1 of 4

১.৪৪ কবি আবু নবাসের দুঃসাহসিক কীর্তি

কবি আবু নবাসের দুঃসাহসিক কীর্তি

একদিন রাতে খলিফা হারুন অল রসিদের চোখে আর কিছুতেই ঘুম আসে না। অবশেষে তিনি একই প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে পড়লেন। ঘুরতে ঘুরতে এক সময়ে তিনি তার বাগানে এসে উপস্থিত হন। দেখতে পেলেন, বাগান-সন্নিহিত তার হাবেলীতে আলো জ্বলছে। পায়ে পায়ে এগিয়ে যান। তিনি। দরজা খোলা। পর্দা ঝুলছে। বাইরে খোঁজাটা নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে। অতি সন্তৰ্পণে খোঁজটাকে ডিঙিয়ে খলিফা ঘরের ভিতরে ঢুকলেন।

এক পাশে একটি পদাঘেরা পালঙ্ক। পালঙ্কের দুই দিকে দুটি ঝুলন্ত ঝাড়বাতি। মাথার দিকে ছোট্ট একটা মেজ। তারপর একটা সোনার তৈরি সরাবের ঝারি। ঝারির মুখ একটি সোনার পেয়ালায় ঢাকা।

হারুন অল রসিদ অবাক হয়ে দেখতে থাকেন। তার হাবেলীর ঘরে এই সব কাণ্ডকারখানা চলছে—তিনি ভাবতেও পারেন না। পালঙ্কের পর্দা তুলতে খলিফা আরও অবাক হলেন। এ কি? অসামান্য রূপলাবণ্যবতী এক ডানাকাটা পরী-আঘোরে ঘুমাচ্ছে।

হারুন অল রসিদ সরাব ঢাললেন। আস্তে আস্তে পেয়ালাটা শেষও করলেন। মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবতে থাকলেন, কী করে কোথা থেকে এলো এই সুন্দরী? মেয়েটির কপালে হাত রাখেন খলিফা। চোখ মেলে তাকালো সে। এক মুহূর্ত। খলিফাকে চিনতে পেরেই ধড়মড় করে উঠে বসে সে। ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে কাঁপতে লাগলো। খলিফা হাসলেন, ভয় কী? ঠিক হয়ে বস।

মেয়েটি তবু নিজেকে সহজ করতে পারে না। কোন রকমে বেশবাস সংবৃত করে সরে গিয়ে এক কোণায় বসে।

খলিফা বললেন, পাশে তানপুরা দেখছি, তুমি গাইতে জান?

মেয়েটি ঘাড় নেড়ে জানায়-হ্যাঁ, জানে।

খলিফা বললেন, যদিও জানি না, তুমি কে, কেনই বা এখানে এসেছ, তবু, থাক সে-সব পরিচয়, আজ সারা রাত তোমার গান শুনে কাটাবো, শোনাবে?

মেয়েটি তানপুরা হাতে তুলে নেয়। তারে টঙ্কার দিয়ে সুর তোলে কণ্ঠ গুনগুনিয়ে ওঠে। অপূর্বসুরেলা কণ্ঠ। খলিফা তন্ময় হয়ে শোনেন। এক এক করে একুশটা রাগরাগিণী গাইলো সে।

এক অনাবিল আনন্দে খলিফার মনপ্ৰাণ ভরে গেছে। এবার বুকে সাহস নিয়ে মেয়েটি বলে, ধর্মাবতার আজ আমি ভাগ্যদোষে এই নির্জনপুরীতে নির্বাসিত হয়ে আছি।

খলিফা অবাক হয়ে বলেন, কেন? কী ব্যাপার?

—আপনার পুত্র, অল আমিন কয়েকদিন আগে আমাকে বাঁদীবাজার থেকে দশ হাজার দিনার দিয়ে কিনে এনেছেন। আমাকে শোনানো হয়েছিলো, ধর্মাবতারকে ভেট দেবার জন্যই নাকি তিনি আমাকে নিয়ে এসেছেন। কিন্তু আমার নসীব মন্দ, খাস বেগম জুবেদা এই ব্যাপারটা সুনজরে দেখলেন না। তিনি একটা নিগ্রো খোজাকে সঙ্গে দিয়ে আমাকে এই নির্জনপুরীতে পাঠিয়ে দিলেন। খোজাকে তিনি হুকুম করেছেন, এখানে যেন আমাকে বন্দী করে রাখা হয়।

মেয়েটির কথা শুনে খলিফা ক্রোধান্বিত হন।-এ ভারি অন্যায়। যাই হোক, তুমি দুঃখ করো না। সুন্দরী, আমি তোমার জন্য আলাদা একটা প্রাসাদের বন্দোবস্ত করে দেব। সেখানে তুমি দাসী-বাঁদী নিয়ে স্বাধীনভাবে থাকতে পারবে। আমি তোমার মোটা মাসোহাবার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

গানের আওয়াজে খোজাটার ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিলো। কোরবানীর খাসীর মতো সে দাঁড়িয়েছিলো দরজার পাশে। খলিফা বললেন, যা, খুব চটপট কবি সাহেব আবু নসাবকে তল্লাস করে ডেকে নিয়ে আয়।

আপনারা শুনে রাখুন, খলিফার মাথায় যখনই কোন দুষ্টু বুদ্ধি আসে, তিনি আবু নসাবের খোঁজ করেন।

খোজা আবু নসাবেরবাড়ি ছুটে যায়। কিন্তু ঐ গভীর রাতে-তখনও সেবাড়ি ফেরেনি। বাগদাদের সমস্ত গাঁজা-ভঙ্গের আড়ডায় হানা দিতে দিতে সবুজ দরজার কাছে এক তাডিখানায় তাকে পেলো সে।

খোজা বলে, জাঁহাপনা আপনাকে তলব করেছেন। এখুনি যেতে হবে। চলুন।

মদে চুর আবু নসাব কোনরকমে বলতে পারে, সে কি করে হবে বাবা, একটা ছেলের কাছে আমার এই দেহটা যে বন্ধন দিয়ে দিয়েছি, খোজা সাহেব। ও না ছাড়লে যাই কী করে?

খোজা ঠিক বুঝতে পারে না। সোনা-দানা সওদাপত্ব বাঁধা দেওয়া যায়। কিন্তু নিজের দেহটাও বন্ধক দেওয়া চলে নাকি?

—ব্যাপারটা তো বুঝতে পারলাম না, কবি সাহেব?

কবি হো হো করে হাসতে লাগলো, পারলে না, একটুও বুঝতে পারলে না, খোজা বাবা? ছেলেটা খুবই কচি, এখনও গোঁফ দাড়ি গজায়নি, লম্বা ছিপছিপে। একেবারে লালটুস। আমি তাকে বলেছিলাম এক হাজার দিরহাম দেব। কিন্তু আগে খেয়াল হয়নি—আমার কাছে টাকা পয়সা কিছু ছিলো না। তাই, টাকা না পেলে সে তো আমাকে ছাড়বে না?

–ইয়া আল্লাহ, খোজা অসহায়ের মতো আর্তনাদ করে ওঠে, কোথায় সে ছেলে? এই সময়ে ছেলেটি এসে দরজায় সামনে দাঁড়ালো। আবু নসাব উল্লাসে ফেটে পড়ে, ঐ তো এসেছে, সোনারচাদ।

সোনার চাঁদই বটে। অপূর্ব সুন্দর তার চেহারা। আর অপূর্ব সাজে। সেজেছে সে। ছেলেটির মুখে মিষ্টি হাসি। কাছে এগিয়ে এসে দাঁড়ালো সে।

খোজা হাভেলীতে ফিরে এসে খলিফাকে জানালো; আবু নসাব, একটা তাডিখানায় নেশা করে চুর হয়ে পড়ে আছে। সেখান থেকে আসার তার উপায় নাই। একটি বাচ্চা ছেলেকে টাকা দেবে বলেছিলো, কিন্তু দিতে পারে নি। তাই সে নিজেকেই বাধা দিয়েছে তার কাছে।

খলিফা মজাও পেলেন, ক্রুদ্ধও হলেন। খোজার হাতে এক হাজার দিরহাম দিয়ে বললেন, ওকে ছাড়িয়ে নিয়ে আয়। যা, ছুটে যাবি, আর দৌড়ে আসবি।

খোজা দ্রুত পায়ে তাডিখানায় গিয়ে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসে।

আবু নসাবকে দেখে খলিফা হুঙ্কার দিয়ে ওঠেন, তোমার লজ্জা করে না, বেহেড মাতাল হয়ে তাডিখানায় পড়ে থাকতে?

আবু নসাব কিন্তু খলিফার এই ক্ৰোধে বিচলিত হয় না। দাঁত বের করে হাসে।-বাঃ, মেয়েটা তো বেড়ে জোগাড় করেছেন, জাঁহাপনা। .

আবু নসাব মেয়েটির গা ঘেঁষে বসে পড়ে। মেয়েটি খলিফাকে এক পেয়ালা মদ ঢেলে দিলো খলিফা গভীর মুখে নসাবকে বলে, নাও, চুমুক দাও।

আবু নসাব দ্বিধা না করে মদের পেয়ালাটা তুলে নিয়ে এক চুমুকে সাবাড় করে দেয়। মদের ক্রিয়া করবেই, আবু নসাব টাল সামলাতে না পেরে টলতে টলতে পড়ে যায়। খলিফা তলোয়ার বের করে বাগিয়ে ধরেন-ভাবখানা, এক কোপে নসাবের মুণ্ডুটা নামিয়ে দেবেন। আবু নসাব ভয়ে ছিটকে সরে যায়। কিন্তু খলিফাও ঘাবড়াবার পাত্র নন, নসাবকে তাড়া করতে করতে ঘরময় এদিক ওদিক বাঁচিয়ে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পািখও লুকোচুরি খেলতে থাকে। শেষে খলিফা ক্লান্ত হয়ে বলে, ঢের হয়েছে, এবার এসো, আর এক পাত্র চড়িয়ে নাও, নেশা তো সব পানি হয়ে গেছে।

আবু নসাব খলিফাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারেনা। সেটুক করে মেয়েটির পিছনে এসে লুকিয়ে পড়ে। খলিফা তলোয়ারখানা রেখে মুচকি হেসে বলেন, এবার থেকে তোমাকে আমি এক নতুন চাকরীতে বহাল করবো, নসাব। তুমি হবে বাগদাদের মেয়েমানুষের দালালদের সর্দার।

আবু নসাব ঠোঁট কাটা। ভয় ডর কিছু নাই। বলে, জাঁহাপনা দালালীটা আজ থেকেই পাবো তো।

–কেন?

—বাঃ, এমন খুব সুরৎ মেয়েমানুষ নিয়ে রাত কাটাবেন! দালালী দেবেন না?

খলিফা রাগে থর থর করে কাঁপতে থাকেন। খোজাকে হুকুম করেন, এই—মসরুরকে ডেকে নিয়ে আয়। আজ আমি এর গর্দান নেব।

এই সময়ে রাত্রি শেষ হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ চুপ করে বসে থাকে।

 

দু’শো নব্বইতম রজনীতে আবার সে বলতে থাকে :

মসরুর এসে কুর্নিশ জানালো। খলিফা বললেন, এই বেয়াদপকে উলঙ্গ কর। গাধার জীনের রেকবীর সঙ্গে রসি দিয়ে বেঁধে ওকে শহর ঘুরিয়ে নিয়ে এসো। তারপর সকালবেলা শহরের সিংহ দরজায় সকলের সামনে এর গর্দান নেবে।

মাসরুর সারা রাত ধরে সুলতানের হুকুম তামিল করে নসাবকে শহরের সদর ফটকে নিয়ে আসে। শহরবাসীরা দলে দলে এসে জড়ো হতে থাকে। আহা বেচারা! লোকটা বড় রসিক ছিলো। সুলতানের কোপে পড়ে আজ প্রাণ হারাতে হবে।

উজির জাফর অলবারম্যাকী প্রাসাদে যাওয়ার পথে জনতার ভিড় দেখে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে, কী ব্যাপার? কী হয়েছে, এত জমায়েত কেন?

কে যেন বললো, সভাকবি আবু নসাবের গর্দান নেওয়া হবে।

জাফর ভিড় ঠেলে ভিতরে ঢুকে দেখে, সত্যিই তাই। জাফর জিজ্ঞেস করে আবু নসাব, কী ব্যাপার? কী করেছ? এ দশা কেন?

আবু নসাব বলে, আল্লাহ সাক্ষী, কোনও দোষ করিনি আমি। এমন কি কবিতা শুনিয়ে খলিফাকে এইসা মাতিয়ে দিয়েছি যে খুশি হয়ে তিনি আমাকে তার গায়ের বাদশাহী সাজপোশাক ইনাম দিয়েছেন।

খলিফা কাছে দাঁড়িয়েছিলেন। নসাবের কথা শুনে হো হো করে হাসতে লাগলেন। নিসাবকে তিনি শুধু ক্ষমাই করলেন না, সত্যিই নিজের অঙ্গের পোশাক খুলে পুরস্কার দিলেন।

শাহরাজাদ গল্প থামাতে দুনিয়াজাদ হেসে গড়িয়ে পড়লো।—কী মজার গল্প, দিদি। আর একটা আবু নসাবের গল্প বলো না।

সুলতান শারিয়ার বাধা দিয়ে বলে ওঠে, না না, ঐ সব ফচুকে গল্প আর না। এবার তুমি রোমাঞ্চকর কিছু একটা শোনাও।

শাহরাজাদ বললো, ঠিক আছে এবার সিন্দবাদ-এর সমুদ্রযাত্রার কাহিনী শোনাচ্ছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *