1 of 3

১.৪২ কানুর বাড়ির ছাদের আলসেতে

কানুর বাড়ির ছাদের আলসেতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পিকলু। তার হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। নিজের বাড়িতে সিগারেট খাওয়ার কোনো প্রশ্নই নেই। বসন্ত কেবিন বা বন্ধুদের আচ্ছায় প্রচুর ধোঁয়া ওড়ে বটে কিন্তু রাস্তা দিয়ে একলা হাঁটার সময় পিকলু সিগারেট ধরাতে লজ্জা পায়। হঠাৎ বাড়ির কেউ দেখে ফেলবে সেই আশঙ্কায় নয়, যে-কোনো অচেনা বয়স্ক লোকের সামনেও সে সঙ্কোচ বোধ করে। কানুর ঘরটা সারা দুপুর খালি পড়ে থাকে, এখানে মাঝে মাঝে এসে শুয়ে থাকে পিকলু।

এখন কানুর সঙ্গে দু’জন লোক দেখা করতে এসেছে, কী সব দরকারি কাজের কথা হচ্ছে ওদের, পিকলু তাই অপেক্ষা করছে বাইরে। নিচের রাস্তায় অবিশ্রান্ত গোলমাল, গাড়ির হর্ন, রিশার হর্ন, ফেরিওয়ালাদের চ্যাঁচামেচি, পিকলু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে আকাশ। বিকেলের দিকে প্রায়ই ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে কয়েকদিন। আজও আকাশ মেঘে মেঘে প্রায় কালো। মাঝে মাঝে ফাঁক দিয়ে একটু একটু নীল দেখা যাচ্ছে যেন এখনও, পিকলু সেই মেঘের আকার নিয়ে খেলা খেলছে মনে মনে। কোথাও দুর্গ, কোথাও পাহাড়, কোথাও সমুদ্রের ঢেউ। মেঘ জমলে আকাশ নিচু হয়ে আসে। নীলাকাশের বিপুল সুদূরের কথা কখন মনে আসে না, মনে হয় যেন মাথার ওপর আর একটা পৃথিবী।

এই আকাশের কোথাও কি আছে স্বর্গ? পিকলু কিছুদিন আগেও ঠাকুর দেবতাদের মূর্তি বা ছবি দেখলে প্রণাম করতো, কলেজে বিজ্ঞান পড়তে এসে সে যুক্তিবাদী ও নাস্তিক হয়েছে। কিন্তু সমস্ত বিশ্ব ভুবনে মানুষ একেবারে নিঃসঙ্গ এ কথা মানতে চায় না তার মন। মানুষ যা দেখেনি তা কল্পনা করতে পারে না। তা হলে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই আকাশনিবাসী দেব-দেবী বা এঞ্জেল বা ফেরেস্তা, এই সব কল্পনা এলো কী করে? এককালে হয়তো অন্য গ্রহের মানুষ মাঝে মাঝে দেবদূত হয়ে নেমে আসতো পৃথিবীতে, এখন তারা পথ ভুলে গেছে?

কানুর ঘর থেকে বেরিয়ে এলো নোক দুটি। ধুতির ওপর হাফ শার্ট পরা, দু জনেরই মুখে। খোঁচা খোঁচা দাড়ি, লোক দুটির ভাবভঙ্গি পিকলুর ঠিক পছন্দ হয় না, কানুকাকা এতক্ষণ ধরে কী। এত কথা বলে এদের সঙ্গে!

লোক দুটি সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাবার পর পিকলু জিজ্ঞেস করলো, কানুকাকা, এরা কারা?

কানু বললো, আমার বিজনেসের এজেন্ট। আয়, ঘরের মধ্যে আয়।

খাটের ওপর নতুন একটা সুজনি পাতা। ছোট একটা টেবিল আর দুটো চেয়ারও কিনেছে কান। টেবিলের ওপর একটা বেশ দামি চেহারার রেডিও। রেডিওটা দেখেই পিকলুর চোখ আনন্দ আর বিস্ময়ে চকচক করে উঠলো। কাছে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, এটা কবে কিনলে, কানুকাকা?

কানু উৎফুল্ল ভাবে বললো, আজই দুপুরে নিয়ে এলাম। অল-ওয়েভ, বুঝলি? পৃথিবীর যে-কোনো দেশ পাওয়া যায়, বিলেত, আমেরিকা…এই, এই, হাত দিস না!

পিকলু তাড়াতাড়ি হাতটা সরিয়ে নিয়ে বললো, একটু চালাও, শুনি।

–দাঁড়া, আগে এরিয়াল টাঙাতে হবে। ঘরে প্লাগ পয়েন্ট করতে হবে, আমার এক বন্ধু সব করে দেবে বলেছে। দুদিন পরে এসে শুনবিতুতুলকে নিয়ে আসিস, ওর তো খুব রেডিও শোনার শখ।।

–তুমি হোল্ডার, তার-টার কিনে আনো, আমি প্লাগ পয়েন্ট করে দিচ্ছি।

–না, না, ইলেকট্রিকের জিনিসে না জেনেশুনে হাত দিতে নেই। আমি ইলেকট্রিশিয়ান নিয়ে আসবো। তুই চা খাবি, পিকলু?

পিকলু মাথা হেলালো।

কানু দু বেলাই হোটেলে খায়। শিয়ালদার দিকে একটু এগোলেই অনেক হোটেল আছে। চায়ের জন্য ছাদ থেকেই হাঁক দিলে রাস্তার উল্টোদিকের দোকান থেকে একটা ছোঁকরা চা দিয়ে যায়, প্রথম প্রথম সেই ব্যবস্থাই ছিল, এখন কানু ঘরেই চায়ের সরঞ্জাম রেখেছে।

খাটের তলা থেকে কানু টেনে বার করলো একটা স্পিরিট স্টোভ, একটা কল্ডে মিল্কের কৌটো, আর দুটো গোল্ড ফ্লেক সিগারেটের টিনের কৌটোয় চা আর চিনি, একটা সসপ্যান। কুঁজো থেকে খানিকটা জল সসপ্যানে ঢেলে কানু জিজ্ঞেস করলো, তুই স্টোভ জ্বালতে জানিস?

পিকলু হেসে বললো, না। আমাদের বাড়িতে তো স্টোভ নেই!

–শিখে নে। সবই শিখে রাখতে হয়। ভগবান না করুন, আমার মতন তোকেও যদি কোনোদিন একলা থাকতে হয়…

পিকলু কানুর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকালো।

কানু সেই দৃষ্টির মর্ম বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে সুর পাল্টে বললো, না, না, তোর বাবা আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে তা বলছি না। আমি চলে এসেছি আমার ব্যবসার সুবিধে হবে বলে।

-কানুকাকা, মা কালকেও বলছিল কানুর এখানে খাওয়া-দাওয়ার খুব কষ্ট। রোজ রোজ হোটেলে খাওয়া মোটেই ভালো নয়। কানু রোজ দু’ বেলা এখানে এসে খেয়ে গেলেই তো পারে। তুই ওকে বলবি…

–সে কথা হচ্ছে না। খেতে তো যাবোই মাঝে মাঝে। আমি জানি, আমি সারা জীবন বেকার থাকলেও সেজদা আমাকে কোনোদিন তাড়িয়ে দিত না। আমি বলছিলাম, কখন কী অবস্থা হয়, বলা তো যায় না। ধর, যদি তোকে কখনো বাইরে পড়াশুনো করতে গিয়ে মেসে-হস্টেলে থাকতে হয়!

স্টোভটা পাম্প করে তারপর দেশলাই জ্বালাতেই শোঁ শোঁ শব্দ হতে লাগলো। নীল রঙের শওন। সসপ্যানটা চাপিয়ে দিয়ে কানু বললো, এই দ্যাখ না, আমার কাছে যখন তখন ব্যবসার বাইরের লোক আসে, ও বাড়িতে থাকলে অসুবিধে হতো না! তোদেরই পড়াশুনোর ক্ষতি হতো। তবে এই একখানা ঘরেও আমার কুলোবে না। শিগগিরই দু’ কামরার একটা ফ্ল্যাট হবে। সেখানে রান্নার ব্যবস্থাও রাখবো। বড়দি সেখানে মাঝে মাঝে এসে থাকতেও পারবে, বড়দির কাছ থেকে রান্নাটা শিখে নেবো।

–পিসিমণির কাছ থেকে তুমি রান্না শিখলে আমরাও মাঝে মাঝে তোমার রান্না খেতে আসবো। পিসিমণি কী দারুণ রাঁধে!

–তোর মা-ও ভালো রাঁধে।

–মার থেকেও পিসিমণির রান্না ভালো। এক এক সময় আমার দুঃখ হয়, পিসিমণিরা কী বিরাট বাড়িতে থাকতেন, আমরা মাঝে মাঝে সেখানে যেতাম বেশ, এখন পিসিমণিকে কত কষ্ট করে থাকতে হয়, তুতুল: বেচারি ইচ্ছে মতন বাড়ি থেকে বেরুতে পারে না..।

–মালখানগরে আমাদেরও বিরাট বাড়ি ছিল, পিকলু। তোর নিশ্চয়ই মনে নেই। বাড়ি ভরা লোকজন, আমরা কোনেদিন নিজের হাতে এক গেলাস জল পর্যন্ত গড়িয়ে খাইনি।

–হ্যাঁ, আমার মনে আছে একটু একটু। উঠোনটাই তো মস্ত বড় ছিল।

–আমি বুঝতে পারি, সেজদার কেন মেজাজটা প্রায়ই খিঁচড়ে থাকে। এত কষ্ট করে থাকেনি তো কখনো। হ্যাঁ রে, সেজদা এর মধ্যে বাবলুকে আবার মেরেছে? এখন আমি নেই, এখন রাগের কোপটা বেশি পড়বে বাবলুর ওপর। তুই তো সেজদার ফেভারিট ছেলে, তোর গায়ে সেজদা কোনোদিন হাত তুলবে না।

–সত্যি, বাবার ঐ একটা দোষ, রাগলে জ্ঞান থাকে না।

–তা বলে ভাবিস না, সেজদা যে আমায় মারতো, তার জন্য আমি মনে কোনো ঝাঁঝ পুষে রেখেছি। সেজদার মনটা যে ভালো তা তো আমি জানিই। তবে কি, এই সব মানুষ নিজেরাই বেশি দুঃখ পায়। আমি বাবা ঠিক করে ফেলেছি, যেমন ভাবেই হোক, অনেক টাকা পয়সা আমাকে রোজগার করতেই হবে। বড়লোক আমি হবোই। এই যে রিফিউজি বলে সবাই আমাদের দূর দূর ছাই ছাই করে, এটা আমার সহ্য হয় না। এদেশের লোক কথায় কথায়। আমাদের ঠাট্টা করে বলে, কী, ইস্ট বেঙ্গলে তোমার বাপের কত বড় জমিদারি ছিল? ফেলে এলে কেন? তোকে তোর কলেজের বন্ধুরা বাঙাল বলে ঠোঁট ওল্টায় না?

–নাঃ, সেরকম কেউ করে না, তবে, দু একজন আছে।

–তুই পাস-টাস করে দাঁড়ালে সেজদার কাঁধের বোঝা অনেকটা কমবে। তুই মন দিয়ে পড়াশুনো কর, পিকলু। তুই নাকি টিউশানি করছিস? ওটা ছেড়ে দে, তোর যা হাত খরচ লাগে আমি দেবো। তোর ওপর আমাদের অনেক ভরসা।

জল গরম হয়ে গেছে, তাতে চা ফেলে দিয়ে ঢাকনা চাপা দিল কানু। কাপ নেই, গেলাসে খেতে হবে, চিনির কৌটোটা খুলে দেখা গেল তার মধ্যে থিক থিক করছে পিঁপড়ে। কৌটোটা মাটিতে ঠুকে ঠুকে কিছু পিঁপড়ে তাড়ানো হলেও তবু সব যায় না।

কানু চামচে করে দু চারটে পিঁপড়ে শুদ্ধ চিনি তুলে বললো, ওতে কিছু হবে না। পিঁপড়ে খাওয়া ভালো, সাঁতার শেখা যায়। তোরা তত সাঁতার-ফাতার শিখলি না। আমার গরম লাগলে আমি রাত্তিরের দিকে কলেজ স্কোয়ারে নেমে এক পাক সাঁতার কেটে আসি। মালিদের মাঝে মাঝে দু চার আনা ঘুষ দিই, কিছু বলে না।

কানুর এই রকম জীবনযাপন বেশ পছন্দ হয় পিকলুর। কানুকাকা সম্পূর্ণ স্বাধীন, যা খুশী করতে পারে। মা-বাবাকে পিকলু খুব ভালোবাসলেও সম্পূর্ণ একলা একলা জীবন কাটাবার এই ছবি তাকে মুগ্ধ করে।

চায়ের স্বাদটাও অপূর্ব লাগলো। একটু ধোঁয়া ধোঁয়া গন্ধ আছে বটে তবু এমন চা’যেন পিকলু কোনোদিন খায়নি আগে।

গেলাস হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে কানু বললো, তোর গরম লাগছে না? এবার একটা পাখা কিনতে হবে। চল, বাইরে দাঁড়িয়ে চা-টা খাই।

কানুকাকা রেডিও কিনেছে, এই বাড়ি ছেড়ে অন্য বড় ফ্ল্যাটে উঠে যাবার কথা ভাবছে, গরম লাগলেই ফ্যান কেনার কথা ভাবে। প্রত্যেকবার এখানে এলেই একটা না একটা নতুন জিনিস চোখে পড়ে। ব্যবসা করলে এত তাড়াতাড়ি টাকা রোজগার করা যায়? পিকলু ব্যবসার ব্যাপারটা তেমন বোঝে না, তবে এটা সে বোঝে যে যে-কোনো কাজেই উন্নতি করতে গেলে বুদ্ধি লাগে, কানুকাকার তো তা হলে বেশ বুদ্ধি আছে। কানুকাকা লেখাপড়ায় ভালো ছিল না, তা হলে দেখা যাচ্ছে লেখাপড়ার সঙ্গে বুদ্ধির সব সময় সম্পর্ক নাও থাকতে পারে।

আকাশে মেঘ অনেক গাঢ় হয়ে এসেছে। এর পর যে-কোনো সময় বৃষ্টি নামবে। অদ্ভুত একটা নরম আলো হয়েছে এখন।

কার্নিসের পাশে এসে কানু বললো, পিকলু, ঐ হলদে রঙের বাড়িটার ছাদের দিকে দ্যাখ। ঐ যে, যে বাড়ির পাঁচিলে দুটো কাপড় শুকোচ্ছে। দেখতে পাচ্ছিস?

সেদিকে তাকিয়ে পিকলু শুধু লজ্জা পেল না, একটু শঙ্কিতও বোধ করলো। মীজাপুরের এই বাড়িতে এসে কানুকাকার চরিত্রে একটা নতুন জিনিস যোগ হয়েছে, প্রায়ই বেশ অসভ্য কথা বলে। জিভে কোনো আড় নেই, অবলীলাক্রমে বলে যায়। তা হলে নিশ্চয়ই নতুন শেখেনি, আগেও বাড়ির বাইরে বলতো। পিকলু খারাপ কথা, আদিরসের শ্ল্যাং একেবারে সহ্য করতে পারে না। তার বন্ধুদের ছোট গোষ্ঠীর মধ্যেও এ ব্যাপারে কড়া নিয়ম আছে। বন্ধুদের মধ্যে একজনই শুধু কথায় কথায় বাঞ্চোৎ, মাজাকি, বাপের বিয়ে দেখিয়ে দেবো, এই সব বলতো। এখন রুল জারি করা হয়েছে যে সে ঐ রকম কিছু একটা বলে ফেললেই তাকে এক কাপ চায়ের দাম ফাইন দিতে হবে। বাবলু পাশের বস্তির ছেলেদের কাছে শিখে বাড়িতে একদিন শালা বলেছিল বলে পিকলু তার কান মুলে দিয়েছিল। কিন্তু কানুকাকাকে তো সেরকম ভাবে শাসন করা যায় না।

কানু আঙুল তুলে বললো, দুটো মেয়ে ঘুরছে, একজন ফ্রক পরা, আর একজন নীল শাড়ি, ঐ দ্যাখ দ্যাখ, এদিকেই তাকিয়েছে, ওদের মধ্যে কোন বেশি সুন্দরী বল্ তো?

পিকলুর মনে হলো, দুটি মেয়েকেই দেখতে তুতুলের মতন। তুতুলের কথা মনে পড়া মাত্র। সে একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে গেল। তারপর মাথা নেড়ে বললো, জানি না।

কানু বললো, দু জনের প্রায় কাছাকাছি বয়েস হলেও ওরা কিন্তু দুই বোন নয়। ঐ ফ্রক পরা মেয়েটা হচ্ছে শাড়ি পরা মেয়েটির মাসি। হে-হে-হে-হে! সত্যি বলছি! বিকেলবেলা ছাদে দাঁড়ালেই ওদের সঙ্গে চোখাচোখি হয়। তুই হিড়িক দেওয়া কাকে বলে জানিস? ভেবেছিলুম, মেয়ে দুটোর সঙ্গে কিছুদিন একটু হিড়িক দেবো। কিন্তু ওমা, তার আগেই একটা কাণ্ড হয়ে গেল।

চায়ের গেলাসটা নামিয়ে রেখে কানু পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটি বিলিতি সিগারেটের প্যাকেট বার করে বললো, তুই চার্মিনার খাস কেন, ওতে ঠোঁট কালো হয়ে যায়। দেখবি, পরে মেয়েরা তোকে পাত্তা দেবে না। ভালো সিগারেট খাবি, এই নে, প্যাকেটটা তোর কাছেই রাখ।

দু জনে দুটি সিগারেট ধরাবার পর কানু বললো, একদিন এই পাড়ার এক ভদ্রলোক নিজে যেচে এসে আমার সঙ্গে আলাপ করলো। এ কথা সে কথার পর বুঝলুম, ভদ্রলোক ঐ নীল শাড়ি পরা মেয়েটির বাপ। ভদ্রলোকের মোট পাঁচ মেয়ে, এর আগে চার-চারটি মেয়ের বিয়ে, দিয়ে প্রায় ফেীত হয়ে গেছে, এখন ঐ পাঁচ নম্বর মেয়েটিকে ঘাড় থেকে নামাতে চায়। আমার সম্পর্কে সেই জন্য ইন্টারেস্টেড। আমি ঘাড়টি হেলালেই বিয়ের শানাই বাজতে পারে, বুঝলি?

–মেয়েটি লেখাপড়া করে না?

কানু দরাজ গলায় হেসে উঠে বললো, জানতুম, তুই ঠিক এই কথাটা জিজ্ঞেস করবি। কোন বংশের ছেলে তা দেখতে হবে তো! আরে, আমি নিজে আই এ ফেল। আমি কি আর এম এ, বি এ পাস মেয়ে বিয়ে করতে পারবো? ঐ মেয়েটা ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়ে ছেড়ে দিয়েছে, ও-ই যথেষ্ট।

–কানুকাকা, তুমি এর মধ্যেই বিয়ে করবে?

–এর মধ্যে কী বলছিস, আমার বয়েস প্রায় থার্টি হতে চললো। হ্যাঁ, আমি বিয়ে করবো ঠিক করে ফেলেছি, সেটা আজ হোক বা ছ’ মাস বাদেই হোক। একা থাকতে আমার ভালো লাগে না। কিন্তু আমি আমার বংশের ধারা মেইনটেইন করতে চাই। হুট করে অন্যের কথায় নেচে উঠে একটা বেজাতের মেয়েকে বিয়ে করা, ওসব আমার দ্বারা হবে না। আমার মাথার ওপর দাদা-বৌদি আছে, বড় দিদি আছে, তাদের মত না পেলে কিছু হবে না, সে কথা আমি বলে দিয়েছি ভদ্রলোককে। এ ছাড়া আমি খোঁজ নিয়েছি, ওরা আমাদের পাল্টি ঘর। ওরা হলো ঘোষ, না, না, গয়লা নয়, গয়লা নয়, কায়স্থ। ওরা ঘটি, সেটা একদিক থেকে ভালোই, আমি ঘটিদের সমাজে ঢুকতে চাই। আমি মনে মনে ঠিক করেই রেখেছি, ঘটিদের বাড়ির কোনো মেয়েকে বিয়ে করবো, করিচি, খেয়িচি, এলুম, গেসলুম এই রকম কথা বলবো, কোনো শালা যাতে আমাকে আর বাঙাল বলে হ্যাঁটা না করতে পারে।

কানুকে আজ কথায় পেয়েছে, সে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে। পিকলু আবার হলুদ বাড়িটার দিকে আড় চোখে তাকালো। মেয়ে দুটি বোধ হয় ভেতরের কথা জানে, তারাও ঘুরতে ঘুরতে। এদিকে তাকাচ্ছে মাঝে মাঝে। পিকলুর এখনো মনে হচ্ছে মেয়ে দুটিকেই দেখতে তুতুলের মতন।

কানু বললো, এখন কোশ্চেন হচ্ছে, কোন্ মেয়েটিকে? আমার ওই ফ্রক পরা মেয়েটিকেই বেশি পছন্দ। ফ্রক পরা বলে ভাবিস না বাচ্চা, মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়েছে। ভদ্রলোক চায় তার নিজের মেয়েকে আগে পার করতে।

পিকলু দুঃখিত স্বরে বললো, কানুকাকা—

–কী রে, কী বলছিস?

–মেয়েরা কি বিড়ালের বাচ্চা যে তুমি পার করার কথা বলছো?

–ওঃ হো-হো, তুই তো আবার…এই রকমই হয়, আর একটু বড় হলে বুঝবি। থাক, আমি আপাতত সেটুল করেছি, শাড়ি পরা মেয়েটি হলেও আপত্তি নেই, ওর ফ্রক পরা মাসি তো ঐ বাড়িতেই থাকবে, তার সঙ্গে মাঝে মাঝে হিড়িক মারা যাবে। গাছেরও খাবো, তলারও কুড়োবো। হে-হে-হে-হে।

হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি আসায় ওরা চলে এলো ঘরের মধ্যে। পিকলু জুতো-মোজা খুলে রেখেছিল, সেগুলো পরে নিয়ে বললো, কানুকাকা, এবারে আমি চলি। অলরেডি দেরি হয়ে গেছে।

–এই বৃষ্টির মধ্যে যাবি কী করে। একটু বসে যা। শোন পিকলু, সেজদার সামনে দাঁড়াতে আমার সাহস হয় না। তোকেই তোর বাবার কাছে আমার বিয়ের প্রসঙ্গটা পাড়তে হবে।

–আমি? বাবাকে আমি বলবো?

–তুই সেজদাকে যা বলবি সেজদা তাই-ই শুনবে। তুই তো সেজদার নয়নের মণি! যাকগে, তুই যদি সরাসরি না বলতে পারিস তোর মায়ের গ্লু দিয়ে বল। আমি মাস ছয়েকের মধ্যেই বিয়েটা চুকিয়ে ফেলতে চাই। ওরা সোনাদানা মোটামুটি দেবে, বিয়ের খরচাপাতিও দেবে।

–তা হলে শিগগিরই আমাদের একটা কাকিমা হচ্ছে?

–শুধু কাকিমা কেন রে, দু’ চার বছরের মধ্যেই দেখবি খুড়তুতো ভাই-বোন। আমি ঠিক করে রেখেছি, বিয়ের পরে পরেই দুটো ছেলে আর একটা মেয়ে। ব্যাস, তার বেশি আর চাই না!

বৃষ্টি পুরোপুরি থামবার আগেই পিকলু বেরিয়ে পড়লো সেখান থেকে। এতক্ষণ ধরে কানুকাকার বিয়ে সম্পর্কে কথাবার্তা তার মনকে বেশ নাড়া দিয়েছে। পৃথিবীর যেকোনো নারীকেই সে শূন্যের ওপর একটা সিংহাসনে বসিয়ে দেখতে চায়। কোনো রমণীর একটুখানি হাসি, একবার পাশ ফিরে তাকানো, হঠাৎ কথা বলতে বলতে থেমে যাওয়া, এই সবই যেন দারুণ দুর্লভ কিছু পাওয়ার মতন। আর কানুকাকার কাছে মেয়েরা যেন জল-ভাতের মতন অতি সাধারণ। এখনো বিয়ের কোনো ঠিকই নেই, এর মধ্যেই দু তিনটি ছেলেমেয়ের কথা ভাবছে। শেষের এই কথাটাতেই পিকলু যেন প্রায় শারীরিকভাবে ব্যথা পেয়েছে।

শিবেনের সেই বন্ধু এখনো তুতুলকে বিয়ে করার আশা ছাড়েনি। থানায় খবর দেবার পর ওদের উপদ্রব খানিকটা বন্ধ হয়েছে, কিন্তু দূর থেকে এখনো ওদের উঁকিঝুঁকি মারতে দেখা যায়। তুতুলকে একলা বেরুতে দেওয়া হয় না বাড়ি থেকে। তুতুল,কলেজে ভর্তি হবার আগে ঐ বাড়ি বদল করতেই হবে।

সারা রাস্তা তুতুলের কথাই ভাবতে ভাবতে এলো পিকলু।

বাড়ি ফিরে সে মমতাকে ডেকে বললো, মা, কানুকাকা আজ তোমাদের একটা কথা বলতে বলেছে।

মমতা বাধা দিয়ে বললেন, তুই কানুর কাছে বুঝি রোজই যাওয়া শুরু করেছিস? তোর বাবা শুনে একদিন রাগ করছিল। কানুর কোনো জিনিস-টিনিস দিলে নিবি না।

–আহা, শোনোই না কথাটা। কানুকাকা বিয়ে করতে চায়।

–অ্যাাঁ? এর মধ্যেই বিয়ে করবে? সবে তো ব্যবসা শুরু করেছে, দু চার বছর না গেলে কি। ব্যবসার কিছু বোঝা যায়? কোথায় বিয়ে করছে?

–ও বাড়ির, কাছেই মেয়ের বাবা এসে কানুকাকার কাছে প্রস্তাব দিয়েছেন। মমতা তাড়াতাড়ি ডেকে আনলেন সুপ্রীতিকে। সুপ্রীতি কিন্তু সব শুনে খুশীই হলেন। তিনি বললেন, তা হলে তো বলতে হবে ছেলেটার সুবুদ্ধি হয়েছে। বয়েস কালের ছেলে, ওরকম একলা একলা থাকা মোটেই ভালো নয়। মতিচ্ছন্ন হতে তো আর দেরি লাগে না। মেয়েটির বয়েস কত, বাড়ির অবস্থা কী রকম? মেয়ে একবস্ত্রে আসছে না তো?

কানুর মুখ থেকে পিকলু যা শুনেছে সবই খুলে বললো, শুধু সে যে ছাদ থেকে মেয়েটিকে দেখেছে তা জানাতে তার লজ্জা করলো। সুপ্রীতি বললেন, তা হলে তো থোকনকে আজই জানাতে হয়। এ সব কাজে দেরি না করাই ভালো।

পিকলু এই সন্ধেবেলাতেও একবার স্নান করার জন্য বাথরুমে ঢুকে গেল। এই রকমভাবে বিয়ের আলোচনা করায় তার কেমন যেন নোংরা নোংরা লাগছে। বাথরুমের কল খুলে দিয়ে সে আবার কল্পনায় দেখতে পেল শূন্যে সিংহাসন-আরূঢ়া এক দেবীকে, মুখোনি ঈষৎ ফিরিয়ে মৃদু মৃদু হাসছে, সেই মুখ কিন্তু তুতুলের নয়, অচেনা, রহস্যমাখা, সেই মুখ তার কাছে সমস্ত নারী জাতির প্রতীক।

প্রতাপ বাড়ি ফেরার পর মমতা আর সুপ্রীতির ডেলিগেশন গেল তাঁর কাছে। প্রতাপ চুপ  করে সব শুনলেন, তারপর উদাসীন ভাবে বললেন, সে বিয়ে করতে চায়, ভালো কথা।

করুক। আমাদের মতামতে কী আসে যায়! সে তো এখন স্বাধীন।

সুপ্রীতি বললেন, না রে খোকন, কানু ছেলে খারাপ নয়। আমাদের খুব মানে। সে কন্যেপক্ষকে বলেছে, আমার দাদা-বৌদি আছে, বড় দিদি আছে, তাদের মতামত ছাড়া কিছু হবে না। পিকলুকে ডাকবো, সব শুনবি?

প্রতাপ হাত তুলে বললেন, না, ওকে ডাকার দরকার নেই। কানু পিকলুর সঙ্গে এই সব বিষয়ে আলোচনা করে, তাও আমার পছন্দ নয়। কেন, সে নিজে এসে বলতে পারলো না?

–আসবে, দু একদিনের মধ্যে নিশ্চয়ই আসবে। ও তো মাঝে মাঝেই দুপুরের দিকে এসে আমাদের সঙ্গে দেখা করে যায়।

–কানুর মামারাই তো আছে, তাদের কাছে গেলেই পারে। তারাই ব্যবস্থা করবে।

–এ তুই কী বলছিস, খোকন? বিয়ের চিঠিতে তো তোর নাম থাকবে। মামাদের নামে কখনো বিয়ে হয়? তা হলে কানুকে খবর পাঠাই, পাত্রীর বাবা এসে একদিন তোর সঙ্গে দেখা করুক?

শেষ পর্যন্ত সম্মতি দিলেন প্রতাপ।

রাত্রে বিছানায় শুয়ে তিনি মমতাকে বললেন, কানুর মামাদের তোমার মনে আছে।

মমতা বললেন, সেই কবে শিউলির বিয়েতে একবার গিয়েছিলাম। তারপর তো আর…মা কলকাতায় এলেও তো ওঁরা কেউ দেখা করতে আসেন না।

প্রতাপ বললেন, আমি গত সপ্তাহে নিজেই একবার মেজোমামার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। ওঁর হাঁটুতে খুব বাত, হাঁটা চলা করতে পারেন না প্রায়। উনি বললেন, কানু ওঁদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখে না। আমি কানুর সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়েছিলুম, ওঁরা কোনো আগ্রহ দেখালেন না। ওঁরা কোনো দায়িত্ব নিতে চান না।

-–কানু তো কোনোদিনই মামাদের তেমন পছন্দ করে না। ঐ মেজোমামার বউ নাকি এক সময় কানুকে খুব কষ্ট দিয়েছে।

–তবু ওঁরা কানুর নিজের মামা। কানু আমার কোনো কথা গ্রাহ্য করে না, ইচ্ছে মতন যা খুশী করছে, তা হলে আমি ওর বিয়ের ব্যাপারে মাথা গলাতে যাবো কেন?

–কানু আলাদা হয়ে গেছে বলে তুমি এত রাগ করছো কেন? ও যদি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে, সেটাই তো ভালো। ওর বিয়ে দিয়ে ঘর-সংসারী করা তোমারই দায়িত্ব।

দায়িত্ব, হুঁ।

প্রতাপ উঠে বসে আর একটা সিগারেট ধরাতে গেলেন। মমতা বললেন, তুমি আজকাল বড্ড বেশি সিগারেট খাচ্ছো। একটু কমাও। রাত্রে তোমার কাশি হয়।

প্রতাপ তবু সিগারেট ধরালেন। তারপর গোঁজ মুখে বললেন, ঠিক আছে, তোমরা যখন দায়িত্বের কথা বলছে, তখন ওর বিয়ের ব্যাপারে আমার যেটুকু সাধ্য তা আমি করবো। কিন্তু। একটা কথা তোমাদের আগে থেকেই বলে রাখছি। কানুকে যদি হঠাৎ কখনো পুলিসে ধরে তখন কিন্তু আমি ওকে ছাড়াতে যাবো না। তখন তোমরা আমাকে অনুরোধ করো না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *