রেল ব্রিজের উত্তর পাশে অফিসারদের একটা রেস্ট হাউস থাকায় প্রশাসনিক দিক থেকে মানো মাজরার কিছুটা গুরুত্ব ছিল। ইটের তৈরী ঘরটার ছাদ সমান্তরাল, নদীর দিকে একটা বারান্দা। চারদিকে প্রাচীর দেয়া জমির মাঝখানে এই রেষ্ট হাউস। মূল গেট থেকে বারান্দা পর্যন্ত ইটের তৈরী একটা রাস্তা৷ রাস্তার দুধারে উঁচু করে কোণাকুণিভাবে ইট বসানো। রাস্তার দুপাশে বাগান। বাগানের মাটি শক্ত, আগাছা বলতে কিছু নেই। ফলে মাটিতে ফাটল ধরার প্রশ্ন নেই এবং মাটি একেবারে সমান। বারান্দার আশেপাশে ও রেষ্ট হাউসের পিছন দিকে সার্ডেন্ট কোয়াটারের কাছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কয়েকটা জুই ফুলের গাছ। ব্রিজ নির্মাণের সময় রেস্ট হাউসটি বানানো হয়। যে প্রকৌশলী এ ব্রিজের নির্মাণ কাজ দেখাশোনা করতেন, তিনিই ওখানে থাকতেন। ব্রিজ নির্মাণ শেষ হওয়ার পর রেষ্ট হাউসটি সিনিয়র অফিসারদের সাধারণ সম্পত্তিতে পরিণত হয়। রেস্ট হাউসটি নদীর তীরে হওয়ার কারণে মোটামুটিভাবে সবার কাছেই আকর্ষণীয় ছিল। এর আশেপাশে আছে অনাবাদী মাঠ, বন-জঙ্গল ও বিভিন্ন ধরনের গাছ। এছাড়াও আছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তিতির-পাখির ডাক। শীতকালে নদীর পানি কমে গেলে নদীতীরের জলাভূমিতে গজিয়ে ওঠে নল খাগড়ার গাছ। পুকুরটা তখন আলাদা অস্তিত্ব নিয়েই টিকে থাকে। রাজহাঁস, বুনো হাঁস, বালি-হাস এবং এমন ধরনের অনেক জলচর পাখির আগমন ঘটে। এখানে। বড় জলাশয়ে দেখা যায় রুই, মালি ও মাহসি মাছের প্রাচুর্য।
সারা শীতকাল ধরে অফিসাররা তাঁদের ভ্ৰমণ তালিকা এমনভাবে তৈরি করেন। যেন মানো মাজরার রেক্ট হাউসে সাময়িকভাবে যাত্রাবিরতি করা যায়। সূর্যোদয়ের সময় তাঁরা বেরোন জলচর পাখি শিকারে, দিনে যান তিতির পাখি ধরতে এবং বিকেলে যান মাছ ধরতে। ভ্রমণ শেষে ফিরে আসার সময় তাঁরা সন্ধ্যার দিকে যান হাঁস শিকার করতে। বসন্তকালে আসেন আবেগপ্রবণ লোকেরা তাঁদের অতীত স্মৃতি রোমন্থন করতে। মদের গ্লাসে চুমুক দিয়ে দেখেন উজ্জ্বল কমলার মত বিনম্র সূর্যটক, উপভোগ করেন নদীর পানিতে ডুবন্ত সূর্যের গাঢ় লাল রঙের আভা। জলাভূমিতে ব্যাঙের ডাক ও চলন্ত ট্রেনের গুড়গুড় শব্দ শুনে তাঁরা সময় কাটান। ব্রিজের খিলানের মধ্য দিয়ে ওপরে চাঁদ ওঠার সময় তাঁরা দেখেন নল খাগড়ার বনে জোনাকি পোকার আলোর ঝালকানি। নিঃসঙ্গতা যাঁদের কাম্য, তাঁরাই কেবল মানো মাজরার রেষ্ট হাউসে আসেন গ্ৰীষ্মকালে। বর্ষাকাল শুরু হলেই পর্যটকের সংখ্যা বেড়ে যায় কয়েক গুণ। তরঙ্গাকারে ফুলেফেপে ওঠা শক্রিয় নদীর প্রবাহিত স্রোতের দৃশ্য যেমন চমৎকার তেমনি তা ভয়াবহ।
মানো মাজরায় ডাকাতি হওয়ার দিন সকালে রেস্ট হাউসকে সজ্জিত করা হল একজন গুরুত্বপূর্ণ অতিথিকে বরণ করার জন্য। সুইপার বাথরুম পরিষ্কার করুল, ঘরের মেঝে মুছল এবং রাস্তায় পানি ছিটিয়ে দিল। বেয়ারা ও তার স্ত্রী আসবাবপত্রের ধুলো মুছে তা সুন্দর ও পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখল। সুইপারের ছেলে ঘরের ভিতর দিককার ছাদের সাথে বাধা হাওয়া পাখার দড়ির ছিড়ে যাওয়া অংশ ঠিক করে তা দেওয়ালের ছিদ্র দিয়ে বাইরে বের করে দিল বারান্দায় বসে পাখা টানার জন্য। নতুন লাল কাপড় পরে সে বারান্দায় বসে দাঁড়িতে গিট দিয়ে মাপ ঠিক করে নিল। বাবুর্চিখানা থেকে হাওয়ায় ভেসে আসতে লাগল মুরগী রান্নার গন্ধ।
বেলা এগারটার দিকে রেস্ট হাউসে সাইকেল চেপে এল একজন পুলিশ সাবইন্সপেক্টর ও দু’জন কনস্টেবল। তাদের উদ্দেশ্য, রেষ্ট হাউসের আয়োজন ঠিকমত হয়েছে কিনা তা দেখা। এরপর এল সাদা ইউনিফরম পরা দু’জন চাপরাশি। তাদের কোমরে লাল ফিতা আর মাথায় সামনের দিকে উপচে পড়া চওড়া ফিতাসহ টুপি। ঐ চওড়া ফিতায় পিন দিয়ে আটকানো পাঞ্জাব সরকারের পিতলের প্রতীকঢেউখেলানো পাঁচটা রেখার ওপর দিয়ে সূর্য উঠছে। এই পাঁচটা রেখা হল পাঞ্জাব প্রদেশের পাঁচটা নদীর প্রতীক। তাদের সাথে এল কয়েকজন গ্রামবাসী। তারা বহন করে আনল বাক্স-পেটরা ও উজ্জ্বল ক্যালো ফাইলে মোড়া সরকারী চিঠিপত্র।
আরও ঘন্টাখানেক পরে ধূসর রঙের একটা বড় মার্কিন গাড়ী রেস্ট হাউস চত্বরে প্রবেশ করল। চাপরাশি সামনের সীট থেকে নেমে পিছনের দরজা খুলে দিল তার প্রভুর জন্য। সাব-ইন্সপেক্টর ও কনস্টেবলরা সামনে এসে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে তাঁকে সালাম জানাল। গ্রামবাসীরা দাঁড়িয়ে রইল সম্মানজনক দূরত্বে। চাপরাশি তারের জালিবিশিষ্ট দরজা খুলে দিল। এই দরজা দিয়েই যেতে হয় বসার ও শোয়ার ঘরে। জেলার ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কমিশনার মি: হুকুম চাঁদ তাঁর মাংসল দেহটা নিয়ে গাড়ী থেকে নামলেন। সারা সকাল ধরে তিনি গাড়ীতেই ভ্রমণ করছিলেন এবং এজন্য তিনি ছিলেন ক্লান্ত ও রুক্ষ। তাঁর দুই ঠোঁটের মাঝে আটকে পড়া সিগারেটের ধোঁয়া তাঁর চোখে গিয়ে ঢুকল। তাঁর ডান হাতে ছিল সিগারেটের টিন ও দেশলাই। তিনি কয়েক কদম এগিয়ে সাব-ইন্সপেক্টরের কাছে গেলেন এবং হৃদ্যতার সাথে তাঁর পিঠ থাপড়ে দিলেন। অন্যরা তখনও সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
আসুন ইন্সপেক্টর সাহেব, আসুন, বললেন হুকুম চাঁদ। তিনি ইন্সপেক্টরের ডান হাত ধরে একেবারে কামরার মধ্যে নিয়ে গেলেন। চাপরাশি ও ডেপুটি কমিশনারের ব্যক্তিগত কর্মচারীরা তাদের অনুসরণ করল। ড্রাইভার গাড়ী থেকে মালপত্র বের করছিল। কনষ্টেবলরা তাকে সাহায্য করল।
হুকুম চাঁদ সরাসরি বাথরুমে গিয়ে ঢুকলেন। মুখের ধুলোবালি পানি দিয়ে ভাল করে ধুয়ে তিনি বাইরে এলেন। তখনও তিনি তোয়ালে দিয়ে মুখের পানি মোছার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। সাব-ইন্সপেক্টর পুনরায় উঠে দাঁড়ালেন।
বসুন, বসুন, তিনি আদেশ দিলেন।
তিনি বিছানার ওপর তোয়ালে রেখে আরাম কোদারায় বসলেন। পাখা আগে পিছে করতে লাগল। দেওয়ালের ছিদ্র দিয়ে দড়ি টানার ফলে বিরক্তিকর শব্দ হতে লাগল। একজন চাপরাশি ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের জুতা মোজা খুলে পা টিপতে শুরু করল। হুকুম চাঁদ সিগারেটের টিন খুলে সাব-ইন্সপেক্টরের দিকে বাড়িয়ে দিলেন। সাব-ইন্সপেক্টর সাহেব প্রথমে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের সিগারেট ধরিয়ে নিজেরটা ধরালেন। হুকুম চাঁদের সিগারেট টানার পদ্ধতি এমনই যে, তাতে প্ৰকাশ পায় তিনি নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। তিনি শব্দ করে সিগারেট টানেন, মুষ্টিবদ্ধ হাতে মুখ দিয়ে তিনি সিগারেট টানেন। তিনি আঙ্গুলো তুড়ি দিয়ে সিগারেটের ছাই ফেলেন। অপরদিকে যুবক সাব-ইন্সপেক্টরের সিগারেট টানার পদ্ধতি ছিল মোটামুটি আধুনিক।
বলুন ইন্সপেক্টর সাহেব, দিনকাল কেমন চলছে?
ইন্সপেক্টর সাহেব দুই হাত নমষ্কারের ভঙ্গী করে বললেন, স্ৰষ্টা দয়ালু। আমরা শুধু আপনার কৃপা প্রার্থনা করি।
এ এলাকায় কোন সাম্প্রদায়িক সমস্যা নেই?
এখনও পর্যন্ত ঐ সমস্যা থেকে আমরা মুক্ত আছি, স্যার। পাকিস্তান থেকে আগত হিন্দু ও শিখ উদ্বাস্তু দল এ পথ দিয়ে গিয়েছে। কিছু মুসলমানও এ পথ দিয়ে ওপারে গিয়েছে। কিন্তু কোন সমস্যার সম্মুখীন আমরা হইনি।
আপনি সীমান্তের এপারে মৃত শিখদের আনতে দেখেননি? তাদের আনা হচ্ছে অমৃতসরে। তাদের মধ্যে কেউ বেঁচে নেই। ওপারে হত্যা চলছে। হুকুম চাঁদ তাঁর দুই হাত উচু করে জোরে উরুর ওপর ছেড়ে দিলেন হতাশভাবে। সিগারেটের আগুন থেকে একটা টুকরা তাঁর প্যান্টের ওপর পড়ল। সাব-ইন্সপেক্টর সাহেব অতি দ্রুততার সাথে হাত বাড়িয়ে তা নিভিয়ে দিলেন।
আপনি জানেন, ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব বললেন, শিখরা প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য একটা মুসলমান উদ্বাস্তু ট্রেনে আক্রমণ করে। প্রায় এক হাজারের বেশি লোককে হত্যা করে সব মৃতদেহ সীমান্তের ওপারে পাঠিয়ে দেয়। তারা ট্রেনের ইঞ্জিনের বগিতে লিখে দেয়, পাকিস্তানের জন্য উপহার।
সাব-ইন্সপেক্টর সাহেব চিন্তান্বিত হয়ে মাথা নত করলেন। তিনি উত্তরে বললেন, তারা বলে যে, সীমান্তের ওপারে হত্যা বন্ধ করার ওটাই একটা পথ। পুরুষের বদলে পুরুষ, মহিলার বদলে মহিলা, শিশুর বদলে শিশু। কিন্তু আমরা হিন্দুরা তাদের মত নই। সত্য সত্যই আমরা এই ছোরা খেলায় মেতে উঠতে পারি না। সামনাসামনি যুদ্ধ হলে আমরা যে কোন লোকের মোকাবিলা করতে পারি। আমি বিশ্বাস করি যে, আমাদের আর. এস. এস ছেলেরা সব শহরে মুসলমানদের পিটিয়ে দিয়েছে। শিখরা তাদের দায়িত্ব পালন করছে না। তারা তাদের সাহস হারিয়ে ফেলেছে। তারা শুধু বড় কথা বলে। আমরা এখানে এই সীমান্তে দেখছি, শিখ অধুষিত গ্রামে মুসলমানরা এমনভাবে বসবাস করছে যেন কিছু হয়নি। মানো মাজরার মত গ্রামে প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় মোয়াজ্জিন আজান দিচ্ছে। শিখরা এটা করতে দিচ্ছে কেন জিজ্ঞাসা করলে তারা জবাব দেয়, মুসলমানরা তাদের ভাই। আমি নিশ্চিত যে, তারা তাদের কাছ থেকে টাকা পায়।
হুকুম চাঁদ তাঁর প্রশস্ত কপালে হাত দিয়ে মাথার চুলের দিকে নিয়ে গেল। টাক পড়ার জন্য তাঁর কপাল ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে প্রশস্ত।
এ এলাকার কোন মুসলমান কি সচ্ছল আছে?
বেশি নয়। স্যার। তাদের প্রায় সবাই তাঁতী নয়তো কুমোর।
কিন্তু চন্দননগর তো একটা ভাল থানা বলে পরিচিত। এখানে অনেক খুন হয়, অবৈধ চোলাই মদের কারখানা বেশি আর শিখ কৃষকরা বেশ সম্পদশালী। আপনার পূর্বসূরীরা এখানে থেকেই শহরে বাড়ী তৈরি করেছে।
আপনি বোধ হয় স্যার আমার সাথে কৌতুক করছেন।
আপনিও যদি কিছু করেন তাতে আমার মনে করার কিছু নেই। যা পারেন নিয়ে নিন, অবশ্য সীমার মধ্যে। সবাই এ কাজ করছে। শুধু সতর্ক থাকবেন। এ ধরনের সব কিছু নির্মূল করার কথা নতুন সরকার খুব বড় গলায় বলছে। কয়েক মাস পরে তাদের উৎসাহ কমে যাবে এবং সব কিছু আগের মতই চলবে। রাতারাতি সব কিছু পরিবর্তন করার চেষ্টা বৃথা।
তারাই শুধু একথা বলছে না। দিল্লী থেকে যারা আসছে তাদের কাছে জিজ্ঞাসা করে দেখুন, তারা বলবে যে, সব গান্ধীবাদীরা টাকার, পাহাড় গড়ে তুলছে। তারা সব সারস পাখীর মতো সাধু! তারা বকধার্মিকের মত চোখ বন্ধ করে থাকে। আর সাধনায় মগ্ন যোগীর মত এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে; হাতের কাছে মাছ আসলেই তারা খপ করে ধরে ফেলে।
পা টেপায় রত চাকরকে হুকুম চাঁদ কিছু বিয়ার আনার আদেশ দিলেন। চাকর বাইরে গেলে তিনি তাঁর একটা হাত সাব-ইন্সপেক্টর সাহেবের হাঁটুর ওপর রাখলেন সস্নেহে।
আপনি শিশুর মত হঠকারী কথা বলেন। এ রকম করলে একদিন আপনি বিপদে পড়বেন। আপনার নীতি হবে সব কিছু দেখা এবং কোন কথা না বলা। বিশ্ব খুব দ্রুত পালটে যাচ্ছে। আপনি চাইলেও কারও মতের সাথে নিজেকে মিশিয়ে দিতে পারবেন না বা আপনার দৃষ্টিভঙ্গি অন্যের সাথে মিলবে না। কোন বিষয়ে আপনি দৃঢ়ভাবে কিছু বিশ্বাস করলেও চুপ থাকার শিক্ষা গ্রহণ করুন।
সাব-ইন্সপেক্টর সাহেবের মন কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠল। তিনি কড়া সমালোচনামূলক পিতার মত উপদেশ আরও কামনা করলেন। তিনি জানতেন যে, হুকুম চাঁদ তাঁর সাথে একমত হবেন।
অনেক সময় স্যার, কেউ নিজেকে সংযত রাখতে পারে না। দিল্লীতে বসে গান্ধী টুপি পরে তারা পাঞ্জাব সম্পর্কে কি জানে? সীমান্তের ওপারে পাকিস্তানে কি ঘটছে তা তাদের কাছে কোন বিষয়ই নয়। তারা তাদের বাড়ী বা সম্পত্তি হারায় নি, তাদের মা, স্ত্রী, বোন, কন্যা রাস্তায় ধর্ষিতা হয়নি, খুন হয়নি। শেখুপুরা ও গুজরানওয়ালায় হিন্দু ও শিখ উদ্বাস্তুদের ওপর সবার চোখের সামনে মুসলমানরা কি করেছে তা কি আপনি শুনেছেন? ঐ হত্যাযজ্ঞে পাকিস্তান পুলিশ ও মিলিটারী অংশ নিয়েছে। তাদের কেউ বেঁচে নেই। মহিলারা নিজেদের সন্তানকে হত্যা করে ঝাঁপ দিয়েছে কুয়ার মধ্যে। কুয়া ভর্তি হয়েছে মৃতদেহে।
হরে রাম, হরে রাম, গভীর দুঃখের সাথে বললেন হুকুম চাঁদ। আমি সব কিছু জানি। হিন্দু মহিলার বৈশিষ্ট্যই ঐ রকম। তারা এমনই পবিত্র যে, পরপুরুষে স্পর্শ করার চেয়ে তারা আত্মহত্যা করাকে শ্ৰেয় মনে করে। কোন মহিলার ওপর আমরা হিন্দুরা কখনও হাত তুলি না। কিন্তু দুর্বল মহিলাদের প্রতি মুসলমানদের কোন শ্রদ্ধা নেই। কিন্তু এ নিয়ে আমাদের কি করা উচিত? এখানে ঐ রকম ঘটনা শুরু হওয়ার আগে এটা কতদিন চলবে?
মানো মাজরা হয়ে কোন লাশভর্তি ট্রেন আসবে না বলে আমার বিশ্বাস। যদি আসে তাহলে প্রতিশোধ গ্ৰহণ ঠেকানো অসম্ভব হবে। আমাদের চারপাশে শত শত ছোট গ্রাম আছে মুসলমানদের। মানো মাজরার মত অনেক শিখপ্রধান গ্রামে বহু মুসলিম পরিবারও আছে, কিছুটা আশার বাণী শুনিয়ে বললেন সাব-ইন্সপেক্টর সাহেব।
হুকুম চাঁদ বেশ শব্দ করে সিগারেটে টান দিয়ে আঙ্গুলো তুড়ি দিয়ে ছাই ঝাড়লেন।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বললেন, আমাদের অবশ্যই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করতে হবে। সম্ভব হলে মুসলমানদের শান্তিপূর্ণভাবে চলে যেতে দিন। রক্ত ঝরিয়ে সত্যিকারের কেউ লাভবান হয় না। অসৎ চরিত্রের লোকেরা লুঠতরাজ চালাবে আর সরকার আমাদের হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী করবে না ইন্সপেক্টর সাহেব, তা হতে পারে না। আমাদের উদ্দেশ্য যা-ই থাক না কেন, একমাত্র সৃষ্টিকর্তা জানেন, সরকারী কর্মকর্তা না হলে এসব পাকিস্তানীদের আমি কি করতাম-আমরা কাউকে হত্যা করতে বা কারও সম্পত্তি ধ্বংস করতে দেব না। তারা চলে যাক। তবে খেয়াল রাখবেন, তারা যেন সাথে বেশি কিছু নিয়ে না যায়। পাকিস্তানের হিন্দুদের চলে আসার অনুমতি দেওয়ার আগে তাদের সব কিছু কেড়ে নেওয়া হয়েছে। পাকিস্তানী ম্যাজিস্ট্রেটরা রাতারাতি কোটিপতি হয়েছে। আমাদের এখানকার কেউ কেউ কিছু করেছে, কিন্তু অতটা করতে পারেনি। যেখানে হত্যা ও অগ্নি সংযোগের ঘটনা ঘটেছে, সেখানে সরকার তাদের সাময়িকভাবে বরখাস্ত বা বদলি করেছে। কোন হত্যাযজ্ঞ নয়। হবে শান্তিপূর্ণ উদ্বাসন।
ভৃত্যটি এক বোতল বিয়ার এনে হুকুম চাঁদ ও সাব-ইন্সপেক্টর সাহেবের সামনে দু’টো গ্লাস রাখল। সাব-ইন্সপেক্টর সাহেব গ্রাসটা হাতে নিয়ে প্রতিবাদের ভঙ্গিতে বললেন, না স্যার, আমি শিষ্টাচার লঙ্ঘন করে আপনার সামনে বসে। বিয়ার পান। করতে পারিনে।
ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব সরাসরি ঐ প্রতিবাদ নাকচ করে দিয়ে বললেন, আপনাকে আমার সাথে বসে বিয়ার পান করতে হবে। এটা আমার আদেশ। বেয়ারা, ইন্সপেক্টর সাহেবের গ্লাস ভরে দাও। তাঁর জন্য মধ্যাহ্ন ভোজেরও ব্যবস্থা কর।
সাব-ইন্সপেক্টর সাহেব তাঁর গ্লাস বেয়ারার দিকে এগিয়ে দিলেন। আপনি আদেশ দিলে আমি অমান্য করতে পারি না। তিনি তাঁর মাথার পাগড়ি খুলে টেবিলের ওপর রাখলেন। শিখদের পাগড়ি যেমন খোলার পর বাঁধতে হয়, এই পাগড়ি তেমন নয়। এটা হল তিন গজ লম্বা শক্ত খাকি মসলিনের কাপড়ের চারপাশে নীল বেষ্টনীবিশিষ্ট টুপি, যা টুপির মত যখন-তখন পরা ও খোলা যায়।
মানো মাজরার পরিস্থিতি কেমন?
এখনও পর্যন্ত সব ঠিক আছে। গ্রামের মোড়ল নিয়মিত খবর দিচ্ছে। এ গ্রামের মধ্য দিয়ে এখনও কোন উদ্বাস্তু আসেনি। আমি নিশ্চিত, মানো মাজরার কেউ এখনও জানেই না যে বৃটিশরা চলে গেছে এবং দেশটা পাকিস্তান ও হিন্দুস্থানে ভাগ হয়ে গেছে। অনেকে গান্ধীর নাম শুনেছে, কিন্তু জিন্নাহর নাম কেউ শুনেছে বলে আমার সন্দেহ আছে।
খুব ভাল। মানো মাজরার ওপর আপনি দৃষ্টি রাখবেন। সীমান্তের কাছে এটাই গুরুত্বপূর্ণ গ্রাম। এটা ব্রিজেরও খুব কাছে। গ্রামে কোন অসৎ চরিত্রের লোক আছে?
মাত্র একজন স্যার। তার নাম জুগ্গা। আপনি দয়াপরবশ হয়ে তাকে গ্রামেই নজরবন্দী করে রেখেছেন। সে প্রতিদিনই মোড়লের কাছে রিপোর্ট করে এবং সপ্তাহে একবার থানায় হাজিরা দেয়।
জুগ্গা? সে কে?
আপনার বোধ হয় ডাকাত আলম সিং-এর কথা স্মরণ আছে, দুবছর আগে যার ফাঁসি হয়েছিল। জুগ্গাত্ সিং তারই ছেলে। বেশ লম্বা। এ এলাকায় সে-ই সবার চেয়ে লম্বা। ছ’ফুট চার ইঞ্চি তো হবেই। মোটাও তেমনি। শক্ত সমর্থ ষাঁড়ের মত।
ও হ্যাঁ, আমার মনে পড়ছে। সে খারাপ কাজ থেকে দূরে থাকার জন্য কিছু করে? প্রতি মাসেই তো সে একটা না একটা মামলায় আমার সামনে হাজির হয়।
সাব-ইন্সপেক্টর সাহেব খোলা মনেই হাসলেন। স্যার, পাঞ্জাবের পুলিশ যা করতে পারেনি, ষোল বছরের একটি মেয়ের, দু’টো চোখের যাদুই তা করেছে।
হুকুম চাঁদের উৎসাহ বেড়ে গেল।
তার সাথে কি সম্পর্ক আছে? তিনি জিজ্ঞাসা করলেন।
হ্যাঁ, এক মুসলমান তাঁতীর মেয়ের সাথে তার সম্পর্ক আছে। মেয়েটি কালো, তার চোখ দু’টো অধিক কালো। সে-ই জুগ্গাকে গ্রামে আটকে রেখেছে। ঐ মুসলমানের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস কারো নেই। মেয়েটির অন্ধ পিতা গ্রামের মসজিদের মোল্লা।
বেয়ারা দুপুরের খাবার না দেওয়া পর্যন্ত তাঁরা দুজন বিয়ার পান করলেন এবং সিগারেট জ্বালালেন একটার পর একটা। খাওয়ার পরও তারা দুজনে বিয়ার পান করলেন, সিগারেট ধরালেন এবং জেলার পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করলেন বিকেল পর্যন্ত। বিয়ার ও বেশি খাবার খাওয়ার জন্য হুকুম চাঁদের চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসতে লাগল। সূর্যের কিরণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বারান্দার চিক নীচু করে দেওয়া হয়েছিল। টানা পাখা চলছিল ধীরে ধীরে। হুকুম চাঁদ ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন। তিনি তাঁর রূপার দাঁত খিচুনি বের করে দাঁতের ফাঁকে ঢোকালেন এবং টেবিলের ওপর পাতা কাপড়ে তা মুছলেন। এত কিছু করেও তিনি ঘুমঘোর থেকে অব্যাহতি পেলেন না। সাব-ইন্সপেক্টর সাহেব লক্ষ্য করলেন যে, ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব নাক ডাকছেন। তিনি বিদায় নেওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালেন।
আমাকে স্থান ত্যাগ করার অনুমতি দিন স্যার।
আপনি বিশ্রাম নিতে পারেন, পাশেই একটা বিছানা আছে।
আপনি মেহেরবান স্যার। স্টেশনে আমার কিছু কাজ আছে। আমি দুজন কনষ্টেবলকে রেখে যাচ্ছি। আপনি যদি আমার উপস্থিতি প্রয়োজন মনে করেন, তাহলে তারা আমাকে ডেকে দেবে।
ঠিক আছে, ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব ইতস্তত করে বললেন, আপনি কি রাতের জন্য কোন ব্যবস্থা করেছেন?
ঐ ব্যাপারটা খেয়ালে না রাখা কি আমার পক্ষে সম্ভব? সে যদি আপনাকে খুশি করতে না পারে তাহলে আপনি আমাকে চাকুরী থেকে বরখাস্ত করে দেবেন। আমি ড্রাইভারকে বলে দেব, কোথায় যেতে হবে এবং কাকে আনতে হবে।
সাব-ইন্সপেক্টর সাহেব তাঁকে সালাম জানিয়ে চলে গেলেন। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন এবং দিবানিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন।