প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
চতুর্থ পর্ব
পরিশিষ্ট : ‘মহাস্থবির’ প্রেমাঙ্কুর আতর্থী প্রসঙ্গ

১.৪ স্তব্ধ বনস্থলীতে

স্তব্ধ বনস্থলীতে হঠাৎ ঝড় উঠলে প্রথমে যেমন দূর-বহুদূরাগত জয়ধ্বনির মতো শব্দ হতে থাকে, তারপরে সেই অখণ্ড আওয়াজ বাড়তে বাড়তে সমস্ত অরণ্যব্যাপী উল্লাস জাগে–এসেছে, এসেছে, ওরে এসেছে রে! বিশাল বনস্পতি থেকে আরম্ভ করে শিশু বৃক্ষলতা পর্যন্ত উদ্বেলিত হয়ে ওঠে, যে জননী-ধরণী নিয়ত স্তন্যদানে তাদের পোষণ করেছে, তার বুক ছিঁড়ে এই নবচেতনার উন্মাদনায় ভেসে যেতে চায়, কামদেবের ফুলধনুর স্পর্শমাত্র সেই কৈশোরেই আমার মনের অবস্থা সেইরকম হয়ে পড়ল। মনের সমস্ত বৃত্তি, জীবনের সমস্ত কামনা লতুকে ঘিরে- সে যেন আমার চোখের সেই অঞ্জন, যা লাগলে পৃথিবীর সব কিছুই সুন্দর ঠেকে। ধরণী আমার কাছে সুন্দরতর হয়ে উঠল।

একদিন পাগলা সন্নোসী বললেন, রামবাবু, তোমাকে ব্রাদার কিছুদিন থেকে যেন কেমন-কেমন দেখছি! লভে-টভে পড়েছ নাকি?

গোষ্ঠদিদিকে আগেই লতুর সব কথা বলেছিলুম, সেদিন তাঁকেও বললুম।

আমার কথা শুনে পাগলা সন্নোসী বললেন, সাবাস ব্রাদার! কাল থেকে বায়রন পড়া যাবে, কি বল?

জিজ্ঞাসা করলুম, আচ্ছা পাগলা সন্ন্যেসী, আপনি কখনও প্রেমে পড়েছিলেন?

তিনি হেসে উঠলেন, কিন্তু সে কণ্ঠখানি তখুনি থেমে গেল। অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, সেকথা কি আর মনে আছে! আমাদের জীবন বৃথাই কেটেছে ব্রাদার, বৃথাই কেটেছে–

Like the ghost of a dear friend dead
Is Time long past
A tone which is now forever fled.
A hope which is now forever past
A love so sweet it could no last
Was time long past.

আমার জীবনে লক্ষ করেছি, একটা সুখের কারণ ঘটলেই ঠিক সেই ওজনের একটা দুঃখও এসে জোটে। সুখ-দুঃখের নাগরদোলায় এই ওঠা-নামার ওপর এমন একটা মানসিক মৌতাত জন্মেছে যে, সরল একটানা জীবনযাত্রায় আমি হাঁপিয়ে উঠি, লৌকিক ও সাংসারিক বিধিমতে সে-জীবন সুখের হলেও। লতুর সঙ্গে আমার এই, যে নতুন পরিচয় ঘটল, তারই আনন্দে আত্মহারা হয়ে আমি দিন কাটাতে লাগলুম। লতু একদিন বললে, ভালো করে পড়াশোনা কর।

সেদিন থেকে পড়ায় এমন মন লাগালুম যে, বাবা পর্যন্ত খুশি হয়ে উঠলেন। মনে পড়ে, এই সময় আমাদের ইস্কুলে একজন নতুন শিক্ষক এলেন। ক্লাসের মধ্যে আমি শচীন ও প্রমথ একেবারে দুর্দান্ত হয়ে উঠেছিলুম। তর্ক, মারামারি ও নানারকম উৎপাতের জন্য শিক্ষক-সম্প্রদায় সর্বদাই উৎকণ্ঠিত থাকতেন। ক্লাসের মধ্যে আমরা তিনজন সবার চাইতে বেশি, মার খেলেও অধিকাংশ শিক্ষকই আমাদের পছন্দ করতেন বেশি। তাঁদের আশা ছিল, একদিন –যেদিন আমাদের সদ্ধি হবে, সেদিন আমরা সব বিষয়েই সব ছেলের চাইতে ভালো হয়ে যাব।

আমাদের এই নতুন শিক্ষকটি আসামাত্র তাঁর সঙ্গে কি জ্যাঠামো করায় তিনি আমার ও শচীনের বেশ করে কান রগড়ে দিলেন। নতুন মাস্টারের হাতে কানৌটি খেয়ে আমাদের মাথায় দুষ্ট-সরস্বতী চেপে বসল। আমরা রকম-রকমের বুলি-চালি কাটতে আরম্ভ করে দিলুম। শেষকালে তিনি রেগে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলেন।

ঠিক সেইসময় শচীনের বাবা অর্থাৎ আমাদের ইস্কুলের যিনি কর্তা, তিনি কি-একটা কাজে এসেছিলেন। নতুন মাস্টারটি একেবারে তাঁর কাছে গিয়ে উৎপাতের কথা বলতেই আমাদের ডাক পড়ল। আমরা লাইব্রেরি-ঘরে যেতেই আমাদের ওপর বেত্রাঘাতের হুকুম দিয়ে তিনি চলে গেলেন। ঠিক হল, ইস্কুলের ছুটির পর সব ছেলের সামনে আমাদের বেত মারা হবে। নতুন মাস্টার অর্থাৎ যাঁর ক্লাসে আমরা হাঙ্গামা করেছিলুম, তিনি বেত্রাঘাত করবেন–তাঁর যত ঘা খুশি।

ইস্কুলের ছুটি হতে সব ছেলেরা ও মাস্টারেরা উঠোনে ভিড় করে দাঁড়াল। উঠোনের মাঝখানে একটা বেঞ্চি পেতে তার উপরে আমাকে চড়ানো হল। মাস্টারমশায় একখানা হাত-তিনেক লম্বা বেত নিয়ে এলেন। রাগে তখনও তিনি কাঁপছিলেন। প্রথমেই তিনি আমার পায়ে ঘা পাঁচ-সাত গায়ের জোরে মারতেই আমি একেবারে বসে পড়লুম। পায়ের যন্ত্রণায় মাথা পর্যন্ত ঝনঝন করছিল, তবুও রসিকতা করবার প্রলোভন সামলাতে পারলুম না। বললুম, পায়ে মারবেন না স্যার। পা ভেঙে গেলে আর ইস্কুলেও আসতে পারব না, আপনার হাতে মার খাবার সৌভাগ্যও আর হবে না।

আমরা তখন দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়তুম। ওপরে ও নীচের সব ক্লাসের ছেলেরাই আমাদের পছন্দ করত। আমাদের ওপরে এই সাজার ব্যবস্থাটা তাদের মনঃপূত হয়নি। আমার ওই কথা শুনে তারা একেবারে হো-হো করে হেসে উঠল।

অন্য মাস্টারেরা ছেলেদের এই ধৃষ্টতা দেখে চিৎকার করে উঠলেন, এই, চুপ চুপ, হাসতে লজ্জা করে না তোমাদের! ইত্যাদি বলায় তারা চুপ করলে।

তারপর মাস্টারমশায় এলোপাতাড়ি প্রায় পনেরো মিনিট ধরে আমাকে প্রহার দিয়ে হুঙ্কার ছাড়লেন, কোথায় শচীন্দ্রনাথ?

শচীন্দ্রনাথ সেইখানেই দাঁড়িয়ে ছিল। আমি নেমে যেতেই সে টপ করে বেঞ্চির ওপরে উঠে দাঁড়াল। মাস্টারমশায় বেত আপসাতে আপসাতে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার কোথায় মারব?

শচীন ডান হাতখানা বাড়িয়ে দিলে, তারই ওপরে সাঁই সাঁই বেত পড়তে লাগল। পনেরো-বিশ ঘা বেত মারবার পর তিনি বললেন, ও হাত পাতো।

এই হাতেই মারুন স্যার, আবার ও হাত কেন?

ও, তা হলে তোমার এখনও কিছু হয়নি!

হবে আবার কি স্যার! আপনার বগলে বীচি আউরে যাবে, তবু আমার কিছু হবে না।

শচীনের এই কথা শুনে ছেলের দল হো-হো করে হেসে উঠল। মাস্টারেরা কিছুতেই সে গোলমাল থামাতে পারেন না, শেষকালে প্রথম শ্রেণীর একজন মুরুব্বি গোছের ছাত্র মাস্টারদের বললে, স্যার, ওঁদের সঙ্গে আমাদেরও কেন সাজা দিচ্ছেন, ক্ষিধে পেয়েছে, এবার বাড়ি যাই।

প্রথম শ্রেণীর ছেলেরা বেরিয়ে যেতেই তাদের সঙ্গে আরও অনেক ছেলে বেরিয়ে গেল। দর্শকের সংখ্যা কমে যাওয়ায় মাস্টারমশায়ের উৎসাহও কমে গেল। তিনি শচীনকে নামতে বলে বেত রাখতে গেলেন। আমরা দুজনে অন্য ছেলেদের সঙ্গে বেরিয়ে যাচ্ছি, এমন সময় মাস্টারমশায় আমাদের ডেকে একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে বললেন, এই শাস্তিই তোমাদের শেষ মনে করো না। আমি তোমাদের ইতিহাস পড়াব, এই আরম্ভ–জেনে রেখো।

রাস্তায় চলতে চলতে শচীন বললে, এবার থেকে তো Salium (শালা শব্দের Latin, অবশ্য আমাদের তৈরি শব্দশাস্ত্র অনুসারে) হরদম পিটবে রে!

তাই তো, কি করা যায় বল্ তো! দোব নাকি Salium-কে কম্বল চাপা দিয়ে–বেশ করে?

পরামর্শ ঠিক করে বাড়ি যাওয়া হল।

আমাদের দুখানা ইতিহাস পড়া হত। একখানা অধর মুখোপাধ্যায়ের ভারতবর্ষের ইতিহাস আর একখানা Townsend Warner-এর ইংল্যান্ডের ইতিহাস। দুখানা মিলিয়ে প্রায় পাঁচশো পৃষ্ঠা হবে। ঠিক হল, বই দুখানা ঝাড়া মুখস্থ করে ফেলা যাবে। তা সত্ত্বেও যদি মারধর করে তো বাধ্য হয়ে একদিন কম্বল চাপা দিতে হবে।

দিন তিন-চার অসুখের অছিলায় ইস্কুলে গেলুম না। সারা দিন-রাত্রি ধরে দুখানি বই গড়গড়ে মুখস্থ করে ফেলা গেল। কামাইয়ের পর যে-দিন দুই বন্ধুতে ইস্কুলে গেলুম, সেই দিনই নতুন মাস্টারের ক্লাস ছিল। সে-দিন ভারতবর্ষের ইতিহাস পড়া ছিল। মাস্টারমশায় ক্লাসে বেত নিয়ে ঢুকলেন। এ দৃশ্য এই ইস্কুলে নতুন দেখলুম।

জিজ্ঞাসা করলেন, কতদূর পড়া হয়েছে।

ইতিহাসখানা সম্পূর্ণ পড়া হয়ে গিয়েছিল, তখন গোড়া থেকে দ্বিতীয়বার পড়া হচ্ছিল। মাস্টারমশায় শুনে বললেন, আচ্ছা, কার কতদূর তৈরি হয়েছে, আমি একবার ক্লাসসুদ্ধ ছেলেকে পরীক্ষা করতে চাই। স্থবির শর্মা, উঠে এস।

উঠে মাস্টারমশায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ালুম। তিনি একটা প্রশ্ন করলে, আমি টপ করে তার-সঠিক উত্তর দিলুম। একটা প্রশ্নে রেহাই হল না। বোধ হয় তিনি প্রহার দেবার জন্যে বদ্ধপরিকর হয়েই এসেছিলেন। প্রশ্নের পর প্রশ্ন চলতে লাগল। আর আমিও টপাটপ তার জবাব দিতে লাগলুম। মাস্টারমশায় অবাক, ক্লাসের ছেলেরা একেবারে থ। শেষকালে তিনি বললেন, আচ্ছা, তুমি এখানেই দাঁড়াও। শচীন্দ্রনাথ, এধারে এস।

শচীন উঠে গটগট করে এগিয়ে এল। একটা প্রশ্ন করা মাত্র সে উত্তর দিয়ে দিলে। মাস্টারমশায় আর একটা প্রশ্ন করার জন্যে বইয়ের পাতা উলটোচ্ছেন, এমন সময় শচীন বললে স্যার, অভয় দেন তো একটা নিবেদন করি!

বল।

প্রশ্ন খোঁজবার জন্যে অত পাতা উলটোবার দরকার কি? এক কাজ করুন বইয়ের গোড়া থেকে শেষ অবধি আমি বলে যাচ্ছি, তার মধ্যে আপনি সব প্রশ্নেরই উত্তর পাবেন। আর মারবারই যদি ইচ্ছে থাকে তো ঘা-কয়েক দিয়ে ছেড়ে দিন, গিয়ে বসে পড়ি।

শচীনের কথা শুনে রাগে মাস্টারমশায়ের মুখ লাল হয়ে উঠল। তিনি বললেন, কি! গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত বলবে?

হ্যাঁ স্যার, ও তো সামান্য। এটা কি আর ইতিহাস! ওর চেয়ে বড় বড় ইতিহাস আমার মুখস্থ আছে, সে-সব বইয়ের নাম পর্যন্ত ইস্কুলের কেউ জ ন না। মাস্টারমশায় বললেন, আচ্ছা, বল। শচীন বইয়ের গোড়া থেকে গড়গড় করে মুখস্থ বলে যেতে লাগল, মাস্টারমশায় স্তম্ভিত হয়ে গেলেন।

ঘণ্টা কাবার হয়ে গেল। মাস্টারমশায় আমাকে আর শচীনকে ক্লাস থেকে ডেকে নিয়ে লাইব্রেরি-ঘরে চললেন। সেখানে মাস্টারদের ভিড় কমে যাওয়ার পর বললেন, দেখ হে বাপু স্থবির শর্মা এবং শচীন্দ্রনাথ, তোমাদের এমন merit, এমন intellegence হেলায় হারিও না। তোমরা ইচ্ছে করলে জগতে অনেক উন্নতি করতে পারবে; কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, তোমরা নষ্ট হয়ে যাবে।

আমি ভারতবর্ষের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত অবধি বহু সন্ন্যাসী, সাধু, সন্ত, সাঁইবাবা, ফকির, মোহান্ত, মঠধারী ও জ্যোতিষীকে আমার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করেছি, কিন্তু এক-কথায় আমাদের সম্বন্ধে এমন মোক্ষম ও নিশ্চিত ভবিষ্যদ্বাণী আর শুনিনি।

দিনগুলি বেশ কাটছিল। পড়াশোনার উৎসাহ, পাগল সন্ন্যেসীর লেকচার ও কবিতাপাঠ, লতু, গোষ্ঠদিদি ইত্যাদি মিলিয়ে নিরুপদ্রবে কাটছে। বিকেলবেলায় ছুটি পাওয়ায় মনের মধ্যে মুক্তির আনন্দ অনুভব করছি, এমন সময় এক অভাবনীয় ব্যাপার ঘটে গেল।

এই সময় আমাদের আর একজন নতুন মাস্টার এলেন। নতুন মাস্টার দেখলেই আমাদের দুষ্টুমি করবার উৎসাহ বেড়ে যেত চতুর্গুণ। এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হল না। দু-চার দিনের মধ্যেই একদিন প্রমথকে তিনি বেধড়ক প্রহার দিলেন। এর পরেই তাঁর মেজাজ একেবারে দস্তুরমতো খেঁকি হয়ে উঠল। সকলকেই মারতে উদ্যত। কয়েক দিনের মধ্যেই ক্লাসের একটি ভালো এবং ভালোমানুষ ছেলের ওপরে কি কারণে রেগে গিয়ে ভদ্রলোক মেরে তাকে একেবারে আধমরা করে দিলেন।

ইস্কুলে মারধর খাওয়াটা আমরা খুব একটা অপমানজনক কাণ্ড বলে মনে করতুম না। মাস্টারেরা মারবে জেনেই আমরা ক্লাসে দুষ্টুমি করতুম। কখনও কখনও প্রহারের মাত্রা বেশি হয়ে যেত সন্দেহ নেই, কিন্তু আমাদের দুষ্টুমি ও মাস্টার-জ্বালানো কায়দাগুলোও যে কোনো সময়েই মাত্রা ছাড়িয়ে যেত না, এমন কথাও হলপ করে বলতে পারি না। পরের দিন বেলা দশটার সময় ইস্কুলে যাচ্ছি, দেখি, পথে–ইস্কুল থেকে একটু দূরেই–আমাদের ছেলেরা দাঁড়িয়ে জটলা করছে। তারা আমাকে আটকে বললে, আজ আর ইস্কুলে যাওয়া হবে না।

কেন?

উপেনকে কিরকম মেরেছে নতুন মাস্টার! ওর কোনো দোষ নেই। মিছিমিছি মারার জন্যে আমরা ধর্মঘট করেছি, এর বিহিত না হওয়া পর্যন্ত কেউ ইস্কুলে যাব না।

বহুৎ আচ্ছা।–বলে আমিও দাঁড়িয়ে গেলাম।

বেলা সাড়ে এগারোটা অবধি থাকার পর অনেকেই বাড়ি চলে গেল। আমি আর শচীন হেদোয় গিয়ে বসে রইলুম। বেলা দুটো-আড়াইটে নাগাদ ইস্কুলের একটা চাকর আমাদের দেখতে পেয়ে ইস্কুলে গিয়ে খবর দিয়ে দিলে।

পরের দিন ইস্কুলের মালিক মহাশয় ক্লাসে এসে খুব ধমকধামক করলেন। বললেন, তোমরা আমাকে না জানিয়ে এইরকম ধর্মঘট করে অত্যন্ত অন্যায় করেছ। তোমাদের দলপতিকে ইস্কুল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে।

বেলা তিনটে নাগাদ ইস্কুলময় রটে গেল, দ্বিতীয় শ্রেণীর একজন ছাত্রের নাম কাটা যাবে। কে সে?

পরের দিন আমাদের ক্লাসে একজন মাস্টার পড়াতে পড়াতে হঠাৎ থেমে গিয়ে বললেন, স্থবির শর্মা, আমি শুনলুম, তোমাকে ইস্কুল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে।

ম্যালেরিয়ার দেশে জন্মালেও পিলে চমকানো অনুভূতিটা যে ঠিক কিরকম, তা অধিকাংশ বঙ্গবাসীই বোধ হয় জানেন না। সে রস অবর্ণনীয়। মাস্টারের মুখে এই মনোরম সংবাদটি শুনে আমার পিলে চমকে উঠল। জিজ্ঞাসা করলুম, কেন স্যার?

তুমি নাকি সেদিনকার ধর্মঘটের Ring-leader ছিলে।

ক্লাস-সুদ্ধ ছেলে একবাক্যে এই অভিযোগের প্রতিবাদ করে উঠল। তারা বললে, স্থবির আগে কিছু জানত না স্যার, আমরাই ওকে ইস্কুলে আসতে বারণ করেছিলুম। ওকে তাড়িয়ে দিলে আমরা ধর্মঘট করব।

মাস্টারমশায় বললেন, ঠিক জানি না, ওইরকম কি-একটা শুনছিলুম।

মাথার মধ্যে ভোঁ-ভোঁ করতে লাগল। বাড়িতে ফেরবার পথে অস্থির বললে, স্থবরে তোকে ইস্কুল থেকে তাড়িয়ে দেবে শুনছি।

কি হবে ভাই?

তুই এক কাজ কর। বাড়ি থেকে লম্বা দে, নইলে বাবা মেরে ফেলবে।

লতুকে বললুম। সে সব শুনে বললে, কি হবে?

লতু কাঁদতে লাগল। দীর্ঘদিনের আবছায়ায় আচ্ছন্ন সেই অশ্রুমুখী কিশোরীর মুখখানি আজ আমার মানসপটে ফুটে উঠছে আর মনে হচ্ছে, জীবন-প্রভাতে সেই ভয়ঙ্কর দুর্দিনে তার আর অস্থিরের সহানুভূতি যদি না পেতুম, তা হলে কি করতুম।

লতু দু-হাত থেকে দু-গাছা চুড়ি খুলে আমায় দিয়ে বললে, এই দুটি বিক্রি করে পালিয়ে যা।

টাকার দরকার হলেই আমায় লিখিস, আমি পাঠিয়ে দোব, কেউ জানতে পারবে না।

গোষ্ঠদিদিকে সব বললুম। পালিয়ে যাব ঠিক করেছি শুনে বললে,অমন কাজ করিসনি। বললুম, না পালিয়ে উপায় নেই! ইস্কুল থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে শুনলে বাবা মেরে ফেলবেন। গোষ্ঠদিদি জিজ্ঞাসা করলে, পালাবি যে, টাকা পাবি কোথায়?

আমি ভেবেছিলুম, পালাবার কথা শুনলে গোষ্ঠদিদি নিজে থেকেই আমাকে টাকা দেবে। লতু আমায় চুড়ি দিতে চেয়েছিল, কিন্তু আমার বয়সী ছেলে স্যাকরার দোকানে চুড়ি বিক্রি করতে গেলে নিশ্চয় তারা সন্দেহ করে হাঙ্গামা বাধাবে–এই ভয়ে চুড়ি নিইনি। গোষ্ঠদিদি প্রায়ই বলত, আমার টাকা ও গয়না যা কিছু আছে, সবই তো তোদের দুই ভায়ের, তোদের ভাবনা কি?

সেই গোষ্ঠদিদি যখন জিজ্ঞাসা করলে, টাকা পাবি কোথায়?–তখন আমার ভয়ানক অভিমান হল। আমার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়তে লাগল। ইস্কুল থেকে তাড়িয়ে দেবে, তারপর বাড়িতে যে কি হাঙ্গামা হবে–এই চিন্তা আমাকে আকুল করে তুলেছিল; কিন্তু গোষ্ঠদিদির কথায় আমার সমস্ত আশঙ্কা অবসন্ন হয়ে পড়ল। শুধু মনে হতে লাগল, এতদিন ধরে এই নারী কথার মোহে আমাদের শুধু ছলনায় করে এসেছে। গোষ্ঠদিদির জন্যে না করতে পারতুম এমন কাজ আমরা কল্পনাই করতে পারতুম না। ইস্কুল কোনোদিনই আমার প্রিয় ছিল না। সেখান থেকে বিনা দোষে তাড়িত হলে লজ্জারও কোনো কারণ নেই। তবুও ইস্কুল থেকে তাড়িয়ে দিলে বাবা যে মেরে ফেলবেন সে-কথা গোষ্ঠদিদি যে না জানত তা নয়। এসব জেনে-শুনেও সে যখন আমাকে সাহায্য করলে না, তখন মনে হল, আমরা তাকে যতখানি নিজের বলে মনে করেছি, সে তা করে না। আমাকে কাঁদতে দেখে গোষ্ঠদিদি আমাকে জড়িয়ে ধরে বললে, আমাকে ছেড়ে যেতে তোর কষ্ট হবে না?

অভিমানক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললুম, কিছু কষ্ট হবে না। কেন কষ্ট হবে? আমি মরে গেলে যদি তোমাদের কষ্ট না হয় তো তোমাকে ছেড়ে যেতে আমার কিসের কষ্ট?

গোষ্ঠদিদি আমাকে আরও জোরে চেপে ধরলে। আমি বললুম, ছেড়ে দাও, যাই।

আমার মুখখানা একবার তুলে দেখে গোষ্ঠদিদি প্রাণপণে আমার বুকের মধ্যে চেপে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললে, না, তুই যেতে পারবি না, কিছুতেই তোকে ছাড়ব না।

ঠিক হল ইস্কুল থেকে তাড়িয়ে দিলে বাবা যখন মারতে থাকবেন, সে সময় গোষ্ঠদিদি গিয়ে মাঝে পড়ে আমাকে উদ্ধার করবে। সে গিয়ে পড়লে মারের মাত্রা কম হবে।

কয়েকদিন ইস্কুলে কিন্তু আর কোনো কথাই উঠল না। মনে হল, ফাঁড়াবুঝি কেটে গেল। হঠাৎ একদিন ক্লাসের চাকর একটুকরো কাগজ এনে মাস্টারমশায়ের হাতে দিলে। তিনি চেঁচিয়ে পড়ে ক্লাসসুদ্ধ ছেলেকে শুনিয়ে দিলেন,–ক্লাসে অনবচ্ছিন্ন অসদ্ব্যবহারের জন্য (continuous ill- behaviour) স্থবির শর্মার নাম ইস্কুলের খাতা থেকে কেটে নেওয়া হল।

দণ্ডাজ্ঞা শুনেই আমার দুই কানের মধ্যে একবার ঝমঝম করে ঝাঁজর বেজে উঠল। তারপর সমস্ত চিন্তা এক কেন্দ্রের চতুর্দিকে চিৎকার করতে লাগল, কি হবে?

ক্লাসসুদ্ধ ছেলে স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। মাস্টারমশায় পড়ানো বন্ধ করে দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে বললেন, স্থবির, তোমার জন্যে আমি দুঃখিত–অত্যন্ত দুঃখিত।

মাস্টার পড়া শেষ করে চলে গেলেন, অন্য মাস্টার এসে পড়ানো শুরু করলেন; কিন্তু খানিকটা শব্দ ছাড়া আর আমার কানে কিছুই গেল না। ছুটির কিছু আগে হেডমাস্টার আমায় ডেকে একখানা চিঠি দিয়ে বললেন, এখানা তোমার বাবাকে দিও।

ছুটির পর ক্লাসের বন্ধুরা আমাকে সহানুভূতি জানালে ও কর্তৃপক্ষের এই অবিচারের জন্যে তারা ইস্কুল ছেড়ে দেবে বললে। আমার কানে কিন্তু কোনো কথাই যাচ্ছিল না। মনের মধ্যে এক প্ৰশ্ন খোঁচা দিতে লাগল, কি হবে, কি করব?

বাড়িতে এসে মাকে চিঠিখানা দিয়ে সোজা ছাতে চলে গেলুম। সেদিন গোষ্ঠদিদির সঙ্গে দেখা করলুম না, লতুদের বাড়িতেও যাওয়া হল না। শুধু অস্থিরের সঙ্গে পরামর্শ চলতে লাগল, কি হবে, কি করব?

রাত্রে বিছানায় শুয়ে প্রতি মুহূর্তে মনে হতে লাগল, এতক্ষণে বোধ হয় চিঠিখানা বাবার হাতে পড়েছে, এইবার বুঝি ডাক পড়ে। রাত্রি বারোটা বেজে গেল, তখনও ডাক পড়ল না! মনে হতে লাগল, পাঁচ বছর আগে মেয়েদের ইস্কুলে পড়বার সময় তিন পয়সা চুরির মিথ্যা অভিযোগে পড়ে এইরকমই এক নিদ্রাহীন রাত্রি কেটেছিল–সেই আট বছর বয়সে হেদোর জলে ডুবে সব হাঙ্গামা চুকিয়ে দেবার সংকল্প করেছিলুম, আজ তার চেয়েও অনেক বড় বিপদে আত্মহত্যার কথা বারে বারে মনে হতে লাগল, কিন্তু লতুর মুখ আমার সে-সংকল্পকে ভাসিয়ে দিলে। কায়মনোবাক্যে ঈশ্বরকে ডাকতে লাগলুম, হে ভগবান, আমার ছোট্ট জীবনে কতবার কত বিপদে তুমি উদ্ধার করেছ, এইবার বাঁচাও!

কে যেন ছাতের দরজায় টোকা দিলে। উৎকর্ণ হয়ে উঠে বসলুম। আবার টোকা! আবার টোকা! তাড়াতাড়ি বাতি জ্বালিয়ে দেখলুম, অস্থির অগাধ নিদ্রায় অভিভূত। টপ করে বাতি নিবিয়ে দিয়ে তিন লাফে ছাতের সিঁড়ি পার হয়ে সন্তর্পণে দরজাটা খুলতেই এক ঝলক জ্যোৎস্না আমার মুখের ওপরে এসে পড়ল। মুখ বাড়িয়ে দেখি, গোষ্ঠদিদি এসে দাঁড়িয়ে আছে। তার অঙ্গে ধবধবে সাদা একখানা শাড়ি, তার ওপর চাঁদের আলো পড়ে অপূর্ব সুষমায় মণ্ডিত হয়ে উঠেছে। জ্যোৎস্নালোকপ্লাবিত নিস্তব্ধ রাত্রে গোষ্ঠদিদির সেই স্বভাববিষণ্ণ মুখের মৌন নিরুক্ত অভয়-আশ্বাসে আমার উদ্বেলিত মন জুড়িয়ে গেল। মনে হল, আমার প্রার্থনা শুনে চাঁদের দেশ থেকে নেমে এসেছে আমার আসল মা, তার হাত ধরে ফিরে চলে যাব আমার কল্পলোকে, কাল সকাল থেকে আমাকে আর কেউ দেখতে পাবে না। সকালে বলবে, আহা, ছেলেটা বেশ ছিল, কোথায় চলে গেলে!

গোষ্ঠদিদি বললে, কি রে, হাঁ করে কি দেখছিস? দু-ধণ্টা ধরে দরজায় টোকা দিচ্ছি, শুনতেই পাস না?

আমি আর কথা বলতে পারলুম না, প্রাণপণে গোষ্ঠদিদিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে আরম্ভ করে দিলুম।

দুজনে চলে গেলুম ছাতের এক কোণে। গোষ্ঠদিদি বলতে লাগল, তোর কোনো ভয় নেই। যেমন করে পারি মারের হাত থেকে তোকে বাঁচাবই। স্থবির, তুই জানিস না, তোকে আমি কত ভালোবাসি, বড় হলে বুঝতে পারবি। তোর জন্যে আমি প্রাণ পর্যন্ত দিতে পারি।

রাত্রি তখন প্রায় ভোর হয়ে এসেছে। গোষ্ঠদিদি আমায় চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে নীচে পাঠিয়ে দিলে। বিছানায় শুয়ে বোধ হয় একটু তন্দ্রা এসেছিল। এমন সময় মার কণ্ঠস্বরে আমার ঘুম ভেঙে গেল। তাড়াতাড়ি উঠে মুখ ধুয়ে চায়ের জায়গায় গিয়ে উপস্থিত হলুম। তখনও বাড়ির আর কেউ সেখানে হাজির হয়নি। চা খাবার আগেই মাকে জিজ্ঞাসা করলুম, হ্যাঁ মা, বাবাকে চিঠিখানা দিয়েছিলে?

না, কিসের চিঠি ওখানা?

আমাকে ইস্কুল থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে।

আমার কথা শুনে মা এমন চেঁচামেচি করতে শুরু করে দিলেন যে, ৰাবা সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। মা বললেন, তোমার গুণধর ছেলেকে ইস্কুল থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে।

বাবা আমায় জিজ্ঞাসা করলেন, কেন?

সত্যি কথা বলতে কি, ঠিক কোন বিশেষ অপরাধটির জন্যে আমাকে তাড়িয়ে দেওয়া হল, তার স্পষ্ট ধারণা আমার নিজেরই ছিল না।

আমি বললুম, জানি না।

সেইখানেই কিল চড় লাথি এক পক্কড় হয়ে গেল। তারপরে তিনি একটা ঘরে আমায় নিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়ে প্রথমে হেডমাস্টারের দেওয়া চিঠিখানা পড়লেন। তারপরে জিজ্ঞাসা করলেন, কেন তাড়িয়ে দিয়েছে বল, আজ তোমার শেষ দিন।

আজ যে আমার শেষ দিন, সে জ্ঞান আমারও ছিল; তবু শেষ মিনতি করে বলুম, কেন তাড়িয়ে দিয়েছে, তা সত্যিই আমি জানি না। আপনি হেডমাস্টারমশায়কে জিজ্ঞাসা করে তারপরে আমাকে যা ইচ্ছা হয় করুন।

বাবা সে কথা গ্রাহ্য না করে আমায় মারতে শুরু করলেন। আমার চিৎকার শুনে গোষ্ঠদিদি এসে দেখলে, দরজা বন্ধ। ঘরের ভেতরে আমি চিৎকার করতে লাগলুম, বাইরে দরজা ধরে গোষ্ঠদিদি কাঁদতে লাগল। আর আমার চিৎকারের সঙ্গে অস্থিরও তারস্বরে চেঁচিয়ে কাঁদতে আরম্ভ করে দিলে। সেই ভোর থেকে বেলা ন’টা অবধি প্রহার দিয়ে বাবা আমাকে নিয়ে চললেন হেডমাস্টারমশায়ের বাড়ি।

মার খেয়ে আমার চেহারা এমন বদলে গিয়েছিল যে হেডমাস্টার আমাকে দেখে একেবারে চমকে উঠলেন। তিনি বাবাকে বললেন, এমন করে প্রহার করা আপনার উচিত হয়নি। ইস্কুল থেকে বিতাড়িত হবার মতো কোনো অপরাধ স্থবির করেনি। ইস্কুলের মালিকমশায় চান না যে, ও ওখানে পড়ে।

বাবা জিজ্ঞাসা করলেন, কেন?

হেডমাস্টারমশায় আমতা-আমতা করতে লাগলেন। তারপরে বাবাকে একটা আলাদা ঘরে নিয়ে প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে কি সব বললেন।

বাবা আমাকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে এসে বললেন, যাও, চান-টান করে ইস্কুলে যাও। আমি স্কুলে যেতে লাগলুম। ঠিক হল বছরটা পুরো না হওয়া পর্যন্ত আমি সেইখানেই পড়ব। আসছে বছরে অন্য ইস্কুলে গিয়ে ভর্তি হব।

এই ঘটনায় আমার জীবন সম্পূরূপে পরিবর্তিত হয়ে গেল। পড়াশুনোর প্রতি যে অনুরাগ ও মনোযোগ এসেছিল, তার মূল পর্যন্ত মন থেকে উৎপাটিত হয়ে গেল। বাবা আমার কোনো আবেদন ও মিনতি গ্রাহ্য না করে আগে শাস্তি দিয়ে পরে বিচার করলেন, এজন্য তাঁর ওপর এমন ক্রোধ হল যে, মনে মনে একেবারে দৃঢ়সংকল্প করে ফেললুম, এবার মারতে এলে আমিও দু-এক হাত এমন চালাব যে, ভবিষ্যতে আমাকে প্রহার করবার সময় আক্রমণ ও আত্মরক্ষা দু-দিকেই তাঁকে সমান নজর রাখতে হবে। কিন্তু আমার বয়স তখন মাত্র তেরো। সেই বয়সেই আমরা যথেষ্ট শারীরিক শক্তি অর্জন করেছিলুম বটে, কিন্তু বাবার সঙ্গে পেরে ওঠবার শক্তি কোথায় পাব? তাই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলুম, সবার আগে গায়ের জোর বাড়াতে হবে।

লতুদের বাড়িতে যাবার রাস্তায় একটা মাঠ পড়ত। সেই মাঠের অনেকখানি জায়গা ঘিরে নিয়ে পাহারাওয়ালারা কুস্তির আখড়া করেছিল। সেখানে প্রকাণ্ড একখানা পাথরের গায়ে তেল-সিঁদুর দিয়ে মহাবীরের মূর্তি আঁকা ছিল ও মাঝে মাঝে খুব ধুমধাম করে পুজো হত। মহাবীরের পুজোর জন্যে অনেক মহিষ ও গরুর গাড়ির গাড়োয়ান ও চৌধুরী অর্থাৎ তাদের সর্দার সেখানে ব্যায়াম করতে আসত। তা ছাড়া অনেক সাংঘাতিক চরিত্রের গুণ্ডাও সেখানে আসত যেত। আমরা দু-ভাই মাঝে মাঝে আখড়ার মধ্যে ঢুকে তাদের কুস্তি দেখতুম, ও দু-একজনের একটু-আধটু মৌখিক ভাবও হয়েছিল। বাবাকে মারবার উত্তেজনায় আমরা এই আখড়ায় গিয়ে ভর্তি হলুম ও রোজ ইস্কুল থেকে ফিরে সেখানে গিয়ে কুস্তি সেরে সেইখানেই স্নান করে পরিষ্কার হয়ে লতুদের ওখানে যেতে আরম্ভ করলুম। গোষ্ঠদিদি রোজ আমাদের জন্যে বাদাম ও মিছরির শরবত তৈরি করে রাখত ও সপ্তাহের মধ্যে তিন-চার দিন দুটি করে মুরগির বাচ্চা রোস্ট হতে লাগল।

আমরা প্রতিদিন দু-ভাই নিয়ম করে মহাবীরের মাথায় ফুল ও বাতাসা চড়াতে লাগলুম। এসব পয়সা অবিশ্যি গোষ্ঠদিদির তহবিল থেকে খরচ হত। ব্রাহ্ম-বাড়িতে আমাদের জন্ম হয়েছিল। পরিবারে ও পরিবারের ধর্মবন্ধুদের কাছে নিশিদিন শুনেছি যে, পুতুলপুজো করে হিন্দুরা ঈশ্বরের অবমাননা করে, এসব সংস্কার সত্ত্বেও স্রেফ প্রাণের দায়ে আমাদের পুতুলের শরণাপন্ন হতে হল। তার ওপর অতি নিম্নস্তরের সেই গরুর গাড়ির সর্দার ও গুণ্ডা হিন্দুদের, মহাবীরের ওপর নিষ্ঠা দেখে আমরাও মহাবীরের মহাভক্ত হয়ে উঠলুম। মহাবীরকে শত শত ধন্যবাদ! তিনি আমাদের শরীরে শক্তি তো দিলেনই, উপরন্তু বাবাকে সুমতি দিলেন, কারণ এর পর আমাকে তিনি আর কখনও সেরকম প্রহার করেননি। বাড়িতে দিনরাত ভয়ে ভয়ে থাকা তো চুকলই, বরং কলকাতার সেরা সেরা গুণ্ডা এবং গরু ও মোষের গাড়ির সর্দারদের প্রাণের ইয়ার হওয়ার ফলে আমরা নিজেরাই এক-একটি ভয়ের কারণ হয়ে উঠলুম। মহাবীরকে ধন্যবাদ! সে শক্তি ও প্রতিপত্তির অপব্যয় আমরা কখনও করিনি।

একদিন বিকেলে অস্থিরের শরীরটা ভালো না থাকায় আমি একলাই বেরিয়েছিলুম। সন্ধ্যার সময় বাড়ি ফিরে অস্থিরের মুখে শুনলুম যে, কাল রাত্রে পাগলা সন্ন্যেসী আমাদের দুজনকে নেমন্তন্ন করেছেন।

রাত্রে গোষ্ঠদিদি এসে মাকে আবার বলে গেল, কাল ওরা দুজনে আমাদের ওখানে খাবে–শ্বশুরমশায় নেমন্তন্ন করেছেন।

পরদিন একটু তাড়াতাড়ি লতুদের বাড়ি যাওয়া হল। উদ্দেশ্য, দিন থাকতে ফিরে পাগলা সন্নোসীর ঘরে গিয়ে জমা যাবে। আড্ডা সেরে উঠব-উঠব মনে করছি, এমন সময় লতু আমায় আলাদা ডেকে নিয়ে বললে, একটা খুব গোপনীয় কথা আছে, না শুনে যেতে পাবে না।

বল।

না, এখন বলব না। সেই সন্ধের পর বলব, তার আগে যাওয়া হবে না বলে দিচ্ছি।

ওরে বাবা! আজ সন্ধের সময় পাগলা সন্ন্যেসীর ওখানে নেমন্তন্ন আছে, ঠিক সময়ে না গেলে ভদ্রলোক বড্ড দুঃখিত হবেন।

সে-সব জানি না। বলে লতু ফিরে চলল। আমি তাকে টেনে নিয়ে বললুম, বল না লতু, লক্ষ্মী লতু আমার!

লতু আমার গলা জড়িয়ে ধরে কানে কানে বললে, না না না, এখন যাওয়া হবে না। –বলে ছটকে পালিয়ে গেল।

কি বিপদেই পড়লুম, লতুটা কি যে করে!

খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে আবার গিয়ে সবার সঙ্গে বসা গেল। লতু আগেই এসে সেখানে জুটেছিল। তার হুকুম না পেলে আমার যাবার যে জো নেই, সে-বিষয়ে সে একেবারে নিশ্চিন্ত। ওদিকে অস্থির তাড়া দিতে লাগল, কি রে, যাবি না?

শেষকালে অস্থিরকে বলতে হল, তুই যা, আমার যেতে একটু দেরি হবে।

সঙ্গে সঙ্গে এ-কথাও বলে দিলুম, বাড়িতে আমার খোঁজ হলে বলে দিস, সে সন্ন্যেসীর ঘরে আছে।

অস্থির চলে গেল। সন্ধে হল, কিন্তু লতু কোনো কথাই বলে না। ওদিকে আমার মনের অবস্থা খুবই চঞ্চল হতে লাগল। লতুটা যে কি করে!

ইতিমধ্যে সে যে উঠে কোথায় চলে গেল, আধঘণ্টা কোনো খোঁজ নেই। শেষকালে লতুকে ফাঁকি দিয়েই পালাব মনে করে সবার কাছে বিদায় নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গুটিগুটি কয়েক পা এগিয়েছি, এমন সময় কোথা থেকে লতু এসে আমায় ধরে বললে, চোর! গুটিগুটি পালানো হচ্ছে!

তুমিই তো পালিয়েছিলে। তুমি আসছ না দেখে চলে যাচ্ছিলুম। কি প্রাইভেট কথা আছে, বল?

এখানে না, ওই ছাতে চল।

দুজনে ছাতে উঠলুম। লতু বললে, এ ছাতে নয়, ওই ওপরের ছাতে।

লতুদের ছাতের ওপরে একটা বড় ঠাকুরঘর ছিল। তারও ছাতে ওঠা যেত। সেটা ছিল তাদের পাড়ার সবচেয়ে উঁচু ছাত। সেই ছাতে ওঠা হল।

সেদিন বোধ হয় শুক্লা ত্রয়োদশী তিথি ছিল। আকাশ ও ধরণীতে জ্যোৎস্নার প্লাবন ছুটেছে–যতদূর চোখ যায় আলোয় আলো, যেন আনন্দের মুক্তধারা, কোথাও কোনো মালিন্য নেই। লতু আমায় ছাতের এক কোণে ডেকে নিয়ে গেল। তারপর বুকের ভেতর থেকে একটা মোটা বেলফুলের মালা বের করে আমার গলায় পরিয়ে দিয়ে প্রণাম করলে।

আমার মনে হল, চারিদিকেই সেই জ্যোৎস্নারাশির সঙ্গে আমি যেন রেণু রেণু হয়ে একাকার হয়ে গেছি। ফুলমালার স্পর্শে অস্থিমাংসের অস্তিত্ব যেন আমার লোপ পেয়েছে, বায়বীয় শরীর নিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি।

লতু উঠে দাঁড়াতেই আমার গলা থেকে মালাটা নিয়ে তার গলায় পরিয়ে দিলুম। তারপর প্রাণপণে আমরা পরস্পরকে আঁকড়ে ধরলুম। আমার মনে হতে লাগল, সেই জ্যোৎস্না-সাগরে আমরা দুটিতে ভেসে চলেছি–লক্ষ তরঙ্গের আলোড়নে শত সহস্র জন্মের অভিজ্ঞতা মথিত হয়ে উঠতে লাগল আমাদের চারিদিকে। সেই বিরাট নিস্তব্ধতার মধ্যে কানে শুধু একটা আওয়াজ শুনতে লাগলুম, ধক ধকধক।

সেটা কার বুকের আর্তনাদ, তা ঠিক বলতে পারি না।

লতু বললে, আজ আমাদের বিয়ে হল। এই বিয়ের সাক্ষী রইল ওই চাঁদ। এ-কথা চিরদিন গোপন থাকবে, শুধু জানলে ওই চাঁদ—আজ থেকে চাঁদ আমাদের সঙ্গে এই সম্বন্ধে বাঁধা রইল। আমি মরবার আগে এ-কথা আর কারুকে বলো না।

আবার প্রগাঢ় আলিঙ্গনে আমাদের বাঁধন দৃঢ়তর হল। আমায় একটু চুমু খেয়ে সঙ্গে সঙ্গে পিঠে দুম করে একটা কিল মেরে লতু বললে, যা তোর পাগলা সন্ন্যেসীর কাছে!

হায় পাগলা সন্নোসী, এমন সন্ধেটি কি তোমার ঘরে কাটাবার জন্যে তৈরি হয়েছিল।

লতুদের ওখান থেকে একরকম দৌড়ে পাগলা সন্ন্যেসীদের বাড়িতে গেলুম। বাড়িতে ঢুকেই অস্থিরের হাসির হররা কানে গেল। আমাদের দুই ভাইয়ের খুব চেঁচিয়ে হাসার অভ্যাস ছিল। এই অসভ্যতার জন্যে বাড়িতে প্রায়ই বকুনি খেতে হত। অস্থিরের হো-হো হাসি শুনে তিন লম্ফে সিঁড়ি পার হয়ে ঘরে ঢোকামাত্র অস্থির চিৎকার করে বললে, স্থরে, এতক্ষণে এলি? আমরা এক্ষুণি উঠছিলুম খাবার জন্যে।

পাগলা সন্ন্যেসী খাটের ওপর আধ-শোয়া বসেছিলেন। তিনি উঠে বসে বসলেন, রামবাবুর বুঝি এতক্ষণে মজলিশ ভাঙল?

আমি একটু লজ্জিত হয়ে অস্থিরের পাশে বসামাত্র সে, বললে পাগলা সন্ন্যেসী, স্থেেক একটু ওষুধ দিন তো।

কি ওষুধ রে?

মধু মধু, এ ওষুধ খেলে যে-কোনো ব্যারাম সেরে যাবে।–এই বলে সে আমার মুখের কাছে মুখে নিয়ে এসে হা দিলে। একটা বিশ্রী গন্ধ পেলুম। এমন গন্ধ ইতিপূর্বে কখনও নাকে যায়নি। কিন্তু খুব সম্ভব পূর্বজন্মের অভিজ্ঞতার ফলে তখনই বুঝতে পারলুম, সেটা কিসের গন্ধ।

খাটের ওপর থেকে কতগুলো বই সরিয়ে পাগলা সন্ন্যেসী একটা কালো পেট-মোটা অদ্ভুত আকারের বোতল বের করলেন। খাটের ওপরে বসেই ঘাড় নীচু করে খাটের তলা থেকে তিনটে বেঁটে পল-কাটা কাঁচের গেলাস টেনে খাটের ওপরে তুলে সেগুলোর মধ্যে ওষুধ ঢালতে আরম্ভ করলেন। দৃশ্যটি আমি জীবনে এই প্রথম দেখলুম। অস্থির কিন্তু এমন একটা ভাব দেখাতে লাগল, যেন এরকম ব্যাপার তার চোখের সামনে সর্বদাই ঘটছে।

দেখলুম, পাগলা সন্ন্যেসী একটা গেলাসে অনেকখানি আর দুটিতে একটু একটু করে মধু ঢাললেন, তারপরে ঘটি থেকে একটু করে জল সবগুলোতে দিয়ে একটা গেলাস আমায় এগিয়ে দিয়ে বললেন, এস রামবাবু।

গেলাসটা তাঁর হাত থেকে নিয়ে নিলুম। অস্থির যে আমার চাইতে এককাঠি বেড়ে যাবে, তা সহ্য হচ্ছিল না। গেলাসটা মুখের কাছে নিয়ে যেতেই একটা বিশ্রী তীব্র গন্ধ পেলুম। দ্বিতীয়বার গেলাসটাকে নাকের কাছে আনবার আগেই অস্থির বললে, এই ‘চিনচিন’ করলি না?

অস্থির নিজের গেলাসটা বাড়িয়ে পাগলা সন্ন্যেসীর গেলাসে ঠন করে ঠেকালে। আমি দেখাদেখি আমার গেলাস বাড়িয়ে তাদের গেলাস দুটোতে ঠেকালুম। পাগলা সন্ন্যেসী বললেন, To your future.

আমরাও সমস্বরে বললুম, To your future.

আমাদের হাতেখড়ি হল। অস্থিরের বয়েস বারো, আমার বয়েস চোদ্দ আর পাগলা সন্ন্যোসীর বয়েস তিয়াত্তর

পাগলা সন্ন্যেসী বলতে লাগলেন, রামবাবু আর লক্ষ্মণবাবু, ব্রাদার তোমাদের একটা কথা বলবার জন্যে ডেকেছি। পৃথিবী থেকে বিদায় নেবার আগে তোমাদের দু-ভায়ের সঙ্গে ভাব হয়ে এই কটা বছর আমার পরমানন্দে কাটল। আমি চলে যাব, তোমরা এখনও অনেকদিন থাকবে আমার কথা মনে রেখো ভাই।

সঙ্গে সঙ্গে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, তোমাদের বয়স যদি বেশি হত কিংবা আমার বয়েস যদি কিছু কম হত-

বেশ হাসিখুশি হুল্লোড় চলছিল, হঠাৎ এইসব কথায় ঘরের মধ্যে যেন একটা বিষাদের ছায়া এসে পড়ল। পাগলা সন্ন্যেসী বলে যেতে লাগলেন, একটা অনুরোধ তোমাদের কাছে করব ব্রাদার, রাখতে হবে।

বলুন।

আমার অবর্তমানে বউমাকে অর্থাৎ তোমাদের গোষ্ঠদিদিকে তোমরা দেখো, বুঝলে?

তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, বাড়ি-ঘর সব রইল, টাকা-পয়সার অভাব আমি রেখে যাবো না। তোমরা শুধু দেখবে, ও যেন ভেসে না যায়। ও তোমাদের ভালোবাসে, তোমাদের কথার অবাধ্য হবে না।

পাগলা সন্ন্যেসীর ওখানে খাওয়াদাওয়া সেরে বাড়িতে এসে শুতে প্রায় সাড়ে এগারোটা বেজে গেল। ভোরবেলা গোষ্ঠদিদির আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। তাদের বাড়ির দু-তিনটে গরাদবিহীন জানলা খুললে আমাদের বাড়ির সব দেখা যেত। এই একটা জানলা খুলে গোষ্ঠদিদি ডাকছিল, মা, মা, মা গো, একবার এদিকে আসুন না।

মা নীচে ছিলেন, বোধ হয় গোষ্ঠদিদির আওয়াজ কানে যায়নি। আমি তড়াক করে বিছানা ছেড়ে জানলার ধারে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলুম, কি হয়েছে দিদি?

গোষ্ঠদিদি কাঁদতে কাঁদতে বললে, বাবা মরে গেছে রাম-ভাই।

চেঁচামেচি শুনে বাবা মা দাদা সবাই সেখানে এসে উপস্থিত হল। আমরা তখুনি জানলা টপকে পাগলা সন্ন্যেসীর ঘরে গিয়ে দেখলুম, চিত হয়ে তিনি শুয়ে আছেন, বুকের ওপরে হাতদুটি জোড় করা, মুখ ঈষৎ ফাঁক, চোখের দুইপাশে অশ্রুর রেখা, যেন নিশ্চিন্ত আরামে ঘুমুচ্ছেন।

পাগলা সন্ন্যেসীর বাড়িতে এই ক’বছরের মধ্যে কখনও কোনো আত্মীয়-স্বজনকে দেখি নি; কিন্তু তিনি মারা যাওয়া মাত্র, বোধ হয় ঘণ্টা-দুয়েকের মধ্যে, আহিরীটোলা থেকে চলে এল ভাগ্নের দল, নেবুতলা থেকে এসে গেল ভাইপোর দল, পৌত্র ও দৌহিত্রে বাড়ি ভরে গেল। বড় ছেলের কাছে টেলিগ্রাম গেল, দিন ছয় বাদে সেও এসে পড়ল। যে যেখানে ছিল, সবাই এল, শুধু এল না আমাদের গোষ্ঠদিদির দেবতা।

শ্রাদ্ধশান্তি হয়ে যাবার পর সমস্যা উঠল, গোষ্ঠদিদির খরচ চলবে কি করে? সে কোথায় থাকবে?

ভাশুর জানালেন, বাবা তো কিছুই রেখে যাননি, আমারও এমন কিছু অবস্থা নয় যে, ভাদ্রবউকে নিয়ে গিয়ে রাখি। বউমা তাঁর নিজের লোকজনের কাছে গিয়ে থাকুন; আমার যখন সুবিধে হবে, আমি কিছু কিছু করে সাহায্য করতে পারি।

ভাদ্রবউ জানালে, তিন চুলোয় কেউ থাকলে আপনার ভাইয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে হত না। কারুর সাহায্যে আমার দরকার নেই। আমার স্বামী নিরুদ্দেশ, সেজন্যে এই বাড়ির অর্ধেক ভাগে আমার অধিকার আছে। বাড়ি বিক্রি করে অর্ধেক টাকা আমায় দেওয়া হোক।

ভাশুর পরম পুলকিত হয়ে জানালেন, বাবা বাড়ি বন্ধক রেখে গিয়েছেন। বিক্রি করে পাওনাদারদের সব দেনা মিটবে কি-না সন্দেহ।

এটা যে একেবারে মিথ্যে কথা, সে-বিষয়ে সন্দেহ ছিল না; কিন্তু গোষ্ঠদিদির হয়ে কে লড়বে? সব শুনে সে চুপ করে রইল।

আমাদের বাড়িতে কয়েকটি বিধবা ও অনাথ ছেলে থাকত। এরা ছিল বাবার পেটোয়া। আমাদের ওপর বাবার শাসন যতই কঠিন হোক না কেন, এদের প্রতি তাঁর সহৃদয়তার মাত্রা প্রায় অপরাধের সীমায় গিয়ে পৌঁছত। এরা হাজার অন্যায় করলেও কারুর কিছু বলবার জো ছিল না। এদের নিয়ে মার সঙ্গে বাবার খিটিমিটি বাধত এবং তাই নিয়ে সংসারে মাঝে মাঝে ভারি অশান্তি হত। আমরা মার দলে থাকলেও ভরসা করে কাউকে কিছু বলতে পারতুম না। গোষ্ঠদিদির বাসস্থানের সমস্যা উঠতেই আমরা দু-ভাই পরামর্শ করে ঠিক করলুম, তাকে আমাদের বাড়িতেই এনে রাখতে হবে। এও ঠিক হল, প্রস্তাবটা বাবার কাছে পাড়তে হবে, কারণ বাড়িতে যে কয়টি মেয়ে আছে তাদের নিয়েই মা ব্যতিব্যস্ত হয়ে আছেন, নতুন আগন্তুকের সম্ভাবনাকে তিনি আমলই দেবেন না।

একদিন বিকেলে সাহস করে বাবাকে গোষ্ঠদিদির কথা বলে ফেলা গেল। দুজনে মিলে গোষ্ঠদিদির অবস্থার এমন বর্ণনা করলুম যে, বাবার চোখে জল এসে গেল। ছেলেবেলায় বাবা অনেক সাংসারিক দুঃখকষ্ট পেয়েছিলেন, বোধ হয় সেইজন্যে দুঃখীজনের প্রতি তাঁর স্বাভাবিক মমতা অত্যন্ত প্রবল ছিল। আমাদের কথা শুনে তিনি বললেন, নিশ্চয় নিশ্চয়, আমরা থাকতে গোষ্ঠ আবার যাবে কোথায়? যাও, তাকে এখুনি নিয়ে এস; বল গিয়ে–তোমার কোনো ভাবনা নেই, আমরা আছি।

আমরা কাজ ফতে করে উৎফুল্ল হয়ে চলেছি, এমন সময় বাবা বললেন, আচ্ছা দাঁড়াও, আজ আর তাকে কিছু বলো না, তোমাদের মাকে একবার জিজ্ঞাসা করা দরকার।

সে-রাত্রে বাবা গোষ্ঠদিদিকে নিয়ে আসবার প্রস্তাব করা মাত্র মা একেবারে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বললেন, তোমার কি বুদ্ধিসুদ্ধি একেবারে লোপ পেয়ে গেল?

এক ধমকেই বাবা চুপ হয়ে গেলেন। তিনি হয়তো ভাবতে লাগলেন, বুদ্ধিসুদ্ধি তাঁর যে কোনোকালে ছিল সে-কথাটা তাঁর স্ত্রী তাহলে প্রকারান্তরে স্বীকার করছেন।

কিন্তু ব্যাপারটা এইখানেই শেষ হয়ে যায় দেখে আমরা দুজনে একটু একটু করে গোষ্ঠদিদির হয়ে বলতে লাগলুম। দু-চারটে কথা বলতে না-বলতে মা ঝঙ্কার দিয়ে উঠলেন, চুপ কর তোরা, এই বয়েস থেকেই বাপের ধারা নিচ্ছেন আর কি!

মা বাবাকে বলতে লাগলেন, গোষ্ঠকে যে বাড়িতে নিয়ে আসবে বলছ, একবার তার স্বামীর কথা ভেবে দেখেছ? ও এখানে থাকুক, তারপর একদিন সেই মাতাল বদমাইশটা এসে এখানে উঠুক আর বাড়িতে মদ আর গাঁজার হল্লা চলুক।

মদ-গাঁজার নাম হতেই বাবা একেবারে চমকে উঠলেন, না না না, ও-কথাটা আমার মনেই হয়নি, তুমি ঠিকই বলেছ, না না না।

গোষ্ঠদিদির ভাশুর মাস-তিনেক কলকাতায় থেকে বাড়ি বিক্রি করে শ’পাঁচেক টাকা তার হাতে দিয়ে বললেন, বাড়ি বেচে পাওনাদারদের দেনা ও অন্য খরচ চুকিয়ে হাজারটি টাকা বেঁচেছে। তার পাঁচশো তোমায় দিলুম। আমি পরশু মঙ্গলবারের স্টিমারে চলে যাচ্ছি। বাড়ি যারা কিনেছে তারা এক মাসের সময় দিয়েছে, এই এক মাসের মধ্যে অন্য জায়গা ঠিক করে তুমি চলে যেয়ো

সেই রাত্রেই গোষ্ঠদিদি সব কথা বলে আমাদের বললে, একদিনের মধ্যে যেখানে হোক আমার জন্যে একখানা ঘর ঠিক করে দে।

কলকাতা শহরে ইলেকট্রিক ট্রাম যখন প্রথম চলতে আরম্ভ করে, তখন সেই ঘোড়াবিহীন গাড়ি দেখবার জন্যে সকালে সন্ধ্যায় কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের দুই ফুটপাথে বিপুল জনতা হত। রাত্রির অন্ধকারে ট্রলির চাকায় ও গাড়ির চাকায় ঝকঝক করে বিদ্যুৎ ঝলকাত। বিনি পয়সায় এই আতশবাজি দেখার জন্যে, বিশেষ করে রাতেই, লোক জমত বেশি। আমাদের তো কোনো পরব ফাঁক যাবার জো ছিল না। প্রায় রোজই রাত্রে পড়াশুনা শেষ হবার পর বাড়ি থেকে দশ মিনিটের ছুটি নিয়ে ঘণ্টা-দেড়েক ধরে ট্রাম-বাজি দেখে বাড়ি ফিরতুম। এইরকম এক রাত্রে তামাশা দেখে বাড়ি ফিরছি, এমন সময় দেখি, একটি ছোট্ট মেয়ে, বয়স বোধ হয় তার সাত-আট বছর হবে, পথ হারিয়ে”মা গো’ ‘মাসি গো’ বলে প্রাণপণে চিৎকার করছে আর কাঁদছে। মেয়েটির চারদিকে বেশ একটি ভিড় জমেছে, সবাই তাকে নানা প্রশ্নে আরও ব্যস্ত করে তুলেছে। মেয়েটির দিকে এগিয়েই আমরা তাকে চিনতে পারলুম। আমাদের ইস্কুলের পথে একটা গলির মধ্যে প্রায়ই তাকে খেলতে দেখতুম।

অস্থির তার কাছে গিয়ে বললে, খুকী, তোমার অমুক জায়গায় বাড়ি না?

সে হাঁ-না কিছুই বললে না, শুধু কাঁদতে লাগল। চল খুকী, তোমায় বাড়ি পৌঁছে দিই। –বলে আমরা তাকে নিয়ে চললুম। ভিড়েরও কেউ কেউ আমাদের সঙ্গে চলল।

আমরা ঠিকই আন্দাজ করেছিলুম। মেয়েটিকে নিয়ে তাদের বাড়িতে গিয়ে দেখি যে, তার মা আর মাসি মড়াকান্না জুড়েছে, মেয়ের শোকে যায়-যায়, এমন সময় আমাদের সঙ্গে তাকে দেখা মাত্র দুজনে মিলে প্রহার দিতে আরম্ভ করলে। অনেক কষ্টে তাদের কবল থেকে তাকে রক্ষা করে সে-রাত্রে বাড়ি ফেরা গেল।

এর পর থেকে ইস্কুলে যাবার মুখে অথবা ফেরবার পথে প্রায়ই আমরা তাদের বাড়িতে গিয়ে মেয়েটির খোঁজ করতুম। মেয়েটির নাম ছিল শৈল, সবাই তাকে ‘শৈলী’ বলে ডাকত। শৈলর মা ও মাসি আমাদের দুই ভাইকে ‘বেম্মজ্ঞানীদের ছেলে’ বলে ডাকত। মা ও মাসি উভয়েই ছিল রুগ্না, কিন্তু কথাবার্তা ছিল ভারি মিষ্টি। তাদের পরিবারে পুরুষ কেউ ছিল না, মা ও মাসি কাজও কোথাও করত না, কি করে তাদের সংসার চলত জানি না। মাসি মাঝে মাঝে পিঠে ও গজা বানিয়ে আমাদের খেতে দিত। বেশ লোক ছিল তারা।

একটা অতি পুরাতন বাড়ির একতলায় দুখানা ঘর ভাড়া নিয়ে তারা থাকত। একতলায় আরও কতগুলো অন্ধকার ঘরে ভাড়াটে ভর্তি ছিল। বাড়ির দোতলায় একখানা মাত্র ঘর ছিল, কিন্তু সে-ঘরখানায় পাঁচ টাকা ভাড়া ছিল বলে ভাড়া হত না।

গোষ্ঠদিদি ঘর ঠিক করবার কথা বলা মাত্র আমরা শৈলীর মা ও মাসির কাছে গিয়ে তাদের বাড়ির দোতলার ঘরখানা তার জন্যে ঠিক করে ফেললুম। গোষ্ঠদিদির ভাশুর বর্মা যাবার আগেই তাকে নিয়ে গিয়ে শৈলদের দোতলায় তার নতুন সংসার পেতে দিলুম।

আমি একাধিক সাধুমুখে শুনেছি যে, সাধকেরা যদি বুঝতে পারেন, দৈহিক অপটুত্ব তাঁদের যোগে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তা হলে নতুন কলেবর লাভের জন্য তাঁরা স্বেচ্ছায় দেহত্যাগ করেন। আমার মনে হয়, পাগলা সন্ন্যেসী উপযুক্ত শিষ্যবোধে আমাদের দু-ভাইকে মাধুর্য-সাধনের দীক্ষা দিয়ে ইহলোক থেকে বিদায় নিলেন।

যে অজ্ঞাত শক্তি এই বিশ্বপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করছে, সেদিনকার সেই রাত্রিটুকুর মধ্যে সে আমার জীবনে যে বিচিত্র অভিজ্ঞতার প্রবাহ নিয়ে এল, তা ভোলবার নয়। সন্ধ্যার সময় লতুর সঙ্গে গান্ধর্ব বিবাহে আবদ্ধ হওয়া, রাত্রি নটা নাগাদ জীবনে সর্বপ্রথম মধুর আস্বাদন ও শেষরাত্রে পাগলা সন্ন্যেসীর অকস্মাৎ রঙ্গমঞ্চ থেকে অপসরণ, আমাকে একেবারে বিহ্বল করে ফেললে।

গোষ্ঠদিদিকে শৈলদের বাড়িতে স্থিতি করে দিয়ে সন্ধেবেলায় যখন বাড়ি ফিরলুম, তখন আমাদের বিষণ্ণ মুখ দেখে মা বাবা পর্যন্ত সান্ত্বনা দিতে লাগলেন। তবুও গোষ্ঠদিদি ও পাগলা সন্ন্যোসী যে আমাদের কি ছিল, তা বাড়ির কেউ জানত না। যে-বাড়ি একরকম আমাদের নিজেরই ছিল, পাগলা সন্ন্যেসী আর পাঁচ-সাত বছর জীবিত থাকলে হয়তো যে-বাড়ির মালিকই আমরা হতুম, সে বাড়ির সদর দরজায় তালা পড়ল। দোতলার বারান্দায় ইংরেজি ও বাংলায় কার্ড ঝুলল –বাড়ি ভাড়া। রাত্রে বাতি নিবিয়ে বিছানায় শুয়ে ছাদের দরজায় কখন পাঁচটা টোকা পড়বে তা শোনবার জন্যে আর উৎকর্ণ হয়ে থাকতে হয় না। জ্যোৎস্নারাতে মনে হতে লাগল, আমাদেরই একান্ত গোষ্ঠদিদি শৈলর মা-মাসিকে নিয়ে ছাতে বসে গল্প করছে।

অদৃষ্ট সেদিন আমার সঙ্গে কি ছলনাই করেছিল–সে কথা মনে হলে হাসিও যেমন পায়, বিস্ময়ও তেমনই জাগে।

মনের যখন এরকম অবস্থা, ঠিক সেই সময় আমাদের বাড়িওয়াল। নোটিশ দিলে, এক মাসের মধ্যে বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে, তার যক্ষ্মা হয়েছে, সে কলকাতায় এসে চিকিৎসা করাবে।

ভালোই হল। সেই অবস্থা আমার ও অস্থিরের পক্ষে অসহ্য হয়ে উঠেছিল। আমরা আবার কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে আমাদের সেই পুরনো বাড়ির কাছেই একটা বড় বাড়িতে উঠে গেলুম।

.

স্বদেশী আন্দোলনের কিছু আগে টহলরাম নামে এক পাঞ্জাবি ভদ্রলোক কলকাতায় এসে খুব হৈ-চৈ লাগিয়ে ছিলেন। ইনি বিডন উদ্যানে প্রত্যহ বিকেলে ইংরিজিতে বক্তৃতা করতেন–ইংরেজ জাত এবং ভারতবর্ষের তদানীন্তন বড়লাট কার্জনের নিত্য বাপান্ত করতেন। তখনকার দিনের ইংরেজ গবর্মেন্ট কি হজমিগুলি খেয়ে যে সে-সব নিছক গালাগালি বরদাস্ত করত, তা গবেষণার বিষয়। এজন্য সে-সময় অনেকে টহলরামকে ইংরেজের গুপ্তচর বলত। যা হোক, আমি, অস্থির ও বিশেষ করে আমাদের বন্ধু প্রভাত টহলরামের একনম্বরের চেলা হয়ে পড়লুম।

টহলরাম ইংরিজিতে একটা গান লিখেছিল, তার প্রথম স্ট্যাঞ্জাটা মনে আছে–

God save our ancient Ind
Ancient Ind once glorious Ind
From Sagar Island to the Sind
From Himalayas to Cape Comorin
May perfect peace ever regin therein.

প্রতিদিন বিডন উদ্যানে বেলা চারটে থেকে সাড়ে পাঁচটা অবধি টহলরাম ইংরেজ জাতকে খিস্তি করত। তারপর দিশি সুরে এই ইংরিজি গানটি গাওয়া হত। পরে এই গান গাইতে গাইতে শোভাযাত্রা করে পথে পথে ঘুরে শঙ্কর ঘোষের লেনে টহলরামের বাড়িতে এসে আমাদের নিজস্ব সভা বসততা।

পড়াশুনার সঙ্গে মনোমালিন্য তো ছিলই, দেশোদ্ধারের হাওয়া লেগে তার সঙ্গে একদম বিচ্ছেদই হয়ে গেল।

এই সময় আবার লাগল রুশ-জাপানে যুদ্ধ। তখনকার দিনে আমরা জাপানকে পরম বন্ধু বলে জানতুম। এর মূলে ছিল কয়েকটি কারণ। প্রথম কারণ হচ্ছে ইংরেজরা মনে করত যে ভারতবর্ষের ওপরে রুশের নজর আছে। রুশকে ঠেকিয়ে রাখবার জন্যে আফগানিস্তানকে তারা বহুদিন অবধি টাকা যুগিয়েছে। এইজন্যে ভারতবাসীরা মনে করত, জাপানের প্রতি ইংরেজ সহানুভূতিসম্পন্ন দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে যে, সে-সময়ে বাঙালি ছেলেদের বিদেশ থেকে নানা বিদ্যে শিখে দেশকে উন্নত করবার একটা বিরাট অনুপ্রেরণা এসেছিল। ইংল্যান্ডের চাইতে জাপানে থেকে লেখাপড়া শিখতে খরচ কম ছিল, ওদিকে আবার কালাপানি পার হয়ে জাত যাবার ভয়টাও ছিল না বলে মাঝামাঝি একটা রফা করে অনেকেই জাপানে যেত।

রুশ-জাপানে যুদ্ধ লাগতেই কলকাতায় জাপানকে সাহায্য করবার জন্যে নানা অনুষ্ঠান হতে লাগল। থিয়েটার, ম্যাজিক প্রভৃতি দেখিয়ে জাপানের নামে টাকা তোলা হতে থাকল। সে-সব টাকা জাপান অবধি পৌঁছত, না, রাস্তাতেই টর্পেডোর আঘাতে জাহাজডুবি হত তা জানি না। মনে পড়ে, সেই হুল্লোড়ে অনেক ছেলেই মেতেছিল, আমরাও কিছু মেতেছিলুম।

এর পরেই এল স্বদেশীর প্লাবন। সেই প্লাবনে আমরা একেবারে গা ভাসিয়ে দিলুম। প্রতিজ্ঞা করা হল–দেশের সেবা করব, ইংরেজের চাকরি করব না, হাইকোর্টের জজিয়তি পেলেও নয়। দেশের সেবা কতখানি করেছি তা জানি না, তবে হাইকোর্টের জজিয়তি কখনও করিনি। প্রতিজ্ঞা অটুট আছে কারণ প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করবার অবসরই ইংরেজ গবর্মেন্ট কোনোদিন আমাকে দিলে না।

গোষ্ঠদিদি নতুন আবহাওয়ার মধ্যে পড়ে নিজেকে দিব্যি মানিয়ে নিলে। তার হাতে বেশ কিছু টাকা ও গয়নাপত্র ছিল, যা দিয়ে সারাজীবন সে ভালোভাবেই কাটাতে পারত। শৈলদের বাড়িতে আরও যে-সব ভাড়াটে থাকত, তারা সকলেই ব্রাহ্মণের জাত। তারা সকলেই তাকে বামুনদিদি বলে খুব খাতির করত। আমরা প্রতিদিন অন্তত পাঁচ মিনিটের জন্যেও তার কাছে গিয়ে তদারক করে আসতুম। মধ্যে মধ্যে সেও আমাদের বাড়িতে এসে একদিন-দুদিন থাকত। এই দিনগুলি যে কি ভালোই লাগত।

মানুষের দেহে রোগের বীজাণু প্রবেশ করা মাত্র যেমন সারা দেহের মধ্যে তাকে প্রতিরোধ করবার সাড়া পড়ে যায়, তেমনই মনের মধ্যে কোনো বাসনা বা সংকল্প জাগা-মাত্র প্রকৃতির মধ্যে আলোড়ন শুরু হয়, আর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেখানে প্রতিরোধের সাড়াই জাগে। শুধু তাই নয়, প্রকৃতি মানুষকে দিয়েই তার ইচ্ছার সাফল্যের বিরুদ্ধেই কাজ করিয়ে নিতে থাকে। এই ব্যাপার আমি নিজের জীবনে বার বার প্রত্যক্ষ করেছি।

লতুকে আমি ভালোবাসতুম, সেও আমাকে ভালোবাসত। আমাদের সামাজিক মিলন হওয়া সম্ভব কি-না, যদি-বা হয় তা হলে ভবিষ্যতে আমাদের সংসারযাত্রা নির্বাহিত হবার উপায় কি হবে, সে-সম্বন্ধে কোনো প্রশ্নই দুজনের কারুর মনে উদয় হয়নি। আমাদের স্থূল দৃষ্টির অন্তরালে যে বিরাট শক্তি এই দুনিয়া-যন্ত্রকে নিয়ন্ত্রিত করছে, সে-ই এই মিলনের ঘটকালি করেছিল। আমাদের মধ্যে কখনও বিচ্ছেদ আসতে পারে অথবা কোনো শক্তি আমাদের একজনকে আর একজনের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতে পারে, এমন সম্ভাবনার কথা কল্পনাতেও আমাদের মনে আসেনি।

কার্তিক মাস। পুজোর ছুটির পর সবেমাত্র ইস্কুল খুলেছে, এই সময় একদিন লতুর মা আমাকে বললেন স্থবির, শুনেছিস, সামনের অঘ্রানে লতুর বিয়ে যে।

কোথায়? ·

ছেলে পশ্চিমে সরকারি কাজ করে, খুব ভালো কাজ। খুব লেখাপড়া জানে, খুব সুন্দর দেখতে। তাদের বাড়িই পশ্চিমে, লতুর উপযুক্ত বর হয়েছে।

লতু সেখানে ছিল না। জিজ্ঞাসা করলুম, লতু কোথায়?

মা বললেন, সে লুকিয়ে বেড়াচ্ছে। বিয়ের কথা শুনে লজ্জা হয়েছে বোধ হয়।

লতুকে খুঁজে বার করলুম। তেতলার একটা ঘরের কোণে হাঁটুতে মুখ লুকিয়ে সে বসে ছিল। আমি কাছে গিয়ে ডাকতেই সে মুখ তুলে আমার দিকে চাইলে, চোখে তার একফোঁটা অশ্রু নেই।

আমি পাশে বসতেই আমার একখানা হাত মুঠো করে ধরে নিজের কোলের ওপর তুলে নিয়ে বললে, শুনেছিস?

আমি শুধু ঘাড় নেড়ে জানালুন, হ্যাঁ। গলা দিয়ে কোনো শব্দ বেরুল না।

ঠিক সেইরকম করে আমরা বসে রইলুম। কারুর মুখে কোনো কথা নেই, কারুর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ নেই। নীচে আনন্দ-কোলাহল চলছিল, তারই আওয়াজ এক-আধটা ছিটকে এসে আমাদের কানে লাগতে লাগল। মধ্যে মধ্যে লতু আমার হাতখানা জোরে চেপে ধরতে লাগল। মধ্যে মধ্যে মনে হতে লাগল, তার সর্বাঙ্গ যেন থরথর করে কাঁপছে।

আমাদের চারদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে উঠতে লাগল। ঠাকুরঘরে শাঁখ-ঘণ্টা বাজা শুরু হল। ঘরের মধ্যে ঝি ঢুকে সুইচ টিপে আলো জ্বালিয়ে আমাদের দুজনকে ওইভাবে বসে থাকতে দেখে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বেরিয়ে গেল।

আরও কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পর আমি বললুম, লতু, চললুম।

লতু আমার দিকে চেয়ে ঘাড় নেড়ে জানাল, আচ্ছা।

টলতে টলতে বেরিয়ে চলে এলুম।

পরের দিন একটু তাড়াতাড়ি ওদের ওখানে গিয়ে দেখি, খুব সমারোহ শুরু হয়ে গিয়েছে। শাড়িওয়ালা এসেছে দু’তিনজন। তিন-চারজন স্যাকরা বসে গেছে হীরের-কুচি, পান্নার-কুচি নিয়ে, –জড়োয়া গয়নাগুলো শিগগিরই তৈরি হওয়া চাই; আর সময় নেই, অঘ্রানের মাঝমাঝি বিয়ে, কার্তিক মাসের আর কটা দিন মাত্র আছে।

লতু আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললে, আমি এ বিয়ে কিছুতেই করব না। তুই আমায় নিয়ে পালিয়ে চল, শিগগির ব্যবস্থা কর।

পরদিন ভোরবেলা উঠেই গোষ্ঠদিদির কাছে গিয়ে সব কথা খুলে বললুম, তুমি লতুকে মাসখানেক রাখ, তারপরে আমি একটা চাকরি পেলেই তাকে নিয়ে চলে যাব।

গোষ্ঠদিদি কিছুতেই রাজি হল না। সে বললে, তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। সে বড়লোকের মেয়ে তাকে কোথায় এখানে এনে রাখবি? তার বাপ আমাকে তোকে দুজনকেই জেলে পুরবে।

গোষ্ঠদিদির পায়ে ধরলুম, কত কাঁদাকাটি করলুম, কিছুতেই সে রাজি হল না।

বন্ধুবান্ধবদের জানালুম, কিন্তু এ সমস্যার সমাধান কেউ করতে পারলে না। ওদিকে লতু রোজই তাড়া দিতে লাগল, কি রে, কি হল?

বিয়ে করবে না বলে দিনরাত্রি কাঁদতে থাকায় তাদের বাড়িতেও মহা অশান্তি শুরু হয়ে গেল। শেষকালে লতুর মা একদিন আমাকে আড়ালে ডেকে বললেন, লতুকে তুই একটু বুঝিয়ে বল, ও কি পাগলামি করছে!

লতু আমাকে বললে, তুই যদি আমাকে না নিয়ে যাস তো আমি বিষ খাব।

পাগলা সন্ন্যেসীর কথা মনে পড়তে লাগল। এই দুর্দিনে তিনি থাকলে হয়তো কিছু সুরাহা হতে পারত। রাগে ও অভিমানে গোষ্ঠদিদির ওখানে যাওয়া বন্ধ করে দিলুম।

আমি ও লতু নিত্য গোপনে পরামর্শ করি, নিত্য নতুন উপায় উদ্ভাবন করি, কিন্তু সে-সব উদ্ঘাতিনী পন্থায় পা বাড়াতে সাহস হয় না। অদৃষ্টচক্রকে জোর করে ঘুরিয়ে দেবার যে চেষ্টা আমরা করেছিলুম, তাতে সফল তো হলুমই না, বরং আস্তে আস্তে তার নীচে আমরা মাথা পেতে দিলুম। লতু বললে, অদৃষ্ট এই যে জোর করে আমাদের আলাদা করে দিলে, অদৃষ্টের এই আঘাত আমরা কাটিয়ে উঠবই, কিছুতেই সে আমাদের বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না। আমি যেখানেই থাকি না কেন, তোরই থাকব, তুই আমারই থাকবি, দেখি কোথায় গিয়ে এর শেষ হয়।

লতু বলে দিয়েছিল, বিয়ের দিন তুই আসিসনি, পরের দিন সকাল-সকাল আসবি। আমরা এগারোটায় স্টেশনে যাব, বারোটায় গাড়ি ছাড়বে।

সেদিন সন্ধ্যাবেলায় দুই ভাই সেজেগুজে বেরিয়ে পড়লুম। আমার একটা সোনার বকলস-আংটি ছিল, কোথাও যেতে-টেতে হলে সেটা পরতুম। রাস্তায় বেরিয়ে অস্থিরের হাতে আংটিটা দিয়ে বললুম, এটা লতুকে দিস, তার বিয়ের উপহার।

অস্থির চলে গেল, আর আমি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে লাগলুম। রাত্রি সাড়ে দশটা নাগাদ ক্লান্তদেহে বাড়ি ফিরে এলুম, অস্থির তখনও ফেরেনি।

বিছানায় শুয়ে কাঁদবার চেষ্টা করতে লাগলুম, কিন্তু কান্না এল না। মনের মধ্যে সে এক অদ্ভুত অস্থিরতা, অব্যক্ত অসহনীয় যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লুম।

সকালবেলা অস্থির বললে, লতু তোকে তাড়াতাড়ি যেতে বলে দিয়েছে।

তাড়াতাড়ি স্নান করে না-খেয়েই ওদের ওখানে ছুটলুম। সেখানে গিয়ে দেখি, একাধারে অশ্রু ও আনন্দের ঢেউ চলেছে। কাল আসিনি বলে লতুর মা অনুযোগ করতে লাগলেন। কতবার সুজাতার নাম করে চোখের জল ফেললেন। লতুর বরের সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিয়ে বললেন, এটি লতুর প্রাণের বন্ধু।

আমার চোখে জল এসে গেল। আমাকে দেখে লতুও কাঁদতে লাগল।

বর চমৎকার দেখতে। স্বভাবটিও তার ভারি মিষ্টি। আমাকে বললে, তুমি লতুর বন্ধু, তোমাকেও যেতে হবে আমাদের ওখানে।

লতু আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললে, চললুম, চললুম। কষ্ট হলেই আমার কাছে চলে যাবি।

বেলা প্রায় সাড়ে এগারোটার সময় লতুরা চলে গেল ইস্টিশানে। তার বাবা, ললিত ও আরও অনেকে পৌঁছে দিতে গেল।

সবাই চলে গেলে লতুর মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, স্থবির, তুই আমার বড় ছেলে, আমাকে কখনও ছেড়ে যাসনি বাবা।

লতুদের বাড়ি থেকে যখন বেরুলুম, তখন বারোটা বেজে গেছে। মাথার মধ্যে অদ্ভুত যন্ত্রণা, মনের মধ্যে কে যেন বিষম তাড়া লাগাচ্ছে!

কোথায় যাই, কোথায় যাই–

চলতে চলতে হঠাৎ দৌড়তে আরম্ভ করে দিলুম। মানিকতলার খালের পোল পেরিয়ে সোজা রাস্তা ধরে দৌড়তে লাগলুম। আজ সে-সব জায়গা শহরের মধ্যিখানে এসে গিয়েছে, কিন্তু তখন সে-স্থান ছিল একেবারে পাড়াগাঁ বললেই হয়। একটা মেটে চওড়া রাস্তা, দু-দিকে চওড়া পাঁক-ভরা নর্দমা। তারপরে বড়লোকদের বাগান, আর নয় জঙ্গল। এই রাস্তা দিয়ে দৌড়তে দৌড়তে এসে পড়লুম একেবারে নতুন খালের ধারে, আজ যেখানে বেঙ্গল কেমিক্যালের কারখানা হয়েছে। খালের ধারে, ভজন উড়ের খেয়া-নৌকোয় আধপয়সা দিয়ে পার হয়ে চলে গেলুম ওপারের বাদা-বনে।

বিশাল লবণাক্ত জলরাশি, এপার-ওপার নজর চলে না। ডাঙা-জমি নেই বললেই চলে। কোনো কোনো স্থানে ঘন জঙ্গল, কোথাও-বা একেবারে ফাঁকা, এক গাছি ঘাস পর্যন্ত নেই। মধ্যে মধ্যে এক-দুএকটা খেজুরগাছ গলায় হাঁড়ি ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমার মন অবসন্ন, পা-দুটো যেন আর দেহটাকে টানতে পারছিল না। কোনো রকমে টলতে টলতে একটা খেজুরগাছের নীচে গিয়ে বসে পড়লুম। মনের মধ্যে এক চিন্তা–লতু চলে গেছে, দুনিয়ায় আর কোনো আকর্ষণ নেই। সমস্ত সুখ, সমস্ত দুঃখ–জীবনের সব মাধুর্য চলে গেল লতুর সঙ্গে।

কতক্ষণ সেইভাবে বসে ছিলুম জানি না, হঠাৎ আমার কানের মধ্যে কিরকম ঝাঁ-ঝাঁ করতে লাগল। হাত-পা যেন অবশ হয়ে আসতে লাগল। মনে হতে লাগল, যেন এখুনি মরে যাব।

মনকে শক্ত করে বলতে লাগলুম–আসুক মৃত্যু! এস মৃত্যু। তুমি দু-দুবার আমার কাছে এসে চলে গিয়েছ, আজ আর তোমায় ছাড়ব না।

আমি সেই অনুভূতির কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করে সেখানেই শুয়ে পড়লুম।

হয়তো কয়েক মুহূর্তের জন্য সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিলুম। জ্ঞান ফিরে আসতেই ধড়মড় করে উঠে বসলুম। তারপরে আস্তে আস্তে আবার খেয়ানৌকোয় পার হয়ে এপারে চলে এলুম।

যখন বাড়ি ফিরলুম, তখন বেলা পড়ে গিয়েছে। ছাতের ওপরে উঠে নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছি, এমন সময় মার সঙ্গে দেখা। মা অত বেলায় পড়ন্ত রোদে চুল শুকোচ্ছিলেন। আমাকে দেখেই বললেন, গাছগুলোতে একটু জল দিয়ে দে তো।

মা’র ছিল গাছের শখ। ছাতের ওপরে প্রায় আড়াইশো-তিনশো ছোট-বড় টবে তিনি নানারকমের ফুল ও ফলের গাছ করেছিলেন। তাঁর এই ছাতবাগানে কাবুলী কলা থেকে আঙুর পর্যন্ত ফলত। তিনি নিজের হাতে এই গাছগুলিকে লালন করতেন। ছাতে গঙ্গাজলের একটা ট্যাঙ্ক থেকে নিজে জল তুলে গাছে দিতেন।

মার হুকুমমতো গাছে জল দেওয়া সেরে ফেললুম। মা বললেন, আজ শরীরটা ভালো নেই বাবা। তার ওপরে সারাদিন যা হাঙ্গামা গিয়েছে আজ আর একটু হলেই তোরা মাতৃহীনা হতিস।

কি ব্যাপার?

তোমাদের বাবার জ্বালায় এতদিন যে প্রাণে বেঁচে আছি কি করে, তাই মাঝে মাঝে ভাবি। এই তো স্নান করে উঠলুম। লতুরা চলে গেল বুঝি?

আজকাল যেমন কলকাতার রাস্তায় দলে দলে পাগল ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়, তখনকার দিনে ও পাগলের সংখ্যা এর চাইতে কম ছিল না। কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের এই নতুন বাড়িতে এসে বাবার একটা নতুন খেয়াল চেপেছিল। একদিন রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে তিনি দেখলেন যে, কোনো এক উৎসব-বাড়ির সামনে স্তূপীকৃত উচ্ছিষ্ট আবর্জনার ভেতর থেকে একটা পাগল নিমন্ত্রিতদের ভুক্তাবশিষ্ট থেকে বেছে বেছে কি খাচ্ছে। এই দৃশ্য দেখে তিনি পাগলটাকে ধরে বাড়িতে নিয়ে এসে তার মাথার জটা ও দাড়ি ছেঁটে স্নান করিয়ে তাকে ভদ্র করে আমাদের বললেন, এঁকে তোমরা ‘মামাবাবু’ বলে ডাকবে।

রাস্তার পাগলের সঙ্গে হঠাৎ সম্পর্ক স্থাপন করতে মা ঘোরতর আপত্তি করায় সে-ব্যক্তি তখুনি আমাদের ‘কাকাবাবু’ হয়ে গেল। সেই থেকে সে আমাদের বাড়িতেই থেকে গেল।

ব্যাপারটা কিন্তু এখানেই শেষ হল না। তারপর থেকে বাবা প্রায় প্রতিদিনই দুটি-তিনটি করে পাগল রাস্তা থেকে ধরে আনতে আরম্ভ করলেন। দেখতে দেখতে মাসখানেকের মধ্যে বাড়ি একটি ছোটোখাটো পাগলা-গারদে পরিণত হয়ে গেল। প্রতিদিন সকালবেলা একখানা কাপড়-কাঁচা সাবান দিয়ে এই পাঁচ-ছটি পাগলকে স্নান করিয়ে তিনি আপিসে যেতেন। এরা খেয়ে-দেয়ে বাইরে চরতে যেত আর সেই সন্ধের সময় বাড়ি ফিরত। এদের অঙ্গে প্রায়ই শতচ্ছিন্ন ধুতি জামা থাকত। বাবা কোন জন্মে সরকারি বনবিভাগ ও তারপরে চা-বাগানে চাকরি করেছিলেন। সেই সময়কার পেন্টুলান ও অদ্ভুত অদ্ভুত সব জামা একটা কাঠের সিন্দুকে জমা ছিল। সেইসব জামা ও পেন্টুলান এতদিন পরে এই পাগলদের অঙ্গে চড়তে লাগল।

দু-তিনজন পাগল সন্ধে হলেই গুটিগুটি বাড়ি ফিরে আসত আর জন-দুয়েক প্রায়ই ফিরত না। বাবা আপিস থেকে বাড়িতে ফিরেই তাদের খোঁজ করতেন আর তারা তখনও ফেরেনি শুনে তক্ষুণি বেরিয়ে যেতেন তাদের খোঁজে। সারা শহর ঘুরে কোনোদিন ছাতাওয়ালা গলি, কোনোদিন-বা সার্পেনটাইন লেন থেকে তাদের আবিষ্কার করে আবার বাড়িতে ফিরিয়ে আনতেন। এইভাবে চলতে চলতে এক এক করে তিনজন পাগল কোথায় যে উধাও হয়ে গেল, আর তাদের খোঁজ পাওয়া গেল না।

যে দুজন পাগল আমাদের বাড়িতে থেকে গেল, তারা হাঙ্গামা কিছু করত না, বরং এদের নিয়ে আমাদের বেশ আমোদেই দিন কাটত। এদের মধ্যে একজনের অভিনয় করবার ও গান গাইবার বাতিক ছিল। মধ্যে মধ্যে যেদিন তার ওপর নটরাজ ভর করতেন, সেদিন সে সারারাত চিৎকার করতে থাকত। আর একজনের ছিল লঙ্কা খাওয়ার বাতিক। আমরা তাকে প্রতিদিন লুকিয়ে আট-দশটা কাঁচা লঙ্কা দিতুম, আর সে আমাদের সামনেই সেগুলোকে কচকচ করে চিবিয়ে খেয়ে ফেলত।

সে-সময় আমাদের বাড়িতে অমূল্য ও বিনোদ নামে দুটি ছেলে থাকত। অমূল্যকে বাবা কোথায় একটা কাজে লাগিয়ে দিয়েছিলেন। সে বেচারি রাত থাকতে উঠে বেরিয়ে যেত আর ফিরত বেলা বারোটায়। বিনোদ ইস্কুলে পড়ত। কি কারণে জানি না, গাইয়ে ও লঙ্কাবিলাসী দুই পাগলাই অমূল্যকে দেখলেই ক্ষেপে যেত।

সেদিন, কি জানি কেন, লঙ্কাবিলাসী পাগলা খাবার সময় আমাদের রাঁধুনির ওপর চটে গিয়ে ভাতের থালা, জলের ঘটি ইত্যাদি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চেঁচামেচি জুড়ে দিল। গাইয়ে পাশে বসেই খাচ্ছিল। জুড়িদারের সাড়া পেয়ে সেও খাওয়া ছেড়ে রাঁধুনিকে দমাদ্দম মারতে আরম্ভ করে দিলে। মা কাছেই ছিলেন, তাঁর ধমক-ধামকে তারা একটু শান্ত হয়েছিল, এমন সময় অমূল্য কাজ থেকে ফিরে এল। তাকে দেখেই লঙ্কাবিলাসী আরও ক্ষিপ্ত হয়ে মাকে বঁটি নিয়ে তাড়া করলে। অমূল্য কোনোরকমে মাকে রক্ষা করলে বটে, কিন্তু তারা ভাতের হাঁড়ি আর যা কিছু খাবার ছিল সব নষ্ট করে দিয়ে গেছে, মার খাওয়া পর্যন্ত হয়নি।

সমস্ত কাহিনিটি বলে মা জিজ্ঞাসা করলেন, তুই লতুদের ওখানে খেলি বুঝি?

মার প্রশ্নে মনে পড়ল, চব্বিশ-ঘণ্টার ওপর আমার পেটে অন্ন পড়েনি। তবুও বললুম, হ্যাঁ।

মা বলে যেতে লাগলেন, এই লোক নিয়ে আমি কি করব, সামান্য একটু বুদ্ধি নেই। পাগল ওরা, ওদের কি জ্ঞানগম্যি আছে!

মা বলে যেতে লাগলেন, কোনোদিন কি আমার কথা শুনলেন! একবার, তখন উনি আসামের এক চা-বাগানে ম্যানেজারি করতেন। একদিন রাতদুপুরে আর এক বাগানের ম্যানেজার এসে ওঁর কাছে কিছু টাকা ধার চাইলে। লোকটা ছিল অতি বদমাইশ–আমি দুচক্ষে দেখতে পারতুম না তাকে। উনি বাগানের টাকা ভেঙে তাকে দিলেন। আমি বারণ করাতে বললেন বন্ধুর বিপদে সাহায্য করতে যে স্ত্রী বারণ করে, সে স্ত্রী-ই নয়।

শুনে আমি আর কিছু বললুম না।

তারপরে সে আর টাকা দেয় না। রোজই তাগাদা করেন, কিন্তু কোনো উচ্চবাচ্যই সে করে না। উনি রোজ সকালে ঘোড়ায় চড়ে বেড়াতে যেতেন। একদিন, সকালবেলা সেইরকম বেড়িয়ে ফিরে এসে উনি কিরকম করতে লাগলেন, হাত-পা এলিয়ে আসতে লাগল, চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসতে লাগল–এখন যান তখন যান অবস্থা।

বাগানের ডাক্তার ছিল, তখুনি তাকে ডেকে পাঠালুম। সে এসে ব্যাপার দেখে আমাকে আলাদা ডেকে বললে, মা, আমার মনে হচ্ছে, উনি বিষ খেয়েছেন।

কি সর্বনাশ! ছুটে গিয়ে বললুম, হ্যাঁগো, ডাক্তার বলছে, তুমি বিষ খেয়েছ! কি দুঃখে তুমি বিষ খেলে?

তখন ওঁর কথা জড়িয়ে গেছে, চোখ প্রায় উল্টে গেছে। তবুও গেঙিয়ে-গেঙিয়ে যা বললেন, তাতে বোঝা গেল যে, বেড়িয়ে ফেরবার সময় বন্ধুর চা-বাগানে গিয়ে এক গ্লাস জল চাওয়ায় সে ভালোবেসে বন্ধুকে এক গেলাস দুধ খেতে দিয়েছিল। বিষ-টিস উনি কিছুই খাননি।।

আধ ঘণ্টার মধ্যে ওঁর কথা বন্ধ হয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। ডাক্তার বললে, মা, আর দেখছেন কি, হয়ে গেল যে!

কি করি! সেই জঙ্গলে এমন একটা লোক নেই যার কাছে একটা পরামর্শ পাই। ডাক্তার আমায় ‘মা’ বলত। তাকে বললুম, বাবা, ওদেরই খবর দাও, ওরাই তো ওঁর বন্ধু।

বন্ধুদের বাগান প্রায় পনেরো মাইল দূরে। তাদের কাছে লোক ছুটল ঘোড়ায়। বন্ধু প্রায় বেলা একটার সময় এল তাদের বাগানের ডাক্তারকে নিয়ে। তখন চোখ উলটে গেছে, হাত-পা শক্ত হয়ে গেছে। তারা দেখে বললে, হয়ে গেছে।

বাগানের অন্য কর্মচারীরা ও ওঁর সেই বন্ধু–তারা সবাই মিলে আমাকে শহরে পাঠিয়ে দেওয়া ঠিক করলে। শহর সেখান থেকে মাইল দশ-বারো দূরে। ঠিক হল, গরুর গাড়িওয়ালা আমাকে শহরের স্টিমার-ঘাট অবধি পৌঁছে দেবে, তার পরে কাল সকালে আমি কলকাতায় রওয়ানা হব। আমাদের জিনিসপত্র যা-কিছু সব তারা পরে পাঠিয়ে দেবে। ইতিমধ্যে তারা ওঁর দেহ সৎকার করবে–সেজন্যে কোনো ভাবনা নেই।

তোর দাদার তখন বছর দেড়েক বয়স। সেই বাচ্চা কোলে নিয়ে বিকেল নাগাদ আমি গরুর গাড়িতে চড়ে রওনা হলুম শহরের দিকে।

গাড়ির মধ্যে বসে ভাবছি আকাশ-পাতাল। কখন সন্ধে হয়ে গিয়েছে। রাত্রি অন্ধকার নেমেছে জঙ্গলে তা খেয়ালই নেই। আসামের জঙ্গল, দিনেই অন্ধকার, রাতে তো কিছুই দেখা যায় না। দূরে কাছে মাঝে মাঝে জানোয়ারের ডাক শোনা যাচ্ছে। বাঘ-ভাল্লুকের ভয়ে ছেলেটাকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে কাঁটা হয়ে বসে আছি। গাড়োয়ানটা ভাল্লুক তাড়াবার জন্যে থেকে থেকে বিকট চিৎকার করছে। আর কতদূর–কতক্ষণে গিয়ে পৌঁছব? সেখানে জানাশোনা দু-একটি পরিবার থাকতেন, তাঁদের বাড়িতে গিয়ে অত রাত্রে উঠব–এইসব ভাবছি, এমন সময় গাড়োয়ান জিজ্ঞাসা করলে, আর কত দূরে যাবে?

গাড়োয়ানের প্রশ্ন শুনে আমার মাথায় যেন বজ্রাঘাত হল। বলে কি লোকটা!

বললুম, শহর আর কত দূর?

কোন শহর?

নওগাঁ।

সে তো জানি না। বাবুরা তো তোমাকে জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে যেতে বললে। নওগাঁ তো অন্য রাস্তা দিয়ে যেতে হবে। সে এখান থেকে বিশ-পঁচিশ মাইল হবে।

একবার ভেবে দেখ। তখন আমার অল্প বয়েস, কোলে একটা বছরদেড়েকের ছেলে, আসামের সেই ভীষণ জঙ্গল, রাত্রি প্রায় দুপুর।

মনে মনে ভগবানকে ডেকে বললুম, পোড়ারমুখো ভগবান, এ কি করলে আমার!

গাড়োয়ানকে বললুম, বাবা, আমাকে শহরে পৌঁছে দে। আমি বামুনের মেয়ে, তোকে আশীর্বাদ করব, তোর ভালো হবে। আমার স্বামীকে ওরা বিষ খাইয়ে মেরে ফেলেছে, আমাকেও মেরে ফেলতে চায়–বুঝতে পারছিস না?

গাড়োয়ান বললে, মেয়েছেলেকে রাত-দুপুরে জঙ্গলে নামিয়ে দেবার কথা শুনেই আমার সন্দেহ হয়েছিল, কিন্তু অতটা বুঝতে পারিনি।

আমি বললুম, তুই আমায় শহরে পৌঁছে দে, আমার গায়ে যত গয়না আছে সব তোকে দোব, তুই আমার ছেলে।

আমার কান্না দেখে আর সব কথা শুনে তার মন গলে গেল। সে বললে, তোমার কোনো ভয় নেই মা, আমি গয়না চাই না, আমি তোমায় শহরে পৌঁছে দিচ্ছি।

গাড়োয়ান যখন আমায় স্টিমার ঘাটে এনে পৌঁছে দিলে, তখন সকাল হয়ে গেছে। ভাগ্যক্রমে স্টিমার-ঘাটেই আমাদের জানাশোনা ওখানকার একজন বড় উকিলের সঙ্গে দেখা। আমাকে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি এখানে?

আমি তাঁকে সব কথা বলাতে তিনি তক্ষুণি লোকজন, ডাক্তার ও আমাদের নিয়ে গাড়ি করে ছুটলেন বাগানে। সেখানে গিয়ে দেখি, তারা ওঁকে এক জায়গায় মাটিতে শুইয়েছে–দূরে একটা চিতা তৈরি হচ্ছে পোড়াবার জন্যে। আমাদের জিনিসপত্র কিছুই নেই। সঙ্গে সঙ্গে ওঁর প্রাণের বন্ধু, যার জন্যে উনি স্ত্রী পর্যন্ত ত্যাগ করতে পারেন,, সে উধাও।

এঁদের ডাক্তার ওঁকে পরীক্ষা করে বললেন, এখনও প্রাণ আছে, চেষ্টা করলে বাঁচতেও পারেন।

তখুনি ওঁকে শহরে নিয়ে আসা হল। তারপরে প্রায় তিন মাস চিকিৎসার পরে সেরে উঠলেন। ওই যে নীচে Shakespeare and Newtown-এর স্টিল-ট্রাঙ্কটা আছে, সেটা এক বছর পরে মাটি খুঁড়ে বের করা হয়েছিল। ওঁর সেই প্রাণের বন্ধুটি সেই যে পলায়ন করলে, আজও পুলিশ তার সন্ধান করতে পারলে না।

কাহিনি শেষ করে মা চুপ করলেন। তখনও তিনি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন। আমাদের দুজনকে ঘিরে সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে উঠতে লাগল। আমার বুকের মধ্যে অশ্রুসাগর জমাট হয়েইছিল, এই কাহিনি শুনে নিরুদ্ধ অশ্রু শতধা উৎসারিত হয়ে পড়ল। কাঁদতে কাঁদতে মাকে জড়িয়ে ধরে বললুম, মা মা মা, আমি রয়েছি, তোমার ভয় কি?

অশ্রুবিজড়িত কণ্ঠে মা বললেন, তুই আমার বুদ্ধিমান ছেলে, তুই মায়ের দুঃখ বুঝবি, তাই বললুম।

তখুনি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলুম, যেমন করে পারি মার দুঃখ ঘোচাতেই হবে। নিজে মানুষ হয়ে মাকে নিয়ে চলে যাব দূর দেশে। সেখানে আমরা থাকব, কোনো দুঃখ কোনো আঘাত মাকে স্পর্শ করতে দেব না।

কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে মা উঠে চলে গেলেন। আমি আমাদের ঘরের ছাতে উঠে গিয়ে বসলুম–নিবিড় অন্ধকারে আপনাকে লুকিয়ে। লতুর সঙ্গে হঠাৎ এই বিচ্ছেদের আঘাতে এমনিতেই আমি মুষড়ে পড়েছিলুম, তার ওপরে মার মুখে ওই কাহিনি শুনে ও তাঁর চোখে অশ্রু দেখে অন্ধকারে বসে বসে আমি কাঁদতে আরম্ভ করে দিলুম। মনের মধ্যে এক চিন্তা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে গুমরোতে লাগল, লতু চলে গেল, লতু চলে গেছে। আমি পড়ে আছি একা। লতুর নতুন সংসার, নতুন জীবন। কিন্তু আমার কি রইল? আমি কি নিয়ে থাকব?

লতুর সঙ্গে কি চিরবিচ্ছেদ হয়ে গেল? তবে কেন ভগবান আমাদের দুজনকে এত কাছাকাছি এনেছিলেন? কে এ রহস্যের উত্তর দিতে পারে? একান্তমনে পাগলা সন্ন্যেসীর কথা ভাবতে লাগলুম। তাঁর সেই গেরুয়া বসন, তাঁর লাইব্রেরি, তাঁর কবিতাপাঠ মনের মধ্যে জ্বলজ্বল করে ফুটে উঠতে লাগল। ভাবতে ভাবতে একবার যেন তাঁর অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর কানে এসে বাজল। এক মুহূর্ত যেতে-না-যেতে সমস্ত আকাশ ব্যেপে মেঘ-গর্জনের মতো পাগলা সন্ন্যেসীর কণ্ঠস্বর গর্জে উঠল-

If day should part us night will mend division
And sleep parts us-we will meet in vision
And if life parts us–we will meet in death
Yielding our mite of unreluctant breath
Death cannot part us-we must meet again
In all in nothing in delight in pain
How, why or when or where-it matters not
So that we share an undivided lot…

এই মহামন্ত্র শুনতে আমি সেইখানেই লুটিয়ে পড়লুম অজ্ঞান হয়ে।

বোধ হয় ঘণ্টা-দুয়েক পরে অস্থির এসে আমায় ধাক্কা দিয়ে তুলে বললে, চল, খাবি চল, মা ডাকছে।

আমি ঠিক করলুম, কলকাতা ছেড়ে চলে যাব ভাগ্য-অন্বেষণে। বিদায়ের আগে লতু বলেছিল, আমার সারাজীবন তোর চিন্তাতেই কাটবে। আমিও সারাজীবন লতুর ধ্যানেই কাটিয়ে দোব। সে আমায় ভালোবাসতে শিখিয়েছে, এই ভালোবাসাই হবে আমার ধর্ম। যদি কখনও জীবনে উন্নতি করতে পারি, তাহলে মার দুঃখ ঘোচাব, আর আমার কোনো কর্তব্য নেই।

অস্থির বললে, স্থবরে, আমিও তোর সঙ্গে যাব। কিন্তু পরামর্শ করে ঠিক হল, দুজনে একসঙ্গে পালানো ঠিক হবে না। আমার একটা কিছু হলে অর্থাৎ উন্নতির রাস্তায় পৌঁছলে, তাকে খবর দোব, সে চলে আসবে।

বাড়ি থেকে বেরুতে হলে কিছু অর্থের প্রয়োজন, কিন্তু অর্থ কোথায় পাই? আমার মনের এই সংকল্প বন্ধুদের জানাতে সাহস হল না। তারা চেষ্টা করলেও হয়তো কিছু অর্থের জোগাড় করে দিতে পারত, কিন্তু ভয়ে তাদের কিছু বলতে পারলুম না। কারণ আমার গৃহত্যাগ যদি তাদের মনঃপূত না হয়, তারা বাড়িতে বলে দিয়ে সব মাটি করে দিতে পারে। অনেক ভেবেচিন্তে শেষকালে আমার অন্যতম প্রাণের বন্ধু পরিতোষ রায়কে আমার মনের কথা বলে ত্রিশ টাকা ধার চাইলুম। পরিতোষের কাছে তাদের সংসারের টাকা থাকত। সে বেচারি আমাকে বড় ভালোবাসত। সে সব শুনে বললে, আমিও তোর সঙ্গে যাব।

ঠিক হল, পরিতোষের সংসার খরচের টাকা ভেঙে আমরা দুজনে সরে পড়ব।

যাবার আগে গোষ্ঠদিদিকে সব বলে যাবার কথা মনে হল। পাগলা সন্ন্যেসী ইহলোক থেকে বিদায় নেবার আগে আমাদের দুই ভাইয়ের হাতে তাকে সমর্পণ করে গিয়েছিলেন, সে-কথা আমরা ভুলিনি।

একদিন বিকেলে গোষ্ঠদিদির সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে দেখলুম, সে সেখানে নেই। শৈলর মা, মাসি ও গোষ্ঠদিদি সবাই মিলে সে-বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথায় চলে গিয়েছে। বাড়ির অন্যান্য ভাড়াটেরা বললে, তারা আন্টুনিবাগান না দপ্তরীপাড়ায় কোথায় উঠে গেছে।

গোষ্ঠদিদি আমাদের না বলে কোথায় চলে গেল? বিচিত্র এই সংসার! বিচিত্র এই নারীচরিত্র! আমাদের চেয়ে আপনার তার কে ছিল?

প্রায় দশ দিন ধরে আমি আর অস্থির আন্টুনিবাগান ও দপ্তরীপাড়ার বাড়ি বাড়ি অনুসন্ধান করেও গোষ্ঠদিদির ও শৈলদের খুঁজে বের করতে পারলুম না, কোথাও তাদের সন্ধান মিলল না। নিশ্চয় তারা সে-পাড়ায় ছিল না, আমাদের ফাঁকি দেবার জন্যে এ-বাড়ির লোকদের কাছে মিথ্যে কথা বলে গিয়েছিল।

পাগলা সন্ন্যেসী আমাদের ক্ষমা কর ভাই!

ইস্কুলে বার্ষিক পরীক্ষা ঘনিয়ে আসার সময় বাবা আমাদের রাত থাকতে তুলে দিতেন পড়বার জন্যে। তাঁর কাছে শুনতুম যে, শেষরাত্রে উঠে পড়লে খুব ভালো পড়া হয়। অঘ্রান মাসের মাঝামাঝি এইরকম একদিন শেষরাত্রে বাবা আমাকে পড়াবার জন্যে ঠেলে তুলে দিলেন। সেই ব্রাহ্মমুহূর্তে মনে মনে সকলের কাছে বিদায় নিয়ে একবস্ত্রে গৃহত্যাগ করলুম।

তখন আমার পনেরো বছর বয়স চলছে।

।। প্ৰথম পর্ব সমাপ্ত।।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *