সমুদ্রতীরে – উপন্যাস – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
জানলা দিয়ে একবার বাইরে তাকিয়ে মনে হল, এখন আর ঘরে বসে থাকার কোনও মানে হয় না। বিকেল শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু আকাশের আলো মিলিয়ে যায়নি।
আজ সারা দুপুর বইয়ের পাতায় ডুবে ছিলাম। এক-এক দিন পড়াশোনায় খুব মনে বসে যায়, এক-এক দিন কিছুটা অস্থির ভাব থাকে। আজ খুব বেশি হাওয়া ছিল না, গরমও ছিল না। বই পড়তে পড়তে আজ একবারও খেয়াল হয়নি যে কাছেই একটা সমুদ্র আছে।
বেরুবার আগে জানলা দুটো মনে করে বন্ধ করে দিতে হয়, নইলে হাওয়ায় সব উড়িয়ে নিয়ে যায়। টেবিলের ওপর গোটা চারেক কলা পড়ে আছে, খোসার ওপর কালচে কালচে ছোপ পড়েছে। এগুলো ফেলে দেওয়াই ভাল। আমি কলা তেমন একটা ভালবাসি না, তবু কিনেছিলাম অসম্ভব সস্তা বলে। ছ’খানা মর্তমান কলার দাম মাত্র এক টাকা।
কলাগুলো হাতে নিয়ে বেরুতে গিয়ে আমি একটু হাসলাম। মানুষ একা একা নিজের কাছেও মিথ্যে বলে! শুধু সস্তা বলেই কি আধ ডজন কলা কিনেছিলাম? না, তা ঠিক নয়।
কিশোর কলা বিক্রেতাটি এসে বসেছিল বিচের ওপর। সমুদ্রের ঢেউয়ের আওয়াজকেও ছাড়িয়ে সে তীক্ষ্ণকণ্ঠে চিৎকার করছিল, কেলা, কেলা, কেলা! আস্তে আস্তে ছোটখাটো একটা ভিড় জমে গেল তাকে কেন্দ্র করে। আমি তখনও যাইনি, বসেছিলাম তটরেখার একেবারে ধার ঘেঁষে। চমৎকার রোদ-ঝকঝকে সকাল। খুব জোর হাওয়া তখন। এ-রকম প্রবল হাওয়ায় মেয়েরা শাড়ি সামলাতে খুব বিব্রত হয়ে পড়ে, দেখতে বেশ লাগে।
সেই মেয়েটি, তার নাম চন্দ্রা, সে-ও দাঁড়িয়েছিল কলাওয়ালার সামনে। তার সবুজ রঙের শাড়ির আঁচলটা উড়ছিল পত পত করে। সকালবেলার পক্ষে বড় বেশি উজ্জ্বল রঙ তার শাড়ির। তবে ওরা ওই রকমই বেশি রঙচঙে, ঝলমলে পোশাক পরে, সকালবেলাতেও প্রসাধন না করে বাইরে বেরোয় না।
চন্দ্রা এক হাতে ধরেছিল উড়ন্ত আঁচল, অন্য হাতে এক থোকা কলা। থোকা কথাটা বোধহয় ঠিক হল না, ফুলের থোকা হয়, কলার কি হয়? সবুজ শাড়ি পরা চন্দ্রার হাতে সেই নিখুঁত হলুদ রঙের কলাগুলো ফুলের মতোই দেখাচ্ছিল। রঙের সেই সমন্বয় আমার পছন্দ হল। সেই দৃশ্যটার কাছাকাছি যাওয়ার জন্যই আমার কলা কেনার কথা মনে হয়েছিল। আমি চন্দ্রার একেবারে পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম।
চন্দ্রার সঙ্গে সেই আমার শেষ দেখা।
বাইরে এসে কলাগুলো ফেলতে গিয়েও মনে হল, এখনও ঠিক পচেনি, শুধু শুধু নষ্ট না করে খেয়ে নিলেও তো হয়। একটা খোসা ছাড়িয়ে খানিকটা মুখে দিয়েই ফেলে দিলাম থুঃ থুঃ করে। পচে যায়নি বটে কিন্তু বেশি মজে গেছে, তলতলে ভাব, এই স্বাদটা আমার ঘোরতর অপছন্দ। নাঃ, খাওয়া যাবেনা।
অনেক সময় কাছাকাছি ভিখিরিরা ঘুর ঘুর করে। তাদের কারুকে দিয়ে দেওয়া যেত। এখন কেউ নেই।
চন্দ্রাকে আমি বলেছিলাম, আমার জন্য কয়েকটা বেছে দাও তো।
চন্দ্রা নিজের হাতে এই কলাগুলো তুলে দিয়েছিল। আমি তার হাতের আঙুল ও স্বর্ণাভ মুখখানা দেখছিলাম।
তিন দিনেই কলাগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। ছুঁড়ে ফেলে দিলাম বালির ওপর। তারপর আবার এগিয়ে গিয়ে সেগুলো তুলে একটুখানি ডান দিকে যেতে হল। সেদিন ঠিক এই জায়গায় বসেছিল কলাওয়ালাটি। বালির ওপর কারুর পায়ের ছাপ থাকে না, কিন্তু চন্দ্রা কোথায় দাঁড়িয়েছিল, তা আমার স্পষ্ট মনে আছে। সেখানেই ফিরিয়ে দিলাম কলাগুলো।
.
০২.
সমুদ্রে সূর্যাস্ত আমার দেখতে ভাল লাগে না। বড় বেশি জমকালো। ক্যালেন্ডারের ছবির মতো। বরং সূর্য ডুবে যাবার পর যে কিছুক্ষণ মধুর-বিষণ্ণ আলো, তখনকার আকাশের দিকে চোখ চলে যায়। এই আলোটা গায়ে মাখলেও বেশ আরাম বোধ হয়।
এরপর অন্ধকার হয়ে গেলে ঢেউয়ের ফণাগুলো জ্বলবে। গোপালপুরে আমি যতবার এসেছি, রাত্তিরের দিকে ঢেউয়ের মাথায় ফসফরাস জ্বলতে দেখেছি। মাইকেলের সেই লাইনটা মনে পড়ে যায়, কী সুন্দর মালা আজি পরিয়াছ গলে, প্রচেতঃ…। মাইকেলের আসল লাইনটা ছিল সমুদ্রের প্রতি বিদ্রুপের, এখানে সেটা প্রশস্তি হয়ে যায়।
চটি খুলে রেখে আমি জলে পা দিলাম। ঢেউ এসে পায়ের ওপর ঝাপটা মারে, আবার সরে যায়। এই সময় নিজেকে বেশ রাজা রাজা মনে হয়। এত বড় সমুদ্র, সে আমার পায়ে এসে লুটোচ্ছে। আমার পাদবন্দনা করে যাচ্ছে।
একজন ভদ্রলোক এই অসময়ে জাঙিয়া পরে স্নানে নামছেন। আমার পাশ দিয়ে খানিকটা জলের মধ্যে এগিয়ে গিয়েও আবার ফিরে এসে জিজ্ঞেস করলেন, আর কিছু শুনলেন?
আমি দু’দিকে ঘাড় নাড়লাম।
এখন আর এখানে দাঁড়াবার কোনও মানে হয় না। এক জন মাঝবয়সি পুরুষের স্নানের দৃশ্য কে দেখতে চায়?
সাদা ফেনা মাড়িয়ে মাড়িয়ে আমি হাঁটতে লাগলাম ডান দিকে। কিছু কিছু মানুষজন বসে আছে বালির ওপর। অনেকেরই মুখ চেনা। আকাশ শুষে নিচ্ছে শেষ আলো, মুখগুলো অস্পষ্ট হয়ে আসছে।
হঠাৎ খেয়াল হল, আমি পাম বিচ হোটেলের দিকে যাচ্ছি কেন? উলটো দিকে জেলেদের বস্তির দিকে গেলে ভাল হত। কিন্তু এদিকে চলে এসেছি অনেকটা।
পাজামার ওপর পাঞ্জাবি গলিয়ে বেরিয়ে পড়েছি, পকেটে হাত দিয়ে দেখলাম, টাকা-পয়সার খামটা রয়েছে। আমার মানি ব্যাগ বা যাকে পার্স বলে, তা ব্যবহার করার অভ্যেস আজও হল না। পাম বিচ হোটেলে গিয়ে চা খাওয়া যেতে পারে, ওরা চিকেন প্যাটিসও খুব ভাল বানায়। কিন্তু ওখানে গেলে সিনেমার লোকজনদের সঙ্গে দেখা হবেই, তাদের সঙ্গে গল্প করতে হবে।
কিংবা তাদের সঙ্গে গল্প করার লোভেই কি আমি এ-দিকে চলে এসেছি? কৌতূহল আমাকে টেনে এনেছে?
আমি গোপালপুর পৌঁছবার পর দিন তিনেক জায়গাটা বেশ নিরিবিলি ছিল। এখানে কোনও তীর্থস্থান নেই, কখনও খুব বেশি ভিড় হয় না, সেটাই গোপালপুরের বৈশিষ্ট্য।
এখানে এসে আমি কখনও হোটেলে উঠি না। অনেক কটেজ ভাড়া পাওয়া যায়। খুব ছেলেবেলায় যখন প্রথমবার আসি, তখন প্রচুর অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান দেখেছি। আমার শৈশবের চোখে তারা ছিল সাহেব-মেম। বুড়োবুড়ি অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা এখানে বাড়ি বানিয়ে শেষ জীবন কাটাত, একখানা দু’খানা ঘর ভাড়া দিত। এখন তারা আর নেই।
অনেক বাড়ির ধ্বংসস্তূপ চোখে পড়ে। দেয়াল ভাঙা, জানালা-দরজা নেই। কোস্ট লাইন খানিকটা এগিয়ে এসেছে, জোয়ারের সময় প্রথম সারির অনেক বাড়িতে ছলাত ছলাত করে ঢেউ ধাক্কা মারে।
আমি একটা পুরো বাড়িই ভাড়া নিয়েছি, কারণ একা থাকাই আমার উদ্দেশ্য। যখন ইচ্ছে হবে না, কারুর সঙ্গে কথা বলব না, কোনও মানুষের মুখও দেখব না। রান্নাবান্নারও ঝামেলা রাখিনি। বেশ কাছেই একটা গেস্ট হাউস রয়েছে। গোটা ছয়েক পরিবার থাকার মতো, সেখানে বললেই চা থেকে সব কিছু পাঠিয়ে দেয়। একটি তেলেঙ্গি স্ত্রীলোক দু’বার আমার ঘর ঝাঁট দিয়ে, খাবার জল তুলে দিয়ে যায়। তার স্বামীই বাড়িটির কেয়ারটেকার। স্বামীটি মাছ ধরার নৌকো নিয়ে চলে যায় সমুদ্রের অনেকখানি গভীরে।
তিন দিন পর সিনেমার বিরাট দলটি এসে উঠল পাম বিচ হোটেলে। তাদের সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই, হোটেলটাও বেশ দূরে, তবু বেশ বিরক্ত বোধ করেছিলাম আমি। তারা যে খুব একটা হই-হট্টগোল করে, তা-ও না। কিন্তু এই ছিমছাম নিরিবিলি জায়গায় এক সঙ্গে অনেক লোক এসে পড়েছে, যখন তখন গাড়ি হাঁকিয়ে তারা ঘোরাঘুরি করছে। এটাই যেন অসহ্য বোধ হয়।
সিনেমার শুটিঙের মতো বিরক্তিকর জিনিস আমি কখনও দেখতে যাই না। মনে আছে, একবার থাকতে গিয়েছিলাম চিল্কার এক গেস্ট হাউসে। খুবই সুন্দর পরিবেশ। কিন্তু হঠাৎ পরদিন সেখানে শুরু হল একটা তামিল ফিলমের শুটিং। একটা গান বাজানো হচ্ছে, যুবতীটি বার বার নাচতে শুরু করছে, আর পরিচালক হেঁকে উঠছে, কাট, কাট! একই গান, একই নাচ, শুরু হচ্ছে আর থামছে, এই রকম চলল ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সেই দিনই বিকেলে আমি পালিয়েছিলাম চিল্কা থেকে।
এখানেও এক দিন শুটিং হচ্ছিল আমার বাড়ির খুব কাছেই। আমার দেখতে যাওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই। এরা অবশ্য মাইকে গান-টান কিছু বাজাচ্ছে না, জলের ধারে প্রেমালাপের দৃশ্য, তারপর স্নান। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আমি একবার শুটিং পার্টিটা দেখেই জানালা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। কিন্তু তারপর আর কিছুতেই লেখাপড়ায় মন বসেনা। জানলা বন্ধ, তবু যেন আমি দেখতে পাচ্ছি ক্যামেরা, লোকজন, নায়ক-নায়িকা। সে এক মহা জ্বালা।
পরদিন আমি দুপুরে স্নান করতে নেমেছি, তখনই আবার কাছাকাছি এসে উপস্থিত হল সিনেমার দলবল।
সে-দিন আবার জলের মধ্যে মারামারির দৃশ্য। ওরা অন্য লোকজনদের সরিয়ে দিচ্ছে। আমি বেশ রেগে গিয়ে রোঁয়া ফোলাচ্ছি। আমাকে একবার সরে যেতে বলুক না, দেখিয়ে দেব মজা। আমি স্নান করতে এসেছি, আমার যখন ইচ্ছে উঠব। এই সমুদ্রটা সিনেমার লোকদের বাবার সম্পত্তি নয়। ওরা ফাঁকা জায়গায় যাক না!
কিন্তু ঘটনাটা সম্পূর্ণ অন্য রকম হয়ে গেল।
সাদা টুপি পরা এক জন লোক আমার দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, আরে, সুনীলবাবুনা? কবে এসেছেন আপনি?
সঙ্গে সঙ্গে রাগের বদলে আমাকে পেয়ে বসল একরাশ লজ্জা। এখন মেয়েদের সামনে দিয়ে আমাকে খালি গায়ে উঠতে হবে।
.
০৩.
পাম বিচ হোটেলের আলো দেখা যাচ্ছে, ওখানে যাব কি না এখনও মনস্থির করতে পারছি না। এক-একসময় মানুষের সংসর্গের জন্য মন আনচান করে, তবু মানুষের কাছাকাছি যেতে ইচ্ছে করে না। মুখটা ফেরাতেই চমকে উঠলাম। শুধু চমক নয়, বুকটা ধক করে উঠল। ঠিক ভয়ের অনুভূতি।
একটা ডিঙি নৌকোর গলুইয়ের কাছে বসে আছে একটি মেয়ে। কালো রঙের শাড়ি পরা। কিংবা শাড়ির রঙ গাঢ় নীলও হতে পারে। মুখটা জলের দিকে, আমি দেখতে পাচ্ছি না।
প্রথমে মনে হয়েছিল চন্দ্রা, এবং সেই জন্যই ভয় পেয়েছিলাম। অথবা চন্দ্রা হতেই পারে না। চন্দ্রা যদি ফিরে আসে কোনওক্রমে, তাহলে কি আমি ভয় পাব?
অবিকল চন্দ্রার মতো ভঙ্গিমায় এখানে এখন কে বসে থাকতে পারে? এই দৃশ্যটার মধ্যে বেশ অস্বাভাবিকতা আছে। প্রায় অলৌকিকের কাছাকাছি। এই সব ব্যাপারে আমার বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই, তবু বুক তো কেঁপে উঠল একবার।
আমি এতখানি রাস্তা হেঁটে আসছি, নৌকোগুলোতে আগেই দেখেছি, কেউ ছিল না। মেয়েটি হঠাৎ কী করে এল? ঠিক আছে, ধরা যাক, ওর নীল রঙের শাড়ি অন্ধকারে মিশে গেছে বলে ওকে আমি আগে দেখতে পাইনি। তাহলেও সন্ধের পর কোনও মেয়ে তো এখানে এমন ভাবে একা বসে থাকে না। স্থানীয় মেয়ে নয়, কোনও জেলের বউ নয়, মেয়েটির দু’হাঁটু জড়িয়ে বসে থাকার ভঙ্গির মধ্যেই একটা শহুরে ছাপ আছে।
তীব্র কৌতূহল আমাকে টেনে রেখেছে, জায়গাটা ছেড়ে নড়তে পারছি না। হাওয়া বাঁচিয়ে একটা সিগারেট ধরালাম।
নৌকোগুলোর তলায় জলের ছলাত ছলাত শব্দ হচ্ছে, জল বাড়ছে। শুরু হয়েছে জোয়ার। যে নৌকোগুলি অর্ধেক বালির ওপর ওঠানো থাকে, জোয়ারের সময় সেগুলোই অনেকখানি জলের মধ্যে চলে যায়। মেয়েটি কি তা জানে না?
তিন দিন আগে সন্ধের সময় চন্দ্রাও এ-রকমভাবে বসে ছিল একটা নৌকোয়।
কাছাকাছি আর কোনও মানুষজনের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না, একটি মেয়েকে দেখে আমি থমকে গিয়ে সিগারেট টানছি, এটা বেশ বিসদৃশ ব্যাপার।
তবু আমার মনে হল মেয়েটিকে সাবধান করে দেওয়া উচিত। আমি একটু গলা খাঁকারি দিয়ে এগুতেই মেয়েটি নেমে পড়ল নৌকো থেকে। আমার উপস্থিতি সে টের পেয়েছে কিনা বোঝা গেল না, একবারও তাকাল না পেছন ফিরে, সোজা হাঁটতে লাগল জলের ধার ঘেঁষে।
এরপর আর মেয়েটিকে অনুসরণ করা যায় না। তবু আমি তাকিয়ে রইলাম সেই অপস্রিয়মাণ নারীর দিকে। মেঘলা আকাশ, চাঁদ দেখা যাচ্ছে না, তবু আকাশের কিছুটা নিজস্ব আলো আছে। এক সময় মেয়েটি কি জলে নামতে শুরু করল না। অন্ধকারে মিলিয়ে গেল? স্পষ্ট মনে হল, মেয়েটি সমুদ্রে নেমে যাচ্ছে, হাঁটু জল ছাড়িয়ে বুকজলে, তারপর ডুব দিল, আর উঠল না।
আমি সে-দিকে ছুটে যাবার জন্য উদ্যত হয়েও থেমে গেলাম। এ-সব কী ছেলেমানুষি করছি আমি একটা মেয়ে সত্যি সত্যি জলের মধ্যে নেমে মিলিয়ে যেতে পারে? জলকন্যা? ভূত? যতই অবিশ্বাস করি, তবু ভেতরে ভেতরে কিছু সংস্কার রয়েই গেছে। ও-সব কিছু না! ও-দিকটায় খানিকটা কুয়াশা জমেছে। মেয়েটি কুয়াশার আড়ালে চলে গেল। তাছাড়া আর কিছুই হতে পারে না।
নিজের এ-রকম দুর্বলতায় নিজের ওপর চটে গেলাম খুব। এই অবস্থায় আর কারুর সঙ্গে আড্ডা দিতে যাওয়া যায় না। অন্যদের কাছেও আমার দুর্বলতা ধরা পড়ে যেতে পারে।
.
০৪.
রবীন ঘোষ যে একজন পুলিশ অফিসার, সে-কথা তিনি আমার কাছে একবারও গোপন করেননি। যদিও অন্য আর কেউই বোধহয় তা জানে না। ভদ্রলোক এখানে সপরিবারে ছুটি কাটাতে এসেছে। ওর স্ত্রীর কিছু একটা অসুখ আছে। যদিও ওঁর স্ত্রী প্রতিমা বেশ বিদূষী ও পরিচ্ছন্ন চেহারার মহিলা, কথাবার্তায় কোনও আড়ষ্টতা নেই, অসুস্থ বলেও বোঝা যায় না। ওঁদের সঙ্গে দশ বছরের মেয়েও এসেছে, বড় ছেলে হস্টেলে থাকে।
রবীন ঘোষ ইংরিজি সাহিত্যের খুব ভক্ত। দুর্গাপুরে কোনও একটি সভায় উনি আমাকে দেখেছিলেন, সামান্য পরিচয়ও হয়েছিল, আমার অবশ্য সে-কথা একেবারেই মনে নেই। আমি পুরুষদেব মুখ মনে রাখতে পারি না। এখানে ওঁরা উঠেছেন পাশের গেস্ট হাউসে, এক দিন নিজে থেকেই আলাপ করেছিলেন আমার সঙ্গে।
প্রথমেই আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, এখানে আপনি কিছু লিখতে এসেছেন বুঝি? নতুন উপন্যাস?
আমি উত্তর না দিয়ে হেসেছিলাম। লোককে বোঝানো শক্ত। লেখার জন্য আমাকে কলকাতার বাইরে যেতে হয় না। নির্জনতাও খুঁজতে হয় না। নিজের বাড়িতে কিংবা অফিসে নানান গোলমাল, হইচই, লোকজনের আসা-যাওয়া, দরজার বেল, টেলিফোনের যখন তখন ঝঙ্কার, স্ত্রীর সঙ্গে কথা কাটাকাটি, বাজার করা, নাটকের রিহার্সাল দেওয়া, এর মধ্যেও দিব্যি লেখা এগিয়ে চলে। কিন্তু কখনও কখনও আমার না-লেখা নিজস্ব সময় দরকার। লেখার থেকে পুরোপুরি ছুটি নেবার জন্যই নির্জনতা খুঁজি। যখন এই রকম বাইরে চলে আসি একা, সঙ্গে কাগজ কলমও রাখি না। কেউ বিশ্বাস করবে না যে আমি এক জন লেখক বটে, কিন্তু আমার কোনও কলম নেই।
গেস্ট হাউসে আমার খাবারের কথা বলতে গেলে রবীন ঘোষ আমাকে ধরে ফেললেন।
উনি অবশ্যই একেবারেই জোর করেন না, কথা বলেন খুব মৃদু গলায়। বললেন, আসুন, ওপরে গিয়ে একটু বসা যাক। পরে এক সময় খেয়ে নিলেই হবে।
গেস্ট হাউসটি দো-তলা। রবীনবাবুরা একটা সুন্দর সুইট পেয়েছেন। শোবার ঘরের সংলগ্ন একটা বেশ চওড়া বারান্দা, সেখানে বসলে সমুদ্রের সম্পূর্ণ বিস্তার দেখা যায়।
প্রতিমা আগে থেকেই সেখানে একটা বেতের চেয়ারে বসে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে গুন গুন করে গান গাইছিলেন।
এ-সব ক্ষেত্রে ভদ্রতা করে বলতে হয়, থামলেন কেন? আপনার তো বেশ ভাল গলা। গানটা করুন।
প্রতিমা তবু গান থামিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে হেসে বললেন, কিছু কিছু গান থাকে একলা গাইবার। ও আপনাকে নিশ্চয়ই গল্প করার জন্য টেনে এনেছে, বউয়ের গান শোনাবার জন্য নয়।
আমি আর জোর করলাম লা। সত্যিই তো কিছু কিছু গান মানুষ শুধু নিজেকে শোনাবার জন্যই গায়।
রবীনবাবু আমাকে ডেকে আনায় খুশিই হয়েছি। আমি মানুষের সঙ্গ চাইছিলাম, কিন্তু নিজে থেকে কারুর কাছে যেতে পারি না, এটা আমার স্বভাবদোষ। কেউ ডাকলে মনে হয়, এই ডাকের প্রতীক্ষাতেই ছিলাম।
ওঁদের মেয়েটি বসবার ঘরে খুব মন দিয়ে পড়াশুনো করছে।
আমরা বারান্দায় বসার পর প্রতিমা একটা ছোট টেবল এনে রাখলেন, তারপর নিয়ে এলেন গেলাস, জলের জাগ ও হুইস্কির বোতল।
রবীনবাবু বললেন, নিচে ওদের বললে সোডা পাওয়া যেতে পারে।
প্রতিমা আমার দিকে তাকাতেই আমি বললাম, আমার সোডার দরকার নেই।
প্রতিমা তিনটি গেলাসে হুইস্কি ঢাললেন।
আগেই এক দিন লক্ষ্য করেছি যে ওঁকে মদ খাওয়াবার জন্য পিড়াপিড়ি করতে হয় না, উনি নিজেই নিজেরটা নিয়ে নেন। কিন্তু একবারই। মদ্যপান বিষয়ে ওঁর কোনও সংস্কার নেই, অথচ নেশাও করতে চান না।
দূরের অন্ধকার সমুদ্রের ঢেউগুলো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, কারণ তাদের মাথায় দুলছে ফসফরাসের মালা। বেশ দেখায়। এদিকে জাহাজ চলাচল করে কদাচিৎ। এক দিন শুধু একটা আলো ঝলমল জাহাজ দেখা গিয়েছিল এর মধ্যে। রাত্তিববেলা জাহাজ দেখার জন্য আমি ছেলেমানুষের মতো উৎসুক হয়ে থাকি।
রবীনবাবু বললেন, ওরা আজ থেকে আবার শুটিং শুরু করছে, জানেন তো?
কথাটা আমার একটা আঘাতের মতো লাগে। আবার শুটিং শুরু হয়ে গেছে? পরিচালক সন্তোষ মজুমদারের সঙ্গে আমার সকালেই একবার দেখা হয়েছিল, উনি তখন কিছু বলেননি।
রবীনবাবু বললেন, এখন ওরা হোটেলের মধ্যেই কিছু কিছু শট নেবে। পরশু থেকে আবার আউটডোর।
রবীন ঘোষ আর্ট ফিল্মের ভক্ত। পৃথিবীর নানা দেশের ভাল ভাল ফিল্মের খবরাখবর বাখেন। সেই জন্যই শুটিঙের ব্যাপারে ওঁর খুব উৎসাহ। যদিও সন্তোষ মজুমদার যে ফিলমের শুটিঙের জন্য গোপালপুরে এসেছেন, সেটা একটা রদ্দি গল্প। ওঁদের ধারণা, এই সব ছবি কমার্শিয়াল হিট করবে, আবার এইসব ছবিই রিলিজ করার পর দু-এক সপ্তাহের মধ্যেই উঠে যায়। সন্তোষ মজুমদার আমার একটা গল্প নিয়ে ফিরতে চেয়েছিলেন, প্রথমেই বলেছিলেন, আমি দাদা প্রাইজ-ফ্রাইজ পাওয়ার জন্য কিংবা ফরেনে যাবার জন্য সিনেমা তুলিনা, আমি চাই দর্শকদের খুশি করতে। বেশ কয়েক দিন আমার বাড়িতে যাওয়া-আসা করেছিলেন উনি, আমার কয়েকটি সকালের কাজ নষ্ট করলেন, এক হাজার টাকা অ্যাডভান্স দেওয়ালেন এক বাচ্চা প্রোডিউসারকে দিয়ে, তারপর হঠাৎ এক দিন সবাই অদৃশ্য, সে-ফিল্মের মহরতও হল না। সিনেমা জগতে এটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। সন্তোষ মজুমদার মানুষটিকে অবশ্য আমার খারাপ লাগে না, বেশ খোলামেলা, হাসিখুশি ধরনের, নিজের বোকামি কিংবা মূর্খতা চাপা দেবারও কোনও চেষ্টা নেই।
প্রতিমা বললেন, আমরা ভেবেছিলাম, ওরা বুঝি দলবল নিয়ে ফিরে যাবে। কিন্তু সিনেমা তোলা তো অনেক টাকার ব্যাপার, শুটিং বন্ধ করে দিলে প্রচুর ক্ষতি হয়ে যাবে। টাকার হিসেব করলে মানুষের সেন্টিমেন্টের কোনও দাম নেই।
রবীনবাবু বললেন, চন্দ্রার বডি এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। পুলিশ অবশ্য ম্যাড্রাস থেকে আরও দু’জন ডুবুরি আনাচ্ছে। তবে এর মধ্যে তিনটে জোয়ার-ভাটা হয়ে গেছে, এরপর বডি রিকভার করার আশা খুব কম।
প্রতিমা ধমক দিয়ে বললেন, অ্যাই। তুমি আবার পুলিশি ভাষায় কথা বলছ? তোমাকে এখানে ডিউটিতে পাঠানো হয়নি। তোমাকে বলেছি না, তুমি ওই নিয়ে একদম মাথা ঘামাবে না। এটা স্বর্গ নয়, তুমিও ঢেঁকি নও।
রবীনবাবু হেসে ফেলে বললেন, ডিউটি না করলেও সাধারণ কৌতূহল থাকবে না। এ-রকম একটা ঘটনা ঘটে গেল…এই যে সুনীলবাবু, ওঁরও কি কৌতূহল নেই? আচ্ছা সুনীলবাবু আপনি ঠিক করে বলুন তো, আপনার মতে, এটা খুন না আত্মহত্যা?
আমি বললাম, কী জানি, আমি এখনও কিছুই বুঝতে পারছি না।
রবীনবাবু বললেন, তবু মনে মনে একটা কিছু ধারণা তো তৈরি হয়। সেটাই বলুন না। আপনার মতামতের একটা মূল্য আছে।
আমি বললাম, কেন? আমার মতামতের আবার কীসের মূল্য?
রবীনবাবু বললেন, আপনি মানুষের চরিত্র স্টাডি করেন তো। সামারসেট মম তাঁর আত্মজীবনীতে কী লিখেছেন জানেন? লেখক, স্কুল মাস্টার আর ডিটেকটিভ, এদের মধ্যে একটা মিল আছে। এরা মানুষের চরিত্র ভাল বোঝে।
প্রতিমা বললেন, এখানে এক জন মাস্টারও রয়েছে।
রবীনবাবু বললেন, ও হ্যাঁ, তাই তো!
তখনই আমি জানলাম যে প্রতিমা একটি কলেজের অধ্যাপিকা। তিনি দর্শন পড়ান।
রবীনবাবু বললেন, তাহলে আমরা তিন জনে মিলে এই ঘটনা কিংবা দুর্ঘটনার একটা বিশ্লেষণ করতে পারি। পুলিশ হিসেবে এই তদন্তে আমার কোনও ভূমিকা নেই, কিন্তু এক জন সাধারণ মানুষ হিসেবে কৌতূহল তো থাকবেই। আচ্ছা সুনীলবাবু, আপনিই আগে বলুন, আপনার ইনটুইশন কী বলছে, এটা খুন না আত্মহত্যা?
আমি মাটির দিকে চেয়ে রইলাম। চন্দ্রাকে আমি ভাল করে চিনিই না। গোপালপুর আসবার আগে তার সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল না, কোনও ফিল্মেও তার অভিনয় দেখিনি। সন্তোষ মজুমদার আমার সঙ্গে চন্দ্রার পরিচয় করিয়ে দিলেন, সে-দিন পাম বিচ হোটেলে ফিল্ম ইউনিটের সঙ্গে আমাকে খেতে নেমন্তন্ন করা হয়েছিল। চন্দ্রা তখন বসে ছিল আমার ঠিক পাশে। চন্দ্রা এই ফিল্মের নায়িকা নয়, নায়কের ছোট বোন, এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নয়, তবে কাহিনির ভিলেন একবার তাকে কিডন্যাপ করবে, তারপর নায়ক এসে বীরত্ব দেখাবে। এই ফিল্মের নায়িকার চেয়ে কিন্তু চন্দ্রা অনেক বেশি রূপসী।
আমার পাশে বসেছিল বলেই চন্দ্রার সঙ্গে আমার ভাব জমে গিয়েছিল তাড়াতাড়ি। সে বই-টই পড়ে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে এমএ পাশ করেছে। তাছাড়া সে হাসতে জানে, সমস্ত মজার কথায় সে হেসে গড়িয়ে পড়ে।
যাদের রসবোধ আছে, যারা জীবনের উপভোগটাকে বেশি মূল্য দেয়, তারা কি আত্মহত্যা করে? আমি বললাম, চন্দ্রার মতো মেয়ে আত্মহত্যা করবে, এটা আমার কিছুতেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। সবেমাত্র তার ফিল্ম কেরিয়ার শুরু হয়েছে, সামনে ভবিষ্যৎ পড়ে আছে।
রবীনবাবু বললেন, বয়সটা তো অল্প, এই বয়সের মেয়েরা খুব ইমোশনাল আর ইমপালসিভ হয়, হঠাৎ ঝোঁকের মাথায় কিছু একটা করে ফেলতে চায়। এরমধ্যে আবার ব্যর্থ প্রেমের অ্যাঙ্গেল আছে কিনা, তা অবশ্য জানা যায়নি এখনও।
আমি বাধা দিয়ে বললাম, না না, ব্যর্থ প্রেম-ট্রেম…ফিল্মের মেয়েরা কি সে-সবের কোনও গুরুত্ব দেয়? চন্দ্রার ব্যবহারে আমি সেরকম কোনও ছায়া দেখিনি। নাঃ, আমার ঠিক বিশ্বাস হয় না। চন্দ্রা এমন প্রাণ খুলে হাসে, ঠিক ব্রুড করার টাইপই নয়।
প্রতিমা বললেন, আপনি চন্দ্রা সম্পর্কে পাস্ট টেন্স ব্যবহার করছেন না। আপনি এখন চন্দ্রার মৃত্যুটা মেনে নিতে পারেননি, তাই না?
আমি অন্ধকার সমুদ্রের দিকে তাকালাম। সন্ধেবেলা নৌকোর ওপর বসে থাকা নীল শাড়ি পরা রহস্যময়ীর কথা কিছুতেই এঁদের সামনে বলব না ঠিক করে ফেলেছি।
চন্দ্রার জলে-ডোবা শরীর কেউ এখনও দেখিনি। অমন সুন্দর একটি যৌবনবন্ত শরীর শেষ পর্যন্ত মাছেদের খাদ্য হল?
রবীনবাবু আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি ন্যাটালি উডের নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই? ন্যাটালি উডের ঘটনাটা জানেন?
আমি কিছু উত্তর দেবার আগেই প্রতিমা বললেন, ন্যাটালি আবার কী? মেয়েটির নাম নেটালি উড। ওয়েস্ট সাইড স্টোরির নায়িকা ছিল।
রবীনবাবু ঈষৎ ক্ষুণ্ণভাবে বললেন, আবার তুমি মাস্টারি শুরু করলে? আমিও যেমন এখানে পুলিশ অফিসার নই, তুমিও মাস্টারনি সাজতে পারবে না। বাঙালিরা ন্যাটালিই বলে। উচ্চারণের ব্যাপারে এত খুঁতখুঁতে হবার কী আছে? বিদেশিরা আমাদের নামের উচ্চারণ ভুল করে না?
আমি জিজ্ঞেস করলাম, নেটালি উড… সে-ও জলে ডুবে মারা গিয়েছিল না?
এক জন পুলিশ অফিসার হিসেবে রবীনবাবুর চলচ্চিত্র জগত সম্পর্কে জ্ঞান সত্যি বিস্ময়কর। তিনি হলিউডের চিত্রতারকাদের জীবনীর খুঁটিনাটিরও খবর রাখেন।
তিনি বললেন, লস এঞ্জেলস শহরে প্যাসিফিক মহাসাগর জেটি ঘাটে অনেক অল্পবয়সি ছেলে মেয়ে সার্ফিং করে, পালতোলা নৌকোও বাঁধা থাকে, অনেক লোকেরই প্রাইভেট বোট থাকে জানেন নিশ্চয়ই, আপনি তো ও-দেশে গেছেন, তাই না? আমি যাইনি অবশ্য, কিন্তু এত ছবি দেখেছি, তা ন্যাটালি..ওঃ, ন্যাটালি না, নেটালি উড একদিন শুটিঙের রিসেস-এর সময় কাককে কিছুনা জানিয়ে…ওর কী-রকম সুন্দর চেহারা ছিল মনে আছে? কিছুতেই যেন বয়েস বাড়ত না, রবার্ট রেডফোর্ডের সঙ্গে একটা ছবিতে নামল, তখনও ও নায়িকা, কী যেন নাম ছবিটার?
প্রতিমা বললেন, ‘দিস প্রপার্টি ইজ কনডেমন্ড’, টেনেসি উইলিয়ামের কাহিনি, পরিচালক সিডনি পোলাক।
আমি মুগ্ধভাবে প্রতিমার দিকে তাকালাম। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কেউ কারুর চেয়ে কম নয়!
রবীনবাবু বললেন, নেটালি উডের মনে কোনও ক্ষোভ থাকার কথা নয়, রূপ-খ্যাতি-অর্থ সবই আছে, তবু এক দিন শুটিঙের ফাঁকে সে চলে এল সমুদ্রের ধারে, চড়ে বসল একটা নৌকোয়, ভাসতে ভাসতে চলে গেল অনেক দূরে, গভীর সমুদ্রে, আর ফিরে এল না। অ্যাকসিডেন্ট হলেও হতে পারে, কিন্তু প্রায় সবাই আত্মহত্যা বলেই মেনে নিয়েছে।
প্রতিমা বললেন, নেটালি ড্রাগ অ্যাডিক্ট ছিল, সেই সঙ্গে বিয়ার খেত খুব। অনেকের ধারণা, সে নৌকায় মাতাল অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়ে, নৌকোটা বহু দূরে চলে যায়, আর ফিরতে পারেনি।
রবীনবাবু বললেন, চন্দ্রা ড্রাগ অ্যাডিক্ট ছিল কি না, সেটা খুঁটিয়ে দেখা দরকার। আজকাল ফিল্ম লাইনের অনেকে, শোনা যায় স্মিতা পাতিলও…।
আমি বললাম, না, চন্দ্রার ড্রাগের নেশা ছিল না।
রবীনবাবুঝট করে মুখ তুলে তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, আপনি কী করে জানলেন? এখানে আসবার আগে আপনার সঙ্গে পরিচয় হয়নি বলেছিলেন।
আমি বললাম, সেটা ঠিক, তবু ওই যে আপনি বললেন, মানব চরিত্র বোঝার ক্ষমতা? চন্দ্রার সঙ্গে দু’একদিন মিশেই, যে-কোনও মানুষের সঙ্গে খানিকটা মিশেই এ-সব বুঝতে পারি। চন্দ্রার টাইপটা ও-রকম ছিল না।
রবীনবাবু বললেন, উধাও হয়ে যাবার আগের দিন চন্দ্রা আপনার বাড়িতে এসেছিল। একা এসেছিল। আপনার কাছে নিশ্চয়ই সে অনেক কথা বলেছে।
প্রতিমা বললেন, আবার তুমি ওভাবে…ঠিক পুলিশি জেরার মতো কথা বলছ?
রবীনবাবু লজ্জা পেয়ে হেসে বললেন, আই অ্যাম সরি। অভ্যেস সহজে কাটানো যায় না। তাহলে সুনীলবাবু, আপনি বলছেন চন্দ্রা আত্মহত্যা করেনি?
আমি আস্তে আস্তে দু-দিকে মাথা নাড়ালাম। যদিও আত্মহত্যার চেয়ে খুন অনেক বেশি জঘন্য ব্যাপার।
প্রতিমা বললেন, চন্দ্রার অবশ্য ফাসট্রেশানের অনেক কারণ থাকতে পারে।
রবীনবাবু সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন। তবু জিজ্ঞেস করলেন, তুমি তা জানলে কী করে? তুমি কি চন্দ্রার সঙ্গে এক দিনও কথা বলেছ?
প্রতিমা বললেন, না, বলিনি। দূর থেকে দেখেছি। তবে পত্র পত্রিকা পড়ে আমি এই সব মেয়ের কেরিয়ার ফলো করি। একটি অল্পবয়সি মেয়ে মেল ডমিনেটেড ফিল্ম ইণ্ডাস্ট্রিতে কী করে আস্তে আস্তে ওপরে ওঠে, কীভাবে সেই মেয়েটিকে অন্যরা ব্যবহার করে, সেগুলো নোট করা আমার অভ্যেস। চন্দ্রার দুতিনটে ইন্টারভিউ আমি পড়েছি সস্তা সিনেমার কাগজে। ওর অনেক অভিযোগ। এ পর্যন্ত চন্দ্রা মোট আট-দশটা ফিল্মে অভিনয় করেছে, সবই ছোট ইনসিগনিফিকেন্ট রোল। কেউ এ পর্যন্ত ওকে ভাল সুযোগ দেয়নি। শিক্ষিত ভাল পরিবারের মেয়ে, ওর নিজস্ব রুচিবোধ ছিল, প্রোডিউসার ডিরেক্টরদের অন্যায় আবদার মেনে নেয়নি বলেই বোধহয় ও ভাল রোল পায়নি। তাছাড়া বেচারা সত্যজিৎ-মৃণাল-গৌতমের মতো কোনও বড় পরিচালকের নজরেও পড়েনি।
রবীনবাবু জিজ্ঞেস করলেন, তুমি চন্দ্রার অভিনয় কোন ফিল্মে দেখেছ? দেখোনি নিশ্চয়ই!
প্রতিমা বললেন, না, বাবা রক্ষে করো। এই সব বাংলা ন্যাকা ন্যাকা ছবি আমার একেবারেই সহ্য হয় না।
রবীনবাবু বললেন, আমিও আগে দেখিনি, তবে এই ছবির শুটিঙে আমি কয়েক জায়গায় উপস্থিত ছিলাম। চন্দ্রা দেখতে যে-রকম ভাল, চেহারায় যত চাকচিক্য, সেই তুলনায় অভিনয় প্রায় কিছুই জানত না, কেমন যেন কাঠপুতুলের মতো। সেই জন্যই পরিচালকরা ওকে ইমপর্টান্ট রোল দিতে চায় না, ওর শরীরটাকেই বেশি করে দেখায়। এই ছবিতে সন্তোষ মজুমদারও তো ওর এক-একটা সিন পাঁচ-ছ’বার করে টেক করতে হত বলে খুব বিরক্ত হয়ে যেতেন মাঝে মাঝে। শুনেছি উনি চন্দ্রার রোল খানিকটা ছেঁটে আরও ছোট করে দেবেন ভাবছিলেন।
প্রতিমা বললেন, এতে চন্দ্রার মন ভেঙে যেতে তো পারেই।
রবীনবাবু বললেন, ফিল্ম লাইনে এ-রকম স্ট্রাগল করতে হয় অনেককেই। হঠাৎ একটা ব্রেক আসে। এইটুকু ফ্রাসট্রেশানের জন্য কেউ আত্মহত্যা করে না।
ওঁদের মেয়ে টিনা পড়াশুনো শেষ করে উঠে এসে বলল, মা, তোমরা খেতে যাবে না? আমার কিন্তু খিদে পেয়েছে।
রবীনবাবু ব্যস্ত হয়ে বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, এবার খেতে যাব। তুই নিচে ডাইনিং রুমে গিয়ে অর্ডার দে তো আগে। এই সুনীল আঙ্কেলও আজ আমাদের সঙ্গে যাবেন।
প্রতিমা বললেন, তোমরা তাড়াতাড়ি শেষ করে নাও!
তারপর তিনি উঠে রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে চেয়ে রইলেন সমুদ্রের দিকে।
আস্তে আস্তে আপন মনে বললেন, যদি আত্মহত্যা করতেই হয় তাহলে নেটালি উডের মতোই। কী সুন্দর, আস্তে আস্তে একটা নৌকোয় ভেসে যাওয়া, দূরে, গভীর সমুদ্রে, চারপাশে আর কেউ নেই, কেউ আমাকে দেখতে পাবে না, যেন প্রকৃতির মধ্যে হারিয়ে যাওয়া।