খেলার খেয়াল বশে কাগজের তরী
স্মৃতির খেলনা দিয়ে দিয়েছিনু ভরি
পশ্চিম আকাশ কাঁচের মতো লাল হয়ে উঠেছে। সূর্য অস্ত গেল এই কিছুক্ষণ আগে। একঝাক পাখি মাথার ওপর দিয়ে উড়ে চলে গেল পশ্চিম আকাশের দিকে। যত দূরে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে কে যেন একরাশ খুঁটি খেলার দানের মতো আকাশের দিকে চেলে দিয়েছে। পাখি কেন সবসময় আলোর দিকে উড়ে যায়! সূর্যকে কি অনুসরণ করা যায়। পশ্চিম আকাশের অদ্ভুত ওই সোনালি আলো একটু পরেই নিবে যাবে। এ আকাশে রাত নামল, ও আকাশে ভোর। না, অত দর্শন ভাল নয়!
নীচে থাকতে না পেরে ওপরে চলে এসেছি। মুকুরা প্রায় তৈরি হয়ে গেছে। একটু পরেই গাড়ি নিয়ে আসব, ছুটবে স্টেশনের দিকে। সারাবাড়িতে এখানে-ওখানে যা কিছু ছড়ানো ছিল সব ভরে ফেলেছে বাক্সে। আমাদের যেসব জিনিস ছিল, যেগুলো লেগেছিল ওদের ব্যবহারে, সেসব জিনিস ফিরিয়ে দিয়ে গেল। কুলুঙ্গিতে আয়না ছিল, চিরুনি ছিল, একটা বুরুশ ছিল, চুলবাঁধা ফিতে ছিল, পাউডারের কৌটো, মেসোমশাইয়ের শেভিংসেট ছিল। সব অদৃশ্য হয়েছে, পড়ে আছে নিঃসঙ্গ ব্রাশ। কেমন যেন লাগে। কাঁদতে ইচ্ছে করে। একটু আগেও তারে সার সার কাপড় ঝুলছিল। সব যেন ভোজবাজি হয়ে গেছে, হাওয়ায় উড়ছে সাদা একটা গামছা।
মানুষের জীবন কিছুতেই পূর্ণ হতে চায় না, কেবলই শূন্য হয়ে যায়!
এই ছাতে কত কী ঘটে গেল। কত রাতে আমি আর কনক পাশাপাশি বসে থেকেছি। ক্ষয়া চাঁদ দেখেছি, পূর্ণ চাঁদ দেখেছি। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়েছে। কনকের শাড়ির আঁচলে দু’জনে একসঙ্গে মাথা ঢেকেছি। তখন মনে হয়েছিল, এইসব মুহূর্ত বুঝি রাজার মাথার উষ্ণীষের হিরা, চুনি, পান্নার মতো, যতদিন বাঁচব ততদিনই মাথায় থেকে যাবে। কোথায় কী! মালা ছিঁড়ে মানিক পড়ে গেল কালের স্রোতে। ভাসতে ভাসতে চলে গেল। দূর থেকে দূরে! আর ফিরবে না। স্মৃতি ক্ষীণ থেকে। ক্ষীণতর হবে। নতুন স্মৃতির পলি পড়বে। কোনও একদিন যক্ষের মতো কোনও এক নির্জন ঘরে সিন্দুকের ডালা খুলব। কাঁচ করে শব্দ হবে। ভেতরে দেখব থরে থরে সাজানো আমার জীবনের মৃতঝরা মুহূর্ত। মাকড়সার ঝুলে ঢাকা, ধূসর। তখন আমি বৃদ্ধ; হাত কাঁপছে, পা কাঁপছে। চুল সাদা। চোখদুটো মৃত মাছের মতো। এই তো মানুষের জীবন, মানুষের নিয়তি! এই পথেই সকলকে চলতে হবে। বর্তমানের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতে না পারলে, অতীত বড় কষ্ট দেয়। সোনার হরিণ সামনে ছেড়ে পেছন পেছন ছুটে চলল। রোজই দাও নতুন নেশা।
প্রতি পদক্ষেপে গন্তব্যের সুদূরতা আমার কাছে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে, আমার চলাকে পেছনে ফেলে জনশূন্য বনভূমি এগিয়ে চলে আরও জোরে।
দুঃখের দিনে গালিবকে বড় ভাল লাগে, হর কদম দূরী-এ মনজিল হৈ নুমায়া মুঝসে;/মেরি রফতার-সে ভাগে হৈ বয়াবা মুঝসে ।
শেষের ক’টা দিন মুকুও এই ছাতে এসেছে। আলসেতে বসেছে। কত কথা হয়েছে। জীবনকথা। রাত বেড়ে গেছে। পেটা ঘড়ি বেজেছে। মাঝরাতে অদ্ভুত একটা ভৌতিক বাতাস ওঠে, প্রকৃতি ছমছম করতে থাকে। দু’হাত দূরে বসে থাকা মুকুকে কেমন যেন রহস্যময় মনে হতে থাকে। মধ্যরাতে মানুষ কেমন যেন জ্যোতির্ময় হয়ে ওঠে। এই ছাদে আমি কাল আসব, পরশু আসব, তার পরের দিন আসব, আসব একা, পাশে কেউ থাকবে না। যত দিন যাবে স্মৃতি ততই পুরনো হতে থাকবে। কালের হাত ধরে এরা অদৃশ্য হয়ে যাবে। সমুদ্রে জাহাজ যেমন হারিয়ে যেতে থাকে। সব শেষ মাস্তুলের ডগাটিও চলে যায় দৃষ্টিপথের বাইরে। সমুদ্র পড়ে থাকে ঢেউ নিয়ে, ফেনরাশি নিয়ে। মানুষের তিনটি অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী, আকাশ বাতাস আর শূন্যতা। এই তিনটিকে কেউ কখনও কেড়ে নিতে পারবে না।
আকাশের সোনালি আগুন নিবে গেছে। গোলাপি পেখম মেলে রাত উড়ে আসছে। বন্ধু কাঁদতে দাও, শোনো, তিরস্কার কোরো না, হৃদয়ের দুঃখভার কখনও তো খালি করতে হবে! রোনে সে ওই নাদিম সলামত ন কর মুঝে। আখির কভি তো অকদএ দিল বা করে কোই।
খসখস শব্দে পেছনে ফিরে তাকাতেই দেখি মুকু দাঁড়িয়ে আছে। বিশাল ছাত এপাশ থেকে ওপাশে চলে গেছে। পশ্চিমে গাছগাছালি ভরা বিশাল এক ভূখণ্ড ক্রমশ ঢালু হতে হতে নেমে গেছে গঙ্গার কুলে। দূরে অন্ধকার আকাশ ফুঁড়ে উঠে গেছে মন্দিরের ত্রিশূল। গাছের মাথায় মাথায় অন্ধকার নেমে আসছে ডানা-মোড়া পাখির মতো। উনুনের ধোয়া কিছু দূর উঠেই বাতাসে থমকে গেছে।
মুকু আমার দিকে দু’পা এগিয়ে আসতেই চার পাশে সন্ধ্যার শাঁখ বেজে উঠল। দিন ঘুমিয়ে পড়ল রাতের কোলে। মুকু কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। শরতের একখণ্ড মেঘ থেকে চাপা একটা আলো এসে পড়েছে মুখে। চোখদুটো যেভাবে চকচক করছে, তাতে মনে হচ্ছে সামান্য জল এসেছে। মুকু চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। কোনও কথা নেই মুখে। অনেক সময় না বলা কথা বলা কথার চেয়ে অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে। মানুষের এমন অনেক ভাব আছে যা কথা দিয়ে স্পর্শ করা যায় না। ভোরের মতো সন্ধ্যার অস্বচ্ছ আলোয় উন্মুক্ত এই ছাদে মুকুর শেষবারের মতো দাঁড়ানো। মুহূর্তের নদীতে একই জলে মানুষ দু’বার স্নান করতে পারে না। মুকু কী বলছে আমি জানি,
খেলার খেয়াল বশে
কাগজের তরী
স্মৃতির খেলনা দিয়ে দিয়েছিনু
ভরি
যদি ঘাটে গিয়ে
ঠেকে প্রভাত বেলায়
তুলে নিয়ে
তোমাদের প্রাণের খেলায়
মুকু ধরাধরা গলায় বললে, আমার একেবারেই যেতে ইচ্ছে করছে না।
আমি বললুম, সময় হয়ে এল, একটু আগে বেরোনোই ভাল।
মুকু আরও ধরাগলায় বললে, কাল তোমরা থাকবে, আমি থাকব না।
আমি বললুম, সব গোছগাছ হয়ে গেছে? কিছু পড়ে নেই তো? একবার ভাল করে সব দেখে নিয়েছ?
মুকু বললে, কতদিন লাগবে তোমাদের ভুলতে!
আমি বললুম, তোমরা এসেছিলে দু’জন, ফিরে যাচ্ছ একজন।
মুকুর গলায় এবার কান্নার শব্দ, দিদি রইল, পারো তো খুঁজে বের কোরো। যদি দেখা হয় বোলা মুকুকে যেন ভুল না বোঝে।
মুকু সারা ছাতটা একবার ঘুরে এল। ছাতে এলেই কনকের একটা নিজস্ব বসার জায়গা ছিল। ফুলগাছের টবের পাশে সেই বসার জায়গায়, মুকু অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল চুপ করে, কারুর সমাধির সামনে মানুষ যেভাবে দাঁড়ায়।
মুকুর পাশে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে বললুম, এবার চলল।
মুকু সামনে ঝুঁকে ছিল। দুটো হাত ছিল সামনে জোড়া হয়ে। কথা শুনে মুকু সোজা হয়ে দাঁড়াল। নিশ্বাস নেবার চেষ্টায় শরীর টানটান হল। খুব মৃদু গলায় বললে, তুমি যদি আমাকে রাখতে পারতে পিন্টু! চিরকালের জন্যে এখানে যদি আমাকে রাখতে পারতে!
মুকু আমার কাঁধের ওপর ভেঙে পড়ল। আমার খুব অবাক লাগছে, এতদিন পরে বাড়ি ফিরছে, কোথায় আনন্দে মন যাই যাই করবে। পরবাস থেকে নিজবাসে ফিরে চলার আনন্দ নেই! তা হলে এ বেদনা কীসের? মুকু আমার কাঁধে মাথা রেখে বারেবারে বলতে লাগল, তুমি পারলে না, পারলে না, পারবে না, পারবে না।
কেমন যেন নেশাচ্ছন্নের মতো লাগছে! কে যে কখন কত আপন হয়ে যায়! মুকু দু’হাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগল, তুমি তুমি তুমি তুমি!
আমি দাঁড়িয়ে আছি বেওকুফের মতো। যে-কোনও কথাই এই আবেগের কাছে বড় খেলো হয়ে যাবে। এই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছে মানুষের মনের সবচেয়ে সূক্ষ্ম ভাবপ্রকাশ কথায় সম্ভব হয় না, চোখের জলে হয়তো কিছুটা হয়, ঠোঁটের হাসিতে হয়তো হয়, চোখের দৃষ্টিতেও হতে পারে। শব্দ শব্দের সীমা ছাড়াতে পারে না। যে-আর্তনাদ মুখে ফোটে না, সে আর্তনাদ বুকে দাগ কেটে বসে। যে-জল সমুদ্রে পথ পায় না সে জল শুষে নেয় মাটি। সিনে কা দাগ হৈ বহ নালা কা লব তক নগয়া/খাক কা রিজক হৈ বহ কতরা জো দরিয়া ন হুআ ॥
বিদায় ছাত বলে নীচে নামার মুখে সিঁড়িতে কাকিমার সঙ্গে দেখা হল, তোমাদের ডাকতে যাচ্ছিলুম। ওঁরা ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
কাকিমা অবাক হয়ে মুকুর দিকে তাকাচ্ছেন। আমাদের চেয়ে মুকু যেন বেশি বিচলিত হয়ে পড়েছে। চাপা স্বভাবের মানুষের এই এক সমস্যা। প্রথমে কেউ তাদের চিনতে পারে না, ধরতে পারে না, যখন পারে তখন সে চলে যায় ধরার বাইরে।
এতক্ষণ ছাতে ছিলুম। সোনার বরণ আকাশ থেকে আঁধার আকাশ হয়ে তারার আলো গায়ে মেখে নীচে নেমে এসে বিদ্যুতের আলো কেমন যেন অস্বাভাবিক হলুদ হলুদ লাগছে। মনে হচ্ছে সব ন্যাবা হয়েছে। বড়ঘরে কাকিমা দুটি আসন পেতেছেন। মুকু আর মেসোমশাই খেয়ে যাবেন। এ বাড়িতে তাঁদের শেষ আহার। কাকিমার যেন কোনও ক্লান্তি নেই। দুপুরে কম ছুটোছুটি হয়েছে!
সেই নোংরা রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে চোরের মতো আমরা আবার সেই শাড়ির দোকানে ফিরে এসেছিলুম। দোকানের সেলসম্যান প্রশ্ন করেছিলেন, তখন কী হয়েছিল বলুন তো! অমন করে পালালেন কেন?
রেস্তোরাঁয় বসে বসে উত্তর একটা কাকিমার জন্যে তৈরিই করে ফেলেছিলুম, তারই একটা অংশ কাজে লেগে গেল। বললুম, একজন চেনা ভদ্রলোককে দেখে পালাতে হয়েছিল।
সেলসম্যানের চোখেমুখে কেমন যেন একটা সন্দেহের ছায়া ঘনিয়ে এসেছিল। কাকিমার মুখের দিকে বারেবারে তাকাতে লাগলেন। জানি কী ভাবছিলেন। অবৈধ প্রণয়-ট্রনয়ের কথা নিশ্চয়ই। মন এমন জিনিস! সেই মুহূর্তে কেন জানি না নিজেকে বেশ ভাবুক ভাবুক লাগছিল। কাকিমাকে গল্পটা অবশ্য বেশ গুছিয়ে বলতে পেরেছিলুম। অফিসে শরীর খারাপ বলে ছুটি নিতে হবে তো, তাই অফিসের চেনা লোক দেখে অমন দুদ্দাড় করে পালিয়েছিলুম। গল্পে অবশ্য অনেক ফঁক ছিল। কাকিমা যদি প্রশ্ন করতেন, উনিও কি ছুটিতে আছেন। তা হলে আবার আমাকে আর একটা কিছু ভাবতে হত।
কাকিমা বললেন, তুমি আর বটঠাকুরও কিছু খেয়ে নাও, আসতে রাত হবে তো!
আমরা কত বেলায় খেয়েছি, আপনার খিদে পেয়েছে?
আমার ক্রমশই পেট ফুলছে।
তা হলে? আপনি বরং বাবাকে কিছু খেতে দিন।
উনি খাবার কথা শুনলে বিরক্ত হন।
তা হলে থাক।
দু’জনে প্রথমতো আহারে বসলেন। মেসোমশাই যদিও দু’-একখানা খেলেন, মুকু স্রেফ খেলা করে গেল। কাকিমা অবশ্য করেছিলেন অনেকরকম। নানা ধরনের লোভনীয় পদ। এই অল্প সময়ে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় আর কাউকে না পারুন আমাকে চমকে দিয়েছেন।
পিতা ঘড়ি দেখলেন। আমাকে বললেন, যাও এবার বেরিয়ে পড়ো, একটা গাড়ি ডেকে নিয়ে এসো।
কিছুদূর গিয়েই দেখি উলটো দিক থেকে একটা গাড়ি আসছে। রংটা বেশ চেনাচেনা। সামনে একটা ঠ্যালা পড়ায় গাড়িটা আস্তে আস্তে আসছে। পেছনের আসনে মাতুল বসে আছেন। সেই পরিচিত ভঙ্গি, গালের ওপর একটি আঙুল। দোকানের আলোয় অনামিকার আংটির পাথর জ্বলছে। শুনেছি পাথরটা হিরে।
মাতুল আমাকে দেখতে পাননি। ভাব কি ভাবনা জানি না, বিভোর হয়ে বসে ছিলেন। জানলার সামনে দাঁড়িয়ে মামা বলে ডাকতেই চমকে উঠলেন। মুহূর্তের বিস্ময় কেটে যেতেই মুখে খেলে গেল। সেই ছেলেমানুষি হাসি। মাতুলের মধ্যে একটি শিশু লুকিয়ে আছে। মাঝে মাঝেই ছুটে ছুটে বেরিয়ে আসতে চায়।
জিজ্ঞেস করলেন, চললি কোথায়?
একটা গাড়ি ডাকতে।
কেন গাড়ি কী হবে?
মেসোমশাইরা স্টেশনে যাবেন, আজ চলে যাচ্ছেন।
মাতুল দরজা খুলে দিয়ে বললেন, আয়, উঠে আয়। গাড়ি ডাকতে হবে না, আমি পৌঁছে দেব। আসনে বসতেই মাতুল বললেন, কীরকম সময়ে এসে পড়েছি বল? জাস্ট ইন টাইম।
বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড়াতেই, জানলায় একটা মুখ উঁকি মেরে সরে গেল। মাতুল সিঁড়ি ভেঙে আগে আগে উঠছেন, আর হেঁকে হেঁকে বলছেন, গাড়ি আ গিয়া হুজুর।
গলা পেয়ে পিতা বেরিয়ে এসেছেন সিঁড়ির মুখে, আরে, জয় তুমি! আনএক্সপেক্টেড। এ যেন মেঘ না চাইতে জল।
মাতুল বললেন, তাই কি! আমার মনে হল, আপনি আমাকে ডাকছেন।
তুমি বুঝতে পেরেছিলে?
তা না হলে এলুম কেন?
বুঝলে, সেদিন তুমি চলে যাবার পর ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল। আমি একটা রাস্তা খুঁজে পেয়েছি, মনে হয় তোমার খুব কাজে লাগবে।
আপনার আগেই কিন্তু আমি একটা রাস্তা খুঁজে পেয়েছি।
তাই নাকি, তাই নাকি?
পিতা ভীষণ উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন, ঠিক আছে পরে শোনা যাবে। আমি জানতুম, হেয়ার দেয়ার ইজ এ উইল দেয়ার ইজ এ ওয়ে। তা হলে চলল এঁদের আমরা পৌঁছে দিয়ে আসি। তোমার অসুবিধে হবে না তো!
কাল হলে অসুবিধে হত। আজ আর কী অসুবিধে!
মাতুলের এই কথার মধ্যে কীসের একটা ইঙ্গিত রয়েছে। পিতা তেমন খেয়াল করলেন না, আমার কানে কিন্তু লাগল।
সামান্যই জিনিসপত্র। হাতে হাতে উঠে গেল গাড়িতে। কাকিমা কোথা থেকে বিভিন্ন মাপের কৌটো জোগাড় করে গরম লুচি, আলুমরিচ, সন্দেশ, এমনকী একটা শিশিতে আচারও ভরেছেন।
মাতুল মুখ কাচুমাচু করে বললেন, আমার জন্যে যেন একটু থাকে বউদি, আমি ফিরে আসছি।
কাকিমার মুখটা মাঝে মাঝে কেমন যেন মেরী মাতার মতো হয়ে ওঠে। মুখচোখ সব কিছু চুঁইয়ে অদ্ভুত একটা স্নেহের ধারা নেমে আসে। এখন অত ভাবার সময় নেই, পরে ভাবা যাবে।
কাকিমা বললেন, আজ তো আমার রান্না দেবতার ভোগ হয়ে গেল, আপনি এলেন। সব রাখা আছে, ভালয় ভালয় ফিরে আসুন।
সব প্রস্তুত। সময় যেন হেঁকে বলছে, চলে এসো।
মুকু কোথায়! দেখো দেখো মেয়েটা আবার কোথায় গেল। দেরি হয়ে যাচ্ছে।
মুকু দাঁড়িয়ে আছে দক্ষিণের নির্জন ঘরে। যে-ঘরে এতদিন তারা থেকে ছিল। রাতের পর রাত মুকুর সেই অনন্ত লেখাপড়া। মেসোমশাইয়ের পড়ানো। জীবন যে-ঘরে ছড়িয়ে ছিল এখন তা আবার গুটিয়ে গেছে। শূন্য ঘরে কণ্ঠস্বর এক ধরনের প্রতিধ্বনি তোলে।
মুকু বলে ডেকে নিজেই চমকে উঠলুম। নিজের গলা নিজের বলা নিজের কাছে ফিরে এলে যা হয়। মুকু দাঁড়িয়ে ছিল আমার মায়ের ছবির সামনে। অবাক কাণ্ড! ডাক শুনে চমকে নয়, ধীরে ফিরে তাকাল।
মুকু, এবার চলো, ট্রেনের সময় হয়ে যাবে।
হ্যাঁ যাই।
মুকু আমার সামনে এসে দাঁড়াল। আমার চোখের ওপর তার স্থির পরিষ্কার দৃষ্টি। ঠোঁট দু’বার কাপল, তিনবারের বার শব্দ বেরোল, আমি তা হলে যাই।
নিচু হয়ে প্রণাম করার চেষ্টা করছিল, হাতদুটো ধরে ফেললুম। প্রণাম নেবার একটা বয়েস আছে। যখন আর কিছু নেবার থাকে না মানুষ তখনই প্রণম্য হয়ে ওঠে। মুকুর হাত সেই যে ধরেছিলুম ছাড়লুম এসে সদরে। কাকিমা মুকুকে দু’হাতে বুকে চেপে ধরে চাটনি খাওয়ার শব্দ তুলে অমোচন করতে লাগলেন। পরস্পরের আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে দু’জনেই ফুলে ফুলে উঠছেন।
আর সময় নেই, এবার চলে এসো। কালের হুংকার।
দু’পা এগিয়ে এসে কাকিমা মুকুকে গাড়িতে তুলে দিয়ে আঁচলে চোখ মুছতে লাগলেন। একে একে সবাই গাড়িতে উঠছেন। মেসোমশাই উঠতে উঠতে বললেন, আপনাদের ওপর যথেষ্ট উৎপাত করে গেলুম, ক্ষমা করবেন। গাড়ির জানলা দিয়ে মুখ বের করে কাকিমাকে বললেন, আসি তা হলে? বলার সময় মুখে এক ধরনের হাসি ফুটে উঠল। হাসির প্রলেপ মাখিয়ে মেসোমশাই বললেন, ভুলব না কোনওদিন।
কাকিমার মুখ দেখে মনে হল ভীষণ ভয় পেয়েছেন। কেউ কিছু ভুলতে চান, কেউ কিছু মনে করিয়ে দিতে চান, কারুর স্মৃতিতে আনন্দ, কারুর বিস্মৃতিতে আনন্দ। কী বিচিত্র এই পৃথিবী!
পেছনের আসনে পিতাকে বসাবার জন্যে মাতুল ঝুলোঝুলি করছেন।
পিতা বললেন, ভাবছি আমি আর যাব না, তোমরা তো রয়েইছ।
মাতুল বললেন, বাঃ, আপনাকে গাড়িতে একবার তুলব বলেই আমার আজ আসা।
তার মানে? সে আবার কী? হঠাৎ তোমার এমন উদ্ভট ইচ্ছে হল!
আজই যে শেষ দিন। অদ্যই শেষ রজনী।
কথা না বাড়িয়ে পিতৃদেব পেছনের আসনে বসলেন। মানুষের কথায় অনেক কিছু লুকিয়ে থাকে, গুটোনো টেপের মতো, দেখতে ছোট্ট এতটুকু, খুলতে শুরু করলে ফুটের পর ফুট কাহিনি বেরোতে থাকবে। সামনের আসনে আমি আর মাতুল বসলুম। গাড়ি ছেড়ে দিল। চাপা স্বরে সকলে বললেন, দুর্গা দুর্গা।
এতক্ষণের ছড়ানো ছত্রাকার জিনিস বেশ যেন গুছিয়ে উঠেছে। গাড়ির এই স্বল্পপরিসরে সব কাহিনি বেশ জমাট বেঁধে উঠেছে। যাওয়া আর থাকা দুটো দিকই গতিশীল, এর মাঝে মাতুল এক রহস্যের উপাদান। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালুম। আমাদের সদরে সাদা শাড়ি পরে কাকিমা তখনও পঁড়িয়ে আছেন। হঠাৎ মনে হল অত বড় একটা ভুতুড়ে বাড়িতে কাকিমাকে একা পাহারায় রেখে আসা কি ঠিক হল? যতক্ষণ আমরা না ফিরছি ততক্ষণ কী বিশ্রী লাগবে! একেবারে ফাঁকা। শুধু বিশাল এক গ্র্যান্ডফাদার ঘড়ির পদচারণের শব্দ!
পিতা মেসোমশাইকে ছোটখাটো নানারকম পরামর্শ আর আশ্বাস দিতে লাগলেন। গিয়েই একটা পৌঁছোনো-সংবাদ পোস্ট করে দেবেন, ভুলবেন না। মেসোমশাই হ্যাঁ বলতে পারতেন, বললেন না। আইনের লোক বললেন, চিঠি লেখার অভ্যাস আমার তেমন নেই, ওই মেয়েকে বলব, সেই একটা পোস্ট করে দেবে।
পিতা বললেন, ওদিক থেকে আপনি চেষ্টা চালান, এদিক থেকে আমরাও চালাই। কনককে যেমন করেই হোক ট্রেস-আউট করতে হবে।
মেসোমশাই বললেন, আপনাদের কী-ই বা করার আছে!
মেসোমশাইয়ের জবাবে গা জ্বলে জ্বলে উঠছে, আচ্ছা ঠোঁটকাটা লোক তো! পিতা প্রসঙ্গ পালটে মাতুলের সঙ্গে কথা শুরু করলেন, তোমার গাড়িটা বেশ কমফর্টেবল্ হে! চলো, একদিন দূরে কোথাও ঘুরে আসা যাক!
তা হলে আজই চলুন। কাল আর এ গাড়ি থাকবে না। আজই আমার গাড়ি চাপার শেষ দিন। আজই আমাদের লাস্ট রাইট টোগেদার।
হঙ্ক হঙ্ক, হর্নের শব্দে মাতুলের কথা চাপা পড়ে গেল। শিস দিয়ে ট্রাম চলেছে।