করালীর চোখ জ্বলে উঠল।
জাঙলের মাইতো ঘোষকে দেখলে যত তার ভয় লাগে, মনে মনে তত তার ক্ষোভ জেগে ওঠে। চন্ননপুরের কারখানায় কাজ করার জন্য তার মনে যত অহঙ্কার, তার অজ্ঞাত কোন গোপন মনে তার চেয়েও বেশি বেদনাও জমে আছে। ওই চন্ননপুরের কারখানায় তাড়িয়ে নিয়ে গেছেন এই মাইতো ঘোষ। ওই সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার মায়ের ইতিহাস। লজ্জা এই হাঁসুলী বাঁকের আলো-আঁধারিতে কম। কিন্তু তবুও মায়ের লজ্জাই সবচেয়ে বড় লজ্জা। তার সঙ্গে আরও আছে মা হারানোর বেদনা। আর আছে এই বাঁশবাঁদি ছেড়ে যাওয়ার প্রথম দিনের বেদনার স্মৃতি।
সেসব অনেক পুরনো কথা। হাঁসুলী বাঁকের উপকথার একটা টুকরো গল্প, গোটা পাঁচালির মধ্যের কয়েকটা ছড়া। সে ছড়া বলতে বনওয়ারীর মত মাতব্বরেরা লজ্জা পায়। ছোঁড়ারা আনাচে-কানাচে বলে। মেয়েরা বলে নিজেদের মধ্যে, রঙের কথা উঠলে ফিসফাস করে। কেবল চিৎকার করে বলে সুচাঁদ। সে বলে—আঃ, তার আবার লাজ কিসের? বলে যে সেই বেগুনে কেনে খাড়া? না বংশাবলীর ধারা। এই তো কাহারদের পুরুষে পুরুষে চলে আসছে। তারা অকপটে বলেও আসছে এই কাহিনী। করালী তখন ছেলেমানুষ, বাপ মারা গিয়েছিল তিন বছর বয়সে। পাঁচ বছর বয়স যখন তার, তখন তাকে ফেলে তার মা পালিয়ে যায় ওই চন্ননপুরে ইস্টিশানের একজন লোকের সঙ্গে। তখন ওই রেললাইন তৈরি হচ্ছে, দেশ-দেশান্তর থেকে লোক এসে লাইন বসাচ্ছে, কোপাইয়ের উপরে পুল তৈরি হচ্ছে, সে যেন এক মস্ত ব্যাপার করে। তুলেছে। হাঁসুলী বাঁকের মেয়েরা খাটতে যেত চন্ননপুরের বাড়িঘর তৈরির কাজে। রেললাইনের ওই মস্ত ব্যাপারে যাওয়া ছিল তাদের বারণ। বনওয়ারীই তখন মাতব্বর, বারণ ছিল তারই। ওখানে গেলে জাত যায়—ধৰ্ম থাকে না। চাষ করে খায় যারা, তারা ওই কারখানার বাতাস গায়ে লাগালে তাদের মঙ্গল হয় না। ওই বাতাস, ওই ঘরাণ অর্থাৎ ঘ্রাণ সহ্য করতে পারেন না চাষীর লক্ষ্মী। যাক সে কথা। করালীর মা বিধবা হয়ে চন্ননপুরে বাবুদের বাড়ি মজুরনী খাটতে গিয়ে পয়সার লোভে ইস্টিশানে কারখানার লোকদের সঙ্গে গোপ্ত যোগাযোগ পায়। তারপর সে একদিন সন্তানের মায়া পর্যন্ত পরিত্যাগ করে চলে গেল কোথায়। কেইবা খোঁজ করবে? আর খোঁজ করেই-বা কি হবে? করালী কাঁদতে লাগল। তবে হাঁসুলী বাঁকে এটা কোনো নূতন ব্যাপার নয়। এমন অনেক ঘটে, অনেক ছেলে কাদে; আত্মীয়স্বজনে টেনে নেয় কাছে। আত্মীয়স্বজন না। থাকলে মাতব্বর নেয় টেনে। অনাদরের মধ্যেই কোনো রকমে বড় হয়। দশ-বার বছর বয়স হলেই আর ভাবনা থাকে না; সে তখন সক্ষম হয়ে ওঠে, নিজের অন্নবস্ত্ৰ নিজেই রোজগার করতে। পারে। জাঙলে সদ্গোপের বাড়িতে ভাত কাপড় আর মাসিক চার আনা মাইনে বাঁধা। গরুর রাখালি কর্মে ঢুকে পড়ে।
করালীর তিনকুলে থাকার মধ্যে ছিল এক পিসি-ওই নসুর মা, সে-ই করালীকে টেনে। নিলে। লোকে করালীকে বলত–ভুতুড়ে ছেলে। করালী খুঁজে বেড়াত তার মাকে। খুঁজতে যেত মহিষডহরির বিলে, খুঁজত কোপাইয়ের তীরের বনে বনে, দুয়ের ধারে, শিমুলগাছের তলায়, ওই। বাবাঠাকুরতলায়; কোনো কোনোদিন চলে যেত চন্ননপুরের আলপথ ধরে মাঝপথ পর্যন্ত। কাদত মা মা বলে। তারপর কোনো খেলা আবিষ্কার করে তাই নিয়ে মত্ত হয়ে পড়ত, অথবা ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ত। বাবাঠাকুরতলায় বসে বসে সে দেখত বেলগাছে পিঁপড়ের সারি, গোড়ায় উইয়ের ঢিপি। বেলগাছ ঢাকা অপরাজিতার লতা থেকে পাড়ত ফুল। কাহারেরা যেদিন বাবা ঠাকুরের থানে পুজো দিত, সেদিন পুজোর পরে সে সেখানে যেত গিয়ে ভোগ-দেওয়া বাতাসা পাটালি কুড়িয়ে খেত, পিঁপড়েদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হত। ঊড়ে দুধ রেখে আসত কাহাররা, সে সেটুকু খেত। ওই দহের শিমুলগাছতলায় বসে সে দেখত ঝাকবন্দি টিয়াপাখির খেলা—লেজ নাচিয়ে তারা উড়ত, রাঙা ঠোঁটে বয়ে আনত ধানের শিষ, কত দিন লড়াই করত তারা ছানাআক্রমণকারী সাপের সঙ্গে। করালী সাহায্য করত টিয়াপাখিদের, সে ঢিল ছুঁড়ে মারত, সাপটাকে বিব্রত করত। দু-একটা সাপকে ঢেলা মেরে নিচে ফেলে দিয়েছে। হঠাৎ এক সময় খেলার নেশা ছুটত, তখন সে আবার মাকে খুঁজত। ক্রমে বয়স বাড়ল, মায়ের ইতিহাসের লজ্জা তাকে স্পর্শ করল, তখন মাকে খোঁজা ছাড়লে সে। তখন একদিন-বার বছর বয়স হতেই বনওয়ারী তাকে রাখালি কর্মে ঢুকিয়ে দিলে ঘোষ মহাশয়দের বাড়ি। গরু চরাত, গোবর কুড়াত, ফাইফরমাশ খাটত। মধ্যে মধ্যে মেজ ঘোষকে ইস্টিশানে গাড়িতে চড়িয়ে দিলে প্রতিবারেই মেজ ঘোষ তাকে একটি করে আনি দিত।
করালীর ভারি ভাল লাগত মাইতো অর্থাৎ মেজ ঘোষকে, ভয়ও লগত তেমনই। এমন যার বাক্স বিছানা, এন যার সাজপোশাক, যে লোক এমন করে অবহেলায় ফেলে দিতে পারে একটা আনি, যে তোক রেলগাড়িতে চড়ে দেশ-দেশান্তরে ঘুরে বেড়ায়, তাকে কাহারদের যত ভাল লাগে, তত ভয় লাগে। হঠাৎ একদিন এই ভাল লাগাটা বিষ হয়ে উঠল।
ঘোষ তাকে জুতোর বাড়ি মারলেন। ঘাড়ে ধরে তার মাথাটা নুইয়ে ধরলে বনওয়ারী, আর মেজ ঘোষ মারলেন পিঠে চটাচট চটিজুতোর পাটি। ব্যাপারটা ঘটেছিল এই। মেজ ঘোষের এক। খদ্দের পাঠিয়েছিল এক ঝুড়ি খাস আম। সেই আমের ঝুড়ি করালী আনতে গিয়েছিল চন্ননপুর ইস্টিশান থেকে। মাস্টার মশায়ের মত এমন ভাল লোক আর হয় না। এত জিনিস আসে ইস্টিশানে, রাজ্যের সামগ্রী; সব মাস্টারই তার থেকে কিছু কিছু নিয়ে থাকে। কিন্তু সে মাস্টার কখনও কারুর জিনিসে হাত দিতেন না। শুধু মালের রসিদপিছু তার যে পার্বণীটি পাওনা সেইটেই নিতেন। ঘোষের আমের ঝুড়ি বেশ করে চট দিয়ে মুড়ে সেলাই করাই ছিল। কিন্তু উৎকৃষ্ট জাতের ল্যাংড়া আমের সুগন্ধে মালের ঘরখানা একেবারে মউ মউ করছিল। ঢুকলেই সে গন্ধে মানুষের নাক থেকে বুক পর্যন্ত ভরে উঠেছিল, জিভের তলা থেকে জল বেরিয়ে মুখটাকে সপপে সরস করে তুলছিল। মাস্টারের একটি ছোট মেয়ে সেই গন্ধে লুব্ধ হয়ে আম খাওয়ার জন্য বায়না ধরে শেষ পর্যন্ত কান্না জুড়ে দিয়েছিল। মাস্টার তবু একটি আমও বার করে নেন নি। কিন্তু করালী থাকতে পারে নি। সে নিজে দুটি আম বার করে মেয়েটির হাতে দিয়েছিল। বলেছিল—আমার মুনিব তেমন লয়, মাস্টার মশায়। তারপর ইস্টিশান থেকে বেরিয়ে আসতেই জমাদার ধরেছিল করালীকে। সে দুটো আম না নিয়ে ছাড়লে না। শুধু ছাড়লে না নয়, পকেট থেকে ছুরি বার করে একটা আম কেটে খেয়ে আমের প্রশংসায় শতমুখ হয়ে এক চাকা আম করালীকে আস্বাদন করিয়ে তবে ছাড়লে। তাই তার অপরাধ। চারটে আম কম-বেশিতে ঘোষ। করালীকে ধরতে পারত না, ধরলে করালীর হাতের ও মুখের গন্ধ থেকে। আমের ঝুড়িটা মেজ ঘোষই ধরে তার মাথা থেকে নামাচ্ছিল। নামিয়েই সে করালীর ডান হাতখানা খপ করে ধরে নাকের কাছে টেনে নিয়ে কলে, তারপর বনওয়ারীকে ডেকে বললে মুখটা শোক তো বনওয়ারী। হারামজাদা ঝুড়ি থেকে আম বের করে খেয়েছে পথে। বনওয়ারী লজ্জায় মাথা হেঁট করে রইল প্রথমটা। এ লজ্জা সে রাখবে কোথায়? করালী তার জাত-জ্ঞাতের ছেলে, সেই তাকে এনে এ বাড়িতে চাকরি করে দিয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, যে পাড়ার সে মাতব্বর, সে-ই পাড়ার ছেলে করালী। প্রজার পাপ জমিদার-রাজাকে অর্সায়, সেই জন্যই তো জমিদার-রাজার প্রজাকে শাসনের অধিকার। সমাজের পাপ মণ্ডলকে মাতব্বরকে অসায়, সেই জন্যই মণ্ডল মাতব্বরের কাজ হল—অধর্মের পথে পুরুষ-মেয়েকে যেতে নেবারণ করা। ছিছিছি। দেবতা আছেন, ব্রাহ্মণ আছেন, বাড়ির মালিক আছেন—তারা তোর মনিব, তারা খেয়ে তবে না তোকে প্রসাদ দেবেন। বনওয়ারীর ইচ্ছা হয়েছিল, একটা লোহার শিক আগুনে পুড়িয়ে তার। জিভে হেঁকা দেয়। কিন্তু মেজ ঘোষ নিজেই তাকে সাজা দিলেন। তাকে বললেন—ধ, বেটার ঘাড় ধরে মাটিতে মাথাটা নুইয়ে ধর। তাই ধরলে বনওয়ারী। মেজ ঘোষ নিজেই পায়ের চটি খুলে পেচণ্ড পেহার দিলেন। এবং কালীকে তাড়িয়ে দিলেন মেজবাবু। মাইনে কিছু পাওনা। ছিল, সেও দিলেন না। কথাটা কানে গিয়েছিল স্টেশন মাস্টারের। তিনি লজ্জায় মাটির সঙ্গে মিশে গেলেন, এবং তিনিই করালীকে ডেকে দিলেন ইস্টিশানের গুদামে কুলির কাজ। কিন্তু ছোট স্টেশনে এ কাজে উপাৰ্জন নাই। কায়ক্লেশে একটা লোকের পেট চলে। তাই লাইন-ইন্সপেক্টরকে বলে শেষে ঢুকিয়ে দিলেন কুলি-গ্যাঙের মধ্যে। সেই জন্যই-না করালী আজ এই করালী, এবং এই সবের জন্যই সে অন্য দশজনের মত বনওয়ারীকে খাতির করতে চায় না এবং ঘোষ বাড়ির ছায়াও মাড়াতে চায় না। হোক না কেন এসব অনেক দিনের কথা, এবং দশে বিচার করে বলুক-না কেন অন্যায় তারই, তবু করালী সে কথা ভুলতেও পারে না, এবং অন্যায় তার বলে মানতেও পারে না।
মেজ ঘোষকে দেখে করালীর চোখ দুটো জ্বলে উঠল প্রথমে; কিন্তু পরক্ষণেই মনটা নেচে উঠল। বনওয়ারী তার ঘাড় ধরেছিল, মেজ ঘোষ তাকে মেরেছিল। আজ বনওয়ারী তাকে তারিফ করছে, মেজবাবু এসেছে তার মারা সাপটা দেখতে। মেজ ঘোষ কি বলে, কি রকম ভাবে তার দিকে চেয়ে থাকে প্ৰশংসা-ভরা দৃষ্টিতে, সে আজ তা একবার দেখবে।
উঠানে নেমে সে সত্যই বুক ফুলিয়ে দাঁড়াল। ঘোষ দাঁড়িয়ে ছিলেন সাপটার কাছেই। বনওয়ারী সামনের ভিড় সরিয়ে এগিয়ে গিয়ে প্রণাম করলে। করালী কিন্তু এগিয়েও এল না, প্ৰণামও করলে না। সে লটবরের সঙ্গে কি একটা কথা নিয়ে হাসাহাসি শুরু করে দিলে। বনওয়ারী বারকয়েক চোখের ইশারায় তাকে এগিয়ে এসে ঘোষ মহাশয়ের চরণে দণ্ডবৎ করতে ইঙ্গিত করলে। করালী দেখলে, কিন্তু দেখেও যেন দেখতে পেলে না, এই ভাবেই দাঁড়িয়ে রইল। কান কিন্তু তার খুব সজাগ ছিল, কে কি বলছে, তার প্রতিটি কথা সে শুনছিল। অধীরভাবে প্রতীক্ষা করছিল মেজ ঘোষের মুখে কি কথা বার হয়—সেইটুকু শুনবার জন্য। সকলেই খুব বিস্ময় প্রকাশ করলে, করালীর বীরত্বের তারিফ করলে। কিন্তু কিছুক্ষণ দেখেশুনে একটু হেসে মেজ ঘোষ বললেন, নাঃ, খুব বড় না। এর চেয়ে অনেক বড় পাহাড়ে চিতি চিড়িয়াখানাতেই আছে। আসামের জঙ্গলে তো কথাই নাই। সেখানে এত বড় সাপ আছে যে, বাঘের সঙ্গে লড়াই হলে বাঘ মেরে ফেলে। রেললাইনের উপর যদি কোনো ট্রেন যাবার সময় পড়ে তো ট্রেন আটকে যায়।
বনওয়ারী সায় দিলে কথাটায়, বললে—আজ্ঞে হ্যাঁ। মাঝারি সাপ।
করালী এবার উদ্ধতভাবেই এগিয়ে এল। সাপটাকে এখনই এখান থেকে তুলে নিয়ে যাবে সে। নিয়ে যাবে চন্ননপুর স্টেশনে, সেখানে বাবুদের দেখাবে, সায়েবকে দেখাবে। তাদের কাছে ঘোষের দাম কানাকড়ি। জাঙলের একজন ভদ্রলোকের ছেলে বললে—কিন্তু এ তো পাহাড়ের চিতি নয়-এ হল চন্দ্রবোড়া। চন্দ্রবোড়া এত বড় কিন্তু কেউ কখনও দেখে নি। আর সাপও ভীষণ সাপ।
ঘোষ একটু হেসে বললেন–জাত ওই একই হে, চিতির জাত। তারপর করালীর দিকে চেয়ে দেখে বললেন, জোয়ান তো হয়েছিস বেশ। বুদ্ধিরও একটু ধার আছে মনে হচ্ছে। কি করিস এখন?
করালী বেশ মাথা উঁচু করে গম্ভীরভাবেই জবাব দিতে চেষ্টা করলে, অ্যাললাইনে কুলিগ্যাঙে কাজ করি। কিন্তু আশ্চর্যের কথা, গম্ভীর আওয়াজ তার গলা দিয়ে একেবারেই বার হল না। উত্তর দিতে গিয়ে বার দুই ঢোক গিলে সে চুপ করে রইল। বুকটা ঢিপঢিপ করতে লাগল। উত্তর দিলে বনওয়ারী, বললে—এ এখন অ্যাললাইনের কুলি খাটে।
—ও, আচ্ছা! তা হলে তো অনেক দূর এগিয়েছিস রে! আর কি করছিস? রাত্রে চুরি? যে রকম শরীরটা বেঁধেছে আর বুদ্ধিতে যেমন বড়শির বাঁকা ধার, তাতে তো ও-বিদ্যেটায় পণ্ডিত হতে পারবি।
করালীর শরীরটা ঝিমঝিম করতে লাগল। মাথা হেঁট করে রইল সে। কথা বলার ভঙ্গিই এমন মেজ ঘোষের যে, সকলেই মুখ টিপে হাসতে লাগল। বনওয়ারী হেসে বললে—আজ্ঞে না, চুরি-চুরি করে না। সেসব আমার আমলে হবার যো নাই কাহারপাড়ায়। সে যিনি করবেন, তাকে গা থেকে উঠে যেতে হবে। তবে করালী বজ্জাত খুব। যত বজ্জাত, তত ফিচলেমি বুদ্ধি।
মেজ ঘোষ হাসতে হাসতে বললেন—তা হলে চোর হওয়া ওর অনিবার্য। যদি চোর না হয় তবে পয়লা নম্বরের লোচ্চা হবে—এ আমি বলে দিলাম বনওয়ারী। তারপর পকেট থেকে চামড়ার বাহারে মনিব্যাগ বার করে একটা সিকি ছুঁড়ে দিয়ে বললেননে।
সঙ্গে সঙ্গে মেজ ঘোষ সমস্ত লোকের কাছে আশ্চর্য রকমের সম্ভ্রান্ত হয়ে উঠলেন। তারপর বললেন—উঠিয়ে নিয়ে যা ওটা। গন্ধ উঠেছে এর মধ্যে। সকলেই জোরে জোরে নিশ্বাস টানতে লাগল কথাটা শুনে। গন্ধ উঠছে নাকি? গন্ধ? বনওয়ারীও নিশ্বাস টানলে জোরে জোরে। করালী একটা রুদ্ধ অথবা ক্ষুব্ধ দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেও সিকিটাকে উপেক্ষা করলে না, সিকিটা নিয়ে কোঁচড়ে গুঁজে সঙ্গীদের বললে—লে, তো। নিয়ে যাব চন্ননপুর ইস্টিশান। তোল্।
আজ এই মুহূর্তটিতে আবার করালীর আক্ষেপ হল নসুদিদি নাই, সে থাকলে জবাব দিতে পারত ঘোষকে। সে থাকলে কোমরে কাপড় বেঁধে মেজ ঘোষকে দেখে মাথায় একটু ঘোমটা দিয়েও ঘোষের কথার উত্তর না দিয়ে ছাড় না।
ঘোষ বললে–না, খুব বড় না।
নসু সঙ্গে সঙ্গে গালে হাত দিয়ে জবাব দিত—হেই মাগো! বড় তবে আর কাকে বলে। মাশায়?
ঘোষ বললে আসাম না কোথাকার জঙ্গলে পাহাড়ে চিতির কথা।
নসু হাত নেড়ে বলে উঠত-গোখুরা কোথা পাব বাবা? আমাদের এই হেলেই গোখুরা। আসাম না বেলাত কোথাকার কথা বলছেন, সেথাকার রজগর সেথাকেই থাকুক। আমাদের এই রজগর, ওই আমাদের খুব বড়; লঙ্কায় বলে সোনা সস্তা, সেখানকার নোকের সব্বঅঙ্গে সোনা, আমাদের দ্যাশে কাচের চুড়ি, রুপদস্তার চুড়িই সোনার চুড়ি।
আরও কত ছড়াকাটত। করালীর বারবার মনে হল নসুবালার কথা। আর আজ নসুদিদি। থাকলে বড় ভাল হত! এতবড় একটা কীৰ্তির গৌরব-উৎসাহ স্নান করে দিল মেজ ঘোষ। ঘোষ চোখের অন্তরাল হতে তবে তার সাহস খানিকটা ফিরে এল। সে মাথলাকে ধমক দিয়ে বললে–কি রে, কানে কথা যায় না, লয়? লে, তেল। সাপটাকে বয়ে নিয়ে যাবার বাঁশের একদিকে কাঁধ দিয়েছিল মাথলা, অন্যদিকে লটা অর্থাৎ নটা, মানে নটবর।
ঘোষ বাড়ি থেকে চলে গেলে কেঁচড় থেকে সিকিটা বার করে করালী বললে—দেখ দিনি রেসিকিটা আবার চলবে তো? মেকি-ফেকি লয় তো? মাথলা এবং নটবর সাপটাকে বশে ঝুলিয়ে বয়ে নিয়ে যাবে, তাদেরই বললে সে। তারা কেউ বলবার আগেই এগিয়ে এল নিমতেলে। পানু। বললে—কই, দে দেখি!
দেখে বললে–না, চলবে। ভালই বটে। তা ছাড়া মাইতো ঘোষ মশায়ের বেগের সিকি। নতুন চকচকে ছাড়া রাখেই না তিনি টাকা-পয়সা।
করালী বললে—হুঁ।
পানু বললে—আমাকে সেবার পয়সা দেবার তরে বেগটা ঢাললে তক্তপোশের ওপর। একেবারে সোনার পয়সার মত চকচকে লালবন্ন পয়সা—সে এই এত।
পানুও তাদের সঙ্গ নিলে বেহায়ার মত, সেও যাবে চন্ননপুর ওদের সঙ্গে। চন্ননপুরে যে অনেক পয়সা মিলবে তাতে সন্দেহ নাই। করালী তাতে আপত্তি করে নাই। আসুক বেটা ছুঁচো। পানুই দিলে একটা কাঁধ। অজগর চললেন চন্ননপুর।
কয়েক মুহূর্ত পরেই হঠাৎ করালী দূরে দাঁড়িয়ে পানুর গালে ঠাস করে এক চড় বসিয়ে দিলে আচমকা—শালা, কানার মত চলছ যে বড়? কানার মত চলছে যে? পায়ে পায়ে টক্কর দিলি যে বড়? আমাদের আর চোখে দেখতে পাও না, লয়? শালো! সোনার পয়সার মত চকচকে। লালবন্ন। শালে, যাও না কেনে, সেইখানে যাও না। আমার সাথে কি বটে তোমার?
মাথলা বললে—ঠিক বলেছে করালী। আজ আমাদের সাথে কি বটে হে তোমারঃ মুরুদ্ধির কাছে তো সাতখান করে লাগাও তুমি। আজ কি বটে আমাদের সাথে?
নটবর তাকে সাবধান করে দিলে—আই, চুপ কর। মুরুদ্ধি আসছে কি না দেখ্ আবার।
ওদের দুজনের ঘাড় ফেরাবার উপায় ছিল না, একে আলপথ, তার উপর কাধে সাপ ঝুলানো বাঁশ।
মাথলা তবু ঘাড় ফিরিয়ে দেখে বললে–না। কই? আসে নাই সে।
করালী বললে তার বিদ্যাসম্মত হিন্দিতে সে আসেঙ্গা সে আসেঙ্গা, হাম কেয়ার করতা নেহি হ্যায়। হুঁ। তারপর হঠাৎ বললে—কাহারদের ছেলে পালকি বওয়ার হক ধ না কেনে শালোরা। হাক ধৰ্ব কেনে। কথাটা ভারি মনে লাগল মাথলাদের। মরা সাপটাকে পালকির আরোহী ধরে নিয়ে তারা হাত দুলিয়ে হাঁক ধরলে—প্লো হিঁ–প্লো হিঁ। হঠাৎ পিছন থেকে বনওয়ারীর মোটা গলার হক তারা শুনতে পেলে, দাঁড়া—দাঁড়া। এই! দাঁড়া। থেমে গেল সকলে। থেমে যেতে হল। পা আর উঠল না। শুধু করালী উঠল অধীর হয়ে। এ কি কাণ্ড! এ কি জুলুম!
বনওয়ারীর মুখটা হয়ে উঠেছে হাঁড়ির মত। সে এসে দাঁড়াল। বললে—ফিরে আয়।
—ফিরব? কেনে?
–দাহ করতে হবে।
—সে তো আত্তে করব বলেছি।
–না। এখুনি হবে দাহ। গোটা কাহারপাড়াকে চান করতে হবে। তারপর হঠাৎ আক্ষেপভরা আক্রোশভরা কণ্ঠে সে বলে উঠল, তুই গাঁয়ের সর্বনাশ করবি রে—তুই সব অনত্থের মূল।
করালী স্তম্ভিত হয়ে গেল।
বনওয়ারী একটা দীৰ্ঘনিশ্বাস ফেললে। বললে—ফিরে আয়। যা করেছি, তার পিতিবিধেন করতে হবে।
করালী বললে–না। ওঠা রে সব, ওঠা।
কিন্তু কেউ ওঠাতে সাহস করে না। দাঁড়িয়ে রইল মাটির পুতুলের মত।
করালী আবার বললে—শুনছিস? ওঠা!
কেউ যেন শুনতেই পাচ্ছে না। বনওয়ারী বললে—মুখ দিয়ে অক্ত উঠে যদি মরতে না চাস তবে ফেরা।
এবার সাপ উঠল। চলল সকলে সাপ কাঁধে করে বাঁশবাঁদিতে ফিরে। ফিরল না শুধু করালী। সে হনহন করে চলতে শুরু করলে চন্ননপুরের দিকে।
বনওয়ারী ওর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ফিরল।
কাহারপাড়ার আদ্যিকালের যত বিধান সুচাঁদের কাছে। সেই বিধানই চিরদিন বলবতী হয়েছে এখানে, আজও হল।
মেজ ঘোষকে বিদায় করে বনওয়ারী বাড়ি ফিরে দেখলে, সুচাঁদ বসে আছে। সুচাঁদ পাখীর সঙ্গে ঝগড়া করে এসেছে। পাখীকে বলে এসেছে—এ বাড়িতে যদি আর ফিরি, তোর মায়ের গতরের ওজগারের রন যদি খাই, তবে আমার জাত নাই, আমি বেজাত। আমি বনওয়ারীর বাড়িতে থাকব।
বনওয়ারী সম্মান করতে জানে। সে বললে—বেশ তো পিসি। ছেলেকালে অ্যানেক দোগ্ধ তুমি দিয়েছ আমাকে। তুমি থাকবে সে তো ভাগ্যি আমার গো। কি, হল কি?
সুচাঁদ সবিস্তারে সমস্ত বর্ণনা করে বললে বনওয়ারী, উনি যদি কত্তার বাহন না হন, কিমা-মনসার বেটী না হন, তো আমি কি বলেছি।
বনওয়ারীর-কাহারপাড়ার মাতব্বরের দৃষ্টি যেন এতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিল, এবার জেগে উঠল। খুশিও হল সে। অত্যন্ত খুশি হল। মনের মধ্যে সাপ মারার সেই স্মৃতির বেদনা যেন ঘন হয়ে। উঠছে। সে পিসির পায়ের ধুলে নিলে।
পিসি আশীৰ্বাদ করলে—ছেরায়ু হ বাবা। আমার মাথার চুলের মতন তোর পেরমাই হোক। তারপর কাপড়ের খুঁট দিয়ে চোখ মুছে বললে—আহা, আগুনে দগুধে গিয়েছেন মা আমার, তবু কি বনের বাহার, কি গড়ন! আঃ! সর্বনাশ করে দিলে বাবা!
বনওয়ারীর মন সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবিধানের জন্যই বেশি আগ্ৰহান্বিত হয়ে উঠেছে। প্রতিবিধান-বাবাঠাকুরের পূজা। মদে-মাংসে ঢাকে-ঢোলে আতপে-চিনিতে বস্ত্ৰে-সিঁদুরে পূজা। সকল কর্মের উপর হল তার মাতব্বরির দায়িত্ব, গ্রমের ভাল আগে দেখতে হবে তাকে। হে বাবা কর্তা! গ্রামের মঙ্গল কর তুমি। সাজা দিতে হয়, যে দোষ করেছে তাকে দাও। করালীকে কিন্তু শাসন করা দরকার হয়েছে। বড়ই বৃদ্ধি হয়েছে। জোয়ান বয়সের রক্তের তেজ। হঠাৎ ক্রোধে ফুলে উঠল বনওয়ারী। আজও ওই ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন বাঁশবনের মধ্যে। আফসোসের সঙ্গে মনে করতে চেষ্টা করলে বনওয়ারী, বাঁশপাতার উপর অসাবধানে কেমন করে তার পা পিছলে গিয়েছিল। কিন্তু তবুও সে তার অপমান। সে তার পরম লজ্জার কথা।
বনওয়ারী মাতব্বর কপালে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করলে বাবাঠাকুরকে। উপরের দিকে চাইলে একবার। তারপর মনে মনে মানত করলে ঠাকুরকে—হে ঠাকুর, পুজো দেবার কথা তো হয়েই আছে। আবারও মানত করছি—এর জন্যে একটি নতুন পাঁঠা দেব আমি। তুমি কাহারদের রক্ষা কর।
সুচাঁদ প্রশ্ন করলে—কি করছিস তা বল্?
বনওয়ারী বললে—এর তরে আমি পুজো দেব পিসি, আলাদা পাঁঠা মানত করছি।
—কি করছিস? আরও একটা পাঠা? স্থির দৃষ্টিতে বনওয়ারীর মুখের দিকে চেয়ে সুচাঁদ প্রশ্নচ্ছলে কথাটার পুনরুক্তি করলে।
বনওয়ারী আবার বুঝিয়ে বললো, হ্যাঁ, মানত করছি—মানত।
মানত?
–হ্যাঁ। দুটো পাঁঠা দিয়ে কত্তার পুজো দোব।
আঙুল দেখিয়ে সুচাঁদ বললে—দুটো পাঁঠা দিবি?
–হ্যাঁ।
–বেশ বেশ। কিন্তুক, অ্যানেক কল্যেণ করতেন উনি বাবা-ওই উনি। আঃ, কি শিস! বনওয়ারী বললে—দাহ হবে বাবার বাহনের। কাহারপাড়ার সবাইকে চান করতে হবে। বলে দাও সব। আমি চললাম ডাকতে। সে ছুটল।
কোপাইয়ের তীরে চিতা সাজিয়ে দাহ হল বাবার বাহনের। গোটা কাহারপাড়া চান করে ফিরল। বনওয়ারী প্রণাম করে এল বাবার থানে।–হে বাবা! রক্ষা কর বাবা। পাষণ্ডকে দলন কর বাবা। কাহারদের মালিক, কাহারদের রক্ষা কর।