ভালো লাগে না — উপন্যাস — বুদ্ধদেব গুহ
০১.
যেদিন এখানে এসে পৌঁছোল তার কয়েকদিন পরে বিকেলে বেরিয়েছে। সামনে দিয়ে একটা খালি সাইকেল রিকশা বেরিয়ে যাচ্ছিল।
এই যে, এই রিকশা, পাবলিক লাইব্রেরি যাবে?
চলমান সাইকেল রিকশাটা থেমে গেল। রিকশাওয়ালার বয়স তিরিশ-টিরিশ হবে।
একটি হলুদ-কালো চেকচেক বুশ শার্ট উর্ধ্বাঙ্গে আর নিম্নাঙ্গে একটি আধময়লা পায়জামা। মুখের দুই কষে সদ্যচিবোনো পানের রসের লালিমা লেগে আছে।
রিকশাওয়ালা দার্শনিকের মতন চোখ সরু করে কয়েক মুহূর্ত নমিতের দিকে চেয়ে রইল। তারপর বলল, ভালো লাগে না।
বলে কী মানুষটা! ভারি অবাক হল নমিত। কী বলা যায়। দার্শনিকের মতনও নয়, যে পুরোপুরিই দার্শনিক।
তারপর ভাবল, এই শিলচর শহরটা, এই বরাক উপত্যকা এবং পুরো কাছাড়-ই একটি বিশেষ জায়গা, যা ওরিজিনাল। যার সঙ্গে অন্য কোনো জায়গারই তুলনা চলে না।
ওষুধ কোম্পানির ম্যানেজার-এর চাকরি নিয়ে এখানে না এলে সত্যিই হারাত নমিত অনেক কিছুই। এই উপত্যকা, এই শহর, এই শহরের মানুষজন, সব কিছুরই এক বিশেষত্ব আছে। মাসখানেক হল এখানে এসেই বুঝেছে সেকথা।
ঘড়িতে দেখল, পাঁচটা বাজে।
মেঘাদা বলেছিলেন পাবলিক লাইব্রেরিতে দেখা করতে। উনি সাড়ে পাঁচটাতে পৌঁছোতে বলেছিলেন। অনেকে যেমন পুলিশ হয়েও ভদ্রলোক থাকেন, মেঘাদাও একেবারে ধুতি পাঞ্জাবি পরা বাঙালি হলেও স্বভাবে পাক্কা সাহেব ছিলেন। অথচ যাকে বলে একেবারে ভেতো বাঙালি। লুঙ্গি পরেন, সিঁদল শুঁটকি খান। তাঁর সাড়ে পাঁচটা মানে সাড়ে পাঁচটাই।
নমিত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে একটু চিন্তাতেই পড়ল। রিকশাওয়ালা তো তার দুয়ে ভালো লাগে না উচ্চারণ করেই চলে গেল। এখন, সময়ে পৌঁছোয় সে কী করে! শেষে ঠিক করল, হেঁটেই যাবে।
তার অফিসের সামনে থেকে পাবলিক লাইব্রেরিতে পৌঁছে যেতে আধঘণ্টা মতনই লাগা উচিত। কিন্তু, এই ভালো লাগে নার দেশে এ ছাড়া আর উপায়ই বা কী? অন্যদিন হলে রিকশার অভাব ছিল না। কী কারণে যেন সারাদিন আজ রিকশাওয়ালাদের হরতাল ছিল। চারটেতে হরতাল উঠেছে। তারপর আর অনেক রিকশাওয়ালাই রিকশা বের করেনি! হয়তো দুপুরে খেয়েদেয়ে বউকে জড়িয়ে ধরে ঘুম লাগিয়েছিল। তারপর আর ভালো লাগেনি বেরোতে। আর ওই রিকশাওয়ালারই মতো যারা বা পথে বেরিয়েছে তাদেরও মুখে ‘ভালো লাগে না’।
এ শিলচরেই সম্ভব। হয়তো এই শান্ত, সবুজ শহরে, এই উপত্যকাতে এখনও কলকাতার মতন সর্বগ্রাসী লোভ এসে থাবা গেড়ে বসেনি। কিন্তু জমির দাম শুনলে মাথা খারাপ হয়ে যায়। এত টাকা আসে কোত্থেকে? উৎসটা? কে জানে! তবে কাছেই বাংলাদেশ। চোরাচালান-টালানও করে নিশ্চয়ই কিছু মানুষ, যেমন প্রায় অধিকাংশ সীমান্তভূমিতেই করা হয়ে থাকে। তা ছাড়া আছে চা। ক্যাশ ক্রপ। এই শহরের চারদিকে তো বটেই, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি, ওদিকে হাফলঙ সবদিকেই অগুন্তি চা বাগান। কংগ্রেসের মারকুটে মন্ত্রী সন্তোষমোহন দেবও তো এই শিলচরেরই মানুষ। তাঁদের পরিবারেও একাধিক চা বাগান আছে।
কলকাতার নমিতদের কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর সতু সেন সাহেবের বাড়ির একপার্টিতে সন্তোষমোহন দেব-এর এক ভাই-এর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। মাঝারি উচ্চতার, সামান্য ভুঁড়ি আছে, মাঝবয়েসি ভদ্রলোক। হাতে পাইপ। মুখে হাসি। নাম সম্ভবত ঝুনু দেব। হ্যাঁ ঝুনুবাবুই! ঝুনুবাবু সেন সাহেবকে বলেছিলেন, যদি কখনো চুপচাপ বিশ্রাম নিতে চান কয়েকদিন তাহলে আমাদের বাগানে গিয়ে থাকুন। অলফাউণ্ড। এভরিথিং অন দ্যা হাউস। উই উইল বি ভেরি হ্যাপি। আমার মেজদা থাকেন ওখানে। দেখাশোনার কোনোই খামতি হবে না।
সেন সাহেবও পাইপ কামড়ে বলেছিলেন, দেখি, যাব একবার। সবই তো আছে জীবনে। শুধু সময় নেই। সময়।
এমনই হয় সংসারে। যাদের হাজার জায়গা আছে বেড়াতে যাওয়ার, হাজার নেমন্তন্ন, তাদেরই যাওয়ার সময় নেই কোথাওই। আর নমিতের মতন স্বল্পবিত্ত, সাধারণ যারা, যাদের সাধ আর সাধ্যের মধ্যে ফাঁক থাকে সব সময়ই বিস্তর, তাদের কে ডাকে? কেউই ডাকে না। তাদের বাৎসরিক ছুটি, তাদের মধুচন্দ্রিমা সব অবহেলাতে অপসৃত হয়। অথচ মধুচন্দ্রিমাতে মধু তো বড়োলোকদের বেশি থাকে না স্বল্পবিত্তদের চেয়ে!
মানি বিগেটস মানি। তা ছাড়া, তেলামাথার মানুষেরা তেলামাথাতেই তেল দিতে ভালোবাসেন।
অবশ্য ওদেরও একটা বক্তব্য আছে। নমিতের কোম্পানির বড়োসাহেব সেন সাহেব একদিন অন্য কারওকে বলছিলেন, ওভারহিয়ার করেছিল নমিত। বলেছিলেন, যাঁরা ওয়েল অফ, অবস্থাপন্ন, তাঁদের মধ্যে বেশকিছু মানুষ জীবনের একটা সময়ে এসে নিজেদের আর্থিক সমতার মানুষ ছাড়া অন্যদের সঙ্গে মেলামেশা করতে চান না। না, সবাই যে স্বার্থপর বা গরিবদের মানুষ মনে করেন না, তা নয়। নানারকম লোভ স্বার্থপরতা, কী অকৃতজ্ঞতা এবং নীচতার শিকার হতে হতে তাঁরা হয়তো বাধ্য হয়েই নিজেদের Coterie-তেই ফিরে যান। তা ছাড়া ঈর্ষার কামড় তো সব সময়ে থাকেই।
সেন সাহেব বলেছিলেন, ঘোষ সাহেবকে, বুঝলে ঘোষ, আমাদের এই বঙ্গভূমে তোমার সাফল্যের পরিমাপ নির্ধারিত হয় তোমার শত্ৰুসংখ্যা দিয়েই। Success is measured by the number of your enemies 1
ঘোষ সাহেব বলেছিলেন, শুধু বঙ্গভূমে কেন? সব জায়গাতেই তো এরকমই।
না, ঘোষ। বঙ্গভূমির মতন দেশ আর নেই এই বাবদে। ডি এল রায় ঠিকই লিখেছিলেন, এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি।
নমিত ভাবছিল এই শিলচর তো বঙ্গভূম নয়। একদিন অবশ্যই ছিল। এখন মানচিত্রে অসম হয়ে গেছে। আসলে শুধুমাত্র বঙ্গভূম তো নেই-ই আর, এ জায়গা। সবার্থেই কসমোপলিটান হয়ে গেছে। যাই হোক। তবে এও ঠিক যে, এই কাছাড়ে, বরাক উপত্যকাতে মুখ্যত বাংলা ভাষাভাষী মানুষদেরই বসবাস যদিও, কিন্তু রাজ্যটা তো অসমই। এখানের মানুষদের ওপরে জোর করে অহমিয়া ভাষা চাপানোর চেষ্টার বিরুদ্ধে উনিশশো একষট্টিতে যে আন্দোলন হয়েছিল তাতে অল্পবয়েসি ছেলে-মেয়ে সমেত চোদ্দো জনের প্রাণ গেছিল পুলিশের গুলিতে। কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গের ক-জন শিক্ষিত বাঙালি এই খবর রাখেন? যদিও তাঁদের প্রত্যেকেই বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের কথা জানেন, একুশে ফেব্রুয়ারির কথা জানেন। বাংলাদেশের শহিদদের জন্যে নানা কবিতা, গদ্য, গানে কান্নাকাটি করেন। তাতে কোনো দোষ দেখেনি নমিত। কিন্তু বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনে নাকি মাত্র দুজন মারা গেছিলেন। ওর মনে হয় যে, এটা অত্যন্তই লজ্জার কথা। কাছাড়ের শহিদদের কোনো খোঁজই রাখেন না কলকাতার মানুষেরা। কলকাতায় মানুষদের মতন কূপমন্ডুক মানুষ সম্ভবত পৃথিবীতে নেই। তাঁদের কাছে কলকাতা আর ভারতবর্ষ সমার্থক। শুধু ভারতবর্ষই বা কেন, হয়তো সারাপৃথিবীই। তাজ্জব ব্যাপার।
লজ্জাই হয় ভাবলে।
.
০২.
দেরি করলা ক্যান? ইটা কিতা?
কী করব দাদা! সাইকেল রিকশা এল না। অন্য রিকশাও ছিল না।
যখনই কারও সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট রাখতে বারাইবা, এইসব ইভেনচুয়ালিটির কথা মনে রাইখ্যাই বারাইতে অইব। হাজারও ছুতা দেওয়া, হেই আমাগো বাঙালিগো একটা হেবিট-এ দাঁড়াইয়া গ্যাছে। কোনো জাতেরই কিসসুই অইব না, অইতে পারে না, যদি পাংচুয়ালিটি, ডিসিপ্লিন তাদের রক্তে-মাংসে মিশ্যা না যায়।
তারপর মেঘাদা একটু চুপ করে থেকে বললেন, চেষ্টা করলেই পারন যায়। যারা সময় দিয়া সময় রাখবার না পারে, তাদের লগে আমার পক্ষে কুনো সম্পর্ক রাখনই সম্ভব নয়। এই কথা তোমারে আজ শ্যাষবারের মতনই কয়্যা দিলাম নমিত। মনে কিছু খারাপ পাইও না য্যান।
নমিত লজ্জিত হয়ে বলল, না না, খারাপ পাব, মানে, ভাবব কেন? আপনি তো ঠিকই বলেছেন। আর আপনি নিজে তো সব সময়েই সময় মেনে চলেন।
হ। অবশ্যই চলি। টাইম ইজ মানি। কিন্তু এহনে সময় যে হতভাগারা মাইন্যা চলে তারাই হইল গিয়া ওয়ারষ্ট সাফারার ইন অল স্ফিয়ারস অফ লাইফ। তাগো পদে পদেই বিপদ। কী অফিসে, কী কলেজে, কী থিয়েটারের রিহার্সালে! আমাগো কিস অইব না।
তারপরই বললেন, চলো, আগগুয়াইয়া যাই গিয়া।
প্রথম প্রথম মেঘাদার ভাষাটা বুঝতে নমিতের খুবই কষ্ট হত। এখন অসুবিধে হয় না। তবে মেঘাদার ভাষাটা সিলেটি বা কাছাড়ের ভাষা নয়। ওঁর বাড়ি ফরিদপুরে না কোথায় যেন ছিল। ওঁর মানে, ওঁর পিতৃপুরুষের। ওঁর বাবা উদবাস্তু হয়ে এসেছিলেন। উনি ফরিদপুর জায়গাটা দেখেননি কখনো। অথচ আশ্চর্য, ভাষাটা ওঁর মুখে জলজ্যান্ত বেঁচে আছে।
কে জানে! এমনি করেই বোধ হয় অসহায় মানুষেরা, বিনা দোষের উদবাস্তুরা, পৃথিবীর সব দেশেই নিজেদের শিকড় আঁকড়ে থাকার বৃথা চেষ্টা করেছে যুগে যুগে। স্বদেশ হারিয়ে গেছে কিন্তু নস্টালজিয়া যায়নি।
নমিত ভাবে, এ অবশ্যই একধরনের মূর্খামি। যে দেশ, তাদের স্বদেশি বলে মানেনি সেই দেশকে বর্জন করাই উচিত ছিল। কিন্তু যা কিছুই উচিত তার কতটুকুই বা করতে পারে মানুষ! পৃথিবীর সব দেশেরই অগণ্য হতভাগ্য মানুষ।
যারা না বেরোল, না বেরোল, কিন্তু যারা বেরোলও, তাদের ভালো না লাগার কী কারণ হল? মানে, রিকশাওয়ালাদের কথা বলছি।
মেঘাদা হেসে উঠলেন। বললেন, আরে ভাল্লাগে না-র সঙ্গে প্রকৃত ভালো লাগা-না-লাগার কোনো সম্পর্ক নাই। ওইটা একটা স্পেশ্যাল এক্সপ্রেশান বরাক উপত্যকার মানুষদের।
বলেন কী আপনি? ভাল্লাগে না?
ঠিকেই কই।
শিলচরের মানুষদের মুখের এই ভালো লাগে না-র মানেটা আক্ষরিকার্থে ধরবা না। তার লগে রিয়্যাল ভালো লাগা-না-লাগার কুনো রিলেশান-ই নাই।
এ আবার কী কথা? ভালো লাগে না মানে ভালো না-লাগা নয়?
না। কইল্যাম-ই ত! ভালো লাগে না মানে এখানে হইতাছে, না। মানে, নিগেটিভ। বোঝলা?
এ তো আশ্চর্য মজা। কী নেগেটিভ?
হঃ। কত রঙ্গে ভরা আমাগো দ্যাশ।
তারপরই বললেন, তুমি জলপাইগুড়িতে বা উত্তরবঙ্গে গেছ কি কখনো? ঔষধ বেচো নাই সেই তল্লাটে কখনোই?
নাঃ।
গ্যালে জানতা। সিখানে যদি কুনো চাষারে জিগাও তুমি, কী করেন বা হে? সে তোমারে উত্তর দিবে, না করি কোনো।
দক্ষিণ কলকাতার স্থায়ী বাসিন্দা নমিত অবাক হল। তারপর হেসে বলল, তার মানে?
মানে হইল গিয়া, কিছু করতাছিও না, কিছু করুমও না। খামোখা আমারে বিরক্ত কইরেন না। এই আর কী!
নমিত হেসে ফেলে বলল, এর মানেটা কী? এই নেগেটিভ অ্যাপ্রোচের? এই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির?
মানেডা আর কী? কাজ করুম না। ভালো লাগে নার না আর না-করি-কোনোর না-এর মধ্যে তফাত বিশেষ নাই। বোঝলা নমিত। ইসব অঞ্চলের মাটি বড়ো উর্বরা। বৃষ্টিও হয় প্রচুর। চাষে তেমন কষ্ট ত ছিল না আগে। কৃষিভিত্তিক দ্যাশ ত। এই সুরমা, বরাক, খুশিয়ারা সবই প্রাণদায়িনী। তবে এহনে এই হইল গিয়া আমাগো ফিলসফি অফ লাইফ। পুরা ভারতবর্ষেরই। ইন জেনারাল। কাম আমরা করুম না। নিজের নিজের কাম ভালো কইর্যা করুম না, কিসসুই জানুম না, শিখুম না। কিন্তু আমরা এহনে হইলাম গিয়া টিভির পুকা। আমরা, এই অধুনা মানুষেরা সর্বজ্ঞ।
পুকা মানে?
আরে ওই হইল গিয়া। তোমরা যারে কও পোকা, ওই আর কী!
তাই?
হ।
এহনে আমরা গল্ক জানি (যদিও যহনে পোলাপান আছিলাম তহনে ডাণ্ডাগুলি আর কাঁচা জাম্বুরা দিয়া মুথা-ঘাসে ভরা মাঠে ফুটবল খেলন ছাড়া কিসসুই খেলি নাই), সুকার জানি, চেস জানি (সেটা অবশ্য বরাবরই জানতাম), ক্রিকেট, সকার, ব্যাডমিন্টন, টেনিস। সাধারণের ব্যাডমিন্টন আর টেবল টেনিস ত ছাইড়াই দিলাম। কী আমরা এহনে জানি না, আমারে কও তো একবার দেহি নমিতবাবু? কোন ফিলিম অ্যাকট্রেসের কোন তারিখ থিক্যা ডিভোর্স হইছে তা পর্যন্ত জানি। শুধু জানি না, আমাগো নিজেদের করণীয় যা কিছু কাম, কী বাড়িতে, কী অফিসে, কী স্কুলে বা কলেজে। এই জাতের উপর দিয়া অন্য হক্কল জাত হাঁইটা যাইব না ত কে যাইব? আমরা চাকর অইব না ত কে অইব?
আপনি বড়ো পেসিমিস্ট মেঘাদা। বড়ো নিন্দুকও বটেন।
নমিত ক্ষীণকণ্ঠে বলল।
হঃ। মাইন্যা লইলাম।
তারপর বললেন, খাইবা নাকি একখান?
কী?
পান?
তারপর বলল, আচ্ছা! আপনি বলছেন, তাই খেতে পারি একখিলি।
বাবা:! আমার এতই বাধ্য! ক্যান? আমার তো বিবাহযোগ্যা মাইয়া নাই ঘরে! আর ব্রাহ্মণীও তো নাই।
আঃ। আপনি না!
তারপর বলল, খয়ের ছাড়া খুব একটা। আর জর্দা-টর্দা তো একদমই না।
হঃ। কও কী! জর্দাই না খাইবা তো পান খাইবা ক্যান? পথের পাশে কত ঘাস, পাতা পুতা গজাইয়া আছে, তারই দুগা ছিড়া লইয়া ছাগলের মতন চিবাও গিয়া। পয়সা খরচ কইর্যা পান খাওনের কাম কী?
নমিত হেসে ফেলল।
বলল, যাই বলুন। আমি একদিনই জর্দা খেয়েছিলাম। প্রাণ প্রায় গেছিল আর কী।
এমন পাখির ছাও-এর মতন যার পরান তার পরানডা চইল্যা গেল কী রইয়্যা গেল তা জাইনবার লইগ্যা আমার কুনো ইন্টারেস্ট-ই নাই।
.
০৩.
আজ শনিবার। মেঘাদা ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্টের সুপারভাইজার। খুব কড়া। তবে দুঃখ। করে বলেন যে, আজকাল যেকোনো কাজই নিজে যেটুকু করা যায় শুধু সেটুকুই করা যায়। অন্যের সাহায্য ও সহযোগিতা যে কাজে দরকার, সে কাজ করতে পারা ভারি কঠিন। কাজ করতে বললে এবং ভালো করে করতে বললে তো বটেই, শত্ৰুই শুধু বাড়ে। তাই অফিসে কাজ আর কারওকেই করতে বলেন না উনি। নিজে ঘাড় গুঁজে কাজ করেন। ফলে, চিরাচরিত নিয়মে অন্যদের অধিকাংশ কাজও তাঁর ঘাড়েই চাপে। তবে শনিবার পাবলিক লাইব্রেরিতে আসেন অফিস করার মতন। রিলিজিয়াসলি। নানা বিষয়ে তাঁর ইন্টারেস্ট। পড়েন, নোটস নেন। শখ ছিল বড়ো ঔপন্যাসিক হবেন। তা না হতে পেরে ব্যাচেলার মানুষ শিলচর থেকেই একটি লিটল ম্যাগাজিন বার করেন। সেইসূত্রে বহু তরুণ-তরুণীর যাতায়াত ঘটে, সবিশেষ, প্রতি শনিবার সন্ধেবেলা। তাঁর অম্বিকাপট্টির বাড়িতে শিলচরের তরুণ কবি, সাহিত্যিক, গায়ক, চিত্রী সবাই জমায়েত হন। কবিতা-গল্প পাঠ হয়, নানা বিষয়ে আলোচনা হয়। কেউ কেউ গানও গায়। আঁকা ছবি নিয়ে আসে কেউ কেউ। তাঁর মাতৃপিতৃহীন ভাইঝি সরোজা নাকি একাই দশভুজা হয়ে সবাইকে চা-তেলেভাজা আর মুড়ি জোগায়।
মেঘাদার বাড়ির শনিবারের এই আড্ডার কথা এখানে আসা অবধি অনেকের মুখেই শুনেছে নমিত। কিন্তু আজই প্রথম এসে পৌঁছোল সেখানে। সরোজার মা-বাবা প্লেনে যখন কলকাতা থেকে শিলচরে আসছিলেন তখন হাইলাকান্দির কাছে এয়ারক্র্যাশে মারা যান একইসঙ্গে। কাছাড়ের গরিব মানুষেরাও প্লেনে যাতায়াত করতে বাধ্য হন কলকাতাতে। কারণ, ট্রেনে বা বাসে গুয়াহাটি যাওয়া বড়ো কষ্টকর। দীর্ঘ সময়ও লাগে। কাছাড়ের মানুষদের অনেক রকমের কষ্ট। সেসব এখানে না এলে জানতেও পেত না নমিত। মাঝে মাঝে ভেবে ও অবাক হয় যে, কলকাতার তথাকথিত শিক্ষিত মানুষেরা প্রকৃতই নিজেদের প্রতিবেশ সম্বন্ধে কত কম জানে। অথচ শিক্ষার আর এক নাম অনুসন্ধিৎসা। কষ্ট সত্যিই আছে অনেক। তবে আনন্দও আছে। যেমন সরোজা।
বাইরের দরজাটা খোলাই ছিল। দরজার বাইরে কয়েকটা সাইকেল। কয়েক জোড়া চটি, কাবলি এবং কেডস জুতো। আজকাল যে কত রকমেরই জুতো বেরিয়েছে। হাঁটার, দৌড়োনোর, নানারকম খেলার। সারাপৃথিবীর মানুষে হবুচন্দ্র রাজার গবুচন্দ্র মন্ত্রীর জুতো আবিষ্কারের পর থেকে এতদিন সম্ভবত তথ্যটি জানতই না। সহসাই যেন আবালবৃদ্ধবনিতা বুঝতে পেরেছে যে, ওইসব জুতো ছাড়া অন্য জুতো পরলেই পায়ের বারোটা বেজে যাবে।
এইসব কথা ভাবতে ভাবতেই মেঘাদার সঙ্গে ভেতরে ঢুকল নমিত।
ঘরে ঢুকেই মেঘাদাই যে গৃহস্বামী এমন মনে করার কোনো কারণ আর রইল না। যারা ইতিমধ্যেই বসার ঘরের মেঝেতে পাতা মস্ত শতরঞ্চি এবং সাদা চাঁদরে ঢাকা তক্তপোশের উপরে ইতস্তত বসে ও আধশোয়া হয়েও ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল, তারা মেঘাদাকে স্বাগত জানাল এমনই ভাবে, যেন বাড়িটা তাদেরই। মেঘাদাই অতিথি।
একজন উঠে এসে মেঘাদার হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে ভেতরের ঘরে রেখে এল। আর একজন বলল, গেঞ্জি আর লুঙ্গিটা নিয়ে আসব নাকি?
যাঃ
মেঘাদা বললেন, লজ্জিত হয়ে।
তারপর বললেন, দ্যাখস নাই যে নমিত সঙ্গে আছে। নূতন মানুষ, কী ভাবব অনে। পুরানা হইতে দে অরে এটু। আমি ইন্দারাতে দুই বালটি জল ঢাইল্যাই লুঙ্গি-গেঞ্জি পইরা চুল ফিরাইয়া ফিটফাট হইয়া আইতাছি পাঁচ মিনিটে। সরোজা বুঝি এহনেও চা-টা দ্যায় নাই তুমাগো?
একবার দিয়েছে সরোজাদি। আবার হবে পেঁয়াজি আর মুড়ির সঙ্গে।
মেঘাদা দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন, ওহো, আলাপই করানো হয় নাই। ইনি হইলেন গিয়া নমিত মুখার্জি। ইওরো ফার্মাসিউটিক্যালস-এর সেলস ম্যানেজার। ইনিও তুমাদেরই মতন রোগাক্রান্ত।
কী রোগ?
একজন জিজ্ঞেস করল।
ভাইরাল ফিবার?
অন্যজনে বলল।
ওষুধ কোম্পানির ম্যানেজারেরও জ্বর হয় তাহলে। এটা একটা নিউজ।
আরেকজন বলল।
সকলেই সেই কথাতে হেসে উঠল।
যে ছেলেটি বলল কথাটা, সে সুদর্শন, তরুণ। একটা সবুজ-রঙা খদ্দরের পাঞ্জাবি পরে আছে আধময়লা পায়জামার সঙ্গে। মুখে বুদ্ধির প্রসাধন। একমাথা ঘন কালো চুল পাশ ফিরিয়ে আঁচড়ানো। কপালের একটা পাশ ঢেকে রয়েছে সেই চুলের ঢলে। তীক্ষ্ণ নাক। উজ্জ্বল দুটি চোখ। ঝকঝকে ছেলে। নমিতের চেয়ে বয়েসে বছর পাঁচেকের ছোটো হবে।
একজন বলল, দুর্বিনয়ের কথার ধরনই এমন। কিছু মনে করবেন না স্যার।
কী নাম বললেন? দুর্বিনয়?
ইয়েস।
বাঃ।
নমিত বলল।
বাঃ কেন?
অন্য আর একজন বলল।
বাঃ এইজন্যে যে, বাঙালিদের নামের মধ্যে বিনয় আর সুবিনয়দের ভিড়ে দুর্বিনয়ও যে, আদৌ থাকতে পারে এটা ভাবার ক্ষমতা পর্যন্ত লোপ পেয়ে গেছিল আমার।
তাই?
বলে, লাজুক হাসি হাসল ছেলেটি।
এমন সময়ে আর একজন বলল, এই তো এসে গেছে সরোজাদি!
নমিত ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। এবং তাকাতেই বিদ্ধ হল। বিদ্ধ হল মানে, বাল্যাবধি কতশো নারীকেই তো কাছ থেকে দেখেছে। আত্মীয়, অনাত্মীয়, বোনের বন্ধু, বন্ধুর বোন, পাড়ার মেয়ে, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সতীর্থ, কিন্তু তাদের কারওকে দেখেই বা তাদের কারও সঙ্গে মিশেই নমিতের একবারও তারই মতন অন্য একজন মানুষ ছাড়া আর অন্যকিছু বলেই মনে হয়নি। মনে হয়নি যে, নারীরা অন্যরকম, মনে হয়নি যে তারা পুরুষের পরিপূরক বা তারা নইলে বিধাতার সৃষ্টি হিসেবে পুরুষ অসম্পূর্ণই থেকে যেত।
সরোজাকে পেঁয়াজির প্লেট সাজানো ট্রে-হাতে করে ঘরে ঢুকতে দেখেই বিদ্যুত্তড়িতের মতন নমিত চমকে উঠেছিল। কে যেন ওর বুকের মধ্যে না বলেও বলে উঠল এই নারীর জন্যেই তোমার জন্ম। এরজন্যেই এত বছর তুমি অপেক্ষাতে ছিলো কোনো মেয়েও যে, এমন মেয়েলি হতে পারে এই সত্য সরোজাকে না দেখলে নমিত হয়তো কোনোদিন জানতেও পেত না।
মাথার ওপরে বাঁশের ধারার বেড়ার ফলস-সিলিং থেকে লম্বা ঝোলানো তারের শেষে একা ন্যাংটো বালব জ্বলছিল। সরোজার পরনে একটা হালকা খয়েরি, বেদানার দানার মতন রঙের খয়েরি শাড়ি, সাদা, ছোটো-হাতার ব্লাউজ। ছোটো-হাতা মানে, বগলকাট্টি নয়। সভ্য অথচ হ্রস্ব। পেছন থেকে ঘুরিয়ে এনে বুকের ওপরে ফেলে-রাখা একটি পুষ্ট বেণী। কোমর ছাপিয়ে নেমেছে এসে ঊরুসন্ধির কাছে। তার একেবারে প্রান্তে, আজকাল আকছার দেখা-যাওয়া রঙিন বা সাদা কাপড়ের ফুল নয়, সত্যিকারের ফুল। গোলাপের মতো দেখতে অথচ গোলাপ নয়। হালকা খয়েরি-রঙা। একেই কি মাছি-গোলাপ বলে? ভাবল নমিত। তারপরই ভাবল, না:। মাছি-গোলাপ তো এত বড়ো হওয়ার কথা নয়।
নমিত দাঁড়িয়ে উঠে হাতজোড় করে নমস্কার করেই নির্বাক হয়ে অপলকে চেয়ে রইল তার দিকে। আর আশ্চর্য! সরোজাও যে স্থান-কাল পাত্র সব ভুলে ওইভাবেই ওই ন্যাংটো উজ্জ্বল বালব-এর নীচে দু-হাতে ট্রেটি ধরে দাঁড়িয়ে রইল নমিতের চোখে চেয়ে। তাদের দুজনের দিকে যে, বহুজোড়া চোখ তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে সেকথা তারা দুজনে একেবারেই ভুলে গেছিল। সময়ের মনে সময় বয়ে যেতে লাগল।
জমায়েত হওয়া বহুজনের মধ্যে থেকে কে যেন কথা বলল। কে বলল, কী বলল, কিছুই কানে গেল না নমিতের। হয়তো সরোজারও নয়। মানুষ-মানুষীর হাতে কখনো কখনো, কোনো দেবদুর্লভ সময়ে সময়ও যে পরাজিত হয়, তা আচম্বিতে উপলব্ধি করে চমৎকৃত হয়ে গেল নমিত।
সংবিত ফিরে পেয়ে সরোজা ট্রেটা নীচু করল। সকলে হাতে-হাতে বড়ো বড়ো প্লেটগুলি নিয়ে নিজেদের মধ্যে ভাগ ভাগ করে রাখল।
একজন বলল, এই সরোজা, মুড়ি দিলি না আর?
দেব। হাত তো দুটোই। এসো না পলাশদা, নিয়ে আসবে আমার সঙ্গে।
সরোজা যেন সংবিত ফিরে পেয়ে, আবারও নিজেকে নিজের মালকিন করে নিয়ে বলল।
চল।
বলে, পলাশ নামক ছেলেটি, যে নমিতেরই সমবয়েসি হবে বলে মনে হল, সরোজার সঙ্গে ভেতরে গেল।
দুর্বিনয় চুপ করে নমিতের মুখে চেয়েছিল। কী যেন খুঁজছিল সে নমিতের মুখে। নমিতের মনে হল নমিত মেঘাদার বাড়িতে সন্ধেবেলাতে আসাতে অত মানুষের মধ্যে একমাত্র দুর্বিনয়ই অত্যন্ত ক্ষুব্ধ এবং কিছুটা বিরক্তও বোধ করছে।
কে একজন বলল, সরোজাদি, মুড়ির মধ্যে পেঁয়াজ কুচিয়ে দিয়ো। ভুলো না।
আর একজন বলল, কাঁচালঙ্কাও দিয়ে কুচি করে।
কপট বিরক্তির সঙ্গে সরোজা বলল, আজ আমার পিমা আসেনি। তার জ্বর। একা হাতে তোদের মতন এক সৈন্যদলকে সামলানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
আরে দাও দাও, প্লিজ। তুমি ইচ্ছে করলে, কী না দিতে পারো।
দুর্বিনয় বলল।
কী না শব্দ দুটি নমিতের কানে লাগল। দুর্বিনয়ও হয়তো নমিতের কানে লাগাবার জন্যেই বলেছিল। কিন্তু সরোজা কথাটা শুনেও না শোনার ভান করল।
পেঁয়াজ-লঙ্কা যা খাও তোমরা, দেখে মনে হয় মুসলমান।
মুসলমানদের গায়ে কত জোর দেখো না! কত খাটতে পারে তারা। হিন্দুদের মতন নাকি? যে একটা বউ রেখেই…
অ্যাই কী হচ্ছে স্থিত!
পলাশ সরোজার সঙ্গে ভেতরে যেতে যেতে ফিরে দাঁড়িয়ে বকে দিল, যে ছেলেটি এইকথা বলল, তাকে।
একটুপরেই পলাশ ফিরে এল একাধিক মুড়ির বাটি নিয়ে ট্রেতে। সরোজা এল না আর। সম্ভবত চা করছে। চা বলে চা! ভাবছিল নমিত। কত কাপ চা লাগবে কে জানে। কেটলি এখানে এনেই তো দিলে পারে। বেচারি!
হঠাৎ-ই এই সদ্য, আলাপিত কন্যাটির প্রতি ওর এত মমত্ববোধ, সহমর্মিতা, সমবেদনা সমব্যথা-এইসবেরই আর এক নাম কি ভালোবাসা?
কে জানে! কখনো ভালবাসেনি তো কারওকে আগে!
ভাবছিল, নমিত।
চা নিয়ে এল পলাশ এবং সরোজা। তাদের পেছনে পেছনে মেঘাদাও এসে ঢুকলেন। ঢুকে তাঁর ইজিচেয়ারটাতে বসলেন লুঙ্গির ওপরে হাফ-হাতা গেঞ্জি এবং একখানা পাতলা সুতির চাদর গায়ে দিয়ে।
শীত বড়ো তাড়াতাড়ি চলে গেল এবারে।
বললেন, মেঘাদা।
চেয়ারাটা যে তাঁরই সে কথা নমিত ঘরে ঢুকেই বুঝেছিল। কারণ, সে চেয়ারটাতে ঘরে অত মানুষ থাকা সত্ত্বেও অন্য কেউই বসেনি। একটা নীল-রঙা বড়ো তোয়ালে পাতা ছিল তার ওপরে। মাথার কাছে তেলের ছোপ। কিছু তেলও মাখেন বটে মেঘাদা! মাথার তেলের ব্যবহার যখন প্রায় উঠেই গেল দেশ থেকে তখন মেঘাদা সম্ভবত একাই হেয়ার-অয়েল ইণ্ডাস্ট্রিকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। চেয়ারটার ডানধারে একটা ছোটো তেপায়া। তাতে কাগজ, কলমদানি, একটি কালো-রঙা ডায়েরি, সুর কোম্পানির, প্রতিদিন দৈনিক পত্রিকার পুজোসংখ্যা, বহু ব্যবহৃত হয়ে প্রায় ছেঁড়াখোঁড়া এ মাসের নবকল্লোল। পানের বাটা রাখা ছিল তার পাশে।
.
মেঘাদা জমিয়ে সেই ইজিচেয়ারে পা তুলে বসে হাতে এককাপ চা তুলে নিয়ে চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, দুর্বিনয়, তোমার কাছে আজ নতুন খবর কী আছে?
দুর্বিনয় বলল, আজ জম্মজিৎদার একটা নতুন কবিতা শোনাব। দারুণ কবিতা। কাছাড়ি ভাষাতে লেখা কিন্তু।
বলেই নমিতের দিকে ফিরে বলল, আপনারই বুঝতে একটু অসুবিধে হবে। আমরা সকলেই ঠিকই বুঝব।
অসুবিধে হবে কেন? আমরা মানে বলে দেব। তা ছাড়া যেকোনো ভাষাই শিখে নেওয়া যায় দু-দিনেই একটু কান থাকলেই। গানেরই মতন। সরোজাই কি আগে তোমাদের ভাষা বুঝতে পারত! ওর মা যেহেতু খাস শ্যামবাজারের মেয়ে, ওর মাদার-টাঙ তো ছিল শ্যামবাজারি ভাষা। ও যখন পারে তখন নমিতই বা পারবে না কেন?
বলেই বললেন, কলকাতাতে তোমাদের বাড়ি কোন পাড়াতে?
লাজুক লাজুক মুখে নমিত বলল, আনন্দবাজারের পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপনে কলিকাতায় নিজ বাটী বোঝাতে যা বোঝায়, তা নেই আমাদের। তবে দু-পুরুষ হল ভবানীপুরেই আছি। ভাড়া বাড়িতে।
মেঘাদা বললেন, তাই?
তারপর বললেন, বিবাহযোগ্য এবং নেগোশিয়েটেড ম্যারেজ যাদের হবে তেমন ছেলে মেয়ে যে বাড়িতে আছে, তাদের রবিবারের আনন্দবাজার রাখতেই হয়।
কী অসীম সার্থকতা একটি কাগজের জীবনের!
পলাশ বলল।
তারপর মেঘাদা বললেন, আমিও কি ছাই বুঝতাম, এখানে যখন প্রথম এলাম ধুবড়ি থেকে। পার্টিশানের পরই না আমার বাবা ফরিদপুর থেকে পাট গুটিয়ে ধুবড়িতেই এসে উঠেছিলেন। মানুষ যেখানে থাকে সেখানেরই মতো তাকে হয়ে যেতে হয়। ভাষা বুঝতে হয়, সেখানের খাওয়া-দাওয়াতে অভ্যস্ত হতে হয়, সেখানের রীতিনীতি, সামাজিক ক্রিয়া-বিক্রিয়া, বিধিনিষেধ জানতে-শুনতে হয়। তা নাহলে সেখানের মানুষের একজন হয়ে থাকাই তো সম্ভব নয়।
পলাশ বলল, জম্মজিৎদার কবিতাটা তো শুনতে দিন মেঘাদা।
আপনি তো থিসিসই সাবমিট করবেন মনে হচ্ছে। চেঞ্জ ইন হ্যাঁবিট্যাট-এর ওপরে। আমরা কি হাতি, না পাণ্ডা ভালুক?
ওয়াইল্ডলাইফ এনথুজিয়াস্ট, জনার্দন বলল।
মেঘাদা বললেন, পাণ্ডা ভালুক তবু এখনও অনেকগুলান পাওয়া যাইব, তুমি আমাগো ওয়ান অ্যাণ্ড ওনলি জনার্দন।
সরি। সরি।
তারপরই বললেন লজ্জা পেয়ে।
তারপর বললেন, কও দেহি দুর্বিনয়। পড়ো জম্মজিবুর কবিতাখান। তা তিনি নিজে আইলেন না ক্যান?
তিনি গেছেন হাইলাকান্দি।
ক্যান? হাইলাকান্দি ক্যান?
হাতি বারাইছে।
হাতি? হাতির লগে তাঁর কী?
আহা! তাঁর আত্মীয়দের চা বাগানে হাতি বড়ো উপদ্রব করছে। চারজন লোক মেরে দিয়েছে মস্ত একটা একরা দাঁতাল। সেটাকে রোগ ডিক্লেয়ার করাতে না পারলে কুলিরা কাজ বন্ধ করে দেবে বলেছে পরশু থেকে। আলটিমেটাম দিয়েছে। জম্মজিৎদার সঙ্গে যে এস ডি পি ও-র খুব খাতির। শিলচর গুরুচরণ কলেজের এক ইয়ারের ছাত্র তো দুজনেই।
দুর্বিনয় বলল, রোগ ডিক্লেয়ার করলেই তো হাতি লজ্জাতে আত্মহত্যা করবে না।
একজন বলল, হাতির আত্মহত্যা করাটাও মোটেই সোজা কথা নয়। দড়ি পাবে কোথায়? হাতিও গাছ থেকে ঝুলতে পারে এমন গাছই বা পাবে কোথায়? কলসিই বা পাবে কোথায় সেই সাইজের?
হেসে বললেন মেঘাদা, তোমরা বড়ো ফাঁকসা আলাপ করো। সময় আর নষ্ট না কইর্যা ইবারে…
ধ্যাৎ! জম্মজিব্দার কবিতাটি শুনতে দেবে কি দেবে না এল তো। এ যে একেবারে পদ্মবনে হস্তীসম ব্যাপার-স্যাপার। কোথায় কবিতা, কোথায় হাতি!
উত্তেজিত হয়ে এবারে বলল দুর্বিনয়।
নমিত চুপ করে চা-এর সঙ্গে একমুঠো মুড়ি পেঁয়াজি দিয়ে খেতে খেতে এইসব কথোপকথন শুনছিল। মজা লাগছিল ওর। রসবোধ আছে শিলচরের মানুষদের। তা ছাড়া, আরও একটা ব্যাপার খুব ভালো লাগছে ওর এই একমাস এখানে আসার পর থেকে। তা হল, কলকাতার মতন মদের সংস্কৃতি শিলচরে এখনও এসে পৌঁছায়নি। গত মাসেই বরাক উপত্যকা সাহিত্য ও সংস্কৃতির সম্মেলন হয়ে গেল। প্রায় দিন পনেরো ব্যাপী। যাত্রা, লোকগীতি, সাহিত্যসভা, কবিতা পাঠ। কলকাতা থেকে সাহিত্যিক, গায়ক এসবও এসেছিলেন। গায়ক তো নয়, গায়িকা। গান ভালো লেগেছিল লোপামুদ্রা মিত্রর। জয় গোস্বামীর কবিতা এবং আরও অনেকের কবিতাকে সুর দিয়ে গাইলেন। জীবনমুখী গানের একটি ধারা। কিন্তু সাহিত্যিক যিনি এসেছিলেন তিনি সুপার-ফ্লপ। না পারেন কথা বলতে, না আছে রসবোধ! বোধ হয় মদটদ না পেয়ে চটেও ছিলেন উদ্যোক্তাদের ওপরে। যখন সাহিত্যসভা হবে তখন তিনি করিমগঞ্জে তাঁর এক কবিবন্ধুর বাড়ি গিয়ে বসে থাকলেন। বাংলাদেশ থেকেও এসেছিলেন দু-জন সাহিত্যিক। তাঁরাই বলতে গেলে সবদিক সামলে নিলেন। ওই সাহিত্যিকের চেয়ে অন্য যেকোনো কবি-সাহিত্যিক এলেই ভালো হত। যাকগে, নমিতের তো কোনো হাত ছিল না। ও এখানে একেবারেই নতুন। সবে দেখছে শুনছে। তার কিছু বলার মতো অবস্থা এখনও আসেনি।
পড়ব?
দুর্বিনয় বলল এবারে।
আর নছল্লা না কইর্যা এবারে দয়া কইর্যা পইড়্যা ফ্যালাও। মেঘাদা অনেকক্ষণ ধরেই এই Beating about the bush এবং নানা detractions দেখে (তারমধ্যে তাঁর নিজের অবদান। যদিও কম নয়।) বিরক্ত হয়ে বললেন। এই সভা বা অ্যাসেমব্লিতে উনিই Speaker। মেঘাদার কথাতে সভা নীরব হল।
দুর্বিনয় উঠে দাঁড়িয়ে পড়তে যাবে এমন সময়ে পলাশ চেঁচিয়ে উঠল, দাঁড়া, দাঁড়া। সরোজা আসেনি। তার আবার আজ কী হল? ভেতরে করেটা কী সে? সরোজা, ও সরোজা! তাড়াতাড়ি।
সরোজা এসে দাঁড়াল।
বসে পড়! বসে পড়।
আবার বলল, পলাশ।
সরোজা মেঘাদার ডানপাশে দেওয়ালে পিঠ দিয়ে মেরুদন্ড সোজা করে শতরঞ্চিতে বসলে এবারে দুর্বিনয় সত্যিই পড়া শুরু করল।
কবিতার নাম : তোমারে কইয়ার হুনো।
নমিত বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল দুর্বিনয়ের মুখে।
মেঘাদা চা-টা শেষ করে বাটা থেকে একখিলি পান মুখে পুরে জর্দার কৌটো থেকে একটু জর্দা নিয়ে মুখে ফেলে, নমিতকে ইঙ্গিতে চুপ করে শুনতে বললেন।
দুর্বিনয় এবার কাগজটা সামনে ধরে আবৃত্তি করতে লাগল :
কাইল মাইজ রাইত কিতা যে অইল আমার মনে একবার ই কাইত একবার হি কাইত ঘুম আইল না তেবো। আলপিন একটা খুচা দিল বুকুর জেব আসলে আলপিন নায় ই তোমার চেরা কুশিয়ারার, এ পারো তুমি, হিপারো আমি মাঝেদি এক বেড়া।
সকলেই হাততালি দিয়ে উঠল। কেউ বলল, মার্ভেলাস। কেউ বলল, দুর্দান্ত। আনন্দে আত্মহারা সকলেই। শুধুমাত্র সরোজাই মুখ নীচু করে চুপ করে রইল। আর দুর্বিনয় মাথা উঁচু করে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে সরোজার মুখে চেয়ে তার নিথর নীরবতার সমুদ্রে কারণ খোঁজার জন্যে মনে মনে ডুবুরি হয়ে নামল। নিস্তব্ধতা ভেঙে সবচেয়ে প্রথম নমিতই প্রশ্ন করল, মানেটা আমাকে বলবেন না?
মেঘাদা বললেন, নিশ্চয়ই বলবে। আসলে, কাছাড়ি ভাষার সঙ্গে আমাদের লিখ্য ভাষার বিশেষ অমিল নেই। একটু মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করলে আর কান খুলে শুনলেই বুঝতে পারবে। বল দুর্বিনয়, মানেটা বলে দে নমিতকে।
দুর্বিনয় একবার চকিতে আড়চোখে সরোজার দিকে চেয়েই মুখ ঘুরিয়ে নমিতকে বলল—‘কাল মাঝরাতে কী যে হল আমার মনে।
একবার এপাশ ফিরি আর একবার ওপাশ, তবু ঘুম কিছুতেই এল না।
একটা আলপিন। বুকের পাঁজরে খোঁচা
দিতে লাগল।
আসলে সেটা আলপিন নয়,
তোমার চেহারা। কুশিয়ারার
এপারে তুমি ওপারে আমি,
মধ্যিখানে এক বেড়া।’
বাঃ।
উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠে বলল নমিত।
বুঝলেন তো?
সবই বুঝলাম শুধু চেরা আর কুশিয়ারা শব্দ দুটির মানে বুঝলাম না।
সকলেই হো হো করে হেসে উঠল।
নমিত বুঝতে পারল না এতে হাসির কী হল?
দুর্বিনয় বলল, চেরা শব্দটির অর্থ হল চেহারা কিন্তু এখানে মুখও বলা যেতে পারে!
আর কুশিয়ারা?
আরে! এয়ারপোর্ট থেকে যখন এলেন শিলচর শহরে তখন কুশিয়ারা নদী পেরিয়ে কি আসেননি! বরাক নদীর একটি উপনদী কুশিয়ারা। অবশ্য কতজন আর নদীর নাম জিজ্ঞেস করে। নদী শুধু নদীই!
কাকে জিজ্ঞেস করবেন? নদীকে?
হঠাৎ সরোজা বলে উঠল।
তা কেন? যদি কেউ জানতে চায়, তবে কি তাকে বলার লোকের অভাব হয়?
পলাশ বলল।
নমিত বলল, এখানের, মানে, বরাক উপত্যকার সকলেই কি এইরকম ভাষাতেই কথা বলেন?
না না। সকলেই কেন বলবেন! এখানে যে অনেকই ভাষাভাষী আছেন। তবে বাংলা ভাষাভাষীরাই তো বেশি তাই বরাক উপত্যকায় বাংলা কম-বেশি বোঝেন অন্য সব ভাষাভাষীই।
বাংলা ছাড়া আর কোন ভাষাভাষী আছেন এই উপত্যকায়? আর সুরমা উপত্যকায়?
সুরমা নদী আর উপত্যকা তো চলে গেছে পূর্ব-পাকিস্তান। অধুনা বাংলাদেশে। শ্রীহট্টতে। ইংরেজরা যাকে বলতেন সিলেট। তাই বরাকের কথাই বলি।
পলাশ বলল।
এখানের মোট জনসংখ্যা কত হবে?
নমিত শুধোল।
তা প্রায় সাড়ে সতেরো লাখ মতন হবে। তারমধ্যে বাংলা ভাষাভাষীই সাড়ে তেরো লাখ। অসমিয়া ভাষাভাষী সাতহাজার মতন হবে। হিন্দিভাষী প্রায় দু-লাখ মতন, রাফলি। ডিমাছা বলে একটি ভাষা আছে। তাও প্রায় ন-হাজারের ওপরে হবে ওই ভাষাভাষীর সংখ্যা। এ ছাড়াও আছে দু-রকম মণিপুরি ভাষা।
দু-রকম মানে?
কেন? বাংলা ভাষারও তো কতরকম আছে। নেই? লিখ্য ভাষার কথা বলছি না। কথ্য ভাষা। দক্ষিণ বাংলার ভাষা আর উত্তর বাংলার ভাষা কি এক? রাঢ় বাংলার ভাষার সঙ্গে কলকাতার ভাষা কি মেলে? বাংলাদেশের চাটগাঁ, নোয়াখালি, মৈমনসিং, বরিশাল, ঢাকা, এসমস্ত জায়গার মুখের ভাষাই তো আলাদা আলাদা। তাই মণিপুরিরও রকমভেদ আছে। স্বাভাবিক। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি আর মেইতেই মণিপুরি।
বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষাভাষীর সংখ্যা কত হবে মেঘাদা?
জনার্দন বলল।
মেঘাদা বললেন, তা বত্রিশ-তেত্রিশ হাজার তো হবেই।
আর মেইতেই মণিপুরির?
–তার ডবল-এরও বেশি। আরে! তোরা ছ্যামড়ারা পড়াশুনা ত করবি না! সুজিতবাবু চমৎকার একখান আর্টিকেল লিখছিলেন না স্মরণিকাতে।
কীসের স্মরণিকা?
নমিত শুধোল।
বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য সংস্কৃতি সম্মেলনের স্মরণে যে বইটি বারাইছিল এই ত মাত্র কয়দিন আগেই। সপ্তদশ সম্মেলনের স্মরণিকা। তাতেই পইড়্যা লইয়ো সুজিত চৌধুরির আর্টিকেলখান। কী যেন নাম ছিল? আরে নামটাও যে মনে পড়ত্যাছে না।
বরাক উপত্যকার দুখিনী বর্ণমালা।
একটি ছেলে বলল।
রাইট। ঠিকেই কইছ কল্যাণ।
মেঘাদা বললেন।
তারপর বললেন, আরে আজ জম্মজিৎ-এর ফাস্টক্লাস কবিতাটা ছাড়া তোরা কেউই কি আর কিছুই শুনাইবি না?
নমিত বলল, মেঘাদা আপনার এই গুরুচন্ডালি ভাষাটা বড়োই পীড়াদায়ক।
নমিতের সেই কথাটাতে সরোজার ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসি এসেই মিলিয়ে গেল।
মেঘাদা বললেন, আমাগো ফরিদপুইর্যা ভাষাটা এক্কেরে ত্যাগ কইরা ফ্যালাইলে, পরে ত আর কইতেই পারুম না।
ক্যান? শুনিসনি কি তোরা নিধুবাবুর গান। নানান দেশে নানান ভাষা, বিনে স্বদেশীয় ভাষা পুরে কি আশা।
কে নিধুবাবু?
আরে! তরা একেবারেই ইললিটারেট, গবেট। রামনিধি গুপ্ত। যিনি প্রথম বাংলা টপ্পার প্রবর্তন করেন।
পলাশ বলল, কখনো তো শুনিনি ওই গান।
নমিত বলল, আমি কিন্তু জানি ওই গানটি। ওর গলাতে লজ্জা ফুটে উঠল। লজ্জা কার জন্যে, কেন, তা সে নিজেও বুঝল না।
জানো গানটা? এল কী তুমি নমিত? সে তো দাঁতভাঙা টপ্পা। লাস্ট লাইনটাতে এসে ঘুচে কি তৃষাতে মনে হয় যেন গায়ক অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবেন। কুঁকড়ে কুঁচিমুচি হয়ে প্রাণই ঘুচে যাবে বুঝি। মাত্র একবারই আমি শুনেছিলাম গানটি হাতিবাগানের এক ভদ্রলোকের বাড়ির আসরে কালীপদ পাঠক মশায়ের গলাতে। শোনাও তো দেখি গানখানি। হায়! হায়! সেই কবে শুনেছিলাম! সে কি আজকের কথা!
সকলের দৃষ্টিই নমিতের মুখের ওপরে পড়ল। নমিত একটু গুনগুন করেই ধরে দিল। ও জানে যে, গানটা ও ভালোই গায়। কিন্তু মেঘাদাদের গান শোনাবার কোনো ইচ্ছে বা আশু প্রয়োজন ওর ছিল না। ও কিন্তু রাজি ছিল গানটি শুধুমাত্র সরোজাকেই শোনাবার জন্যে। গানটি ধরে দিয়েই ও একঝলক তাকাল সরোজার দিকে।
প্রথম কলিটি গাইবার পরই ওর মনে হল সরোজা যেন তিরবদ্ধ হরিণের মতো স্থির হয়ে গেছে। গান-এর মতন তির কি আর আছে? যে সেই তির কখনো খেয়েছে আর যে কখনো সেই তির আত্মবিশ্বাস ভরে ছুঁড়েছে কারও দিকে, শুধু তারাই জানে এর সুখ-দুঃখের কথা। অস্থায়ী থেকে অন্তরাতে এল নমিত, শেষ বিকেলের বিধুর আলোতে হরিণী যেমন করে বনের গভীর থেকে বনজ ঝরনায় জল খেতে নামে।
নমিতের গান শেষ হলে স্তব্ধতা নেমে এল ঘরের মধ্যে। ঘরে যারা ছিল তাদের প্রত্যেকেরই যেন বাকরোধ হয়ে গেল। সরোজা মুখ নামিয়ে তার গোড়ালি-ঢাকা শাড়ির পাড়ের দিকে অপলক চেয়েছিল। ফুল-সাজানো বেণীও ছিল সেই পাড়ের পারে। বেণীতে লাগানো সেই মাছি-গোলাপের মধ্যেও যেন চাঞ্চল্য দেখা গেল সেই গানের অভিঘাতে।
প্রথমে কথা বললেন মেঘাদাই।
বললেন, এ এক আশ্চর্য প্রাপ্তি।
বলেই, একটু চুপ করে থেকে সকলের দিকে চেয়ে বললেন, তোমরা কী বল?
অন্য কেউই কিছু বলার আগেই উনি আবার বললেন, নমিতকে আমাদের মিলনির পার্মানেন্ট মেম্বার না করে কি আর উপায় আছে? ওর এই প্রতিভাটির কথা তো জানা ছিল
আমার। জানি যে ও কবিতা-টবিতাই লেখে শুধু। যেমন তোদের মধ্যে অনেকেই লেখে। কিন্তু এমন গান! এমন গান তো তোরা কেউ গাইবার কথা ভাবতেই পারিস না।
সকলেই সমস্বরে বলল, তা ঠিক।
পলাশ বলল, কথা থাক। পরে হবে। আর কথা না হয়ে আর একটা গান হোক।
সরোজাও মুখ তুলে সলজ্জে বলল, হ্যাঁ। তাই হোক।
ঘরভরতি সকলে এবং মেঘাদাও অবাক হয়ে সরোজার মুখে চাইলেন।
পলাশ বলল, তাও কথা ফুটল আজ। কী হয়েছে রে তোর সরোজা আজ? শরীর খারাপ নয় তো?
দুর্বিনয় বলল, এখনও হয়নি কিছুই। তবে হতে পারে। অবশ্যই হতে পারে।
একথার মানে?
মানে, যে বোঝার বা যারা বোঝার, তারা ঠিকই বুঝেছে।
দুর্বিনয় বলল।
মেঘাদাকে এই প্রথম একটু চিন্তিত দেখাল। চিন্তাটা ঠিক কার জন্যে? এই সাপ্তাহিক মিলনমেলার ভবিষ্যৎ? না, সরোজার ভবিষ্যৎ? না অন্য আর কিছুর জন্যে? তা তিনি নিজেও সঠিক বুঝলেন না। কিন্তু কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন।
দুর্বিনয়ই নীরবতা ভেঙে বলল, গান নমিতবাবু। শুরু করুন।
কিন্তু ওর গলার স্বরে যত না আগ্রহ ঝরল তার চেয়ে অনেক বেশি ঝরল ঈর্ষা। হয়তো একটু বিদ্রূপও। বসন্তের বনপথে যখন পলাশ ও শিমুলের ফুল মিলেমিশে পড়ে থাকে তখন যেমন দূর থেকে বোঝা যায় না কোনটা শিমুল আর কোনটা পলাশ, দুর্বিনয়ের ঈর্ষা আর বিদ্রূপকেও তেমনই আলাদা করা যাচ্ছিল না। মিলেমিশে ছিল।
তখনও নমিত চুপ করে মাথা নীচু করে বসে রইল। মাথা তুলবে কী করে? তুললেই যে সরোজার চোখে চোখ পড়বে। সে যে বাঘের চোখে চোখ পড়ারই মতন হবে। ওর আটত্রিশ বছরের জীবনে নমিত এমন বিপদে এবং অস্বস্তিতে আর পড়েনি। নিজেই নিজের কারণে লজ্জাতে মরে গেল। ওষুধ কোম্পানির সেলস ম্যানেজার হিসেবে বলিয়ে কইয়ে–তুখোর বহির্মুখী হিসেবে ওর খ্যাতি ছিল, কিন্তু ও যে হঠাৎ বাহ্যত এমন অন্তর্মুখী হয়ে উঠবে বা উঠতে পারে তা ও নিজেও জানেনি কখনো।
মেঘাদা বললেন, গাও, আর একখানা গান গাও নমিত। সকলেই শুনতে চাইছে।
নমিত মেঘাদার বাক্যটি শেষ হওয়ার আগেই ধরে দিল গানটা। সুখ কি সতত হয়, প্রণয় হলে।
গানের মুখটি পরিষ্কার হতেই মেঘাদা বললেন, বাঃ। এটা কার গান হে? এটাও কি নিধুবাবুর?
নমিত বলল, না। এটা গিরীশ ঘোষের জীবনের প্রথম গান বলে শুনেছি।
কার কাছে শুনেছ?
দিলীপ মুখোপাধ্যায়ের কাছে। উনি কালীপদ পাঠকের কাছে গান শিখতেন তো!
জনার্দন বলল, তাই? ঠিকানাটা দেবেন তো।
কেন? তুই কী করবি?
পলাশ বলল।
গান শিখব, যখন কলকাতায় যাব।
দেব। নমিত বলল।
তা দিতে পারেন কিন্তু জনার্দনও যে ওঁর কাছে শিখলেই আপনার মতো গাইতে পারবে এ কথা ভাবার মতো মূর্খ আমাদের জনার্দনই হতে পারে। তুই জীবনমুখী গান গা জনার্দন। যা তোর হবে। যা তুই গাইছিস।
এই গানের কী নাম?
চোখ সরু করে অত সহজে দমবার অপাত্র জনার্দন বলল।
পলাশ বলল, গান শুনে আমাদের এক এক জনের বুকের মধ্যে কীসব ঘটে যাচ্ছে বুঝছিস না, কত ফিউজ কেটে গিয়ে সব ঘোর অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে দেখছিস না? এ গানের নাম হওয়া উচিত মরণমুখী গান। আবার কারও কারও হৃদয়ে আলোও জ্বলে উঠছে।
বলেই, সরোজার দিকে ফিরে বলল, বল সরোজা? উঠছে না?
সরোজাকে বাঁচাবার জন্যে মাঝে পড়ে মেঘাদা তাড়াতাড়ি বললেন, গানটা আবার শুরু করার আগে গানের বাণী কী শোনাও তো একবার নমিত।
নমিত বলল,
সুখ কি সতত হয় প্রণয় হলে?
সুখ অনুগামী দুখ, গোলাপেও কণ্টক মেলে।
শশী প্রেমে কুমুদিনী
উন্মাদিনী একাকিনী
তথাপি সে কুহকিনী কত নিশি ভাসে জলে।
সুখ কি সতত হয় প্রণয় হলে?
বাঃ বাঃ মেঘাদা বললেন।
তারপর বললেন, নাও শুরু করো নমিত। কোনোরকম বাজনা ছাড়াই এমন গান তুমি গাও কী করে হে ছেলে!
নমিত মুখে কিছু বলল না। বলবেই বা কেমন করে? ও যখন ওর মনকে কেন্দ্রীভূত করে গান গায় তখন কোনো অদৃশ্য পুরুষ তার পাশে বসে এসরাজে সুর দেন আর পেছনে কারা যেন জোড়া তানপুরার ঝিনিঝিনিতে দু-কানে তার সুর ঢেলে দেন। ওর গলা সুর থেকে নড়বে কী করে?
গানটা শুরু করল নমিত মেঘাদার শেষপ্রশ্নের উত্তর না দিয়েই।
সব প্রশ্নের উত্তর হয় না।
.
০৪.
এখন রাত গভীর।
যে বাড়িতে ও পেয়িং গেস্ট হয়ে আছে সেই বাড়ির মালিক অমলবাবুও ঘুমিয়ে পড়েছেন। উনি মাতাল। তবে ক্ষতিকারক মাতাল নন। শুনেছে নমিত। ও থাকাকালীন একজন শালা শালিও আসেননি পালিতলি থেকে রাত করে বাড়ি ফেরেন সোম থেকে শনি। তারপর খাওয়া-দাওয়ার পরই তাঁর স্ত্রীর কাছে তাঁর বাপের বাড়ির নিন্দা করেন। সরকার পরিবারের সকলেই যে নিমকহারাম, অকৃতজ্ঞ, বেইমান, এইসব কথা রোজই বলেন। একই কথা, একই স্বরগ্রামে, হাজার বার, প্রতিরাতে। সেকথা শুনে শুনে প্রতিবেশীদের সকলেরই বিশ্বাস জন্মে গেছে যে পালিতলির সরকারদের মতন অমন নীচ মানুষ সংসারে আর হয় না। অথচ তাঁর কোনো শালা-শালি যখনই আসেন কালে-ভদ্রে, তাঁদের আপ্যায়নের ঠেলা দেখে ভিরমি খেতে হয় নাকি প্রতিবেশীদের।
পালিতলি জায়গাটা ঠিক কোথায়? কোন বাংলায়? পুবে না পশ্চিমে? উত্তরে না দক্ষিণে? কোন জেলায়? কোন সাবডিভিশনে? কোন মৌজাতে তা জানতে খুব ইচ্ছে করে নমিতের। কিন্তু রবিবার, যেদিনটি সন্ধ্যায় বাড়ি থাকেন অমলবাবু, তাঁর মতে, ভদ্র, স্ত্রী-অন্তপ্রাণ, সন্তানবৎসল, প্রতিবেশী-প্রিয় মানুষ আর দুটি দেখা যায় না। যে কারণে তাঁর অসীম ধৈর্যশীলা চমৎকার স্ত্রী চৈতালি বউদি অমলবাবুর সারাসপ্তাহর দোষকে সপ্তাহান্তের প্রাপ্তির কারণে নিঃশর্তে ক্ষমা করে দেন, সেই একই কারণে হয়তো পাড়া-প্রতিবেশী প্রত্যেকেই অমলবাবুকে ক্ষমা করে দেয়। যেকোনো মহল্লাতে বাস করতে গেলেই যেমন হঠাৎ-হঠাৎ এসে পড়া বে-আদপ, দুশ্চরিত্র হনুমানের অত্যাচার অথবা ভাদ্র মাসে পথের মাঝে রাতভর জুড়ে-থাকা কুকুর-কুকুরির উদ্ভট বিরক্তিকর দৃশ্য সহ্য করতেই হয়, তেমনই অমলবাবুর মতন কিছু স্বীকৃত বিপত্তি নিয়েই বাস করতে হয় এই মহল্লাতেও। কলকাতাতে নমিতদের ক্লাবের ভটচারিয়াদা যেমন পাইপ মুখে বলেন, ইটস ওল ইন দ্যা গেম ব্রাদার! নমিতও ঠিক তেমন করেই নিজেকে বোঝায় অমলবাবুর করা পুরো সপ্তাহের অশান্তি মেনে নিতে-নিতে।
অমলবাবু ঘুমিয়েছেন। অশান্তির আর কোনো কারণ নেই। কিন্তু তবু ঘুম আসছে না আজ নমিতের।
ওর জানলার পাশেই পথ। পথের ওপাশে একটা মস্ত কদম গাছ। কলকাতাতে থাকতে কদম গাছ চিনত না। এখানে এসে চিনেছে। আর জানলার দিকেই বাড়ির গা ঘেঁষেই আছে একটি রাবার গাছ। সেটিকে নাকি অমলবাবুর তেরো বছরের বড়োমেয়ে চার বছর আগে রথের মেলা থেকে এনে লাগিয়েছিল। গাছটার চার বছরের বাড় দেখে অবাক হয়ে যায় নমিত। একটা বয়েস পর্যন্ত মেয়েদের বাড়-এরই মতন। তাদের একটা বয়েস পর্যন্ত, মেয়েদের তিন মাস না দেখলে, দেখে চিনতেই পারা যায় না, এমনই বদলে যায় চেহারা। একই বয়েসি হাফ প্যান্ট পরা ক্যাবলাচরণ খেলার সাথিকে একই জায়গাতে দাঁড় করিয়ে রেখে ওরা দৌড়ে যায় কোন না কোন অচিনপুরে। ওদের গলার স্বরে কিন্তু তেমন কোনো পরিবর্তন হয় না। সেই স্বর আগের থেকে গাঢ় হয় শুধু। আর তাদের খেলার সাথির এতদিন তারই মতন মিষ্টি গলার স্বর ভেঙে-চুরে একেবারে অন্যরকম হয়ে যায়। নাকের নীচে যখন গোঁফের রেখা ছায়া ফেলে তখন ছেলেদের গলার স্বর পুরোটাই বদলে যায়। পুরুষেরা যে নারীদের থেকে অনেকই ব্যাপারে আলাদা, তখনই বুঝতে শেখে মেয়েরা নিজেরাই এবং হয়তো ক্যাবলাচরণ খেলার সাথিরাও।
এরকম নানা এলমেলো পারম্পর্যহীন ভাবনা আসছে নমিতের মাথাতে। ঘুম আসছে না কিছুতেই। একবার এপাশ আর একবার ওপাশ করছে। কণ্টকশয্যা শব্দটা জানে শিশুকাল থেকেই। কিন্তু শব্দটার মানে জানল আজ এই প্রথম।
কী যেন নাম সেই কবির? হ্যাঁ জন্মজিৎ রায়। আলাপ করতে হবে ওঁর সঙ্গে। কুশিয়ারা নদীটাও দেখা হয়নি ভালো করে। সব নদীই নারীদের মতন। তাদের পেরিয়ে আসার সময়ে তাদের ভালো করে দেখা হয় না, হয়তো বোঝাও যায় না। কিন্তু পেরিয়ে দূরে আসার পরে তখন বড়ো সাধ যায় আশ মিটিয়ে দেখতে, ভালো করে চিনতে।
কী যেন কবিতাটা! দারুণ কিন্তু কোনোই সন্দেহ নেই। জন্মজিৎ রায়ের কি কোনো কাব্যসংগ্রহ আছে এই বরাক উপত্যকার ভাষাতে লেখা? খোঁজ করতে হবে মেঘাদার শনিবারের মিলনির সভ্যদের কাছ থেকে। কথা হয়েছে যে, পরের শনিবার মিলনির সব সভ্যের নাম, ঠিকানা, পেশা, শখ এবং তিনি কবি না গায়ক না চিত্রী না আবৃত্তিকার এবং আরও বিশদ বিবরণ সংবলিত একটা সাইক্লোসটাইলড লুজ-লিফ-এর পুস্তিকা দেওয়া হবে নমিতকে। মাসিক চাঁদা চল্লিশ টাকা। তা ও দিয়ে এসেছে। অলটারনেট শনিবারে শুধু মুড়ি তেলে ভাজা নয়, ভালো ভালো খাওয়া থাকে। খাওয়া থাক আর নাই থাক নমিতকে সেখানে যেতেই হবে। মরেছে সে। জীবনে এত বিপদে আর কখনোই পড়েনি। তাও এখানে জীবকটা থাকলে তার পরামর্শ নেওয়া যেত। একেবারে ছেলেবেলার বন্ধু। কিন্তু ছেলেবেলার বন্ধুর কাছ থেকেও যেমন পরীক্ষার হল-এ পাশাপাশি পরীক্ষা দিতে বসেও টোকা যায় না, তেমনই জীবনের অনেকই সমস্যা থাকে, যেখানে তার সাহায্যও পাওয়া যায় না। প্রত্যেক মানুষের হৃদয়ের অন্তস্তলে একটা নিভৃত জায়গা থাকইে, যেখানে অন্তরঙ্গতম বন্ধু বা নিকটতম আত্মীয়র স্পর্শও পোঁছোয় না। সেখানে শুধুমাত্র অন্তর্যামীরই আসন। শুধুমাত্র তাঁর আঙুলই পৌঁছোতে পারে সেখানে।
আর একবার পাশ ফিরল নমিত।
কী যেন কবিতাটা!
তোমারে কইয়ার হুনো অর্থাৎ, তোমাকে বলছি শোনো।
তাই তো?
তাই-ই হবে।
কাইল মাইজ-রাইত কিতা যে
অইল আমার মনো
একবার ই কাইত
একবার হি কাইত
ঘুম আইল না তেবো
আলপিন একটা খুচা দিল বুকুর জেব
আসলে আলপিন নায়
ই তোমার চেরা
কুশিয়ারার এ পারো তুমি, হি পারো আমি।
মাজেদিই এক বেড়া।
বেড়াটা ভাঙতে হবে, ভাঙতে হবে। ওর একটা বুলডোজার চাই। হ্যালো হ্যালো সি এম ডি এ, সুভাষ চক্রবর্তী মশাই, মিস্টার কান্তি গাঙ্গুলি, আমার একটা বুলডোজার চাই। দয়া করে স্পিড-পোস্টে পাঠান শিলচর-এ।
রাত আরও নির্জন। দূরের পথের মোড়ে নাকি চার্চের কাছে কারা যেন নীচুগ্রামে কথা বলতে বলতে হেঁটে যাচ্ছে। দু-তিনজন পুরুষ। নাকি কেউ কথা বলছে নমিতের মাথারই মধ্যে! পথের আলোতে কদম আর রাবার গাছের ডালপালার পাতা-পুতার ছায়াগুলো পথের ওপরে নানা হালকা-গাঢ় সাদা-কালো আলপনা বুলোচ্ছে মৃদুমন্দ হাওয়াতে। বসন্ত আসছে। তার পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।
ঘুম আসছে না সত্যিই নমিতের। সরোজা! আঃ সরোজা! ইঃ সরোজা! কেন মরতে এলাম শিলচরে। প্রোমোশনে? ছাতার প্রমোশন। এমন প্রাণঘাতিকা উন্নতির কোনোই প্রয়োজন ছিল না নমিতের।
ভাবল, নমিত।
আবারও পাশ ফিরে মনে মনে ঠিক করল কালকে কুশিয়ারা নদীটা ভালো করে দেখতে যাবে। সারাদিন কাটাবে নদীপারে, নৌকোতে। কুশিয়ারার এ পারো তুমি হি পারো আমি, মাঝেদি এক বেড়া।
তারপরই মনে পড়ল যে, কাল নটার সময়ে ভাড়ার গাড়িকে বলে দিয়েছে। হাইলাকান্দি যাবে। সেখানে ওর দুজন সেলসম্যান আছে। তাদের সমস্যা নিয়ে আলোচনায় বসতে হবে। অফিসটা নাকি খুবই ছোটো। ওরা একটু বড়ো জায়গা দেখে রেখেছে দু-তিনটি, নমিত গিয়ে দেখে আসবে আজ রাত পোয়ালে। হাইলাকান্দিতে যেতে কি কুশিয়ারা নদী পেরোতে হবে? নদীও তো নারীরই মতন ঘুরে ঘুরে চলে, কুরে কুরে খায়। কে যেন বলল, এয়ারপোর্ট থেকে আসার পথে পেরিয়ে এসেছিল ও। নদী তো ঘুরে গিয়ে হাইলাকান্দির পথে আবারও দেখা দিতে পারে।
আর একটা গান বার বার মনে আসছে ওর। এই ছোট্ট জায়গাতে সাতটার পরেই মহল্লা নির্জন হয়ে যায়। আটটার পরে সাইকেল রিকশার প্যাঁকপ্যাঁকানিও শোনা যায় না আর। এখন গুনগুন করে গান গাওয়া যাবে না। এখন রাত একটা। তবে আওয়াজ না করে গলার অভ্যন্তরে গানটাকে জাগিয়েই আবার আঁতুড়ের শিশুরই মতন নুন খাইয়ে মারবে বলে ঠিক করবে ভাবল।
এটাও যে নিধুবাবুরই গান।
প্রবোধ কি মানে আঁখি? না দেখি তাহারে তারে বুঝলে বুঝিবে কেন? মোর মতো দেখে যারে। মনোনয়ন সংযোগ তারে দেখিবারে প্রবৃত্তিরে নাহি দেখে থাকে নিবৃত্তিরই ঘরে। প্রবোধ কি মানে আঁখি? না দেখি তাহারে!
বুদ্ধদেব গুহর মৃত্যুর পর এ উপন্যাসটি আমাদের কাছে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। তিনি পনেরো ষোলো বছর আগেকার বরাক উপত্যকার যে চিত্রটি এঁকে গেছেন এটা যদি ইতিমধ্যে বহির্বঙ্গের বাঙালির মর্মে পৌঁছোতে পারত তবে আসামে বাঙালির বিরদ্ধে আজকের এত অপপ্রচার, দিল্লি থেকে দিসপুর অবধি বাঙালি বিরোধী চক্রের এত রমরমা দেখে মানুষ এত নির্লিপ্ত থাকতে পারত না।