প্রথম কাণ্ড। চতুর্থ প্রপাঠক
প্রথম অনুবাক
মন্ত্র- আদদে গ্রাবাহস্যধ্বরকৃদ্দেবেভ্যো গম্ভীরমিমমধ্বরং কৃধত্তমেন পবিনেন্দ্রায় সোমং সুষুতং মধুমন্তং পয়স্বন্তং বৃষ্টিবনিম্। ইন্দ্রায় বা বৃত্ৰষ্ম ইন্দ্রায় ত্বা বৃত্ৰতুর ইন্দ্রায় ত্বাইভিমাতিঘ্ন ইন্দ্রায় ভ্ৰাহদিত্যবত ইন্দ্রায় ত্বা বিশ্বদেব্যাবতে। শ্বাত্রাঃ স্থ বৃত্ৰতুবো রাধোগৃর্তা অমৃতস্য পত্নীস্তা দেবীৰ্দেবত্ৰেমং যজ্ঞ ধত্তোপহুতাঃ সোমস্য পিবতোপহূত যুম্মা সোমঃ পিবতু। যত্তে সোম দিবি জ্যোতির্থৎ পৃথিব্যাং যদুরাবন্তরিক্ষে তেনাস্মৈ যজমানায়োরায়া কৃধ্যধি দাত্রে বোচঃ। বিষণে বীড় সতী বীড়য়েথামূৰ্জং দধাথামূৰ্জং মেধত্তম মা বাং হিংসিষং মা মা হিংসিষ্টম। প্রাগপাগুদগধরাক্তাস্তা দিশ আ ধাবম্ব নি স্বর। যত্তে সোমাদাভ্যং নাম জাগৃবি তস্মৈ তে সোম সোমায় স্বাহা ॥১॥
মর্মার্থ– উৎকর্ষসাধক পবিত্রকারক হে ভগবন্ বা শুদ্ধসত্ত্ব! আপনি সৎকর্মের সম্পাদক হন। অতএব আত্মার উৎকর্ষসাধনের জন্য আপনাকে হৃদয়ে ধারণ (প্রতিষ্ঠিত) করছি। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক আত্ম-উদ্বোধক)। দেবগণের প্রীতিসাধনের জন্য অর্থাৎ অন্তরে দেবভাবের উদ্দীপনার নিমিত্ত আপনি আমাদের অনুষ্ঠিত সৎকর্ম হিংসাপ্রত্যবায় ইত্যাদি পরিশূন্য করুন। শ্রেষ্ঠ পবিত্রকারক আপনার প্রীতির জন্য (আপনার অনুগ্রহে) আমার অন্তরস্থিত শুদ্ধসত্ত্ব যেন পবিত্রতাসম্পন্ন, অনন্তমাধুর্যযুক্ত অর্থাৎ ভক্তিরসের উদ্দীপক জ্ঞানদায়ক–অমৃতপ্রদ এবং অভীষ্টসাধক করতে সমর্থ হই। (মন্ত্রটি সঙ্কল্পমূলক)। হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! সর্বশক্তির আধার ভগবানের প্রীতির নিমিত্ত তোমাকে উৎসর্গ করছি। হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! তোমাকে অজ্ঞানরূপ আবরণের নাশক প্রজ্ঞানস্বরূপ ভগবানের প্রীতির নিমিত্ত উৎসর্গ করছি। হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! রিপুশত্রুর নাশক পরম-ঐশ্বর্যশালী ভগবানের (ভগবান্ ইন্দ্রদেবতার) প্রীতির নিমিত্ত তোমাকে নিয়োজিত করছি। হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! পাপতাপবিনাশক সর্বশক্তির আধার ভগবান ইন্দ্রদেবতার প্রীতির নিমিত্ত তোমাকে নিবেদন করছি। হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! প্রজ্ঞানদায়ক স্বপ্রকাশ ভগবান ইন্দ্রদেবতার প্রীতির নিমিত্ত তোমাকে নিয়োজিত করছি। হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! সর্বদেবময় একমেবাদ্বিতীয় ভগবানের পূজার নিমিত্ত তোমাকে উৎসর্গকৃত করছি। হে আমার জন্মসহজাত সৎ-ভাবসমূহ! তোমরা ভগবানের প্রীতিসাধক হও। অপিচ, তোমরা অন্তঃশত্রুনাশক পরমধনের গোপয়িতা অর্থাৎ প্রকাশক, অমৃতস্বরূপ সোম-আধার ভগবানের পালয়িতা অর্থাৎ হৃদয়ে প্রতিষ্ঠাপয়িতা হও। তথাবিধ তোমরা অর্থাৎ তোমরা তেমনই হয়ে, পরমজ্যোতিঃপ্রদ দেবভাবসমূহে অর্থাৎ পরমজ্যোতিঃপ্রদ দেবভাব সংজননের দ্বারা আমাদের অনুষ্ঠিত সৎকর্ম সম্পূরণ করো। হে দেবতাগণ! আপনারা আমাদের আহুতির দ্বারা হৃদয়ে উদ্দীপিত হয়ে আমাদের প্রদত্ত সৎ-ভাবকে গ্রহণ করুন। অপিচ, আপনাদের অনুগ্রহে আমাদের হৃদয়ে উদ্দীপিত শুদ্ধসত্ত্বকে আমাদের হৃদয়ে সুপ্রতিষ্ঠিত করুন। হে শুদ্ধসত্ত্বাধার ভগবন্! দুলোক ভূলোক এবং বিস্তীর্ণ অন্তরিক্ষলোক অর্থাৎ সর্বলোকে আপনার যে প্রসিদ্ধ দিব্যজ্যোতিঃ বিদ্যমান আছে, সেই জ্যোতির দ্বারা প্রার্থনাকারী শরণাগত আমাকে পরমধনের দ্বারা সমৃদ্ধ করুন। অপিচ, কর্মফল প্রদানকারী আপনার সম্বর্ধনার নিমিত্ত এই যজমানকে অর্থাৎ আমাকে সৎপথ প্রদর্শন করুন। শুদ্ধসত্ত্বের ধারক হে আমার জ্ঞানভক্তি! তোমরা অচঞ্চল হয়ে আমাকে অচঞ্চল করো অর্থাৎ আমার মনের চাঞ্চল্য দূর করো; এবং বলপ্রাণ প্রদান করো। আমি তোমাদের হিংসা করব না,–তোমরাও আমাকে হিংসা অর্থাৎ পরিতাগ করো না। হে আমার অন্তর! পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ–সর্বদিকে অবস্থিত অর্থাৎ সর্বদিরূপে বর্তমান সেই ভগবান্ তোমাকে সম্যভাবে প্রাপ্ত হোন অথবা ব্যাপ্ত করুন। হে আমার অন্তরস্থিত শুদ্ধসত্ত্ব! তোমরা ভগবানের প্রীতির উপযোগী হয়ে অবির্ভূত হও। হে শুদ্ধসত্ত্বস্বরূপ ভগবন্! আপনার যে নামের দ্বারা আপনি শত্রু কর্তৃক অনভিভূত অর্থাৎ যে নামে শত্রুসমূহ অভিভূত হয়, চৈতন্যস্বরূপ (চৈতন্যদায়ক) শুদ্ধসত্ত্বস্বরূপ হে ভগবন্! আপনার সেই সোম-নামের দ্বারা (নাম উচ্চারণে) স্বাহা (অর্থাৎ স্বাহা মন্ত্রে এই হবিঃ প্রদান করছি; আমার অনুষ্ঠান সুহুত হোক) ॥ ১।
[এই প্রপাঠকের এই অনুবাকে সোমাভিষব পরিবর্ণিত। পাত্রগুলিতে রসগ্রহণের জন্য তৃতীয় প্রপাঠের মন্ত্রের দ্বারা সোম আহরিত হয়েছে। আর এই চতুর্থ অনুবাকের মন্ত্রের দ্বারা সেই সোম থেকে রস নিঃসারিত হচ্ছে। রসনিঃসারণে গ্রাব অর্থাৎ প্রস্তর ইত্যাদি প্রয়োজন বলে প্রথম মন্ত্রে গ্রাব অর্থাৎ সোমকুণ্ডয়নের প্রস্তর-বিশেষের উল্লেখ দেখতে পাই। ভাষের প্রারম্ভে অনুক্রমণিকায় ভাষ্যকারের মন্তব্যও তা-ই। এই স্থলে মন্ত্রগুলিতে সোম শব্দ যে ভাবে ব্যবহৃত হয়েছে, তাতে সোম বলতে সোমলতা ভিন্ন অন্য কিছুই উপলব্ধ হয় না। কিন্তু মাদকতাপূর্ণ সোমরস পাত্রে নিঃসারিত করে দেব-উদ্দেশ্যে যজ্ঞকার্যে প্রদত্ত হলে কি যে পারমার্থিক মঙ্গল সংসাধিত হয়, তা সহজে বোধগম্য হয় না। সেই জন্য আমরা বেদমন্ত্রের ব্যাখ্যায় সাধারণ প্রচলিত (এবং কল্পিত) সোমের অর্থ পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছি। আমরা সোম বলতে হৃদয়ে বিশুদ্ধ শুদ্ধসত্ত্ব অংশকেই বুঝেছি এবং সেই অনুসারে পূর্বাপর মন্ত্র-ব্যাখ্যানে প্রয়াসী হয়েছি। আমরা মনে করি, জ্ঞানরূপ অগ্নিমুখে সুসংস্কৃত হয়ে হৃদয়ের অভ্যন্তরে সাধনারূপ যজ্ঞহবির যে সূক্ষ্মতম শুদ্ধসত্ত্ব অংশে দেবতার সমীপে গমন করে, তাদের প্রীতি উৎপাদন করে, তা-ই সোম। অর্থাৎ অন্তর্নিহিতা যে বিশুদ্ধ ভক্তি, তা-ই সোম। ক্লেদকলঙ্কপরিশূন্য আবিল্যরহিত যে জ্ঞান, তা-ই সোম। এই সোমকে আশ্রয় করে ভগবানের সমীপে উপনীত হতে হয়। দেবতার উদ্দেশ্যে হুত সোম যে বাস্তব কোনও পদার্থ নয় (মাদকদ্রব্য তো নয়ই), সেটি যে প্রাণের সামগ্রী, পুরাণ প্রমাণেও তা সপ্রমাণ হয়। পুরাণে ত্রিত ঋশির উপাখ্যান আছে। দৈবচক্রে এক সময় তিনি কূপের মধ্যে নিপতিত হন। তিনি সেই অবস্থাতেই কুপের মধ্যে বৈদিক নিত্যকর্ম যজ্ঞের অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। সেখানে সোম ছিল না, সরস্বতী নদী ছিল না, অগ্নি বা আহবনীয় দ্রব্য কিছুই ছিল না, অথচ তিনি সেই কূপের মধ্যেই সোমযাগ সম্পন্ন করেছিলেন। ফলে দেবতাগণ তার প্রতি প্রসন্ন হন এবং ঋষি কূপ থেকে উদ্বার লাভ করেন। সোম যে কি বস্তু, এ থেকেই তা আপনা-আপনি উপলব্ধ হয়। সোম–প্রাণের সামগ্রী; সোম–জ্ঞানস্বরূপ। ঋষি অন্ধকারে নিপতিত হয়েছিলেন; হৃদয়ে অনুষ্ঠিত সোমযজ্ঞের প্রভাবে জ্ঞান-স্ফুর্তিতে তিনি মুক্তিলাভ করেন। যাই হোক, প্রথম মন্ত্রের অন্তর্গত গ্রাব পদে ভাষ্যকার স্বাভাবিক ভাবেই অভিযবসাধনকারী পাষাণকে লক্ষ করেছেন। প্রস্তরমধ্যে নিক্ষেপ করে নিষ্পেষণের দ্বারা সোমলতা থেকে রস-নিঃসারণ করতে হয়,–এই লক্ষ্যেই ভাষ্যকারের অর্থের অবতারণা। কিন্তু আমরা ঐ পদে ভগবানের প্রতি লক্ষ্য আছে বলে মনে করি। পাপীর পরিত্রাণের জন্য তিনি পাষাণের মতো দৃঢ়। দ্বিতীয় মন্ত্রের অন্তর্গত ইন্দ্রায় বৃত্ৰতুর ইন্দ্রায়, অভিমাতিঘ্ন ইন্দ্রায়, আদিত্যবত ইন্দ্রায় এবং বিশ্বদেবতাবতে ইন্দ্রায় পদগুলিতে সাধনার বিভিন্ন স্তরের বিষয় সূচিত হয়েছে বলেই আমরা মনে করি। তৃতীয় মন্ত্রে অন্তরস্থিত সৎ-ভাব ইত্যাদির সম্বোধন কল্পনা করি। অর্থাৎ স্নিগ্ধ চন্দ্রকিরণের মতো হৃদয়ের নির্মলতা সাধিত হোক, এটাই কামনা। এইভাবে হৃদয় নির্মল হলে জ্যোতির্মানের দিব্যজ্যোতিঃ-লাভে হৃদয় উদ্ভাসিত হবে; আর তখনই সৎ-পথের প্রতি লক্ষ্য আসবে; তখনই সকর্মের ফলস্বরূপ পরমধন মোক্ষধন অধিগত হবে। আমরা মনে করি, চতুর্থ মন্ত্রে এই ভাবেই পরিব্যক্ত। পঞ্চম মন্ত্রে জ্ঞান-ভক্তির প্রতি লক্ষ্য রয়েছে। কিন্তু ধিষণা পদে ভাষ্যমতে সোমের চর্ম বা সোম-লতার গায়ের বল্কল বোঝাচ্ছে। ষষ্ঠ মন্ত্রের ভাষ্যানুসারী অর্থ–হে সোম! দিমূহ তোমার অভিমুখে প্রধাবিত হোক। হে অশ্ব! মাতৃস্থানীয় সোম রসাত্মক হয়ে নিঃসারিত হোক। অভিষব-আধার পাষাণের উপরি ভাগে সোম স্থাপন করে এই নিগ্রাভ মন্ত্র পাঠ করতে হয়। আমরা কর্মকাণ্ডের বিরোধী না হলেও মনে করি, এই মন্ত্রে সর্বদিকরূপে সর্বদিকে নিত্য-বিদ্যমান ভগবানের প্রতি লক্ষ্য আছে। শেষ মন্ত্রে আমরা যে অভিনব প্রার্থনার ভাব দেখতে পাই, তা-ই মর্মার্থে প্রকাশ করেছি। পরিশেষে মন্ত্রের অন্তর্গত স্বাহা পদটি লক্ষ্য করতে অনুরোধ করি। যজুর্বেদের অনেক স্থলে স্বাহা পদের প্রয়োগ দেখা যায়। অগ্নির সহধর্মিণী স্বাহা। স্বাহা নাম উচ্চারণ করে অগ্নিতে আহুতি প্রদান করলে সে অনুষ্ঠান সুসিদ্ধ হয়, অগ্নিদেব সে আহুতি গ্রহণ করেন এবং পরিতুষ্ট হন। পুরাণের উপাখ্যানে এই ভাব দেখতে পাওয়া যায়। যা কিছু দেব-উদ্দেশ্যে সর্বথা প্রদত্ত হয়, আমরা মনে করি, তা-ই স্বাহা পদের দ্যোতক। সেই অনুসারে ঐ পদে ভগবানে কর্ম বা কর্মফল সমর্পণের ভাব আসে। আমরা তাই সর্বত্রই ঐ পদে সুহুত-মস্তু মম অনুষ্ঠানং ইত্যাদি অর্থ পরিগ্রহণ করেছি। সায়ণাচার্যের মতে ঐ পদে স্বাহা নামক অগ্নির প্রতি লক্ষ্য হয়। স্বাহা শব্দে মন্ত্র বোঝায়। সুতরাং মন্ত্ররূপ ব্ৰহ্মও ঐ পদের লক্ষ্য বলে মনে করতে পারি। স্বাহা শব্দে দেবতাদের আহ্বান করাও বোঝায়। মাতৃকাবিশেষও অভিধায়ে সম্পূজিতা হন। স্বাহা মন্ত্র উচ্চারণে যজ্ঞে পূর্ণাহুতি দেওয়া হয়। স্বাহা পদে সেই পূর্ণাহুতির ভাবই বিদ্যমান। পূর্ণাহুতি বলতে কায়মনোবাক্যে ভগবানে আত্মসমর্পণ] । ১।
.
দ্বিতীয় অনুবাক
মন্ত্র- বাচম্পতয়ে পবস্ব বাজিষা বৃষ্ণো অংশুব্যাং গভত্তিপতো দেবো দেবানাং পবিত্রমসি যেং ভাগগাহসি তেভ্যস্থা। স্বাক্তৃতোহসি মধুমতীর্ন ইষধি বিশ্বেভ্যস্থেন্দ্রিয়েডভ্যা দিব্যেভঃ পার্থিবেলভ্যা। মনস্তাহৰ্বন্তরিক্ষমন্বিহি স্বাহা ত্বা সুভবঃ সূৰ্য্যায় দেবেভ্যস্তা মরীচিপেভ্য। এষ তে যোনিঃ প্রাণায় ত্বা ॥ ২॥
মর্মার্থ- পরমার্থধনদাত হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! জ্ঞানের অধিপতি ভগবানের প্রীতির নিমিত্ত আমার হৃদয়ে বিশুদ্ধীকৃত হও। অভীষ্টবর্ধণশীল ভক্তিধারার সাথে ক্ষরিত হও। তুমি দেবভাবসমূহের উন্মেষক এবং সৎ-ভাবসমূহের পবিত্রতা-সাধক হও। অতএব তুমি দেবভাবসমূহের অংশসস্তৃত হয়ে থাকো। সেই দেবভাব-সমূহের রক্ষণের নিমিত্ত তোমাকে নিয়োজিত করছি। হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি ভগবানের পথে সংযোজক হও। তুমি আমাদের নিমিত্ত অমৃতপ্রদ অভীষ্টফলসমূহ সম্পাদন করো। ইহজন্মে অথবা পরজন্মে অর্থাৎ ইহকাল-পরকালে সর্বভূতের হিতের নিমিত্ত তোমাকে হৃদয়ে ধারণ করছি। হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! তোমাকে আমার মন ব্যপ্ত করুক অর্থাৎ আমার মনে সৎ-ভাব সঞ্জাত হোক। অপিচ, তুমি আমার নির্মল অন্তরিক্ষের মতো হৃদয়রূপ আধারক্ষেত্রকে লক্ষ্য করে আগমন করে। ভগবানের প্রীতির নিমিত্ত স্বাহা-মন্ত্রে তোমাকে নিয়োজিত করছি। হে আমার অন্তর-নিহিত সৎ-ভাব! স্বপ্রকাশ পরমদেবতার এবং পালকদেবতার অর্থাৎ ভগবানের প্রীতির জন্য তোমাকে উৎসর্গ করছি। হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! আমার নির্মল হৃদয়ই তোমার আধারক্ষেত্র। অতএব প্রাণদেবতার সন্তোষ-সাধনের জন্য তোমাকে নিয়োজিত করছি। ২৷৷
[কর্মকাণ্ডানুসারে উপাংশু-গ্রহণের জন্য প্রথম অনুবাকে তার পূর্ববিহিত সোমাভিষবসংনাহ অভিহিত হয়েছে। দ্বিতীয় অনুবাকে উপাংশু-গ্রহণের মন্ত্রগুলি পরিবর্ণিত হচ্ছে। অনুবাকের প্রথম মন্ত্রে প্রথমেই বাগাধিষ্ঠাতা জ্ঞানদেবতার প্রীতি-সাধনের জন্য সৎ-ভাব-সংজননের সঙ্কল্প বর্তমান রয়েছে। তারপর সৎ ভাবে অন্তর পরিপ্লুত হলে যে বিশ্বজনীন প্রেম অন্তরে উদিত হয়, তারই জন্য শত্রু-মিত্র প্রভেদ থাকে না। দ্বিতীয় মন্ত্রের বক্তব্য তা-ই। তৃতীয় মন্ত্রে ভগবৎ-কার্যে আত্মনিয়োগের ভাব উপলব্ধ হয়। জপ, তপ, পূজা, আরাধনা-যা কিছুই করো না কেন, সকলের মধ্যেই দেবভাবের সমাবেশ থাকা আবশ্যক৷ মন্ত্রের অন্তর্গত স্বাহা শব্দে সে সব কর্মফল ভগবানে সমর্পিত হচ্ছে। এই তো নিষ্কাম কর্ম! তার কর্ম সাধনে সে কর্মের ফল তাতেই তো সমর্পিত! মন্ত্রের উপসংহারে সেই নিষ্কাম কর্মের ভাবই পরিস্ফুট] ॥ ২॥
.
তৃতীয় অনুবাক
মন্ত্র- উপযামগৃহীতোহস্যন্তর্যচ্ছ মঘবন পাহি সোমমুরুষ্য রায়ঃ সমিযো যজন্তস্তে দধামি দ্যাবাপৃথিভী অন্তরুব্বন্তরিক্ষং সজোষা দেবৈরবরৈঃ পরৈশ্চান্তর্যামে মঘবন্মাদয়স্ব। স্বক্তৃতোহসি মধুমতীর্ন ইষধি বিশ্বেভ্যস্তুেন্দ্রিয়েডভ্যা দিব্যেভ্যঃ পার্থিবেভ্যো মনস্তাহৰ্বন্তরিক্ষমম্বিহি স্বাহা ত্বা সুভবঃ সূৰ্য্যায় দেবেভ্যস্তা মরীচিপেভ্য। এষ তে যোনিরপানায় বা ॥ ৩৷৷
মর্মার্থ- হে আমার হৃদয়নিহিত ভক্তিরসামৃত! তুমি সৎ-কর্মের দ্বারা সমুদ্ভুত হও। অতএব তুমি আমার হৃদয়রূপ আধারে প্রবেশ করে অর্থাৎ হৃদয়ে সমুৎপন্ন হও। পরম-ধনদাত হে ভগবন্! আপনি আমার অন্তরে ভক্তিরসামৃতকে রক্ষা করুন। অপিচ, শুদ্ধসত্ব এবং চতুর্বর্গরূপ ধন-সমূহকে শত্রুগণ হতে রক্ষা করুন অর্থাৎ শত্রুদের দ্বারা যাতে অন্তর্ধান না হয়, সেইভাবে নিয়মিত করুন। তার পর সমীচীন অন্ন-সমূহ অর্থাৎ সৎ-কর্মের সুফল প্রদান করুন। আপনার অনুগ্রহে আমি যেন ইহকাল-পরকালের সমস্ত কল্যাণসাধন করতে পারি এবং বিস্তীর্ণ হৃদয়রূপ আধারে যেন আপনাকে ধারণ করতে সমর্থ হই। পরমধনদাত হে ভগবন্! আপনি সকল দেবগণের সাথে আমার ভক্তি রসাপ্লুত হৃদয়রূপ গৃহে আগমন করুন; এবং আপনি আনন্দ লাভ করে দেবতাসমূহকে আনন্দিত করুন। (অর্থাৎ আপনি অধিষ্ঠিত হয়ে দেবভাবগুলিকে উৎপাদন কুরুন)। হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি ভগবানের সাথে সংযোজক হও। তুমি আমাদের নিমিত্ত অমৃতপ্রদ অভীষ্টফলসমূহ সম্পাদন করো। ইহজন্মে ও পরজন্মে অর্থাৎ ইহকাল-পরকালে সর্ব ভূতের হিতের নিমিত্ত তোমাকে হৃদয়ে ধারণ করছি। হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! তোমাকে আমার মন ব্যাপ্ত করুক অর্থাৎ আমার মনে সৎ-ভাব সঞ্জাত হোক। অপিচ, তুমি আমার নির্মল অন্তরিক্ষের মতো হৃদয়রূপ আধার-ক্ষেত্রকে লক্ষ্য করে, আগমন করো। ভগবানের প্রীতির নিমিত্ত স্বাহা মন্ত্রে তোমাকে নিয়োজিত করেছি; আমার অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ হোক। হে আমার অন্তর্নিহিত সৎ-ভাব! স্বপ্রকাশ পরমদেবতার এবং পালক দেবতার নিমিত্ত অর্থাৎ ভগবানের প্রীতির জন্য তোমাকে উৎসর্গ করছি। হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! আমার নির্মল হৃদয়ই তোমার আধারক্ষেত্র। অতএব প্রাণ-দেবতার সন্তোষ-সাধনের জন্য তোমাকে নিয়োজিত করছি ॥ ৩॥
[ দ্বিতীয় অনুবাকে, কর্মকাণ্ড অনুসারে, উপাংশু-গ্রহের বিষয় অভিহিত। তারপর চতুর্থ থেকে ষট্ত্রিংশৎ পর্যন্ত অনুবাকগুলিতে যোড়শ্যন্ত গ্রহ-সমূহ বিবৃত হয়েছে। পৌর্বাপৌর্য অনুসারে এই তৃতীয় অনুবাকে অন্তর্যাম-গ্রহ উক্ত হচ্ছে। এই মন্ত্রের অন্তর্গত উপযাম এবং অন্তর্যাম পদ দুটি লক্ষ্যস্থানীয়। ভাষ্যমতে উপম পদে পৃথিবী অর্থ পরিগৃহীত। পৃথিবীতে সোমলতা উৎপন্ন হয়; সেই ভাবেই এই অর্থ অধ্যাহৃত হয়েছে। আর অন্তর্যাম বলতে দারুময় অন্তর্যাম সংজ্ঞাক পাত্র-বিশেষকে বোঝায়। সোমলতার রস নিঃসারণ করে দারুময় পাত্রে সংরক্ষিত হয়–তা-ই ভাষ্যকার এমন অর্থ অধ্যাহার করেছেন। ক্রিয়া-কাণ্ডের অনুসারী এমন অর্থ সম্বন্ধে আমরা বিরুদ্ধ মত প্রকাশ করি না। তবে, আধ্যাত্মিক ভাবের অনুসারী হয়ে আমরা ভিন্নমতে কি অর্থ উপলব্ধি করে তা আমাদের মর্মার্থেই প্রকাশিত। সোম যেমন পৃথিবীতে উৎপন্ন, অন্তরের সোম তেমনি সৎ-কর্ম থেকে সঞ্জাত হয়-এই-ই আমাদের বক্তব্য। মন্ত্রটিতে সঙ্কল্প বিদ্যমান। সঙ্কর্মের প্রভাবে জ্ঞান-ভক্তির সমাবেশে অন্তর বিশুদ্ধীকৃত করে ভগবানকে প্রতিষ্ঠিত করবার সঙ্কল্প মন্ত্রের প্রধান লক্ষ্য-স্থানীয়]। ৩৷৷
.
চতুর্থ অনুবাক
মন্ত্র- আ বায়ো ভূষ শুচিপা উপ নঃ সহস্রং তে নিযুত বিশ্ববার। উপো তে অন্ধো মদ্যমযামি যস্য দেব দধিষে পূৰ্বপেয়ম্। উপযামগৃহীতোহসি বায়বে ত্বেবায়ু ইমে সুতাঃ। উপ প্রয়োভিরা গতমিন্দবো বামুশন্তি হি। উপমগৃহীতোহসীন্দ্ৰবায়ুভ্যাং ত্বৈ তে যোনিঃ সজোষাভ্যাং ত্বা গিমনপত)! তুমি সত্ত্ব যেন
মর্মার্থ- প্ৰাণবায়ুরূপে সর্বভূতে অধিষ্ঠিত হে ভগবন! অথবা, বায়ুরূপে সর্বত্রগামি হে ভগবন! আপনি আগমন করুন অর্থাৎ হৃদয়ে সমুদিত হোন। (হৃদয়ে আগমন করে) আমাকে অলঙ্কৃত অর্থাৎ পবিত্রতাসম্পন্ন করুন। শুদ্ধসত্ত্বগ্রাহক হে ভগবন! আপনি আমাদের প্রাপ্ত হোন। বিশ্বব্যাপক হে ভগবন্! আপনার করুণার অন্ত নেই অর্থাৎ আপনি অনন্তমহিমান্বিত। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক)। হে ভগবন্!শুদ্ধসত্ত্বরূপ ভক্তিরসামৃতের প্রবাহই যদি আপনার একমাত্র গ্রহীতব্য বলে মনে হয়, আপনার প্রীতিকর পরমানন্দদায়ক সেই ভক্তিরসামৃত বা শুদ্ধসত্ত্ব যেন প্রাপ্ত হই (অথবা আমাদের প্রদান করুন)। হে শুদ্ধসত্ত্ব (অথবা ভক্তিরসামৃত)! তুমি সৎ-কর্মের দ্বারা সঞ্জাত হও। অতএব সৎকর্মসাধনের উদ্দেশ্যে বায়ুরূপে সর্বত্রগমনকারী ভগবানের প্রীতির নিমিত্ত তোমাকে উৎসর্গীকৃত করি। পরমেশ্বর্যশালিন্ হে ইন্দ্রদেবতা! সর্বান্তর্যামি হে বায়ুদেবতা! আমাদের অন্তরস্থিত সোম-সুধা অর্থাৎ ভক্তিরসামৃত সুসংস্কৃত হয়ে বিদ্যমান আছে। আপনারা বিশুদ্ধ ভক্তিসুধা কামনা করেন বলে, আপনারা উভয়ে, (সেই ভক্তিসুধা গ্রহণের জন্য) গুণসাম্য সাধনে আমাদের নিকটে আগমন করুন। (মন্ত্রে ভগবানের সামীপ্য লাভের জন্য সাধকের প্রবল আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছে। সাধক সত্ত্ব–সাম্য-ভাবও কামনা করছেন)। হে শুদ্ধসত্ত্ব (অথবা ভক্তিরসামৃত)! তুমি সৎকর্মের দ্বারা সঞ্জাত (হৃদয় থেকে উৎপন্ন) হও; অতএব ইন্দ্ৰবায়ু-দেবতার প্রীতির নিমিত্ত তোমাকে নিয়োজিত করছি। আমার নির্মল হৃদয় তোমার আধারস্থানীয়। দেবভাব-সংজননের জন্য তোমাকে ধারণ বা স্থাপন করছি । ৪।
[ভাষ্যমতে (কর্মকাণ্ডানুসারে) এই মন্ত্রের অর্থ–হে বায়ু! তুমি আগমন করে গ্রহসমূহকে অলঙ্কৃত করো। হে শুদ্ধ সোমপানকারী! আমাদের প্রাপ্ত হও। হে বিশ্বব্যাপক! তোমার বাহনভূত অযুত অশ্ব আছে। সোমরসরূপ অন্ন তোমার হর্ষকর; অতএব তোমাকে যেন সমীপে প্রাপ্ত হই। হে দেব! সোম-সম্বন্ধি যে। রসদ্রব্য তুমি প্রথম পানযোগ্য বলে মনে ধারণ করে, সেইরকম সোমের সাথে তোমার সামীপ্য যেন প্রাপ্ত হই। হে সোমরস! তুমি পৃথিবীরূপ দারুপাত্রে গৃহীত হয়েছ। তোমাকে বায়ুর নিমিত্ত গ্রহণ করি। হে, ইন্দ্ৰবায়ু! এই সোম অভিযুত হয়েছে। অতএব তোমরা সোমরসরূপ অন্ন গ্রহণের জন্য সমীপে আগমন করো। কেননা, সোমরস তোমাদেরই কামনা করে। হে সোম! দারু-পাত্রে গৃহীত হয়েছে। ইন্দ্র-বায়ুর নিমিত্ত তোমাকে গ্রহণ করি। হে পাত্র! খরের একদেশে তোমার স্থান। অতএব এই স্থানে সমান-প্রীতিযুক্ত ইন্দ্ৰবায়ুর নিমিত্ত তোমাকে স্থাপন করছি।–ইত্যাদি। আমাদের ব্যাখ্যার অনেক স্থলে আমরা ভাষ্যের ভাব প্রকারান্তরে গ্রহণ করেছি বটে; কিন্তু স্বাভাবিক ভাবেই তাৎপর্যের অর্থ ভিন্ন পন্থা পরিগ্রহ করেছে। মন্ত্রের অন্তর্গত সহস্রং নিযুতঃ পদে ভাষ্যকার বায়ুর বাহনভূত অশ্ব-সমূহের বিষয় উল্লেখ করেছেন। তার দ্বারা সহস্ৰ নিযুত অর্থাৎ অসংখ্য অশ্বের বেগে বায়ু প্রবাহিত হয়, এই ভাব উপলব্ধ হয়। সাধারণ বায়ুর পক্ষে সে ভাব অসঙ্গত হতে পারে। কিন্তু এখানে বায়ো সম্বোধনে সর্বভূতে প্রাণবায়ুরূপে বিরাজিত ভগবানকে লক্ষ্য করা হয়েছে বলে মনে করি। তার অনন্ত রূপ, অনন্ত নাম; তার অনন্ত বিভূতি, অনন্ত আকৃতি। মানুষ তার অনন্তত্বের ধারণা করতে পারে না বলেই তাকে ক্ষুদ্র গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ করে! বলে–তিনি বায়ু, বলে তিনি অগ্নি; বলে–তিনি ইন্দ্র; বলে–তিনি মরুৎ; বলে–তিনি ব্যোম; বলে–তিনি যম। কিন্তু যখন সে বুঝতে পারে–তিনি সবই, সবের মধ্যেই তিনি বিরাজমান; তখনই তার স্বরূপ উপলব্ধ হয়–তখনই সকল সংশয় টুটে যায়। যিনি অগ্নিরূপে তাঁকে দেখেছেন, কিংবা বায়ুরূপে তাঁকে দেখেছেন, তিনি যে ভূল দেখেছেন তা নয়। যিনি ইন্দ্র, মিত্র, মরুৎ, বরুণ প্রভৃতি রূপে তাকে দেখেছেন, তিনিও যে বিভ্ৰমগ্রস্থ, তাও নয়। অগ্নি, বায়ু, ইন্দ্র, মিত্র, বরুণ প্রভৃতি–সবই তার বিভূতির বিকাশ মাত্র। যে জন যত নিকটে যেতে পারে, সে ততই তাতে লীন হতে সমর্থ হয়। বায়ো সম্বোধনে তাই সেই প্রাণবায়ুরূপে বিরাজমান ভগবানের প্রতি লক্ষ্য আছে বলেই মনে করি। সে হিসেবে সহস্রং নিযুতঃ পদ দুটিতে তার অনন্ত মহিমার–তাঁর অনন্ত করুণার বিষয়ই প্রখ্যাপিত। তাই ঐ পদের অর্থ করা হয়েছে–করুণায়াঃ পারং নাস্তি–ত্বং হি অনন্তমহিমোপেতঃ। মন্ত্রের অন্তর্গত মদ্যং পদে আমরা মাদকতা-সাধক সোমরস মনে করি না। কি মনে করি, তা পূর্বেই বলেছি। মন্ত্রের অন্তর্গত ইন্দ্ৰবায়ু থেকে বামুশন্তি হি অংশে চাররকম ভাব মনে আসতে পারে। শরীরধারী ইন্দ্র ও বায়ুদেবতা যেন মানুষের অন্নদাতা; সোমরসের দ্বারা তাদের তুষ্ট করে যজমান যেন অন্ন ইত্যাদি প্রার্থনা করছেন, প্রথম দৃষ্টিতে সাধারণতঃ এমন অর্থই উপলব্ধ হয়। আবার রূপক ভেদ করে যে দ্বিতীয় অর্থ-নিষ্কাশন করা যায়, সেই অনুসারে ইন্দ্র বলতে তেজকে বোঝায়, সোম শব্দে রস বোঝায়। পৃথিবীর রস তাপে শুষ্ক হয়ে বায়ুমণ্ডলে আকৃষ্ট ও সঞ্চিত হয়। তা থেকে মেঘসঞ্চার ও বারিবর্ষণ ঘটে। সেই বর্ষণই অন্ন ইত্যাদির উৎপাদক। অন্য অর্থ দেহাত্মভাব-মূলক। যেমন জীবদেহে বায়ু-পিত্ত-কফের দ্বন্দ্ব চলেছে, ঐ তিনের একের আধিক্য হলে যেমন অপরকে এনে পরস্পরের সাম্য-বিধানের চেষ্টা হয়; ইহসংসারে সত্তরজস্তমোরূপ গুণতিনটির সাম্যভাব-স্থাপনের জন্যও সেইরকম বিষম দ্বন্দ্ব চলছে। মন্ত্রে, দেহপক্ষে, বায়ু-পিত্ত-কফ–এই তিনের সাম্য-বিধানের প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়েছে; অথবা অন্তরের পক্ষে, সত্ত্বরজস্তমঃ গুণতিনটির সাম্যসাধনের প্রয়াস দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। উগ্রমূর্তির অহঙ্কারের প্রশমনই ইন্দ্রদেবতার ও বায়ুদেবতার সোমপান–প্রশান্ত ভাব ধারণ। সোম (শান্তভাব), রুদ্রভাবকে প্রশান্ত করবার জন্য আপনা-আপনিই প্রযত্নপর। অর্থাৎ সৎ-ভাবের সাথে মিশ্রিত হতে পারলেই,-সত্ত্বের সংশ্রবে রুদ্রভাবে শান্তি এলেই, ইন্দ্রদেবতার ও বায়ুদেবতার সোমপান হয়। সোম– সত্ত্বভাব নিয়তই আকাঙ্ক্ষা করছে,রজোভাব ও তমোভাব আমাকে এসে পান করুক অর্থাৎ আমার সাথে মিশে স্নিগ্ধতা প্রাপ্ত হোক। মন্ত্রে ইমে সূতা পদ দুটিতে সোম সংস্কারের বিষয় উপলব্ধ হয়। আমাদের মতে, সোম অর্থে ভক্তিসুধা-যখন অনন্যভাবে শ্রীভগবানের চরণ সরোজে ন্যস্ত হয়, তখনই তা (ভক্তিসুধা) সুসংস্কৃত হয়। মন্ত্রের অন্তর্গত ইন্দর পদের সোমরসরূপ মাদকদ্রব্য অর্থ পরিকল্পিত হয়। আমাদের মতে-ইন্দবঃ পদেরও ভক্তি-সুধা অর্থই সুসঙ্গত] ॥ ৪
.
পঞ্চম অনুবাক
মন্ত্র- অয়ং বাং মিত্রবরুণা সুতঃ সোম ঋতাবৃধা। মমেদিহ তং হব। উপযামগৃহীতোহসি মিত্রাবরুণাভ্যাং বৈষ তে যোনিঋতায়ুভ্যাং ত্বা ॥ ৫॥
মর্মার্থ- ঋতের বা জলের বৃদ্ধিকারী (অর্থাৎ শস্যের উপাদনে সহায়ক) অথবা সত্যের বা যজ্ঞের পালক, অথবা সঙ্কর্মের ক্রমপ্রদর্শক বা সকমে নিয়োজক, হে মিত্রাবরুণ দেবদ্বয় অর্থাৎ মিত্রস্থানীয় করুণাময় ভগবন! আমার অন্তরস্থিত ভক্তিসুধা অভিযুত অর্থাৎ বিশুদ্ধীকৃত হয়েছে। সেই ভক্তিসুধা গ্রহণ করে আমার প্রার্থনা শ্রবণ (পূরণ) করুন। হে আমার অন্তরস্থিত ভক্তিসুধা! তুমি সৎকর্মে সঞ্জাত হও। সৎ-ভাবের সংজনয়িতা ভক্তি-রস-প্রদাতা মিত্রাবরুণ দেবদ্বয়ের প্রতির নিমিত্ত তোমাকে গ্রহণ (নিয়োজিত) করছি। হে আমার অন্তরস্থিত ভক্তি-সুধা! আমার নির্মল হৃদয় তোমার আধারস্থানীয়। অতএব তুমি আমার হৃয়ে দৃঢ় হও । ৫।
[চতুর্থ প্রপাঠকের এই পঞ্চম অনুবাকটি, কর্মকাণ্ডের অনুসারে, মিত্রাবরুণগ্রহ-অভিধায়ে বিনিযুক্ত। ভাষ্যমতে মন্ত্রের অর্থ–সত্যের বর্ধক হে মিত্রাবরুণ দেবদ্বয়! তোমাদের জন্য সোম অভিযুত হয়েছে। যেহেতু সোম অভিযুত, সেই হেতু এই কর্মে তোমরা আমার আহ্বান শ্রবণ করো। সত্য-ইচ্ছাকারী মিত্রাবরুণ দেবদ্বয়ের নিমিত্ত (সেই বিশুদ্ধীকৃত সোম বিনিযুক্ত হোক)–ইত্যাদি। এখানে মিত্রদেবতার ও বরুণ দেবতার বিশেষণ পদ ঋতাবৃধৌ প্রধান লক্ষ্য-স্থানীয়। ঋত শব্দ বহুভাবদ্যোতক। সাধারণ ভাবে ঐ শব্দে জল অর্থ উপলব্ধ হয়। ঋত শব্দের আর এক অর্থ–সত্য। ঋত শব্দে আর বোঝায়–সত্যধর্ম। মরুদেশে বা জলহীন স্থানে মানুষ বারিবিন্দুর প্রার্থনায় জলাধিপতির শরণে, তাঁকে জলাধিপতি বা ঋতাবৃধ বুঝে তার কাছে বারিবর্ষণের কামনা করে–এটা স্বাভাবিক। কিন্তু একই উচ্চস্তরের মানুষ যাঁরা, তারা দেখেন তিনি কেবল এই সাধারণ জলের অধিপতি নন; তিনি যেন শান্তি-বারি প্রদানকারী–স্নিগ্ধতার বিধানকর্তা। সংসারের জ্বালামালায় অন্তর যখন জ্বলে ক্ষার হবার উপক্রম হয়, এই স্তরের মানুষ, তাকে স্নিগ্ধতা গুণের আধার জেনে, তার শরণাপন্ন হয়। সুতরাং ঋতাবৃধৌ পদ সংসার-তাপ-তপ্ত এবং শুধুই তাপ-দগ্ধ–ঐ দুরকম মানুষের পক্ষে যথাক্রমে স্নিগ্ধকারী ও জলাধিপতি অর্থ সুচিত করে। আরও একটু উচ্চস্তরের সাধক–সংসারের দৃঢ় গণ্ডী অতিক্রম করে যিনি কিছুটা উধ্বক্ষেত্রে অগ্রসহ হয়েছেন–তিনি বুঝে থাকেন, এ মিত্র ও বরুণদেব তাঁরই নাম মাত্র; যার নাম নেই, তারই নাম; যাঁর রূপ নেই, যিনি অরূপ, তাতে রূপের কল্পনা মাত্র। সেই সাধকের চক্ষেই প্রতিভাত হয়–ঋতাবৃধৌ সত্যস্বরূপৌ অর্থাৎ তিনিই সৎ, তিনিই সত্যস্বরূপ।–বৈজ্ঞানিক দেখবেন কিভাবে মিত্রের (সূর্যের) খরকরতাপে জল থেকে বাষ্প উখিত হয়ে আকাশে মেঘরূপে সঞ্চারিত হচ্ছে; আর কিভাবে সেই মেঘ থেকে বারিবর্ষণ হয়ে পৃথিবীর উৎপাদিকা শক্তি বৃদ্ধি করছে। ফলতঃ মন্ত্রের আধ্যাত্মিক অর্থ–জ্ঞান ও ভক্তিমূলক। মন্ত্রে প্রার্থনা হচ্ছে-হে মিত্রদের! হে বরুণদেব! আপনার সেই সামর্থ্য প্রদান করুন, যেন আমাদের শক্তি যথার্থরূপে ভগবৎ-কর্মসাধনে নিয়োজিত হয়।–ইত্যাদি। এবার সুতঃ সোম পদ দুটির তাৎপর্য উপলব্ধি করা যাক। ঐ দুটি পদে সাধারণতঃ সুসংস্কৃত সোমরস অর্থ নিষ্পন্ন হয়। কিন্তু ঐ দুই পদের অন্য অর্থও নিষ্কাশন করা যেতে পারে। সুতঃ শব্দে সম্বন্ধ এবং সোম শব্দে অমৃত অর্থ নিষ্পন্ন হয়। যিনি অমৃতের সাথে সম্বন্ধযুক্ত, তাঁকেই সুতঃ সোম বলা যেতে পারে। যিনি অমৃতের সন্ধান পেয়েছেন, যিনি অমৃতের রস আস্বাদনে সমর্থ হয়েছেন, আমাদের মতে, তিনিই সুতসোম। দ্বিতীয় মন্ত্রটির অর্থ পূর্ব পূর্ব মন্ত্রের ক্ষেত্রে প্রকাশিত। মিত্রাবরুণ দেবতাকে এই মন্ত্রে ঋতায়ুভ্যাং বলা হয়েছে। তারা ঋত অর্থাৎ সত্যের বর্ধক; সুতরাং তারা সৎস্বরূপ। সৎ ভিন্ন, সত্যের প্রতিষ্ঠায় আর কে সমর্থ হতে পারে? সৎস্বরূপ যাঁরা, সৎ-বস্তুই তাঁদের গ্রহণীয়। মন্ত্রে তাই অন্তরের ভক্তি-সুধা প্রদান করে তাদের পরিতৃপ্ত করবার কামনা প্রকাশ পেয়েছে বলে মনে করি। আকাঙ্ক্ষা–আমায় আত্মসম্মিলন; ভক্তিই সে পক্ষে একমাত্র অবলম্বন] ৷ ৫৷৷
.
ষষ্ঠ অনুবাক
মন্ত্র- যা বাং কণা মধুমত্যশ্বিনা সুনৃতাবতী। তয়া যজ্ঞং মিমিক্ষত। উপধামগৃহীতোহস্যশ্বিভ্যাং বৈষ তে যোনিৰ্মাধ্বীভ্যাং ত্বা ॥৬॥
মর্মার্থ- ভবব্যাধিনিবারক ত্রিগুণসাম্যসাধক হে দেবদ্বয়। আপনারা সেই অমৃতনিঃস্যন্দিনী প্রিয়সত্যবাস্বরূপিণী বিবেকরূপা তাড়নী সহ উপস্থিত হয়ে আমাদের যাগ ইত্যাদি কর্ম সম্পন্ন করুন। (প্রার্থনার ভাব এই যে,হে দেবদ্বয়! আমরা ভ্রান্তি-পরায়ণ। সেই হেতু সতর্ক করবার জন্য বিবেকরূপে সর্বদা আমাদের হৃদয়দেশে বিরাজ করুন। হে আমার হৃদয়নিহিত ভক্তিরসামৃত! তুমি সকর্মের দ্বারা হৃদয়ে সমুদ্ভূত হও; অতএব তোমাকে অমৃত-বিধায়ক ভবব্যাধিনাশক দেবতার প্রীতির নিমিত্ত গ্রহণ বা নিয়োজিত করছি। আমার নির্মল হৃদয় বা সঙ্কর্ম তোমার আধার; অতএব তোমাকে হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত করছি। তুমি দৃঢ়তা অবলম্বন করো ॥ ৬।
.
সপ্তম অনুবাক
মন্ত্র- প্রাতখুঁজৌ বি মুচ্যেথামশ্বিনাবেহ গচ্ছতম্। অস্য সোমস্য পীতয়ে। উপযামগৃহীতোহস্যশ্বিভ্যাং ত্বৈষ তে যোনিরখিভ্যাং ত্ব। ৭।
মর্মার্থ- প্রাতঃসবনসম্বন্ধযুক্ত অর্থাৎ প্রাতঃস্মরণীয়, অন্তর্ব্যাধি-বহির্ব্যাধি-ভবব্যাধি-নাশক (অথবা জ্ঞানের উন্মেষকালে সাধকের সাথে যুক্ত) হে দেবদ্বয়! আপনারা উভয়ে আমাদের সর্বতোভাবে পাপসম্বন্ধ হতে বিমুক্ত করুন। অপিচ, এই সুসংস্কৃত অর্থাৎ একৈকশরণ্যভাবে উৎসর্গীকৃত ভক্তি রসামৃত পানের জন্য আমাদের কর্মে বা অন্তরে আগমন করুন–চিরপ্রতিষ্ঠিত হোন। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধক। আসূর্যোদয় সর্বকাল মন ভগবানের সম্পর্কে চিন্তাপরায়ণ হোক– এটাই কামনা)। হে আমার হৃদয়নিহিত ভক্তিরসামৃত! তুমি সৎকর্মের দ্বারা সমুদ্ভূত অর্থাৎ হৃদয় হতে উৎপন্ন হও। অতএব ভবব্যাধি-নাশক আধিব্যাধির বিনাশক দেবতার প্রীতির নিমিত্ত তোমাকে গ্রহণ অর্থাৎ বিনিযুক্ত করি। আমার নির্মল হৃদয় বা সৎকর্মই তোমার আধার-স্বরূপ; অতএব তোমাকে হৃদয়ে ধারণ বা স্থাপন করছি ॥৭॥
[ষষ্ঠ ও সপ্তম অনুবাক, ক্রিয়াকাণ্ডনুসারে, আশ্বিন-গ্রহ-বিধানে বিনিযুক্ত। ভাষ্যকারের মতে, ষষ্ঠ অনুবাকের মন্ত্রের অর্থ-হে অশ্বিদ্বয়! তোমাদের যে কশা বা বাক্য, তার দ্বারা যজ্ঞকে সম্পন্ন করো। সমান জিহ্বার দ্বারা উৎপন্ন বাক্য এখানে কশা নামে অভিহিত। কিরকম কশা? মধুমতী অর্থাৎ পরুষশব্দরহিত; সুনৃতাবতী অর্থাৎ প্রিয়বচনোপেত। মধুর দ্বারা পূর্ণ বলে মাধ্বী। সেই অশ্বিমূর্তিদ্বয়ের নিমিত্ত তোমাকে গ্রহণ করি।–এই মন্ত্রের সাথে একটি উপাখ্যানের সমাবেশ দেখা যায়।–একসময়ে যজ্ঞপুরুষ দেবগণের সামগ্রী গ্রহণ করে, দেবগণের সাথে যুদ্ধে প্রস্তুত হন। সেই সময়ে তিনি ধনু বাম হস্তে গ্রহণ করে এক কোটী ভূমিতে এবং অপর কোটী গলদেশে স্থাপন করে অবস্থান করেছিলেন। এই অবস্থায় ভূমিতে প্রতিষ্ঠিত জ্যা-ভাগ কীট কর্তৃক ভক্ষিত হওয়ায়, গলদেশে স্থাপিত ধনুর ঊর্ধ্বকোটী আপনা-আপনি দুরিত হয় এবং যজ্ঞের শিরচ্ছেদ করে যজ্ঞপুরুষের সাথে উর্ধ্বে সঙ্কলিত হয়। প্রবর্গ-ব্রাহ্মণে এই বৃত্তান্ত বর্ণিত আছে। যাই হোক, এই অনুবাকের প্রথম মন্ত্রের বড়ই এক হাস্যাস্পদ অর্থ প্রচারিত আছে। ঘোড়া তাড়াবার চাবুক যা ঘোড়ার গায়ের ঘামে ভিজেছে, আর যা অশ্বকে দ্রুত লাতে পারে-সেইরকম চাবুক সঙ্গে করে তোমরা আমাদের যজ্ঞক্ষেত্রে আগমন করো;–এই যেন মন্ত্রের প্রার্থনা] ॥ ৬।
[ সপ্তম অনুবাকের মন্ত্রের যে অর্থ করা হয়, তাতে হোত যেন ঋত্বিকদের সম্বোধন করে উপদেশ দিচ্ছেন। সে মতে প্রাতুর্যজৌ শব্দের অর্থ হয়–প্রাতঃকালে যাঁরা রথে অশ্বযোজনা করেন। সে ব্যাখ্যায় মন্ত্রের ভাব দাঁড়ায়–প্রাতঃকালে রথে অশ্বযোজনা যাঁদের কার্য (শকটচালক কোচম্যান আর কি) সেই অশ্বিনীদ্বয় সোমরসরূপ মাদকদ্রব্য পানের জন্য এই যজ্ঞে আগমন করুন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ মন্ত্রের ভাব সম্পূর্ণ অন্যরকম। এখানে সাধক নিজের অন্তরকে ভগবৎ-আরাধনায় উদ্বুদ্ধ করছেন। মন্ত্রের প্রথমে ঐ যে প্রাতুষুজৌ বিমুচ্যেথাং বাক্য, ওটি আর কিছুই নয়,–ওটি আত্ম-উদ্বোধনের মন্ত্র। ঘোটকের সম্বন্ধ ওখানে কোথাও নেই। এখানে আর এক গভীর তত্ত্বকথা ব্যক্ত হয়েছে মনে করা যায়। একদিকে অজ্ঞানতারূপ নৈশ-অন্ধকার, অন্যদিকে জ্ঞান-স্বরূপ দিবার আলোক। দুয়ের সন্ধি-স্থল–প্রাতঃকাল। জ্ঞান অজ্ঞান, আঁধার-আলোক–এখানে একে একীভূত হয়ে গেছে। প্রাতুর্যজৌ শব্দে সেই মিলনের-সঙ্গমের ভাব প্রকাশ পেয়েছে বলেও মনে করা যেতে পারে। অশ্বিনৌ অর্থাৎ অশ্বিদ্বয়কে সম্বোধন-এরও কোনও নিগুঢ় লক্ষ্য আছে বলে মনে করা যেতে পারে। ব্যাপ্তার্থক অশ ধাতু-অশ্বিন শব্দের মূল। নিশায় ও দিবায়, আঁধারে ও আলোকে, অজ্ঞানে ও জ্ঞানে তারা ব্যাপ্ত হয়ে আছেন, এইজন্যই অশ্বিদ্বয়রূপে তারা সম্পূজিত হন। জ্ঞানের ও অজ্ঞানের মিলনে তাদের সহায়তা প্রথম প্রয়োজন। জ্ঞানের ও অজ্ঞানের স্বরূপ জ্ঞাপনের জন্য তারা ব্যাপ্ত হয়ে আছেন। এখানে তাদের সেই মূর্তিই কল্পিত হয়েছে। মনে হয়, এই জন্যই–অজ্ঞান, জ্ঞানে বিলীন করবার ভাব বিকাশের জন্যই-যুগ্মদেবতার-অশ্বিদ্বয়ের আহ্বানে মন্ত্রের সূচনা করা হয়েছে। তারপর অশ্বিদ্বয়কে দেববৈদ্য বলা হয় এবং পুরাণে তাদের যুগ্মমূর্তির (অশ্বিনীকুমারযুগলের) পরিকল্পনা দেখি। তা থেকেই তাদের অন্তর্ব্যাধি ও বহিব্যাধির নাশক দেবযুগল বলে বিশ্লেষণ দেখি। ব্যাধি দুরকম–অন্তরের (কাম-ক্রোধ ইত্যাদি) ও বাহিরের (রোগ, শোক ইত্যাদি)। দেবতা তাই যুগ্ম] ॥ ৭
.
অষ্টম অনুবাক
মন্ত্র- অয়ং বেনশ্চোদয়ৎ পৃশ্নিগর্ভা। জ্যোতির্জরায়ু রজসো বিমানে। ইমমপাং সঙ্গমে সূৰ্য্যস্য শিশুং ন বি মতিভী রিহস্তি।। উপযামগৃহীতোহসি শণ্ডায় বৈষ তে যোনিবীরতাং পাহি ॥৮
মর্মার্থ- জ্ঞানরশ্মিসম্ভব দিব্যকান্তি ভক্তি, হৃদয়ে সৎ-ভাব অথবা সস্বরূপকে প্রেরণ বা প্রকটিত করে। উদরে গর্ভ যেমন জরায়ুর দ্বারা বেষ্টিত হয়ে অবস্থিত থাকে, আত্মদর্শিগণের হৃদয়ে দিব্য-জ্যোতির দ্বারা পরিবেষ্টিত সেই ভক্তি মরুসদৃশ (মরুভূমির মতো) শুষ্ক অজ্ঞান অন্ধকারে আবৃত হৃদয়ে সৎ-ভাব ও জ্ঞানের জ্যোতিঃ প্রেরণ করে। জ্ঞান-জ্যোতির সাথে সৎ-বৃত্তিসমূহের সম্মিলন-সাধনের নিমিত্ত ক্রান্তদর্শিগণ, মাতাপিতা বান্ধবগণ যেমন শিশুপুত্রকে আদর ইত্যাদির দ্বারা সম্বর্ধিত ও লালিত করে, সেইরকমভাবে জ্ঞানদেবকে প্রীতিদায়ক স্তোত্র-কর্মের দ্বারা সম্বর্ধিত অর্থাৎ পূজা করেন। অথবা,-অশেষকান্তির আধার সেই ভগবান দিব্যজ্যোতির আধার অর্থাৎ নিখিল জ্যোতিঃসমূহকে প্রেরণ করেন। তিনি জরায়ুর ন্যায় জ্যোতিঃসমূহের ধারক অর্থাৎ জরায়ু যেমন উদরে গর্ভকে বেষ্টন করে অবস্থিতি করে, সেইরকম সাধকগণের হৃদয়ে জ্ঞান-জ্যোতিঃ-বেষ্টনের দ্বারা অধিষ্ঠান করেন। সেই ভগবান্ আত্ম-জ্ঞানসম্পন্নদের হৃদয়ে সেইভাবে অধিষ্ঠিত হয়ে, ধূলিসমূহ যেমন জলে সিক্ত ও মৃত্তিকায় পরিণত হয়, সেই ভাবে শুষ্ক মরুর মতো কঠিন হৃদয়কে প্রেরণ বা নির্মাণ করেন অর্থাৎ দিব্য-জ্যোতিঃ এবং করুণাধারা বর্ষণ করেন। সৎ-ভাবসমূহের সাথে জ্ঞান-সূর্যের সঙ্গম-সাধনের নিমিত্ত আত্মদর্শিগণ, মাতাপিতা যেমন আদরের দ্বারা শিশুপুত্রকে তুষ্ট করেন, সেইভাবে প্রীতিকর স্তোত্রের দ্বারা ভগবানকে পূজা করে থাকেন। অথবা-উদরে গর্ভ যেমন জরায়ুর দ্বারা বেষ্টিত হয়ে অবস্থিত হয়, সেই মতোই মেঘের মধ্যে গর্ভের ন্যায় প্রসিদ্ধ দিব্যকান্তিবিশিষ্ট সেই বেনদেবতা, উদকের নির্মাতা অন্তরিক্ষে স্থিত হয়ে, আদিত্যের গর্ভভূত অর্থাৎ সপ্ত-উজ্জ্বলবর্ণ সূর্যরশ্মিসমূহের দ্বারা সঞ্জাত অন্তরিক্ষস্থিত অপকে পৃথিবীতে প্রেরণ করেন। উদক, অন্তরিক্ষ ও সূর্যের পরস্পর সঙ্গমের নিমিত্ত অন্তরিক্ষে স্থিত এই বেনদেবতাকে, মেধাবি স্তোতাগণ, শিশুপুত্রকে পিতামাতা যেমন মিষ্ট-বাক্যে লালিত করেন, সেইরকম ভাবে স্তুতির দ্বারা অর্চনা বা পূজা করে থাকেন।
হে আমার হৃদয়নিহিত ভক্তিরসামৃত! তুমি সৎকর্মের দ্বারা সঞ্জাত অথবা হৃদয় হতে উৎপন্ন হও। অতএব তোমাকে শুর ভগবানের প্রীতির নিমিত্ত গ্রহণ বা নিয়োজিত করি। আমার নির্মল হৃদয়েই তোমার স্থান। তুমি আমাদের কর্ম-শূরত্ব অর্থাৎ কর্ম-সামর্থ্য রক্ষা করো॥ ৮৷৷
.
নবম অনুবাক
মন্ত্র- তং প্রথা পূৰ্ব্বথা বিশ্বথেমথা জ্যেষ্ঠতাতিং বহিষদং সুবৰ্বিদং প্রতীচীনং বৃজনং দোহসে গিরাহশুং জয়স্তমনু যাসু বর্ষসে। উপযামগৃহীতোহসি মক্কায় বৈষ তে যোনিঃ প্রজাঃ পাহি ॥ ৯৷
মর্মার্থ- হে অন্তরাত্মা! পুরাতন, আমাদের পূর্ববর্তী, ইদানীং বর্তমান বিশ্বের সকল প্রাণী ভগবাকে আরাধনা করে অভীষ্টফল প্রাপ্ত হয়েছেন। অতএব তুমিও সর্বশ্রেষ্ঠ পুরাণপুরুষ, হৃদয়রূপ বৰ্হিতে অধিষ্ঠিত অথবা সঙ্কর্মের সুফলদাতা চৈতন্যস্বরূপ, শরণাগতদের পরিত্রাণের জন্য ত্বরান্বিত, সকলের অভিভবিতা, সকলের আরাধনীয় সেই ভগবানকে স্তোত্র-কর্মের দ্বার পূজার্চনা করো। সেই ভগবান্ আমাদের প্রতিকূল সবরকম কামনা আমাদের নিকট হতে বিচ্ছিন্ন করেন। অতএব হে অন্তরাত্মা! কাম-সঙ্কল্প-বর্জনের নিমিত্ত সেই ভগবানের আরাধনা করো। যে স্তুতি-কর্মের দ্বারা সেই ভগবানের প্রবৃদ্ধি হয় (অর্থাৎ ভগবান্ প্রবৃদ্ধ হন), সেই স্তোত্রের দ্বারা তাকে স্তুতি করো। অথবা-পুরাতন, পূর্বে বর্তমান, ইদানীং বর্তমান সকল প্রাণিগণ ভগবাকে আরাধনা করেছিলেন ও করেন। অনাগত অর্থাৎ ভবিষ্যৎ সকল প্রাণীও সেই ভগবানকে আরাধনা করবেন। অতএব হে অন্তরাত্ম! তুমিও পুরাতন, কর্ম-সমুহে সদা বিরাজিত, সৎ-কর্মের সুফলপ্ৰদাতা, সর্বজ্ঞ আমাদের অনুকুল, বলবান–সকল শক্তির আধার, ভক্তগণের রক্ষার জন্য শীঘ্রগমনকারী, সকলের অভিভবিতা সেই ভগবানকে সাধনার প্রভাবে (স্তুতির দ্বারা) পূজা করো। (অর্থাৎ সকল-কাম-সম্বন্ধ হতে বিমুক্ত হবার জন্য আরাধনা করো)। অপিচ, যে সকল কর্মে ভগবানের মহিমা বৃদ্ধি হয় অর্থাৎ ভগবান্ তৃপ্ত হন, সেই সকল কর্মের দ্বারা ভগবানের স্তুতি করো। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধনমূলক ও নিত্যসত্যপ্রকাশক)। হে আমার হৃদয়নিহিত ভক্তিরসামৃত! তুমি সৎকর্মের দ্বারা হৃদয় হতে সঞ্জাত হও। অতএব তোমাকে জ্ঞান-জ্যোতির আধার ভগবানের প্রীতির নিমিত্ত নিয়োজিত করছি। আমার নির্মল হৃদয় তোমার উৎপত্তিস্থান। অতএব তুমি আমার অন্তরস্থিত সৎ-বৃত্তিসমূহকে রক্ষা করো । ৯।
[ কর্মকাণ্ড অনুসারে অষ্টম ও নবম অনুবাকের মন্ত্রের দ্বারা শুক্র-মনি গ্রহদ্বয়ের প্রক্রিয়া-পদ্ধতি বিবৃত হয়েছে। মন্ত্র দুটি একত্র-সন্নিবিষ্ট এবং ভাষ্যকার কর্তৃক একযোগে ব্যাখ্যাত। ভাষ্য অনুসারে অষ্টম অনুবাকের প্রথম মন্ত্রে ইন্দ্রকে নির্দেশ করে। প্রথম মন্ত্রের ভাষ্যানুসারী যে একটি বঙ্গানুবাদ প্রচলিত আছে, তা এইবেন নামে যে দেবতা, তিনি জ্যোতির দ্বারা পরিবেষ্টিত, তিনি জল-নির্মাণকারী আকাশের মধ্যে সূর্যকিরণের সন্তানস্বরূপ জল-গণকে পৃথিবীতে প্রেরণ করেন। যখন সূর্যের সাথে জলের মিলন হয়, তখন বুদ্ধিমান স্তবকারীগণ সেই বেনদেবতাকে বালকের মতো নানা মিষ্টবচনে সন্তুষ্ট করেন। ভাষ্যের এবং ব্যাখ্যার ভাবে বোঝা যায়, মন্ত্রে যেন বৃষ্টির বারিধারার জন্য আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছে। বেন (ইন্দ্র) মেঘাধিপতি। তার প্রভাবে মেঘরাশি বারিরূপে নিপতিত হয়ে ধরিত্রীতে শান্তিশীতলতা আনয়ন করে, শস্য-উৎপাদন করে। এখানে সূর্যই যে বৃষ্টির বা জলের জনক, সেই ভাব উপলব্ধ হয়। বলা বাহুল্য, এই ভাবটির মধ্যে সূর্যকিরণে জলরাশি শুষ্ক ও বাষ্পরূপে ঊর্ধ্বে উখিত হয়ে মেঘে পরিণত হয়–এই বৈজ্ঞানিক তত্ত্বটির সন্ধান পাওয়া যায়। যাই হোক, এই মন্ত্রটি আরও একটু সূক্ষ্মভাবে দেখলে, এর দ্বারা মুক্তির আকাঙ্ক্ষাও প্রকাশ পায়। বোঝা যায়,অবিমিশ্র ভক্তিসুধা মুমুক্ষুর মোক্ষের ইচ্ছা বহন করে তার প্রীতির জন্য গমন করে। স্থল-দেহ তার কাছে পৌঁছাতে পারে না; তাই এস্থানে অপাং সূর্যস্য সঙ্গমে অংশে সূক্ষ্মদেহের দৃষ্টান্ত পরিস্ফুট। ফলতঃ মন্ত্রটি যেন নিরাশায় আশার সঞ্চার করছে। সেই মতোই আমরা মন্ত্রটির বিশ্লেষণে প্রবৃত্ত হয়েছি। অষ্টম অনুবাকের প্রথম অংশটি ঋগ্বেদসংহিতার দশম মণ্ডলে পাওয়া যায়। এখানে যে শব্দের একাধিক অর্থ উপলব্ধ হয়, সেখানে একাধিক অম্বয় অনুসারী মর্মার্থ লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। ভাষ্যমতে অষ্টম অনুবাকের দ্বিতীয় মন্ত্রের অর্থ-হে শুক্রগ্রহ! তুমি দারুপাত্রের দ্বারা গৃহীত হও। শুক্ৰপুত্র শণ্ডের (ষণ্ডের) নিমিত্ত তোমাকে গ্রহণ করি। এই খরের একদেশে তোমার স্থান। সেই মতোই তুমি যজমানের কর্মরত্ব পালন করো। আমরা উপযামগৃহীতঃ অর্থে সৎকর্মণা সমুদ্ভুতং, হৃদয়াৎ উৎপন্নং বা অর্থ ধরেছি। শণ্ডায় পদে শুরায় ভগবতে, যদ্বা–তস্য ভগবতঃ প্রীত্যর্থং ইত্যাদিরূপ অর্থ ধরেছি] ॥ ৮।
[নবম অনুবাকের মন্ত্রে ভাষ্যে যে ভাব প্রকটিত তা এই–সেই ইন্দ্রকে আমরা স্তুতি করি। পুরাতন ভৃগু ইত্যাদি যেভাবে ইন্দ্রকে স্তুতি করেছিলেন, সেইভাবে স্তুতি করি। পিতৃ ইত্যাদির মতে, অতীত যজমানগণের মতে, বর্তমান যজমানদের মতে, স্তুতি করি। কিরকম ইন্দ্র? জেষ্ঠতাতি, যাগসন্নিহিত, স্বর্গের বেত্তা ইত্যাদি। হে ইন্দ্র! আপনি আমাদের প্রতিকূল বর্জনীয় আলস্য-অশ্রদ্ধা ইত্যাদি বিনাশ করেন; এইরকম আপনার স্তুতি করি। যে সকল কার্যে আপনি ক্ষিপ্রতার সাথে সোমপানের দ্বারা যজমানকে সম্বর্ধিত করেন, সেই সকল কার্যে আপনাকে স্তুতি করি। হে মন্থিগ্রহ! তুমি উপযামগৃহীত হও। মর্কনামক শুক্রপুত্রের নিমিত্ত তোমাকে গ্রহণ করি। এই খর প্রদেশে তোমার স্থান। তুমি যজমানের প্রজাসমূহকে পালন করা। আমাদের পরিগৃহিত অর্থ, একাধিক অন্বয়ানুসারে, মর্মার্থে লিপিবদ্ধ হয়েছে] ॥ ৯।
.
দশম অনুবাক
মন্ত্র- যে দেবা দিব্যেকাদশ ও পৃথিব্যামধ্যেকাদশ স্থাদো মহিনৈকাদশ তে দেবা যজ্ঞমিমং জুষধ্বমুপমগৃহীতোহস্যাগ্রয়ণোহসি স্বাগ্রায়ণে জিম্ব যজ্ঞং জিম্ব যজ্ঞপতিমভি সবনা পাহি বিষ্ণুস্থাং পাতু বিশং ত্বং পাহীন্দ্রিয়েনৈষ তে যোনিৰ্বিশ্বেভ্যস্তা দেবেভ্যঃ ॥ ১০
মর্মার্থ- দ্যুলোকে যে দেবগণ অভিন্নভাবাপন্ন হন, ভূলোকেও যাঁরা অভিন্নভাবাপন্ন হন, অপিচ, শুদ্ধসত্ত্বের গ্রাহক অন্তরিক্ষের যে দেবগণ আপন মহিমায় অভিন্নভাবাপন্ন হন, এই রকম হে দেবগণ, আপনারা (অর্থাৎ সকল দেবতা) আমাদের সকর্ম গ্রহণ করুন, অর্থাৎ আমাদের সকর্মে প্রীত হয়ে আমাদের প্রাপ্ত হোন। হে দেবভাব! আপনি সাধকের হৃদয়ে আবির্ভূত হন; আপনি শ্রেষ্ঠ কাম্য হন। হে দেবভাব! শ্রেষ্ঠতম কাম্য হয়ে আমাদের সৎকর্ম যেভাবে সুসম্পন্ন হয়, তা করুন। আপনি সকর্মের সাধনকারীকে প্রীত করুন অর্থাৎ সকল সৎকর্ম যে রকমে সুসম্পন্ন হয়, তা করুন। আপনিই সকল জগৎকে কর্ম-সামর্থ্য প্রদান করে রক্ষা করুন। হে শুদ্ধসত্ত্ব! আপনাকে বিশ্বব্যাপক বিশ্বপালক দেবতা রিপু কবল হতে রক্ষা করুন। হে শুদ্ধসত্ত্ব! আমাদের হৃদয়-দেশ আপনার আশ্রয়-স্থান হোক, সকল দেবভাবের অর্থাৎ সকল দেবভাব প্রাপ্তির জন্য আপনাকে যেন আমরা হৃদয়ে উৎপাদন করতে পারি। ১০
.
একাদশ অনুবাক
মন্ত্র- ত্রিংশৎ এয়শ্চ গণিনো রুজন্তো দিবং রুদ্রাঃ পৃথিবীং চ সচন্তে। একাদশাসো অশ্লষদঃ সুতং সোমং জুষাং সবনায় বিশ্বে। উপযামগৃহীতোহস্যা-গ্রয়ণোহসি স্বাগ্রয়ণে জিম্ব যজ্ঞং জিব যজ্ঞপতিমভি সবনা পাহি বিষ্ণুত্ত্বাং পাতু বিশং ত্বং পাহীন্দ্রিয়েনৈষ তে যোনিৰ্বিশ্বেভ্যস্তা দেবেভ্যঃ ॥ ১১।
মর্মার্থ- ত্রিগুণত্রিধাতুসাম্যসাধক একত্রে অবস্থিত দেবগণ দ্যুলোকে অবস্থিতি করেন; রিপুনাশক দেবতা পৃথিবীস্থিত অর্থাৎ পার্থিব বিষয়-ভোগ বিনাশ করেন; অভিন্নভাবাপন্ন সকল শুদ্ধসত্ত্বগ্রহকে অন্তরিক্ষবাসী দেবগণ আমাদের আরাধনা সফল করবার নিমিত্ত আমাদের হৃদয়নিহিত ভগবৎ-পূজোপচাররূপ শুদ্ধসত্ত্ব যেন গ্রহণ করেন। হে দেবভাব! আপনি সাধকের হৃদয়ে আবির্ভূত হন; আপনি শ্রেষ্ঠ কাম্য হন। হে দেবভাব! শ্রেষ্ঠতম কাম্য হয়ে আমাদের সকর্ম যেভাবে সুসম্পন্ন হয়, তা করুন। আপনি সৎকার্মের সাধনকারীকে প্রীত করেন; সুতরাং আমাদের অনুষ্ঠিত সকল সৎ-কর্ম যেভাবে সুসম্পন্ন হয়, তা করুন। আপনিই সকল জগৎকে কর্মসামর্থ্য প্রদান করে রক্ষা করুন। হে শুদ্ধসত্ত্ব! আপনাকে সর্বব্যাপক সর্বপালক দেবতা রিপুর কবল হতে রক্ষা করুন। হে শুদ্ধসত্ত্ব! আমাদের হৃদয়দেশ আপনার আশ্রয়স্থান হোক; সকল দেবভাবের অর্থাৎ সকল দেবভাবপ্রাপ্তির জন্য আপনাকে যেন আমরা হৃদয়ে উৎপাদিত করতে সমর্থ হই ॥ ১১৷৷
[দশম অনুবাকে সাতটি মন্ত্র আছে। প্রথম মন্ত্রের একাদশঃ পদটিই বিশেষভাবে সমস্যামূলক। এই পদটি মন্ত্রে তিনবার ব্যবহৃত হয়েছে। প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে মন্ত্রটির যে অর্থ গ্রহণ করা হয়ে থাকে, তার সারমর্ম এই যে, পৃথিবীতে এগারো জন, অন্তরিক্ষে এগারো জন এবং দ্যুলোকে এগারো জন, এই সর্বমোট তেত্রিশজন দেবতা আছেন। পাশ্চাত্য মতাবলম্বীদের মতে এই মূল তেত্রিশজন দেবতা থেকেই তেত্রিশ কোটি দেবতার উদ্ভব হয়েছে। আবার অন্য কারও মতে কোটি শব্দ সংখ্যাবাচক কোটী বা কোটি শব্দ থেকে পৃথক ছিল। তেত্রিশ কোটি বলতে তেত্রিশজন দেবতাকে বোঝাত। কিন্তু পরবর্তীকালে কোটি শব্দ সংখ্যাবাচক অর্থ গ্রহণ করায় মূল শব্দটিই সংখ্যাবাচক হয়ে যায় এবং তারই ফলে তেত্রিশজন দেবতার স্থানে তেত্রিশ কোটি দেবতা হয়ে গেলেন। এছাড়া আরও অনেক মতবাদ আছে। বিভিন্ন মতানুসারে এই তেত্রিশজন দেবতার বিভিন্ন বর্ণনাও পাওয়া যায়। আমরা মনে করি, এখানে একাদশঃ পদ সংখ্যাবাচক নয়। একা দশা যস্য সঃ এই অর্থে একাদশঃ পদ নিষ্পন্ন হয়েছে। অর্থাৎ এক ভগবানেরই বিভিন্ন বিভূতি বিভিন্ন ভাবে প্রকাশিত হয়; এবং তা-ই বিভিন্ন নামে জগতে প্রকাশ পায়। সেই সমস্তকেই বিভিন্ন দেবতা বলে কল্পনা করা হয়। ভূলোকে যে দেবতার প্রকাশ দ্যুলোকেও তারই প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। বস্তুতঃ অদ্বিতীয় একং-ই বিশ্ব ব্যেপে বিরাজিত আছেন। সেই দেবগণ অথবা সেই এক পরমদেবতা আমাদের প্রতি কৃপাপরবশ হয়ে আমাদের প্রাপ্ত হোন, অর্থাৎ সকর্মসাধনের দ্বারা যেন আমরা তাঁর চরণতলে পৌঁছাতে পারি। সুতরাং দেবতার প্রকাশ বা দেবভাবকেই এখানে একাদশঃ প্রভৃতি পদে লক্ষ্য করা হয়েছে। দ্বিতীয় মন্ত্রে সেই দেবভাবকেই সম্বোধন করা হয়েছে। সেই দেবভাব আগ্রয়ণঃ অর্থাৎ মানবের শ্রেষ্ঠ কাম্য বস্তু। তৃতীয় মন্ত্রে তার কারণ বিবৃত হয়েছে। স্বায়ণঃ যজ্ঞং জিম্ব অর্থাৎ সেই দেবভাবই আমাদের সকর্মের সাধনে যেন সহায় হন। চতুর্থ মন্ত্রের সম্বোধ্যও দেবভাব। পঞ্চম মন্ত্রের মধ্যে প্রকটিত নিত্যসত্যটি এই যে-দেবভাবের দ্বারাই সমগ্র বিশ্ব রক্ষিত হচ্ছে। ষষ্ঠ মন্ত্রের সম্বোধ্য বস্তু ভিন্ন। এখানে শুদ্ধসত্ত্বকে সম্বোধন করা হয়েছে। শেষ মন্ত্রটিও শুদ্ধসত্ত্বসম্বন্ধে উচ্চারিত] । ১০।
[একাদশ অনুবাকের প্রথম মন্ত্রে ত্রিংশত্রয়শ্চ গণিনঃ পদ দুটি থাকতে ভাষ্যকারগণ বলছেন, পূর্ব মন্ত্রের আমরা যে অর্থ করেছিলাম, পরবর্তী মন্ত্রে তাই সমর্থিত হচ্ছে। ত্রিংশত্রিয়ঃ পদে তেত্রিশ সংখ্যাই বোঝায়। সুতরাং এই মন্ত্র দুটি দেবতার সংখ্যাসম্বন্ধেই প্রযুক্ত হয়েছে। আমরা পূর্ব অনুবাকের মন্ত্রের মতো এখানেও সেই অর্থের অনুসরণে ত্রিংশত্রয়ঃ পদের অর্থ নির্ধারণ করেছি–ত্রিগুণ-ত্রিধাতু-সাম্য-সাধকাঃ, একত্রাবস্থিতাঃ দেবাঃ। মন্ত্রের অন্তর্গত রুদ্রাঃ পদের ভাষ্যার্থ,–যিনি শত্রুপক্ষীয়গণের নারীদিগকে রোদন করান। নারীগণ রোদন করেন কখন? স্বামী হত হলে নারীর রোদনের কারণ উপস্থিত হয়। এছাড়াও অন্য বহু কারণ আছে এবং থাকতে পারে, কিন্তু এখানে শত্রু শব্দের উল্লেখ আছে বলেই এখানে পরাজয় বা মৃত্যুর বিষয় আনয়ন করা যায়। আমরা তাই রুদ্রাঃ পদে সাধারণ ভাবে রিপুনাশক অর্থই গ্রহণ করেছি। পরবর্তী পদগুলির দ্বারাও এ অর্থের সমর্থন পাওয়া যায়। রুদ্রাঃ কি করেন?-পার্থিব ভোগপ্রবৃত্তি প্রভৃতি বিনাশ করেন। মন্ত্রের শেষভাগে একটি প্রার্থনা উচ্চারিত হয়েছে। দ্বিতীয় মন্ত্রে দেবভাবকে আহ্বান করা হয়েছে এবং তৃতীয় মন্ত্রে তার কারণ বিবৃত হয়েছে।স্বায়ণঃ যজ্ঞং জিম্ব অর্থাৎ সেই দেবভাবই আমাদের শ্রেষ্ঠতম কাম্য বস্তু হয়ে আমাদের সকর্মসাধনে যেন সহায় হন। চতুর্থ মন্ত্রটিরও সম্বোধ্য দেবভাব। পঞ্চম মন্ত্রে যে নিত্যসত্যটি প্রকটিত তার মর্ম এই যে, দেবভাবের দ্বারাই সমগ্র বিশ্ব রক্ষিত হচ্ছে। ষষ্ঠ মন্ত্রের সম্বোধ্য বস্তু ভিন্ন। এখানে শুদ্ধসত্ত্বকে সম্বোধন করা হয়েছে। এই শুদ্ধসত্ত্ব আমাদের অন্তর্নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব বিশ্বশক্তি শুদ্ধসত্ত্ব নয়। এই উভয় বস্তু এক হলেও আধার ও ক্রিয়াভেদে বিভিন্ন গুণ প্রকাশ করছে। অনুবাকের শেষ মন্ত্রটিও শুদ্ধসত্ত্বসম্বন্ধে উচ্চারিত হয়েছে। এই মন্ত্রের প্রথম অংশ–এষঃ তে যোনিঃ অর্থাৎ আমাদের হৃদয়ই আপনার (অর্থাৎ শুদ্ধসত্ত্বের) প্রকৃত বিশ্রামস্থান অথবা আশ্রয়স্থান হোক। অর্থাৎ আমাদের মধ্যে যেন শুদ্ধসত্ত্ব উপজিত হয়। তার প্রয়োজনীয়তা কি? এর উত্তরে মন্ত্র বলছে-বিশ্বেভ্যঃ দেবেভ্যঃ ত্বঃ-সর্বদেবভাব প্রাপ্তির জন্যই শুদ্ধসত্ত্বের প্রয়োজন। যেখানে পবিত্র হৃদয়, আন্তরিক অনুরাগ আছে, যেখানে শুদ্ধসত্ত্ব বিরাজিত সেখানে দেবভাব আগমন করবেই। দেবভাবের প্রয়োজনীয়তা দেবতাকে প্রাপ্তি–তাতেই মানবজীবনের চরম সার্থকতা। সেই সার্থকতা লাভের জন্যই মন্ত্রে প্রার্থনা করা হয়েছে। (দশম অনুবাকের প্রথম মন্ত্রটি সামান্য পাঠভেদের সাথে ঋগ্বেদ-সংহিতার প্রথম মণ্ডলের ঊনচত্বারিংশাধিকশততম সূক্তের একাদশী ঋকে পাওয়া যায়)] । ১১।
.
দ্বাদশ অনুবাক
মন্ত্র- উপযামগৃহীতোহসীন্দ্রায় ত্বা বৃহদ্বতে বয়স্বত উথায়ুবে যত্ত ইন্দ্র বৃহদ্বয়স্তস্মৈ ত্বা বিষ্ণবে বৈষ তে যোনিরিায় জ্যোথায়ুবে। ১২।
মর্মার্থ- হে শুদ্ধসত্ত্ব! আপনি সাধকের হৃদয়ে উৎপাদিত হন; পূজনীয় পরম শক্তিশালী বেদ-মন্দ্রের দ্বারা আরাধনীয় ভগবান্ ইন্দ্রদেবের জন্য আপনাকে যেন আমরা লাভ করি। বলধিপতে হে দেব! আপনার প্রসিদ্ধ যে পরম বল আছে, তা লাভ করবার জন্য আপনাকে আরাধনা করছি। (প্রার্থনার ভাব এই যে,-হে ভগবন্! কৃপাপূর্বক আমাদের আপনার পরাশক্তি প্রদান করুন। হে শুদ্ধসত্ত্ব! সর্বব্যাপক দেবতার জন্য, অর্থাৎ তাকে লাভ করবার জন্য আমরা যেন আপনাকে হৃদয়ে সমুৎপাদিত করতে পারি। হে শুদ্ধসত্ত্ব! আমাদের হৃদয়দেশ আপানার আশ্রয়স্থল হোক; বেদ-মন্ত্রের দ্বারা আরাধনীয় ভগবান্ ইন্দ্রদেবের জন্য আপনাকে যেন আমাদের হৃদয়ে সমুৎপাদিত করতে পারি, অর্থাৎ আমরা যেন শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করি । ১২।
[এই অনুবাকের চারটি মন্ত্রের মধ্যে প্রথমটিতে শুদ্ধসত্ত্বকে সম্বোধন করা হয়েছে। এই মন্ত্রের দুটি অংশ। প্রথম অংশে একটি নিত্যসত্য প্রখ্যাপিত হয়েছে, তার মর্ম এই যে, সাধকগণই সকর্মসাধনের দ্বারা হৃদয়ে শুদ্ধসত্য লাভের অধিকারী হন। দ্বিতীয় অংশের প্রার্থনা–সেই পরম দেবতাকে লাভ করবার জন্য আমরা যেন হৃদয়ে বিশুদ্ধ সত্ত্বভাব উৎপাদন করতে পারি। দ্বিতীয় মন্ত্রে ভগবাকে সম্বোধন করে প্রার্থনার বিষয় ভগবৎশক্তি। তৃতীয় মন্ত্র প্রথম মন্ত্রেরই অনুরূপ। বিষ্ণবে পদে ভগবানকেই বোঝাচ্ছে। চতুর্থ মন্ত্রে শুদ্ধসত্ত্ব প্রাপ্তির জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। সেই প্রার্থনার চরম উদ্দেশ্য–ভগবৎপ্রাপ্তি]। ১২।
.
ত্রয়োদশ অনুবাক
মন্ত্র- মূৰ্দ্ধানং দিবো অরতিং পৃথিব্যা বৈশ্বনরমৃতায় জাতমগ্রিম। কবিং সম্রাজমতিথিং জনানামাসন্না পাত্ৰং জনয়ন্ত দেবাঃ। উপযামগৃহীতোহস্যগয়ে ত্বা বৈশ্বানরায় ধ্রুবোহসি ধ্রুবক্ষিতি বাণাং ধ্রুবতমোহচ্যুতানামচ্যুতক্ষিত্তম এষ তে যোনিরগয়ে ত্বা বৈশ্বানরায় ॥ ১৩
মর্মার্থ- দ্যুলোকের মস্তকস্থানীয়, মত্যলোকের গতিকারক, বিশ্ববাপী নরগণের সৎকর্ম হতে সর্বতোভাবে উৎপন্ন, সর্বদর্শী, সর্বপ্রকাশশীল, হবিবাহক, সত্ত্বভাব গ্রহণকারী পরিত্রাতা, সেই জ্ঞান-স্বরূপ অগ্নিদেবকে দেবভবসমূহ উৎপন্ন করেছেন। ভাব এই যে,-সত্ত্বভাবসহযুত সৎকর্মের দ্বারা জ্ঞানাগ্নি উৎপাদিত হয়। হে শুদ্ধসত্ত্ব! বিশ্বের পরিচালক পরাজ্ঞানের জন্য আপনাকে আমরা যেন প্রাপ্ত হই; আপনি সাধকের হৃদয়ে সমুৎপাদিত হন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন শুদ্ধসত্ত্বসমন্বিত পরাজ্ঞান লাভ করি)। হে ভগবান্! আপনি অপরিণামী হন লোকবর্গের পরমাশ্রয় হন; অচঞ্চলের মধ্যেও স্থিরতম, অক্ষয় অব্যয় হন; সকর্মসাধনসম্পন্নদের পরমাশ্রয় হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে,ভগবানই লোকগণের পরমাশ্রয় হন)। হে শুদ্ধসত্ত্ব! আমাদের হৃদয়-প্রদেশে আপনার নিবাসস্থান; বিশ্বধারক, পরাজ্ঞানের জন্য আপনাকে আমাদের হৃদয়ে আহ্বান করছি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করি) ॥ ১৩৷৷
[এই অনুবাকটি চারটি মন্ত্রে বিভক্ত। প্রথম মন্ত্র অগ্নি সম্বন্ধে প্রযুক্ত হয়েছে। দেবভাব হতে শুদ্ধসত্ত্বভাবের প্রভাবে-জ্ঞানাগ্নি উৎপন্ন হন। এই মন্ত্রের এটাই মুখ্য বক্তব্য। দ্বিতীয় বক্তব্য–সেই জ্ঞানাগ্নি কি রকম? এখানে যে পরিদৃশ্যমান জ্বলন্ত অগ্নিকে মাত্র লক্ষ্য নেই, অগ্নিদেবের বিশেষণ কয়েকটিতে তা প্রতিপন্ন হয়। এখানে দুটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষ্য করবার আছে। প্রথম–বৈশ্বানরমৃত আ জাতিমগ্নিং। দ্বিতীয়-জনয়ন্ত দেবাঃ। এর প্রথম অংশের অর্থ-সকল লোকের ঋত হতে উৎপন্ন অগ্নিকে। দ্বিতীয় অংশের অর্থ-দেবগণ উৎপন্ন করেন। ভাষ্যকার ঋত পদে যজ্ঞ অর্থ গ্রহণ করেছেন;এবং তা থেকে, যজ্ঞে যে অগ্নি প্রজ্বলিত হয়–এই ভাব এসেছে।দেবাঃপদে তিনি ঋত্বিক-গণ অর্থ গ্রহণ করেছেন; এবং জনয়ন্ত পদে, অরণি-কাষ্ঠ হতে ঋত্বিগণ যে অগ্নিকে উৎপাদিত করেন–এই ভাব প্রকাশ করে গেছেন। সেই অনুসারে ঐরকম ব্যাখ্যাই অধুনা প্রচলিত। অরণি কাঠের দ্বারা ঋত্বিকেরা যজ্ঞক্ষেত্রে যে অগ্নি প্রজ্বলিত করেন, তারই বিষয় ঐ মন্ত্রে প্রখ্যাপিত হয়েছে, তারই মাহাত্ম্য কথা মন্ত্রে পরিকীর্তিত আছে, এটাই এখানকার ভাষ্য-ব্যাখ্যার অভিমত। আমাদের অর্থ আমাদের মর্মার্থেই প্রকাশিত। দ্বিতীয় মন্ত্রটির লক্ষ্য শুদ্ধসত্ত্ব। বৈশ্বানর শব্দের অর্থ–বিশ্বের নেতা, পরিচালক, সমগ্র বিশ্বকে যিনি বা যে শক্তি পরিচালিত করতে পারেন–তাঁকেই বৈশ্বনার বলা হয়। অগ্নির পক্ষে এটি সার্থক বিশেষণ। বিশ্বকে যদি কেউ পরিচালিত করতে পারে, তবে তা জ্ঞান। জ্ঞানের বলেই জগৎ বিধৃত আছে। বিশ্ব পরিচালনা, বিশ্বকে ধারণ করা জ্ঞানের কার্য। বিশ্বকে ধারণ করেন বলে জ্ঞানকে বিশ্বধারক বলা যায়। বৈশ্বানর শব্দে এই দুইরকমই অর্থ সাধিত হয় বলেই আমরা দুটি ব্যাখ্যাই গ্রহণ করেছি। মন্ত্রের তৃতীয় অংশে ভগবানের মহিমা প্রখ্যাপিত হয়েছে। তিনি ধ্রুব, অর্থাৎ চিরস্থির, অপরিণামী। ভগবানের প্রতি যখন এই ধ্রুব শব্দ প্রযুক্ত হয়, তখন এর অর্থ হয় অপরিণামী, যার পরিণাম অর্থাৎ পরিবর্তন নেই। তিনি কেবলমাত্র ধ্রুব নন, তিনি অচ্যুতও বটেন, অর্থাৎ তাঁর কখনও পতন নেই। কিন্তু এই পরম ও চরম সত্য প্রখ্যাপনের পরেই শুদ্ধসত্ত্বলাভের জন্য প্রার্থনা আছে। সাধক বলছেন–শুদ্ধসত্ত্ব সাধকদের হৃদয়েই উপজিত হয়; আমরা যেন ভগবানের কৃপায় সেই পরমবস্তু লাভ করে ধন্য হতে পারি। দ্বিতীয় মন্ত্রের সাথে চতুর্থ মন্ত্রের ভাবগত যথেষ্ট সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হবে। এই অনুবাকের প্রথম মন্ত্রটি ঋগ্বেদের ষষ্ঠ মণ্ডলের সপ্তম সূক্তের প্রথমা ঋক রূপেও পাওয়া যায়] । ১৩।
.
চতুর্দশ অনুবাক
মন্ত্র- মধুশ্চ মাধবশ্চ শুক্রশ্চ শুচিশ্চ নভশ্চ নভস্যশ্চেষশ্চোর্জশ্চ সহশ্চ সহস্যশ্চ তপশ্চ তপস্যক্ষোপমতীতোহসি সংসপোহসাংহম্পত্যায় ত্ব। ১৪।
মর্মার্থ- হে ভগবন! আপনি অমৃতস্বরূপ এবং সর্বসিদ্ধিদায়ক হন; জ্যোতময় এবং পবিত্র হন; দুলোক এবং দ্যুলোকবিহারী হন; বল এবং বলদাতা হন; সাধনা এবং সাধ্য হন। (ভাব এই যে, ভগবানই বিশ্বরূপে সর্বভাবে প্রকাশিত হন)। হে ভগবন্! সর্বত্র ব্যাপ্ত আপনি সকলের হৃদয়ে বর্তমান আছেন। হে শুদ্ধসত্ত্ব! পাপনাশক দেবতার জন্য অর্থাৎ তার অনুগ্রহ লাভের জন্য আমরা যেন আপনাকে প্রাপ্ত হই। (ভাব এই যে,–শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা ভগবানকে প্রাপ্ত হওয়া যায়)। ১৪।
[তিন অংশে বিভক্ত এই অনুবাকটির প্রথম মন্ত্রে ভগবানের বিশ্বরূপ প্রকটিত হয়েছে। তিনি অমৃত, তিনি জ্যোতি; তিনিই স্বর্গ, আবার স্বর্গপ্রাপক, স্বর্গবিহারীও তিনি। তপঃ চ তপস্য চ মন্ত্রাংশে একটি বিশেষভাব প্রকাশিত হয়েছে। তিনিই তপস্যা, আবার আরাধ্যও তিনি, অন্যপক্ষে আরাধকের মধ্যেও তিনি বর্তমান আছেন। দ্বিতীয় মন্ত্রটি প্রথম মন্ত্রেরই ভাব অনুসরণ করেছে। প্রথম মন্ত্র কতকটা বহির্জগতের বিষয় বলেছেন দ্বিতীয় মন্ত্রে পাই অন্তর্জগতের বিষয়। তৃতীয় মন্ত্রের সম্বোধ্য বিষয়–শুদ্ধসত্ত্ব। শুদ্ধসত্ত্বের উদ্বোধনের কারণ বর্ণিত হয়েছে-অংহস্পত্যায়–পাপনাশক দেবতাকে লাভ করবার উপায়স্বরূপ শুদ্ধসত্ত্বের উদ্বোধন হয়েছে। ভাষ্য মন্ত্রের ভিন্ন অর্থ করা হয়েছে। ভাষ্যকারের মতে মধুঃ প্রভৃতি পদে চৈত্র ইত্যাদি দ্বাদশ মাসকে লক্ষ্য করেছে। আমরা এই মত গ্রহণ করতে পারিনি।] । ১৪।
.
পঞ্চদশ অনুবাক
মন্ত্র- ইন্দ্রাগ্নী আ গতং সুতং গীৰ্ভির্নভো বরেণ্যম। অস্য পাত ধিয়েষিতা। উপযামগৃহীতোহসীন্দ্রাগ্নিভ্যাং বৈষ তে যোনিরিন্দ্রাগ্নিভ্যাং ত্বা ১৫৷৷
মর্মার্থ- হে বলাধিপতিদেব এবং জ্ঞানদেব! আপনারা সাধকের প্রার্থনার দ্বারা প্রীত হয়ে দুলোক হতে আগমন করেন এবং আত্ম-শক্তির দ্বারা এর বরণীয় সত্ত্বভাব রক্ষা করেন (অথবা গ্রহণ করেন)। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে,-ভগবান্ সাধককে সর্বতোভাবে রক্ষা করেন)। হে শুদ্ধসত্ব! আপনাকে আমরা যেন প্রাপ্ত হই; বলাধিপতি দেবতা এবং জ্ঞানদেবের দ্বারা আপনি আমাদের হৃদয়ে উৎপাদিত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে,আমরা যেন ভগবক্তৃপায় শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করতে পারি)। হে শুদ্ধসত্ত্ব! আমাদের হৃদয়প্রদেশ আপনার নিবাসস্থান হোক। হে শুদ্ধসত্ত্ব! বলধিপতি দেব এবং জ্ঞানদেবের দ্বারা অর্থাৎ এই দুই দেবতার কৃপায় আপনাকে আমরা যেন লাভ করি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভ্যাবান আমাদের শুদ্ধসত্ত্ব প্রদান করুন) ১৫
[এই অনুবাকটির দেবতা–ইন্দ্রাগ্নি; অর্থাৎ ইন্দ্র ও অগ্নিরূপে পরিচিত ভগবৎ-বিভূতিদ্বয়কে লক্ষ্য করেই মন্ত্র উচ্চারিত হয়েছে। ইন্দ্র বলতে শক্তির এবং অগ্নি বলতে জ্ঞানকে লক্ষ্য করে। জ্ঞানই শক্তি অথবা জ্ঞানই পরমৈশ্বর্য অর্থাৎ এই উভয়ের একত্ব প্রতিপাদনের জন্যই ইন্দ্রাগ্নি-রূপে ভগবানের উপাসনা বিহিত হয়েছে। বস্তুতঃ তিনি এক, বহু তারই বিকাশ মাত্র। কিন্তু ইন্দ্রাগ্নি মিত্রবরুণ বিশ্বদেব প্রভৃতি দেবতার উল্লেখ দেখে পাশ্চাত্যপণ্ডিতগণ এক অপূর্ব গবেষণা করেছেন। তাদের গবেষণার সার কথা এই যে,–আদিম আর্যগণ বহুদেববাদী ছিলেন। জগতের প্রাকৃতিক কার্যের মধ্যে তারা এক একজন দেবতা কল্পনা করতেন। তা থেকেই বহু দেবতার সৃষ্টি হয়…।–ইত্যাদি। কিন্তু আমাদের মত ভিন্ন। আমরা মনে করি–বেদ সর্বজনীন ধর্মগ্রন্থ, তার মধ্যে সর্ববিষয়ই পাওয়া যায়। সুতরাং বেদে বিভিন্ন স্তরের চিন্তাধারার পরিচয় পাওয়াই স্বাভাবিক। অপরপক্ষে আমরা বেদের মধ্যে যে একত্ব দ্বিত্ব বহুত্ব প্রভৃতির পরিচয় পাই, তা বিভিন্নশ্রেণীর অধিকারীদের জন্য নির্দিষ্ট হয়েছে। সকল লোক এক সঙ্গে সাধনার উচ্চতরলোকে আরোহণ করতে পারে না, তাই সকল শ্রেণীর সাধকের জন্যই যথোপযুক্ত ব্যবস্থা বিহিত হয়েছে। নতুবা বেদের মধ্যে অজ্ঞানতা অথবা অসম্পূর্ণ জ্ঞানের আরোপ করাই বাতুলতা মাত্রা। পুর্বেই উল্লেখিত হয়েছে, প্রথম মন্ত্র ইন্দ্রাগ্নির প্রতিই প্রযুক্ত। অথচ সূতং পদটি দেখেই প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে সোমরসের সম্বন্ধ কল্পনা হয়েছে। একটি প্রচলিত বঙ্গানুবদ হে ইন্দ্রাগ্নি! তোমরা স্তুতিদ্বারা আহুত হয়ে স্বর্গলোক হতে অভিযুত ও বরণীয় (এই সোমের উদ্দেশে) আগমন করো। আমাদের ভক্তিহেতু আগমন করে (এই সোম) পান করো। মূলে কিন্তু সোমরসের উল্লেখ নেই। আমরা সুতং পদে বিশুদ্ধং–সত্ত্বভাবং মনে করি। দ্বিতীয় মন্ত্রের বিষয় সাক্ষাভাবে শুদ্ধসত্ত্ব হলেও পরোক্ষভাবে ইন্দ্র ও অগ্নির মহিমাও পরিকীর্তিত হয়েছে। মন্ত্রটিতে প্রার্থনা করা হয়েছে, আমরা যেন শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করতে পারি। কিভাবে তা লাভ করা যায়? তার উত্তর–ইন্দ্রাগ্নিভ্যাং অর্থাৎ ইন্দ্র ও অগ্নির দ্বারা, তাদের কৃপাতেই শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করতে সমর্থ হবে। তৃতীয় মন্ত্রের ভাবও দ্বিতীয় মন্ত্রের অনুরূপ। তবে দ্বিতীয় মন্ত্রে পরোক্ষভাবে ভগবানের নিকট প্রার্থনা করা হয়েছে, আর তৃতীয় মন্ত্রে সাক্ষাভাব ভগবৎ-শক্তি শুদ্ধসত্ত্বের নিকটেই প্রার্থনা করা হয়েছে। চতুর্থ মন্ত্রের ভাব দ্বিতীয় মন্ত্রেরই অনুরূপ) ॥ ১৫।
.
ষোড়শ অনুবাক
মন্ত্র- ওমাসশ্চর্ষণীতো বিশ্বে দেবাস আ গত। দাশ্বাংসসা দাশুযঃ সুতম্। উপযামগৃহীতোহসি বিশ্বেভ্যস্তা দেবেভ্য এষ তে যোনিৰ্ব্বিশ্বেভ্যস্খা দেবেভ্যঃ ॥ ১৬৷৷
মর্মার্থ- রক্ষক, প্রতিপালক, কর্মফলদাতা হে বিশ্বদেবগণ! অর্চনাকারী পূজা বা শুদ্ধসত্ত্বভাব গ্রহণের জন্য আপনারা আগমন করুন। (ভাব এই যে,-দেবগণ বা দেবভাবসমূহই আমাদের রক্ষক ও প্রতিপালক, সকল দেবভাব বা সকল দেবতা আমাদের মধ্যে অধিষ্ঠিত হোন–এই প্রার্থনা)। হে শুদ্ধসত্ব! আপনি সাধকের হৃদয়ে উৎপাদিত হন; সর্বদেবভাব লাভের জন্য আমরা যেন আপনাকে প্রাপ্ত হই। হে শুদ্ধসত্ত্ব! আমাদের হৃদয়প্রদেশ আপনার নিবাসস্থান হোক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করি)। হে শুদ্ধসত্ত্ব! সর্বদেবভাব লাভের জন্য আপনাকে আমরা প্রার্থনা করছি । ১৬।
ষোড়শ অনুবাকের প্রথম মন্ত্রে বিশ্বদেব অভিধায়ে সকল দেবতাকে আহ্বান করা হয়েছে। একে একে আহ্বান করতে করতে যখন অন্তরের ব্যাকুলতা বৃদ্ধি পেল, বিভিন্ন দেবতার বিভিন্ন শক্তির অভিব্যক্তির ভাব যখন অন্তরে জাগরূক হলো, অভাবের তীব্র জ্বালা যখন চারদিকে প্রকট হয়ে পড়ল; তখন আর এক বিশেষ দেবতাকে ডেকে তৃপ্তি হলো না, তখন সর্বদেবকে এক সঙ্গে এক স্বরে ডেকে জ্বালা-নিবারণের জন্য প্রার্থনা জানান হলো। এই মন্ত্রের আর এক নিগূঢ় তাৎপর্য এই যে, এখানে এই প্রার্থনায় প্রার্থনাকারী আপন হৃদয়ে সব রকম দেবভাব সঞ্চয়ের জন্য উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। এখানে যেন তার জ্ঞানসঞ্চার হয়েছে–সকল রকম দেবভাব-সত্ত্বভাবসমূহই–শ্রেয়ঃসাধক,দেবভাবের দ্বারাই সত্ত্বভাবের প্রভাবেই মানুষ রক্ষা প্রাপ্ত হয়। তাই সকল দেবতাকে সকল দেব-ভাবকে তিনি আহ্বান করছেন। আবার বিশ্বদেবকে এক সঙ্গে আহ্বান করার আরও একটি নিগূঢ় অর্থ এই যে,–এই বিশ্বের সবই যে সেই একেরই প্রতিরূপ তা প্রতিপাদন করা। দ্বিতীয় মন্ত্রের প্রার্থিত বস্তু দেবভাব। তা লাভ করার উপায়-হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্বের উপজন। তৃতীয় মন্ত্রের প্রার্থনার ভাবও দ্বিতীয় মন্ত্রেরই মতো।–পঞ্চদশ ও ষোড়শ, উভয় অনুবাকেই শুদ্ধসত্ত্বলাভের জন্য প্রার্থনা পরিদৃষ্ট হয়। বস্তুতঃ এই প্রার্থনাই উভয় অনুবাকের মধ্যে যোগসূত্র। পঞ্চদশ অনুবাকের প্রথম মন্ত্রটি ঋগ্বেদ-সংহিতায় এবং সামবেদ-সংহিতায় পাওয়া যায়। যোড়শ অনুবাকের প্রথম মন্ত্রটি ঋগ্বেদ-সংহিতার প্রথম মণ্ডলের তৃতীয় সূক্তের সপ্তমী ঋক্-রূপে পাওয়া যায়] ॥ ১৬৷৷
.
সপ্তদশ অনুবাক
মন্ত্র- মরুত্বং বৃষভং বাবৃধানমকবারিং দিব্যং শাসমিম। বিশ্বাসাহমবসে নৃতনায়োগ্রং সহোদামিহ তং হুবেম। উপযামগৃহীতোহসীন্দ্রায় ত্বা মরুত্বত এষ তে যোনিরিদ্ৰায় ত্বা মরুত্বতে। ১৭৷
মর্মার্থ- পাপকবল হতে রক্ষার নিমিত্ত অর্থাৎ আশুমুক্তি প্রাপ্তির জন্য বিবেক-জ্ঞানদায়ক অভীষ্টবষক, কাম্যসমুহের বর্ধক প্রভূতশক্তিসম্পন্ন জ্যোতির্ময় রিপুজয়ী বিশ্বশাসক তেজস্বী অর্থাৎ শত্রুনাশে উগ্রমূর্তিধারী বিশ্বজয়ী অর্থাৎ বিশ্বপালনে সদা উদ্বুদ্ধ বলদাতা প্রসিদ্ধ সেই বলাধিপতি অর্থাৎ পরম ঐশ্বর্যশালী ভগবানকে আমরা নবজীবন লাভের জন্য এই সৎকর্ম-সাধনে আহ্বান করছি,–তারই কৃপা ভিক্ষা করছি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে,–সৎকর্মের সাধনে সিদ্ধিলাভের জন্য আমরা যেন ভগবৎ-অনুসারী হই)। হে ভক্তি! আপনি সাধকের হৃদয়ে উৎপন্ন হন; প্রজ্ঞানের আধার ভগবানের জন্য আপনাকে যেন আমরা প্রাপ্ত হই। হে ভক্তি। আমাদের হৃদয়প্রদেশ আপনার নিবাসস্থান হোক। হে ভক্তি! ভগবান্ ইন্দ্রদেবের এবং বিবেকজ্ঞানের জন্য আপনাকে যেন আমরা লাভ করি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে,-ভগবান্ কৃপাপূর্বক আমাদের পরাভক্তি প্রদান করুন) ৷ ১৭৷৷
.
অষ্টাদশ অনুবাক
মন্ত্র- ইন্দ্র মরুত্ব ইহ পাহি সোমং যথা শাৰ্য্যাতে অপিবঃ সুতস্য। তব প্রণীতী তব শূর শপুন্ন বিবাসন্তি কবয়ঃ সুজ্ঞাঃ। উপমগৃহীতোহসীন্দ্রায় ত্বা মরুত্বত এষ তে যোনিরিদ্ৰায় ত্বা মরুত্বতে। ১৮৷৷
মর্মার্থ- অশেষ প্রজ্ঞানের আধার হে ভগবন্ ইন্দ্রদেব! আপনি যে রকমে রিপুজয়ী পবিত্র-হৃদয় ব্যক্তির অন্তরস্থিত শুদ্ধসত্ত্ব গ্রহণ করেন, সেইরকম ভাবে আমাদের সৎকর্ম-সাধনে প্রীত হয়ে আমাদের হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব গ্রহণ করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে,হে ভগব। কৃপাপূর্বক দীনহীন আমাদের ভক্তিরূপ পুজোপচার গ্রহণ করুন)। হে পরমশক্তিসম্পন্ন দেব! সঙ্কর্মের সাধক জ্ঞানিগণ (আত্মদর্শিগণ) আপনার পরম মঙ্গল-শক্তিতে অবস্থিত হয়ে আপনাকে পূজোপচার প্রদানের দ্বারা সম্যকভাবে আরাধনা করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে,–সাধকগণ সঙ্কৰ্ম-সাধনের দ্বারা ভগবানকে আরাধনা করেন)। হে সৎকর্মসাধনসামর্থ! পরম প্রজ্ঞানের আধার ভগবানের প্রীতির জন্য আপনাকে যেন প্রাপ্ত হই। হে সৎকর্মসাধনসামথ্য! আপনি আপনা-আপনিই সাধকগণের হৃদয়ে অবির্ভূত হন। হে সৎকর্মসাধনসামর্থ! আমাদের হৃদয়প্রদেশ আপনার নিবাসস্থান হোক। পরম প্রজ্ঞানের আধার ভগবানের জন্য আপনাকে যেন প্রাপ্ত হই। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন সঙ্কর্ম সাধনের সামর্থ্য লাভ করি)। ১৮৷
.
উনবিংশ অনুবাক
মন্ত্র- মরুত্বাং ইন্দ্র বৃষভো রণায় পিবা সোমমনুম্বধম মদায়। আ সিঞ্চস্ব জঠরে মধ্ব উর্মিং ত্বম রাজাহসি প্রদিবঃ সুতানা। উপমগৃহীতোহসীন্দ্রায় বা মরুত্বত এষ তে যোনিরিদ্ৰায় ত্বা মরুত্বতে। ১৯৷৷
মর্মার্থ- পরমশক্তিসম্পন্ন সর্বশক্তির আধার হে দেব! বিবেকজ্ঞানদায়ক অভীষ্টবর্ষক আপনি পরমানন্দ দানের জন্য এবং রিপুসংগ্রাম-জয়ের নিমিত্ত আমাদের প্রার্থনাসমন্বিত অর্থাৎ আমাদের হৃদয়নিহিত ভক্তি প্রভৃতির দ্বারা বিশুদ্ধীকৃত শুদ্ধসত্ত্ব গ্রহণ করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে,-হে ভগবন্! কৃপাপূর্বক আমাদের শুদ্ধসত্ত্বরূপ পুজোপচার গ্রহণ করুন)। হে দেব! অমৃতের প্রবাহকে আমাদের মধ্যে সম্যকভাবে প্রদান করুন। হে দেব! আপনি নিত্যকাল শুদ্ধসত্ত্বের অধিপতি বা গ্রহণকারী হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে,ভগবানই শুদ্ধসত্ত্ব অধিপতি হন) হে শুদ্ধসত্ত্ব! আপনি সাধকের হৃদয়ে আবির্ভূত হন; ভগবানের প্রীতির নিমিত্ত আমরা আপনাকে যেন প্রাপ্ত হই। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক এবং নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক। ভাব এই যে,-সাধকেরা শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করেন, আমরা ভগবানের কৃপায় যেন সেই পরমধন প্রাপ্ত হই)। হে শুদ্ধসত্ত্ব! আমাদের হৃদয়প্রদেশ আপনার নিবাসস্থান হোক। হে শুদ্ধসত্ত্ব! প্রজ্ঞানের আধার ভগবানের প্রীতির নিমিত্ত আপনাকে যেন আমরা লাভ করি । ১৯।
.
বিংশ অনুবাক
মন্ত্র- মহাং ইন্দ্রো য ওজস্য পৰ্জনা বৃষ্টিমান ইব। স্তেমৈৰ্ব্বৎসস্য বাবৃধে। উপযামগৃহীতোহসি মহেন্দ্রায় ত্বৈষ তে যোনিৰ্ম্মহেন্দ্ৰায় ত্বা ॥ ২০।
মর্মার্থ- অভীষ্টপূরক অমৃতদায়ক দেবতার মতো শক্তিতে শ্রেষ্ঠ বল-ঐশ্বর্য্যের অধিপতি যে দেবতা, তিনি তাঁর পুত্রস্থানীয় সাধকের স্তুতির দ্বারা আরাধিত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে,–অমৃতপ্রাপক ভগবান্ সাধকদের দ্বারা আরাধিত হন)। হে আত্মশক্তি! আপনি সাধক-হৃদয়ে সমুৎপাদিত হন; পরম দেবতার জন্য আপনাকে যেন প্রাপ্ত হই। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে,-সাধকলভ্য আত্মশক্তি ভগবানের কৃপায় যেন আমরা লাভ করি)। হে আত্মশক্তি! আমাদের হৃদয়প্রদেশ আপনার নিবাসস্থান হোক। পরমদেবতার জন্য আপনাকে যেন লাভ করি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে,-ভগবাকে লাভের জন্য আমাদের হৃদয়ে আত্মশক্তি আবির্ভূত হোক) ॥২০।
.
একবিংশ অনুবাক
মন্ত্র- মহাং ইন্দ্রো নৃবদা চৰ্ষণি উত দ্বিবহা অমিনঃ সহোভিঃ। অম্মদ্রিয়গ্রাবৃধে বীৰ্যায়োরুঃ পৃথুঃ সুকৃতঃ কর্তৃভির্ভূৎ। উপমগৃহীতোহসি মহেন্দ্ৰায় বৈষ তে যোনিৰ্ম্মহেন্দ্ৰায় ত্ব। ২১।
মর্মার্থ- মহত্ত্বসম্পন্ন রাজার মতো স্তোতাদের অভীষ্টপূরক ভগবান্ ইন্দ্রদেব আমাদের হৃদয়ে আগমন করুন; অপিচ, বিশ্বের অধিপতি অজাতশত্রু দেব তার শক্তির সাথে আমাদের অভীমুখী হোন; আমাদের উধ্বমার্গপ্রাপ্তির জন্য এবং পরাশক্তি লাভের জন্য সর্বব্যাপী শক্তিমান্ সেই দেবতা সল্কর্মসাধকগণ কর্তৃক আরাধিত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক এবং প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, –বিশ্বাধিপতি ভগবান্ পরাশক্তি মুক্তি প্রদানের জন্য আমাদের হৃদয়ে অবির্ভূত হোন; সাধকবর্গ সেই পরম দেবতাকে আরাধনা করেন)। হে আত্মশক্তি! পরমদেবের জন্য আপনাকে যেন প্রাপ্ত হই। হে আত্মশক্তি! আপনি সাধকের হৃদয়ে উৎপাদিত হন। হে আত্মশক্তি! আমাদের হৃদয়প্রদেশ আপনার নিবাসস্থান হোক। হে আত্মশক্তি! পরমদেবতার জন্য আপনাকে যেন লাভ করি । ২১।
সপ্তদশ থেকে একাদশ পর্যন্ত পাঁচটি অনুবাক পরস্পর পরস্পরের সাথে এমনভাবে গ্রথিত যে তাদের বিভিন্ন করা যায় না। তথাপি স্বতন্ত্রভাবে এক একটির আলোচনা করা হচ্ছে।-সপ্তদশ অনুবাকের মন্ত্রের নূতনায় অবসে পদ দুটির সাধারণ অর্থ হয়–অভিনব রক্ষার জন্য; কিন্তু এই অভিনব রক্ষা কি? আমরা এর অর্থ করেছি-আশুমুক্তিপ্রাপ্তির জন্য। মন্ত্রের মূলভাব–আমরা যেন আমুক্তিলাভের জন্য ভগবানের আরাধনায় প্রবৃত্ত হতে পারি। সেই ভগবান্ বা দেবতা কেমন? তিনি মরুত্বং -বিবেকজ্ঞানদায়ক। তিনি সেই জ্ঞানসাধনের উপযোগী শক্তিও দান করেন, তিনি–সহোদাং। তিনি কিভাবে শক্তি দেবেন? তিনি ববৃধানং–প্রভূতশক্তিসম্পন্ন। তিনি অকবারিং–অর্থাৎ কোনশত্রুই যাঁর শক্তির সাথে প্রতিযোগিতা করতে পারে না। প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতেও এই ভাবই কতকটা প্রকাশিত হয়েছে। একটি প্রচলিত অনুবাদ আমরা অভিনব রক্ষার নিমিত্ত এই যজ্ঞে সেই ইন্দ্রের আহ্বান করছি। তিনি মরুৎগণসমবেত অভীষ্টবর্ষী সমৃদ্ধ শত্রুর দ্বারা অধর্ষিত দীপ্তিমান্ শাসনকারী, সর্বাভিভাবী প্রচণ্ড ও বলপ্রদ। দ্বিতীয় ও তৃতীয় মন্ত্রে ভক্তিকে সম্বোধন করে উচ্চারিত হয়েছে। চতুর্থ মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। পূর্বোক্ত মন্ত্র দুটির ভাবই এখানে স্পষ্টীকৃত হয়েছে। পরাভক্তি লাভ এখানে অন্য উদ্দেশ্য সাধকের উপায়স্বরূপে গৃহীত হয়েছে। সেই চরম উদ্দেশ্য–ভগবাকে প্রাপ্তি।-ইন্দ্রায় মরুত্বতে ত্বা লতভমহি বলার এটাই তাৎপর্য । ১৭।
[অষ্টাদশ অনুবাকের মন্ত্র কয়টিতে শক্তিলাভের প্রার্থনা আছে। প্রথম দুটিতে ভগবাকে সম্বোধন করা হয়েছে। শেষ তিনটিতে সম্বোধ্যকর্মসাধনের সামর্থ্য। কিন্তু প্রত্যেক মন্ত্রের মধ্যে সকর্মসাধনের শক্তিই প্রার্থনীয় বিষয়। প্রথম মন্ত্রের অন্তর্গত উপমার যে প্রচলিত ব্যাখ্যা আছে, তা থেকে বোঝা যায় যে, মন্ত্রে শর্যাতি নামক কোনও রাজার উপাখ্যান আছে এবং সেই প্রসঙ্গেই বর্তমান মন্ত্রের উপমা ব্যবহৃত হয়েছে। এর একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ-হে মরুগণযুক্ত ইন্দ্র! তুমি যেমন শর্যাতির পুত্রের অভিযুত সোম পান করেছিলে, সেইরকম এই যজ্ঞে সোমপান করো। হে শুর! তোমার নির্বাধস্থানে স্থিত সুন্দর যজ্ঞবিশিষ্ট কবিগণ হব্যের দ্বারা তোমার পরিচর্যা করে। কিন্তু আমরা মনে করি নিত্য বেদমন্ত্রে কোনও অনিত্য ব্যক্তি বা বস্তুর নাম থাকতে পারে না। শর্যাতি বলতে রিপুজয়ী সাধককেই লক্ষ্য করে। এই অনুবাকের দ্বিতীয় মন্ত্রেও ভগবাকে সম্বোধন করা হয়েছে। সাধকের প্রার্থনা–ভগবানের করুণার সুদৃঢ় দুর্গে তিনি আশ্রয়লাভ করে যেন নির্বিঘ্নে ভগবানের আরধনায় আত্মনিয়োগ করতে পারেন। তৃতীয় মন্ত্রের সম্বোধ্য বিষয় সৎকর্মর্সাধন সামর্থ্য। পূর্বের মন্ত্রে সৎকর্মের মহিমা নিগুঢ়ভাবে প্রখ্যাপিত হয়েছিল। তৃতীয় মন্ত্রে তা-ই সুস্পষ্ট রূপ ধারণ করেছে। ভগবানকে প্রাপ্তির জন্য, বিবেকজ্ঞান প্রাপ্তির জন্য আমরা যেন সকর্মসাধনের সামর্থ্য লাভ করি। কারণ সৎকর্মসাধনের দ্বারাই জ্ঞানলাভ অথবা মুক্তিলাভ সম্ভবপর। চতুর্থ মন্ত্রে বলা হয়েছে- সাধকগণ সেই সামর্থ্য লাভ করতে পারেন। এর অন্তর্নিহিত ভাব এই যে, সৎকর্ম করতে করতে প্রবৃত্তিগুলি সঙ্কর্মের অভিমুখী হয়। তখন সাধক আপনা থেকেই, বিনা চেষ্টার অথবা বিশিষ্ট ইচ্ছাব্যতীতও সৎকর্মে প্রবৃত্ত হয়ে থাকেন। একেই–এই স্বাভাবিক প্রবৃত্তি বা প্রেরণাকেই সকর্মসাধনসামর্থ্য বলা হয়েছে। এইজন্যই পঞ্চম মন্ত্রে প্রার্থনা করা হয়েছে–এষঃ তে যোনিঃ–আমাদের এই হৃদয় তোমার নিবাসস্থান হোক]। ১৮৷
[উনবিংশ অনুবাকের ছটি মন্ত্রের প্রথম তিনটির সম্বোধ্য বিষয়–ভগবান স্বয়ং; অন্য তিনটিতে ভগবৎ শক্তি-শুদ্ধসত্ত্বকে সম্বোধন করা হয়েছে। প্রথম মন্ত্রে প্রার্থনা করা হয়েছে–যেন আমরা ভগবানের আরাধনার শক্তি লাভ করতে পারি। কিন্তু এই প্রার্থনার উদ্দেশ্য কি? তা-ই মদায় এবং রণায় দুটি পদে বিবৃত হয়েছে। পরমানন্দলাভ, রিপুসংগ্রামে জয়লাভ এই দুই মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই প্রার্থনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় মন্ত্রের প্রার্থনার মর্মও বহুল পরিমাণে প্রথম মন্ত্রের অনুযায়ী। প্রথম মন্ত্রে যেমন পরমানন্দ লাভের জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে, দ্বিতীয় মন্ত্রে তেমনি অমৃতলাভের প্রার্থনা আছে। বস্তুতঃ এই দুটির মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। তৃতীয় মন্ত্রের অর্থ-ভগবান্ শুদ্ধসত্ত্বের অধিপতি অর্থাৎ পবিত্রতার আধার। তার অবির্ভাবে, তার করুণায় অপবিত্রতা দূর হয়। তাই তাকে সুতানাং রাজা বলা হয়েছে। চতুর্থ মন্ত্রের প্রথম অংশে বলা হয়েছে–সাধক-হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্বের আবির্ভাব হয়, অর্থাৎ সাধকেরা শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করেন। তা লাভ করার জন্য এই মন্ত্রে প্রার্থনা করা হয়েছে। পঞ্চম ও ষষ্ঠ মন্ত্রের মধ্যেও সেই একই ভাব প্রতিধ্বনিত হয়েছে। ১৯।
[বিংশ অনুবাকে তিনটি মন্ত্র আছে। মন্ত্রটিতে ভগবানের মাহাত্ম্য প্রখ্যাপিত হয়েছে। মন্ত্রে ভগবানের দুটি বিভূতির একত্র তুলনা করা হয়েছে। পর্জন্যঃ ইন্দ্রঃ ভগবানের এই দুই প্রকাশের মধ্যে একত্ব সূচিত। হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ভগবানেরই বিভূতিগুলির মধ্যে যে একত্ব বর্তমান মন্ত্রে তাই প্রখ্যাপিত হয়েছে। দ্বিতীয় মন্ত্রটি আত্মশক্তির প্রতি প্রযুক্ত হয়েছে। আত্মশক্তিসম্বন্ধে মন্ত্রে বলা হয়েছে-মহেন্দ্রায় বা উপযাম পরমদেবতার জন্য, অর্থাৎ পরমদেবতাকে প্রাপ্তির জন্য যেন আমরা যত্নপরায়ণ হতে পারি। অনুবাকের তৃতীয় মন্ত্রটিও প্রার্থনামূলক। তৃতীয়টির প্রার্থনার মূলভাবের সাথে দ্বিতীয় মন্ত্রের প্রার্থনার ঐক্য আছে। ফলতঃ–এক প্রার্থনাই বিভিন্ন ভাবের মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে] ॥ ২০।
[একবিংশ অনুবাকের প্রথম মন্ত্রটির বিষয় ভগবান্ ইন্দ্রদেব। প্রার্থনার মধ্যেও ভগবানের মহিমা পরিকীর্তিত হয়েছে। তার সম্বন্ধে বলা হয়েছে-মহান নৃবৎ চৰ্ষণিপ্রাঃ। তিনি মহৎ–তিনি মহতঃ মহীয়া৷ নৃষৎ চৰ্ষণিপ্রাঃ–রাজা যেমন প্রার্থীদের অভীষ্ট পূর্ণ করেন, ঠিক তেমনিভাবে ভগবানও প্রার্থনাকারীর প্রার্থনা পূর্ণ করেন। দ্বিতীয় মন্ত্রের ভাব–আত্ম-শক্তিলাভের প্রার্থনা। তৃতীয় মন্ত্রের ভাব এই যে, সাধকের হৃদয়ে আত্মশক্তি লাভ করে থাকেন। সাধনার প্রধান উদ্দেশ্যই শক্তিলাভ। কারণ শক্তির দ্বারাই মুক্তি লাভ হয়। জ্ঞান ভক্তি প্রভৃতি সবই শক্তির রূপান্তর মাত্র। চতুর্থ মন্ত্রের অর্থ–আমাদের মধ্যে যেন আত্মশক্তির আবির্ভাব হয়। আবার পঞ্চম মন্ত্রের মধ্যেও সেই আত্মশক্তিলাভের জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। তাতে একটা উদ্দেশ্য সংযোজিত হয়েছে, সেই উদ্দেশ্য–ভগবপ্রাপ্তি।-সপ্তদশ অনুবাকের প্রথম মন্ত্রটি ঋগ্বেদ সংহিতার ষষ্ঠ মণ্ডলের উনবিংশ সুক্তের ঋ; অষ্টাদশ অনুবাকের প্রথম মন্ত্রটি ঋগ্বেদ-সংহিতার তৃতীয় মণ্ডলের একপঞ্চাশত্তম সুক্তের ঋক্; ঊনবিংশ অনুবাকের প্রথম মন্ত্রটি ঋগ্বেদ-সংহিতার তৃতীয় মণ্ডলের সপ্তচত্বারিংশত্তম সুক্তের ঋ; বিংশ অনুবাকের প্রথম মন্ত্রটি ঋগ্বেদ-সংহিতার অষ্টম মণ্ডলের প্রথমা ঋক, আবার সামবেদ-সংহিতার উত্তরার্চিকের ১০ম অধ্যায়ে পাওয়া যায়; একবিংশ অনুবাকের প্রথম মন্ত্রটি ঋগ্বেদ-সংহিতার ষষ্ঠ মণ্ডলের উনবিংশ সুক্তের প্রথম ঋক)। ২১।
.
দ্বাবিংশ অনুবাক
মন্ত্র- কদা চন শুরীরসি নেন্দ্র সশ্চসি দাশুষে। উপপাপে মঘব ভূয় ইমু তে দানং দেবস্য পৃচ্যতে। উপাযামগৃহীতোহস্যাদিত্যেভ্যন্ত। কদা চন প্র যুচ্ছস্যভে নি পাসি জন্মনী। তুরীয়াহদিত্য সনং ত ইন্দ্রিয়মা তস্থামৃতং দিবি। যজ্ঞো দেবানাং প্রত্যেতি সুমাদিত্যাসো ভবতা মৃডয়ন্তঃ। আ বোহাচী সুমতিৰ্ববৃত্যাদংহোশ্চিদ্যা বরিবোবিত্তরাইসৎ। বিবস্ব আদিত্যৈষ তে সোমপীথনে মন্দ তেন তৃপ্য তৃপ্যাশ্ম তে বয়ং তপয়িতাররা। যা দিব্যা বৃষ্টিস্তয়া ত্বা শ্ৰীণামি ॥ ২২।
মর্মার্থ- বলৈশ্বর্যাধিপতি হে দেব! আপনি কখনও আমাদের প্রতি–এই জীবগণের প্রতি স্নেহশূন্য হন না; আপনি ত্যাগশীল সকর্মসাধককে মোক্ষ প্রদান করেন; পরমধনশালী হে দেব! জ্যোতির্ময়-রূপ আপনার প্রদত্ত প্রকৃষ্ট জ্ঞান-রূপ দান ত্বরায় নিশ্চিত ভাবে আমাদের প্রাপ্ত হোক; (প্রার্থনার ভাব এই যে,-হে দেব! আমাদের জ্ঞান প্রদান করুন)। হে শুদ্ধসত্ত্ব! আপনি সাধক হৃদয়ে উৎপন্ন হন; পরাজ্ঞানের জন্য আপনাকে যেন প্রাপ্ত হই। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন সাধকলভ্য শুদ্ধসত্ত্ব প্রাপ্ত হই)। হে দেব! আপনি সর্বদা সাধকদের প্রতি কৃপাপরায়ণ হন; ইহলোকে ও পরলোকে সাধকদের পালন করেন। তুরীয় জ্ঞানদায়ক হে দেব! আপনার সম্বন্ধীয় সৎকর্ম দ্যুলোকে ইন্দ্রিয়দের অমৃত প্রাপ্ত করায়। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে,-পরাজ্ঞানের দ্বারা অমৃত ও মোক্ষ লাভ হয়)। আমাদের অনুষ্ঠিত সঙ্কর্ম দীপ্তিদান ইত্যাদি গুণবিশিষ্টগণের অর্থাৎ সকলগুণ-নিলয় ভগবানের আনন্দকে প্রাপ্ত হোক; (ভাব এই যে, ভগবানের প্রীতির জন্য আমাদের কর্ম নিয়োজিত হোক); অনন্তের অঙ্গীভূত সকল দেবগণ (দীপ্তিদান ইত্যাদি গুণনিবহ) আমাদের সুখী করে অর্থাৎ আমাদের দুঃখনাশক ও সুখপ্রদায়ক হয়ে অবস্থিতি করুন; (ভাব এই যে, দীপ্তিদান ইত্যাদি গুণনিবহ আমাদের সুখদায়ক হোক); হে দেবগণ! আপনাদের সম্বন্ধীয় যে সুমতি দারিদ্র-প্রাপ্ত পুরুষের–পাপক্লিষ্ট জনের ধনের বা সুখের প্রদাত্রী হন, সেই সৎ-বুদ্ধি আমাদের অভিমুখী হয়ে আগমন করুন; (প্রার্থনার ভাব এই যে,–দেবত্বের উপজন সমর্থ সুমতি আমাদের মধ্যে সদাকাল অধিষ্ঠান করুন)। বিশ্বজ্যোতিঃস্বরূপ হে দেব! আপনার গ্রহণীয় শুদ্ধসত্ত্ব আমাদের হৃদয়ে বর্তমান আছে; সেই শুদ্ধসত্ত্ব গ্রহণ করে তৃপ্ত হোন; আমাদের হৃদয়-নিহিত শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা তৃপ্ত হোন; আপনার উপাসক আমরাও যেন পূর্ণকাম হই। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে,ভগবান আমাদের পূজোপচাররূপ শুদ্ধসত্ত্ব গ্রহণ করুন; আমরা যেন সর্বাভীষ্ট লাভ করি)। হে শুদ্ধসত্ত্ব! স্বর্গীয় অমৃতের সাথে আপনাকে যেন মিশ্রিত করতে পারি; অর্থাৎ শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা আমি যেন অমৃত লাভ করতে সমর্থ হই ॥ ২২।
[প্রথম মন্ত্রটিতে একটি বিষয় স্পষ্টভাবে আমাদের দৃষ্টিতে পড়ে। তা ভগবানের দান। তিনি দাতা। আমাদের যা কিছু আছে, সবই তাঁর দান–ভূয়ঃ তে দানং। জ্ঞান, কর্মশক্তি, ভক্তি, হৃদয়ের সৎ-বৃত্তি–যা কিছু আছে, সমস্তই তাঁর কাছ থেকে পাওয়া। দ্বিতীয় মন্ত্রটির প্রথম অংশে নিত্যসত্য প্রখ্যাপিত হয়েছে গৃহীতঃ অসি। মন্ত্রটি শুদ্ধসত্ত্ব সম্বন্ধে প্রযুক্ত হয়েছে। দ্বিতীয় অংশের প্রার্থনার সাথে প্রথম অংশের নিত্যসত্যের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ আছে। সাধকগণ তো সেই পরমবস্তু-শুদ্ধসত্ত্ব–লাভ করতে সমর্থ হন, কিন্তু দুর্বল আমাদের উপায় কি হবে? আমরা যাতে ভগবানের কৃপায় সেই পরমবস্তু লাভ করতে পারি তার জন্যই মন্ত্রে প্রার্থনা পরিদৃষ্ট হয়। কিন্তু সেই প্রার্থনার মধ্যে একটা বিশেষত্ব আছে। সেই বিশেষত্ব এই যে, এখানে শুদ্ধসত্ত্ব লাভের প্রার্থনা–অন্য একটা বিশিষ্ট উদ্দেশ্য সাধনের জন্য। সেই বিশিষ্ট উদ্দেশ্য পরাজ্ঞানলাভ। আদিত্যেভ্যঃ পদে সেই পরাজ্ঞানকে বোঝাচ্ছে। কেউ কেউ আদিত্য শব্দে এখানে সূর্য অর্থ করেন। কিন্তু বহুবচনান্ত আদিত্য শব্দের সূর্য অর্থ কিভাবে সূচিত হয়? পুরাণে প্রচলিত দ্বাদশ আদিত্য এই ভাবও যদি গ্রহণ করা যায়, তাহলেও আদিত্যেভ্যঃ পদে সাধারণ সূর্য অর্থ গ্রহণ করা যায় না। আদিত্য শব্দ জ্ঞানকিরণের দ্যোতক। তাই আমরা ঐ পদে,জ্ঞানকিরণেভ্যঃ পরাজ্ঞানায় অর্থ গ্রহণ করেছি। তৃতীয় মন্ত্রের মধ্যে ভগবানের মহিমা প্রখ্যাপিত হয়েছে। তিনি যে কেবলমাত্র সাধকের ইহলোকের মঙ্গল সাধন করেন, তা নয়, তিনি মানবের পরলোকের মঙ্গলসাধনও করেন। বরং পরলোকের মঙ্গলই বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করে, কারণ ইহলোক তো-দুদিনের মাত্র। এটি অনন্ত জীবনপ্রবাহের এক অতি ক্ষুদ্রতম অংশ মাত্র। ইহলোক কেবলমাত্র পরলোকে যাবার সোপান। কিন্তু এই ইহলোককেও বর্জন করা যায় না। কারণ এই ইহজগত, ইহজীবনই পরলোকের জন্য প্রস্তুত হবার সুযোগ দেয়, অথবা এই ইহজীবনই সাধনার জীবন। তাই পৃথিবীকে কর্মভূমি বলা হয়েছে। এখানে সকর্মের সাধনের দ্বারাই পরলোকের জন্য প্রস্তুত হতে হয়। ভগবান্ এই উভয় জীবনকেই মঙ্গলময় পথে পরিচালিত করেন। চতুর্থ মন্ত্রে বিশেষভাবে দুলোক সম্বন্ধে অথবা পরলোক সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে। ব্যাখ্যা-ব্যপদেশে এই মন্ত্রের প্রথম চরণটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়। প্রথম অংশ–যজ্ঞঃ দেবানাং সুঘ্নং প্রত্যেতু বাক্যাংশ; এবং দ্বিতীয় অংশ–আদিত্যাসর মৃড়য়ন্তঃ ভবত পদ তিনটি। প্রচলিত ব্যাখ্যা অনুসারে ঐ দুটি অংশের ভাব এই যে,-আমাদের যজ্ঞ দেবগণকে সুখী করুক; হে আদিত্যগণ! তুষ্ট হও। দ্বিতীয় চরণের অন্তর্গত অংহোশ্চিৎ পদে দারিদ্র্যপ্রাপ্ত পুরুষের এবং বারিবোবিত্তরা পদে অতিশয়-রূপে ধনপ্রদাতা প্রতিবাক্য দৃষ্ট হয়। প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতেও ভাষ্যের অনুরূপ অর্থই গৃহীত হয়েছে। সেই অনুসারে দ্বিতীয় চরণের মর্ম এই যে, আদিত্যগণের অনুগ্রহ আমাদের অভিমুখে প্রেরিত হোক; এবং সেই অনুগ্রহ দরিদ্র জনের পক্ষে প্রভূত ধনের কারণ হোক। ষষ্ঠ মন্ত্রটির ভাব প্রার্থনামূলক। জ্যোতিঃস্বরূপ দেবতাকে সম্বোধন করে মন্ত্র উচ্চারিত হয়েছে। অনুবাকের সর্বশেষ মন্ত্রটির বিষয়–শুদ্ধসত্ত্ব। এটির ভাব প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার অর্থ এই যে, আমরা যেন শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা অমৃত লাভে সমর্থ হই। ষষ্ঠ মন্ত্রটির সাথে এই মন্ত্র একত্র পাঠ করলেই এর ভাব পরিষ্কার হবে।এই অনুবাকের প্রথম মন্ত্রটি সামবেদ-সংহিতার ঐন্দ্ৰপর্বে পাওয়া যায়; পঞ্চম মন্ত্র ঋগ্বেদ-সংহিতার প্রথম মণ্ডলের ষড়াধিক-শততম সূক্তের প্রথমা ঋক-রূপে পাওয়া যায়] ॥২২।
.
ত্রয়োবিংশ অনুবাক
মন্ত্র- বামমদ্য সবিতৰ্বামমু শো দিবেদিবে বামমম্মুভ্যং সাবী। বামস্য হি ক্ষয়স্য বেব ভূরেরয়া ধিয়া বামভাজঃ স্যাম। উপমগৃহীতোহসি দেবায় ত্বা সবিত্রে ॥ ২৩
মর্মার্থ- বিশ্বের কারণভূত হে দেব! অদ্য পরমধন আমাদের প্রদান করুন; কল্যও পরমধন প্রদান করুন, অর্থাৎ নিত্যকাল পরমধন প্রদান করুন; হে দেব! আপনিই পরমাশ্রয়স্বরূপ প্রভূত পরমধনের দাতা হন; হে দেব! আমাদের প্রার্থনার দ্বারা আমরা যেন পরমধনসম্পন্ন হই। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে,-হে ভগবন্! কৃপাপূর্বক আমাদের পরমধন প্রদান করুন)। হে দেবভাব! আপনি সাধক-হৃদয়ে উৎপন্ন হন; জগৎকারণস্বরূপ দেবতার জন্য আমরা যেন আপনাকে প্রাপ্ত হই। ২৩
(প্রথম মন্ত্রের দেবতা-সবিতা অর্থাৎ সবিতাদেবকে লক্ষ্য করে মন্ত্রটি উচ্চারিত হয়েছে। সবিতা পদ প্রসবার্থক সূ ধাতু থেকে উৎপন্ন; যিনি বিশ্বকে প্রসব করেছেন, অর্থাৎ যাঁর থেকে বিশ্ব উৎপন্ন হয়েছে, তাঁকেই সবিতা বলে। এই সবিতা বলতে পরমব্রহ্মকেই বোঝায়। জগতের উৎপত্তির পরম কারণ একমাত্র তিনিই। কিন্তু কেউ কেউ, এমন কি ভাষ্যকার পর্যন্ত কোন কোনও স্থলে সবিতা পদের অর্থ করেছেন– সূর্য। কিন্তু সূর্য বলতে যদি আলোকময় জড়পিণ্ড সূর্যকে বোঝায়, তাহলে এই অর্থ কখনই সঙ্গত বলে গৃহীত হতে পারে না। অপিচ, সূর্য বলতে বাহ্যজগতের আলোকময় জড়পিণ্ডকে বোঝালেও সুর্য শব্দে জ্যোতির আধার সেই পরমদেবতাকে,–জ্ঞানস্বরূপকে বোঝায়। সূর্য শব্দের এই আধ্যাত্মিক অর্থই আমরা গ্রহণ করেছি। সেই দেবতার কাছে প্রার্থনা করা হয়েছে-বামং-পরমমঙ্গলং, পরমধনং। এই প্রার্থনার প্রথম অংশ–অদ্য অস্মভ্যং বামং সাবীঃ–অদ্য আমাদের পরমধন প্রদান করুন। কিন্তু অদ্য দিলেই কি চলবে? মন্ত্র বলছেন-স্বঃ-না শুধু অদ্য নয়, কল্যও বটে? কল্য অর্থে কোন নির্দিষ্ট কালসীমা বোঝায় না। অধিকন্তু একটি নিত্যকালের দ্যোতক। তাই পরবর্তী অংশ–দিবে দিবে বামং–প্রত্যেক দিন, অনন্তকাল আমাদের ধনদান করুন।-বামভাজঃ স্যাম–আমরা যেন ভগবানের কৃপায় পরমধনের অধিকারী হই।এই অনুবাকের দ্বিতীয় মন্ত্রে সিদ্ধিলাভের অন্য একটি উপায়ের কথা বলা হয়েছে। সাধকগণ শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করেন, আমরা যাতে ভগবৎ প্রাপ্তির জন্য শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করতে পারি, মন্ত্রে তারই জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। এই অনুবাকের প্রথম মন্ত্রটি ঋগ্বেদ-সংহিতার ষষ্ঠ মণ্ডলের একসপ্ততিতমসূক্তের ষষ্ঠী ঋক-রূপে পাওয়া যায়] ॥২৩৷৷
.
চতুর্বিংশ অনুবাক
মন্ত্র- অব্দেভিঃ সবিতঃ পায়ুভিং শিবেভিরদ্য পরিপাহি নো গয়। হিরণজিহুঃ সুবিতায় নব্যসে রক্ষা মাকিনো অঘশংস ঈশত। উপযামগৃহীতোহসি দেবায় ত্বা সবিত্রে ॥২৪৷
মর্মার্থ- বিশ্বের কারণভূত হে দেব! আপনি সকলের আকাঙ্ক্ষিত মঙ্গলসাধক জ্যোতির দ্বারা আমাদের চরম-আশ্রয়কে নিত্যকাল সর্বতোভাবে রক্ষা করুন। হে দেব! সান্ত্বনাদায়ক আপনি চির নূতন অর্থাৎ পরম সুখের জন্য আমাদের পরিপালন করুন; আমাদের রিপুগণ বিনষ্ট হোক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে,–হে ভগবান! কৃপাপূর্বক আমাদের সর্বতোভাবে রক্ষা করুন, আমাদের রিপুগণকে বিনাশ করুন)। হে দিব্যজ্যোতিঃ! আপনি সাধক-হৃদয়ে উৎপন্ন হন; জগৎকারণের স্বরূপ দেবতার জন্য আপনাকে যেন প্রাপ্ত হই) ॥২৪৷
[ত্রয়োবিংশ থেকে ষড়বিংশ অনুবাকের প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে প্রায় প্রত্যেক মন্ত্রের দেবতা সবিতা অর্থাৎ জগৎ প্রসবকারী পরমব্রহ্ম। তিনি সত্যং শিবং সুন্দরং–এখানে তার মঙ্গলময় স্বরূপের পরিচয় দেওয়া হয়েছে। শিবং–চরম ও পরমমঙ্গল। তাই প্রার্থনা–শিবেভিঃ পায়ুভিঃ ন গয়ং পরিপাহি মঙ্গলের দ্বারা অথবা মঙ্গলের সাথে আমাদের পরমাশ্রয় রক্ষা করুন। দ্বিতীয় মন্ত্রটির দুটি অংশেই প্রার্থনা আছে। প্রথম অংশের প্রার্থনার মূল কথা রক্ষ–আমাদের রক্ষা করো। কি জন্য? উত্তর,-নব্যসে সুবিতায়–চিরন্তন সুখের জন্য। দ্বিতীয় অংশের প্রার্থনার মর্ম-রিপুবিনাশ। অঘশংসঃ মা কি ঈশত পাপরিপুগণ যেন প্রভূত্ব লাভ না করে, অর্থাৎ আমাদের রিপুগণ যেন বিনষ্ট হয়। মন্ত্রের প্রথম অংশে যে রক্ষার প্রার্থনা আছে, দ্বিতীয় অংশে সেই রক্ষার স্বরূপ প্রকটিত হয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় মন্ত্রের মধ্যে যে দিব্যজ্যোতিঃর উল্লেখ আছে, তৃতীয় মন্ত্রে সেই দিব্যজ্যোতিঃই মন্ত্রের সম্বোধ্য। মুক্তিলাভের জন্য দিব্যজ্ঞান প্রয়োজন, ভগবানের চরণ লাভ করতে হলে দিব্যজ্ঞানের একান্ত আবশ্যক।–এই অনুবাকের প্রথম মন্ত্রটি ঋগ্বেদ-সংহিতার ষষ্ঠ মণ্ডলের একসপ্ততিতম সূক্তের তৃতীয় ঋক্-রূপে পাওয়া যায়] ॥২৪৷
.
পঞ্চবিংশ অনুবাক
মন্ত্র- হিরণ্যপাণিমূহয়ে সবিতারমুপ হয়ে। সচেত্তা দেবতা পদ। উপযামগৃহীতোহসি দেবায় ত্বা সবিত্রে ॥২৫৷
মর্মার্থ- আমাদের পরিত্রাণের নিমিত্ত সেই হিরণ্যপাণি (জ্ঞানপ্রদ) সবিতা (সত্যপ্রকাশক) দেবকে আহ্বান করছি। সেই দেবতা আমাদের চতুর্বর্গ ইত্যাদি জ্ঞাপক স্থান বা কর্ম জ্ঞাপন করুন। (ভাব এই যে,-সবিতাদেব সাধকের রক্ষক হয়ে চতুর্বর্গপ্রাপক স্থান জ্ঞাপন করেন)। হে রক্ষাশক্তি! আপনি সাধকহৃদয়ে উৎপন্ন হন; জগকারণস্বরূপ দেবতার জন্য আপনাকে যেন প্রাপ্ত হই ॥২৫।
[প্রথম মন্ত্রটির সাথে এক বিচিত্র উপাখ্যান সংশ্লিষ্ট রয়েছে। সবিতা-দেবের বিশেষণে যে হিরণ্যপানিং শব্দ প্রযুক্ত হয়েছে, উপাখ্যান সেই উপলক্ষেই সূচিত হয়ে থাকে। সায়ণের ভাষ্যেও সেই উপাখ্যান বিবৃত রয়েছে। উপাখ্যানটি এই-সূর্যদেব কোনও যজ্ঞে অন্যায়ভাবে হব্যাংশ গ্রহণ করেছিলেন বলে তার হস্ত ছিন্ন হয়; তাতে ঋত্বিকেরা সুবর্ণনির্মিত হস্ত প্রস্তুত করে দিয়েছিলেন। এই জন্যই সবিতা (সূর্য) দেবের নাম হিরণ্যপাণি। কেউ বা বলেন, দেবতার হস্তে সুবর্ণের বলয় ছিল বলে তিনি হিরণ্যপাণি নামে পরিচিত হন। কেউ বা বলেন,-যজমানকে প্রদানের জন্য সুবর্ণ ধারণ করেছিলেন বলে, সবিতার (সূর্যের) নাম হিরণ্যপাণি হয়েছিল। আমরা মনে করি-হিরণ্যপাণিং শব্দের অর্থ–সুবর্ণধারিণং–কি না জ্ঞানপ্রদং। দ্বিতীয় মন্ত্রের সম্বোধ্য বস্তু–রক্ষাশক্তি। ভগবানের যে শক্তিবলে আমরা সকলরকম বিপদ থেকে রক্ষা লাভ করি, মন্ত্রে সেই শক্তিকে রক্ষাশক্তি বলা হয়েছে। ভগবানের অনন্ত শক্তি ও মহিমার মধ্যে রক্ষাশক্তিও একটি। রক্ষাশক্তির কাছে প্রার্থনার অর্থ ভগবানের কাছে প্রার্থনা এবং সেই প্রার্থনার উদ্দেশ্য রিপুগণের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা–এই অনুবাকের প্রথম মন্ত্রটি ঋগ্বেদ-সংহিতার প্রথম মণ্ডলের দ্বাবিংশ সুক্তের পঞ্চমী ঋক্] ॥২৫৷
.
ষড়বিংশ অনুবাক
মন্ত্র- সুশৰ্মহসি সুপ্রতিষ্ঠানো বৃহদুক্ষে নম এষ তে বোনিৰ্বিশ্বেভ্যন্তা দেবেভ্যঃ ২৬৷
মর্মার্থ- হে দেব! আপনি পরমমঙ্গলদায়ক হন; সর্বজীবের শোভন-আশ্রয় হন। হে দেব! শ্রেষ্ঠতম অভীষ্টবর্ষক আপনাকে আমরা নমস্কার করি অর্থাৎ আপনাকে যেন আরাধনা করি। হে শুদ্ধসত্ত্ব! আমাদের হৃদয়-প্রদেশ আপনার আশ্রয়স্থান হোক। (প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করি। হে শুদ্ধসত্ত্ব! সর্বদেবভাব প্রাপ্তির জন্য আপনাকে যেন লাভ করি ॥২৬।
[এই অনুবাকটি চারটি মন্ত্রে বিভক্ত। প্রথম মন্ত্রে নিত্যসত্য-ভগবৎ-মহিমা প্রখ্যাপিত হয়েছে। ভগবান সম্বন্ধে মন্ত্রে দুটি পদ ব্যবহৃত হয়েছে। একটি সুশৰ্মা অন্যটি সুপ্রতিষ্ঠানঃ। প্রথম পদ-সুশমা। শর্মন শব্দের অর্থ কল্যাণ-মঙ্গল। যিনি কল্যাণের আকর, যিনি মানবকে কল্যাণের পথে পরিচালিত করেন, তিনিই সুশর্মা। তাই তাঁকে শিবং বলা হয়। অন্য পদ–সুপ্রতিষ্ঠানঃ অর্থাৎ সকল জীবের শ্রেষ্ঠতম আশ্রয়স্থল। বিশ্ব ভগবানের মধ্যেই অবস্থিত আছে। তার থেকে জগৎ এসেছে, তাতেই বিলীন হবে। জগতের সকলকেই একদিন সেই আদি কারণে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। সেই জন্যই ভগবানকে সুপ্রতিষ্ঠানঃ-চরমায় বলা হয়েছে। দ্বিতীয় মন্ত্রটিতে প্রার্থনা আছে। ভগবানকে বৃহদুক্ষ বলা হয়েছে। উ শব্দ সেচনাৰ্থক, বর্ষণার্থক। যিনি প্রভূত পরিমাণে অভীষ্টবর্ষণ করেন। তাকেই বৃহদুক্ষ বলা যায়। একমাত্র সেই জগৎপিতা ব্যতীত আর কে মানবের সর্বাভীষ্ট পূর্ণ করেন। তাই তিনি অবশ্যই-বৃহদুক্ষ। তৃতীয় মন্ত্রের সম্বোধ্য বিষয়–শুদ্ধসত্ত্ব। আমাদের হৃদয় যাতে শুদ্ধসত্ত্বের আবাসস্থল হয়, অর্থাৎ যাতে আমরা শুদ্ধসত্ত্বের অধিকারী হতে পারি, মন্ত্রের প্রার্থনার তা-ই সারমর্ম। চতুর্থ মন্ত্রে এই প্রার্থনার উদ্দেশ্য বর্ণিত হয়েছে।বিশ্বেভ্যঃ দেবেভ্যঃ অর্থাৎ সকল দেবভাব লাভের জন্য প্রার্থনা)। শুদ্ধসত্ত্ব লাভের উদ্দেশ্য–দেবত্বলাভ বা মুক্তি। সেই উদ্দেশ্যকে লক্ষ্য করে এই মন্ত্রটি উচ্চারিত হয়েছে। অনুবাকের চারটি মন্ত্রকে একত্রে আলোচনা করলে দেখা যায় যে, অনুবাকের মধ্যে মুক্তিলাভের প্রার্থনাই বিশেষ ভাবে পরিস্ফুট হয়েছে) ॥২৬।
.
সপ্তবিংশ অনুবাক
মন্ত্র- বৃহস্পতিসুতস্য ত ইন্দো ইন্দ্রিয়াবতঃ পত্নীবন্তং গ্রহং গৃহাম্যগ্না ই পত্নীবাঃ সজুৰ্দেবেন ত্বা সোমং পিব স্বাহা ॥২৭৷
মর্মার্থ- হে শুদ্ধসত্ত্ব! সৎ-জন-পালক দেবতার পুত্রস্বরূপ (অথবা জ্ঞানদেবতার পুত্রভূত) পরম শক্তিদায়ক আপনার পালনশক্তিযুত দান গ্রহণ করতে যেন সমর্থ হই। পালনশক্তিযুত হে জ্ঞানদেব! আপনি ত্রাণকারক দেবতার সাথে আমাদের হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব গ্রহণ করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে,ভগবান কৃপাপূর্বক আমাদের দীন পূজোপচার গ্রহণ করুন) ॥২৭।
[প্রথম মন্ত্রটির সম্বোধ্য–ইন্দো–অর্থাৎ শুদ্ধসত্ত্ব। দ্বিতীয় মন্ত্রেও শুদ্ধসত্ত্বের প্রসঙ্গ রয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় মন্ত্রে শুদ্ধসত্ত্বের দুটি ভাব বিবৃত হয়েছে।–শুদ্ধসত্ত্ব মূলতঃ ভগবানের বিভূতি। তা ভগবানের মধ্যেই অবস্থিত থাকে। ভগবান্ থেকে যখন জগৎসৃষ্টি হয়, তখন তার সেই বিভূতি বা শক্তি মানুষের মধ্যেও প্রবিষ্ট হয়। সুতরাং এই শক্তিকে দুদিক থেকে দেখা যায়। প্রথম–এটি যখন ভগবানেই নিহিত থাকে। দ্বিতীয়–এটি যখন মানুষের মধ্যে অবির্ভূত বা বিকশিত হয়। প্রথম মন্ত্রে ভগবানে নিহিত অনন্তশক্তিসম্পন্ন শুদ্ধসত্ত্বের মহিমাই প্রখ্যাপিত হয়েছে। এই শক্তিকে বৃহস্পতিপুত্র বলা হয়েছে। বৃহস্পতি, শব্দের অর্থ–বৃহতাং মহতাং, সজ্জনানাং পতিঃ রক্ষকঃ যিনি সৎ-জনের পালক ও রক্ষক, যাঁর কৃপায় সৎ-জনগণ উন্নতিমার্গে অগ্রসর হতে পারেন তাঁকেই বৃহস্পতি বলা হয়েছে। বৃহস্পতি পদের অন্য অর্থ জ্ঞানাধিপতি, অথবা জ্ঞানদেব। এই দুটি অর্থেই পরমব্রহ্মকে বোঝায়। সুতরাং তার পুত্র এই সংজ্ঞার দ্বারা ভগবানের মহান্ বিভূতিকে লক্ষ্য করা হয়েছে। সেই বিভূতিকেই ইন্দো পদের দ্বারা সম্বোধন করা হয়েছে। প্রার্থনা–আমরা যেন শুদ্ধসত্ত্বের পরমদান গ্রহণ করবার উপযুক্ত হই। সেই সম্বন্ধেই বলা হচ্ছে–পত্নীবত্নং। ভাষ্যকার এর অর্থ করেছেন–পত্নীবদ্বেতা। আমরা মনে করি, পালনার্থক পা ধাতু থেকে নিষ্পন্ন এই পদটির অর্থ হয়,-পালনশক্তিযুতং অর্থাৎ যা মানুষকে পালন করে, রক্ষা করে। শুদ্ধসত্ত্বের দান সম্বন্ধে এই বিশেষণ সুপ্রযুক্ত হয়েছে। প্রথম মন্ত্রে আমরা দেখলাম, জ্ঞানস্বরূপ ভগবান্ শুদ্ধসত্ত্বের জনক, উৎপাদক। আর দ্বিতীয় মন্ত্রে আমরা দেখছি, আমাদের হৃদয়নিহিত ভগবৎপুজোপচাররূপ শুদ্ধসত্ত্ব গ্রহণ করবার জন্য তার কাছে প্রার্থনা করা হয়েছে ] ॥২৭৷
.
অষ্টবিংশ অনুবাক
মন্ত্র- হরিরসি হারিযোজনো হৰ্যোঃ স্থাতা বজ্রস্য ভর্তা পৃশ্নেঃ প্রেতা তস্য তে দেব সোমেষ্টযজুযঃ স্তুতন্তোমস্য শস্ত্যেকথস্য হরিবং গ্রহং গৃহূমি হরীঃ স্থ হৰ্যোৰ্দ্ধানঃ সহসোমা ইন্দ্রায় স্বাহা ॥২৮।
মর্মার্থ- হে দেব! আপনি পাপহারক হন; অপিচ, ভগবৎ-প্রাপক হন। আপনি পাপনাশিকা শক্তির প্রতিষ্ঠাপয়িতা হন। হে দেব! আপনি রক্ষাস্ত্রের পোষক হন। হে দেব! আপনি জ্ঞানকিরণের প্রেরয়িতা অর্থাৎ পরাজ্ঞানদায়ক হন। সত্ত্বের স্বরূপ হে পরমদেব! ইষ্টপ্রাপক, স্তোমের দ্বারা আরাধিত, বেদমন্ত্রের দ্বারা আরাধনীয় প্রসিদ্ধ আপনার পাপানাশকশক্তিযুত দান যেন গ্রহণ করতে সমর্থ হই। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা পরমমঙ্গল লাভ করি)। হে পাপনাশিকাশক্তিদায়ক সৎ-বৃত্তিসমূহ! শুদ্ধ সমন্বিত হয়ে তোমরা আমাদের পাপ-নাশক হও। ভগবান্ ইন্দ্রদেবের জন্য অর্থাৎ তাকে প্রাপ্তির জন্য আমাদের পুজোপচার তাঁর উদ্দেশে গমন করুক। (ভাব এই যে, আমরা যেন ভগবৎপূজাপরায়ণ হই) ॥ ২৮৷৷
[এই অনুবাকের সাতটি মন্ত্রের মধ্যে প্রথম চারটিতে ভগবানের মহিমা বিবৃত হয়েছে। প্রথম মন্ত্রের পাপহারক এবং আমাদের মোক্ষপ্রাপ্তির অর্থাৎ তার চরণপ্রাপ্তির উপায়কারী ভগবান্ সম্পর্কে বলা হয়েছে, হরিঃ অসি হারিযোজনঃ। হরিঃ শব্দ হরণার্থক হৃ ধাতু নিষ্পন্ন। যিনি মানবের সকল দুঃখদৈন্য হরণ করেন, তিনিই হরিঃ নামবাচ্য। এই অর্থেই হরিঃ অসি অংশ ব্যবহৃত হয়েছে। হারিযোজনঃ পদের অর্থ-যা আমাদের পাপহারক দেবতায় সংযুক্ত, মিলিত করে দেয় তা-ই হারিযোজনঃ। ভগবান্ নিজেই এই ব্যবস্থা করেছেন। মানুষ যাতে তার চরণে পৌঁছাতে পারে তিনি তার উপায় বিধান করেন। দ্বিতীয় মন্ত্রের ভাব–ভগবানই মানবের মধ্যে পাপনাশের শক্তি–রিপুজয়ের ক্ষমতা প্রদান করেন প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি বর্জস্য ভর্তা–রিপুনাশক অস্ত্রের পোষণকর্তা। অর্থাৎ দুর্বল মানুষকে রিপুরূপ অসুরের আক্রমণ থেকে রক্ষার মানসে তিনি হস্তে অস্ত্রধারণ করে আছেন। তৃতীয় মন্ত্রের এটাই বক্তব্য। চতুর্থ মন্ত্রের পৃশ্নি শব্দ কিরণবাচক, ভগবানই পরাজ্ঞানের অধিপতি, জ্ঞানস্বরূপ দেবতা–তিনিই মানুষের হৃদয়ে বিশুদ্ধ জ্ঞান প্রদান করেন; তার প্রদত্ত সেই জ্ঞানের আলোকেই মানুষ নিজের গন্তব্য পথ জানতে পারে, বুঝতে পারে। তাই তিনি-পৃশ্নেঃ প্রেতা। পঞ্চম মন্ত্রের সম্বোধ্য শুদ্ধসত্ত্বকে ইষ্টযজুষঃ স্তুতস্তামস্য প্রভৃতি বিশেষণে বিশেষিত করা হয়েছে। শুদ্ধসত্ত্বস্বরূপ ভগবানের পরমদান যেন আমরা গ্রহণ করতে পারি, মন্ত্রে তা-ই প্রার্থনা করা হয়েছে। শুদ্ধসত্ত্বের দান যে মুক্তি, পরোক্ষভাবে তা-ই এই মন্ত্রের প্রার্থনা। ষষ্ঠমন্ত্রের ধানাঃ পদটির ভাষ্যকার অর্থ করেছেন–ভৃষ্টান্তণ্ডুলা। কিন্তু হঠাৎ এখানে তণ্ডলের কোনও প্রয়োজনীয়তা নেই, এবং এখানে তণ্ডুল অর্থ করলে মন্ত্রের অর্থের পৌর্বাপর্য বা সঙ্গতি রক্ষিত হয় না। আমরা মনে করি, ধারণার্থক ধা ধাতু থেকে ধান শব্দ নিষ্পন্ন হয়েছে। সুতরাং হর্যোধানাঃ পদ দুটির অর্থ হয় পাপনাশিকাশক্তিদায়কাঃ। সপ্তম মন্ত্রের ভাব এই যে, আমাদের পূজা আরাধনা যেন ভগবানের চরণে পৌঁছায়, যাতে আমরা সম্যভাবে ভগবানের আরাধনায় নিযুক্ত হয়ে মুক্তি লাভে সমর্থ হই] ॥২৮
.
ঊনত্রিংশ অনুবাক
মন্ত্র- অগ্ন আয়ুংষি পবস আ সুবোৰ্জমিষং চ নঃ। আরে বাধষ দুচ্ছনা। উপযামগৃহীতোহস্যগয়ে ত্বা তেজস্বত এষ তে যোনিরগয়ে ত্ব তেজষতে ॥ ২৯৷
মর্মার্থ- হে জ্ঞানদেব! সৎকর্মের সাধনশক্তি আমাদের প্রদান করুন এবং শক্তিপ্রদায়ক সিদ্ধি আমাদের প্রদান করুন; রিপুবর্গকে আমাদের নিকট হতে দূরে প্রেরণ করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে,-হে ভগবন্! কৃপাপূর্বক আমাদের রিপুজয়ী এবং সকর্মসমৰ্থ করুন)। হে শুদ্ধসত্ত্ব! আপনি সাধকগণের হৃদয়ে উৎপন্ন হন; জ্যোতির্ময় জ্ঞান-দেবের জন্য আমরা যেন আপনাকে প্রাপ্ত হই। হে শুদ্ধসত্ত্ব! আমাদের হৃদয় প্রদেশ আপনার আশ্রয়স্থান হোক। (প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করি)। হে শুদ্ধসত্ত্ব! জ্যোতির্ময় জ্ঞানদেবের জন্য আপনাকে যেন প্রাপ্ত হই ॥২৯।
[এই অনুবাকের প্রথম মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। মন্ত্রে সাধনশক্তিলাভ ও রিপুজয়ের জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। প্রথমে শক্তি লাভ, তারপর সিদ্ধি। আমরা আয়ুংসি পদে সৎকর্মশক্তিং অর্থ গ্রহণ করেছি। দ্বিতীয় মন্ত্রের ভাব এই যে, আমরা যেন শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা পরাজ্ঞানের অধিকারী হতে পারি। সেখানে বলা হয়েছে, শুদ্ধসত্ত্ব সাধকদের হৃদয়ে উপজিত হয়; তার প্রতি লক্ষ্য করেই তৃতীয় মন্ত্রে বলা হয়েছে–আমাদের হৃদয়ও যেন শুদ্ধসত্ত্বের লীলাভূমি হয়। চতুর্থ মন্ত্রের ভাব দ্বিতীয় মন্ত্রের দ্বিতীয়াংশেরই অনুরূপা–এই অনুবাকের প্রথম মন্ত্রটি সামবেদ-সংহিতায় (৪৭-৬অ-৫খ-১সা) প্রাপ্তব্য)] ॥২৯।
.
ত্রিংশ অনুবাক
মন্ত্র- উত্তিষ্ঠমোজসা সহ পীত্বা শিপ্রে অবেপয়ঃ। সোমমিন্দ্ৰ চমু সুতম্। উপযামগৃহীতোহসীন্দ্রায় বৌজস্বত এষ তে যোনিরিন্দ্রায় বৌজস্বতে ॥৩০৷
মর্মার্থ- বলাধিপতে হে দেব! আত্মশক্তির সাথে হৃদয়ে আগমন করে আমাদের হৃদয়স্থিত বিশুদ্ধ সত্ত্বভার গ্রহণ করে জ্যোতিঃতে আমাদের স্থাপন করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে,-ভগবান কৃপাপূর্বক আমাদের হৃদয়স্থিত শুদ্ধসত্ত্বরূপ পুজোপহার গ্রহণ করুন)। হে পরাজ্ঞান! আপনি সাধকের হৃদয়ে উৎপন্ন হন। পরমশক্তিশালী ভগবান্ ইন্দ্রদেবের জন্য আপনাকে যেন প্রাপ্ত হই। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক! প্রার্থনার ভাব এই যে,-শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা আমরা যেন ভগবানকে লাভ করি)। হে পরাজ্ঞান! আমাদের হৃদয়প্রদেশ আপনার আশ্রয়স্থান হোক; পরমশক্তিশালী ভগবান্ ইন্দ্রদেবের জন্য আপনাকে যেন প্রাপ্ত হই ॥৩০।
[ভাষ্যকার এই অনুবাকের মন্ত্রের ব্যাখ্যায় ইন্দ্রের সোমরস পানের এক চিত্র অঙ্কিত করবার চেষ্টা করেছেন। শিপ্রে অবেপয়ঃ পদ দুটির ব্যাখ্যা করেছেন-হনু অকম্পয় মদাবেশাদিতি ভাবঃ। অর্থাৎ-হে ইন্দ্র! সোমরস পান করে যখন তোমার খুব মত্ততা উপস্থিত হবে, তখন তোমার হনু অর্থাৎ চোয়াল কম্পিত করো। মাতালেরা মদ্যপান করে কখনও চোয়াল কম্পিত করে কি না, জানি না, কিন্তু ইন্দ্রদেবের চোয়াল কম্পন কিরকম ব্যাপার তা আমাদের নিকট সম্পূর্ণ দুর্বোধ্য। এই শিপ্রে পদ আমরা অন্যত্রও পেয়েছি, তাতে ওটি জ্যোতি অর্থ প্রকাশ করে, তা দেখেছি। চ পদে হৃদয়রূপ পাত্রকেই লক্ষ্য করে। শুদ্ধসত্ত্ব হৃদয়রূপ পাত্রেই অভিযুক্ত হয়; তাই ঐ পদে আমরা হৃদয়কেই লক্ষ্য করেছি। এই প্রথম মন্ত্রের একটি প্রচলিত অনুবাক-তুমি অভিষণফলকে অভিযুত সোম পান করে বলের সাথে উঠে হনুদ্বয় কম্পিত করো।–পূর্বের অনুবাকে দ্বিতীয় তৃতীয় ও চতুর্থ মন্ত্রে শুদ্ধসত্ত্বের মহিমা প্রখ্যাপিত হয়েছে; অথবা শুদ্ধসত্ত্বের কাছে প্রার্থনা করা হয়েছে। আলোচ্য অনুবাকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় মন্ত্রে পরাজ্ঞানের কাছে প্রার্থনা করা হয়েছে। শুদ্ধসত্ত্ব ও পরাজ্ঞান উভয়ই ভগবানের বিভুতি। এই দুটির মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ, আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি। এই ত্রিংশ অনুবাকের দ্বিতীয় মন্ত্রে পরাজ্ঞানের দ্বারা ভগবৎ প্রাপ্তির জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। তৃতীয় মন্ত্রে প্রার্থনাও কতকাংশে দ্বিতীয়টির অনুরূপ। আলোচ্য মন্ত্রে প্রার্থনা করা হয়েছে যে, আমাদের হৃদয় যেন জ্ঞানের আলোকে উদ্ভাসিত হয়। এই প্রার্থনার উদ্দেশ্য কি? তার উত্তরে মন্ত্র বলছেন তেজস্বতে ইন্দ্রায়-পরমশক্তিশালী ভগব ইন্দ্রদেবকে লাভ করবার জন্য আমরা যেন পরমশক্তির উৎস পরাজ্ঞান লাভ করতে সমর্থ হই। কারণ পরাজ্ঞানের সাহায্যেই ভগবানকে লাভ করা যায়। এই অনুবাকটির প্রথম মন্ত্র সামবেদ-সংহিতার উত্তরার্চিকে (৬অ-তদ-৩-১সা) দ্রষ্টব্য] ॥৩০।
.
একত্রিংশ অনুবাক
মন্ত্র- তরণিৰ্বিশ্বদর্শতে জ্যোতিষ্কৃদসি সূৰ্য্য। বিশ্বমা ভাসি নোচন। উপযামগৃহীতোহসি সূৰ্য্যায়ঃ ত্বা ভ্রাজস্বত এষ তে যোনিঃ সূর্যায় ত্বা ভ্রাজস্বতে ॥৩১।
মর্মার্থ– হে সূর্য! (সর্বান্তর্যামী-হেতু সকলের প্রেরণকর্তা পরমাত্মা)! তুমি এই ভবসাগরে একমাত্র উদ্ধারকর্তা, মুক্তিলিঙ্গু জীবগণের দর্শনযোগ্য, জ্যোতিষ্কগণের সৃষ্টিকর্তা; তুমিই দৃশ্যমান সকল পদার্থকে প্রকাশ করছ। (ভাব এই যে,-হে পরমাত্ম! তুমিই এই জগতের স্রষ্টা, প্রকাশক ও উদ্ধারকর্তা)। হে দিব্যজ্যোতিঃ! আপনি সাধকের হৃদয়ে উৎপন্ন হন; জ্যোতির্ময় জ্ঞানদেবের জন্য আমরা যেন আপনাকে প্রাপ্ত হই। হে দিব্যজ্যোতিঃ! আমাদের হৃদয়-প্রদেশ আপনার নিবাসস্থান হোক; জ্যোতির্ময় জ্ঞানদেবের জন্য আপনাকে যেন প্রাপ্ত হই ॥৩১৷৷
[এই অনুবাকের প্রথম মন্ত্রের সব পদই আত্মজ্ঞানের অনুকূল। কিন্তু রুচি-বৈচিত্র্যের ভিন্নভাবে পরিণত। ভাষ্যকার অনুকূল পদ প্রয়োগ করেছেন; কিন্তু লক্ষ্য রাখতে পারেননি। তিনি মন্ত্রের অর্থে লিখেছেন,-হে সূর্য! ত্বং তরণিস্তারিতা–তুমি খুব বেগশালী; যে পথে অপরে যেতে পারে না, তুমি সেখানে যেতে পার।-সূর্যের বেগগামিত্ব যে সম্ভব নয়, এখানে তা তিনি লক্ষ্য করতে পারেন নি। ভৌগোলিক দৃষ্টান্তে সূর্য জড় ও স্থির, পৃথিবী গতিশীলা। উপনিষদ-চিন্তায় সকল বস্তুই এক চেতনের স্পন্দনে স্পন্দিত। সে পক্ষে তরণিঃ পদের লক্ষ্য–আত্মা বা চেতন। কারণ বেগগমিত্ব আত্মারই সম্ভবপর; তা ব্যতীত অপরে এটি অসম্ভব। উপনিষদ দৃষ্টান্তে পাওয়া যায়,অপানিপাদো জবননা গ্রহীতা পশ্যত্যচক্ষুঃ স শৃণোত্যকর্ণঃ।–তার হাত নেই, কিন্তু সকল কর্মই যথানিয়মে সম্পন্ন করছেন; তার পা নেই, কিন্তু খুব বেগে অনন্তবিশ্বে পরিভ্রমণ করছেন; তার চক্ষুঃ নেই, তা হলেও তিনি বিশ্বদ্রষ্টা; তাঁর কর্ণ নেই, তবু কিন্তু তিনি সর্বশ্রোতা।–সূর্য বলতে এখানে সেই আত্মাকেই বোঝাচ্ছে। আত্মা চেতন বা অন্তর্যামী এবং তরণি অর্থে বেগগামী–এটি স্বীকার করলেই ভাষ্যকারের ভাবের মধ্যেও সামঞ্জস্য লক্ষ্য করা যাবে। কিন্তু ভাষ্যকার তা লক্ষ্য করেননি; এবং আত্মজ্যোতিঃ ভিন্ন যে জ্যোতিঃই নেই, এটাও চিন্তা করেননি।ন তত্র সূর্যো ভাতি ন চন্দ্রতারকং নেমা দিতে ভান্তি কুতোহয়মগ্নি/তমেব ভামনুভাতি সর্বং তস্য ভাসা সর্বমিদং বিভাতি।–সেখানে সূর্য নেই, তারকা নেই, বিদ্যুৎ নেই, অগ্নি নেই, কেবল তার দীপ্তি। তাঁর দীপ্তিতেই সকল দীপ্ত। আর তার বিভায় নিখিল জগৎ বিভাত। এ মন্ত্র সেই ভূমারই লক্ষ্যস্থল। ভাষ্যকার বোধ হয় তরণি শব্দের বেগগামিত্ব অর্থ করে চিত্তপ্রসন্নতা লাভ করতে পারেননি; তাই তিনি যদ্বা বলে পক্ষান্তর অবলম্বন করেছেন। কারণ, পূর্বের অর্থে সংশয় না এলে, কখনও অর্থান্তরের অবকাশ হতে পারে না। বোধ হয়, এই জন্যই তিনি সন্দিহান হয়ে বলেছেন,–তরণিঃ রোগনাশকঃ; সে পক্ষে প্রার্থনা এই,-হে সূর্য! তোমার উপসাকদের কখনও রোগ থাকে না, তুমি রোগ হতে তোমার ভক্তদের পরিত্রাণ করো।–আমরা ভাষ্যকারের এই দ্বিতীয় অর্থেরই অনুসরণ করেছি। তবে তিনি সাধারণতঃ দৈহিক পীড়াকেই লক্ষ্য করেছেন; আমরা আধ্যাত্মিক আধিভৌতিক ও আধিদৈবিক এই তিনরকম পীড়াকেই লক্ষ্য করছি; যেহেতু মানব প্রতিনিয়ত এই তিনরকম সন্তাপে সন্তপ্ত। একদিকে জন্মজরামৃত্যুর ভীষণ আক্রমণ ইত্যাদি (আধ্যাত্মিক পীড়া); অপর দিকে সর্পভীতি, ব্যাঘ্রের দারুণ শঙ্কা ইত্যাদি (আধিভৌতিক পীড়া); আবার অন্যত্র বজ্রপাতের তীব্র শিহরণ ইত্যাদি (আধিদৈবিক পীড়া)। মন্ত্রে প্রার্থনা করা হয়েছে,-হে ভগবন্! তুমি ভবব্যাধিরূপ দুস্তর সংসার সাগরের নিস্তারক! তুমি পরম জ্যোতিঃ! তুমি সর্বপ্রতিষ্ঠাতা। তোমা হতেই দৃশ্যমান প্রপঞ্চ পূর্ণদীপ্ত। তোমা হতেই এ বিশ্ব প্রকাশিত। তুমি হৃদয় গগনে প্রকাশিত হও। জড় জগতের অন্ধকার যেমন সূর্যদীপ্তির ভয়ে কোন এক অতলস্পর্শী পর্বতের গহ্বরে লুকিয়ে পড়ে, হে জ্যোতির্মুর্তে, তোমার পবিত্র প্রভায় আমার হৃদয়ের অজ্ঞান অন্ধকার চিরদিনের মতো দূরীভূত হোক। আমি আলোকিত হই,–আমি পবিত্র হই–আমি যেন আমার যথার্থ পথের অনুসরণ করতে সামর্থ্য পাই। আলোকময়!–আলোক বিতরণ করো।–দ্বিতীয় মন্ত্রের সম্বোধ্য পদ–দিব্যজ্যোতিঃ বা ভগবৎ-জ্যোতিঃ। ভগবানের যে দিব্য-আলোক লাভ করে মানব ধন্য হয়, সেই দিব্য-আলোক সাধনার দ্বারা লব্ধ হয়। কিন্তু আলোক লাভ করাই যথেষ্ট নয়, এই জ্ঞানের আলোক অথবা দিব্যজ্যোতিঃ লাভের মহান উদ্দেশ্য–ভগবৎপ্রাপ্তি।-তৃতীয় মন্ত্রের প্রার্থনার ভাব অনেকটা দ্বিতীয়টিরই অনুরূপ। মানবের বিশুদ্ধ পবিত্র হৃদয়েই ভগবান্ আপন আসন প্রতিষ্ঠিত করেন। তাই প্রার্থনায় বলা হয়েছে-এষঃ তে যোনিঃ। অর্থাৎ আমাদের হৃদয়দেশই তোমার আশ্রয়স্থান হোক।এই অনুবাকের প্রথম মন্ত্রটি ঋগ্বেদ-সংহিতার প্রথম মণ্ডলে পাওয়া যায়] ॥৩১।
.
দ্বাত্রিংশ অনুবাক
মন্ত্র- আ প্যায়স্ব মদিন্তম সোম বিশ্বাভিরাতিভিঃ। ভবা নঃ সপ্রথশস্তমঃ ॥৩২।
মর্মার্থ- শ্রেষ্ঠ জ্ঞানন্দপ্রদ হে শুদ্ধসত্ত্ব! সকল রক্ষাশক্তির দ্বারা আপনি আমাদের বর্ধিত করুন– রক্ষা করুন; (ভাব এই যে,-শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে আমরা যেন পরাশক্তি লাভ করি); হে দেব! আপনি আমাদের শ্রেষ্ঠ রক্ষক হোন; (প্রার্থনা–শুদ্ধসত্ত্ব আমাদের পরমা গতি প্রদান করুন) ॥৩২।
সুচিন্তাহীন ব্যাখ্যাকারদের দ্বারা বেদমন্ত্রের অর্থ-বিকৃতি কিভাবে সংসাধিত হয়েছে, এই মন্ত্রটিকে তার একতম দৃষ্টান্ত-রূপে উপস্থিত করা যায়। মন্ত্রে সোমের বিশেষণ (সম্বোধন) মদিন্তম পদ আছে। মদঃ পদে হর্ষ বা আনন্দ অর্থ আসে। তা থেকেই মদিন্তম পদের ব্যুৎপত্তি। অথচ প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে ঐ পদে মদকর বা মত্ততাপ্রদ অর্থ গ্রহণ করা হয়। সোমলতার রসে মাদক-দ্রব্য প্রস্তুত হয়ে থাকে–এই অবাঞ্ছিত কল্পনাই ঐরকম অর্থ গ্রহণের কারণ।-শুদ্ধসত্ত্ব আমাদের সকল জ্ঞান প্রদান করুন। তিনি আনন্দময়; তার দ্বারা আমরা যেন জ্ঞানানন্দ লাভ করি। মন্ত্রের প্রথম চরণে, আমরা বলি, এই ভাব পরিব্যক্ত। তাই বলা হয়েছে-সর্বেঃ উতিভিঃ আপ্যায়স্ব। তারপর, তাঁকে বলা হয়েছে, তিনি সুপ্রথমঃ সখা হোন। প্রথঃ শব্দে রক্ষা মঙ্গল প্রভৃতি অর্থ প্রাপ্ত হওয়া যায়। কিন্তু সে প্রথঃ কেমন? না–সু এবং তম; অর্থাৎ মিত্র হয়ে, সু ও শ্রেষ্ঠ রক্ষাকে তিনি আমাদের প্রদান করুন–দ্বিতীয় চরণের এটাই প্রার্থনা। এ প্রার্থনা মাদকদ্রব্যের উপাদানভূত লতার উদ্দেশে কখনই বিহিত হতে পারে না। হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্ব (সোম) উদ্দীপিত হয়ে, আমাদের পরম মঙ্গল প্রদান করুন–এটাই এখানকার তাৎপর্য।–এই অনুবাকটি ঋগ্বেদ-সংহিতায় (১ম-৯১সু-১৭ঋ) পরিদৃষ্ট হয়] ॥৩২৷৷
.
ত্রয়ত্রিংশ অনুবাক
মন্ত্র- ঈয়ুষ্টে যে পূৰ্ব্বতরামপশ্যহ্বাচ্ছন্তীমুষসং মাসঃ।। অম্মাভিরূ নু প্রতিচক্ষ্যাহভূদো তে যন্তি যে অপরীধু পশ্যাম্ ॥৩৩।
মর্মার্থ- যে সকল প্রসিদ্ধ (সমাধিমগ্ন) মনুষ্যগণ (মণীষীবর্গ) অজ্ঞাননাশিনী, জ্যোতিঃ-স্বভাবা, আদিভূতা, জ্ঞানদায়িনী উষা-দেবীকে দর্শন করেছেন, সেই সকল মহাপুরুষেরা মহেশ্বর পরমাত্মাকে লাভ করেছেন; এইরকম ভাবে, তাদের অনুসরণের দ্বারা, ব্রহ্মচর্যপরায়ণ আমাদের কর্তৃক নিশ্চয়ই তিনি পরিদৃষ্ট হন; অর্থাৎ, মহাপুরুষদের পথ অনুসরণ করলে আমাদের দ্বারাও ভগবান দৃষ্ট হন; অপিচ, এই রীতির অনুসরণ করে, যে সব সংযত-পুরুষ পরবর্তী সংসারসমূহে কর্ম সকল দর্শন করবেন; অর্থাৎ, কর্মক্ষেত্রগুলিতে বিচরণ করেন; সেই সব মুমুক্ষুগণ প্রণবরূপী ভগবানকে প্রাপ্ত হন। (ভাব এই যে,-যে রীতির দ্বারা পূর্বমনীষিগণ ভগবানকে লাভ করেছেন, সেই রীতিতে মসংযমশীল হয়ে, আমরাও যেন তাকে লাভ করতে সমর্থ হই) ॥৩৩৷
[জ্ঞানদায়িনী ঊষা (ভগবানের অন্যতম বিভূতি) হৃদয়ে এলে মুমুক্ষুর যে যে অবস্থা হয়; অর্থাৎ, চিত্তবৃত্তির বিলয় বা সমাধিলাভের পরে জীবের যা থাকে,–এ মন্ত্র তারই দ্যোতনা করছে। এই জন্য মন্ত্রের উং ও ও পদ দুটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে উ-কারকে ও ও-কারকে পাদপূরণের জন্য ব্যবহৃত করা হয়েছে। কিন্তু অলৌকিক বেদের মধ্যে শব্দের পাদপূরণের জন্য ব্যবহার সঙ্গত নয়। এই অবিসম্বাদী অভিমতের ভিত্তি স্থাপন করে বলা যেতে পারে যে,-উ অর্থে মহেশ্বর, আর ও অর্থে প্রণবরূপী ভগবান্ বা তিন গুণের সাম্য-অবস্থার অতীত পুরুষ। সমাধিমগ্ন মনীষী যাঁরা, তারা অজ্ঞাননাশিনী জ্যোতিঃস্বভাবা আদিভূতা জ্ঞানদায়িনী, উষাকে দর্শন করেন। অজ্ঞান নষ্ট হলেই, জ্যোতির বিকাশ; জ্যোতির বিকাশ হলেই জগৎকারণ–জ্ঞানদায়িনী উষার বিমল হাসি। এই হাসি যাঁরা উপভোগ করতে পারেন, তাঁরাই উ-কার বা পরম শিবকে লাভ করতে সমর্থ হন। এই যে ভগবৎ-দর্শন বা আত্মস্বরূপ-বোধ, এর মূলে জ্ঞান। আদি ও অনন্ত এই জ্ঞান লাভ করে যাঁরা ভগবাকে প্রাপ্ত হন বা আত্মানুভূতি লাভ করেছেন, তারাই এ রাজ্যের বা এ সৃষ্টির রীতির হস্ত হতে পরিত্রাণ পেয়েছেন। অজ্ঞান ও জ্ঞান, রাত্রি ও দিবস–এই চিরন্তনী রীতির অনুবর্তন এখানে চিরদিন। এই মন্ত্রের মর্ম এই যে,-যে রীতিতে, যে জ্ঞানদায়িনী উষার পথের পথিক হয়ে, যে জ্ঞানমার্গ অবলম্বন করে, মহাপুরুষগণ মুক্ত হয়ে গেছেন; আমরাও তাকেই অবলম্বন করে মুক্ত হতে চলেছি, এবং ভবিষ্যতেও জীবগণ সেই পথ অবলম্বন করে পরিমুক্ত হবেন। এটাই ভগবানের জ্ঞানন্দায়িনী চৈতন্যময়ী শক্তির ত্ৰৈকালিক সত্তা–যা জীবের নিতান্ত লক্বব্য।–এই মন্ত্রটি ঋগ্বেদ-সংহিতার প্রথম মণ্ডলের একনবতিতম সূক্তের সপ্তদশী ঋক্-রূপে পাওয়া যায় ] ॥৩৩৷৷
.
চতুস্ত্রিংশ অনুবাক
মন্ত্র- জ্যোতিষ্মতীং ত্বা সাদয়ামি জ্যোতিষ্কৃতং ত্বা সাদয়ামি জ্যোতির্বিদং। ত্বা সাদয়ামি ভাস্বতীং ত্বা সাদয়ামি জ্বলন্তীং ত্বা সাদয়ামি যন্মলাভবন্তীং ত্বা সাদয়ামি দীপ্যমানাম্ ত্বা সাদয়ামি রোমানাং ত্বা সাদয়ামাজাং ত্বা সাদয়ামি বৃহজ্জ্যোতিষং ত্বা সাদয়ামি বোধয়ন্তীম ত্বা সাদয়ামি জাগ্রতীং ত্বা সাদয়ামি ॥ ৩৪৷
মর্মার্থ- হে ভগবন্! জ্যোতির্ময় আপনাকে আরাধনা করছি। হে ভগবন্! পরাজ্ঞানদায়ক, আপনাকে আরাধনা করছি। হে ভগবন্! সর্বজ্ঞ আপনাকে আরাধনা করছি। হে ভগবন্! দিব্য-উজ্জ্বল আপনাকে আরাধনা করছি। হে ভগব! দিব্য-আলোকস্বরূপ আপনাকে আরাধনা করছি। হে ভগবন্! পরম-উজ্জ্বল-রূপ আপনাকে আরাধনা করছি। হে ভগব! জ্যোতিঃদায়ক আপনাকে আরাধনা করছি।–হে ভগবন্! জগৎপ্রকাশ আপনাকে আরাধনা করছি।–হে ভগব। অনন্তশক্তিযুত আপনাকে আরাধনা করছি। হে ভগবন্! মহান্ জ্যোতিঃ-স্বরূপ আপনাকে আরাধনা করছি।-হে ভগবন্! জ্ঞান-বুদ্ধিদাতা আপনাকে আরাধনা করছি। হে ভগব! চৈতন্য-স্বরূপ আপনাকে আরাধনা করছি ॥৩৪৷
[এই অনুবাকের দ্বাদশটি মন্ত্রের প্রত্যেকটিতে ভগবানের সম্বোধন আছে। প্রত্যেক মন্ত্রের ক্রিয়াপদ সাদয়ামি-আরাধনা করব, অথবা যেন আরাধনা করতে পারি। সকল মন্ত্রেরই একভাব থাকলেও প্রত্যেক মন্ত্রে ভগবানের বিশেষ বিশেষ প্রকাশকে লক্ষ্য করা হয়েছে। কিন্তু এই সব মন্ত্রের মধ্যে দিব্যজ্যোতিঃর প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। প্রথম মন্ত্র-জ্যোতিষ্মতীং ত্বা সাদয়ামি-জ্যোতির্ময় আপনাকে আরাধনা করছি। মন্ত্রগুলির অন্তর্গত প্রার্থনার মধ্যে ভগবানের মাহাত্ম কীর্তনও আছে। প্রতিটি মন্ত্রই এক ভাব প্রকাশ করছে। তিনি জ্যোতিঃর আধার। কিন্তু তাতেই তার মহিমা পর্যবসিত নয়, তিনি জ্যোতিষ্কৃতংও বটেন, অর্থাৎ মানুষকে বিশ্বকে তিনি জ্যোতিঃদানও করেন, জ্যোতিঃ সৃষ্টি করেন, তাই তিনি জ্যোতিষ্কৃতং। আবার তৃতীয় মন্ত্রে তিনি–জ্যোতির্বিদং–জ্ঞানের প্রকৃত জ্ঞাতা, অর্থাৎ জ্ঞান তাতেই অবস্থিতি করে। (জ্যোতির্বিদং পদের সাধারণ অর্থ-সর্বজ্ঞ। এখানে আমরা সেই অর্থই গ্রহণ করেছি)। চতুর্থ মন্ত্রের ভাস্বতীং এবং পঞ্চম মন্ত্রের জলস্তীং পদের অর্থও তা-ই। ভাস অর্থাৎ দীপ্তি যার আছে এই অর্থে ভাস্বতী শব্দ পাওয়া যায়, তার অর্থ–জ্যোতির্ময়। জলন্তীং পদ ভাস্বতীং পদের অপেক্ষা অধিকতর ঔজ্জ্বল্যবাচক। ঐ পদে আমরা দিব্যালোকস্বরূপং অর্থ গ্রহণ করেছি। সপ্তম মন্ত্রের দীপ্যমানং এবং জ্বলন্তীং পদ দুটি প্রায় একার্থক। অষ্টম মন্ত্রে তিনি–রোচমানাং অর্থাৎ জগৎকে যিনি প্রকাশ করেন। আদিতে যে বিশ্ব তমসাচ্ছন্ন ছিল, পরে ভগবানের জ্যোতিঃতেই তা প্রকাশিত হয়েছে। সর্বশেষ মন্ত্রের একটি পদের দ্বারা অন্য সকল পদের ভাবই প্রকাশিত হয়েছে। সেই পদটি–জাগ্রতীং অর্থাৎ ভগবান্ চিরজাগ্রত, চৈতন্যস্বরূপ। তার থেকে জ্ঞান চৈতন্য বিশ্বজ্যোতিঃ উদ্ভূত হয়, মন্ত্র তা-ই বিবৃত করছেন] ॥৩৪।
.
পঞ্চত্রিংশ অনুবাক
মন্ত্র- প্রয়াসায় স্বাহাহয়াসায় স্বাহা বিয়াসায় স্বাহা সংয়াসায় স্বাহোদ্যাসায় স্বাহ-ইয়াসায় স্বাহা শুচে স্বাহা শশাকায় স্বাহা প্যত্বৈ স্বাহা। তপতে স্বাহা ব্রহ্মহত্যায়ৈ স্বাহা সর্বম্মৈ স্বাহা ॥৩৫৷৷
মর্মার্থ- ভগবৎপ্রাপ্তির চেষ্টাতে মঙ্গল হোক, অর্থাৎ ভগবপ্রাপ্তির চেষ্টা সফল হোক। সাধনাতে মঙ্গল হোক, অর্থাৎ সাধনা সিদ্ধিপ্রদ হোক। বিশিষ্ট সাধনায় মঙ্গল হোক, অর্থাৎ ভগবৎপ্রাপিকা সাধনা সফল হোক। শ্রেষ্ঠতম প্রচেষ্টাতে মঙ্গল হোক, অর্থাৎ মোক্ষপ্রাপ্তির চেষ্টা সফল হোক। উদ্যোগে মঙ্গল হোক, অর্থাৎ আমাদের সর্বরকম উদ্যোগ মোক্ষপ্রদ হোক। আমাদের সর্বপ্রযত্ন সিদ্ধ হোক। আমরা যেন পবিত্ৰহৃদয় হই। শোকপ্রাপ্তিও আমাদের মঙ্গলসাধিকা হোক। আরাধনাতে মঙ্গল হোক; অর্থাৎ আমাদের ভগবৎ-আরাধনা ইষ্টপ্রদা হোক।–সাধনাতে মঙ্গল হোক; অর্থাৎ তপঃ সাধনের দ্বারা আমরা যেন ভগবানকে লাভ করি। ব্রহ্মহত্যাজনিত পাপ হতেও যেন আমরা মুক্ত হই, (অথবা আমরা যেন ব্রহ্মপরায়ণ হই)! বিশ্বের সফল জীব পরাশান্তি লাভ করুক ॥৩৫৷৷
[দ্বাদশ মন্ত্রের প্রত্যেকটিই প্রার্থনামূলক। প্রথম থেকে ষষ্ঠ পর্যন্ত দুটি মন্ত্রের মূলভাব এই যে, আমরা যেন সফলকাম হই, আমাদের সাধনা আরাধনা যেন সিদ্ধিপ্রদা হয়। প্রয়াসায় আয়াসায় প্রভৃতি প্রত্যেক পদই মূলতঃ এক বস্তুকে লক্ষ্য করছে, তা–সিদ্ধি। সপ্তম থেকে দ্বাদশ পর্যন্ত মন্ত্রের ভাব স্বতন্ত্র। সপ্তম মন্ত্রে পবিত্রতা লাভের জন্য প্রার্থনা আছে। নবম মন্ত্রের ভাব আপাততঃ অদ্ভুত বলে মনে হতে পারে-শোকের দ্বারা মানুষের মঙ্গল হয় কেমন করে? হ্যাঁ, শোকের দ্বারা মঙ্গল হয়, বৈ কি? শোকের আগুনে পুড়ে মানুষ সংসারের অনিত্যতা যেভাবে উপলব্ধি করে, শত সহস্র উপদেশে তা হয় না। তাই–শোকায় স্বাহা-শোক প্রাপ্তিও যেন আমার কল্যাণপ্রদ হয়। একাদশ মন্ত্রের ব্রহ্মহত্যা বলতে পরমব্রহ্মের প্রতি অশ্রদ্ধা বা অভক্তি বোঝায়। মন্ত্রের প্রার্থনা, আমরা যেন সেই ভীষণতর পাপ হতে মুক্তিলাভ করতে পারি, অর্থাৎ পক্ষান্তরে আমরা যেন ভগবানে ভক্তিপরায়ণ হই। সর্বশেষ মন্ত্রের প্রার্থনায় উচ্চভাব প্রকটিত হয়েছে–সর্বস্মৈ স্বাহা–জগতের সর্বজীবের মঙ্গল হোক, বিশ্বের সকল প্রাণী শান্তিলাভ করুক, কল্যাণলাভ করে ধন্য হোক/অনুবাকের অন্যান্য মন্ত্রের প্রার্থনাগুলি এই মন্ত্রে পূর্ণতা পেয়েছে। অনুবাকের সব মন্ত্রের মধ্যেই স্বাহা পদটি আছে। এর অর্থ এই যে,-মঙ্গলের সাথে যেন আমাদের সাধনা সাফল্যমণ্ডিত হয়] ॥৩৫৷৷
.
ষড়ত্রিংশ অনুবাক
মন্ত্র- চিত্তং সন্তানেন ভবং যা রুদ্রং তনিম্ন পশুপতিম সুলহৃদয়েনাগ্নিং হৃদয়েন রুদ্রং লোহিতেন শৰ্ব্বং মতাভ্যাম মহাদেবমন্তঃপার্শ্বেনৌযিহনং শিঙ্গীনিকোশ্যাভ্যাম্ ॥৩৬৷৷
মর্মার্থ– সর্বব্যাপী শক্তির জন্য অর্থাৎ সেই শক্তিহেতু চিৎস্বরূপ দেবতাকে সকলে জানতে সমর্থ হয়। তাঁর করুণার জন্য জগতের উৎপত্তিকারণ দেবতাকে সকল লোকে জানতে সমর্থ হয়। সূক্ষ্মশক্তির জন্য রিপুনাশে কঠোরহৃদয় দেবতাকে সকলে জানতে সমর্থ হয়। সর্বভূতাধীশ দেবতাকে লোকবর্গ মহৎ-অন্তঃ করণের জন্য জানতে সমর্থ হয়। জ্ঞানদেবকে হৃদয়শক্তির জন্য লোকে জানতে সর্মত হয়। রিপুনাশে ক্রোধপরায়ণ দেবকে লোকে রুদ্রশক্তির জন্য জানতে সমর্থ হয়। রিপুনাশক দেবতাকে লোকে রক্ষাপালনশক্তির জন্য আরাধনা করে। পরমদেবতাকে লোকে অন্তঃশক্তিদ্বারা জানতে সমর্থ হয়। দুর্ধর্ষরিপুনাশক দেবতাকে সাধকেরা জ্ঞানভক্তির দ্বারা লাভ করেন ॥৩৬৷
[প্রথম মন্ত্র সন্তানেন চিত্তং অর্থাৎ সর্বব্যাপক বলেই আমরা চিৎস্বরূপ ভগবানকে জানতে পারি। সন্তানেন পদ বিস্তারার্থক তন্ ধাতু-নিষ্পন্ন। সম্যকরূপে যা বিস্তৃত হয় বা বিস্তৃত আছে, অর্থাৎ যা সর্বব্যাপী তার বিশেষত্বকেই সন্তানেন পদে লক্ষ্য করছে।–দ্বিতীয় মন্ত্রে যা অর্থাৎ হৃদয়ভাব, করুণাকে লক্ষ্য করছে। তৃতীয় মন্ত্রের লক্ষ্য ভগবানের সূক্ষ্মশক্তি, তনিম্না পদে তা-ই বিবৃত করছে। চতুর্থ মন্ত্রের উদ্দিষ্ট দেবতা–পশুপতিং অর্থাৎ যিনি সকল জীবের অধিপতি। পঞ্চম মন্ত্রের উদ্দিষ্ট বিভূতি-জ্ঞান। ষষ্ঠ মন্ত্রে রুদ্রং–ভগবানের ভক্তের রিপুনাশে ক্রোধপরায়ণ দেবতা, যাঁর লোহিতেন অর্থাৎ রজঃশক্তি বা রুদ্রশক্তির জন্য আমরা জানতে পারি। সপ্তম মন্ত্রের শর্বং পদ বধার্থক শর্ব ধাতু থেকে উৎপন্ন হয়েছে। তাই আমরা ঐ পদে রিপুনাশকং দেবং অর্থ গ্রহণ করেছি। অষ্টম মন্ত্রের লক্ষ্য–মহাদেবং। দেবতারও যিনি দেবতা, সেই পরমদেবতাই, অর্থাৎ পরমব্রহ্মই এই মন্ত্রের উদ্দিষ্ট দেবতা। যে নামে, যে ভাবে, যাকেই ডাকা যাক না কেন, মূলতঃ সেই এক দেবতাকেই আরাধনা করা হয়, তারাই মাহাত্ম পরিকীর্তিত হয়। নবম মন্ত্রের ওষিষ্ঠহনং পদেও সেই এক দেবতার বিষয়ই প্রখ্যাপিত হয়েছে। সমস্ত অনুবাকটি একত্র দেখলে এটা স্পষ্ট বোধগম্য হয় যে, আমরা ভগবানের বিশেষ কৃপাবলেই তার সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ করতে পারি] ॥৩৬৷৷
.
সপ্তত্রিংশ অনুবাক
মন্ত্র- আ তিষ্ঠ বৃত্ৰহন রথং যুক্তা তে ব্ৰহ্মণা হরী। অর্বাচীন সু তে মনো গ্রাবা কৃণোতু বথুনা। উপযঅমগৃহীতোহসীন্দ্রায় ত্বা ঘোড়শিন এষ তে যোনিরিদ্ৰায় ত্বা ঘোড়শিনে ॥৩৭৷৷
মর্মার্থ- অজ্ঞানতানাশক হে ভগবন! আমাদের হৃদয়কে কর্মকে সম্পূর্ণরূপে প্রাপ্ত হোন; আমাদের উচ্চারিত স্তোত্রের দ্বারা (শস্ত্রমন্ত্রের দ্বারা) আপনার বহনের উপযোগী জ্ঞানভক্তি-রূপ বাহক দুটি আমাদের হৃদয়ে যুক্ত হোক; পাষাণের মতো বিশুষ্ক আমাদের হৃদয়, স্তোত্রমন্ত্রের দ্বারা অভিষিক্ত হয়ে, আপনার অন্তরকে–আপনার অনুগ্রহকে সুষ্ঠুভাবে আমাদের অভিমুখ করুক। (প্রার্থনার ভাব এই যে,–পাষাণের মতো দৃঢ় আমাদের হৃদয় মন্ত্রের প্রভাবে আর্দ্র হোক; সেই হৃদয়ে, হে ভগবান, আপনি অবস্থান করুন–আমাদের প্রতি কৃপাপরায়ণ হোন)। হে পরাজ্ঞান। আপনি সাধকের হৃদয়ে উৎপন্ন হন; সর্ব-গুণোপেত ভগবান্ ইন্দ্রদেবের জন্য আপনাকে যেন প্রাপ্ত হই। হে পরাজ্ঞান! আমাদের হৃদয়-প্রদেশ আপনার নিবাসস্থান হোক। হে পরাজ্ঞান! সর্ব-ঐশ্বর্যশালী ভগবান্ ইন্দ্রদেবতার জন্য, অর্থাৎ তাকে পাবার জন্য আপনাকে যেন আমরা হৃদয়ে উৎপন্ন করতে পারি ॥৩৭ ৷৷
[এই অনুবাকের প্রথম মন্ত্রের প্রথম চরণের রথং ও হরী পদ দুটি এবং দ্বিতীয় চরণের গ্রাবা পদ মন্ত্রের অর্থ সংশয়-সন্দেহ বৃদ্ধি করেছে। এই অনুসারে মন্ত্রের প্রথম চরণের প্রচলিত অর্থ, কর্মকাণ্ডানুসারে, দাঁড়িয়ে গেছে,-হে বৃত্রহননকারী! তুমি রথে আরোহণ করো; তোমার অশ্বদ্বয় (হরী) রথে সংযুক্ত হয়েছে। এইভাবে দ্বিতীয় চরণের অর্থ দাঁড়িয়েছে, প্রস্তর (গ্রাবা) দ্বারা সোমরস বার করা যাচ্ছে; তার শব্দে (বগুনা) অর্থাৎ শব্দ শুনে তোমার চিত্ত আমাদের দিকে প্রধাবিত হোক। সোমরস (মাদক-দ্রব্য) প্রস্তুতের আয়োজন হলেই, সেই উপলক্ষিত প্রস্তর সঞ্চালিত হলেই, (মাদক-লোভী?) ইন্দ্র যেন আর স্থির থাকতে পারেন না। এই রকম ভাবই এখানে প্রকাশমান দেখি। যাই হোক, আমরা, আধ্যাত্মিক বিচারে, এইরকম অর্থ গ্রহণ করি না। রথং, হরী, ও গ্রাবা পদ তিনটিতে আমরা যথাক্রমে হৃদয় বা কর্ম, জ্ঞানভক্তি-রূপ বাহকদ্বয় এবং পাষাণের মতো বিশুষ্ক আমাদের হৃদয় প্রভৃতি অর্থ গ্রহণ করেছি। বথুনা পদে স্তোত্র-মন্ত্রের দ্বারা অতিষিক্ত হয়ে ভাব আসে/দ্বিতীয় চরণের ক্ষেত্রে গ্রাবা বথুনা পদ দুটিতে পাষাণ ঘর্ষণের শব্দের দ্বারা অর্থ গ্রহণ না করে, পাষাণের মতো বিশুষ্ক হৃদয় স্তোত্র-মন্ত্রের দ্বারা অভিষিক্ত হলে-এইরকম অর্থেই সঙ্গতি দেখি। মনঃ পদে অন্তরকে (ভাবে–অনুগ্রহকে) বোঝায়।–দ্বিতীয় মন্ত্রে পরাজ্ঞানকে সম্বোধন করা হয়েছে। সাধকগণ সাধনাবলে পরাজ্ঞান লাভ করেন। কিন্তু সাধনশক্তিহীন আমাদের কি উপায় হবে? সেই উপায়–ভগবানের আরাধনা। মন্ত্রের প্রার্থনায় এটাই প্রদর্শিত হয়েছে। তৃতীয় মন্ত্রের প্রার্থনাও দ্বিতীয়টির অনুরূপ।এষঃ তে যোনিঃ–আমাদের হৃদয়দেশ আপনার আশ্রয়স্থল হোক। চতুর্থ মন্ত্রের প্রার্থনা বহুলাংশে দ্বিতীয় মন্ত্রেরই সমতুল্য।–এই অনুবাকটি ঋগ্বেদ-সংহিতার প্রথম মণ্ডলে পরিদৃষ্ট হয় ] ॥৩৭৷৷
.
অষ্টাত্রিংশ অনুবাক
মন্ত্র- ইন্দ্ৰমিদ্ধরী বহতোহপ্রতিধৃষ্টশসমৃষীণাং চ তীরূপ যজ্ঞং চ মানুষাণাম। উপযামগৃহীতোহসীন্দ্ৰায় ত্বা যোড়শিন এষ তে যোনিরিন্দ্রায় জ্বা ঘোড়শিনে৷ ৩৮।
মর্মার্থ- জ্ঞানভক্তি-রূপ বাহকদ্বয় অশেষশক্তিশালী ভগবান্ ইন্দ্রদেবকে মন্ত্রদ্রষ্টা সাধকদের এবং জনসাধারণের স্তোত্রসমূহের ও সকলরকম সৎকর্ম-অনুষ্ঠানের সমীপে নিশ্চয়ই বহন করে আসে। (ভাব এই যে,জ্ঞানভক্তি-সহযুত কর্মের দ্বারা মানুষ সর্ব অবস্থায় ভগবান্কে প্রাপ্ত হয়ে থাকে। হে পরাজ্ঞান! আপনি সাধকের হৃদয়ে উৎপন্ন হন; সবগুলোপেত ভগবান্ ইন্দ্রদেবের জন্য আপনাকে যেন প্রাপ্ত হই। হে পরাজ্ঞান? আমাদের হৃদয়-প্রদেশ আপনার নিবাসস্থান হোক। হে পরাজ্ঞান? সর্ব-ঐশ্বর্যশালী ভগবান্ ইন্দ্রদেবের জন্য, অর্থাৎ তাকে পাবার জন্য আপনাকে যেন আমরা হৃদয়ে উৎপাদন করি ॥৩৮৷৷
[প্রথম মন্ত্রে হরী পদে ইন্দ্রের অশ্বদ্বয় অর্থ গ্রহণ করে, প্রচলিত ব্যাখ্যায়, মন্ত্রের ভাব গ্রহণ করা হয় ইন্দ্রের অশ্বদ্বয় ইন্দ্রকে ঋষিগণের এবং মানুষ্যগণের স্তোত্রের ও যজ্ঞের সমীপে বহন করে নিয়ে যায়। এতে সাধারণতঃ মনে আসে, ইন্দ্র নামে কোনও এক মানুষ রাজপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, ঋষিগণ এবং মনুষ্যগণ যখন তার অভ্যর্থনার আয়োজন করতেন, তখন তিনি আপন দুটি অষে আরোহণ করে বা অশ্বদুটির দ্বারা পরিচালিত রথে সেই অভ্যর্থনা-ক্ষেত্রে গমন করতেন এবং নিজের প্রশংসাবাদ শ্রবণ করে পরিতুষ্ট হতেন।যদি তাই হবে–সেই অর্থেরই যদি সার্থকতা থাকবে, তাহলে এই সব মন্ত্র আজও যজ্ঞ ইত্যাদিতে–ক্রিয়াকর্মে ব্যবহৃত হচ্ছে কেন? ইন্দ্রদেব কি অশ্বে আরোহণ করে এখন যজ্ঞস্থলে আগমন করেন? এবং মন্ত্র শ্রবণ করেন? কেউ দেখেছেন কি? সে পরিকল্পনা নিরর্থক বলেই প্রতিপন্ন হয়। আমরা বলি, মন্ত্ৰাৰ্থ নিত্যসত্য-ভাব-প্রকাশক। ভগবান্ ইন্দ্রদেব (তথা ভগবানের বল-ঐশ্বর্য-রূপ বিভূতি) চিরদিনই মানুষের স্তোত্রের সমীপে-উপাসনার কাছে এবং যজ্ঞের নিকটে-সঙ্কর্মানুষ্ঠানের কাছে এসে থাকেন। আমাদের জ্ঞানভক্তি-রূপ বাহক দুটিই তাকে বহন করে আনে।–দ্বিতীয় মন্ত্রে পরাজ্ঞানকে সম্বোধন করা হয়েছে। সকলের পক্ষে পরাজ্ঞানকে পাবার উপায়, তার চরণেই প্রার্থনা বা আত্মসমর্পণ। তৃতীয় মন্ত্রে বলা হয়েছে-এষঃ তে যোনিঃ–আমাদের হৃদয়দেশ আপনার আশ্রয়স্থল হোক। চতুর্থ মন্ত্রের প্রার্থনা বহুলাংশে দ্বিতীয় মন্ত্রটিরই অনুরূপা–এই অনুবাক ঋগ্বেদ-সংহিতার প্রথম মণ্ডলে দ্রষ্টব্য] ॥৩৮৷৷
.
ঊনচত্বারিংশ অনুবাক
মন্ত্র- অসাবি সোম ইন্দ্র তে শবিষ্ঠ ধৃষ্ণবা গহি।। আ ত্বা পৃণত্ত্বিন্দ্ৰিয়ং রজঃ সূর্যং ন রশ্মিভিঃ। উপযামগৃহীতোহসীন্দ্রায় ত্বা ঘোড়শিন এষ তে যোনিরিায় ত্বা ঘোড়শিনে ॥৩৯৷৷
মর্মার্থ- হে ভগব ইন্দ্রদেব! আপনার জন্য আমাদের মধ্যে শুদ্ধসত্ত্ব উৎপন্ন বা সঞ্চিত হোক। অতিশয় বলবান্ শত্রুধর্ষণকারী হে ভগবন্! আসুন আমাদের প্রাপ্ত হোন; আমাদের সকল ইন্দ্রিয়–সকল শক্তি, সূর্য যেমন রশ্মিসমূহের দ্বারা অন্তরীক্ষকে ব্যাপ্ত করে, তেমনই (অথবা জ্ঞানদেবতা যেমন আপন জ্যোতির দ্বারা রজো-ভাবকে-অহঙ্কার ইত্যাদি জন্মকারণকে নাশ করেন, সেইভাবে) সর্বতোরকমে আপনাকে প্রাপ্ত হোক। (প্রার্থনার ভাব এই যে,-হে ভগবন্! আমাদের সকল শক্তি আপনাতে বিনিবিষ্ট হোক–আমাদের হৃদয় শুদ্ধসত্ত্বে পূর্ণ থাকুক; আর, আপনি আমাদের মধ্যে বিরাজমান থাকুন)। হে শুদ্ধসত্ত্ব! আপনি সাধকহৃদয়ে উৎপাদিত হন; সর্ব-ঐশ্বর্যশালী ভগবান্ ইন্দ্রদেবতার জন্য আপনাকে যেন প্রাপ্ত হই। (প্রার্থনার ভাব এই যে, শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা আমরা যেন ভগবানকে লাভ করি)। হে শুদ্ধসত্ত্ব! আমাদের হৃদয়দেশ আপনার আশ্রয়স্থান হোক; (প্রার্থনার ভাব এই যে,-আমরা যেন শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করি)। হে শুদ্ধসত্ত্ব! সর্ব-ঐশ্বর্যশালী ভগবান্ ইন্দ্রদেবের জন্য অর্থাৎ তাকে প্রাপ্তির জন্য আমরা যেন আপনাকে হৃদয়ে উৎপাদিত করতে পারি ॥৩৯৷৷
[প্রথম মন্ত্রটিতে দুটি সমস্যা-মূলক পদ আছে-সোমঃ ও ইন্দ্রিয়ং। উপমাটি–সূর্যঃ ন রশ্মিভিঃ রজঃ। সোম-পদে যথাপূর্ব সকলেই সোমরস মাদক-দ্রব্য অর্থ গ্রহণ করে গেছেন। অসাবি ক্রিয়াপদে সেই অনুসারে অভিষর-ক্রিয়ার দ্বারা প্রস্তুত হয়েছিল, ভাব গ্রহণ করা হয়েছে। সেই অনুসারে, এই মন্ত্রের প্রথম চরণের প্রচলিত অর্থে প্রকাশ পেয়েছে,-হে ইন্দ্র! আপনার জন্য সোমরস মাদক-দ্রব্য প্রস্তুত রয়েছে; শত্রু বিমর্দক আপনি এসে তা পান করুন। এইরকমেই ইন্দ্রিয়ং পদে সেই সোমরস-পানে মত্ততা-জনিত বলঞ্চারের ভাব গ্রহণ করা হয়েছে। সেই অনুসারে ঐ অংশের প্রচলিত অর্থ দাঁড়িয়েছে, সোমরসপানজনিত শক্তিতে তোমাকে পূর্ণ করুক, অর্থাৎ মত্ততাজনিত বল তোমাতে সঞ্চিত হোক। কেমনভাবে সেই বল তোমাতে সঞ্চিত হবে বা তুমি সেই বলে পূর্ণ হবে? তারই উপমা-রজঃ সূর্যঃ ন রশ্মিভিঃ। এর প্রচলিত অর্থ–সূর্য যেমন অন্তরীক্ষকে আপন রশ্মিসমূহের দ্বারা পূর্ণ করেন। আমরা কিন্তু পুনঃ পুনঃ খ্যাপন করেছি যে, সোমঃ পদে শুদ্ধত্ত্বকে বোঝায়, আর সেই শুদ্ধসত্ত্বই ভগবানের আশ্রয়স্থল। অসাবি শব্দে উৎপন্ন হোক-সঞ্চিত হোক এইরকম ভাবই গ্রহণ করেছি। আমরা বলি ইন্দ্রিয়ং পদে আমাদের সকল ইন্দ্রিয়কে–যত রকম ইন্দ্রিয় আছে তাদের সকলকে–আমাদের সবরকম শক্তিকে–অর্থ আসছে।সূর্য পদে জ্ঞানদেবতা (প্রজ্ঞান অর্থ) গ্রহণ করা হয়েছে। রজঃ পদে অহঙ্কার ইত্যাদি জন্মকারণের। প্রতি লক্ষ্য রয়েছে। দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ মন্ত্রে শুদ্ধসত্ত্ব-সম্বন্ধীয় প্রার্থনা আছে।–এই অনুবাকেও পূর্ব অনুবাকের মতো যোড়শিনে পদ ব্যবহৃত হয়েছে। এর অর্থ–সর্ব-ঐশ্বর্যশালিনে।–এই ঊনচত্বারিংশ অনুবাকের প্রথম মন্ত্রটি ঋগ্বেদ-সংহিতার প্রথম মণ্ডলে পাওয়া যায় ] ॥৩৯।
.
চত্বারিংশ অনুবাক
মন্ত্র- সর্বস্য প্রতিশীবরী ভূমিন্তোপন্থ আধিত। সস্যানাহস্মৈ সুষদা ভব যচ্চাস্মৈ শৰ্ম সপ্রথাঃ। উপযামগৃহীতোহসীন্দ্রায় ত্বা যোড়শিন এষ তে যোনিরিন্দ্রায় জ্বা ঘোড়শিনে ॥৪০৷৷
মর্মার্থ- হে আমার মন! সর্বভূতজাতের অনুগ্রহকারী সাধকদের আশ্রয়স্থান তোমাকে পরমাশ্রয় প্রদান করুন। হে পরমাশ্রয়! ভগবৎপ্রাপ্তির জন্য আপনি সুখপ্রদ এবং শোভননিবাস হোন; ভগবৎপ্রাপ্তির জন্য পরমসুখপ্রদ হয়ে মঙ্গল প্রদান করুন। হে পরমাশ্রয়! আপনি সাধকগণ কর্তৃক প্রাপ্ত হন; সর্ব-ঐশ্বর্যশালী ভগবান্ ইন্দ্রদেবের জন্য যেন আপনাকে প্রাপ্ত হই। হে শুদ্ধসত্ত্ব! আমাদের হৃদয়দেশ আপনার আশ্রয়স্থান হোক; সর্ব-ঐশ্বর্যশালী ভগবান্ ইন্দ্রদেবের জন্য অর্থাৎ তাকে পাবার জন্য আমরা যেন আপনাকে আমাদের হৃদয়ে উৎপাদিত করি ॥ ৪০
[এই অনুবাকের প্রথম মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধনমূলক; কিন্তু এই আহোদ্বোধনের মধ্যে প্রার্থনার ভাব বিশেষভাবে পরিস্ফুট হয়েছে। এই মন্ত্রের কেন্দ্রীভূত পদ–ভূমিঃ অর্থাৎ আশ্রয়স্থল-নিবাসস্থান। যে আশ্রয় লাভ করলে তা থেকে আর পতনের ভয় থাকে না। সাধকেরা–ভক্তের দল–সেই পরমাশ্রয় লাভ করতে পারেন, কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে তা সহজলভ্য নয় বলেই প্রার্থনা। মন্ত্রে মনকে সম্বোধন করা হলেও, কার্যতঃ প্রার্থনা ভগবানের উদ্দেশেই উচ্চারিত হয়েছে। মনকে বলা হয়েছে, মন যেন ভগবানের কৃপায় পরমাশ্রয় লাভ করে। তা কিভাবে সম্ভবপর? উত্তরে বলা হয়েছে,-ভূমিঃ ত্বা উপস্থে-জগতের পরম ও চরমাশ্রয়ই সেই আশ্রয় দান করবে। অর্থাৎ যা জগতের সাধারণ আশ্রয়ভূমি, তা-ই আমাকে যেন চরমাশ্রয় প্রদান করে–এটাই মন্ত্রের প্রতিপাদ্য বিষয়। প্ৰতিশীবরী পদের ব্যাখ্যায় ভাষ্যকার আভিমুক্যশায়িনী অর্থাৎ অনুকূল অর্থ গ্রহণ করেছেন। আমরাও এইরকম অর্থ গ্রহণ করেছি।–দ্বিতীয় ও তৃতীয় মন্ত্রের ভাব এই যে, সেই পরমাশ্রয় যেন আমাদের পরমমঙ্গলদায়ক হয়। সোনা পদের অর্থ সুখদায়ক।সুষদা পদের অর্থ শোভননিবাস অর্থাৎ যে নিবাসে মানুষ পরমসুখে থাকতে পারে। কিন্তু সেই পরমনিবাস কে লাভ করতে পারে? সাধকের সাধনার দ্বারা তা লাভ করতে পারেন। আর আমার? আমাদের জন্যই প্রার্থনা। কিন্তু সেই পরমাশ্রয় বা পরম নিবাসটি কি? ভগবানের চরণ ] ॥৪০৷৷
.
একচত্বারিংশ অনুবাক
মন্ত্র- মহান্ ইন্ট্রো বজ্ৰবাহুঃ যোড়শী শৰ্ম্ম যচ্ছতু। স্বস্তি নো মঘবা করোতু হন্তু পাপ্লানং যোইস্মন্ দ্বেষ্টি। উপযামগৃহীতোহসীন্দ্রায় ত্বা ঘোড়শিন এষ তে যোনিরিায় ত্বা ঘোড়শিনে৷৪১।
মর্মার্থ- মহৎ-অন্তঃকরণবিশিষ্ট, মহত্ত্বযুত রক্ষাস্ত্রধারী বলাধিপতিদেব আমাদের সবরকম মঙ্গল প্রদান করুন। পরমধনদাতা দেব আমাদের মঙ্গল করুন; যে রিপু প্রার্থনাকারী আমাদের হিংসা করে, পাপপথে প্রবর্তনকারী সেই রিপুকে সেই দেবতা বিনাশ করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে,-ভগবান কৃপাপূর্বক আমাদের পরমমঙ্গল বিধান করুন)। হে শুদ্ধসত্ত্ব! আপনি সাধকের হৃদয়ে উৎপন্ন হন; সর্ব-ঐশ্বর্যশালী ভগবান্ ইন্দ্রদেবের জন্য আপনাকে যেন প্রাপ্ত হই। হে শুদ্ধসত্ত্ব! আমাদের হৃদয়দেশ আপনার নিবাসস্থান হোক; সর্ব-ঐশ্বর্যশালী ভগবান্ ইন্দ্রদেবের জন্য আপনাকে যেন লাভ করি ॥ ৪১।
[এই অনুবাকের চারটি মন্ত্রই প্রার্থনামূলক। বিভিন্নভাবে বিভিন্ন মন্ত্রে ভগবানের কাছে শাশ্বত মঙ্গলোভের জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। প্রথম মন্ত্রে ভগবানকে বজ্ৰবাহুঃ বলা হয়েছে। এর অর্থ–যাঁর হস্তে বজ্র নামক মহাস্ত্র আছে। সেই অস্ত্রের প্রয়োজনীয়তা–রিপুনাশে। ভগবানের রিপু নেই, কিন্তু দুর্বল মানবতার সন্তান–চারদিকে রিপুগণকর্তৃক পরিবেষ্টিত। তাদের রক্ষা করবার জন্যই তিনি বজ্ৰবাহু। তার কাছে আমাদের প্রার্থিত বস্তু–যোড়শী শর্ম। ইতি পূর্বে দৃষ্ট যোড়শিনে পদটির মতোই এই যোড়শী শর্ম পদ দুটিতে সবরকম মঙ্গলকেই অর্থাৎ পরম ও চরম মঙ্গলকেই লক্ষ্য করছে। মন্ত্রের প্রার্থনা–যোড়শী শর্ম প্রযচ্ছতু–আমাদের সকল রকম মঙ্গল প্রদান করুন।–দ্বিতীয় মন্ত্রে পরোক্ষভাবে প্রার্থনা করা হয়েছে। মঘবা নঃ স্বস্তি করোতুপরমেশ্বর্যশালী অথবা পরমধনদাতা দেব আমাদের মঙ্গল করুন, এটাই দ্বিতীয় মন্ত্রের প্রথম অংশ। মন্ত্রের দ্বিতীয় অংশ–যঃ অস্মন্ দ্বেষ্টি পানং হন্তু–পাপমার্গে প্রর্বতক যে রিপুগণ আমাদের হিংসা করে, আমাদের পাপপথে নিয়ে যায়, তাদের যেন ভগবান বিনাশ করেন। প্রার্থনার মধ্যে দুটি বিষয় লক্ষ্য করবার আছে। প্রথম বিষয়, রিপুগণের প্রকৃতি। পাপ্লানং পদের দ্বারাই তা প্রকাশিত হয়েছে। যারা নিজে পাপ করে, যারা অন্যকে পাপ পথে নিয়ে যায়, তারাই পাপ্নানং। রিপুগণই পানং। দ্বেষ্টি পদ হিংসা অর্থ প্রকাশ করছে। সেই হিংসার কর্ম–পাপথে প্রবর্তন। মন্ত্রের দ্বিতীয় বিষয় এই যে অসামর্থ্যজ্ঞাপন করে ভগবানের কাছে প্রার্থনা। মানুষ দুর্বল,দুর্বল সন্তান যেমনভাবে পিতার স্নেহকরুণা ভিক্ষা করে, এই মন্ত্রেও তা-ই জ্ঞাপন করা হয়েছে। এই অনুবাকের তৃতীয় ও চতুর্থ মন্ত্রে শুদ্ধসত্ত্বকে সম্বোধন করা হয়েছে। দুটি মন্ত্রেরই ভাব–বিশুদ্ধ পবিত্র সত্ত্বভাব সাধকলভ্য বস্তু। সকল মানবের অন্তরে এই স্বর্গীয় সামগ্রী অঙ্কুর অবস্থায় বিরাজিত আছে সত্য, কিন্তু সাধনা ভিন্ন তা বিকশিত হয় না। তাই বলা হয়েছে– শুদ্ধসত্ত্ব সাধক-লভ্য অর্থাৎ সাধনার দ্বারাই বিশুদ্ধ সত্ত্বভাব অধিগত হয়। আমরাও যেন সেই পরমবস্তু লাভ করে ধন্য হতে পারি–এটাই মন্ত্রের প্রার্থনার সারমর্ম। সেই বস্তু লাভ করবার উদ্দেশ্য কি? তার দ্বারা আমাদের কি উপকার হয়?-শুদ্ধসত্তের সাহায্যে আমরা ভগবানের চরণে পৌঁছাতে পারি, সেটি ভগবৎপ্রাপ্তির শ্রেষ্ঠ উপায়। অনুবাকের প্রথম দুই মন্ত্রে ভগবানের কাছে পরমধন পরমমঙ্গল প্রাপ্তির জন্য প্রার্থনা আছে, এবং শেষ দুই মন্ত্রে ভগবাকে প্রাপ্তির উপায়-স্বরূপ শুদ্ধসত্ত্ব লাভের প্রার্থনা আছে) ॥৪১।
.
দ্বিত্বারিংশ অনুবাক
মন্ত্র- সজোষাঃ ইন্দ্র সগণো মরুভিঃ সোমং পিব বৃহঞ্জর বিদ্বান। জহি শত্রুপ মৃধো নুস্বার্থভয়ং কৃণুহি বিশ্বততা নঃ। উপমগৃহীতোহসীন্দ্রায় ত্বা ঘোড়শিন এষ তে যোনিরিদ্ৰায় ত্বা ঘোড়শিনে৷ ৪২
মর্মার্থ- সর্বশক্তিমান বলাধিপতি হে দেব! বিবেকজ্ঞানদায়ক, দেবভাবপ্রদায়ক, অজ্ঞানতানাশক, পরাজ্ঞানদায়ক, আপনি আমাদের হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব গ্রহণ করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমাদের হৃদয়নিহিত পূজোপকরণরূপ শুদ্ধসত্ত্ব ভগবান্ গ্রহণ করুন)। হে দেব! আমাদের রিপুগণকে বিনাশ করুন; হিংসক শত্রুগণকে বিতাড়িত করুন; তারপর আমাদের ভয় দূর করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে,হে ভগবন্! কৃপাপূর্বক রিপুগণকে বিনাশ করে আমাদের অভয় প্রদান করুন)। হে শুদ্ধসত্ত্ব! আপনি সাধকদের হৃদয়ে উৎপাদিত হন; সর্ব-ঐশ্বর্যশালী ভগবান্ ইন্দ্রদেবের জন্য আপনাকে যেন প্রাপ্ত হই। হে শুদ্ধসত্ত্ব! আমাদের হৃদয়দেশ আপনার আশ্রয়স্থান হোক। সর্ব-ঐশ্বর্যশালী ভগবান্ ইন্দ্রদেবের জন্য অর্থাৎ তাঁকে প্রাপ্তির জন্য আপনাকে যেন হৃদয়ে উৎপাদিত করি ॥৪২৷
[এই অনুবাকের চারটি মন্ত্রের মধ্যে প্রথম দুটিতে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করা হয়েছে। মরুদ্ভিঃ সজোষা পদ দুটির অর্থ-বিবেকজ্ঞানসম্পন্ন। মরুৎ শব্দে বিবেকরূপী দেবগণকে বোঝায়। সজোষাঃ পদের অর্থ–সাথে। তাই মরুদ্ভিঃ সজোষাঃ পদ দুটির অর্থ দাঁড়ায়-মরুৎ-গণের সাথে অর্থাৎ বিবেকজ্ঞানদায়ক। সগণঃ পদের অর্থ সকল গণের সাথে বর্তমান যিনি। এই গণ অর্থাৎ দেবভাব। এ ছাড়া বৃত্ৰহা এবং বিদ্বান্ এই দুই বিশেষণও ভগবানের প্রতি প্রযুক্ত হয়েছে। তিনি বিদ্বান অর্থাৎ সকল জ্ঞানের আধার। বৃত্ৰহা পদেও অজ্ঞানতানাশক, রিপুনাশক পরমদেবতাকে বোঝায়। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করা হয়েছে, তিনি যেন কৃপা করে আমাদের হৃদয়স্থিত শুদ্ধসত্তরূপ পুজোপচার গ্রহণ করেন। তাই বলা হয়েছে-সোমং পিব। দ্বিতীয় মন্ত্রটির ভাবও প্রার্থনামূলক। কিন্তু এই প্রার্থনা প্রথমটির অপেক্ষা একটু ভিন্ন ভাবের।আমরা যেন নিরুপদ্রবে ভগবানের উপাসনা করতে পারি, তিনি তার উপায় বিধান করে দিন। সেই উপায়, আমাদের রিপুনাশ এবং আমাদের সবরকমে রিপুগণের আক্রমণের অতীত করা। তাই উপযুক্তভাবে ভগবৎসাধনার উপায়স্বরূপ রিপুজয়ের জন্য মন্ত্রে প্রার্থনা করা হয়েছে] ॥৪২।
.
ত্ৰিচত্বারিংশ অনুবাক
মন্ত্র- উদু ত্যং জাতবেদসং দেবং বহন্তি কেতঃ। দৃশে বিশ্বায় সূৰ্য্যম্।। চিত্রং দেবানামুদগাদনীকং চক্ষুৰ্মিত্রস্য বরুণস্যাগ্নেঃ। আহপ্রা দ্যাবাপৃথিবী অন্তরিক্ষং সূৰ্য্য আত্মা জগতস্তষশ্চ। অগ্নে নয় সুপথা রায়ো অম্মা বিশ্বানি দেব বরুনানি বিদ্বান। যুয়োধ্যম্মজ্জহুরাণমেনো ভূয়িষ্ঠাং তে নমউজিং বিধেম। দিবং গচ্ছ সুবঃ পত। রূপেণ বো রূপমভৈমি বয়সা বয়ঃ। তুথো বো বিশ্ববেদা বি ভজতু বর্ষিষ্ঠে অধি নাকে। এতত্তে অগ্নে রাধ ঐতি সোমচ্যুতং তন্মিস্য পথা নয়ৰ্ত্তস্য পথা প্রেত চন্দ্রদক্ষিণা যজ্ঞস্য পথা সুবিতা নয়ন্তী। ব্রাহ্মণমদ্য রাধ্যাসমৃষিমাৰ্ষেয়ং পিতৃমন্তং পৈতৃমত্যং সুধাতুদক্ষিণম্। বি সুবঃ পশ্য ব্যতরিক্ষং শুষ সদস্যৈঃ।। অম্মদ্দাত্রা দেবত্ৰা গছত মধুমতীঃ প্ৰদাতারমা বিশতানবহায়াম্মান্দেবযানেন। পথেত সুকৃতাং লোকে সদীত তন্নঃ সংস্কৃতম্ ॥৪৩
মর্মার্থ- জ্ঞান-রশ্মিসমূহ, সমস্ত দেবভাবকে দর্শন করবার জন্য, সেই প্রসিদ্ধ সর্বজ্ঞ অথবা প্রজ্ঞানের আধার দ্যোতমান্ জ্যোতিঃস্বরূপ পরব্রহ্মকে সাধকের সহস্রার পদ্মে প্রকাশিত করে থাকে। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে,–জ্ঞানের সাহায্যে সাধকবর্গ ভগবানের স্বরূপ অনুভব করেন)। দেবগণের (দীপ্তিদান ইত্যাদি গুণগুলির) বিচিত্র যে তেজঃ, মিত্র দেবতার, বরুণদেবতার, অগ্নিদেবতার প্রকাশক যে তেজঃ–উর্ধ্বে দেবলোকে বিদ্যমান রয়েছে; সেই তেজের দ্বারাই পরমাত্মা-রূপ সূর্যদেব স্বর্গ-মর্ত্যকে গগনমণ্ডলকে স্থাবরসমূহকে জঙ্গমসমূহকে অথবা গতিশীল সমগ্র জগৎকে সর্বতোভাবে পরিপূর্ণ করে রেখেছেন। (ভাব এই যে,-দেবভাবসমূহে-সূর্যে, বরুণে ও অগ্নিতে, খণ্ড খণ্ড ভাবে যে তেজঃ পরিলক্ষিত হচ্ছে, সে তেজঃ পরমাত্মারই; এই তেজঃ, খণ্ডভাব পরিত্যাগ করে পুঞ্জীভূত হলেই পরমাত্মা)। প্রজ্ঞানস্বরূপ হে ভগবন! শুদ্ধসত্ত্বজনক দীপ্তিদান ইত্যাদি গুণযুক্ত বিশ্বের সবরকম প্রকৃষ্টজ্ঞানের (প্রজ্ঞানের) উন্মেষকারী আপনি আমাদের পরমধনদানের জন্য আমাদের শোভনমার্গে (সৎপথে পরিচালিত করুন। (ভগবানের জ্ঞানশক্তির পরিমাণ বা পরিসীমা নেই। সেই ভগবান আমাদের সৎপথে পরিচালিত এবং সঙ্কর্মে নিয়োজিত করুন); অপিচ, হে দেব! আমাদের থেকে অর্থাৎ আমাদের অনুষ্ঠিত আরব্ধ কর্ম থেকে অভিলক্ষিত ক্রিয়া-প্রতিবন্ধক পাপকে বিযুক্ত অর্থাৎ পৃথক করুন। হে দেব! আপনার প্রীতির জন্য নমস্কম সমযুত স্তুতিবাক্য উচ্চারণ করছি। (সঙ্কর্মের প্রতিবন্ধক শত্রুর অন্ত নেই। প্রজ্ঞানরূপী ভগবানের প্রভাবে সকল বাধক-শই বিনাশপ্রাপ্ত হয়। অতএব প্রার্থনা-হে ভগবন্! আমাদের সৎকর্মের বিরোধী অন্তঃশত্রুদের বিনাশ করুন এবং সৎ-ভাবের উন্মেষণে আমাদের অভীষ্ট ফল প্রদান করুন)। হে আমার মন! স্বর্গপ্রাপ্তির জন্য যথা বিহিত সৎকর্ম সম্পাদন করো; তার পর স্বর্গ প্রাপ্ত হও। হে দেবভাবসমূহ! তোমাদের প্রার্থনীয় সামর্থ্য যেন আমরা কঠোর সৎকর্মসাধনের দ্বারা প্রাপ্ত হই। হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ! শ্রেষ্ঠতম স্বর্গে অবস্থিত সর্বজ্ঞ পরমদেবতা তোমাদের–অকিঞ্চনদের সম্যকভাবে প্রাপ্ত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে,–আমি যেন ভগবানের কৃপা লাভ করি)।–হে জ্ঞানদেব! আপনার প্রসিদ্ধ শুদ্ধসত্ত্বযুত পরমধন আমাদের প্রাপ্ত হোক; সেই ধন পরাশান্তির সাথে আমাদের প্রাপ্ত করান; হে শ্রেষ্ঠ হ্লাদিনীশক্তিসমূহ! আপনারা সত্যের মার্গে গমন করুন, অর্থাৎ সত্যসাধনের দ্বারা আমাদের অধিগত হোন; সৎকর্মের মোদায়ক মার্গে পরিচালিত করুন।ভগবান নিত্যকাল পরমধনাকাঙ্ক্ষী সত্যদ্রষ্টা জ্ঞানী সুশিক্ষিত ভগবৎ-ভক্ত শোভন কর্মোপেত স্তোত্রপরায়ণ সাধককে প্রাপ্ত হন। হে আমার মন! স্বর্গলাভের জন্য যথাবিহিত প্রচেষ্টাপরায়ণ হও; এবং দ্যুলোক প্রাপ্ত হও অর্থাৎ মোক্ষলাভের জন্য যথাবিহিত সকর্ম সম্পাদন করো; সৎ-জ্ঞানের সাথে বর্তমান থাকো। হে আমাদের মনোবৃত্তিসমূহ! তোমরা আমাদের কর্তৃক পরিচালিত হয়ে দেবভাবসমূহকে প্রাপ্ত হও; হে সৎ-বৃত্তিসমূহ! আপনারা অমৃতপ্রাপিকা হয়ে ভগবানে আত্ম-উৎসর্গে অভিলাষী আমাদের প্রাপ্ত হোন, তার পর আমাদের পরিত্যাগ না করে দেবভাবপ্রাপক মার্গের দ্বারা পরমাশ্রয়ে উপনীত করুন; আমাদের প্রসিদ্ধ সৎকর্ম প্রাপ্ত করান ॥৪৩ ৷৷
[প্রথম (উদুত্যং প্রভৃতি) মন্ত্র, ভাষ্যমতে, শকটের উপরে বিস্তৃত কৃষ্ণসার মৃগের চর্মের দ্বারা বস্ত্রে আবদ্ধ সোমকে বন্ধন করতে হয়। মন্ত্রটি সূর্য-মন্ত্র। ভাষ্যের অর্থ–কল জগতের বেত্তা সূর্যকে রশ্মিসমূহ ঊর্ধ্বদেশ প্রাপ্ত করায়। কি জন্য?–সকল জগতের দর্শনের জন্য। কেতবঃ পদের অর্থ–ভাষ্যমতে, রশ্ময়। আমাদের মতে ঐ পদের অর্থ–প্রজ্ঞাপক জ্ঞানরশ্মিসমূহ। এই স্থলে প্রজ্ঞাপক শব্দ জ্ঞানকিরণেরই পূর্ণদ্যোতক। দৃশে বিশ্বায় পদের অর্থে সায়ন মন্তব্য প্রকাশ করেছেন,-সমগ্র ভুবনের দর্শনের নিমিত্ত। ও আমাদের মতে সমস্ত দেবভাবের দর্শনের নিমিত্ত। এ স্থলে ভুবন বা দেবভাব উভয় পদই অধ্যাহৃত। সূর্য শব্দের ব্যাখ্যায় আমরা জ্যোতি-স্বরূপ পরব্রহ্ম অর্থ গ্রহণ করেছি। পরব্রহ্মের সূর্য-রূপ বিভূতিতেই জ্যোতিঃর পূর্ণ অভিব্যক্তি। তাই তিনি পূর্ণব্রহ্ম। এ পক্ষে মন্ত্রের বিশেষণ পদকটির বেশ সার্থকতা প্রতিপন্ন হয়। মন্ত্রের ভাবার্থ হয় এই যে,সাধক যখন শুদ্ধসত্ত্বজ্ঞান লাভে সমর্থ হন, তখন তিনি সেই জ্ঞানের সাহায্যে পরব্রহ্মের পূর্ণজ্যোতিঃ ব্রহ্মরস্থিত সহস্রারপদ্মে দেখতে পান; এবং সেই পরব্রহ্মের পূর্ণজ্যোতিঃর প্রভাবে তার সমস্ত দেবভাব আপনা-আপনিই অধিগত হয়ে থাকে। এই মন্ত্রটি সামবেদ-সংহিতার আগ্নেয় পর্বে (১-৩-১২সা) পরিদৃষ্ট হয়। সেখানে সায়ণ যে অর্থ করেছেন, তা কৃষ্ণযজুর্বেদে উদ্ধৃত এই মন্ত্রের অর্থ থেকে স্বতন্ত্র। অপর ব্যাখ্যাকারগণ এই মন্ত্রের যেমন অর্থ পরিগ্রহণ করেছেন, তার মধ্য থেকে আমরা দুটি অর্থ প্রদান করলাম। যথা-(প্রথম)-অশ্বরূপ রশ্মি সকল জন্তু মাত্রের প্রবুদ্ধকর সূর্য নামে প্রসিদ্ধ সেই অগ্নিদেবতাকে নিরন্তর উর্ধে বহন করছে। তাতেই এই বিশ্বচরাচর দৃষ্ট হচ্ছে। (দুই)–যেভাবে ভুবনস্থ সকল লোক দেখতে সমর্থ হয়, সূর্যের রশ্মি বা ঘোটকসমূহ প্রাণিসকলের বিজ্ঞাতা দ্যোতমান্ সেই প্রসিদ্ধ সূর্যকে সেই রকমে উর্ধ্বে বহন করছে অর্থাৎ নিয়ে যাচ্ছে।–দ্বিতীয় মন্ত্র প্রসঙ্গে বলা যায়–এই দৃশ্যমান চরাচরের মধ্যে যে সকল তেজঃ পরিদৃষ্ট হচ্ছে, (যেমন–অগ্নি, বরুণ, সূর্য, চন্দ্র ও নক্ষত্র প্রভৃতির) এ সব তেজের মূলে এক অনির্বচনীয় অখণ্ড তেজঃ বিদ্যমান আছে। তেজের কেন্দ্র একটি। সেই কেন্দ্রীভূত তেজঃ থেকেই পরিব্যক্ত হয়ে এই দৃশ্যমান তেজঃসকল নানারকমভাবে জীবজগতে পরিলক্ষিত হচ্ছে। সুতরাং বহুত্ত্বের মধ্য দিয়ে একত্বকে লক্ষ্য করেই এই মন্ত্র প্রবর্তিত। এই মন্ত্র ব্রাহ্মণগণের সন্ধ্যাবন্দনার মধ্যে সূর্য-উপস্থানের সূর্য-উপস্থানের জন্য স্থান পেয়েছে। কিন্তু সে কোন্ সূর্য? দৃশ্যমান ঐ সূর্যের উপস্থানের জন্য অর্থাৎ সূর্যকে উদ্গত করবার জন্য অথবা সূর্যকে আহ্বান করবার জন্য যদি এই মন্ত্রের প্রয়োগ হতো, তাহলে কেবল প্রাতঃকালে এই মন্ত্রের ব্যবহার হলেই চলত। ত্রিসন্ধ্যায় এটি পাঠের আবশ্যকতা কেন? ফলতঃ এই মন্ত্র এই দৃশ্যমান্ জ্বলন্ত সূর্যকে লক্ষ্য করে প্রবর্তিত হয়নি। এটি পরমাত্মাকে লক্ষ্য করেই নির্দিষ্ট হয়েছে। প্রচলিত অর্থে–মিত্র, বরুণ ও অগ্নির চক্ষুস্বরূপ তেজোময় সূর্য উদিত হয়ে দ্যুলোককে পৃথিবীকে অন্তরীক্ষকে আপন কিরণে উদ্ভাসিত করেছেন। তিনি স্থাবর জঙ্গম পদার্থের প্রাণস্বরূপ। দৃশ্যমান সূর্য স্থাবর জঙ্গমের না হয় প্রাণতুল্য হতে পারেন; কিন্তু মিত্র বরুণ ও অগ্নি প্রভৃতির চক্ষুস্বরূপ অর্থাৎ প্রকাশক–এর তাৎপর্য কি? সূর্যের (অর্থাৎ মিত্রের) প্রকাশক সূর্য-তাই বা কি রকম? এ সূর্যই বা কেন? আর এর প্রকাশক সূর্যই বা কে? সুতরাং এটা চিন্তা করাই কি উচিত নয় যে, সূর্যের প্রকাশক যে সূর্য, অগ্নির প্রকাশক যে সূর্য–সে সূর্য পরমাত্মা। সূর্যঃ আত্মা–এতে কি সূর্যকে পরমাত্মা বলা হলো না? তৃতীয় (অগ্নে নয় সুপথা প্রভৃতি) মন্ত্রে শোভনমার্গে গমন করে, জ্ঞান ভক্তি ও কর্ম মার্গের সাধনায় ভগবানের সন্নিকর্ষলাভের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছে। এ মন্ত্রের ব্যাখ্যায় ভাষ্যকারের সাথে আমাদের বিশেষ মতান্তর ঘটেছে। ভাষ্যমতে মন্ত্রটি দর্শপূর্ণমাস যজ্ঞের পুরোনুবাক্য। সেই অনুসারে মন্ত্রের অর্থ হয়েছে,-হে অগ্নি! আপনি দর্শপূর্ণমাস ইষ্টির ফলস্বরূপ ধনলাভের নিমিত্ত আমাদের অতিপাদদোষ রহিত সুমার্গে পরিচালিত করুন। হে দেব! আপনি সবরকম পথের বিষয়ই অবগত আছেন। নরকহেতুক কুটিল অতিপাদরূপ পাপকে আমাদের সম্বন্ধ হতে বিযুক্ত করুন। তাহলে আমরা বহুরকমে আপনার নমস্কার উক্তি করব।–আমাদের মতে মন্ত্রটি অগ্নিরূপী-জ্ঞানরূপী ভগবানের উদ্দেশ্যে নিয়োজিত।–চতুর্থ মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধনমূলক। নিজের মনকে বলা হচ্ছে-দিবং গচ্ছ অর্থাল স্বর্গে গমনের যথোপযুক্ত সৎকর্মে আত্মনিয়োগ করো এবং তার ফলস্বরূপ স্বর্গ প্রাপ্ত হও অর্থাৎ মোক্ষ লাভ করো। এখানে আমাদের মন যাতে সৎকর্মে নিবিষ্ট হয়, ভগবানে আসক্ত হয় তারই জন্য সাধক চেষ্টা করছেন। পঞ্চম মন্ত্রে প্রার্থনা পরিলক্ষিত হয়। প্রার্থিত বস্তু-শক্তি। বয়ঃ পদের অর্থ শক্তিও হয়, এবং কমনীয় অর্থও হয়। ভাষ্যকারই বিভিন্ন স্থলে এমন অর্থ গ্রহণ করেছেন।-ষষ্ঠ মন্ত্রের প্রার্থনায় তুথঃ পদে ভগবানকে লক্ষ্য করা হয়েছে। ভাষ্যকারও ঐ পদে দেবতা অর্থ গ্রহণ করেছেন। এই মন্ত্রে প্রার্থনার মধ্যে আত্ম-উদ্বোধনাও আছে। বিশ্ববেদা পদের অর্থ– যিনি বিশ্বকে জানেন, সমস্ত বিষয় জানেন। অর্থাৎ সর্বজ্ঞ। একমাত্র ভগবান্ ব্যতীত সর্বজ্ঞ আর কে হতে পারে? মধ্যে তার কৃপা প্রাপ্তির জন্যই প্রার্থনা করা হয়েছে।-সপ্তম মন্ত্রের প্রধান ভাব প্রার্থনা, আরাধ্য দেবতা জ্ঞানদেব। অগ্নে পদে ভগবানের জ্ঞানস্বরূপকে লক্ষ্য করা হয়েছে, সুতরাং তে রাধঃ পদ দুটিতে ভগবানের পরমধনেরই উল্লেখ আছে। সেই ধন কেমন?সোমচ্যুতং অর্থাৎ শুদ্ধসত্ত্বজাত, শুদ্ধসত্ত্বযুত। ভগবানের পরমধন বলতে ভগবৎশক্তিকে–ভগবানের কৃপাকে বিশেষ ভাবে লক্ষ্য করে।-কে ব্রহ্মলাভ করতে পারেন, কার দ্বারা ভগবৎপ্রাপ্তি সম্ভবপর, তা অষ্টম মন্ত্রে বর্ণিত হয়েছে। যাঁরা প্রমধন লাভের জন্য যত্নপরায়ণ, অর্থাৎ যাঁরা নিজেদের হৃদয়কে পবিত্র বিশুদ্ধ করতে পারেন, তারাই ভগবাকে বা তার পরমধনকে লাভ করতে পারেন। অষ্টম মন্ত্রে এই যে নিত্যসত্য প্রখ্যাপিত হয়েছে, তার প্রতি লক্ষ্য রেখেই নবম মন্ত্রের অবতারণা। যাতে আমরা মোক্ষলাভের উপায়ভূত সৎকর্ম সম্পাদন করতে পারি, সেই জন্যই মন্ত্রে আত্ম-উদ্বোধনা আছে। দশম মন্ত্রটি কয়েকটি অংশে বিভক্ত। প্রথম অংশে আত্ম-উদ্বোধন আছে। তার মর্ম এই যে আমাদের চিত্তবৃত্তিসমূহ যেন দেবভাবের অভিমুখী হয়। দ্বিতীয় অংশের ভাবও প্রায় একইরকম; তবে তা ভিন্নভাবে প্রকাশিত হয়েছে। সৎ-বৃত্তিসমূহ যেন আমাদের মধ্যে পূর্ণশক্তিতে বিরাজিত থাকে। সেই সৎ-বৃত্তিসমূহ যেন আমাদের মোক্ষমার্গে পরিচালিত করে–এটাই এই অংশের মর্ম। সৎকর্মের দ্বারাই মানুষ মোক্ষলাভ করতে সমর্থ হয়। দেবভাব মোক্ষলাভের সহায়। তাই বলা হয়েছে,–সুকৃতা লোকে সীতঃ-দেবভাবের প্রাপক পথের দ্বারা আমরা যেন পরমাশ্রয় লাভে সমর্থ হই। ভগবান্ যেন আমাদের সৎকর্ম সাধনের শক্তি ও দেবভাব প্রদান করেন–এটাই মন্ত্রের তাৎপর্য।–এই অনুবাকের প্রথম মন্ত্রটি কৃষ্ণযজুর্বেদের অন্যত্র (১কা-২৪-৮অ) পরিদৃষ্ট হয়; দ্বিতীয় মন্ত্রটি ঋগ্বেদ-সংহিতার প্রথম মণ্ডলের ১৫০ তম সুক্তের প্রথমা ঋ; তৃতীয় মন্ত্রটি কৃষ্ণযজুর্বেদের অন্যত্র দ্রষ্টব্য] ॥৪৩।
.
চতুশ্চত্বারিংশ অনুবাক
মন্ত্র- ধাতা রাতিঃ সবিতেদং জুষাং প্রজাপতিনিধিপতিনো অগ্নিঃ। ত্বষ্টা বিষ্ণুঃ প্ৰজয়া সংররাণো যজমানায় দ্রবিণং দধাতু। সমি লো মনসা নেষি গোভিঃ সং সূরাভৰ্ম্মঘবৎসং স্বস্ত্যা। সং ব্ৰহ্মণা দেবকৃতং যদ ও সং দেবানাং সুমত্যা যজ্ঞিয়ানা। সং বৰ্চসা পয়সা সং তনুভিরগহি মনসা সং শিবেন। বৃষ্টা নো অত্র বরিবঃ কৃণোতু অনু মার্ক্স তনুবো যদ্বিলিস্টম। যদদ্য ত্বা প্রয়তি যজ্ঞে অস্মিন্নগ্নে হোরমবৃণীমহীহ। ঋধগয়াড়ধগুতাশমিষ্টাঃ প্রজানন্যজ্ঞমুপহি বিদ্বান। স্বগা বো দেবাঃ সদনমকর্ম য আজন্ম সবনেদং জুষাণাঃ। জক্ষিবাংসঃ পপিৰাংস বিশ্বেহস্মে ধও বসবো বসুনি। যানাহবহ উশতো দেব দেবার্তা প্রেরয় স্বে অগ্নে সংহে।। বহমান ভরমাণ্য হবীংবি বসুং ঘর্মং দিবমা তিষ্ঠতানু। যজ্ঞ যজ্ঞং গচ্ছ যজ্ঞপতিং গচ্ছ স্বাং যোনিং গচ্ছ স্বাহৈয়। তে যজ্ঞে যজ্ঞপতে সহসুক্তবাকঃ সুবীরঃ স্বাহা। দেবা গাতুবিদ্যে গাতুং বিত্তা গাতুমিত মনসম্পত ইমং নো দেব দেবেযু যজ্ঞং স্বাহা বাঁচি স্বাহা বাতে ধাঃ ॥৪৪৷
মর্মার্থ- পরমধনদাতা বিশ্ববিধাতা জগস্রষ্টা পরমধনাধিপতি, লোকসমূহের পালক, জ্ঞানদেব আমাদের আরাধনা গ্রহণ করুনঃ বিশ্বস্রষ্ঠা সর্বব্যাপক দেব সাধককে পরমানন্দ প্রদান করেন; সৎকর্মের সাধক আমাদের পরমধন প্রদান করুন। বলাধিপতে হে দেব! আপনি কৃপাপূর্বক আমাদের জ্ঞান-কিরণের সাথে সম্মিলিত করুন; পরমধনবান্ হে দেব! আপনি আপনার মঙ্গলশক্তির দ্বারা আমাদের জ্ঞানের সাথে সম্মিলিত করুন; ভগবানের আরাধনার সাথে আমাদের সম্মিলিত করুন। অর্থাৎ আমাদের ভগবৎ-পরায়ণ করুন; হে দেব! আরাধনীয় দেবভাবসমুহের যে দেবত্বপ্রাপক সৎ-ভাব আছে, কৃপাপূর্বক আমাদের তার সাছে সংযোজিত করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে,-হে ভগব! কৃপাপূর্বক আমাদের পরমধন পরাজ্ঞান প্রদান করুন)। (ভগবানের অনুগ্রহেই) আমরা ব্ৰহ্মতেজের সাথে সংযুক্ত হবো; সেই রকম, অমৃতের সাথে এবং কল্যাণাস্পদ মনের সাথে সংযুক্ত হবো। শোভন-দানশীল সেই ভগবান্ আমাদের চতুবর্গরূপ পরমধন বিতরণ করুন এবং আমাদের শরীরের মধ্যে যে অঙ্গ সৎকর্মসাধনে অক্ষম, তাকে সৎকর্মসাধনের অনুকূল করে পোষণ করুন।–হে জ্ঞানদেব! যে হেতু আমরা অদ্য অর্থাৎ নিত্যকাল সক্কর্মের সাধনে প্রবর্তমান হয়ে সৎকর্মের সাধক আপনাকে আহ্বান করছি, সেই হেতু আপনি আমরা যাতে সমৃদ্ধ হতে পারি তা করুন; অপিচ, আমাদের সমৃদ্ধ করে আমাদের বিঘ্ন বিনাশ করুন; তারপর আমাদের প্রার্থনা জেনে সৎকর্মকে প্রাপ্ত হোন। হে দেবভাবসমূহ! স্বাধীন প্রসন্নচিত্ত আপনারা আমাদের সৎকর্মসমূহকে প্রাপ্ত হন, সেই আপনাদের আমাদের আশ্রয়স্থান করব; হে দেবগণ! সকলের আরাধনায় এবং আমাদের প্রার্থনা-গ্রহণকারী সকল পরমধনসম্পন্ন আপনারা আমাদের পরমধন প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে,-হে ভগবন্! কৃপাপূর্বক আমাদের পরমধন প্রদান করুন; আমরা যেন ঐকান্তিকতার সাথে ভগবৎপরায়ণ হই। জ্যোতির্ময় হে জ্ঞানদেব! আপনি আমাদের প্রার্থনীয় যে দেবভাবসমূহ সাধকদের প্রাপ্ত করান, সেই দেবভাবগুলি আমাদের হৃদয়ে সংস্থাপিত করুন; হে দেবভাবসমূহ! ভগবানের পূজোকরণপ্রাপক সাধকদের পালনকারী আপনারা জ্যোতিঃরূপ পরমধম আমাদের প্রদান করুন; তার পর মোক্ষ সম্যকভাবে প্রাপ্ত করান। হে সৎকর্মশক্তি! আপনি আমাদের সৎকর্ম প্রাপ্ত করান, অর্থাৎ আমরা যেন সৎকর্মপরায়ণ হই; হে সকর্ম! আপনি সঙ্কর্মের অধিপতি ভগবানকে প্রাপ্ত হোন; হে সৎকর্ম! আপনি আপন আশ্রয়স্থান আমাদের প্রাপ্ত হোন; আমাদের মঙ্গল হোক।–হে সৎকর্মাধীশ! আমাদের অনুষ্ঠীয়মান সস্তোত্রক আত্মশক্তিদায়ক সঙ্কর্ম আপনাকে প্রাপ্তির জন্য হোক; আমাদের মঙ্গল হোক।-যজ্ঞ ইত্যাদি সৎকর্মের বেত্তা হে দেবভাবসমূহ! আপনারা আমাদের সঙ্কর্মের ইচ্ছা জেনে সেই সকর্মকে প্রাপ্ত হোন; দ্যোতমান, মনে অধিষ্ঠিত হে দেব! অনুষ্ঠিত সকর্ম দেবভাবের অর্থাৎ দেবভাব সংজননের জন্য আপনাদের সমর্পণ করছি। স্তোত্র মন্ত্রে (অথবা স্তোত্রমন্ত্রের উৎকর্ষসাধনের জন্য, শক্তিপ্রজননের জন্য আমার কর্ম আপনাকে সমর্পণ করছি; এই কর্মফল ভগবানে সমর্পিত হোক। হে দেবগণ! আপনাদেরও ভগবানে সংস্থাপিত করুন; হে দেব! এই কর্মফলকে বায়ুর মতো অনন্ত করুন ॥৪৪৷
[ভাষ্যকার প্রথম মন্ত্রের ধাতা সবিতা অগ্নিঃ প্রভৃতি পদে বিভিন্ন দেবতাকে লক্ষ্য করেছেন। তাঁর মতে ঐ পদের উদ্দিষ্ট দেবতারা যেন বিভিন্ন। তার এমন মত প্রকাশ করবার কারণ সম্ভবতঃ এই যে, মন্ত্রে জুবন্তাং এই বহুবচনান্ত ক্রিয়াপদ ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু আমরা মনে করি, রাতিঃ ধাতা প্রভৃতি পদগুলি অগ্নিঃ পদের বিশেষণরূপে ব্যবহৃত হয়েছে। গৌববে বহুবচনং এই সূত্র অনুসারে একবচনের স্থলে বহুবচন ব্যবহৃত হয়েছে। অথবা অন্যদিক দিয়ে আলোচনা করলেও সেই এক মীমাংসায় উপনীত হওয়া যায়। অগ্নিঃ ধাতাঃ প্রভৃতি পদে ভগবানেরই বিভিন্ন বিভূতির উল্লেখ আছে, বস্তুতঃ সেই এক দেবতারই মহিমা প্রখ্যাপিত হয়েছে। মূলতঃ এখানে বহুত্ব নেই, একত্ব আছে। রাতিঃ পদে যে অর্থ প্রকাশ করা হয়েছে, তার মূলভাব নিধিপতিঃ এবং প্রজাপতিঃ পদ দুটিতে নিহিত আছে। ভগবান নিধিপতিঃ পরমধনের অধিপতি। কিন্তু তাতে আমাদের কি আসে যায়? উত্তরে বলা যাচ্ছে–তিনি কেবল নিধিপতিই নন, তিনি প্রজাপতিও বটেন। কৃপণের মতো তিনি ধন রক্ষা করাকেই একমাত্র কর্তব্য বলে মনে করেন না, কারণ তার সন্তানকে রক্ষা করা, তাদের মঙ্গল সাধন করাই তার লক্ষ্য। তাই তিনি রাতিঃ–দানশীল, তার অসীম ধনভাণ্ডার তিনি মানবকে বিতরণ করেন। সবিতা এবং প্রজাপতি পদ দুটিতে তার বিশ্বকর্তৃত্ব প্রথ্যাপিত হচ্ছে।–দ্বিতীয় মন্ত্রে ভগবান্ ইন্দ্রদেবকে সম্বোধন করা হয়েছে। তিনি যেন কৃপা করে আমাদের পরাজ্ঞান পরমধন প্রদান করেন এটাই প্রার্থনার মর্ম। গোভিঃ সংনেষি পদ দুটিতে কেউ কেউ অর্থ করেছেন–গরুর সাথে আমরা যেন মিলিত হই, অর্থাৎ গো-ধন লাভের জন্য যেন প্রার্থনা করা হয়েছে। কিন্তু আমরা গো শব্দে জ্ঞানকিরণ বুঝি। গোভি সংনেষি পদ দুটিতে জ্ঞানলাভের প্রার্থনাই বোঝাচ্ছে। মন্ত্রটির দ্বিতীয় প্রার্থনার সাথে প্রথম প্রার্থনার বিশেষ কোন পার্থক্য নেই। কেবলমাত্র স্বস্ত্যা পদের দ্বারা একটা বিশেষত্বের সৃষ্টি হয়েছে। সেই বিশেষত্ব এই যে, আমরা যা লাভ করব, তা যেন মঙ্গল শক্তির দ্বারা পরিচালিত হয়, অর্থাৎ আমরা যেন মঙ্গলের পথে যেতে পারি। তৃতীয় মন্ত্রের ভাবে– যজমান অঞ্জলির দ্বারা পূর্ণপাত্র গ্রহণ করে বিসর্জন দেবে। সংবচসা এই মন্ত্রের দ্বারা মুখমার্জন করবে। তাতে মন্ত্রের প্রথম অর্ধের অর্থ হয়,ব্রহ্মবর্চের সাথে আমরা সঙ্গত হচ্ছি; ক্ষীর ইত্যাদি রসের সাথে আমরা সঙ্গত হচ্ছি; অনুষ্ঠানক্ষম শরীর-অবয়বের সাথে অথবা ভাষা-পুত্র ইত্যাদির সাথে আমরা সংযুক্ত হচ্ছি এবং শান্ত কর্মশ্রদ্ধাযুক্ত মনের সাথে আমরা সঙ্গত হচ্ছি। দ্বিতীয়ার্ধের অর্থ এই যে,-তৃদেব, ধনসমূহ বিহিত করুন এবং আমার শরীরের যে অঙ্গ বিশেষভাবে ন্যূন, তাকে সেই ন্যুনত্ব নাশ করে সৎকর্মের অনুকূল করে শোধন করুন অর্থাৎ ধনের এবং শরীরের সৃষ্টিসাধন করুন। প্রচলিত ভাষ্যের এইরকম অর্থ ছাড়াও, কোনও ব্যাখ্যাকার আবার এই মন্ত্রটির অর্থ করেছেন–আমি অদ্য প্রচুর অন্নের সাথে সঙ্গত হচ্ছি, প্রচুর পানীয়ের সাথে সঙ্গত হচ্ছি, আপন শরীরে সৌন্দর্য, বল, তেজঃ প্রভৃতির উন্নতি লাভ করছি, অদ্য আমার মনে সুন্দর শান্তি স্থাপিত হলো, বিখ্যাত বদান্য ত্বদেবতা আমাকে প্রভূত ঐশ্বর্য প্রদান করুন; এবং আমার শরীরে যে সকল দোষ আছে, তা সংশোধন করুন। আমাদের বক্তব্য মর্মার্থেই প্রকাশিত হয়েছে–চতুর্থ মন্ত্রের সম্বোধ্য দেবতা–জ্ঞানদেব অর্থাৎ ভগবানের জ্ঞানরূপ বিভূতি৷ অদ্য পদে নিত্যকাল বোঝায়। ইহ পদে যজ্ঞের প্রতি লক্ষ্য আসে। যজ্ঞে অর্থাৎ সৎকর্মের সাধনে প্রবৃত্ত হয়ে যজ্ঞসাধনের মুখ্যকারণভূত জ্ঞানকেই সকর্মসাধক নিজের পথপ্রদর্শকরূপে লাভ করতে চান; জ্ঞানকে যজ্ঞের হোতা বলা হয়েছে। মন্ত্রের প্রার্থনার মধ্যে একটা বিশিষ্ট কারণ এই যে, আমরা আপনার শরণাগত হচ্ছি, শরণাগতকে রক্ষা করা অবশ্য কর্তব্য। আমরা আপনার দুয়ারে আশ্রয় ভিক্ষার জন্য উপস্থিত হয়েছি; সুতরাং আপনি আমাদের সমৃদ্ধ করুন, উন্নত করুন।–পঞ্চম মন্ত্রের সম্বোধ্য বিষয়–দেবভাবঃ–দেবভাবসমূহ। তাঁরা কেমন?–স্বগা–স্বাধীন। স্বাধীন–অর্থাৎ স্ব এবং অধীন–অর্থাৎ যিনি নিজের অধীন। নিজে নিজেরই অধীন, অর্থাৎ আপন শক্তির ও জ্ঞানের বলেই নিজেকে পরিচালিত করেন। কখনই তিনি অন্যের দ্বারা চালিত হন না, জগৎ তাঁর শক্তিতে চালিত হয়, তাই তিনি স্বাধীন। প্রসন্নচিত্ত, সাধকের প্রতি কৃপাপরবশ যে পরম দেবতা, তিনি আমাদের প্রাপ্ত হোন; অর্থাৎ আমরা যেন ভগবানকে লাভ করতে পারি–এটাই প্রার্থনার মর্ম। সেই দেবভাবের সাহায্যে যাতে আমরা পরমধনের অধিকারী হতে পারি তার জন্য মন্ত্রের শেষাংশে প্রার্থনা আছে। সেই পরমধন কে দান করবে? উত্তরে বলা হচ্ছে জক্ষিবাংসঃ–সকলের আরাধনীয় এবং পপিবাংসঃ–আমাদের প্রার্থনা গ্রহণকারী। ষষ্ঠ মন্ত্রের আরাধ্য অগ্নিদেবের অর্থাৎ জ্ঞানদেবতার স্বরূপ কেমন? তিনি উশতঃ অর্থাৎ আমাদের আরাধনা-কামনাকারী। এর কারণ কি? তার কারণ এই যে, মানুষ ভগবানের আরাধনার দ্বারাই আপন জীবনের চরম ও পরম অভীষ্ট সিদ্ধ করতে পারে। এই মন্ত্রে কয়েকটি প্রার্থনা আছে। প্রথম প্রার্থনার অর্থ এই যে, জ্ঞানের দ্বারা যে উচ্চ পবিত্র ভাব লাভ করা যায়, তা যেন আমরা লাভ করতে পারি। এই জ্ঞানকিরণই মানুষকে দেবত্ব প্রাপ্ত করান, পরমধন প্রদান করেন। ঘর্মং বসুং তিষ্ঠত–প্রার্থনার মধ্যে ঘর্মং পদটি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। জ্ঞানের দ্বারা পরমধন লাভ হয়, সে কিরকম ধন? ঘর্মং অর্থাৎ জ্যোতির্ময় জ্যোতিস্বরূপ পরমধন,–যে ধনের দ্বারা জীবন উজ্জ্বল ও মধুর হয়।
সপ্তম মন্ত্রের যজ্ঞ যজ্ঞং গচ্ছ অংশের সাধারণ অর্থ-হে যজ্ঞ! যজ্ঞকে প্রাপ্ত হও। মনে হয়, এটি অর্থহীন। কিন্তু মন্ত্রটির সমগ্রভাব দেখলে এর অর্থ স্পষ্ট হয়। দ্বিতীয় অংশ–যজ্ঞপতিং গচ্ছ–অর্থাৎ যজ্ঞপতিকে প্রাপ্ত হও। এখানেও যজ্ঞ শব্দকেই সম্বোধনসূচক বলে গ্রহণ করা হয়। মন্ত্রের প্রথম অংশের যজ্ঞ যজ্ঞং গচ্ছ অংশের দুটি অর্থ গ্রহণ করা যায়। উভয়ক্ষেত্রেই সঙ্কর্মের অধিপতি দেবতাকে সম্বোধন করা হয়েছে। প্রথম অর্থ এই হয় যে, সৎকর্মকে পাবার জন্য সৎকর্মের কাছেই প্রার্থনা করা হয়েছে। ভগবানকে লাভ করবার জন্য ভগবানের কাছেই প্রার্থনার মতো, ভগবানের কর্মশক্তির কাছে কর্মশক্তির জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। অথবা এই অর্থও করা যায় যে, যজ্ঞ পদে ভগবানের কর্মশক্তিকেই লক্ষ্য করা হয়েছে। ভগবৎ-শক্তির কৃপায় আমরা যেন সকর্মে আত্মনিয়োগ করতে পারি–এটাই মন্ত্রাংশের অর্থ। আমরা এই শেষোক্ত অর্থটিই গ্রহণ করেছি। মন্ত্রের অপর অংশের ভাব–আমাদের সঙ্কর্ম যেন যজ্ঞপতি সেই ভগবানকে প্রাপ্ত হয় অর্থাৎ সৎকর্ম-সাধনের দ্বারা আমরা যেন ভগবানের চরণে পৌঁছাতে পারি, তা-ই এই প্রার্থনার উদ্দেশ্য। স্বাহা পদ মঙ্গলবাচক। সেই মঙ্গলময় অবস্থাই স্বাহা পদে লক্ষিত হয়েছে।-অষ্টম মন্ত্র সপ্তম মন্ত্রের ভাবই বিশদভাবে প্রকাশ করছে। এই মন্ত্রের সম্বোধ্যপদ-যজ্ঞপতি অর্থাৎ সকল সৎকর্মের অধিপতি। ভগবানের চরণেই সব কর্মাকর্মের বোঝা নামিয়ে দিতে হয়। আমরা পূর্বৰ্মন্ত্রের যজ্ঞ যজ্ঞপতিং গচ্ছ অংশের মধ্যে তা-ই দেখেছি। এই অষ্টম মন্ত্রের প্রার্থনার বিষয়–ভগবৎপ্রাপ্তি। তাই বলা হয়েছে সহসূক্তবাকঃ সুবীরঃ যজ্ঞঃ তে ভবতুঃ–প্রার্থনাসমন্বিত আত্মশক্তিদায়ক সৎকর্ম আপনার জন্য, আপনাকে প্রাপ্তির জন্য হোক। অর্থাৎ প্রার্থনা ও সৎকর্মের দ্বারা আমরা যেন আপনাকে লাভ করতে পারি, এটাই প্রার্থনার সারমর্ম।এই অনুবাকটির দ্বিতীয় মন্ত্র ঋগ্বেদ-সহিতায় (৫ম-৪২-৪ঋ) প্রাপ্তব্য; তৃতীয় মন্ত্র শুক্লযজুর্বেদসংহিতার দ্বিতীয় অধ্যায়ের চতুবিংশী কণ্ডিকা; চতুর্থ মন্ত্র ঋগ্বেদ-সংহিতার তৃতীয় মণ্ডলের ঊনত্রিংশ সূক্তের যোড়শী ঋ; নবম মন্ত্র কৃষ্ণযজুর্বেদের প্রথম কাণ্ড প্রথম প্রপাঠক, এয়োদশ অনুবাকে পরিদৃষ্ট হয় ] ॥৪৪।
.
পঞ্চচত্বারিংশ অনুবাক
মন্ত্র- উরুং হি রাজা বরুণকার সূৰ্য্যায় পন্থমন্বেতবা উ। অপদে পাদা প্রতিধাতবেহকরুতাপবক্তা হৃদয়াবিধশ্চিৎ। শতং তে রাজ ভিষজঃ সহস্ৰমুৰ্ব্বী গম্ভীরা সুমতিম্ভে অস্তু। বাধস্ব দেযষা নিঋতিং পরাচৈঃ কৃতং চিদেনঃ প্ৰ মুমুক্ষ্যম্মৎ। অভিষ্ঠিত বরুণস্য পাশে। অষ্মেরনীকমপ আ বিবেশ।। অপাং নপাৎ প্রতিরক্ষন্নসূয্যং দমেদমে সমিধং যক্ষ্যগ্নে। প্রতি তে জিহ্বা ঘৃতমুচ্চরণ্যেৎ। সমুদ্রে তে হৃদয়মস্বতঃ। সং ত্বা বিশেন্তোষধীরুতাহপো যজ্ঞস্য ত্বা যজ্ঞপতে হবির্ভিঃ। সূক্তবাকে নমোবাকে বিধেম। অবyথ নিচম্পূণ নিচেরুরসি নিচম্পুণঃ দেবৈৰ্দেকৃতমোনোহয়াডব মৰ্তৈৰ্ম্মৰ্ত্তকৃতমুরোরা নো দেব বিষম্পাহি। সুমিত্রা না আপ ওষধয়ঃ সন্তু দুৰ্ম্মিত্ৰাস্তস্মৈ ভূয়াসুর্যোহম্মান্দেষ্টি যং চ বয়ং দ্বিম্মঃ। দেবীরাপ এষ বো গর্ভস্ত বঃ সুপ্রীতং.. সুভৃতমকর্ম দেবেষু নঃ সুকৃতো ৰূতাৎ। প্রতিযুতো বরুণস্য পাশঃ প্রত্যস্তো বরুণস্য পাশঃ। এবোহস্যেধিষীমহি সমিদসি তেজোহসি তেজো ময়ি ধেহ্যপো অম্বচারিষং রসেন সমসৃম্মুহি। পয়স্বাং অগ্ন আহগমং তং মা সং সৃজ বৰ্চসা ॥৪৫৷৷
মর্মার্থ- সেই শ্রেষ্ঠ অভীষ্টসাধক বরুণদেব, যথাক্রমে সুর্যের উদয় ও অস্তের পথ বিস্তীর্ণ করে রেখেছেন; (ভাব এই যে,–সেই দেবতাই সূর্যের প্রতিষ্ঠাতা)। সেই দেবতা পদহীন (উপায়হীন) বিপন্নজনে পদ দুটি বিধান করে পথ প্রদর্শন করুন; আর সেই দেবতা হৃদয়মর্মভেদী শত্রুরও সংহারকারী হোন। (প্রার্থনার ভাব এই যে,-যে দেবতা সুর্যেরও গতিপথ নির্ধারিত করেছেন, তিনি উপায়হীন বিপন্ন আমাদের মুক্তিপথ প্রদর্শন করুন)। হে স্বপ্রকাশ বরুণদেব! আপনার অশেষ রকম ঔষধ আছে; (ভাব এই যে,-হে দেব! আপনিই অশেষ রকমে বন্ধনমোনক্ষম)। আমাদের প্রতি আপনার করুণা-প্রদর্শনের ইচ্ছা প্রভূত ও অচঞ্চল হোক; আমাদের অনিষ্টকারী পাপবুদ্ধিকে আমাদের নিকট হতে পরান্মুখ করে দুরীকৃত করুন; আমাদের কৃত পাপকে আমাদের হতে সম্পূর্ণভাবে দূর করুন। (প্রার্থনার ভাব–হে দেব! আমাদের পাপ হতে মুক্ত করুন এবং মোক্ষ প্রদান করুন)। হে দেব! অভীষ্টবর্ষক দেবতার কৃপায় আধিভৌতিক ইত্যাদি তিনরকম বন্ধন নিরাকৃত হোক। হে দেব! জ্ঞানদেবের মুখস্বরূপ অর্থাৎ জ্ঞানের সারভূত অমৃত আমাদের মধ্যে প্রবেশ করুক; হে অমৃতদায়ক দেব! হে জ্ঞানদেব! আপনি প্রতিহৃদয়ে অর্থাৎ সর্বত্র সৎকর্মসাধনে প্রতিবন্ধককে নিরাকৃত করে জ্ঞানসাধনের উপায় আমাদের প্রদান করুন; হে দেব! আপনার অমৃততুল্য জ্ঞান আমাদের প্রদান করুন। হে আমার মন! তোমার হৃদয় অমৃতসমুদ্রে প্রবেশ করুক; মোক্ষপ্রাপিকা ভক্তি ইত্যাদি অপিচ, অমৃত তোমাকে প্রাপ্ত হোক; হে সৎকর্মের অধিপতি দেব! সৎকর্মর্জাত প্রজোপকরণের দ্বারা আপনাকে যেন প্রাপ্ত হই; হে ভগব! সবরকম প্রার্থনামন্ত্রের দ্বারা আমরা যেন আপনাকে আরাধনা করি। সর্বতোভাবে পাপক্লেদপরিশূন্য (শুদ্ধসত্ত্বপোষণকারী) স্থিতপ্রজ্ঞ (মহত্ত্ব ইত্যাদি গুণসম্পন্ন) হে দেব! যদিও আপনি চঞ্চলগতিবিশিষ্ট (সহসা কেউ আপনাকে ধারণা করতে পারে না); তথাপি কৃপা করে আমাদের ধারণার অধীন হোন (আমাদের মধ্যে প্রজ্ঞানরূপে অবস্থিত হোন)। (ভাব এই যে,–মহত্ত্ব ইত্যাদি গুণসম্পন্ন দেবতা উচ্চ-নীচ নির্বিশেষে সকলেরই প্রতি করুণা বিতরণ করেন। সুতরাং অকিঞ্চন হলেও আমরা তাঁর করুণা-লাভে বঞ্চিত হবো না)। দেবতা-বিষয়ে জ্ঞানতঃ আমাদের যে সব ক্রটি-বিচ্যুতি হয়েছে; অপিচ, মনুষ্য-সম্বন্ধে মনুষ্যস্বভাবসুলভ আমাদের যে ক্রটি-বিচ্যুতি ঘটেছে; সে সব ত্রুটি-বিচ্যুতি (এর দ্বারা–সৎকর্মের অনুষ্ঠানে) অপনীত হোক। (অর্থাৎ-দেবতা বা মনুষ্য-বিষয়ে আমরা জ্ঞানকৃত বা অজ্ঞানকৃত যে সব পাপ-অনুষ্ঠান করেছি; আমাদের সে সমস্ত পাপ দূর হোক)। হে দেব! বহু অনিষ্টসাধক সংসাররূপ বন্ধন হতে আমাদের পরিত্রাণ করুন। (অথবা যাতে আমরা কঠোর সংসার-বন্ধনে আবদ্ধ না হই, তার উপায় বিধান করুন। হে ভগব মোক্ষপক জ্ঞানভক্তি ইত্যাদি আমাদের জন্য অমৃতস্বরূপ পরমমঙ্গলদায়ক হোক; যে রিপু আমাদের হিংসা করে এবং মুক্তিকামী আমরা যে রিপুকে বিনাশের বা বিনাশ করতে ইচ্ছা করি, সেই রিপুর প্রতি ভগবানের শক্তি ধ্বংসকারী হোক। (প্রার্থনার ভাব এই যে, আমাদের রিপুগণ বিনষ্ট হোক)। হে অমৃতস্বরূপিণী দেবীগণ! আমাদের হৃদয় আপনাদের নিবাসস্থান হোক; আপনাদের জন্য যেন আমাদের হৃদয়কে প্রীতিদায়ক এবং সৎকর্মসাধক করি। দেবভাবের মধ্যে আমাদের সকর্ম প্রচারিত হোক অর্থাৎ আমরা যেন সকর্মের প্রভাবে দেবভাব লাভ করি। হে ভগবন্! অভীষ্টবর্ষক দেবতার কৃপায় মুক্তিবিঘ্ন নিরাকৃত হোক; অভীষ্টবৰ্ষক দেবতার কৃপায় আমাদের আধিভৌতিক ইত্যাদি সবরকম বন্ধন বিনষ্ট হোক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন সবরকম বন্ধন থেকে মুক্ত হই)। হে দেবভাব। আপনি আমাদের উন্নতি-বিধায়ক হন; আপনার কৃপায় আমরা যেন উর্ধমার্গ লাভ করি। আপনি সকর্মের সাধনহেতু হন; আপনি জ্যোতিঃস্বরূপ হন; প্রার্থনাকারী আমাতে অমৃত প্রদান করুন; সৎকর্ম সাধনের উপায়কে অমৃতের সাথে যেন লাভ করি; হে জ্ঞানদেব! অমৃতযুত আপনি আমাদের সেই প্রসিদ্ধ মোক্ষের সাথে সংযোজিত করুন অর্থাৎ মোক্ষপ্রদান করুন । ৪৫৷
[প্রথম মন্ত্রেও রাজা বরুণঃ পদ দুটিতে সেই পরমপিতা পরমেশ্বরের প্রতিই লক্ষ্য রয়েছে। যিনি সূর্যের গতিপথ নির্ধারিত করে রেখেছেন, অর্থাৎ যার নির্দেশে ঐ জগৎলোচন সূর্যদেব প্রতিষ্ঠিত হয়ে আপন নির্দিষ্ট পথে পরিভ্রাম্যমাণ রয়েছেন, তার বিষয় স্মরণ করতে হলে, রাজা বরুণঃ নামে পরমেশ্বরকেই নির্দেশ করে কি? তা ছাড়া, এখানে পরমেশ্বরকে এই নামে সম্বোধন করার একটু বিশেষ তাৎপর্য আছে। বরুণদেব নামে প্রধানতঃ বৃষ্টির অধিপতি দেবকে বোঝায়। বর্ষণই তার বরুণত্বের দ্যোতক। অভীষ্টবর্ষণে শান্তিশীতলতা প্রদানেই তাঁর বরুণ নামের সার্থকতা। এই মন্ত্রে, বিষম সংসারবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে, দারুণ জ্বালায় জ্বলে পুড়ে পাপতাপে তপ্ত জন ভগবাকে আহ্বান করছে। তিনি যেমন বর্ষণের দ্বারা সংসারের শান্তিদান করেন; সেইরকম প্রার্থনাপূরণ করে, মুক্তির পথ প্রদর্শন করুন। তার মাহাত্মের অন্ত নেই। তিনি চলৎশক্তিহীনকে চলৎশক্তি দান করেন, শত্ৰুসংহারে, আমাদের নিঃশঙ্ক করেন, ইত্যাদি। দ্বিতীয় মন্ত্রটিও বন্ধন-মোচনের প্রার্থনা-মূলক। ঔষধ ইত্যাদি প্রয়োগের মাধ্যমে জরাব্যাধির আক্রমণ-প্রতিরোধই একপক্ষে বন্ধন-নিবারণ–বন্ধনমোচন। পক্ষান্তরে, মায়ামোহরূপ সংসারের যে বন্ধনে মানুষ অহর্নিশ বিজড়িত হচ্ছে, সে বন্ধন মোচনের অসংখ্যরকম ঔষধও, হে ভগবান, তোমার কাছেই আছে,–প্রার্থনায় সেই ভাব প্রকাশ, পাচ্ছে। নিঋতি অর্থে পাপ বুঝি।–তৃতীয় মন্ত্রের প্রার্থনার বিষয়-মুক্তি। অভীষ্টবৰ্ষক দেবতার অনুগ্রহে আমাদের সব রকম বন্ধন যেন নিরাকৃত হয়–এটাই প্রার্থনার মূল মর্ম। পাশ পদের দ্বারা মানুষের সব রকম বন্ধনকে বোঝাচ্ছে। এই বন্ধন তিনরকম; আধিভৌতিক, আধিদৈবিক এবং আধ্যাত্মিক। শরীরজনিত এবং শারীর শক্তির সসীমতাজনিত যে বন্ধন, তাই আধিভৌতিক পাশ। শরীর পঞ্চভূতের সমবায়ে গঠিত; তাই ক্ষিতি ইত্যাদি ভূতগণ প্রাকৃতিক যে নিয়মবন্ধনের অধীন, জাগতীয় যাবতীয় বস্তুও সেই নিয়মের অধীন। কেউই সেই প্রাকৃতিক নিয়ম লঙ্ঘন করতে পারে না। এই যে শৃঙ্খল, একেই আধিভৌতিক পাশ বলা হয়েছে। মুমুক্ষু এই আধিভৌতিক বন্ধনকেও অতিক্রম করে যাবেন। আধিদৈবিক বন্ধন সাধারণ মানুষের করায়ত্ত নয়, কিন্তু মুক্তিলাভের পূর্বে এই বন্ধনও বিনাশ করতে হয়। সর্বাপেক্ষা কঠিন শৃঙ্খল–আধ্যাত্মিক বন্ধন। মানুষের অন্তরে অজ্ঞাতভাবে রিপুগণ শৃঙ্খল রচনা করে। সেই অজ্ঞাত-শত্রুকে বিনষ্ট করে মুক্তি পথে অগ্রসর হতে হয়। যাতে আমরা সর্ব রকম বন্ধন হতে মুক্তিলাভ করতে পারি। মন্ত্রে তারই জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। চতুর্থ মন্ত্রের প্রথম অংশের ভাব–আমরা যেন জ্ঞানের সারভূত অমৃত লাভ করি। জ্ঞানের সারভূত অমৃত বলতে কি বোঝায়? মানুষের সর্বাপেক্ষা কাম্য বস্তু–অমৃতত্ব লাভ। মানুষ অমৃতের সন্তান, অমৃত থেকে এসেছে, অমৃতেই মিশবে অর্থাৎ অমৃতত্ব লাভ করবে। সেই অবস্থা প্রাপ্তি–জ্ঞানের সাহায্যেই সম্ভবপর হয়। অপাং নপাৎ পদ দুটিতে অমৃতস্বরূপ দেবতাকে লক্ষ্য করা হয়েছে। ঐ পদ দুটিরও অর্থ হয়–অমৃতের পুত্র। অমৃতের পুত্র অমৃতস্বরূপ। মন্ত্রের এই অংশে জ্ঞানকেই অমৃতের সাথে এক পর্যায়ভুক্ত করা হয়েছে।–পঞ্চম মন্ত্রে প্রার্থনাকারীর হৃদয় যেন অমৃতসমুদ্রে প্রবেশ করে, নিমজ্জিত হয়ে যায়। যজ্ঞপতে পদে ভগবানকেই বোঝায়। যজ্ঞস্য হবির্ভিঃ ত্বং-যজ্ঞজনিত অথবা যজ্ঞস্বরূপ উপকরণের দ্বারা যেন আপনাকে পেতে পারি। আমরা যেন ভগবৎ-পরায়ণ হতে পারি।-ভাষ্যে প্রকাশ-ষষ্ঠ মন্ত্রে বরুণ-প্রঘাস যজ্ঞের অঙ্গীভূত শেষ ক্রিয়া অবতৃথ-যজ্ঞ সম্পন্ন করতে হয়। অবভৃথ শব্দের সাধারণ অর্থ যজ্ঞাবশেষ স্নান। প্রধান যজ্ঞে কোনও ত্রুটি-বিচ্যুতি আশঙ্কা করে, সম্ভাবিত সেই ত্রুটি-বিচ্যুতি পরিহারের জন্য, অপিচ প্রধান যজ্ঞ সমাপনের জন্য, এই অবভৃথ-ক্রিয়া (কর্মকাণ্ডানুসারে) অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। নদী বা জলাশয়ে গমন করে, যজমান যজমান-পত্নী দুজনেই জলের মধ্যে কলসী অধোমুখে স্থাপন করবেন। তারপর মন্ত্র উচ্চারণ করে স্নান সমাপনের পর তারা সেই কলসী পরিত্যাগ করবেন। এটাই সাধারণতঃ অবভৃথ নামে। অভিহিত হয়ে থাকে। তাই মন্ত্রের প্রচলিত অর্থ এই যে,-হে অবতৃথ! হে মন্দগতি জলাশয়! তুমি স্বভাবতই বেগে গমনশীল; তথাপি এক্ষণে মন্দগতিবিশিষ্ট হও। আমরা দেবকার্যের বিষয়ে অজ্ঞানকৃত যে পাপ করেছি, এবং মনুষ্যবিষয়ে মনুষ্য-স্বভাবসুলভ অর্থাৎ অজ্ঞানকৃত যে পাপ করেছি, সে সকলই এই জলে প্রক্ষালিত করছি। হে দেব! আমাদের নানারকম অনিষ্টকারী পাপ রিপুর হস্ত হতে, পরিত্রাণ করুন, অর্থাৎ আমরা যেন আর পাপকার্যে লিপ্ত না হই। প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতেও প্রায় একই ভাব পরিব্যক্ত দেখতে পাই। এই যষ্ঠ মন্ত্রের প্রথম অংশের সব পদই বিশেষ সমস্যা-মূলক। অবyথ পদের অব পূর্বক ভৃ ধাতুর অর্থ পোষণ করা। যিনি সত্ত্বভাব ধারণ এবং পোষণ করেন তিনিই অবভৃথ। একপক্ষে এ ভাব গ্রহণ করা যায়। অন্যপক্ষে, ভাষ্যের অনুসরণে, স্নান-সংক্রান্ত ক্রিয়া ইত্যাদি থেকে ঐ পদে পরিস্নাত কলুষ-ক্লেদ পরিশূন্য অর্থ পরিগৃহীত হতে পারে। দুটি নিচণ পদের প্রথমটি সম্বোধনে প্রযুক্ত। যা নিম্নগতিবিশিষ্ট, তা-ই নিচণ। দয়া-করুণা-স্নেহ নিম্নগতিশীল। দয়ার আধার যিনি, তিনি তাই নিচম্পুণ অর্থাৎ মহত্ত্ব ইত্যাদি গুণসম্পন্ন। সেই জন্যই প্রথম (সম্বোধন পদ) নিচণ পদের এক অর্থ মহত্ত্বাদিগুলোপেত পরিগৃহীত হয়েছে। অন্য অর্থ ভাষ্যমতের অনুসারী। ভাষ্যের মন্দগতিবিশিষ্ট প্রতিবাক্য থেকে ঐ পদে স্থিতপ্রজ্ঞ ভাব আসে। নিচেরুঃ পদের ভাষ্যানুসারী ভাব চঞ্চলগতিবিশিষ্ট; অর্থাৎ সহসা কেউ ধারণ করতে সমর্থ হয় না। আবার চর ধাতু গমন অর্থে প্রযুক্ত হয়। সে পক্ষে যা নিম্নগামী, নিচেরুঃ পদে তাকেই বোঝায়। এইভাবে প্রথম অংশের একরকম ভাব এই হয় যে,–হে শুদ্ধসত্ত্বপোষণকারী মহত্ত্ব ইত্যাদি গুলোপেত দেব! আপনি সকলেরই অনায়াসলভ্য। অতএব, আপনি আমাদের মতো অকিঞ্চনের অনায়াস-লভ্য হোন। আপনি ছোট-বড়-নির্বিশেষে সকলেরই প্রতি করুণা বিতরণ করে থাকেন। অতি অকিঞ্চন আমরা; আপনার করুণায় আমরা বঞ্চিত হবে না বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস আছে। আমরা যাতে আপনাকে অনায়াসে পেতে পারি, আমাদের আপনি সেই সামর্থ্য প্রদান করুন। অন্য ভাবটি, যা প্রার্থনামূলক, আমাদের মার্থে আমরা তা-ই প্রকাশ করেছি। তার মর্ম এই যে,অ-ধর আপনি ধরা দিন; চঞ্চল আপনি, অচঞ্চল হোন। মন্ত্রের দ্বিতীয় অর্থ অপেক্ষাকৃত সরল ও সহজবোধ্য। এখানে প্রার্থনাকারীর জ্ঞানকৃত এবং অজ্ঞানকৃত সর্ব-রকম পাপক্ষালনের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছে। এই মন্ত্রের দেবৈঃ পদের ভাষ্যকৃত অর্থদ্যোতনাত্মকের স্মদীয়ৈরিন্দ্রিয়ৈঃ। যা দ্যোতনাত্মক, তা-ই দীপ্তিদানসমর্থ। এই ভাব থেকে দেবৈঃ পদের আমরা জ্ঞানকৃতৈঃ প্রতিবাক্য গ্রহণ করেছি। মত্যৈঃ পদের ভাষ্যানুমোদিত অর্থ,-মনুষ্যৈরম্মৎসহায়ভূঋৈত্বিগভিঃ। এই অর্থের সাথে সামঞ্জস্য রক্ষার উদ্দেশ্যে মর্তকৃতং পদের অর্থ হয়েছে, যজ্ঞদর্শনে সমাগত ব্যক্তিদের প্রতি আমাদের ঋত্বিগণ অবজ্ঞাপ্রকাশরূপ যে পাপাঁচরণ করেছেন। মনুষ্য-ভাব থেকেই অবজ্ঞা ইত্যাদির সূচনা হয়ে থাকে। তা থেকেই আমরা মর্ত্যেঃ পদে মনুষ্যস্বভাব-সুলভৈঃ অর্থ অধ্যাহার করেছি। এ পক্ষে মন্ত্রের ভাব হচ্ছে এই যে,আমাদের অনুষ্ঠানে, জ্ঞানকৃতই হোক আর অজ্ঞানকৃতই হোক, যে সকল পাপকার্য করেছি, তা অপনীত হোক। মন্ত্রের তৃতীয় অংশের অর্থ অনায়াসেই বোধগম্য হবে।-সপ্তম মন্ত্রের প্রথম অংশের অর্থ–মোক্ষপাক জ্ঞানভক্তি প্রভৃতি যেন আমাদের মঙ্গলদায়ক হয়। ওষধয়ঃ পদটির অর্থ এখানে-ফলপাকাস্তাঃ বৃক্ষাদয়ঃ, মোক্ষপাপিকাঃ জ্ঞানভক্ত্যাদয়ঃ। কোন্ বস্তুর দ্বারা মানুষের নানারকম মঙ্গল সাধিত হতে পারে? এই প্রার্থনায় মোক্ষপ্রাপ্তিরূপ মঙ্গলের প্রতি লক্ষ্য করা হয়েছে। মোক্ষপ্রাপ্তির সর্বাপেক্ষা কঠিন বিঘু–মানুষের রিপুগণ। তাই মন্ত্রের দ্বিতীয় অংশে রিপুনাশের জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে!–অষ্টম মন্ত্রের প্রথম অংশে অমৃতস্বরূপ দেবীগণকে সম্বোধন করে প্রার্থনা করা হয়েছে যে, অমৃতের অধিষ্ঠাত্রী দেবী যেন আমাদের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হন, আমাদের হৃদয় অমৃতে পূর্ণ হোক, অর্থাৎ আমরা যেন অমৃতলাভে ধন্য হই। কিন্তু কেবল মাত্র প্রার্থনা করলেই তো প্রার্থিত বস্তু মিলবে না, তারজন্য সাধনা চাই, উপযুক্ত কর্ম চাই। তাই বলা হয়েছে–অমৃতপ্রাপ্তির উপযোগী শক্তি ও অবস্থা যেন লাভ করি। সেই শক্তি সামর্থ্য লাভ হয়–সৎকর্মের দ্বারা। সুভৃতং পদে সৎকর্মেরই ইঙ্গিত আছে। কিরকম সৎকর্ম? সুপ্রীতং পদে তার উত্তর দেবার চেষ্টা করা হয়েছে। আমাদের হৃদয়কে যেন সৎ-ভাব ও সৎকর্মের দ্বারা পবিত্র করতে পারি। শেষ অংশে সৎকর্মসাধনের দ্বারা দেবভাব প্রাপ্তির জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। নবম মন্ত্রের সেই প্রার্থনাই দুবার করা হয়েছে, যা চতুর্থ মন্ত্রে করা হয়েছে। দশম মন্ত্রের প্রথম অংশে ভগবানের মহিমা প্রখ্যাপিত হয়েছে। ভগবানই মানুষের ঊর্ধ্বগতি বিধান করেন, তাই তাঁর চরণে পরাগতি লাভের জন্য প্রার্থনা–এধঃ অসি, এধিষীমহি। তার পরের কয়েকটি অংশে ভগবানের মাহাত্ম প্রখ্যাপিত হয়েছে। সমিৎ অসি তজঃ অসি অংশ দুটিতে ভগবানের গুণগান করা হয়েছে। ভগবানই তেজঃ ও জ্যোতিঃর উৎস। তাঁর অনুকম্পাতেই মানুষ সৎকর্মসাধনে সমর্থ হয়। তাঁর জ্যোতিঃলাভ করেই নিজেদের গন্তব্যপথ নিধারণ করতে সমর্থ হয়। সেই জ্যোতিঃই মানুষকে অমৃতের পথে নিয়ে যায়। তাই মন্ত্রের প্রার্থনা–ময়ি অপঃ ধেহি–আমাতে অমৃত সংস্থাপন করুন, আমাকে অমৃত প্রদান করুন। মন্ত্রের শেষ অংশেও অমৃত লাভের প্রার্থনাই আছে, কেবলমাত্র সর্বশেষ অংশে জ্যোতিঃ ও মোক্ষ-প্রাপ্তির প্রার্থনা পরিদৃষ্ট হয়। এই অনুবাকের প্রথম মন্ত্র ঋগ্বেদ-সংহিতায় (১ম-২৪-৮ঋ) প্রাপ্তব্য; দ্বিতীয় মন্ত্রটিও ঋগ্বেদ-সংহিতায় উপরোক্ত মণ্ডলের ২৫ সুক্তে পরিদৃষ্ট হয়; ষষ্ঠ মন্ত্রটি শুক্লযজুর্বেদ-সংহিতার তৃতীয় অধ্যায়ের অষ্টচত্বারিংশী কণ্ডিকা] ॥৪৫৷
.
ষট্চত্বারিংশ অনুবাক
মন্ত্র- যা হৃদা কীরিণা মন্যমানোহমং মর্ত্তো জোহবীমি। জাতবেদো যশো অম্মাসু ধেহি প্রজাভিরগ্নে অমৃতত্বমশ্যাম। যস্মৈ ত্বং সুকৃতে জাতবেদ উ লোকমগ্নে কৃণবঃ স্যোন। অশ্বিনং স পুত্ৰিণং বীরবন্তং গোমন্তং রয়িং নশতে স্বস্তি। ত্বে সু পুত্র শবসোহবৃত্ৰ কামকাতয়ঃ। ন জামিন্দ্রাতি রিচ্যতে।। উথউথে সোম ইন্দ্রং মমাদ নীথেনীথে মঘবানম্ সুতাসঃ। যত্বীং সধঃ পিতরং ন পুত্রাঃ সমানদক্ষা অবসে হবন্তে। অগ্নে রসেন তেজসা জাতবেদো বি বোচসে। রক্ষোহাহমীবাতনঃ। অপো অম্বচারিষং রসেন সমসৃম্মাহি। পয়স্বাং অগ্ন আহগমং তং মা সৎ সৃজ বৰ্চসা। বসু পতিহিকমস্যয়ে বিভাবসু। স্যাম তে সুমতাবপি। ত্বমগ্নে বসুপতিং বসুনামভি প্র মন্দে অরেষু রাজ। ত্বয়া বাজং বাজয়ন্তো জয়েমাভি য্যাম পৃৎসুতীমত্তানা। ত্বমগ্নে বাজাতমং বি বর্ধন্তি সৃষ্টুতম্।। স নো রা সুবীৰ্য্যম। অয়ং নো অগ্নিৰ্ব্বরিবঃ কৃপোত্বয়ং মৃধঃ পুর এতু প্রভিন্দ। অয়ং শত্ৰঞ্জয়তু জঈর্ষাণোয়ৎ ব জং জয়তু বাজাসাতে। অগ্নিনাইগ্নিঃ সমিধ্যতে কবিগৃহপতির্যবা। হব্যবাজুহাস্যঃ। ত্বং হ্যগ্নে অগ্নিনা বিপ্রো বিপ্ৰেণ সৎসতা। সখা সখ্যা সমিধ্যসে। উদগ্নে শুচয়স্তব বি জ্যোতিষা৷ [আ দদে বাচম্পতয় উপমহীতোহস্যা বায়ো অয়ং বাং যা বা প্রাতযুঁজাবয়ং বেনস্তং প্রথা যে দেবাস্ত্রিংশদুপযামগৃহীতোহসি মুৰ্দ্ধানং মধুশ্চেন্দ্রাগ্নী ওমাসো মরুত্বস্তমি মরুত্বো মরূত্বাহাম্মহাবৎ কদা বামমদর্কেভিহিরণ্যপাণিং সুশৰ্মা বৃহস্পতিরিরস্য উত্তিস্তরণিরা প্যায়স্কেষ্টে যে জ্যোতিতীং প্রয়াসায় চিত্তমা তিষ্ঠেমসাবি সর্বস্য মহাৎসজোষা উদু ত্যং ধাততারুং হি যা ষট্চত্বারিংশৎ। আদদে যে দেবা মহানুত্তিষ্ঠৎসবর্বস্য সন্তু দুৰ্মিত্রাশ্চতুঃপঞ্চাশৎ] ॥৪৬৷৷–
মর্মার্থ- সর্বজ্ঞ হে দেব! মরণ-ধর্ম আমি প্রার্থনাপরায়ণ হয়ে অমৃতস্বরূপ আপনাকে স্তুতি পরায়ণ হৃদয়ের দ্বারা সম্যকভাবে পূজা করছি। হে জ্ঞানদেব! প্রার্থনাকারী আমাদের মধ্যে যশোধন সংস্থাপিত করুন, আমরা শক্তির সাথে অমৃতত্ব যেন প্রাপ্ত হই। জ্ঞাতপ্রজ্ঞ হে জ্ঞানদেব! আপনি যে সৎকর্মসাধকের জন্য মঙ্গলকর আশ্রয় করেন, সে সাধকই ব্যাপক-জ্ঞানযুত মোক্ষের উপায়ভূত আত্মশক্তিযুত পরাজ্ঞানযুত মঙ্গলকর পরমধন প্রাপ্ত হন। –হে প্রবল পরাক্রান্ত দেব! আমাদের সবরকম স্তুতি আপনাতে সুষ্ঠুভাবে বর্তমান থাকুক; হে বলাধিপতে দেব! কোনও স্তুতি আপনাকে অতিক্রম করতে পারে না অর্থাৎ আপনাতে সর্বগুণ সর্বশক্তি বর্তমান আছে। যখন সকল প্রার্থনাতে সাধকবর্গের হৃদয়ে উৎপদ্যমান শুদ্ধসত্ত্ব ভগবান্ ইন্দ্রদেবকে তৃপ্ত করেন, সর্ব সৎকর্মে উৎপদ্যমান বিশুদ্ধ সত্ত্বভাব পরম-ঐশ্বর্যশালী দেবতাকে তৃপ্ত করেন, তখন একমতাবলম্বী সৎকর্মের সাধনে সামান-উৎসাহযুত পুত্র স্থানীয় মানবগণ পিতৃ-স্থানীয় এই দেবতাকে রক্ষা লাভের জন্য আরাধনা করেন। –হে জ্ঞানদেব! হে সর্বজ্ঞ দেব! রিপুনাশক অন্তঃশত্রুবিনাশক আপনি অমৃত ও জ্যোতিঃর সাথে আমাদের সম্যভাবে সংযোজিত করুন। –হে জ্ঞানদেব! আপনি অমৃত-আকাঙ্ক্ষী আমাদের অমৃতের সাথে সংযোজিত করে দিন; হে দেব! জ্যোতিঃর সাথে অমৃতকামী আপনারা অনুগত আমাকে প্রাপ্ত হোন।–হে জ্ঞানদেব! যেহেতু আপনি পরম ধনের অধিপতি, জ্যোতিঃসম্পন্ন সাধকদের পরম-আশ্রয় হন, সেই হেতু আমরাও আপনার কৃপাতে বর্তমান থাকব অর্থাৎ আপনার কৃপা লাভ করব।–হে জ্ঞানদেব! পরমধনের অধিপতি আপনাকে পরমধন-প্রাপ্তির জন্য সকর্মের সাধনে আরাধনা করছি; হে বিশ্বের অধিপতে! আপনার আনুকূল্যে পরমধন-কামনাকারী আমরা যেন পরমধন লাভ করি,–রিপু-সেনাসমুহ অভিভব করি।–হে জ্ঞানদেব! সর্ব-আরাধনীয় শ্রেষ্ঠ শক্তিযুত আপনাকে জ্ঞানী সাধকবর্গ পূজা করেন, সেই প্রসিদ্ধ আপনি আমাদের আত্মশক্তি প্রদান করুন। প্রসিদ্ধ জ্ঞানদেব আমাদের প্রভূত ধন প্রদান করুন; প্রসিদ্ধ এই জ্ঞানদেব রিপুদের বিনাশ করে আমাদের প্রাপ্ত হোন; জ্ঞানদেব আমাদের রিপুবর্গকে জয় করুন; জয়শীল আনন্দদায়ক এই দেবতা রিপু-সংগ্রামে আমাদের শক্তি প্রদান করুন। মেধাবী, কর্মকুশল, লোকসমূহের পালক বা রক্ষক, নিত্যতরুণ চিরনূতন, সত্ত্বপ্রাপক–ভগবানের সমীপে কর্মবাহক, প্রকাশরূপে সত্যজ্যোতিঃ সম্পন্ন, জ্ঞানাগ্নি (জ্ঞানদেব), জ্ঞানের দ্বারাই সম্যক্ দীপ্যমান বা পরিবৃদ্ধি প্রাপ্ত হন। (ভাব এই যে-আলোকের সাহায্যে যেমন আলোক প্রকাশ পায়, জ্ঞানই সেইরকম জ্ঞানের প্রকাশক হন)। হে জ্ঞানদেব! আপনিই জ্ঞান-তেজের দ্বারা আমাদের উদ্বোধিত করেন, সর্বজ্ঞ আপনি জ্ঞানের দ্বারা আমাদের উদ্বোধিত করেন; হে দেব! সত্য-স্বরূপ আপনি সত্যের দ্বারা আমাদের উদ্বোধিত করেন, বন্ধুভূত আপনি সখিত্বের দ্বারা আমাদের উদ্বোধিত করুন। –হে জ্ঞানদেব! আপনার পবিত্র নির্মল প্রভা জ্ঞানকিরণসমূহের সাথে আমাদের হৃদয়ে উপজিত হোক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন বিশুদ্ধ পরাজ্ঞান লাভ করি) ॥ ৪৬।
[এই অনুবাকের ত্রয়োদশটি মন্ত্রের প্রথম মন্ত্রে ভগবানের জ্ঞানশক্তিকে সম্বোধন করে প্রার্থনা করা হয়েছে। প্রথম মন্ত্রের প্রথম অংশের ভাবমর্ত্য মানব, অমর্ত্য দেবতাকে পূজা করছেন অথবা পূজা করেন। দ্বিতীয় অংশের ভাব–অমৃতত্বপ্রাপ্তি। যিনি অমর্ত, যিনি মরণধর্মরহিত তার কাছেই মৃত্যুর উপরে যাবার জন্য প্রার্থনা রয়েছে।–দ্বিতীয় মন্ত্রেরও সম্বোধ্য পদ–অগ্নি–জ্ঞানদেব–জাতবেদঃ। যিনি জামাত্রই জ্ঞানী, অর্থাৎ জ্ঞানের বিকাশমাত্রই তাকে জাতপ্রজ্ঞ বলা বলা হয়েছে। যিনি মানুষকে পরমাশ্রয় প্রদান করেন, তিনিই জগতের সবরকম মঙ্গলের সৃষ্টিকর্তা ও বিধাতা। যিনি ভগবানের কৃপালাভের যোগ্য, তিনিই পরমসুখের অধিকারী হতে পারেন; অথবা ভগবানের কৃপাবলেই মানুষ চরম ও পরম সুখ লাভ করে জীবন সার্থক করে।-তৃতীয় মন্ত্রে ভগবানের শক্তি-স্বরূপের উপাসনা করা হয়েছে। শবসঃ পুত্রঃ পদ দুটিতে শক্তির পুত্র অর্থ হয়। ভাবের অনুসরণে ঐ পদ দুটিতে শক্তিস্বরূপ, প্রবলপরাক্রান্ত প্রভৃতি অর্থ গৃহীত হয়েছে। কিন্তু সসীন মানুষ যে ভাবে, যে ভাষার সাহায্যেই ভগবানের মহিমা কীর্তন করুক না কেন, কিছুতেই সেই অনন্ত পুরুষের মাহাত্ম সম্যভাবে পরিব্যক্ত করতে পারবে না। তাই মন্ত্র বলছেন–ত্বাং ন অতিরিচ্যতে–কেউই আপনার মহিমা সম্যভাবে বর্ণনা করতে পারে না। ভগবান যে অবামনসোগোচরং এটাই এই মন্ত্রে প্রখ্যাপিত হয়েছে।–চতুর্থ মন্ত্রে প্রিতরং ন পুত্ৰাঃ উপমাবাক্যে এক উচ্চভাবের পরিস্ফুটন দেখতে পাই। সাধনার প্রথম স্তরে যে বিচ্ছেদ-ব্যবধান–যে সঙ্কোচ বিদ্যমান ছিল, এখন সে ব্যবধান–সে সঙ্কোচ-সে অন্তরায় দূর হয়েছে। পিতা-পুত্রের সম্বন্ধ-ভাবের মধ্য দিয়ে ভগবানকে দর্শন–এ এক উচ্চ আদর্শ–এ এক মহান্ লক্ষ্য। মন্ত্রের অভিপ্রায় এই যে,–তেমন পুত্র হতে হবে যার মঙ্গল-বিধানের জন্য পরমপিতা সর্বদা নিকটে উপস্থিত থাকেন। শাস্ত্রগ্রন্থে বাৎসল্য-ভাবের যে পরিণতি দেখতে পাই, এখানে তারই অঙ্কুরোদ্গম পরিদৃষ্ট হয়। ফলতঃ যিনি বিশ্বরূপে বিশ্বব্যাপ্ত হয়ে আছেন;–যিনি পিতা, যিনি পালনকর্তা, যিনি পরমেশ্বর, ইন্দ্র বলতে তাকেই বোঝাচ্ছে। –নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক ও প্রার্থনামূলক পঞ্চম মন্ত্রে বলা হচ্ছে, সেই জ্ঞান-শক্তি–রক্ষোহা, অমীবচাতনঃ অর্থাৎ জ্ঞানই আমাদের সবরকমের শত্রুকে–অন্তঃশত্রু বহিঃশত্রুকে বিনষ্ট করে, জ্ঞানের প্রভাবেই আমরা অজ্ঞানতা মায়ামোহ প্রভৃতির প্রভাব থেকে আত্মরক্ষা করতে পারি। কিভাবে তা সম্ভবপর হয়, তা মন্ত্রের প্রার্থনায় পরিস্ফুট হয়েছে। সেই প্রার্থনা–তেজস্ব রসেন বিরোচসে- জ্ঞানশক্তি, অমৃতের সাথে আমাদের সংযোজিত করুন অর্থাৎ আমাদের প্রদান করুন। সেই জ্ঞানশক্তির কাছেই পরাজ্ঞান লাভ ও রিপুনাশের জন্য প্রার্থনা করা। হয়েছে।–পঞ্চম মন্ত্রের মতো ষষ্ঠ মন্ত্রেরও সম্বোধ্য অগ্নে–জ্ঞানদেব। এই মন্ত্রেরও প্রার্থনার মূল উদ্দেশ্য-অমৃতপ্রাপ্তি।-সপ্তম মন্ত্রে ভগবানকে বিভাবসু বসুপতিঃ বসু প্রভৃতি পদের দ্বারা বিশেষিত করা হয়েছে। বিভাবসুঃ বসুপতিঃ বসুঃ প্রভৃতি পদের দ্বারা বিশেষিত করা হয়েছে বিভাবসুঃ পদের অর্থ জ্যোতিঃই যাঁর ধন, অর্থাৎ পরমজ্যোতিঃসম্পন্ন জ্যোতিঃস্বরূপ।বসুপতি পদে সেই পরমধনের অধিপতিকে বোঝায়। বসু অর্থ বাসয়িতা, অর্থাৎ যিনি সাধকদের পরমাশ্রয় প্রদান করেন, তিনি বসু বা বাসয়িতা। সেই পরমদেবতার কৃপালাভেই এই মন্ত্রের প্রার্থনা।–অষ্টম মন্ত্রের প্রথম অংশের অর্থ এই যে,–আমার আপনার আরাধনা করছি। এই উক্তির উদ্দেশ্য পরে বিবৃত হয়েছে,বাজং জয়েম এবং মতানাং পৃৎসুতি অভিস্যাম। ভগবানকে পূজা করলে, ভগবানের আরাধনায় আত্মনিয়োগ করলে, মানুষ পরমধনের অধিকারী হয়–ভগবানের কৃপায় রিপুকে জয় করতে সমর্থ হয়। সেইজন্য পূজা আরাধনা। পূজা আরাধনার দ্বারা মানুষ উন্নত ও পবিত্র হয়; পরিশেষে মোক্ষলাভে সমর্থ হয়ে থাকে। মন্ত্রের প্রার্থনার ভাবও তা-ই।-নবম মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার বিষয় আত্মশক্তি। চার অংশে বিভক্ত এই মন্ত্রের প্রত্যেক অংশেই প্রার্থনা উচ্চারিত হয়েছে। প্রথম অংশ–বরিবঃ কৃপোতু–আমাদের প্রভূত ধন প্রদান করুন। দ্বিতীয় অংশ–মৃধঃ প্রভিন্দন পুরঃ এতুরিপুবগর্কে বিকাশ করে আমাদের হৃদয়ে বা অন্তরে আগমন করুন, আমাদের প্রাপ্ত হোন। তৃতীয় অংশ–রিপূন জয়তু-ভগবান্ আমাদের রিপুগুলিকে জয় করুন। চতুর্থ অংশের ভাব তৃতীয় অংশের অনুরূপ।–আলোকের সাহায্যেই যে আলোক লাভ সম্ভবপর–জ্যোতির সাহায্যেই যে জ্যোতির্ময়কে লাভ করতে পারা যায়, দশম মন্ত্র সেই তত্ত্ব বিবৃত করছেন। স্বরূপতঃ সর্বত্র অগ্নি তথা জ্ঞানদেব অভিন্ন এ মন্ত্র তারই আভাষ দিচ্ছেন।–একাদশ মন্ত্রের সমোধ্য পদ অগ্নে অর্থাৎ জ্ঞানদেব। ভগবানের জ্ঞান-বিভূতিকে লক্ষ্য করে মন্ত্রটি উচ্চারিত হয়েছে। ভগবানই আমাদের পাপপথ থেকে নিবৃত্ত করবার উপায় বিধান করেন, তিনিই আমাদের পুণ্য-জ্যোতির দ্বারা সৎ-মা প্রদর্শন করেন। আবার যে অভাব ও দুশ্চিন্তার জন্য আমরা পাপকে গ্রহণ করি, সেই অভাব পূরণ করেন–দুশ্চিন্তা দূর করেন। সত্যলাভের জন্য, জ্ঞানলাভের জন্য তিনিই আমাদের হৃদয়ে পুণ্যের প্রেরণা প্রদান করেন। তিনিই বন্ধুরূপে আমাদের হাত ধরে শ্রেষ্ঠতম পথে নিয়ে যান। প্রার্থনামূলক দ্বাদশ বা শেষ মন্ত্রটির সাধারণ অর্থ সরল হলেও, আপাতঃদৃষ্টিতে একটু জটিল বলে মনে হয়। মন্ত্রে অগ্নি অথবা জ্ঞানদেবের নিকট প্রার্থনা করা হয়েছে। কিসের জন্য? জ্ঞানকিরণ অথবা পরাজ্ঞান প্রাপ্তির জন্য। কে সেই প্রার্থনা পূরণকর্তা? অগ্নিদেব। কিভাবে তা পূর্ণ হবে? জ্ঞানদেবের শক্তি আমাদের পরাজ্ঞান প্রদান করবে, তাতেই অভীষ্ট সিদ্ধ হবে। কিন্তু জ্ঞানদেবের জ্যোতিঃ আমাদের পরাজ্ঞান প্রদান করবে কি ভাবে? শক্তি ও শক্তিমান্ যেহেতু অভিন্ন, সুতরাং শক্তি যা প্রদান করবে, তা প্রকৃতপক্ষে শক্তিধরেরই দান। জ্ঞান-শক্তির অধিপতি পরমদেবতা আমাদের পরাজ্ঞান প্রদান করবেন। ফলতঃ মন্ত্রের ভাবার্থ এই যে, আমার স্তুতি বা আমার পূজা যে তিনি গ্রহণ করবেন, সে স্পর্ধা করবার ক্ষমতা কি আমার আছে? তিনি যদি সে পূজা গ্রহণ করেন, সে তার অনুগ্রহের লক্ষণ মাত্র। তার সুবিমল আলোকজ্যোতিঃর মধ্যে প্রতিভাত প্রতিবিম্বিত হয় আমাদের সকর্মনিবহ। সকর্মের সুফল যে অবশ্যম্ভাবী, তা তখন আপনা-আপনিই প্রকট হয়ে পড়ে। সৎস্বরূপ ভগবান–সৎকর্মে পরিতুষ্ট হন। সৎকর্মের সাধনে প্রবুদ্ধ হয়ে সৎ-জ্ঞান লাভ করতে পারলে ভগবানের করুণাধারা আপনা-আপনিই বিগলিত হয়। সৎ-ভাবের নিয়ন্তা সৎস্বরূপ সেই ভগবান্ তাতে স্বয়ংই অনুগ্রহপরায়ণ হন। তার পর সর্বদেব-আহ্বানকারী যে স্তোত্র, সে তো তাঁরই–ভগবানেরই মুখনিঃসৃত। তাঁরই প্রকাশরূপ ভিন্ন সে তো জন্য কিছুই নয়। সুতরাং তারই দেওয়া স্তোত্রমন্ত্রে তিনি তুষ্ট না হবে কেন? একে তিনি আপনা হতেই অনুগ্রহপরায়ণ; তার উপর, তাঁরই স্তোত্রে তার অনুবর্তী হলে, তার প্রদর্শিত পথে বিচরণ করলে, তার তুষ্টিসাধনে সমর্থ না হবো কেন? ভগবান্ করুণাময়। তিনি করুণার প্রস্রবণ উন্মুক্ত করে আছেন। তুমি সামান্য আয়াস স্বীকার করলেই নিঝরের আপনা-আপনি নিঃসারিত সে অমৃতের ধারা পান করতে সমর্থ হবে। তারই জ্যোতিঃ তারই পথে তোমাকে পরিচালিত করবে। সুতরাং সেই জ্যোতিঃ লাভে তৎপর হও।এই অনুবাকের একাদশ মন্ত্রটি ঋগ্বেদেও (১ম-১২সূ-৬ঋ) পরিদৃষ্ট হয়; দ্বাদশ মন্ত্রটি সামবেদের উত্তরার্চিকে (১৪অ-৪দ-৩সূ-৩ম) প্রাপ্তব্য] ॥৪৬। পূজ্যপাদ স্বর্গীয় দুর্গাদাস লাহিড়ী মহাশয় কৃষ্ণযজুর্বেদ-সংহিতার এই পর্যন্ত আধ্যাত্মিক বিশ্লেষণাত্মক অনুবাদ সম্পন্ন করেন। এর পর এই সংহিতার অবশিষ্ট অংশ (অর্থাৎ ১ম কাণ্ড ৫ম প্রপাঠক থেকে ৭ম কাণ্ড ৫ম প্রপাপঠক পর্যন্ত মর্মার্থ) সায়ণাচাৰ্যকৃত ভাষ্যাবলম্বনে অর্থাৎ কর্মকাণ্ড-অনুসারে গৃহীত হয়েছে। আমরা সুধী পাঠকগণকে দেখাতে চেয়েছি যে, এইভাবে এই সংহিতার অপর মন্ত্রগুলিকেও আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যেতে পারে। তবে কর্মকাণ্ডের প্রয়োজনীয়তাও আমরা অস্বীকার করতে পারি না।