সামবেদ-সংহিতা — ঐন্দ্র পর্ব (তৃতীয়) [৪র্থ অধ্যায়]
প্রথম দশতি
ছন্দ আর্চিক। কৌথুমী শাখা। ঐন্দ্র পর্ব (তৃতীয়)। চতুর্থ অধ্যায়।
দেবতা ১–৪/৬/৮ ইন্দ্র, ৫ মরুদগণ, ৭ দধিক্রাবা৷
ছন্দ অনুষ্টুপ৷৷
ঋষি ১ ভরদ্বাজ বার্হস্পত্য, ২ বামদেব গৌতম বা শাকপূত, ৩ প্রিয়মেধ আঙ্গিরস, ৪ প্রগাথ কাণ্ব, ৫ শ্যাবাশ্ব আত্রেয়, ৬ শংযু বার্হস্পত্য, ৭ বামদেব গৌতম, ৮ জেতা মাধুচ্ছন্দস৷৷
প্রত্যস্মৈ পিপীষতে বিশ্বানি বিদুষে ভর। অরঙ্গমায় জন্ময়েই পশ্চাদধ্বনে নরঃ ১। আ নো বয়ো বয়ঃশয়ং মহান্তং গহ্বরেষ্ঠাস্ মহান্তং পূর্বিনেষ্ঠা। উগ্রং বচো অপাবধীঃ। ২ আ ত্বা রথং যথোতয়ে সুস্নায় বর্তয়ামসি। তুবিকুর্মিমৃতীষহমিং শবিষ্ঠ সৎপতি৷৷ ৩৷৷ স পূর্বে মহোনাং বেনঃ তুভিরানজে। যস্য দ্বারা মনুঃ পিতা দেবেযু ধিয় আনজে৷৷ ৪৷ যদী বহন্ত্যাশবো ভ্ৰাজমানা রথেষ্য। পিবন্তো মদিরং মধু তত্র বাংসি কৃঞ্চতে৷৷ ৫৷৷ ত্যমু বো অপ্রহণং গৃণীষে শবসম্পতি। ইন্দ্ৰং বিশ্বাসাহং নরং শবিষ্ঠং বিশ্ববেদসম্৷৬৷৷ দধিক্রাবণে অকারিষং জিষ্ণোরশ্বস্য বাজিনঃ। সুরভি নো মুখা করৎ প্র ণ আয়ুংষি তারিষৎ৭৷৷ পুরাং ভিন্দুযুর্বা কবিরমিতৌজা অজায়ত। ইন্দ্রো বিশ্বস্য কর্মণণা ধর্তা বর্জী পুরুষ্টুতঃ॥৮॥
মন্ত্ৰাৰ্থ— ১। হে আমার মন! সত্ত্বভাবের সাথে মিলতে ইচ্ছুক, সর্বজ্ঞ, মোক্ষপ্রাপক, এ সৎকর্মসাধনসামর্থ্য-প্রদাতা, সর্বশ্রেষ্ঠ, সৎকর্মের নেতৃস্থানীয় সেই দেবতার জন্য হৃদয়ে সত্ত্বভাব সঞ্চার ও কর। (প্রার্থনার ভাব এই যে, আমি যে ভগবানের অনুসারী হয়। ) [আত্ম-উদ্বোধন-মূলক এই ৭ মন্ত্রটিতে সাধক-গায়ক ভগবানে আত্মসমর্পণ করছেন। আর সেই উদ্দেশ্যেই তিনি চিত্তবৃত্তি-সমূহকে উদ্বোধিত করছেন। ভগবান্ পাপী মানুষের সাথেও মিলিত হতে ইচ্ছুক যদি সে, সেই মিলনের অধিকার লাভ করতে সমর্থ হয়। এই বাণীর মধ্যেই মহান সত্য নিহিত আছে। দ্বৈতের মধ্যে যে অদ্বৈতের সাড়া পাওয়া যায়, সসীমের মধ্য যে অসীমের স্পন্দন অনুভূত হয়, তা-ই আমাদের গৌরবময় অধিকারের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এখানে নরঃ অর্থে নরায়, সৎকর্মণং নেতৃস্থানীয়ায় দেবায় ধরা হয়েছে, এবং সেটিই যথার্থ]। [এর গেয়গানের নাম কীল্মণবর্হিষে দ্বে এবং নানদম। এর ঋষি–ভরদ্বাজ]।
২। হে জগৎ বন্ধো! শ্রেষ্ঠ, মোক্ষলাভে প্রথম-সহায়ভূত, হৃদয়ের কন্দরে সুপ্ত আমাদের আত্মশক্তিকে আপনি উদ্বোধিত করুন; এবং পরমশ্রেষ্ঠ মোক্ষলাভের জন্য আমাদের ব্যাকুল প্রার্থনা চিরতরে নিবারণ করুন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, -হে ভগবন! আমাদের মহানির্বাণ প্রদান করুন)। [মানুষের মধ্যে সমস্ত শক্তিব বীজই নিহিত আছে। উপযুক্ত যত্ন ও সাধনার বলে সেই বীজকে অঙ্কুরিত ও প্রবর্ধিত করতে হয়। অথবা হৃদয়স্থিত সুপ্ত শক্তিকে জাগরিত করতে হয়। শক্তির উদ্বোধনেই মনুষ্যত্বের বিকাশ। আমাদের মধ্যে আছে সমস্তই–আমরা বিশ্বশক্তির সসীম ক্ষুদ্র প্রতিরূপ মাত্র। সেই শক্তিকে হঠযোগীদের ভাষায় কুলকুণ্ডলিনীকে–জাগরিত করতে পারলে মানুষের অসাধ্য কিছুই থাকে না। শক্তিই মোক্ষলাভের প্রথম সহায়। আর একদিক দিয়ে দেখলে–ওটাই চরম সহায়। জ্ঞান বুদ্ধি প্রভৃতি সমস্তই শক্তির বিভিন্ন বিকাশ মাত্র। সেই আত্মশক্তিকে জাগরিত করবার জন্য ভগবানের কাছে প্রার্থনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় অংশের প্রার্থনা–নির্বাণলাভের জন্য। মোক্ষলাভের আকাঙ্ক্ষা–তীব্র পিপাসা। প্রচলিত ভাষ্যে এই পিপাসাকে মানুষের পার্থিব ক্ষুধাতৃষ্ণা বলে বর্ণনা করে দেখানো হয়েছে–আমাদের ক্ষুধাতৃষ্ণা দূর হওয়ার অর্থ–দেবত্বলাভ; কারণ দেবতাদের ক্ষুধাতৃষ্ণা নেই]। [এই সাম-মন্ত্রটির গেয়গানের নাম–শাকপূতং]।
৩। হে দেব! আমাদের পরিত্রাণের জন্য সৎকর্ম যেমন কার্যকরী হয়; তেমনি আমাদের পরমসুখসাধনের জন্য অর্থাৎ মোক্ষপ্রাপ্তির জন্য আপনি সুখস্বরূপ আপনাকে প্রাপ্ত করান। অর্থাৎ আপনিই আপনাকে পাইয়ে দেন। হে সর্বশক্তিমান্ দেব! বহুকর্মা, রিপুবিমদ, সজ্জনের রক্ষক, বলৈশ্বর্যাধিপতি আপনাকে আমরা যেন প্রাপ্ত হই। (প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন ভগবানকে প্রাপ্ত হই)। [মন্ত্রটির প্রথম অংশে ভগবৎ-প্রাপ্তির প্রার্থনার সঙ্গে, ভগবৎ-প্রাপ্তির উদ্দেশ স্বরূপ দুটি বিষয় ব্যক্ত করা হয়েছে–পাপকবল থেকে রক্ষা ও পরমানন্দ লাভ। মন্ত্রের দ্বিতীয়াংশে সৎপতিং পদটি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। অর্থ–সতাং পালকং, রক্ষকং। ভগবানের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত সমস্ত বিশেষণের সার ঐ একটি পদের মধ্যেই নিহিত আদ্বে]। [এর গেয়গানের নাম–কৌন্মবলহিংষে দ্বে]।
৪। দেবভাবসমূহের অধিকারী মানব, যে দেবতাকে প্রাপ্তির উপায়ভূত সৎকর্মসমূহ সম্পাদন করেন, জ্যোতির্ময় আদিভূত সেই দেবতা সাধকদের কর্মের দ্বারা প্রীত হয়ে আগমন করেন, অর্থাৎ সাধকদের প্রাপ্ত হয়। (ভাব এই যে, –সৎকর্ম-সমূহের দ্বারা প্রীত হয়ে, ভগবান্ সাধকদের প্রাপ্ত হন অর্থাৎ তাদের মোক্ষপ্রদান করেন)। [এই মন্ত্রে কর্মযোগের কথা বলা হয়েছে। সৎকর্মসাধনের দ্বারা ভগবানকে পাওয়া যায়–এই সত্যটিই এখানে রয়েছে। কিন্তু এখানে একটা বিষয় লক্ষ্য করতে হবে যে, সৎকর্মের দ্বারা ভগবানকে পাওয়া যায় বটে, কিন্তু সেই সৎকর্ম সাধনের পূর্বে অথবা তার সঙ্গেই ও হৃদয়কে পবিত্র করা চাই। হৃদয়ে দেবভাবের উপজন হলে সাধক অনায়াসেই কর্মমার্গ অবলম্বন করে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেন। আবার, হৃদয়ে দেবভাবের উপজন হলেও তার পরেও সাধককে সৎ-সর্ম সম্পাদনে রত থাকতে হয়, অথবা তখনই মোক্ষলাভের উপায়ভূত কর্মযোগ সাধনের প্রকৃত অধিকার জন্মে। শুদ্ধ পবিত্র হৃদয় নিয়ে সাধক আদিভূত জ্যোতির্ময় (বেনঃ) সেই পরম দেবতার আরাধনায় মগ্ন হবেন]। [এর গেয়গানের নাম–মধুশ্চুন্নিধনং]।
৫। হে দেব! যখন সৎকর্মসমূহের মধ্যে দীপ্যমান হয়ে, পরমানন্দদায়ক অমৃতপানকারী সাধকগণ আপনাকে প্রাপ্ত হন, তখন পরমমঙ্গল (বিশ্বমঙ্গল) সাধিত হয়। (ভাব এই যে, –সৎকর্মের সাধনের দ্বারা সাধক ভগবানকে প্রাপ্ত হন; তাদের সৎকর্মগুলির দ্বারা জগতের মঙ্গল হয়)। [সৎকর্মের দ্বারা সাধকগণই যে মুক্তিলাভ করেন, নিজেদের চরম মঙ্গল সাধন করেন, তা-ইনয়, –তার দ্বারা জগতেরও মঙ্গল সাধিত হয়। বাস্তবিক যাঁরা সত্তাবে সৎকার্যে সৎ-চিন্তায় জীবন অতিবাহিত করেন, তারা দীপ্যমান–অর্থাৎ তাদের অন্তর-বাহির দিবালোকে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। এ যে শুধু বাহিরের বা। অন্তরের জ্যোতি, তা নয়–এ ভগবৎ-প্রদত্ত তাঁদের বিজয়-চিহ্ন]। [এই মন্ত্রের গেয়গানের নাম উষঃ সাম]।
৬। হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ! তোমরা ভক্তবৎসল, সর্বশক্তিমান, রিপুবিমর্দক, সৎকর্মের নেতা, সৎকর্ম-সাধনসামৰ্থ-প্রদাতা, সর্বজ্ঞ সেই বলৈশ্বর্যাধিপতি দেবতাকে আরাধনা কর। (ভাব এই যে– আমি যেন ভগবৎ-অনুসারী হই)। (ঋগ্বেদ; এর গেয়গানের নাম–ভারদ্বাজং]।
৭। জগৎ-ধারণকারী রিপুজয়ী আশুমুক্তিদায়ক সৎকর্মের সম্বন্ধীয় ব্যাপক-জ্ঞান লাভের জন্য আমরা যেন তার উপযোগী কর্ম করি; সেই কর্ম আমাদের সৎবৃত্তি-সমূহকে শক্তিসম্পন্ন করুক এবং আমাদের সৎকর্মসাধন সামর্থ্যকে প্রবর্ধিত করুক। (ভাব এই যে, -ভগবান্ কৃপা করে আমাদের সৎকর্ম সাধনের সামর্থ্য প্রদান করুন)। [এই মন্ত্রের দেবতা দধিক্রানণ অর্থাৎ এই বিভূতিতে ভগবানের আরাধনা করা হয়েছে। প্রচলিত ভাষ্য ইত্যাদিতে অশ্বরূপী অগ্নিকে উদ্দেশ করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ধাতুগত অর্থ অনুসারে এই পদটির অর্থ-জগৎ-ধারণকারীই যথাযথ]। [এর গেয়গানের নাম– দধিক্রাবণম]।
৮। সেই ইন্দ্রদেব রিপুশত্রুগণের দুর্ভেদ্য দুর্গ ভেদকারী, চিরনবীন, মেধাবী, প্রভূতবলশালী, বিশ্বের সকল সৎকর্মের পরিপোষক, অনুগতজনের রক্ষার জন্য সর্বদা বজ্রধারী, সর্বজন কর্তৃক স্তুত এবং সৎকর্মের সাথে প্রকাশমান। (ভাব এই যে, ইন্দ্রদেব বহুকর্মশালী বহুগুণেপেত; কর্মের উদ্দেশ্যে স্তুত হয়ে কর্মের দ্বারাই তিনি প্রকাশিত হন; তার অর্চনার দ্বারাই মানুষ তার মতো গুণযুত হয়)। [রিপুশত্রুপরিবৃত অজ্ঞানান্ধকারাচ্ছন্ন হৃদয়-এর চেয়ে শত্রুর দুর্গ আর কি হতে পারে? ভগবানের অনুকম্পায় জ্ঞানরশ্মি প্রবিষ্ট হলে, সে দুর্গ ভঙ্গ হয়। সেই জ্ঞানরশ্মির প্রার্থনার সঙ্গে সঙ্গে লোকরক্ষাকর সজ্জন-পালন-রূপ কর্মের জন্যই তার স্তুতি-বন্দনা প্রবর্তিত হয়। আর, তেমনই কর্মের মধ্যে দিয়ে তিনি প্রকাশিত আছেন]।
.
দ্বিতীয়া দশতি
ছন্দ আর্চিক। কৌথুমী শাখা। ঐন্দ্র পর্ব (তৃতীয়)। চতুর্থ অধ্যায়।
দেবতা ১-৭ ইন্দ্র (ঋগ্বেদে ৬ মন্ত্রের দেবতা অগ্নি), ৮ ঊষা, ৯ বিশ্বদেবগণ, ১০ ঋক্ ও সাম৷
ছন্দ অনুষ্টুপ৷
ঋষি ১।৩।৫ প্রিয়মেধ আঙ্গিরস, ২।১০ বামদেব গৌতম, ৪ মধুচ্ছন্দা বৈশ্বামিত্র, ৬ ভরদ্বাজ বার্হস্পত্য, ৭ অত্রি ভৌম, ৮ প্রস্কণ্ব কাণ্ব, ৯ ত্ৰিত আপ্ত্য।
প্র প্র বস্ত্ৰিষ্ঠুভমিষং বদদ্বীরায়েন্দবে। ধিয়া বো মেধসাতয়ে পুরন্ধ্যা বিবাসতি৷৷ ১। কশ্যপস্য স্ববিদো যাবাহুঃ সযুজাবিতি। যযোর্বিশ্বমপি ব্রতং যজ্ঞং ধীরা নিচাৰ্য৷৷ ২৷ অৰ্চত প্রার্চতা নরঃ প্রিয়মেধাসো অর্চত। অৰ্চন্তু পুত্ৰকা উত পুরমিদ ধৃষ্ণচত৷৷ ৩৷৷ উথমিন্দ্রায় শংস্যং বর্ধনং পুরুনিষিধে। শক্রো যথা সুতেষু নো রারণৎ সখ্যেষু চ ৷৷ ৪৷৷ বিশ্বানরস্য বম্পতিমনানতস্য শবসঃ।এবৈশ্য চৰ্ষণীনামূতী হুবে থানা৷ ৫৷৷ স ঘা যন্তে দিবো নরো ধিয়া মর্তস্য শমতঃ। উতী স বৃহততা দিবো দ্বিষা অংহো ন তরতি৷৷ ৬৷৷ বিভোষ্ট ইন্দ্র রাধসো বিড়ী রাতিঃ শতক্রতো। অথা নো বিশ্বচর্ষণে দ্যুম্নং সুদত্ৰ মংহয়৷৷ ৭৷৷ বয়শ্চিত্তে পতত্রিণেণা দ্বিপাচ্চতুষ্পদৰ্জুনি। উষঃ প্রারষ্ঠুরনু দিবো অন্ত্যেম্পরি৷৷ ৮৷৷ অমী যে দেবা স্থান মধ্য আরোচনে দিবঃ। কদু ব ঋতং কদমৃতং কা প্রত্না ব আহুতিঃ॥ ৯৷৷ ঋচং সাম যজামহে যাভ্যাং কর্মাণি কৃথতে। বি তে সদসি রাজতো যজ্ঞং দেবেষু বক্ষতঃ। ১০
মন্ত্ৰাৰ্থ— ১। হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ! তোমরা সাধকগণ কর্তৃক আরাধনীয় ঐশ্বর্যসম্পন্ন এ দেবতাকে প্রাপ্তির জন্য জ্ঞানযুক্ত শক্তিকে প্রবৃদ্ধি কর; সেই দেবতা সৎকর্মসাধনের জন্য প্রজ্ঞাযুক্ত
কর্মশক্তি দান করে তোমাদের প্রবর্ধিত করবেন। (ভাব এই যে, -সাধকদের ভগবান্ শক্তিদান করে ও মোক্ষলাভে সহায়তা করেন)। [যেদিক দিয়েই হোক না কেন, সাধককে নিজের শক্তির উদ্বোধন করতে হবে। তাতেই তার নিঃশ্রেয়স্ লাভ ঘটে]। [এর গেয়গানের নাম–বামদেব্যং]।
২। সর্বজ্ঞ দেবতার সহচর ভক্তি ও জ্ঞান; জ্ঞানভক্তিসমন্বিত ব্যক্তির সমস্ত কর্মই ভগবানের আরাধনা, এটা জেনে জ্ঞানীব্যক্তিগণ তা জগতে প্রখ্যাপিত করেন। (ভাব এই যে, -সাধকগণই ভগবানের মাহাত্ম্য জগতে প্রচার করেন)। [যিনি জ্ঞান ও ভক্তিলাভ করেছেন, যাঁর মন জ্ঞান ও ভক্তিলাভের ফলে রজঃ ও তমের উর্ধ্বে উঠেছে, তিনি পাপকার্যে রত হতে পারেন না; তাঁর কর্ম প্রেরণার মধ্যে বিশুদ্ধ সত্ত্বভাব থাকে বলে তিনি অন্যায় অসকার্য সম্পাদন করতে পারেন না। — এখানে কশ্যপ অর্থে সর্বজ্ঞ দেবতা ধরাই সঙ্গত]। [এর গেয়গানের নাম–কশ্যপং]।
৩। হে তোমার চিত্তবৃত্তিসমূহ! তোমরা নেতা হয়ে অভীষ্টপূরক দেবতাকে সর্বতোভাবে আরাধনা কর; সৎকর্মপ্রিয় হয়ে তাঁকে প্রকৃষ্টরূপে (সৎকর্মসাধনের দ্বারা) পূজা কর; তোমরা রিপুবিমর্দক দেবতাকে আরাধনা কর; অপিচ, সর্বজীব সেই দেবতাকে যেন ভগবানের আরাধনা করে। (প্রার্থনাটির ভাব এই যে, আমি যেন ভগবানের অনুসারী হই; সমস্ত লোকও যেন ভগবানের অনুসারী হয়)। [এখানে প্রার্থনার ব্যাকুলতা ও সার্বজনীনতা অতি সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। শুধু আমিই নয়, সেই সঙ্গে বিশ্ববাসী সকলেই ভগবানের আরাধনা করে মুক্তিলাভ করুক]। [এর গেয়গানের নাম প্রৈয়মেধম্]।
।৪। যেহেতু সেই পরমশক্তিশালী ইন্দ্রদেব আমাদের ভক্তিসহযুত সখিত্বে অতিশয় প্রীত হন (অথবা, সেই হেতু, বহুশত্রুবিনাশকারী পরমৈশ্বর্যশালী ইন্দ্রদেবের তৃপ্তিসাধনের উদ্দেশ্যে, স্তোত্র ইত্যাদি মন্ত্র উচ্চারণ করা বিধেয়)। (ভাব এই যে, আমাদের ভক্তিসহযুত সখ্যতার সাথে তার বিদ্যমানত্ব হেতু শত্রুনাশক ভগবান্ ইন্দ্রদেবে তৃপ্তিপ্রদ কর্ম সম্পাদন করা কর্তব্য)। [সায়ণ ব্যতীত অন্যান্য ব্যাখ্যাকারগণ এখানে উচ্চৈঃস্বরে সামগানের সঙ্গে সঙ্গে ইন্দ্রদেবকে আহ্বান করে সোমরস। পান করিয়েছেন। তার সুতেষুশব্দে সোমরস মাদকদ্রব্য অর্থ পরিগ্রহণ করে এই বিভ্রাট ঘটিয়েছেন। সায়ণ ঐ শব্দে পুত্রেযু অর্থ ধরেছেন। প্রকৃতপক্ষে ঋকের অন্তর্নিহিত ঐ সুতেষু আর সখ্যেযু শব্দ দুটিতে যথাক্রমে বিশুদ্ধা ভক্তি ও সখ্যভাব ধরাই সঙ্গত। ভক্তিমিশ্রিত সখ্য–সে এক উচ্চস্তরের সাধনা। সখ্যের পরই আত্মনিবেদন। আত্মনিবেদনে সাধ্য-সাধকে অভিন্ন মিলন]। [এর গেয়গানের নাম–বাহ দুকথং এবং এটির গায়ক-ঋষি-মধুচ্ছন্দা]।
৫। হে মম চিত্তবৃত্তিসমূহ! শত্ৰুজয়কারিণী, অপরাজেয় শক্তির আধারভূত দেবতাকে তোমরা আরাধনা কর; ভগবৎপ্রীতি সাধনের দ্বারা আত্ম-উৎকর্ষ-বিধায়ক সৎবৃত্তিসমূহের এবং সৎকর্মসাধনসামর্থ্যের রক্ষার জন্য আমি যেন ভগবানের নিকট প্রার্থনা করি। ভাব এই যে, –আত্ম উৎকর্ষ সাধনের ও সৎকর্মের সাধন-সামর্থ্য লাভের জন্য আমি যেন ভগবানের আরাধনা করি)। [ভগবান্ শবসঃ পতিঃ–তিনি শক্তির অধিকারী। এই পূর্ণশক্তিস্বরূপের ধ্যানে, –অহং বা ত্বং যে কোন অবলম্বনেই হোক না কেন–মানুষের মধ্যে সেই শক্তি জাগরিত হয়। লক্ষণীয়–এখানে শক্তির শত্রুঞ্জয়কারিণী বিশেষণ ব্যবহৃত হয়েছে। সাধক পরোক্ষভাবে আত্ম-উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে, রিপুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবার জন্যই ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেছেন]। [এর গেয়গানের নাম বৈশ্বানরস্য সামনী দ্বে। এর গেয়গানের ঋষি—প্রিয়মেধ]।
৬। সৎকর্মানুষ্ঠানে শান্তচিত্ত ব্যক্তিদের মধ্যে যে ব্যক্তি প্রার্থনা দ্বারা দেবভাবসম্পন্ন আপনার মিত্রভূত উপাসক হন, তিনি মহৎ দেবতার–আপনার–রক্ষাশক্তি দ্বারা রিপুতুল্য পাপকে পরাজয় করেন। (ভাব এই যে, ভগবানের অনুসারী জন দেবতার কৃপায় পাপের কবল থেকে মুক্ত হন)। [মন্ত্রটিতে নিত্যসত্য-তত্ত্ব প্রখ্যাপিত হয়েছে। ভগবানের প্রিয় উপাস্য–সখ্যভাবের সাধকতার সাথে অভিন্নরূপে মিলিত হন বলে পাপের আক্রমণ থেকে মুক্তিলাভ করেন]। [এই সাম-মন্ত্রটির গেয়গানের নাম–শাকপূতে দ্বে। এটির ঋষির নাম ভরদ্বাজ]।
৭। সর্বশক্তিমান্ বলৈশ্বর্যাধিপতি হে দেব! পরম ধনের মহৎদান আপনার-ই; অর্থাৎ কেবলমাত্র আপনি-ই পরমধন দান করেন; অতএব সর্বজ্ঞ পরমমঙ্গলদাতা হে দেব! আমাদের পরমধন প্রদান করুন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, -হে ভগবন! কৃপা করে আমাদের পরম-কল্যাণপ্রদ ধন প্রদান করুন)। [পরমধন–মোক্ষ। একমাত্র সর্বশক্তিমান্ ভগবানই সেই ধন প্রদান করতে পারেন]। [এর গেয়গানের নাম–বরুণান্যাঃ সাম। এর গেয়গানের ঋষি—অত্রি]।
৮। সংস্কারকারিণি (সত্ত্বভাবপ্রদায়িনী) জ্ঞান-উন্মোষিণী হে দেবি (ঊষা)! আপনার আগমন অনুসরণ করলে, মনুষ্য পশু ও পক্ষী প্রভৃতি প্রাণিগণ বল প্রাপ্ত হয়; আরও, তারা সকলে স্বর্গলোকের সীমান্তভাগে (কাছে) প্রকৃষ্টরূপে প্রয়াণ করে। (ভাব এই যে, –সকল প্রাণীর মধ্যেই জ্ঞানদেবতার ক্রিয়া প্রত্যক্ষীভূত হয়; জ্ঞানের প্রভাবে প্রাণিগণ ঊর্ধ্বগতি লাভ করে)। [অর্জ ধাতু থেকে উৎপন্নপদ অর্জুনি। ধাতুর অর্থ–সংস্কার বা পরিষ্কার। পাপের ক্লেদ যার অঙ্গে অঙ্গে সংলিপ্ত আছে, তার সেই ক্লেদকে জ্ঞানের উন্মেষকারিণী দেবী ঊষা অপসারণ করে দেন। তাই তার নাম–অর্জুনি · অর্থাৎ শ্বেতবর্ণা। অজ্ঞানতার অন্ধকার দূরীভূত হলে যে জ্ঞানজ্যোতিঃ প্রভা বিস্তার করে, তার সম্বন্ধেই ঐ পদটি প্রযুক্ত]। [এর গেয়গানের নাম-উষসম]।
৯। হে দেবগণ! (দীপ্তিদানাদিগুণনিবহ)! অন্তরীক্ষলোকে প্রসিদ্ধ আপনারা যেখানে অবস্থিতি করেন, স্বর্গের প্রভায় সে স্থান দীপ্তিমান থাকে; (ভাব এই যে, –যেখানে দেবত্ব বর্তমান থাকে, সেই স্থানই স্বর্গ বলে অভিহিত হয়); হে দেবগণ! আপনাদের সম্বন্ধীয় সত্য কোথায়? আর কোথা হতেই বা অসত্য এলো? আরও, আপনাদের সম্বন্ধীয় সনাতন নিত্য সৎকর্ম কোথায় গেল? (প্রার্থনার ভাব এই যে, –ইহজগতে অসত্যের ও অপকর্মের প্রভাব পরিদৃষ্ট হচ্ছে; আমাকে সত্যের ও সৎকর্মের তত্ত্ব জ্ঞাপন করুন)। [দেবাঃ পদটিতে দেবগণ অর্থে দীপ্তিদান ইত্যাদি গুণবিশিষ্টকে বোঝাচ্ছে। ঋতং পদটিতে সত্য এবং যজ্ঞ অর্থাৎ সৎকর্ম অর্থ পাওয়া যায়। সমগ্র মন্ত্রটির ভাব এই যে, যেখানেই দেবগণের আবির্ভাব হয়, সেইস্থানই স্বর্গের নন্দনকানন। অর্থাৎ হৃদয়ে দেবভাবের উদয় হলেই স্বর্গ লাভ হয়। নানা পাপময় প্রলোভনে ও রিপুর তাড়নে এ সংসার অসত্যের ও অপকর্মের ক্ষেত্র বলে প্রতিভাত হয়। আমাদের সর্বদাই জর্জরিতকারী রিপুগণের কবল থেকে মুক্ত হয়ে যাতে সত্যের ও সৎকর্মের অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হতে পারি, দেবগণ যেন তারই উপায় বিহিত করেন]। [এই সাম-মন্ত্রটির গেয়গানের নাম–দেবানাং রুচিঃ]।
১০। ঋক্সামরূপ যে স্তোত্রের দ্বারা সাধকগণ মোক্ষপ্রাপক প্রার্থনা ইত্যাদি কর্মসমূহ করেন, সেই স্তোত্রসমূহের দ্বারা আমরা যেন ভগরানকে আরাধনা করি (অথবা ঋক্সামরূপ স্তোত্রকে আমরা পূজা করি); সৎকর্মকে স্তোত্ৰসমূহ দীপ্তি প্রদান করে এবং সৎকর্মকে স্তোত্ৰসমূহ দেবভাবের অভিমুখী করে। (ভাব এই যে, –সৎকর্মসমন্বিত প্রার্থনার দ্বারা মানুষ দেবভাব লাভ করে)। [কর্মের সাথে প্রার্থনার যোগ থাকলে, সেই কর্মগুলি দেবার অভিমুখী হয়। সাধক সৎকর্ম সাধন করছেন; প্রার্থনা ও বৈদিক মন্ত্র তাকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, সৎকর্মসম্পাদনের মহৎ উদ্দেশ্য–ভগবৎ-প্রাপ্তি। ভগবানের উদ্দেশেই স্তোত্রসমূহ উচ্চারিত হয়; তাই তা আমাদের তার বিরাট মহিমার–অনন্ত গৌরবের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়; আমাদের হৃদয়ে দেবভাবের সঞ্চার হয়, আমাদের কর্মকে ভগবানের উদ্দেশে পরিচালিত করে। বেদ সেই স্তোত্ররাজির অনন্ত আকর, বেদই মানুষের ভগবৎ চরণে পৌঁছাবার উপায় বিধান করে দিয়েছেন। জগতের আদিভূত অনন্তজ্ঞানের সন্ধান মানুষ এই অপৌরুষেয় অনাদি বেদের সাহায্যেই লাভ করে]। [এই সাম-মন্ত্রটির গেয়গানের নাম–ঋকসাম্নোঃ সামনী দ্বে।
.
তৃতীয়া দশতি
ছন্দ আর্চিক। কৌথুমী শাখা। ঐন্দ্র পর্ব (তৃতীয়)। চতুর্থ অধ্যায়।
দেবতা ইন্দ্র, ২ দ্যাবাপৃথিবী।
ছন্দ জগতী, ১ অতি জগতী, ১০ মহাপঙক্তি।
ঋষি ১ রেভ কাশ্যপ, ২ সুবেদা শৈরীষি বা শৈলুষি, ৩ বামদেব গৌতম, ৪।৭।৮ সব্য বা সত্য আঙ্গিরস, ৫ বিশ্বামিত্র গাথিন, ৬ কৃষ্ণ বা কৃষ্ট আঙ্গিরস, ৯ ভরদ্বাজ বার্হস্পত্য, ১০ মেধাতিথি কাণ্ব (ঋগ্বেদে মান্ধাতা যৌবনাশ্ব), ১১ কুৎস আঙ্গিরস৷৷
বিশ্বাঃ পৃতনা অভিভূতরং নরঃ সম্পূস্ততক্ষুরিং জজনুশ্চ রাজসে। .. ক্ৰত্বে বরে হেমন্যামুরীমুতোগ্রমোজিং তসং তরস্বিন৷৷৷ শ্ৰত্তে দমি প্রথমায় মন্যবেংহ্যদ্দসং নর্যং বিবেরপঃ। উভে যত্বা রোদসী ধাবতামনুভ্যসাতে শুম্মাৎ পৃথিবী চিদদ্রিবঃ৷ ২৷৷ সমেত বিশ্বা ওজসা পতিং দিবো য এক ইদ ভূরতিথির্জনানাম্। স পূৰ্বো নূতনমাজিগীষং তং বর্তনীরনুবাবৃত এক ইৎ৷৷ ৩৷৷ ইমে ত ইন্দ্র তে বয়ং পুরুত যে দ্বারভ্য চরামসি প্রভূবসো। নহি হৃদন্যো গির্বণণা গিরঃ সঘৎ ক্ষোণীরিব প্রতি তদ্ধর্য নো বছঃ৷৷ ৪৷৷ চর্ষণীধৃতং মঘবানমুকথাতমিং গিরো বৃহতীরভ্যন্ত। বাবৃধানং পুরুতং সুবৃক্তিভিরমং জরমাণং দিবেদিবে। ৫৷৷ অচ্ছা ব ইন্দ্রং মতয়ঃ স্বর্য বঃ, সীর্বিশ্বা উশতীরন্ষত পরি স্বজন্ত। জনয়ো যথা পতিং মর্যং ন শুল্কং মঘবানমূতয়ে৷৷ ৬৷৷ অভি ত্যং মেষং পুরুতমৃগ্নিয়মিন্দ্রং গীভিমতা বম্বো অর্ণব। যস্য দ্যাবো ন বিচরন্তি মানুষং ভুজে মংহিষ্ঠমভিবিপ্ৰমৰ্চত৷৷ ৭৷৷ ত্যং সু মেষং মহয়া স্বর্বিদং শতং যস্য সুভুবঃ সাকমীরতে। অত্যং ন বাজং হবনস্যদং রথমিং ববৃত্যামবসে সুবৃক্তিভিঃ৷ ৮৷৷ ঘৃতবতী ভুবনা-নামভিশিয়োর্বী পৃথ্বী মধুদুঘে সুপেশসা। দ্যাবাপৃথিবী বরুণস্য ধর্মণা বিষ্কভিতে অজরে ভূরিরেতসা। ৯। উভে যদি রোদসী আপথোষা ইব। মহান্তং ত্বা মহীনাং সাজং চর্ষণীনা। দেবী জনিৰ্যজীজনদভদ্রা জনিৰ্যজীজনৎ৷৷ ১০৷৷ প্র মন্দিনে পিতুমদর্চতা বচো যঃ কৃষ্ণগর্ভা নিরহজিশ্বনা। অবস্যবো বৃষণং বজ্রদক্ষিণং মরুত্বন্তং সখায় হুবেমহি৷৷ ১১।
মন্ত্ৰার্থ— ১। সাধকগণ মিলিত হয়ে সর্বব্যাপী রিপুসংগ্রাম-জয়কারী বলৈশ্বর্যাধিপতি দেবতাকে অর্থাৎ দেবতার নিকটে প্রার্থনা করেন, এবং আত্মজ্ঞানলাভের জন্য তাঁকে হৃদয়ে জাগরিত করেন; সুতরাং, বিশ্বমঙ্গল-সাধনের জন্য আত্মজ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত, রিপুনাশক, বীর্যবন্ত, ও জস্বিতম, বলবান, আশুমুক্তিদায়ক দেবতাকে পরমধনলাভের জন্য আমরা যেন আরাধনা করি। (ভাব এই যে, মোক্ষলাভের জন্য আমরা যেন ভগবানের অনুসারী হই)। [এই সাম-মন্ত্রটির গেয়গানের নাম ত্রৈশোকং]।
২। পাপনাশে পাষাণ কঠোর হে দেব! যেহেতু আপনি রিপুগণকে নিঃশেষে বিনাশ করে জগতে অমৃত প্রদান করেন, এবং যেহেতু দ্যুলোক-ভূলোক আপনাকে পূজা করে এবং আপনার প্রভাবে ত্রিলোক ভয়ে কম্পিত হয়; সেই হেতু আপনার আদিভূত জ্ঞানাত্মিক শক্তিলাভের জন্য আমি আপনার নিকট প্রার্থনা করছি। (প্রার্থনাটির ভাব এই যে, –সর্বলোকের আরাধনীয় হে ভগবন! কৃপা করে আমাকে জ্ঞান-শক্তি প্রদান করুন)। [ভগবানের সাহায্য ব্যতিরেকে মোক্ষলাভের অন্তরায়ক অজ্ঞানতারূপ শত্রুর বিনাশ হয় না। –শক্তির আদি, শক্তির বিকাশই এই জগৎ। সেই আদিশক্তি জ্ঞান। ভগবান জ্ঞানস্বরূপ। এই জ্ঞান-শক্তির বলেই জগৎ সৃষ্ট হয়েছে এবং জগৎ বর্তমান আছে। …..বিশ্বের মূলে আছেন–চৈতন্যসত্তা। এই চৈতন্যসত্তার দৃষ্টিতেই সৃষ্টি আরম্ভ হয়; আবার সেই–দৃষ্টির অপসারণেই সৃষ্টি বিলয়প্রাপ্ত হয়। সাধক-গায়ক সেই আদিশক্তি মূলশক্তি লাভের জন্যই ভগবানের কাছে প্রার্থনা জানাচ্ছেন]। [এর গেয়গান আটটির নাম–শৈখণ্ডিনে দ্বে, আত্ৰের্বিবর্তৌ দ্বে, মহাসাবেতসে দ্বে, মহাশৈরীষে দ্বে]।
৩। হে আমার কর্মপ্রবৃত্তিসমূহ বা চিত্তবৃত্তিসমূহ! দ্যুলোকে স্বামীকে সৎকর্মসাধনের ও প্রার্থনার দ্বারা অনুসরণ কর অর্থাৎ তাকে প্রাপ্ত হও। একমাত্র যে দেবতা লোকসমূহের অতিথির ন্যায় প্রিয় হন, আদিভূত সেই দেবতা একমাত্র বিজয়-পথ-স্বরূপ হয়ে রিপুজয়েছু স্তোতাকে প্রাপ্ত হন। (ভাব সন্তানকেই নিজের ক্রোড়ে তুলে নেবার জন্য হস্ত প্রসারণ করে আছেন। মানুষ একটুখানি অগ্রসর হলে–অগ্রসর হবার জন্য ঐকান্তিক ভাবে চেষ্টা করলে তিনিও অগ্রসর হয়ে তাকে গ্রহণ করেন।
এই মন্ত্রের মধ্যে অতিথিঃ পদটি অনুধাবনযোগ্য। ভগবান্ অতিথির মতো প্রিয় হন। এর মধ্যে আর্যধর্মের সেই বিশেষত্ব–আতিথেয়তা দেখা যায়। এই মন্ত্র থেকে ইতিহাসবেত্তাগণ প্রাচীন আর্যসমাজের উচ্চ সামাজিক ও গার্হস্থ্য জীবনের পরিচয় পেয়ে থাকেন]। [এই সাম-মন্ত্রের গেয়গানের নাম–ইন্দ্রায় প্রিয়ায় ত্রীণি]।
৪। প্রকৃষ্টধনসম্পন্ন, সকলের পূজ্য, হে ভগবন ইন্দ্রদেব! সৎকর্মের অনুষ্ঠাতা যে সকল প্রার্থনাকারী আমরা আপনাকে অবলম্বন করে কর্মে প্রবৃত্ত হই; সে আমরা সকলেই আপনার অঙ্গীভূত, (আশ্রয়প্রাপ্ত) হয়ে থাকি। স্তুতিমন্ত্রসেব্য হে ভগবন! আপনার ভিন্ন কোনও স্তুতি ইহজগতে নেই; অর্থাৎ যে কোনও স্তুতিমন্ত্রই আমরা উচ্চারণ করি না কেন, সবই আপনাকে প্রাপ্ত হয়; অতএব সকলের ধারণকত্রী পৃথ্বীমাতার ন্যায়, আমাদের উচ্চারিত স্তুতিলক্ষণ বাক্যকে, আপনি গ্রহণ (শ্রবণ) করুন। (ভাব এই যে, ভগবৎ-কর্মে আমাদের আসক্তি হোক এবং ভগবান্ আমাদের প্রার্থনা গ্রহণ করুন)। [প্রথম প্রার্থনা–আমরা যেন ভগবানেরই কর্মে (সৎকর্মে) জীবন ন্যস্ত করতে পারি। দ্বিতীয় প্রার্থনা–যেখানে যার উদ্দেশ্যে কিছু স্তুতিমন্ত্র উচ্চারিত সবই তো সেই একতম ঈশ্বরেই বর্তায়; সুতরাং আমাদের স্তুতিমন্ত্রও যেন তার উদ্দেশেই বিহিত হয়। তৃতীয় প্রার্থনা–আমাদের শত ত্রুটিবিচ্যুতি সত্ত্বেও ভগবান্ যেন আমাদের পূজা গ্রহণ করেন]। [এটির গেয়গানের নাম–বৈরূপাণি ত্রীণি]।
৫। হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ! অভীষ্টদায়ক, পরমধনসম্পন্ন স্তবনীয়, প্রবর্ধমান, সর্বলোকের আরাধ্য, নিত্য, পূজনীয়, বলৈশ্বর্যাধিপতি দেবতাকে তোমরা মহনীয় বাক্য এবং সৎকর্মর্সমন্বিত প্রার্থনার দ্বারা অনুক্ষণ আরাধনা কর। (ভাব এই যে, আমি যেন সর্বতোভাবে ভগবানের অনুসারী হই)। [কিভাবে ভগবানের আরাধনা করলে তার কৃপা লাভ হয়, তার উত্তর মন্ত্রের মধ্যে দিবে দিবে পদে পাওয়া যায়। অনুক্ষণ তার আরাধনা করবে, প্রত্যেক কার্য তার আরাধনা মনে করে সম্পন্ন করতে হবে। প্রত্যেক নিশ্বাস-প্রশ্বাসেও যেন তার মাহাত্ম্য ধ্বনিত হয়, তবেই তার কৃপালাভ করা যায়]। [এই সাম-মন্ত্রটির গেয়গানের নাম বার্হদুকথম]।
৬। মোক্ষদায়ক মুক্তিবিধায়ক ভগবানে সঙ্গত সর্বব্যাপী স্তুতিসমূহ সর্বতোভাবে পরমৈশ্বর্যশালী ভগবানকেই প্রাপ্ত হয়। জায়া যেমন তার মরণধর্মশীল পতিকে আলিঙ্গন করে, আমার উচ্চারিত সেই স্তুতিসমূহ, আমাদের মোক্ষদানের জন্য, পরমধনস্বামী ভগবানকে প্রাপ্ত হোক। (ভাব এই যে, -কর্মের প্রভাবে যেন আমরা ভগবানকে প্রাপ্ত হই)। [জনগোঃ পতিং মর্যং–এই উপমা বাক্যের অর্থে– জায়া যেমন তার মরণধর্মশীল পতিকে আলিঙ্গন করেন। এর দ্বারা প্রাচীন ভারতবর্ষে পতির সাথে চিতারোহণ প্রথার ইঙ্গিত পাওয়া যায়]। [এর গেয়গানের নাম–ত্রাসদস্যবে দ্বে]।
৭। হে আমার মনোবৃত্তিসমূহ! তেজস্বী (শত্রুস্তম্ভনকারী), সকলের পূজনীয়, স্তুতিমন্ত্রের দ্বারা, জুয়মান, সকল ধনের আধারস্থান, সেই ভগবানকে তোমরা স্তোত্র-মন্ত্রের দ্বারা সর্বতোভাবে আনন্দ দান কর। যে ভগবানের অনুকম্পায় মনুষ্যগণের হিতসাধক কর্মসমূহ, হিতকর সূর্যরশ্মির ন্যায়, সর্বত্র প্রবর্তিত রয়েছে; আপনার এবং অপর সকলের সুখের নিমিত্ত, সর্বশ্রেষ্ঠ সেই জ্ঞানের আধারকে তোমরা সর্বতোভাবে আরাধনা কর। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধনমূলক; ভাব এই যে, ভগবানের আরাধনা সকলের সুখদায়ক; অতএব, হে জীব! তুমি সদাকাল ভগবানের আরাধনায় প্রবৃত্ত হও)। [প্রচলিত ব্যাখ্যায় যজমান অথবা পুরোহিতের কণ্ঠে ঋত্বিকদের সম্বোধন করে বিষয়-ভোগের জন্য ইন্দ্রের পূজা। করতে বলা হয়েছে। আবার, মেষং পদে পুরাণের একটি উপাখ্যানকে টেনে আনা হয়েছে; মেধাতিথির যজ্ঞে মেষের আকার ধারণ করে ইন্দ্রের সোমপান–এমন, গল্প বর্ণনা করা হয়েছে। মেষং পদের অর্থ এখানে স্পর্ধমান, তেজস্বী, শত্রুস্তম্ভনকারী সমীচীন]। [এই সাম-মন্ত্রের গেয়গানটির নাম–সোম সাম]।
৮। হে আমার মন! যে ভগবানের উদ্দেশে অসংখ্য স্তোতা সর্বদা স্তব করছে; শ্রেষ্ঠ, মহাপ্রভাবসম্পন্ন, স্বর্গ-প্রদাতা সেই ভগবানকে সর্বতোভাবে আরাধনা কর; আত্মরক্ষার জন্য পরিত্রাণলাভের জন্য, ক্ষিপ্রগতিশীল শব্দের ন্যায় (অথবা, সৎকর্মজাত শুদ্ধসত্ত্ব যেমন অতিত্বরায় ভগবানের সান্নিধ্য প্রদান করে, তেমনই ভাবে) সাত্ত্বিক পূজার দ্বারা, শুদ্ধসত্ত্ব-ক্ষরণশীল কর্মরূপ যানের প্রতি অথবা হৃদয়ে সেই ভগবানকে (ইন্দ্রদেবকে) ত্বরায় আনয়ন কর। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধন-মূলক; মনকে সম্বোধনসূচক। ভাব এই যে, হে মন! তুমি আলস্য পরিত্যাগ কর;শীঘ্র সৎকর্মপরায়ণ হও; তোমার সৎকর্ম থেকে জাত শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা ভগবান শীঘ্রই তোমাকে সকল পাপ-পতন থেকে রক্ষা করবেন)। [মেষং–মহাপ্রভাবসম্পন্নং। মন্ত্রের প্রকৃষ্ট প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন এমন ভাবের সাত্ত্বিকপূজায় ব্রতী হতে পারি, যে পূজার ফলে আমাদের হৃদয় বা কর্মসকল শুদ্ধসত্ত্বভাব প্রাপ্ত হয় এবং সেই হৃদয় বা কর্মের মধ্যে যেন ভগবান্ এসে বিরাজ করেন]। [এর গেয়গানের নাম সৌভরম]।
৯। দীপ্তিমান বিস্তীর্ণ প্রসিদ্ধ অমৃতপূর্ণ সৌন্দর্যশালী নিত্য বহুবীর্যশালী দ্যুলোক-ভূলোক অভীষ্টবর্ধক দেবতার ধারণশক্তির দ্বারা বিশেষভাবে ধৃত হয়ে সর্বলোকের আশ্রয়ভূত হয়েছে। (ভাব এই যে, ভগবানের শক্তির দ্বারা সমস্ত লোক বিধৃত আছে)। [এর গেয়গানের নাম–বরুণসামনী দ্বে]।
১০। বলৈশ্বর্যাধিপতি হে দেব! জ্ঞানের উন্মেষিকা বৃত্তি যেমন অজ্ঞানতা বিনাশ করেন, তেমনই আপনিও দ্যুলোক-ভূলোককে আপনার জ্যোতিতে পূর্ণ করেন; সেইজন্য দেবভাবপ্রদাতা, আত্ম উৎকর্ষ-সাধকদের রক্ষক আপনাকে দ্যুলোক-ভূলোক অনুসরণ করে; দেবভাব-উৎপাদিকা আপনার শক্তি লোকদের দেবভাব প্রদান করেন; মঙ্গল-উৎপাদিকা আপনার শক্তি লোকদের মঙ্গল প্রদান করেন। (ভাব এই যে, সর্বলোককর্তৃক আরাধনীয় দেবতা মানুষকে দেবভাব ও পরম-মঙ্গল প্রদান করেন)। [আগের মন্ত্রে দ্যুলোক-ভূলোক অর্থাৎ দ্যাবাপৃথিবীকে দীপ্তিশালী ও সৌন্দর্যশালী বলা হয়েছে। এই মন্ত্রে সেই দীপ্তির কারণ বর্ণিত হয়েছে। জগৎ তার শক্তিতে শক্তি পায়, তার জ্যোতিতে জ্যোতি পায়। অর্থাৎ জ্ঞানরূপী তার উন্মেষ হলে মানুষের এবং দেবতারও হৃদয় জ্যোতির্ময় হয়ে ওঠে; অজ্ঞানতার অন্ধকার দূরে পলায়ন করে। জগতের প্রতি যখন ভগবানের কৃপা-দৃষ্টি পতিত হয়, তখন দিব্যজ্যোতিতে দ্যুলোক-ভূলোক পূর্ণ হয়ে যায়। মন্ত্রে তাই বলা হয়েছে–দুলোক-ভূলোক। সর্বলোক আপনার (ভগবানের) অনুসরণ করে। আবার, যাঁরা তাঁর দিকে অগ্রসর হতে ইচ্ছা করেন, তাদের হাতে ধরে তিনি কোলে তুলে নেন, যাতে তারা পথভ্রান্ত না হন, পাপের দ্বারা আক্রান্ত না হন। অন্তরের সাথে যারা মুক্তিকামনা করেন, তারা ভগবানের কৃপায় অবশ্যই অভীষ্ট ফল লাভ করতে পারেন। তাই তিনি–চর্ষণীনাং সম্রাজং]। [এই সাম-মন্ত্রটির নাম–শ্যেনম]।
১১। যে দেবতা সরলপথ-অবলম্বী সৎ-মার্গ-অনুসারী সাধুজনের দ্বারা অর্থাৎ সাধুহৃদয়ে আবির্ভূত হয়ে, অজ্ঞানতার উৎপাদক মূলীভূত অসৎ প্রবৃত্তিসমূহকে নিরন্তর নাশ করছেন; হে আমার। চিত্তবৃত্তিনিবহ! তোমরা সেই স্তোতব্য দেবতার উদ্দেশে শ্রেষ্ঠস্তোত্রকে (বেদমন্ত্রকে) প্রকর্ষের সাথে উচ্চারণ কর অর্থাৎ সৎকর্ম সাধনার সাথে অনুধ্যান কর; আত্মরক্ষায় অভিলাষী হয়ে আমরা, অভীষ্টপূরক, আমাদের হিতসাধনের নিমিত্ত রিপুবিমর্দক আয়ুধধারী, বিবেকরূপী দেবগণের সাথে মিলিত, সেই দেবতাকে সখিত্ব লাভের জন্য যেন আহ্বান করি–অনুসরণ করি। (ভাব এই যে, দেবশক্তি অসৎপ্রবৃত্তির নাশক ও সর্বদা শ্রেয়ঃসাধক; সুতরাং সেই শক্তি অনুসরণ অবশ্য কর্তব্য)। [প্রচলিত ব্যাখ্যায় বীভৎস দেবচরিত্র অঙ্কন করা হয়েছে। সেখানে ঋজিনা রাজার সাথে কৃষ্ণের (ঐ নামধারী এক অসুরের) গর্ভবতী ভার্যাদের হত্যাকারী হৃষ্ট ইন্দ্রের উদ্দেশে অন্নের সাথে স্তুতি অর্পণের জন্য আহ্বান করা হয়েছে। ঋষিরা যেন রক্ষা পাবার ইচ্ছায় সেই অভীষ্টদাতা দক্ষিণ হস্তে বজ্রধারী ইন্দ্রকে মরুৎ-গণের সাথে তাদের সখা হবার জন্য আহ্বান করছেন। –এমন অর্বাচীন ও অবিশ্বাস্য ব্যাখ্যা অবশ্যই পরিত্যাজ্য। –এখানে ঋজিশ্বনা অর্থে সরলপথগামী বা সৎমার্গ অনুসারী অর্থ গৃহীত হয়েছে। কৃষ্ণগর্ভাঃ অর্থাৎ অজ্ঞানতায়াঃ উৎপাদয়িত্রীঃ মূলীভূতা বা–অসৎপ্রবৃত্তীন এমন। অর্থই সমীচীন। মরুৎ যে বিবেকরূপী দেবতাগণ তা আমরা প্রতি সামেই দেখিয়েছি]। [এই সাম মন্ত্রটির গেয়গানের নাম—বৈরূপম]।
.
চতুর্থী দশতি
ছন্দ আৰ্চিক। কৌথুমী শাখা। ঐন্দ্র পর্ব (তৃতীয়)। চতুর্থ অধ্যায়।
দেবতা ইন্দ্র৷৷
ছন্দ উষ্ণিক।
ঋষি ১ নারদ কাণ্ব, ২।৩ গোযূক্তি ও অশ্বসুক্তি কাণ্বায়ন, ৪ পর্বত কাণ্ব, ৫-৭।১০ বিশ্বমনা বৈয়শ্ব, ৮ নৃমেধ আঙ্গিরস, ৯ গৌতম রাহুগণ।
ইন্দ্র সুতেষু সোমেষু তুং পুনীষ উথ্যম্। বিদে বৃধস্য দক্ষস্য মহা হি ষঃ ৷৷ ১৷৷ তমু অভি প্র গায়ত পুরুতং পুরুষ্টুত। ইন্দ্রং গীভিস্তবীষমা বিবাসত৷৷ ২৷৷ তং তে মদং গৃণীমসি বৃষণং পৃষ্ণু সাসহি। উ লোককৃত্মমদ্রিবো হরিশিয়৷ ৩৷৷ যৎ সোমমিন্দ্র বিষ্ণবি যদ বা ঘ ত্ৰিত আপ্ত্যে। যদ বা মরুৎসু মন্দসে সমিন্দুভিঃ। ৪। সামবেদ-সংহিতা এদু মধোর্মদিন্তরং সিঞ্চ্যধ্বৰ্যো অন্ধসঃ। এবা হি বীর স্তবতে সদাবৃধঃ ॥ ৫৷৷ এমিন্দ্রায় সিঞ্চত পিবাতি সোম্যং মধু। প্র রাধাংসি চোদ্দয়তে মহিত্বনা৷৷ ৬৷৷ এতো দ্বিন্দ্ৰং স্তবাম সখায়ঃ স্তোম্যং নরম্। কৃষ্টীর্যো বিশ্বা অভ্যস্ত্যেক ইৎ৷৷ ৭৷ ইন্দ্রায় সাম গায়ত বিপ্ৰায় বৃহতে বৃহৎ। ব্ৰহ্মকৃতে বিপশ্চিতে পনস্যবে৷ ৮। য এক ইদ বিদয়তে বসু মর্তায় দাশুষে। ঈশানো অপ্রতিদ্ভুত ইন্দ্রো অঙ্গ৷৷ ৯৷৷ সখায় আ শিমহে ব্রহ্মেন্দ্রায় বত্রিণে। ঔষ উ য়ু বো নৃতমায় ধৃষ্ণবে৷৷ ১০
মন্ত্ৰাৰ্থ— ১। পরমৈশ্বর্যশালিন হে ভগবন! হৃদয়ে সৎ-ভাব সঞ্জাত হলে, সৎ-ভাববর্ধক। মোক্ষপ্রাপ্তি-সামর্থ্য প্রদানের জন্য আপনি-সৎ-ভাব-সহযুত সৎকর্মকে প্রাপ্ত হন। (ভাব এই যে, সৎ-ভাব-সমন্বিত সৎকর্ম ভগবানকেই প্রাপ্ত হয়; আবার, সৎ-ভাবের সঞ্চার করে ভগবান্ সাধককে ও তার কর্মকে পবিত্র করেন)। সেই ভগবান্ নিশ্চয়ই মহান্। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য প্রকাশক; সৎ-ভাব সমন্বিত সাধক অবিলম্বে সৎ-ভাবের আধার ভগবানকে প্রাপ্ত হন; অতএব প্রার্থনা–হে ভগবন! আমাকে সৎ-ভাব-সমন্বিত করে মোক্ষপদে প্রতিষ্ঠিত করুন)। [সুতেষু অর্থে বিশুদ্ধেষু, সোমেষু অর্থে সত্ত্বভাবেষু, বৃধস্য অর্থে সদ্ভাব-বর্ধকস্য, মোক্ষপ্রাপকস্য, ইত্যাদিই সমীচীন]। [এই সাম মন্ত্রের নাম–কৌশং অনুক্রোমাং এবং কৌসং। এর ঋষি-নারদ]।
২। হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ! তোমরা সর্বলোকপূজনীয়, সর্বলোক-আরাধনীয় বলৈশ্বর্যাধিপতি ভগবানকে প্রকৃষ্টরূপে আরাধনা করে প্রার্থনা দ্বারা সেই দেবতাকেই সম্যকরূপে পূজা করো (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধক। মন্ত্রের ভাব এই যে, আমি যেন সর্বতোভাবে ভগবানের আরাধনা করি)। [তিনি তবিষং–মহান্ তিনি। তাই তাঁর কৃপালাভ মানুষের পক্ষে অসম্ভব নয়]। [এই সাম-মন্ত্রটির গেয়গানের নাম–দৈবোদাসে দ্বে এবং প্রহিতোঃ সংযোজনং। এর ঋষি–গোযুক্তি ও অশ্বসুক্তি]।
৩। পাপনাশে বজ্রের ন্যায় পাষাণকঠোর হে দেব! আপনার অভীষ্টবর্ষক রিপুসংগ্রামে শজয়কারী লোকসমূহের রক্ষক এবং জ্ঞানভক্তি সঞ্চারকারী, মোক্ষদায়ক সেই পরমানন্দ আমরা প্রার্থনা করছি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, -হে ভগবন! কৃপা করে আমাদের মোক্ষসাধক পরমানন্দ প্রদান করুন)। [ভগবান্ পরমানন্দের উৎস, অর্থাৎ ভগবানকে পাওয়া বা তার কৃপা-লাভই মানুষের পরমানন্দ। এই মন্ত্রের মধ্যে সেই আনন্দের স্বরূপ ব্যক্ত করা হয়েছে। পরমানন্দই মুক্তি–মোক্ষ। এই পরমানন্দকে যিনি লাভ করেছেন তার অন্তরের ও বাহিরের সকলশই বিধ্বংস হয়ে যায়]। [এই সাম-মন্ত্রের গেয়গানের নাম–হ্যারিবর্ণানি চত্বারি]।
৪। পরমৈশ্বর্যশালিন হে ভগবন! আপনি ভগবৎপরায়ণ জনে, অপিচ, ত্রিগুণসাম্যপ্রাপ্ত আত্মদর্শী জনে এবং বিবেকসম্পন্ন জনে পরমার্থসাধক শুদ্ধসত্ত্বের সঞ্চার করে দেন; আপনি আমাদের জ্ঞানরশ্মি ও শুদ্ধসত্ত্ব ইত্যাদি দ্বারা সম্যক দীপ্ত করুন এবং পরমানন্দ প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। বিবেকী জন বিবেকের প্রভাবেই ভগবানকে প্রাপ্ত হয়। অকিঞ্চন আমরা, আমাদের মধ্যে জ্ঞানের জ্যোতিঃ বিচ্ছুরণে অপিচ, সৎ-ভাব ইত্যাদির দ্বারা আমাদের স্বপদে প্রতিষ্ঠিত করে আপনি আমাদের উদ্ধার করুন এবং পরমানন্দ প্রদান করুন)। [জটিল মন্ত্রটিকে কোন কোন ভাষ্যকার অনেক কষ্ট-কল্পনা করে আরও জটিল করে তুলেছেন। এমনই একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদে পাওয়া যায়–হে ইন্দ্র! বিষ্ণু অথবা আপ্তত্রিত অথবা মরুৎগণ (আগত হলে) যে সোম (পান করে) প্রমত্ত হয় সেই সোমরসের সাথে আগমন কর। কিন্তু বিষ্ণবি অর্থে ভগবৎপরায়ণে জনে, ত্রিত আপ্তে অর্থে ত্রিগুণসাম্যপ্রাপ্তে আত্মদর্শনে, সোমং অর্থে শুদ্ধসত্ত্বং–ইত্যাদি বোঝাই সঙ্গত]। [এই মন্ত্রটির ঋষি-পর্বত]।
৫। সৎকর্মের নেতা হে আমার মন! তুমি সত্ত্বভাব-জনিত পরমানন্দদায়ক মোক্ষপ্রাপক বিশুদ্ধ জ্ঞান হৃদয়ে সঞ্চয় কর। সত্ত্ব ইত্যাদির দ্বারা চিরবর্ধনশীল আত্মশক্তিসম্পন্ন সাধকই কেবল ভগবানের পূজায় সমর্থ হন। (ভাব এই যে, –মোক্ষলাভের জন্য আমি যেন ভগবানের আরাধনা করি)। [যিনি মোক্ষলাভে অভিলাষী তিনিই ভগবানের উপাসনায় রত হন। তিনি সদাবৃধঃসত্ত্বাদির দ্বারা চিরবর্ধনশীল। ভগবানের উপাসক-সৎকর্মে রত সাধক–ক্রমশই–উচ্চ থেকে উচ্চতর সাধন রাজ্যে প্রবেশ করেন, অবশেষে ভগবৎ-পদে আত্মলীন হয়ে যান; অর্থাৎ মোক্ষলাভ করেন]। [এর গেয়গানের নাম–সুরাধসে দ্বে]।
৬। হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ! বুলৈশ্বর্যাধিপতি দেবতাকে প্রাপ্তির জন্য সত্ত্বভাব হৃদয়ে উপজন। কর; তিনি সেই অমৃতোপম শুদ্ধসত্ত্বভাব গ্রহণ করুন এবং কৃপা করে তোমাদের পরমধন প্রকৃষ্টরূপে প্রদান করুন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবান্ কৃপা করে আমাকে পরমধন মোক্ষ প্রদান করুন)। [মোক্ষ বা মুক্তি লাভের অর্থই স্বরূপ অবস্থায় ফিরে আসা। একেই বলে স্বপদে প্রতিষ্ঠিত হওয়া। যে শুদ্ধসত্ত্বভাব থেকে মানুষ এসেছে, সেই পূর্বভাবে ফিরে যাওয়াকেই বলে মুক্তি–মোক্ষ-মায়া মোহ অজ্ঞানতা ইত্যাদি সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে বুদ্ধপূর্ণ অবস্থায় প্রত্যাবর্তন বা ঈশ্বরে লীন হওয়া]। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানের নাম–মারুতং। এটির ঋষি–বিশ্বমনা বৈয়শ্ব]।
৭। সৎকর্মে মিত্রস্বরূপ হে চিত্তবৃত্তিনিবহ! তোমরা একাগ্রভাবে আগমন কর–সৎকর্মে উদ্বোধিত হও। অদ্বিতীয় যে ভগবান্ রিপুশত্রুদের বিনাশ করেন (অথবা আত্ম-উৎকর্ষ-সম্পন্ন সাধককে উদ্ধার করেন), সকলের আরাধনীয়, সকল সৎকর্মে নেতৃস্থানীয়, পরমৈশ্বর্যশালী সেই ভগবানকে আমরা যেন পূজা করি। (ভাব এই যে, আমি যেন একাগ্রভাবে ভগবৎপরায়ণ হই)। [চিত্তবৃত্তিগুলি যখন সৎকর্মের প্রতি অনুরক্ত হয়, তখন তারাই মানুষের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ বন্ধু। মানুষকে মোক্ষের পথে নিয়ে। যাওয়ার পক্ষে সৎ-ভাবপূর্ণ চিত্তবৃত্তি ভিন্ন অন্য বন্ধু সংসারে আর নেই। তাই তো তারা সখায়ঃ]। [এর গেয়গানের নাম–বৈশ্বমনসং]।
৮। হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ! মেধাবী মহত্ত্বপূর্ণ বা মহত্ত্বসম্পন্ন সর্বজ্ঞ সকলের স্তবনীয় পরমব্রহ্ম বলৈশ্বর্যাধিপতি দেবতাকে প্রাপ্তির জন্য সৎ-ভাব সৎকর্ম-সহযুত প্রার্থনা-মন্ত্র উচ্চারণ কর। [ভাব এই যে, –আমি যেন পরমব্রহ্মের অনুসারী হই]। [এর গেয়গানের নাম–সৌমিত্রাণি ত্রীণি]।
৯। সকল জগতের পতি, না-প্রতিশব্দরহিত, অভীষ্টপূরক, অদ্বিতীয় লোকহিতসাধক যে ভগবান্ ইন্দ্রদেব, তিনি এই মরণধর্মশীল উপাসককে শীঘ্রই ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষরূপ ধন বিশেষভাবে প্রদান করেন। (ভাব এই যে, –সকলের অভীষ্টপূরক ভগবান্ উপাসককে শীঘ্রই পরিত্রাণ করে থাকেন)। [প্রচলিত বঙ্গানুবাদে ইন্দ্রকে কেবলমাত্র হব্যদাতা ঋত্বিককে অথবা হব্যদাতা যজমানকে ধন প্রদানকারী রূপে বর্ণনা করা হয়েছে এবং শেষে আবার তাকে জগতের প্রভু বা সমস্ত জগতের নির্বিরোধী স্বামী বলা হয়েছে। জগৎ-প্রভু কি এমন পক্ষপাতপূর্ণ হতে পারেন?]। [এই গানের ঋষি-গোতম। গেয়গানের নাম–ত্রেকুভানি ত্ৰীণি]।
১০। রিপুনাশে বজ্রের ন্যায় কঠোরস্বভাব, সর্বলোকের নেতৃস্থানীয় বলৈশ্বর্যাধিপতি পরমব্রহ্মের উদ্দেশে আমরা সর্বতোভাবে স্তোত্র উচ্চারণ করি। (ভাবার্থ-ভগবানকে প্রাপ্তির জন্য আমরা প্রকৃষ্টভাবে প্রার্থনা করি)। সৎকর্মে মিত্রস্বরূপ হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ! তোমরাও সেই দেবতাকে প্রকৃষ্টরূপে আরাধনা কর। (ভাব এই যে, আমি যেন সকলরকমে ভগবানকে আরাধনা করি)। [তিনি রিপুনাশক। দেবতার কঠোরতার বিকাশ হয়–রিপুদলনে, পাপের উচ্ছেদসাধনে। সাধকের প্রতি তিনি যেমন কৃপাপরায়ণ, পাপের বিনাশ কল্পে তেমনি তিনি বজ্রকঠোর। তিনি বজ্ৰাদপি কঠোরাণি মৃদুনি কুসুমাদপি–একদিকে মাতার স্নেহ, অপরদিকে রুদ্রের ভীষণ সংহারমূর্তি। মন্ত্রে সেই অপূর্ব রুদ্রমূর্তিরই পরিচয় রয়েদ্বে]। [এটির ঋষি–বিশ্বমনা। এর গেয়গানের নাম–ঔক্ষ্ণৌ নিয়ানানিব্রীণি]।
.
পঞ্চমী দশতি
ছন্দ আর্চিক। কৌথুমী শাখা। ঐন্দ্র পর্ব (তৃতীয়)। চতুর্থ অধ্যায়।
দেবতা ১-৪।৮ ইন্দ্র, ৫।৭ আদিত্যগণ, ৬ অগ্নি৷
ছন্দ উষ্ণিক, ৮ বিরাট উষ্ণিক্
ঋষি ১ প্রগাথ ঘৌর কাণ্ব, ২ ভরদ্বাজ বার্হস্পত্য, ৩ নৃমেধ আঙ্গিরস, ৪ পর্বত কাণ্ব, ৫।৭ ইরিম্বিঠি কাণ্ব, ৬ বিশ্বমনা বৈয়শ্ব, ৮ বসিষ্ঠ মৈত্রাবরুণি।
গৃণে তদিন্দ্র তে শব উপমাং দেবতাতয়ে! যদ্ধংসি বত্রমোজসা শচীপতে৷৷ ১৷ যস্য ত্যচ্ছম্বরং মদে দিবোদাসায় রন্ধয়। অয়ং স সোম ইন্দ্র তে সুতঃ পিব৷৷ ২ এন্দ্র নো গধি প্রিয় সত্ৰাজিদগোহ। গিরির্ন বিশ্বতঃ পৃথুঃ পতির্দিবঃ ৷৷ ৩৷৷ য ইন্দ্র সোমপাতমো মদঃ শবিষ্ঠ, চেততি। .. যেনা হংসি ন্যাত্ৰিণং তমীমহে৷৷ ৪৷৷ তুচে তুনায় তৎ সু নো দ্রাঘীয় আযুজী বসে। আদিত্যাসঃ সুমহসঃ কৃণোতন৷৷ ৫৷৷ বেঙ্খ হি নিঋতীনাং বজ্রহস্ত পরিবৃজম্। অহরহঃ শুল্কঃ পরিপদামিব৷৷ ৬৷৷ অপামীবামপ ধিমপ সেধত দুর্মতি। আদিত্যাসো যুমোতনা নো অংহসঃ ৭৷৷ পিবা সোমমিন্দ্র মন্তু ত্বা যং তে সুষাব হ্যশ্বাদ্রিঃ। সোতূর্বাহুভ্যাং সুযতো নাবা৷৷ ৮৷৷
মন্ত্ৰার্থ— ১। সকল সৎকর্মের নেতা পরমৈশ্বর্যশালী হে ভগবন! আপনার বলেব অন্ত নেই। (ভাবার্থ-ভগবান্ শ্রেষ্ঠবলসম্পন্ন, সকল শক্তির আধারভূত)। অপিচ, আপনি বলের দ্বারা সৎ ভাবের বিনাশক অজ্ঞানতারূপ শত্রুকে বিনাশ করেন। যেহেতু আপনি সর্বলের আধার, সেই জন্য সৎকর্ম-সাধনের জন্য আপনাকে স্তুতি করি। (ভাব এই যে, –হে ভগবান, আপনি শক্তি-স্বরূপ; আমাকে শনাশের সামর্থ্য প্রদান করুন; সকর্মে নিয়োজিত করে আমাকে উদ্ধার করুন)। [এখানে সাধক-গায়ক পাপ-কবল থেকে রক্ষা করবার জন্য প্রার্থনা না করে নিজে শক্তিলাভের জন্য প্রার্থনা করছেন]। [এর গেয়গানের নাম–প্রযন্বৎ, আক্ষারম এবং প্রযন্বৎ]।
২। পরমৈশ্বর্যশালিন্ হে ভগবন! দেবভাবসম্পন্ন জনের মোক্ষপ্রাপ্তির জন্য অপিচ, সৎ-ভাবজনিত পরমানন্দ-দানের উদ্দেশ্যে আপনি শুদ্ধসত্ত্বনাশক সৎ-ভাবের রোধক অজ্ঞানতারূপ শত্রুকে বিনাশ করেন; আমাদের হৃদয়-নিহিত এমন সব শুদ্ধসত্ত্ব অভিযুত-উৎকর্ষ প্রাপ্ত হয়েছে; আপনি (তা) গ্রহণ করুন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, -হে ভগবন! আমাদের হৃদয়ে নিহিত বা সুপ্ত শুদ্ধসত্ত্ব গ্রহণ করে আমাদের মোক্ষ প্রদান করুন)। [মানুষের হৃদয়ের মধ্যে মোক্ষলাভের উপায়ভূত সমস্ত সৎকর্মের, সৎ-চিন্তার ও সৎ-ভাবের বীজ নিহিত আছে। অজ্ঞানতা, মোহ, প্রভৃতির দ্বারা তা যতক্ষণ পর্যন্ত আবৃত থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষ মোক্ষলাভের পথে অগ্রসর হতে পারে না। জ্ঞানের উৎকর্ষের দ্বারাই সেই আবরণ উন্মোচিত হতে পারে। বিশুদ্ধ সত্ত্বভাবের উন্মেষ হলে মোক্ষলাভের পথে অগ্রসর হওয়া যায়]। [এর গেয়গানের নাম–দৈবোদাসানি চত্বারি]।
৩। সকলের প্রিয়তম, রিপুজয়কারী, অপরাজেয়, পরমৈশ্বর্যশালি হে ভগবন! আপনি পর্বতের ন্যায় স্থির অটল, অপিচ, বিশ্বব্যাপী সর্বলোকের অধিপতি হন। আপনি আমাদের হৃদয়ে আগমন করুন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, –হে ভগবন! কৃপা করে আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন)। [এর গেয়গানের নাম–সম্বৰ্ত্তে দ্বে]।
৪। সর্বশক্তিমান্ পরমৈশ্বর্যশালিন্ হে ভগবন! আপনি শুদ্ধসত্ত্বের গ্রহীতা হন; (আপনার অনুগ্রহে) হৃদয়ে যে সৎ-ভাব-জনিত পরমানন্দ উপজিত হয়; অপিচ, যে শুদ্ধসত্ত্বজনিত পরমানন্দের প্রভাবে (অথবা, শুদ্ধসত্ত্ব গ্রহণ করে) আপনি কাম ইত্যাদি অন্তঃশত্রুকে বিনাশ করেন; আমরা সেই সৎ ভাব-জনিত পরমানন্দ লাভের প্রার্থনা করি। (প্রার্থনাটির ভাব এই যে, –সেই ভগবান্ আমাদের শুদ্ধসত্ত্বজনিত পরমানন্দ (মোক্ষ) প্রদান করুন)। [ভগবানই একমাত্র আনন্দধারা, আনন্দদাতা–এই সত্য উপলব্ধি করেই সাধক গায়ক সেই অনন্ত অবিনশ্বর আনন্দের জন্য প্রার্থনা করছেন]। [গেয়গানের নাম—আক্ষারম্]।
৫। দীপ্তিমান্ স্বপ্ৰকাশ হে দেবগণ! সৎকর্মের সম্পাদনের জন্য ও পরমধন-প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে (অথবা, আমাদের পুত্রপৌত্র ইত্যাদির এবং আমাদের অনন্তজীবন-লাভের জন্য)। সৎকর্ম-সাধনশীল, শ্রেষ্ঠ জীবন প্রদান করুন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবান্ যেন আমাদের সৎকর্ম সাধনের সামর্থ্য প্রদান করেন)। [মন্ত্রটির মধ্যে সাধক-গায়ক শুধু নিজেরই জন্য অনন্তজীবনের কামনা করছেন না, পুত্রপৌত্র ইত্যাদি সকলেই যাতে সেই পরম সম্পদ লাভের অধিকারী হতে পারে, তার জন্যও প্রার্থনা করছেন। এটাই স্বাভাবিক। সৎ-মানুষ চান যে, তাঁর সন্তান-সন্ততি, আত্মীয়স্বজন সকলেই ভগবৎ পরায়ণ হোক; সকলেই সেই পরমধন প্রাপ্ত হোক]। [এর গেয়গানের নাম–দীর্ঘায়ুষ্যং]।
৬। পাপনাশে বজ্রকঠোর হস্ত হে ভগবন! সদাকাল সূর্য যেমন পক্ষীদের ইতস্ততঃ পরিচালিত
করেন; অথবা, সূর্যের উদয় হলে পক্ষিগণ যেমন ইতস্ততঃ গমন করে, তেমনই আপনিই কেবল অন্তঃশত্রুদের পরিবর্জন অর্থাৎ বিনাশের উপায় অবগত আছেন। (ভাব এই যে, ভগবান্ রিপুনাশক সৎ-ভাবসঞ্চারক হন)। [আলোক ও অন্ধকারের মতো দেবত্ব ও পশুত্ব এক সময়ে একই স্থান। অধিকার করতে পারে না, অর্থাৎ একাধারে থাকতে পারে না। দেবত্বের আবির্ভাব হলেই পশুত্ব পলায়ন করে। তাই জ্ঞানস্বরূপ ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা–তার আবির্ভাবে আমার অজ্ঞানতা দূর হোক। সেই পরমানন্দের একমাত্র অধিস্বামীর কৃপায় আমি যেন পরমানন্দ লাভে সমর্থ হই]। [এর গেয়গানের নাম–শুন্ধ্যুঃ সাম]।
৭। জ্যোতিস্বরূপ হে দেবভাবসমূহ! আপনারা আমাদের পাপপ্রবৃত্তি নিবারণ করুন; রিপুগণকে বিনাশ করুন; অসৎবৃত্তি দূর করুন; আমাদের পাপকবল হতে উদ্ধার করুন। (ভার এই যে, হে ভগবন! সৎ-বৃত্তির সঞ্চার করে আমাদের সর্বতোভাবে রক্ষা করুন)। [এই গেয়গানের নাম অপামীবং]।
৮। পরমৈশ্বর্যশালি হে দেব! আমাদের হৃদয়স্থিত সত্ত্বভাব গ্রহণ করুন; আপনাকে প্রাপ্ত হয়ে সেই সত্ত্বভাব আমাদের পরমানন্দ প্রদান করুক; জ্ঞানভক্তিদাতা হে দেব! বল্পা দ্বারা যেমন অশ্ব সংযত হয়, তেমনই সাধকের জ্ঞানভক্তি দ্বারা সংযত কঠোর তপ আপনাকে প্রাপ্তির জন্য এই সত্ত্বভাব উৎপাদন করে। (প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! আমাদের হৃদয়ে সত্ত্বভাব উৎপাদনপূর্বক কৃপা করে আমাদের প্রাপ্ত হোন)। [ভগবানকে লাভ করবার উপায় তপস্যা। জ্ঞানভক্তি-সহযুত যে সৎকর্ম, তা সাধকের হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্বভাব উৎপাদন করে। হৃদয়ে সত্ত্বভাব উপজিত হলে সাধক শুদ্ধসত্ত্বময় ভগবানের সামীপ্য লাভ করেন, অর্থাৎ সৎকর্মের সাহায্যেই সেই সত্ত্বভাবের বিকাশ হয়। শুধু কর্ম করলেই হয় না, তাকে উপযুক্ত পথে পরিচালিত করবার জন্য জ্ঞান চাই। জ্ঞানই কর্মকে, মোক্ষসাধকরূপে পরিণত করতে পারে। আবার যেখানে প্রকৃত জ্ঞান থাকে, সেখানে ভক্তিরও উপস্থিতি অবশ্যম্ভাবী। ভক্তিই মানুষকে সেই পরমপুরুষের প্রতি আকর্ষণ করে। ভক্তিবশেই মানুষ তাঁর চরণে আত্মনিবেদন করে। তাই জ্ঞান ও ভক্তিই সাধককে মোক্ষমার্গ-অনুসারী কর্মে নিয়োজিত করে। ফলতঃ জ্ঞান ভক্তি ও কর্ম তিনের সম্মিলনেই মানুষ মোক্ষলাভ করে–প্রচলিত বঙ্গানুবাদে ইন্দ্রকে সোমপান করতে আহ্বান জানানো হয়েছে। (সোম) যেন তাকে মত্ত করুক এমন প্রার্থনা করা হয়েছে। ইন্দ্রের অশ্বের নাম হরি–এমন সব পাওয়া যায়। [গেয়গানের নাম–সহোদৈর্ঘতমসং]।
.
ষষ্ঠী দশতি
ছন্দ আর্চিক। কৌথুমী শাখা। ঐন্দ্র পর্ব (তৃতীয়)। চতুর্থ অধ্যায়।
দেবতা ইন্দ্র (৩।৬ মরুদগণ) ৷
ছন্দ ককুপ৷
ঋষি ১-৬, ৯।১০ সৌভরি কাণ্ব; ৭।৮ নৃমেধ আজিরস৷৷
অভ্রাতৃব্যো অনা মনাপিরিন্দ্র জনুষা সনাদসি। যুপেদাপিত্ব-মিচ্ছসে। ১। যো ন ইদমিদং পুরা প্র বস্য আনিনায় তমু বঃ স্তষে। সখায় ইন্দ্ৰমূতয়ে। ২৷৷ আ গন্তা মা বিষণ্যত প্রস্থাবানো মাপ স্থাত সমন্যবঃ। দৃঢ়া চিময়িষ্ণবঃ৷ ৩৷ আ যাত্যয়মিন্দবেহশপতে গোপত উর্বরপতে। সোমং সোমপতে পিব৷ ৪৷৷ ত্বয়া হ স্বিদ যুজা বয়ং প্রতি শ্বসন্তং বৃষভ ব্রুবীমহি। সংস্থে জনস্য গোমতঃ ৫৷. গাবশ্চিদ ঘা সমন্যবঃ সজাত্যেন মরুতঃ সন্ধবঃ। রিহতে ককুভো মিথঃ ৷৷৬৷ ত্বং ন ইন্দ্রা ভর ওজো নৃণং শতক্রতো বিচৰ্ষণে। আ বীরং পৃতনাসহ৷৷ ৭৷ অধা হীন্দ্র গির্বণ উপ জ্বা কাম ঈমহে সমৃগহে। উদেব গন্ত উদ্ধভিঃ৷৷ ৮। সীদন্তস্তে বয়ো যথা গোশ্রীতে মধৌ মদিরে বিবক্ষণে। অভি ত্বামিন্দ্র নোনুমঃ ॥ ৯৷৷ বয়মু ত্বামপূর্ব স্তুরং ন কচি ভরন্তোহবস্যবঃ। বজিং চিত্রং হবামহে৷৷ ১০৷
মন্ত্ৰাৰ্থ— ১। পরমৈশ্বর্যশালিন হে দেব! আপনি অজাতশত্রু এবং স্বতন্ত্র হন; আপনি অনাদিকাল ॥ ই হতে স্বতন্ত্র; চিরকাল যে জন রিপুসংগ্রামে আপনাকে আহ্বান করে, তাকে আপনি বন্ধু করেন। (ভাব এই যে, –অজাতশত্রু অনাদি দেব চিরকাল রিপুসংগ্রামে সাধকের সহায় হন)। [সর্বকালেই ভগবান্ স্বতন্ত্র (অনা)। তিনিই জগতের প্রভু। তিনিই জগতের উৎপত্তি, গতি ও স্থিতির মূলকারণ। তিনি অজাতশত্রু (অভ্রাতৃব্যঃ)। তিনি জগৎবন্ধু, সুতরাং কেউই তার শত্রু নয়। তথাপি রিপু সংগ্রামে ভক্ত সাধকের পরিত্রাণের জন্য বা জগতকে পাপের আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য তাকে অগ্রসর হতে হয়। তাই এখানে ব্যক্ত হয়েদ্বে]। [এর গেয়গানের নাম–শাক্বরে দ্বে]।
২। সৎকর্মের মিত্রস্বরূপ হে চিত্তবৃত্তিসমূহ! যে দেবতা নিত্যকাল আমাদের সকলের আকাঙ্ক্ষণীয় পরমধন প্রদান করেন, পাপকবল হতে রক্ষা পাবার জন্য তোমরা সেই পরমৈশ্বর্যশালী দেবতাকেই স্তুতি কর। (ভাব এই যে, –পাপের কবল থেকে উদ্ধার পাবার জন্য আমি যেন পরমধনদাতা দেবতার আরাধনা করি)। [যিনি মানুষকে পরমধন–পরাশান্তি দান করেন, তিনিই তাকে পাপের আক্রমণ থেকে রক্ষা করে মোক্ষমার্গে পরিচালিত করেন। তিনি যদি তার মঙ্গলময় হস্ত প্রসারিত না করেন, তাহলে মানুষের সাধ্য নেই যে, ভীষণ শক্তিশালী রিপুদের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করে]। [এর গেয়গানের নাম–বৃহৎ কম্]।
৩। রিপুনাশক জ্যোতির্ময় হে ভগবন! আমাদের আপনারা প্রাপ্ত হোন; আপনারা আগমন করে আমাদের রিপুকবল হতে রক্ষা করুন; কঠোর রিপুদেরও শাসনকারী আপনারা আমাদের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হোন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, হে দেব! কৃপাপূর্বক হৃদয়ে আবির্ভূত হয়ে আমাদের রিপুসমূহ বিনাশ করুন)। [প্রচলিত ব্যাখ্যায় প্রস্থাবানঃ পদে শত্ৰুণামুপরি যুদ্ধার্থ গন্তারঃ বা রিপুনাশকাঃ না ধরে প্রতারঃ প্রগন্তারঃ মরুতঃ অর্থ ধরা হয়েছে। ফলে, প্রস্থানশীল মরুৎগণকে উদ্দেশ করা হয়েছে। এটি ভ্রান্ত ব্যাখ্যা]। [এর গেয়গানের নাম-বৃহৎকম্]।
৪। পরাজ্ঞানদাতা, জ্ঞানাধীশ, সকল সৎ-ভাবের অধিপতি হে দেব! সত্ত্বভার গ্রহণের জন্য আমাদের। হৃদয়ে আবির্ভূত হোন; সত্ত্বভাবদাতা হে দেব! আপনার প্রদত্ত আমাদের হৃদয়স্থিত সত্ত্বভাব গ্রহণ করুন, অর্থাৎ আমাদের সাথে মিলিত হোন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, হে দেব! কৃপা করে আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন, আমাদের প্রাপ্ত হোন)। [সোমসত্ত্বভাব। হৃদয়ের এই সত্ত্বভাবই ভগবানের সাথে মিলিত হবার যোগসূত্র। তিনিই এই সত্ত্বভাব মানুষকে দিয়েছেন। এই সত্ত্বভাবের সাহায্যেই মানুষ তাকে লাভ করে এবং মিলিত হতে আহ্বান জানায়। কিন্তু তিনি যখন আসেন, তখন মানুষ তাকে কি দেবে? মানুষের নিজস্ব তো কিছুই নেই। তাই সে তাকে হৃদয়ের ঐ শুদ্ধসত্ত্বভাবই উৎসর্গ করবে]। [এর গেয়গানের নাম–সৈয়বসানি ত্রীণি]।
৫। অভিমতফলবর্ষক হে দেব! রিপুগণের সংগ্রামে আপনার কৃপায় প্রার্থনাকারী আমরা জ্ঞানলাভ করে রিপুদের নিশ্চয়ই যেন পরাজয় করতে সমর্থ হই। (ভাব এই যে, –হে দেব! আমরা জ্ঞানলাভ করে যেন রিপুজয়ী হই)। [এই মন্ত্রেও সাধক-গায়ক প্রার্থনার মাঝে আত্মশক্তিলাভের সুর ধ্বনিত করেছেন। মানুষের অন্তরস্থিত যে শক্তিবীজ আছে, তিনি তাকে ফুটিয়ে তুলতে সাহায্য করুন, তখন মানুষ নিজের সেই শক্তিতেই সকল রিপুশত্রুকে বিনাশ করতে সমর্থ হবে]। [গেয়গানের নাম– ধেনুসাম]।
৬। জ্যোতির্ময় বিবেকরূপী হে দেবগণ! জ্ঞানরশ্মিসমূহ আপনাদের হতে উৎপন্ন হেতু, বন্ধুভূত হয়ে সকল উপাসকদের নিশ্চিতভাবে এবং দৃঢ়ভাবে প্রাপ্ত হয়। (ভাব এই যে, বিবেকশীল ব্যক্তিতে এ জ্ঞান নিশ্চিতভাবে আপনা-আপনিই উৎপন্ন হয়)। [বিবেক, মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের প্রতিনিধি। মানুষ যদি নিজের অসৎকর্মের দ্বারা নিজেকে অধঃপাতিত না করে, যদি বিবেকের উপর পাপের মলিন ছাপ না পড়ে, তবে একমাত্র বিবেকের পরিচালনাতেই মানুষ মোক্ষপথে অগ্রসর হতে পারে। প্রচলিত ব্যাখ্যায় মরুৎ অর্থে বিবেকরূপী দেবতা না ধরে বিভ্রাট ঘটানো হয়েছে। ঐ বঙ্গানুবাদে আছে–হে সমান ক্রোধশীল মরুঙ্গণ! গো-সমূহ একজাতি বলে সমান বন্ধুযুক্ত হয়ে চারিদিকে পরস্পর লেহন করছে। –এ কি বেদমন্ত্র? গাবঃ অর্থে জ্ঞানরশ্মি না-ধরে গরু ধরায় প্রচলিত বহু মন্ত্রের ব্যাখ্যায় এমন বিপর্যয় দেখা যায়]। [গেয়গানের নাম—সবেশীয়ম্]।
৭। সর্বশক্তিমন্ সর্বজ্ঞ পরমৈশ্বর্যশালিন্ হে দেব! আপনি আমাদের আত্মশক্তি এবং পরমধন প্রদান করুন; বীর্যবন্ত, রিপুগণের অভিভন্বিতা আপনাকে যেন আমরা পূজা করতে পারি। (প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! আমাদের পরমধন পরাজ্ঞান প্রদান করুন)। [সীমার মধ্যে থেকে অসীমের অনুভবই প্রার্থনার চরম-লক্ষ্য। সুতরাং নিজের শক্তিবলে মুক্তিলাভ করলেও বৃহৎ ও ক্ষুদ্র আমির মধ্যে যে পৰ্য্যন্ত ভেদ থাকে, শেষ পর্যন্ত প্রার্থনার প্রয়োজনও আছে। [এর গেয়গানের নাম–আভরে দ্বে]।
৮। আরাধনীয় পরমৈশ্বর্যশালিন্ হে দেব! সম্প্রতি পরমধনের জন্য আপনার নিকট প্রার্থনা করছি; সত্ত্বভাবযুক্ত সাধক যেমন সত্ত্বভাব-প্রবাহের দ্বারা আপনাকে প্রাপ্ত হয়, তেমনই আমরা আপনাকে যেন প্রাপ্ত হই। (ভাব এই যে, আমরা যেন ভগবানকে লাভ করতে পারি)। [ভগবান্ বিশুদ্ধভাব ও বিশুদ্ধজ্ঞানের আধার। তাই মুক্তিকামী সাধক নিজেকে সবরকম অবিশুদ্ধ, অসৎ কর্মের ও চিন্তার সংস্পর্শ থেকে মুক্ত রাখতে চেষ্টা করেন। যে ভাবধারার সাহায্যে সাধক শুদ্ধং অপাপবিদ্ধং সেই পরমেশ্বরের চরণে পৌঁছাতে পারেন, সেই ভাবধারা লাভের জন্য প্রার্থনা এই মন্ত্রে রয়েছে। [এর গেয়গানের নাম–ঐবিরাণি ত্ৰীণি]।
৯। পরমেশ্বর্যশালি হে দেব! সৎকর্মের সাধক যেমন আপনাকে প্রাপ্ত হন, তেমনই আপনার প্রদত্ত জ্ঞানযুক্ত পরমানন্দদায়ক মোক্ষপ্রাপক সত্ত্বভাবে অবস্থিত হয়ে থাকেন; আমরা যেন আপনাকে প্রাপ্ত হই। (ভাব এই যে, হে দেব! বিশুদ্ধ সত্ত্বভাবের দ্বারা আমরা যেন আপনাকে প্রাপ্ত হতে পারি)। [প্রচলিত বঙ্গানুবাদ–হে ইন্দ্র! গব্যমিশ্রিত মদকর স্বর্গপ্রাপ্তির হেতুস্বরূপ তোমার সোমে (মদ্যে) পক্ষীসমূহের ন্যায় নিষগ্ন হয়ে আমরা তোমারই স্তব করছি। –সোম (মদ্য)-এর বিশেষণগুলিও অপব্যাখ্যাত। –মধৌ অর্থে সত্ত্বভাবে, অমৃতে; মদিরে অর্থে পরমানন্দদায়কে; গোশ্ৰীতে অর্থে জ্ঞানযুক্তে এমন বোঝাই সঙ্গত]। [গেয়গানের নাম–সীদান্তীয়ে দ্বে]।
১০। রক্ষাস্ত্রধারী আদিভূত হে দেব! সাধক যেমন ভগবান্ আপনাকে আহ্বান করেন, তেমন রিপুসংগ্রামে প্রবৃত্ত হয়ে আমরাও যেন বিচিত্র-শক্তিযুক্ত আপনাকে রিপুর কবল হতে রক্ষার জন্য আরাধনা করি। (ভাব এই যে, –আমরা যেন ভগবৎ-অনুসারী হই)। [প্রচলিত ব্যাখ্যা ও বঙ্গানুবাদ বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে। ভাষ্যকার সায়ণের ব্যাখ্যাও সন্তোষজনক হয়নি। –সে সবই আমাদের মন্ত্রার্থে পরিত্যাগ করা হয়েছে। [গেয়গানের নাম–পকথসাম ও সৌভরম]।
.
সপ্তমী দশতি
ছন্দ আর্চিক। কৌথুমী শাখা। ঐন্দ্র পর্ব (তৃতীয়)। চতুর্থ অধ্যায়।
দেবতা ১-৮ ইন্দ্র, ৯ বিশ্বদেবগণ, ১০ অশ্বিদ্বয়৷৷
ছন্দ পঙক্তি৷
ঋষি ১-৮ গোতম (বা সম্মদ) রাহুগণ, ৯ ত্ৰিত আপ্ত্য অথবা কুত্স আঙ্গিরস, ১০ অবস্যু আত্রেয়।
স্বাদোরিখা বিষুবতো মধ্যেঃ পিবন্তি গৌর্যঃ। যা ইন্দ্রেণ সোবরীবৃষ্ণা মদন্তি শোভথা বস্বীর স্বরাজ্য৷৷ ১৷৷ ইখা হি সোম ইন্মদো ব্ৰহ্ম চকার বর্ধন। শবিষ্ঠ বজ্বিন্নেজসা পৃতিব্যা নিঃ শশা অহিমচন্ননু স্বরাজ্য৷ ২ ইন্দ্রো মদায় বাবৃধে শবসে বৃত্ৰহা নৃভিঃ। তমিন্মহৎজিতিমর্ভে হবামহে স বাজেযু প্ৰ নোহবিষৎ৷৩৷৷ ইন্দ্র তুভ্যমিদদ্রিবোহনুত্তং বজি বীর্য যদ্ধ ত্যং মায়িনং। মৃগং তব তন্ময়য়া বধীরচন্ননু স্বরাজ্য৷ ৪৷৷ প্ৰেহ্যভীহি ধৃষ্ণুহি ন তে বক্রোনি সংসতে। ইন্দ্র নৃং হি তে শবো হননা বৃত্ৰং জয়া অপোর্চন্ননু স্বরাজ্য৷ ৫৷৷ যদুদীরত আজয়ো ধৃষ্ণবে ধীয়তে ধীয়তে ধন। যুঙ্ক্ষা মদ্যুতা হরী কং হনঃ কং বসৌ দধোহল্ম ইন্দ্র বসৌ দধঃ ॥৬। অক্ষমীমদন্ত হ্যব প্রিয়া অধূষত। অন্তোষত স্বভানবো বিপ্রা নবিষ্ঠয়া মতী যোজা দ্বিন্দ্ৰ তে হরী৷৷ ৭ উপোষু শৃণুহী গিরো মঘব মা তথা ইব। কদা নঃ সূতাবতঃ কর ইদৰ্থয়াস ইদ যোজা দ্বিন্দ্ৰ তে হরী৷৷ ৮৷৷ চন্দ্রমা অপস্বাংস্তরা সুপর্ণো ধাবতে দিবি। ন বো হিরণ্যনেময়ঃ পদং বিন্দন্তি বিদ্যুতো বিত্তং মে অস্য রোদসী৷ ৯৷৷ প্রতি প্রিয়তমং রথং বৃষণং বসুবাহন। স্তোতা বামখিনাবৃষিঃ স্তোমেভির্ভূষতি প্রতি মাধ্বী মম শ্রুতংহব৷ ১০৷
মন্ত্রার্থ— ১। শুদ্ধসত্ত্বসমন্বিত মনোবৃত্তিসমূহ, অর্থাৎ সাধুগণ, ভগবানের অথবা সৎকর্মের সাথে মিলিত হয়ে, স্বাদুভূত মধুরসের সারস্বরূপ অমৃতকে পান করেন। (ভাব এই যে, –জ্ঞানী সাধকগণ ও নিজেদের কর্মের দ্বারা নিরন্তর পরমানন্দ উপভোগ করেন)। যে সৎবৃত্তিসমূহ অভীষ্টবর্ষক ভগবান ইন্দ্রদেবের সাথে গমনশীল অর্থাৎ নিত্য-সম্মিলিত আছে, সেই সৎবৃত্তিসমূহ ভগবানের সামীপ্যকে লক্ষ্য করে নিবাসকারী অর্থাৎ ভগবৎসামীপ্য প্রদায়ক হয়, এবং উপাসকগণকে শোভনীয় স্থান স্বর্গ– ইত্যাদি পাইয়ে আত্মানন্দ প্রাপ্ত হয়ে থাকে অথবা উপাসকগণকে পরমানন্দ প্রদান করে। (ভাব এই যে, –সৎবৃত্তির প্রভাবে এবং সৎ-জ্ঞানের সহায়ে ভগবানের সান্নিধ্যযুত হয়ে মানুষ পরমানন্দস্থানকে–মোক্ষকে লাভ করেন)। [গেয়গানের নাম–যামং]।
২। বিধিক্রমে অর্থাৎ যথাশাস্ত্র, আনন্দপ্রদ শুদ্ধসত্ত্বে বা সৎকর্মের সম্পাদনে, যখন উপাসক পরিমগ্ন থাকেন, তখন বিধাতা নিশ্চিতই উপাসকের শ্রীবৃদ্ধিসাধন শ্রেয়ঃবিধান করে থাকেন। (ভাব এই যে, সৎকর্মপরায়ণ উপাসকের মঙ্গল ভগবানই বিধান করেন)। অমিত বলশালী শত্রুবিনাশী হে ভগবন। আপনার বলের দ্বারা (আমাদের প্রতি অনুকম্পা প্রকাশের দ্বারা) ইহলোক হতে সর্পপ্রকৃতি স্বভাব রিপুকে (সর্পের ন্যায় হিংসপ্রকৃতির পাপকে) নিরন্তর শাসন করুন–নিঃশেষে বিতাড়িত করুন; এইভাবেই আপনার রাজত্ব অর্থাৎ ভগবনপ্রাধান্য পূজিত হোক–ইহজগতে প্রতিষ্ঠিত হোক। (প্রার্থনার ভাব এই যে, –জগতের জনগণ সৎকর্মের অনুষ্ঠানে, শুদ্ধসত্ত্বের অনুধ্যানে, রত হোক; তার ফলে ভগবান্ সংসার থেকে পাপকে দুর করুন; আর সংসার স্বর্গতুল্য হয়ে উঠুক)। [গেয়গানের নাম–গৃৎসমদস্য মদৌ দ্বৌ]।
৩। অজ্ঞানতানাশক ভগবান্ ইন্দ্রদেব শ্রেষ্ঠ নরগণ কর্তৃক অর্থাৎ সাধকগণ কর্তৃক সম্পূজিত হয়ে সেই সাধকগণের আনন্দবর্ষণের জন্য এবং সেই সাধকগণের বলবৃদ্ধির জন্য আত্মবিস্তার করেন, অর্থাৎ সেই সাধকগণের মধ্যে অধিষ্ঠান করে থাকেন; প্রবল বিষম সংগ্রামসমূহে এবং এই অল্প সংগ্রামে অর্থাৎ আমাদের নিত্য অনুষ্ঠিত পাপকর্মে, সেই ইন্দ্রদেবতাকেই আমাদের রক্ষার জন্য আহ্বান করছি; সেই ইন্দ্রদেব সকলরকম সংগ্রাম সমূহে আমাদের প্রকৃষ্টরূপে রক্ষা করুন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, সাধকেরা নিজেদের কর্মের দ্বারাই ভগবানকে প্রাপ্ত হয়ে থাকেন, কিন্তু এই অসাধু আমাদের উপায় কি হবে? প্রার্থনা–এই প্রবল সংসার-সংগ্রামে সেই ভগবান্ আমাদের রক্ষা করুন)। [গেয়গানের নাম–আভীকে দ্বে, আভীশবে দ্বে, বার্হদিগবাণি দ্বে]।
৪। পাপনাশের নিমিত্ত পাষাণসদৃশ কঠোর, পাপনাশে বজ্রধারী, হে ভগবন ইন্দ্রদেব! শত্রুগণ কর্তৃক অজেয় আপনার যে প্রসিদ্ধ বীর্য আছে, তার দ্বারা সেই মায়াবী কপটচারী পাপকে (অথবা অজ্ঞানতা রূপ অসুরকে) আপনার প্রাধান্য বিস্তারের দ্বারা আপনি বিনাশ করুন; এই রকমে স্বরাজ্য (আপনার রাজত্ব–ভগবৎপ্রাধান্য) ইহজগতে প্রতিষ্ঠিত হোক। (প্রার্থনার ভাব এই যে, –সেই ভগবান্ কঠোর বজ্রের দ্বারা পাপকে ছেদন করুন, তার দ্বারা ইহজগতে স্বরাজ্য প্রতিষ্ঠিত হোক)। [ভগবানের কৃপাই সবরকম পাপনাশের মূলীভূত কারণ। এই কৃপা জ্ঞানরূপে কৃপার্থীর উপরে বর্ষিত হয়। তার দ্বারাই অন্তর ও বাইরের শত্রুর কবল থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়; সেই পরিত্রাণ-লাভেরই নামান্তর–স্বরাজ লাভ)। [এর গেয়গানের নাম–স্বরাজ্যং]।
৫। হে আমার মন (অথবা হে আমার আত্মা)! তুমি প্রকৃষ্টভাবে গমন কর, অর্থাৎ প্রকৃষ্ট কর্মের সাথে ভগবানের অভিমুখী হও; এবং অভিমুখ্যে তাঁকে প্রাপ্ত হও, অর্থাৎ ভগবৎ-সামীপ্য লাভ কর; আর রিপুবর্গকে বা শত্রুগণকে অভিভব কর, অর্থাৎ ভগবানের প্রভাবে রিপুবর্গের প্রভাব খর্ব হোক; তোমার রক্ষণের জন্য ভগবানের নিকট হতে এসে শত্রুনাশক আয়ুধ যেন শত্রুগণ কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত তা না হয়, অর্থাৎ শত্রনাশে অপ্রতিহতগতি হোক। (ভাব এই যে, ভগবানের প্রতি অনুরাগের দ্বারা এ আমাদের উচ্চগতি প্রাপ্তি হোক, এবং সে পথের সকলরকম বাধা অপসৃত হোক)। হে ভগবন ইন্দ্রদেব! এর আপনার বল আমাদের অভিভাবক হোক, অর্থাৎ শবের ন্যায় যে আমরা, সেই আমাদের মধ্যে বিকসিত ও হয়ে আপনার শক্তি প্রতিষ্ঠান্বিতা হোক; তার দ্বারা অজ্ঞানতারূপ শত্রুকে হনন করুন এবং আমাদের শুদ্ধসত্ত্বকে আপনি গ্রহণ করুন, অথবা আপনার করুণাধারাসমূহকে ইহজগতে প্রেরণ করুন, বর্ষণ। করুন; আর এইরকমে স্বরাজ্য (আপনার রাজত্বভগবৎ-মহিমা) জগতে প্রতিষ্ঠিত হোক। (প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! আমাদের মধ্যে আপনার শক্তির উন্মেষণ হোক; তার দ্বারা রিপুগণ সংযত হোক, এবং শুদ্ধসত্ত্বের সাথে স্বরাজ্য প্রতিষ্ঠিত হোক)। [মন্ত্রটি প্রকৃতপক্ষে মনঃসম্বোধনে প্রযুক্ত হওয়ায় তে পদের প্রতিবাক্যে তুভ্যং বা তব রক্ষণায় ভাব গৃহীত হয়েছে। দ্বিতীয় অংশের শবঃ পদে যে বল অর্থ গৃহীত হয়েছে, তার মর্ম—মৃতদেহে শক্তিসঞ্চয়। অপঃ পদে–শুদ্ধসত্ত্বের প্রবাহ এবং বৃত্রং পদে অজ্ঞানতা-রূপ-শত্রু অর্থই সঙ্গতিপূর্ণ। [গেয়গানের নাম—সবেশীয়ম]।
৬। যখন সংগ্রাম অর্থ সৎ ও অসৎ-বৃত্তির দ্বন্দ্ব উপস্থিত হয়, তখন শত্রুধর্ষণকারীকে অর্থাৎ রিপুদমন-সমর্থ জনকে ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষরূপ ধন ভগবান্ কর্তৃক প্রদত্ত হয়। হে ভগবন! শত্রুগণের গর্বের খর্বকারী অর্থাৎ রিপুনাশক জ্ঞানভক্তি-রূপ আপনার বাহকদ্বয়কে আমাদের হৃদয়ের মধ্যে সংযোজন করুন; তাদের যোজনা করে কোনও শত্রুকে নাশ করুন, কোনও শত্রুকে বা ধনে প্রতিষ্ঠিত রাখুন হে ভগবন ইন্দ্রদেব! এই উপাসক আমাদের পরমার্থ রূপ ধনে স্থাপিত অর্থাৎ সম্বন্ধযুত করুন। (ভাব এই যে, আমরা যখন রিপুদমনে প্রবৃত্ত হই, জয়শ্রী তখন আমাদের অধিগত হয়; হে ভগবন! আমাদের মধ্যে জ্ঞানভক্তির সমাবেশ ঘটিয়ে আমাদের জয়শ্রীযুক্ত অর্থাৎ পরমধনের অধিকারী প্রার্থনার মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে যেন বৈপরীত্য বা ঈশ্বরের একদেশিকতার পরিচয় পরিব্যক্ত হয়েছে। আসলে, এখানে বুঝতে হবে, যে রিপু আমাদের অনিষ্টসাধক, তারাই আবার সময়ে সময়ে আমাদের মঙ্গল করে থাকে। যেমন, হিংসা। হিংসার বশবর্তী হয়ে মানুষ বহু অপকর্ম সাধন করে। সেইজন্যই হিংসাকে পরিবর্জন ও অহিংসাকে পরিগ্রহণ আবশ্যক। কিন্তু ঐ হিংসাই আবার সৎ-সহযোগে লোকের প্রাণহানি পর্যন্ত ঘটতে পারে। সে অবস্থায় হিংসা অবশ্যই বরণীয়। আত্মরক্ষা অবশ্যই ধর্মনীতির অন্তর্গত। এইভাবে হিংসাও ধর্মের মধ্যে পরিগণিত হলে সেই রিপুকে ভগবান অবশ্যই আশ্রয় দান করেন। রক্ষকরূপী হিংসা যেমন আদরণীয়, মানুষকে বিভ্রান্তকারী হিংসা তেমনই পরিত্যজ্য। তাই প্রার্থনা–কং হনঃ কং বসৌ দধঃ। হৃদয়ে জ্ঞানভক্তি-রূপ বাহকের যোজনা করে দিয়ে ভগবান্ আবশ্যক অনুসারে কোনও রিপুকে বা বিমর্দিত করুন, কোন রিপুকে বা আত্মকার্যে নিয়োজিত রাখুন]। [গেয়গানের নাম—সংবেশীয়ম]।
৭। অমৃত ভক্ষণ করে অর্থাৎ ভগবানের ধ্যানপরায়ণ হয়ে তৃপ্তিপ্রাপ্তি পূর্বক ভগবৎপ্রীতিপরায়ণ উপাসকগণ অথবা ভগবানের প্রিয় সাধকগণ অকম্পিত অবিচলিত রক্ষাকে অর্থাৎ মোক্ষকে নিশ্চয়ই প্রাপ্ত হন; আত্মজ্ঞানসম্পন্ন মেধাবীগণ অর্থাৎ জ্ঞানী সাধকগণ অভিনবত্বসম্পন্ন চিরন্তন স্তুতির দ্বারা .ভগবানকে স্তব করেন-পূজা করেন; অতএব, হে ভগবন ইন্দ্রদেব! আপনার: তৎকর্মসাধক জ্ঞানভক্তিরূপ বাহকদ্বয়কে শীঘ্র আমাদের হৃদয়ে বা কর্মে সংযোজনা করুন–প্রতিষ্ঠাপিত রাখুন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, জ্ঞানভক্তিসমন্বিত কর্মের দ্বারাই ভগবৎপ্রাপ্তিরূপ আনন্দ অধিগত হয়; অতএব হে ভগবন! আমাদের কর্মসমূহকে জ্ঞানভক্তিসমন্বিত করুন)। [মন্ত্রটি শ্রাদ্ধে পিণ্ডদানে ব্যবহৃত হয়। সে দৃষ্টিতে মন্ত্রের তাৎপর্য এই যে, তারা (পিতৃগণ) সূক্ষ্মদেহে অমৃত ভক্ষণ করে ভগবানের ধ্যানে তন্ময় হয়ে তৃপ্তিলাভপূর্বক অবিচলিতভাবে অবস্থিত আছেন; আত্মজ্ঞান সম্পন্ন সেই তাদের (আমাদের পিতৃপুরুষদের) চিরন্তন স্তুতি ভগবানে নিত্য সমর্পিত হচ্ছে, অর্থাৎ তারা শুদ্ধসত্ত্ব অবস্থায় ভগবানের পূজাপরায়ণ হয়েভগবানে লীন হয়ে আছেন। আমাদের কর্ম তাদের অনুসারী হোক–তারা গ্রহণ করুন]। [এর গেয়গানের নাম-যামং]।
৮। পরমৈশ্বর্যশালিন্ হে ভগবন! আমাদের স্তুতিসমূহ অর্থাৎ এই প্রার্থনাসকল, সমীপে প্রাপ্ত হয়ে, সম্যকরূপে শ্রবণ করুন–গ্রহণ করুন; আর বিপরীত বা বিরূপ হবেন না; আমাদের যখন প্রিয়সত্যবাক্যযুক্ত অর্থাৎ আপনার স্তুতিপরায়ণ করেন, তখন আমাদের দ্বারা প্রযুক্ত স্তুতিসমূহ স্বীকার করেন–গ্রহণ করে থাকেন। অতএব, হে ভগবন ইন্দ্রদেব! আপনার জ্ঞানভক্তিরূপ বাহকদ্বয়কে শীঘ্র আমাদের হৃদয়ের মধ্যে বা কর্মসমূহে সংযোজনা করুন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, –জ্ঞানভক্তি সমন্বিত স্তুতির বা কর্মের দ্বারা আমরা যেন আপনার সামীপ্য লাভ করি, তার বিধান করুন)। [এর গেয়গানের নাম–যামং]।
৯। সত্ত্বভাবসমূহের মধ্যে বর্তমান, শোভনগতিশীল অর্থাৎ ঊধ্বর্নয়ন-সমর্থ, স্নিগ্ধজ্ঞানকিরণ, দুলোকে, সত্ত্বনিলয় স্বর্গে, সর্বতোভাবে গমন করে, মনুষ্যগণকে নিয়ে যায়। পরমহিতসাধক জ্যোতিঃস্বরূপ দেবগণ! আপনাদের গমনাগমনের তত্ত্বকে অর্থাৎ আপনাদের প্রাপ্তির উপায়স্বরূপ কর্মকে আমাদের ইন্দ্রিয়সকল অবগত নয়। হে দ্যাবাপৃথিবী অর্থাৎ দ্যুলোক ও ভূলোক সম্বন্ধীয় দেবগণ! আমার অজ্ঞানতারূপ এই দুঃখের কারণকে আপনারা অবগত হোন–অবগত হয়ে এই দুঃখকে দূর করুন। (ভাব এই যে, সৎকর্ম-সহজাত জ্ঞান পরিত্রাণসাধক হয়; এ তত্ত্ব বিমূঢ় ইন্দ্রিয়সকল অনুভব করে না। হে দেবগণ! আপনাদের প্রাপ্তির উপায় আমাদের জানিয়ে দিন, অর্থাৎ আমাদের দেবভাবে ভাবান্বিত করুন)। [বিদ্যুতঃ অর্থে জোতিস্বরূপ দেবগণ]। [এর গেয়গানের নাম–ত্ৰৈতানি ত্ৰীণি এবং সৌপর্ণে দ্বে]।
১০। ভবব্যাধিনাশক হে দেবদ্বয় (নাসত্য ও দ্রস্য নামধারী অশ্বিনীকুমারদ্বয়–আপনারা যারা অন্তর্ব্যাধি কামক্রোধ ইত্যাদি এবং বহির্ব্যাধি রোগ-শোক অসুর ইত্যাদির আক্রমণ হতে জীবকে রক্ষা সৎকর্মরূপ বাহনকে সৎ-ভাব-সমন্বিত স্তোত্রের দ্বারা অলঙ্কৃত করছেন। (ভাবার্থ আত্মজ্ঞানসম্পন্ন সাধক ভগবানের মাহাত্ম্য কীর্তন করছেন এবং সত্যৰ্ম-সাধন-সামর্থ্য লাভের জন্য ভগবানকে আরাধনা করছেন)। অমৃতপ্রদানকারী (জরা-মরণব্যাধি ইত্যাদি থেকে রক্ষাকারী) হে দেবদ্বয়! আপনাদের কর্মে নিযুক্ত আমার প্রার্থনা আপনারা প্রকৃষ্টরূপে গ্রহণ করুন। (ভাব এই যে, –হে ভগবন! কৃপাপূর্বক সৎকর্ম সাধনের সামর্থ্য প্রদান করে আমাকে উদ্ধার করুন)। [ভবব্যাধিনাশক অশ্বিনীকুমারযুগল স্বতন্ত্র কোন দেবতা নন, স্বয়ং ভগবানের বিভূতিধারী দুই দেবতা–অর্থাৎ স্বয়ং ভগবানই ইন্দ্র, চন্দ্র, সূর্য, বরুণ ইত্যাদির মতো তাদেরই রূপ ধারণ করে অবতীর্ণ। রথং, কাঠ ইত্যাদি দ্বারা নির্মিত যান নয়। এটি ভগবানের প্রিয়তমং। সস্বরূপ ভগবানের প্রিয় কি হতে পারে? মানুষের সৎকৰ্মই তার অতিশয় প্রিয়। সুতরাং এই রথ মানুষের সৎকর্ম, সৎ-ভাবনা। এই রথবৃষণং–অভীষ্টবর্ষণশীল; অর্থাৎ এই সৎকর্মের সহায়তাতেই মানুষ সেই ঈশ্বরে মিলিত হতে পারে, মোক্ষলাভ করতে পারে। সে রথ আমাদের বসুবাহনং–পরমধনপ্রাপক]। [গেয়গানের নাম–ত্বৌশম।
.
অষ্টমী দশতি
ছন্দ আর্চিক। কৌথুমী শাখা। ঐন্দ্র পর্ব (তৃতীয়)। চতুর্থ অধ্যায়।
দেবতা ১।২।৭ অগ্নি, ৩ ঊষা, ৪ সোম, ৫।৬ ইন্দ্র, ৮ বিশ্বদেবগণ।
ছন্দ ১-৭ পঙক্তি, ৮ উপরিষ্টাদ বৃহতী৷
ঋষি ১।৭ বসুশ্রুত আত্রেয়, ২।৪ বিমদ ঐন্দ্র, বা প্রাজাপত্য বা বাসুক বসুকৃৎ, ৩ সত্যশ্রবা আত্রেয়, ৫।৬ গোতম রাহুগণ, ৮ অংহোমুক বামদেব্য বা কুল্মল শৈলুষি৷৷
আ তো অগ্ন ইধীমহি দ্যুমন্তং দেবাজর। যুদ্ধ স্যাঁতে পনীয়সী। সমিদদীদয়তি দ্যবীষং স্তোতৃভ্য আ ভর৷৷ ১৷৷ আগ্নিং ন স্ববৃক্তিভিহোতারং ত্বা বৃণীমহে। শীরং পাবকশোচিষং বি বো মদে যজ্ঞেযু স্তীর্ণবহিষং বিবক্ষসে৷৷ ২৷৷ মহে নো অদ্য বোধযোযো রায়ে দিবিত্মতী। যথা চিন্নো অবোধয়ঃ সত্যবসি বায্যে সুজাতে অশ্বসুনৃতে৷৷ ৩৷৷ ভদ্রং নো অপি বাতয় মনো দক্ষমুত ক্রতু। অথা তে সখ্যে অন্ধসসা বি বোমদেরণা গাবো ন যুবসে বিসে৷৷ ৪৷৷ ক্ৰত্বা মহা অনুঘধং ভীম আ বাবৃতে শবঃ। শ্রিয় ঋদ্ধ উপাকযোর্নি শিপ্ৰী হরিবা দধে হস্তয়োর্বজ্রমায়সম্৷৷ ৫৷ স ঘা তং বৃষণং রথমধি তিষ্ঠাতি গোবিদ। যঃ পাত্রং হারিযোজনং পূর্ণমিন্দ্রা চিকেততি যোজা দ্বিন্দ্ৰ তে হরী। ৬। অগ্নি তং মন্যে যো বসুরস্তং যং যন্তি ধেনবঃ। অস্তমন্ত আশাবোহস্তং নিত্যাসসা বাজিন ইষং স্তোতৃভ্য আ ভর৷৷ ৭৷ ন তমংহো ন দূরিতং দেবাশো অষ্ট মর্ত্যম্। সজোষসো যমযমা মিত্রো নয়তি বরুণা অতি দ্বিষঃ। ৮৷৷
মন্ত্ৰার্থ— ১। দীপ্তির আধারভূত জ্ঞানস্বরূপ হে ভগবন। আপনার সেই প্রসিদ্ধ আকাঙক্ষণীয় এ জ্ঞানদ্যুতি কেবল সৎ-ভাব-সমন্বিত হৃদয়েই দীপ্তি প্রাপ্ত হয়; (অর্থাৎ সৎ-ভাব-সম্পন্ন ব্যক্তিই জ্ঞানের এ জ্যোতিঃ লাভ করেন); দীপ্তিমান আত্মপ্রকাশক চিরনবীন আপনার স্বভূত (আত্মস্বরূপ), সেই জ্ঞানকিরণ যেন সর্বতোভাবে হৃদয়ে প্রদীপ্ত হয়। অতএব হে ভগবন! প্রার্থনাকারী আমাদের অভীষ্ট পূরণ করুন। (ভাব এই যে, -হে ভগবন! কৃপা করে আমাদের পরাজ্ঞান প্রদান করুন)। [জ্ঞান নিত্য, জ্ঞান–অনন্ত; তাই জ্ঞান চিরন্তন। জ্ঞানের সীমা নেই, আদি নেই। অন্ত নেই। জ্ঞান সত্য কখনও পুরাতন হতে পারে না। জ্ঞানজ্যোতির কাছে জগতের সমস্ত আলোক হীনপ্রভ। সেই জ্যোতির বলেই মানুষ নিজের স্বরূপ অবস্থা উপলব্ধি করতে পারে। জ্ঞানজ্যোতিই ঈশ্বর; সুতরাং জ্ঞানজ্যোতি লাভই ঈশ্বরপ্রাপ্তি। তাই সেই পরম আকাঙক্ষণীয় জ্ঞানজ্যোতিকে লাভের জন্য আত্ম-উদ্বোধনা এই মন্ত্রের মধ্যে পরিব্যক্ত]। [এর গেয়গানের নাম–সঞ্চয়ে দ্বে]।
২। অভীষ্টলাভের নিমিত্ত দেবভাবসমূহের উৎপাদক অনুষ্ঠিত সৎকর্মসমূহের দ্বারা সকলরকমে জ্ঞানদেবতার আরাধনা করি; আরও হে জ্ঞানদেব (অগ্নি)! সূকর্মসাধনজনিত পরমানন্দ প্রাপ্তির জন্য সর্বব্যাপী পবিত্রতাসাধক সদা সৎকর্মে প্রবর্তক আপনাকে বিশেষভাবে যেন আরাধনা করি। (ভাব এই যে, কৃপা করে আমাদের সৎকর্মের সাধন-সামর্থ্য ও পরাজ্ঞান প্রদান করুন)। [অগ্নি– ভগবানের জ্ঞানরূপ বিভূতি। জ্ঞানের প্রভাবে হৃদয়ে দেবভাবের উদয় হয়। জ্ঞানস্বরূপ ভগবানই কৃপা করে মানুষকে জ্ঞানদান করেন। সেই জ্ঞানে যে আনন্দলাভ হয়, সেটাও তারই বিধান। তবে ঈশ্বর যাকে-তাকে এই পরমধন জ্ঞান দান করেন না। একমাত্র সৎকর্ম সাধনকারী সাধকই তা লাভ করেন। [গেয়গানের নাম-নিষেধম]।
৩। সৎকর্মসমুদ্ভুত সৎকর্মের অধিষ্ঠাত্রি জ্ঞানোন্মোষিকে হে দেবি! দীপ্তিমতি আপনি যেভাবে আত্মশক্তিসম্পন্ন সত্যশীল ব্যক্তিতে নিজেকে নিত্যকাল প্রকাশিত করেন, সেভাবে পরমধনলাভের জন্য আমাদের উদ্বোধিত করুন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, -হে ভগবন! কৃপা করে আমাদের পরাজ্ঞান প্রদান করুন)। [দেবী ঊষা-স্বয়ং সত্যং জ্ঞানং অনন্তং ব্রহ্ম–স্বরূপ ঈশ্বরেরই বিভূতি। ভগবান যেমন সত্য-স্বরূপ, জ্ঞানস্বরূপ-ঊষার মধ্যে সেই বিভূতিতেই তিনি প্রকাশিত]। [গেয়গানের নাম– সত্যশ্রবসশ্ব বায়াস্য সাম্]।
৪। হে দেব! আপনি মহান্ হন; আমাদের প্রকৃষ্ট সৎকর্মসাধন-সামর্থ্য ও পরমমঙ্গল প্রদান করুন; অপিচ, জ্ঞানকিরণসমূহ যেমন শুদ্ধ-অন্তঃকরণে (প্রীত) অধিষ্ঠিত হয়, তেমনই আমাদের মনও সত্ত্বভাবের পরমানন্দে, আপনার সখিত্বলাভে প্রীত, হোক। (প্রার্থনার ভাব এই যে, -হে ভগবন! আমাদের সৎকর্ম সাধনের সামর্থ্য প্রদান করুন, আমরা যেন আপনার পূজাপরায়ণ হই)। (মানুষ জানে যে, সে যতই হীন পতিত হোক না কেন, মহতো মহীয়া পরম করুণাময় ভগবান্ তাকে উপেক্ষা করবেন না, ঘৃণা করবেন না। তিনি জগতের সকলকে উদ্ধার করবার জন্য মানুষকে শক্তি ও জ্ঞান প্রদান করেন। তাই সৎকর্ম (ভগবানের নীতি অনুসরণ) করার সামর্থ্য লাভের জন্য সখিত্বের বা বিশুদ্ধ সত্ত্বভাবের উদ্বোধনে এই প্রার্থনা]। [গেয়গানের নাম–পৌষং]।
৫। সৎকর্মের দ্বারা প্রাপ্তব্য, সাধকগণের সম্বন্ধে মহত্ত্বযুক্ত এবং শত্রুগণের পক্ষে অতি ভয়ঙ্কর, সেই ভগবান—স্বধার অনুসারী (অর্থাৎ ভগবৎপরায়ণ) শবের (মৃতের) ন্যায় জনকে (শক্তিহীন উপাসককে) সর্বতোভাবে শক্তিসম্পন্ন করেন। (ভাব এই যে–শবের ন্যায় শক্তিহীন জন যদি ভগবানের অনুসারী হন, তিনি নিশ্চয়ই তাঁর কৃপায় শক্তিলাভ করেন)। সকলের দর্শয়িতা দৃষ্টিশক্তিদাতা জ্যোতির্ময় জ্ঞানভক্তির সাথে সম্বন্ধযুত সেই ভগবান্ সমীপবর্তী উপাসকের বাহু দুটিতে অতিকঠোর শত্রুনাশক অস্ত্রকে স্থাপন করেন। (ভাব এই যে, উপাসকদের শক্তিদানের জন্য ভগবান্ নিজের বলকে নিরন্তর তাদের মধ্যে ধারণ করে আছেন)। [ক্রত্বা পদে সৎকর্মের দ্বারাই ভগবান্ প্রাপ্তব্য এই অর্থই সুসঙ্গত। মহাও ভীমা অর্থাৎ ঈশ্বরের কোমল ও কঠোর দুভাব প্রকাশ করছে। ভগবান্ সকলের দর্শয়িতা, তিনি যে প্রদর্শক, ঋষঃ পদে সেই অর্থ পাওয়া যায়। জ্ঞানভক্তির সাথে ভগবান্ যে সম্বন্ধযুত হয়ে আছেন, হরিবান পদে তারই দ্যোতনা রয়েছে। উপকয়ো পদে সমীপবর্তীর অর্থাৎ উপাসকের অর্থ পাওয়া যায়। ইত্যাদি]। [এর গেয়গানের নাম–ঔষসং]।
৬। পরমৈশ্বশালিন্ হে ভগবন! সৎকর্মস্বরূপ যে রথ প্রজ্ঞানসহযুত সত্ত্বভাবসমন্বিত হৃদয়রূপ আধারকে বিজ্ঞাপিত অর্থাৎ প্রদীপ্ত করে, অভীষ্টবর্ষণশীল জ্ঞান-উন্মেষক সেই রথে আপনি অধিষ্ঠিত হোন। তারপর হে ভগবন! সেইভাবে রথারূঢ় আপনি সৎকর্মসাধক জ্ঞানভক্তিরূপ বাহক দুটিকে শীঘ্র আমাদের হৃদয়ে বা কর্মে সংযোজিত করুন–প্রতিষ্ঠাপিত রাখুন। (ভাব এই যে, জ্ঞানভক্তিসমন্বিত কর্মের দ্বারাই ভগবৎপ্রাপ্তিরূপ আনন্দ অধিগত হয়; অতএব ভগবান্ আমাদের সকল কর্মকে জ্ঞানভক্তির দ্বারা সমন্বিত করুন–এই প্রার্থনা)। অথবা–যে পরমৈশ্বর্যশালী দেবতা জ্ঞানভক্তিযুক্ত সত্ত্বভাবপূর্ণ সৎকর্মকে (অথবা, হৃদয়কে) জগতে বিজ্ঞাপিত করেন (অথবা, জানেন), সেই দেবতাই প্রসিদ্ধ অভীষ্টবর্ষক জ্ঞানযুক্ত সৎকর্মসাধন সামর্থ্যে (অথবা, হৃদয়ে) অধিষ্ঠান করেন; পরমৈশ্বর্যশালী হে দেব! আপনার জ্ঞানভক্তি শীঘ্র আমাদের হৃদয়ে প্রদান করুন। (ভাব এই যে, সত্ত্বভাবপূর্ণ হৃদয়ে ভগবান অধিষ্ঠান করেন; সেই দেবতা আমাদের জ্ঞানভক্তি প্রদান করুন) অন্বয়ে মন্ত্রে দুরকম ভাবের বিকাশ দেখা যায়। প্রথম অন্বয়ে সৎকর্মপ্রসূত সৎ-জ্ঞানে হৃদয় আলোকিত হোক, আর সেই সৎকর্মস্বরূপ রথে আরোহণ করে ভগবান্ হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হোন–মন্ত্র এই ভাব প্রকাশ করছে। দ্বিতীয় অন্বয়ে–ভগবান্ জ্ঞানভক্তির সঞ্চার করুন, মন্ত্রে এইভাব দ্যোতিত হচ্ছে। আসলে, দুরকম অন্বয়েই মন্ত্রের লক্ষ্য অভিন্ন]। [এর গেয়গানের নাম–লৌশম)।
৭। প্রজ্ঞানস্বরূপ যে ভগবান্ সকলের পরম আশ্রয়ভূত; সকলের আধারভূত প্রজ্ঞানস্বরূপ যে ভগবানকে আশ্রয় করে জ্ঞানকিরণসমূহ অবস্থিতি করে; অপিচ, সকলের আশ্রয়স্বরূপ যে ভগবানকে সদাসৎকর্মপরায়ণ আত্ম-উৎকর্ষসম্পন্ন সাধুগণ আশ্রয় করেন এবং সদাসৎকর্মশীল আত্ম-উৎকর্ষসম্পন্ন জ্ঞানিগণ সকলের আশ্রয়ভূত যে ভগবানকে প্রাপ্ত হন অর্থাৎ যাঁতে আত্মশীল করেন, জগতের আধারভূত জগৎকারণ প্রজ্ঞানাধার সেই ভগবানকে আমরা স্তুতি করি অর্থাৎ আশ্রয় করি। সেই সকল সৎকর্মপরায়ণ সাধুরাই ইহসংসারে অবিচলিতভাবে ভগবানের আরাধনায় রত থাকেন। সেই কর্মের দ্বারাই ভগবৎ-সামীপ্য প্রাপ্ত তারা পরমপদ লাভ করেন। অতএব সেই ভগবান্ আমাদের পরমপদ সিদ্ধি প্রদান করুন)। [ভগবানই সর্বলোকের পরম আশ্রয়স্থল। তার থেকেই জগতের উৎপত্তি, তাতেই জগৎ বিধৃত, তাতেই জগতের বিলয়। জগতের আধার–তিনি; মানুষের একমাত্র গতি–তিনি। শুধু তাকে পাবার জন্যই সাধকের সাধনা, তার উদ্দেশেই সামগান উচ্চারিত, তার উদ্দেশেই ঋত্বিকদের যজ্ঞসম্পাদন। তাঁর পদপ্রাপ্ত থেকে জ্ঞানধারা প্রবাহিত হয়ে মানুষকে শান্তির পথ প্রদর্শন করে, আবার তাতেই সেই জ্ঞান পুনরাবর্তন করে। জ্ঞানস্বরূপ তিনি, তাঁর কৃপাতেই জগতের অজ্ঞান-অন্ধকার দূর হয়। [এর গেয়গানের নাম–নিষেধঃ সাম]।
৮। সকলের প্রতি সমান প্রীতিযুক্ত হে আমার অন্তর্নিহিত দেবভাবসমূহ (দেবাসঃ)! মিত্রস্থানীয় গতিকারক সর্বশত্রুনাশক জ্ঞান-উন্মেষক ভগবান যে ব্যক্তিকে অন্তশত্রুর আক্রমণ হতে (অতিদ্বিষঃ). রক্ষা করেন অর্থাৎ উপদে প্রতিষ্ঠাপিত করেন, সেই সাধককে পাপ এবং অসৎকর্ম প্রাপ্ত হয় না অর্থাৎ ব্যাপ্ত করে না। (ভাব এই যে, ভগবানের অনুগ্রহে সাধক পাপের কবল থেকে মুক্ত হন)। [এই মন্ত্রে মিত্র, অর্যমা, বরুণ-তিনটি পদ দৃষ্ট হয়। অনেক স্থলে ঐ তিন পদে তিন দেবতাকে বোঝাচ্ছে এইভাবেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এখানেও মূলতঃ, সেইভাবেই ব্যাখ্যাত। তবে, সকলেই বা সব দেবতাই যে সেই এক বিরাট পুরুষেরই অভিব্যক্তি; মিত্র বা অর্যমা বা বরুণ–সকলই যে তার ভিন্ন ভিন্ন রূপ বা বিভূতি, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। আসলে, প্রত্যেক দেবতাতেই ভগবানের এক এক মহিমা বিঘোষিত বলেই ঐসব দেবতার নামগুলিকে ঈশ্বরের বিশেষোণরূপেও গ্রহণ করা অসঙ্গত হয় না। যখন দেখা যায় মিত্ররূপে তিনি আমাদের অশেষ হিতসাধন করছেন, তখন তাঁকে মিত্রদেব বলে আহ্বান করি; যখন দেখতে পাই তিনি আমাদের তার নিকট পৌঁছে দেবার জন্য আমাদের মধ্যে আবেগের বা গতির বা শক্তির সঞ্চার করে দিচ্ছেন, তখনই তাঁকে অমা বলে আহ্বান করি আবার যখন দেখতে পাই, তিনি বরুণ-রূপে আমাদের সকল অভীষ্ট পূরণ করছেন, –আমাদের মোক্ষের পথ দেখিয়ে দিচ্ছেন, তখনই তাকে বরুণদেব বলে সেই সেই ভগবানেরই পূজায় ব্রতী হই। সকলই তিনি–সকলই তার নামরূপ গুণবিভূতি]। [এর গেয়গানের নাম–গৌরাঙ্গিরসস্য সাম]।
.
নবমী দশতি
ছন্দ আর্চিক। কৌথুমী শাখা। ঐন্দ্র পর্ব (তৃতীয়)। চতুর্থ অধ্যায়।
দেবতা ১-৬।১০ পবমান সোম, ৭ মরুদগণ, ৮ অগ্নি, ৯ বাজিগণ৷৷
ছন্দ ১।৩-৫।৭।১০ দ্বিপদা পঙক্তি, ৮ পদপঙক্তি, ৯ পরোষ্ণিক, ২।৬ ত্রিপদা অনুষ্টুপ পিপীলিকামধ্যা।
ঋষি ১।৩-৫।১০ অগ্নি ধিষ্ণ্য দেবগণ, ২।৬ ত্র্যরুণ ত্র্যসদস্যু, ৭ বসিষ্ঠ মৈত্রাবরুণি, ৮ বামদেব গৌতম, ৯ বাজি স্তুতি।
পরি প্র ধন্বেন্দ্রায় সোম স্বাদুর্মিত্রায় পূষ্ণে ভগায়৷৷ ১। পর্য যু প্র ধন্থ বাজসাতয়ে পরি বৃত্রাণি সক্ষণিঃ। দ্বিষস্তরধ্যা ঋণয়া ন ঈরসে৷৷ ২৷ পবস্ব সাম মহানৎসমুদ্রঃ পিতা দেবানাং বিশ্বাভি ধাম৷৷৩৷৷ পবস্ব সোম মহে দক্ষায়াশ্বে ন নিক্তো বাজী ধনায়৷৷ ৪. ইন্দুঃ পবিষ্ট চারুমদায়াপামুপস্থে কবিৰ্ভগায়। ৫৷৷অনু হি ত্বা সুতং সোম মদামসি মহে সমর্যরাজ্যে। বাজাঁ অভি পবমান প্র গাহসে৷৷ ৬৷ ক ঈং ব্যক্তা নরঃ সনীডা রুদ্রস্য মর্যা অথা স্বশ্বাঃ। ৭. অগ্নে তমদ্যাশ্বং ন স্তোমৈঃ ক্রতুং ন ভদ্র হৃদিম্পৃশ৷ ঋধ্যামা ত হৈঃ। ৮। আবিমৰ্য্যা আ বাজং বাজিনো অগ্ম দেবস্য সবিতুঃ সব। স্বর্গাং অর্বন্তো জয়ত৷৷ ৯৷৷ পবস্ব সোম দুমী সুধায়রা মহা অবীনামনুপূৰ্যঃ। ১০।
মন্ত্ৰাৰ্থ— ১। হে শুদ্ধসত্ত্ব (সোম)! অমৃতোপম (স্বাদুঃ) তুমি, মিত্রস্থানীয় দেবতা, সৎ-ভাব পোষক দেবতা ও ঐশ্বর্যাধিপতি দেবতাকে [অথবা মিত্রস্থানীয় (মিত্রায়) সৎ-ভাব-পোষক (পূষ্ণে) ঐশ্বর্যাধিপ দেবতাকে (ভগায়) প্রাপ্তির জন্য আমাদের হৃদয়ে সর্বতোভাবে উপজিত হও। (ভাব এই যে, ভগবানকে লাভ করবার জন্য আমাদের হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্বভাবের উপজন হোক)। [সামবেদে এই মন্ত্রের ঋষির নাম সম্বন্ধে উক্ত আছে-ঋণত্ৰসদস্যসহিতৌ। ঋগ্বেদে এই মন্ত্রের ঋষি অগ্নি নামক ঋষিগণ। এর গেয়গানের পাঁচটির নাম–ইন্দ্রস্য সক্ৰঙমে দ্বে, স্বার্ণধনং সৌহাবষং, বাঙনিধনং সৌহাবষং]।
২। হে ভগবন! সুষ্ঠুরূপে সৎকর্মসাধনের জন্য আমাদের হৃদয়ে সত্ত্বভার উপজিত করুন; ক্ষমাপ্রবণ আপনি সত্ত্বভাব-অপরোধক অজ্ঞানতারূপ পাপসমূহ বিনাশ করুন; আরও, আমাদের সঞ্চিত কর্মফল নাশক আপনি আমাদের রিপুশত্রুদের বিনাশ করবার জন্য প্রবৃত্ত হোন। (ভাব এই যে, -রিপুনাশক ভগবান্ রিপু বিনাশ করে আমাদের হৃদয়ে সত্ত্বভাব সঞ্চার করে দিন)। [সুকর্ম বা দুষ্কর্ম–সব রকম। কর্মের ফলই মানুষকে আবদ্ধ করে; ফলে মুক্তিযাত্রায় বিঘ্ন ঘটে। দুষ্কর্মের ফলে অবশ্যই পতন। সুকর্মের ফলে স্বর্গ ইত্যাদি লাভ হয়; কিন্তু তা মানবজীবনের চরম লক্ষ্য নয়। বরং ঐটি সেই লক্ষ্যসাধনের বিঘ্ন পদবাচ্য কারণ স্বর্গ ইত্যাদি প্রাপ্তি চিরস্থায়ী নয়। সুকর্মের ফলভোগের অন্তে পুনরায় মর্তের পাপমণ্ডলে প্রত্যাবর্তন করতে হয়। অথচ মানুষকে কর্ম করতেই হয়, সুতরাং ফলও ভোগ হয়। তাই কর্ম-শৃঙ্খল বিনাশের জন্য ভগবানকে আহ্বান]। [গেয়গানের নাম–বাকাণি ত্রীণি]।
৩। হে শুদ্ধসত্ত্ব (সোম)! তুমি মহত্ত্বাদিসম্পন্ন; তুমি সমুদ্রতুল্য অসীম ও অভিক্ষরণশীল; তুমি দেবভাবসমূহের উৎপাদক; তুমি সকল স্থান অভিলক্ষ্য করে অর্থাৎ সমগ্র বিশ্বে ক্ষরিত হও। (ভাব এই যে, সমগ্র বিশ্ব সত্ত্বভাবে পরিপূরিত হোক)। [সোমলতার রস (মদ্য) নয়—সোম– হৃদয়ের শুদ্ধসত্ত্বভাব। সেই সত্ত্বভাবে বিশ্বপূর্ণ হোক–অমৃতের স্রোত প্রবাহিত হোক। নরনারী সেই অমৃতপ্লাবনে অভিষিক্ত হয়ে ধন্য হোক। ভগবান্ শুদ্ধসত্ত্বময়। এই বিশ্ব তারই বহিঃপ্রকাশ মাত্র। জগতের পাপমোহ অপসৃত হলেই সেই সত্ত্বভাব প্রকাশিত হয়। তাই পরোক্ষভাবে জগতের পাপ অজ্ঞানতা প্রভৃতি নাশের জন্য প্রার্থনা এই মন্ত্রে দেখা যায়]। [এর গেয়গানের নাম-ধাম সাম এবং ধর্ম সাম]।
৪। হে শুদ্ধসত্ত্ব (সোম)। ব্যাপকজ্ঞানের তুল্য বিশুদ্ধ, মোক্ষপ্রাপক তুমি মহতী আত্মশক্তি সঞ্চয়ের জন্য, এবং পরমধন প্রদানের জন্য আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হও। (ভাব এই যে, বিশুদ্ধ সৰ্বভাব আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোক)। [সোম অর্থে সোমরস (মাদক লছার রস বা মদ্য) ধরে বহু মন্ত্রের অপব্যাখ্যা প্রচলিত হয়েছে। যেমন, একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ–হে সোম! ঘোটকের ন্যায় প্রক্ষালন করা হয়েছে, তুমি আমাদের জ্ঞান ও বল ও ধনের জন্য ক্ষরিত হও। –পাঠকের মাথা ঘুরিয়ে দেবার পক্ষে এই সব অপব্যাখ্যা অবশ্যই কার্যকরী। সোম প্রকৃতপক্ষে হৃদয়ের শুদ্ধসত্ত্বই]। [এর গেয়গানের নাম–সৌয়বসানি ত্ৰীণি]।
৫। মঙ্গলময় সর্বজ্ঞ সকলের জ্ঞানপ্রদাতা ভগবান্ সত্ত্বভাবসম্পন্নদের হৃদয়ে পরমানন্দ উৎপাদনের জন্য এবং তাদের পরমধন দান করবার জন্য আবির্ভূত হন। (ভাব এই যে, আমরা যেন সত্ত্বভাবজনিত পরমানন্দ লাভ করি)। [সেই দেবতা আমাদের পরাশান্তি দান করুন, আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হয়ে আমাদের ধন্য করুন। সেই শুদ্ধসত্ত্বময়ের আগমনে হৃদয়ে সত্ত্বভাবের উদয় হয়, এবং হৃদয়ে আনন্দের প্রস্রবণ বইতে থাকে। কারণ তিনি তো আবার আনন্দস্বরূপ]। [ঋগ্বেদের ঋষি অগ্নি নামক ঋষিগণ। এর গেয়গানের নাম—ভাগম]।
৬। হে শুদ্ধসত্ত্ব (সোম)। বিশুদ্ধভাবপ্রাপক তোমাকে আমরা প্রার্থনা করছি (হৃদয়ে উৎপন্ন করি)। হে অমৃতপ্রাপক! মহৎসমলোকের মধ্যে তুমি সৎকর্মসাধকদের সম্যক প্রাপ্ত হও। (ভাব এই যে, সৎকর্মের সাধকেরা সত্ত্বভাব প্রাপ্ত হন)। অথবা, -হে শুদ্ধসত্ত্ব! বিশুদ্ধতাপ্রদানকারী তোমাকেই প্রাপ্তির জন্য আমরা প্রার্থনা করছি। হে অমৃতপ্রাপক! তুমি মহান্; সমস্ত লোককে উদ্ধার করবার জন্য, সৎকর্মসমূহ লক্ষ্য করে অর্থাৎ আমাদের সৎকর্মসাধক করে আমাদের প্রাপ্ত হও। (ভাব এই যে, আমরা সকলে যেন সত্ত্বভাবসম্পন্ন এবং সৎকর্মসাধক হই)। [সত্ত্বভাব মানুষকে অমৃতের অধিকারী করে–ভগবানের চরণে পৌঁছিয়ে দেয়। ভগবান্ শুদ্ধসত্ত্বময়, সত্ত্বভাব তারই গুণ। সুতরাং যাঁর হৃদয়ে সত্ত্বভাবের সঞ্চার হয়েছে, তিনি অনায়াসেই ভগবানের চরণ লাভ করতে পারেন]। [এর গেয়গানের নাম–বাজিনাং সাম]।
৭। সৎকর্মের নেতা, জগতের আশ্রয়ভূত, সংসার-সংগ্রামে রুদ্রভাবের বিনাশকারী অর্থাৎমৃত্যুভয় অপহারক এবং শ্রেষ্ঠজ্ঞানপ্রাপক প্রজ্ঞানস্বরূপ, এমন সব কারা জ্যোতিঃরূপে প্রকাশিত হন?(কে সেই পরমপুরুষ? মন্ত্রটি এইরকম জিজ্ঞাসামূলক। ভাব এই যে, একমাত্র ভগবানই সকল গুণের আকর)। [মানুষের অন্তরে যে জিজ্ঞাসা আছে, যে জিজ্ঞাসা না থাকলে মানুষ প্রকৃতভাবে মানুষ হতে পারত না, যে জিজ্ঞাসার জন্য মানুষ নিজের জীবনের চরম সম্পদ-লাভ করতে পারে, সেই জিজ্ঞাসাই এই মন্ত্রে ধ্বনিত হয়ে উঠেছে। জগতের বৈচিত্র্যের মধ্যে নানারকম বিভিন্নমুখী ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে থেকে মানুষ যখন বিহ্বল হয়ে যায়, তখন তার অন্তর থেকে প্রশ্ন ওঠে–কে তিনি? অন্ধকারের মধ্যে জ্যোতিঃ বিকীরণকারী কে তিনি? মায়ের স্নেহে বিগলিত হয়ে যায়, পিতার শাসনে রক্ষা করেন তিনি কে? কে তুমি, বসন্তের আনন্দ, আবার প্রলয়ঙ্কর ঝড়ঝঞ্ঝাবাতে প্রাণের আতঙ্ক, বিশ্বের নিখিল সৌন্দর্যের পরিচায়ক, শিশুর হাসিতে ও জননীর চুম্বনে স্বর্গীয় মাধুর্য লহরীকে তুমি? সেই অনন্ত। অসীম–তার সম্বন্ধে ক্ষুদ্র মানুষের মন যতটুকু ধারণা করতে পেরেছে ততটুকুই বলেছে–কিন্তু তাতে তো অনন্তের পরিচয় অসম্পূর্ণই থেকে গেছে। [এর গেয়গানের নাম–হিকং সাম, বিকং সাম, নিকং সাম]।
৮। প্রজ্ঞানস্বরূপ হে দেব! ক্ষিপ্রগমনশীল অথবা সত্বর ভগবৎপ্রাপক জ্ঞানভক্তির ন্যায় কল্যাণদায়ক অথবা দীপ্তিমন্ত এবং সৎ-ভাব প্রাপক সৎকর্মের ন্যায় অতিশয় প্রিয়তম তোমাকে আমরা সদাকাল ভগবৎপ্রাপক স্তোত্রের দ্বারা যেন আরাধনা করি। (ভাব এই যে, আমরা সদাকাল সর্বতোভাবে যেন ভগবানের অনুসারী হই)। [ঋষিবামদেব। এর গেয়গানের নাম–আশ্বে দ্বে]।
৯। দিব্যজ্যোতিঃসম্পন্ন লোকহিতকারক ভগবৎপরায়ণ ব্যক্তি জগকারণ পরিত্রাণকারক দেবতার অনুগ্রহে সত্ত্বভাব এবং সৎকর্মসাধনসামর্থ্য প্রাপ্ত হন। অতএব হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ! দেবভাব এবং জ্ঞানলাভ কর। (ভাব এই যে, ভগবৎপরায়ণ জন পরাজ্ঞান এবং সৎকর্মসাধনসামর্থ্য লাভ করেন)। [এখানে স্বর্গং পদে দেবব অর্থ গৃহীত হয়েছে। স্বর্গং জয়ত—স্বর্গজয় কর, -এর সঙ্গত অর্থ এই যে, স্বর্গলাভের উপযোগী দেবভাব হৃদয়ে সঞ্চার কর। সবং পদের অভিধানিক অর্থ যজ্ঞে প্রস্তুত আসব–সোম। তথাপি এখানে সোমরস বা মদ্য না ধরে যথারীতি সত্ত্বভাব অর্থ গৃহীত হয়েছে। [এই সাম-মন্ত্রটির গেয়গানের নাম বাজিনাং সাম]।
১০। হে শুদ্ধসত্ত্ব (সোম)! দিব্যজ্যোতিঃ সম্পন্ন সৎ-মার্গ-প্রদর্শক মহত্ত্বপ্রাপক অনাদি তুমি শীঘ্র আমাদের হৃদয়ে উপজিত হও। (ভাব এই যে, আমরা যেন শুদ্ধসত্ত্বভাব প্রাপ্ত হই)। [এই মন্ত্রের মধ্যে পরোক্ষভাবে প্রার্থনা আছে–সে প্রার্থনা সত্ত্বভাব লাভের জন্য। সোম অর্থাৎ শুদ্ধসত্ত্বভাব অনাদি। অনন্ত ভগবানের সত্যসঙ্গী বলে সত্ত্বভাবও অনাদি। ভগবান্ সত্ত্বভাবময়; সুতরাং ভগবানের অনাদি অনন্তত্ব তার গুণ-সত্ত্বভাবের প্রতিও প্রযোজ্য]। [ঋষি–এই দশতির ১ম সামের মতো। তবে সামবেদে উক্ত আছে ঐশ্বরয়োর্ধিষ্ণ্যা ঋষয়ঃ। ঋগ্বেদের ঋষি- অগ্নি নামক ঋষিগণ। এর গেয়গানের নাম–পবিত্রং]।
.
দশমী দশতি
ছন্দ আর্চিক। কৌথুমী শাখা। ঐন্দ্র পর্ব (তৃতীয়)। চতুর্থ অধ্যায়।
দেবতা ১-৫,।৮-১০ ইন্দ্র, ৬ বিশ্বদেবগণ, ৭ ঊষা।
ছন্দ দ্বিপদা বিরাট (কোন কোন গ্রন্থে ১।৬।৯ পঙক্তি বিরাট বা গায়ত্রী); ২ দ্বিপদা অনুষ্টুপ, ৩।৪ খ্রিষ্টুপ, ৫ বৃহতী ১০ জগতী বা গায়ত্রী।
ঋষি ১।২।৪-৬।৮-১০ বসিষ্ঠ বা মতান্তরে বামদেব গৌতম ৩ ত্রসদস্যু পৌরকুৎস্য, ৭ সম্পাত (সংবর্ত আঙ্গিরস)।
বিশ্বততাদাব বিশ্বততা ন আ ভর যং ত্বা শবিষ্ঠমীমহে৷৷ ১৷৷ এষ ব্রহ্মা য ঋত্বিয় ইন্দ্রো নাম তো গৃণে৷৷ ২৷ ব্ৰহ্মাণ ইন্দ্ৰং মহয়ন্তো অর্কৈরবধয়হয়ে হন্তবা উ৷ ৩৷ অনবস্তে রথমশ্বায় তক্ষুস্পৃষ্টা বজ্রং পুরুতং দ্যুমন্ত৷৷ ৪৷৷ শং পদং মঘং রয়ীষিণে ন কামমব্রত হিনোতি ন স্পৃশদ্রয়িম্। সদা গাব শুচয়ো বিশ্বধায়সঃ সদা দেবা অরেপসঃ ৷৷ ৬৷– আ. যাহি বনসা সহ গাবঃ সচন্ত বর্তনিং যদ্ধভিঃ। ৭উপ প্রক্ষে মধুমতি ক্ষিয়ন্তঃ পুষ্যেম রয়িং ধীমহে ইন্দ্র৷৷ ৮৷৷ প্র ব ইন্দ্রায় বৃহত্তমায় বিপ্ৰায় গাথং গায়ত যং জুজোষতে৷ ১০
মন্ত্ৰার্থ— ১। পরমদাতা হে দেব! আপনি সকলরকমে আমাদের সর্বাভীষ্ট প্রদান করুন; (কেন ) সর্বশক্তিমান আপনারই নিকটে আমরা পরমধন প্রার্থনা করছি। (প্রার্থনার ভাব এই যে, –হে। ভগবান্! কৃপা করে আমাদের পরমধন-ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ-রূপ পরমধন-প্রদান করুন)। [এর গেয়গানের নাম–আভরে দ্বে]।
২। পরমৈশ্বর্যশালী যে ভগবান সত্যস্বরূপ, যিনি লোকসমূহের বিধাতা অর্থাৎ সর্বাভীষ্টপুরয়িতা, যিনি বিশ্ববিশ্রুত, অকৃতজনের উদ্ধারকর্তা, সেই ভগবানকে যেন আরাধনা করি। (প্রার্থনার ভাব এই যে, আমি যেন ভগবৎ-অনুসারী হই)। [এই সাম-মন্ত্রের গেয়গান-বাসুমন্দে দ্বে এবং কাবষ্যাণি ত্রীণি]।
৩। সর্পপ্রকৃতি রিপুকে বিনাশ করবার জন্য সৎকর্মপরায়ণ তত্ত্বদর্শী সাধকগণ স্তোত্রসমুহের দ্বারা পরমৈশ্বর্যশালী দেবতাকেই আরাধনা করেন। (ভাব এই যে, –রিপুনাশের জন্য সাধকগণ ভগবানের আরাধনা করেন)। [এর গেয়গানের নাম–শ্লোকে দ্বে]।
৪। হে ভগবন! আত্মদর্শী সাধকগণ আপনার সম্বন্ধী পরাজ্ঞান লাভের জন্য (আপনার সংবাহনযোগ্য) সৎকর্মরূপ যানকে প্রস্তুত করেন। অতএব সর্বলোকের আরাধনীয় হে দেব! ত্রাণকারক আপনি, লোকসমূহকে পাপ হতে রক্ষার নিমিত্ত, দীপ্তিমন্ত (তথা শক্তিমন্ত) বজ্রের ন্যায় কঠোর সৎ ভাব-রূপ অস্ত্রকে উৎপাদন করুন। (ভাব এই যে, –সৎকর্মের দ্বারা সৎ-জ্ঞান লাভ হয়; আর সেই জ্ঞান লোকসমূহকে পাপ হতে রক্ষা করে)। [এই সাম-মন্ত্রের গেয়গানের নাম–আনুশ্লোকং]।
৫। ভগবৎপ্রাপ্তিকাম ভগবৎ-অনুসারী ব্যক্তিগণ পরমসুখ, পরমপদ এবং পরমধন লাভ করেন; কিন্তু সর্মরহিত দুষ্কৃতিপরায়ণ ব্যক্তি অভীষ্ট প্রাপ্ত হয় না এবং পরমধনও লাভ করে না। (ভাব এই যে, সৎকর্মপরায়ণ ব্যক্তি মোক্ষ লাভ করেন; সৎকর্ম ভিন্ন কেউই মোক্ষলাভে সমর্থ হয় না)। [এই সাম-মন্ত্রের গেয়গানের নাম–আনুশ্লোকং]।
৬। প্রজ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিগণ নিত্যকাল নির্মলচিত্ত, পরমশক্তিসম্পন্ন এবং নিত্যকাল তারা
ভগবৎগুণসম্পন্ন অর্থাৎ শুদ্ধ অপাপবিদ্ধ হন)। [ব্রহ্মবিৎ ব্রহ্মৈব ভবতি-ভগবৎপরায়ণ ব্যক্তি ভগবানের সমস্ত গুণ ও শাক্ত লাভ করেন। সাধক যখন পরাজ্ঞান লাভ করে নিজের স্বরূপ অবস্থায় প্রতিষ্ঠিত হন, তখন তিনি ব্রহ্মস্বরূপ হয়ে যান, পূর্ণজ্ঞান পূর্ণশক্তি তাতে অধিষ্ঠিত হয়]। [এই সাম মন্ত্রের গেয়গানের নাম-বাচঃ সাম]।
৭। হে ভগবন! আপনার জ্ঞানজ্যোতির সাথে আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন। আপনার সম্বন্ধী পু, যে জ্ঞানকিরণসমূহ সত্ত্বভাবুপ্রবাহের দ্বারা সৎ-মার্গকে বা হৃদয়রূপ রথকে অভিসিঞ্চিত করে; সেই এ জ্ঞানকিরণসমূহ আমাদের মধ্যে আবির্ভুত হোক। (প্রার্থনার ভাব এই যে, -হে ভগবন! কৃপা করে আমাদের সত্ত্বভাবসমন্বিত প্রজ্ঞানসম্পন্ন করুন)। [প্রচলিত একটি বঙ্গানুবাদ–হে ঊষা! চমৎকার তোমার তেজের সাথে তুমি এস; এই দেখ গাভীগণ পরিপূর্ণ আপীন স্তিন) হয়ে পথে চলেছে। অনুবাদটি অনেকাংশে ভাষ্যের অনুগত। দুটি ক্ষেত্রেই ঊষাকে সম্বোধন করা হয়েছে; কিন্তু মন্ত্রটির মধ্যে ঊষা দেবতার সম্বোধনমূলক কোন পদই নেই। বরং ভগবানকে সম্বোধন করাতেই সঙ্গতি দেখা যায়]। [এর গেয়গানের নাম–বাচঃ সাম]।
৮। পরমৈশ্বর্যশালিন্ হে ভগবন! হৃদয়রূপ পাত্র জ্ঞানভক্তিযুক্ত হলে পাপের প্রভাবে ক্ষীণ আমরা যেন তোমার পরমৈশ্বর্য লাভ করতে পারি; অপিচ, হে ভগবন! আমরা যেন তোমাকে আরাধনা করতে সমর্থ হই। (প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! আমাদের জ্ঞানভক্তিসমন্বিত এবং পরমেশ্বর্য প্রদান করুন)। [এই সাম-মন্ত্রের গেয়গানের নাম—মাধুচ্ছন্দসং]।
৯। স্তোত্রপরায়ণ বিবেকসম্পন্ন ব্যক্তিগণই ভগবানকে আরাধনা করতে সমর্থ হন। প্রসিদ্ধ চিরনবীন সর্বগুণময় সেই পরমৈশ্বর্যশালী ভগবান্ প্রকৃষ্টরূপে সাধকদের শত্রুসমূহকে বিনাশ করেন। (ভাব এই যে, ভগবানের অনুগ্রহে বিবেকসম্পন্ন ব্যক্তিই কেবল ভগবৎ-পূজা জানেন; ভগবৎ-অনুগ্রহে তারা পাপবিনিমুক্ত হন)। [মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক। সাধক ও ভগবানের মধ্যে যে সম্বন্ধ আছে, তার একটি দিক মন্ত্রের মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। মানুষের হৃদয়ে ভগবানের বাণী–বিবেক। সুতরাং যাঁর হৃদয়ে বিবেকরূপী ভগবৎশক্তির বিকাশ হয় তিনি ভগবানের মাহাত্ম্য অনুধাবন করে পূর্ণবিশ্বাসে ভগবৎ সাধনায় আত্মনিয়োগ করতে পারেন। এইভাবে তিনি ভগবানের দ্বারাই রক্ষিত হয়ে নিরাপদে চরম অভীষ্টের দিকে অগ্রসর হতে পারেন]। [এই সাম-মন্ত্রের গেয়গানের নাম–মারূতং]।
১০। হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ! তোমরা পাপনাশক প্রজ্ঞানস্বরূপ পরমৈশ্বর্যশালী ভগবানকে লাভ করবার জন্য, যে স্তোত্রে ভগবানের প্রতি উৎপাদন কর, সেই স্তোত্র প্রকৃষ্টরূপে উচ্চারণ কর, অর্থাৎ ভগবানকে আরাধনা কর। (ভাব এই যে, ভগবানের জন্য যেন আমি উপাসনাপরায়ণ হই)। [ভগবানের প্রীতি সম্পাদনই তাঁর আরাধনা। কিন্তু মুখে ভগবানের একটু গুণগান, দুটি স্তোত্র আবৃত্তি করলেই ভগবানের আরাধনা হয় না। প্রার্থনার সাথে হৃদয়ের যোগ থাকা চাই, তাকে পাবার আকুলতা চাই, সৎকর্মসাধন করা চাই। সৎকর্মসমন্বিত হৃদয়-উত্থিত যে প্রার্থনা তা-ই প্রকৃত প্রার্থনা–তা-ই প্রকৃত আরাধনা]। [এই সাম-মন্ত্রের গেয়গানের নাম–উদ্বাংশং সাম]।
.
একাদশী দশতি
ছন্দ আর্চিক। কৌথুমী শাখা। ঐন্দ্র পর্ব (তৃতীয়)। চতুর্থ অধ্যায়।
দেবতা ১।২ অগ্নি, ৩।৪।৮।১০ ইন্দ্র, ৫ ঊষা, ৬।৭।৯ বিশ্বদেবগণ৷৷
ছন্দ ১।২।৫।৭ দ্বিপদা পঙক্তি, ৩।৪ পঞ্চদশাক্ষরা আসুরী গায়ত্রী, ৬।৮।৯ দ্বিপদা ত্রিষ্টুপ, ১০ একপদা অষ্টাক্ষরা গায়ত্রী৷
ঋষি ১ পৃষধ্র কাণ্ব বা সম্পাত, ২-৪ বন্ধু সুবন্ধু বিপ্ৰবন্ধু গোপায়ন, ৫ সংবর্ত আঙ্গিরস, ৬ ভৌবন আপ্ত্য, ৭ কবষ ঐলুষ, ৮ ভরদ্বাজ বার্হস্পত্য, ৯ আত্রেয়, ১০ বাসিষ্ঠ মৈত্রাবরুণি৷৷
অচেত্যগ্নিশ্চিকিতিহ্যবান সমুদ্রথঃ ১। অগ্নে ত্বং নো অন্তম উত ত্রাতা শিববা ভুবো বরূথ্যঃ ৷৷ ২৷৷ ভগে ন চিত্রো অগ্নির্মহোনাং দধাতি রত্ন৷ ৩৷৷ বিশ্বস্য প্র স্তোভ পুরো বা সন্ যদি বেহ নূন৷৷ ৪৷ ঊষা অস্বসুষ্টম সং বর্তয়তি বর্তনিং সজাততা৷ ৫৷৷ ইমা নু কং ভুবনা সীষধেমের্শ বিশ্বে চ দেবাঃ৷৷ ৬। বি সুতয়ো যথা পথা ইন্দ্র হৃদ্যন্তু রাতয়ঃ৷৷ ৭৷৷ অয়া বাজং দেবহিতং সনেম মদেম শহিমাঃ সুবীরাঃ ৮ ঊর্জা মিত্রো বরুণঃ পিন্থতেডাঃ পীবরীমিষং কৃণুহী ন ইন্দ্র। ৯৷৷ ইন্দ্রো বিশ্বস্য রাজতি৷৷১০৷৷
মন্ত্ৰাৰ্থ— ১। সাধন-সামর্থ্যপ্ৰদাতা সকল সৎকর্মের আধার সর্বজ্ঞ জ্ঞানদেব সকলই অবগত আছেন। (ভাব এই যে, একমাত্র ভগবানই সর্বজ্ঞ)। [অগ্নি অর্থাৎ ভগবানের জ্ঞানরূপ বিভূতি জ্ঞানদেব]। [এই সাম-মন্ত্রটির গেয়গানের নাম–শাম্যে দ্বে]।
২। হে জ্ঞানদেব! আপনি সংসারবন্ধননাশক পরম-আশ্রয়স্বরূপ পরমমঙ্গলময়; আপনি আমাদের প্রিয়তম বন্ধুভূত এবং ত্রাণকারী হোন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, –হে ভগবন! আপনি আমাদের মিত্রস্বরূপ হয়ে আমাদের বিপদ থেকে রক্ষা করুন এবং সংসার বন্ধন নাশ করুন)। [সমগ্র বিশ্ব তার মঙ্গলনীতিতে পরিচালিত। জগতে কোথাও অমঙ্গল চিরদিনের জন্য আধিপত্য বিস্তার করতে পারে না। আমরা যে অমঙ্গল দুঃখ-বিপদ দেখি, তা আমাদের অসম্যক দৃষ্টির, পরিণাম, অজ্ঞানতার ফল মাত্র। ভগবানের বিশ্বনীতিতে অমঙ্গলের স্থান থাকলে বিশ্ব ধ্বংসের পথে যেত। আমাদের এই সাময়িক দুঃখ-যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে উচ্চতর লোকে নিয়ে যাবার জন্য তিনি আমাদের প্রস্তুত বা উপযুক্ত করে তোলেন। ব্যথাহারী ভগবান্ ব্যথা দিয়ে ভববাধা দূর করেন, যেমন পিতা শাসনের দ্বারা অর্থাৎ প্রহারের যন্ত্রণা দিয়ে পুত্রকে সৎপথে নিয়ে যান। ব্যথা না পেলে মানুষ সেই ব্যথাহারীকে স্মরণ করে না। তাই সাধকের প্রার্থনা–রুদ্র যত্তে দক্ষিণং মুখং তেন মাং পাহি নিত্যং। এমন যে পরমদেবতা–তার তুল্য নিকটতম আর কে হতে পারে? তাই তাকে বন্ধুরূপে পাবার অনন্ত আকাঙ্ক্ষা এই মন্ত্রের মধ্যে প্রকাশিত দেখতে পাওয়া যায়। দূরে নয়–ভগবানের সাথে একাত্মতা হওয়াই সাধকজীবনের শ্রেষ্ঠ লক্ষ্য]। [এর গেয়গানের নাম–গৃদং, অতর্দঃ, গূর্দঃ, অর্ত্যদ]।
৩। মহত্ত্বসম্পন্নদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ও বরণীয়, সূর্যের ন্যায় বিচিত্রগুণোপেত, পরমশক্তিসম্পন্ন, জ্ঞানদেব (অগ্নি) মোক্ষরূপ রমণীয় ধন ধারণ করে আছেন অর্থাৎ প্রদান করেন। (ভাব এই যে, ভগবানই লোকসমূহকে পরমপদ প্রদান করে থাকেন)। [ভগবানের জ্ঞানশক্তি মানুষের হৃদয়ে আবির্ভূত হয়ে তাকে জগতের শ্রেষ্ঠ সম্পদের অধিকারী করে। মোক্ষ জ্ঞানের দ্বারাই লভ্য। অজ্ঞান- অন্ধকারে আচ্ছন্ন মানুষ যখন আকুল হয়ে তাঁকে ডাকে, তখন তিনি কৃপা করে নিজের দিব্যজ্যোতিঃ (জ্ঞান) বিকাশ করেন। তখন এক মুহূর্তে মানুষের মনের যুগযুগান্তের জমাটবাঁধা অন্ধকার (অজ্ঞানতা) পলায়ন করে]। [এর গেয়গানের নাম–সাতনিকে দ্বে]।
৪। বিশ্বের সকল শত্রুর স্তম্ভনকারী হে ভগবন! আপনি যদি ইহজগতে থাকেন, অথবা যদি স্বর্গলোকে থাকেন, আপনি যেখানেই থাকুন, সেখান হতে সত্বর আমাদের হৃদয়ে আগমন করুন। (ভাব এই যে, -হে ভগবন! আমাদের হৃদয়ে অবস্থিত হয়ে আমাদের ত্রাণ করুন)। [মানুষ-অবোধের মতো যত্রতত্র তাকে খুঁজে বেড়ায়। মনে করে, এখানে তিনি; অথবা এখানে নয়, ওখানে তিনি। কিন্তু যখন আত্মদৃষ্টি লাভ করে, তখন সে বুঝতে পারে সর্বময় তিনি এবং সবই তন্ময়। সুতরাং তিনি সেই সাধকেরও হৃদয়ে অধিষ্ঠিত]। [ঋষি-বিপ্ৰবন্ধুঃ। এর গেয়গানের নাম–ধনসাম ও ধর্মসাম]।
৫। জ্ঞানের উন্মোষিণী দেবী অজ্ঞান অন্ধকার দূর করেন; এবং আপন তেজের দ্বারা সেগুলিকে নিজের স্বপ্রকাশক ও সৎমার্গ প্রাপ্ত করান। (ভাব এই যে, ভগবান্ কৃপা করে লোকসমূহকে জ্ঞান প্রদান করেন; সেই জ্ঞানের দ্বারা লোক-সকল সৎমার্গের অনুসারী হয়)। [অন্ধকারের মধ্যে এই যে আলোক-বিকাশ, দিগভ্রান্ত পথিককে যে এই পথ-নির্দেশ, তা ভগবানেরই করুণার পরিচায়ক। হৃদয়ে জ্ঞানজ্যোতিঃ বিকশিত হলে মানুষ-আপনি থেকেই সৎপথের পথিক হয়]। [এর গেয়গানের নাম–ঊষসং সাম]।
৬। এই পরিদৃশ্যমান জগৎ–মায়াপ্রপঞ্চ–আমাদের কি সুখ প্রদান করে? অর্থাৎ, প্রকৃত কোনও সুখই দিতে পারে না; পরমৈশ্বর্যশালী ভগবান্ এবং ভগবানের বিভূতিরূপ সকল দেবতাই আরাধনা দ্বারা প্রীত হয়ে আমাদের নিশ্চিতভাবে (অথবা, শীঘ্র) পরমসুখ প্রদান করেন। (ভাব এই যে, ভগবানই পরমসুখদাতা)। [ভগবানের কৃপায় ক্রমশঃ মানুষের হৃদয়ে সত্যের আলোক ফুটে ওঠে, সে দেখতে পায়–সবক্ষণিক স্বপ্ন, সব মায়া। মিথ্যার পিছনে ছুটে সে মিথ্যা পরিশ্রম করেছে। কোথায় অনন্ত সুখ, কোথায় অনন্ত শান্তি? তখন সে ভগবানের কাছেই জিজ্ঞাসু হয়ে ওঠে–তুমিই বলে দাও, তোমার জগতে কি প্রকৃত সুখ নেই?–আছে–নিশ্চয় আছে। সত্য সত্যই সেই অবিনশ্বর সুখের সন্ধান সে পায়, যখন তার অন্তরস্থ অমৃতের বীজই তাকে সেই সন্ধান দেয়। অসত্যের দ্বারা সেই ভূমানন্দের (সত্যের সন্ধান পাওয়া যায় না। সেই অনাদি অবিনশ্বর আনন্দস্বরূপের চরণে আত্মসমর্পণ : কর, তাতেই ভূমানন্দ লাভ করবে–পরমশান্তি প্রাপ্ত হবে]। [এর গেয়গানের নাম–ভারদ্বাজং]।
৭। পরমৈশ্বর্যশালিন্ হে ভগবন! রাজমার্গ হতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পথসমূহ যেমনভাবে নির্গত হয়, তেমনভাবে আপনার নিকট হতে মোক্ষ প্রবাহিত হোক, অর্থাৎ আমাদের প্রাপ্ত হোক। (ভাব এই যে, -হে ভগবন! কৃপা করে আমাদের পরমধন প্রদান করুন)। অথবা–পরমৈশ্বর্যশালি হে ভগবন! ক্ষুদ্রমাগসমূহ যেমন রাজমার্গকে আশ্রয় করে; তেমনি আমাদের শুদ্ধসত্ত্বসমূহ আপনার সমীপে প্রবাহিত হোক অর্থাৎ আপনাকে প্রাপ্ত হোক। (ভাব এই যে, -হে ভগবন! আপনি আমাদের হৃদয়স্থিত শুদ্ধসত্ত্ব গ্রহণ করুন)। [ভগবান্ কল্পতরু, কিন্তু তার দান গ্রহণ করবার মতো শক্তি থাকাও চাই। মোক্ষলাভের জন্য শুধু প্রার্থনা করলেই তো হয় না–হৃদয়-মন মোক্ষলাভের উপযোগী হওয়া চাই। ভগবানের কাছে মোক্লাভের জন্য প্রার্থনা করার অর্থই এই যে, ভগবান্ যেন আমাদের তার এ পরমদান মোক্ষ লাভ করবার শক্তি দেন, আমরা যেন তাঁর অভিমুখে চলবার, সৎ-ভাবে জীবনযাপন করবার শক্তি লাভ করি। বলা বাহুল্য, ভগবানই কৃপা করে মানুষকে তার দান গ্রহণ করবার উপযোগী শক্তি দান করেন। তবে তার জন্য সাধক-মনের সীমাহীন আকাঙ্ক্ষা থাকা চাই। মন্ত্রের অপর ভাব– রাতয়ঃ–পরমদান মোক্ষ ইত্যাদি অথবা শুদ্ধসত্ত্বসকল–কেবল যে ভগবানেরই দান, তা নয়। প্রার্থীও দাতাকে কোনও বিশেষ সামগ্রী দান করতে সমর্থ। ভগবানের কাছে যেমন সৎ-ভাব প্রার্থনা কর যায়, তেমনি আবার তাকে সৎ-ভাব (শুদ্ধসত্ত্ব) প্রদান করাও চলে। ক্ষুদ্র নদী যেমন মহানদীতে মিলিত হয়, ক্ষুদ্র পথ যেমন বৃহৎ পথে মিশে যায়, তেমনি আমার হৃদয়ের ক্ষুদ্র সৎ-ভাবটুকু বিরাট তোমাতেই গিয়ে মিলিত হোক, তোমাকেই আশ্রয় করে তোমাতে আত্মলীন হয়ে যান]। [এর গেয়গানের নাম–রাতি সাম]।
৮। ঐকান্তিক প্রার্থনার দ্বারা আমরা যেন ভগবৎপ্রদত্ত সৎকর্মসাধনসামর্থ্য লাভ করতে পারি; সৎকর্মসাধক হয়ে আমরা যেন অনন্ত জীবন লাভ করতে পারি। (ভাব এই যে, –ভগবানের কৃপায় সৎকর্মসমন্বিত হয়ে আমরা যেন অনন্তজীবন লাভ করি)। [ঐকান্তিক ব্যাকুলতার সাথে প্রার্থনা করলে, নিজের যতকিছু অপরাধ, তার চরণে নিবেদন করলে, ভগবান্ কৃপা করে মানুষকে তার অভীষ্ট প্রদান করেন]। [গেয়গানের নাম–ভারদ্বাজং]।
৯। পরমৈশ্বর্যশালিন্ হে ভগবন! মিত্রস্বরূপ দেব (মিত্রঃ), অভীষ্টবর্ষণশীল দেব (বরুণঃ) এবং আপনি (ইন্দ্র) আমাদের আত্মশক্তিযুক্ত সৎকর্মসাধনসামর্থ্য প্রদান করুন। হে ভগবন! আমাদের সাধন শক্তি প্রবৃদ্ধ করুন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! কৃপাপূর্বক আমাদের সৎকর্ম সাধনের সামর্থ্য, প্রদান করুন)। [সাধক নিজের শক্তিতে তার অন্তরস্থ শক্তিকে জাগরিত ও বিকশিত করে সেই শক্তির সাহায্যে, নিজের অভীষ্টলাভ করতে চাইছেন। প্রকৃত প্রার্থনাই এই]। [ঋষির নাম–আত্রেয়। এর গেয়গানের নাম–ঐষম্]।
১০। পরমৈশ্বর্যশালী ভগবান্ সকল ভুবনের ঈশ্বর হন। (ভাব এই যে, ভগবানই জগতের একমাত্র প্রভু)। [তিনিই জনক, পালক, রক্ষক। তিনি সর্বত্র। এই অনন্ত জগৎ তারই মহিমা প্রকাশ করছে। সুতরাং যে রূপে যেখানে তাঁকে ভাববে, সেই রূপে সেখানেই তিনি ভক্তের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ। করবেন]। [এর গেয়গানের নাম–বৈরাজ দ্বে]
.
দ্বাদশী দশতি
ছন্দ আর্চিক। কৌথুমী শাখা। ঐন্দ্র পর্ব (তৃতীয়)। চতুর্থ অধ্যায়।
দেবতা ১।৩।৪।১০ ইন্দ্র, ২ সূর্য ৫ বিশ্বদেবগণ, ৬ মরুদগণ, ৭ পবমান সোম, ৮ সবিতা, ৯ অগ্নি৷
ছন্দ ১।৩।৫।৭।৯ অত্যষ্টি (কোন কোন পুস্তকে ১ অষ্টি), ২।৪।৬ অতি জগতী, ৮।১০ অতিশক্করী (কোন কোন গ্রন্থে ৮ অত্যষ্টি)।
ঋষি ১।১০ গৃৎসমদ শৌনক, ২ গৌরাঙ্গিরস, ৩।৫।৯ পরুচ্ছেপ দৈবদাসি, ৪ রেভ কাশ্যপ, ৬ এবয়ামরুৎ আত্রেয়, ৭ অনানত পারুচ্ছেপি, ৮ নকুল৷৷
ত্রিকে মহিষো যবাশিরং তুবিশুম্মম্পৎ সোমমপিবদ্বিষ্ণুনা সুতং যথাবশ। স ঈং মমাদ মহি কর্ম কর্তবে মহামুরুং সৈনং সশ্চদেববা দেবং সত্যং ইন্দুঃ সত্যমি৷১৷ অয়ং সহস্ৰমানববা দৃশঃ কবীনাং মতির্জ্যোতির্বিধর্ম। ব্ৰধঃ সমীচীরুষসঃ সমৈরয়দরেপসঃ সচেতসঃ স্বসরে মমন্তশ্চিতা গো৷৷ ২৷ এন্দ্র যাপ নঃ পরাবতো নায়মচ্ছা বিদথানবি সৎপতিরস্তা রাজেব সৎপতিঃ। হবামহে ত্বা প্ৰস্বন্তঃ সুতো পুত্ৰাসোন পিতরং বাজসাতয়ে মংহিষ্ঠং বাজসাতয়ে৷৷ ৩৷৷ তমিং জোহবীমি মঘবানমুগ্ৰং সত্রা দধানমপ্রতিদ্ভুতং শবাংসি ভূরি। মংহিষ্ঠো গীৰ্ভিরা চ যজ্ঞিয়ো ববর্ত রায়ে নো বিশ্ব সুপথা কৃপোতু বর্জী। ৪। অস্তু শ্রৌষটু পুরো অগ্নিং ধিয়া দধ আ ন ত্যচ্ছধো দিব্যং বৃণীমহ ইন্দ্ৰবায়ু বৃণীমহে। যদ্ধ ক্রাণা বিবস্বতে নাভা সন্দায় নব্যসে। অধ প্ৰ নূনমুপন্তি ধীতয়ো দেবাঁ অচ্ছ ন ধীতয়ঃ৷৷ ৫৷৷ প্র বো মহে মতয়ো যন্তু বিষ্ণবে মরুত্বতে গিরিজা এবয়ামরুৎ। প্র শর্ধায় প্রযজ্যবে সুখাদয়ে তবসে ভদিষ্টয়ে ধুনিব্রতায় শবসে৷৷ ৬৷৷ অয়া রুচা হরিণ্যা পুনানো বিশ্বা দ্বেষাংসি তরতি সয়ুথভিঃ সুরো ন সযুগ্মভিঃ। ধারা পৃষ্ঠস্য রোচতে পুনাননা অরুষো হরিঃ। বিশ্বা যরূপা পরিয়াস্যকৃতি সপ্তাস্যেভিঋকৃভিঃ৷৷ ৭৷৷ অভি তং দেবং সবিতারমোণ্যোং কবিক্রতুমৰ্চামি সত্যসবং রত্নধামভি প্রিয়ং মতি৷ ঊধ্বা যস্যামতির্ভা অদিতৎ সবীমনি হিরণ্যপাণি রমিমীত সুতুঃ কৃপা স্বঃ৷৷ ৮৷৷ অগ্নিং হোতারং মন্যে দাস্বন্তং বসোঃ সূনুং সহসো জাতবেদসং বিপ্রং ন জাতবেদসম্। য ঊর্ধ্বয়া স্বধ্বররা দেবো দেবাচ্য কৃপা। ঘৃতস্য বিভ্রাষ্টিমনু শুক্ৰশোচিষ আজুনস্য সর্পিষঃ৷ ৯৷৷ তব ত্যং নং নৃহেপ ইন্দ্র প্রথমং পূর্বং দিবি প্ৰবাচ্যং কৃতম্। যো দেবস্য শবসা প্রারিণা অসুরিণন্নপঃ। ভুবো বিশ্বমভ্যদেবমোজসা বিদেদূর্জং শতক্রতুবিদেদিষ৷৷ ১০৷৷
মন্ত্ৰাৰ্থ— ১। কর্মভক্তিজ্ঞানের সমন্বয় সাধন করবার জন্য, মহিমান্বিত সর্বশক্তিমান আত্মতৃপ্ত ভগবান্ সাধকের হৃদয়স্থিত বিশুদ্ধ অর্থাৎ সুসংস্কৃত পোষণ শক্তিসম্পন্ন সত্ত্বভাব যথানুক্রমে (যথাযথরূপে) গ্রহণ করেন। (ভাব এই যে, ভগবান্ সাধকের শুদ্ধসত্ত্ব গ্রহণ করে তার সাথে ই সম্মিলিত হন); আর সেই ভগবান্ মহৎ, সাধকের মঙ্গল সাধনভূত, প্রসিদ্ধ পতিত-উদ্ধার রূপ কর্ম করতে আনন্দ লাভ করেন; (তাই) সত্যপ্ৰাপক দীপ্তিযুক্ত সেই সত্ত্বভাব, সত্যস্বরূপ দীপ্তিমন্ত মহত্ত্বসম্পন্ন সর্বত্রপ্রকাশমান্ পরমৈশ্বর্যশালী ভগবানকে ব্যাপ্ত করে আছে। (ভাব এই যে, ভগবান্ সত্যস্বরূপ সত্ত্বভাবময়)। [ত্রিকদ্রুকেষু-কর্ম, ভক্তি ও জ্ঞানের সমন্বয় সাধনাৰ্থে; মহিষঃ মহিমান্বিত; বিষ্ণুনা–সাধকের হৃদয়স্থিত; সুতং–বিশুদ্ধ বা সুসংস্কৃত; যবাশিরং– পোষণশক্তিসম্পন্ন; সোমং–সত্ত্বভাব ইত্যাদি অর্থই সঙ্গত]। [গেয়গানের নাম-বাজাজন]।
২। জগতে প্রকাশমান জ্ঞানস্বরূপ সকলের দ্রষ্টা জ্ঞানিগণের মননীয় জ্যোতিঃস্বরূপ জগতের বিধাতা মহান্ ব্রহ্ম, নির্মলা অজ্ঞানতানাশিকা জ্ঞানপ্রদায়িকা জ্ঞান-উন্মোষিকা দেবীকে (অর্থাৎ সৎবৃত্তিসমূহকে) : লোকের হৃদয়ে সম্যক্ প্রকারে প্রেরণ করেন; ভগবানের কৃপায় জ্ঞানকিরণের দ্বারা আলোকিত হলে সকল লোক দীপ্তিমন্ত ও জ্ঞানবন্ত হয়। (ভাব এই যে–ভগবৎপ্রদত্ত জ্ঞানের দ্বারা তোক জ্ঞানবান্ হয়)। [ঊষসঃ-ঊষা, জ্ঞানের উন্মেষকারিণী দেবী, তথা ভগবানের সৎবৃত্তিরূপ বিভূতি]। [গেয়গানের নাম–গৌরাঙ্গিরসস্য সামনী দ্বে]।
৩। পরমৈশ্বর্যশালিন্ হে ভগবন! বন্ধু যেমন বন্ধুর নিকট আগমন করে, সৎ-জনের পালক যেমন জ্ঞানিগণকে প্রাপ্ত হয়, জগতের অধীশ্বর আপনি যেমন সাধকদের হৃদয়ে আগমন করেন, তেমনই আপনি স্বর্গ হতে আমাদের হৃদয়ে আগমন করুন; পুত্রস্থানীয় সাধক সৰ্কৰ্মসাধনশক্তি লাভ করবার জন্য মহত্ত্বসম্পন্ন আপনাকে যেমন আহ্বান করেন, তেমন আমরাও সত্ত্বভাবসম্পন্ন হয়ে বিশুদ্ধ সৎকর্মসাধনের জন্য আপনাকে যেন প্রকৃষ্টরূপে আহ্বান করতে পারি; হে ভগবন! পিতা যেমন পুত্রের কল্যাণসাধনে তৎপর হন, তেমনি আপনিও আমাদের প্রার্থনা শ্রবণ করে আমাদের পরমমঙ্গল বিধান। করুন। (ভাব এই যে, –আমরা যেন সৎকর্মসমন্বিত ভগবৎপরায়ণ হই)। [এর গেয়গানের নাম অক্ষর্যম]।
৪। প্রভূতধনসম্পন্ন (সকল ঐশ্বর্যের আধার সকল শক্তির আধার সত্যস্বরূপ সর্বৈশ্বর্যসম্পন্ন বিবিধরকমে শেয়ঃপ্রদানকারী অর্থাৎ প্রভূত মঙ্গলবিধায়ক অতএব পরমধনপ্রদানে কার্পণ্যরহিত অর্থাৎ না-প্রতিশব্দরহিত সর্বগুণময় পরম ঐশ্বর্যশালী ভগবানকে হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত করি; অপিচ, বিশ্বের সকলের আরাধনীয় অর্থাৎ বিশ্বের পরমমঙ্গলবিধায়ক সকলের পূজ্য পরমৈশ্বর্যশালী ভগবান্ আমাদের স্তুতির দ্বারা (অথবা, আমাদের অনুষ্ঠিত সৎকর্মে) পরিতুষ্ট হয়ে আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন; তারপর শত্রনাশে বজ্ৰায়ুধধারী সেই ভগবান্ আমাদের পরমধনদানের জন্য সকলরকম সুপথের বিধান করুন অর্থাৎ আমাদের সৎপথে প্রতিষ্ঠাপিত করুন। (ভাব এই যে, ভগবানই একমাত্র পরমমঙ্গলের বিধায়ক। আমাদের সৎকর্ম তাকে আমাদের মধ্যে আনয়ন করুক, তাতে আমরা তাঁর অনুগ্রহ লাভ করতে সমর্থ হব। আর তাতে আমরা সৎপথে পরিচালিত হতে পারব)। [এর গেয়গানের নাম– অক্ষর্যং]।
৫। সৎকর্মপ্রভাবে প্রজ্ঞা-স্বরূপ ভগবানকে হৃদয়রূপ বেদীতে প্রতিষ্ঠিত করি। (ভাবার্থ– সৎকর্মের সাধনে ভগবানকে যেন পরিতুষ্ট করতে পারি); তারপর ভগবৎ-সম্বন্ধী শ্রেষ্ঠ বল হৃদয়ে সঞ্চয় করি। (ভাবার্থ–আমাদের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হয়ে ভগবান্ আমাদের সৎকর্মসাধনসামর্থ্য প্রদান করুন); (এইভাবে সামর্থ্য উপজিত হলে) আমরা জ্ঞানভক্তিরূপ ইন্দ্র ও বায়ু দেবতার প্রার্থনায়।
সমর্থ হই। (ভাবার্থসৎকর্ম-সাধনের সামর্থ্য প্রাপ্ত হলে, ভগবানকে ডাকবার সামর্থ্যও লাভ করা এ যায়)। (প্রার্থনার সামর্থ্য উপজিত হলে) আমরা সত্ত্বসমন্বিত হৃদয়রূপ যজ্ঞাগারে চিরনবীন পরমানন্দপ্রাপক পরমধনবিধাতা নিত্যতরুণ ইন্দ্র-বায়ু দেবতাকে হৃদয়ে প্রতিষ্ঠা করতে পারি। হে ভগবন! আমাদের স্তুতি গ্রহণ করুন। তারপর, আমাদের সৎ-ভাবরাশি প্রকৃষ্টরূপে আমাদের ভগবৎ সামীপ্য প্রাপ্ত করুক; এবং দেবভাবকামী আমাদের অনুষ্ঠিত কর্মসমূহ আমাদের ভগবানের সমীপে নিয়ে যাক। (ভাব এই যে, –সৎ-ভাবের এবং সৎকর্মের দ্বারা আমরা যেন নিত্য ভগবানকে অনুসরণ করি)। [মন্ত্রে একদিকে যেমন প্রার্থনাকারীর সঙ্কল্প–আত্ম-উদ্বোধনা প্রকাশ পেয়েছে, অন্যদিকে তেমনি ভগবানের কাছে তার ব্যাকুল প্রার্থনার ভাব সূচিত হয়েছে। এই মন্ত্রে অগ্নিং পদে আহবনীয় বা অন্য কোন অগ্নি কল্পিত হয়নি। এখানে অগ্নিং পদে ভগবানের সেই বিভূতিকে লক্ষ্য করা উচিত, যাঁর প্রভাবে অজ্ঞানতার অন্ধকার দূরীভূত হয়]। [এর গেয়গানের নাম–যাজ্ঞতুরম্]।
৬। বিবেকরূপী হে ভগবন (মরুৎ-দেবতা–যাঁরা ভগবানের বিশেষ বিভূতি–বিবেকরূপে আবির্ভূত)! হৃদয়সঞ্জাত অথবা কর্মের দ্বারা সমুদ্ভুত প্রসিদ্ধ স্তুতিসমূহ অথবা সৎ-ভাবসমূহ আমাদের সম্বন্ধী বিবেকসম্বন্ধযুত সর্বব্যাপী আপনার উদ্দেশে নিত্যকাল গমন করুন। (আমাদের ঐকান্তিক প্রার্থনা নিত্যকাল ভগবানকে প্রাপ্ত হোক অর্থাৎ ভগবানের নিকট উপস্থিত হোক)। অপিচ, হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ! তোমরা প্রকৃষ্টরূপে যষ্টব্য সুখপ্রদ সকল শক্তির আধার মহিমান্বিত পরমধনপ্রদাতা কল্পিতকর্মা (অর্থাৎ শত্রুনাশক ও সকল সৎকর্মের আধারভূত, শবস্বরূপ আমাদের রক্ষক মহান্ ভগবানের উদ্দেশ্যে হৃদয়সঞ্জাত শুদ্ধসত্ত্ব নিবেদন কর; তাই ব্রত বা সৎকর্ম-সাধন। (সাধক এখানে নিজেকে উদ্বোধিত করছেন। ভাব এই যে, ভগবানে সর্বসমর্পণরূপ ব্রতই মোক্ষ-বিধায়ক)। [ভাষ্যের মতে এই মন্ত্রের ঋষি-এবয়ামরুৎ। তিনি যেন স্তোত্রসমূহ প্রণয়ন করছেন, ভাষ্যকারের গিরিজাঃ পদে তা-ই উপলব্ধি হয়। কিন্তু বেদমন্ত্র কোনও মরদেহধারী পুরুষের বা রমণীয় লিখিত নয়, বেদের অপৌরুষেয়ত্ব মানলে একথা স্বীকার করতেই হয়। গিরিজাঃ পদে হৃদয় সঞ্জাতাঃ অথবা কর্মণা সমুদ্ভুতাঃ অর্থই সঙ্গত। বিষ্ণবে অর্থে সর্ব্ব্যাপিনে ভগবনতে তুভ্যং ইতি ভাবঃ-ই সঙ্গত]। [এর গেয়গানের নাম–এবযামরুতঃ সামঃ]।
৭। সূর্য যেমন আপন কিরণের দ্বারা আবরক অন্ধকারসমূহ নাশ করেন, তেমনই পবিত্রতাপ্রাপ্ত শুদ্ধসত্ত্ব তেজঃপ্রদীপ্ত ও দীপ্তিমন্ত তেজপূর্ণ শক্তির দ্বারা এবং আত্মজ্ঞান-উন্মেষণের দ্বারা বিশ্বের সকল শত্রুকে নাশ করেন। (ভাবার্থ-সূর্য যেমন রশ্মির দ্বারা অন্ধকারসমূহ নাশ করেন, তেমনই শুদ্ধসত্ত্বরূপী ভগবান্ নিজের অমিত প্রভাবের দ্বারা আত্মজ্ঞান-উন্মেষ করে অন্তঃশত্রুদের বিনাশ করেন)। এরপর (শুদ্ধসত্ত্ব প্রদীপ্ত হলে) পবিত্রকারক জগৎ-উদ্ধারক সেই ভগবানের তেজোরাশি অর্থাৎ করুণাধারা সাধকগণকে উদ্ভাসিত অর্থাৎ অভিসিঞ্চিত করে। (ভাব এই যে, –হৃদয়ে সৎ-ভাব সঞ্জাত হলে ভগবানের করুণাধারা আপনিই বিগলিত হয়)। আরও, ভগবান্ যখন দেহ ইত্যাদি সপ্তসংজ্ঞক সৎকর্ম সাধনের উপাদানসমন্বিত তেজঃসমূহের দ্বারা বিশ্বের ভূতজাতসমূহকে সর্বতোভাবে পরিব্যাপ্ত করেন, তখন শুদ্ধসত্ত্বের গ্রাহক পবিত্রকারক ভগবান্ আপন তেজের দ্বারা আপনিই প্রকাশমান হন। (ভাব এই যে, সূর্যরশ্মিসমূহ যেমন সপ্তকিরণের দ্বারা জগৎকে সূর্যসম্বন্ধ প্রদান করে, সত্ত্বভাবসমূহ তেমনই দেহেন্দ্রিয় প্রভৃতির দ্বারা হৃদয়ে ভগবানকে প্রতিষ্ঠিত করে)। [সূর্যের সপ্তরশ্মি বা সপ্তজিহ্বা একত্রে মিলিত হয়ে শ্বেতবর্ণের সৃষ্টি করে, তেমনই সত্ত্বভাব-উন্মেষের পক্ষে সপ্ত উপাদান হলো– পঞ্চভূতাত্মক দেহ, পঞ্চকর্মেন্দ্রিয়, পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়, মন, বুদ্ধি, অহঙ্কার ও চিত্ত। এগুলি যখন ভগবানে সংন্যস্ত হয়, তখন দেহ সত্ত্বভাবে বা দেবভাবে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। এই ভাবটাই সপ্তাস্যেতিঃ পদে এ উপলব্ধ হয়]। [এর গেয়গানের নাম–বিষমাণানি ত্ৰীণি]।
৮। দ্যাবাপৃথিবীর অভ্যন্তরে সর্বত্র বর্তমান অর্থাৎ বিশ্বব্যাপী, মেধাবী অথবা অশেষ প্রজ্ঞাসম্পন্ন সত্যস্বরূপ অথবা অর্চনাকারিদের সৎপথে নয়নকর্তা, সৎকর্মের ফল-রূপ রত্নধারণকারী অথবা মোক্ষফল-রূপ শ্রেষ্ঠ রত্নের ধারক ও পোষক, সকলের প্রীতির সামগ্রী অথবা সকলের প্রতি প্রীতিসম্পন্ন–নিখিল বিশ্বের প্রতিস্থানীয়, মননযোগ্য অথবা অর্চনাকারিদের সুমতিবিধায়ক, ক্রান্তদর্শী (সর্বদর্শী) সেই প্রসিদ্ধ সবিতৃদেবকে (জ্ঞানপ্রেরক দেবতাকে) প্রকৃষ্টরূপে অর্চনা করি অর্থাৎ হৃদয়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করি। (এই মন্ত্রাংশ সঙ্কল্পমূলক এবং আত্ম-উদ্বোধনসূচক)। যে সবিতৃদেবের (জ্ঞানদেবতার) অপরিমেয় অর্থাৎ সর্বপ্রকাশশীল দীপ্তি বা জ্ঞানকিরণ (নিখিল সৎ-ভাবের জননের নিমিত্ত) গগনাভিমুখী অর্থাৎ সাধকদের উচ্চ-হৃদয়াভিমুখী হয়ে, সকল বস্তুকে দীপ্তিশালী করে অর্থাৎ ইহজগতে সত্ত্বভাব ইত্যাদি উৎপন্ন করে; জ্ঞানপ্রদ অর্থাৎ হিরণ্য-সদৃশ জ্ঞানধনপ্রদানে মুক্ত হস্ত, শোভনক্রতু-সম্পন্ন অথবা সৎকর্মমণ্ডিত সেই সবিতৃদেব, লোকসমূহের হিতসাধনে অসীম শক্তিসম্পন্ন হন, অর্থাৎ কল্পনায়ও তার শক্তির শেষ জানা যায় না। (এই মন্ত্রাংশে ভগবানের গুণ এবং তার স্বরূপ পরিব্যক্ত হয়েছে)। [এই মন্ত্রটি যজুর্বেদেও দৃষ্ট হয়। সেইসঙ্গে আরও যে তিনটি মন্ত্র আছে, ভাষ্যমতে সেগুলি সবই সোম-সম্বোধনে প্রযুক্ত। সেখানেও প্রকাশ, শেষভাগ গ্রহণ করে, তৃতীয় মন্ত্রে, সোমকে উষীষের দ্বারা বন্ধন করবার বিধি আছে। তাতে মন্ত্রে অর্থ দাঁড়িয়েছে–হে সোম! প্রজাগণের উপকার জন্য তোমাকে বন্ধন করি। কিন্তু প্রকৃত অর্থে সকল পদের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচারে বোঝা যায়, এই মন্ত্র যেন বলছেনভগবান্ প্রজ্ঞানের স্বরূপ, সৎকর্মমণ্ডিত। সুতরাং হে মানব! তুমিও জ্ঞানের দ্বারা পরিচালিত হয়ে সৎকর্মের অনুষ্ঠান কর। জ্ঞানমিশ্রিত সকর্মেই ভগবান্ পরিতুষ্ট। তাই উপদেশ, তিনি যেমন প্রজ্ঞানস্বরূপ, তেমনই প্রজ্ঞানসম্পন্ন হও। তিনি যেমন সৎকর্মমণ্ডিত, তুমিও তেমনই সৎকর্মপর হও। হও–জ্ঞানবান, হও–সৎকর্মের সাধক; সঞ্চয় কর জ্ঞান-কিরণ, সম্পন্ন কর সৎকর্ম। তাহলেই প্রজ্ঞানরূপী সৎকর্মর্মণ্ডিত ভগবানের করুণাকণা-লাভে সমর্থ হবে, তাহলেই তোমার, গতিমুক্তির পথ সুগম হয়ে আসবে]। [এর গেয়গানের নাম–সবিতুঃ সাম। যজুর্বেদ সংহিতায় এই মন্ত্রটি দৃষ্ট হয়]।
৯। দেবগণের আহ্বানকারী অর্থাৎ দেবভাবসমূহের জনক, অতিশয়িতরূপে দানবন্ত অর্থাৎ পরমধন প্রদাতা, সকলের নিবাসহেতুভূত, সকল শক্তির আধার অর্থাৎ সৎকর্ম-সাধন-সামর্থ্য প্রজননকারী, তত্ত্বদর্শী আত্ম-উৎকর্ষসম্পন্ন সাধকের ন্যায় সর্বতত্ত্বজ্ঞ, প্রজ্ঞানস্বরূপ ভগবানকে স্তুতি করি। পূর্বোক্ত প্রভাবসম্পন্ন সেই ভগবান, সৎকর্মসমূহে বিশেষভাবে উদ্বোধিত করবার জন্য, সাধক-হৃদয়ে শক্তি সামর্থ্য উৎপাদন করেন। এবং সেই ভগবান্ প্রদীপ্ততেজষ্ক জ্ঞানভক্তি-সহযোগে দীয়মান ভগবৎ সম্বন্ধযুক্ত শুদ্ধসত্ত্বের অনুক্রমে গ্রহীতা হন অর্থাৎ গ্রহণ করেন। (ভাব এই যে, ভগবানের অনুসরণ জ্ঞানপ্রাপ্তিমূলক। এই জন্যই সাধুগণ সৎ-জ্ঞানলাভের জন্য ভগবানকে আরাধনা করেন। তাদের পদাঙ্ক: অনুসরণে আমরা যেন জ্ঞানার্থী হই। হে ভগবন! আমাদের জ্ঞানসম্পন্ন করুন; তাতে আমাদের মধ্যে পরমার্থের সমাবেশ হোক)। [অগ্নি–প্রজ্ঞানস্বরূপ ভগবান্। ভগবান্ সকল শক্তির আধার। তার শক্তিমত্তার তুলনা নেই। তার বিভূতিস্বরূপ এই অগ্নিদেবতার শক্তিমত্তার পরিচয় যেমন রয়েছে জড়জগতে, তেমনি এর পরিচয় রয়েছে অধ্যাত্ম-জগতেও। বাষ্পীয় যান, বাষ্পীয় পোত, তাড়িত এ শক্তি, বিমান-বিহার প্রভৃতিতেও যেমন তার শক্তির নিদর্শন মেলে, তেমনি আত্মজ্ঞানসম্পন্ন জনগণের ও এ পরমপদ-প্রাপ্তিতে–অধ্যাত্মজগতেও সে পরিচয় বিদ্যমান। ফলতঃ কি আত্মতত্ত্ব-লাভের পথে, কি কর্মসাফল্যের জন্য আবশ্যকানুরূপ জ্ঞানের প্রয়োজন]। [ঋগ্বেদে এই মন্ত্রের কিছুটা পাঠান্তর দেখা যায়। এই সামমন্ত্রের গেয়গানের নাম–ভারদ্বাজে দ্বে, অবভৃথং সাম এবং প্রবগ্ন্যং সাম]।
১০। পরমৈশ্বর্যশালিন্ হে ভগবন! আপনি লোকসমূহের পরমানন্দদায়ক অথবা সৎকর্মে প্রবর্তক হন; অতীত-বর্তমান সর্বকালেই বিদ্যমান আপনার সম্বন্ধি আপনার মহিমাব্যঞ্জক পতিত-উদ্ধারণের জন্য শত্রুনাশের দ্বারা সৎ-ভাবের জননরূপ কর্ম (অথবা অজ্ঞানতার নাশে জ্ঞানের উন্মেষণ) সকল লোকে প্রশংসিত হয়। (ভাবার্থ-ভগবানের মহিমা সর্ববিদিত)। সেই ভগবান্ আপনার বলের দ্বারা দেবভাব সমূহের অবরোধক অজ্ঞানতামস বিদূরিত করে (সাধকগণের হৃদয়ে) সত্ত্বভাব-প্রবাহ প্রকৃষ্টরূপে প্রেরণ করেন। (ভাবার্থ-ভগবানের অনুগ্রহেই হৃদয়ে সত্ত্বভাব উপজিত হয়)। তারপর সেই ভগবান্ সর্বব্যাপী তমোরূপ অসুরকে বলের দ্বারা অভিভূত করেন; এইভাবে শত্রনাশে হলে সর্বকর্মাধার ভগবান্ সাধকদের মধ্যে সৎকর্মসাধন-সামর্থ্য প্রেরণ করেন এবং তাদের অভীষ্ট পূরণ করেন। (ভাব এই যে, -হে ভগবন! আমাদের শত্রু-সম্বন্ধ থেকে বিচ্ছিন্ন করুন অর্থাৎ কাম-ক্রোধ ইত্যাদি, পাপ, অজ্ঞানতা ইত্যাদি এবং ব্যাধি ও ভৌতিক আক্রমণ থেকে রক্ষা করুন; এবং জ্ঞানভক্তি সহযুত সত্ত্বভাবসম্পন্ন করে আমাদের পরমধন প্রদান করুন)। [উপসংহারে ভগবানের অশেষ মাহাত্ম্য কীর্তিত হচ্ছে। তারই অনুগ্রহে যে জগতের পরম কল্যাণ সাধিত হয়, এখানে তা বিঘোষিত হচ্ছে। স্রষ্টা, সৃষ্টি ও সৃষ্ট-সামগ্রী যে সেই মহৎব্রহ্মে পর্যবসিত এবং সবই যে তারই বিভিন্ন অভিব্যক্তি, মন্ত্রের মধ্যে এই তত্ত্বই ব্যাখ্যায়িত হয়েছে। উল্লেখনীয়–এই মন্ত্রের সাথে দেবাসুরের সংগ্রামের কল্পনা করে দেবস্য পদে অসুরস্য অর্থ নেওয়া হয়েছে। পণ্ডিতদের মতে, দেব শব্দ বেদে অসুর বোঝাতে প্রযুক্ত হয়ে থাকে। এখানে অদেবং পদে তমোরূপ অসুরকেই নির্দেশ করা হয়েছে। আবার ঐ পদের ভগবৎ-সম্বন্ধ বিরোধী সব রকম অনাচার বা ধর্মহীনতা অর্থও নিষ্পন্ন হতে পারে। যা দেবভাবের বিরোধী, যা ধর্মবিরুদ্ধ–ভগবৎ-প্রাপ্তির অন্তরায়-স্বরূপ, তা-ই অদেবং। এইভাবে মন্ত্রের প্রার্থনা হয়–আমাদের অন্তঃশত্রুর নিপীড়ন থেকে মুক্ত করে আমাদের মুক্তিদান করুন। পতিত আমরা; আপনার চরণে শরণ নিচ্ছি। আপনি কৃপা করে সদয় হোন]। [এর গেয়গানের নাম–ঐষং সাম]।
—চতুর্থ অধ্যায় সমাপ্ত–