ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট
শেখ মুজিবের লেখা এবং শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের মাধ্যমে ছাত্র-কর্মীদের দিয়ে তা বিলি করা প্রচারপত্রে পূর্ববঙ্গ মুক্তি ফ্রন্টের নাম উল্লেখ করা হয়েছিল। এটি ছিল বাংলায় লেখা। শেখ মুজিবের মূল লেখাটি ছিল ইংরেজিতে। সুতরাং নামটি হওয়ার কথা ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট। ইংরেজি ভাষ্যটি বিভিন্ন দূতাবাসের গেটের কাছে ফেলে রাখা হয়েছিল এবং বাংলা ভাষ্যটি প্রচার করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে। বাংলায় লেখা লিফলেটটি আবদুর রাজ্জাক পেয়েছিলেন শেখ ফজলুল হক মনির কাছ থেকে। শেখ মনি এটা বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন। অজ্ঞাত কারণে শাহ মোয়াজ্জেম কিংবা সিরাজুল আলম খান এটি স্বীকার করেন না।
প্রশ্ন হলো, ইংরেজি ভাষ্যে প্রচারিত লিফলেটে ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট’ নামটি এল কীভাবে। এই কাহিনির সূত্র খুঁজতে আমাদের যেতে হবে জামালপুরে।
জামালপুর হাইস্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষক সলিল কাহালি। নামটি একটু অন্য ধরনের, মনে রাখার মতো। ‘কাহালি’ নাম সচরাচর দেখা যায় না। ১৯৫৪ সালে যখন এ দেশে সাধারণ নির্বাচন হয়, তখন তিনি কিশোর। নির্বাচনী প্রচার চালাতে আওয়ামী লীগের তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এসেছেন জামালপুরে। স্থানীয় যুবকদের একজন হলেন আওয়ামী লীগের কর্মী আলী আসাদ। গায়ের রং কালো। তাই সবাই ডাকে কালা থোকা। জামালপুর শহরে আছেন আরেকজন খোকা। গায়ের রং ফরসা। তার নাম হয় ধলা থোকা। দুই খোকার মধ্যে খুব বন্ধুত্ব। ধলা খোকার আসল নাম ফজলুল হক। তিনি সংগীতশিল্পী। পরে বেশ নামডাক হয়েছিল–ওস্তাদ ফজলুল হক। সলিল কাহালির বিবরণ থেকে জানা যায়, নির্বাচনের আগে শেখ মুজিব বেশ কয়েকবার। জামালপুরে গেছেন। সেখানে তার সঙ্গী হতেন কালা থোকা। জামালপুরে এলে মুজিব থাকতেন নিরালা হলের উল্টো দিকে মাহির মণ্ডল সাহেবের টিনের দোতলা ঘরে। এখন আমরা সলিল কাহালির গল্প শুনব, তার জবানিতে:
১৯৫৪ সালের কোনো এক পড়ন্ত বেলা। আমি তখন জামালপুর হাইস্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র। বন্ধুরা মিলে হিন্দু বোর্ডিং মাঠে ফুটবল খেলছিলাম। কলেজের দিক থেকে শেখ মুজিবুর রহমান কালা খোকাদাসহ রিকশাযোগে শহরের দিকে যাচ্ছিলেন। খোকাদা রিকশা থামিয়ে শেখ সাহেবের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন, সলিল কাহালি, আমার ছোট ভাইয়ের মতো। আমি ওকে খুব ভালোবাসি। ওর বাড়ি জামালপুরের আমলাপাড়ায়। ওর দাদু একজন প্রতিষ্ঠিত উকিল, বাবা সরকারি কর্মচারী।
কাহালি নামটি শেখ মুজিবের নজর এড়ায়নি। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোদের আসল বাড়ি আমাদের জেলা ফরিদপুরে, তাই না? আমি বললাম, আমার দাদু ওকালতি করতে স্থায়ীভাবে জামালপুর চলে আসেন। সেই থেকে আমাদের বাড়ি জামালপুর। আমার দাদু জয়রাম কাহালিকে শেখ মুজিব চিনতেন। শেখ সাহেব খোকাদাকে ধমকের সুরে বললেন, কী রাজনীতি করিস? মানুষের সঠিক পরিচয় জানিস না? আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, ভালো করে পড়াশোনা করিস।
কালা খোকাদা তখন নির্বাচন নিয়ে খুবই ব্যস্ত। সাথিদের নিয়ে তিনি থানায় থানায় বক্তব্য দিয়ে বেড়াচ্ছেন। সে সময় মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন সাহেব ট্রেনযোগে জামালপুর আসেন। কালা থোকাদা, খুররম ভাই, মতি ভাই এদের নেতৃত্বে পতাকা হাতে স্কুলের ছাত্ররাসহ নুরুল আমিন মুর্দাবাদ ধ্বনি মুখরিত করে স্টেশন অভিমুখে বিপুল ছাত্র জনতা রওনা হয়। পুলিশের প্রবল বাধার মুখে মিছিলটি ভেঙে যায়। শেষ পর্যন্ত ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে নুরুল আমিন সরকার তথা মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটে।
১৯৫৭ সালে শেখ মুজিবুর রহমান মন্ত্রী হিসেবে জামালপুরে সরকারি সফরে আসেন। জামালপুরের সংস্কৃতির বিশেষত্ব দেখানোর জন্য জামালপুর বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষক মুখলেসুর রহমান ফকির সাহেবের লেখা ও নির্দেশনায় কেরানির মেয়ে নামে একটি নাটক নিরালা হলে মঞ্চস্থ হয়। শেখ মুজিবুর রহমান প্রধান অতিথি হিসেবে ওই নাটক উপভোগ করে অত্যন্ত প্রীত হন এবং নাট্যকার মুখলেসুর রহমান সাহেবকে ধন্যবাদ জানান।
সেদিন ছিল আমার জীবনের একটি বিশেষ দিন। বর্তমানে আমার স্ত্রী অনুরাধা কাহালি ওই নাটকের একটি অংশে অভিনয় করে। তার অভিনয় দেখার জন্য আমি খুবই উদগ্রীব ছিলাম। ছেলেদের ভেতরে ঢোকার অনুমতি ছিল না। জোরদার পুলিশি পাহারা ছিল। প্রবল ইচ্ছা সত্ত্বেও হলে ঢোকার কোনো সুযোগ পাচ্ছিলাম না। ঠিক সেই সময় কালা খোকাদা আমাকে ডেকে বললেন, ‘চল শেখ সাহেবের সাথে পরিচয় করিয়ে দিই।’ আমি সুযোগটা গ্রহণ করলাম। বললেন, কলেজে পড়ছিস, চাকরি-বাকরির প্রয়োজন হলে মুজিব ভাইয়ের কাছে যাবি।
তখন হয়তো আমি না-ও থাকতে পারি। কিন্তু আমার পরিচয় দিয়ে তার কাছে গেলে নিশ্চয়ই তিনি একটা ব্যবস্থা করে দেবেন। কারণ একসময় মুজিব ভাই এ দেশের খুবই বড় নেতা হবেন। তাকে অনুসরণ করে হলে প্রবেশ করলাম। শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব তখন প্রধান অতিথির আসনে বসা। কালা খোকাদা আমাকে দেখিয়ে বললেন, মুজিব ভাই, আমার ছোট ভাই সলিল কাহালি। সাথে সাথেই শেখ মুজিব সাহেব বললেন, ‘ওর নাম সলিল কাহালি। বাড়ি আমার জেলা ফরিদপুরের শরীয়তপুরে। বর্তমানে ওর দাদু ওকালতির সুবাদে জামালপুরের বাসিন্দা। হিন্দু বোর্ডিং মাঠের কাছে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলি, আমি তা ভুলিনি। আমি বিস্মিত হলাম। তিনি এত কথা কী করে মনে রাখেন, কী প্রখর স্মৃতিশক্তি! আমাকে উদ্দেশ করে বললেন, কোন কলেজে পড়িস? বলেছিলাম, আনন্দমোহন কলেজ, ময়মনসিংহ। উনি আমার মাথায় হাত দিয়ে বলেছিলেন, ‘মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করিস। আর একটা কথা, তোর দাদা (কালা থোকা) যদি কোনো দিন ডাকে, দেরি না করে সাথে সাথে তার ডাকে সাড়া দিস।’
আমি আর কী নাটক দেখব। অবাক বিস্ময়ে তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। দেশের প্রয়োজনে ডাক আসতে পারে এবং কালা থোকাদা কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে জড়িয়ে পড়তে পারেন, এমন ইঙ্গিত ছিল তাঁর কথায়। তিনি যতক্ষণ ছিলেন, প্রথম সারির একটি চেয়ারে তাঁর কাছাকাছি বসে ছিলাম। কিছুক্ষণ পর কালা খোকাদাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি চলে গেলেন। কিন্তু আমার বিস্ময় রয়েই গেল।
নির্বাচনী প্রচারের সময় কালা থোকাদার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। যার ফলে তাঁকে বেশ কয়েকবার জেলে যেতে হয়। ১৯৫৮ সালে দেশে সামরিক আইন জারি হলে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ওপর ব্যাপক নির্যাতন শুরু হয়। কালা খোকাদার নামে হুলিয়া জারি হয়। ১৯৫৯ সালে কালা থোকাদা, মেলান্দহের আবদুর রহমান সিদ্দিকী এবং গফরগাঁওয়ের আর এম সাঈদ দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যান। [১]
.
২
সলিল কাহালির বিবরণে কয়েকজন তরুণের ভারতে চলে যাওয়ার তথ্য পাওয়া গেল। প্রশ্ন হলো, তাদের দেশত্যাগের পটভূমি কী? এরপর কী হলো? এ বিষয়টি গবেষক মোরশেদ শফিউল হাসান তার স্বাধীনতার পটভূমি : ১৯৬০ দশক বইয়ে উল্লেখ করেছেন। এর সূত্র ধরে আরও তথ্য পাই ১৯৮৭ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রার বিজয় দিবস সংখ্যায় প্রকাশিত আফসান চৌধুরীর একটি নিবন্ধে। সেখানে আবদুর রহমান সিদ্দিকীর একটি সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছিল। সেখানে তুলে ধরা হয় পূর্ব বাংলা লিবারেশন পার্টির ভারত। অভিযানের কথা। [২]
শাহ মোয়াজ্জেমের ভাষ্য অনুযায়ী, শেখ মুজিবের নিজের লেখা ও ছাপানো প্রচারপত্রে ‘পূর্ববঙ্গ মুক্তি ফ্রন্ট’-এর উল্লেখ আছে। লেখাটি ছিল ইংরেজিতে। সেখানে ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট’ নামটি ব্যবহৃত হয়েছিল বলে ধারণা করা যায়। প্রশ্ন হলো, এ নামটি শেখ মুজিবের মাথায় এল কীভাবে?
‘ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট’ নামে একটি উদ্যোগ বাস্তবে ছিল। এর উদ্যোক্তাদের অন্যতম ছিলেন জামালপুরের তরুণ আলী আসাদ, যিনি কালা খোকা নামে পরিচিত। সলিল কাহালির দেওয়া বিবরণে তার প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। ২০১৮ সালের মাঝামাঝি আমার হাতে এল ধ্রুবতারানামের একটি সংকলন। জামালপুরের ভাষাসৈনিক মতি মিয়া ফাউন্ডেশন’ এটি প্রকাশ করেছে। এটি পড়ে আমি ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট সম্পর্কে অনেক তথ্য পাই। আমার সামনে খুলে যায় স্বাধীনতাসংগ্রামের এক অজানা অধ্যায়।
আলী আসাদ ১৯৪৮ সালে ছাত্রলীগে যোগ দেন। খাদ্যমন্ত্রী মফিজউদ্দিনের সমালোচনা করায় তিনি নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। ১৯৫১ সালে তিনি জামালপুর মহকুমা (এখন জেলা) ছাত্রলীগের সহসম্পাদক হন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি। ওই সময় আবারও গ্রেপ্তার হয়ে তিনি ময়মনসিংহ জেলে তিন মাস আটক ছিলেন। ১৯৫৪ সালে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং জামালপুর শাখা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক হন। ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে দেশে সামরিক শাসন জারি হলে ওই সময় তিনি আরও কয়েকজনসহ প্রতিষ্ঠা করেন ইষ্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট। জামালপুর হাইস্কুলের (এখন জিলা স্কুল) বিপরীত দিকে আবদুর রহমান সিদ্দিকীর ভাড়া বাসায় ফ্রন্টের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়।
এ নিয়ে আবদুর রহমান সিদ্দিকীর একটি সাক্ষাৎকার ১৯৮৭ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রার বিজয় দিবস সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল। তার বর্ণনামতে, ব্রহ্মপুত্র নদে সম্মেলনের পর ১৯৫৯ সালের মার্চে আলী আসাদ, আর এম সাঈদ, খন্দকার ফজলুর রহমান এবং তিনি ভারতে যান। ফজলুর রহমানের আদি বাড়ি আসামের নওগাঁয়। তাঁদের কোনো পাসপোর্ট ছিল না। ফজলুর রহমান তাঁদের পথঘাট চিনতে সাহায্য করেন। তাঁরা মাইনকারচর হয়ে ধুবড়ি যান। সেখানে জেলা কংগ্রেসের সভাপতি সৈয়দ আহমেদ আলী (পরে মন্ত্রী) এবং সম্পাদক জিতেন দত্তের সঙ্গে তাঁদের কথা হয়। পরে তাঁরা কলকাতায় গিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মুক্তাগাছার রাজকুমার স্নেহাংশু আচার্য (পরে পশ্চিমবঙ্গের অ্যাডভোকেট জেনারেল) এবং মুজাফফর আহমদের সঙ্গে কথা বলেন। তারা বলেন, পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট নেতাদের সঙ্গে কথা না বলে আমরা আপনাদের সমর্থন বা বিরোধিতা কোনোটাই করতে পারব না।’ এরপর তারা পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেসের সম্পাদক সুরেন ঘোষের সঙ্গে কথা বলেন। সুরেন ঘোষ তাদের বলেছিলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রী নেহরুর সঙ্গে আপনাদের দেখা করিয়ে দিতে পারি। তিনি রাজি হলে আপনাদের সাহায্য করতে পারবেন। পার্লামেন্ট সম্মেলন উপলক্ষে সুরেন ঘোষের দিল্লিতে যাওয়ার কথা। তিনি আসাদদের সঙ্গে নিয়ে যান। তাঁর চেষ্টায় নেহরুর সঙ্গে তাঁদের দেখা হয়। তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে লিয়াকত-নেহরু প্যাক্টের কথা উল্লেখ করে বলেন, যেহেতু এই চুক্তি আমি নিজেই স্বাক্ষর করেছি, তাই তোমাদের (অস্ত্র) সাহায্যের মাধ্যমে এর বিরুদ্ধে কাজ করতে পারব না যতক্ষণ এটা বলবৎ আছে। নেহরু সাহায্য দিতে অপারগ হলেও বাঙালি নেতাদের কাছে তারা উৎসাহ পেয়েছিলেন। এরপর তাঁরা কলকাতায় ফিরে এসে দেশের পথে রওনা হন। আবদুর রহমান সিদ্দিকীর বর্ণনায় জানা যায় :
এর মধ্যে আলী আসাদ ডিনামাইট ও বোমা তৈরির ফর্মুলা বিভিন্ন সূত্র হতে জেনে নেয়। স্নেহাংশু আচার্য ও অন্য নেতারা কিছু অর্থ সাহায্যের সংস্থান করে দেন। তা দিয়ে আমরা কলকাতা প্রেস থেকে কিছু বিজ্ঞাপন (প্রচারপত্র) ছাপিয়ে নিয়ে দেশের পথে পা বাড়ালাম। উদয়নালার কাছে সহযাত্রী ফজলুর রহমান হঠাৎ করে নিখোঁজ হয়ে যান। এক জায়গায় যাওয়ার কথা বলে তিনি আর নেই। অতঃপর আমরা তিনজনই রওনা হই।
শিলিগুড়িতে এসে আমাদের সাথে দেখা হলো চারু মজুমদার ও কানু সান্যালের। চারু মজুমদার তখন চা-বাগান শ্রমিকনেতা ছিলেন, আর কানু সান্যাল শিলিগুড়ি কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি। তাঁরা। আমাদের আর্থিক সাহায্যও করলেন। অতঃপর কোচবিহার থেকে ধুবড়ি।
গারো পাহাড় হয়ে মহেন্দ্রগঞ্জ থানার কাছে একটা বাড়িতে উঠি। সেখানে পুলিশ খবর পেয়ে আমাদের ধরে নিয়ে গেল তুরায়। ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের বিচারে এক মাসের জেল হলো আমাদের। অপরাধ, বিনা পাসপোর্টে সীমান্ত পারাপার। আমাদের সঙ্গে বিজ্ঞাপন দেখে তারা গোয়েন্দা বিভাগে খবর দেয়। গোয়েন্দা বিভাগের কর্তারা এসে গেলেন আমাদের জেলখানায়। তারা বিবৃতি নিলেন, বিজ্ঞাপন দেখলেন। শেষে রাজনৈতিক নেতা হিসেবে জেলে আমাদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদা দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে গেলেন।
দিন পনেরো পর তারা আবার এসে হাজির। এবার বললেন, ভারত সরকারের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা আপনাদের সাহায্য করতে রাজি। আপনারা দেশে গিয়ে ভারতীয় হাইকমিশন অফিসে যোগাযোগ করবেন। এই গোয়েন্দাগণ আদিতে পূর্ববঙ্গের লোক ছিলেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই তারা আমাদের নৈতিক সমর্থন দেন।
এক মাস পর জেল থেকে ছাড়া পেলে গোয়েন্দা বিভাগের লোকজন আমাদের বর্ডার পর্যন্ত এগিয়ে দেন। এটা ছিল গভীর রাত, তিনটা-চারটা হবে। যে পথে পাক সীমান্তপ্রহরী থাকবে না এমন পথেই তারা আমাদের যেতে সাহায্য করেন।
আমরা তিনজনই প্রায় আধা মাইল বিলের গলাপানি ভেঙে বকশীগঞ্জে এলাম। সেখানে আমাদের বন্ধু আশরাফ হোসেনের বাড়িতে উঠলাম। ভারতে ছাপানো প্রচারপত্রগুলো পানিতে ভিজে যাওয়ায় আশরাফের বাড়িতে রোদে শুকানো হয় এবং জামালপুর, ময়মনসিংহ ও ঢাকায় বিতরণ করা হয়।
বন্ধুর বাড়িতে এক দিন থেকে জামালপুরে ফিরেই দেখি আমাদের প্রত্যেকের নামে ওয়ারেন্ট। কেমন করে জানাজানি হয়েছিল জানি না। সুতরাং আত্মগোপন করতে হলো। সাঈদকে বাড়ি পাঠালাম। আলী আসাদ ও আমি ঢাকা চলে এলাম। [৩]
.
৩
আবদুর রহমান সিদ্দিকীর ভাষ্যে বকশীগঞ্জের আশরাফ হোসেনের কথা উঠে এসেছে। তিনি আমাকে জানিয়েছেন, যে দলটি সীমান্ত পেরিয়ে আসামে গিয়েছিল, তিনিই তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে। গিয়েছিলেন। সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দা। হিসেবে তিনি পথঘাট চিনতেন। ওই সময়। তিনি ছিলেন জামালপুর আশেক মাহমুদ কলেজ ছাত্র সংসদের সহসভাপতি। তিনি এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে শুরু থেকেই যুক্ত ছিলেন। আসামে একটি মাজারে তারা কয়েক দিন ছিলেন। তারপর মহেন্দ্রগঞ্জে তাদের রেখে চলে আসেন।
সাপ্তাহিক বিচিত্রায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রস্তুতিপর্ব’ নিবন্ধে প্রকাশিত বক্তব্যের কিছু অংশের সঙ্গে ভিন্নমত প্রকাশ করে আবদুর রহমান সিদ্দিকী একটি চিঠি দেন। চিঠিটি বিচিত্রায় ছাপা হয় ২২ জানুয়ারি ১৯৮৮ তারিখে। চিঠিতে আবদুর রহমান সিদ্দিকী ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্টের জন্মকাহিনির একটি বিস্তারিত বিবরণ দেন। তাতে বলা হয়, সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে পূর্ব বাংলাকে মুক্ত করার জন্য ১৯৫৮ সালের নভেম্বরে ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের কাছে ১৫ নম্বর মুহাম্মদ আলী রোডে সিদ্দিকীর বাসায় গঠন করা হয় ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট। প্রতিষ্ঠাতা তিনজন সদস্য হলেন সিদ্দিকী, আর এম সাঈদ এবং খন্দকার বজলুর রহমান। সিদ্দিকী দলের জন্মলগ্ন থেকেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৫৩ সালের ১৪-১৫ নভেম্বর আওয়ামী লীগের বিশেষ কাউন্সিল সভা বসেছিল ময়মনসিংহ শহরে অলকা সিনেমা হলে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলন আয়োজনে সিদ্দিকী অনেক সাহায্য করেছিলেন। তথ্যটি শেখ মুজিবুর রহমান অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন।
১৯৫৫ থেকে ১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারি হওয়া পর্যন্ত সিদ্দিকী ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ছিলেন। খন্দকার ফজলুর। রহমান ছিলেন আওয়ামী লীগের কর্মী এবং আর এম সাঈদ ছিলেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) কর্মী। সিদ্দিকীকে ফ্রন্টের সেক্রেটারি করা হয়।
১৯৫৮ সালের নভেম্বরের শেষের দিকে জামালপুরে আলী আসাদের নেতৃত্বে ফ্রন্টের শাখা কমিটি তৈরি হয়। এ কমিটিতে ছিলেন জামালপুরের আওয়ামী লীগ নেতা আখতারুজ্জামান (মতি মিয়া), সৈয়দ আলী মণ্ডল, রেজাউল করিম, সৈয়দ আবদুস শরিফ প্রমুখ। সবাই পবিত্র কোরআন ছুঁয়ে পূর্ব বাংলাকে মুক্ত করার জন্য সশস্ত্র বিপ্লবের শপথ নেন। আলী আসাদকে ‘মেজর তারিক’ এবং আখতারুজ্জামানকে মুহম্মদ মুসা নাম দেওয়া হয়। জামালপুরের সমবায় প্রেসে কিছু প্রচারপত্র ছাপানো হয়। প্রচারপত্রে ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্টের বদলে ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন পার্টি নাম লেখা হয়। প্রচারপত্রে স্বাধীন বাংলার দাবি করে স্লোগান দেওয়া হয়–পূর্ব বাংলা বাঙালিদের, পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাংলা ছাড়ো।
আলী আসাদ ছিলেন জামালপুর মহকুমা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। তাঁকে ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন আর্মি’ গঠনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ডিসেম্বরের (১৯৫৮) প্রথম দিকে সিদ্দিকী, আর এম সাঈদ এবং নেত্রকোনার আওয়ামী লীগ সেক্রেটারি এম এ খালেকের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের পার্টি কমিটি গঠন করা হয়। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি টাঙ্গাইলের শ্রমিকনেতা সৈয়দ আবদুল মতিনকে সেক্রেটারি করে সাত সদস্যের টাঙ্গাইল কমিটি গঠন করা হয়। ডিসেম্বরের শেষের দিকে ব্যবসায়ী আবু বাকারের নেতৃত্বে চার সদস্যের কমিটি গঠন করা হয় কিশোরগঞ্জে। ১৯৫৯ সালে ময়মনসিংহে আরও একটি শাখা কমিটি হয়। আর এম সাঈদ ছিলেন এই কমিটির দায়িত্বে।
১৯৫৯ সালের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি ব্রহ্মপুত্র নদের মধ্যে একটি বড় নৌকায় পার্টির সম্মেলন হয়। সম্মেলনের কয়েক দিন পর অস্ত্র ও অর্থ জোগাড়ের জন্য সিদ্দিকী, আলী আসাদ, আর এম সাঈদ ও খন্দকার ফজলুর রহমান ভারতে যান। ভারত থেকে ফিরে আসার পর ১৯৫৯ সালের সেপ্টেম্বরে সিদ্দিকী ঢাকার পল্টন ময়দান থেকে গ্রেপ্তার হন। সিদ্দিকীর ভাষ্য। অনুযায়ী :
গ্রেপ্তার হওয়ার কয়েক দিন আগে আমরা ঢাকায় পার্টির একটি শাখা কমিটি গঠন করি। ইঞ্জিনিয়ারিং হোস্টেলে সিরাজ সিকদার নামের এক ছাত্র ছিলেন এই কমিটির সেক্রেটারি। এই সিরাজ সিকদার পরে সর্বহারা পার্টির সিরাজ সিকদার কি না, সেটা আমি বলতে পারব না। তার সঙ্গে পরে আর কোনো দিন দেখা হয়নি। ১৯৫৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে জেলে ছিলাম। ভারত থেকে ফিরে আসার পর সেখানে ছাপানো প্রচারপত্রগুলো পানিতে ভিজে যাওয়ায় বকশীগঞ্জের আশরাফ হোসেনের বাড়িতে রোদে শুকিয়ে নিয়ে আসা হয় এবং জামালপুর, ময়মনসিংহ ও ঢাকায় বিতরণ করা হয়।
আমাদের এই ইতিহাস জানেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, সাংবাদিক মানিক মিয়া, আবুল মনসুর আহমদ, শেখ মুজিবুর রহমান, আতাউর রহমান খান, ময়মনসিংহের আওয়ামী লীগ নেতা রফিক উদ্দিন ভূঁইয়া, হাতেম আলী তালুকদার, শামসুল হক, আলতাব উদ্দিন তালুকদার (ভাসানী-ন্যাপ নেতা) এবং আরও অনেকে। জানতেন মওলানা ভাসানী এবং পাকিস্তানের গোয়েন্দা বিভাগ। [৮]
ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্টের সঙ্গে আরও যারা যুক্ত হয়েছিলেন, তাঁদের একজন হলেন নুরউদ্দিন আহমদ তারা মিয়া। তার বাবা গিয়াসউদ্দিন আহমদ ১৯৫৫-৫৬ সালে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার খাদ্যমন্ত্রী ছিলেন। তারা মিয়ার দেওয়া বিবরণে জানা যায়, ১৯৫৯ সালের আগস্ট বা সেপ্টেম্বরে একদিন সকালে আলী আসাদ ও আবদুর রহমান সিদ্দিকী তাদের ঢাকার ২২ নম্বর টিপু সুলতান রোডের বাসায় আসেন এবং তার বাবা গিয়াসউদ্দিনকে ভারত থেকে ছাপানো কয়েকটা বিজ্ঞাপন (লিফলেট) দেন। ছাপানো কাগজে স্বাধীনতার দাবি এবং পূর্ব বাংলাকে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসন ও শোষণ থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে সশস্ত্র বিপ্লবের ডাক দেওয়া হয়েছিল। গিয়াসউদ্দিন আহমদ লিফলেট পড়লেন। ছেলে তারা মিয়া পাশেই দাঁড়ানো ছিলেন। তিনি সবে ম্যাট্রিক পাস করে কলেজে ভর্তি হয়েছেন। লেখাপড়ার ক্ষতি হবে বিধায় তাঁকে যেন দলে না নেওয়া হয়, এ অনুরোধ জানিয়ে গিয়াসউদ্দিন সাহেব তাঁদের চা-বিস্কুট খাইয়ে বিদায় করেন। আলী আসাদ ও আবদুর রহমান সিদ্দিকী বেরিয়ে যাওয়ার সময় তারা মিয়া অনেক দূর হেঁটে তাদের এগিয়ে দেন। তাঁকে সদস্য হওয়ার প্রস্তাব দেওয়ামাত্র তিনি রাজি হয়ে যান। শুধু বলেন, বাবা যেন জানতে না পারেন। ওই দিন বিকেলে গিয়াসউদ্দিন সাহেব লিফলেটটি শেরেবাংলাকে দেখান। শেরেবাংলা তাঁকে বলেছিলেন, গিয়াস, আমি জানি বাংলা একদিন স্বাধীন হবেই। সেদিন পর্যন্ত আমরা হয়তো বেঁচে থাকব না।’ এই বলে তিনি কেঁদে ফেলেন। ফিরে আসার সময় শেরেবাংলা গিয়াসউদ্দিনকে বলেছিলেন, ‘যদি পারো, ওই ছেলেদের গোপনে আমার সঙ্গে দেখা করাইও। আমি তাদের আশীর্বাদ করব।’ এ কথা তারা মিয়া শুনেছেন তার বাবার কাছে।
তারা মিয়ার ভাষ্যে জানা যায়, এই দলে আরও যারা যোগ দিয়েছিলেন, তাঁদের একজন হলেন আওয়ামী লীগ কর্মী আকরাম হোসেন। এত দিন দলের কেন্দ্রীয় দপ্তর ছিল ময়মনসিংহে আবদুর রহমান সিদ্দিকীর বাড়িতে। এরপর এটি সরিয়ে ঢাকার ফকিরাপুলে আকরামের বাসায় নিয়ে আসা হয়। আলী আসাদ ও আবদুর রহমান সিদ্দিকী এ বাসায় থাকতেন। সেখানেই তারা মাঝেমধ্যে সভা করতেন। কাজ হতো খুব গোপনে। সবাইকে সবার পরিচয় জানানো হতো না। সন্ধ্যার পর মাঝেমধ্যে পল্টন ময়দানের উত্তর-পশ্চিম কোণে একটি নির্দিষ্ট স্থানে সংগঠকেরা আসতেন। এক সাধু সেখানে ধূপধুনা জ্বালিয়ে বসতেন। তার কাছে গাঁজা খেতে আসত কিছু লোক। ফ্রন্টের লোকেরা সেখান থেকে একটু দূরে বসতেন। সেখানে আসতেন ঢাকা বেতারের শিল্পী ওস্তাদ ফজলুল হক এবং আরও কয়েকজন বন্ধুবান্ধব।
এক সন্ধ্যায় তাদের কয়েকজনের সভা করার কথা পল্টন ময়দানে। সেখান থেকে সিদ্দিকীকে গ্রেপ্তার করা হয়। আলী আসাদ বসে ছিলেন একটু দূরে। টের পেয়ে তিনি পালিয়ে আকরামের বাসায় চলে যান। ওই বাসায়। ডাকে পাঠানোর জন্য ২০০টি লিফলেট ছিল। তারা মিয়া ও সিরাজুল ইসলাম। পোস্ট অফিস থেকে ২০০টি খাম কিনে আনেন। খামে তাঁরা ঠিকানা লিখতে থাকেন। বিভিন্ন জেলার বার লাইব্রেরি, কলেজের অধ্যক্ষ, কলেজ ছাত্র সংসদের সেক্রেটারি এবং রাজনৈতিক নেতাদের ঠিকানায় লিফলেট পাঠানোর ব্যবস্থা হয়। রাতে রেলওয়ে পোস্ট অফিসের ডাকবাক্সে খামগুলো ফেলা হয়েছিল। [১০]
এর কয়েক দিন পর আর এম সাঈদ গফরগাঁওয়ে তাঁর গ্রামের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার হন। তাঁকে ময়মনসিংহ জেলে রাখা হয়। গোয়েন্দারা হন্যে হয়ে খুঁজছে আলী আসাদকে। আলী আসাদ সিদ্ধান্ত নেন, তিনি জামালপুরে যাবেন। তাঁর সঙ্গী হন তারা মিয়া। তারা মিয়ার জবানিতে জানা যায় :
সবাই বললেন প্রথমে জামালপুর শহরে না ঢুকে দূরে কোনো আত্মীয়বাড়ি থেকে সব সংবাদ জানতে। সে অনুযায়ী আমরা নান্দিনা স্টেশনে নামলাম ট্রেন থেকে। উঠলাম আলী আসাদের এক বন্ধুর বাড়িতে। বন্ধুকে পাঠানো হলো আসাদের বাবার কাছে। বিকেলে তার বাবা তাসিরউদ্দিন মোক্তার এলেন। তিনি বললেন, আমাদের এ দেশে থাকা বিপজ্জনক। কারণ, গোয়েন্দা বিভাগ কোথা থেকে তার। ফটো জোগাড় করে বিভিন্ন থানা ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের কাছে পাঠিয়েছে, তাকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য। ধরিয়ে দিলে পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। জামালপুরে ভারতে ছাপানো কিছু বিজ্ঞাপন (লিফলেট) পুলিশের হাতে পড়েছে। গুজব রটেছে, এসব সে ভারত থেকে ছাপিয়ে এনেছে।
তাসিরউদ্দিন মোক্তার ভারতের জাতীয় কংগ্রেস নেতা ও পার্লামেন্ট সদস্য সুরেন ঘোষের কাছে চিঠি লিখলেন, যেন আসাদকে ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়া হয়। দেশভাগের আগে সুরেন ঘোষ ময়মনসিংহ জেলা কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন। এই সুরেন ঘোষই কিছুদিন আগে তাদের চারজনকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহরুর সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেছিলেন।
আমরা রাতের ট্রেনে আসাদকে উঠিয়ে দিলাম। আসাদের বাবা কলকাতায় যাওয়ার খরচ বাবদ কিছু টাকা দিলেন। বললেন, কুড়িগ্রাম মহকুমার ভূরুঙ্গামারী সীমান্তের কাছে তাদের আত্মীয় আছে। সেখানে গেলে তারাই ওপারে পৌঁছে দেবে। রাত ১২টায় আমরা চোখের জলে। আসাদকে বিদায় জানালাম। ঘটনাটি ১৯৬০ সালের কোনো এক সময়ের। [১১]
আলী আসাদ (কালা থোকা) সম্পর্কে সলিল কাহালি আরও তথ্য দিয়েছেন। তাঁর স্কুলের সহপাঠী ও বন্ধু সত্যেন্দ্রমোহন নিয়োগীর সঙ্গে কালা খোকার দেখা হয়েছিল কয়েক মিনিটের জন্য আলিপুরদুয়ার জংশন স্টেশনে। নিয়োগী পরিচিত ছিলেন শংকর বাবু নামে। কালা খোকা স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো ছিলেন। নিয়োগী ছিলেন ট্রেনের ভেতরে। দুজনের। চোখাচোখি হলে কালা খোকা ট্রেনের কামরায় জানালার কাছে এসে জামালপুরের খোঁজখবর নেন। [১২]
সত্যেন নিয়োগী তখন কলকাতা থেকে আসামের বিজনি যাচ্ছিলেন। নিয়োগীর ভাষ্য অনুযায়ী, ‘আমি তাকে জিজ্ঞাসা করি, আপনি এখানে কেন? উত্তরে তিনি বলেন, “আমি আপাতত এখানেই আছি। এমন সময় ট্রেন ছেড়ে দেওয়ায় কথা আর এগোয়নি। [১৩]
ওই সময় কালা খোকার সঙ্গে সলিল কাহালির শিক্ষক রবীন্দ্রচন্দ্র দত্তের দেখা হয়েছিল দর্শনা সীমান্তে। কালা থোকা তাকে একটি লিফলেট পড়তে। দিয়েছিলেন। লিফলেটে কী লেখা ছিল, তা তিনি সলিলকে বলেননি। সলিল কাহালি আরও কিছু তথ্য দেন, যা গল্পের চেয়েও রোমাঞ্চকর :
১৯৬০ সালে আমার বাবা সুশীল কুমার কাহালি যখন টাঙ্গাইলে খাদ্য বিভাগের চিফ ইন্সপেক্টর, সে সময় তিনি অফিসের কাজে জামালপুরে এসেছিলেন। ফেরার পথে টাঙ্গাইল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) বাবার সহযাত্রী হন। একটি ট্রাক থামিয়ে ড্রাইভারকে পেছনে যেতে বলে তিনি নিজেই ট্রাকটি চালিয়ে টাঙ্গাইলের দিকে রওনা হন। সম্ভবত তিনি বেসামাল অবস্থায় গাড়ি চালাচ্ছিলেন। কিছুদূর আসার পর গাছের সঙ্গে ধাক্কা লেগে ট্রাকটি খাদে পড়ে যায়। দুজনই আহত হন। পরদিন খবরটি ইত্তেফাক-এ ছাপা হয়। পোস্টকার্ডে বাবা তার অবস্থা জানিয়ে তাড়াতাড়ি টাঙ্গাইলে যেতে বলেন। পরদিন সকালে আমি জামালপুর থেকে ময়মনসিংহে রওনা হই। তখন টাঙ্গাইল যেতে ট্রেনে ময়মনসিংহ হয়ে তারপর বাসে যেতে হতো। টিকিট কেটে আমি ট্রেনে উঠি। ট্রেন ছাড়ার মুহূর্তে আর এম সাঈদ ট্রেনের একই কামরায় উঠে আমার পাশে বসে এবং কথাবার্তা বলতে থাকে। ওর হাতে ছিল কালো রঙের একটা ব্যাগ। আলাপের একপর্যায়ে ব্যাগ থেকে ডিমাই সাইজের একটি লিফলেট আমার হাতে দিয়ে টয়লেটে গিয়ে পড়তে বলে। টয়লেটে গিয়ে আমি কাগজটি সম্পূর্ণ পড়লাম। এই কাগজে ‘পূর্ববঙ্গের স্বাধীনতা কাটা স্বাধীনতা’ বলে উল্লেখ করে পাকিস্তানি শাসকদের অত্যাচার-উৎপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে যুবসমাজের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট নামে গঠিত তাদের সংগঠনে যোগ দেওয়ার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। কাগজটা পড়ে খুব আনন্দ বোধ করি এবং সাঈদের হাতে ফেরত দিই। কাগজটা সাঈদ তৎকালীন আলম কেবিনের মালিক নেপাল মিয়ার ছোট ছেলে আজিজ ভাইকে পড়তে দিয়েছিল। আজিজ ভাই কাগজটি আর ফিরিয়ে দেননি। বলেছেন, টয়লেটে ফেলে দিয়েছি। সাঈদ জামালপুরে আশরাফ হোসেনের বাসায় আশ্রয় নিয়েছিল। আশরাফ আমার সহপাঠী ছিল।
সাঈদ দু-একটা স্টেশন পরে হঠাৎ ট্রেন থেকে নেমে অদৃশ্য হয়ে যায়। তার সঙ্গে আর কোনো দিন দেখা হয়নি। বাবা খানিকটা সুস্থ হলে জামালপুরে ফিরে আসি। সে সময় জামালপুরে ডিআইবি প্রধান ছিলেন আলী বিশ্বাস সাহেব। তিনি একসময় আমাদের বাড়ির পশ্চিম দিকে রফিকুল চৌধুরীর বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। ছোটবেলা থেকেই বিশ্বাস সাহেবকে আমরা চাচা ডাকতাম। তিনিও আমাদের খুব ভালোবাসতেন। তিনি গম্ভীর স্বরে মাগরিবের নামাজের পর তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বললেন। আমি কিছুটা ভীত হয়ে রহিম চাচার (আবদুর রহিম অ্যাডভোকেট) সঙ্গে দেখা করি। তাঁর চেম্বারেই বিশ্বাস চাচার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। বিশ্বাস চাচা রাগত স্বরে আমাকে তিরস্কার করলেন এবং পরদিন সকাল নয়টার পর তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বললেন। পরদিন তার দেওয়ানপাড়ার বাসায় গেলাম। তিনি আর এম সাঈদের দেওয়া লিফলেট থেকে গাড়ির ঘটনা–সবই বললেন। আমি ওই দিন বাবার দুর্ঘটনাসংবলিত চিঠি এবং পরদিন ইত্তেফাক-এ প্রকাশিত দুর্ঘটনার কথা তাকে বললাম। সেখানেই আর এম সাঈদের সঙ্গে কথা এবং তার দেওয়া লিফলেটের কথা বিস্তারিত জানালাম। বাবার চিঠি ও পত্রিকাটি পরদিন দেখাতে বললেন। আমি রহিম চাচাকে বিস্তারিত জানালাম। তিনি বললেন, স্টেটমেন্টে ভুলেও সই দিবি না। স্টেটমেন্টে সই দিতে বললে আমি বললাম, রহিম চাচার সঙ্গে না বুঝে কোনো সই দেব না। বিশ্বাস সাহেব রাত দুইটার সময় আমাকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে বললেন, ১৫ দিনের মধ্যে জামালপুর থেকে কোথাও যেতে পারবে না। রহিম চাচা কোর্ট থেকে ফিরে আমাকে ডেকে এনে সব কথা শুনলেন। বললেন, সন্ধ্যায় বিশ্বাস সাহেব যদি আমার কাছে আসে, তাহলে তার সঙ্গে দেখা করতে তুই এখানে আসবি। যথারীতি তিনি এলেন। রহিম চাচা তাঁকে বললেন, আমি ছোট থেকে ওদের চিনি। ওর বাবা বিদেশে (টাঙ্গাইলে) চাকরি করে এবং এখানে আমিই তার প্রকৃত অভিভাবক। দেখবেন ওর যেন কোনো ক্ষতি না হয়।
কয়েক দিন পর ময়মনসিংহ ডিআইবি অফিসে নিয়ে যাওয়া হলো। আমার ওপর নির্যাতন চলল। একটা বদ্ধ ঘরে বসিয়ে ধীরে ধীরে একটার পর একটা ইলেকট্রিক বাতি জ্বালাতে লাগল। আমি ঘামতে লাগলাম। একজনের পর একজন একেক ধরনের প্রশ্ন করতে শুরু করল ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্টের সদস্যদের আমি চিনি কি না। তারপর কালা থোকা, আর এম সাঈদ, আবদুর রহমান সিদ্দিকী–এমন আরও অনেকের কথা জিজ্ঞাসা করল। বললাম, কালা খোকাদাকে ভালো করে চিনি এবং দাদা বলে সম্মান করি। আর এম সাঈদ আমার বন্ধু। আবদুর রহমান সিদ্দিকী বয়সে বড় বলে তার সঙ্গে শুধুই আলাপ হয়েছে, সখ্য হয়নি। আমি ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্টের সদস্য নই। ওরা আশরাফ হোসেন ও আজিজ ভাইয়ের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ার কথা বলল এবং আলো জ্বালাতে থাকলে আমি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলি।
হঠাৎ বিশ্বাস সাহেবের কথা শুনতে পাই। তিনি বললেন, ওকে আমার হেফাজতে ছেড়ে দিন। আমি ওকে দেখেশুনে রাখব। আমার ইনভেস্টিগেশনে তেমন কিছু পাইনি। আলোগুলো ধীরে ধীরে নিভে গেল। গম্ভীর গলায় ডিআইবি কর্মকর্তা বিশ্বাস সাহেবকে বললেন, ‘আপকো হেফাজত মে ছোড় দেতিহু। ইস আদমিকো গলদ কুই তুমসে গলদ। ইউ উইল বি সোল রেসপনসিবল হোগা, মাইন্ড ইট।
বিশ্বাস সাহেব ট্রেনে করে আমাকে জামালপুরে নিয়ে বাসায় পৌঁছে দিলেন। তাঁর রিপোর্টেই এ সমস্যা থেকে মুক্তি পেলাম। [১৪]
.
৪
লিবারেশন ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সংগঠক আবদুর রহমান সিদ্দিকী হঠাৎ গ্রেপ্তার হয়ে যাওয়ায় বিভিন্ন শাখার সংগঠকদের নাম অন্যদের দিয়ে যেতে পারেননি। এই সংগঠনে সবাই সবাইকে চিনতেন না। সিদ্দিকী একদিন তারা মিয়াকে বলেছিলেন, কোনো সময় টাকার অসুবিধা হলে আমার কথা এবং লিবারেশন ফ্রন্টের সদস্য পরিচয় দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে গেলে তিনি টাকা দিয়ে তোমাদের সাহায্য করবেন। তারা মিয়ার ভাষ্যে জানা যায় :
আমি ও আকরাম সাহেব শেখ সাহেবের সঙ্গে আলফা ইনস্যুরেন্সের অফিসে দেখা করলাম। শেখ সাহেব আকরামকে চেনেন অনেক আগে থেকেই। তিনি বললেন, ‘আকরাম, কী খবর? কেমন আছ? আকরাম সাহেব আমাদের পরিচয় দিলেন লিবারেশন ফ্রন্টের সদস্য হিসেবে এবং আলী আসাদ যে ভারতে গেছে, তা-ও জানালেন। শেখ। সাহেব বললেন, সিদ্দিকী জেলে আছে। পুলিশ ওকে নির্যাতন করছে। আমরা ওকে বাঁচানোর চেষ্টা করছি। সোহরাওয়ার্দী সাহেবকেও জানিয়েছি। গোয়েন্দা বিভাগ কিছু লিফলেট পেয়েছে। সন্দেহ করছে, এগুলো ভারতে ছাপানো। ওরা নাকি ভারত থেকে অনেক অস্ত্রশস্ত্র এনেছে, এসব গুজব রটেছে। পুলিশ তাদের পাকড়াও করার জন্য পাগল হয়ে খুঁজছে। ধরতে পারলে ফাঁসি হয়ে যাবে। আমি তোমাদের সংগ্রামকে সমর্থন করি না, বিরোধিতাও করি না। আমি পার্লামেন্টারি রাজনীতিতে বিশ্বাসী। এখন রাজনীতি নিষিদ্ধ, তাই করি না। যেহেতু সিদ্দিকী ও আলী আসাদ আওয়ামী লীগের নির্ভীক কর্মী ও জাঁদরেল সংগঠক এবং তোমাদের সবাই আওয়ামী লীগের লোক, ভবিষ্যতে সবাইকে নিয়ে আওয়ামী লীগ করতে হবে।’ তিনি আমাদের ৫০০ টাকা দিলেন, আকরামের হাতে। বললেন, গ্রামে চলে যাও। অবস্থা ভালো হলে শহরে আসিও।’ ওই টাকা থেকে বিমানভাড়া নিয়ে আমি পরদিন করাচি চলে যাই আমার বোনের কাছে। [১৫]
আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবের সঙ্গে ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্টের সদস্যদের যোগাযোগ ছিল বলে তারা মিয়ার ভাষ্যে জানা যায়। বিষয়টি আরও নিশ্চিত করেছেন শিশুসাহিত্যিক আখতার হুসেন। লিবারেশন ফ্রন্টের নেতা আর এম সাঈদ ছিলেন তার গুরুস্থানীয়। আখতার হুসেন জানিয়েছেন :
গফরগাঁওয়ে স্কুলে পড়ার সময় সাঈদ ভাই আমাদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথাবার্তা বলতেন। আমি ছাড়া আরও ছিলেন আলতাফ হোসেন গোলন্দাজ (সাবেক সংসদ সদস্য), জামালউদ্দিন (সোনালী ব্যাংকের সাবেক সিবিএ নেতা) ও হেলালউদ্দিন। আমরা সবাই গফরগাঁওয়ে থাকি।
১৯৬৩ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে আমি ঢাকায় আসি। সাঈদ ভাই একদিন মতিঝিলে আলফা ইনস্যুরেন্স কোম্পানির অফিসে আমাকে নিয়ে যান। সেখানে শেখ মুজিব অফিস করতেন। সাঈদ ভাই এবং শেখ সাহেব একসঙ্গে জেলে ছিলেন। সাঈদ ভাই ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি করতেন। শেখ সাহেব তাকে বললেন, তুই আমার দলে চলে আয়।’ তিনি সাঈদ ভাইকে পকেট হাতড়ে ৩০ টাকা দিলেন। সেই টাকা দিয়ে আমি দুদিন খাওয়াদাওয়া করলাম, পত্রপত্রিকা কিনলাম। [১৬]
অলি আহাদ একসময় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। গুরুত্ব বিবেচনায় দলের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের পরেই ছিলেন তিনি। ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনের সময় আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়। ১৯৫৮ সালে দেশে সামরিক শাসন জারি হলে আরও অনেকের মতো তিনিও গ্রেপ্তার হন। ছাড়া পান ১৯৬৩ সালে। ওই সময়ের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তিনি খুব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। তার দেওয়া বিবরণে জানা যায় :
কারামুক্তির পর অত্যন্ত সতর্কতার সহিত লক্ষ করিতেছিলাম যে, পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র-যুবসমাজে ও রাজনৈতিক অঙ্গনে স্বাধীন বাংলার আওয়াজ একটি সোচ্চার আওয়াজে পরিণত হইয়াছে। বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপে উদ্বিগ্ন পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কাউন্সিল) সভাপতি খাজা নাজিমউদ্দিন ২৭ নভেম্বর (১৯৬২) রাত্রিতে ঢাকায় অনুষ্ঠিত কাউন্সিল সভায় ভাষণদানকালে মন্তব্য করেন, ‘পাঁচ বৎসরকাল ঢাকায় অবস্থানকালে বিভিন্ন স্তরের লোকজন, যাহার অধিকাংশই আমার বন্ধুবান্ধব ও সহকর্মী, আমার সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছেন। তাহাদের নিকট হইতে আমি জানিতে পারিয়া ব্যথিত হইয়াছি যে, বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিচ্ছিন্ন হইবার ব্যাপারে কানাঘুষা চলিতেছে। দুর্ভাগ্যবশত পশ্চিম পাকিস্তানিদেরও একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ এই মতের সমর্থক। সম্প্রতি এক নৈশভোজে পশ্চিম পাকিস্তানের একজন অতি উচ্চপদস্থ কর্মচারী আমাকে বলেন যে, কনফেডারেশন গঠন। করিলে ক্ষতি কী?…
১৯৬২ সালের নভেম্বর মাসে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অবস্থানকালে ময়মনসিংহ নিবাসী রাজবন্দীদ্বয় আবদুর রহমান সিদ্দিকী ও আবু সৈয়দের (এটি হবে আর এম সাঈদ) নিকট হইতে আমি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের বিষয়াদি অবগত হই। ভারতে মুদ্রিত বিচ্ছিন্নতাবাদ সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন ময়মনসিংহ ও বিভিন্ন জেলায় বিতরণকালেই তাহারা গ্রেপ্তার হইয়াছিলেন। [১৭]
আবদুর রহমান সিদ্দিকী বারবার গ্রেপ্তার হয়ে জেলে আটক ছিলেন। ১৯৬৩ সালে ছাড়া পেয়ে তিনি আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ডে আবারও সক্রিয় হন। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা দাবি নিয়ে সারা দেশে হইচই পড়ে গিয়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেপ্তার হন ৮ মে ১৯৬৬। ওই দিন ময়মনসিংহ থেকে জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক আবদুর আবদুর রহমান সিদ্দিকীও গ্রেপ্তার হন।
‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ চলাকালে শেখ মুজিব যে জবানবন্দি দিয়েছিলেন, তাতে তিনি দলের নেতা কর্মীদের ওপর নির্যাতন ও গ্রেপ্তারের অভিযোগ জানিয়ে একপর্যায়ে বলেন, …মোমেনশাহীর অন্যতম আওয়ামী লীগ কর্মী জনাব আবদুর রহমান। সিদ্দিকীসহ অন্যান্য বহু আওয়ামী লীগ কর্মী, ছাত্রনেতা ও শ্রমিকনেতাকে পাকিস্তান রক্ষাবিধি ৩২ ধারাবলে কারান্তরালে নিক্ষেপ করা হয়। [১৮]
.
৫
আলী আসাদ দ্বিতীয়বার ভারতে গিয়ে নিশ্চেষ্ট বসে ছিলেন না। তখন তাঁর সঙ্গে আর কে কে ছিলেন, তা জানা যায় না। ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন ১৯৬৬ সালে। তখনো আলী আসাদের তৎপরতার সন্ধান পাওয়া যায়। স্মিতা মিত্রকে দেওয়া আসাম বিধানসভার সদস্য শৈলেন মেধির একটি সাক্ষাৎকারে বিষয়টি উঠে এসেছে। গবেষক হারুন হাবীব তার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত: তথ্য ও দলিল, আসাম ও মেঘালয় বইয়ে সাক্ষাৎকারটি উদ্ধৃত করেছেন। পুরোনো স্মৃতি হাতড়ে শৈলেন মেধি বলেছেন :
অনেক দিন আগের কথা। একদিন ছয়জনের একটা দল গুয়াহাটিতে এল। ওরা এসেছিল ওদের সংগ্রামের জন্য অস্ত্রশস্ত্রের খোঁজে। ওরা প্রথমেই কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃস্থানীয় কয়েকজন লোকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। কিন্তু বন্দুকের সঙ্গে পরিচয় না থাকা আসামের কমিউনিস্ট পার্টি তাদের জানিয়ে দিল যে অস্ত্র-সংগ্রামে ওরা বিশ্বাস করে না, তাই পূর্ব পাকিস্তানের আন্দোলনে সাহায্য করার জন্য ওরা অপারগ। তখন মুক্তিবাহিনীর লোকেরা আরসিপিআইয়ের খোঁজে কমলা মজুমদারের বাড়িতে হাজির হলো। মজুমদার আমার সঙ্গে যোগাযোগ করল। তারপর ওদের কলকাতায় নিয়ে গিয়ে পান্নাবাবুর (পান্নালাল দাশগুপ্ত) সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হলো।
উড়িষ্যা রাজ্যের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী নন্দিনী সৎপথির সঙ্গে পান্নাবাবুর পুরোনো বন্ধুত্ব ছিল। সেই সূত্রেই পান্নাবাবু ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। প্রয়াত ফখরুদ্দিন আলী আহমদ সাহেবের সহযোগিতায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার অনেক মন্ত্রীর সঙ্গেও তাঁর সাক্ষাৎ করার সুযোগ হলো। ইন্দিরা গান্ধী পান্নাবাবুকে আসাম গিয়ে বিমলা প্রসাদ চালিহার (তখন আসামের মুখ্যমন্ত্রী) সঙ্গে আলোচনা করার পরামর্শ দিলেন। এই কথাও বললেন যে আন্তর্জাতিক রীতিনীতির জন্য ভারত সরকার পূর্ব পাকিস্তানের বিদ্রোহীদের প্রকাশ্যে সাহায্য করতে পারবে না।
শ্রী বিমলা চালিহার সঙ্গে পান্নাবাবুর আগে থেকেই পরিচয় ছিল। চালিহা বাবুকে পান্নাবাবু ওর পরিকল্পনার কথা জানান। পরিকল্পনাগুলো হলো ১. আসাম ও ত্রিপুরা সীমান্তে মুক্তিবাহিনীর যুবকদের অস্ত্রশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া। ২. প্রচারপত্র আর গোপন রেডিওর সাহায্যে পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা। ৩, মুক্তিবাহিনীর জন্য খাদ্য, বস্ত্র, অস্ত্র, ওষুধ ইত্যাদি সাপ্লাই করা।
চালিহা বাবু রাজি হলেন। তিনি টেলিফোনযোগে সীমানা সুরক্ষা বাহিনীর (বিএসএফ) ব্রিগেডিয়ার বরুরাকে ডেকে পাঠালেন। আমি ও পান্নাবাবু ব্রিগেডিয়ারের সঙ্গে পরিচিত হলাম। দুই দিন পর ব্রিগেডিয়ার বরুরা, আমি আর পান্নাবাবু বিএসএফের একটা গাড়িতে চেপে পূর্ব পাকিস্তান ও আসাম সীমান্তে মানকারচর এবং ডাউঁকির সীমান্ত অঞ্চলগুলো পরিদর্শন করলাম। দুই রাত্রি সীমান্ত অঞ্চলের বিএসএফ ক্যাম্পেই আমাদের থাকতে হলো। চালিহা বাবু আমার হাতে নগদ ৬০ হাজার টাকা দিলেন, খরচের একটি হিসাবও ওর। কাছে দাখিল করার অনুরোধ করলেন। সেই সময় ত্রিপুরা রাজ্যের কৈলাশহর কলেজে প্রভাষক হিসেবে কাজ করত আমার এক বন্ধু (প্রয়াত) ববিজিৎ চৌধুরী। কৈলাশহর, খোয়াই ও আসামের করিমগঞ্জ, ডাউঁকি, বাঘমারা আর মানকারচরে আমরা ক্যাম্প স্থাপন করেছিলাম। [১৯]
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু করার পর আসাম বিধানসভায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে একটি অভিনন্দন প্রস্তাব নেওয়া হয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চালিহা অসুস্থ থাকায় তার জায়গায় মহেন্দ্রমোহন চৌধুরী দায়িত্ব পালন করছিলেন। সে সময় বিধায়ক শৈলেন। মেধি এতই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন যে অভিনন্দন প্রস্তাবের ওপর ভাষণ দিতে গিয়ে মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করার ক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রী চালিহার অতীতের অবদানের কথা বলে দেন। বিধানসভায় বেশ হইচই হয়। স্পিকার মুখ্যমন্ত্রী চালিহার কথা উল্লেখ থাকা অংশটি বিধানসভার কার্যবিবরণী থেকে বাদ দেন। কেননা, আন্তর্জাতিক রীতিনীতির বাইরে গিয়ে ভারতের একটি অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী অন্য এক সার্বভৌম দেশের বিরুদ্ধে এমন কাজ করতে পারেন না। [২০]
শৈলেন মেধি তাঁর কাছে সাহায্যপ্রার্থী ছয়জনের নাম উল্লেখ করেননি। অনুমান করা যায়, তারা ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্টেরই সদস্য হবেন। আলী আসাদ তখনো ভারতেই ছিলেন।
আলী আসাদ মায়ের কাছে শুনেছিলেন, তাঁদের এক আত্মীয় মোমেনা বেগম কোচবিহারে থাকেন। দ্বিতীয়বার ১৯৬০ সালে তিনি যখন ভারতে যান, তখন কিছুদিন কোচবিহারে ছিলেন। তিনি ‘বেঙ্গল ইমিউনিটি’ নামক একটি ওষুধ তৈরির কারখানায় কাজ পেয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে জামালপুরে পরিবারের কারও সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। তার ছোট ভাই আলী ইয়ার পারভেজ জানিয়েছেন, ১৯৬৪ সালে তার মা ছোট দুই বোন রেহেনা ও সেলিনাকে নিয়ে কোচবিহারে তার সঙ্গে দেখা করতে যান। সেখানে পাঁচ-ছয় দিন থাকার পর তারা জামালপুরে চলে আসেন। মা খোকাকে দেশে ফিরে আসতে বলেছিলেন। জবাবে তিনি বলেছিলেন, মা, এখনো অনেক কাজ বাকি আছে। কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি দেশে ফিরে যেতে পারি না।’ ১৯৭১ সালের শুরুর দিকে কলকাতার কালান্তর পত্রিকার সাংবাদিক আশুতোষ দত্ত (কমরেড আশুদত্ত) আসাদের বাবাকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন, ‘কালা খোকা এখনো। জীবিত আছে। তার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আমি দেশে আসলে আপনার সঙ্গে বিশদ আলোচনা করব।’ [২১]
আলী ইয়ার তার ভাইকে কখনো দেখেননি। মায়ের কাছে তাঁর কথা শুনেছেন। কালা খোকার আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। নুরউদ্দিন আহমদ তারা মিয়া করাচি থেকে ফিরে আসেন ১৯৬৫ সালে। এরপর তিনি আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত হন এবং ছয় দফা আন্দোলনে অংশ নেন। আবদুর। রহমান সিদ্দিকীর সঙ্গে ১৯৭২ সালে আবার দেখা হয়েছিল তাঁর।
আর এম সাঈদ শেষ জীবনে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। তিনি রক্ষীবাহিনীর গুলিতে নিহত হন বলে শোনা যায়।২২ তিনি ১৯৭৫ সালে মারা যান। সিদ্দিকীর সঙ্গে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক মতভেদ হয়েছিল। তিনি ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশ নেওয়ার বিরুদ্ধে এবং স্বাধীনতার জন্য লড়াই চালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। সিদ্দিকী ১৯৭০ সালে ভাসানী-ন্যাপে যোগ দেন। তাঁর মৃত্যু হয় ১৯৯৬। সালে।২৩ আকরাম হোসেন ১৯৭১ সালে রাজাকারদের হাতে নিহত হন। আখতারুজ্জামান মতি মিয়া ১৯৯১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি সদরঘাটের আলহামরা লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে পুরান ঢাকায় তাঁর আত্মীয়বাড়িতে ফেরার পথে নিখোঁজ হন। [২৪]
বকশীগঞ্জের আশরাফ হোসেন ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিটে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি ময়মনসিংহ শহরে থেকে আইন ব্যবসা করতেন।[২৫] ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২০ তিনি মারা যান।
নেত্রকোনার এম এ খালেক ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে প্রাদেশিক পরিষদের এবং ১৯৭৩ সালে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। সলিল কাহালি দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করে ২০০৫ সালে জামালপুর জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে অবসরে যান। [২৬]
.
তথ্যসূত্র
১. সলিল কাহালি, স্বাধীনতা সংগ্রামে উৎসর্গকৃত জামালপুরের প্রথম সৈনিক আমাদের কালো খোকাদা’, ধ্রুবতারা, সম্পাদনা : স্বাধীন আশরাফুজ্জামান, ভাষাসৈনিক মতি মিয়া ফাউন্ডেশন, জামালপুর, পৃ. ২৭-২৯
২. হাসান, মোরশেদ শফিউল (২০১৪), স্বাধীনতার পটভূমি : ১৯৬০ দশক, অনুপম প্রকাশনী, ঢাকা, পৃ. ২৩০-২৩৩: আফসান চৌধুরী, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রস্তুতিপর্ব বিচিত্রা, বিজয় দিবস সংখ্যা, ১৯৮৭
৩. আবদুর রহমান সিদ্দিকী, ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্টের ভারত অভিযান’, ধ্রুবতারা, পৃ. ১৬-১৭
৪. আশরাফ হোসেন
৫. রহমান, শেখ মুজিবুর (২০১২), অসমাপ্ত আত্মজীবনী, ইউপিএল, ঢাকা, পৃ. ২৪৬
৬. বিচিত্রা, ২২ জানুয়ারি ১৯৮৮
৭. ওই
৭. ওই
৯. নুরউদ্দিন আহমদ (তারা মিয়া), স্মৃতিতে ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট’, ধ্রুবতারা, পৃ. ১৮-১৯
১১. ওই
১২. ওই
১৩. ওই
১৪. সলিল কাহালি, ধ্রুবতারা, পৃ. ২৯-৩০
১৫. নুরউদ্দিন আহমদ (তারা মিয়া), পৃ. ২০
১৬. আখতার হুসেন
১৭. আহাদ, অলি (২০০৪), জাতীয় রাজনীতি: ১৯৪৫ থেকে ৭৫, বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লি., ঢাকা, পৃ. ২৭৩-২৭৪
১৮. বেগম, সাহিদা (২০০০), আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা : প্রাসঙ্গিক দলিলপত্র, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, পৃ. ৮২৬।
১৯. বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত: তথ্য ও দলিল, আসাম ও মেঘালয় (২০১৭), গ্রন্থনা ও সম্পাদনা : হারুন হাবীব, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, পৃ. ১৯৬-১৯৭।
২০. ওই
২১. আলী ইয়ার পারভেজ, অকুতোভয় স্বাধীনতাসংগ্রামী আলী আসাদ’, ধ্রুবতারা, পৃ. ৫৩
২২. সেন, নির্মল (২০১২), আমার জবানবন্দি, ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ, ঢাকা, পৃ. ১৭
২৩. শাহজাহান সিদ্দিকী
২৪. স্বাধীন আশরাফুজ্জামান
২৫. আশরাফ হোসেন
২৬. সলিল কাহালি