট্টু ঠাণ্ডার বাই আছে। শীতের দিনে ঘন ঘন লাগে।

রাবি দাঁড়িয়ে আছে ভিতর দিককার দরজার সামনে। বাদলা তার কোলে। বোধহয় কোল থেকে একটু পিছলে পড়েছিল, আঁকি (ঝাঁকুনি) দিয়ে রাবি তাকে জায়গা মতন উঠাল। বলল, কুনসুম ঠাণ্ডা লাগলো হুজুর? আমি যহন আপনেরে সমবাত দিতে গেলাম তহনও তো দেকলাম ভাল!

চোখ তুলে রাবির দিকে তাকালেন মান্নান মাওলানা। তহন লাগে নাই। লাগলো এই বাইত্তে আইতে আইতে।

কন কী? কেমতে?

খেতখোলার মাঝখান দিয়ে হাইট্টা আইলাম তো! মনে অয় এর লেইগাই লাগছে। শীতের দিনে খোলা জাগায় বাইর অইলেঐ ঠাণ্ডা লাগে আমার।

দেলোয়ারা বললো, চা খাইবেননি?

মান্নান মাওলানার মুখ উজ্জ্বল হল। খাইতে পারি।

দুদচা না আদাচা?

এনামুল বলল, আদাচাঐ দিতে কন। ঠাণ্ডার মইদ্যে আদাচা খাইলে আরাম পাইবো।

মান্নান মাওলানা বললো, হ এইডা ঠিক কথা।

দেলোয়ারা এনামুলের মুখের দিকে তাকাল। তুমিও ইট্টু খাইবানি বাজান?

এনামুল বলল, না। চা আমি খাই না।

 মান্নান মাওলানা বললেন, ক্যা?

চা খাইলে আমার শইল কইষ্যা (কষে) যায়।

তাইলে না খাওনঐ ভাল।

দেলোয়ারা বললেন, আদাচা খাইলে শইল আরও বেশি কষে।

তারপর রাবির দিকে তাকালেন তিনি। ঐ রাবি, মাওলানা সাবরে এককাপ আদাচা বানাইয়া দে।

দিতাছি।

বাদলাকে কোলে নিয়েই রান্নাঘরের দিকে চলে গেল রাবি।

এবার মান্নান মাওলানার দিকে তাকাল এনামুল। হঠাৎ আমারে দিয়া মজজিদ করাইতে চাইতাছেন ক্যান আপনে?

মান্নান মাওলানা একটু থতমত খেলেন। তবে পলকের জন্য। তারপরই নিজেকে সামলালেন। তুমি ছাড়া আমগো পাড়ায় আর টেকাআলা মানুষ কে আছে? কারে কমু?

যে সব লোকের টাকা আছে তাদের মধ্যে কাউকে কাউকে টাকাআলা বললে তারা খুশি হয়। এনামুল এই ধরনের লোক। মান্নান মাওলানার কথা শুনে ভিতরে ভিতরে খুবই খুশি হল সে। তবে মুখে তা প্রকাশ করল না। মুখটা হাসি হাসি করে বেশ একটা বিনয়ের ভাব ফোঁটাল। কী যে কন মাওলানা সাব! আমি আর কয় টেকার মালিক! আমারে কিনতে পারে এমন মানুষ ম্যালা আছে গেরামে।

গেরামে থাকতে পারে, আমগো পাড়ায় নাই।

আছে।

 কেডা কও তো!

ধরেন রাজা মিয়া।

রাজা মিয়ার টেকা আছে জানি। তয় তোমার লাহান না।

আরেকজন তো আপনের বাইত্তেঐ আছে। ম্যালা টেকার মালিক।

কেডা, কার কথা কইতাছো?

মন্তাজ।

হ মন্তাজের টেকা আছে। তয় যাই কও, তোমার লাহান না।

দেলোয়ারা বললেন, আপনেরই বা কম টেকা আছেনি।

মান্নান মাওলানা আকাশ থেকে পড়লেন। আমার টেকা! আমি টেকা পামু কই?

আপনের ছোডপোলা থাকে জাপানে। বাড়ির একখান পোলা জাপানে থাকলে আর কিছু লাগেনি? মাসে সব বাদ দিয়া কমপক্ষে লাকটেকা পাড়ায়। বচ্ছরে বারোলাক। চাইর পাঁচ বচ্ছর ধইরা আছে। আপনের আর লাগে কী!

মান্নান মাওলানা আবার নাক টানলেন। তুমি যা কইলা এইডা পুরাপুরি সত্য না। মাসে লাটেকা আজাহারে পাড়ায় না। অনেক কম পাড়ায়। মাসে কামাই করে লাক দেড়েক এইডা আমি বুজি। বহুত চালাক পোলা আজাহারে। বাড়িতে অল্প টেকা পাড়ায়, বাকি নিজের কাছে রাখে। আমার এই পোলাডা অন্যপদের। সহাজে কেরে বিশ্বাস করে না।

হোনলাম জাপানে বলে কেঐ আর থাকতে পারবো না। ঐ দেশের সরকার বলে ধইরা ধইরা বেবাকতেরে দেশে পাড়াইয়া দিবো!

কথাটা শুনে চমকালেন মান্নান মাওলানা। কার কাছে হোনলা?

 ফকির বাড়ির মালেকের বউয়ে কইলো। মালেকের এক পোলায় থাকে জাপানে।

হ, ইব্রাহিম। আজাহার ইব্রাহিম অরা একলগেই গেছিল। ইব্রাহিম পত্র লেকছেনি? পত্রে এই হগল কথা লেকছে?

হ। মালেকের বউয়ে তো কইল।

তাইলে কথা মিছা না।

মান্নান মাওলানা চিন্তিত চোখে খোলা দরজা দিয়ে বাইরে, আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

শীতের বিকাল দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে তখন। রোদ উঠে গেছে গাছপালার মাথায়। একটু পরেই আকাশ থেকে নামতে শুরু করবে কুয়াশা। চকমাঠ, গিরস্ত বাড়ির উঠান পালান ভরে যাবে কুয়াশায়। কুয়াশার উপর কুয়াশার মতো জমবে অন্ধকার। শন শন করে বইবে উত্তরের হাওয়া। পাটাপুতার মতো ভারী একখান রাত নামবে।

মান্নান মাওলানাকে চিন্তিত দেখে এনামুল গলা খাঁকারি দিল। আপনে এত চিন্তায় পড়লেন ক্যা মাওলানা সাব?

মান্নান মাওলানা মুখ ঘুরিয়ে এনামুলের দিকে তাকালো। চিন্তার কথা। আজাহাররে যুদি জাপান থিকা খেদাইয়া দেয় তাইলে বিপদে পইড়া যামু।

কীয়ের বিপদ?

এতবড় সংসার। বড় পোলার বিধবা বউ পোলাপান, আমি, আতাহার, আতাহারের মায়। এতডি মাইনষের সংসার চলবো কেমতে?

সংসার কি আজাহারের টেকায় চলেনি?

তয়!

ক্যা বিলে আপনের এত খেতখোলা, এত ইরি পান, এতডি গরু। আজাহারের টেকা না পাইলে কী! অভাব আছেনি আপনের!

মান্নান মাওলানা হাসলেন।

দেলোয়ারা বললেন, মাওলানা সাবে খালি গলা হুগায়।

এনামুল বলল, বাদ দেন এই হগল কথা। কামের কথা কন।

তখনই বড় একটা কাপে চা এনে মান্নান মাওলানার হাতে দিল রাবি।

দেলোয়ারা বললেন, বাদলা কো?

রাবি লাজুক গলায় বলল, রান্দনঘরে।

কী করে?

বাডিতে ইট্টু চা দিছি। ফুয়াইয়া ফুয়াইয়া খাইতাছে।

দেলোয়ারা একটু রাগলেন। এতটু পোলার চা খাওনের অব্বাস করিচ না।

রাবি কথা বলল না।

চায়ে চুমুক দিয়ে মান্নান মাওলানা বললেন, রাজা মিয়ার টেকা আছে, মন্তাজের টেকা আছে আমি জানি। তাগো দুইজনরে ধরলে দুইজনে টেকা দিয়া, দুইজনে মিল্লা মজজিদ একখান বানাইয়া দিবো। তাগো আমি ধরতে চাই না।

এনামুল বলল, ক্যা?

তারা মানুষ ভাল না। বারোপদের কথা কইবো।

কী কথা?

তারা তো এমতেঐ আমারে দেকতে পারে না। মনে করবো মজজিদ আমি অন্য মতলবে বানাইতাছি।

 মজজিদ আবার অন্য মতলবে বানায় কেমতে? মজজিদ অইলো আল্লার ঘর। মাইনষে নমজ (নামাজ) পড়বো। মজজিদের লগে মতলবের কোনও সমন্দ নাই।

এনামুলের কথা শুনে মান্নান মাওলানা মুগ্ধ হলেন। এইডা তুমি বোজো দেইক্কাঐ তোমারে ধরছি। অন্য কের কাছে যাই নাই।

বোজলাম। তয় খাইগো বাড়ির মজজিদ থাকতে একঐ গেরামে আরেকখান মজজিদ আপনে বানাইতে চাইতাছেন ক্যা?

এই প্রশ্নের উত্তর তৈরিই ছিল মান্নান মাওলানার। বললেন, খাইগো বাড়ির মজজিদটা আমগো পাড়া থিকা অনেক দূরে। অতদূরে গিয়া জামাত ধরন বহুত অসুবিদা। অনেক বুড়া মানুষ আছে এতাহানি হাইট্টা যাইতে পারে না। তাগো চিন্তা কইরা তোমারে ধরছি।

এনামুল কী চিন্তা করল তারপর বলল, ইগো বাড়ির মজজিদে মাইক আছে না?

আছে

আয়জান দিলে গেরামের বেবাকতে হোনে না?

হোনে।

নিয়ম আছে বলে এক মজজিদের আয়জান যতদূর পর্যন্ত হুনা যায় অতদূরের মইদ্যে আর কোনও মজজিদ করন যাইবো না?

কে কইছে তোমারে? আমি হুনছি।

বাজে কথা। ঢাকার টাউনে দেহো না এক মহল্লায় চাইর পাঁচখান কইরা মজজিদ। একলগে দশখান মজজিদের আয়জান হুনা যায়।

এইডার কারণ আছে।

কী কারণ?

ঢাকার টাউনে মানুষ বেশি। এক মহল্লায় যেই পরিমাণ মানুষ থাকে, একখান মজজিদে অত মানুষ নমজ পড়তে গেলে মজজিদে মানুষ আড়ে না। এর লেইগা মজজিদ বেশি। তারপরও জুমমার দিন কোনও কোনও মজজিদের সামনের রাস্তায়ও নমজ পড়তে খাড়ইয়া যায় মাইনষে।

এনামুলের কথা শুনে একটু যেন ফাপড়ে পড়লেন মান্নান মাওলানা। হাঁ করে এনামুলের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

এনামুল কী বুঝল কে জানে, বলল, ঠিক আছে আপনে যহন আইছেন আমার কাছে, মজজিদ করন ছোঁয়াবের কাম, কী রকম টেকা পয়সা লাগবো কন! চিন্তা কইরা দেখি।

মান্নান মাওলানার মুখ আবার উজ্জ্বল হল।

তখনই মোতালেব এসে ঢুকল এই ঘরে। এনামুলের দিকে তাকিয়ে খুবই ফুর্তির গলায় বলল, কুনসুম আইলা মামু?

মোতালেবকে পাত্তা দিল না এনামুল। অবজ্ঞার চোখে একবার তার দিকে তাকাল, তারপর খোলা দরজা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলল, দোফরে আইছি।

অবজ্ঞাটা মোতালেব বুঝল, বুঝেও গায়ে লাগাল না। লম্বা বেঞ্চটায় বসল। হাসিমুখে বলল, কেমতে আইলা? লনচে?

এনামুল আগের মতোই অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, না।

 তয়?

 গাড়ি লইয়াছি।

কোনতরি আইলা?

 ছিন্নগর তরি।

গাড়ি ছিন্নগরে রাকছ?

না।

তয়?

গায়ে পড়ে এত কথা বলা মোতালেবের পছন্দ করছিল না এনামুল। তবু একটা লোক কথা জিজ্ঞাসা করলে সে কথার জবাব না দিয়ে তো পারে না। তার ওপর লোকটা যদি হয় খুব কাছের আত্মীয়।

বিরক্তি চেপে এনামুল বলল, গাড়ি ফিরত পাডাই দিছি।

কই?

কই আবার? ঢাকা।

বিরক্তির ভাব এবার পরিষ্কার ফুটল এনামুলের গলায়। মোতালেব পাত্তা দিল না। বলল, তোমারে নামাইয়া দিয়া গাড়ি ঢাকা গেছে গা?

হ।

তয় ছিন্নগর থিকা আইলা কেমতে হাইট্টা?

রিকশায় আইছি।

ও তাইলে তুমিঐ আইছো রিকশা কইরা? গেরামে প্রথম রিকশা আইলো তোমারে লইয়া? ভাল, ভাল।

তারপর যেন মান্নান মাওলানার হাতে চায়ের কাপ দেখতে পেল মোতালেব। দেখে রাবির দিকে তাকাল। ঐ রাবি, চা আছেনি?

তার ছেলের গায়ে হাত তুলেছে মোতালেব, ওই ঘটনার পর থেকে দুইচক্ষে মোতালেবকে দেখতে পারে না রাবি। দেখলেই মুখ আপনা আপনি বেঁকা হয়ে যায়। এই ঘরে মোতালেবকে ঢুকতে দেখেই হয়েছিল। এখন চায়ের কথা বলায় আরও হল। মুখ ঝামটা দিয়ে বলল, না।

এককাপ বানায় দে আমারে।

আমি অহন চা বানাইতে পারুম না। আমার কাম আছে।

হয়তো মোতালেবের কথা শুনে এনামুল নয়তো দেলোয়ারা, এমন কি মান্নান মাওলানাও রাবিকে বলতে পারেন, দে এককাপ চা বানাইয়া। এইসব মানুষের কথা রাবি না রেখে পারবে না। তারচেয়ে এখান থেকে সরে যাওয়াই ভাল। চোখের আড়ালে

থাকলে তাকে ডেকে মোতালেবের জন্য চা বানাতে কেউ বলবে না। মোতালেব এত দামী লোক না।

এসব ভেবে রাবি আর দাঁড়াল না, পিছন দিককার দুয়ার দিয়ে বেরিয়ে গেল।

মোতালেব তীক্ষ্ণচোখে রাবির চলে যাওয়া দেখল তারপর এনামুলের দিকে মন দিল।

এনামুল আর একবারও তাকায়নি মোতালেবের দিকে। সে তাকিয়ে আছে মান্নান মাওলানার দিকে। একহাতে গলার চেন নাড়াচাড়া করতাছে।

শব্দ করে চায়ে শেষ চুমুক দিলেন মান্নান মাওলানা। এই শব্দে বরাবরে মতো বিরক্ত হলেন দেলোয়ারা। নিজের অজান্তেই ভুরু কুঁচকে গেল তার। বিরক্তি কাটাবার জন্যই কিনা কে জানে, একফাঁকে চশমা খুলে শাড়ির আঁচলে মুছতে লাগলেন।

এনামুল বলল, তয় কোন জাগায় করতে কন মজজিদ।

কাপটা পায়ের কাছে নামিয়ে রাখলেন মান্নান মাওলানা। কথা বলতে যাবেন তার আগেই গভীর আগ্রহের গলায় মোতালেব বলল, কীয়ের মজজিদ?

এনামুল বিরক্ত হয়ে বলল, মজজিদ আবার কীয়ের অয়?

এনামুলের বিরক্তিটা বুঝলেন মান্নান মাওলানা। মোতালেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, চুপ কইরা বহো মিয়া, বেশি পাচাইল পাইরো না। এনামুল সাবে কী কয় বইয়া বইয়া হোনো।

এনামুলকে সাহেব বলছেন মান্নান মাওলানা, শুনে খুবই খুশি হল এনামুল। মোতালেবের ওপরকার বিরক্তি কেটে গেল্ড। হাসিমুখে বলল, কন মাওলানা সাব কোনহানে করবেন মজজিদ?

তোমগো ছাড়া বাইত্তে।

লগে লগে দেলোয়ারার দিকে তাকাল এনামুল। হাসল। ছাড়া বাড়িডা আমগো না। আমার মা খালার।

মোতালেব আগ বাড়িয়ে বলল, মা খালার বাড়ি আর তোমগো বাড়ি তো মিয়া একঐ।

না এক না।

মোতালেব তারপর দেলোয়ারার দিকে তাকাল। বুজি কী কয়?

দেলোয়ারা নরম গলায় বললেন, আমিও হেইডা কই।

তারপর চশমা চোখে পরলেন।

মান্নান মাওলানা বললেন, মজজিদের ব্যাপার তো। মুখ দিয়া খালি কইলেঐ অইবো না। হয় খালার কাছ থিকা বাড়িডা কিন্না নিতে অইবো এনামুলের, নাইলে দেলোয়ারারা দুই বইনে মিল্লা মজজিদের নামে বাড়িডা লেইক্কা দিবো।

এনামুল বলল, তাইলে তো মজজিদ আমার একলা অইলো না। আমার মা খালায় দিলো জাগা আমি উডাইলাম বিন্ডিং।

মোতালেব বলল, হ। তাতে অসুবিধা কী?

 এবার মোতালেবকে ছোটখাট একটা ধমক দিল এনামুল। এই মিয়া আপনে চুপ করেন তো। কথার মইদ্যে কথা কইয়েন না।

মোতালেব একটু থতমত খেল কিন্তু এনামুল তা গ্রাহ্য করল না। মান্নান মাওলানার দিকে তাকিয়ে বলল, আমার একখান নীতি আছে মাওলানা সাব। বেবাক কামেঐ নীতিডা আমি মাইন্না চলি।

মান্নান মাওলানা সামান্য গলা খাকারি দিলেন। কী নীতি?

যেই কামঐ করি, একলা করতে চাই। নিজের ক্ষমতায় করতে চাই।

এইডাঐত্তো ভাল।

যেইডা করুম, একলা কম। অন্যরে লইয়া করুম না। ছোড করি আর বড় করি, আমি একলা করুম। নাম অউ বদলাম অউক আমার একলা অইবো। নিজের কামে অন্য কেঐরে জড়ামু না।

দেলোয়ারা নরম গলায় বললেন, মা খালারা কি তোমার পরনি?

খালার দিকে তাকিয়ে হাসল এনামুল। কথা কইলাম তা না আম্মা। কথাডা কইলাম অন্য। একখান মজজিদ যহন আমি করুম, একলাঐ করুম। আপনেগো ঐ ছাড়া বাড়িডা যুদি না থাকতো তারবাদেও যুদি গেরামে মজজিদ আমি করতে চাইতাম, কেমতে করতাম? কোনও একখান বাড়ি নাইলে জাগা কিন্না, মাডি উড়াইয়া, বাড়ি বাইন্দা তারবাদে করতাম না

হ তাতো করতাঐ।

অহন করলেও অমতে করুম।

জাগা কিন্না?

হ।

জাগা পাইবা কই?

এনামুল হাসল। জাগা তো আছেঐ।

কোনহানে?

আপনেগো ছাড়াবাড়ি

অনেকক্ষণ চুপচাপ ছিল মোতালেব। আর পারল না। বলল, মা খালার কাছ থিকা বাড়ি কিন্না লইবা মামু?

মোতালেবের কথায় এবার আর রাগল না এনামুল। হাসল। হ। লেইজ্জ (ন্যায্য) দাম যা অয় তা দিয়াঐ কিনুম। তারবাদে মজজিদ করুম।

আবার দেলোয়ারার দিকে তাকাল এনামুল। কী আম্মা, বাড়ি বেচবেন না আমার কাছে।

দেলোয়ারা বললেন, আমার কিছু কওয়ার নাই। তোমার মায় যা কইবো তাই অইবো।

মায় আমার কথা হালাইবো না।

হেইডা আমি জানি। তয় তোমারে আমি আরেকখান কথা কই বাজান, তোমার মায় দেউক না দেউক আমার অংশ আমি তোমারে দিয়া দিলাম।

একথায় এনামুলের চেয়ে মান্নান মাওলানা বেশি মুগ্ধ হলেন। মোতালেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, দেকছো মিয়া, খালা কারে কয়! খালা অইলে এমুনঐ অইতে অয়। মুখের কথায় লাকটেকার সমপিত্তি বইনপোরে দিয়া দিল।

মোতালেব কথা বলবার আগেই এনামুল বলল, আমার মায়ও এই কথাই কইবো আমারে।

এবার মোতালেব আর চুপ করে থাকতে পারল না। বেশ একটা গর্ব নিয়ে বলল, এনামুলের মা খালারা কোন বাড়ির মাইয়া হেইডা দেকতে অইবো না? কাগো (কাদের) বইন হেইডা দেকতে অইবো না? আমার বইনতো মিয়া, বুজলেন না!

মোতালেবের কথা শুনে অন্যদিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন মান্নান মাওলানা।

এনামুল বলল, মজজিদ করনের লেইগা ঐ ছাড়াবাড়িডা সব থিকা ভাল।

মান্নান মাওলানা বললেন, হ বড় সড়কের এক্কেরে লগে। সড়ক দিয়া হাজার হাজার মানুষ যাইবো আর চাইয়া চাইয়া মজজিদ দেকবো। দেইক্কা মাইনষেরে জিগাইবো, মেদিনীমণ্ডল গেরামে এত সোন্দর মজজিদখান কেডা করলো? মাইনষে কইবো, এনামুল সাবে করতাছে। মাইনষের মুখে মুখে তোমার নাম ছড়াইয়া যাইবো।

মোতালেব বলল, তয় ঐ বাড়ি থিকা কইলাম সড়ক দেড় দুইকানি অইবো।

অইলে কী অইছে, রাস্তা আছে না?

আছে, তয় ভাল রাস্তা না। আইল (আলপথ)।

এনামুল বলল, ঐ আইল থাকবো না। বড় সড়ক থিকা মজজিদ তরি ঐ আইল বাইন্দা আমি হালট (সড়ক) বানাইয়া দিমু। সড়ক তার বাড়ির লেবেল অইবো এক। হালটের লেবেল অইবো এক।

মোতালেব বলল, তাইলে তো মাডি উডান লাগবো?

উডামু।

কই থিকা?

ছাড়াবাড়ির পশ্চিমে পুকঐর আছে না! ঐ পুকর থিকা মাডি উড়াইয়া বাড়িডারেও ঠিক মতন বান্দন লাগবো, হালটও বান্দন লাগবো।

মান্নান মাওলানা বললেন, হ এই হগল কাম আগে করন লাগবো।

এনামুল হাসিমুখে বলল, অইয়া যাইবো। চিন্তা কইরেন না। কাইল ঢাকা যামু আমি। গিয়া মার লগে কথা কমু। আম্মার লগে কথা তো অইয়া গেল। কহেক (কয়েক) দিনের মইদ্যে বাড়িডা আমার নামে রেস্টারি (রেজিষ্ট্রি) কইরা হালামু। তারপর মাডির কাম লাগাইয়া দিমু। বাড়ি আর হালট বান্দা অইলে বিল্ডিংয়ের কাম ধরুম। আইচ্ছা হোনেন মাওলানা সাব, ইট সিমিটি (সিমেন্ট) রড এইসব আনুম কেমতে? বাইষ্যাকাল অইলে তো নৌকায় কইরা আনন যাইতো।

অহন আনবা টেরাকে।

টেরাক আইবো?

আইবো না ক্যা? ছিন্নগর তরি তত আহেঐ। আইজ রিকশা আইছে গেরামে। তোমার কাম কাইজ শুরু করতে মাস দেড়মাস লাগবো না।

হ তা তো লাগবোঐ।

হেতদিনে মেদিনীমণ্ডল তরি টেরাক আইয়া পড়বো।

তয় তো কোনও চিন্তা নাই। টেরাক ভইরা মাল পাডামু। সামনের বাইষ্যার আগেঐ মজজিদ অইয়া যাইব।

একটু থেমে এনামুল বলল, সবমিল্লা কত টেকা লাগতে পারে মাওলানা সাব কইলেন না?

চাইর পাঁচলাক টেকা।

 হ আমিও এমনুঐ আন্তাজ করছি। পাঁচলাক টেকা আমি খরচা করুম।

এত সহজে এতদিনকার স্বপ্ন সত্য হবে ভাবেননি মান্নান মাওলানা। উত্তেজনায় ফেটে পড়তে চাইছিলেন তিনি। তবু কায়দা করে চেপে রাখছিলেন উত্তেজনা। এখন সবকিছু একেবারে পাকা হয়ে যাওয়ার পর ধীর শান্ত গলায় বললেন, আমার যে আরেকখান কথা আছে।

এনামুল হাসল। কন। যা কথা আছে কইয়া হালান।

মজজিদের ইমাম হমু আমি।

হইবেন। আমার আপিত্তি নাই। আপনে যহন আছেন অন্য ইমাম আনুম ক্যা? অন্যরে যেই মায়না দিমু আপনেও ঐডাই নিবেন।

অনেকক্ষণ পর এই প্রথম কথা বললেন দেলোয়ারা। মাওলানা সাবে তো বলে। মায়না নিবো না!

একথা শুনে বেশ একটা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন মান্নান মাওলানা। বেতনের কথা শুনে আনন্দিত হয়েছিলেন। মসজিদের ইমামতি পাওয়া মানে গ্রামের মাতব্বরি সর্দারি সব পাওয়া। বিচার সালিশের ভার সব পড়বে তার ওপর। তিনি যা বলবেন তাই হবে। সমাজে মসজিদের ইমামের বিরাট দাম। ইমাম সাহেবের কথার উপর দিয়া কেউ কোনও কথা বলে না। ইমাম সাহেব যা বলবে তাই হবে। ইমামের মিথ্যাও সত্যর চেয়ে জোরাল। এই ক্ষমতার লগে যদি মাসে মাসে পাওয়া যায় বেতন তাহলে তো সোনায় সোহাগা।

কিন্তু বেতনটা যে দেলোয়ারার কারণে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। এজন্য অবশ্য মান্নান মাওলানাই দায়ী। দেলোয়ারার কাছে মসজিদের কথা বলতে এসে বেতন না নেওয়ার কথা তিনি নিজ মুখেই বলেছিলেন! ইস আগ বাড়িয়ে কথা বলে নিজের কতবড় সর্বনাশ যে করে বসে আছেন মান্নান মাওলানা!

সর্বনাশের হাত থেকে তাকে বাঁচিয়ে দিল এনামুল। বলল, না না, মায়না নিবো না ক্যা? মায়না ছাড়া ইমাম আমি রাখুম ক্যা? লাক লাকটেকা খরচা কইরা মজজিদ বানাইতে পারুম আর ইমাম রাখুম মাগনা, এইডা অয় না। লেইজ্জ মায়না আপনে পাইবেন মাওলানা সাব, চিন্তা কইরেন না।

মান্নান মাওলানা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। মুখে অমায়িক হাসি ফুটল তাঁর। ঐডা লইয়া আমি চিন্তা করি না। আমি জানি তুমি আমারে ঠকাইবা না। তুমি মানুষ ঠকাও না। মানুষ ঠকাইলে এতঅল্প বন্ধে আল্লায় তোমারে এতটেকা দিতো না।

মান্নান মাওলানার কথা শুনে মুগ্ধ হল এনামুল। সে আর কোনও কথা বলল না। খোলা দরজা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল।

বাইরে তখন শীতের বিকাল প্রায় শেষ। গাছপালার মাথায় জমতে শুরু করেছে। কুয়াশা। ঘরের ভিতর কুয়াশার মতো করে জমছে অন্ধকার। হঠাত্র যেন এই পরিবেশটা খেয়াল করলেন মান্নান মাওলানা। ব্যস্তভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালেন। তয় যাই অহন। নমজের সমায় অইয়া গেল।

এনামুল বল, আইচ্ছা যান। ফাইনাল কথা তো অইয়া গেল। দশ পোনরো দিনের মইদ্যে আমি আবার বাইত্তে আইতাছি। আইয়া মাডির কাম শুরু কইরা দিমু। আপনে ধইরা নেন মজজিদ আপনের অইয়া গেছে।

হেইডা আমি জানি।

তয় আমারে আপনে দোয়া কইরেন। কামডা যেন ঠিকঠাক মতন করতে পারি।

গদগদ ভঙ্গিতে এনামুলের মাথায় হাত রাখলেন মান্নান মাওলানা। খালি দোয়া করুমনি তোমারে! জান পরাণ দিয়া দোয়া করুম। ধর্মের কতবড় একখান কাম যে তুমি করলা, আখেরের কতবড় কাম যে করলা এইডা অহন বোজবা না। এইডা বোজ পরে।

মান্নান মাওলানা বেরিয়ে গেলেন। দেলোয়ারাও উঠলেন। দেখে এনামুল বলল, আপনে উঠলেন ক্যা আম্মা?

সন্ধ্যা অইয়া গেছে। হারিকেন ধরাই।

রাবিরে কন, রাবি ধরাইবো নে। আপনে বহেন।

দেলোয়ারা বসলেন। বসে রাবিকে ডাকলেন। ঐ রাবি, হারিকেন ধরা।

রান্নাঘরের দিক থেকে সাড়া দিল রাবি। ধরাইতাছি।

এবার এনামুল একটু লড়েচেড়ে বসল। দেলোয়ারার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, কী কন আম্মা, মজজিদের কাম তাইলে শুরু কইরা দেই।

দেলোয়ারা অমায়িক গলায় বললেন, দেও।

তার আগে অন্য কামডি যে করতে হয়।

কী কাম?

ছাড়াবাড়ি রেস্টারি।

কইরা হালাও।

আপনে তাইলে আমার লগে ঢাকা লন। মার লগে কথা কইয়া বাড়ি আমার নামে রেস্টারি কইরা দেন। দামের টেকা লগে লগেঐ দিয়া দিমুনে। দিয়া ব্যাংকে একাউন্ট কইরা দিমুনে। টেকা ব্যাংকে রাইক্কা দিয়েন।

দেলোয়ারা নরম গলায় বললেন, তুমি যা ভাল বোজো করো।

এনামুল বলল, বাড়ির দলিল পরচা কো?

তোমার মার কাছে।

তাইলে ঠিক আছে। কাইল আপনে আমার লগে লন।

লও।

অনেকক্ষণ পর এবার কথা বলল মোতালেব। হ যান বুজি। ভালকামে দেরি করন ঠিক না।

একটু থামল মোতালেব। তারপর এনামুলের মুখের দিকে তাকাল। তোমারে একখান কথা কইতে চাই মামু।

এনামুল ভুরু কুঁচকে বলল, কী?

এতবড় একখান কাম করতাছো তুমি, দেশ গেরামে কত নাম অইবো তোমার। আল্লায় টেকা দিচ্ছে তোমারে, হেই টেকা তুমি আল্লার কামে লাগাইতাছো। তয় আমরা কিছু আশা করতে পারি না তোমার কাছে? আমরা তো পর না! তোমগো আপনা মানুষঐ। আপনা মানুষগো ইট্টু দেবা না?

মুখ তুলে মোতালেবের দিকে তাকাল এনামুল। কথাডা বোজতে পারলাম না। খোলসা কইরা কন।

মোতালেব হাত কচলাতে কচলাতে বলল, মজজিদ বানাইবা, কত কাম মজজিদের! মাইট্টাল দিয়া মাডি কাইট্টা বাড়ি বানবা, হালট বানবা। বড় সড়কে আইয়া টেরাক থামবো, টেরাক থিকা ইটা নামান লাগবো, রড সিমিট নামান লাগবো। তারবাদে বাড়ি তড়ি আনন লাগবো। এই হগল কামের দেখভালের লেইগা একজন মানুষ লাগবো না?

মোতালেবের উদ্দেশ্য ততক্ষণে বুঝে ফেলেছে এনামুল। বুঝেও না বোঝার ভান করল। সরল গলায় বলল, হ তা তো লাগবোঐ।

ঐ কামডা আমারে দেও। দরকার অইলে কনটাক দিয়া দেও। বেবাক কাম ঠিক মতন কইরা দেই। তোমার কোনও চিন্তা থাকবো না।

এনামুল কথা বলবার আগেই দেলোয়ারা গম্ভীর গলায় বললেন, না তরে কোনও কাম দেওন যাইবো না।

মোতালেব থতমত খেল। ক্যা?

 তুই আইজ কাইল বহুত বড় বড়কথা কচ।

কবে আপনের লগে বড়কথা কইলাম আমি?

হারিকেন হাতে রাবি এসে দাঁড়াল ভিতর দিককার দরজার সামনে। তার পিছনে বাদলা। হারিকেনটা দুই কামরার মাঝামাঝি মাটিতে রাখল রাবি। ঘরের ভিতর জমে ওঠা অন্ধকার হারিকেনের আলোয় কেটে গেল।

রাবি এবং বাদলার দিকে একবার তাকালেন দেলোয়ারা, তারপর বললেন, কয়দিন আগে বাদলারে তুই মারছস। আমি হেই কথা জিগাইছি দেইক্কা আমার লগে কুইদ্দা (রেগে ওঠা অর্থে) উঠছস। এনামুলের কথা কওনের লগে লগে কইছস আমি তরে এনামুলের ডর দেহাইনি!

বাদলার গায়ে হাত তোলার কথা উঠেছে দেখে রাবি ভাবল এই তো সুযোগ। এই সুযোগে এনামুল মামার সামনে মোতালেবকে যতটা নাকাল করা যায় করবে সে।

দেলোয়ারার দিকে তাকিয়ে রাবি বলল, বুজি, আসল কথাডিই তো কইতাছেন না আপনে। হেয় যে বাদলারে কইছিলো আমগো তো বাইত থিকা উড়াইয়া দিবোঐ দরকার অইলে আপনেরে শুদ্দা উডাইয়া দিবো।

একথা শুনে মুখ চুন হয়ে গেল মোতালেবের। কোনও রকমে সে বলল, না এই কথা আমি কই নাই। কীরে বাদলা, কইছি?

বাদলা বলল, হ কইছেন।

বাদলাও যে এরকম সাক্ষী দিবে ভাবেনি মোতালেব। সে একেবারে বেকুব হয়ে গেল। মুখে আর কথা জুটল না।

এনামুল ততক্ষণে বেশ রেগেছে। রাগলে নাকের পাটা ফুলে যায় তার। এখনও ফুলল। গম্ভীর গলায় বলল, আমি আগেও দুই চাইরবার হুনছি আমগো ঘরে যারা থাকে তাগ লগে খারাপ ব্যবহার করেন আপনে। উল্টাপাল্টা কথা কন। আমার মা খালারেও বলে বকাবকি করেন। এত সাহস আপনে পান কই? আমরা কি আপনের হাতের ফাঁক দিয়া পইড়া যাই? বিপদে পড়লে তো পয়লা দৌড়াইয়া যান ঢাকায়, আমগো বাসায়। টেকা দিয়া সাহাইয্য করলে আপনেরে আমিঐ করি। মাইয়ার চিকিৎসা করাইবেন কইয়া তিন চাইর মাস আগেও তো পাঁচ হাজার টেকা আনছেন আমার কাছ থিকা।

একথা শুনে ঝট করে এনামুলের দিকে তাকালেন দেলোয়ারা। কও কী? পাঁচ হাজার টেকা আনছে? কবে আনলো? তুমি দিহি আমারে কিছু কইলা না?

কই নাই এমতেঐ। মাইনষের উপকার কইরা সেই কথা না কওনঐ ভাল।

মাইয়ার চিকিৎসা কইলাম ও করায় নাই।

তাইলে কী করতাছে টেকা আইন্না?

রাবি বলল, কী আর করবো? খাইছে। পরের টেকা বইয়া বইয়া খাইতে তো বহুত মজা।

মোতালেব তখন মাথা নিচু করে বসে আছে। যেন কারও দিকে তাকাবার মুখ আর নাই তার।

দেলোয়ারা আবার মোতালেবের দিকে তাকালেন। এত কিছুর পরও আমগো লগে এত বড় বড়কথা কেমতে কচ তুই! আরে তর তো থাকনের কাম আমগো চাকর বাকরের লাহান।

এনামুল শ্লেষের গলায় বলল, কাম কাইজ যা চায় তাও তো চাকর বাকরের কাম। কামলার কাম।

তারপর মোতালেবের দিকে তাকিয়ে বলল, ঐ মিয়া আমগো বাড়ির কামের মাইনষের লগে এত বড় বড়কথা কইয়া আমগো কাছে কাম চাইতে আহেন, সাহাইয্য চাইতে আহেন, শরম করে না আপনের? তহন বড়কথা থাকে কই?

মোতালেব মাথা তুলল না, কথা বলল না।

এনামুল বলল, মজজিদের কাম কয়দিনের মইদ্যে শুরু করুম আমি। কনটাক। আপনেরে দিমু না। ঐ আশা কইরা লাভ নাই। লেবারগ সর্দারিডা ইচ্ছা করলে আপনেরে আমি দিতে পারি। রোজ দরে পয়সা পাইবেন। তয় হেইডাও ফাইনাল না। মাওলানা সাবের লগে কথা কইয়া লই। দেহি হেয় কী কয়।

এবার মুখ তুলল মোতালেব। কাতর গলায় বলল, তুমি কইলে আমি গিয়া মাওলানা সাবরে ধরি।

না আপনের ধরনের কাম নাই। তয় আমার মনে অয় লেবার সর্দারিও আপনে পাইবেন না। মাওলানা সাবে না করবো। এই হগল তদারকি হেয় নিজেঐ করবো।

মোতালেব বুঝে গেল নানা রকম কায়দায় অপমান যা করার করা হয়েছে তাকে। কাজের লোভের মুলাটা নাকের আগায় ঝুলিয়ে দিয়েও সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। মসজিদের কাজে তার আর কোনও আশা নাই।

ব্যাজার মুখ করে উঠে দাঁড়াল সে। কারও দিকে না তাকিয়ে দুয়ারের দিকে পা বাড়াল।

এনামুল বলল, যান গা নি?

হ। কী করুম আর।

কামডা পাইলে কি এমতে যাইতেন গা?

মোতালেব কথা বলল না।

এনামুল বলল, ধরেন লেবার সর্দারির কাম আপনেরে আমি দিয়া দিলাম।

লগে লগে মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল মোতালেবের। তুমি তো ইচ্ছা করলে দিতে পারোঐ। মাওলানা সাবরে লাগেনি!

না তা লাগে না। কাম আমার, টেকা আমার। আমার যারে ইচ্ছা তারে আমি দিমু। আপনেরে দিয়া দিলাম।

আলহামদুলিল্লাহ।

তয় আমার কহেকখান কথা আপনের মাইন্না চলতে অইবো।

চলুম।

আমার মা খালার সামনে, আমগো বাইত্তে যারা থাকে, মতলা রাবি বাদলা অগো সামনে সিনা টান কইরা হাঁটতে পারবেন না। এমুনভাবে হাটবেন, মালিকের সামনে চাকররা যেমতে হাটে। কথা কইবেন এমুনভাবে, আপনের গলার আওজে য্যান বুজা যায়, অরা মালিক আর আপনে অইলেন চাকর। কোনও রকমের হামতাম (আস্ফালন) করলে লেবার সর্দারি আপনের থাকবো না। ঠিক আছে

মোতালেব বিনীত গলায় বলল, ঠিক আছে।

তয় যান অহন।

মোতালেব মাথা নিচু করে বেরিয়ে গেল।

মোতালেব বেরিয়ে যেতেই দেলোয়ারার দিকে তাকিয়ে হাসল এনামুল। কী কন আম্মা! উচিত শিক্ষা দিছি না?

দেলোয়ারাও হাসলেন। হ একদম উচিত শিক্ষা দিছো বাজান। জিন্দেগানিতে আর বড়কথা কইতে পারবো না।

রাবি বলল, কথা যাঐ কইছেন না কইছেন, কামডা তো ঠিকঐ দিলেন মামা!

১.৫১

দুইপা তুলে বেশ গুছিয়ে পালঙ্কের মাথার দিকটায় ঢেলান দিয়ে বসলেন দেলোয়ারা। চোখ থেকে চশমা খুলে শাড়ির আঁচলে মুছতে মুছতে বললেন, সমবাত (সংবাদ) না দিয়াঐ যে বাইত্তে আইলা!

পালঙ্কের মাঝামাঝি জায়গায় একখান ছপ (মাদুর) বিছানো হয়েছে। সেই ছপে আসাম (আসনপিঁড়ি) করে বসে ভাত খাচ্ছে এনামুল। তার পরনে এখন আকাশি রঙের চেক লুঙ্গি আর সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি। গলায় মোটা সোনার চেন আছে। চেনের মাথায় সিকির মতো একখান লকেট। মাথা ঝুঁকিয়ে ভাতের লোকমা যখন মুখে তুলছে এনামুল, গলার চেন আর লকেট এসে পড়ছে পাতের ওপর। এক ফাঁকে চেনটা স্যান্ডো গেঞ্জির বুকের কাছে ঢুকিয়ে দিল এনামুল, দেলোয়ারার দিকে তাকাল। মুখভর্তি ভাত চাবাতে চাবাতে জড়ান গলায় বলল, সমবাত দিয়া সব সময় আহন যায়নি? আথকা আইয়া পড়নঐ ভাল।

চশমা মোছা শেষ করে চোখে পরলেন দেলোয়ারা। নিজেগ বাইত্তে সমবাত না দিয়া আইলেও অয়। তয় অসুবিদা খালি একখানঐ, খাওন দাওনের। আগে সমবাত পাইলে বাজার হাট করাইয়া রাখন যায়। দেহো তো কী দিয়া কী খাইতাছে আইজ!

এনামুল আরেক লোমা ভাত মুখে দিল। ভালঐ তো খাইতাছি। এত বড় বড় দুইডা কইমাছ, দুইডা হাসের আন্ডা, ডাইল দুদ, খারাপ কী!

এনামুলের সামনে সাজিয়ে রাখা ভাতের গামলা, তরকারির বাটি, ডাল আর দুধের বাটির দিকে একবার তাকালেন দেলোয়ারা। বললেন, আগে জানলে মাওয়ার বাজার থিকা বড় একখান ইলশা মাছ আনাইতাম। এক দেশসের দুদ আনাইতাম।

ইলশা মাছের থিকা কইমাছ অনেক ভাল। শীতকাইল্লা কই খাইতে খুব স্বাদ। এই দিনে বুকটা লাল টকটইক্কা অইয়া যায় কইমাছের। শইলভর্তি তেল। আর জোয়াইরা দিনের কই অইলো খারাপ। মুখে দেওন যায় না। পেটভর্তি আন্ডা। শইলডা যায় লাম্বা হইয়া, মাথাডা যায় বড় অইয়া, খাইতে লাগে টাকি মাছের লাহান।

একটা কই খাওয়া শেষ করেছে এনামুল। এখন বাটি উপুড় করে বাকি কইটাও নিল। প্রচুর তেল মশলা দিয়ে, প্রচুর পিয়াজ দিয়ে ভুনা করা হয়েছে কই। মাছটা পাতে নেওয়ার পর বাটির গায়ে লেগে থাকা ঝোল আঙুল দিয়ে কেচে প্লেটে নিল এনামুল। ভঙ্গি দেখে বোঝা যায় রান্না খুবই পছন্দ হয়েছে তার, আগ্রহ নিয়ে খাচ্ছে। যদিও প্রায় সব খাবারই সমান আগ্রহ নিয়েই খায় এনামুল। ছেলেবেলা থেকেই সে একটু পেটুক স্বভাবের। তবু আজকের এই খাবারের প্রতি তার এতটা আগ্রহ দেখে দেলোয়ারা খুশি হলেন। সরল গলায় বললেন, রান কেমুন অইছে?

আপনে রানছেন আম্মা?

না বাবা আমি রান্দি নাই। রানছে রাবি। আল্লায় বাচাইছে যে ছেমড়িডা আইজ বাড়া বানতে (ধানভানা। ঢেঁকি সংক্রান্ত কাজ) যায় নাই। গেলে আমি ঝামেলায় পড়তাম।

কই মাছটা এত বড়, এনামুলের প্লেট ভরে গেছে। ভাতও আছে বেশ খানিকটা, তবে ভাতের দিকে মন নাই তার। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কই মাছের পেটের দিকটা ভাঙছে আর মুখে দিচ্ছে। দেলোয়ারার দিকে তাকাচ্ছেও না, কথা টুকটাক বলছে। এখনও বলল। কী ঝামেলায় পড়তেন।

রান্দন বাড়নের কী করতাম?

ক্যা আপনের রান্দন রান্দেন নাই।

হেইডা তো রানছি। ঐ রান তুমি মুখে দিতে পারতা না। এক পোয়া চাউলের ভাত রান্দি আর ইট্টু ডাইল, ইট্টু দুদ। ঐ এক রানে দুফইরা খাওনও অয় রাইতের খাওনও অয়।

কিছু না থাকলে ঐডাঐ খাইতাম নে।

তারপর যেন হঠাৎ মনে পড়েছে এমন গলায় এনামুল বলল, ও আম্মা, এতবড় কই পাইলেন কই?

দেলোয়ারা হাসলেন। কইডি আমার না।

তয়?

রাবিগো।

অরা পাইলো কই?

বাদলকে কোলে নিয়ে রাবি দাঁড়িয়ে আছে পুব দিককার দুয়ারের সামনে। সেখান থেকে বলল, বাদলার বাপে ধরছেলো।

চোখ তুলে রাবির দিকে তাকাল এনামুল। কই থিকা?

বিলেরবাড়ির পুকর থিকা। বিলে কামলা দিতে গেছিলো, ফিরনের সমায় আইত্তাইয়া (হাতিয়ে) ধইরা আনছে।

হ বিলেরবাড়ির পুকঐরের কই বহুত বড় অয়।

বাদলা বলল, তিনডা ধরছিলো। একটা আমি খাইয়া হালাইছি।

বলেই হি হি করে হাসল। হাসিটা বেশ মজা লাগল এনামুলের। খেতে খেতে বাদলাকে সে বলল, কীরে ছেমড়া, মার কুলে উইট্টা রইছস ক্যা?

বাদলা কথা বলবার আগেই দেলোয়ারা বললেন, ছেমড়াডা এমনই। বেশি আল্লাইন্দা। মায় যহন বাড়া বানতে যায় তহন দেহগা (দেখ গিয়া) টই টই কইরা ঘোরতাছে। এক্কেরে ডাঙ্গর পোলাপানের লাহান। মায় বাইত্তে আইলো আর নান্নাবাচ্চা অইয়া গেল। কুলে উইঠা বইয়া থাকে।

রাবি হাসিমুখে বলল, না বুজি সব সমায় কুলে ওড়ে না। মানুষজন দেকলে ওডে। অহন উটছে মামারে দেইক্কা।

এনামুল আনমনা গলায় বলল, মামাডা আবার কেডা?

রাবি লাজুক গলায় বলল, ক্যা আপনে? আপনেরে আমি মামা কই জানেন না! আপনের মা খালারে যদি বুজি কই, আপনে তো তাইলে মামা!

বাদলা বলল, আর আমার অইলেন দাদা।

চোখ পাকিয়ে, কপট রাগে বাদলার দিকে তাকাল এনামুল। তোমার আর দাদা কওনের কাম নাই। কুল থিকা নামো।

দেলোয়ারা বললেন, হ ও আর নামছে। কতুক্ষণ পর দেইক্কোনে মার বুকের দুদ খাইতাছে।

একথা শুনে এনামুল মজা পেল, রাবি পেল লজ্জা। মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। মুখে লাজুক হাসি।

এসব কথার ফাঁকে ফাঁকে কই মাছটা খেয়ে শেষ করেছে এনামুল ভাত শেষ করেনি। কইয়ের কাটা একপাশে রেখে আঙুলের ডগায় ভাত নাড়াচাড়া করতাছে। দেলোয়ারা বললেন, আভা দুইডা খাও বাজান।

এনামুল ডিমের বাটির দিকে তাকাল। দুইডা খাইতে পারুম না আম্মা। একটা খাই।

খাও।

 এনামুল একটা ডিম নিল। ডিমও রাবি রানছে?

 হ। বেবাক রান্দনঐ রাবির।

এত তাড়াতাড়ি রানলো কেমতে?

ও কামের আছে। তুমি বাইত্তে আহনের লগে লগে রান্দনঘরে গিয়া হানছে। আমার কিছু কওন লাগে নাই, রান বাড়ন শেষ।

ডিম ভেঙে ভাতে মিশিয়ে বেশ পরিপাটি করে একটা লোকমা মুখে দিল এনামুল। মুখভর্তি ভাত, সেই অবস্থায়ই বলল, রান বাড়ন খুব ভাল শিখছে রাবি। আমগো বাড়ির মতন।

দেলোয়ারা বললেন, আগে এমুন রানতে পারতো না। আমি হিগাইছি। আগের রান্দন আছিলো চউরাগো রান। মুখে দেওন যাইতো না।

পারভীনের রান্দনও আগে মুখে দেওন যাইতো না।

ঐডা বউর দোষ না। বিয়ার আগে কোনওদিন রানছেনি? পারবো কেমতে।

অহন খুব ভাল রানে। মার কাছে শিখছে।

বুজির শইলডা কেমুন? ভাল আছে?

হ অহন ভালই। কয়দিন আগে বি চদরীরে (বদরুদ্দোজা চৌধুরী) দেহাইছি। এত বড় ডাক্তার চদরী সাবে, মারে দেইক্কা কইলো আরে কিছু হয় নাই আপনের। একদোম ভাল আছেন। সংসারের কাম কাইজ যত পারেন করবেন আর সকালে বিকালে যতক্ষণ পারেন হাটবেন। দুইডা না তিনডা অষইদ দিল। তার কথা মতন চলতাছে দেইক্কা মায় অহন একদোম ভাল। আপনে ইবার ঢাকা গেলে আপনেরেও দেহাইয়া আনুম।

দেলোয়ারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, হ দেহান ইট্টু লাগবো। বুকের মইদ্যে আইজ কাইল জানি কেমুন করে!

খাওয়া শেষ করে ঢক ঢক করে একগ্লাস পানি খেল এনামুল। দেখে হা হা করে উঠলেন দেলোয়ারা। দুদভাত খাইবা না?

না।

ক্যা?

খাজুরা মিডাই না অইলে দুদ ভাত খাওন যায় না।

খাজুরা মিডাই তো আছে। ঐ রাবি কারে (ঘরের চালার কাছাকাছি পাটাতন করা, কাঠের দোতলার উপরতলার মতো। দরকারি জিনিসপত্র রাখার জায়গা। কোথাও কোথাও আপারও বলে) ওট। মুড়ির জেরে দেক খাজুরা মিডাই আছে। লইয়ায়।

বাদলাকে কোল থেকে নামাল রাবি। বেতের ছোট্ট একখান সাজি (পাত্র) হাতে সিঁড়ি ভেঙে তরতর করে কারে উঠে গেল। একদলা গুড় নিয়ে নেমে এল। গুড়ের দলায় মুড়ি লেগে আছে দেখে দেলোয়ারা বললেন, কী লো রাবি, মিডাই গইল্লা গেছেনি?

রাবি বলল, হ। মুড়িডি ওদাইয়া (নরম হয়ে যাওয়া) গেছে। আরবচ্ছর যে মুড়ির জেরে মিডাই রাকলেন, মুড়িডি তো আর বদলান নাই।

হায় হায় মুড়ি বদলানের কথা তো আমার মনে আছিলো না।

এনামুল বলল, মিডাই গইল্লা গেছে কী অইছে। ঐ রাবি অন্য একখান পেলেট দে। এই পেলেটে তরকারি লাইগ্না রইছে, এই পেলেটে দুদভাত খাওন যাইবো না।

চটপটা হাতে অন্য একখান প্লেট দিল রাবি। একবার সেই প্লেটের দিকে তাকিয়ে আগের প্লেটটায় যত্ন করে হাত ধুয়ে ফেলল এনামুল। তারপর নতুন প্লেটে সামান্য ভাত নিল, বাটির দুধ অর্ধেকটা ঢালল, প্লেটের সামনে রাখা গুড়ের সাজি থেকে এক খামছা থকথকা গুড় নিল, নিয়ে নতুন করে খাওয়া শুরু করল।

এনামুলের দিকে তাকিয়ে একটু নড়েচড়ে বসলেন দেলোয়ারা। আবার চোখ থেকে চশমা খুললেন, শাড়ির আঁচলে কাঁচ মুছতে মুছতে বললেন, ইবার কী তুমি দুই একদিন থাকবা বাজান?

দুধভাত খেতে খেতে এনামুল বলল, হ থাকুম। কয়দিন আজাইর (বেকার) আছি।

ক্যা কনটেকদারি কাম নাই তোমার? কাপড়ের ব্যবসা চলতাছে না?

 চলতাছে, বেবাকঐ চলতাছে।

তয়?

তয় আগের থিকা ইট্টু কম চলতাছে। এর লেইগাঐ বাইত্তে আইলাম। মান্নান মাওলানা সাবে আমারে একখান পত্ৰ দিছিলো। তার বলে কী কথার কাম আছে আমার লগে!

হ আমারেও কইছিল তুমি বাইত্তে আইলে য্যান তারে খবর দেই।

দুধ ভাতের লগে এক কামড় গুড় মুখে দিয়ে এনামুল বলল, পত্রে মাওলানা সাবে আমারে লেকছিল আমার যুদি টাইম না থাকে তাইলে হেয়ঐ ঢাকা গিয়া আমার লগে দেহা করবো। আমার কাছে এমুন কী কাম পড়লো মাওলানা সাবের? আপনে কিছু জানেননি আম্মা?

চশমাটা চোখে পরে দেলোয়ারা বললেন, পুরা জানি না। তয় তার লগে একদিন কথা অইছিলো, কথা হুইন্না বোজলাম তোমারে দিয়া গেরামে একখান মজজিদ করাইতে চায়।

একথা শুনে খাওয়ার কথা যেন ভুলে গেল এনামুল। দেলোয়ারার মুখের দিকে তাকাল। মজজিদ করাইতে চায়? কোনহানে?

আমগ ছাড়া বাইত্তে।

কন কী?

দেলোয়ারা হাসলেন। হ আমার কাছে তো কইলো!

খানিক আনমনা হয়ে কী ভাবল এনামুল তারপর রাবির দিকে তাকিয়ে বলল, ঐ রাবি, আতাহারগ বাইত্তে যা তো। মাওলানা সাবরে ডাইক্কা লইয়ায়। আমার কথা কবি।

.

১.৫২

কোলাপাড়া বাজারের কাছাকাছি রিকশা থামাল রুস্তম। থামিয়ে লাফ দিয়ে রিকশা থেকে নামল। তছির দিকে তাকিয়ে অস্থির গলায় বলল, তুমি ইট্টু বহো। আমি খালি যামু আর আমু।

ঘোমটায় মুখ মাথা ঢেকে এখনও আগের মতোই বসে আছে তছি। কী রকম একটা ঘোরের মধ্যে যেন ছিল। রুস্তমের কথা শুনে ছটফট করে উঠল। দাঁতে কামড়ে রেখেছিল শাড়ির আঁচল, ছেড়ে দিয়ে বলল, কই আইলাম

আগের মতোই অস্থির গলায় রুস্তম বলল, কোলাপাড়া আইছি। এইডা কোলাপাড়া বাজার।

উঁকি মেরে বাজারের দিকটা দেখল তছি,। এত তাড়াতাড়ি কোলাপাড়া আইয়া পড়লাম? ও রিশকাআলা ভাই, রিশকা তো আপনের উড়াজাহাজের লাহান। চোক্কের নিমিষে মেদিনমোণ্ডল থন কোলাপাড়া আইয়া পড়লাম।

হ আমার রিশকা উড়াজাহাজঐ। তয় তুমি বহে আমি মুরলিভাজা কিন্না আনি।

আমিও আপনের লগে যামু।

ক্যা?

এইমিহি কোনওদিন আহিনাই। কোলাপাড়া গেরামডা কেমুন, বাজারডা কেমুন ইট্টু দেহি। ও রিশকাআলা ভাই, কাঁচারুগো (তামা পেতল কাঁচের জিনিসপত্র এবং এলুমিনিয়ামের ব্যবসা করেন যারা) বাড়ি কোনডি কন তো? কোলাপাড়ায় বলে বহুত কাঁচারু বাড়ি।

তছির কথায় রুস্তম একটু বিরক্ত হল তবে বিরক্তিটা প্রকাশ করল না। তছিকে বুঝতেও দিল না কিছু। ভিতরের অস্থিরতা ভিতরে চেপে হাসিমুখে নরম গলায় বলল, কাঁচাৰুগো বাড়ি তোমারে যাওনের সমায় দেহামুনে। কোলাপাড়া গেরামে কাঁচাৰুগো বাড়ি ছাড়া দেহনের কিছু নাই। আগে কইলে আহনের সমায়ঐ দেহাইতাম। খালপাড়ের লগে অনেক কাঁচাৰু বাড়ি আছে। পাডাতন করা ঘর, দোতালা ঘর। নতুন ঢেউটিনের বেডা ঝকঝক করে। কোনও কোনও ঘরের টিনে রঙ লাগাইন্না, জানলা কপাটে রঙ লাগাইন্না। যাওনের সমায় দেহামুনে।

তছি বাধুক শিশুর মতো বলল, আইচ্ছা দেহাইয়েন। তয় অহন খালি বাজার দেহান।

বাজার দেইক্কা কী করবা, আর বাজারে যাওন তোমার ঠিকও অইবো না।

ক্যা?

তোমগো গেরামের কোনও মাইনষে যুদি তোমারে এহেনে দেইক্কা হালায়?

কেমতে দেখবো? আমগো গেরামের কোনও মানুষ এই বাজারে আহে না। মাওয়ার বাজারে যায়, নাইলে যায় কাজির পাগলা বাজারে।

এই বাজারেও আহে। আমি দেকছি।

দেকতে পারেন। কেঐ মরলে কাফোনের কাপোড় কিনতে আহে। ছনু মামানি যেদিন মরলো হেদিন মেন্দাবাড়ির মোতালেইব্বা আইছিলো। আইজ তো আমগ গেরামের কেঐ মরে নাই। কেডা আইবো?

তছির কথা শুনে রুস্তম একটা ফাপরের মধ্যে পড়ে গেল। ভিতরে আগের অস্থিরতাটা আছেই। সে চাইছে একরকম, হতে যাচ্ছে অন্যরকম। এত কিছুর পরও যদি পরিকল্পনা মতো কাজ না হয় তাহলে কী লাভ হল এসব করে! তার লগে যদি বাজারে যায় তছি, তছির পরিচিত না হোক রুস্তমের পরিচিত কেউ না কেউ দেখবেই! কথা কিছু না কিছু উঠবেই। কেউ যদি জিজ্ঞাসা করে, কী রে রোসতইমা, লগে কেডা? কী জবাব দিবে রুস্তম! স্বভাব চরিত্রের কথা রুস্তমের এদিককার অনেকেই জানে। ভারি একটা প্যাঁচঘোচের মধ্যে রুস্তম পড়ে যাবে।

না তছিকে নিয়ে বাজারে সে কিছুতেই যাবে না।

হঠাৎ করে নিজেকে তারপর বদলে ফেলল রুস্তম। গভীর চিন্তার একখান ছায়া মুখে ফেলে বলল, আসলে এই হগল কোনও কামের কথা না। রিশকায় থিকা নামতে তোমারে ক্যান দিতাছি না, ক্যান বাজারে নিতে চাইতাছি না তার অন্য একধান কারণ আছে।

তছি উদ্বিগ্ন গলায় বলল, কী কারণ?

আমগ এইমিহি রিশকা চোর খুব বাইড়া গেছে।

কন কী?

হ। চোরডি খালি তালে থাকে কুনসুম কোন রিশকাআলা রিশকা রাইক্কা চোক্কের আঐল (আড়াল) অইলো। লগে লগে সিডে বইয়া রিশকা চালাইয়া দেয়। মাইনষে তো মনে করে যার রিশকা হেয়ঐ চালাইয়া যাইতাছে। কিছু কয় না। রিশকা যার চুরি অয় মাথায় বাড়ি পড়ে তার। পাছ ছয় হাজার টেকা দাম এহেকখান রিশকার। পুরা টেকাডা গলায় পাড়া দিয়া উসিল কইরা লয় মাহাজনে। এর লেইগা রিশকা থুইয়া কোনওহানে যাই না আমি।

যেন ব্যাপারটা খুবই ভাল ভাবে বুঝেছে তছি এমন গলায় বলল, ভাল করেন। রিশকা থুইয়া যাইবেন ক্যা?

এইত্তো বুজছো। তয় বহে, আমি মুরলিভাজা লইয়াহি।

তছি কাতর গলায় বলল, আমি যামু না?

শুনে হেসে ফেলল রুস্তম। অইছে কাম। আমি কই কী আর আমার সারিন্দায় (সারেঙ্গি) কয় কী! আরে রিশকা চুরি অওনের ডর আছে দেইক্কাইত্তো তোমারে বহাইয়া থুইয়া যাইতাছি। তুমি বইয়া রিশকাড়া পাহারা দেও, আমি আইতাছি।

এবার তছিও হাসল। বুজছি। যান আপনে। তয় তাড়াতাড়ি আইয়েন।

আইচ্ছা।

রুস্তম পা বাড়িয়েছে, তছি বলল, মুরলিডি দেইক্কা আইনেন। ওদাইন্না (ন্যাতানো) মুরলি আইনে না।

রুস্তম আবার বলল, আইচ্ছা।

.

১.৫৩

ছাই রঙের খাদায় ভাতের ফ্যান আর তরিতরকারির ছালবাকল নিয়ে মান্নান মাওলানার সীমানায় এসেছে ফিরোজা। গোয়াল ঘরের লগে মাটির ভিটির ওপর বসান জাবনা দেওয়ার গামলায় জিনিসগুলি ফেলে ফিরে যাবে, মান্নান মাওলানা তাকে দেখে ফেললো। দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষ করে মুখে একখান পান পুরেছেন তিনি। ছিলেন বড়ঘরের দুয়ারের সামনে, ফিরোজাকে দেখে পান চাবাতে চাবাতে গোয়ালঘরের দিকে এলেন। গরুর জাবর কাটার মত মুখখানা নাড়াতে নাড়াতে বললেন, সমবাত কী লো ফিরি।

খাদা কাত করে জিনিসগুলি মাত্র জাবনার গামলায় ফেলতে যাবে ফিরোজা, হাত থেমে গেল। মান্নান মাওলানাকে দেখলেই বুক ধুগৰুগ ধুগযুগ করতে থাকে, গলা শুকিয়ে আসে, হাত পা আড়ষ্ট হয়ে যায়। নড়াচড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে ফিরোজা। এখনও তেমন হল। বুকের কাছে খাদা ধরে দাঁড়িয়ে রইল সে। এক ফাঁকে বুকের আঁচল ভাল করে টেনে দিয়েছে। চোখ এখন মাটির দিকে। ভঙ্গি জড়সড়।

তাকিয়ে তাকিয়ে ফিরোজাকে দেখলেন মান্নান মাওলানা। তারপর বললেন, কথা কচ না ক্যা?

ফিরোজা তবু কোনও কথা বলল না, তবু নড়ল না।

মান্নান মাওলানা বললেন, আইচ্ছা ফ্যানডি হালা।

এবার নড়ল ফিরোজা। তবে মান্নান মাওলানার দিকে তাকাল না। খাদা কাত করে জিনিসগুলি জাবনার গামলায় ফেলল।

কাজ শেষ করবার পর এখানে আর দাঁড়িয়ে থাকবার কারণ নাই, যে রকম দ্রুত পায়ে এসেছিল সেইরকম পায়েই ফিরে যাওয়ার কথা ফিরোজার। এখনও কত কাজ বাকি রয়ে গেছে। ঘাটে গিয়ে গোসল করবে, ভিজা কাপড় রোদ দিবে উঠানের তারে, নানীকে খাওয়াবে, নিজে খাবে, তারপর যদি একটু আজার পাওয়া যায়। কিন্তু পা নড়াতে পারছে না ফিরোজা। মান্নান মাওলানা এসে সামনে দাঁড়াবার পর পা যেন মাটিতে গেঁথে গেছে। সেই পা টেনে তোলবার শক্তি নাই।

ফিরোজার মুখের দিকে তাকিয়ে পান চাবাতে চাবাতে মান্নান মাওলানা বললেন, মন্তার সমবাত কী লো?

ফিরোজা চোখ তুলে তাকাল না, কথার জবাবও দিল না।

 তিনি প্রশ্ন করেছেন অথচ সামনে দাঁড়ান মানুষ জবাব দিচ্ছে না এটা হতে পারে। এটা বরদাশত করবার মানুষ মান্নান মাওলানা নন। প্রথমেই প্রচণ্ড একখান ধমক দিবেন, তারপরও কথার জবাব না পেলে কোনওদিকে তাকাবেন না, কোনও কিছু খেয়াল করবেন না, গায়ে হাত তুলবেন।

তবে এখন তেমন কোনও অনুভূতি হল না মান্নান মাওলানার। একদমই রাগলেন তিনি। মুখখানা হাসি হাসি করে নরম গলায় বললেন, তুই আমারে এত ডরাচ ক্যা লো ছেমড়ি? আমি কি বাঘ ভাল্লুক যে তরে খাইয়া হালামু, নাকি তর লগে কোনওদিন রাগ করছি, তরে ধমক দিছি!

এবার পলকের জন্য মান্নান মাওলানার দিকে চোখ তুলে তাকাল ফিরোজা। তারপরই আগের মতো মাথা নিচু করল, কিন্তু কথা বলল না।

মান্নান মাওলানা বললেন, মন্তার সমবাত বেবাকঐ আমি জানি। দুই বউ লইয়া মোজে (মৌজে) আছে। এক রাইত এই বউর কাছে আরেক রাইত ঐ বউর কাছে। মাইনষে যা কউক আমি মনে করি কামডা মন্তা খারাপ করে নাই। ভাল করতাছে। মোসলমানের চাইরখান পইরযন্ত বিয়া জায়েজ।

বলেই চোখ মুখের অশ্লীল ভঙ্গি করলেন মান্নান মাওলানা। খিক করে একটু হাসলেন। জুয়ান মর্দ পুরুষ পোলাগো তিন চাইর বউ না অইলে কাম অয় না। একখান বউ থাকলে দুই তিনডা পোলাপান অওনের পর হেইডা যায় ভিজা কেথার লাহান লোতলোতা হইয়া। হেইডারে আর বউ মনে অয় না। তহন আরেকখান বিয়া করুন লাগে। দুইনম্বরডা যহন দুই তিনডা পোলাপান পয়দা কইরা আগেরডার লাহান অইয়া যায় তহন করতে হয় তিন নম্বরটা। এইভাবে চাইরখান জায়েজ।

আবার খি খি করে হাসলেন মান্নান মাওলানা। হোন ছেমড়ি, তুই তো ডাঙ্গর অইছস, দুইদিন বাদে বিয়া দিলে বচ্ছরও ঘোরতে দিবি না, পোলাপান পয়দা কইরা হালাবি, আমার কথা হুইন্না রাখ, কামে লাগবো। পুরুষ পোলাগো জুয়ানকি থাকে সইত্তর আশি বচ্ছর আর মাইয়া ছেইলাগ কুড়ি বহর। ডাকের কথা আছে, মাইয়া ছেইলারা কুড়িতে বুড়ি। আতাহারের মারে দেহচ না একদোম বুড়ি অইয়া গেছে। আর আমারে দেখ। অহনতরি কী জুয়ান! তর লাহান ছেমড়ির লগে বিয়া হইলে বচ্ছর বাদে পোলা অইবো।

মান্নান মাওলানার কথা শুনতে শুনতে ফিরোজার মনে হচ্ছিল সে যেন আর বেঁচে নাই, সে যেন মরে গেছে। এই ধরনের কথা সে জীবনেও শোনেনি, তাও বাপ দাদার বয়সী কোনও পুরুষ মানুষের কাছে। নাতনীর বয়সী মেয়েকে কেমন করে এসব কথা বলতে পারে একজন মানুষ! তাও যে মানুষ মাওলানা। পরহেজগার লোক।

মান্নান মাওলানা বললেন, হোন ছেমড়ি, তরে এই হগল কথা কওনের কারণ আছে। মাসে মাসে দোকানের কর্মচারি দিয়া মন্তার মারে টেকা পাডায় মন্তা। হেই বেডা দুই তিনদিন বাইত থাইক্কা বাজার হাট কইরা দিয়া যায়। মন্তার মায় বুড়ি তো আর দুইন্নাইদারি বোজে না অহন, বোজচ তুই। বেডা যে আহে, দুই তিনদিন যে থাকে বাইত্তে, তরা বলে একঘরে হোচ?

শেষ কথাটা এমনভাবে বললেন মান্নান মাওলান, ফিরোজা চমকে উঠল। নিজের অজান্তেই কথা বলে ফেলল। কে কইছে আপনেরে

আমি হুনছি।

কার কাছে হোনছেন?

হেইডা তরে কমু ক্যা? বাইত্তে কী কম মানুষ আছে! তিন শরিকের অউক আর যারঐ অউক বাড়ি তো আসলে আমার। এই বাড়ির কোনহানে কী হয় বেবাক আমি জানি।

তয় এইডা ঠিক জানেন না। যেই বেডারে মন্তাজ মামায় পাড়ায় হেই বেডার নাম মালেক। আমার বাপের বইশশা। আমি তারে মামা কই।

মান্নান মাওলানা আবার হাসলেন। বয়সের কথা কইচ না। এতক্ষুণ তো তরে আমি ঐ হগল বুজাইলাম।

তয় মালেক মামায় বড়ঘরে থাকে না। ঐ ঘরে থাকি আমি আর নানী। মামায় থাকে পুবের ঘরে।

চিরিক করে পানের পিক ফেললেন মান্নান মাওলানা। মুখখানা অমায়িক করে ফিরোজার দিকে তাকালেন। ঠিক আছে যা, তর কথা আমি বিশ্বাস করলাম।

তারপর একটু এগিয়ে গিয়ে ফিরোজা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার কাঁধে হাত দিলেন, দিয়ে খামচে ধরলেন। যেন ইচ্ছা করলেই হাতটা সরিয়ে দিতে না পারে ফিরোজা, দৌড় দিয়ে পালাতে না পারে।

মান্নান মাওলানা তারপর বললেন, তরে আমি বহুত ভাল জানি ফিরি। কেন জানি কইতে পারি না। তুই এই বাইত্তে আহনের পর থিকা, তর মুখখানা দেকলে আমার মায়া লাগে। মালেকরে লইয়া তর কথা আমি অনেকদিন আগেই হুনছি, তরে কিছু কই নাই এর লেইগাঐ। তুই অনাত এতিম মাইয়া। আমি পারি মালেকের লগে একখান বদলাম রটাইয়া তরে এই বাইত থিকা খেদাইয়া দিতে। দেই নাই। দিমুও না। ঐ যে তরে আমি ভাল জানি এর লেইগা। হোন, আজাইর পাইলে আমি তগ ঘরে যামু। তুই আমারে ইট্টু সেবা যত্ন করিস।

মান্নান মাওলানা তার কাঁধ খামছে ধরার পর থেকে ফিরোজা যেন আর ফিরোজা নাই, সে যেন মাটি হয়ে গেছে, মরা গাছ হয়ে গেছে। তার কোনও অনুভূতি নাই, জীবন মরণ বোধ নাই। ফ্যাল ফ্যাল করে মান্নান মাওলানার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল সে।

এ সময় বাদলার পিছু পিছু মান্নান মাওলানার বাড়িতে এসে উঠল রাবি।

দুইজন মানুষ যে বাড়িতে এসে উঠেছে মান্নান মাওলানা তা টেরই পেলেন না। ফিরোজার কাঁধ খামছে ধরে মুখে ওসব কথা তিনি বলছিলেন ঠিকই কিন্তু ভিতরে ভিতরে মশগুল হয়ে গিয়েছিলেন অন্য একটা ব্যাপারে। মুখের পান মুখে আছে, চাবানের কথা মনে নাই। শরীর ভরে গেছে অদ্ভুত এক পুলকে। মৃতের মতো অনুভূতিহীন চোখে ফিরোজা তাকিয়ে ছিল তার দিকে। সেই চোখে চোখ রেখে গদগদ কণ্ঠে গভীর কোনও আবেগের কথা বলতে যাবেন মান্নান মাওলানা তার আগেই লোকজন দেখে বাদলা তার স্বভাব মতন কাজটা করল। রাবির দিকে দুইহাত বাড়িয়ে বলল, কুলে লও মা।

বাদলার কথায় হিংস্র থাবা থেকে শিকার ফসকে যাওয়া জন্তুর মতো চোখ করে পিছন ফিরে তাকালেন মান্নান মাওলানা। এই ফাঁকে ফিরোজা যেন জান ফিরে পেল। ঝটকা মেরে মান্নান মাওলানার হাত কাঁধ থেকে নামিয়ে দিল, খাদা বুকের কাছে ধরে হন হন করে হেঁটে মন্তাজদের সীমানার দিকে চলে গেল।

ততক্ষণে বাদলাকে কোলে নিয়েছে রাবি। এই ফাকে ঘোমটাও দিয়েছে মাথায়। মান্নান মাওলানা ফিরে তাকাতেই বলল, মামায় আইছে বাইত্তে।

সাদা কালোয় মিশান বিছার মতো জোড়া ভুরু কুঁচকে, মুখখানা যতদূর সম্ভব বিকৃত করে খাই খাই করা গলায় মান্নান মাওলানা বললেন, মামাডা আবার কেডা?

প্রথমে ওইরকম হিংস্র চোখে তাকানো তারপর এমন মুখ করে কথা বলা, রাবি ভড়কে গেল। তার কাছে মান্নান মাওলানা রক্ত মাংসের তৈরি মানুষ না। মাটি দিয়ে নিশ্চয় এই রকম পরহেজগার বান্দা তৈরি করেননি আল্লাহতায়ালা। তৈরি করেছেন নূর দিয়ে। মান্নান মাওলানা তো আসলে ফেরেশতা। এই রকম একজন ফেরেশতা বদমাস মানুষদের মতো খাউ খাউ করতাছেন কেন? যুবতী মেয়েটার কাঁধে হাত দিয়েই বা কী করছিলেন তিনি!

রাবি একটা ঢোক গিলল। কাচুমাচু গলায় বলল, এনামুল মামায়।

এনামুল নামটা দোয়া দরুদের মতন কাজ দিল। চোখের পলকে চেহারা বদলে গেল মান্নান মাওলানার। চোখের হিংস্রতা কোথায় উধাও হল, কোথায় গেল মুখ বিকৃতি আর কুত্তার মতন খেউক্কানি! মুখ অমায়িক হয়ে গেল। গলার স্বর হল পুকুরের অনেক গভীরে লুকিয়ে থাকা কাদার মতো। হাসিমুখে মান্নান মাওলানা বললেন, কচ কী! এনামুল আইছে।

মাওলানা সাহেবের এই আচরণে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল রাবি। সেও হাসল। হ।

কুনসুম?

দুফইরা ভাত খাওনের আগে।

কেমতে আইছে। লনচে?

না। রিশকা কইরা।

রাবি কথা বলবার আগেই তার কোল থেকে বাদলা বলল, হ রিশকা কইরা আপনেগ বাড়ি ছাড়াইয়া হাজামবাড়ি মিহি আইয়া নামছে।

আমগো গেরামে তাইলে রিশকা আইয়া পড়ছে! বা বাবা বা।

তারপর আবার চিন্তিত হলেন মান্নান মাওলানা। ঢাকা থিকা রিশকা লইয়া বাইত্তে আইছে এনামুল! না, এইডা সম্ভব না। ছিন্নগর তরি গাড়ি লইয়াইছে তার বাদে লইছে রিশকা।

বয়স্ক লোকদের মতো মাথা নাড়িয়ে বাদলা বলল, হ। অমনেঐ আইছে।

এবার বাদলাকে একটা ধমক দিলেন মান্নান মাওলানা। ঐ বেডা, এত ডাঙ্গর অইছস অহনতরি মার কুলে উইঠা রইছস ক্যা?

রাবি বলল, হ হুজুর, বাদলা সব সময় খালি আমার কুলে উইট্টা থাকে। আপনে অরে ইট্টু ফুঁ দিয়া দেন।

তরে না আমি কইছিলাম, আহিচ আমার কাছে, পোলাডারে ঝাইড়া দিমুনে আর খাওনের লেইগা পানি পড়া দিমুনে। তুই তো আহচ ভাই।

কেমতে আমু! হারাদিন কাম থাকে।

পোলাডার ভালমন্দও কাম। এইডা করতে অইবো না?

হ করতে তো অইবোঐ।

আমি ঐদিন যে ঝাইড়া দিয়াইলাম তারবাদে মোতালেইব্বাগ ঐমিহি কইতর দেকতে যায়?

রাবি কথা বলবার আগেই বাদলা বলল, হ যাই।

মান্নান মাওলানা ভুরু কুঁচকালেন। কচ কী?

ছেলের দিকে তাকিয়ে তাকে একটা ধমক দিল রাবি। এই ছেমড়া মিছাকথা কচ ক্যা? ঐ দিনের পর থিকা তুই কি আর কইতর দেকতে যাচ? গেলে আমি জানতাম না। যহন বাইত্তে থাকি তহন তো দেকতামও!

বাদলা হাসল। আমি তো পলাইয়া পলাইয়া যাই। কেঐ দেহে না। চুপ্পে চুপ্পে মোতালেব নানাগো খোয়াড়ের সামনে খাড়ইয়া কইতর দেইক্কাহি। তোমারেও কই না।

মান্নান মাওলানা চিন্তিত গলায় বললেন, রাবি রে পোলাডা তর কমিনা। এই পোলায় বহুত ভোগাইবো তরে।

রাবি ভয়ার্ত গলায় বলল, তাইলে অহন কী করুম?

ভাল কইরা ঝাড়ন লাগবো অরে, তিনওক্ত পানি পড়া খাওয়ান লাগবো।

তাইলে আজ থিকাই ঝাড়েন, আইজ থিকাই পানি পড়া দেন।

ঐডা অইবো নে। তার আগে আরেকখান কথা ক আমারে। বাদলা বলে অহনতরি তর বুকের দুধ খায়?

একথায় লজ্জা পেল রাবি। মাথা নিচু করে বলল, হ।

এইডা তো সব্বনাইশা কথা। না না বুকে মুখ দিতে পারবো না পোলায়। দুধ ছাড়ান লাগবো।ইলে ফাড়া আছে পোলার কপালে।

রাবি ভয়ার্ত গলায় বলল, কেমতে ছাড়ামু?

মান্নান মাওলানা আশ্বাসের গলায় বললেন, ব্যবস্থা আছে। কইরা দিমুনে।

আইজঐ কইরা দেন।

আইজ মইবো না। সময় লাগবো। আমি যেদিন কমু ঐদিন আবি। বাদলারে লগে আনবি না। একলা আবি। ঝাড়ন লাগবো তরে, বাদলারে না।

রাবি চিন্তিত গলায় বলল, আমারে ঝাড়ন লাগবো ক্যা? ·

মান্নান মাওলানা হাসলেন। তর পোলার সামনে এই কথা কওন যাইবো না। পরে কমুনে।

আইচ্ছা।

অহন ক এনামুল কী কইছে।

এ কথায় রাবি চমকাল। হায় হায় আসল কথাঐত্তো ভুইল্লা গেছি। যেই কামে আইছি ঐ কামঐত্তো অহনতরি করি নাই। এনামুল মামায় আপনেরে যাইতে কইছে।

কুনসুম? অহনঐ?

না বিয়ালে।

বিয়ালে ক্যা? অহন কী করে?

দুফইরা ভাত খাইয়া লেপ মুড়া দিয়া যুমাইছে।

আইচ্ছা তাইলে বিয়ালেঐ যামুনে।ঐ  রাবি আমার পত্ৰডা এনামুল পাইছিলো?

 হ।

 তরে কইল কেডা?

এনামুল মামায় দেলরা বুজিরে কইতাছিল। আমি হুনছি।

মান্নান মাওলানা বেশ একটা ফুর্তির শব্দ করলেন। আমার পত্র পাইয়া যহন বাইত্তে আইছে এনামুল, তাইলে কাম অইয়া যাইবো।

রাবি কথা বলল না, বাদলা বিজ্ঞের মতো বলল, হ অইয়া যাইবো।

মান্নান মাওলানা ঘেটি ত্যাড়া করে বাদলার দিকে তাকালেন। ঐ বেডা, কী অইয়া যাইবো?

বাদলা হাসল। আপনের কাম।

আমার কী কাম তুই জানচ?

হ।

কী কাম ক তো?

আপনে একখান মজজিদ বানাইবেন।

মান্নান মাওলানা চমকে উঠলেন। তুই জানলি কেমতো

বাদলা না এবার কথা বলল রাবি। ভাত খাইতে বইয়া দেলরা বুজির লগে এই হগল প্যাচাইল পারতাছিল এনামুল মামায়। ও হোনছে।

মান্নান মাওলানা অতি উৎসাহের গলায় বললেন, তুই সামনে আছিলি না? কী প্যাচাইল পারছে আমারে ইট্টু ক তো।

ঐত্তো আপনে পত্র লেকছেন, মজজিদ বানাইতে চান এই হগল। এনামুল মামায় এর লেইগাঐ আপনেরে খবর দিছে।

মান্নান মাওলানার চোখ তখন কী এক আশায় চকচক করতাছে। খানিক আনমনা হয়ে কী ভাবলেন তিনি তারপর রাবির দিকে তাকিয়ে বললেন, ঠিক আছে তুই যা। আমি বিয়ালে আমুনে।

.

১.৫৪

সড়কের পাশে একটা ছাড়াবাড়ি। দুপুরের পর পর নিঝুম হয়ে আছে বাড়িটা। গাছপালা আর ঝোপঝাড়ের ছায়ায় বেশ একটা শীত শীত ভাব। ডালপালার ফাঁক ফোকর দিয়ে টুকরা টাকরা রোদ ছড়িয়ে পড়েছে গাছের তলায়, ঝোপঝাড়ের মাথায়। সেই রোদে শীত ভাব কমেনি। একটা ঝোপে অচেনা কিছু ফুল ফুটে আছে। বেশ ঝাঁঝাল গন্ধ। সেই গন্ধে বিভোর হয়ে আছে বাড়ি। কয়েকটা প্রজাপতি মাতাল হয়ে উড়ছে। জামগাছটার মগডালে বসে থেকে থেকে ডাকছে একটা ঘুঘু। ঘুঘুর ডাকে নিঝুম ভাব তো কাটেইনি আরও বেড়ে গেছে।

রিকশা নিয়ে এই বাড়িটার সামনে চলে এল রুস্তম। খানিক আগে কোলাপাড়া বাজার থেকে মুরলিভাজা কিনেছে। কিনে ঠোঙাটা দিয়েছে তছির হাতে। যেন হাতে চাঁদ পেয়েছে এমন ভঙ্গিতে মুরলির ঠোঙা তছি বুকে চেপে ধরেছে। আনন্দ আহল্লাদে বিগলিত হয়ে বলেছে, অহনঐ খামু রিশকাআলা ভাই?

রুস্তম হেসেছে। না ইট্টু পরে খাও।

ক্যা?

রাস্তাঘাডে খাওন ভাল না।

তয় কই গিয়া খামু?

লও অন্য একখান জাগায় যাই। ওহেনে গিয়া নিরালায় বইয়া দুইজনে মিল্লা সুখ দুর্কের কথা কমুনে আর মুরলিভাজা খামুনে।

বাইত্তে যাইতে তাইলে দেরি অইয়া যাইবো না আমার?

না, কীয়ের দেরি অইবো? রিশকা কইরা আমি তোমারে দিয়ামু না? এহেন থিকা রিশকা ছাড়ুম, চোঙ্কের নিমিষে তোমগো গেরামে যামু গা।

তয় লন।

রুস্তম তারপর রিকশায় চড়েছে। হাওয়ার বেগে রিকশা চালিয়ে এসেছে ছাড়াবাড়িটার সামনে।

তছির তখন আর মন মানছে না, মন চলে গেছে আঁচলের তলায়। কতক্ষণে আঁচল তুলবে সে, মুরলির ঠোঙায় হাত দিবে। মনে মনে ততক্ষণে আরেকটা পরিকল্পনাও করে ফেলেছে সে। এখনকার মুরলিটা রুস্তমই খাওয়াচ্ছে, ওইদিকে এনামুল দাদার দেওয়া টাকা দশটা পুরা রয়ে গেল। এটা একটা বিরাট লাভ। কাল থেকে রোজ সকালে সীতারামপুরের খালের ঘাটে যাবে সে। ওখানকার মুদি দোকান থেকে এক টাকার করে মুরলিভাজা কিনে খাবে। এক টাকার করে রোজ খেলে দশ টাকায় দশদিন। একটানা দশদিন খেলে মুরলিভাজা খাওয়ার লোভটা কমবে।

এসব চিন্তা ছিল বলে কোথায় এসে রিকশা থামাল রুস্তম তছি খেয়াল করল না।

রুস্তম তখল চঞ্চল চোখে চারদিক তাকাচ্ছে। তাকিয়ে নিচু গলায় বলল, নামো।

তছি লাফ দিয়ে রিকশা থেকে নামল। আঁচলে প্যাচিয়ে দুইহাতে যক্ষের ধনের। মতো ধরে রেখেছে মুরলির ঠোঙা। কোনওদিকে খেয়াল নাই তার।

রুস্তম বলল, ঐ যে ফুলের ঝাড়টা দেকতাছো ঐডার আঐলে গিয়া বহো। আমি আইতাছি।

তছি কোনওদিকে তাকাল না, কিছু খেয়াল করল না, ভর পেট মুরলিভাজা খাওয়ার আনন্দ উত্তেজনায় বনফুলের ঝোপটার দিকে ছুটে গেল। ঝোপের আড়ালে বসেই আঁচলের তলা থেকে মুরলিভাজার ঠোঙা বের করল। কোনওদিকে তাকাল না, হামহাম করে খেতে লাগল। কোথায় বসে আছে সে, কেমন করে এখানে এল, কখন বাড়ি ফিরবে কোনও কিছুই মনে রইল না। এমন কী রুস্তমের কথাও। অচেনা মানুষটা যে মেদিনীমণ্ডল গ্রাম থেকে এতটা দূরে নিয়ে এসেছে তাকে, তছির দশ টাকার নোটখান ভাঙাতে দেয়নি, নিজের তফিলের (তহবিল) পয়সা খরচা করে কোলাপাড়া বাজার থেকে মুরলিভাজা কিনে দিয়েছে তাকে, এরকম নির্জন ছাড়াবাড়িতে নিয়ে এসেছে এসব এখন একেবারেই ভুলে গেছে তছি। তার মন ঢুকে গেছে মুরলির ঠোঙায়, মন পড়ে আছে মুরলি খাওয়ায়।

শীতকালের দুপুরে তখন লেগেছিল আশ্চর্য সমাহিত ভাব। গাছপালার আড়াল সরিয়ে গাঁদাফুলের পাপড়ির মতন রোদের টুকরা এসে পড়েছিল ছাড়াবাড়ির এখানে ওখানে। বনফুলের ঝোপের কাছটা তীব্র গন্ধে মাতোয়ারা। তছির মাথার ওপর, বনফুলের গা ঘেঁষে ওড়াউড়ি করতাছে কয়েকটা প্রজাপতি। ফুলের মধু খেতে এসেছে অজস্র মৌমাছি। মধু খেতে খেতে গুনগুন গুনগুন করে শব্দ করতাছে। তুলতুলে হাওয়া। মন্থর হয়ে আছে শীত আর ফুলের গন্ধে। জামগাছের মগডালে বসে ঘুঘুর ঘুঘ, ঘুঘুর ঘুগ শব্দে ডাকছে একটা রাজঘুঘু। গাবগাছটার অন্ধকার খোড়লে স্থির হয়ে আছে একটা আরজিনা (গিরিগিটি)। বনফুলের ঝোপ ছাড়িয়ে ভাঙনের দিকে খাল। খালের শীতল কোমল পানিতে শ্বাস ফেলতে উঠেছিল পানির তলার মাছ। আর দূরের কোনও নির্জন গ্রাম প্রান্তরের একাকী বৃক্ষের ছায়ায় বসে প্রাণখুলে ডাকছিল এক কোকিল। শীতকালেই বসন্তের ডাক ডাকতে শুরু করেছে। আশ্চর্য ব্যাপার, মুরলিভাজা খেতে খেতে কোকিলের ডাকটা পরিষ্কার শুনতে পেল তছি। কেন যে সে একটু আনমনা হল! কেন যে সে একটু কান খাড়া করল!

তখনই রুস্তম এসে বসল তার পাশে।

মাজার গামছা খুলে মাফলারের মতো গলায় প্যাঁচিয়েছে। চোখ মুখে কী রকম উত্তেজনা। আচরণে মাছের মতো চাঞ্চল্য। পাশে বসেই তছির খোলা কাঁধে হাত রাখল। জড়ান গলায় আস্তে করে করে বলল, মুরলিভাজা খাইতে কেমুন লাগে?

তছির মুখভর্তি মুরলি। তবু রুস্তম এসে পাশে বসার পর আরেক মুঠ মুরলি মুখে দিল। যেন যত দ্রুত সম্ভব খেয়ে শেষ করতে হবে এক ঠোঙা মুরলি। নয়তো রুস্তম যদি ভাগ বসায়।

মুরলি মুখেই তছি বলল, খুব ভাল।

কথাটা একেবারেই জড়িয়ে গেল তার। কিছুই বোঝা গেল না। অবশ্য তছির কথা বোঝ না বোঝায় রুস্তমের কিছু আসে যায় না। সে কি আর মুরলির চিন্তায় আছে। সে আছে অন্য চিন্তায়, অন্য উত্তেজনায়। তবু কোনও একটা কথা দিয়ে শুরু করতে হয় বলে কথাটা সে বলেছে।

রুস্তম যতটা নিচু গলায় কথা বলছে তছি যেন বলছে ততটাই উঁচু গলায়। মুখে মুরলিভাজা ছিল বলে কথা বোঝা যায়নি, শব্দটা বোঝা গেছে। সেই শব্দে চমকেছে রুস্তম। চঞ্চল চোখে চারদিক তাকিয়েছে। তারপর নিজের শরীর তছির পিঠে ঠেকিয়ে ফিসফিস করে বলেছে, আস্তে কথা কও, আস্তে।

মুরলি চাবাতে চাবাতে তছি নির্বিকার গলায় বলল, ক্যা?

কেঐ হুনবো।

হুনলে কী হইছে?

তছির পিঠের উপর দিকে নিজের মুখ একটুখানি ঘষে দিয়ে রুস্তম বলল, হুনলে মন্দ কইবো?

ক্যা আমরা কী মন্দ কথা কইছি?

না।

তয়?

এমুন নিটাল জাগায় আমরা দুইজন মানুষ বইয়া রইছি দেকলে মাইনষে মনে করব অন্যকাম করতাছি।

কী কাম?

তুমি বোজ না?

না।

সত্যঐ বোজ না?

তয় কী মিছা? আমি আপনের লগে মিছাকথা কই?

না মিছাকথা কইবা ক্যা! বোজবা, আস্তে আস্তে বোজবা। বহো। মুরলিভাজা খাও। তয় আওজ কইরো না।

বলে মুখখানা গভীর আবেগে তছির পিঠের উপর দিকে, আগের জায়গায় ঘষতে লাগল রুস্তম। আর দুইহাতে হাতাতে লাগল তার দুইবাহু। প্রথম প্রথম ব্যাপারটা পাত্তা দিল না তছি। তারপরই ছটফট করে উঠল। উঁহুহু, এমুন কইরেন না রিশকাআলা ভাই।

আমার জানি কেমুন লাগে!

রুস্তম গুঙিয়ে গুঙিয়ে বলল, কেমুন লাগে?

শইল্লের পশম খাড়ইয়া যায়। ক্যাতকুতি (সুরসুরি) লাগে। উঁহু উঁহু। এমুন করতাছেন ক্যা আপনে? কী অইলো আপনের, এমুন করতাছেন ক্যা?

বোজ না ক্যান এমুন করি! বোজ না তুমি?

না বুজি না। আপনে আমার কাছ থিকা সরেন, সইরা বহেন। এমুন কইরেন না। মুরলিভাজা খাইতে দেন আমারে।

তছির কথা গ্রাহ্য করল না রুস্তম। তছির কাঁধে, পিঠে মুখ ঘষতে ঘষতে, তছির বাহুতে হাত বুলাতে বুলাতে, আকাতলির (বগল) দিকে হাত দিয়ে বেশ যত্নে, বেশ কায়দায় তার গা থেকে সরাতে লাগল কাপড়। শ্বাস প্রশ্বাস হঠাৎ জ্বর আসা রোগির মতন গরম। মুখে মৃদু গোঙানীর শব্দ। বুকের ভিতর অদ্ভুত উত্তেজনা। তলপেট ফেটে যেতে চাইছে যন্ত্রণায়। পিছন থেকে আস্তে ধীরে নিজের দুটি হাত তছির বুকের দিকে এগিয়ে দিল রুস্তম।

তখনই যা বোঝার বুঝে গেল তছি। ঠোঙায় তখনও রয়ে গেছে কিছু মুরলিভাজা। সেদিকে আর খেয়াল রইল না তার। সাপের ছোবল এড়াতে যেমন করে লাফিয়ে ওঠে সাবধানী পাখি ঠিক তেমন করে লাফ দিয়ে উঠল সে। দাঁতে দাঁত চেপে হিসহিস করে বলল, বুজছি। তোমার মতলব আমি বুজছি। তুমি তো মানুষ ভাল না! তুমি তো বদ! মুরলি খাওনের লোভ দেহাইয়া এর লেইগা ছাড়াবাইত্তে লইয়াছো আমারে

হিংস্র হাতে থাবা দিয়ে রুস্তমের গলার গামছাটা ধরল তছি। ধরে চোখের পলকে গিটঠু দিয়ে ফেলল। দুইহাতে দুইদিকে টেনে ধরল গামছার দুইমাথা। আগের মতোই দাঁতে দাঁত চেপে হিসহিস করে বলল, কীরে খানকি মাগির পোলা, কীরে ছিলানী মাগির পোলা, মা বইন নাই তর? এই হগল করতে অয় তর মার লগে কর, তর বইনের লগে কর। আমার লগে ক্যা?

রুস্তম এতটা কল্পনাও করেনি। প্রথমে সে হতভম্ব হল, তারপর গেল ভয় পেয়ে। শরীরের উত্তেজনা কোথায় উধাও হল! শুধু মনে হল যে রকম হিংস্র গলায় কথা বলছে তছি, শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে গলায় ফাঁস দিয়েছে গামছা, অবস্থাটা এরকম থাকবে না। এভাবে তাকে ধরে রেখে এখনই চিৎকার শুরু করবে সে। তোমরা কে কোনওহানে আছো, আউগগাও। রোস্তম রিশকাআলা আমার ইজ্জত নষ্ট করতে চায়। আর তছির সেই চিৎকার শুনে সড়ক পথে চলতে থাকা পথিকরা একজন দুইজন করে একত্রিত হবে। দল বেঁধে এগিয়ে আসবে ছাড়াবাড়ির বনফুলের ঝোপটার কাছে। তছির হাত থেকে ছাড়িয়ে নিবে রুস্তমকে। তারপর শুরু করবে মাইর। একেকজন একেক ভাষায় বকাবাজি করবে আর মারবে। কেউ কোকসা বরাবর লাথথির পর লাথি মারবে, কেউ মারবে নাকে মুখে ঘুষি। সেইসব ঘুষির কোনওটায় খাড়া হয়ে থাকা নাক যাবে চ্যাপটা হয়ে, দাঁতগুলি কদুবিচির মতন ছিটকে ছিটকে পড়বে এদিক ওদিক, জিভের অর্ধেকটা কেটে বউন্না গাছের বাকলার মতন খসে পড়বে। কারও কারও কিল ঘুষিতে ঠোঁট হবে ফালা ফালা, চোখের মণি গলে ভাঙা ডিমের মতন বেরিয়ে আসবে। কেউ হয়তো অতিরিক্ত ক্রোধে ভেঙে নেবে শক্ত কোনও গাছের ডাল। সেই ডাল দিয়ে বেছে বেছে বাড়ি মারবে হাত পায়ের জোড়ায়। জোড়াগুলি ভেঙে দিবে। অতিরিক্ত নৃশংস কোনও মানুষ হয়তো দুইখান থানইট জোগাড় করে আনবে। যে কর্মের উদ্দেশ্যে তছিকে সে এখানে নিয়ে এসেছে সেই কর্ম সমাধার অঙ্গ একটা থানইটের ওপর রেখে অন্য থানইট দিয়ে গিরস্ত বাড়ির বউঝিরা যেভাবে টাকিমাছ ভর্তা করে সেইভাবে ভর্তা করবে। গুহ্যদ্বার দিয়ে হাতের লাঠিও প্রবেশ করিয়ে দিতে পারে কেউ।

এরপর রুস্তম আর কিছু ভাবতে পারল না। দুইহাত মাফ চাওয়ার ভঙ্গিতে একত্র করে দিশাহারা গলায় তছিকে বুঝ দেওয়া, চেষ্টা করতে গেল। আমার ভুল অইয়া গেছে। মস্ত বড় ভুল হইয়া গেছে। তছি, ইন গো, বইন, তুমি আমারে মাপ কইরা দেও বইন। এমন ভুল জিন্দেগিতে আর করুম না। বইন কইলাম, তোমারে আমি বইন কইলাম, তুমি আমারে মাপ কইরা দেও। চিকইর দিও না বইন, মানুষজন ডাক দিও না। মানুষ ডাক দিলে আমার আর বাচন নাই। আমারে তারা মাইরা হালাইবো। বইন না, দরকার অইলে তোমারে আমি মা ডাকতাছি। মা, তছি মা, তুমি আমারে মাপ কইরা দেও মা।

আশ্চর্য ব্যাপার, রুস্তমের গলা দিয়ে শব্দ বের হল না। কথা বলতে গিয়েও রুস্তম দেখে কথা সে বলতে পারছে না। গলা বন্ধ হয়ে গেছে। বুকের ভিতর ফুরিয়ে আসছে দম। চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। জিবলাটাও থাকতে চাইছে না মুখের ভিতর, নিজের অজান্তেই অনেকখানি বের হয়ে আসছে। থুতনি ছাড়িয়ে নেমে গেছে। গামছার ফাঁস কঠিন থেকে কঠিন হয়ে আটকে গেছে গলায়।

রুস্তম তার তাগড়া জোয়ান শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে দুইহাতে টেনে ছাড়াতে চাইল গামছার ফাস। কোরবানী দেওয়া গরুর মতো দাপড়া দাপড়ি করতে লাগল। বিন্দুমাত্র আলগা করতে পারল না। কোরানী দেওয়ার সময় গরুর সর্বাঙ্গ যেমন চেপে ধরে আট দশজন তাগড়া জোয়ান পুরুষ, যতই দাপড়া দাপড়ি করুক লোকগুলিকে যেমন গা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিতে পারে না গরু, তছিকেও তেমন ঝেড়ে ফেলতে পারছে না রুস্তম। তছি যেন এখন আর কোনও নরম কোমল, ঢলঢল যৌবনের যুবতী মেয়ে না। তছি যেন এখন কোনও অবলা নারী না। তছি যেন এখন একাই আট দশজন তাগড়া জোয়ান পুরুষ। রুস্তম নামের গরুটাকে মাটিতে ফেলে জবাই করতাছে। রুস্তমের গলায় গিট দিয়ে ধরা গামছা যেন ঝকঝকা ধারের গরু জবাই করার বিশাল ছুরি। সেই ছুরি দিয়ে পুচিয়ে পুচিয়ে রুস্তমকে যেন সে জবাই করতাছে।

রুস্তমের ধ্বস্তাধ্বস্তি আর তছির রাগ ক্রোধের হিসহিস শব্দে বনফুলের মাথার ওপর ওড়াউড়ি করতে থাকা প্রজাপতিগুলি ভয় পেয়ে অন্যদিকে উড়াল দিয়েছে। মধু খেতে আসা মৌমাছিরা বন্ধ করেছে গুনগুন শব্দ, পালাবার পথ খুঁজছে। আমগাছের আগডালে বসা রাজঘুঘুটা আচমকাই স্তব্ধ হয়েছে। গাবগাছের গোড়লের কাছে স্থির হয়ে থাকা আরজিনাটা লুকাতে ব্যস্ত হয়েছে অন্ধকার খোড়লে। বনফুলের গন্ধে মাতায়োরা হাওয়া হয়েছে আরও ধীর। দূর থেকে ভেসে আসা কোকিলের ডাক আর শোনা যায় না।

কতক্ষণ, কতক্ষণ এভাবে চলেছে কে জানে। হঠাৎ করেই যেন নিজের মধ্যে ফিরে এল তছি পাগলনি। একে একে সব মনে পড়ল তার। মুরলিভাজার ঠোঙাটা পড়ে আছে রুস্তমের পায়ের কাছে। ধ্বস্তাধ্বস্তির ফলে যে কয়টা মুরলি তখনও ছিল ঠোঙায় সেগুলি ছড়িয়ে পড়েছে এদিক ওদিক। গামছার ফাস তখনও শক্ত হাতে টেনে রেখেছে তছি। রুস্তমের কোনও সাড়া নাই। একবোরেই স্থির হয়ে আছে সে। ধ্বস্তাধ্বস্তি দূরের কথা, হাত পা ছোঁড়া দূরের কথা, লড়াচড়াও নাই তার। কুকরার আন্ডার মতন চোখ দুইটা বেরিয়ে, ভুরুর তলায়, নাকের বাঁকের কাছে এসে ঠেকে আছে। হাঁ করা মুখ থেকে জিভ বেরিয়েছে বিঘতখানেক। থুতনির তলায় বরকির দাঁড়ির মতো ঝুলছে। এসব দেখেও ক্রোধ যেন কমল না তছির। গামছার ফাসে হ্যাঁচকা একটা টান দিল, দিয়েই ছেড়ে দিল। নুনের বস্তার মতো একদিকে কাত হয়ে পড়ল রুস্তম।

তছির বুক তখন হাপরের মতন ওঠানামা করতাছে। ফোঁস ফোঁস ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস পড়ছে। গভীর ক্লান্তিতে ভেঙে আসতে চাইছে শরীর। ইচ্ছা করে রুস্তমের পাশে সেও লুটিয়ে পড়ে থাকে।

তছি তা করে না। ক্রোধ এখন অচেনা এক দুঃখে রূপ নিয়েছে। গভীর কষ্টের এক কান্নায় বুক ফেটে যেতে চাইছে, চোখ জ্বালা করতাছে। তবু শেষ ক্রোধটা রুস্তমের ওপর মিটাল সে। ডান পা তুলে প্রচণ্ড একখান লাথি মারল রুস্তমের মুখ বরাবর। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, মিটছে না, মনের খায়েশ মিটছে না তর?

তছির লাথথি খেয়ে রুস্তমের দেহ তখন গাছের গুঁড়ির মতো গড়িয়ে যাচ্ছে ভাঙনের দিকে। দেখতে দেখতে ঝপ করে গিয়ে পড়ল খালের পানিতে। সেই শব্দে কী হল তছির, বুকের কান্না, চোখের কান্না আর ধরে রাখতে পারল না সে। মুখে আঁচল চেপে গুঙিয়ে গুঙিয়ে কাঁদতে লাগল। কাঁদতে কাঁদতে বনফুলের ঝোপের আড়াল থেকে বেরুল। বেরিয়ে পাগলের মতো সড়ক বরাবর ছুটতে লাগল।

.

১.৫৫

গলার চেন হাতাতে হাতাতে এনামুল বলল, বলেন মাওলানা সাব, খবর কী?

মান্নান মাওলানা বসে আছেন হাতলআলা ভারী চেয়ারে। বিকাল হতে না হতেই শীতের কাপড় পরে বাড়ি থেকে বেরিয়েছেন। খয়েরি রঙের ফ্লানেলের পানজাবি। পানজাবির উপর নীল রঙের হাফহাতা সোয়েটার। গলায় জড়ান হলুদ রঙের মাফলার। পায়ে উলের সাদা মোজা আর খয়েরি রঙের পাম্পসু। এমনিতেই পেট মোটা মানুষ তার ওপর পরেছেন এতগুলি কাপড়, মান্নান মাওলানাকে দেখাচ্ছিল গাবগাছের গুঁড়ির মতন। তার ওপর কাপড় একেকটা একেক রঙের। কাপড়ের কারণে তাকে মনে হচ্ছিল সার্কাসের জোকার। বসে আছেন ঘরের ভিতর, দেলোয়ারদের বড়ঘরের উত্তর দিককার কামরায়, তবু যেন শীতে কাতর।

এনামুলের কথা শুনে একবার নাক টানলেন মান্নান মাওলানা আছে, খবর আছে। আমার পত্র পাও নাই তুমি?

হ পাইছি।

পত্রে তো খবর আমি কিছু লেকছিলাম।

হ লেকছেন। তয় তেমুন খোলসা কইরা কিছু লেকেন নাই। বাড়িতে আসনের পর আম্মায় আমারে কইছে।

কী কইছে?

আমারে দিয়া গেরামে একখান মজজিদ করাইতে চান।

মান্নান মাওলানা আবার নাক টানলেন।

এনামুলের পাশাপাশি চৌকিতে পা ঝুলিয়ে বসে আছেন দেলোয়ারা। খানিক আগে চোখ থেকে চশমা খুলে মুছে নিয়েছেন। মন দিয়ে এনামুল আর মান্নান মাওলানার কথা শুনছিলেন। মান্নান মাওলানাকে পরপর দুইবার নাক টানতে দেখে বললেন, ঠাণ্ডা লাগছেনি মাওলানা সাব?

হ বইন। ভাল ঠাণ্ডা লাগছে। আমার ইট্টু ঠাণ্ডার বাই আছে। শীতের দিনে ঘন ঘন লাগে।

রাবি দাঁড়িয়ে আছে ভিতর দিককার দরজার সামনে। বাদলা তার কোলে। বোধহয় কোল থেকে একটু পিছলে পড়েছিল, আঁকি (ঝাঁকুনি) দিয়ে রাবি তাকে জায়গা মতন উঠাল। বলল, কুনসুম ঠাণ্ডা লাগলো হুজুর? আমি যহন আপনেরে সমবাত দিতে গেলাম তহনও তো দেকলাম ভাল!

চোখ তুলে রাবির দিকে তাকালেন মান্নান মাওলানা। তহন লাগে নাই। লাগলো এই বাইত্তে আইতে আইতে।

কন কী? কেমতে?

খেতখোলার মাঝখান দিয়ে হাইট্টা আইলাম তো! মনে অয় এর লেইগাই লাগছে। শীতের দিনে খোলা জাগায় বাইর অইলেঐ ঠাণ্ডা লাগে আমার।

দেলোয়ারা বললো, চা খাইবেননি?

মান্নান মাওলানার মুখ উজ্জ্বল হল। খাইতে পারি।

দুদচা না আদাচা?

এনামুল বলল, আদাচাঐ দিতে কন। ঠাণ্ডার মইদ্যে আদাচা খাইলে আরাম পাইবো।

মান্নান মাওলানা বললো, হ এইডা ঠিক কথা।

দেলোয়ারা এনামুলের মুখের দিকে তাকাল। তুমিও ইট্টু খাইবানি বাজান?

এনামুল বলল, না। চা আমি খাই না।

 মান্নান মাওলানা বললেন, ক্যা?

চা খাইলে আমার শইল কইষ্যা (কষে) যায়।

তাইলে না খাওনঐ ভাল।

দেলোয়ারা বললেন, আদাচা খাইলে শইল আরও বেশি কষে।

তারপর রাবির দিকে তাকালেন তিনি। ঐ রাবি, মাওলানা সাবরে এককাপ আদাচা বানাইয়া দে।

দিতাছি।

বাদলাকে কোলে নিয়েই রান্নাঘরের দিকে চলে গেল রাবি।

এবার মান্নান মাওলানার দিকে তাকাল এনামুল। হঠাৎ আমারে দিয়া মজজিদ করাইতে চাইতাছেন ক্যান আপনে?

মান্নান মাওলানা একটু থতমত খেলেন। তবে পলকের জন্য। তারপরই নিজেকে সামলালেন। তুমি ছাড়া আমগো পাড়ায় আর টেকাআলা মানুষ কে আছে? কারে কমু?

যে সব লোকের টাকা আছে তাদের মধ্যে কাউকে কাউকে টাকাআলা বললে তারা খুশি হয়। এনামুল এই ধরনের লোক। মান্নান মাওলানার কথা শুনে ভিতরে ভিতরে খুবই খুশি হল সে। তবে মুখে তা প্রকাশ করল না। মুখটা হাসি হাসি করে বেশ একটা বিনয়ের ভাব ফোঁটাল। কী যে কন মাওলানা সাব! আমি আর কয় টেকার মালিক! আমারে কিনতে পারে এমন মানুষ ম্যালা আছে গেরামে।

গেরামে থাকতে পারে, আমগো পাড়ায় নাই।

আছে।

 কেডা কও তো!

ধরেন রাজা মিয়া।

রাজা মিয়ার টেকা আছে জানি। তয় তোমার লাহান না।

আরেকজন তো আপনের বাইত্তেঐ আছে। ম্যালা টেকার মালিক।

কেডা, কার কথা কইতাছো?

মন্তাজ।

হ মন্তাজের টেকা আছে। তয় যাই কও, তোমার লাহান না।

দেলোয়ারা বললেন, আপনেরই বা কম টেকা আছেনি।

মান্নান মাওলানা আকাশ থেকে পড়লেন। আমার টেকা! আমি টেকা পামু কই?

আপনের ছোডপোলা থাকে জাপানে। বাড়ির একখান পোলা জাপানে থাকলে আর কিছু লাগেনি? মাসে সব বাদ দিয়া কমপক্ষে লাকটেকা পাড়ায়। বচ্ছরে বারোলাক। চাইর পাঁচ বচ্ছর ধইরা আছে। আপনের আর লাগে কী!

মান্নান মাওলানা আবার নাক টানলেন। তুমি যা কইলা এইডা পুরাপুরি সত্য না। মাসে লাটেকা আজাহারে পাড়ায় না। অনেক কম পাড়ায়। মাসে কামাই করে লাক দেড়েক এইডা আমি বুজি। বহুত চালাক পোলা আজাহারে। বাড়িতে অল্প টেকা পাড়ায়, বাকি নিজের কাছে রাখে। আমার এই পোলাডা অন্যপদের। সহাজে কেরে বিশ্বাস করে না।

হোনলাম জাপানে বলে কেঐ আর থাকতে পারবো না। ঐ দেশের সরকার বলে ধইরা ধইরা বেবাকতেরে দেশে পাড়াইয়া দিবো!

কথাটা শুনে চমকালেন মান্নান মাওলানা। কার কাছে হোনলা?

 ফকির বাড়ির মালেকের বউয়ে কইলো। মালেকের এক পোলায় থাকে জাপানে।

হ, ইব্রাহিম। আজাহার ইব্রাহিম অরা একলগেই গেছিল। ইব্রাহিম পত্র লেকছেনি? পত্রে এই হগল কথা লেকছে?

হ। মালেকের বউয়ে তো কইল।

তাইলে কথা মিছা না।

মান্নান মাওলানা চিন্তিত চোখে খোলা দরজা দিয়ে বাইরে, আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

শীতের বিকাল দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে তখন। রোদ উঠে গেছে গাছপালার মাথায়। একটু পরেই আকাশ থেকে নামতে শুরু করবে কুয়াশা। চকমাঠ, গিরস্ত বাড়ির উঠান পালান ভরে যাবে কুয়াশায়। কুয়াশার উপর কুয়াশার মতো জমবে অন্ধকার। শন শন করে বইবে উত্তরের হাওয়া। পাটাপুতার মতো ভারী একখান রাত নামবে।

মান্নান মাওলানাকে চিন্তিত দেখে এনামুল গলা খাঁকারি দিল। আপনে এত চিন্তায় পড়লেন ক্যা মাওলানা সাব?

মান্নান মাওলানা মুখ ঘুরিয়ে এনামুলের দিকে তাকালো। চিন্তার কথা। আজাহাররে যুদি জাপান থিকা খেদাইয়া দেয় তাইলে বিপদে পইড়া যামু।

কীয়ের বিপদ?

এতবড় সংসার। বড় পোলার বিধবা বউ পোলাপান, আমি, আতাহার, আতাহারের মায়। এতডি মাইনষের সংসার চলবো কেমতে?

সংসার কি আজাহারের টেকায় চলেনি?

তয়!

ক্যা বিলে আপনের এত খেতখোলা, এত ইরি পান, এতডি গরু। আজাহারের টেকা না পাইলে কী! অভাব আছেনি আপনের!

মান্নান মাওলানা হাসলেন।

দেলোয়ারা বললেন, মাওলানা সাবে খালি গলা হুগায়।

এনামুল বলল, বাদ দেন এই হগল কথা। কামের কথা কন।

তখনই বড় একটা কাপে চা এনে মান্নান মাওলানার হাতে দিল রাবি।

দেলোয়ারা বললেন, বাদলা কো?

রাবি লাজুক গলায় বলল, রান্দনঘরে।

কী করে?

বাডিতে ইট্টু চা দিছি। ফুয়াইয়া ফুয়াইয়া খাইতাছে।

দেলোয়ারা একটু রাগলেন। এতটু পোলার চা খাওনের অব্বাস করিচ না।

রাবি কথা বলল না।

চায়ে চুমুক দিয়ে মান্নান মাওলানা বললেন, রাজা মিয়ার টেকা আছে, মন্তাজের টেকা আছে আমি জানি। তাগো দুইজনরে ধরলে দুইজনে টেকা দিয়া, দুইজনে মিল্লা মজজিদ একখান বানাইয়া দিবো। তাগো আমি ধরতে চাই না।

এনামুল বলল, ক্যা?

তারা মানুষ ভাল না। বারোপদের কথা কইবো।

কী কথা?

তারা তো এমতেঐ আমারে দেকতে পারে না। মনে করবো মজজিদ আমি অন্য মতলবে বানাইতাছি।

 মজজিদ আবার অন্য মতলবে বানায় কেমতে? মজজিদ অইলো আল্লার ঘর। মাইনষে নমজ (নামাজ) পড়বো। মজজিদের লগে মতলবের কোনও সমন্দ নাই।

এনামুলের কথা শুনে মান্নান মাওলানা মুগ্ধ হলেন। এইডা তুমি বোজো দেইক্কাঐ তোমারে ধরছি। অন্য কের কাছে যাই নাই।

বোজলাম। তয় খাইগো বাড়ির মজজিদ থাকতে একঐ গেরামে আরেকখান মজজিদ আপনে বানাইতে চাইতাছেন ক্যা?

এই প্রশ্নের উত্তর তৈরিই ছিল মান্নান মাওলানার। বললেন, খাইগো বাড়ির মজজিদটা আমগো পাড়া থিকা অনেক দূরে। অতদূরে গিয়া জামাত ধরন বহুত অসুবিদা। অনেক বুড়া মানুষ আছে এতাহানি হাইট্টা যাইতে পারে না। তাগো চিন্তা কইরা তোমারে ধরছি।

এনামুল কী চিন্তা করল তারপর বলল, ইগো বাড়ির মজজিদে মাইক আছে না?

আছে

আয়জান দিলে গেরামের বেবাকতে হোনে না?

হোনে।

নিয়ম আছে বলে এক মজজিদের আয়জান যতদূর পর্যন্ত হুনা যায় অতদূরের মইদ্যে আর কোনও মজজিদ করন যাইবো না?

কে কইছে তোমারে? আমি হুনছি।

বাজে কথা। ঢাকার টাউনে দেহো না এক মহল্লায় চাইর পাঁচখান কইরা মজজিদ। একলগে দশখান মজজিদের আয়জান হুনা যায়।

এইডার কারণ আছে।

কী কারণ?

ঢাকার টাউনে মানুষ বেশি। এক মহল্লায় যেই পরিমাণ মানুষ থাকে, একখান মজজিদে অত মানুষ নমজ পড়তে গেলে মজজিদে মানুষ আড়ে না। এর লেইগা মজজিদ বেশি। তারপরও জুমমার দিন কোনও কোনও মজজিদের সামনের রাস্তায়ও নমজ পড়তে খাড়ইয়া যায় মাইনষে।

এনামুলের কথা শুনে একটু যেন ফাপড়ে পড়লেন মান্নান মাওলানা। হাঁ করে এনামুলের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

এনামুল কী বুঝল কে জানে, বলল, ঠিক আছে আপনে যহন আইছেন আমার কাছে, মজজিদ করন ছোঁয়াবের কাম, কী রকম টেকা পয়সা লাগবো কন! চিন্তা কইরা দেখি।

মান্নান মাওলানার মুখ আবার উজ্জ্বল হল।

তখনই মোতালেব এসে ঢুকল এই ঘরে। এনামুলের দিকে তাকিয়ে খুবই ফুর্তির গলায় বলল, কুনসুম আইলা মামু?

মোতালেবকে পাত্তা দিল না এনামুল। অবজ্ঞার চোখে একবার তার দিকে তাকাল, তারপর খোলা দরজা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলল, দোফরে আইছি।

অবজ্ঞাটা মোতালেব বুঝল, বুঝেও গায়ে লাগাল না। লম্বা বেঞ্চটায় বসল। হাসিমুখে বলল, কেমতে আইলা? লনচে?

এনামুল আগের মতোই অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, না।

 তয়?

 গাড়ি লইয়াছি।

কোনতরি আইলা?

 ছিন্নগর তরি।

গাড়ি ছিন্নগরে রাকছ?

না।

তয়?

গায়ে পড়ে এত কথা বলা মোতালেবের পছন্দ করছিল না এনামুল। তবু একটা লোক কথা জিজ্ঞাসা করলে সে কথার জবাব না দিয়ে তো পারে না। তার ওপর লোকটা যদি হয় খুব কাছের আত্মীয়।

বিরক্তি চেপে এনামুল বলল, গাড়ি ফিরত পাডাই দিছি।

কই?

কই আবার? ঢাকা।

বিরক্তির ভাব এবার পরিষ্কার ফুটল এনামুলের গলায়। মোতালেব পাত্তা দিল না। বলল, তোমারে নামাইয়া দিয়া গাড়ি ঢাকা গেছে গা?

হ।

তয় ছিন্নগর থিকা আইলা কেমতে হাইট্টা?

রিকশায় আইছি।

ও তাইলে তুমিঐ আইছো রিকশা কইরা? গেরামে প্রথম রিকশা আইলো তোমারে লইয়া? ভাল, ভাল।

তারপর যেন মান্নান মাওলানার হাতে চায়ের কাপ দেখতে পেল মোতালেব। দেখে রাবির দিকে তাকাল। ঐ রাবি, চা আছেনি?

তার ছেলের গায়ে হাত তুলেছে মোতালেব, ওই ঘটনার পর থেকে দুইচক্ষে মোতালেবকে দেখতে পারে না রাবি। দেখলেই মুখ আপনা আপনি বেঁকা হয়ে যায়। এই ঘরে মোতালেবকে ঢুকতে দেখেই হয়েছিল। এখন চায়ের কথা বলায় আরও হল। মুখ ঝামটা দিয়ে বলল, না।

এককাপ বানায় দে আমারে।

আমি অহন চা বানাইতে পারুম না। আমার কাম আছে।

হয়তো মোতালেবের কথা শুনে এনামুল নয়তো দেলোয়ারা, এমন কি মান্নান মাওলানাও রাবিকে বলতে পারেন, দে এককাপ চা বানাইয়া। এইসব মানুষের কথা রাবি না রেখে পারবে না। তারচেয়ে এখান থেকে সরে যাওয়াই ভাল। চোখের আড়ালে

থাকলে তাকে ডেকে মোতালেবের জন্য চা বানাতে কেউ বলবে না। মোতালেব এত দামী লোক না।

এসব ভেবে রাবি আর দাঁড়াল না, পিছন দিককার দুয়ার দিয়ে বেরিয়ে গেল।

মোতালেব তীক্ষ্ণচোখে রাবির চলে যাওয়া দেখল তারপর এনামুলের দিকে মন দিল।

এনামুল আর একবারও তাকায়নি মোতালেবের দিকে। সে তাকিয়ে আছে মান্নান মাওলানার দিকে। একহাতে গলার চেন নাড়াচাড়া করতাছে।

শব্দ করে চায়ে শেষ চুমুক দিলেন মান্নান মাওলানা। এই শব্দে বরাবরে মতো বিরক্ত হলেন দেলোয়ারা। নিজের অজান্তেই ভুরু কুঁচকে গেল তার। বিরক্তি কাটাবার জন্যই কিনা কে জানে, একফাঁকে চশমা খুলে শাড়ির আঁচলে মুছতে লাগলেন।

এনামুল বলল, তয় কোন জাগায় করতে কন মজজিদ।

কাপটা পায়ের কাছে নামিয়ে রাখলেন মান্নান মাওলানা। কথা বলতে যাবেন তার আগেই গভীর আগ্রহের গলায় মোতালেব বলল, কীয়ের মজজিদ?

এনামুল বিরক্ত হয়ে বলল, মজজিদ আবার কীয়ের অয়?

এনামুলের বিরক্তিটা বুঝলেন মান্নান মাওলানা। মোতালেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, চুপ কইরা বহো মিয়া, বেশি পাচাইল পাইরো না। এনামুল সাবে কী কয় বইয়া বইয়া হোনো।

এনামুলকে সাহেব বলছেন মান্নান মাওলানা, শুনে খুবই খুশি হল এনামুল। মোতালেবের ওপরকার বিরক্তি কেটে গেল্ড। হাসিমুখে বলল, কন মাওলানা সাব কোনহানে করবেন মজজিদ?

তোমগো ছাড়া বাইত্তে।

লগে লগে দেলোয়ারার দিকে তাকাল এনামুল। হাসল। ছাড়া বাড়িডা আমগো না। আমার মা খালার।

মোতালেব আগ বাড়িয়ে বলল, মা খালার বাড়ি আর তোমগো বাড়ি তো মিয়া একঐ।

না এক না।

মোতালেব তারপর দেলোয়ারার দিকে তাকাল। বুজি কী কয়?

দেলোয়ারা নরম গলায় বললেন, আমিও হেইডা কই।

তারপর চশমা চোখে পরলেন।

মান্নান মাওলানা বললেন, মজজিদের ব্যাপার তো। মুখ দিয়া খালি কইলেঐ অইবো না। হয় খালার কাছ থিকা বাড়িডা কিন্না নিতে অইবো এনামুলের, নাইলে দেলোয়ারারা দুই বইনে মিল্লা মজজিদের নামে বাড়িডা লেইক্কা দিবো।

এনামুল বলল, তাইলে তো মজজিদ আমার একলা অইলো না। আমার মা খালায় দিলো জাগা আমি উডাইলাম বিন্ডিং।

মোতালেব বলল, হ। তাতে অসুবিধা কী?

 এবার মোতালেবকে ছোটখাট একটা ধমক দিল এনামুল। এই মিয়া আপনে চুপ করেন তো। কথার মইদ্যে কথা কইয়েন না।

মোতালেব একটু থতমত খেল কিন্তু এনামুল তা গ্রাহ্য করল না। মান্নান মাওলানার দিকে তাকিয়ে বলল, আমার একখান নীতি আছে মাওলানা সাব। বেবাক কামেঐ নীতিডা আমি মাইন্না চলি।

মান্নান মাওলানা সামান্য গলা খাকারি দিলেন। কী নীতি?

যেই কামঐ করি, একলা করতে চাই। নিজের ক্ষমতায় করতে চাই।

এইডাঐত্তো ভাল।

যেইডা করুম, একলা কম। অন্যরে লইয়া করুম না। ছোড করি আর বড় করি, আমি একলা করুম। নাম অউ বদলাম অউক আমার একলা অইবো। নিজের কামে অন্য কেঐরে জড়ামু না।

দেলোয়ারা নরম গলায় বললেন, মা খালারা কি তোমার পরনি?

খালার দিকে তাকিয়ে হাসল এনামুল। কথা কইলাম তা না আম্মা। কথাডা কইলাম অন্য। একখান মজজিদ যহন আমি করুম, একলাঐ করুম। আপনেগো ঐ ছাড়া বাড়িডা যুদি না থাকতো তারবাদেও যুদি গেরামে মজজিদ আমি করতে চাইতাম, কেমতে করতাম? কোনও একখান বাড়ি নাইলে জাগা কিন্না, মাডি উড়াইয়া, বাড়ি বাইন্দা তারবাদে করতাম না

হ তাতো করতাঐ।

অহন করলেও অমতে করুম।

জাগা কিন্না?

হ।

জাগা পাইবা কই?

এনামুল হাসল। জাগা তো আছেঐ।

কোনহানে?

আপনেগো ছাড়াবাড়ি

অনেকক্ষণ চুপচাপ ছিল মোতালেব। আর পারল না। বলল, মা খালার কাছ থিকা বাড়ি কিন্না লইবা মামু?

মোতালেবের কথায় এবার আর রাগল না এনামুল। হাসল। হ। লেইজ্জ (ন্যায্য) দাম যা অয় তা দিয়াঐ কিনুম। তারবাদে মজজিদ করুম।

আবার দেলোয়ারার দিকে তাকাল এনামুল। কী আম্মা, বাড়ি বেচবেন না আমার কাছে।

দেলোয়ারা বললেন, আমার কিছু কওয়ার নাই। তোমার মায় যা কইবো তাই অইবো।

মায় আমার কথা হালাইবো না।

হেইডা আমি জানি। তয় তোমারে আমি আরেকখান কথা কই বাজান, তোমার মায় দেউক না দেউক আমার অংশ আমি তোমারে দিয়া দিলাম।

একথায় এনামুলের চেয়ে মান্নান মাওলানা বেশি মুগ্ধ হলেন। মোতালেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, দেকছো মিয়া, খালা কারে কয়! খালা অইলে এমুনঐ অইতে অয়। মুখের কথায় লাকটেকার সমপিত্তি বইনপোরে দিয়া দিল।

মোতালেব কথা বলবার আগেই এনামুল বলল, আমার মায়ও এই কথাই কইবো আমারে।

এবার মোতালেব আর চুপ করে থাকতে পারল না। বেশ একটা গর্ব নিয়ে বলল, এনামুলের মা খালারা কোন বাড়ির মাইয়া হেইডা দেকতে অইবো না? কাগো (কাদের) বইন হেইডা দেকতে অইবো না? আমার বইনতো মিয়া, বুজলেন না!

মোতালেবের কথা শুনে অন্যদিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন মান্নান মাওলানা।

এনামুল বলল, মজজিদ করনের লেইগা ঐ ছাড়াবাড়িডা সব থিকা ভাল।

মান্নান মাওলানা বললেন, হ বড় সড়কের এক্কেরে লগে। সড়ক দিয়া হাজার হাজার মানুষ যাইবো আর চাইয়া চাইয়া মজজিদ দেকবো। দেইক্কা মাইনষেরে জিগাইবো, মেদিনীমণ্ডল গেরামে এত সোন্দর মজজিদখান কেডা করলো? মাইনষে কইবো, এনামুল সাবে করতাছে। মাইনষের মুখে মুখে তোমার নাম ছড়াইয়া যাইবো।

মোতালেব বলল, তয় ঐ বাড়ি থিকা কইলাম সড়ক দেড় দুইকানি অইবো।

অইলে কী অইছে, রাস্তা আছে না?

আছে, তয় ভাল রাস্তা না। আইল (আলপথ)।

এনামুল বলল, ঐ আইল থাকবো না। বড় সড়ক থিকা মজজিদ তরি ঐ আইল বাইন্দা আমি হালট (সড়ক) বানাইয়া দিমু। সড়ক তার বাড়ির লেবেল অইবো এক। হালটের লেবেল অইবো এক।

মোতালেব বলল, তাইলে তো মাডি উডান লাগবো?

উডামু।

কই থিকা?

ছাড়াবাড়ির পশ্চিমে পুকঐর আছে না! ঐ পুকর থিকা মাডি উড়াইয়া বাড়িডারেও ঠিক মতন বান্দন লাগবো, হালটও বান্দন লাগবো।

মান্নান মাওলানা বললেন, হ এই হগল কাম আগে করন লাগবো।

এনামুল হাসিমুখে বলল, অইয়া যাইবো। চিন্তা কইরেন না। কাইল ঢাকা যামু আমি। গিয়া মার লগে কথা কমু। আম্মার লগে কথা তো অইয়া গেল। কহেক (কয়েক) দিনের মইদ্যে বাড়িডা আমার নামে রেস্টারি (রেজিষ্ট্রি) কইরা হালামু। তারপর মাডির কাম লাগাইয়া দিমু। বাড়ি আর হালট বান্দা অইলে বিল্ডিংয়ের কাম ধরুম। আইচ্ছা হোনেন মাওলানা সাব, ইট সিমিটি (সিমেন্ট) রড এইসব আনুম কেমতে? বাইষ্যাকাল অইলে তো নৌকায় কইরা আনন যাইতো।

অহন আনবা টেরাকে।

টেরাক আইবো?

আইবো না ক্যা? ছিন্নগর তরি তত আহেঐ। আইজ রিকশা আইছে গেরামে। তোমার কাম কাইজ শুরু করতে মাস দেড়মাস লাগবো না।

হ তা তো লাগবোঐ।

হেতদিনে মেদিনীমণ্ডল তরি টেরাক আইয়া পড়বো।

তয় তো কোনও চিন্তা নাই। টেরাক ভইরা মাল পাডামু। সামনের বাইষ্যার আগেঐ মজজিদ অইয়া যাইব।

একটু থেমে এনামুল বলল, সবমিল্লা কত টেকা লাগতে পারে মাওলানা সাব কইলেন না?

চাইর পাঁচলাক টেকা।

 হ আমিও এমনুঐ আন্তাজ করছি। পাঁচলাক টেকা আমি খরচা করুম।

এত সহজে এতদিনকার স্বপ্ন সত্য হবে ভাবেননি মান্নান মাওলানা। উত্তেজনায় ফেটে পড়তে চাইছিলেন তিনি। তবু কায়দা করে চেপে রাখছিলেন উত্তেজনা। এখন সবকিছু একেবারে পাকা হয়ে যাওয়ার পর ধীর শান্ত গলায় বললেন, আমার যে আরেকখান কথা আছে।

এনামুল হাসল। কন। যা কথা আছে কইয়া হালান।

মজজিদের ইমাম হমু আমি।

হইবেন। আমার আপিত্তি নাই। আপনে যহন আছেন অন্য ইমাম আনুম ক্যা? অন্যরে যেই মায়না দিমু আপনেও ঐডাই নিবেন।

অনেকক্ষণ পর এই প্রথম কথা বললেন দেলোয়ারা। মাওলানা সাবে তো বলে। মায়না নিবো না!

একথা শুনে বেশ একটা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন মান্নান মাওলানা। বেতনের কথা শুনে আনন্দিত হয়েছিলেন। মসজিদের ইমামতি পাওয়া মানে গ্রামের মাতব্বরি সর্দারি সব পাওয়া। বিচার সালিশের ভার সব পড়বে তার ওপর। তিনি যা বলবেন তাই হবে। সমাজে মসজিদের ইমামের বিরাট দাম। ইমাম সাহেবের কথার উপর দিয়া কেউ কোনও কথা বলে না। ইমাম সাহেব যা বলবে তাই হবে। ইমামের মিথ্যাও সত্যর চেয়ে জোরাল। এই ক্ষমতার লগে যদি মাসে মাসে পাওয়া যায় বেতন তাহলে তো সোনায় সোহাগা।

কিন্তু বেতনটা যে দেলোয়ারার কারণে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। এজন্য অবশ্য মান্নান মাওলানাই দায়ী। দেলোয়ারার কাছে মসজিদের কথা বলতে এসে বেতন না নেওয়ার কথা তিনি নিজ মুখেই বলেছিলেন! ইস আগ বাড়িয়ে কথা বলে নিজের কতবড় সর্বনাশ যে করে বসে আছেন মান্নান মাওলানা!

সর্বনাশের হাত থেকে তাকে বাঁচিয়ে দিল এনামুল। বলল, না না, মায়না নিবো না ক্যা? মায়না ছাড়া ইমাম আমি রাখুম ক্যা? লাক লাকটেকা খরচা কইরা মজজিদ বানাইতে পারুম আর ইমাম রাখুম মাগনা, এইডা অয় না। লেইজ্জ মায়না আপনে পাইবেন মাওলানা সাব, চিন্তা কইরেন না।

মান্নান মাওলানা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। মুখে অমায়িক হাসি ফুটল তাঁর। ঐডা লইয়া আমি চিন্তা করি না। আমি জানি তুমি আমারে ঠকাইবা না। তুমি মানুষ ঠকাও না। মানুষ ঠকাইলে এতঅল্প বন্ধে আল্লায় তোমারে এতটেকা দিতো না।

মান্নান মাওলানার কথা শুনে মুগ্ধ হল এনামুল। সে আর কোনও কথা বলল না। খোলা দরজা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল।

বাইরে তখন শীতের বিকাল প্রায় শেষ। গাছপালার মাথায় জমতে শুরু করেছে। কুয়াশা। ঘরের ভিতর কুয়াশার মতো করে জমছে অন্ধকার। হঠাত্র যেন এই পরিবেশটা খেয়াল করলেন মান্নান মাওলানা। ব্যস্তভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালেন। তয় যাই অহন। নমজের সমায় অইয়া গেল।

এনামুল বল, আইচ্ছা যান। ফাইনাল কথা তো অইয়া গেল। দশ পোনরো দিনের মইদ্যে আমি আবার বাইত্তে আইতাছি। আইয়া মাডির কাম শুরু কইরা দিমু। আপনে ধইরা নেন মজজিদ আপনের অইয়া গেছে।

হেইডা আমি জানি।

তয় আমারে আপনে দোয়া কইরেন। কামডা যেন ঠিকঠাক মতন করতে পারি।

গদগদ ভঙ্গিতে এনামুলের মাথায় হাত রাখলেন মান্নান মাওলানা। খালি দোয়া করুমনি তোমারে! জান পরাণ দিয়া দোয়া করুম। ধর্মের কতবড় একখান কাম যে তুমি করলা, আখেরের কতবড় কাম যে করলা এইডা অহন বোজবা না। এইডা বোজ পরে।

মান্নান মাওলানা বেরিয়ে গেলেন। দেলোয়ারাও উঠলেন। দেখে এনামুল বলল, আপনে উঠলেন ক্যা আম্মা?

সন্ধ্যা অইয়া গেছে। হারিকেন ধরাই।

রাবিরে কন, রাবি ধরাইবো নে। আপনে বহেন।

দেলোয়ারা বসলেন। বসে রাবিকে ডাকলেন। ঐ রাবি, হারিকেন ধরা।

রান্নাঘরের দিক থেকে সাড়া দিল রাবি। ধরাইতাছি।

এবার এনামুল একটু লড়েচেড়ে বসল। দেলোয়ারার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, কী কন আম্মা, মজজিদের কাম তাইলে শুরু কইরা দেই।

দেলোয়ারা অমায়িক গলায় বললেন, দেও।

তার আগে অন্য কামডি যে করতে হয়।

কী কাম?

ছাড়াবাড়ি রেস্টারি।

কইরা হালাও।

আপনে তাইলে আমার লগে ঢাকা লন। মার লগে কথা কইয়া বাড়ি আমার নামে রেস্টারি কইরা দেন। দামের টেকা লগে লগেঐ দিয়া দিমুনে। দিয়া ব্যাংকে একাউন্ট কইরা দিমুনে। টেকা ব্যাংকে রাইক্কা দিয়েন।

দেলোয়ারা নরম গলায় বললেন, তুমি যা ভাল বোজো করো।

এনামুল বলল, বাড়ির দলিল পরচা কো?

তোমার মার কাছে।

তাইলে ঠিক আছে। কাইল আপনে আমার লগে লন।

লও।

অনেকক্ষণ পর এবার কথা বলল মোতালেব। হ যান বুজি। ভালকামে দেরি করন ঠিক না।

একটু থামল মোতালেব। তারপর এনামুলের মুখের দিকে তাকাল। তোমারে একখান কথা কইতে চাই মামু।

এনামুল ভুরু কুঁচকে বলল, কী?

এতবড় একখান কাম করতাছো তুমি, দেশ গেরামে কত নাম অইবো তোমার। আল্লায় টেকা দিচ্ছে তোমারে, হেই টেকা তুমি আল্লার কামে লাগাইতাছো। তয় আমরা কিছু আশা করতে পারি না তোমার কাছে? আমরা তো পর না! তোমগো আপনা মানুষঐ। আপনা মানুষগো ইট্টু দেবা না?

মুখ তুলে মোতালেবের দিকে তাকাল এনামুল। কথাডা বোজতে পারলাম না। খোলসা কইরা কন।

মোতালেব হাত কচলাতে কচলাতে বলল, মজজিদ বানাইবা, কত কাম মজজিদের! মাইট্টাল দিয়া মাডি কাইট্টা বাড়ি বানবা, হালট বানবা। বড় সড়কে আইয়া টেরাক থামবো, টেরাক থিকা ইটা নামান লাগবো, রড সিমিট নামান লাগবো। তারবাদে বাড়ি তড়ি আনন লাগবো। এই হগল কামের দেখভালের লেইগা একজন মানুষ লাগবো না?

মোতালেবের উদ্দেশ্য ততক্ষণে বুঝে ফেলেছে এনামুল। বুঝেও না বোঝার ভান করল। সরল গলায় বলল, হ তা তো লাগবোঐ।

ঐ কামডা আমারে দেও। দরকার অইলে কনটাক দিয়া দেও। বেবাক কাম ঠিক মতন কইরা দেই। তোমার কোনও চিন্তা থাকবো না।

এনামুল কথা বলবার আগেই দেলোয়ারা গম্ভীর গলায় বললেন, না তরে কোনও কাম দেওন যাইবো না।

মোতালেব থতমত খেল। ক্যা?

 তুই আইজ কাইল বহুত বড় বড়কথা কচ।

কবে আপনের লগে বড়কথা কইলাম আমি?

হারিকেন হাতে রাবি এসে দাঁড়াল ভিতর দিককার দরজার সামনে। তার পিছনে বাদলা। হারিকেনটা দুই কামরার মাঝামাঝি মাটিতে রাখল রাবি। ঘরের ভিতর জমে ওঠা অন্ধকার হারিকেনের আলোয় কেটে গেল।

রাবি এবং বাদলার দিকে একবার তাকালেন দেলোয়ারা, তারপর বললেন, কয়দিন আগে বাদলারে তুই মারছস। আমি হেই কথা জিগাইছি দেইক্কা আমার লগে কুইদ্দা (রেগে ওঠা অর্থে) উঠছস। এনামুলের কথা কওনের লগে লগে কইছস আমি তরে এনামুলের ডর দেহাইনি!

বাদলার গায়ে হাত তোলার কথা উঠেছে দেখে রাবি ভাবল এই তো সুযোগ। এই সুযোগে এনামুল মামার সামনে মোতালেবকে যতটা নাকাল করা যায় করবে সে।

দেলোয়ারার দিকে তাকিয়ে রাবি বলল, বুজি, আসল কথাডিই তো কইতাছেন না আপনে। হেয় যে বাদলারে কইছিলো আমগো তো বাইত থিকা উড়াইয়া দিবোঐ দরকার অইলে আপনেরে শুদ্দা উডাইয়া দিবো।

একথা শুনে মুখ চুন হয়ে গেল মোতালেবের। কোনও রকমে সে বলল, না এই কথা আমি কই নাই। কীরে বাদলা, কইছি?

বাদলা বলল, হ কইছেন।

বাদলাও যে এরকম সাক্ষী দিবে ভাবেনি মোতালেব। সে একেবারে বেকুব হয়ে গেল। মুখে আর কথা জুটল না।

এনামুল ততক্ষণে বেশ রেগেছে। রাগলে নাকের পাটা ফুলে যায় তার। এখনও ফুলল। গম্ভীর গলায় বলল, আমি আগেও দুই চাইরবার হুনছি আমগো ঘরে যারা থাকে তাগ লগে খারাপ ব্যবহার করেন আপনে। উল্টাপাল্টা কথা কন। আমার মা খালারেও বলে বকাবকি করেন। এত সাহস আপনে পান কই? আমরা কি আপনের হাতের ফাঁক দিয়া পইড়া যাই? বিপদে পড়লে তো পয়লা দৌড়াইয়া যান ঢাকায়, আমগো বাসায়। টেকা দিয়া সাহাইয্য করলে আপনেরে আমিঐ করি। মাইয়ার চিকিৎসা করাইবেন কইয়া তিন চাইর মাস আগেও তো পাঁচ হাজার টেকা আনছেন আমার কাছ থিকা।

একথা শুনে ঝট করে এনামুলের দিকে তাকালেন দেলোয়ারা। কও কী? পাঁচ হাজার টেকা আনছে? কবে আনলো? তুমি দিহি আমারে কিছু কইলা না?

কই নাই এমতেঐ। মাইনষের উপকার কইরা সেই কথা না কওনঐ ভাল।

মাইয়ার চিকিৎসা কইলাম ও করায় নাই।

তাইলে কী করতাছে টেকা আইন্না?

রাবি বলল, কী আর করবো? খাইছে। পরের টেকা বইয়া বইয়া খাইতে তো বহুত মজা।

মোতালেব তখন মাথা নিচু করে বসে আছে। যেন কারও দিকে তাকাবার মুখ আর নাই তার।

দেলোয়ারা আবার মোতালেবের দিকে তাকালেন। এত কিছুর পরও আমগো লগে এত বড় বড়কথা কেমতে কচ তুই! আরে তর তো থাকনের কাম আমগো চাকর বাকরের লাহান।

এনামুল শ্লেষের গলায় বলল, কাম কাইজ যা চায় তাও তো চাকর বাকরের কাম। কামলার কাম।

তারপর মোতালেবের দিকে তাকিয়ে বলল, ঐ মিয়া আমগো বাড়ির কামের মাইনষের লগে এত বড় বড়কথা কইয়া আমগো কাছে কাম চাইতে আহেন, সাহাইয্য চাইতে আহেন, শরম করে না আপনের? তহন বড়কথা থাকে কই?

মোতালেব মাথা তুলল না, কথা বলল না।

এনামুল বলল, মজজিদের কাম কয়দিনের মইদ্যে শুরু করুম আমি। কনটাক। আপনেরে দিমু না। ঐ আশা কইরা লাভ নাই। লেবারগ সর্দারিডা ইচ্ছা করলে আপনেরে আমি দিতে পারি। রোজ দরে পয়সা পাইবেন। তয় হেইডাও ফাইনাল না। মাওলানা সাবের লগে কথা কইয়া লই। দেহি হেয় কী কয়।

এবার মুখ তুলল মোতালেব। কাতর গলায় বলল, তুমি কইলে আমি গিয়া মাওলানা সাবরে ধরি।

না আপনের ধরনের কাম নাই। তয় আমার মনে অয় লেবার সর্দারিও আপনে পাইবেন না। মাওলানা সাবে না করবো। এই হগল তদারকি হেয় নিজেঐ করবো।

মোতালেব বুঝে গেল নানা রকম কায়দায় অপমান যা করার করা হয়েছে তাকে। কাজের লোভের মুলাটা নাকের আগায় ঝুলিয়ে দিয়েও সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। মসজিদের কাজে তার আর কোনও আশা নাই।

ব্যাজার মুখ করে উঠে দাঁড়াল সে। কারও দিকে না তাকিয়ে দুয়ারের দিকে পা বাড়াল।

এনামুল বলল, যান গা নি?

হ। কী করুম আর।

কামডা পাইলে কি এমতে যাইতেন গা?

মোতালেব কথা বলল না।

এনামুল বলল, ধরেন লেবার সর্দারির কাম আপনেরে আমি দিয়া দিলাম।

লগে লগে মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল মোতালেবের। তুমি তো ইচ্ছা করলে দিতে পারোঐ। মাওলানা সাবরে লাগেনি!

না তা লাগে না। কাম আমার, টেকা আমার। আমার যারে ইচ্ছা তারে আমি দিমু। আপনেরে দিয়া দিলাম।

আলহামদুলিল্লাহ।

তয় আমার কহেকখান কথা আপনের মাইন্না চলতে অইবো।

চলুম।

আমার মা খালার সামনে, আমগো বাইত্তে যারা থাকে, মতলা রাবি বাদলা অগো সামনে সিনা টান কইরা হাঁটতে পারবেন না। এমুনভাবে হাটবেন, মালিকের সামনে চাকররা যেমতে হাটে। কথা কইবেন এমুনভাবে, আপনের গলার আওজে য্যান বুজা যায়, অরা মালিক আর আপনে অইলেন চাকর। কোনও রকমের হামতাম (আস্ফালন) করলে লেবার সর্দারি আপনের থাকবো না। ঠিক আছে

মোতালেব বিনীত গলায় বলল, ঠিক আছে।

তয় যান অহন।

মোতালেব মাথা নিচু করে বেরিয়ে গেল।

মোতালেব বেরিয়ে যেতেই দেলোয়ারার দিকে তাকিয়ে হাসল এনামুল। কী কন আম্মা! উচিত শিক্ষা দিছি না?

দেলোয়ারাও হাসলেন। হ একদম উচিত শিক্ষা দিছো বাজান। জিন্দেগানিতে আর বড়কথা কইতে পারবো না।

রাবি বলল, কথা যাঐ কইছেন না কইছেন, কামডা তো ঠিকঐ দিলেন মামা!

এনামুল আবার হাসল। কেন যে দিছি হেইডা বোজলে তুই আর মতলার বউ হইতি। তুই হইতি আমার খালা। খালায় যা বোজনের ঠিকঐ বোজছে।

এনামুল আবার হাসল। কেন যে দিছি হেইডা বোজলে তুই আর মতলার বউ হইতি। তুই হইতি আমার খালা। খালায় যা বোজনের ঠিকঐ বোজছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *