০৪. মধ্যযুগ : ভারতে মুসলিম আগমন
দখলদারি রাজনীতির ইতিহাস বহু পুরোনো ইতিহাস। যবদ্বীপের প্রাচীন অর্থাৎ হিন্দুযুগের ইতিহাসের প্রথম কল্প বড়োই অন্ধকারময়। ভারতবর্ষ থেকে খুব সম্ভব পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতবর্ষ থেকে ব্রাহ্মণ্য ধর্মাবলম্বী বণিকরা এসে উপনিবেশ করে এবং যবদ্বীপের আদি মালয় জাতীয় অধিবাসীদের সঙ্গে বিবাহসূত্রে মিলিত হয়ে হিন্দু যবদ্বীপীয় অভিজাতবর্গের সৃষ্টি করে। প্রথম যুগের এই মিশ্র ভারতীয়-যবদ্বীপীয় জনগণের ধর্ম ব্রাহ্মণ্যই ছিল। ইতোমধ্যে সুমাত্রা দ্বীপেও হিন্দু বা ভারতীয় উপনিবেশ গড়ে ওঠে। সুমাত্রায় আগত ভারতীয়রা বোধহয় উত্তর ও পূর্ব ভারত থেকেই আসে। এরপর সুমাত্রা বৌদ্ধদের দখলে চলে আসে শৈলেন্দ্র বংশের শাসনকালে। বৌদ্ধধর্মের দাপটে ব্রাহ্মণ্যধর্ম সংকুচিত হয়ে পড়ে যবদ্বীপেও। মগধকে কেন্দ্র করে মৌর্যযুগ ভারতের ইতিহাসে এক নব-ভারত সৃষ্টি করেছিল। মৌর্যযুগের শেষে যবন, শক, কুষাণ প্রভৃতি ভিনদেশি জাতি ভারতে প্রবেশ করে ভারতীয় জাতিদের মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। কুষাণ যুগে আবার বৌদ্ধধর্ম নতুনরূপে এশিয়ার বিভিন্ন অংশে প্রচারিত হল। তারপর শুরু গুপ্তযুগ। ব্রাহ্মণ্য তথা পৌরাণিক হিন্দুধর্মের পুনরুত্থান। মুসলমানদের আগমন পর্যন্ত এই প্রবাহ অব্যাহত ছিল। ভিনদেশ আর্যরাও। বৈদিক যুগে বহিরাগত আর্যদের সঙ্গে প্রাচীন ভারতবাসীর দীর্ঘকালব্যাপী রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম বা যুদ্ধ হয়েছিল। বিজেতা আর্যরা এই সমস্ত বিজিত জাতির নামকরণ করেছিল অসুর, দৈত্য, দানব, রক্ষ, যক্ষ, নাগ, অপ্সরা, দাস, কিরাত ইত্যাদি। কালক্রমে এঁদের কেউ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, কেউ-বা বনাঞ্চলে অথবা পার্বত্য অঞ্চলে আশ্রয় গ্রহণ করে, কেউ-বা সমুদ্র অতিক্রম করে ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপাঞ্চলে বসবাস করতে থাকে, আবার কেউ বা আর্য জাতির মধ্যে বিলীন হয়ে যায়। গৌতমবুদ্ধের সময়কালে ইরানের আকামেনীয়রা ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে কয়েকটি উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। তাঁরাও কালক্রমে ভারতবাসী মধ্যে বিলীন হয়ে যায়। বুদ্ধের পরবর্তী সময়ে নন্দবংশের রাজত্বকালে গ্রিকরা ভারতবর্ষ আক্রমণ করে। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর ভারতের সীমান্তে বহুীক বা বাকট্রিয়া অঞ্চলে কয়েকটি উপনিবেশও গড়ে ওঠে। কালক্রমে গ্রিকরা সীমান্তবর্তী ভারতবাসীর মধ্যে বিলীন হয়ে যায়।
খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দী থেকে সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত বহু বৈদেশিক জাতি ভারতে প্রবেশ করে দখল নিয়েছিল। এঁদের মধ্যে শক, পহুব, ইউচি, কুষাণ ইত্যাদি জাতি ভারতীয় জাতির সঙ্গে মিশে গেছে। গুপ্ত ও গুপ্তোত্তর যুগে মধ্য এশিয়া থেকে হুন, গুর্জর জাতি দক্ষিণে গুজরাট এবং পূর্ববঙ্গের সীমান্ত পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিল। পরবর্তীকালে তাঁরা হিন্দুর ধর্ম ও সভ্যতা গ্রহণ করে ভারতীয় জাতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছে। এই গুর্জর জাতি খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে মুসলমান কর্তৃক বিতারিত হয়ে ইরানের পারসিক জাতির একটি অংশ সমুদ্রপথে এসে ভারতের সিন্ধু, গুজরাট এবং বোম্বাই অঞ্চলে বসবাস করতে আরম্ভ করে। অষ্টম শতাব্দীতে অসংখ্য আরব ভারতের পশ্চিম উপকূলে সিন্ধুদেশে বসবাস আরম্ভ করেছিল। একাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ থেকে গজনী এবং ঘুর অঞ্চল থেকে বহু তুর্ক, আফগান ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে ও পাঞ্জাবে বসতি স্থাপন করেছিল। তাঁদের অনুসরণ করে ৩০০ বছর পর্যন্ত তুর্ক, আফগান, মোগল, তাতার, পারসিক প্রভৃতি জাতি ভারতে বসতি স্থাপন করে। এই বহিরাগত জাতিরা বিভিন্ন গোষ্ঠীর ভারতবাসীর সঙ্গে বিবাহ-সম্বন্ধ স্থাপন করে একটি ভারতীয় মিশ্র মুসলিম জাতি গঠিত হয়েছে। এই সময় চিন, মধ্য এশিয়া, তিব্বত এবং ব্রহ্ম থেকে মোঙ্গল জাতির বিভিন্ন শাখা হিমালয়ের পাদদেশে বসবাস করতে শুরু করে। এই মোঙ্গলরা কাশ্মীরের লাদাখ, চিত্রল, কুমায়ুন, গাড়োয়ালের বাসিন্দা। খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে পশ্চিমের জলপথে পোর্তুগিজরা পশ্চিমে গোয়া এবং বঙ্গোপসাগরে দ্বীপাঞ্চলে বসবাস করতে শুরু করে। ভারতীয় গোয়ানিজ এবং পূর্ববঙ্গের উপকূলবাসী খ্রিস্টানরা অনেকেই এই পোর্তুগিজ জাতিরই বংশধর। ভারতীয়দের সঙ্গে তাঁদের রক্তের মিশ্রণ ঘটেছে। চট্টগ্রামের পূর্বাঞ্চলে ব্ৰহ্ম জাতির বংশধররা ‘মগ’ নামে পরিচিত। বাংলাদেশে বর্মন উপাধিধারী গোষ্ঠীর সঙ্গে এঁদের সম্বন্ধ অনুমান করা যায়। এই সূত্র ধরে ১৯০১ সালে স্যার হার্বাট রিজলি ভারতবাসীদের সাত ভাগে ভাগ করা হয়। যেমন –(১) মোঙ্গলীয়, (২) ভারতীয় আর্য, (৩) দ্রাবিড়, (৪) মোঙ্গলীয়-দ্রাবিড়, (৫) আর্য-দ্রাবিড়, (৬) শক-দ্রাবিড়, (৭) তুর্ক-ইরানীয়। ১৯১৬ সালে বিখ্যাত ঐতিহাসিক ও নৃতত্ত্ববিদ রমাপ্রসাদ চন্দ একটি গ্রন্থে রিজলির মত খণ্ডন করেন। ১৯৩১ সালে আদমসুমারির সময় ডক্টর হার্টন ভারতের অধিবাসীদের আট ভাগে ভাগ করেন। প্রখ্যাত নৃতাত্ত্বিক ডক্টর বিরজাশঙ্কর গুহ সমগ্র ভারত উপমহাদেশীয়দের ছয়টি ও নয়টি উপবিভাগে বিভক্ত করে। যেমন–
(১) নেগ্রিটো জাতি : এঁদের পূর্বপুরুষ আফ্রিকার ‘নিগ্রো। বর্তমানে জনসমুদ্রে এঁরা বিলীন। এঁদের বংশধররা আন্দামান, নিকোবর এবং সামান্য পরিমাণে কোচিন, ত্রিবাঙ্কুর, আসামের অঞ্চল ও রাজমহলে ছড়িয়ে আছে। এই জাতি খর্বকায়, কৃষ্ণবর্ণ ও কুঞ্চিতকেশ।
(২) আদিম অস্ট্রোলয়েড জাতি : এই জাতি ইন্দোচিন থেকে ভারত উপমহাদেশে প্রবেশ করেছে। এঁদের বহু অংশ ভারতের বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে গেছে। বাকি অংশ ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ায় চলে গেছে। এঁরা কৃষ্ণকায়, চওড়া কপাল, মোটা নাকের অধিকারী।
(৩) মোঙ্গলীয় জাতি : এঁরা মধ্য এশিয়া ও হিমালয়ের অপরপ্রান্ত থেকে এসে ব্রহ্ম, আসাম, চট্টগ্রাম ও ত্রিপুরার পার্বত্য অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছে। সিকিম, ভূটান, নেপাল, গাড়োয়াল, লাদাখ ও হিমালয়ের কাছাকাছি অঞ্চলের অধিবাসীরা মোঙ্গল জাতির বংশধর। কেউ কেউ এই জাতির মধ্যে কিরাত, কিন্নর প্রভৃতি জাতির সন্ধান পেয়েছে। এঁরা বিরলশ্মশ্রু, ছোটো নাক, অ-কৃষ্ণবর্ণ।
(৪) ভূমধ্যসাগরীয় জাতি : এঁদের আদি নিবাস ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল। এঁদের তিনটি শাখা (i) আদিম শাখা সেমিটিক জাতির অন্তর্ভূক্ত। এঁরা ইহুদি নামে পরিচিত। লম্বা নাক, ফর্সা গায়ের রং এই শাখার বৈশিষ্ট্য। (ii) ইউরোপীয় জাতির অন্তর্ভুক্ত। মূলত ভারতের পাঞ্জাব ও উত্তর গাঙ্গেয় উপত্যকা অঞ্চলে এঁদের বসতি। (iii) সম্ভবত এঁরা দ্রাবিড় জাতির পূর্বপুরুষ। এঁরা কৃষ্ণবর্ণ, মাঝারি গড়ন, অপুষ্ট শরীরের অধিকারী। বর্তমানে কানাড়ি, তামিল ও মালয়ীরা এই শাখার অন্তর্ভুক্ত।
(৫) পাশ্চাত্য প্রশস্তশির জাতি : এঁরা আলপাইন, দিনারীয় ও আর্মেনীয় জাতির সমন্বয়ে একটি জাতি। আলপাইন শাখা গুজরাট, মধ্য ভারত, উত্তরপ্রদেশ ও বিহার হয়ে পূর্বদিকে অগ্রসর হয়। দিনারীয় শাখা কণাদ, তামিলনাদ, ওড়িশা ও বাংলাদেশে আসেন। বোম্বাই প্রদেশে পার্সি জাতি (গুর্জর) আর্মেনীয় শাখার সন্তান।
(৬) নর্ডিক বা আর্য ভাষাভাষী জাতি : এই জাতি ভারত উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত, পাঞ্জাব, রাজপুতানা এবং গাঙ্গেয় উপত্যকায় অধিবাসী। মহারাষ্ট্র অঞ্চলের চিৎপাবন ব্রাহ্মণ, মধ্য ও উত্তরপ্রদেশের কনৌজি ব্রাহ্মণ, দাক্ষিণাত্যের গৌরবর্ণ ব্রাহ্মণ এবং ভারতের অন্যান্য অংশের উচ্চবর্ণের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে নর্ডিক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। ডক্টর গুহের মতে, এই জাতি খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ থেকে ১০০০ বছর আগে ভারত উপমহাদেশে প্রবেশ করেছিল। তাহলে দেখা যাচ্ছে প্রকৃত ভারতীয় অর্থাৎ ভূমিপুত্র-কন্যা বলতে বোঝাচ্ছে শুধুমাত্র তথাকথিত অসুর, দৈত্য, দানব, রক্ষ, যক্ষ, নাগ, অপ্সরা, দাস, কিরাত ইত্যাদিরা। এঁরা ছাড়া বাকি সব জাতিই ভিনদেশি, বহিরাগত।
এমন একটি অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্র সমন্বয়ের উপমহাদেশ ভারতে ভিনদেশি মুসলিমরা জাতিও প্রবেশ করেছিল। এমন একটা সময়, যখন অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলির মধ্যে একে অপরের কাছে শক্ৰমনোভাবাপন্ন অবস্থান। যখন ভিনদেশি আক্রমণকারী মুসলিম শাসকদের কাজে লাগিয়ে একে অন্যকে একহাত নেওয়ার সুযোগ নিতে থাকল। আর আক্রমণকারী মুসলিমরা তাঁদের সঙ্গে নিয়ে ক্ষমতার কেন্দ্রে ঢুকিয়ে দিয়ে হৃষ্টচিত্তে দিব্য ৮০০ বছর সাম্রাজ্য বিস্তার করে গেল। তাঁরা সাম্রাজ্য বিস্তারের সুযোগ পেল কীভাবে? এর জন্য দায়ী কারা? নন্দ ঘোষের ঘাড়ে সব। দোষ চাপিয়ে দিলে নিজেদের দোষমুক্ত রাখা যাবে? আর সাধারণ মানুষকে সঙ্গে না-নিয়ে কোনো দেশে কখনো সাম্রাজ্য বিস্তার করা সম্ভব? কেন সাধারণ মানুষ নতুন শাসকদের বরণ করে নিল? সব কি তলোয়ার দেখিয়ে হয় নাকি?
২১ বছর উমাইয়া সাম্রাজ্য শাসন করার পর আব্দুল মালিকের মৃত্যুর পর তাঁর সুযোগ্য পুত্র ওয়ালিদ ৮৬ হিজরি সনে খেলাফতির আসনে বসেন। ওয়ালিদ অত্যন্ত যোগ্য ব্যক্তি ছিলেন। শাসনক্ষমতা হাতে নিয়ে প্রথমেই খারেজিদের দমন করেন এবং সাম্রাজ্য বিস্তারে মনোনিবেশ করেন। ওয়ালিদের সময় মুসলিম সাম্রাজ্য বহুদূর পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল। ওয়ালিদ সেনাপতি হিসাবে দক্ষ ছিলেন না। কিন্তু হাজ্জাজ বিন ইউসুফ, মোহম্মদ বিন কাসিম, কোতায়বা, তারিক, মুসার মত কিছু অসীম সাহসী বীর ও রণনিপুণ সেনাপতির সাহায্যে ইসলামি সাম্রাজ্যকে বহুদূর ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন। এঁদের পরাক্রমশীলতায় এশিয়া, ইউরোপ আফ্রিকায় মুসলিম সাম্রাজ্যের পতাকা ওড়ে। মধ্য এশিয়ার তুর্কিরা মুসলমানদের উপর অত্যাচার চালাত। এজিদ বিন মোহাল্লাব তা দমন করতে ব্যর্থ হন। তখন ওয়ালিদ কোতাইবাকে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করেন। কোতাইবা তুর্কিদের পরাজিত করে বোখারা, বালখ, তুখাবিস্তান, সমরখন্দ প্রভৃতি জয় করেন। এরপর খোঁজাম্মা, শাশ ও ফরঘনা অধিকার করে চিন সীমান্ত পর্যন্ত অগ্রসর হন। ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হজরত মোহম্মদের মৃত্যুর প্রায় এক শতকের মধ্যে আরবের মুসলমান রাজ্যগুলি এক সর্বগ্রাসী শক্তি নিয়ে চতুর্দিক সাম্রাজ্য বিস্তার করতে লাগল। আরবিরা অত্যন্ত যুদ্ধবাজ ছিলেন। ইসলাম প্রবর্তনের আগেও, পরেও। ইসলাম প্রতিষ্ঠার পর ঘরে ‘শান্তির ধর্ম প্রতিষ্ঠা করে, ঘর ছেড়ে বহির্জগত শাসনের বাসনা নিয়ে একের পর এক দেশে ইসলাম ধর্মের বিস্তারের মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্য বিস্তার করে। কার্পাস বীজের মতো ছড়িয়ে পড়ল ইসলামের ধর্মীয়-শাসকরা। খ্রিস্ট্রীয় অষ্টম শতকের প্রারম্ভেই আরব সাম্রাজ্য আটলান্টিক মহাসাগর থেকে ভারতের সিন্ধু প্রদেশের সীমান্ত এবং কাস্পিয়ান সাগর থেকে মিশরের নিলনদ পর্যন্ত সমগ্র অঞ্চল দখল/অধিকার করে নিয়েছিল। স্পেন, পোর্তুগাল, ফ্রান্সের দক্ষিণের কিয়দংশ, আফ্রিকা মহাদেশের সমগ্র উত্তর উপকূল, নিলনদের অববাহিকা অঞ্চল, মেসোপটামিয়া, সিরিয়া, পারস্য, আফগানিস্তান, বেলুচিস্তান, অক্ষুনদীর উপত্যকা অঞ্চল প্রভৃতি আরব সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হল। ডক্টর কিরণচন্দ্র চৌধুরী তাঁর ‘ভারতের ইতিহাসকথা’ গ্রন্থে বলেছেন– “৭৩২ সালে ফ্রাঙ্কোনিয়া (ফরাসি-জার্মান) রাজ্যের চার্লস মার্টেলের (Charles Martel) হাতে টুয়রসের (Tours) যুদ্ধে মুসলমান শক্তি পরাজিত না-হলে সমগ্র ইউরোপ তথা বিশ্ব। মুসলমান শাসন ও ইসলাম ধর্ম বিস্তৃত হত, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।” তবে অন্য ইতিহাসও জানা যায়। “The Preaching of Islam’ গ্রন্থে Thomas Walker Arnold লিখেছেন– “বলপ্রয়োগ নয়, বরং শান্তিপূর্ণ পন্থায় স্বাভাবিক প্রচারণাই ছিল ইসলাম ধর্মপ্রচারের বৈশিষ্ট্য ও ধারা।” ‘A Short History of Muslim Rule in India’ গ্রন্থে Ishwari Prasad লিখেছেন– “ভারতবর্ষে বলপূর্বক ইসলাম বিস্তার করা হয়নি। কারণ ইতিহাসে অমুসলমানদের প্রতি অকথ্য নির্যাতনের কোনো নজির নেই।”
ইতিহাস তো জানব, তার আগে ভূগোলটাও জানব– ভারতবর্ষের ভূগোল। এখন পর্যন্ত যে ইতিহাস লিখছি যে ভারতের ইতিহাস লিখছি সেই ভারতবর্ষের ভৌগোলিক সংজ্ঞা ও নামের তাৎপর্য অন্বেষণ করতে পারি। বর্তমান ভারতের সংবিধানের প্রথম বাক্যটি হল –“India, that is Bhart, will be a Union of States.” যার নাম ইন্ডিয়া, তারই নাম ভারত। যেমন যার নাম ইরান তারই নাম পারস্য। যার নাম মিশর তারই নাম ইজিপ্ট। যারই নাম আবিসিনিয়া তারই নাম ইথিয়োপিয়া ইত্যাদি। ইন্ডিয়া বা ভারত, ভারতের সংবিধানে কোথাও ভারতবর্ষ’ বলা হয়নি। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে যায়– এক ভাগের নাম ভারত, অন্য ভাগের নাম পাকিস্তান। দেশের অঙ্গচ্ছেদ বোঝনোর জন্যই হয়তো ভারতবর্ষ থেকে ‘বর্ষ’-টা হেঁটে দিয়ে ভারত রাখা হয়। অবশ্য ভারত দেশভাগের আগেও বলা হত, নতুন কিছু নয়।
ভাগবত ও ভৌগোলিক অর্থেই ‘ভারতবর্ষ আছে। বস্তুত সব দেশেই প্রাকৃতিক সীমারেখা থাকে না। সেই কারণেই পোল্যান্ডের মতো দেশকেও প্রাকৃতিক সীমানার অভাবে প্রচুর দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। আধুনিক ভারতবর্ষ বলতে পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং ভারত মিলে হিমালয়ের দক্ষিণে অবস্থিত সমুদ্রবেষ্টিত সমগ্র ভূখণ্ডকেই বোঝায়। বালুচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত যে সীমারেখা তার ওপারে আফগানিস্তান, ইরান ও রাশিয়া। উত্তরের সীমারেখার ওপারে আছে নেপাল, তিব্বত প্রভৃতি পার্বত্য দেশ। পূর্বের সীমা আসামের ওপারে চিন ও ব্রহ্মদেশ। বাকি সীমানা সমুদ্র দিয়ে সুনির্ধারিত। ভারতবর্ষের দক্ষিণে সিংহল, একটি বৃহৎ দ্বীপ। সিংহল আর আফগানিস্তানের সঙ্গে ভারতবর্ষের মিল পাওয়া গেলেও এসব দেশ নিজেদের স্বতন্ত্র সত্তা অক্ষুণ্ণ রেখেছে। ১৫,৮১,৪১০ বর্গমাইল জুড়ে এই বিশাল দেশ। পুরাণ মতে ভারতবর্ষ সাতটি দ্বীপের অন্যতম জম্বুদ্বীপের অন্তর্গত। হিন্দুস্তান বা হিন্দুস্থান ভারতীয় উপমহাদেশ/Indian Subcontinent-এর জনপ্রিয় নামগুলির একটি। এই নামের আক্ষরিক অর্থ “সিন্ধুনদের দেশ”। হিন্দুস্তান নামটি বেশ প্রাচীন, যা এসেছে ফারসি শব্দ “হিন্দু” থেকে। ফারসি ভাষায় সিন্ধুনদকে বলা হত হিন্দুনদ। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জনপ্রিয় স্তান অনুসর্গটি (ফারসি ভাষায় যার অর্থ স্থান)। আগে ‘হিন্দুস্তান’ বলতে অখণ্ড ভারতীয় উপমহাদেশকে বোঝাত। সারা বিশ্বের মুসলিমরাও অতীতে এই ভূখণ্ডকে (এবং এখনও) হিন্দুস্তান’ বলেই ডাকতেন। ইংরেজি India বলতে বোঝানো হয়েছে গোটা Indian subcontinent (বর্তমান বাংলাদেশ, ভারত, এবং পাকিস্তান), যা মূলত হিন্দুস্তান। ঐতিহাসিকভাবে ইসলামের হারানো ইতিহাসের ক্ষেত্রে তাই আমরা হিন্দুস্তান’ শব্দটিও ব্যবহার করব। রাধাকৃষ্ণণের বিশ্লেষণ অনুসারে এই হিন্দুস্তানে প্রস্তরযুগীয় সভ্যতার মানুষ থেকে শুরু করে সুসংস্কৃত দ্রাবিড়, বৈদিক আর্য এবং আরও অনেক ভাষাভাষীর বাস। প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় সভ্যতা সংস্কৃতি অস্ট্রিক, দ্রাবিড়ীয়, আর্য প্রভৃতি ভাষাগোষ্ঠীগুলির সমন্বিত উদ্যমের ফসল এবং এদের সমন্বিত ধর্মরূপটাই পরে ‘হিন্দু বলে পরিচিতি পায়। অর্থাৎ হিন্দুধর্মে একাধিক ভাষাগোষ্ঠীর ধর্মচিন্তার মিশ্রণ ঘটেছে। কিন্তু এই মিশ্রিত ধর্মে সংস্কৃত ভাষার প্রাধান্য থেকে বোঝা যায় যে হিন্দুধর্মের বিকাশে সংস্কৃতভাষী আর্যরাই নেতৃত্ব দিয়েছে। হিন্দুসমাজের ধর্মীয় আদর্শ এবং ধ্যানধারণা শ্রুতি স্মৃতি এবং গীতার মধ্যেই সবচাইতে বেশি উজ্জ্বল ও স্পষ্ট। তাহলে ‘হিন্দু’ বলতে আমরা কী বুঝব? শুধু একটা ধর্মীয় সমাজ? দৃষ্টিভঙ্গি? নাকি বিশেষ ভৌগোলিক অভিব্যক্তিতে বসবাসকারীদের বোঝাবে? “The History and culture of the Indian people’ গ্রন্থের পঞ্চম খণ্ড ‘The Struggle for Emper’-এ একাদশ থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। Religion and Philosophy’ শিরোনামের প্রবন্ধে রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেন– In any case the term Hindu comes into general use during this period and it would be convenient to refer henceforth to the Indians, other than Muslims, and their religion as Hindu, As is well known, Hindu, a modified form of Sindhu, was originally a georgraphical term used by the western foreigners to denote, first the region round the Sindhu river, and then the whole of India. The Indians, however, never called themselves by this name before the Muslim conquest. It was re-introduced after that event, with the added significance of a particular form of religious persuasion. Historically, therefore, “Hindu” really signifies the aggregate of people in India and their culture and religion, as distinguished from Muslims.” “হিন্দু’ বলতে তিনি একই সঙ্গে বোঝাচ্ছেন এমন এক জনসমষ্টিকে, যারা এক বিশেষ ভূখণ্ডের অধিবাসী, যারা এক বিশেষ সংস্কৃতির অধিকারী এবং এক বিশেষ ধর্মের অনুসারী। কিন্তু মুসলিম বলতে কাদের বোঝাচ্ছেন? মুসলিম বলতে বোঝাচ্ছেন শুধুই এক বিশেষ ধর্মের অনুসারীদের অর্থাৎ ভূখণ্ড ও সংস্কৃতির প্রসঙ্গকে বাদ দিচ্ছেন। ইরানিয়ানিজম’ গ্রন্থে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন— ভারতীয় আর্য আর ইরানি-আর্য নিঃসন্দেহে একই জনগোষ্ঠী মানুষ হিসাবে একাত্মবোধ করত। পরশু বা পারশ্ব নামে কুঠারজীবী একটা সম্প্রদায় হিন্দুস্তানী জনসমষ্টির মধ্যে মিশে গেছে। এরা কোনো সময়েই একটা উল্লেখ্য সম্প্রদায় হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। কিন্তু ইরানে এই পারশ্বরা অর্থাৎ কুঠারজীবী বা কুঠারধারীরা একটা সময়ে প্রবল প্রতাপান্বিত হয়ে ওঠে এবং এদের নামের ধ্বনি অনুসারে গ্রিকরা এদের বসবাসের স্থানকে পারসীয়া বলত। যেভাবে হিন্দুদের বাসস্থান ইন্ডিয়া হয় সেভাবেই পারশ্বদের বাসস্থান পারসীয়া, যা বাংলায় পারস্য বলে পরিচিত। পারস্য ইরান থেকে আগত বৈদিক আর্যদের পরে বহু ভিনদেশি দলে দলে ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছে, এখানকার জনজীবনকে বিপর্যস্ত করেছে, এখানকার আচার-প্রথাকে। পরিবর্তিত করেছে, আবার নিজেরাও বহুদিক দিয়ে পরিবর্তিত হয়েছে, এখানকার বহু আচার-প্রথা স্বীকার করে নিয়েছে, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের মাধ্যমে এখানকার জীবনের সঙ্গে মিশে গেছে। এই ভিনদেশিদের অনেকেই ছিল আর্যভাষী। এইভাবে ভারতবর্ষে সুপ্রাচীন সভ্যতার উপর বিদেশিদের আক্রমণ চলতেই থাকে। পাথর বা ইটের তৈরি আমরি ও কোটডিজি ভস্মীভূত হয় ভিনদেশিদের অগ্নিসংযোগের কারণে। বৈদিক আর্যরা আদিবাসীদের নগর বা পুরগুলি (পুর’ শব্দটি দ্রাবিড় ভাষা থেকেই সংস্কৃতে সংগৃহীত হয়।) ধ্বংস করেছিল বলেই তাদের সংগ্রামী নেতা (দেবতা) ইন্দ্র পুরন্দর বা পুর ধ্বংসকারী নামে অভিষিক্ত হয়। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলির সঙ্গে ঋগবেদের বর্ণনা ও প্রার্থনা মিলিয়ে দেখলে স্পষ্ট হয় যে প্রাচীনতর ভারতীয় সভ্যতা-সংস্কৃতি ধর্মীয় বিশ্বাসকে ধ্বংস করার দিকে এবং পুরের অধিবাসীদের হত্যা করার দিকে বৈদিক আর্যদের প্রবল প্রবণতা ছিল। এসব কাজে তাঁরা উল্লাস ও গৌরব বোধ করতেন। সিন্ধুনদের উপত্যকা থেকে ভূমিপুত্রদের উৎখাত করতে সমর্থ হলেও বিশাল ভারতবর্ষ থেকে তাঁদেরকে নির্মূল করতে আর্যরা সফল হয়নি। অধিকৃত জনপদে যাঁরা থেকে গেল বাধ্য হয়ে তাঁরা বিজয়ীদের সেবাতে নিযুক্ত হল এবং এইভাবে ‘দাস’ শব্দটার অর্থান্তর ঘটে, সেবার জন্যে নিযুক্ত ভৃত্যের অর্থে দাস শব্দটির ব্যবহার হতে থাকে। আর্য তথা দেবতাদের দ্বারা নরসংহারের কাহিনি পুরাণের ছত্র ছত্রে বর্ণিত হয়ে আছে। পুরাণে এই জনগোষ্ঠীই রাক্ষস-খোক্ষস, দৈত্য-দানো, অসুর হিসাবে বর্ণিত হয়েছে সুচতুরভাবে, ঘৃণিত হয়েছে। এঁরা বিদ্রোহী, রাষ্ট্রদ্রোহী। এরাই অনার্য, অস্পৃশ্য জাতি। এখন যেমন জঙ্গি, সন্ত্রাসবাদী, আতঙ্কবাদী, মাওবাদী ইত্যাদি।
মুসলমানরা বহিরাগত হলে আর্যরাও বহিরাগত। একদল আগে প্রবেশ করেছেন, অন্যদল পরে। আর্যধর্মের পরে ভারতবর্ষে ভৌগোলিক সীমানার বাইরে থেকে উপরে বর্ণিত ধারণা অনুসারে প্রথম যে ধর্ম একটা সুনির্দিষ্ট অবয়ব নিয়ে এদেশে এসেছিল সেটা হল ইসলাম ধর্ম। বৈদিক আর্যদের বাহ্মণ্যবাদী ধর্মাবলম্বীরা যেভাবে ভারতে এসেছিলেন অনেকটা সেইভাবেই ইসলাম ধর্মাবলম্বীরাও এখানে এসেছিলেন। তবে বৈদিক আর্যধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে ভারতে বসবাসকারী বিভিন্ন অনার্যধর্মাবলম্বীদের প্রথম পরিচয় ধ্বংস ও সংঘাতের মাধ্যমেই হয়েছিল। ভারতের অসংখ্য পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারতে কবিদের দিয়ে লেখানো ধারাবিবরণীর ছত্রে ছত্রে সেই রক্তাক্ত কাহিনি স্বর্ণরেখায় আঁকা আছে। আর্যদের দ্বারা অনার্যদের ‘সবক’ শেখানোর পাঠ। কিন্তু ইরানি আরব তুর্কি প্রভৃতি মধ্য ও পশ্চিম প্রাচ্যের অধিবাসীরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণের অনেক আগেই ভারতীয়দের পরিচয় ও যোগাযোগ ঘটে সেকথা আগেই বলেছি। এছাড়া তাঁরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পরেও তাঁদের সঙ্গে ভারতের অধিবাসীদের রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল এবং ভারতে মুসলিমদের সশস্ত্র অভিযানগুলো শুরু আগেই ইসলাম ধর্মাবলম্বী বণিকরা ভারতে কোনো কোনো অঞ্চলে নিজস্ব একটা সমাজ গড়ে তোলা হয়েছিল। যেমন মুসলিম সৈনিকদের অভিযান শুরুর আগেই মুসলিম বণিকদের আসা-যাওয়া শুরু হয়, তেমনি উত্তর ভারতে মুসলিমদের প্রথম অনুপ্রবেশ নিরস্ত্র এবং প্রেমিক সুফি সাধুসন্তদের শুরু হয়ে যায়। স্থানীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি ধ্বংস করার জন্যে আর্যরা যতখানি দাবি করতে পারে, মুসলিম যোদ্ধারা ততখানি সাফল্য দাবি করতে পারে না। আর্যরা স্থানীয় অনার্যদের রাষ্ট্রদোহী’ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। আর্যরা ভারতে প্রবেশ করে অনার্যদের রাক্ষস-খোক্ষস-অসুর-দৈত্য-দানো শিরোপায় ভূষিত করে ‘অবাধ্যদের’ নির্মমভাবে হত্যা করেছেন। মুসলমানরা উপমহাদেশের সবাই চিহ্নিত করলেন ‘হিন্দু বলে। অতএব সর্বজন প্রচারিত এক হাতে কোরান অন্য হাতে কৃপাণ’ ইসলাম ধর্মের প্রসার ঘটিয়েছেন, এ তত্ত্বটি সর্বৈ সত্য নয়। কোনো কোনো মুসলিম শাসক এ ধরনের কর্মকাণ্ড করে কুখ্যাত হলেও বেশির ভাগ মুসলিম শাসক সুশাসনই উপহার দিয়েছেন ভারতকে।
আর্য প্রসঙ্গে একটু খোলসা করে নেওয়া যাক। না-হলে অনেকে আবার পুরাতত্ত্ববিদ বসন্ত শিন্ডের মতো একগুচ্ছ প্রমাণ হাতে নিয়ে এসে বলবে আর্যরা মোটেই বহিরাগত নয়, এরা ভারতীয়। যদিও আর্যরা বহিরাগত এ তত্ত্ব বহু বছর প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, তা সত্ত্বেও সাম্প্রতিক একটি ঘটনার উল্লেখ করতেই হচ্ছে। সাম্প্রতিক পুরাতাত্ত্বিক গবেষণা ও জিনবিদ্যার ভিত্তিতে আজকের দক্ষিণ এশীয়দের বংশগত উৎসের হদিস মেলার দাবি করেছিলেন পুরাতত্ত্ববিদ বসন্ত শিন্ডে। এমনকি আর্যদের বাইরে থেকে আসার তত্ত্বও কার্যত খারিজ করে ভারতীয় জাদুঘরের আশুতোষ শতবার্ষিকী সভাঘরে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন তিনি। গত সেপ্টেম্বরে বিজ্ঞান পত্রিকা ‘সেল’-এ গবেষণাপত্র প্রকাশের পরে যিনি ঘটা করে বৈদিক সভ্যতা ও প্রাচীন হরপ্পা সভ্যতা মোটামুটি অখণ্ড ধারা বলে দাবি করেন, বৃহস্পতিবার কলকাতায় এসে জিনতত্ত্ববিদ বিজ্ঞানীদের প্রশ্নের মুখে শিন্ডেকে কিছুটা পিছু হটতে হল।
ডেকান বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতত্ত্ববিদ বসন্ত শিন্ডের সঙ্গে সেলের গবেষণাপত্রটির অন্যতম সহ লেখক হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের ডেভিড রাইখের পরিচিত কল্যাণীর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চের মলিকিউলার বায়োলজিস্ট তথা অধ্যাপক পার্থসারথি রায়। শিন্ডে, রাইখ প্রমুখের গবেষণাপত্রটির ছত্রছত্র উদ্ধৃত করেই তিনি দাবি করেন, বিভিন্ন বক্তৃতা বা সংবাদমাধ্যমের সামনে বিবৃতিতে যা বলা হচ্ছে, তার সঙ্গে গবেষণাপত্রটির অনেকটাই অমিল। যেমন, শিন্ডে দৃঢ়তার সঙ্গে দাবি করেছিলেন, গত ১২ হাজার বছর ধরেই দক্ষিণ এশীয়দের জিনে তেমন হেরফের ঘটেনি। পশ্চিম এশীয়দের সঙ্গেও দক্ষিণ এশিয়াবাসীর জিনগত মিল নেই। ইরান, তুর্কমেনিস্তানের কয়েকটি জায়গার প্রাচীন দেহাবশেষের জিনে যে দক্ষিণ এশীয় বৈশিষ্ট্য মিলেছে, তা আদতে হরপ্পা যুগের মানুষের ভারত ছেড়ে বহির্গমনের ফল। এতশত প্রমাণের ভিত্তিতে হরপ্পা যুগের সভ্যতাই আদতে আর্যদের বৈদিক সভ্যতার প্রত্যক্ষ পূর্বসূরি বলেও নাগাড়ে ইঙ্গিত দিয়ে আসছেন শিন্ডে এবং তাঁর সঙ্গে সহমত পণ্ডিতবর্গ, যা অনেকটাই আজকের হিন্দুত্ববাদীদের বিশ্বাসের সঙ্গেও মিলে যাচ্ছে বলে অনেকে মনে করেন। জাদুঘরে শিন্ডের বক্তৃতার পরে তাঁকে পাল্টা প্রশ্নে বিধলেও পার্থসারথিবাবু অবশ্য সরাসরি রাজনৈতিক অভিসন্ধির অভিযোগ তোলেননি। ইন্টারনেটে সুলভ তরজার ভঙ্গিতে বিরোধিতার পথও তিনি নেননি। তার পরিবর্তে পার্থবাবু বুঝিয়ে বলেন, কীভাবে শিন্ডেদের গবেষণাপত্রে সম্পূর্ণ উল্টো কথা বলা আছে। পার্থবাবুর কথায়, “গবেষণাপত্রে স্পষ্টতই বলা হয়েছে দক্ষিণ এশীয়দের, বিশেষত উত্তর ভারতীয়দের রক্তে শতকরা ৩০ ভাগ ইরানি জিনের ছাপ রয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে এমনও দেখা গিয়েছে, এই ইরানি জিনের ভাগটা বাবার কাছ থেকে পাওয়া। বিশেষত, ব্রাহ্মণদের রক্তে এই পশ্চিম এশীয় জিনের ভাগ বহমান।”
আজকের ভারতীয়দের অনেকের রক্তে এই শতকরা ৩০ ভাগ পশ্চিম এশীয় জিনকে কেন ধর্তব্যের মধ্যে আনতে চাইছেন না অধুনা ন্যাশনাল মেরিটাইম হেরিটেজ কমপ্লেক্সের কর্তা বা ন্যাশনাল কাউন্সিল অব সায়েন্স মিউজিয়মের গভর্নিং বডির সদস্য শিন্ডে? ওঁর জবাবে তা স্পষ্ট হয়নি। তিনি খানিক ঢোঁক গিলে বলেছেন, “গবেষণা যে দিকে আভাস-ইঙ্গিত দিয়েছে, তাই তো আমি বলেছি।” পার্থসারথিবাবুর প্রশ্ন, “কেন আপনি নিজে যা লিখেছেন, তাকেই প্রায় অস্বীকার করছেন, তা বিস্ময়ের!” সভাঘরে উপস্থিত পুরাতত্ত্ববিদেরাও কেউ কেউ শিন্ডের পর্যবেক্ষণ নিয়ে খানিক সংশয় প্রকাশ করেন। আড়াই দশক আগে, এই সভাঘরেই দেবতাদের গ্রহান্তর থেকে আসার তত্ত্ব নিয়ে বলতে এসে কলকাতার যুক্তিনিষ্ঠ বিদগ্ধমহলের প্রশ্নের মুখে পড়েছিলেন এরিক ভন দানিকেন। এ যাত্রা, শিন্ডেকে যুক্তিজালে বিদ্ধ করার মধ্যে কারও কারও সেই স্মৃতি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। (আনন্দবাজার পত্রিকা, ৮ নভেম্বর, ২০১৯)।
প্রাচীন ভারতে হিন্দু নামেও কোনো ধর্মপরিচয় ছিল না কোনো ভারতীয়র। যে সময় ইসলামিক ভারতে প্রবেশ করেছিল ‘হিন্দু’ বলে কোনো ধর্ম ছিল না। হিন্দু নামটা দিয়েছিল এদেশে আসা পার্সিয়ানরা। দিল্লিতে পাবলিশড ফার্সি অভিধানে ‘হিন্দু’ শব্দের অর্থ, চোর, ক্রীতদাস ও কালো গায়ের রঙের লোক। এই উপমহাদেশের সব মানুষকেই ‘হিন্দু বোঝান হত, এমনকি মুসলমানদেরও। হিন্দু বলতে পার্শিয়ানরা সিন্ধুদেশের মানুষদের বলত। সেই অর্থে সিন্ধুদেশের অদিবাসী, বৌদ্ধ, কাঁপালিক, অঘোর, বৈষ্ণব, শৈব, গাণপত্য, লিঙ্গায়েত সকলেই হিন্দু। মূলত বেদবিশ্বাসীরাই অনেক পরে হিন্দু বলে চিহ্নিত হল। বেদ-অবিশ্বাসীরা বৌদ্ধ, জৈন ইত্যাদি। সারা ভারতে হিন্দু ধারণার আগে কায়েম ছিল ব্রাহ্মণ্যধর্ম, কয়েক দশক আগেও কিছু মানুষের উর্বর মস্তিষ্ক ‘সনাতন ধর্ম’ বলে বোঝাতে চাইল। আলেকজান্দারের বা যবনদের সময় থেকেই হিন্দুকুশের এপারের মানুষদেরই হিন্দু বলা হত। তারপর মুসলমানরা পাকাপাকিভাবে ভারতের মানুষদের ‘হিন্দু নামটা দিল। তাঁরা আবার ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের ছাড়া বাকি সকল বিভাজিত গোষ্ঠীকেই ‘হিন্দু বলত। বিখ্যাত ইসলামিক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব ফরিস্তার পুরো নাম, মোহাম্মদ হিন্দু শাহ ফরিস্তা। হিন্দুদের তথাকথিত অসংখ্য ধর্মগ্রন্থ পাওয়া যায় এবং একটিতেও হিন্দু বা হিন্দুধর্মের প্রসঙ্গ উল্লেখ নেই।
আরব, প্যালেস্টাইন, মিশর প্রভৃতি দেশের সঙ্গে ভারতীয় উপমহাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক অতি প্রাচীন। বম্বে প্রেসিডেন্সির গেজেটিয়ারে লুফুল্লাহ ফরিদি চৌল, কল্যাণ ও সুপারা নামে অঞ্চলে প্রাক-মুসলিম আরব বসতির কথা উল্লেখ করেছেন। অ্যাগাথারসাইডসের সময়ে মালাবার উপকূলে প্রচুর আরবীয়রা বসবাস করতেন। অর্থাৎ ইসলাম প্রচারের অনেক আগে থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশে বিভিন্ন অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন। তখনকার সময়ে নাগরিকত্ব ধারণা ছিল না। যে কেউ পৃথিবীর যেখানে খুশি বসবাস বা বাণিজ্য করতে পারত। সপ্তম শতকের শেষের দিকে সর্বপ্রথম মুসলিম আরবীয় বণিক ও ধর্মপ্রচারকদের আগমন হয়। সপ্তম শতকের পর থেকেই ভারতের পশ্চিম উপকূলীয় বিভিন্ন বন্দরে পারসিক-আরব বণিকরা বিপুল সংখ্যায় বসবাস করতে শুরু করেন। এমনকি স্থানীয় মেয়েদের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। আরবদেশের সঙ্গে ভারত উপমহাদেশের সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে দুটি অঞ্চল খুব কাছে। একটি সিন্ধু, অপরটি দক্ষিণ আরবের উপকূলীয় অঞ্চলসমূহ। এই দুটি অঞ্চলের সঙ্গে আরবীয়দের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক এবং যোগাযোগ স্থাপন ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক বিষয়।
ইসলাম প্রবেশের আগে ভারতে খুবই অরাজক অবস্থা ছিল। মৌর্যরা উত্তর ভারতে এক বিশাল অখণ্ড রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু মৌর্য সাম্রাজ্যের ফলেই ভারতীয় উপমহাদেশের রাষ্ট্রীয় ঐক্য ধ্বংস হয় এবং একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময়কালেও পুনরায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে। উত্তর-পশ্চিম ভারতের সর্বেসর্বা শাসক হর্ষবর্ধন মৌর্য ও গুপ্তযুগের হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হন। তবে হর্ষবর্ধনের আমলেই কাশ্মীর স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়। সপ্তম শতাব্দীতে দুর্লভবর্ধন কাশ্মীরকে একটি শক্তিশালী হিন্দু রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর সিন্ধু স্বাধীন হয়। সিন্ধু প্রদেশে সে সময় বৌদ্ধ অধ্যুষিত ছিল।
এই অধ্যায় শেষ করব চেরামন পেরুমলের ইতিহাস দিয়ে। নবি হজরত মোহাম্মদের জীবদ্দশাতেই (সপ্তম শতকের প্রথম ভাগে) ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে অনেকটা নীরবে-নিভৃতে ইসলাম প্রবেশ করে আরব ব্যবসায়ীদের হাত ধরে। আর সেখানেই নির্মিত হয় ভারতবর্ষের প্রথম মসজিদ চেরামন জুমা মসজিদ। এটি শুধু ভারতবর্ষের প্রথম মসজিদই নয়, আরব বিশ্বের বাইরে নির্মিত পৃথিবীর প্রাচীনতম মসজিদগুলোর একটি। ভারতের দক্ষিণ পশ্চিমে, আরব সাগরের উপকূলে (বর্তমানে কেরাল) এক হিন্দু রাজা ছিলেন। সেই রাজা নাম ছিল চেরামন পেরুমল। জনশ্রুতি, একদিন তিনি স্বপ্নে দেখেন যে, আকাশের চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেছে। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত রাজা তাঁর সভার বিজ্ঞজনদের কাছ থেকে স্বপ্নের অর্থ জানতে চাইলেন। কেউ কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি। রাজার মন অস্বস্তি কাটছে না। কিছুতেই সুস্থভাবে থাকতে দিচ্ছে না। সেসময় ভারতের সঙ্গে আরবের বাণিজ্যিক সুসম্পর্ক ছিল। আরব দেশীয় বণিকরা সমুদ্রপথে ভারতে এসে বাণিজ্য করত। রাজার স্বপ্নের কিছুদিন পরেই একদল আরব মুসলিম বণিক উপকূল বন্দরে এসে পৌঁছোয়। এই বণিকদের কাছ থেকেই রাজ্যে নতুন ধর্ম ইসলাম এবং নবি হজরত মোহাম্মদের প্রশংসা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। একসময় নবির ‘আঙুলের ইশারায়’ চাঁদকে দ্বিখণ্ডিত করার কাহিনিও রাজার কানে এসে পৌঁছোয়! রাজা বণিকদেরকে ডেকে তাঁদের কথা শোনেন এবং বুঝতে পারেন যে, তাঁর স্বপ্নে তিনি এই ঘটনাটিরই ইঙ্গিত পেয়েছিলেন। অবশেষে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং বণিকদের সঙ্গে মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। জনশ্রুতি আছে, সেখানে তিনি হজরত মোহাম্মদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ধর্মান্তরের ফলে চেরামন পেরুমল হয়ে গেলেন তাজউদ্দিন। মক্কা থেকে ভারতে ফেরার সময় চেরামন পেরুমল ওরফে তাজউদ্দিন ওমানে তিনি মারা যান। মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর আরব সঙ্গীদেরকে ভারতে গিয়ে ইসলাম প্রচারের জন্য অনুরোধ করেন এবং তাঁদের হাতে তাঁর রাজ্যের সভাসদদের উদ্দেশ্যে লেখা একটি চিঠি তুলে দেন। সেই চিঠিতে তিনি নিজ রাজ্যে একটি মসজিদ স্থাপনের ইচ্ছের কথা ব্যক্ত করেন।
বণিকরা রাজার চিঠি নিয়ে কেরালায় আসেন। রাজার নির্দেশ অনুযায়ী তাঁরা ৬২৯ সালে ভারতের বুকে সর্বপ্রথম মসজিদ নির্মাণ করে। রাজা চেরামনের নাম অনুসারে মসজিদের নাম রাখা হয় চেরামন জুমা মসজিদ, তাজউদ্দিন নামে নয়। স্থানীয় স্থাপত্য অনুযায়ী তৈরি এ মসজিদটি দেখতে অনেকটাই হিন্দুদের মন্দিরের আদলে।
যদিও কিছু কিছু ইতিহাসবিদ চেরামন মসজিদের প্রতিষ্ঠার এই কাহিনির সঙ্গে একমত পোষণ করেন না। কারণ এ বিষয়ে কোনো লিখিত ইতিহাস নেই। কেরালার স্থানীয় ইতিহাসবিদ রাজন গুরুল মনে করেন, মসজিদটি হয়তো একাদশ অথবা দ্বাদশ শতাব্দীতে নির্মিত হয়ে থাকতে পারে। তবে মসজিদের ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সায়ীদ বলেন, এটিই ভারতে নির্মিত প্রথম মসজিদ। মসজিদের ভিতরে অবস্থিত একটি ফলকে মসজিদটির প্রতিষ্ঠাকাল হিসাবে ৬২৯ সাল লেখা আছে। যদিও ফলকটি সম্ভবত পরবর্তী কোনো সংস্কারকার্যের সময় স্থাপিত। ইতিহাসবিদরা মসজিদটির প্রতিষ্ঠাকাল সম্পর্কে নিশ্চিত হতে না-পারলেও, মুসলিম বণিকরা যে এর কাছাকাছি সময়ে ওই অঞ্চলে এসেছিল, এ ব্যাপারে কারোর তেমন দ্বিমত নেই।
যদিও হাজার হাজার বছর ধরেই ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিমের এই উপকূলীয় অঞ্চলগুলোর সঙ্গে আরবের বাণিজ্যিক সম্পর্কের প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রায় ৩,০০০ বছর আগে হজরত সোলায়মানের সময় থেকেই মিশরীয়দের মশলা ক্রয়ের জন্য এই এলাকায় আসার ইতিহাসও পাওয়া যায়। আরবীয় বণিকরা মৌসুমি বায়ুপ্রবাহকে কাজে লাগিয়ে ভারতে আসত। এখানে ব্যবসা-বাণিজ্য শেষ করে পরবর্তী ঋতুতে বিপরীত দিকের বায়ুপ্রবাহের জন্য অপেক্ষা করত এবং এরপর সেই বায়ুপ্রবাহকে কাজে লাগিয়ে আবার ফেরত যেত। মাঝখানের এই সময়টা তাঁদের অনেকেই স্থানীয় নারীদেরকে বিয়ে করে সংসারধর্ম করত। প্রাচীন মিশরীয় এবং সিরিয়ানরা অনেকেই এই অবসরকালীন সময়ে নিজেদের প্রার্থনার জন্য উপাসনালয়ও গড়ে তুলেছিল। এই অঞ্চলে তাই পাশাপাশি হিন্দু বৌদ্ধ-মুসলমান-খ্রিস্টান সবগুলো ধর্মের উপাসনালয়ই দেখতে পাওয়া যায়। কাজেই ইসলামের আবির্ভাবের পরপরই ব্যাবসা করতে আসা আরবীয় বণিকরা এখানে যে মসজিদ গড়ে তুলবেই, সেটাই স্বাভাবিক।
স্থানীয় ইতিহাস অনুযায়ী, যাঁর নেতৃত্বে চেরামন জুমা মসজিদটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তিনি হলেন মালিক দিনার নামে এক মুসলমান ব্যবসায়ী এবং ধর্মপ্রচারক। মালিক দিনার শুধুমাত্র এই মসজিদটিই না, বরং কেরালার বিভিন্ন অংশে আরও কয়েকটি মসজিদ প্রতিষ্ঠার জন্যেও বিখ্যাত। মালিক দিনারের সত্যিকার পরিচয় নিয়ে বিভ্রান্তি আছে। কিছু ইতিহাসবিদ তাঁকে মালিক ইবনে দিনার নামের আর-একজন মুসলিম সুফি সাধকের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলার কারণে তাঁর অবদান নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। কিন্তু মালিক ইবনে দিনার নামে যাঁর কথা ইতিহাসে পাওয়া যায়, তিনি ছিলেন হজরত হাসান বসরির ছাত্র, আর তাঁর জীবনী থেকে দেখা যায়, তিনি কখনোই ভারতবর্ষে আসেননি।
ইতিহাসবিদ বাহাদুর সি গোপালানের বর্ণনা অনুযায়ী, চেরামন মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা তাই মালিক ইবনে দিনার নয়, মালিক দিনার। তিনি ছিলেন নবির সাহাবি। তিনি ভারতে এসেছিলেন তাঁর চাচাতো ভাই মালিক ইবনে হাবিবের সঙ্গে, যিনি নাকি নবির চাঁদ দ্বিখণ্ডিত করার ঘটনাটির একজন প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন! মালিক দিনারের প্রকৃত নাম অবশ্য জানা যায় না। মনে করা হয়, “দিনার’ শব্দটি তাঁর মূল নামের অংশ নয়, এটি স্থানীয়দের দ্বারা তাঁকে দেওয়া সম্মানসূচক উপাধি। ইতিহাসবিদদের ধারণা, ‘দিনার’ শব্দটি এসেছে আরবি ‘দ্বীন’ শব্দটি থেকে, যার অর্থ ধর্ম। “দ্বীন’ শব্দটির সঙ্গে মালায়লাম ভাষার উপসর্গ ‘অর’ যুক্ত হয়ে তৈরি হয়েছে দিনর’ বা ‘দিনার’ শব্দটি। যার অর্থ যিনি ধর্ম ধারণ করেন। মালিক দিনার মোট তিনবার ভারতে এসেছিলেন বলে জানা যায়। প্রথমবার তিনি আসেন মালিক ইবনে হাবিবের সঙ্গে, যখন রাজা চেরামন পেরুমল ইসলাম গ্রহণ করেন এবং তাঁদের সঙ্গে মক্কাযাত্রা করেন। দ্বিতীয়বার তিনি ভারতে আসেন রাজা পেরুমলের মৃত্যুর পর তাঁর চিঠি নিয়ে। এ সময়ই তিনি চেরামন জুমা মসজিদ ছাড়াও আরও কিছু মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর শেষ বয়সে তিনি আবারও ভারতে আসার পথে মৃত্যুবরণ করেন।
মূল চেরামন জুমা মসজিদটি আকারে ছিল খুবই ছোটো। পরবর্তীতে একাধিক সংস্কারের মাধ্যমে এটি বর্তমান আকার লাভ করে। মূল মসজিদটি কাঠের তৈরি ছিল, যার কেন্দ্রীয় মূল কাঠামোর কিছু অংশ আজও অক্ষত আছে। প্রথমে একাদশ শতাব্দীতে এবং পরে ১৯৭৫ সালে মসজিদটি দুটি বড়ো ধরনের সংস্কারের মধ্য দিয়ে যায়। মসজিদটির ভিতরে একটি প্রাচীন তেল প্রদীপ আছে, যেটি সর্বদাই জ্বালানো থাকে। মনে করা হয়, এটি প্রায় ১,০০০ বছর ধরে জ্বলছে। শুধু মুসলিম নয়, অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও এই প্রদীপের জন্য তেল সরবরাহ করে। কেরালার অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয়গুলির মতো এই মসজিদটিও সমস্ত ধর্মবিশ্বাসীদের প্রবেশের জন্য উন্মুক্ত। অমুসলিমরাও এই প্রাচীন ঐতিহাসিক মসজিদটিতে তাঁদের সন্তানদের হাতেখড়ি দিয়ে থাকে। ঐতিহ্যগতভাবে ধর্মনিরপক্ষে চরিত্রের কেরালার এই মসজিদটিতে দিনের কিছু কিছু সময় হিন্দুরাও প্রার্থনা করে থাকে।
ভারত সরকার জাতিসংঘের সহায়তায় এই মসজিদটি সহ এর আশেপাশের বিশাল এলাকা জুড়ে যে প্রাচীন স্থাপত্যগুলো আছে, সেগুলোকে পুনরুদ্ধার এবং সংরক্ষণের বিশাল উদ্যোগ নিয়েছে। মুজিরিস হেরিটিজ প্রজেক্ট নামের এই প্রকল্পের অধীনে থাকবে একটি মশলা জাদুঘর সহ মোট ২৭টি জাদুঘর, পর্যটকদেরকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম এরকম ৫০টি আকর্ষণীয় স্থান এবং প্রাচীন রোমান সভ্যতার নিদর্শন সংবলিত একটা খননকৃত এলাকা। এই প্রকল্পটি ২০০৯ সালে শুরু হয়েছে। সম্প্রতি এর প্রথম ধাপ সম্পন্ন হয়েছে। চেরামন মসজিদ কর্তৃপক্ষও এই প্রকল্পের সঙ্গে মিল রেখে মসজিদটিকে সর্বশেষ সংস্কারের পূর্বাবস্থায় নিয়ে যেতে আগ্রহী, যাতে ঐতিহ্যবাহী এই মসজিদটি পঞ্চদশ শতকের রূপ লাভ করে। (roar.media)