1 of 3

১.৪৪ আর্মানিটোলার পিকচার প্যালেস

আর্মানিটোলার পিকচার প্যালেস থেকে মামুন ফিরে এলেন ভাঙা মন নিয়ে। যা সব ঘটনা ঘটছে তার সঙ্গে তিনি কিছুতেই নিজেকে মেলাতে পারছেন না।

মাদারিপুর থেকে চলে আসার পর মামুন এই কয়েকমাস ঢাকাতেই আছেন। তিনি আলাদা একটা বাসা ভাড়া করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর দিদি কিছুতেই তাতে রাজি হননি। সেগুনবাগিচার বাড়িটা মস্ত বড়, বেশ কয়েকটা ঘর খালিই পড়ে থাকে, তবু তাঁর ভাই পয়সা খরচ করে আলাদা বাসায় থাকবে একথা মালিহা বেগম কানেই তুলতে চান না।

মামুন এখন পরিপূর্ণ বেকারও নন। টাঙ্গাইলে সেই সম্মেলনের সময় মানিক মিঞার সঙ্গে পুরোনো আলাপটা ঝালিয়ে নেবার পর তিনি মানিক মিঞার কাছ থেকে ইত্তেফাক পত্রিকায় যোগ দেবার প্রস্তাব পান। মামুন অবশ্য চাকরি নিতে সম্মত হননি, তবে প্রতি সপ্তাহে একটি করে কলাম লিখছেন, প্রায় প্রতি সন্ধেবেলাতেই তিনি ইত্তেফাক অফিসে আড্ডা দিতে যান। তাঁর আর একজন পুরনো দোস্ত জনাব আবুল মনসুর আহমদের প্রভাবে তিনি আওয়ামী লীগ কাউন্সিলের সদস্য হয়েছেন।

তাঁর মেয়ে হেনা এমনই বাবার ভক্ত যে সে-ও ফিরে যেতে চায় নি দেশের বাড়িতে, মামুন তাকে ভর্তি করে দিয়েছেন ঢাকার একটি ইস্কুলে। মাঝে অবশ্য দু’বার মামুন ঘুরে এসেছেন মাদারিপুর, তাঁর স্ত্রী ফিরোজাকে অতিকষ্টে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে এখন ঢাকা ছেড়ে চলে আসতে কিছুতেই তাঁর মন চাইছে না। পাকিস্তানের এখন একটা সন্ধিক্ষণ চলছে বলা যায়। এই সময়ে তিনি ঘটনার কেন্দ্র থেকে দূরে থাকতে চান না। ফিরোজা বেগম নিজে ঢাকায় আসতে চান না, বড় শহর তাঁর পছন্দ নয়, নিজের সংসার ছেড়ে অন্যের সংসারে অতিথি হয়ে থাকা তিনি বরদাস্ত করতে পারবেন না। তাঁর বাগান করার শখ, নিজের তত্ত্বাবধানে পোঁতা বেগুন, টমাটো ও শশাগাছগুলির ফলাফল না দেখে তিনি কোথাও নড়তে চান না। তা ছাড়া, মামুন জানেন, তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর দিদির কোনো দিন বনিবনা হয়নি। মামুনও মনে মনে কিছুদিনের জন্য সাংসারিক জীবন থেকে অব্যাহতি চাইছিলেন।

সেগুনবাগিচার এই বাড়িটিতে মামুনের প্রধান আনন্দের উৎস হলো মঞ্জু। মামুনের স্ত্রী গান-বাজনা পছন্দ করেন না, আর এ বাড়িতে সব সময়ই যেন আবহাওয়াতে সুর ভাসছে। তাঁর ভগ্নীপতি আলম সাহেব মজলিসি মানুষ, বাইরে থেকে গায়ক বাজনাদারদের তিনি প্রায়ই ডেকে আনেন, তা ছাড়া নিজের সন্তানদের গান-বাজনা শেখাবার ব্যাপারেও তিনি যথেষ্ট উদার। মঞ্জু মেয়েটার যেন সত্তায় মিশে আছে সঙ্গীত। যখন তখন সে গান গেয়ে ওঠে। অনেক সময় সে অন্যের কথার উত্তর দেয় গানের লাইন দিয়ে।

মামুন তাঁর নিজের জীবন বা সংসারের ভবিষ্যৎ নিয়ে কখনো চিন্তা করেন না। যা হবার তা তা হবেই, এইরকম একটা দার্শনিকসুলভ মনোভাব আছে তাঁর। অবশ্য তাঁর খাওয়া-পরার সমস্যা নেই, জমি-জমা থেকে বৎসরের খোরাকিটা ঠিকই জুটে যাবে। কিন্তু তিনি প্রায়ই চিন্তা করেন দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে। দেশের ভবিষ্যৎটা অনিশ্চিতের হাতে ফেলে দেওয়া যায় না। দেশের মানুষকেই দেশের ভবিষ্যৎ গড়তে হয়। এই ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য স্বপ্ন দেখতে হয়, সকলের স্বপ্ন দেখতে হয় না, সকলের স্বপ্ন এক হয় না, তাই নিয়েই যত বিপত্তি।

বাইরের জগতের ব্যাপার-স্যাপার দেখে যখন মামুনের খুব মন খারাপ লাগে তখন তিনি দু’তিনদিন আর বাড়ি থেকে বেরোন না। তখন তিনি মঞ্জুকে অনবরত অনুরোধ করেন, গান শোনা, মামণি গান শোনা আমাকে!

মঞ্জুকে দেখে, মঞ্জুর গান শুনে মামুনের অনেক দিন বাদে কবিতা লিখতে ইচ্ছে হয়েছে। লিখেছেনও দু’তিনটে, কোথাও ছাপতে দেননি। মঞ্জুকে দেখে তাঁর ক্ষণে ক্ষণে মনে পড়ে যায়, ছাত্র বয়েসে তাঁর প্রেরণাদাত্রী, দায়ুদকান্দির সেই গায়ত্রী ওরফে বুলার কথা। বুলার বন্দনা স্তোত্রেই তাঁর ‘আশমানী প্রজাপতি’ নামে প্রথম কাব্যপুস্তকটি ভরা। সে কথা বোধহয় আর কেউ জানে না, এমনকি বুলাও জানে না। বুলাকে তিনি তার বিয়ের পর একবারও দেখেন নি, সেইজন্যই বুলার অষ্টাদশী তরুণী মূর্তিটি তাঁর চোখে জেগে আছে। বুলা এখন কোথায় আছে, কে জানে। মামুনের সেই সময়কার বন্ধু প্রতাপের সঙ্গেও আর যোগাযোগ নেই।

বুলার সঙ্গে মঞ্জুর অবশ্য তুলনা চলে না। মুখে কিছু প্রকাশ না করলেও বুলার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটা ছিল প্রেমের। কোনোরকম প্রতিদানের আশা না করেও মামুন বুলাকে ভালোবেসেছিলেন। আর মঞ্জু তাঁর দিদির মেয়ে, তাঁর কন্যাসমা। তবু মঞ্জুর যৌবন-চাঞ্চল্য, তার সারল্যের সৌন্দর্য, গান গাওয়ার সময় তার আত্মনিবেদনের রূপ, এসব যখন মামুন দেখেন, তখন তিনি মঞ্জুর গুরুজন থাকেন না, তখন তিনি দেখেন একজন কবি হিসেবে। এই অনুভূতি তাঁর একান্ত নিজস্ব, সব গোপনের চেয়েও অতি গোপন।

শহীদ আর পলাশ নামে কলকাতার দুটি ছোঁকরা এসে মঞ্জুর জীবনে একটা ঝড় বইয়ে। দিয়েছিল। ওরা চলে যাবার পর মঞ্জু যখন তখন কান্নায় ভেঙে পড়তো। বাবা-মায়ের কাছে তখন খুব বকুনি খেয়েছে মঞ্জু। মামুন তখন অতিশয় স্নেহে ও যত্নে মঞ্জুর হৃদয়ের শুশ্রূষা করেছেন। এখন সে অনেকটা সামলে উঠেছে। প্রথম কয়েকমাস তো কলকাতায় যাবার জন্য খুব বায়না ধরেছিল, এখন আর সে কথাও বলে না। মামুন অবশ্য কোনো এক সময় ওকে কলকাতায় নিয়ে যাবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছেন।

এ বাড়ির তিনতলায় একটি মাত্র ঘর, বাদবাকি ছাদ। সেই ঘরে মামুনের আস্তানা। সম্প্রতি তাঁর পঁয়তাল্লিশ বছর পূর্ণ হয়েছে। এই বয়েসে আর নতুন কিছু করা যায় না। কিন্তু ইত্তেফাক কাগজে লেখা শুরু করা ও আওয়ামী লীগে সক্রিয় অংশগ্রহণ করার পর তিনি যেন আবার নতুন করে কর্মচাঞ্চল্য অনুভব করছেন।

মামুনের অগোছালো স্বভাবের জন্য মঞ্জু প্রায়ই এসে তাঁকে বকুনি দেয়। মামুন তাতে মজা। পান। বয়েস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বকুনি দেবার লোক কমে আসছে। এক সময় মামুন তাঁর। বাবাকে খুব ভয় পেতেন। তাঁর বাবার ইন্তেকাল হয়েছে অনেকদিন। কলকাতায় থাকার সময় মামুন ভয় ও ভক্তি সম্রম করতেন ফজলুল হককে। সেই ফজলুল হক এখন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর, তাঁর আগেকার ব্যাঘ্রবিক্রম আর নেই। বয়েসের ভারে পীড়িত, কেমন যেন জরঙ্গব অবস্থা। মামুন একদিন দেখা করতে গিয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে। ফজলুল হক মামুনকে ঠিক যেন চিনতেই পারলেন না। অথচ এই ফজলুল হকের কথাতেই মামুন নিজের কেরিয়ার নষ্ট করে। পূর্ব বাংলার গ্রামে গ্রামে ইস্কুল খোলার কাজ নিয়ে জীবনের মূল্যবান কয়েকটি বৎসর ব্যয় করেছেন। আর মামুন ভয় পেতেন তাঁর এক পিসিমাকে, তিনিও আর বেঁচে নেই। নিজের স্ত্রীর সঙ্গে মামুনের ঠিক মনের মিল না হলেও তাঁকে তিনি ভয় পান না। ফিরোজা বেগম বকাবকি করেন না, যেদিন যেদিন অসদ্ভাব হয়, সেদিন সেদিন তিনি কথা বন্ধ করে দেন, মামুন তাতে স্বস্তি বোধ করেন।

এখন বয়েস হচ্ছে, মামুন বুঝতে পারেন, এখন থেকে ছোটরাই তাঁকে বকুনি দেবে।

মঞ্জু যখন তখন তিনতলার ঘরে এসে বলবে, মামু, তোমাকে নিয়ে পারি না! আবার তুমি। মাটিতে সিগারেটের টুকরো ফেলেছো! তোমাকে তিন তিনখানা ছাইদান দিয়েছি!

মামুন মঞ্জুকে দিয়ে কাজ করাতে ভালোবাসেন। তিনি হেসে বলেন, কাল রাতে ঘুমাতে পারি নাই, তোরা তো খোঁজও রাখিস না। ঐ দ্যাখ, দরজার ধারের পেরেকটা খসে গেছে, কাল মশারি টাঙাতে পারি নাই!

মঞ্জু কলকণ্ঠে বলে ওঠে, তুমি বিনা-মশারিতে শুয়ে রইলে? হায় আল্লা, তুমি যে কী, একটা পেরেক ঠুকতেও জানো না। তুমি শুধু কাগজের ওপর কলম ঘষতে জানো!

পেরেক ঠোকার জন্য মঞ্জু একটা হাতুড়ি বা ইঁট খোঁজে, তা না পেয়ে সে তার দাদীর পান হেঁচার হামানদিস্তা নিয়ে আসে। পুরোনো গর্তে পেরেকটি ঠিকঠাক বসাবার জন্য সে মনপ্রাণ একাগ্র করে ফেলে। কৃত্রিম বিরক্তিতে মামুন দু’কানে হাত চাপা দিয়ে বলে ওঠেন, উঃ, আর না, আর না! কর্কশ শব্দ আমি সহ্য করতে পারি না। দিলি তো মুডটা মাটি করে। নে, হয়েছে, এবার একটা গান শোনা তো!

কাজ সাঙ্গ করার পর মঞ্জু বলে, মামু, তোমার মতন গান-পাগল আমি আর দেখি নাই। আমার জানা সব কয়টা গানই তো তোমার পঞ্চাশবার শোনা হয়ে গেছে!

মামুন বলেন, ওরে, ভালো গান পঞ্চাশ কেন,একশোবার শুনলেও পুরানো হয় না। তুই ঐ গানটা কর তো, পুরানো সেই দিনের কথা সেও কি ভোলা যায়..

মঞ্জু কয়েক মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মামুনের দিকে। তার মুখে মৌসুমী মেঘের মতন অকস্মাৎ একটা ছায়া পড়ে। সে আস্তে আস্তে বলে, জানো মামু, আমার কলেজের কয়েকটা মেয়ে বলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান গাইলে নাকি গুনাহ্ হয়। উনি ইণ্ডিয়ার কবি,। বিধর্মী।

মামুন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, কলেজের মেয়েরাও আজকাল এই কথা বলে নাকি? আমি কিছু কিছু সরকারি কর্মচারীর মুখে এই ধরনের কথা শুনেছি। কলেজের ছেলে-মেয়েরাও যদি এরকম কথা বলতে শুরু করে তা হলে বুঝতে হবে এ দেশের খুবই দুর্দিন আসছে। তা তোর নিজের কী মনে হয়?

–আমি অতশত বুঝি না। আমার ভালো লাগে।

–শোন, কবিতা, গান এসব হলো অন্তরের জিনিস। এ সবের ওপর কোনো ফতোয়া জারি করা যায় না। যার যেটা ভালো লাগে সে তাই-ই করবে। তুই ধর তো গানটা!

মঞ্জুকে বেশি সাধাসাধি করতে হয় না। সে সারা ঘর ঘুরতে ঘুরতে গানটা গাইতে থাকে। চক্ষু দুটি বোজা, শরীরটা একটু একটু দোলে। দুটি হাত বুকের কাছে জোড় করা। তার পরনে একটা জাফরানি রঙের শাড়ি, তার অঙ্গটি বেতসলতার মতন, বাতাসে ফুরফুর করে উড়ছে তার চুল। মামুন শ্রবণ ও দর্শন সমান সমান করে চেয়ে রইলেন তার দিকে। প্রকৃতির কী অপার রহস্য, এই মেয়েটাকে তিনি প্রায় জন্মাতে দেখেছেন বলা যায়, হামাগুড়ির বয়েসে বড় ছিচকাঁদুনে ছিল, দেখতেও ভালো ছিল না, সবাই বলতো বাপের মতন মুখ হয়েছে, তারপর ধীরে ধীরে বড় হলো, আর পাঁচটা মেয়ের মতনই ফ্রক পরে ইস্কুলে যেত, আলাদা কোনো বৈশিষ্ট্য ছিল না। হঠাৎ যৌবনে পা দিয়ে তার কী অসাধারণ পরিবর্তন। সর্বক্ষণ ঝলমল করে, তার হাসি সুন্দর, তার কথা বলার ভঙ্গি সুন্দর, তার হাতের আঙুলগুলো পর্যন্ত কী সুন্দর! সে যখন ঘরে ঢোকে, এক ঝলক বসন্ত বাতাস নিয়ে আসে।

এই মেয়েটিকে কোন্ একটা পরের বাড়ির ছেলে একদিন নিয়ে চলে যাবে।

মঞ্জুর কণ্ঠস্বর বেশ খোলামেলা, তবে এখনো সে নিজস্ব স্টাইলটি খুঁজে পায় নি। এখন সে পশ্চিম বাংলার শিল্পী সুচিত্রা মিত্রের অনুকরণ করছে কিছুটা। উচ্চারণ পরিষ্কার, প্রতিটা শব্দের ওপর আলাদা আলাদা ঝোঁক। কলিম শরাফীর কাছে কিছুদিন তালিম নিলে এ মেয়ে উঁচুদরের শিল্পী হতে পারবে।

গানটি শেষ হওয়া মাত্র মামুন অন্যমনস্ক ভাবে তাঁর খাতাটা খুলে লিখলেন, ‘অতীব সুন্দর কিছু দেখি যদি বক্ষে ব্যথা জাগে…’। এই লাইনটা লেখার পর তিনি দ্বিতীয় লাইনটির চিন্তায় তন্ময় হয়ে গেলেন। মঞ্জুকে যে তার গান শুনে কিছু একটা বলা উচিত, সে কথা মনেই রইলো।

মঞ্জু একটুক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলো, মামু, কী লিখছো?

সঙ্গে সঙ্গে ঘোর ভেঙে গেল, মামুন লজ্জা পেয়ে গেলেন। খাতাটা বন্ধ করে বললেন, কিছু না। এই লাইনটা যে তিনি মঞ্জুকে দেখেই লিখলেন তা নয়, হঠাৎ এরকম এক একটা অনুভূতি আসে, গানটা শুনতে শুনতে তাঁর বুকে একটা ব্যথার ভাব জেগেছিল। কিন্তু এরকম একটা লাইন যেন নিজের ভাগ্নীকে দেখানো যায় না, তিনি আবার বললেন, কিছু না।

মঞ্জু তাঁর পাশে বসে পড়ে বললো, তবু আমি দেখবো। তুমি মধ্যে মধ্যেই কী সব লেখো? গান লেখো বুঝি?

মামুন খাতাটা পেছনে লুকিয়ে বললেন, আরে না রে, ওতে সব প্রাইভেট কথা লিখে রাখি, ছোটদের দেখতে নাই।

–ইস আমি বুঝি ছোট?

কথা ঘোরাবার জন্য মামুন জিজ্ঞেস করলেন, হারে, বাবুল আর এসেছিল? তোরে অঙ্ক দেখায় দেবার কথা বলেছিলাম না ওকে?

মুঞ্জু মাথা নেড়ে বললো, মোটেই আমি তার কাছে অঙ্ক শিখবো না! সে মোটে কথাই বলতে পারে না!

আলতাফের ভাই বাবুলকে মামুনের খুব পছন্দ। ছেলেটি খুব লাজুক ঠিকই। কিন্তু পড়াশুনোয় খুব মাথা, একেবারে হীরের টুকরো ছেলে। মঞ্জুর সঙ্গে ভালো মানাবে। তিনি মঞ্জুর চুলে হাত দিয়ে বললেন, বাবুলের সঙ্গে তোর ভাব হয় নাই! চমৎকার ছেলে!

মঞ্জু বললো, সে মোটে কথাই বলে না। তার সাথে আমার ভাব করতে বয়ে গেছে!

মামুন হাসতে হাসতে মঞ্জুর পিঠে একটা চাপড় মেরে বললেন, আঁ, কী বললি, ‘বয়ে গেছে’? তুই যে শহীদ-পলাশদের সঙ্গে কয়েকদিন মিশেই কলকাত্তাইয়াদের মতন কথা বলতে শিখেছিস!

নিচতলা থেকে কে মঞ্জুর নাম ধরে ডাকলো, মঞ্জু চলে গেল।

মামুন ভাবতে লাগলেন বাবুল আর আলতাফের কথা। আলতাফই তাঁকে স্বেচ্ছা নির্বাসন থেকে টেনে এনেছে, আলতাফের প্রতি তিনি কৃতজ্ঞ, কিন্তু আলতাফ আজকাল তাঁকে এড়িয়ে এড়িয়ে চলে। আলতাফ মামুনকে ফুথেষ্ট প্রগতিশীল মনে করে না। একদিন আলতাফ তাঁকে ঠাট্টা করে বলেছিল, কী মামুন ভাই, আপনি আওয়ামী লীগের মুরুব্বিদের ধরে মন্ত্রিত্বের গদি চান নাকি?

আওয়ামী লীগের মধ্যে ভাঙন আসন্ন। সেদিন পিকচার প্যালেসের অধিবেশনের শেষেই। মামুন সেটা বুঝে গেছেন। মওলানা ভাসানী পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে একেবারে জিদ ধরে আছেন। আওয়ামী লীগের নেতা সোহরাওয়ার্দি এখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, তিনি আমেরিকার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার নীতি সমর্থন করবেনই, অথচ সেই আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ভাসানী সাহেব প্রকাশ্যেই এই নীতির নিন্দা করছেন। ভাসানী সাহেবের মনোভাবটাই সব সময় সরকার বিরোধী, এখন তাঁর নিজের দল সরকার হাতে পেয়েছে, তবু তিনি সরকার-বিরোধিতা ছাড়তে পারছেন না। এ এক অদ্ভুত অবস্থা। আগামী নির্বাচনের কথা ভেবে আওয়ামী লীগের এখন সরকারে থাকাই উচিত, মামুনও এটা মনে করেন, কিন্তু মওলানা ও তাঁর সমর্থকরা এটা কিছুতেই বুঝবেন না। দু’পক্ষে নিন্দা-মন্দ, কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি শুরু হয়ে গেছে। সেদিন পিকচার প্যালেসের ভোটাভুটিতে মওলানার হার হলো, তবু মওলানা সেই ভোটের ফলাফলকে মিথ্যা বললেন।

আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকাটাও মামুন ঠিক বুঝতে পারছেন না। এই তরুণ নেতাটি সংগঠনের কাজ ভালো জানে, খাঁটি দেশপ্রেমিক যে তাতেও কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু বড্ড মাথা গরম। নিজের মতটাই চেঁচিয়ে জাহির করে, অন্যের কথা শুনতে চায় না। পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের সঙ্গে তার স্পষ্ট মনোমালিন্য সবাই টের পেয়ে গেছে। ভাসানীপন্থীদেরও অনেককে সে খেপিয়ে রেখেছে। সে তত চেষ্টা করতে পারতো সোহরাওয়ার্দি আর ভাসানীর মধ্যে একটা আপস সমঝোতার ব্যবস্থা করতে, তা নয়, সে যেন ভাসানীকে ঠেলে দিচ্ছে আরও দূরে।

মামুন যা ভেবেছিলেন, কয়েকদিন পর তাই-ই হলো। মওলানা ভাসানী তাঁর অনুগামীদের নিয়ে আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করে বেরিয়ে গেলেন। রূপমহল সিনেমা হলে তিনি আলাদা একটি সম্মেলন ডাকলেন।

মামুন ভাসানীর দলে গেলেন না। তিনি আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী দল হিসেবে টিকিয়ে রাখার পক্ষপাতী। কট্টর প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিম লীগের মোকাবিলা করতে আওয়ামী লীগই সক্ষম, দেশের মানুষ এখনো আওয়ামী লীগের ওপর আস্থা রাখে।

তবু মামুন ভাসানী সাহেবের বক্তব্য শোনার জন্য গেলেন রূপমহল সিনেমা হলে।

ভাসানী সাহেব সমস্ত প্রগতিশীল দলগুলিকে এবং পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির সমর্থকদের ডাক দিয়েছেন। ভিড় মন্দ হয় নি। বামপন্থীরা সবাই এসে জুটেছে। মামুন এদের অনেককেই একটু একটু চেনেন। ফজল আলী মন্টু নামে একজন লোক গেটের সামনে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কী যেন বলছে। কথাগুলো মামুন শুনতে পাচ্ছেন না, কিন্তু তিনি জানেন, ঐ লোকটি সোহরাওয়ার্দি সাহেবকে দু’চক্ষে দেখতে পারে না। কাগমারি সম্মেলনের পর ঐ লোকটি অভিযোগ করেছিল, ছাপ্পান্নর সংবিধানে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবি আটানব্বই ভাগ মেনে নেওয়া হয়েছে, এই কথা ঘোষণা করে সোহরাওয়ার্দি বাঙালী জাতির প্রতি শত্রুতা করেছেন!

মামুন এদিক ওদিক তাকিয়ে আলতাফ আর তার ভাই বাবুলকে খুঁজতে লাগলেন। মতের অমিল হলেও এই দুটি ছেলের ওপর তাঁর বড় টান জন্মে গেছে। তিনি ওদের দেখতে পেলেন না।

সিনেমা হলের বাইরেও ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে বহু লোক। এরা ভেতরে যেতে চায় না, এরা বোধহয় মজা দেখতে এসেছে। এত বড় শক্তিশালী আওয়ামী লীগ দলটা ভেঙে দু’টুকরো হয়ে যাচ্ছে, এতে মুসলিম লীগের সমর্থকরা, পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকরা তো মজা পাবেই। মওলানা ভাসানীর দল কতটা ভারি হয় তার ওপর নির্ভর করছে কেন্দ্রে সোহরাওয়ার্দি সরকারের পতন হবে কি না।

বেশ কিছু পুলিশও দাঁড়িয়ে আছে এখানে সেখানে। গেটের দিকে এগোতে এগোতে মামুন টের পেলেন, কেমন যেন একটা থমথমে ভাব। যেন হঠাৎ একটা কিছু ঘটবে। ইস, এখনো কী মওলানা ভাসানীকে বোঝানো যায় না, দল ভাঙবেন না, দল ভাঙবেন না! আলাপ-আলোচনা করে নিজেদের মধ্যে বিরোধ মিটিয়ে ফেলুন!

মামুন একবার ভাবলেম, তাঁর কী রূপমহল সিনেমার মধ্যে ঢোকা ঠিক হবে? যদি কেউ ভাবে তিনি এই নতুন দলে যোগ দিতে এসেছেন? যদি অত্যুৎসাহী ছেলে-ছোঁকরারা তাঁকে চিনতে পেরে টানাটানি করে মঞ্চে উঠিয়ে দেয়? না, তিনি এই বিভেদের রাজনীতিতে নিজেকে জড়াতে চান না। যদিও তাঁর কষ্ট হচ্ছে খুব।

তিনি বাইরেই দাঁড়িয়ে রইলেন। মাইক দেওয়া হয়েছে, এখান থেকেই বক্তৃতা শোনা যাবে।

তিনি আগেই জেনেছেন যে এই নতুন দলের নাম হবে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, সংক্ষেপে ন্যাপ। এই দল নতুন কী কী প্রোগ্রাম নেয় সেটাই তাঁর জানার কৌতূহল।

সিনেমা হলের মধ্যে সভার কাজ শুরু হতে না হতেই হঠাৎ বাইরে একটা তুমুল সোরগোল উঠলো। কয়েকখানা ট্রাক হুড়মুড়িয়ে এসে থামলো, সেগুলি থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে নামলো তরুণ ছেলের দল, হাতে তাদের লাঠি। ট্রাকগুলির পেছনেও দৌড়ে আসছে অনেক লোক। দৌড়োতে দৌড়াতে তারা বড় বড় ইঁট ছুঁড়ছে।

প্রায় চোখের নিমেষেই স্থানটি রণক্ষেত্র হয়ে গেল। মাথা বাঁচাবার জন্য মামুন দৌড় লাগালেন। কারা এই মিটিং ভাঙতে এলো? মুসলিম লীগের সাপোর্টাররা? তাদের এখনো এতটা ক্ষমতা আছে? যারা মারামারি করতে এসেছে, তারা প্রায় সবাই অল্প বয়েসী, দেখে মনে হয় ছাত্র, ছাত্রদের মধ্যে ওদের এত জনপ্রিয়তা?

কিছু দূরে গিয়ে মামুন থামলেন। ইঁট ছোঁড়া সমান ভাবে চলছে। লাঠি দিয়ে পেটাবার দমাদম শব্দ হচ্ছে। মামুন কান পেতে শ্লোগানগুলো শোনার চেষ্টা করলেন। চিৎকার-চাচামেচিতে কিছুই প্রায় বোঝা যাচ্ছে না, তবু মামুনের খটকা লাগলো। পুলিশ নিষ্ক্রিয় কেন? স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন পুলিশ দিব্যি হাত গুটিয়ে রয়েছে। তাহলে কি তাদের ওপর নির্দেশ আছে আক্রমণকারীদের বাধা না দেবার? কেন্দ্রে এবং রাজ্যে এখন আওয়ামী লীগ। সরকার!

মামুন দেখতে পেলেন একটা ট্রাকের ওপর দাঁড়িয়ে লাফাচ্ছে তাঁর বরিশালের বন্ধু বদ্রু শেখ। এবারে তিনি আরও কয়েকজন আওয়ামী লীগের যুবকর্মীকে চিনতে পারলেন।

মামুন আবার ফিরে এগোতে লাগলেন সেই ট্রাকের দিকে। কোনোরকমে অন্যদের ঠেলেঠুলে তিনি উঠে পড়লেন ট্রাকের ওপর, বদ্রুর হাত চেপে ধরে প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বললেন, এসব কী হচ্ছে পাগলামি! এই বদ্রু, বদ্রু!

বদ্রু শেখ সত্যিই পাগলের মতন গলা ফুলিয়ে চিৎকার করতে করতে লাফাচ্ছিল, মামুনের ঝাঁকুনি খেয়ে থেমে গিয়ে বললো, তুমিও এসেছো? বেশ করেছো, মারো শালাদের!

রাগে জ্বলে উঠে মামুন বললেন, তুই এইসব ছেলেগুলারে ক্ষেপিয়েছিস? মাত্র কয়দিন আগে যারা ছিল আমাগো ভাই ও বন্ধু, তাদের মারতে এসেছিস?

বদ্রু হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো, বাদ দে, ওসব কথা বাদ দে! ভাই-বন্ধু না ছাই! ওরা। বিশ্বাসঘাতক! ওরা রাষ্ট্রের শত্রু! ওদের এই পার্টি ফর্ম করতে আমরা দিমু না কিছুতেই দিমু!

মামুন বদ্রুকে ঠেলতে ঠেলতে এক কোণায় নিয়ে গিয়ে বললেন, তোকে এই ফোপর দালালি করতে কে বলেছে? আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে কী এরকম কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে? আমি কাউন্সিলের মেম্বার, তুই কে? আওয়ামী লীগ গণতান্ত্রিক পার্টি, আমরা গুণ্ডামির প্রশ্রয়। দিই না।

বদু বললো, ওসব কথা এখন রাখো তো মামুন সাহেব! যেমন করে হোক ওদের আটকাতেই হবে। ওদের পিছনে জনগণকে লেলিয়ে দেবো। এই মওলানা ভাসানীটিকে তো চেনো নাই, উনি হচ্ছেন….

দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে যে-কোনো মানুষকে অন্যদের চোখে হেয় কিংবা ঘৃণ্য করতে গেলে তিনটি বিশেষণই যথেষ্ট। সেই তিন বিশেষণ হচ্ছে, ইসলামের শত্রু, পাকিস্তানের শত্রু এবং ভারতের দালাল! মাত্র কিছুদিন আগেও যিনি ছিলেন তাঁদের পার্টির শ্রদ্ধেয় প্রেসিডেন্ট, সেই মওলানা ভাসানী সম্পর্কে বদ্রু শেখ অবিকল সেই তিনটি বিশেষণই প্রয়োগ করলো।

কয়েক মুহূর্ত স্তম্ভিত হয়ে রইলেন মামুন। তাঁর অবস্থা দেখে হেসে উঠলো বদ্রু শেখ। তারপর মামুনের কাঁধ চাপড়ে বললো, তুমি ঠাণ্ডা ধাতের মানুষ, তুমি এসবে মাথা গলাইয়ো না। বাড়ি গিয়া ঘুমাও!

তার দিকে জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে মামুন বললেন, তোমার এত উৎসাহ কেন? সোহরাওয়ার্দি মিনিস্ট্রি ফল করলে তোমার মতন ব্যবসায়ীদের মুশকিল হবে, তাই যেমন করে তোক টিকিয়ে রাখতে চাও!

বদ্রু শেখ জোর দিয়ে বললো, আলবাৎ! আমাদের লীডার এখন পাকিস্তানের প্রাইম মিনিস্টার, শিল্প মন্ত্রী আবুল মনসুর আমাদের নিজস্ব লোক, আমরা এখন নতুন নতুন লাইসেন্স পাইতে আছি, এখন যদি কেউ দুশমনি করতে আসে–

–ব্যবসায়ীদের স্বার্থ আর দেশের মানুষের স্বার্থ তাইলে এক? তার জন্য গণতন্ত্ররে যদি বলি দিতে হয়–

–গণতন্ত্ররে কে বলি দিচ্ছে?

–এই যে পুলিশ চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে আর গুণ্ডামি করে একটা পার্টি কনভেনশন ভাঙা হচ্ছে?

মামুন লরি থেকে নামতে উদ্যত হয়ে বললেন, তোমাদের এসব বাঁদরামো আমি সহ্য করবো। আমাদের পার্টির একটা ইমেজ আছে। আমি সেক্রেটারি শেখ মুজিবর রহমানকে এখনি টেলিফোন করতেছি…

বদ্রু শেখ মামুনের হাত ধরে টেনে বললো, দাঁড়াও, দাঁড়াও, আগে সব শুইন্যা লও! আরে শেখ মুজিবই তো আমাগো পাঠাইছে। আমি নিজের দুই দুইটা ট্রাক দিছি তাঁর কথায়। তিনিই তো ইউনিভার্সিটি আর ছাত্র ডরমিটারিগুলা থেকে ছাত্রদের জুটাইতে কইছেন।

মামুনের মুখখানা মুহূর্তে যেন কালিবর্ণ হয়ে গেল। তিনি আর কথা বলতে পারলেন না।

বদ্রু শেখ পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বার করে বললো, কাম ফতে! দ্যাখো, অরা পলাইতে আছে। কাল পল্টন ময়দানে অরা প্রকাশ্য সম্মেলন করবে, সেখানে আরও জোর পিট্টি দেবো! মামুন ভাই, এয়ারে কয় রাজনীতি!

মামুন এবারে দূরে দেখতে পেলেন আলতাফকে। সে একটি আহত ছেলেকে পাঁজা কোলা। করে নিয়ে যাচ্ছে। ছেলেটির কপালে রক্ত, কে ও, বাবুল নাকি? আলতাফ একবার তাকালো এদিকে। সে কি মামুনকে দেখতে পেয়েছে, এই পাথর-ছোঁড়া, হামলাকারীদের ট্রাকে? মামুন দু’হাতে নিজের মুখ চাপা দিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *