The hour has come:
Let us wander into the night.
হলঘরে মায়ের ছবির সামনে এসে দাঁড়ালুম। রাত বেশ গভীর। সারাবাড়ি আজ নিস্তব্ধ। অন্যদিন হলে ঠিক পাশের ঘরেই মেসোমশাইয়ের নাক ডাকার শব্দ শোনা যেত। শোনা যেত মুকু পাশ ফিরছে, ঘুমের ঘোরে হাত তুলেছে তাই চুড়ির মৃদু প্রতিবাদ, আঃ কী হচ্ছে!
এই চুড়ির শব্দের সঙ্গে আঃ, কী হচ্ছে শব্দটা এমনভাবে আমার মনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে, কিছুতেই যেন ভুলতে পারি না। মনের সঙ্গে শব্দটা ভাল কিছু জড়িয়ে দিতে পারেনি, যেমন ঘণ্টা আর শাঁখের শব্দের সঙ্গে জড়িয়ে আছে দেবালয়ে আরতির দৃশ্য, ধূপ আর ধুনোর গন্ধ, পুরোহিতের পইতা শোভিত, উদার-অনাবৃত গৌরবর্ণ পৃষ্ঠদেশ। উঃ আর আঃ-র সঙ্গে রোগশয্যা। ওই শব্দটি বড় দেহবাদী। মধ্যরাতে কাছাকাছি দুটি দেহের অবস্থান। উত্তাপ আবেগ, জীবলীলার যাবতীয় উষ্ণ প্রক্রিয়া। ইচ্ছা জড়ানো একটি প্রতিবাদ শব্দ। যৌবন উদগমে, আমার এক বন্ধুর বাড়িতে একটি ঘরে শুয়ে, সারারাত পাশের ঘরে এমনি শব্দ শুনেছিলুম। চুড়ির রিনরিন আর আঃ কী হচ্ছে! পরের দিন। সকালে আমার সেই একান্ত বান্ধবের দাদার মুখের দিকে ভাল করে তাকাতে পারিনি। সকালে বউদি যখন চা দিতে এলেন আমি মুখ নিচু করে রইলুম। সব মানুষই অক্লেশে কেমন দুটো জীবন, বহন করে চলে। সবাই জানে পোশাকের তলায় থাকে নগ্ন শরীর। এ জানা আরও এক ধাপ বেশি জানা।
মন যে এক নিয়ন্ত্রণহীন বিশ্রী বস্তু, আর একবার জানা হল এই মুহূর্তে। রাত যখন নিস্তব্ধ গভীর, পৃথিবী যখন ঘন ঘোর, অশরীরীরা যখন বিচরণশীল, সাধকরা যখন ধ্যানের আসনে, সেইসময় সন্তান কেমন করে মায়ের প্রতিকৃতির সামনে দাঁড়িয়ে এইসব ভাবতে পারে! মানুষ বড় ক্ষুধার্ত প্রাণী।
ছবিটা একপাশে সামান্য হেলে আছে। মধ্যরাতে পরলোকগত কোনও নিকটজনের প্রতিকৃতির সামনে দাঁড়ালে যে গা ছমছম করে, শরীরে এক ধরনের শিহরন হয়, এই প্রথম অনুভব করলুম। ঘর থেকে ঘরে লাল মেঝে চলে গেছে। ওপাশের স্টোর রুমে, জানলার খাজে ফার্পো রুটির একগাদা খালি ঠোঙা, পিতৃদেবের, যাকে রাখো সেই রাখের নির্দেশে পর্বতপ্রমাণ হয়ে আছে। সেখানে ধেড়ে ইঁদুর নৃত্য করছে। বাইরে বাতাসের দীর্ঘশ্বাস।
দেয়ালে কোনও ছবি হেলে আছে দেখলে, পিতা বড় অসন্তুষ্ট হন। ঘটনা ঘটে গেছে বিকেলে, তারপর তিনি আর এঘরে আসার সুযোগ পাননি। যদি আসতেন, ছোটখাটো একটা কুরুক্ষেত্র হয়ে যেত। মৃতের প্রতি এত বড় অসম্মান! পারলে অপরাধীকেই ছবি করে ঝুলিয়ে দাও।
দু’হাত বাড়িয়ে ছবিটাকে সোজা করতে গিয়ে আবার হাত সরিয়ে নিলুম। মা যেন ফিসফিস করে বললেন, খোকা! তুই কত বড় হয়ে গেছিস!
সাহস করে মায়ের মুখের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালুম। চোখদুটো যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। এখুনি হয়তো চোখের পাতা পড়বে। শ্বাসপ্রশ্বাসের মৃদু শব্দ শোনা যাবে। ভয়ভয় ভাবটা কেটে গেল। মনে হল জিজ্ঞেস করি, তুমি এখন কোথায় আছ মা? শুনেছি পরলোকে অনেক স্তর আছে! কোন লোকে তোমার অবস্থান!
মা যেন বললেন, জীবন কেমন লাগছে?
এ প্রশ্নের উত্তর এখনই আমি কেমন করে দেব! যেমনই লাগুক, জীবন থেকে তো বেরিয়ে যেতে পারব না। পুরো মেয়াদ আমাকে খেটে যেতে হবে।
মনে আর চোখে যে ঘোর লেগেছিল, হঠাৎ সে ঘোর যেন কেটে গেল! ছবি সেই ছবিই। বহুকাল আগে বেঁচে থাকা কোনও এক স্নেহময়ী জননীর ধূসর হয়ে আসা একটি পট। যিনি ছিলেন এখন আর নেই। ঠোঁটের কোণে সুখের দিনের একচিলতে হাসি। যাকে ভুলতে ভুলতে প্রায় ভুলেই এসেছি। আজকাল ল্যাবরেটরিতে একটা জিনিসের দিকে প্রায়ই হাঁ করে তাকিয়ে থাকি। বোতলের মুখে ফানেল, ফানেলে ভাঁজ করা ফিল্টার পেপার, কাঁচের মতো স্বচ্ছ তরল পদার্থ টুপটুপ করে পড়ছে, ফিল্টার পেপারে জমে উঠছে তলানি। জীবনের নির্যাস কালের বোতলে টুপটুপ করে পড়েই চলেছে, আমরা সব রেসিভিউ।
রবিবাবু মাঝে মাঝে প্রশ্ন করেন, কী অমন দেখো বলো তো হাঁ করে?
অনুমতি নিয়ে ছবির পেছনে হাত দিলুম। দেয়াল আর ছবির মাঝখানে একটা খাম ছিল। দেয়াল বেয়ে খস করে মেঝেতে পড়ে গেল। চমকে উঠেছিলুম। ছবিটিকে জ্যামিতিক কোণ মেপে সোজা করে, টেবিল ল্যাম্পের তলায় এসে বসলুম।
এখন আমার একটা নিজস্ব ঘর হয়েছে। ব্যবস্থা হয়েছিল কয়েকদিন আগেই। দখল নিয়েছি আজ। পিতা যেদিন ঈশ্বরবিশ্বাসী হয়ে উঠলেন হঠাৎ, সেইদিনই বললেন, রাতই হল মানুষের সাধনার সময়, অলৌকিক দর্শনের সময়। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে একই সময়ে বিভিন্ন মতাবলম্বী সাধকরা বসেছেন আসনে, পৃথিবীর নাভিপদ্ম থেকে উঠছে অনাহত ওঁকারধ্বনি, পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসছে ঝরনা কলম্বনে, উত্তাল হিমবাহ নামছে ভীমগর্জনে, সাইবেরিয়ার বরফ-সমুদ্রে সশব্দে। ফাটল ধরছে, এই সময়ের সঙ্গে কেউ যদি নিজেকে একবার জুড়ে দিতে পারে, তার আরোহণ কেউ ঠেকাতে পারবে না। জীবন বড় সংক্ষিপ্ত। যে যেখানে আছ শুরু করে দাও। শুরু করে দাও এখনই। সেই লালাবাবুর মতো। যেই শুনলেন মা ডাকছে মেয়েকে, ওরে আয়, বেলা যে পড়ে এল, অমনি তিনি বেরিয়ে পড়লেন। সব ছেড়ে। জানি প্রথম প্রথম একা শুতে একটু ভয়ভয় করবে, পরে অভ্যস্ত হয়ে যাব। সন্দেহ হয়, এ ব্যবস্থা বোধহয় আমার পিতার পূর্ব-পরিকল্পনা। জীবনে একটি মেয়ে আসছে। ফল পেকে টুসটুসে হয়ে ঝুলছে।
সিলকরা খাম। ভেতরে শক্তমতো কিছু একটা আছে। আলোর সামনে তুলে ধরতেই বোঝা গেল, ভেতরে একটি আংটি, আর ভঁজ করা একটি কাগজ রয়েছে। খামটা সাবধানে ছিঁড়তে যাব, দরজায় টোকা পড়ল। তাড়াতাড়ি ড্রয়ারে ঢুকিয়ে দিলুম। গোপনে দেখতে হবে, কী রেখে গেছে মুকু।
দরজা খুলেই চমকে গেলুম। পঁড়িয়ে আছেন কাকিমা। চোখমুখ ভয়ে কেমন যেন বিবর্ণ। আমার পাশ দিয়ে ঘরে ঢুকে এসে ফিসফিস করে বললেন, দরজা দাও, দরজা দাও।
দরজার ছিটকিনি তুলে দিয়েই মনে হল, কাজটা বোধহয় ঠিক হল না। হঠাৎ পিতা যদি উঠে আসেন খোঁজখবর নেবার জন্যে, আর যদি দেখেন ইনি রয়েছেন, তা হলে এমন কিছু ভাববেন না তো, যা একটু অন্যরকম। ভাবা গেল কিছু করা গেল না। কাকিমা মেঝেতে বসে পড়েছেন।
ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলুম, কী হল? ফিসফিস করেই বললেন, কাছে আয়, বলছি।
পাশে বসতেই আমার একটা হাত চেপে ধরলেন। হাত কাঁপছে। পিন্টু, আমি নীচে শুতে পারলুম না রে! এই দেখ আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছে।
কেন, শীত করছে?
না, না শীত নয়। ভয়ে।
কীসের ভয়!
কাকিমা এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলেন। খোলা জানলায় অন্ধকার আকাশ, সেই দিকে ভয়ে ভয়ে একবার তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিলেন। আমার হাতে তার হাতের মুঠো শক্ত হল। দেয়ালে পিঠ দিয়ে বসেছিলেন, হঠাৎ একপাশ কাত হয়ে পড়ে গেলেন।
সর্বনাশ, অজ্ঞান হয়ে গেলেন? না মৃত্যু! সন্ন্যাস রোগ আজকাল খুব হচ্ছে। বুকে কান পেতে দেখলুম। সাঁ সাঁ শব্দ হচ্ছে। বেঁচে আছেন। পরক্ষণেই মনে হল, মারা গেলে বেঁচে যেতেন। কোনওদিনই জানতে পারতেন না স্বামীর মৃত্যুর কথা। পরক্ষণেই মনে হল, মারা গেলেই থানাপুলিশ হত। শুধু তাই নয়, ফঁকা জীবন আরও ফঁকা হয়ে যেত। তবু তো একজনের স্নেহ পাচ্ছি।
বিশ্রী ভঙ্গিতে শুয়ে পড়েছেন। কোনওরকমে তুলে আমার বিছানায় শুইয়ে দিতে পারলে বেশ হত। আমার সে শক্তি নেই। মেঝেতেই নানা কায়দা করে চিত করে শুইয়ে দিলুম। পা দুটো ধরে সোজা করে দিলুম। একরকম হল। খোঁপা বালিশের কাজ করছে। শাড়িটা জায়গায় জায়গায় ছেঁড়া। এত দৈন্য কেন? স্বামী ছাড়া কি পৃথিবীতে আর কেউ নেই?
কপালে ভিজে হাতের তালু, পাখার বাতাস, কাকিমা চোখ মেলে তাকালেন। পরিবেশে ফিরে আসতে আরও কিছুক্ষণ সময় লাগল।
চাপা স্বরে বললুম, আমার বিছানায় একটু শুয়ে নিন।
দেয়ালে ঠেসান দিয়ে বসতে বসতে বললেন, এখানেই বেশ আছি।
কী হয়েছে আপনার?
আগে ওই জলের গেলাসটা আন।
আলগোছে ঢকঢক করে জল খেলেন। হাত এখনও সামান্য কাঁপছে। বুকের কাছে জল ছলকে পড়েছে। চিবুকে একবিন্দু জল আটকে আছে। টেবিলের আলো পড়ে হিরের মতো চিকচিক করছে। গেলাসটা পাশে রাখলেন। সরাতে গেলুম, বললেন, থাক।
এইবার তা হলে বলুন, কী হয়েছে?
কাকিমা জানলার বাইরের অন্ধকারের দিকে আবার একবার তাকালেন। মহাশূন্য থেকে কেউ কি ভেসে ভেসে আসবে? ওঁর ভাব দেখে আমার নিজেরই কেমন ভয়ভয় করছে। হঠাৎ একটা কথা ভেবে গা হিম হয়ে গেল। এই নিস্তব্ধ অন্ধকার রাতে যে-কোনও মুহূর্তে কাকাবাবু আসতে পারেন। অপঘাতে মারা গেলে আত্মা সহজে মুক্তি পায় না। আপনজনের কাছে ফিরে ফিরে আসতে চায় পূর্বের দেহ ধরে।
কাকিমা আর আমার মাঝে যে ব্যবধান রয়েছে সেটুকু ঘুচিয়ে দিতে পারলে একটু সাহস পাই। বলা যায় না ওইটুকুর মধ্যে প্রফুল্লকাকার আত্মা ঘুরে বেড়াচ্ছে কি না! আমার চোখে আবার সেই মর্গের দৃশ্য ফিরে আসছে। ঢালু বেয়ে এক একটি দেহ গড়িয়ে আসছে। কারুর মুদিত, কারুর নিমীলিত, কারুর বিস্ফারিত আতঙ্কিত চোখ। আততায়ীকে দেখে ঠেলে বেরিয়ে এসেছে, সেই
অবস্থাতেই মৃত্যু হয়েছে। কারুর ঠোঁটের কোণে খেলোয়াড়ি হাসি-মৃত্যুর পরোয়া করি না।
মানুষ মনের কথা পড়তে পারে কি না জানি না, কাকিমা বললেন, আমার কাছে সরে আয়। প্রায় গায়ে গা লাগিয়ে বসলুম। মহিলার অনাবৃত ওপর বাহু বরফের মতো শীতল। লাল সুতোয় বাঁধা ছোট্ট একটি মাদুলি। জানি ওটি কীসের। সন্তানের প্রার্থনা। তাগার সুতো ঝুলছে। সেই ঝোলা। অংশ মাঝে মাঝে আমার হাত স্পর্শ করছে। প্রথমবার চমকে দিয়েছিল।
কাকিমা বললেন, কী ব্যাপার বল তো পিন্টু! এতদিন নীচে একা একা শুয়ে থাকি, কই কোনওদিন তো এমন হয়নি!
কী হল?
হাতপাখা টানতে টানতে কখন একসময় ঘুমিয়ে পড়েছি। খেয়াল নেই। ইঁদুর, আরশোলা খুটুর খুটুর করছিল। ও অমন রোজ করে। অভ্যাস হয়ে গেছে। আলো নিবে গেলে ওদেরই রাজত্ব। কেন। জানি না, হঠাৎ একসময় ঘুম ভেঙে গেল। সারাদিন খাটাখাটুনির পর বিছানায় শুলেই আমি মরে যাই। পড়লুম কি মরলুম। ঘুম ভাঙে সেই ভোরে। ঘুম ভাঙল, ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। কেমন যেন শ্বাসপ্রশ্বাসের কষ্ট হচ্ছে। উঠে পড়লুম বিছানা ছেড়ে। ভাবলুম বাইরে বেরিয়ে ফাঁকা জায়গার একটু হাওয়া বাতাস লাগালে হয়তো ঠিক হয়ে যাবে। অন্ধকারে দরজা খুলে বাইরের গলিতে পা দিয়েই ভয়ে কাঠ হয়ে গেলুম। রান্নাঘরের সামনের রকে সাদামতো কে একজন উবু হয়ে বসে। মাথাটা যেন দু’হাত দিয়ে চেপে ধরে আছে। চোর নয় তো! বদমাইশ লোকও হতে পারে। খুব জোরে কে বলে চিৎকার করার চেষ্টা করলুম, গলা দিয়ে কোনও স্বর বেরোল না। ঘরে ঢুকে আলো জ্বালার ইচ্ছে হল, চলতে পারলুম না। শরীর যেন পাথরের মতো হয়ে গেছে। সেই মূর্তি উঠে দাঁড়াল পিন্টু। তোমার কাকাবাবু। তখন আমার সাহস ফিরে এল। আমি বললুম, একী, তুমি কখন এলে? কে তোমাকে সদর খুলে দিলে? এখানে বসে আছ, আমাকে ডাকোনি কেন? মুখে কোনও কথা নেই। ভাবলুম, কোনও খবর না দিয়ে এতদিন পরে ফিরেছে, তাই বোধহয় লজ্জায় কোনও কথা বলছে না। আমাকে পাশ কাটিয়ে মুখ নিচু করে ঘরে ঢুকে পড়ল। আমি পেছন পেছন ঘরে ঢুকে, হাতড়ে হাতড়ে দেশলাই বের করতে করতে রাগের গলায় বললুম, তোমার সেই ভাঙা লাইটারটা জ্বেলে ধরেও তো একটু উপকার করতে পারো। স্বার্থপর। আলো তো জ্বলল পিন্টু, তারপর যা হল, তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না। ঘরে কেউ নেই। বিছানায় নেই, খাটে নেই, খাটের তলায় নেই, কোথাও নেই। আলো হাতে বাইরে এলুম, জোরে জোরে বললুম, কী গো, আমার সঙ্গে চোরচোর খেলছ নাকি! চারপাশ বাক্সর মতো বন্ধ, মানুষটা এল কোথা দিয়ে! রান্নাঘরের দরজায় বাইরে থেকে শেকল ভোলা। হঠাৎ ঘরের মধ্যে দুম করে একটা শব্দ হল। আলো হাতে ছুটে গেলুম। ঘরের মাঝখানে তবলা-ঠোকা হাতুড়িটা পড়ে আছে। তুমি বিশ্বাস করো পিন্টু, হাতুড়িটা ও যাবার সময় ঝুলিতে ভরে নিয়ে গিয়েছিল। আমি কোনওরকমে হামাগুড়ি দিয়ে ওপরে তোমার কাছে পালিয়ে এসেছি।
কাকিমা হঠাৎ দু’হাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠলেন, ও আর বেঁচে নেই, কিছুতেই বেঁচে নেই।
আর একটু হলেই আমার মুখ ফসকে সত্যি কথা বেরিয়ে পড়ছিল, মিথ্যে বলার নৈতিক সাহস পেলুম এই ভেবে, মর্গে আমিই যে ঠিক দেখেছি, তার কী প্রমাণ আছে।
আমি জোর গলায় বললুম, আপনার চোখের ভুল। বড় বেশি ভাবছেন, তাই স্বপ্ন দেখেছেন।
তুমি বলতে চাও আমি স্বপ্নে দরজা খুলেছি, স্বপ্নে আলো জ্বেলেছি? স্বপ্নে মানুষ এসব পারে!
কী বলছেন আপনি? মানুষ স্বপ্নের ঘোরে মাইলের পর মাইল হেঁটে যেতে পারে। বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে তাস খেলে আসতে পারে। খুন করে আসতে পারে। দিনের পর দিন এইরকম হলে ওটা হয়ে দাঁড়ায় একটা অসুখ, ইংরেজিতে বলে স্লিপ ওয়ার্কিং। তখন ডাক্তার ডাকতে হয়। লেডি ম্যাকবেথ রাজাকে খুন করার পর, ওইভাবে মাঝরাতে প্রাসাদে বাতি হাতে হেঁটে বেড়াতেন।
অদ্ভুত নাম শুনে কাকিমার যেন একটু বিশ্বাস হল। জিজ্ঞেস করলেন, লেডি ম্যাকবেথ কে?
ম্যাকবেথের বউ। ওসব হল রাজরাজড়ার ব্যাপার। উদ্বেগে দুশ্চিন্তায় মানুষের ওরকম হয়।
পিন্টু, তুমি আমার সঙ্গে একবার নীচে যাবে! একবার ভাল করে দেখা দরকার। তুমি যাই বলল, এ আমার চোখের ভুল নয়। আমি খুব একটা ভিতু মেয়েমানুষ নই। পাড়াগাঁয়ে মানুষ। কাল আমি একবার থানায় যাবই। শুনেছি মানুষ হারিয়ে গেলে থানায় খবর দিতে হয়।
থানা কিছু করে না। নাম ঠিকানা লিখে রেখে ছেড়ে দেয়। বড়জোর একটা ছবি চাইতে পারে। ছোট ছেলে হলে একটু যত্ন নেয়। ছেলেধরার উৎপাত আছে। উদ্ধার করতে না পারলে, বিকলাঙ্গ করে ভিক্ষে করাবে। বড়রা কোনওদিনই ছেলেধরার হাতে পদবে না। হারিয়েও যাবে না। বড়দের রাস্তাঘাট সব চেনা। পুলিশ জানে, কেউ সব ছেড়ে সন্ন্যাসী হয়ে বেরিয়ে যায়। কেউ পরিবারকে জব্দ করার জন্যে গা-ঢাকা দিয়ে বসে থাকে অনেকদিন। কেউ কোনও অন্যায় করে ফেরার হয়ে যায়। সময় হলে সবাই আবার সুড়সুড় করে ফিরে আসে। পুলিশ সব জানে। জানে বলেই বাজে কাজে সময় নষ্ট করে না।
কিন্তু কনকের মতো কেউ যদি মারা গিয়ে থাকে?
কনক মারা গেছে কে বললে?
দেখো দক্ষিণেশ্বরের গঙ্গা বড় সাংঘাতিক জায়গা। চান করতে করতে বান এসে গেলে সাঁতার-জানা লোকও সামলাতে পারে না। ডুবে না গেলে মেয়েটা যাবে কোথায়? মেয়েরা কি ছেলেদের মতো পালাতে পারে?
কেন পারবে না? পালানোর ব্যাপারে ছেলেতে মেয়েতে বিশেষ তফাত নেই। আমাদের পাড়ার ভারতী নায়িকা হবে বলে একা একা বম্বে পালিয়েছিল।
তারপর কী হল?
একমাস পরে ফিরে এল। ভারতীর মা রেগে তার সব চুল কামিয়ে ন্যাড়া করিয়ে দিলেন। পাড়ার লোক নায়িকা ভারতীর বদলে বলতে লাগল ন্যাড়া ভারতী।
নানা প্রসঙ্গ টেনে কাকিমাকে সহজ করে আনার চেষ্টা সফল হচ্ছে বলেই মনে হল। কাকিমার, চেয়ে বেশি ভয় পেয়েছি আমি। কাকাবাবু একবার যখন এসেছেন, আবার আসবেন। ভৌতিক বইয়ে পড়েছি, মৃত আত্মা অনেক সময় খুনের কিনারা করে দিতে আসে। এইভাবে কত ক্রিমিন্যাল ধরা পড়েছে। পুলিশ পারছে না, বাঘা বাঘা গোয়েন্দারা ঘোল খেয়ে যাচ্ছে, মৃতের আত্মা এসে আততায়ীকে ধরে দিয়েছে। কাকিমার সঙ্গে কথা বলছি, চোখদুটো পড়ে আছে দু’দিকে, একটা অন্ধকার জানলার দিকে আর একটা বন্ধ দরজার দিকে। কোনওরকম আওয়াজ পেলেই কান খাড়া হয়ে উঠছে। রাতের দিকে এ বাড়িটা এমনিই কেমন যেন হয়ে ওঠে! যারা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন, আমার বিশ্বাস তারা ফিরে আসেন। কখনও শুধুই অপ্রাকৃত শব্দ, কখনও সূক্ষ্ম শরীরে দর্শন। পিতৃদেবকে নিজের সন্দেহের কথা বলে নিজের বিপদ নিজেই ডেকে এনেছি। তিনি বলেন, ভগবান না হলে ভূত দর্শন হয় না! বেশ, দর্শন না হোক শ্রবণ তো হয়। মাঝরাতে ছাদে গড়গড় করে কী একটা শব্দ প্রায়ই হয়। বিশাল ছাদের এ পাশ থেকে ও পাশে লোহার বলের মতো কী একটা গড়িয়ে চলেছে। পিতাকে প্রায়ই বলি। তার বিশ্বাসও হয় না, তেমন পাত্তাও দেন না। শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে বললেন, এবার হলে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে ডাকবে।
সেদিন ছিল পূর্ণিমা। মাঝরাত পেরিয়ে গেছে। শুরু হল সেই শব্দ। ভারী লোহার বল গড়িয়ে চলেছে পুব থেকে পশ্চিমে। পিতাকে জাগালুম, উঠুন উঠুন, সেই শব্দ। এর আগে একবার হয়েছিল, যেই ডাক শুনে তিনি উঠে বসলেন, শব্দ থেমে গেল। বিছানায় আধশোয়া হয়ে আমরা দু’জন, আবার হবার অপেক্ষায় রাতটা জেগেই কাটিয়ে দিলুম। পিতা বললেন, তুমি ভুল শুনেছ। খাওয়ার গোলমালে জ্যান্ত মানুষের পেট মাঝরাতে অমন গড়গড় করে জানান দেয়, অতি আহারে ভূত হবার সম্ভাবনা। মিতাহারী হও, মিতবাক হও।
সেদিন আমার ভাগ্য ভালই ছিল। শব্দ থামল না, হতেই লাগল। তিনি শুনলেন, তারপর বললেন, চলো, লেট আস সি। প্রস্তাব শুনে গলা শুকিয়ে গেল। তিনি ছাড়ার পাত্র নন, আজ আমি তোমাকে ভূতদর্শন করাবই। ভগবান আর ভূত একই বস্তু। ভাইব্রেশনের ইতরবিশেষ। যেমন কনডেনসেশনের ওপর নির্ভর করে, জল থেকে কুয়াশা, জল থেকে স্নো কিংবা আইস।
ছাদের দরজা বন্ধ। সিঁড়ি ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। বন্ধ দরজার ফাটলে সুতোর মতো চাঁদের আলোর রেখা। হাতড়ে হাতড়ে উঠছি। বেঁচে আছি না মরে গেছি বোঝার ক্ষমতা নেই। দরজার হুড়কো খোলার শব্দ হল। বন্যার জলের মতো চাঁদের আলোয় সিঁড়ির ধাপ ভেসে গেল। ধুধু ছাদ, চাঁদের আলোয় ফটফট করছে। গাছপালা, আকাশ বাতাস সব যেন চাঁদের আলোয় স্নান করে উঠেছে। আমরা যখন ঘুমিয়ে পড়ি প্রকৃতি তখন যেন জেগে ওঠে। বিশাল আরও বিশাল হয়ে যায়। উত্তর দিকে আলসে ঘেঁষে একটা নিম গাছ উঠে গেছে, ঝাকড়া হয়ে। তার পাতায় পাতায় চাঁদের আলো কুচিকুচি হয়ে ঝুলছে। মাঝে মাঝে বাতাস এসে প্রকৃতির ঝাড়লণ্ঠন দুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। বিশাল আকাশের তলায় গড়ের মাঠের মতো ছাতে আমরা দুটি প্রাণী। ক্ষুদ্র যে কত ক্ষুদ্র হতে পারে সেদিন বুঝেছিলুম।
পিতা বললেন, কী দেখছ? কোথায় তোমার ভূত? কোথায় লোহার বল! এই তো তোমার ছাত। দেখে নাও। আমি এখানে বসি। তুমি দেখো। যদি কিছু পাও, আমাকে জানিয়ো, গিয়ে চেপে ধরব। নকল ভূত, ইমিটেশন ভূত দেখেই জীবনটা কেটে গেল, একটা রিয়েল ভূত দেখার বাসনা বহুদিনের।
ভূতের দর্শন পাওয়া গেল না ঠিকই, তবে সে রাতে পিতার অদ্ভুত এক রোমান্টিক চেহারার সঙ্গে পরিচয় হল। জনপদের মাথার ওপর বিশাল এক নির্জন ছাতে আমরা দুটি ভূতার্থী প্রাণী জীবন্ত ভূতের মতো পাশাপাশি বসে রইলুম, দুই সমবয়স্ক বন্ধুর মতো।
পিতা বললেন, রোজই তো আমরা ভেঁস ভেঁস করে ঘুমোই, এসো আজ আমরা বসে বসে জাপানিদের মতো চাঁদের আলো দেখি। নীচে গিয়ে মাদুরটা নিয়ে এসো। কী, একা যেতে ভয় করবে?
কী করে বলি ভয় করবে! ভয় অবশ্যই করবে। রাত আমার কাছে ভীষণ রহস্যময়। যত রাত বাড়তে থাকে ধীরে ধীরে, এই বনেদি ভগ্ন প্রাসাদের বিভিন্ন দিক একটু একটু করে আমার কাছে। অচেনা হয়ে ওঠে। এমনকী খাটের তলাটাও আমার হাতছাড়া হয়ে যায়। খাট থেকে পা নামাতে হলে মনে হয়, এই বুঝি কেউ খপ করে চেপে ধরল।
মাদুর এল। বিছানো হল। দু’জনে বসে আছি মুখোমুখি। রাত দুটো। পেটা ঘড়ি জানান দিল গঙ্গার দিকের থানা থেকে। পাহারাদারের পায়ের শব্দ দূরে মিলিয়ে গেল। মালা পাড়ায় একপাল। কুকুর চিৎকার করেই থেমে গেল। বহু দূরে ইলেকট্রিক সাপ্লাই কর্পোরেশনের পাওয়ার হাউস। সশব্দে খানিকটা স্টিম ছেড়ে রাত্রির প্রশান্তি আরও বাড়িয়ে দিয়ে গেল।
পিতা শুরু করলেন তার যৌবনের কাহিনি। ছাত্রজীবনে কত ক্লেশ সহ্য করেছেন! জ্ঞাতিদের উৎপাতে পিতামহের বাস্তুত্যাগ। প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে সংগ্রাম করে তার শিক্ষালাভ। তাঁর পাণ্ডিত্য। শিক্ষক হিসেবে অসামান্য খ্যাতি। ধমনীতে যে রক্তস্রোত বইছে, তার কণায় কণায় ত্যাগ, আদর্শ, সহিষ্ণুতা, উচ্চভাব, সন্ন্যাস। অর্থ নয়, জ্ঞান, ভোগ নয়, ত্যাগ, নীচতা নয়, উদারতা এ পরিবারের রক্তের সংকেত। মোর্স কোডে প্রতি দিন প্রতি মুহূর্তে সেই কথাই জানাতে চাইছে। ঊর্ধ্বে আরও ঊর্ধ্বে।
শেষে এসে পড়ল মায়ের প্রসঙ্গ। জীবনে সিল্কের পাঞ্জাবি পরেননি। হাতে ঘড়ি বাঁধেননি। বুকে সোনার বোতাম ঝোলাননি। চুলে গন্ধতেল মাখেননি। ধুতি আর শার্ট পরে বিবাহ করতে গিয়েছিলেন। বাসর থেকে মাঝরাতে মায়ের হাত ধরে উঠে এসেছিলেন ক্রোধে, চটুল মহিলাদের চপল রসিকতা সহ্য করতে না পেরে। বাড়ি ফিরে এসে প্রথমে স্নান করেছিলেন, তারপর মুগুর আর বারবেল ভেঁজে মনকে শান্ত করেছিলেন। মা খুব কেঁদেছিলেন, আর বিবাহের অধ্যম উত্তীর্ণ হবার আগেই পিতার ধমক খেতে শুরু করলেন। রাত কাটার আগেই নববধূর রোমান্টিকতা কেটে গেল। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই সংসার তাকে গ্রাস করে নিল। সামান্যতম সময় নষ্ট হল না বলে দাম্পত্য জীবন হয়ে উঠল খাগড়াই কাঁসার মতো।
পিতা বললেন, তোমার মায়ের মেটালটা অসম্ভব ভাল ছিল, তাই এত সুন্দর অ্যালয় হয়ে গেল, বোঝাই যেত না কে আমি, আর কে তুমি! সেম ভাইব্রেশন! তোমার দুভার্গ্য! জন্মালে মরুভূমিতে উটের মতো। তুমি তখন ছোট, সবে হামা দিতে শিখেছ, আমরা সব শিমুলতলায় গেলুম বেড়াতে। এমনি চাদিনি রাত। গোলাপ বাগান। দূরে আকাশের গায়ে পাহাড়। তোমার মায়ের মুখে চাঁদের আলো পড়েছে। কোলে শুয়ে আছ তুমি। কপালে সিঁদুরের টিপ জ্বলজ্বল করছে। আমি চাঁদ দেখব না তোমার মায়ের মুখ দেখব! কে বেশি সুন্দর! দেখতে দেখতে চোদ্দোটা বছর কেটে গেল। মৃত্যুর আগে ছমাস যমে-মানুষে টানাটানি চলল। ছ’মাস আমি রাতে ঘুমোইনি। একবার রুগির শিয়রে, একবার এই ছাতে। কত রাত একা একা কাটিয়ে গেছি এই ন্যাড়া ছাতে। অমাবস্যা গেছে, পূর্ণিমা গেছে। উত্তরে তাকিয়ে প্রার্থনা করেছি, দক্ষিণে তাকিয়ে করেছি, দিক-দেবতার ক্ষমতা নেই মানুষের যাবার পথ আটকায়। দীর্ঘ রোগ ভোগ করার পরও মুখের চেহারার এতটুকু পরিবর্তন হয়নি। রাত বারোটার সময় চিতায় শোয়ালুম। কোমর পর্যন্ত চুল চারপাশে ছড়ানো। পা দুটো আলতায় টুকটুক। করছে, চাঁদের মতো মুখে গোল লাল টিপ, সিঁথির সিঁদুর চলে গেছে ঊষার পথের মতো। সেই চিতায় আগুন দিতে হল। হোমের শুকনো কাঠের মত দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। তোমাকে একটা কথা বলে রাখি, মৃত্যু আগুন আর সতী যেখানে আছে সেখানে পাপ থাকতে পারে না, ভূত থাকতে পারে না, ভয় থাকতে পারে না। সে এলাকা হল ভগবানের। গায়ে পুট করে এক বিন্দু জল পড়েছিল। মাথার ওপর নির্মল নির্মেঘ নীল আকাশ, জল এল কোথা থেকে! পিতা বলেছিলেন, হয়তো স্বাতী নক্ষত্রের জল। ঝিনুকে পড়লে মুক্ত হত। তোমার গায়ে পড়েছে, দেখো মনটা যদি মুক্তোর মতো হয়ে ওঠে! আমি যদি ঈশ্বর হতুম, সেই রাতে পিতার কাছে তার জীবনসঙ্গিনীকে, আমার মাকে ফিরিয়ে দিতুম। অন্তত এক রাতের জন্যে। তারপর পাশে বসে মজা করে শুনতুম তাদের দু’জনের দীর্ঘ চোদ্দো বছরের জমা কথা। অমন রাত এখনও পর্যন্ত আর আসেনি, আসবে কি না তাও জানি না। অতীত দুঃখ আর সুখের স্মৃতি নিয়ে দূরাগত পাখির মতো পাখা মুড়ে বসেছিল। একসময় বললেন, আমার এসরাজটা নিয়ে এসো।
চাঁদ ক্রমশ পার হয়ে আসছে দীপ-নেবা জীবনের মতো। রাতের ছড়ানো মায়াজাল ক্রমে ক্রমে গুটোতে শুরু করেছে, পুবের আকাশে সূর্যের নখরচিহ্ন দেখা দিয়েছে। এসরাজ কাঁধে তুলে নিতে নিতে পিতা বললেন, আমার সবচেয়ে সমঝদার শ্রোতা ছিল তোমার মা। জানলার ধারে পা মুড়ে বসত। কোলের ওপর লুটিয়ে পড়ত চাঁদের আলো। বসে বসে বাজনা শুনত।
তারে ছড়ের টান পড়ল। শুরু হল জৌনপুরী রাগে আলাপ। হৃদয়ের মোচড় পড়ল সুরে। পাখি উড়ে গেল।
আলগোছে গেলাসের জলটুকু শেষ করে কাকিমা বললেন, চলো না গো একবার দু’জনে নীচে যাই। ব্যর্থ চেষ্টা। ভদ্রমহিলা ঘুরেফিরে সেই এক প্রসঙ্গে আসছেন। রাত বয়ে চলেছে। আর কতক্ষণই বা! একটু পরেই পাখি ডেকে উঠবে। শেষরাতে মহিলা যদি পিতার সামনে দিয়ে এই ঘর থেকে বেরিয়ে যান, যতই কাকিমা বলি না কেন, বিশ্রী একটা সন্দেহ হতে পারে। এই কিছুদিন আগেই জবার ঘটনায় চরিত্রে দাগ পড়তে পড়তে বেঁচে গেছি। জ্যোতিষীরা একবাক্যে বলেছেন, খুব সাবধান ছোকরা, নারীঘটিত বদনামের তীব্র যোগ রয়েছে। আর বসে থাকা যায় না। রাত বড় ভয়ংকর সময়। অন্ধকারের শক্তি কখন গলায় ফাঁস পরিয়ে দেয় কে জানে?
চলুন তা হলে যাই। বড় টর্চটা সঙ্গে নিই।
মেঝেতে হাতের ভর রেখে কাকিমা মেঝে থেকে শরীর তুললেন। রাত্রির জড়তা লেগেছে। মাথার ওপর দু’হাত তুলে আড়ামোড়া ভাঙলেন।
ধীরে ধীরে শব্দ না করে ঘরের দরজা ভেজিয়ে দিলুম। আলো আগেই নিবিয়ে দিয়েছি। অন্ধকারে পা টিপে টিপে দু’জনে নীচে নামছি। কাকিমার সেই ভয়ভয় ভাবটা আবার ফিরে এসেছে। একটা ব্যাপার কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছে না, স্বামীকে যদি ভালবাসা যায়, তা হলে স্বামীর প্রেতাত্মাকে কেন ভালবাসা যাবে না! মানুষের সবকিছুই কি ফঁকিতে ভরা!
সিঁড়ির বাঁক ঘুরে ভয়ে ভয়ে টর্চের বোম টিপলুম। কাকিমা বললেন বটে তিনি খুব সাহসী, সাহসের তেমন প্রমাণ পাচ্ছি না। আমার শরীরের সঙ্গে প্রায় লেপটে আছেন। নিজে কত সাহসী সে তো জানাই আছে। আলোর রেখা অন্ধকারের বুক চিরে সামনে এগিয়ে গেল। অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই নজরে পড়ল না। আলোর সরণিতে পিনপিন করে এক ঝাক মশা উড়ছে।
আমরা দু’জনে জড়াজড়ি করে অদ্ভুত এক অনিশ্চয়তার দিকে ধাপে ধাপে নেমে চলেছি। একটা সাতসেঁতে ভাব মুখে এসে লাগছে। এই রহস্যপুরীতে একটা কেন, একশোটা ভূত থাকতে পারে। কাকিমার শোবার ঘরের দরজা হাট খোলা। হ্যারিকেন নিবে গিয়ে এক পাশে ভূত হয়ে বসে আছে। বুকের ভেতরটা এবার সত্যিই কাঁপছে। চারপাশ খুব একটা স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। কারুর। ছেড়ে-যাওয়া আসনে বসলে যেমন উত্তাপ থেকে মনে হয় কেউ ছিলেন একটু আগেই, সেইরকম মনে হচ্ছে।
রান্নাঘরের দরজায় আলো ফেলতেই কাকিমা বললেন, ওই দেখো শেকল খোলা।
ব্যস! ওই একটিই কথা। ভারী শরীর কাঁচা মাটির পুতুলের মতো ধীরে ধীরে আমার শরীরের ওপর ভেঙে পড়ল। টর্চটা হাত থেকে ছিটকে পড়ে গিয়ে নিবে গেল। চারপাশে নিচ্ছিদ্র অন্ধকার।