প্রথম অধ্যায় । নবি মুহাম্মদ । মুহাম্মদের নবি হয়ে ওঠা
মক্কা থেকে তিন মাইল দূরে অবস্থিত হেরা পর্বত। শুষ্ক এক শিলাময় স্থান। এই পর্বতের ঢাল বেয়ে ওঠা অত্যন্ত কঠিন কাজ। কিন্তু পর্বতের গুহার ভেতর তৎকালীন অনেক হানিফ নিয়মিত যেতেন নির্জন আশ্রয় ও একাকী ধ্যান করার জন্য। মুহাম্মদও বেশ কিছু দিনের জন্য তাই করছিলেন। বাস্তব জীবনের কোলাহল থেকে মুক্তি পেয়ে একাকী কিছু সময় অতিবাহিত করার স্পৃহা মুহামদকে অনেক বার এই স্থানে নিয়ে আসতো। কখনো কখনো মুহামদ সাথে করে আহার সামগ্ৰী নিয়ে যেতেন এবং গুহা থেকে বের হতেন না আহার ফুরিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত। কখনো কখনো আবার খুব ভোরে তিনি চলে যেতেন আর সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে আসতেন।
৬১০ খ্রিস্টাব্দে একদিন মুহাম্মদ ঘরে ফিরলেন না। কথা ছিল সেদিন সন্ধ্যায় তিনি ঘরে আসবেন। উৎকণ্ঠিত খাদিজা লোক পাঠালেন মুহাম্মদের খোঁজে। অবশ্য অল্পসময় পরে মুহাম্মদ দুয়ারে উপস্থিত হয়ে গেলেন। তাঁকে বিবর্ণ দেখাচ্ছিল এবং শরীর কপিছিল। তিনি বললেন ; আমাকে আবৃত করো তখন তাঁকে চাদর দিয়ে আবৃত করা হলো। কিছু সময় পর যখন মুহাম্মদ স্বাভাবিক হলেন এবং সংবিৎ ফিরে আসলে তিনি খাদিজাকে ঘটনা বর্ণনা করেন।
নির্ভরযোগ্য হাদিস সংগ্রাহক বুখারি, মুসলিম বিন আল হাজ্জাজ, আবু দাউদ আল তায়ালিসি, ইবনে আব্দুল আল-বার, নুয়ারি এবং ইবনে সাইয়েদ আন-নাস প্রণীত হাদিস গ্রন্থে এবং বিখ্যাত ধর্মবিশারদ ইমাম আহমদ বিন হানবলের (১৬৪ হিজরি বা ৭৮০ খ্রিস্টাব্দ-২৪১ হিজরি/৮৫৫ খ্রিস্টাব্দ) মুসনাদে বর্ণিত : হজরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ-এর প্রতি সর্বপ্রথম যে ওহি আসে, তা ছিল ঘুমের মধ্যে সত্য স্বপ্নরূপে। যে স্বপ্নই তিনি দেখতেন তা একেবারে ভোরের আলোর ন্যায় প্রকাশ পেত। তারপর তাঁর কাছে নির্জনতা প্রিয় হয়ে পড়ে এবং তিনি হেরা-গুহায় নির্জনে থাকতেন। আপন পরিবারের কাছে ফিরে আসা এবং কিছু খাদ্যসামগ্রী সঙ্গে নিয়ে যাওয়া, এভাবে সেখানে তিনি একাধারে বেশ কয়েক রাত ইবাদতে নিমগ্ন থাকতেন।
তারপর খাদিজা (রা)-র কাছে ফিরে এসে আবার অনুরূপ সময়ের জন্য কিছু খাদ্যসামগ্ৰী নিয়ে যেতেন। এমনিভাবে হেরা-গুহায় অবস্থানকালে একদিন তাঁর কাছে ওহি এলো। তাঁর কাছে ফেরেশতা এসে বললেন, ‘পড়ুন। রসূলুল্লাহ (সা) বলেন ; আমি বললাম, আমি পড়ি না”। [বাংলাদেশের ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত বুখারী শরীফ, প্রথম খণ্ড, হাদিস নম্বর ৩, পৃ. ৫ থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে।-অনুবাদক]
হাদিস অনুযায়ী মুহাম্মদ তাঁর অভিজ্ঞতা খাদিজাকে জানালেন এভাবে ; তারপর তিনি (ফেরেশতা) আমাকে জড়িয়ে ধরে এমনভাবে চাপ দিলেন যে, আমার অত্যন্ত কষ্ট হলো। তারপর তিনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, ‘পড়ুন। আমি বললাম আমি তো পড়ি না। তিনি দ্বিতীয়বার আমাকে জড়িয়ে ধরে এমনভাবে চাপ দিলেন যে আমার অত্যন্ত কষ্ট হলো। এরপর তিনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন : পড়ুন। আমি জবাব দিলাম, আমি তো পড়ি না। রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, তারপর তৃতীয়বার আমাকে জড়িয়ে ধরে চাপ দিলেন। এরপর ছেড়ে দিয়ে বললেন, পড়ুন আপনার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে আলাক থেকে। পড়ুন, আর আপনার রব মহামহিমাম্বিত। (৯৬:১-৩)। এরপর ফেরেশতা উধাও হয়ে গেলেন। আমি সজাগ হলাম এবং ঘরের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করলাম। হাদিসের অনুবাদটি ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বুখারী শরীফ থেকে সংগৃহীতঅনুবাদক)। পরে মুহাম্মদ খাদিজাকে জানালেন যে তিনি তাঁর জীবনের জন্য ভীত ছিলেন। এ-সবের কী ব্যাখ্যা দেয়া যেতে পারে? কেন তিনি এত ভীত হলেন? মুহাম্মদ কী ভেবেছিলেন তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলছেন, কোনো জাদুর প্রভাবে পড়েছেন, অথবা কোনো নিরাময়-অযোগ্য রোগ তাঁকে কাবু করেছে? এই প্রশ্নের উত্তর আমরা কিছুটা পাই খাদিজা যখন মুহাম্মদকে সান্তুনা দিয়ে উত্তর দিলেন: আপনি একজন অতিশয় সৎ ব্যক্তি। আপনি দরিদ্রদের প্রতি অত্যন্ত সদয়, আপনি অতিথি-বৎসল, আপনি আপনার পরিবারের প্রতি এত স্নেহশীল, পীড়িতদের প্রতি আপনি অত্যন্ত উপকারী। তাই বিধাতা কখনোই আপনাকে তাঁর যত্ন থেকে বঞ্চিত করবেন না।”
খাদিজার সাথে কথোপকথনের পর মুহাম্মদ স্বাভাবিক হলেন। তখন খাদিজা তাড়াতাড়ি গৃহ থেকে বের হলেন এ ঘটনা তাঁর চাচাতো ভাই ওয়ারাকা বিন নওফলকে জানানোর জন্য। হানিফ মতাবলম্বী ওয়ারাক মক্কাবাসীর পৌত্তলিকতাকে ঘৃণা করতেন। তাই ওয়ারাকা একদা মুহামদকে উপদেশ দিয়েছিলেন কুরাইশদের এড়িয়ে চলতে। তিনি মুহামদকে ধ্যান এবং আধ্যাত্মিক কর্মে অনুরক্ত হতেও উপদেশ দিয়েছিলেন। খাদিজার মুখে ঘটনাবলী শুনে ওয়ারাকা বললেন: “খুব সম্ভবত এই ঘটনা ইঙ্গিত দিচ্ছে আল্লাহ তাঁকে তত্ত্বাবধায়ক করছেন এবং মানবতাকে পথ দেখানোর জন্য তাঁকে নির্দিষ্ট করেছেন।”
আয়েশার এই বক্তব্য থেকে অতিপ্রাকৃত কিছুই পাওয়া যায় না। তাঁর সকল বর্ণনা মনোবিজ্ঞানের সাধারণ তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে। মনের মধ্যে প্রবল ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা থাকলে কল্পনার জগতে মানুষ তার বাস্তবায়ন ঘটায় নানাকিছু ভাবনা-চিন্তা করে, নানা কাহিনীর জাল বুনে। কল্পনার জগতে বিরাজ করতে করতে মানুষ অনেক সময় কল্পনার জগত আর বাস্তব জগতের মধ্যে তফাৎ করতে পারে না। তার মধ্যে ভ্রম সৃষ্টি হতে পারে। তার মনে হয় দীর্ঘদিনের লালিত ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা যেন বাস্তবে পরিণত হয়েছে। মুহাম্মদ ত্রিশ বছর ধরে চিন্তা-ভাবনায় মশগুল ছিলেন। তিনি বিভিন্ন অঞ্চলের সন্ন্যাসী-ঋষির সাথে সুদীর্ঘ আলোচনা করেছেন। একেশ্বরবাদের প্রতি গভীরভাবে একনিষ্ঠ হয়েছেন। এরপর হেরা পর্বতের গুহায় ধ্যানরত হন এবং সেখানে অনেক কঠোর তাপসদের সংস্পর্শে আসেন। তাঁদের পৌত্তলিকতা বিরোধিতা এবং একেশ্বরবাদের ভাষ্য তাঁকে আলোড়িত করে। সব মিলিয়ে স্রষ্টা-সৃষ্টি-ধর্ম সম্পর্কিত প্রশ্নে মুহাম্মদের মন প্রচণ্ড উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। তাই একসময় হেরা পর্বতের গুহায় নির্জনে ধ্যান করতে করতে তাঁর ধারণা হলো, কোনো অশরীরী আত্মা তাঁর সামনে উপস্থিত হয়েছে। অথবা এটা এমনও হতে পারে যে, ধ্যানরত অবস্থায় তাঁর অবচেতন মন থেকে সাড়া আসলো এখন সময় এসেছে সক্রিয় হবার। সক্রিয় হবার ভীতি তাঁর মনে এতোই প্রভাব বিস্তার করল যে, তিনি প্রণত হলেন এবং জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এছাড়া নিজের জ্ঞান হারিয়ে ফেলার পূর্বে দেবদূত (ফেরেশতা) তাঁকে কাবু করে ফেলার ঘটনার আর কোনো বিশ্বাসযোগ্য বাস্তবসমত ব্যাখ্যা দেয়া যায় না। এখানে দেবদূতের আবির্ভাব তাঁর মনে দীর্ঘ লালিত সুপ্ত আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন মনে করা যেতে পারে।
এই বিশ্লেষণ পুরোটা অনুমানিক হলেও এর সমর্থন পাওয়া যায় অন্য এক ভাষ্য থেকে। এই ভাষ্য অনুযায়ী মুহাম্মদ একবার খাদিজাকে বলেছিলেন : ‘আমি যখন ঘুমাচ্ছিলাম তখন তিনি (ফেরেশতা) একটা সুদৃশ্য কাপড় দিয়ে ঢাকা একটা বই নিয়ে আসলেন। ফেরেশতা বললেন, ‘পড়ুন! আমি জেগে উঠলাম এবং মনে হলো যেন আমার হৃদপিণ্ডে একটা বই স্থাপিত হয়েছে। এই ভাষ্য থেকে মনে করা যায়, প্রগাঢ় ধ্যানের শ্রান্তি মুহামদকে ক্রমেই মোহগ্ৰস্ত করে ফেলে। তিনি ঘুমের সময়ও তাঁর তীব্র আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন দেখতে পান স্বপ্নে। এই স্বপ্নদর্শন তাঁর চেতনার জগতকে সন্ত্রস্ত করে দেয়। হজরত আয়েশার আরেকটি বর্ণনা আছে : ‘আল্লাহর নবির তখন শরীর কাঁপছিল। তিনি খাদিজাকে বললেন, “আমাকে চাদর দিয়ে ঢেকে দাও!”খাদিজা তাঁকে চাদর দিয়ে ঢেকে দিলেন। অবশেষে তাঁর কাঁপুনি দূর হলো। [ আয়েশা বর্ণিত হাদিসটির বাংলা অনুবাদের সূত্র উপরে উল্লিখিতঅনুবাদক)। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে মুহাম্মদের শরীরে কাঁপুনি সৃষ্ট হয়েছিল তার নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণা থেকে। ধারণা করা যায়, এই ধরনের অবস্থা হয় সেই ব্যক্তির, যে দ্বৈত জীবনযাপন করে-একদিকে সাধারণ জীবন, অন্যদিকে স্বপ্নময় অলীক অভ্যন্তর জীবন। এই দুই জীবনের মধ্যেকার তফাৎ তৈরি করতে অক্ষম সেই ব্যক্তি। এই ঘটনার পর মুহাম্মদ আরও দুইবার হেরা পর্বতের ঐ নির্জন গুহায় যান। কিন্তু এবার আর কোনো কিছু দেখলেন না; কোনো ফেরেশতা আসলেন না, বা কারো কণ্ঠস্বরও শুনতে পেলেন না। মুহামদকে লেখাপড়া না-জানা একজন মানুষ হিসাবে চিত্রিত করা হয়। তাহলে কেন মহান আল্লাহ তাকে ইকুরা অর্থাৎ “পড় এই আদেশ দিয়ে সুরা নাজিল করবেন?]
মুহাম্মদের এই পুরো অভিজ্ঞতাটি স্বপ্ন বা অলীক বিশ্বাস ছাড়া কি বেশি কিছু ছিল? এটা কী নবুওতি প্রদানের কোনো আলামত ছিল কিংবা ওয়ারাকা বিন নওফলের কোনো ভবিষ্যদ্বাণী ছিল? এরপর থেকে ক্ষয়িষ্ণু সন্দেহে মুহামদের মন জর্জরিত হতে থাকে। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌছায় যে, কয়েকবার তিনি উচু পাহাড়ের উপর থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যার কথা চিন্তা করলেন। কিন্তু খাদিজা ও ওয়ারাকা সর্বদা মুহামদকে শান্ত করতেন এবং আশার বাণী শোনাতেন।
ইসলামের ঐতিহাসিক ভাষ্যমতে মুহাম্মদের কাছে প্রত্যাদেশ বন্ধ থাকার সময়কাল বিভিন্ন রকম। অনেকের মতে এই ফাঁকা সময় ছিল তিনদিন, কেউ বলেন তিন মাস, আবার কারো কারো মতে তিন বছর। আবার কেউ কেউ বলেন এই অবস্থা বিরাজমান থাকে যতক্ষণ না সুরা মুদ্দাসসির নাজিল হয়। এরপরে আবার প্রত্যাদেশ আসা বন্ধ হয়ে যায়।
কী কারণে প্রত্যাদেশ আসা বিঘ্নিত হয় তা বোঝা কঠিন নয়। প্রথমবার স্বপ্নবিভোর হয়ে দেবদূত দেখার পর মুহাম্মদের মনে যে দীর্ঘদিনের জ্বলন্ত জিজ্ঞাসা ছিল তা প্রশমিত হয়ে যায়। ঐ দৈবদর্শনে সুদীর্ঘ সময় ধরে লালিত মনের গভীরে সঞ্চিত প্রশ্নসমূহের উত্তরের আগ্রহমিটে যায়। স্বভাবিকভাবেই এরপর আসে সন্দেহ এবং নৈরাশ্য। মনের ভেতর গচ্ছিত আকাঙ্ক্ষাকে পুনর্বার প্রজ্জ্বলিত করার জন্য প্রয়োজন আরও একনিষ্ঠ ধ্যান এবং গভীর একাগ্রতা; যা মস্তিষ্ককে আলোড়িত করবে, এবং একসময় আবারও বাস্তব ও কল্পনাএই দুই জগতের পার্থক্য ঘুচিয়ে দেবে। ফলে অন্তর্মুখী মুহাম্মদের মানস সরোবরে যা লুকিয়ে আছে তা আবার ভেসে উঠবে এবং তাঁকে তাড়িত করবে।
উপরে হজরত আয়েশার দেয়া বিবরণ আমরা পড়েছি। মুহাম্মদের মৃত্যুর এক শতাব্দী পূরণের আগেই একেবারে ভিন্ন বক্তব্য আসতে থাকে। এই স্বল্প সময়ের মধ্যেই তাঁর জীবন নিয়ে বিভিন্ন ধরনের কাহিনী সত্য বক্তব্যের ভেতরে ঢুকে পড়ে। যতই দিন যেতে থাকে ততই কাল্পনিক ও অলৌকিক ঘটনার সমারোহ বৃদ্ধি পায়। এ ব্যাপারে ইবনে ইসহাকের লেখা নবির জীবনী যা ইবনে হিশামের পাণ্ডুলিপিতে এখনো পাওয়া যায়, তার কিছু কিছু উল্লেখ রয়েছে। ইবনে ইসহাক হিজরি ১৫০ (৭৬৭ খ্রিস্টাব্দ) সালে মারা যান এবং মৃত্যুর কিছু আগে তাঁর লেখা শেষ করেন। এখানে তাঁর বই থেকে কিছু উদ্ধৃতি দেয়া হলো: নবি হবার আগে যখন মুহাম্মদ প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে মক্কার বসতবাড়ির বাইরে যেতেন এবং যখন বসতবাড়ি একটি বাঁকের পেছনে দৃষ্টিসীমার বাইরে যেত, তখন প্রত্যেক পাথরের শীলাখণ্ড যার পাশ দিয়ে হেঁটে যেতেন, এরা বলে উঠতো ; হে আল্লাহর প্রতিনিধি! আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক! কিন্তু এদিক-সেদিক তাকালে মুহাম্মদ কাউকে দেখতে পেতেন না। তাঁর চারিদিকে শুধু দেখতেন গাছপালা এবং পাথরখণ্ড।’
একখণ্ড পাথর নিম্প্রাণ বস্তু। আর গাছগাছালির শব্দ সৃষ্টির জন্য কণ্ঠনালী নেই, যা দ্বারা তারা তাদের চিন্তা বা অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে। যুক্তির বিচারে এই গল্প এতোই অনুপযুক্ত যে, পরবর্তীতে নবির অনেক জীবনীকারক এই গল্প সম্পূর্ণ বিশ্বাস করেতে পারেননি। তাঁরা বলেন, যে কণ্ঠস্বর শোনা যেত তা হবে ফেরেশতার কণ্ঠস্বর। নবির জীবনীকারকদের ভাবনায় এই বিষয়টি আসেনি যে, মুহাম্মদ যদি এরকম ডাক কখনো শুনেও থাকেন সেটা হতে পারে নিজেরই অন্তরের ডাক। গায়েবি কিছু নয়। অনেক বছরের একাগ্র ধ্যান ও একই চিন্তায় নিমগ্নতার ফলে সে চিন্তাভাবনা বাস্তব মনে হতে পারে এবং তা অনেক সময়
যাহোক, ধর্মবিশারদের উদ্বিগ্ন হলেও ইবনে হিশামের বক্তব্য নিয়ে বিরোধিতা করতে চান না। তাই তাঁরা এই রহস্যপূর্ণ কণ্ঠস্বরকে কোনো দেবদূত বা ফেরেশতার কণ্ঠস্বর বলে চালিয়ে দিতে চান। কিন্তু এর ফলে কী অনুসিদ্ধান্ত দাঁড়ায় তা বুঝতে তাঁরা ব্যর্থ। ফেরেশতা যদি মুহামদকে সত্যিই সম্ভাষণ করতেন, নিশ্চয়ই তাঁরা তা করতেন প্রকাশ্যে, সবার সামনে। আড়ালে বা লুকিয়ে সম্ভাষণ করার কোনো প্রয়োজনীয় দিক বা উপযোগিতা নেই। প্রকাশ্যে করলে মক্কাবাসী সকলে একবাক্যে মুহাম্মদের কথায় বিশ্বাস করতেন, এবং আল্লাহর যে আসল অভিপ্রায় ছিল সমস্ত আরবজাতিকে ইসলামে দীক্ষিত করার, তাও পূর্ণ হয়ে যেত তাড়াতাড়ি কোনো ধরনের সমস্যা ছাড়াই। এসব ধর্মবিশারদদের নজরে আসেনি যে তথাকথিত গায়েবি আওয়াজ নবির নিজস্ব কাল্পনিক ভাবনা থেকে উৎপন্ন হতে পারে। অথবা অন্য বিষয়েও কিছু চিন্তা করা যেত। নবি শহরের বাইরে শুধুমাত্র একা গেলেই যদি সেই কণ্ঠস্বর শুনতেন তবে অন্যরা কিভাবে তা জানতে পারলেন? নবি কোনোদিন এই বিষয়ে কিছু বলেননি। এমন-কী কোনো প্রামাণিক হাদিসেও এই ঘটনার বিবরণ নেই। সুতরাং এটা পরিষ্কারভাবে এক কল্পকাহিনী ছাড়া আর কিছুই নয়।
তবে ইবনে ইসহাক যে পরিকল্পিতভাবে মিথ্যা সংবাদ দিয়েছেন তাও বলা যায় না। তিনি নিশ্চয়ই কারো কাছ থেকে এই বক্তব্য শুনেছেন এবং কোনো প্রশ্ন ছাড়াই তা গ্রহণ করেছেন। কেননা এই বক্তব্য তাঁর নিজের অলৌকিকতার প্রতি বিশ্বাসের সাথে খাপ খায়। সম্ভবত ইবনে ইসহাক নিজেকে বা সংবাদদাতাকে জিজ্ঞাসা করেননি যে, অন্য কেউ কী শুনেছে পাথরের টুকরো অথবা গাছপালা নবিকে সম্ভাষণ জানিয়েছে। তাছাড়া নবি নিজে এই ঘটনা ব্যক্ত করেছেন এই ধরনের কোনো আলামত সংবাদদাতার কাছে ছিল কী না। আল্লাহ যে মুহাম্মদকে নিজের মনোনীত দূত বানিয়েছেন তার একমাত্র দাবি হচ্ছে মুহাম্মদের স্ত্রী আয়েশার বিবৃতি, যা আগেই আমরা দেখেছি।
বেশিরভাগ মানুষই তার অর্জিত বিশ্বাসের মধ্যে বন্দী এবং শারীরিক ও সহজাত প্রবৃত্তির প্রতি অনুগত। আর এতে মানুষের যৌক্তিক ক্ষমতা হ্রাস পায়। পরিষ্কারভাবে চিন্তা-বিশ্লেষণ তারা করতে পারে না। তখন তারা আসল ঘটনাকে উপেক্ষা করে যা তাদের বিশ্বাসের সাথে সংঘাত সৃষ্টি করে। তারা যা কিছুর মধ্যে তাদের ধারণা ও বিশ্বাসের আলামত পায় তাকেই আঁকড়ে ধরে। মানুষের এই আচরণ ও মানসিকতাই হচ্ছে কুসংস্কার এবং বিভ্রম বিস্তারের কারণ।