1 of 3

১.৪৮ নতুন বাড়ি ঠিক হলো কালীঘাটে

অনেক খোঁজাখুঁজির পর শেষ পর্যন্ত নতুন বাড়ি ঠিক হলো কালীঘাটে। শহরের একেবারে উত্তর প্রান্ত থেকে দক্ষিণে। ছোট একটি একতলা বাড়ি, খুবই পুরোনো যদিও, কিন্তু আর কোনো ভাড়াটে নেই, এটা একটা মস্ত বড় সুবিধে। বাড়ির মালিক একজন অবসরপ্রাপ্ত উকিল, বিমানবিহারীর পরিচিত, তিনিই ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এই বাজারে ভাড়াও বেশ সস্তাই বলতে হবে, দুশো পনেরো টাকা। বাগবাজারের ফ্ল্যাটটির ভাড়া ছিল অবশ্য পঁচাশি টাকা, আড়াই গুণ বেড়ে গেল, কিন্তু এখন বাড়ি বদল করতে হলে এই গচ্চা দিতেই হবে। সুপ্রীতি ও মমতার বাড়ি পছন্দ হয়েছে। বাড়ির মালিক অবসরপ্রাপ্ত উকিল বলেই প্রতাপ এ বাড়ি নিতে সম্মত হয়েছেন, আদালতের হাকিম হিসেবে কোনো প্র্যাকটিসিং উকিলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা তিনি নীতিসঙ্গত মনে করেন না।

দু’ মাসের ভাড়া অগ্রিম জমা দেওয়া হয়েছে, কিন্তু চৈত্র মাসে বাড়ি বদল করতে নেই বলে এখনও একটা মাস বাগবাজারেই থাকতে হবে। কিছু কিছু জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ওখানে। পিকলুবাবলুদের খুব মজা, এখন তাদের দুটো বাড়ি। মাঝে মাঝে বাসে চেপে ওরা কালীঘাটের বাড়িতে চলে আসে, দুপুর-বিকেল কাটিয়ে ফিরে আসে সন্ধের সময়। এখান থেকে বিমানবিহারীদের বাড়ি বেশি দূর নয়, অলি বুলিরাও খেলা করতে আসে তাদের সঙ্গে। বাড়িটি খুব পুরোনো হলেও দেয়ালগুলি সদ্য চুনকাম করা হয়েছে বলে নতুন নতুন গন্ধ,। বাবলুর শুধু একটাই দুঃখ, এ বাড়িতে ছাদ নেই। একতলা বাড়ি, ছাদের সিঁড়ি তৈরি হয়নি। বাবলু অবশ্য দেখে রেখেছে, পাশের একটা পাঁচিলের ওপর উঠে তারপর রেইন পাইপ বেয়ে ওঠা যায় ছাদে। এ পাড়ায় অনেক ঘুড়ি ওড়ে, তাদের ছাদে কোনো কাটা ঘুড়ি এসে পড়লে সে কি এমনি এমনি ছেড়ে দেবে?

শিবেন এবং তার দলবলের সংস্পর্শ থেকে অনেক দূরে চলে যাওয়া হচ্ছে বলে সুপ্রীতি বেশ। খুশী। ভাসুরদের সঙ্গে তাঁর মামলা চলছে সম্পত্তির ভাগ নিয়ে। বরানগরের বাড়ির খানিকটা অংশ ভাড়া দেওয়া হয়েছে, আদালতের ইনজাংশানে সুপ্রীতি সেই ভাড়ার কিছুটা ভাগ পাচ্ছেন। কাশীপুরের যে বাগান বাড়িটা উদ্বাস্তুরা জবরদখল করে আছে তার জন্যও সরকারের কাছ থেকে কমপেসেশান পাওয়া যাবে শোনা যাচ্ছে, সেই টাকার ভাগও যাতে তিনি পান তার চেষ্টা চলছে। প্রতাপকে এখন তিনি নিয়মিত সংসার খরচ হিসেবে কিছু দিতে পারবেন।

কালীঘাট জায়গাটা আগে যতখানি সুদূর মনে হতো, এখন বাগবাজার থেকে কয়েকবার বাসে যাওয়া-আসার পর ততটা দূর মনে হয় না। দোতলা বাসে চড়ে চমৎকার ভ্রমণ, তারপর একটা ফাঁকা বাড়ি, নিজস্ব বাড়ি, বাথরুম শুকনো খটখটে, রান্নাঘরে উনুন নেই, কেমন যেন অদ্ভুত লাগে বাবলুর। খালি ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে সে মুখের পাশে দু হাত দিয়ে টার্জনের মতন। আ-ও-ও বলে চিৎকার করে প্রতিধ্বনি শোনার চেষ্টা করে।

পিকলুর ইচ্ছে ছিল সে একা ঐ বাড়িটাতে থাকবে এই চৈত্র মাসটা। সামনেই তার একটা পরীক্ষা আছে, ওখানে পড়াশুনোর সুবিধে হবে। কিন্তু প্রতাপ রাজি হননি। ওখানে সে খাওয়াদাওয়া করবে কোথায়? বার বার যাতায়াত করতে শুধু শুধু বাস ভাড়া খরচ হবে। একদিন তো এই বাড়িতেই পড়াশুনো হচ্ছিল, আর এখন এই কটা দিনের জন্য ক্ষতি হয়ে যাবে? চৈত্র মাসে বাড়ির ছেলে বাইরে থাকবে, এটা সুপ্রীতিরও ইচ্ছে নয়।

পিকলুর সত্যিই পড়াশুনোয় মন বসছে না। একবার যাবার নাম উঠে গেছে বলে এ বাড়িতে সব সময়েই কেমন যেন একটা চঞ্চলতা। যেন রেলের প্ল্যাটফর্মের ওয়েটিং রুম। একদিন একজন চেনা লোকের একটা ভ্যান পাওয়া গিয়েছিল বলে প্রতাপ একটা কাঠের আলমারি আর দুটো খাট পাঠিয়ে দিয়েছেন। দেয়াল থেকে নামানো হয়ে গেছে ছবিগুলো। কী রকম ফাঁকা ফাঁকা লাগে।

পিকলুর মন বসে না, সে পড়ার টেবিল ছেড়ে বার বার উঠে উঠে যায়। কখনো ফিজিক্সের অঙ্ক কষার বদলে সে সেই খাতাতেই কবিতা লিখতে শুরু করে। বাড়ি বদলের মতন তার মনের মধ্যেও যেন বড় রকমের একটা বদল আসছে। এরকম ছটফটানি তার আগে কখনো ছিল না। ফিজিক্স-কেমিস্ট্রির প্রতি তার সত্যিকারের ভালোবাসা আছে, সে শুধু গেলবার জন্য পড়ার বই পড়ে না, আবিষ্কারের মতন ভেতরে ঢুকে যায়। কিন্তু এখন পরীক্ষার আগে তার মাথায় শুধু কবিতার লাইন আসছে কেন?

বুদ্ধদেব বসু তার একটা কবিতা মনোনীত করে চিঠি দিয়েছেন। আর একটি কবিতায় তিনি সবুজ কালি দিয়ে কিছু কাটাকুটি করে মন্তব্য লিখেছেন যে শব্দ ব্যবহার সঠিক হয়নি, নিজের অনুভূতি থেকে শব্দগুলো আসেনি। অথচ এই দ্বিতীয় কবিতাটাই পিকলুর বেশি পছন্দ ছিল। ‘কবিতা পত্রিকায় তার প্রথম লেখা ছাপা হবে বলে সব সময় ভেতরে ভেতরে যেমন একটা চাপা উত্তেজনা রয়েছে, তেমনি দ্বিতীয় কবিতাটি বুদ্ধদেব বসু পছন্দ করেননি বলে তার খানিকটা ক্ষোভ এবং সংশয়ও বাষ্পের মতন ঘোরাফেরা করছে বুকের মধ্যে।

দুপুরবেলা সুপ্রীতিরা বাজারে বেরুলেন কানুর সঙ্গে। নতুন বাড়ি সাজাবার জন্য কিছু কেনাকাটি করা দরকার। যেমন সব কটা দরজার জন্য পাপোষ, উনুন পাতার শিক, জানলার পদাগুলো ছিঁড়ে গেছে, নতুন পর্দার কাপড় চাই। এ বাড়ির বেড়ানো বাথরুমের মগটা নতুন বাড়িতে নিয়ে যাওয়া যায় না। এতদিন বেশ চলে যাচ্ছিল, তবু বাড়ি বদল করতে হলেই কিছু জিনিস ফেলে দিতে হয়, কিছু নতুন আনতে হয়।

প্রতাপকে নিয়ে বাজার করতে যাওয়া এক বিড়ম্বনা। প্রতাপের ধৈর্য নেই, একটু বাদেই তাড়া দিতে শুরু করেন, তাতে পছন্দ মতন কিছুই কেনা যায় না। আজ কানুকে পাওয়া গেছে, সুবিধে হয়েছে। বাড়ি বদলের ব্যাপারে অনেক সাহায্য করছে কানু। তার বিয়েও ঠিক হয়ে গেছে, কালীঘাটের নতুন বাড়িতে গিয়ে ওখানেই তার বিয়ে হবে।

সুপ্রীতি-মমতার সঙ্গে তুতুলও এসেছে। মোড়ের মাথায় এসে সবাই দাঁড়ালো, কানু তাদের ট্যাক্সি করে বড়বাজারে নিয়ে যাবে। হঠাৎ সুপ্রীতি বললেন, এই যাঃ, আমরা সবাই চলে এলাম, মুন্নিবাবলু ইস্কুল থেকে ফিরলে ওদের খাবার দেবে কে? বাবলুটা তো খাবার না পেলে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করবে!

মমতা লজ্জা পেয়ে গেলেন। এই কথাটা তাঁর আগে মনে পড়েনি। সত্যিই তো, এভাবে যাওয়া চলে না। তিনি বললেন, দিদি, আমি তা হলে থাকি, আপনিই গিয়ে কিনে আনুন!

সুপ্রীতি বললেন, তা হয় নাকি? তুমি না গেলে সব জিনিস পছন্দ করবে কে? তোমরা ঘুরে এসো কানুর সঙ্গে, আমি বাড়ি চলে যাচ্ছি।

এ প্রস্তাবটাও বাস্তব নয়। মজুমদার পরিবারে এখনও সুপ্রীতিই কত্রী। খুঁটিনাটি ব্যাপারেও তাঁর মত না নিয়ে কিছু করা যায় না। মমতা একা বাজার করে আনলে সুপ্রীতি নিশ্চিত কিছু খুঁত ধরবেন।

দু’জনেই তাকালেন তুতুলের দিকে। মমতা জিজ্ঞেস করলেন, তুতুল তুই যাবি? সুপ্রীতি ললেন, হ্যাঁ, তুতুল তুই থাক, তুই বাজারে ঘুরে কী করবি?

গত সামান্যই দূরত্ব, তবু কানু গিয়ে তুতুলকে পৌঁছে দিয়ে এলো বাড়ি পর্যন্ত। পাড়ার কিছু ছেলে রকে আড্ডা দিচ্ছে, ওদের নজর ভালো না।

দোতলায় উঠে এসে তুতুল দরজা ঠক্ ঠক্ করলো। একটু পরে দরজা খুলে দিল পিকলু। তার এক হাতে একটা কলম। সে গম্ভীরভাবে জিজ্ঞেস করলো, কী রে, তুই ফিরে এলি?

উত্তরটা শোনার জন্য অপেক্ষা না করেই অন্যমনস্কের মতন পিকলু আবার দ্রুত ফিরে গেল পড়ার টেবিলে।

তুতুল নিজেদের ঘরের মাঝখানে এসে দাঁড়ালো। ঘরের মধ্যে খুব গরম, তবু পাখা খোলবার কথা তার মনে পড়লো না। তার চোখ দুটি স্থির। বাড়িতে পিকলুদা ছাড়া আর কেউ নেই, সেজন্য বাতাস যেন ভারি লাগছে।

সেদিন সেই ইডেন গার্ডেনের স্বদেশী মেলা দেখতে যাওয়ার পর সে আর পিকলুর দিকে ভালো করে তাকাতে পারে না। পিকলু তার বুক ভেঙে দিয়েছে, একা থাকলেই তার এখন কান্না পায়। আজ মায়েদের সঙ্গে বড়বাজারে যাওয়া তার পক্ষে অনেক ভালো ছিল!

পিকলু অবশ্য তার সঙ্গে স্বাভাবিক ব্যবহারের চেষ্টা করে। যেন সেদিন ইডেন গার্ডেনে কিছুই হয়নি। পিকলু যেন এক ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে তুতুলের একটা স্বপ্ন। সে পৃথিবীর অনেক বড় বড় ব্যাপার নিয়ে চিন্তা করে, সামান্য একটি পিসতুতো বোনের হৃদয় দৌর্বল্য নিয়ে মাথা ঘামাবার তার সময় নেই।

তুতুল বিছানায় শুয়ে পড়লো না, বই নিয়ে বসলো না, সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো ঐ এক জায়গায়। ঘরের মাঝখানে। তার মনে পড়ছে শুধু একটাই কথা। পাশের ঘরে রয়েছে। পিকলুদা, সে আর কিছুতেই আগের মতন পিকলুদার পাশে বসে পড়ে গল্প করতে পারবে না। যে তার সবচেয়ে আপন, সে-ই আজ সবচেয়ে দূরে সরে গেছে।

পাশের ঘরটা নিস্তব্ধ, পিকলুর সামান্য নড়াচড়ার শব্দও পাওয়া যাচ্ছে না। গলি দিয়ে ঠন্ ঠন্ করে কাঁসার বাটি বাজিয়ে হেঁকে যাচ্ছে একজন বাসনওয়ালা। পাশের বাড়ির রেডিওর এরিয়ালে বসে ডাকছে একটা চিল।

কত ক্ষণ, বোধ হয় এক ঘণ্টা কেটে গেছে, তুতুল এখনো বসেনি, তবে ঘরের মাঝখান থেকে সরে গিয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে একটা দেয়ালে ঠেস দিয়ে। তার চোখ দুটি স্থির। পিকলুদার সঙ্গে সে আর কোনোদিন স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারবে না? পিকলুদা তাকে খারাপ মেয়ে ভেবেছে, তাকে উপদেশ দেবার ছলে ধমকেছে। এর পরেও আর এক বাড়িতে থাকা যায়? এর চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভালো নয়?

তুতুল একবার ঘরের ছাদের কড়িবগার দিকে তাকালো। পাখা টাঙাবার হুকের মতন আর একটা হুক খালি আছে, একপাশে ঝুলছে। চেয়ারের ওপরে দাঁড়ালে ওটায় হাত পাওয়া যায়। কিংবা বাড়ি থেকে বেরিয়ে, যেদিকে দু চোখ যায়….যদি কোনো দুষ্টু লোক ধরে, কী আর হবে, মেরে ফেলবে বড় জোর!

পিকলু এসে দরজার কাছে দাঁড়ালো, জিজ্ঞেস করলো, কী করছিস রে তুতুল?

পিকলু পরে আছে ধুতি আর হাতকাটা গেঞ্জি। মাথার বড় বড় চুলগুলো অবিন্যস্ত। বাড়ি থেকে বেরুতে না হলে সে প্রায়ই স্নান করেও চুল আঁচড়ায় না। তার মুখের রঙ তামাটে হলেও তার কাঁধ ও বাহু বেশ ফর্সা। তার মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম।

পিকলুকে দেখে তুতুল কেঁপে উঠলেও কোনো উত্তর দিল না।

পিকলু এগিয়ে এসে বললো, তুই ওরকমভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?

মুখ নিচু করে তুতুল বললো, চা করে দেবো?

পিকলু বললো, না। তারপর সে একেবারে পুতুলের মুখোমুখি দাঁড়ালো। ডান হাতেম একটা আঙুল দিয়ে তুতুলের থুতনিটা উঁচু করে তুলে বললো, মানুষের জীবনে সবচেয়ে শক্ত জিনিস কী জানিস? অন্য মানুষদের ঠিক মতন চেনা। দ্যাখ না, তুই আর আমি কত কাছাকাছি, অথচ দু’জনে দু’জনকে চিনি না।

পিকলু এবারে তুতুলের গালে নরম করে হাত বুলিয়ে বললো, তুই কী সুন্দর, তুতুল। তোর মতন সুন্দর মেয়ে আমি আর কারুকেই দেখিনি। ছোটবেলায় এক সময় বুলা মাসিকে আমার খুব ভালো লেগেছিল…।

হঠাৎ থেমে গিয়ে সে একটুক্ষণ তুতুলের মুখের দিকে চেয়ে রইলো। তারপর কণ্ঠস্বর বদলে বললো, তোর সঙ্গে আমার খুব দরকার আছে। সেদিন ইডেন গার্ডেনে তুই যা বলেছিলি, সব ভুলে যা। ওসব মনে রাখতে নেই। মামাতো-পিসতুতো ভাই-বোনের মধ্যে প্রেম, সে ভারি গোলমেলে ব্যাপার। তাছাড়া তোকে আমি সেইভাবে দেখি না। তুই আমি ভাই-বোন হলেও আমরা বন্ধু হতে পারি। রাইট? তুই বুদ্ধিমতী মেয়ে, তুই ঠিক বুঝবি। বন্ধুর যদি কখনো বিপদ হয়, কিংবা হঠাৎ কোনো কিছুর খুব দরকার হয়, তা হলে অন্য বন্ধু সাহায্য করে, ঠিক কি না? তোর যে-কোনো দরকারে আমি সাহায্য করবো। আমার কাছে কখনো কিছু লুকোবি না।

তুতুল এখনও নির্বাক।

–আমি এখন তোর কাছে একটা সাহায্য চাই, তুতুল।

পিকলু ঘরটার চারদিকে দ্রুত চোখ বোলালো। সুপ্রীতি একটা সেলাই মেশিন কিনেছেন, সেলাই করার জন্য তিনি একটা অনুচ্চ জলচৌকিতে বসেন। তুতুল পা দিয়ে ঠেলে ঠেলে জলচৌকিটা নিয়ে এলো দেয়ালের কাছে। তারপর তুতুলের হাত ধরে বললো, তুই এর ওপর উঠে দাঁড়া।

তুতুলের যেন নিজস্ব কোনো ইচ্ছাশক্তি নেই। সে পা তুললো জলচৌকিটার ওপর। পিকলু কয়েক মুহূর্ত মুগ্ধভাবে চেয়ে রইলো তার দিকে।

তুতুল পরেছে একটা নীল রঙের ব্লাউজ, তার শাড়িটাও নীল-সাদা ডুরে। খোলা চুলে একটা রিবন্ বাঁধা। ঠোঁটে একটু ক্রিম মাখা ছাড়া তুতুল আর কোনো প্রসাধন করে না।

পিকলু বললো, মনে কর, এই একটা বেদীর ওপর তুই দাঁড়িয়ে আছিস। পৃথিবীর একমাত্র নারী। আর কেউ নেই। আমিও কেউ না। পাহাড়, গাছপালা, নদী, কাঠবেড়ালী এরা যে-চোখে নারীকে দেখে, আমি সেইভাবে তোকে দেখবো।

পিকলু তুতুলের শাড়ির আঁচলটা ধরে বুক থেকে নামিয়ে দিতে যেতেই তুতুল মাঝপথে সেটা ধরে ফেলে বললো, এ কী!

তুতুলের গলায় এক পৃথিবী ভরা বিস্ময়।

পিকলু একটু দুর্বলভাবে হেসে বললো, ঐ যে বললুম, বুঝতে পারলি না? আমি তোকে দেখতে চাই। তুই জামাকাপড় খুলে ফেলবি, আমি শুধু দেখবো একবার।

তুতুল এক পৃথিবী-ভরা ঘৃণা নিয়ে বললো, ছিঃ!

পিকলু বললো আমি এখনো কোনো বাস্তব জীবনের নারীকে চিনি না, তার শারীরিক রূপের আভজ্ঞতা আমার নেই, সেইজন্যই বুদ্ধদেব বসু বলেছেন যে আমার শব্দ ব্যবহার ঠিক হয় না। নারার বর্ণনার সময় আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে লিখি না, অন্যদের লেখা থেকে শব্দ ধার কার-আমার চোখে তুই-ই সবচেয়ে সুন্দর, তুতুল, আমার সবচেয়ে কাছের, আমি তোকে আজ পুরোপুরি একবার দেখবো, মাথার চুল থেকে পায়ের নোখ পর্যন্ত….

দু’হাতে কান চাপা দিয়ে তুতুল বলে উঠলো, চুপ করো, প্লিজ, চুপ করো!

এবার পিকলু অবাক হলো। সে যেন পৃথিবীর সবচেয়ে স্বাভাবিক কথাটা বলেছে আর তুতুল তা বুঝতে পারছে না! আরও ভালোভাবে বুঝিয়ে দেবার জন্য সে বললো, আমরা প্রেমিক-প্রেমিকা নই, দ্যাটস সেট্‌লড! আমরা এখন ভাইবোনও নই। আমরা বন্ধু। একজন বন্ধু আর একজন বন্ধুর কাছে সাহায্য চাইছে। আমি কোনোদিন কোনো নারীকে দেখিনি। আই মীন, ছবি দেখেছি, অ্যানাটমিক্যালিও জানি, তবু রক্তমাংসের কোনো নারীকে পরিপূর্ণভাবে দেখা, তার যে অনুভূতি, সেটা আমার নেই বলেই আমি ঠিক লিখতে পারি না। শব্দগুলো আমার উপলব্ধি থেকে আসে না–প্লীজ, তুতুল, একবার মাত্র। দু মিনিটের জন্য…

বিস্ময় আর ঘৃণার সঙ্গে মিশে গেল ব্যথা। তুতুল বললো, ছিঃ, পিকলুদা, তুমি আমাকে এই কথা বলতে পারলে?

পিকলু সরলভাবে আহত হয়ে বললো, তুই আমাকে ভুল বুঝছিস না কি? এর মধ্যে খারাপ তো কিছু নেই। বলছি তো, প্রেম-ভালোবাসার ব্যাপার নয়–

–প্লিজ, পিকলুদা, তুমি চুপ করো!

–শোন, আমি দূরে সরে গিয়ে দাঁড়াচ্ছি। আমি তোকে ছোঁব না। আই প্রমিজ। তা হলে তো দোষের কিছু নেই? শুধু একবার তোর শরীরের সম্পূর্ণ রূপ দেখবো…

পিকলু পিছিয়ে গেল কয়েক পা। আঁচলটা ভালো করে গায়ে জড়ালো তুতুল। তার চোখে এখন ঝকঝক করছে একরকম দীপ্তি। নরম হাতের আঙুল তুলে সে দৃঢ় গলায় বললো, পিকলুদা, যাও, তোমার ঘরে যাও, পড়তে বসো!

পিকলু আরও কিছু বলতে গেলে তুতুল আবার বললো, যাও! ও ঘরে যাও!

ইডেন গার্ডেনে পিকলু যেভাবে তাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল তার থেকে তুতুলের প্রত্যাখ্যান হলো অনেক বেশি কঠোর। পিকলু চলে যাবার পর সে উত্তেজনায় হাঁফাতে লাগলো।

একটু পরেই সে জলচৌকি থেকে নেমে খাটে বসে পড়ে দুই জানুর মধ্যে মুখ নিয়ে ফুঁপিয়ে খুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।

মিনিট দশেক বাদেই ফিরে এলো পিকলু। তার দৃষ্টি সম্পূর্ণ উদ্ভ্রান্ত। চোখ দুটি জ্বলজ্বল করছে, গেঞ্জি ভিজে গেছে ঘামে। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সে খসখসে গলায় বললো, তুতুল, আই অ্যাম এক্সট্রিমলি সরি। আই বীহেভড় লাইক এ ক্যাড, লাইক এ ব্লাডি ফুল

তুতুল মুখ তুললো না।

পিকলু আবার বললো, তুতুল, আমি অন্যায় করেছি। আমি ক্ষমা চাইছি তোর কাছে।

তুতুল তবুও কিছু বললো না, পিকলু ফিরে গেল নিজের ঘরে।

দু’ তিন মিনিট পরেই আবার ফিরে এলো সে। কিন্তু দরজার কাছেই দাঁড়ানো, ঢুকলো না ঘরের মধ্যে। এবারে তার কণ্ঠস্বর ফেটে ফেটে গেছে। সে বললো, তুতুল, সত্যিই আমি খুব অন্যায় করেছি। তোকে অপমান করেছি। আর কোনোদিন এরকম হবে না।

তুতুল তবু মুখ তুললো না।

পিকলু এবারে ব্যাকুলভাবে মিনতি করে বললো, তুতুল, তুই কি কিছু বলবি না?

তুতুল মুখ না তুলেই বললো, এখন আমার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। প্লিজ, তুমি পড়তে যাও। পড়া নষ্ট করো না!

পিকলু নিজের টেবিলে ফিরে এলেও পড়ার বইয়ের দিকে তাকালোই না। প্রবলভাবে নাচাতে লাগলো দু হাঁটু। তার বুকের ভেতরটা মুচড়ে মুচড়ে উঠছে, কিন্তু সে তো কাঁদতে পারবে না তুতুলের মতন।

আবার কয়েক মিনিট বাদে সে তুতুলকে কিছু বলবার জন্য উঠে দাঁড়াতেই বাইরের দরজায় দুম দুম শব্দ হলো। বাবলু-মুন্নিরা এসে গেছে।

এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় পরদিন কিন্তু অনেকটা হালকা হয়ে গেল তুতুলের মন। পিকলুর ওপর তার ঘৃণা তো দূরের কথা, বিন্দুমাত্র রাগও নেই। পিকলুর মাথায় হঠাৎ একটা পাগলামি চেপেছিল, কিন্তু কত ভালো ছেলে সে, একবারও তো তুতুলের ওপর জোর করতে আসেনি।

দু’জনেই দু’জনকে দু’রকমভাবে প্রত্যাখ্যাত করায় যেন সব সমান সমান হয়ে গেছে। তুতুল আবার পিকলুর সঙ্গে স্বাভাবিক ব্যবহার করতে পারবে। সে আবার তার আগেকার পিকলুদা হবে। এখন কয়েকদিন পিকলুর আড়ষ্ট থাকার পালা, নতুন বাড়িতে গিয়ে তুতুল নিজে থেকেই ওর সঙ্গে কথা বলে সব ঠিক করে নেবে।

ভালো দিন দেখা হয়েছে, পরশুই পাকাঁপাকি ছেড়ে দেওয়া হবে এই বাগবাজারের বাড়ি। দুপুরের দিকে সুপ্রীতি বললেন, শেষবারের মতন একবার গঙ্গাস্নান করে আসা হবে না? গঙ্গার ধার থেকে চলে যেতে হলে স্নান সেরে নিতে হয়।

কালীঘাটের বাড়ির কাছেও আদিগঙ্গা আছে বটে, কিন্তু সেই শীর্ণ, মুমূর্ষ নদী দেখলে স্নান করার ভক্তি হয় না।

মমতাও রাজি। কিন্তু কে নিয়ে যাবে? পিকলুই বরাবর নিয়ে যায়। পিকলুর সামনেই পরীক্ষা, সে সর্বক্ষণ পড়ার টেবিলে থাকে, তার সময় নষ্ট করা উচিত নয়। বাবলু-মুন্নির এখানকার স্কুলের ইতি হয়ে গেছে। শেষ কয়েকদিন বাবলু প্রাণপণে ঘুড়ি ওড়াবার সাধ মিটিয়ে নিচ্ছে। সকাল নেই, দুপুর নেই, বিকেল নেই, সর্বক্ষণ সে ছাদে। গায়ের রঙ পুড়ে গেছে, চোখ দুটো পাকা করমচার মতন লাল।

কোনোক্রমে বাবলুকে ধরে মমতা বললেন, বাবলু, আমাদের সঙ্গে একটু গঙ্গার ঘাটে যাবি?

বাবলু চেঁচিয়ে উঠে বললো, ওরে বাবা রে, আমার এখন সময় নেই। কেন, দাদা যাক না!

মমতা ফিসফিস করে বললেন, দাদার এখন পরীক্ষা না? সেইজন্যই তো তোকে বলছি!

আমি পারবো না, বলেই বাবলু দৌড়ে ছাদে চলে গেল। তা হলে আর যাওয়া হয় না। মমতা-সুপ্রীতি এখনো একলা কোথাও বেরোন না!

শেষ চেষ্টা করার জন্য সুপ্রীতি এবার বাবলুকে ডাকিয়ে আনলেন। বাবলু তাঁর কথা শোনে। ব্যক্তিত্ব খাঁটিয়ে সুপ্রীতি বললেন, বাবলু, তুই একটু চল আমাদের সঙ্গে। একবার গঙ্গায় যাওয়ার মানত করে তারপর না গেলে পাপ হয়। তুই চল, তোকে ঘুড়ি কেনার জন্য একটা সিকি দেবো!

বাবলু বললো, আমার পয়সা চাই না। আমার অনেক ঘুড়ি আছে! আগে তো সব সময় দাদাকে নিয়ে যেতে!

পড়ার টেবিল থেকে পিকলু সব শুনতে পাচ্ছে। সে উঠে এসে বললো, চলো, আমি নিয়ে যাচ্ছি। চটপট তৈরি হয়ে নাও!

সুপ্রীতি অপ্রস্তুতভাবে বললেন, তুই পড়া নষ্ট করে যাবি কেন? তা হলে থাক বরং, আমরা যাবো না।

পিকলু বললো, আমি সঙ্গে বই নিচ্ছি, ওখানে বসে পড়বো। চলো, আর দেরি কোরো না।

মমতা বাবলুর দিকে রুষ্ট দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন, অসভ্য ছেলে, দাদা পড়াশুনো ফেলে যেতে চাইছে, আর তোর ঘুড়ি ওড়ানোটাই বড় হলো? এরপর কিছু চেয়ে দেখিস, তোকে কিছু দেবো না।

বাবলু এই ভর্ৎসনা গায়েই মাখলো না, সে আবার অদৃশ্য হয়ে গেল।

গঙ্গার ঘাটে যেমন পুণ্য-সঞ্চয়ের জন্য অনেক মানুষ আসে, তেমনি যারা পুণ্যের পরোয়া করে না, সেইসব বহু ছিচকে চোর ও ফেরেববাজরাও ঘুরঘুর করে। ওপরে জামাকাপড়, জুতো, তোয়ালা-গামছা রেখে গেলেই যখন তখন উধাও হয়ে যায়। সেই জন্যও সঙ্গে একজনকে আনা দরকার।

বাগবাজার ঘাটে একটা বটগাছের গোড়ায় মা আর পিসির শাড়ি-গামছা পাহারা দিতে বসে রইলো পিকলু। সঙ্গে সে একটা বই এনেছে ঠিকই, কিন্তু সেটা পরীক্ষার পড়ার বই নয়। সেটি একটি চটি কবিতার বই, নাম, ‘সাতটি তারার তিমির’। পরীক্ষার আগে পিকলুর কখনো টেনশন হয় না। এবং পরীক্ষার দু একদিন আগে সে টেক্সট বই পড়া কমিয়ে কবিতার বই পড়ে, গান শোনে। তাতে তার মাথা পরিষ্কার হয়। এবারে অবশ্য তার মাথা উত্তেজনার বাষ্পে ভরা, তুতুলের কাছে সে অন্যায় করেছে, তাতে তাকে অপমান করেছে, একথা সে কিছুতেই ভুলতে পারছে না। কোনো মেয়েকে ভালো না বাসলে কি শুধু তার শরীর দেখতে চাওয়া যায়? পিকলুর এরকম ভুল হলে কী করে? মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের চতুষ্কোণ নামে একটা ছোট উপন্যাস সে পড়েছিল, তাতেও তো এই কথাই আছে।

মাথার ওপর গনগন করছে বৈশাখের রোদ, বটগাছের ছত্রছায়া ভেদ করেও তা জাফরি কাটার মতন নিচে এসে পড়েছে। গঙ্গার ঘাটে আজ বেশ ভিড়। বড় চ্যাঁচামেচি হচ্ছে। চারদিকে। বড় বড় পাটের নৌকো এসেছে আজ। বাগবাজাবের খালের মুখ খুলে দেওয়া হয়েছে, আরও নৌকো আসছে। কালো-কেলো, রোগা-রোগা ছেলেরা জল দাপাচ্ছে একটা বয়া-কে ঘিরে।

পিকলু এই সবের দিকে একবার অলস দৃষ্টি বুলিয়ে বইটা খুলে বসলো। একটি কবিতার নাম ঘোড়া। ‘আমরা যাইনি মরে আজো–তবু কেবলি দৃশ্যের জন্ম হয়/ মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে;/ প্রস্তর যুগের সব ঘোড়া যেন–এখনও ঘাসের লোভে চরে/ পৃথিবীর কিমাকার ডাইনামোর’ পরে।…

পিকলু প্রতিটি শব্দ মনোযোগ দিয়ে বিশ্লেষণ করতে লাগলো। প্রথম লাইনে ‘তবু’ কথাটা কেন? ‘আমরা যাইনি মরে’ তার সঙ্গে ‘কেবলি দৃশ্যের জন্ম হয়’ এর তো কোনো দ্বন্দ্ব নেই। তবে কি যাইনি মরের সঙ্গে দৃশ্যের জন্মের কনট্রাস্ট? মহীনের ঘোড়াগুলি-মহীন কে? কারুর নাম? কোনো ঐতিহাসিক রেফারেন্স আছে? চেক করতে হবে! ধ্বনি হিসেবে অবশ্য অদ্ভুত ভালো। পৃথিবীর সঙ্গে ডাইনামোর উপমা, এটা একেবারে অপূর্ব! একেবারে অরিজিনাল। পৃথিবীর পেটের মধ্যেও অনেক নাড়িভুড়ি আছে। কত তার, যন্ত্রপাতি, খনি, ধাতু, লাভা…তাছাড়া পৃথিবী ঘোরে!

‘বিষণ্ণ খড়ের শব্দ ঝরে পড়ে ইস্পাতের কলে…’। পিকলু চোখ বুজে ভাবে, এরকম লাইন। লিখতে পারলে যে কোনো মানুষ ধন্য হয়ে যেত! বিষণ্ণ খড়ের শব্দ–বিষণ্ণ খড়ের শব্দ…তুতুল একদিন বলেছিল, পিকলুদা, তুমি আমাকে জীবনানন্দ দাশের কবিতা বুঝিয়ে দেবে? আমি বুঝতে পারি না…। আর কোনোদিন কি তুতুল এ কথা বলবে? মেয়েটার মনে বড় দুঃখ দেওয়া। হয়েছে। এমন সরল, পবিত্র মন মেয়েটার…।

হঠাৎ ‘দাদা’ ডাক শুনে পিকলু দারুণ চমকে উঠলো।

তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে বাবলু। ধুলোমাখা খালি পা, সারা গা ঘামে ভিজে জবজবে। দেখলেই বোঝা যায় সারা পথ দৌড়ে দৌড়ে এসেছে।

এই দুরন্ত ছোট ভাইটার ওপর পিকলু কখনো রাগ করতে পারে না। পিকলু নিজে ছেলেবেলা থেকেই বহিরঙ্গে শান্ত, তার যত কিছু উদ্দামতা সবই নিভৃত কল্পনায়। বাবলুর সব রকম দুষ্টুমি, একগুয়েমি সে সমর্থন করে কারণ তারও মনের মধ্যে ঐরকম একটা রূপ আছে, কিন্তু বাইরে নেই।

পিকলু জিজ্ঞেস করলো, কি রে, তুই?

বাবলু বললো, তুমি এবার বাড়ি যাও। আমি মা-পিসিমণির জামাকাপড় দেখছি!

পিকলু হেসে বললো, হঠাৎ তোর এরকম সুমতি হলো? বৃষ্টি নামেনি তো, ঘুড়ি ওড়ানো বন্ধ হয়ে গেল কেন?

বাবলু তার পাশে বসে পড়ে বললো, তুমি যাও না! তোমার পরীক্ষা! আমি এবার দেখছি।

–তুই একলা একলা এলি কী করে?

–আমি বুঝি আসতে পারি না? আমি সব রাস্তা চিনি। তোমরা যখন থাকো না, দুপুরবেলা আমি একা একা কত নতুন নতুন রাস্তায় যাই।

–বাবলু, ওরকম দুপুরে টো টো করে ঘুরিস না। ছেলেধরা একদিন ধরে নিয়ে যাবে, তখন বুঝবি!

–ছেলেধরারা ধরে নিয়ে গিয়ে কী করে?

–চোখ অন্ধ করে দেয়। তখন আর বাড়ি চিনতে পারবি না। ওরা তোকে দিয়ে ভিক্ষে করাবে। রাস্তায় কত অন্ধ ভিখিরি থাকে দেখিস না?

–ইস, আমাকে ধরা অত সহজ নয়। দাদা, আমাকে একদিন ডায়মণ্ড হারবার নিয়ে যাবে? অলিবুলিরা গিয়েছিল, সব সময় সেই গল্প করে।

–আচ্ছা, পরীক্ষার পর নিয়ে যাবো একদিন। তুতুল আর মুন্নিও সঙ্গে যেতে পারে। ট্রেনে করে যাবো। ওখানে অনেকে পিকনিক করতে যায়।

–আচ্ছা দাদা, তুমি কবে চাকরি করবে?

-–কেন রে, হঠাৎ চাকরির কথা? আমি চাকরি করলে তোর কী লাভ হবে?

–মা একদিন বাবাকে বলছিল, তুমি তো আমায় কিছু দিলে না? পিকলু যখন চাকরি করবে, তখন সে নিশ্চয়ই আমাকে একটা অলওয়েভ রেডিও কিনে দেবে। কত লোক রেডিও’র নাটক শোনে…

–আমার চাকরি করতে এখনও ঢের দেরি আছে। তবে ছোটখাটো একটা রেডিও কিনে ফেলা যায়, দেখি, পরীক্ষার পরে একটা ভালো টিউশানি পাবার কথা আছে।

–তোমার পরীক্ষা, তুমি পড়তে যাও, পড়তে যাও। সেইজন্যই তো আমি এলাম।

–ভ্যাট! মা-পিসিমণি তো একটু বাদেই উঠে আসবে। একসঙ্গে ফিরবো।

বাবলু পিকলুর ভোলা বইটাতে একবার উঁকি মেরেই মুখ সরিয়ে নিল। কবিতা দেখলেই তার অভক্তি হয়। বোধহয় দাদার পরীক্ষাতে এগুলোও লাগে।

সে চঞ্চলভাবে মাথা ঘোরাতে ঘোরাতে বললো, দাদা, তুমি সিগ্রেট খাচ্ছো না?

পিকলু দু’দিকে মাথা নাড়লো।

বাবলু ঝকঝকে কচি দাঁতে হেসে বললো, তোমার কাছে নেই বুঝি? পয়সা দাও, আমি কিনে এনে দিচ্ছি!

পিকলু বললো, এক চাঁটি খাবি। তোর মতন ছোট ছেলে কিনতে গেলে দোকানদার দেবেই না!

বাবলু জোর দিয়ে বললো, হ্যাঁ দেবে! পয়সা দাও!

পিকলু বললো, কেন রে, তোর এত শখ কেন? তুই খেতে চাস নাকি?

বাবলু এক জায়গায় চুপ করে বসে থাকার পাত্র নয়। সে কিছু একটা করতে চায়। সে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, মা আর পিসিমণি কোন্ ঘাটে গেছে?

পিকলু উত্তর দিল না। ‘সাতটি তারার তিমির’ তার চোখ টানছে। সে আবার ফিরে গেল কবিতায়। বাবলু ছুটে গেল কোনো একটা দিকে।

খানিকবাদে গেল-গেল, ধর-ধর, ডুবে মলো-ডুবে মলো ইত্যাকার চিৎকারে পিকলুর ঘোর লো। ঘাটশুদ্ধ লোকজন শোরগোল করছে, কেউ একজন ডুবে যাচ্ছে। পিকলুর প্রথমেই মনে পড়লো বাবলুর কথা। তার ভাইটার কাণ্ডাকাণ্ড জ্ঞান নেই। বাবলু সাঁতার জানে না। হাতের বইটা নামিয়ে রেখে পিকলু ছুটে গেল জলের দিকে।

কয়েক মিনিট বাদেই সুপ্রীতি আর মমতা মেয়েদের ঘাট থেকে স্নান সেরে ভিজে কাপড়ে উঠে এলেন ওপরে। কিসের যেন চিৎকার-চেঁচামেচি হচ্ছে, ওঁরা কান দেননি। মেয়েদের। ঘাটের পাঁচিলের পাশে দাঁড়িয়ে হাতছানি দিলে পিকলু এসে শুকনো কাপড়-গামছা দিয়ে যায়, ওঁরা ভেতরেই শাড়ি পাল্টে নেন, বরাবরের নিয়ম এই। আজ ওরা পিকলুকে দেখতে পেলেন না। কিন্তু পিকলু যেখানে বসে ছিল সেখানে তাঁদের শাড়ি পড়ে আছে।

একটি বৃদ্ধা স্ত্রীলোক প্রতিদিন এই ঘাটে আসে এবং নিজের মনে মনে জোরে জোরে কথা বলে, সকলেই চেনে তাকে। সেই বৃদ্ধাটি ওঁদের পাশ দিয়ে বলতে বলতে গেল, আ মাগো মা, কী অলুক্ষুনে কথা! দু দুটো ছেলে এক সঙ্গে ডুবে মলো! মা গঙ্গার এ কী আক্কেল! ঘোর কলি, ঘোর কলি, না হলে এমন হয়?

সুপ্রীতি-মমতা ঐ বৃদ্ধার কথা গায়ে মাখলেন না। দুটি ছেলে জলে ডুবেছে শুনে ওঁরা কিছুটা ব্যথিত বোধ করলেন, কিন্তু কিছু পাড়ার ছেলে জলে দাপাদাপি করে বিরক্তি উৎপাদন করে প্রায়ই, তাদেরই কেউ হবে ভাবলেন ওঁরা।

সুপ্রীতি জিজ্ঞেস করলেন, পিকলু গেল কোথায়?

মমতা বললেন, কী যেন হয়েছে ওদিকে, বোধহয় তাই দেখতে গেছে!

যেহেতু সুপ্রীতি বয়েসে বড় এবং বিধবা তাই শরীর সম্পর্কে তাঁর সচেতনতা কম থাকার কথা। শাড়ি-গামছাগুলো দেখা যাচ্ছে, রাস্তাটা পেরিয়ে অনায়াসে নিয়ে আসা যায়। সুপ্রীতি বুকের কাছে দু’হাত জোড় করে প্রায় দৌড়ে সেগুলো নিয়ে এলেন।

মমতার সঙ্গে তিনি মেয়েদের ঘাটে আবার ফিরে যাবেন, এমন সময় একটা রোগা-লম্বা ছেলে দৌড়ে হাঁফাতে হাঁফাতে এসে বললো, ও মাসিমা, শিগগির আসুন! আপনাদের দুটো ছেলে জলে ডুবে গেছে! আসুন, আসুন!

সুপ্রীতি ভুরু কুঁচকে মমতার দিকে তাকালেন। এই ছেলেটিকে তাঁরা চেনেন না। এ কাদের কথা বলছে? দুটো ছেলে মানে কাদের না কাদের ছেলে। তাঁদের সঙ্গে এসেছে একা পিকলু, সে অতি শান্ত ছেলে, সে জলে নামেই না। যদি বা নামে, পিকলু সাঁতার জানে।

ছেলেটি তবু হিস্টিরিয়া রোগীর মতন চ্যাঁচাতে লাগলো, শিগগির আসুন! পিকলু আর বাবলু, আমি চিনি, আমি ও পাড়ার, ওরা আপনাদেরই বাড়ির ছেলে তো, শিগগির দেখবেন আসুন!

নাম দুটি বিদ্যুৎ তরঙ্গের কাজ করলো। ভিজে শাড়ি গায়েই সমস্ত লাজলজ্জা ভুলে সুপ্রীতি আর মমতা সেই ছেলেটির সঙ্গে সঙ্গে ছুটলেন।

সমস্ত ভিড় দু’ফাঁক হয়ে গেল। যেন সবাই জানে। গোলমাল স্তব্ধ হয়ে গেল এক মুহূর্তে। ওঁরা দু’জনে ঘাটের প্রান্তে এসে দেখলেন, এক পলক দেখেই চিনলেন, পাশাপাশি শোয়ানো রয়েছে পিকলু আর বাবলুকে। দু’জনেরই চক্ষু বোজা।

সুপ্রীতির মাথাটা ঘুরে গেল। তবু প্রাণপণে নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করে তিনি দেখলেন, মমতা হাঁটু দুমড়ে পড়ে যাচ্ছেন মাটিতে। সুপ্রীতি তাঁকে ধরবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু ধরলেন শুধু শূন্যতা। তারপর নিজেকে খাড়া রাখবার জন্য পাশে যাকে পেলেন তাকেই জড়িয়ে ধরলেন দু’ হাতে। যাকে ধরলেন, সে মানুষ না গাছ সে বোধও তাঁর নেই। তিনি পাগলের মতন বলতে লাগলেন, না, না, না, না…।

নদী বয়ে চলেছে আপন মনে, স্টিমার যাচ্ছে ভেঁপু বাজিয়ে, গরম বাতাস ছুটোছুটি করছে গাছের মাথায়। পৃথিবীতে কোথাও কিছু থেমে নেই।

॥ সূচনা পর্ব সমাপ্ত ॥

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *